প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৪.৯ জানলা-দরজা হাট করে খোলা

পরদিন উঠে দেখি বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে–জানলা-দরজা হাট করে খোলা। গোবিন্দ তখনও ঘুমুচ্ছে দেখে তাকে ঠেলে তুললুম–দেখলুম তার গা বেশ গরম। বললুম–তোর কিছু করতে হবে না–আমিই সব করে দিচ্ছি। 

কিন্তু সে মানলে না। উনুন ধরিয়ে চা করে ফেললে। তখনই বাজারে ছুটল। বাজার থেকে মাংস তরি-তরকারি কিনে নিয়ে এসে রান্না চড়িয়ে দিলে। 

সেদিন আপিসে গিয়ে গতরাত্রের অভিজ্ঞতার কথা বলা-মাত্র সকলে হো-হো করে হেসে উঠল। কেউ কেউ উপদেশ দিলে–সোডা একটু বেশি খেয়ো। কেউ-বা বললে– নেশার ঘোরে ওরকম মনে হয়। 

এই কয়েক দিনের মধ্যেই আমার একটি ডাক্তার বন্ধু জুটেছিল। তাড়াতাড়ি আপিস থেকে বেরিয়ে ডাক্তারের ওখানে গেলুম আড্ডা দিতে। তাকে রাত্রের অভিজ্ঞতার কথা বলতে সে বললে–ওরকম কিছু শুনিনি বটে। তবে ও-বাড়িটা ছেড়ে দাও–ওটা ভালো নয়। 

ডাক্তারের ডিসপেনসারি থেকে একটা চার-আউন্স শিশিতে হুইস্কি ভরে নিলুম। কম্পাউন্ডারকে বলে শিশিটায় আটটি দাগের কাগজ মেরে নিলুম। 

বাড়ি এসে গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলুম–হ্যাঁ রে, সোডা আছে? 

সে বললে–হ্যাঁ আজ্ঞে। দুটো সোডা এক্ষুনি এনেছি। 

আমি তখন বললুম–যা, দুটো জিঞ্জারেট নিয়ে আয়। 

জিঞ্জারেট নিয়ে আসার পর তাকে জিজ্ঞাসা করলুম–হ্যাঁ রে, কি খেয়েছিস? 

সে বললে–আজ্ঞে, মাংস আর ভাত। 

–বেশ করে জ্বরের ওপরে মাংস-ভাত খেয়েছ? রাত্রিবেলার জন্যে খানকয়েক আটার লুচি বানা, দু’জনেই খাব। 

খাওয়া-দাওয়ার পর বসে বসে গল্প করতে লাগলুম। রাত্রি সাড়ে দশটা নাগাদ গোবিন্দকে একদাগ ওষুধ এক-বোতল জিঞ্জারেট দিয়ে খাইয়ে দিলুম। মিনিট কয়েক পর জিজ্ঞাসা করলুম–কিরকম লাগছে যে গোবিন্দ? 

গোবিন্দর মুখখানা হাসিতে সমুজ্জ্বল। সে জোর করে ঘাড় নেড়ে বলল ওষুধটা খুব ভল্ আছে আজ্ঞে। 

–দরজা-টরজা সব বন্ধ করেছিস তো? 

-হ্যাঁ আজ্ঞে। 

প্রেতলোকের ঘড়ি একেবারে সূর্যের বাচ্চা বললেও হয়। ঠিক এগারোটার সময় আবার সেই দড়াম করে দরজা-জানলা সব খুলে গেল–সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি সব নির্বাপিত। টর্চটা আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছিলুম। টর্চ জ্বালিয়ে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিলুম। মুরগির ঘরটা বাইরে থেকেই শেকল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হত। হঠাৎ ঝনাৎ করে শেকল খুলে দরজাটা খুলে গেল–সঙ্গে সঙ্গে মুরগির পাল ত্রস্ত হয়ে পিক-পিক করে মাঠময় ছুটে বেড়াতে লাগল। বেশ বুঝতে পারা গেল–কে যেন তাদের তাড়া দিচ্ছে। বোধ হয় মিনিট দু’তিন এইরকম চলেছিল। তারপর আবার তারা চিৎকার করতে করতে তাদের নিজেদের ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকল। ইতিমধ্যে আমাদের জানলার সশব্দ উত্থান ও পতন চলতে লাগল। 

গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলুম–কি রে, আর একটু ওষুধ দেব? 

সে বললে–দিন আজ্ঞে। 

তারপর–মানে, গোবিন্দর ওষুধ সেবনের পরে আমিও কিঞ্চিৎ ওষুধ সেবন করে গোবিন্দকে বললুম–এবার শুয়ে পড়। 

সে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল। কিন্তু বৃথা, তখুনি আরও জোরে আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেল। দরজা-জানলা খোলা এবং আলো-জ্বালা অবস্থাতেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লুম। 

.

পরদিন আপিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছি–গোবিন্দ হন্তদন্ত হয়ে এসে বললে–এই গাছটাতে বেহ্মদত্যি আছে আজ্ঞে। 

আমাদের মাঠে কোণের দিকে একটা বড় বটগাছ ছিল। গোবিন্দ সেই দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল–আজ্ঞে, ওর তলায় ফুল আর এক-বাটি দুধ আজ সন্ধেবেলায় রেখে আসব আজ্ঞে। 

গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলুম–এ সংবাদটি তোমায় দিলে কে? 

সে বললে–চাচা দিয়েছে। চাচা বজরুগ লোক। তিনি নিজে দেখেছেন।

–বলিহারি বাপ!–এখানেও চাচা জুটিয়েছ? কোথায় থাকেন তিনি? 

গোবিন্দ বললে–হ্যাঁটের মধ্যে যে দরগা আছে, তিনি সে-দরগার মাতোয়ালী। তিনি আমাকে সস্তায় মুরগি ও ভালো মাখন কিনে দেন। তাঁকে সবাই মানে–কেউ ঠকায় না। 

সন্ধেবেলা একটা বাটিতে করে দুধ আর ফুল গোবিন্দ,আগেই কিনে এনেছিল–আমরা দু’জনে গিয়ে সেই গাছতলায় রেখে এলুম। মনে-মনে বললুম–বাবা ব্ৰহ্মদৈত্য, একটু নিশ্চিন্তে ঘুমুতে দিও বাবা। 

গোবিন্দ তো সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে। 

সেদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পরে গোবিন্দ নিশ্চিন্ত হয়ে সেলেট নিয়ে ‘কর খল’ ইত্যাদি লিখছে–সাবধানের মার নেই মনে করে সাড়ে-দশটা নাগাদ তাকে একদাগ ওষুধও দিয়েছি এগারোটার সময় শোবার ব্যবস্থাও হচ্ছে–আবার সেই দড়াম দড়াম করে দরজা-খোলা আর বন্ধ-করা, বাতি নিবে-যাওয়া আর জ্বলে-ওঠা, মুরগি মাঠে বেরিয়ে-যাওয়া আর ত্রস্ত হয় আবার ঘরে ঢুকে-পড়া ইত্যাদি সমানে শুরু হয়ে গেল। 

গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলুম–কি রে, তোর চাচা কি বলে? 

গোবিন্দ জবাব দেবে কি, ভয়ে তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আর একদাগ ওষুধ তাকে দিয়ে বললুম–শুয়ে পড়, কালই আমরা বোম্বে চলে যাব। 

গোবিন্দ বললে–হ্যাঁ আজ্ঞে, তাই চলুন! 

সক্কালবেলা ঘুম ভাঙতেই গোবিন্দ ছুটল মাঠে; একটু বাদে ফিরে এসে বললে–বেহ্মদত্যি মশাই বাটি-সুদ্ধ খেয়ে ফেলেছেন আজ্ঞে। 

তার সঙ্গে তক্ষুনি গিয়ে দেখলুম–গাছের নীচে সত্যিই বাটি নেই। 

একটুখানি ভালো করে দেখতেই বেশ বুঝতে পারলুম কোনো লোক সকালবেলা মাঠে এসে দুধটা গাছের তলায় ঢেলে দিয়ে বাটিটা নিয়ে সরে পড়েছে। 

গোবিন্দকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়ে ভাবতে বসলুম–কি করা যায়! 

একটু পরেই সে বাজার থেকে ফিরে বললে–চাচা বলেছেন আজ দুপুরবেলায় এসে বাড়িতে মন্ত্র পড়ে দিয়ে যাবেন। তিনি বলছেন যে, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। 

অনেকদিন আগে, আমার ওস্তাদের বাড়িতে এইরকম সব উপদ্রব আরম্ভ হয়েছিল, বন্ধ ঘরের মধ্যে ঝরঝর করে ময়লা এসে পড়ত। সেখানেও এক ‘চাচা’ মন্ত্রতন্ত্র পড়ে কি-সব লিখে দেয়ালে কাগজ মেরে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। শেষপর্যন্ত তাদের ও-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। এই কারণে মন্ত্রতন্ত্রের উপর আমার বিশেষ আস্থা ছিল না। যাই হোক, সেদিন দুপুরবেলা আপিসে গিয়ে জানিয়ে দিলুম–দু’একদিনের মধ্যে যদি আমার জন্যে অন্য বাড়ির ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে যাব। 

এতদিন আমার রাতের অভিজ্ঞতা শুনে যাঁরা হেসেই উড়িয়ে দিতেন, দেখলুম সেদিন তাঁদের অনেকেই আমার কথা শুনে মুখ গম্ভীর করলেন। দু’একজন এমন কথাও বললেন–ও-বাড়িটার সম্বন্ধে অনেক আগে নানা কথা শুনতে পাওয়া যেত বটে, কিন্তু কিছুদিন থেকে ওসব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

এইসব মন্তব্য শুনে বেশ খুশি হয়ে ডেরায় ফিরে এলুম। ঘরের মধ্যে ঢুকে ধূপধুনো ও লোবানের গন্ধ পেয়ে গোবিন্দকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম–কি রে, গন্ধ কোত্থেকে আসছে? 

গোবিন্দ বললে–চাচা এসেছিলেন আজ্ঞে, তিনি নেমাজ পড়ে, ওই দেখুন দেয়ালে মন্তর মেরে দিয়ে গেছেন। 

সেদিন রাত্রে আহারাদির পরে আশা হল–আজ একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যাবে। কিন্তু সেদিন আবার এক নতুন উৎপাত ঘটে গেল। 

আমার ঘরের পাশের ঘরটিতে বাক্স-প্যাঁটরা রাখা ছিল। আমার ট্রাঙ্কটার তলায় দুটো চাকাও লাগানো ছিল। দেখলুম, পাথরের মেঝে দিয়ে ঘড়াক্-ঘড়াক্ করে স্বয়ংচালিত হয়ে সেটা আমার ঘরে এসে ঢুকল। তারপর শতরঞ্চির ওপর দিয়ে সেইভাবে ঘষড়াতে ঘষড়াতে এসে আমার খাটের সামনে স্থির হয়ে এসে দাঁড়াল। গোবিন্দর দিকে চেয়ে দেখলুম, সে বিস্ফারিত-লোচনে ট্রাঙ্কটার দিকে চেয়ে আছে, অর্থাৎ এর পর কি হয় বোধহয় তারই দিকে নজর রাখছে। জিজ্ঞাসা করলুম–কি গোবিন্দ, তোর চাচা কোথায়? 

ওদিকে চ্যাঁ-চ্যা করে একটা আওয়াজ কানে যেতেই সামনের দিকে চেয়ে দেখি, ওদিককার ঘর থেকে গোবিন্দর টিনের বাক্সটা এগিয়ে আসছে। ডাকলুম–গোবিন্দ– ও-গোবিন্দ– 

কিন্তু গোবিন্দ হতবাক্। বলা বাহুল্য, গোবিন্দর বাক্স গোবিন্দর সামনে এসে দাঁড়াল। গোবিন্দকে ডেকে তাকে তাড়াতাড়ি এক-ডোজ ওষুধ তোয়ের করে দিলুম। তাকে বললুম–তোর বাক্সটা ঘরের কোণে রেখে দে। আর আমার ট্রাঙ্কটাও ঠেলে ঘরের একপাশে রেখে দে। 

কিন্তু তখুনি গোবিন্দর বাক্স গোবিন্দর কাছে আর আমার ট্রাঙ্ক আমার কাছে এসে পড়ল। এইরকম রাত্রি প্রায় বারোটা অবধি ভূতের সঙ্গে খেলা করে সর্বাঙ্গ টাটিয়ে গেল। আবার আমরা এক-এক ডোজ ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বার মতলব করছি–এমন সময় দেখি পায়খানা থেকে কমোডটা সরতে সরতে ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত। অবশ্য অবস্থাটা কমোডে বসবার মতোই হয়েছিল কিন্তু ভরসা করে আর বসতে পারলুম না–কাজেই শুয়ে পড়া গেল। 

.

তখনো ভালো করে ভোর হয়নি। দারুণ চিৎকারের চোটে আমরা দু’জনই ধড়মড় করে উঠে পড়লুম। দেখি, আমাদের মাঠের মধ্যে গোটা দশেক গাধা ঢুকে প্রাণপণে গলা সাধছে। এতদিন ভূতের অত্যাচারে যা না হয়েছে, একদিন গাধার চিৎকারে তা হয়ে গেল অর্থাৎ কিনা আমার ধৈর্য্যচুতি ঘটল। গোবিন্দকে বললুম– 

–গোবিন্দ, বিছানাপত্তর বাঁধ, বাসন-কোসন তুলে ফেল্। সুদ্ধ এ-বেলা রাঁধবার জন্যে দু’ একখানা বাসন বাইরে রাখ। একটা মুরগি মেরে ঝোল বানা, আর ভাত। আজই আড়াইটার কিংবা সন্ধের গাড়িতে চলে যাব। 

গোবিন্দ বলল–মুরগি তো নেই আজ্ঞে। 

–সে কি রে! অতগুলো মুরগি কি করলি? 

–চাচাকে দিয়ে দিয়েছি আজ্ঞে। 

–বেশ করেছ আজ্ঞে। তা’হলে আর রেঁধে কাজ নেই আজ্ঞে। আমরা হোটেলেই খেয়ে নেব আজ্ঞে। একটা গাড়ি ডাক, এক্ষুনি আপিসে যাব। 

গোবিন্দ গাড়ি ডেকে নিয়ে এলে তখুনি বেরিয়ে পড়লুম। তাদের আপিসে গিয়ে জানালুম–আমি আজই চলে যাচ্ছি, বাড়ি ঠিক করে আমায় টেলিগ্রাম করবেন–আমি চলে আসব। 

ওরা বললে–বাড়ি তো ঠিক হয়ে গিয়েছে। 

একজন লোককে ডেকে আমাকে আরও বললে–এর সঙ্গে যান। এ আপনাদের নতুন বাড়ির দরজার তালা খুলে দেবে। এ-ক’দিন বাড়িটা ধোয়া হচ্ছিল বলে আর আপনাদের জানানো হয়নি। 

মনে-মনে ভাবলুম–এখানে সবই ভূতগত ব্যাপার দেখছি। 

ফিরে এসে তখুনি গোবিন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে জিনিসপত্তর তুলে নতুন বাড়িতে গিয়ে ওঠা গেল। 

দিব্যি বাড়ি–দোতলা। সামনে খানিকটা জায়গায় বাগান। ঘরে ঘরে আসবাবপত্র ঝকঝক করছে। বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য দরবার থেকে এই বাড়িটাই নির্দিষ্ট আছে। 

ভূতের কল্যাণে এখানেই কায়েমি হয়ে বসা গেল। এখানে ভূতগত নতুন অভিজ্ঞতা কিছু হয়নি বটে, তবে মানুষের জীবনে নিত্যই অভিজ্ঞতা যা সঞ্চিত হয়ে থাকে তাও কম কৌতুকপ্রদ নয়, কম মর্মন্তুদ নয়। 

.

এবার আমার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতার কথা বলি। 

এ আমার সেই প্রথম অরণ্যবাসের প্রায় ত্রিশ বছর পরের ঘটনা। আমি তখন এক ভারতীয় নৃপতির রাজ্যে চাকরি করি। সেখানকার নিয়মানুসারে রাজ্যের প্রত্যেকটি উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে প্রতিদিনই মহারাজার কাছে সেলাম বাজাতে যেতে হয়। 

মহারাজা ও রাজ-পরিবারের মহিলারা আমাকে খুবই কৃপার চক্ষে দেখতেন। তার ফলে রাজ্যের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বিরাগভাজন হতে হয়েছিল। 

এদিকে রাজ-পরিবারের লোকদের ফাইফরমাশ খাটতে হয় বলে দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই রাজপ্রাসাদে কাটাতে হয়। আসল যে-কাজের জন্য নিয়োজিত হয়েছি, সে-কাজ অবহেলিত হয়। কিন্তু রাজ-পরিবারের অনুগৃহীত বলে কেউ সাহস করে আমাকে কিছু বলতে পারে না। 

একটা ব্যাপার আমি বরাবরই লক্ষ করে আসছি যে, চাকুরি-স্থানে মনিব সম্প্রদায় আমার চালচলন দেখে ও বাক্যিটাক্যি শুনে প্রথমটা খুবই খুশি হন এবং কেন যে আমি প্রায়ই বেকার বসে থাকি তার কারণ নির্ণয় করতে পারেন না। এদিকে চাকরিতে ঢুকেই মনিবের নেকনজরে পড়লে সহকর্মীরা চটে, তাতে ক্ষেত্র খানিকটা তৈরি হয়ে থাকে। তার পরে মনিবের চোখে আমি নিজেই যত আবিষ্কৃত হতে থাকি–অর্থাৎ আমার অকর্মণ্যতা, আলস্য এবং কাজের প্রতি ঔদাস্য যতই প্রকাশ পেতে থাকে ততই মনিব মনে-মনে চটতে থাকেন। তারপর হঠাৎ একদিন আমার চট্‌কা ভাঙিয়ে সোজা পথ দেখিয়ে দেন। সহকর্মীদের কাছ থেকে একটুখানি সহানুভূতি বা একটা সমবেদনার কথা শুনতেও পাওয়া যায় না। এতাবৎকাল এই চলছিল। কিন্তু এখানে এসে দেখলুম সবই উলটো। কাজের লোকেরা পড়ে থাকে সবার পেছনে, কথার লোকেরা যায় এগিয়ে। ইতিপূর্বে দু’টি-তিনটি ভারতীয় রাজ্য সম্বন্ধে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এখানে তা কাজে লেগে গেল। 

আমাদের মহারাজার কোনো বিলাস-ব্যসন নেই বললেই চলে। কাপড়-চোপড়ে তিনি বাবু নন। দেহ বিপুল মোটা। আহার করেন অপরিমিত, তারই ফলে তাঁর দেহযন্ত্রটি একটি চিনির কলে পর্যবসিত হয়েছে। আহার সম্বন্ধে ডাক্তার তাঁকে প্রতিদিনই সতর্ক করেন কিন্তু কে কার কথা শোনে! 

মহারাজের মোটর-গাড়ির শখ। প্রতিবৎসর তিনি ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে তাঁর জন্য বিশেষ করে প্রস্তুত গাড়ি আমদানি করেন আর সেইসব গাড়িতে চড়ে, অনেকগুলি রাজকর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে সারা দিন ও সারা রাত্রি সবেগে শহর পরিক্রমা করে থাকেন। দৈহিক যন্ত্রণায় একমুহূর্ত স্থির থাকতে পারেন না। ‘চরৈবেতি’ শব্দটি এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে ইতিপূর্বে আর দেখিনি। 

মহারাজার রাজ্যে পুরুষানুক্রমে বাঘ-সিংহ প্রভৃতি নরখাদক জন্তু পরম স্নেহে প্রতিপালিত হয় সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! দলে দলে খোলা বাঘ এক-এক খাটে এক-একটি করে থাবা গেড়ে বসে আছে। কারো নাম ভবানীপ্রসাদ, কারো নাম ভবানীশঙ্কর ইত্যাদি। প্রত্যেকের আলাদা চাকর দিনরাত্রি বাতাস করে চলেছে। গায়ে তাদের মাছিটি বসবার জো নেই। খাটের নীচে বড় বড় গামলা, তারা বসে বসেই মলমূত্র ত্যাগ করে। এইসব বাঘ আফ্রিকা থেকে বহুমূল্যে সংগ্রহ করা হয়, এদের নাম চিতা। এদের হরিণ শিকার করতে শিক্ষা দেওয়া হয়। এইখান থেকেই শিক্ষিত চিতা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজারা কিনে নিয়ে যায়। এই বাঘের দ্বারা হরিণ-শিকার একটা দর্শনীয় ব্যাপার। তাছাড়া সিংহ, ভাল্লুক, এমনকি নানা জাতের বেড়াল পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় সংগৃহীত হয়েছে। আর হরিণ তো আছেই। এসব কথা লিখতে গেলে আর-একখানি কেতাব হয়ে যাবে। 

মহারাজা এইভাবে যে শুধু ঘুরে বেড়ান তা নয়, মধ্যে মধ্যে কারুর-না-কারুর বাড়িতে গিয়ে হানা দেন। 

একদিনের কথা বলি। 

রাত্রি দ্বিপ্রহর। বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ দরজায় যেন ডাকাত পড়ল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলুম। দমাদ্দম দরজা ধাক্কা চলেছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখি চার-পাঁচ মূর্তি দাঁড়িয়ে। তাঁরা সকলেই উচ্চপদস্থ কর্মচারী। 

শুনলুম, মহারাজা এসেছেন, আমায় ডাকছেন। 

কি সর্বনাশ! 

তাড়াতাড়ি জামাজুতো পরে বেরিয়ে দেখি–বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এক স্টেশন-ভ্যান তাঁরা বললেন–মহারাজা ওই গাড়িতে রয়েছেন–চলো। গাড়িতে উঠে গিয়ে দেখলুম, মহারাজা একটা বেঞ্চিতে কাত হয়ে শুয়ে রয়েছেন। একজন কর্মচারী তাঁর একখানি নগ্ন পদ কোলের উপর তুলে নিয়ে পায়ের তলায় জুতো-বুরুশের মতো হাত চালিয়ে যাচ্ছে। আর-একজন পায়ের গোড়ালি থেকে কোমর অবধি দু’হাতে সমান তালে কিল মেরে চলেছে। 

মহারাজা আমায় দেখে বললেন–এসো শর্মা, কি করছিলে? 

হাত জোড় করে বললুম–আজ্ঞে মহারাজ, একটু বিশ্রাম করবার চেষ্টা করছিলুম।

মহারাজা বললেন–দূর! তার চেয়ে এখানে ব’স। একটু গল্পসল্প করি। 

বলে-মহারাজা যত-সব আঁয়-বাঁয়-সাঁয় বাজে-কথা–যেমন–কলকাতার লোকসংখ্যা কত, কালীঘাট কলকাতা থেকে যতদূর, আমরা শিগগিরই তীর্থ করতে যাব কালীঘাটে–ইত্যাদি ইত্যাদি বলে চললেন। 

মনে-মনে বললুম–মহারাজ! তীর্থাদি করবার যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে এই বেলা বেরিয়ে পড়ুন। দেহের যে অবস্থা দেখছি-তাতে এর পরে যাওয়া নাও ঘটতে পারে। 

ঘণ্টা-দু’ তিন এইরকম সব বাজে-কথায় সময় কাটিয়ে প্রায় ভোরবেলায় তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। 

বাড়িতে ঢুকে বিছানায় শুতে-না-শুতে আবার দরজায় ধাক্কা!

তাড়াতাড়ি উঠে আবার দরজা খুললুম।–একজন রাজকর্মচারী।

তিনি একদম বাড়ির মধ্যে ঢুকে বললেন– দরজাটা বন্ধ করুন। 

ভদ্রলোকের কথাবার্তা বলবার ধরন-ধারণ দেখে তো ভড়কেই গেলুম। খানিকটা দম নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–মহারাজ এসেছিলেন না? 

–আজ্ঞে হ্যাঁ, মহারাজ বলেই তো মনে হল। 

–কিরকম কথাবার্তা হল? 

প্রশ্ন শুনে পেটের মধ্যেকার সুপ্তপ্রায় ও লুপ্তপ্রায় হুইস্কি ফোঁস-ফোঁস করে গর্জে উঠল। কিন্তু তা চেপে গিয়ে বললুম—এইসব নানান কথা আর কি 

-তবু–তবু–

–মহারাজ শিগগিরই তীর্থ করতে কলকাতায় যাবেন এইসব নানান কথা– 

কর্মচারীটি তারপর অনেকক্ষণ ধানাই-পানাই করে অবশেষে আসল কথাটি প্রকাশ করে বললেন–আচ্ছা, আমার কথা কি বললেন? 

–কিছুই বলেননি। 

কর্মচারীটি আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। তবু আরও খানিকক্ষণ নানারকম প্রশ্নে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তিনি যখন বিদায় হলেন তখন ভোরের বাতাস ছেড়েছে। 

শুধু মহারাজ নন, রাজমাতা ও মহারাজার ভগিনী–এঁরাও আমাকে খুবই অনুগ্রহ করতেন। ‘রাজভগিনী’ শুনে আশা করি কেউ স্বপ্নাতুর হবেন না–কেননা তাঁর ঘর নাতি-নাতিনীর কলগুঞ্জনে মুখরিত। 

রাত্রিবেলা বাড়িতে ঘুমুচ্ছি, রাজবাড়ি থেকে গাড়ি এসে হাজির। রাজমাতা মহারাজ ও ভগিনী- মহারাজ তলব করেছেন। হুইস্কির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে প্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হওয়া গেল। দেখলাম, রাজমাতা ও রাজভগিনী আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। 

আমাকে দেখে খুশি হয়ে রাজমাতা বললেন–এসো শর্মা, কি করছিলে? 

–হুজুর, ঘুমোবার চেষ্টা করছিলুম। 

রাজভগিনী বললেন–কী ঘুমোবে! এসো গল্প করি। 

বসতে-না-বসতেই চায়ের পট ও এক-প্লেট গ্ল্যাক্সো-বিস্কুট এসে হাজির। এখানে পরোক্ষে বলে রাখি, যতদিন রাজমাতা ও রাজভগিনী আমাকে প্রাসাদে ডেকে এনেছেন, এই গ্ল্যাক্সো-বিস্কুট ও চা ছাড়া আমার কিছু জোটেনি। অবশ্য অন্য কোনো বিশেষ উৎসব ছাড়া। 

প্রাসাদের মনুষ্যের সংখ্যা খুবই কম। যিনি আসল মহারানী তিনি অন্য প্রাসাদে থাকেন। মহারাজ কালেভদ্রে যান দেখা করতে। 

প্রাসাদে বালক ও বালিকা নামে একপাল ছেলে-মেয়ে মানুষ হয়। রাজমাতা, রাজভগিনী ও উচ্চকর্মচারীর অনুগৃহীত পরিবারের সন্তান এরা। তারা এখানেই মানুষ হয়, এখান থেকেই তাদের বিবাহ হয়। কিছু যৌতুকও পায় জমিদারি হিসাবে এবং এরা যখন বড় হয় তখন রাজ্যের যত কূট ব্যাপার সেইসবে লিপ্ত থাকে। কেউ কেউ অবশ্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীও হয়। 

রাজভগিনী যিনি, তাঁর বিয়ে হয়েছিল অন্য এক দেশের রাজার সঙ্গে। কিন্তু সেখানে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় প্রথমে বাপের বাড়িতে, পরে ভাইয়ের বাড়িতে ফিরে এসেছেন এবং সমারোহ সহকারে বাস করছেন। রাজমাতা মধ্যে মধ্যে মেয়ের এই অদৃষ্ট নিয়ে আমার কাছে দুঃখ করতেন। মেয়ের দুঃখে মাতার চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে দেখেছি। 

প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে কুকুরের দল। তাদের পিতা-প্রপিতামহদের ঠিকানা দরজায় ঝুলছে। পরম সমাদারে তারা প্রতিপালিত হচ্ছে। 

প্রাসাদ-সংলগ্ন প্রকাণ্ড বাগানে বড় বড় গাছে উঁচু-নীচু ডালে দামি দামি ভুবন-বিখ্যাত পাখিদের বাসা করে দেওয়া হয়েছে। তারা পুরুষানুক্রমে পুত্রকলত্রাদি নিয়ে নিজস্ব বাসায় বাস করছে। এদের প্রত্যেকের চরিত্রবৈশিষ্ট্য, প্রয়োজন ও অভাব এবং প্রতিদিন তারা বাসায় আসছে কি না বা এলো কি না, রাজকুমারী নিজে তা জানেন এবং খোঁজ রাখেন। 

একদিনের কথা বলি। 

শেষরাত্রে প্রাসাদ থেকে জরুরি তলব এলো–এখুনি যেতে হবে সেখানে। 

তখুনি যাত্রা করা গেল। 

গিয়ে দেখি, প্রাসাদ-সংলগ্ন বাগানে রাজ্যের অধিকাংশ কর্মচারী ছুটোছুটি করছেন। রাজকুমারী ও রাজমাতা উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করছেন। ব্যাপার দেখে আমার প্রথমেই মনে হল–বোধ হয় মহারাজা তাঁর বিরাট দেহটি রক্ষা করেছেন। রাজকুমারী অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে আমায় বললেন–আমাদের একটা মদ্দা ম্যাক্স বাসায় ফিরে আসেনি। 

শুনেই আমার বুকের মধ্যে গান বেজে উঠল–”জঙলা পাখি পোষ না মেনে শিকলি কেটে উড়ে যায়।” 

দেখি মাদী ম্যাক্‌অ-টাকে একটা খাঁচায় ভরে রাখা হয়েছে। সে-বেচারি জড়োসড়ো হয়ে অপরাধীর মতো খাঁচার এক কোণে বসে রয়েছে। রাজকুমারী চেঁচাতে লাগলেন–সে আসবে, ফিরে আসবে, নিশ্চয়ই আসবে। তবে কিনা দিনকয়েক একটু ফুর্তি-টুর্তি করে নিয়ে তবে ফিরবে। 

মাদীটাকে দেখিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম–এটাকে খাঁচায় ভরে রাখা হয়েছে কেন? 

রাজকুমারী হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–না হলে এটাও যে পালাবে মদ্দার খোঁজে।

রাজকুমারী আকুল হয়ে বলতে লাগলেন–শর্মা, তুমি এক্ষুনি যাও কলকাতায়। সেখানকার টেরিটি-বাজার থেকে এর একটা মদ্দা কিনে নিয়ে এস। 

মাথায় বজ্রাঘাত হল–কী সর্বনাশ! 

ভয়ে ভয়ে বললুম–মহারাজ, আমি তো পাখি চিনি না, শেষকালে কি হতে কি হবে!

রাজকুমারী বললেন–চেনবার কোনো দরকার নেই। 

এই বলেই তিনি একজনকে হুকুম দিলেন–এই অমুককে ডাকো তো। 

অমুক ব্যক্তি প্রাসাদেই উপস্থিত ছিলেন। তাকে ডেকে বললেন–এর জোড়া মদ্দাটার একটা ছবি এখুনি এঁকে দাও। 

সে-ব্যক্তি তখুনি কাগজ-রঙ-তুলি এনে আমাদের সামনেই ছবি আঁকতে লাগল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ছবি তৈরি হয়ে গেল, দেখলুম মদ্দা ও মাদী পাখিতেও চেহারার অনেক তফাৎ! 

রাজকুমারী আমায় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন–কোথায় কি রেখা, কোনখানে কি রঙ, জোয়ান পাখি কতটা লম্বা হবে, মুখ কিরকম হবে, সে চাইবেই বা কিরকম ভাবে–ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মনে হতে লাগল–পক্ষিতত্ত্বে এঁদের জ্ঞান কত গভীর! আরও মনে হচ্ছিল- যিনি বনের পাখিকে এমন করে চেনেন এবং পোষ মানান, একটি মাত্র স্বামীকে তিনি পোষ মানাতে পারলেন না কেন? 

যাই হোক, ভোর হবার আগেই পলাতক ম্যঅ-র ছবি তৈরি হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রার উদ্যোগ হল। আমি কিন্তু সে-যাত্রা কোনোরকমে কাজটা অন্য লোকের ঘাড়ে চাপিয়ে অব্যাহতি পেয়েছিলুম। হপ্তাখানেকের মধ্যেই টেরিটিবাজারের এক ম্যাক্স প্রাসাদে এসে শিক্ষানবিশি করতে লাগল। 

আর একটা কথা বলেই এই রাজকীয় ব্যাপারের বর্ণনা শেষ করি। 

সেবার গরমের সময় শহরের চতুর্দিকে কলেরা রোগ দেখা দিল। মহারাজা স্থির করলেন–শহর থেকে সরে অন্যত্র গিয়ে বাস করবেন। রাজধানী থেকে মাইল-পঞ্চাশেক দূরে পাহাড়ের নীচে ছিল বিরাট জঙ্গল। সেখানে লোক চলে গেল পাঁচ-সাতটা হাতি নিয়ে জঙ্গল সাফ করবার জন্য। তিন-চার মাইল জায়গা সাফ করে সেখানে দর্মার প্রাসাদ তৈরি হয়ে গেল। 

মহারাজা যাবেন, সুতরাং রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসকও চললেন সঙ্গে। ওষুধপত্র, ঘোড়া, প্রিয়পাত্র যত লোক–সবাই চলল মহারাজার সঙ্গে। কদিনের মধ্যেই জঙ্গল শহরে পরিণত হয়ে গেল। 

নতুন দর্মা-শহরে কারুর কোনো কাজ নেই। সকালবেলা পুরুষেরা উঠে এক এক পেট খেয়ে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে গেলেন শিকারে। জঙ্গলে খেদিয়ে শুয়োর তাড়া করে বার করবার লোক আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে। ফাঁকা জায়গায় শিকার বেরুতেই বল্লম হাতে শিকারী তাড়া করলেন তাকে। 

সে এক উত্তেজনাপূর্ণ ভয়াবহ দৃশ্য। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে শুয়োর ছুটেছে নীচের দিকে তীরবৎ, আর তারই পেছনে ঘোড়ায় চড়ে তাকে খোঁচাতে-খোঁচাতে আসছেন শিকারী। ঘোড়ার পা যদি একটু স্খলিত হয় কিংবা জিনের পেটি যদি ছিঁড়ে যায়–কিংবা বামকরধৃত রশ্মি যদি একটু আলগা হয় তাহলে শিকারী কোথায় গিয়ে যে পড়বেন তার কোনো ঠিকানা নেই। ওদিকে মেয়েরাও বেরিয়েছেন ঘোড়ায় চড়ে বল্লম হাতে নিয়ে। তাঁরা মারবেন হরিণ–খুঁচিয়ে। 

শহর থেকে অনেকদূরে এই জঙ্গল-নগর। এখানে দু’শ লোকের আহারের জন্য নিত্য ছাগশিশু জোগানো সম্ভব নয়। তাই সেই ঘোড়ার মতো বিরাট আকারের শম্বর আর হাতির মতো শুয়োর মারিয়ে দুবেলা সেই দু’শ লোকের আহার তৈরি হত এবং সেখানকার নিয়ম অনুসারে দুবেলাই আমাদের সকলকে মহারাজার সঙ্গে আহারে বসতে হত। কাঁচা শালপাতা জোড়া দিয়ে তাতে অন্ন পরিবেশন করা হত। এই জঘন্য খাদ্য দিনকতক খেইে আমার অসুখ করে গেল। 

আগেই বলেছি, পুরুষেরা একদল প্রতিদিনই সকালবেলা শিকার করতে যেত। এই শিকারের পর্ব শেষ হলেই আহারের পর্ব শুরু হত। তখন আবার শিকারের গল্পই চলতে থাকত। একদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল শিকার পালিয়ে যাওয়া; আর, শিকার হাতে এসে পালিয়ে-যাওয়াটা শিকারীর পক্ষে ছিল অত্যন্ত অসম্মানজনক। তা ছাড়া সেদিন একজন শিকারীর হাত থেকে শিকার ফসকে যাওয়ায় খুবই আফশোস চলছিল, এমন সময় ‘বীটার’রা এসে খবর দিলে যে, সেই শুয়োরটা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। 

শোনা-মাত্রই যাঁর হাত থেকে শিকার ফকেছিল, তিনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই বেরিয়ে গেলেন। বাইরে ঘোড়ারা বিশ্রাম করছিল। তিনি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বর্শা-হাতে ছুটলেন সেই শিকারের উদ্দেশে। 

ঘণ্টা-খানেক বাদে, খাওয়ার পর্ব তখন মিটে গিয়েছে, লোকেরা শিকার-ক্ষেত্র থেকে একতাল মাংসপিণ্ড নিয়ে এসে উপস্থিত করলে। তার মধ্যে শিকারী, শিকার এবং ঘোড়া, তিনেরই মৃতদেহ জড়িয়ে আছে। সন্ধের মধ্যে শিকারীর দেহ সৎকার হয়ে গেল। তারপর আর তার নামও কেউ করলে না। 

রাজা এবং রাজকীয় ব্যাপার সম্বন্ধে এত লম্বা করে বলবার কারণ হচ্ছে–স্বাধীনতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে রাজা এবং রাজ্য লোপ পাওয়ায় রাজাদের এইসব খামখেয়ালিপনা –যা গল্পকথার শামিল–ভারতবর্ষ থেকে চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হয়েছে। সে-যুগের রাজকথা এ-যুগে রূপকথায় পর্যবসিত। ধনতন্ত্রবাদ অস্তাচলের অভিমুখে এবং গণতন্ত্র-আগমনের আগমনী পূর্বগগনে ধ্বনিত। গণতান্ত্রিক রাজারা যে কী অবস্থায় এসে দাঁড়াবে তার একটু-আধটু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। 

যে-কথাটি বলবার জন্য এই রাজা ও রাজ্যের গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছিলুম, তাই বলে এখানকার পালা শেষ করি। 

আমাদের শহর থেকে কিছুদূরে একটা পাহাড় ছিল। পাহাড়টা বেশি উঁচু না। মাত্র চারহাজার ফুট। তার মাথাটা বেশ থ্যাবড়া আর পরিষ্কার। চারপাশের লোকেরা এইখানে এই পাহাড়ের চুড়োয় চড়ুইভাতি করতে যেত। আমরাও কয়েকবার গিয়েছিলুম। 

চমৎকার দৃশ্য সেখানকার। যাবার মতো জায়গা বটে! ওপরে কোনো বসতি নেই, কেবল মহারাজার একটি প্রাসাদ মাত্র। দরকার হলে প্রাসাদের বাইরের দিককার দু’ একখানা ঘরও পাওয়া যেতে পারে। সেবার আমাদের বাড়ির সবাই এবং কাছাকাছি আরও দু’টি-তিনটি পরিবার মিলে ব্যবস্থা করলেন–সেখানে গিয়ে একদিন চড়ুইভাতি করতে হবে। 

দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল। জিনিসপত্র কেনা-কাটা শেষ। এমন সময় রাজবাড়ি থেকে এত্তেলা হল–সেইদিনই রাত্রের ভোজসভায় আমায় উপস্থিত থাকতে হবে। ঠিক হল–আমার আর চড়ুইভাতিতে যাওয়া হবে না। 

নির্দিষ্ট দিনে রাত্রি চারটের সময় উঠে বাঁধা-ছাঁদা শুরু হয়ে গেল। বলা বাহুল্য, বাড়ির আর-সবাইয়ের সঙ্গে আমিও উঠে তাদের কাজে সাহায্য করতে লাগলুম। আধঘণ্টার মধ্যেই গাড়ি এসে উপস্থিত হতেই সবাই চড়ুইভাতিতে চলে গেলেন, আমার আর যাওয়া হল না। 

সকলে বিদায় হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই, কেন জানি না, আমার মনটা অত্যন্ত খারাপ লাগতে লাগল। মনে-মনে কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলুম, কিন্তু কোনো কারণই খুঁজে পেলুম না। বেলা যত বাড়তে থাকে–আমার মনের ভারও ততই বাড়তে থাকে। মনে আশঙ্কা হল–এ কোনো অশুভ ঘটনার পূর্বাভাস নয় তো! 

যাই হোক, আহারাদি সেরে কাজে চলে গেলুম। কাজের ভিড়ে সারাদিন ডুবে থাকায় মনের কোনো খোঁজ পাইনি; কিন্তু বিকেলবেলা বাড়িতে আসবার পর আবার সেই অবস্থায় ফিরে এলুম। 

অগত্যা বেশ বড় দেখে একটি পাত্র চড়িয়ে দিলুম। ওদিকে সন্ধে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বাড়ির সবাই পাহাড় থেকে ফিরে এলো। মন তখন কতকটা নিশ্চিন্ত হওয়ায় প্রাসাদে যাওয়ার ব্যবস্থায় মন দিলুম। 

আমাদের মহারাজা কিছুকাল পূর্বে নিমন্ত্রিত হয়ে অন্য এক রাজার রাজত্বে গিয়েছিলেন। ফিরবার সময় তিনি সেখানকার রাজাকে নিমন্ত্রণ করে এসেছিলেন। অনেকদিন পরে সেই রাজা সপারিষদ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমাদের রাজ্যে এলেন। প্রায় পনেরো দিন ধরে পান-ভোজন ও নানা উৎসবের ঠেলায় একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছিলুম। 

আজ উৎসবের শেষরাত্রি। 

আজকে বিদায়ভোজের পর কাল তাঁদের যাত্রার পালা শুরু হবে। ভারতবর্ষে এইসব রাজন্যবর্গ ধরাধামে অবতীর্ণ হতেন শুধু মর্ত্যলোকে ইন্দ্রত্ব করবার জন্য। পেয় ও অপেয়, খাদ্য-সুখাদ্য-অখাদ্য-কুখাদ্য, বাছা বাছা দিব্যাঙ্গনা, পশুহত্যা, নরহত্যা, নারীহত্যা, ঘোড়দৌড়, নানাপ্রকার ক্রীড়ামোদ, সুরা, সৌন্দর্য ও সঙ্গীতের মধ্যে জীবনটাকে পুঁতে দিয়ে উত্তরাধিকারীদের স্কন্ধে তাঁদের এইজাতীয় অসম্পূর্ণ কর্তব্যভার চাপিয়ে দিয়ে চলে যেতেন অমর্ত্যধামে। এক-একজনের খেয়াল-খুশি ও কল্পনার কুহক চরিতার্থ করবার জন্য লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকা ব্যয় হয়ে যেত। 

ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর তৎকালীন শাসনকর্তারা প্রথমেই এই অভিশাপের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও টিকটিকির ল্যাজ যেমন কিছুক্ষণ লাফালাফি করে, তেমনি রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কোনো কোনো রাজা কিছুকাল তুরতুর করে লাফালাফি করেছিলেন বটে, কিন্তু ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছেন। ভবিষ্যতে কোনো ঐতিহাসিক ইংরেজদের প্রশ্রয় বেড়ে-ওঠা এই রাজন্যবর্গের কথা যদি লিপিবদ্ধ করতে পারেন তবে তা যে জগতের একটি বিস্ময়কর গ্রন্থ হবে সে-বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই। এখন সে-কথা যাক। 

সেদিন আমাকে একটু তাড়াতাড়িই বেরুবার হুকুম করা হয়েছিল। এর কারণ আর কিছুই নয়, সেজেগুজে গিয়ে তাঁদের হুল্লোড়ে যোগ দেওয়া। মহারাজা হাসলে হাসা, মুখ গম্ভীর করলে নিজের মুখ গম্ভীরতর করা, আর বিলিয়ার্ডের টেবিলে অতিবিচ্ছিরি মার-কেও বলে ওঠা–মহারাজ, এরকম অদ্ভুত মার খুব কম লোকের হাতেই বেরোয়! 

আমাদের মহারাজ একেই তো অসুস্থ, ডায়াবেটিস-জনিত গাত্রদাঁহে দিনরাত ছটফট করে বেড়ান। তার ওপর এই ক’দিনে অভ্যাগত রাজা এবং তাঁর পারিষদবর্গের সঙ্গে একত্র আহার্য গ্রহণের ফলে ভোজন-ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আধিক্য ঘটায় তিনি শয্যা নিয়েছিলেন। কাজেই আজকের ভোজসভায় অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারে তাঁর নিন্দে যেন না হয় সে-বিষয়ে আমাদের বিশেষ করে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল। 

যথাসময়ে টেবিলে এসে বসা গেল। সেদিন টেবিলে কোনো মহিলা ছিলেন না। যখন অভ্যাগত সবাই টেবিলে এসে বসলেন তখন সকলের অবস্থাই ট্যা। অনেককেই বেয়ারারা ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। অনেকেরই পাগড়ি কপালের উপর ঝুলে পড়েছিল। তুররা প্রায়ই নিম্নগামী। 

আমাদের আসল অভ্যাগত যিনি, তাঁর অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। আমার আসন নির্দিষ্ট হয়েছিল টেবিলের ল্যাজের দিকে। নিজে বেশ বুঝতে পারছিলুম যে বিকেল থেকে পাত্র সেবন করে করে আমার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। ছুরি-কাঁটা হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়–এমনই অবস্থা। 

অভ্যাগতেরা কিছুক্ষণ চুপ করে খানা খাচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে মহারাজা-সাহেবকে চাকরেরা ধরে তাঁর ঘরে নিয়ে চলে গেল। তিনি চলে যেতেই পারিষদদের মুখ ছুটল, প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপরে সরবে উচ্চহাস্যে। 

মিনিট-দশেকের মধ্যে খানা-কামরা ফুটবল ময়দানে পরিণত হল। 

আমার সামনে মাতালদের রকম-সকম দেখে মনে-মনে হাসছিলুম বটে, এদিকে আমার অবস্থা দেখে যে অন্যদের হাসির উদ্রেক হচ্ছিল তা বোঝবার মতো অবস্থা আমার ছিল না। ঢুলতে ঢুলতে একবার টেবিলে মাথাই ঠুকে গেল। তারপরে কখন যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলুম তা জানি না। 

হঠাৎ চট্‌কা ভেঙে দেখি, আমার দেহের কোমর অবধি টেবিলের তলায় চলে গিয়েছে। চেয়ারের হাতল-দুটো দু’হাতে আঁকড়ে রয়েছি। সংবিৎ ফিরতেই ধড়মড় করে চেয়ারে উঠে বসলুম। অভ্যাগতদের অধিকাংশকেই টেবিল থেকে চাকরেরা তুলে নিয়ে গিয়েছে। দু’চারজন এদিকে-ওদিকে যাঁরা তখনও খাবার ভান করছেন অথবা খাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। আমি উঠে বসতেই দু’একজন ‘বয়’ এগিয়ে এসে আমায় বললে-আপনি তো বসেই ঢুলতে আরম্ভ করলেন। খাওয়া-দাওয়া তো কিছুই হয়নি, কিছু খাবেন? 

আমি বললুম–নিয়ে এস তো কিছু খাবার। 

বলতে-না-বলতে তারা ব্যবস্থা করে দিলে আমিও খেতে আরম্ভ করলুম 

খেতে খেতে একবার মুখ তুলে সামনের দিকে চাইতেই মনে হল–আমার দৃষ্টিটা যেন ঝাপসা হয়ে আসছে, কেমন যেন সব আবছায়ার মতন! এই আবছায়ার ভেতর দিয়ে জোর দৃষ্টি প্রসারিত করবার চেষ্টা করছি–দেখতে দেখতে হঠাৎ তারই মধ্যে গাছপালা, চষা মাঠ, দূরের পাহাড় ফুটে উঠল। 

মনে হতে লাগল –তখনও যেন সূর্যের আলো পৃথিবীতে স্পষ্ট ফোটেনি, স্বচ্ছ সেই প্রতিচ্ছায়ার ভেতর দিয়ে দেখতে লাগলুম, লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

টেবিলে বসে কেউ কেউ খাচ্ছেন তখন। 

দেখতে দেখতে ধাঁ করে আমার মনে পড়ে গেল–এ-যে কৈশোরের সেই অরণ্যভূমি! ওদিকে স্বচ্ছ প্রতিচ্ছায়ার ভেতর দিয়ে দলে দলে অরণ্যবাসী নরনারী শ্রমিকের দল আসতে আরম্ভ করেছে। তারা টেবিলের ওপর দিয়ে সিধে এসে আমার দু’পাশে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। সেই নিরন্ন শ্রমিকের দল বহুমূল্য স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্র এবং বিবিধ ভোজ্য ও পানীয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে আসছে। সবার শেষে দেখলাম আমার সেই অরণ্যমাতাকে। দীর্ঘ কুশদেহ, জীবনব্যাপী কঠোর শ্রম ও অর্ধ-উপবাসজনিত কঠিন মুখমণ্ডল। দেহের উত্তরার্ধ এবং নিম্নার্ধ প্রায় উলঙ্গ। সম্মুখে দৃষ্টি প্রসারিত, যেন বর্তমান উপেক্ষা করে কোন্ সুদূর ভবিষ্যতে সে-দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে। মুখে কোনো ভাব নেই, দৃঢ়-পদক্ষেপে অগ্রসর হতে হতে আমার কাছে এসে সে-মূর্তি মিলিয়ে গেল। 

অরণ্যের প্রতিচ্ছায়া অন্তর্হিত হবার সঙ্গেই আমার নেশা চড়াক করে যেন মাটিতে নেমে মিলিয়ে গেল। আমি চেয়ারে একবার নড়ে-চড়ে ঠিক হয়ে বসলুম। এইমাত্র যে-দৃশ্য দেখলুম, আমার মনে তার প্রতিক্রিয়া হল আতঙ্কমিশ্রিত বিস্ময়। এতদিন ধরে যে-কথা মনের কোনো গোপনস্তরে থিতিয়ে পড়ে ছিল, হঠাৎ তা এমন অবস্থায় আজ আমার সামনে ফুটে ওঠার তাৎপর্য কি? একটা বেদনাকর অস্বস্তিতে দেহ-মন পীড়িত হতে লাগল। 

হয়তো বাইরেও আমার মনের অবস্থা প্রকাশ পেয়েছিল। কারণ একজন ‘বয়’ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে–হুঁজুর কি কিছু বলছেন? 

লোকটি আমার পরিচিত। ইতিপূর্বে রাজবাড়িতে বহুবার তার সঙ্গে দেখাশুনো হয়েছে। আমি তাকে বললুম–দেখ, ড্রাইভারকে আমার গাড়ি নিয়ে আসতে বলো। আমি বাড়ি যাব। 

ওদিকে আমার মনে সেই অরণ্যের ছবির কথা ভাসছিল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল–এইখানে একদিন মুমূর্ষু অবস্থায় অরণ্যমাতার জীর্ণ কুটিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলুম। সেখানে তারই সেবায় ও যত্নে প্রাণ ফিরে পেয়ে মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম–এদের কল্যাণের জন্যই আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করব। সেই কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যই হয়তো প্রকৃতিদেবী আজকের এই খেলা খেললেন। 

সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠল-হায়! হায়! জীবনটাকে তো ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছি। এতদিন কী করে সেই প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে ছিলুম! 

ইতিমধ্যে ‘বয়’ এসে বললে–গাড়ি এসে গেছে হুজুর! 

টেবিলে মন্ত্রী-শ্রেণীর একজন উচ্চ-রাজকর্মচারী তখনও বসে খেয়ে বাকি সবাইকে সঙ্গ দান করছিলেন। আমি তাঁকে বলে সিধে গাড়িতে এসে বসলুম। 

বাড়ি এসে কাপড়-চোপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু চোখে ঘুম কোথায়! মনের মধ্যে তখন দারুণ অন্তর্দাহ শুরু হয়েছে। এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে রাত্রি কাবার হয়ে গেল। 

সকালবেলা শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত, কিন্তু মনের মধ্যে চড়াক চড়াক করে সেই দৃশ্যের কথা জাগতে লাগল। 

সে-কথা কাউকে বলবার উপায় নেই। কে আমার কথা বিশ্বাস করবে? সেদিন যারা আমার সঙ্গী ছিল, তাদের মধ্যে পরিতোষ অনেকদিন আগেই লোকান্তরে চলে গিয়েছে। কালী কোথায় আছে তা জানি না। তার সঙ্গে অনেকদিন কোনো সম্পর্ক নেই। নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করলুম–এখানকার কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে এই কাজে লেগে যাব নাকি? 

কিন্তু মন সঙ্কুচিত হয়ে উঠল। এই প্রশ্নের কোনো সাড়াই পেলুম না। ছেলেবেলার সেদিন আর নেই–যেদিন মনে কোনো কথার উদয় হলেই সম্ভব-অসম্ভব বিবেচনা করিনি, আপদ-বিপদের বা ভবিষ্যতের চিন্তা করিনি। 

কিন্তু আজ আর সেদিন নেই। আয়ুসূর্য মধ্যগগন পার হয়ে কবে যে অস্তাচলের দিকে ঢলে পড়েছে তার সন্ধান রাখিনি। রোগ-শোক, বিরহব্যথা ও ব্যর্থতায় দেহ ক্লান্ত, মন জর্জর। মনের সে-শক্তি কোথায়, যেদিন চিত্তমরাল স্বচ্ছন্দে, অনায়াসে মানস সরোবরে কেলি করত! আজ কল্পনার রাজপথ অভিজ্ঞতার কণ্টক-তরুতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তার ওপর স্বেচ্ছাঘটিত নানা দায়িত্বে হস্তপদ শৃঙ্খলিত– সযত্নপালিত নানা অভ্যাসদোষে জীবন দূষিত! এ অবস্থায় কি করে নতুন কাজ আরম্ভ করব? 

তবুও–তবুও একটা কিছু করবার জন্য মন ছটফট করছিল। সামনেই ছিল আমার মা’র মৃত্যুদিন। আমি শহরে ট্যাড়া পিটিয়ে দিলুম–সেইদিন আমার বাড়িতে কাঙালীভোজন হবে। 

নির্দিষ্ট দিনে নরনারায়ণ-দেবতার সেবা শেষ হয়ে গেলে আমি ও আমার পরিবারের সকলে সেই অন্ন ভাগ করে আহার করলুম। 

কিন্তু নিশ্চিন্ত সুখে রাজভোগে থাকা আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলুম–আমি আর চাকরি করতে চাই না। 

মহারাজা আমাকে ডেকে বললেন–তুমি তো বলেছিলে এই দেশকেই তোমার দেশ বানিয়ে নেবে? কি হল তার? তোমায় আমি জমি দিচ্ছি, বাড়ি তৈরি করবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এইখানেই থাকো। 

আমি চুপ করে রইলুম। আমার জীবনদেবতা হাতছানি দিয়েছেন–আমি জানি, আমার এখানে থাকা আর চলবে না। মনের মধ্যে চড়াক করে ভেসে উঠল ভোজসভার স্মৃতি–বহুমূল্য স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্রে স্তরে স্তরে সজ্জিত বিবিধ সুস্বাদু ভোজ্য ও পানীয়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে নিরন্ন শ্রমিকের দল–যাদের সবার পিছনে আছে আমার সেই কৈশোরের অরণ্যমাতা–দীর্ঘ কৃশদেহ, জীবনব্যাপী কঠোর শ্রম ও অর্ধ-উপবাসজনিত কঠিন মুখমণ্ডল–দেহ প্রায় উলঙ্গ–দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত, যেন বর্তমানকে উপেক্ষা করে কোন সুদূর ভবিষ্যতে সে-দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে। 

মনে পড়ল সেই কৈশোরের প্রতিজ্ঞা–এদের অবস্থা–এদের দারিদ্র্য দূর করবার চেষ্টা করতে হবে। এদের নগ্ন অঙ্গে বস্ত্র দিতে হবে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে শক্তি জাগিয়ে তুলতে হবে এদের বুকে। কিন্তু কোথায়–মনের কোন্ অতলে তলিয়ে গেল তাদের অস্তিত্ব! তাদের স্থানে কত লোককে ভাই বললুম, কত শয়তানকে আলিঙ্গন করলুম ভাই বলে, কত মহৎকে পদাঘাত করলুম শত্রু বলে। এমনি করে মানবজীবনের তৃতীয়াংশ ক্ষয় করে আজ জীবন-তরণী চড়ায় আটকে গেল। 

আজ এই জাতক লিখতে-লিখতে মনে হচ্ছে, আর কেন। এইখানেই শেষ হোক। জীবনকে দেখলুম, মানুষকে দেখলুম। তবু নরনারীচিত্তে যে আদিম রহস্য আত্মগোপন করে আছে, আজও তার হিসাব শোধ করতে পারিনি। কেউই পারে না। সেইজন্যেই প্রতিটি যুগ আসে নতুন ভাবের ডালি নিয়ে। আজ সর্বসমক্ষে এই কথা বলে যেতে পারি যে প্রান্তরের গান আমার এই জাতকে আমি কোনো কৃত্রিম ঘরবাড়ি বসাইনি। মানুষকে দেখেছি কিন্তু তাকে সাজাইনি। তার বিষ ও তার অমৃত দুই-ই দু’হাত ভরে নিয়ে সর্বাঙ্গে লেপেছি। কোনো ছেদোকথার জাল ফেলে উড়ন্ত-পাখির ডানা বাঁধতে চাইনি। 

সম্মুখ দিয়ে বয়ে গেছে জগৎসংসার। তার তীরে বসে তৃষ্ণায় আকুল হয়ে কেঁদেছি, কিন্তু সে-তৃষ্ণা মেটাবার পানীয় বাইরে থেকে কোনোদিনই যে পাওয়া যায় না, এ-কথাও মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। এমন সংশয়ও এসেছে–এই যে অসংখ্য নরনারীর জনতা আজ সামনে দিয়ে চলে গেছে, তাদের সঙ্গে সংযোগের সূত্রটি পূর্ব-নির্ধারিত ছিল কি না! কোন্ যন্ত্রী অলক্ষ্যে বসে আমাদের নিয়ে যোগ-বিয়োগের আঁক কষছেন কিন্তু ফল-নির্ণয়ে এখনও পৌঁছতে পারেননি! জীবন তো সে-চক্রীর হাতের কোনো সুপরিকল্পিত কাহিনি নয় যে, ল্যাজ-মাথা এক দড়িতে বেঁধে ড্যাড্যাং-ড্যাং ড্যাড্যাং-ড্যাং করে দেহটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে যাব। 

আজ মোহের কাজল চোখ থেকে অশ্রুজলে ধুয়ে গেছে, তাইতো কোনো তত্ত্বের জ্ঞানশলাকায় এ নেত্রতারকা বিদ্ধ হতে দিইনি। সেই খোলা-চোখে মানুষ-দেখার ইতিহাস এই জাতকে আমি বার বার জন্মেছি–বার বার মরেছি। আমার সেই অসংখ্য জন্ম-মরণের কথাই পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে আজ বিদায় নিলুম। 

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *