ইকবাল তাঁর থালা, ছুরি, চামচ ও টিনের কৌটা ক্যানভাসের থলির মধ্যে পুরলেন। তার মনে হলো তাঁর দেহে উত্তাপ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ যখন তার প্রিয়াকে বলে যে, সে তাকে ভালবাসে, তখন যে ধরনের উত্তাপ বোধ হয়, ঠিক সেই রকম। ইকবালের পক্ষে এখন কিছু একটা ঘোষণা দেয়ার সময় হয়েছে। কিসের ঘোষণা, ইকবাল সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানেন না।
তিনি কি উন্মত্ত জনতার সামনে গিয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলবেন যে, এটা অন্যায়-অনৈতিক ও সশস্ত্ৰ লোকগুলোর দিকে তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবেন-তাঁর দৃষ্টি অবনত হবে না, কোনদিকে ফিরে তাকবেন না যেমনটি সিনেমার নায়ককে দেখা যায়। সিনেমার পর্দায় ক্যামেরার কারসাজিতে তাকে ক্রমেই দেখা যায় বিরাট আকারে-তারপর নায়কের প্রচণ্ড ঘুসি একের পর এক অথবা রাইফেলের গুলি একের পর এক। শিরঃদাঁড়া দিয়ে নিম্নানুভিমুখী একটা শীতল অনুভূতি ইকবাল অনুভব করলেন।
আত্মত্যাগের এই সর্বোৎকৃষ্ট কাজ দেখার জন্য কেউ থাকবে না। অন্য লোককে তারা যেভাবে খুন করবে, ইকবালকেও তারা সেইভাবে মেরে ফেলবে। তাদের দৃষ্টিতে তিনি নিরপেক্ষ নন। তারা তাঁর কাপড় খুলে দেখবে। লিঙ্গের চামড়ার অগ্রবর্তী অংশ কাটা, সুতরাং মুসলমান। জীবনকে একেবারে অকাজে বিনষ্ট করা হবে। এতে কি লাভ হবে? কয়েকজন নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ তাদের সমগোত্রীয় অন্য একজন মানুষকে হত্যা করবে। বছরে চল্লিশ লাখ লোক যে দেশে বাড়ে, সেখানে একজনের হত্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে খুব সামান্য প্রভাব ফেলবে। এমন নয় যে, খারাপ লোকের হাত থেকে ভাল লোককে বাঁচানো হচ্ছে। অন্যদের কোন সুযোগ থাকলে তারাও একই কাজ করত। বস্তৃত কিছু লোক এ কাজ করছে নদীর ওপারে, সামান্য দূরে। সুতরাং আত্মত্যাগ অর্থহীন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখাই পবিত্র দায়িত্ব।
ইকবাল তাঁর ফ্লাস্কের মুখ খুলে প্লাষ্টিকের কাপে বেশ কিছুটা হুইস্কি ঢাললেন। এক ঢোকে। তিনি সবটাই গলাধঃকরণ করলেন।
বুলেট যখন যত্রতত্র ছুটে বেড়ায় তখন বুলেটের গতিপথে মাথা পেতে দিয়ে গুলি খাওয়ার প্রয়োজন কি? বুলেট নিরপেক্ষ। ভাল-মন্দ, গুরুত্বপূৰ্ণ-গুরুত্বহীন কোন কিছু পার্থক্য না করে বুলেট আঘাত করে। সিনেমার পর্দায় আত্মাহুতির কিছুটা প্রভাব আছে-এ থেকে দর্শকরা নৈতিক শিক্ষা পেতে পারে। যা ঘটার তাই যদি ঘটে যায় তা হলে পর দিন সকালে হাজারটা মৃতদেহের সাথে আরও একটা মৃতদেহ যুক্ত হবে, ঐ মৃতদেহটিও দেখা যাবে অন্য মৃতদেহের মতো-কোঁকড়ানো কে বুঝবে যে তোমার মৃতদেহ মুসলমানের নয়! কে জানবে যে, তুমি এমন একজন শিখ যে পরিণতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বুলেট বর্ষণের দিকে অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়েছ। শুধু এ কথা প্রমাণের জন্য যে, অন্যায়ের ওপর ন্যায় বিজয়ী হবে? আর ভগবানা-না, না ভগবান নয়। ভগবান এখানে অপ্রয়োজনীয়।
ইকবাল আর এক পেগ হুইস্কি ঢাললেন। মনে হলো তাঁর মনটা বেশ ঝরঝরে হয়েছে।
তিনি ভাবলেন, আত্মত্যাগের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে। ঐ লক্ষ্যের জন্য এটাই দেখা যথেষ্ট নয় যে, জিনিষটা ভাল; সেটা যে ভাল এ কথা সবার জানা থাকতে হবে। কেউ ঠিক পথে আছে। এ কথা শুধু তার জেনে কোন লাভ নেই; এই সস্তুষ্টি শুধু নিজেরই। স্কুলে বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য নিজে শাস্তি ভোগ করার মতো এটা নয়। সেক্ষেত্রে আত্মত্যাগের সুফল আনন্দের সাথে ভোগ করা যায়। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে তুমি নিজেই যাচ্ছ নিহত হওয়ার জন্য। এ কাজ সমাজের উপকারে আসবে না; সমাজ কোনদিন জানতেও পারবে না, এমন কি তুমি নিজেও জানতে পারবে না, কারণ তুমি নিজেই মারা যাবে। সিনেমার পর্দায় এ ধরনের ঘটনা হাজার হাজার লোক দেখে উত্তেজিত হয়, উদ্বিগ্ন হয়। এ দৃশ্য থেকে তারা শিক্ষাও গ্রহণ করে। সমগ্ৰ বিষয়ের মধ্যে ওটাই প্রধান। গ্রহণকারীরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকলেই কেবল আগ্রহী ব্যক্তিরা কিছু করতে পারে। অন্যথায় সব কিছু বিফলে যায়।
ফ্লাস্ক থেকে আবার কিছু ঢেলে তিনি গ্লাস পূর্ণ করলেন। সব কিছুই তাঁর কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল।
তোমার যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস হয় অবস্থার এমন অবনতি ঘটেছে যাতে তোমার প্রথম কাজ হলো নিজেকে বিসর্জন দেয়া-স্লেট থেকে সব কিছু পরিষ্কার করে মুছে ফেলা।–তাহলে বিসর্জনের মতো সামান্য কাজ করা তোমার উচিত নয়। তোমার প্রথম কাজ হবে, যারা আগুন ছড়াচ্ছে তাদের উপেক্ষা করা-তাদের প্রতি নৈতিক উপদেশ বর্ষণ করে নয়-এমন প্রবল প্ৰমত্তা ঢেউ প্রবাহিত করতে হবে যাতে স্বার্থপরতা, অধৈৰ্য, লোভ, মিথ্যা, চাটুকারিতার মতো সব ঘূণ্য বস্তু ডুবে যায়। প্রয়োজন হলে রক্ত দিতে হবে।
ভারতীয় জনগণ কিছু কিছু প্রতারণার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্মের কথাই ধরুন। হিন্দুদের কাছে ধর্ম জাতিভেদ প্রথা ও গরুকে বাঁচাও ছাড়া আর বিশেষ কিছু নয়। মুসলমানদের কাছে ধর্ম সুন্নত করা আর গরুর গোশত। শিখদের কাছে লম্বা চুল আর মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা। খ্ৰীষ্টানরা মনে করে, হিন্দুত্ব আর সোলার টুপি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পারসিকদের কাছে ধর্ম হলো অগ্নিপূজা করা আর শকুনিকে আহার করানো। ধৰ্মীয় নীতির মূল কথা যে নৈতিকতা, সে কথা সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়। দর্শনের কথাই ধরুন। এ নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়। অতীন্দ্ৰিয়বাদের মতো এ বিষয়ে ছদ্মাবরণে অনেক বোকামি লক্ষ্য করা যায়। আর যোগ! যোগ বিশেষ করে হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার আয়ের উত্তম উপায়। মাথার ওপর ভর করে দু’পা উচু করে থাক। আড়াআড়ি করে দু’পা ভেঙ্গে বস এবং নাভির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখ। নিজের মনকে পূর্ণ আয়ত্তে আন। মহিলারা এতে যথেষ্ট হয়েছে না বলা পর্যন্ত ঐভাবে থাক এবং তুমি চোখ বন্ধ করেই বলতে পার পরবর্তী আসন। পুনর্জন্ম মতবাদ নিয়ে নানা কথা। মানুষ, ষাঁড়, বানর, গোবরে পোকা থেকে শুরু করে আট লাখ থেকে চার লাখ প্রকারের জীবিত প্রাণী। প্রমাণ? প্রমাণের জন্য এত সময় আমাদের নেই। প্রয়োজন বিশ্বাসের। যুক্তির প্রয়োজন নেই, বিশ্বাস থাকলেই হলো। দার্শনিক নীতির সাথে চিন্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অথচ কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে আমরা ওপরে উঠি, অনেক ওপরে। সৃষ্টিশীল বাস্তব জীবনে আমরা দড়ির খেলার চালাকি প্রদর্শন করি। আমরা শূন্যে দড়ি নিক্ষেপ করে ছোট ছেলেকে সেই দড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাতে পারি এবং ছেলেটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে পারে ঐ দড়ি বেয়ে, একথা বিশ্ব যতদিন বিশ্বাস করবে ততদিন আমাদের ছলনা বাড়তেই থাকবে।
শিল্প ও সঙ্গীতের কথাই ধরুন। সমসাময়িক ভারতীয় চিত্রকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্যবিদ্যা এমন ব্যৰ্থ হলো কেন? কারণ এসব বিদ্যা খ্ৰীষ্টজন্মের পূর্বের বিষয় নিয়েই আবর্তিত। অতীত নিয়ে আলোচনা দোষের কিছু নয়, যদি তা একটা প্যাটার্নে পরিবর্তিত হয়। যদি পরিণামে তাই হয়, তাহলে আমাদের অবস্থা হবে এমনই যে, আমাদের সম্মুখের রাস্তা বন্ধ। আকর্ষণহীন কিছুকে আমরা বর্ণনা করি, এর মধ্যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। আর না হয় আমরা সব কিছু ভেঙ্গে ফেলি, যেমন, আধুনিক সিনেমার গান। হাইওয়ান গিটার, ভায়োলিন, এ্যাকোরডিয়ান ও ক্লারিনেটস-এ আমরা ট্যাংগো ও রাম্বা বা সাম্বা বাজাই। অন্য অনেক কিছুর মতো এর প্রতিবিধান করতে হবে।
তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন। গ্লাসে তিনি আর এক পেগ হুইস্কি ঢাললেন।
ভাল কিছু কাজ করতে উৎসাহিত হওয়ার একটা প্রয়োজনীয় শর্ত হলো খারাপ কিছু সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করা। যে ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে গেছে সেই ঘরের ওপর দোতলা করার চেষ্টা কোন কাজেই আসবে না। এর চেয়ে ঐ ঘরটা ভেঙ্গে ফেলাই উত্তম। কেউ যদি সমাজ বা সামাজিক নীতি না মানে তাহলে সামাজিক নীতির প্রতি নতজানু হওয়া ভীরুতা ও বোকার মত সাহসী হওয়ার সমান। ওদের সাহসের অর্থ তোমার ভীরুতা, ওদের ভীরুতার অর্থ তোমার সাহসিকতা। সব কিছুই পরিভাষার ব্যাপার। কেউ বলতে পারে, ভীরু হওয়ার জন্যও সাহসের প্রয়োজন। এটা একটা বাধা, তবে উল্লেখ করার মতো। এর ব্যাখ্যা করার দরকার।
আর এক পেগ হুইস্কি। হুইস্কি পানির মতো। এর কোন স্বাদ নেই। ফ্লাস্কটা ঝাঁকিয়ে দেখলেন ইকবাল। ফ্লাস্কের তলায় ছলাৎ করে একটা শব্দ শোনা গেল। ফ্লাস্ক এখনও খালি হয়নি। ভগবানকে ধন্যবাদ, ফ্লাস্ক এখনও খালি হয়নি।
ইকবাল মনে মনে ভাবলেন, বিভিন্ন বস্তুর দিকে তাকালে এমন কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না যে, মানুষ বা ভগবানের এমন কোন নিয়ম আছে যার ওপর ভিত্তি করে কেউ তার আচরণ সেই ধাঁচে গড়ে তুলতে পারে। অসত্যের ওপর সত্য যেমন জয়ী হচ্ছে তেমনি সত্যের ওপরও অসত্য জয়ী হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্ৰে সত্যের ওপর অসত্যের জয় বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। পরিণামে কি হচ্ছে, তা তুমি জানতে পার না। এমন পরিস্থিতিতে সব ধরনের মূল্যবোধের প্রতি উদাসীন থাকা ছাড়া আর তুমি কি করতে পার ঐ কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না … কোন কিছুই না। ইকবাল ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর হাতে রইল প্লাষ্টিকের কাপ। তার পাশে টুলের ওপর রাখা হারিকেন জ্বলতে থাকল।
গুরুদুয়ারার আঙ্গিনায় চুলার আগুন নিভে ছাই হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাতাস লেগে ছাই সরে যাওয়ায় আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে। বাতি জ্বলছে মিট মিট করে। হল ঘরের মেঝের ওপর পুরুষ, মহিলা ও শিশু বিক্ষিপ্তভাবে শুয়ে। মিত সিং জেগেছিলেন। তিনি মেঝে ঝাড় দিচ্ছিলেন। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জিনিসগুলোও গুছিয়ে রাখছিলেন।
কেউ যেন দরজায় করাঘাত করল। মিত সিং, ঝাড় দেয়া বন্ধ করে আঙ্গিনা অতিক্রম করে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন।
কে?
তিনি দরজা খুলে দিলেন। জুগ্গা ভিতরে ঢুকল। অন্ধকারের মধ্যে তাকে আগের চেয়ে মোটা দেখাচ্ছিল। পুরো দরজার ফাঁক যেন তার দেহ দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেল।
কি ব্যাপার জুল্লাত্ সিংজী, এ সময়ে তুমি এখানে, কি ব্যাপার? মিত সিং জিজ্ঞাসা করলেন।
ভাই, সে আস্তে আস্তে বলল, আমার গুরুর আশীৰ্বাদ দরকার। বাণীর একটা অংশ আমাকে শোনাবেন?
রাতের জন্য পবিত্র গ্রন্থ আমি তুলে রেখেছি, মিত সিং বললেন। তুমি কি কাজ করতে চাও যে গুরুর আশীৰ্বাদ দরকার ?
কাজ নিয়ে আলোচনার দরকার নেই, জুগ্ন অধৈর্যের সাথে বলল। মিত সিংএর কাঁধের ওপর সে তার মাংসল হাত রাখল। কয়েকটা লাইন আমাকে তাড়াতাড়ি পড়ে শোনান।
মিত সিং এগিয়ে গেলেন বিড়বিড় করতে করতে। তুমি কোনদিন কোন সময় গুরুদুয়ারায় আস না। এখন যখন পবিত্র গ্রন্থ তুলে রাখা হয়েছে এবং মানুষজন সব ঘুমাচ্ছে, তখন তুমি আমাকে বলছি গুরুর বাণী শোনাতে। এটা ঠিক নয়। সকালের প্রার্থনা থেকে আমি কিছুটা তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি।
আপনি কি পড়বেন তা নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। কিছু এটা পড়ুন।
মিত সিং একটা হারিকেনের সলতে কিছুটা বাড়িয়ে দিলেন। এর ঘোলা চিমনিটা কিছুটা উজ্জ্বল হলো। যে চৌকির ওপর পবিত্র গ্রন্থ রক্ষিত আছে তার পাশে মেঝের ওপর তিনি বসলেন। চৌকির নিচ থেকে জুগ্গা একটা বাতাস করার ফুলঝড় নিয়ে মিত সিং-এর মাথার ওপর দোলাতে লাগল। মিত সিং প্রার্থনার একখানা ছোট গ্রন্থ হাতে নিয়ে কপালে ঠোকালেন এবং গ্রন্থখানি খুলে একটা অংশ পড়লেন:
দিন ও রাত যিনি সৃষ্টি করেছেন
যিনি সৃষ্টি করেছেন সপ্তাহের দিনগুলো ও ঋতুসমূহ।
যিনি প্রবাহিত করেন মৃদুমন্দ বায়ু ও পানি,
যিনি সৃষ্টি করেছেন আগুন ও নিম্নভূমি।
পৃথিবীকে যিনি সৃষ্টি করেছেন আইনের মন্দির।
যিনি সৃষ্টি করেছেন বিভিন্ন ধরনের প্রাণী।
বিভিন্ন নামে,
এটাই আইন–
চিন্তা ও কাজকে নিশ্চয়ই বিচার করতে হবে;
খোদা সত্য এবং তিনি সত্য বিধান দেন।
তাঁর দরবার অলস্কৃত হয় পছন্দের লোক দিয়ে
এবং স্বয়ং ভগবান তাদের কাজকে গ্রহণ করেন,
সম্পাদিত বাছাইকৃত কাজ এবং যে কাজের পরিণতি ভাল,
যে কাজ তাদের দ্বারা কোনদিন সম্পাদিত হতো না।
এসব, ওহে নানক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে ঘটবে।
মিত সিং প্রার্থনা গ্রন্থ বন্ধ করে কপালে ঠেকালেন। তিনি সকালের প্রার্থনার শেষের কিছু অংশ বিড়বিড় করে পড়তে লাগলেন:
বায়ু, পানি ও মাটি
সব দিয়ে তোমাদের আমি সৃষ্টি করেছি
গুরুর বাণীর মতো বায়ু জীবনকে সচল করে
ধরিত্রী মাতার সব কিছুকে পানি জীবন দান করে।
শেষের দিকে তাঁর কণ্ঠস্বর এমনই ভারি হয়ে গেল যে, তাঁর কথা মোটেই বোঝা গেল না!
জুগ্গাত্ সিং ফুলঝাড়ুটা চৌকির নিচে রেখে দিয়ে পবিত্র গ্রন্থের সামনে নতজানু হয়ে মেঝেতে কপাল ঠেকাল।
গুরুর ঐ বাণী কি ভাল? সে সরল মনে জিজ্ঞাসা করল।
গুরুর সব বাণীই ভাল, মিত সিং অতি ভক্তির সাথে বললেন।
যা পড়লেন তার মানে কি?
মানে দিয়ে তুমি কি করবে? এসব গুরুর কথা। তুমি কোন উত্তম কাজ করতে গেলে গুরু তোমাকে সাহায্য করবেন; কোন খারাপ কাজ করতে গেলে গুরু তোমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন। তুমি যদি খারাপ কাজ করতে জিদ কর, তাহলে অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত গুরু তোমাকে শাস্তি দেবেন এবং শেষে মাফ করে দেবেন।
ঠিক। আমি গুরুর বাণীর মানে জেনে কি করব? আচ্ছা ভাইজি, শুভ বিদায়।
শুভ বিদায়।
জুগ্গা নতজানু হয়ে আবার মেঝের ওপর কপাল ঠেকাল। তারপর সোজা হয়ে সে ঘুমন্ত লোকগুলোর মধ্য দিয়ে বাইরে এসে জুতা জোড়া হাতে নিল। একটা কামরায় আলো দেখা গেল। জুয়া ঘরের মধ্যে কে তাকিয়ে দেখল। বালিশের ওপর পড়ে থাকা উস্কখুস্ক চুল ও মাথা সে চিনতে পারল। ইকবাল ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁর বুকের ওপর পড়ে রয়েছে। শূন্য ফ্রাঙ্কটি।
শুভ রাত বাবুজী, সে মৃদু স্বরে বলল। কোন উত্তর এলো না। আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন??
উনাকে বিরক্ত কর না, মিত সিং আস্তে আস্তে বললেন। ওর শরীরটা ভাল নেই। তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন।
আচ্ছা ভাইজি, আমার পক্ষ থেকে বাবুকে আপনি শুভ বিদায় বলবেন। জুগ্গাত্ সিং গুরুদুয়ারা থেকে বেরিয়ে গেল।