৪.৮ পরিশিষ্ট: ঠাকুরের মানুষভাব

চতুর্থ খণ্ড – পরিশিষ্ট: ঠাকুরের মানুষভাব

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দ্বিসপ্ততিতম জন্মোৎসব উপলক্ষে সন ১৩১৪ সালের ৬ই চৈত্র বেলুড় মঠে আহূত সভায় পঠিত প্রবন্ধ

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের যোগবিভূতিসকলের কথা শুনিয়াই সাধারণ মানবের তাঁহার প্রতি ভক্তি

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের দেবভাব সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলিয়া থাকেন; এমনকি, অনেকের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং নির্ভরের কারণ অনুসন্ধান করিলে তাঁহার অমানুষ যোগবিভূতিসকলই উহার মূলে দেখিতে পাওয়া যায়। কেন তুমি তাঁহাকে মান? – এ প্রশ্নের উত্তরে বক্তা প্রায়ই বলিয়া থাকেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণদেব বহুদূরের ঘটনাবলী ভাগীরথীতীরে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে বসিয়া দেখিতে পাইতেন, স্পর্শ করিয়া কঠিন কঠিন শারীরিক ব্যাধিসমূহ কখনও কখনও আরাম করিয়াছেন, দেবতাদের সহিতও তাঁহার সর্বদা বাক্যালাপ হইত এবং তাঁহার বাক্য এতদূর অমোঘ ছিল যে, মুখপদ্ম হইতে কোন অসম্ভব কথা বাহির হইলেও বহিঃপ্রকৃতির ঘটনাবলীও ঠিক সেইভাবে পরিবর্তিত এবং নিয়মিত হইত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, রাজদ্বারে প্রাণদণ্ডের আজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিও তাঁহার কৃপাকণা ও আশীর্বাদ-লাভে আসন্ন মৃত্যু হইতে রক্ষিত এবং বিশেষ সম্মানিত পর্যন্ত হইয়াছিল; অথবা কেবলমাত্র-রক্তকুসুমোৎপাদী বৃক্ষে শ্বেত কুসুমেরও আবির্ভাব হইয়াছিল, ইত্যাদি।

অথবা বলেন যে, তিনি মনের কথা বুঝিতে পারিতেন, তাঁহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রত্যেক মানবশরীরের স্থূল আবরণ ভেদ করিয়া তাহার মনের চিন্তা, গঠন এবং প্রবৃত্তিসমূহ পর্যন্তও দেখিতে পাইত, তাঁহার কোমল করস্পর্শমাত্রেই চঞ্চলচিত্ত ভক্তের চক্ষে ইষ্টমূর্ত্যাদির আবির্ভাব হইত অথবা গভীর ধ্যান এবং অধিকারিবিশেষে নির্বিকল্প সমাধির দ্বার পর্যন্ত উন্মুক্ত হইত।

কেহ কেহ আবার বলেন যে, কেন তাঁহাকে মানি, তাহা আমি জানি না, কি এক অদ্ভুত জ্ঞান এবং প্রেমের সম্পূর্ণ আদর্শ যে তাঁহাতে দেখিয়াছি, তাহা জীবিত বা পরিচিত মনুষ্যকুলের তো কথাই নাই, বেদপুরাণাদিগ্রন্থনিবদ্ধ, জগৎপূজ্য আদর্শসমূহেও দেখিতে পাই না! – উহারাও তাঁহার পার্শ্বে আমার চক্ষে হীনজ্যোতিঃ হইয়া যায়। এটা আমার মনের ভ্রম কি না তাহা বলিতে অক্ষম, কিন্তু আমার চক্ষু সেই উজ্জ্বল প্রভায় ঝলসিয়া গিয়াছে এবং মন তাঁহার প্রেমে চিরকালের মতো মগ্ন হইয়াছে, ফিরাইবার চেষ্টা করিলেও ফিরে না, বুঝাইলেও বুঝে না; জ্ঞান তর্ক যুক্তি যেন কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে। এইটুকুমাত্র আমি বলিতে সক্ষম –

“দাস তব জনমে জনমে দয়ানিধে;
তব গতি নাহি জানি।
মম গতি – তাহাও না জানি।
কেবা চায় জানিবারে?
ভুক্তি মুক্তি ভক্তি আদি যত
জপ তপ সাধন ভজন,
আজ্ঞা তব দিয়াছি তাড়ায়ে,
আছে মাত্র জানাজানি-আশ,
তাও প্রভু কর পার।”
– স্বামী বিবেকানন্দ

অতএব দেখা যাইতেছে যে, শেষোক্ত অল্পসংখ্যক ব্যক্তির কথা ছাড়িয়া দিলে অপর মানব-সাধারণ স্থূল বাহ্যিক বিভূতি অথবা সূক্ষ্ম মানসিক বিভূতির জন্যই তাঁহাতে ভক্তি-বিশ্বাস ও নির্ভর করিয়া থাকে। স্থূলদৃষ্টি মানব মনে করে যে, তাঁহাকে মানিলে তাহারও রোগাদি আরোগ্য হইবে, অথবা তাহারও সঙ্কট-বিপদাদির সময়ে বাহ্যিক ঘটনাসমূহ তাহার অনুকূলে নিয়মিত হইবে। স্পষ্ট স্বীকার না করিলেও তাহার মনের ভিতর যে এই স্বার্থপরতার স্রোত প্রবাহিত রহিয়াছে, তাহা দেখিতে বিলম্ব হয় না।

দ্বিতীয়শ্রেণীমধ্যগত কিঞ্চিৎ সূক্ষ্মদৃষ্টি মানবও তাঁহার কৃপায় দূরদর্শনাদি বিভূতি লাভ করিবে, তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গমধ্যে পরিগণিত হইয়া গোলোকাদি স্থানে বাস করিবে অথবা আরও কিঞ্চিৎ সমুন্নতদৃষ্টি হইলে সমাধিস্থ হইয়া জন্ম-জরাদি বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিবে, এইজন্যই তাঁহাকে মানিয়া থাকে। স্বকীয় প্রয়োজনসিদ্ধি যে এই বিশ্বাসেরও মূলে বর্তমান, ইহা বুঝিতে বিলম্ব হয় না।

সত্য হইলেও ঐ সকলের আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, কারণ সকাম ভক্তি উন্নতির হানিকর

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ঐরূপ দৈববিভূতিনিচয়ের ভূরি নিদর্শন প্রাপ্ত হইলেও অথবা নিজ নিজ অভীষ্টসিদ্ধি-প্রয়োজনরূপ সকাম ভক্তিও যে তাঁহাতে অর্পিত হইয়া অশেষ মঙ্গলের কারণ হয়, এ বিষয়ে সন্দিহান না হইলেও তত্তদ্বিষয়-আলোচনা অদ্যকার প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়; তাঁহার মনুষ্যভাবের চিত্র কথঞ্চিৎ অঙ্কিত করিতে চেষ্টা করাই অদ্য আমাদের উদ্দেশ্য।

সকাম ভক্তি – নিজের কোনরূপ অভাবপূরণের জন্য ভক্তি, ভক্তকে সত্যদৃষ্টির উচ্চ সোপানে উঠিতে দেয় না। স্বার্থপরতা সর্বকালে ভয়ই প্রসব করিয়া থাকে এবং ঐ ভয়ই আবার মানবকে দুর্বল হইতে দুর্বলতর করিয়া ফেলে। স্বার্থলাভও আবার মানবমনে অহঙ্কার এবং কখনও কখনও আলস্যবৃদ্ধি করিয়া তাহার চক্ষু আবৃত করে এবং তজ্জন্য সে যথার্থ সত্যদর্শনে সমর্থ হয় না। এইজন্যই শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহার ভক্তমণ্ডলীর ভিতর যাহাতে ঐ দোষ প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। ধ্যানাদির অভ্যাসে দূরদর্শনাদি কোনরূপ মানসিক শক্তির নূতন বিকাশ হইয়াছে জানিলেই পাছে ঐ ভক্তের মনে অহঙ্কার প্রবেশলাভ করিয়া তাহাকে ভগবান-লাভরূপ উদ্দেশ্যহারা করে, সেজন্য তিনি তাহাকে কিছুকাল ধ্যানাদি করিতে নিষেধ করিতেন, ইহা বহুবার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। ঐ প্রকার বিভূতিসম্পন্ন হওয়াই যে মানবজীবনের উদ্দেশ্য নয়, ইহা তাঁহাকে বার বার বলিতে শুনিয়াছি। কিন্তু দুর্বল মানব নিজের লাভ-লোকসান না খতাইয়া কিছু করিতে বা কাহাকেও মানিতে অগ্রসর হয় না এবং ত্যাগের জ্বলন্ত মূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবন হইতে ত্যাগ শিক্ষা না করিয়া নিজের ভোগসিদ্ধির জন্যই ঐ মহৎ জীবন আশ্রয় করিয়া থাকে। তাঁহার ত্যাগ, তাঁহার অলৌকিক তপস্যা, তাঁহার অদৃষ্টপূর্ব সত্যানুরাগ, তাঁহার বালকের ন্যায় সরলতা এবং নির্ভর – এইসকল যেন তাঁহার ভোগসিদ্ধির নিমিত্ত অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, এইরূপ মনে করে। আমাদের মনুষ্যত্বের অভাবই ঐ প্রকার হইবার কারণ এবং সেইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মনুষ্যভাবের আলোচনাই আমাদের অশেষ কল্যাণকর।

যথার্থ ভক্তি ভক্তকে উপাস্যের অনুরূপ করিবে

ভক্তি যৎকিঞ্চিৎ ও যথার্থ অনুষ্ঠিত হইলে ভক্তকে উপাস্যের অনুরূপ করিয়া তুলে! সর্বজাতির সর্বধর্মগ্রন্থেই এ কথা প্রসিদ্ধ। ক্রুশারূঢ় ঈশার মূর্তিতে সমাধিস্থ-মন ভক্তের হস্তপদ হইতে রুধির-নির্গমন, শ্রীমতীর বিরহদুঃখানুভব-নিমগ্নমন শ্রীচৈতন্যের বিষম গাত্রদাহ এবং কখনও বা মৃতবৎ অবস্থাদি, ধ্যানস্তিমিত বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে বৌদ্ধ ভক্তের বহুকালব্যাপী নিশ্চেষ্টাবস্থান প্রভৃতি ঘটনাই ইহার নিদর্শন। প্রত্যক্ষও দেখিয়াছি, মনুষ্যবিশেষে প্রযুক্ত ভালবাসা ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে মানুষকে তাহার প্রেমাস্পদের অনুরূপ করিয়া তুলিয়াছে; তাহার বাহ্যিক হাবভাব-চালচলনাদি এবং তাহার মানসিক চিন্তাপ্রণালীও সমূলে পরিবর্তিত হইয়া তৎসারূপ্য প্রাপ্ত হইয়াছে! শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তিও তদ্রূপ যদি আমাদের জীবনকে দিন দিন তাঁহার জীবনের কথঞ্চিৎও অনুরূপ না করিয়া তুলে, তবে বুঝিতে হইবে যে, ঐ ভক্তি এবং ভালবাসা তত্তন্নামের যোগ্য নহে।

প্রশ্ন হইতে পারে, তবে কি আমরা সকলেই রামকৃষ্ণ পরমহংস হইতে সক্ষম? একের সম্পূর্ণরূপে অপরের ন্যায় হওয়া জগতে কখনও কি দেখা গিয়াছে? উত্তরে আমরা বলি, সম্পূর্ণ একরূপ না হইলেও এক ছাঁচে গঠিত পদার্থনিচয়ের ন্যায় নিশ্চিত হইতে পারে। ধর্মজগতে প্রত্যেক মহাপুরুষের জীবনই এক একটি ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচসদৃশ। তাঁহাদের শিষ্যপরম্পরাও সেই সেই ছাঁচে গঠিত হইয়া অদ্যাবধি সেইসকল বিভিন্ন ছাঁচের রক্ষা করিয়া আসিতেছে। মানুষ অল্পশক্তি; ঐসকল ছাঁচের কোন একটির মতো হইতে তাহার আজীবন চেষ্টাতেও কুলায় না। ভাগ্যক্রমে কেহ কখনও কোন একটি ছাঁচের যথার্থ অনুরূপ হইলে আমরা তাঁহাকে সিদ্ধ বলিয়া সম্মান করিয়া থাকি। সিদ্ধ মানবের চালচলন, ভাষা, চিন্তা প্রভৃতি শারীরিক এবং মানসিক সকল বৃত্তিই সেই ছাঁচপ্রবর্তক মহাপুরুষের সদৃশ হইয়া থাকে। সেই মহাপুরুষের জীবনে যে মহাশক্তির প্রথম অভ্যুদয় দেখিয়া জগৎ চমৎকৃত হইয়াছিল, তাঁহার দেহমন সেই শক্তির কথঞ্চিৎ ধারণ, সংরক্ষণ এবং সঞ্চারের পূর্ণাবয়ব যন্ত্রস্বরূপ হইয়া থাকে। এইরূপে ভিন্ন ভিন্ন মহাপুরুষ-প্রণোদিত ধর্মশক্তিনিচয়ের সংরক্ষণ, ভিন্ন ভিন্ন জাতি আবহমানকাল ধরিয়া করিয়া আসিতেছে।

অবতারপুরুষের জীবনালোচনায় কোন্ কোন্ অপূর্ব বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়

ধর্মজগতে যে-সকল মহাপুরুষ অদৃষ্টপূর্ব নূতন ছাঁচের জীবন দেখাইয়া যান, তাঁহাদিগকেই জগৎ অদ্যাবধি ঈশ্বরাবতার বলিয়া পূজা করিয়া থাকে। অবতার ধর্মজগতে নূতন মত, নূতন পথ আবিষ্কার করেন; স্পর্শমাত্রেই অপরে ধর্মশক্তি সঞ্চারিত করেন। তাঁহার দৃষ্টি কখনও অনিত্য সংসারে কামকাঞ্চনের কোলাহলের দিকে আকৃষ্ট হয় না। তাঁহার জীবন-পর্যালোচনায় বুঝিতে পারা যায় যে, তিনি অপরকে পথ দেখাইবার জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। নিজের ভোগসাধন বা মুক্তিলাভও তাঁহার জীবনের উদ্দেশ্য হয় না। কিন্তু অপরের দুঃখে সহানুভূতি, অপরের উপর গভীর প্রেমই তাঁহাকে কার্যে প্রেরণ করিয়া অপরের দুঃখনিবারণের পথ-আবিষ্করণের হেতু হইয়া থাকে।

শ্রীরামকৃষ্ণের দেবকান্তি যতদিন না দেখিয়াছিলাম, ততদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, ঈশা, শঙ্কর, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি অবতারখ্যাত মহাপুরুষগণের জীবনবেদ পাঠ করিতে একপ্রকার অসমর্থ ছিলাম। তাঁহাদের জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলী দলপুষ্টির জন্য শিষ্যপরম্পরারচিত প্ররোচনাবাক্য বলিয়া মনে হইত; অবতার সভ্যজগতের বিশ্বাসবহিৰ্ভূত কিম্ভূত-কিমাকার কাল্পনিক প্রাণিবিশেষ বলিয়াই অনুমিত হইত। অথবা ঈশ্বরের অবতার হওয়া সম্ভব বলিয়া বোধ হইলেও সেইসকল অবতারমূর্তিতে যে আমাদেরই ন্যায় মনুষ্যভাবসকল বর্তমান, এ কথা বিশ্বাস হইত না। তাঁহাদের শরীরে যে আমাদের মতো রোগাদি হইতে পারে, তাঁহাদের মনে যে আমাদেরই মতো হর্ষশোকাদি বিদ্যমান, তাঁহাদিগের ভিতরে যে আমাদেরই ন্যায় প্রবৃত্তিনিচয়ের দেবাসুর-সংগ্রাম চলিতে পারে, তাহা ধারণা হইত না। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পবিত্র স্পর্শেই সে বিষয়ের উপলব্ধি হইয়াছে। অবতারশরীরে দেব এবং মানুষভাবের অদ্ভুত সম্মিলনের কথা আমরা সকলেই পড়িয়াছি বা শুনিয়াছি, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিবার পূর্বে কোন মানবে যে বালকত্ব এবং কঠোর মনুষ্যত্বের একত্র সামঞ্জস্যে অবস্থান হইতে পারে, এ কথা ভাবি নাই। অনেকেই বলিয়া থাকেন, তাঁহার পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর ন্যায় বালকস্বভাবই তাঁহাদিগকে আকর্ষণ করিয়াছিল। অজ্ঞান বালক সকলেরই প্রেমের আস্পদ এবং সকলেই তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য স্বভাবতঃ ত্রস্ত হইয়া থাকে। পূর্ণবয়স্ক হইলেও শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দেখিয়া লোকের মনে ঐরূপ ভাবের স্ফূর্তি হইয়া তাঁহাদিগকে মোহিত ও আকৃষ্ট করিত। কথাটি কিছু সত্য হইলেও আমাদের ধারণা – পরমহংসদেবের শুদ্ধ বালকভাবেই যে জনসাধারণ আকৃষ্ট হইত তাহা নহে; কিন্তু হর্ষ ও প্রীতির সহিত দর্শকের মনে তৎসময়ে যুগপৎ শ্রদ্ধা ও ভক্তির উদয় দেখিয়া মনে হয়, কুসুমকোমল বালক-পরিচ্ছদে আবৃত ভিতরের বজ্রকঠোর মনুষ্যত্বই ঐ আকর্ষণের কারণ। ভারতের যশস্বী কবি অযোধ্যাধিপতি শ্রীরামচন্দ্রের লোকোত্তর চরিত্র-বর্ণনায় লিখিয়াছেন –

“বজ্রাদপি কঠোরাণি মৃদূনি কুসুমাদপি।
লোকোত্তরাণাং চেতাংসি কো নু বিজ্ঞাতুমর্হতি॥”1

সেই কথা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সম্বন্ধেও প্রতি পদে বলিতে পারা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বালকভাব এক অতি অভিনব পদার্থ। অসীম সরলতা, অপার বিশ্বাস, অশেষ সত্যানুরাগ সে বালকের মনে সর্বদা প্রকাশিত থাকিলেও বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন মানব তাহাতে কেবল নির্বুদ্ধিতা এবং বিষয়বুদ্ধিরাহিত্যেরই পরিচয় পাইত। সকল লোকের কথাতেই তাঁহার প্রগাঢ় বিশ্বাস, বিশেষতঃ ধর্মলিঙ্গধারীদের কথায়! দেশের এবং নিজ গ্রামের প্রচলিত ভাবসকলও তাঁহাতে এই অদ্ভুত বালকত্ব পরিস্ফুট করিতে বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল।


1. কবি শ্রীভবভূতি-প্রণীত “উত্তররামচরিত” গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত। – ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, সঙ্কলক।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মভূমি কামারপুকুর গ্রাম

শস্যশ্যামলাঙ্গে হরিৎসমুদ্রপ্রতীকাশ অথবা তদভাবে ধূসর মৃত্তিকাসমুদ্রের ন্যায় অবস্থিত বিস্তীর্ণ বহুযোজনব্যাপী প্রান্তর – তন্মধ্যে বংশ, বট, খর্জুর, আম্র, অশ্বত্থাদি বৃক্ষাচ্ছাদিত কৃষককুলের মৃত্তিকানির্মিত সুপরিচ্ছন্ন দ্বীপপুঞ্জের ন্যায় শোভমান পর্ণকুটিররাজি, সুনীল পত্রাচ্ছাদিত বৃহৎতালবৃক্ষরাজিমণ্ডলিত ভ্রমরমুখরিত পদ্মসমাচ্ছন্ন হালদারপুকুরাদিনামাখ্যাত বৃহৎ সরোবরনিচয়, ‘বুড়োশিবাদি’ নামা প্রথিতযশ দেবাধিষ্ঠিত ইষ্টক বা প্রস্তরনির্মিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবগৃহ, অদূরে পুরাতন গড়মান্দারণ দুর্গের ভগ্নস্তূপরাজি; প্রান্তে ও পার্শ্বে অস্থিসমাকুল বহুপ্রাচীন শ্মশান, তৃণাচ্ছাদিত গোচরভূমি, নিবিড় আম্রকানন, বক্রসঞ্চরণশীল ভূতির খাল খ্যাত ক্ষুদ্র পয়ঃপ্রণালী এবং সমগ্র গ্রামের অর্ধেকেরও অধিক বেষ্টন করিয়া বর্তমান বর্ধমান হইতে পুরীধামে যাইবার যাত্রিসমাকুল সুদীর্ঘ রাজপথ – ইহাই শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি কামারপুকুর।

বালক রামকৃষ্ণের বিচিত্র কার্যকলাপ

শ্রীচৈতন্য এবং তৎশিষ্যগণ-প্রচলিত বৈষ্ণবধর্মই এখানে প্রবল। কৃষক-প্রজাকুল তাহাদের পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে অথবা দিনান্তে কার্যাবসানে তাঁহাদেরই রচিত পদাবলীগানে আনন্দে বিভোর হইয়া শ্রমাপনোদন করে। সরল পদ্যময় বিশ্বাসই এ ধর্মের মূলে, এবং জীবন-সংগ্রামের কঠোর তরঙ্গসমূহ হইতে সুদূরে বর্তমান এই গ্রামের ন্যায় বালকের হৃদয়ও ঐরূপ বিশ্বাস এবং ধর্মের বিশেষ অনুকূলভূমি। বালক রামকৃষ্ণের বালকত্ব কিন্তু এখানেও অদ্ভুত বলিয়া পরিগণিত হইয়াছিল। তাহার বিচিত্র কার্যসকলে না হইলেও, উদ্দেশ্যের গভীরতা এবং একতানতা দেখিয়া সকলে অবাক হইত। ‘রামনামে মানব নির্মল হয়’ – কথকমুখে এ কথা শুনিয়া কখনও বা এ বালক দুঃখিতচিত্তে জল্পনা করিত – তবে কথকঠাকুরের অদ্যাবধি শৌচের আবশ্যক হয় কেন? কখনও বা একবারমাত্র যাত্রাদি শুনিয়া তাহার সকল অঙ্গ আয়ত্ত করিয়া বয়স্যগণসঙ্গে আম্রকাননমধ্যে উহার পুনরভিনয় করিত! গ্রামান্তর-গন্তুকাম পথিক বালকের সে অদ্ভুত অভিনয় ও সঙ্গীত-শ্রবণে মুগ্ধ হইয়া গন্তব্য পথে যাইতে ভুলিয়া যাইত! প্রতিমাগঠন, দেবচিত্রাদিলিখন, অপরের হাবভাব অনুকরণ, সঙ্গীত, সঙ্কীর্তন, রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবতাদি শাস্ত্র শ্রবণ করিয়া আয়ত্তীকরণ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গভীর অনুভবে এ বালকের বিশেষ নৈপুণ্য প্রকাশ পাইত। তাঁহার শ্রীমুখাৎ শ্রবণ করিয়াছি যে, কৃষ্ণনীরদাবৃত গগনে উড্ডীন ধবল বলাকারাজি দেখিয়াই তিনি প্রথম সমাধিস্থ হন; তাঁহার বয়স তখন ছয়-সাত বৎসর মাত্র!

যখন যে ভাব হৃদয়ে আসিত, সেই ভাবে তন্ময় হওয়াই এ বালক-মনের বিশেষ লক্ষণ ছিল। প্রতিবেশীরা এখনও এক বণিকের গৃহপ্রাঙ্গণ নির্দেশ করিয়া গল্প করে, কিরূপে একদিন ঐ স্থানে হরপার্বতী-সংবাদের অভিনয়কালে অভিনেতা সহসা পীড়িত হইয়া অপারগ হইলে রামকৃষ্ণকে সকলে অনুরোধ করিয়া শিব সাজাইয়া অভিনয় করাইবার চেষ্টা করে; কিন্তু তিনি ঐ সাজে সজ্জিত হইয়া এমনই ঐ ভাবে মগ্ন হইয়াছিলেন যে, বহুক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার বাহ্য সংজ্ঞামাত্র ছিল না! এইসকল ঘটনায় স্পষ্টই দেখা যায় যে, বালক হইলেও বালকের চিত্তচাঞ্চল্য তাহাতে আশ্রয় করে নাই। দর্শন বা শ্রবণ দ্বারা কোন বিষয়ে আকৃষ্ট হইলেই তাহার ছবি তাঁহার মনে এরূপ সুদৃঢ়-অঙ্কিত হইত যে, ঐ প্রেরণায় উহার সম্পূর্ণ আয়ত্তীকরণ এবং অভিনবরূপে পুনঃপ্রকাশ না করিয়া স্থির থাকা এ বালকের পক্ষে অসম্ভব ছিল।

তাঁহার সত্যান্বেষণ

গ্রন্থাদি না পড়িলেও বাহ্যজগতের সংঘর্ষে এ বালকের ইন্দ্রিয়নিচয় স্বল্পকালেই সমুচিত প্রস্ফুটিত হইয়াছিল। যাহা সত্য, প্রমাণপ্রয়োগ দ্বারা তাহা বুঝিয়া লইব – যাহা শিখিব, তাহা কার্যে প্রয়োগ করিব – এবং অসত্য না হইলে জগতের কোন বস্তুই ঘৃণার চক্ষে দেখিব না, ইহাই এ বালক-মনের মূল মন্ত্র ছিল। যৌবনের প্রথম উদ্গম – অদ্ভুত-মেধাসম্পন্ন বালক রামকৃষ্ণ শিক্ষার জন্য টোলে প্রেরিত হইলেন, কিন্তু বালকত্বের সাঙ্গ হইল না। সে ভাবিল, এ কঠোর অধ্যয়ন, রাত্রিজাগরণ, টীকাকারের চর্বিতচর্বণ প্রভৃতি কিসের জন্য? ইহাতে কি বস্তুলাভ হইবে? মন ঐপ্রকার অধ্যবসায়ের পূর্ণ ফল টোলের আচার্যকে দেখাইয়া বলিল, তুমিও ঐরূপ সরল শব্দনিচয়ের কুটিল অর্থকরণে সুপটু হইবে, তুমিও উহার ন্যায় ধনী ব্যক্তির তোষামোদাদিতে বিদায়াদি সংগ্রহ করিয়া কোনরূপে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিবে; তুমিও ঐরূপ শাস্ত্রনিবদ্ধ সত্যসকল পাঠ করিবে এবং করাইবে, কিন্তু চন্দনভারবাহী খরের ন্যায় তাহাদিগের অনুভব জীবনে করিতে পারিবে না। বিচারবুদ্ধি বলিল, এই চালকলা-বাঁধা বিদ্যার প্রয়োজন নাই। যাহাতে মানবজীবনের গূঢ়রহস্যসম্বন্ধীয় সম্পূর্ণ সত্য অনুভব করিতে পার, সেই পরাবিদ্যার সন্ধান কর। রামকৃষ্ণ পাঠ ছাড়িলেন এবং আনন্দ-প্রতিমা দেবীমূর্তির পূজাকার্যে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করিলেন; কিন্তু এখানেও শান্তি কোথায়? মন বলিল, সত্যই কি ইনি আনন্দঘনমূর্তি জগজ্জননী অথবা পাষাণপ্রতিমা মাত্র? সত্যই কি ইনি ভক্তি-সমাহৃত পত্রপুষ্পফলমূলাদি গ্রহণ করেন? সত্যই কি মানব ইঁহার কৃপাকটাক্ষলাভে সর্বপ্রকার বন্ধনমুক্ত হইয়া দিব্যদর্শন লাভ করে? – অথবা, মানবমনের বহুকালসঞ্চিত কুসংস্কাররাজি কল্পনাসহায়ে দৃঢ়নিবদ্ধ হইয়া ছায়াময়ী মূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে এবং মানব ঐরূপে আপনি আবহমানকাল ধরিয়া প্রতারিত হইয়া আসিতেছে? প্রাণ এ সন্দেহ-নিরসনে ব্যাকুল হইয়া উঠিল এবং তীব্র বৈরাগ্যের অঙ্কুর বালকমনে ধীরে ধীরে উদ্গত হইল। বিবাহ হইল, কিন্তু ঐ প্রশ্নের মীমাংসা না করিয়া সাংসারিক সুখভোগ তাঁহার অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইল। নিত্য নানা উপায়ে মন ঐ প্রশ্নসমাধানেই নিযুক্ত রহিল এবং বিবাহ, সংসার, বিষয়বুদ্ধি, উপার্জন, ভোগসুখ এবং আবশ্যকীয় আহার-বিহারাদি পর্যন্ত নিতান্ত নিষ্প্রয়োজনীয় স্মৃতিমাত্রে পর্যবসিত হইল। সুদূর কামারপুকুরে যে বালকত্ব বিষয়বুদ্ধির পরিহাসের বিষয় হইয়াছিল, শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বালকত্বই দক্ষিণেশ্বর দেবমন্দিরে নিতান্ত প্রস্ফুটিত হইয়া সেই বিষয়বুদ্ধির আরও অধিক উপেক্ষণীয় বাতুল বলিয়া পরিগণিত হইল। কিন্তু এ বাতুলতায় উদ্দেশ্যহীনতা বা অসম্বদ্ধতা কোথায়? ইন্দ্রিয়াতীত পদার্থকে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে জানিব, স্পর্শ করিব, পূর্ণভাবে আস্বাদন করিব – ইহাই কি ইহার বিশেষ লক্ষণ নহে? যে লৌহময়ী ধারণা, অপরাজিত অধ্যবসায় এবং উদ্দেশ্যের ঋজুতা ও একতানতা কামারপুকুরে বালক রামকৃষ্ণের বালকত্বে অভিনব শ্রী প্রদান করিয়াছিল, তাহাই এখন আপাতদৃষ্টে বাতুল রামকৃষ্ণের বাতুলত্বকে এক অদ্ভুত অদৃষ্টপূর্ব ব্যাপার করিয়া তুলিল।

দ্বাদশবর্ষব্যাপী প্রবল মানসঝটিকা বহিতে লাগিল। অন্তঃপ্রকৃতির সে ভীষণ সংগ্রামে অবিশ্বাস, সন্দেহ প্রভৃতির তুমুল তরঙ্গাঘাতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনতরীর অস্তিত্বও তখন সন্দেহের বিষয় হইয়া উঠিল। কিন্তু সে বীরহৃদয় আসন্ন-মৃত্যু সম্মুখেও কম্পিত হইল না, গন্তব্য পথ ছাড়িল না – ভগবদনুরাগ ও বিশ্বাস-সহায়ে ধীরস্থিরভাবে নিজ পথে অগ্রসর হইল। সংসারের কামকাঞ্চনময় কোলাহল এবং লোকে যাহাকে ভালমন্দ, ধর্মাধর্ম, পাপপুণ্যাদি বলে – সেসকল কতদূরে পড়িয়া রহিল – ভাবের প্রবল তরঙ্গ উজানপথে ঊর্ধ্বে ছুটিতে লাগিল! সে প্রবল তপস্যা, সে অনন্ত ভাবরাশির গভীর উচ্ছ্বাসে শ্রীরামকৃষ্ণের মহাবলিষ্ঠ দেহ ও মন চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া নূতন আকার, নূতন শ্রী ধারণ করিল! এইরূপে মহাসত্য, মহাভাব, মহাশক্তি ধারণ ও সঞ্চারের সম্পূর্ণাবয়ব যন্ত্র গঠিত হইল।

ঐ সত্যান্বেষণের ফল

হে মানব! শ্রীরামকৃষ্ণের এ অদ্ভুত বীরত্বকাহিনী তুমি কি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে? তোমার স্থূল দৃষ্টিতে পরিমাণ ও সংখ্যাধিক্য লইয়াই পদার্থের গুরুত্ব বা লঘুত্ব গ্রাহ্য হইয়া থাকে। কিন্তু যে সূক্ষ্ম শক্তি, স্বার্থগন্ধ পর্যন্ত বিদূরিত করিয়া অহঙ্কারকে সমূলে উৎপাটিত করে, যাহার বলে ইচ্ছা করিলেও কিঞ্চিন্মাত্র স্বার্থচেষ্টা শরীর-মনের পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠে, সে শক্তিপরিচয় তুমি কোথায় পাইবে? জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ধাতুস্পর্শমাত্রেই শ্রীরামকৃষ্ণের হস্ত আড়ষ্ট হইয়া তদ্ধাতুগ্রহণে অসমর্থ হইত; পত্র পুষ্প প্রভৃতি তুচ্ছ বস্তুজাত জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে স্বত্বাধিকারীর বিনানুমতিতে গ্রহণ করিলে নিত্যাভ্যস্ত পথ দিয়া আসিতে আসিতে তিনি পথ হারাইয়া বিপরীতে গমন করিতেন; গ্রন্থিপ্রদান করিলে সে গ্রন্থি যতক্ষণ না উন্মুক্ত করিতেন, ততক্ষণ তাঁহার শ্বাস রুদ্ধ থাকিত – বহু চেষ্টাতেও বহির্গত হইত না; সুকোমল রমণীস্পর্শে তাঁহার কূর্মের ন্যায় ইন্দ্রিয়সঙ্কোচাদি হইত! – এসকল শারীরিক বিকার যে পবিত্রতম মানসিক ভাবনিচয়ের বাহ্য অভিব্যক্তি, আজন্ম স্বার্থদৃষ্টিপটু মানব-নয়ন তাহাদের দর্শন কোথায় পাইবে? আমাদের দূরপ্রসারী কল্পনাও কি এ শুদ্ধতম ভাবরাজ্যে প্রবেশাধিকার পায়? ‘ভাবের ঘরে চুরি’ করিতেই আমরা আজীবন শিখিয়াছি। যথার্থ গোপন করিয়া কোনরূপে ফাঁকি দিয়া বড়লোক হইতে পারিলে বা নাম কিনিতে পারিলে আমাদের মধ্যে কয়জন পশ্চাৎপদ হয়? তাহার পর সাহস। একবার আঘাতপ্রাপ্ত হইয়া দশবার আঘাত করা অথবা অগ্নিউদ্গারকারী তোপসম্মুখে ধাবিত হইয়া স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রাণবিসর্জন, এ সাহস করিতে না পারিলেও শুনিয়া আমাদের প্রীতির উদ্দীপন হয়, কিন্তু যে সাহসে দণ্ডায়মান হইয়া শ্রীরামকৃষ্ণদেব পৃথিবী ও স্বর্গের ভোগসুখ এবং নিজের শরীর ও মন পর্যন্ত, জগতের অপরিচিত অজ্ঞাত অনুপলব্ধ ইন্দ্রিয়াতীত পদার্থের জন্য ত্যাগ করিয়াছিলেন, সে সাহসের কিঞ্চিৎ ছায়ামাত্রও আমরা কি অনুভবে সমর্থ? যদি পার তবে হে বীর শ্রোতা, তুমি আমার এবং সকলের পূজনীয় মৃত্যুঞ্জয়ত্ব লাভ করিয়াছ।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সামান্য কথার গভীর অর্থ

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অতি তুচ্ছ কথাসকল বা অতি ক্ষুদ্র কার্যসমূহও কি গভীর ভাবে পূর্ণ থাকিত, তাহা স্বয়ং না বুঝাইলে কাহারও বুঝিবার সাধ্য ছিল না। সমাধিভঙ্গের পরেই অনেক সময়ে যে তিনি নিত্যপরিচিত বস্তু বা ব্যক্তিসমূহের নামোল্লেখ ও স্পর্শ করিতেন অথবা কোন খাদ্যদ্রব্যবিশেষের উল্লেখ করিয়া ভক্ষণ-পানাদি করিবেন বলিতেন, তাহার গূঢ় রহস্য একদিন আমাদিগকে বুঝাইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, “সাধারণ মানবের মন গুহ্য, লিঙ্গ এবং নাভি-সমাশ্রিত সূক্ষ্ম স্নায়ুচক্রেই বিচরণ করে। কিঞ্চিৎ শুদ্ধ হইলে ঐ মন কখনও কখনও হৃদয়সমাশ্রিত চক্রে উঠিয়া জ্যোতিঃ বা জ্যোতির্ময় রূপাদির দর্শনে অল্প আনন্দানুভব করে। নিষ্ঠার একতানতা বিশেষ অভ্যস্ত হইলে কণ্ঠসমাশ্রিত চক্রে উহা উঠিয়া থাকে এবং তখন যে বস্তুতে সম্পন্ননিষ্ঠ হইয়াছে তাহার কথা ছাড়া অপর কোন বিষয়ের আলোচনা তাহার পক্ষে অসম্ভবপ্রায় হয়। এখানে উঠিলেও সে মন নিম্নাবস্থিত চক্রসমূহে পুনর্গমন করিয়া ঐ নিষ্ঠা এককালে ভুলিয়াও যাইতে পারে। কিন্তু যদি কখনও কোন প্রকারে প্রবল একনিষ্ঠা-সহায়ে কণ্ঠের ঊর্ধ্বদেশস্থ ভ্রূমধ্যাবস্থিত চক্রে তাহার গমন হয়, তখন সে সমাধিস্থ হইয়া যে আনন্দ অনুভব করে, তাহার নিকট নিম্ন চক্রাদির বিষয়ানন্দ-উপভোগ তুচ্ছ বলিয়া প্রতীত হয়; এখান হইতে আর তাহার পতনাশঙ্কা থাকে না। এখান হইতেই কিঞ্চিন্মাত্র আবরণে আবৃত পরমাত্মার জ্যোতিঃ তাঁহার সম্মুখে প্রকাশিত হয়। পরমাত্মা হইতে ঈষন্মাত্র ভেদ রক্ষিত হইলেও এখানে উঠিলেই অদ্বৈতজ্ঞানের বিশেষ আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং এই চক্র ভেদ করিতে পারিলেই ভেদাভেদজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে বিগলিত হইয়া পূর্ণ অদ্বৈতজ্ঞানে অবস্থান হয়। আমার মন তোদের শিক্ষার জন্য কণ্ঠাশ্রিত চক্র পর্যন্ত নামিয়া থাকে, এখানেও ইহাকে কোনরূপে জোর করিয়া রাখিতে হয়। ছয় মাস কাল ধরিয়া পূর্ণ অদ্বৈতজ্ঞানে অবস্থান করাতে ইহার গতি স্বভাবতই সেই দিকে প্রবাহিত রহিয়াছে। এটা করিব, ওটা খাইব, একে দেখিব, ওখানে যাইব ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাসনাতে নিবদ্ধ না রাখিলে উহাকে নামানো বড় কঠিন হইয়া পড়ে এবং না নামিলে কথাবার্তা, চলাফেরা, খাওয়া ও শরীররক্ষা ইত্যাদি সকলই অসম্ভব। সেইজন্যই সমাধিতে উঠিবার সময়ই আমি কোন না কোন একটা ক্ষুদ্র বাসনা, যথা – তামাক খাব বা ওখানে যাব ইত্যাদি করিয়া রাখি, তত্রাপি অনেক সময়ে ঐ বাসনা বার বার উল্লেখ করায় তবে মন এইটুকু নামিয়া আইসে।”

দৈনন্দিন জীবনে যে সকল বিষয়ের তাঁহাতে পরিচয় পাওয়া যাইত

পঞ্চদশীকার এক স্থানে বলিয়াছেন, সমাধিলাভের পূর্বে মানব যে অবস্থায় যে ভাবে থাকে, সমাধিলাভের পরে সমধিক শক্তিসম্পন্ন হইয়াও নিজের সে অবস্থা পরিবর্তন করিতে তাহার অভিরুচি হয় না। কেন না, ব্রহ্মবস্তু ব্যতীত আর সকল বস্তু বা অবস্থাই তাহার নিকট অতি তুচ্ছ বলিয়া প্রতীত হয়। পূর্বোক্ত প্রবল ধর্মানুরাগ প্রবাহিত হইবার পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন যে ভাবে চালিত হইত, তাহার কিছু কিছু নিদর্শন দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার দৈনন্দিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কার্যসমূহে পাওয়া যাইত। তাহার দুই-চারিটি উল্লেখ করা এখানে অযুক্তিকর হইবে না।

শরীর, বস্ত্র, বিছানা প্রভৃতি অতি পরিষ্কার রাখা তাঁহার অভ্যাস ছিল। যে জিনিসটি যেখানে রাখা উচিত, সে জিনিসটি ঠিক সেইখানে নিজে রাখিতে এবং অপরকেও রাখিতে শিখাইতে ভালবাসিতেন, কেহ অন্যরূপ করিলে বিরক্ত হইতেন। কোনস্থানে যাইতে হইলে গামছা বেটুয়া প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যাদি ঠিক ঠিক লওয়া হইয়াছে কি না, তাহার অনুসন্ধান করিতেন এবং সেখান হইতে ফিরিবার কালেও কোন জিনিস লইয়া আসিতে ভুল না হয়, সেজন্য সঙ্গী শিষ্যকে স্মরণ করাইয়া দিতেন। যে সময় যে কাজ করিব বলিতেন, তাহা ঠিক সেই সময়ে করিবার জন্য ব্যস্ত হইতেন। যাহার হস্ত হইতে যে জিনিস লইব বলিয়াছেন, মিথ্যাকথন হইবার ভয়ে সে ভিন্ন অপর কাহারও হস্ত হইতে ঐ বস্তু কখনও গ্রহণ করিতেন না। তাহাতে যদি দীর্ঘকাল অসুবিধাভোগ করিতে হইত, তাহাও স্বীকার করিতেন। ছিন্ন বস্ত্র, ছত্র বা পাদুকাদি কাহাকেও ব্যবহার করিতে দেখিলে, সমর্থ হইলে নূতন ক্রয় করিতে উপদেশ করিতেন এবং অসমর্থ হইলে কখনও কখনও নিজেও ক্রয় করিয়া দিতেন। বলিতেন, ওরূপ বস্ত্র-ব্যবহারে মানুষ লক্ষ্মীছাড়া ও হতশ্রী হয়। অভিমান-অহঙ্কারসূচক বাক্য তাঁহার মুখপদ্ম হইতে বিনিঃসৃত হওয়া এককালে অসম্ভব ছিল। নিজের ভাব বা মত বলিতে হইলে নিজ শরীর নির্দেশ করিয়া ‘এখানকার ভাব’, ‘এখানকার মত’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করিতেন। শিষ্যবর্গের হাত পা চোখ মুখ প্রভৃতি শারীরিক সকল অঙ্গের গঠন এবং তাহাদের চাল-চলন আহার-বিহার নিদ্রা প্রভৃতি কার্যকলাপ তন্ন তন্ন করিয়া লক্ষ্য করিয়া তাহাদের মানসিক প্রবৃত্তিনিচয়ের গতি, কোন্ প্রবৃত্তির কতদূর আধিক্য, ইত্যাদি, এরূপ স্থির করিতে পারিতেন যে, তাহার ব্যতিক্রম এ পর্যন্ত আমরা দেখিতে পাই নাই।

অনেকে বলিয়া থাকেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট যাঁহারা গিয়াছিলেন তাঁহাদের প্রত্যেকেই মনে করেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহাকেই সর্বাপেক্ষা ভালবাসিতেন। আমাদের বোধ হয় প্রত্যেক ব্যক্তির সুখ-দুঃখাদি জীবনানুভবের সহিত তাঁহার যে প্রগাঢ় সহানুভূতি ছিল, তাহাই উহার কারণ। সহানুভূতি ও ভালবাসা বা প্রেম দুইটি বিভিন্ন বস্তু হইলেও শেষোক্তের বাহ্যিক লক্ষণ প্রথমটির সহিত বিশেষ বিভিন্ন নহে। সেইজন্য সহানুভূতিকে প্রেম বলিয়া ভাবা বিশেষ বিচিত্র নহে। প্রত্যেক বস্তু ভাবিবার কালে উহাতে তন্ময় হওয়া তাঁহার মনের স্বভাবসিদ্ধ গুণ ছিল। ঐ গুণ থাকাতেই তিনি প্রত্যেক শিষ্যের মনের অবস্থা ঠিক ঠিক ধরিতে পারিতেন এবং ঐ চিত্তের উন্নতির জন্য যাহা আবশ্যক, তাহাও ঠিক ঠিক বিধান করিতে পারিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বালকত্ব-বৰ্ণনা প্রসঙ্গে আমরা পূর্বেই দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, শৈশবকাল হইতে তিনি তাঁহার চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের কতদূর সম্পূর্ণ ব্যবহার করিতে শিক্ষা করিয়াছিলেন; ঐ শিক্ষাই যে পরে মনুষ্যচরিত্রগঠনে তাঁহার বিশেষ সহায় হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। শিষ্যবর্গও যাহাতে সকল স্থানে সকল বিষয়ে ঐরূপে ইন্দ্রিয়াদির ব্যবহার করিতে শিখে, সে বিষয়ে তাঁহার বিশেষ লক্ষ্য ছিল। প্রত্যেক কার্যই বিচারবুদ্ধি অবলম্বন করিয়া অনুষ্ঠান করিতে নিত্য উপদেশ করিতেন। বিচারবুদ্ধিই বস্তুর গুণাগুণ প্রকাশ করিয়া মনকে যথার্থ ত্যাগের দিকে অগ্রসর করাইবে, এ কথা তাঁহাকে বার বার বলিতে শুনিয়াছি। বুদ্ধিহীনের অথবা একদেশী বুদ্ধিমানের আদর তাঁহার নিকট কখনই ছিল না। সকলেই তাঁহাকে বলিতে শুনিয়াছে, “ভগবদ্ভক্ত হবি বলে বোকা হবি কেন?” অথবা “একঘেয়ে হসনি, একঘেয়ে হওয়া এখানকার ভাব নয়, এখানে ঝোলেও খাব, ঝালেও খাব, অম্বলেও খাব – এই ভাব।” একদেশী বুদ্ধিকেই তিনি একঘেয়ে বুদ্ধি বা একঘেয়ে ভাব বলিতেন। “তুই তো বড় একঘেয়ে” – ভগবদ্ভাবের বিশেষ কোনটিতে কোন শিষ্য আনন্দানুভব না করিতে পারিলে পূর্বোক্ত কথাগুলিই তাঁহার বিশেষ তিরস্কারবাক্য ছিল। ঐ তিরস্কারবাক্য এরূপভাবে বলিতেন যে, উহার প্রয়োগে শিষ্যকে লজ্জায় মাটি হইয়া যাইতে হইত। ঐ উদার সার্বজনীন ভাবের প্রেরণাতেই যে তিনি সকল ধর্মমতের সর্বপ্রকার ভাবের সাধনে প্রবৃত্ত হইয়া ‘যত মত তত পথ’ এই সত্য-নিরূপণে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ধর্মপ্রচার কিভাবে কতদূর হইয়াছে ও পরে হইবে

ফুল ফুটিল। দেশদেশান্তরের মধুপকুল মধুলোভে উন্মত্ত হইয়া চতুর্দিক হইতে ছুটিয়া আসিল। রবিকরস্পর্শে নিজ হৃদয় সম্পূর্ণ অনাবৃত করিয়া ফুল্লকমল তাহাদের পূর্ণভাবে পরিতৃপ্ত করিতে কৃপণতা করিল না। পাশ্চাত্য-শিক্ষাসংস্পর্শমাত্রহীন, ভারত-প্রচলিত কুসংস্কারখ্যাত ধর্মভাবে গঠিতজীবন শ্রীরামকৃষ্ণ যে ধর্মমধু আজ জগৎকে দান করিলেন, তাহার অমৃত-আস্বাদ জগৎ পূর্বে আর কখনও কি পাইয়াছে? যে মহান ধর্মশক্তি তিনি সঞ্চিত করিয়া শিষ্যবর্গে সঞ্চারিত করিয়াছেন, যাহার প্রবল উচ্ছ্বাসে বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানালোকেও লোকে ধর্মকে জ্বলন্ত প্রত্যক্ষের বিষয় বলিয়া উপলব্ধি করিতেছে এবং সর্বধর্মমতের অন্তরে এক অপরিবর্তনীয় জীবন্ত সনাতনধর্ম-স্রোত প্রবাহিত দেখিতেছে – সে শক্তির অভিনয় জগৎ পূর্বে আর কখনও কি অনুভব করিয়াছে? পুষ্প হইতে পুষ্পান্তরে বায়ুসঞ্চরণের ন্যায় সত্য হইতে সত্যান্তরে সঞ্চরণ করিয়া মনুষ্যজীবন ক্রমশঃ ধীরপদে এক অপরিবর্তনীয় অদ্বৈত সত্যের দিকে গমন করিতেছে এবং একদিন না একদিন সেই অনন্ত অপার অবাঙ্মনসোগোচর সত্যের নিশ্চয় উপলব্ধি করিয়া পূর্ণকাম হইবে – এ অভয়বাণী মনুষ্যলোকে পূর্বে আর কখনও কি উচ্চারিত হইয়াছে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, শঙ্কর, রামানুজ, শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি ভারতের, এবং ঈশা, মহম্মদ প্রভৃতি ভারত-ভিন্ন দেশের, ধর্মাচার্যেরা ধর্মজগতের যে একদেশী ভাব দূর করিতে সমর্থ হন নাই, নিরক্ষর ব্রাহ্মণবালক নিজ জীবনে সম্পূর্ণরূপে সেই ভাব বিনষ্ট করিয়া বিপরীত ধর্মমতসমূহের প্রকৃত সমন্বয়রূপ অসাধ্যসাধনে সমর্থ হইল – এ চিত্র আর কখনও কেহ কি দেখিয়াছে? হে মানব, ধর্মজগতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উচ্চাসন যে কোথায় প্রতিষ্ঠিত, তাহা নির্ণয়ে যদি সক্ষম হইয়া থাক তো বল, আমরা কিন্তু ঐ বিষয়ে সাহস করিতে পারিলাম না, তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, নির্জীব ভারত তাঁহার পদস্পর্শে সমধিক পবিত্র ও জাগ্রত হইয়াছে এবং জগতের গৌরব ও আশার স্থল অধিকার করিয়াছে – তাঁহার মনুষ্যমূর্তি পরিগ্রহ করায় নরও দেবকুলের পূজ্য হইয়াছে এবং যে শক্তির উদ্বোধন তাঁহার দ্বারা হইয়াছে, তাহার বিচিত্র লীলাভিনয়ের কেবল আরম্ভমাত্রই শ্রীবিবেকানন্দে জগৎ অনুভব করিয়াছে!

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গে গুরুভাবপর্বে উত্তরার্ধ সম্পূর্ণ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *