প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৪.৮ কোথা দিয়ে আগ্রা যেতে হবে

কি করে কোথা দিয়ে আগ্রা যেতে হবে, সেইসব কথা বলতে বলতে আমরা তাঁদের বাড়ির দরজার কাছে এসে পৌঁছলুম। পুরোনো পাড়ায় বাড়ি হলেও বেশ বড় বাড়ি। একতলাটা পাথরের তৈরি। রাস্তা থেকে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে আমরা বাড়ির মধ্যে ঢুকলুম। তারপরই আধা-অন্ধকার প্রকাণ্ড একটা ঘর, সেখানে মুখোমুখি দুটো দোলনা দুলছে। তারই একটাতে আমাকে বসিয়ে তিনি নিজে সামনেরটায় বসলেন। আমি বললুম–কাল সকাল ন’টায় ট্রেন। সেটা গিয়ে পৌঁছবে বিকেলে কল্যাণে, সেখান থেকে ট্রেন ধরে আগ্রায় যাব। 

–তা হলে বেলা আটটার মধ্যে আসবি। 

বললুম–নিশ্চয়ই আসব। 

ভদ্রমহিলা আমার গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। দেখলুম তাঁর চোখ আবার সজল হয়ে উঠেছে। বললুম–একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বড় প্রলোভন হচ্ছে। 

–কি বল্‌। 

বললুম–আপনার নাম কি? 

–লছমীবাঈ। 

আমি বললুম–আমি আপনাকে লছমীমায়ী বলে মনে করব। আপনি লছমীময়ী হয়ে আমার এই বুকে রইলেন চিরকালের জন্যে। 

‘তিনি বললেন–তোর নাম কি? 

আমি বললুম–আপনি আমার দুষ্টু ছেলে বলেই মনে রাখবেন। আমি আপনার দুষ্টু ছেলে। লছমীমায়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। কিছুকাল ধরে যে অশান্তি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছিলুম তার কোনো বর্ণনা ভাষায় নেই। একেবারে অর্থহীন হয়ে পড়া আমার পক্ষে নতুন নয়। কিন্তু চারিদিক থেকে এই মৃত্যুর বিভীষিকা আমায় যেন ঘিরে ধরেছে। তখন আমার মাত্র আঠারো বছর বয়স। 

আমার মনে হতে লাগল আমি যেন একটা অন্ধকার ঘরে বন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছিলুম। ঘরের চালে ছোট্ট একটি ঘুলঘুলি, তারই ভিতর দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশ করা-মাত্র সেই ক্ষুদ্র রন্ধ্রপথেই আজ মুক্তির ‘খোশখবর-ভরা একখানি খাম আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। 

ছুটলুম পরতাবের দোকানে। আমার মুখে সব কথা শুনে সে খুশি হয়ে এক কাপ চা খাওয়ালে। বললুম–ভাই, তুমি আমার দুর্দিনের বন্ধু। তোমাকে কখনও ভুলব না। 

ব্রিজশরণের ওখানে গেলুম–দেখি; দরজায় তালা ঝুলছে। দিনকয়েক রোজই গেলুম। যাবার দিনেও ভোরে একবার গেলুম–সেদিনও দেখলুম, তালা ঝুলছে। তার সঙ্গে আর দেখা হল না। 

সন্ধেবেলায় অনাথ-আশ্রমে ফিরে এসে সকলকে জানালুম, কাল আমি চলে যাব। তারা খুশিও হল না, দুঃখিতও হল না, শুধুমাত্র চুপ করে রইল। 

পরদিন সকালে উঠে আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে লছমীমায়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। তিনি তৈরিই ছিলেন। আমাকে কাঁসার কাপে চা দিলেন। চা খেয়ে টাঙ্গা করে আমরা স্টেশনে গিয়ে হাজির হলুম। লছমীমায়ী নিজের হাতে টিকিট কেটে নিয়ে এলেন। স্টেশনে গাড়িখানা তৈরিই ছিল। আমি একটা খালি কামরায় উঠে জানলার ধারে বসলুম। তিনি প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি টিকিটখানা আমার হাতে দিয়ে বললেন-এবার মা’র কাছে চলে যা। আর এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানে। 

আমি বললুম–আর কয়েকটা মাস। তারপরেই ফিরে যাব। 

ভাবছিলুম টিকিট তো হল কিন্তু পকেটে একটা পয়সা নেই। খাব কি? এদিকে সময় হয়ে আসছে। একটা ঘণ্টাও পড়ে গেল। শেষকালে মুখ ফুটে বলে ফেললুম–মায়ী, তোমার এই দুষ্টু ছেলে এ-দু’দিন খাবে কি? আমার কাছে একটি পয়সাও নেই। 

–ও, ভুলে গিয়েছিলুম।–বলে তিনি আঁচল খুলে পাঁচটি টাকা আমার হাতে দিলেন। তারপর খানিকক্ষণ স্থিরভাবে আমার দিকে চেয়ে থেকে আমার গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চোখ-দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল। 

আমার চোখও শুষ্ক ছিল না। ভোঁ দিয়ে ইঞ্জিন চলতে আরম্ভ করল। 

.

বহুরূপিণী রমণীর বিচিত্র রূপ জীবনে আমি বার বার দেখেছি–কখনও প্রেমময়ী–কখনও ছলনাময়ী–কখনও মমতাময়ী। কখনও-বা অশ্রুময়ীর এমন রূপও দেখেছি যা জীবনে কোনোদিনই ভুলতে পারিনি, আমার মনের পটে আজও তা উজ্জ্বল হয়ে আঁকা আছে। 

জীবনে দুঃখও পেয়েছি সুখও পেয়েছি। দারিদ্র্যের চাবুকে রক্তাক্ত হয়েছি, আবার প্রেমালিঙ্গনে রক্তিমও হয়েছি। কিন্তু জীবনের প্রথম প্রদোষলগ্নে মাতৃরূপা রমণীর দু’একটি স্নেহস্মৃতি আজও আমার জীবনে পাথেয় হয়ে আছে। লছমীমায়ীর সেদিনের সেই অশ্রুসিক্ত চোখ-দুটির কথা মনে পড়লে আমার আর-এক জোড়া অশ্রুসজল চোখের কথা মনে পড়ে যায়। মনের আকাশে শ্রাবণের ছায়া নেমে আসে। জানি না সেদিন কোনো অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়েছিলুম কি না–বৃন্দাবন-পথযাত্রিণীকে পাগলা গারদের লোহার রড-এর পিছনে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কতটাই বা সত্যকারের সহায়তার অপরাধ ছিল! কিন্তু আজ হলফ করে বলতে পারি সেই অশ্রুময়ীর চোখ-দুটোয় যে শ্রাবণ-ছায়া সেদিন নেমে এসেছিল, আমার জীবনের উজ্জ্বলতম রৌদ্রালোকিত দিনে আজও তা কখনও কখনও ঘনিয়ে ওঠে, রিমিঝিমি ধারায় মনে বেদনার সুর বেজে ওঠে–”আয়ি সাবন রে!” 

এই লছমীমায়ীর মতো সেও ছিল আমার এক নতুন মা। 

তার কথাই এবার বলছি। 

পাঞ্জাব থেকে তখন আমি ঘুরতে ঘুরতে রোহিলখণ্ডের এক শহরে এসে পড়েছিলুম। শহরটি বেশ বিস্তৃত–খোলামেলা। লোকজনের বসতি আছে অনেক–মনে হল আমার কাজের বেশ সুবিধে হবে এখানে। দেখলুম–সেখানে গম ও ডালের বড় বড় পাইকার দোকান ফেঁদে বসেছে। উঠলুম গিয়ে সরাইখানায়–সেই পুরোনো চালের সরাই-লম্বায় ও চওড়ায় প্রায় দু’শ গজ জমি–উঁচু ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের গায়ে পাশাপাশি অসংখ্য ঘর, তার একটি মাত্র দরজা; ঘরের ভাড়া লাগে না, একপয়সা খাঁটিয়ার ভাড়া লাগে। রাত্রিবেলা এই খাঁটিয়া প্রাঙ্গণে টেনে নিয়ে এসে লোকে ঘুমোয়; শীতকালে বোধহয় ঘরের মধ্যেই শোয়। 

রাতের এক অপূর্ব দৃশ্য–অসংখ্য লোক প্রাঙ্গণে খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে, কেউ বা বসে আছে। কেউই কারুকে চেনে না। কোনো কোনো পরিবার ওরই মধ্যে রান্নাবান্না করছে–চলেছে সংসার। আমার রান্নার হ্যাঁঙ্গামা নেই-চারখানা বড় কচুরি চারপয়সার ও আধপো রাবড়ি পাঁচপয়সার–দুবেলা এই চলেছে। 

যাঁরা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ঘুরেছেন তাঁরাই জানেন, সেখানে কিরকম বড় বড় আকাশচুম্বী বাত্তেলার প্রচলন আছে। এই রোহিলখণ্ডের রোহিলাদের সম্বন্ধেও নানান প্রবাদ শুনতে পাওয়া যেত। শুনেছিলুম, তারা খুব বীর আর তলোয়ার চালাতে খুবই মজবুত। নমুনাস্বরূপ একটি উদাহরণ দেবার প্রলোভন সামলাতে পারছি না। 

এদের একজন সর্দার-বাহাদুর খাঁ তাঁর নাম ছিল। তিনি আকবর বাদশার সময় একটি অন্যতম রত্ন ছিলেন। বাহাদুর খাঁর সম্বন্ধে বীরত্বের নানা কথা প্রচলিত আছে; কিন্তু সে-সব ছেড়ে দিয়ে তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রচলিত কাহিনি এইখানে বলি। 

একবার আফগানিস্থানের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাহাদুর খাঁ গিয়েছিলেন সেনানী-রূপে। কিছুদিন পরে তাঁর মা’র কাছে খবর পৌঁছলো যে, যুদ্ধে বাহাদুর খাঁর মৃত্যু হয়েছে। মা শোক করলেন না; বললেন বীরপুত্রের তো এইরকম মৃত্যুই লোকে কামনা করে থাকে। কিন্তু কিছুদিন বাদে খবর পাওয়া গেল, বাহাদুর খাঁ জীবিত আছেন এবং তাঁকে শুশ্রূষার উপর রাখা হয়েছে। 

আরও খবর পাওয়া গেল, আহত সৈনিকদের ওপর দিয়ে যখন বিপক্ষ-পক্ষের লোকেরা তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য হাতি চালাচ্ছিল–সেই সময় একটা হাতির পায়ের তলা থেকে একজন আহত ব্যক্তি হাত সরিয়ে নেওয়ায় দেখতে পাওয়া গেল যে, সে বাহাদুর খাঁ। 

এই খবরটা যখন বাহাদুর খাঁর মা’র কাছে গিয়ে পৌঁছলো তখন তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কি ব্যাপার!–আমার ছেলের এমন দুর্বলতা হল যে, হাতির পায়ের তলা থেকে হাত সরিয়ে নিলে! পঞ্চাশটা হাতি তার গায়ের ওপর দিয়ে গেলে সে গ্রাহ্য করে না–ইত্যাদি। 

বাহাদুরের মায়ের মড়াকান্না শুনে পল্লীর অন্যান্য সর্দারদের বাড়ির মেয়েরা ছুটে এলো। তারা ব্যাপারটা-শুনে আফশোস করতে লাগল–তাইতো বাহাদুরের মা, রোহিলার ছেলের এমন দুর্বলতা! 

বাহাদুরের মা বললেন–আমি শুনে অবধি ভাবছি, কোথা থেকে কী কারণে তার এই দুর্বলতা এলো! ভাবতে ভাবতে মনে হল–ও, এবার কারণটা খুঁজে পেয়েছি। 

অন্যান্য মহিলারা উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠলেন–কি কারণ–কি কারণ? 

বাহাদুরের মা বলতে লাগলেন-বাহাদুর যখন শিশু তখন একদিন বিকেলবেলায় তাকে ঘুম পাড়িয়ে আমি নেমাজ পড়ছিলুম। কিছুক্ষণ বাদেই ছেলে কেঁদে উঠল, কিন্তু সেদিকে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে আমি নেমাজ পড়ে যেতে লাগলুম। কয়েক সেকেন্ড পরেই ছেলের কান্না থেমে গেল। নেমাজ শেষ করে আমি ফিরে দেখি–আমাদের ধোপানি এসেছে, তারই কোলে শুয়ে সে খেলা করছে। আমি ধোপানিকে জিজ্ঞাসা করলুম–ও কান্না থামাল কেন? 

ধোপানি বললে–ওর মুখে দুধ দেওয়াতে একটু ক্ষণ চুষেই থেমে গেল। 

আমি তো শুনে আঁতকে উঠলুম। বললুম–কী সর্বনাশ! তুই ওকে দুধ দিতে গেলি কেন?

তারপর ছেলের পেটে মাথা দিয়ে তাকে খুব ঘুরোলুম–সে বমি করতে লাগল। বমি করতে করতে হাত-পা যখন প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে তখন শুইয়ে দিলাম। সব দুধই উঠে গিয়েছিল–বোধহয় এক ফোঁটা পেটের কোথাও ছিল–তার ফলেই এই দুর্বলতা। 

অন্যান্য সর্দারনীরা হাতির পায়ের তলা থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার একটা সদুত্তর পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যে-যার বাড়ি ফিরে গেল। 

বাহাদুর খাঁর বংশধরেরা বাহাদুরি দেখাতে দেখাতে আজ ধরাপৃষ্ঠ থেকে অবলুপ্ত। এখন সেখানে এসেছে যত ব্যবসাদার–আড়তদার, উকিল-মোক্তার-মুহুরির দল। এদের মধ্যে কাজ করে কোনোরকমে দৈনিক খরচটা আমার উঠে যাচ্ছিল; কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি–কাজে আমার আর মন ছিল না। এই ভবঘুরের জীবন ইতি করে দিয়ে আবার কলকাতায় ফেরবার জন্যে মন হু-হু করছিল–কিন্তু পাথেয়-অভাবে ফিরতে পারছিলুম না। এমন সময়ে এক অভাবিতভাবে সুযোগ এসে গেল। 

সমস্ত দিন কাজ করে বিকেল নাগাদ আমি স্টেশনে গিয়ে বসতুম। গাড়ি আসছে যাচ্ছে–কত লোক উঠছে নামছে–দেখতে বেশ ভালো লাগত। রোজ সেখানে যাওয়ার ফলে স্টেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে আমার বেশ ভাব জমে উঠেছিল। 

একদিন একটি লোক–একে এর আগেও স্টেশনে দেখেছি, তবে আলাপ পরিচয় হয়নি–লোকটি একরকম গায়ে পড়েই আমার সঙ্গে আলাপ করলে। নাম বললে — –দীপচাঁদ ভার্গব। 

আরও বললে–স্টেশনেই কাজ করে। 

দীপচাঁদ বলল–আমি তোমার বড় ভাই, আমাকে লাল্লা বলে ডাকবে। 

দু’দিনেই দীপচাঁদের সঙ্গে বেশ আলাপ জমে উঠল। 

একদিন সে আমাকে বললে–ভাইয়া, তোমার কাছে আট আনা পয়সা হবে? 

আমি তখুনি তাকে পকেট থেকে একটা আধুলি বার করে দিলুম। সামনেই একটা রেউড়িওলা বসে ছিল–তাকে ডেকে সে আট আনার রেউড়ি কিনলে। 

মনে করলুম–রেউড়ির কিছু অংশ আমি পাব। কিন্তু দেখলুম– ঠোঙাটি বেশ করে মুড়ে-ঝুড়ে সে পকেটস্থ করে বললে–পয়সাটা তোমায় কাল ফেরৎ দেব। 

পরের দিন যথারীতি স্টেশনে দীপচাঁদের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু পয়সার কথাটা সে তুললেই না। আমিও চক্ষুলজ্জায় তার কাছ থেকে চাইতে পারলুম না। 

দীপচাঁদ এ-কথা সে-কথার পর জিজ্ঞাসা করলে–ভাইয়া, তোমার খাওয়া-দাওয়া কোথায় হচ্ছে? 

দুবেলা কচুরি আর রাবড়ি খাচ্ছি শুনে সে আঁতকে উঠে বললে–সব্বনাশ! ওই খাবার আরও চালালে ব্যারামে পড়ে যাবে। সে-ব্যারাম সারানো মুশকিল হবে। 

আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলুম–ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যাবে? 

সে একটু ভেবে বললে–আচ্ছা, দাঁড়াও। আমিই ব্যবস্থা করছি। 

সরাইখানায় বাস করছি শুনে সে এমন ভাব দেখালে যেন শ্মশানে বাস করাও তার চেয়ে নিরাপদ। তার কথা শুনে এমন ভয় পেয়ে গেলুম যে, আট আনা ফিরে পাবার আশাও যে কোথায় উবে গেল তা বুঝতেই পারলুম না। 

পরের দিন দেখা হতেই বললে–চলো ভাই, তোমার খাবার বন্দোবস্ত করেছি। আমি বললুম–কোথায়? 

সে জিজ্ঞাসা করলে-আমাদের বাড়িতে থাকতে, আমাদের খাবার খেতে তোমার তো কোনো আপত্তি হবে না? 

বললুম–কিছুমাত্র না। 

–তা হলে এখুনি চলো। 

এই কথা বলে সে আমায় নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়ল। 

পথ চলতে চলতে সে আমাকে বললে–আমাদের বাড়িতে থাকতে কিছু অসুবিধা আছে। আমাদের বাড়িরই আদ্ধেকটায় আমার মাউসি থাকেন, তাঁর ওখানে তোমার থাকবার সমস্ত ব্যবস্থা করেছি। 

মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছলুম। তাঁকে নমস্কার করতেই তিনি বলতে লাগলেন–শুনেছি, শুনেছি–আমি সব শুনেছি। এই বয়সে বাপ-মাকে কাঁদিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর কী লাভ আছে? 

আমি বললুম–মাকে ছেড়ে না এলে কি মাসিকে পেতুম? 

কথা শুনে মাসি খুবই খুশি। বললেন–বেটা, আমার দীপচাঁদও যেমন, তুমিও তেমন। যতদিন ইচ্ছা, এখানে থাকো। 

এখানে মাসি সম্বন্ধে কিছু বলি। মাসির দেহের রঙ অত্যুজ্জ্বল গৌর, দেহটি যেন ‘অমিঞা ছানিয়া’ তৈরি করা হয়েছে। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। সামান্য স্থূলভাব– মুখখানি দেখলেই ভক্তি হয়। সমস্ত দিন তিনি পূজার্চনায় কাটান, সন্ধেবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে ছাতে গিয়ে শুয়ে পড়েন। বহুদিন আগেই বিধবা হয়েছেন। ছেলেপুলে নেই, একলার সংসার। 

মাসি আমাকে নিয়ে গিয়ে একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন–দিনের বেলা এখানেই থাকবে, রাত্রিবেলা তো খাঁটিয়া ছাতে উঠছে। 

একটা নেয়ারের খাট দেখিয়ে বললেন–তোমার বিছানা এইখানেই রাখো। 

তারপর হাঁক দিলেন–পরমেশ্বর–এ পরমেশ্বর– 

প্রথমটা বুঝতেই পারিনি, সমস্তদিন পূজার্চনা করে এত চিৎকার করে ‘পরমেশ্বর’ বলে ডাকবার প্রয়োজন কি! 

খানিক বাদে পরমেশ্বর সশরীরে এসে উপস্থিত হল। কালো, বেঁটেসেঁটে গুলে-ভাঁটার মতন চেহারা। মনে হয় যেন কষ্টিপাথর কুঁদে তাকে তৈরি করা হয়েছে। তাকে মাউসি খাট আর বিছানা দেখিয়ে দিয়ে বললেন–এই বাবুজীর বিছানা আর খাট ছাতে নিয়ে যাও। 

পরমেশ্বর বিজবিজ করে কি বললে বুঝতে পারলুম না। কিন্তু মাউসি বললেন–মনে করে নিয়ে যেও। 

বাড়িতে এই একমাত্র চাকর পরমেশ্বর। সেই রাঁধে। বাড়ির অন্যান্য কাজ–সবই করে।

–একটু ঘুরে আসছি–বলে আমি তখনকার মতন বেরিয়ে পড়লুম। মাসি বলে দিলেন সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরবে। আমরা সন্ধ্যা লাগতেই খেয়ে-দেয়ে সংসারের কাজ মিটিয়ে ফেলি। 

মাসির গলাটি ছিল একেবারে খনখনে। বোধহয় সেইজন্যেই তিনি কথাবার্তা বলতেন অত্যন্ত কম আর আস্তে। তবে বিকেলবেলায় প্রতিদিন দেখতুম পরমেশ্বর ও তিনি এক এক তাল সিদ্ধির গোলা এক এক গেলাস ঘন দুধের সঙ্গে দু’জনেই সেবন করতেন। এর পরেই দেখতুম- মাসির আওয়াজটা যেত একটু চড়ে। এই সময় তিনি পরমেশ্বরের সঙ্গে সংসার সম্বন্ধে কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে আড়াল থেকে মনে হত তিনি বোধহয় আর্তনাদ করছেন। 

পরমেশ্বরের চেহারাটি যাই হোক না কেন–সে রাঁধত অতি পরিপাটি, যদিও রান্না ছিল অতি সামান্য। মোটা হাতে-গড়া রুটি-মোটা হলেও অত্যন্ত নরম হত সে-রুটি আর খেতে দস্তুরমতো মিষ্টি লাগত। আমার মনে হত বোধহয় সে গুড় মিশিয়ে দেয়। এই রুটির সঙ্গে থাকত একটি ডাল আর একটুখানি চাটনি। 

এই সামান্য খাবার আমার কাছে কচুরি-রাবড়ির চেয়েও ঢের ভালো লাগত। 

পরমেশ্বর বিকেলবেলাই ছাতে খাঁটিয়া তুলে বিছানা পেতে রাখত। সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়া সেরে ছাতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তুম। 

পশ্চিমে এঁদের বাড়ি যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই জানেন যে, এ-সব বাড়িতে ছাতের উপর একটি করে ছাতবিহীন ঘর থাকে। চারদিকে দেয়াল-দেয়ালে ঝরোখা, কুলুঙ্গি সবই আছে–খালি ঘরের ছাত নেই। এইঘরে মেয়েরা শোয়। আমি ওপরে উঠবার কিছু পরই মাসি আসতেন। আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে প্রতিদিন নিয়মমতো আশীর্বাদ করে তিনি সেই ছাতবিহীন ঘরে ঢুকে পড়তেন। এর কিছু পরে পরমেশ্বর উঠত ছাতে–সে মাটিতেই নিজের বিছানা করে সেই ছাতবিহীন ঘরেই থাকত। পশ্চিমে অনেক জায়গায় দেখেছি বাড়ির বয়স্থা মহিলারা পুরুষ-চাকারকে দিয়ে গা-হাত-পা টেপায়। পরমেশ্বর খানিকক্ষণ হাত-পা দাবিয়ে নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ত। 

একদিন, সেদিন বোধহয় পূর্ণিমা, ধরণীতল জ্যোৎস্নায় প্লাবিত–বাতাস একটু জোরে বইছিল, ছোট ছোট সাদা মেঘ চাঁদের তলা দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল–এইসব দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম–হঠাৎ একটু ঠান্ডা বোধ হওয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেল। পায়ের কাছ থেকে চাদরটা তুলে নিতে গিয়ে দেখি পরমেশ্বর তার বিছানায় নেই। কোথাও গিয়েছে মনে করে ঘুমুতে চেষ্টা করতে লাগলুম কিন্তু ঘুম আসে না। বিছানা থেকে উঠে ছাতে পায়চারি করতে করতে একবার মাসির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলুম–মাসির সেই স্বল্পপরিসর খাটখানিতে তাঁর অর্ধনগ্ন শুভ্র দেহলতাকে ময়াল-সাপের মতো পাকে পাকে জড়িয়ে নিয়ে পরমেশ্বর ঘুমুচ্ছে। দেবদুর্লভ সে দৃশ্য! সাদায়-কালোয়–আত্মায় পরমাত্মায় এমন গ্রন্থনা ইতিপূর্বে আর চোখে পড়েনি। আমি তো দূরের কথা, মাথার ওপরে অতন্দ্র চাঁদ-ব্যাটাও বিস্ফারিত-লোচনে সে-দৃশ্য দেখছিল। দরজার কাছ থেকে সরে এসে বার বার উঁকি মেরে মেরে আমি সেই অপূর্ব ছবি দেখতে লাগলুম। 

হঠাৎ একটুখানি কাশির আওয়াজে সংবিৎ ফিরে পেয়ে ও-পাশের দোতলার ছাতের দিকে চেয়ে দেখলুম–দীপচাঁদ সরে গেল। 

পরের দিন সকালবেলা খেতে বসেছি, দীপচাঁদ এসে হাজির। দীপচাঁদকে দেখলেই আমার সেই আধুলির কথা মনে পড়ে এবং মনে হয় এইবার বুঝি সে সেইটে ফেরৎ দেবে। সেদিন এ-কথা সে-কথার পর সে বললে–ভাইয়া এখানে দেখছি তোমার খাওয়া-দাওয়ার বড় অসুবিধে হচ্ছে। তোমাদের খাবারের মাছ-মাংস হবার উপায় নেই এখানে। যদিও আমিষ খেতে আমাদের কোনো বাধা নেই, তবুও আমার বাড়িতে ওসব ঢোকে না, কারণ আমার স্ত্রী ওসব খান না। আমার মেসোমশাই কান্তাপ্রসাদ শ্রীবাস্তব এখানকার সবচেয়ে বড় উকিল। তাঁর বাড়িতে রোজ মাংস হয়। আমি সেইখানেই তোমার থাকবার ব্যবস্থা করছি। অবিশ্যি আমার ছোট-মাসি ওসব স্পর্শ করে না, তবে মেসোমশাইয়ের একবেলা মাংস না হলে চলে না; আর রবিবার দিন সকালবেলা মাছও হয়। 

বুঝলুম দীপচাঁদ আমাকে এখান থেকে সরাতে চায়। যাই হোক, মেসোমশাই যখন বড়লোক–তাঁর কাছ থেকে কোনোক্রমে যদি কলকাতায় যাবার গাড়িভাড়াটা জোগাড় করতে পারি, সেই মতলবে বললুম–আমার কোনো আপত্তি নেই, তুমি ব্যবস্থা করো। 

দীপচাঁদ তার মাসিকেও জপালে। মাসি বললেন–বেশ তো, দিনকতক সেখানে থেকে আসুক না। সেও তো আর-এক মাসি বটে। 

পরের দিন সকালবেলা মোটঘাট নিয়ে দীপচাঁদের সঙ্গে কাতাপ্রসাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলুম। তিনি তখন কাছারি বেরুবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ভারি খুশি হয়ে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন–কলেজে আমাদের এক বাঙালি প্রফেসর ছিলেন। 

আরও বললেন–তুমি যখন দীপচাঁদের বন্ধু, তখন তুমি আমার ছেলের মতো। দীপচাঁদকে বললেন–এঁকে এঁর ঘরে নিয়ে যাও, সব ব্যবস্থা করো, কোনোরকম তকলিফ যেন না হয়। 

কথাবার্তায় মনে হল কাতাপ্রসাদ অতি সদাশয় ও অমায়িক ব্যক্তি। যেমন তাঁর দশাসই চেহারা-ব্যবহারটিও তেমনি উদার ও মিষ্টি। 

তিনি বেরোবার মুখে দীপচাঁদকে আবার বললেন–ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাও। 

দীপচাঁদের সঙ্গে আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এলুম। দোতলায় বেশ খোলামেলা পরিষ্কার ঘরখানি। একদিকে ছোট্ট নেয়ারের খাট, ঘরের আর-একদিকে চেয়ার-টেবিল। সেখানে আমার ভাঙা প্যাটরা ও ছেঁড়া বিছানা নিতান্তই বেমানান হল। মনের মধ্যে চিন্তার চক্র ঘুরছিল। নিরামিষ থেকে মাংসের হাটে এলুম বটে, কিন্তু এরকম করে আর কতদিন চলবে! দীপচাঁদকে বললুম–আমাকে কলকাতায় ফিরে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পার? আমার কাছে কিন্তু পয়সাকড়ি কিছু নেই। আর এ-কাজও আর পোষাচ্ছে না। 

দীপচাঁদ মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বললে–দূর দূর-এ-কাজ কি ভদ্রলোক করে! তিরিশ টাকা মাইনে দেয়–তা থেকে ট্রেন ভাড়া যায়। তবে আর থাকে কি! তার ওপর খাবার ঠিক নেই, থাকবার জায়গা নেই। তুমি এইখানেই থাকো। আমি জোর করে বলছি মেসোমশাইকে বলে তোমার একটা চাকরি এইখানেই ঠিক করে দেব। রেলে ও আদালতে প্রায়ই তো লোক নেয়। তুমি নিশ্চিত্ত থাকো। 

দীপচাঁদ একটা চাকরকে ডেকে বললে–তুমি বাবুজীর খিদমতে থাকবে। ইনি আমাদের মেহমান, দেখো যেন তাঁর কোনো অসুবিধা না হয়। 

দীপচাঁদ তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলে –বাবুজী কোথায়? 

চাকরটা বললে–তিনি কাছারি চলে গেছেন। 

দীপচাঁদ বললে–এবার ছোট-মাসির সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দি’। 

চললুম ছোট-মাসির ঘরের উদ্দেশে। বাড়িখানি বেশ বড়। আমরা গোটাকয়েক উঁচু উঁচু ছাত ও ঘর পেরিয়ে ছোট-মাসির ঘরের কাছাকাছি এসে পৌঁছলুম। দীপচাঁদ সেইখান থেকেই তাঁকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলল। 

ঘরের দরজায় একটি মহিলা এসে দাঁড়ালেন। বয়স তাঁর খুব বেশি নয়–তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। মাসির বোন–দেখলেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু মুখখানা দেখলে মনে হয় বুঝি তাঁর ভয়ানক পেটকামড়ানি ধরেছে। আমাদের বললেন–এসো এসো। 

বেশ বড় ঘর। তাকে হলঘরই বলা চলে। সাজানো-গুছানো, মনে হয় যেন স্টেজে এসে ঢুকলুম। মেঝেতে শতরঞ্চি পাতা। তিনি আমাদের বসতে বলে নিজে বসলেন। তারপরে দীপচাঁদের কাছ থেকে আমার কথা শুনতে লাগলেন। অবিশ্যি দীপচাঁদ আগেই তাঁকে আমার কথা বলে রেখেছিল। অনেকক্ষণ গল্প করার পর তিনি বললেন–এবার নাওয়া-খাওয়ার ব্যবস্থা করো। 

ওঠবার সময় আমার দিকে ফিরে হঠাৎ বললেন–তুমি আমাকে মাসি বলো না। আমি তোমার মা। 

আমি বললুম–আমার অনেকগুলি মা আছে, আপনাকে আমি নতুন-মা বলে ডাকব। দেখলুম, নামকরণ শুনে তিনি প্রসন্নই হলেন। দীপচাঁদকে বললেন–একে চানের ঘরটরগুলো দেখিয়ে দাও। আমি এদিকে খাবার ব্যবস্থা করছি। 

আমার ঘরেই খাবার এলো। খেয়েদেয়ে একটু শুয়েছি, চাকর এসে খবর দিলে–মায়িজী ডাকছেন। 

মায়িজীর ঘরে গিয়ে দেখলুম, তাঁর খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে। নানারকম গল্প শুরু করেছেন। তাঁর হালচাল দেখে মনে হল মুখখানা অমন করে থাকলেও তিনি একটি গল্পবাজ লোক। এ-কথা সে-কথার পর তিনি বললেন–দেখ, এ-বাড়ির কোনো কথা তোর মাউসিকে বলবিনি। 

গল্প করতে করতে বেলা পড়ে এলো। আমি বললুম–এবার আপনি একটু বিশ্রাম করুন, আমিও শুইগে। 

ঘরে এসে ভাবতে লাগলুম–এখন কী করি! কী করে কিছু অর্থের জোগাড় করে কলকাতায় পালাই! সেবার পুণেতেও এইরকম বিপদে পড়েছিলুম, কিন্তু অভাবিতরূপে উদ্ধার পেয়ে গিয়েছিলুম। আমার সৃষ্টিকর্তা সারাজীবন ধরে আমাকে এইরকম অভাবিতভাবে উদ্ধার করতে করতে আর কিছু করে উঠতে পারলেন না। 

সমস্ত দিন বাড়ি নীরব নিস্তব্ধ ছিল। সন্ধ্যা নাগাদ কর্তা বাড়ি ফিরতেই দেখলুম চাকরবাকরেরা সব সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল—তারা ধোপদুরস্ত ধুতি আর তার ওপরে একটা করে সাদা আচকান চড়িয়ে নিলে। তারপর সবাই মিলে নীচে কর্তার বৈঠকখানার দিকে চলে গেল। 

একটু বাদেই বৈঠকখানায় অনেক লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগল। তিনটে চাকর চারদিকে ছুটোছুটি করে তাদের ফরমাশ খাটতে থাকল। আমি একবার বেরুবার অছিলা করে বৈঠকখানার দরজার পাশ দিয়ে চলে গেলুম। দেখলুম গোটা-তিনেক লোক বসে খুব উচ্চৈঃস্বরে আলাপচারি করছে। তাদের সামনে একটা বোতল, আর হাতে একটা করে গেলাস। কাতাপ্রসাদবাবু তাদের মধ্যে বসে আছেন–তাঁরও হাতে একটা গেলাস। ফিরে এসে আমি আমার ঘরে বসে রইলুম। হুল্লোড় ক্রমেই বাড়তে লাগল। তিনটে লোক মিলে দশজনের হল্লা করতে লাগল। চাকর তিনটের দম ফেলবার সময় নেই–তারা তাঁদের ফরমাশ খাটতে ইতস্তত ছুটোছুটি করছে। 

সময় কাটতে লাগল। খানিকক্ষণ বাদে, যে-লোকটা রাঁধত সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে এলো–রুটি আর একটি বড় বাটির এক-বাটি মাংস। সকালবেলা কিন্তু একজন চাকরই আমার খাবার এনেছিল। বুঝলুম এ-বেলা তার ফুরসত নেই। যে আমার খাবার এনেছিল তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম–নীচের বাবুরা সকলেই খেয়ে বাড়ি যাবে। তারা রোজ এখানে খায়। 

গোলমাল উত্তরোত্তর বাড়তেই লাগল। রাত্রি দশটা নাগাদ খুব চেঁচামেচি হচ্ছে শুনে নীচে গিয়ে দেখলুম, বাবুদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে–এবার বাড়ি যাওয়ার পালা। 

বাবুদের মধ্যে একটা রোগামতন লোক ছিল। দেখলুম সে কেবলই শুয়ে পড়ছে, আর একটা চাকর ক্রমাগত তাকে সিধে করবার চেষ্টা করছে। এমনি করে কিছুক্ষণ কাটবার পর বাবুদের তিনজনকেই এক-একজন করে চাকর বাড়ি পৌঁছে দিতে গেল। এটা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। 

পরের দিন নতুন-মা আমাকে বললেন–আমাদের বাবুজী বেশ ভালো লোক। ওই তিন ব্যাটাই অতি বদমাশ। এখানে এসে মদ খাবে, রুটি-মাংস খাবে আর বাবুজীকে চাকর-বাকরদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবে। 

আমি বললুম–ওই রোগামতন লোকটা সব থেকে বেশি গোলমাল করছিল। 

নতুন-মা বললেন–ওই হচ্ছে রামলগন ওই ব্যাটাই শয়তানের ধাড়ি! ওর বুকে একটা ছ্যাঁদা আছে। 

আমি বললুম–সেকি! কোথায়? 

তিনি বললেন–শুনেছি ওই যেখানে পাঁজর-দুটো মিশেছে, সেইখানে ছ্যাঁদা আছে, ভেতরের সব দেখা যায়। 

এরকম যে হতে পারে তা আমি আগে জানতুম না। নতুন-মা বললেন–হ্যাঁ। কিন্তু সমস্তক্ষণ ওই জায়গাটা আঠা-দেওয়া ফিতে দিয়ে ঢেকে রাখে। তার ওপর কক্ষনো জামা খোলে না। আমার এসব মোটেই ভালো লাগে না। 

যাই হোক, দিনকয়েক কেটে গেল। গোলমাল রোজই হয়। একদিন এক রাত্রে খুব একটা গোলমাল শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বাবুজীর গলা ও সেইসঙ্গে চাকরদের কান্না ও দৌড়ঝাঁপ শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলুম। দেখি বাবুজী এক-একটা চাকরের পিছনে দৌড়চ্ছেন আর ধড়াধ্বড় লাঠি মারছেন। এইরকম একতলা থেকে দোতলায়, অন্দর থেকে বাইরে চলতে লাগল। আমি তো দেখে-শুনে অবাক! 

এইরকম ছুটোছুটি করতে করতে হঠাৎ একবার বাবুজী উঠোনের নর্দমার কাছে পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়লেন, তারপরেই নড়নচড়ন বন্ধ। ওপর থেকে নতুন-মা কাঁদতে কাঁদতে নীচে নেমে এলেন। বাবুজীর মুখে-চোখে জলের ছিটে দেওয়া হতে লাগল। এর পর, যে চাকরদের তিনি এতক্ষণ ধরে ঠেঙাচ্ছিলেন, তারাই এসে সেই বিরাট দেহ চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। আমি, নতুন-মা আর ওরা, আমরা সবাই মিলে তাঁকে ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলুম। তখনও তাঁর জ্ঞান হয়নি; আমরা তার মুখে-চোখে জলের ঝাঁপটা দিতে লাগলুম। নতুন-মা মাথার কাছে বসে পাখা করতে লাগলেন। সময় বুঝে আমি সেখান থেকে সরে এসে নিজের ঘরে ঢুকলুম। 

এরপর থেকে নিত্যই এই হাঙ্গামা চলতে লাগল। একদিন, বেলা প্রায় দশটা, এমন সময় নতুন-মা আমাকে ডেকে বললেন–আমাকে তীর্থে নিয়ে যেতে পারবি? 

বললুম–হ্যাঁ পারব। কোন্ তীর্থে যাবেন? 

তিনি বললেন–মথুরা-বৃন্দাবন। আগ্রা দিল্লিও দেখব। তারপর কাশী-গয়া। সেখান থেকে দ্বারকা। প্রথমবারে এই ক’টা ঘুরে আসব। 

আমি বললুম–তা বেশ কিন্তু অনেক টাকা লেগে যাবে। 

তিনি বললেন–ওঃ, টাকা আমার ঢের আছে। তুই কি আমায় গরিব লোক বলে মনে করিস? এই বলে উঠে গিয়ে আলমারির ভেতর থেকে একটা আধ-হাত-টাক লম্বা চাবি বার করে সিন্দুকটা খুলে ফেলে আমাকে বললেন–এই ডালাটা তোল্। দিশি ছোট সিন্দুক হলে হবে কি–জিনিসটা খুবই ভারী। 

ডালাটা তুলতেই আমার চোখের সামনে রূপের ফোয়ারা খুলে গেল। দেখি, সিন্দুকের কানায় কানায় ভর্তি টাকা আর মোহরে জড়াজড়ি করে রয়েছে। এমন রূপ এর আগে কখনও দেখিনি। মাসির ওখানে সাদায় কালোয় জড়াজড়ি রূপ দেখেছিলুম–এখানে রুপো আর সোনায় জড়াজড়ি দেখলুম। 

আমি অবাক হয়ে দেখছি দেখে নতুন-মা বললেন–কি রে, নিবি? তোর যা দরকার তুলে নে। আমি বললুম–না, আপনি আমায় পঁচিশটে টাকা তুলে দিন। 

এই বলে আমি দুই হাত অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালুম। নতুন-মা গুনে গুনে পঁচিশটি টাকায় আমার অঞ্জলি পূরণ করে দিলেন। তারপর একখানি মোহর তুলে নিয়ে বললেন–এটাকেও রাখ্ 

আমি বললুম–না, না–এখন ওটা ওখানেই থাক্। দরকার হলে আমি চেয়ে নেব। তিনি অবহেলা-ভরে মোহরখানা সিন্দুকে ফেলে দিলেন। আমি কোঁচার খুঁটে টাকাগুলো বেঁধে সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করে দিলুম। তারপর নিজের ঘরে এসে ভাঙা প্যাঁটরায় একখানা ধোপদস্ত ধুতির খুঁটে টাকাগুলো বেঁধে রাখলুম। 

টাকাটা পাবার পর আর আমার মন সেখানে টিকছিল না। কিন্তু ওদিকে নতুন-মা আবার তীর্থে যাবার ঢেউ তুলেছেন, এদিকে আমার মহাতীর্থ কলকাতা আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে আরম্ভ করেছে। সেই কবে কৈশোরের প্রান্তে এসে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলাম এখন আমার বয়স উনিশ বছর। এই দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অনাহার, অনিদ্রা, অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগে আমার দিন কেটেছে। এর থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মনের মধ্যে হাহাকার উঠেছিল। কবির ভাষায় বলতে গেলে “চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা”। এবার কিছু পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। দেহমন আমার ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, কিছু বিশ্রাম চাই। কিন্তু পথের নেশা আমার কাটেনি, তাই সারাজীবন কখনও পথ কখনও পাথেয় –এরই সাধনা করেছি। পথের নেশা আজও কাটল না, ওদিকে পাথেয়ও কিছু সংগ্রহ হল না। 

যাই হোক, ঘরে বসে বসে ভাবতে লাগলুম–এখন এখান থেকে মুক্তি পাই কি করে? নতুন-মায়ের সঙ্গে যদি তীর্থ-দর্শনে বেরুতে হয় তাহলে ফিরতে সে তো ছ’মাসের ধাক্কা! কিন্তু যিনি অযাচিতভাবে আমার পাথেয় জুটিয়ে দিয়েছেন তিনিই অভাবিতরূপে অচিরে আমাকে মুক্তি দিলেন। 

আগেই বলেছি, বাক্সের মধ্যে টাকা রেখে আমি শান্তি পাচ্ছিলুম না–যখের মতো দিনরাত ঘরেই থাকবার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু থেকে থেকে নতুন-মা ডেকে পাঠান আর তীর্থযাত্রা সম্বন্ধে আমি কি করছি, তার খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু আমার কী-ই বা করবার ছিল? আমি একদিন বললুম–খরচের টাকার ব্যবস্থা করেছেন? 

নতুন-মা জিজ্ঞাসা করলেন–কত টাকা লাগবে? 

বললুম-তা হাজার-দুয়েক টাকা লাগতে পারে। পুরো না লাগলেও, কিছু টাকা কাছে থাকা দরকার। 

–তা হলে সিন্দুক থেকে দু’জনে গুনে হাজার-দুয়েক টাকা বাইরে বার করতে হয়। তাঁকে এ-কথাও জানালুম, নগদ হলে চলবে না। নোট নিতে হবে। 

নতুন-মা বললেন–বেশ, নোট-ও আছে আমার কাছে। বাবুজীর সমস্ত টাকা আমার কাছে থাকে। 

বললুম–তবে আর কি! দশটাকার নোটে দু’হাজার টাকা গুনে আলাদা করে রেখে দেবেন।

নতুন মা বললেন–আচ্ছা দেখ, দীপচাঁদ আমার সঙ্গে যেতে চাইছে। 

বললুম–বেশ তো, ভালোই হয় তাহলে। 

–আর পার্বতীয়ার ইচ্ছা সেও আমাদের সঙ্গে যায়। ওকে আমি নেব না–ভারী বজ্জাত মাগী।

বললুম–আপনাকে কিছু বলেছিল নাকি? 

–না, বলেনি। তবে আমি লোকের মনের কথা টের পাই কিনা! আর বাবুজীকেও এখনও বলা হয়নি। 

নতুন মা’র কথাগুলো কিরকম অসংলগ্ন মনে হতে লাগল। তবুও তাঁকে বললুম–বাবুজীকে বলে তাঁর অনুমতিটা নিয়ে রাখবেন। আমাদের তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে। 

পরদিন নতুন-মাকে জিজ্ঞাসা করলুম–বাবুজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন? 

তিনি কোনো জবাব দিলেন না। দেখলুম তাঁর মাথার চুলগুলি রুক্ষ, বোধ হয় তিন-চারদিন স্নান করেননি। আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলুম। 

ঠিক তার পরের দিনই দুপুরবেলা নতুন-মা’র ঘরের দিকে খুব একটা গোলমাল শুনে চমকে উঠলুম। শুনলুম পাৰ্বতীয়া চিৎকার করে কাঁদছে, সেইসঙ্গে নতুন-মা’র চিৎকারও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। চাকরবাকর ছুটোছুটি করছে। আমি একরকম দৌড়তে-দৌড়তে নতুন-মা’র ঘরে গিয়ে দেখি, সে এক বীভৎস কাণ্ড। ঘরময় রুটি তরকারি, থালা ছড়ানো। পার্বতীয়ার কপাল কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে। নতুন-মা’র দুই চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে, আর তিনি চিৎকার করছেন- হারামজাদী আমাকে বিষ দিয়েছিস! 

পাৰ্বতীয়া প্ৰাণপণে প্রতিবাদ জানাচ্ছে আর কাঁদছে। চাকরেরা তাকে ধরে নিয়ে গেল। নতুন-মা আমাকে বলতে লাগলেন–ওকে তীর্থে নিয়ে যাব না জেনে কতদিন থেকে আমাকে বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করছে– 

আমি দেখলুম, দস্তুরমতো ক্ষিপ্তাবস্থা। তখুনি মাসিকে খবর দেবার জন্যে একটি চাকর পাঠালুম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপচাঁদের মাসি এসে হাজির। নতুন-মা এতক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন চিৎকার করছিলেন, মাসিকে দেখেই একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। 

মাসি ঘরে ঢুকেই বোনকে জড়িয়ে ধরলেন। নতুন-মাও দিদিকে জড়িয়ে নীরবে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে নিঃশব্দ কান্না–তারপর একটু একটু করে কণ্ঠস্বর বাড়তে লাগল, শেষে চিৎকার করে মড়াকান্না জুড়ে দিলেন। 

ইতিমধ্যে দীপচাঁদ ছুটেছিল আদালতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বারজী এসে হাজির। বাবুজী এসেই ডাক্তারের কাছে লোক পাঠালেন। ডাক্তার এসে রুগি দেখেই বললেন–এঁকে পাগলাগারদে পাঠাতে হবে। চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে। 

বাবুজী তখুনি আগ্রায় গারদের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলেন। 

মাসি নতুন-মাকে চান করিয়ে, খাইয়ে সন্ধেবেলায় চলে গেলেন। সেইদিনই কান্তাপ্রসাদবাবুকে বললুম–এবার আমাকে বিদায় দিন। 

তিনি বললেন–না, না–তুমি যেও না। তোমাকে বিশেষ দরকার। তুমি আর দীপচাঁদ ওঁকে গারদে দিয়ে আসবে। তীর্থে যাবার নাম করে ওঁকে গাড়ি চড়াতে হবে। তুমি না থাকলে চলবে না। 

এই কার্যটি আমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিলুম, কিন্তু ঘুরে-ফিরে ঠিক আমার ঘাড়েই এসে পড়ল। 

ক্রমে তীর্থযাত্রার দিন এগিয়ে এল। 

নতুন-মাকে বললুম–আজ সন্ধ্যার গাড়িতে আমরা বেরুব তীর্থযাত্রায়। 

শুনে তিনি মহা উৎসাহিত হয়ে গান শুরু করলেন–”আয়ি বদরিয়া সাবন কি সাবন কি মনভাবন কি–” 

যাই হোক, সন্ধেবেলায় নতুন-মাকে নিয়ে ট্রেনে চড়লুম। কোনো গোলমাল না করে তিনিও আমাদের সঙ্গে ট্রেনে উঠলেন। সকাল প্রায় সাতটার সময় আমরা আগ্রা সিটি স্টেশনে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করলুম। নতুন-মা অদ্ভুত শান্তভাবে আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠলেন আর বৃন্দাবনের কথা বলতে লাগলেন। 

গাড়ি গারদে এসে পৌঁছল। গাড়ি থেকে নেমে দীপচাঁদ গারদের লৌহকপাটের কাছে গিয়ে খবর দিতেই একজন নারী-শাস্ত্রী বেরিয়ে এসে নতুন-মা’র হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালে। আমিও নেমে পড়লুম। 

নতুন-মা কোনো গোলমাল না করে সেই শাস্ত্রীর সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। মোটা-মোটা লোহার-রড দেওয়া লোহার কপাট, তার মধ্যে ছোট্ট আর-একটি সেইরকমই কপাট–তার ভিতর দিয়ে শাস্ত্রী নতুন-মাকে ভেতরে নিয়ে গেল। 

হঠাৎ কি মনে করে চারদিকে চেয়ে পোঁ করে তিনি সামনের দিকে ফিরে দু’হাতে দুটো লোহার রড ধরে তার ফাঁকে মুখ দিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলুম, তাঁর দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে। ভেতর থেকে শাস্ত্রী এসে আকর্ষণ করতেই তিনি ফিরে গুটগুট করে ভেতরের দিকে চলে গেলেন 

আজও কখনও কখনও কোনো শ্রাবণ-দিনের আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অকস্মাৎ আমার অজ্ঞাত মানসলোক থেকে দু’টি সজল চক্ষু চেতনালোকে ভেসে ওঠে। সে-দু’টি চোখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমার চক্ষুও অশ্রু-ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। 

এই অশ্রুতেই তো জীবনের শেষপাতার কালির আখর ধুয়ে দিয়ে রহস্যময় মৃত্যুর দেশে গিয়ে উপস্থিত হবার জন্য প্রস্তুত হই। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও ও-পারের রহস্যের যবনিকা উত্তোলিত হল না–ও-পারের ডাকের চিঠি এসে পৌঁছল কিন্তু চিঠির হরফ অজ্ঞাত রয়ে গেল। মানুষের অহমিকা তার কল্পনার আলোকপাতে সে-রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা করে–ফলে মণিরত্নের বদলে পায় ভাঙা শুক্তি-শামুক–পঞ্চভূতগত বা ভূতগত। 

.

সকলের জীবনেই অবশ্য এমন কিছু কিছু ব্যাপার ঘটে যা জীবনের অনুরূপ অথচ ঠিক এই জীবনের মানে দিয়ে তাকে বোঝা যায় না। তাতে মন ভরে না বটে, কিন্তু অবিশ্বাসের কালিমা কিছু ফিকে হয়ে আসে। আমার জীবনেও এমন দু’ একটি ঘটনা ঘটেছে। 

একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। 

.

আমাকে তখন দক্ষিণ ভারতবর্ষের এক দেশীয় রাজ্যে দিনকয়েক বাস করতে হয়েছিল। কারণ কর্মফল। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস নাগাদ গিয়ে কাজে যোগ দিলুম। স্টেশনে নামতেই রঙচঙে পোশাক ও বিরাট পাগড়িধারী একদল লোক আমাকে অভ্যর্থনা করলে। দেশীয় রাজ্য ঘুরে ঘুরে আমি ঝুনো হয়ে গিয়েছিলুম। এই রকম লাল-নীল আচকান ও পাগড়ি দেখা আমার অভ্যেস ছিল। কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম–আমার বাসস্থান কতদূর? 

তারা বললে–কাছেই। আপাতত একটা স্টেট-গেস্ট-হাউসে আপনার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। 

আমার সঙ্গে ওড়িশাবাসী পরিচারক শ্রীমান্ গোবিন্দ ছাড়া আর কেউ নেই। শ্রীমান্ গোবিন্দ তদারক করে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে তাদের জিম্মেয় দিয়ে আমার পেছু পেছু স্টেশন থেকে বেরুলো। স্টেশনের কাছেই বাসস্থান ঠিক হয়েছিল–হেঁটেই সেইটুকু রাস্তা পার হয়ে এলুম। 

একটা বড় মাঠের চারদিকে তার দিয়ে ঘেরা। ওরই মধ্যে কাঠের দুটো গেট, তাও ঝুলে পড়েছে। মাঠের মাঝখানটা বেশ উঁচু। এই উঁচু জায়গায় মানুষভর উঁচু পাথরের চাতালের ওপর পাথরের একতলা বাড়ি। পাঁচ-ছ’টা সিঁড়ি অতিক্রম করে ওপরে উঠে একটা চওড়া বারান্দা–তার তিন দিক ঢাকা, সামনের দিকটা খোলা। বারান্দার গায়েই দুটো বড় বড় ঘর–তার সঙ্গে এ-কোণে ও-কোণে চারদিকে আটটা-দশটা ঘর–পাথরের উঁচু দেয়াল, চাল খোলার। আমার সঙ্গে যেসব রাজকর্মচারী এসেছিল তারা বললে–ঘরগুলোয় সিলিং লাগানো নেই বটে, তবে সিলিং-এর অর্ডার হয়ে গিয়েছে। এখন দোকানদার কাপড় দিতে পারছে না, কাপড় পেলেই সিলিং হয়ে যাবে। 

দুটো বড় ঘরের পাথরের মেঝেতে মোটা শতরঞ্চি পাতা; খাট, মশারি, ইজিচেয়ার, টেবিল, চেয়ার–কোনো জিনিসেরই কমতি নেই। 

কিছুক্ষণ বাদে রাজকর্মচারীরা চলে গেল। আমার গোবিন্দ জিনিসপত্র সব তুলে এ-ঘরে ও-ঘরে গুছিয়ে রাখতে লাগল। রান্নাঘরে আমাদের জন্যে কিছু, কাঠকয়লা রাখা হয়েছিল, আসবার সময় চাল ডাল আলু পেঁয়াজ ইত্যাদি সব নিয়ে এসেছিলুম–গোবিন্দ মহা আনন্দে উনুন ধরিয়ে খিচুড়ি চাপিয়ে দিলে। 

আপিসে যাতায়াত আরম্ভ করলুম। আপিস থেকেই গাড়ি আসত, বাড়ি পৌঁছে দিত। দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার বৃষ্টি হয়। জায়গাটা পাহাড়ে–এমনিতেই ঠান্ডা, বর্ষার সময় বেশ ঠান্ডা পড়ে সবাই বলতে লাগল–এর চেয়েও ঢের বেশি ঠান্ডা পড়বে। আসলে এইটেই শীতকাল। 

আমি গরম কাপড়-চোপড় সবই বোম্বাইয়ে রেখে এসেছি, আর বেশি ঠান্ডা পড়লে কী যে করব বুঝতে পারছি না। এদিকে বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে একদিন গোবিন্দ বললে–মাংসের দোকান খুঁজে পেয়েছি আজ্ঞে। 

গোবিন্দ সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। কলকাতা ছেড়ে যখন বোম্বাই আসি তখন গোবিন্দ আমার কাছে এসে জোটে। জাতিতে করণ, মাতৃভাষা ওড়িয়া ছাড়া আর কিছুই জানে না। রোগা একহারা চেহারা, রঙ মোটামুটি কালো–বয়স পনেরো-ষোলো। একেবারে নিরামিষাশী বোম্বাইয়ে আসবার সময় ট্রেনে তার জন্য রাইস-কারি আনিয়েছিলুম। সে উৎসাহ করে খেলে বটে, কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শুরু করলে বমি। বোম্বাইয়ে আমি অন্তত একবেলা মাংস খেতুম, নিজেই রাঁধতুম, কিন্তু গোবিন্দ উৎসাহ করে আমার হাত থেকে রাঁধবার ভার কেড়ে নিলে। 

আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই দু’টি মুসলমান পরিবার থাকতেন–গোবিন্দ কি করে সে-বাড়ির বাবুর্চির সঙ্গে ভাব করে ফেললে। বাবুর্চিকে সে চাচা বলে ডাকত এবং তারই কাছ থেকে নানারকমের মাংস রান্না শিখত আর বাড়িতে এসে তারই মহড়া দিত। গোবিন্দ বলত–তার চাচা কলকাতার কোনো এক শৌখিন মহারাজের বাড়িতে বাবুর্চি ছিল। সেখানে প্রায়ই লাটসাহেব আসত খানা খেতে। সেই বাবুর্চির কাছ থেকে গোবিন্দ চপ-কাটলেট-বিরিয়ানি এবং আরও কয়েকরকম রান্না শিখে ফেললে। তরকারি তার মুখে আর রোচে না। 

দু’টি বেলা মাংস সেবন করে দেহটি তার বেশ পুষ্ট হতে লাগল। অবিশ্যি আমার পরিজনবৰ্গ এসে পড়ায় তার স্বাধীনতা কিছু খর্ব হয়ে পড়ল। কিন্তু রাঁধবার ভার সে কিছুতেই ছাড়বে না এবং তার হাতের রান্না খেয়ে এরাও যে-ক’দিন এখানে ছিল বেশ খুশিই ছিল। এখানে এসে গোবিন্দ একেবারে চারখানা হয়ে পড়ল! কোনো বাধা নেই, বলবার বা বারণ করবার কেউ নেই। নিজের ইচ্ছেয় বাজার করে, নিজের ইচ্ছেয় রান্না করে-এমনিভাবেই চলতে থাকল। 

এদিকে বৃষ্টি দিনে দিনে বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও বাড়ছে। আপিসে সবাই বলে–বর্ষাকাল পার না হলে এখানে কাজকর্ম কিছুই আরম্ভ হয় না। এক-একদিন ভোর থেকেই সাংঘাতিক বর্ষণ শুরু হয়। মেঘগর্জন নেই, আকাশ-অন্ধকারকরা মেঘসঞ্চার নেই, বিনা সমারোহে ঝরঝর করে শুধু ঝরেই চলে। এইসব দিনে ধরণী একান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে মেঘলোকের কাছে। কাজকর্ম সব বন্ধ, হাটবাজারও বসে না, ছেলেমেয়েরা ইস্কুল-কলেজে যায় না, দোকানদার দোকান খুলে বসলেও দোকানদারি করে না–কারণ খদ্দের নেই। এইরকম দিনে দ্বিপ্রাহরিক আহারাদি সেরে দরজার সামনে একটি ছোট ইজি-চেয়ার নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে পড়ি–কারণ আপিস থেকে গাড়ি আসবার তাড়া নেই 

চোখের সম্মুখে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিই। যতদূর দেখা যায়–ঝমঝম করে জল পড়ে চলেছে। রাস্তায় লোকজন তো দূরের কথা–গাড়ি পর্যন্ত চলছে না। একশ’ গজ দূরে একটা উঁচু টিলার ওপরে একখানা দু’চালার প্রকাণ্ড খোলার বাড়ি। দূর থেকে মনে হয় দু’দিকের চালা-দুটো যেন-মাটিতে নেমে এসেছে–যেন এক বিরাট কূর্ম হাত-পা-মুখ খোলের মধ্যে টেনে নিয়ে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজছে। 

উঁচু-নীচু মাঠের মাঝখান দিয়ে সরু একটুখানি সাদা পথ চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে। তারপরে কোথায় হারিয়ে গেছে। পথের কাঁকরগুলো বৃষ্টিতে ভিজেভিজে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। দূরে–অনেক দূরে যেন একটা আব্রোয়াঁর পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারই ভেতর দিয়ে পাহাড়ের সার দেখা যাচ্ছে আবছায়ার মতো। 

মনে পড়ে, প্রথম-যৌবনে বেকার অবস্থায় আমরা কয়েকটি বেকার বন্ধু মিলে কাব্যগ্রন্থ নিয়ে বসতুম। কোথা দিয়ে দিন-রাত্রি কেটে যেত–তা আর হুঁশ থাকত না। কোথায় গেল আমাদের সেই দিনগুলি! অতীতের গর্ভ থেকে সুরের রেশ কানে এসে লাগে–”এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়!” –“কারে’ বলা যায়? কৈশোর যৌবন অতীত হয়ে গেছে, মনে পড়ে না–আয়ু ঢলে পড়েছে প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তসীমায়। তবুও সেই ‘তারে’ পাবার আকাঙ্ক্ষায় অন্তর উন্মুখ হয়ে আছে। চিরবিরহী চিত্ত আমার ‘তারে’-র দেখা এখনও পায়নি। এই বাসনার বোঝা বুকে নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়িয়েছি! কত লোক বন্ধু হয়েছে কত অজানার সঙ্গে চিরপ্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি; কিন্তু ‘তারে’ পাবার আকাঙ্ক্ষা অনির্বাণ দীপশিখার মতো অন্তরে জ্বলছে। মনে হয়, হয়তো এ-জন্মে যার দেখা পেলুম না–পরজন্মে তার সঙ্গে দেখা হবে; কিন্তু তখুনি মনে হয়, পরজন্ম কি সত্যই কিছু আছে? 

প্রথম-জীবনে যে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই তা শিথিল হয়ে আসছে। কত আপনার জন, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়তম ভাই-বন্ধু চলে গিয়েছে– পরজন্ম যদি থাকত, সেখান থেকে কোনোদিনই কি আমার কাছে আসত না? এমন সংশয়ময় ঘননীল যবনিকা যদি ঘনতর হয়ে ওঠে তবে তো এ-জীবন বৃথাই কেটে গেল। ব্যর্থতার বেদনায় ব্যথিয়ে ওঠে মন–চোখ আপনি বন্ধ হয়ে আসে, তারই মধ্যে অশ্রুও এসে জোটে।…হয়তো এই পরম ক্ষণটিকে সমস্ত সত্তা দিয়ে উপভোগ করছি—-এমন সময় গোবিন্দর কর্কশ-কণ্ঠে চট্‌কান ভেঙে যায়–চা এনেছি আজ্ঞে—

 চোখ চেয়ে দেখি–ধূমায়মান পেয়ালা হাতে নিয়ে গোবিন্দ দাঁড়িয়ে আছে।

বলি–ওই বড় ইজি-টোয়ারটার হাতলে রাখ–আমি যাচ্ছি। 

উঠেই মুখে-চোখে জল দিয়ে চা খেতে বসলুম। বাইরে বৃষ্টি তখনও ঝরে যাচ্ছে–ঝর ঝর ঝর।

চা-পানের সঙ্গে সঙ্গে আবার সংসারক্ষেত্রে নেমে আসতে হল। হাঁক দিলুম-গোবিন্দ–গোবিন্দ– 

গোবিন্দর দেখা নেই। এখানে এসে অবধি আমার হয়েছে দিনান্তে গোবিন্দ, নিশান্তে গোবিন্দ দিনার্ধে গোবিন্দ, নিশার্ধে গোবিন্দ– 

গোবিন্দ ছুটতে ছুটতে এলো–আজ্ঞে– 

জিজ্ঞাসা করলুম–এ-বেলা কি পাকাচ্ছ? 

গোবিন্দ বললে–আজ্ঞে, এখনও বিষ্টি পড়ছে, বাজার তো বসেনি। 

জিজ্ঞাসা করলুম–আটা আছে? 

উত্তর হল–আছে। 

–আলু আছে? 

–আজ্ঞে হ্যাঁ। 

–প্যাজ আছে? 

–আছে আজ্ঞে। আদা-ও আছে।’ 

–তবে আর কি আজ্ঞে! আটার লুচি বানাও আর আলুর দম বানাও। তাড়াতাড়ি খেয়ে লেটিয়ে পড়া যাক। 

.

শ্রাবণ মাসের আর ক’টা দিন মাত্র বাকি। এখন বৃষ্টি অনেক কমেছে, তবু মাঝে মাঝে বড় জ্বালাতন করছে। এইরকম একটা দিনে ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে দেখি–মেঘ। বেশ জমিয়ে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আমিও চাদরখানা মুড়ি দিয়ে জমিয়ে আর-একটি ঘুমের জন্য তৈরি হলুম। বোধ হয় একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলুম–এমন সময় গোবিন্দর চিৎকার–উঠে পড়ুন আজ্ঞে, সব্বনাশ হয়েছে। 

ধড়মড় করে উঠে বললুম–কি হয়েছে রে? 

গোবিন্দ মেঝের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে–এই দেখুন। 

চোখ রগড়ে ভালো করে দেখলুম–মেঝেটা একেবারে কালো হয়ে রয়েছে। বাইরের জলধারার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে ঘরের মধ্যে শুঁয়োপোকার বৃষ্টি হচ্ছে। আর তাদের কী আকৃতি! মধ্যমাঙ্গুলির মতো লম্বা ও সেইরকম মোটা শুঁয়োপোকার বর্ষণ হচ্ছে চাল থেকে। 

গোবিন্দকে বললুম–শিগির ঝ্যাটা নিয়ে আয়। 

কিন্তু ঝ্যাটা আনতে যাবে কি করে? পা ফেলবার জায়গা নেই। বালিশের খোল দিয়ে শুঁয়োপোকা একটু একটু করে সরিয়ে পথ করে গোবিন্দ ঝ্যাটা নিয়ে এলো। কিন্তু পরিষ্কার করলে কি হবে, বৃষ্টি একসময় থেমে গেল কিন্তু শুঁয়োপোকার বর্ষণ থামল না। 

সেদিন আপিসে গিয়ে সকলকে এ-কথা বলতে তারা বললে–খোলার চালের বাড়িতে বর্ষাকাল ওইরকম হয়। দু’ চারদিন বাদেই থেমে যাবে। 

দু’ চারদিন খুবই জ্বালাতন করে শুঁয়োপোকারা নিরস্ত হলেন। 

শ্রাবণ-ভাদ্র কেটে গেল। আবার ঝকঝকে আলোয় ধরণী হাসতে লাগল। আমারও কাজের চাপ পড়ল। সকালবেলা উঠেই আপিসে চলে যাই, এসেই সন্ধেবেলায় খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় ঘুম। বেশ চলছিল। এমন সময়ে শহরে লাগল ‘মায়ের অনুগ্রহ’। 

আমাদের মধ্যে কয়েকজনের ওপর মায়ের দয়া হওয়ায় কাজ একদম বন্ধ হয়ে গেল। আবার 

এগারোটায় যাই, বিকেলবেলায় চলে আসি। দিন কাটে তো রাত কাটে না। গোবিন্দকে বললুম–হ্যাঁ রে, বাংলা শিখবি? 

সে জোর করে ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল–শিখব। 

–তা হলে আজই বাজারে গিয়ে একটা সেলেট আর সেলেট-পেনসিল কিনে আনবি। সেদিন থেকে রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর গোবিন্দকে বাংলা শেখাতে লাগলুম। গোবিন্দ বেশ মেধাবী ছাত্র–আমিও উৎসাহী শিক্ষক। 

এমন সময় একদিন- 

রাত্রি প্রায় এগারোটা হবে–আমাদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার কাজ শেষ হয়েছে–এবার বাতি নিবিয়ে শোবো। গোবিন্দ তার বিছানায় বসে, আমি আমার খাটে বসে–কালকের রান্না বা কি হবে, তারই কথাবার্তা হচ্ছে–এমন সময় দমাদ্দম করে জানলা-দরজা খুলে গেল। ঘরের বাতিটাও নিবে গেল। 

অন্ধকারে বসে ভাবতে লাগলুম–কি হল! প্রায় কুড়ি-পঁচিশ সেকেন্ড বাদে গোবিন্দকে ডাকলুম, কিন্তু গোবিন্দর কোনো সাড়া নেই। 

বিজলি-আপিসের কোনো গোলমালের দরুন বাতি নিবল কি-না ভেবে উঠে গিয়ে সুইচে হাত দিয়ে দেখলুম–সুইচটা বন্ধ করা রয়েছে। বাতি জ্বালিয়ে দিলুম। কিন্তু বাতি জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গে জানলা-দরজা ধমাস করে বন্ধ হয়ে গেল। খাটে গিয়ে বসেছি–এমন সময় আমার সামনের ঘরটায় আলো জ্বলে উঠল। গোবিন্দকে ডাক দিলুম–এই গোবিন্দ– 

সে বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে এসে আমার খাটটি ঘেঁষে দাঁড়াল। দেখলুম ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেছে।–ঠোঁট কাঁপছে। 

বললুম –কি রে, কি হয়েছে? 

সে বললে–আজ্ঞে, এ যে দেবতা আজ্ঞে- 

বেশ করে এক-পাত্তর হুইস্কি টেনে গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করলুম–গোবিন্দ একটু খাবি? 

সে বললে–না আজ্ঞে। 

ওদিকে দরজা খোলা-বন্ধ ও থেকে থেকে আলো জ্বলতে-নিবতে লাগল। গোবিন্দ তার বিছানাটা টেনে নিয়ে এসে খাটে ঠেকিয়ে বসে পড়ল। তাকে বললুম–তুমি শুয়ে পড়, আমিও শুয়ে পড়ি। ও-দরজা খোলা-বন্ধ হতে থাক্ আর আলো জ্বলুক-নিবুক, দেখা যাক্ কতদূর কি হয়! দু’জনে শুয়ে পড়লুম। দরজা কখনও বন্ধ হয়, কখনও খোলে–কখনও জোরে, কখনও আস্তে। শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *