প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৪.৬ হরিদ্বার থেকে গুরুদেব আসছেন

ইতিমধ্যে একদিন তিনি ঘোষণা করলেন, হরিদ্বার থেকে তাঁর গুরুদেব শিগগিরই আসছেন। লছমন-ঝোলার পারে হিমালয় পাহাড়ে তাঁর আস্তানা-স্বর্গদ্বারে। হরিদ্বারেও তাঁর আস্তানা আছে। গুরুদেবের নাকি অনেক বয়স হয়েছে। সে প্রায় দুশোর কাছাকাছি। শিগিরই তিনি দেহরক্ষা করবেন। তার আগে একবার নানান দেশ পরিভ্রমণ করছেন। 

গুরুদেব সম্বন্ধে আমরা অনেক আজগুবি খবর শুনতে লাগলুম। ইতিমধ্যে তিনি একদিন স্বয়ং এসে উপস্থিত হলেন। কর্তা নিজে গিয়ে তাঁকে স্টেশন থেকে নিয়ে এলেন। 

ছোট্টখাট্ট মানুষটি, মাথায় সামান্য জটা চুড়ো করে বাঁধা। গায়ে নতুন মার্কিনের ছোট্ট একটা চাদর, কোমর থেকে হাঁটু অবধি নতুন কাপড়ে ঢাকা। শুলুম গুরুদেব সাধারণত নেংটিই পরে থাকেন, জনসমাজে এলে ওইরকম বেশ ধারণ করেন। 

গুরুদেবের সঙ্গেই তাঁর একজন চেলা ছিল। চেলার বয়স অল্প। এই একুশ-বাইশ বছর হবে। মাথায় লাল-লাল লম্বা চুল। মনে হয় যেন মেহেদি মাখানো হয়েছে। অল্প দাড়ি, দেহ রোগা। 

কর্তা যে ঘরটায় থাকতেন, তার পাশে একটা ঘর ছিল। সেই ঘরে আগে থাকতে গুরুদেবের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কম্বল-পাতা, বালিশ-আনা ইত্যাদি সব তৈরি। গুরুদেব এসে অঙ্গ ও কটি থেকে নতুন বস্ত্র খুলে ফেলে কম্বলে বসে পড়লেন। একটু বারান্দা-মতো জায়গায় আমরা থাকতুম। তারই একপাশে চেলার থাকবার ব্যবস্থা হল এবং তারই এক কোণে ইট দিয়ে উনুন তৈরি করিয়ে গুরুদেবের রান্নার ব্যবস্থা করা হল। 

ভারতবর্ষে তখনো সন্ন্যাসীর ছিল একটা বিপুল আকর্ষণ। সন্ন্যাসীর আগমন-সংবাদ পেয়ে দলে দলে লোক আসতে আরম্ভ করল। তাদের সব পরে আসতে বলে তখনকার মতো তাড়িয়ে দেওয়া হল, কিন্তু বিকেল থেকে মেয়েদের আগমন আর বন্ধ করা গেল না। 

অধিকাংশ গুজরাটী মহিলা। এসেই লম্বা হয়ে প্রণাম করেই বসে পড়ে। সন্ন্যাসী গুজরাটী ভাষা জানেন না, তারাও হিন্দি ভাষা একবর্ণও বুঝতে পারে না। সন্ন্যাসী মাতৃমণ্ডলীকে সম্বোধন করে উপদেশ দেন। তারাও ঘাড় নেড়ে এমন ভাব দেখায় যেন সবই বুঝতে পেরেছে। এইসব মহিলাদের অধিকাংশই এই বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। সন্ন্যাসী দেখার পর্ব শেষ করে পুরুষেরা যেমন বাইরে যেতেন নারীরা কখনও তেমন করতেন না। তাঁদের কৌতূহল প্রবল। এই ঘরে কে শোয়, সন্ন্যাসী কি খান, কর্তা একলা শোয় কেন, বাড়ির গিন্নি কোথায় ইত্যাদি বলতে বলতে গিন্নির ঘরে ঢুকে গেলেন। দুই পক্ষেই কথা চলতে লাগল–এ গুজরাটীতে, ও বাংলায় : কেউই কারুর ভাষা জানে না–উত্তর-প্রত্যুত্তর চলতে লাগল। ওই ফাঁকেই একঝলক উঁকি মেরে রান্নাঘরের বৃত্তান্ত সব জেনে নিয়ে বাথরুমটাও দেখা হয়ে গেল। এইরকম প্রায় রাত্রি দশটা অবধি চলতে লাগল। 

সন্ন্যাসী আহার অতি স্বল্পই করতেন। সকালবেলায় এক পেয়ালা দুধ প্রায় আধঘণ্টা ধরে ধীরে ধীরে পান করতেন। তাঁর জন্যে একটা নতুন বাটলোই এসেছিল, তাইতে বিকেলবেলায় আশি তোলায় এক সের মোষের দুধ জ্বাল দেওয়া হত। রাত্রি দশটার সময় একখানি রুটি দিয়ে তিনি সেই দুধটুকু পান করতেন। চেলা-মহারাজকে রোজ সিধে দেওয়া হত। ডাল আটা ঘি তরকারি। 

সন্ন্যাসী রোজ বিকেলবেলা একটা বড় মার্বেলের আকারে হালুয়া খেতেন। একটা টিনের মধ্যে হালুয়া জমা করা থাকত, চেলা এসে খাইয়ে যেত। একদিন আমরা দু’জনে সেখানে উপস্থিত ছিলুম। বোধহয় তাঁর পদসেবা করছিলুম। তিনি টিন থেকে দুটো কাবলি মটরের আকারের হালুয়া নিয়ে আমাদের দু’জনকে দিয়ে বললেন–খা-খা। 

চমৎকার খেতে লাগল; আধঘণ্টার মধ্যে বেশ নেশা বোধ হতে লাগল। পৃথিবী রঙিন হয়ে উঠল। ওদিকে ক্ষিদেও বেশ চনচনে হয়ে উঠল। চেলার কাছে শুনলুম সেটা গাঁজার হালুয়া। চেলাকেও দেখতুম রোজ বেশ একটি বড় গুলি নিয়ে গালে ফেলতেন। 

আমরা দু’জনে সন্ন্যাসীর দুই পদ সেবা করতুম। সন্ন্যাসী বলতেন—এরা বড় প্রেমিক বালক। অবিশ্যি মিনিট পাঁচ-ছয় পা টিপিয়ে পরেই তিনি আদর করে আমাদের বলতেন, এবার যা, খেলতে যা। 

গুরুদেব আসার পর থেকে গিন্নি বিছানা ছেড়ে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে এসে বসতেন। গুরুদেব তখন বলেছিলেন–তোর ব্যায়রাম সেরে যাবে। কর্তাগিন্নির মুখে হাসি ফুটে উঠল। এই কমাসে তাঁদের মুখে হাসি ফুটে উঠতে কখনও দেখিনি। গুরুদেব গিন্নিকে প্রতি সপ্তাহে সোমবারে বারো ঘণ্টা মৌনী থাকতে বলে দিলেন। কিছুদিন হইহই হবার পর গুরুদেব চলে গেলেন পুণের দিকে। সেখানে উদাসীবাবার মঠে দিনকতক কাটিয়ে ফিরে যাবেন আবার তাঁর আশ্রমে। দিন-দশেক খুব হইহই হবার পর আবার সব ঠান্ডা হয়ে গেল। গিন্নি নিলেন আবার তাঁর বিছানা–কর্তা তাঁর সেই কোণটি। 

গুরুদেব বোধ হয় বুধবারে চলে গেলেন। গিন্নিমার মৌনী থাকার কথা আমরা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলুম। পরের সোমবার সকালে আমি রান্নাঘরে চা তৈরি করছি এমন সময় গিন্নির চ্যা-চ্যা চিৎকার কানে এসে পৌঁছল। ছুটে তাঁর কাছে যেতেই দেখি খাটের সামনে পরিতোষ উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে আছে আর গিন্নি চ্যাঁ-চ্যা করে চেঁচিয়ে ইশারায় তাকে কি বলবার চেষ্টা করছেন। অন্য অন্য দিন গিন্নি সকালবেলায় কথায় মাথায় একটা করে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা কইতেন, কিন্তু সেদিন সবটাই চন্দ্রবিন্দু শুনে মনে পড়ে গেল–আজ তাঁর মৌনী থাকার দিন। তখুনি ছুটে গিয়ে চা এনে দিলুম। চা দেখে তখনকার মতো চ্যা-চ্যা-করা থামালেন বটে, কিন্তু সেদিন সারাদিন তিনি ওইরকম চ্যা-চ্যা করে কাটালেন। মনে হল এরকম নীরবতার চেয়েও সানুনাসিক সরবতা যে ছিল ভালো। যাই হোক, বেলা পাঁচটার সময় তিনি মৌনতা ত্যাগ করলেন; তিনিও বাঁচলেন, আমরাও বাঁচলুম। 

এইরকম দু’তিন সপ্তাহ কাটাবার পর একদিন কর্তা জানালেন–যে-ক’টি মালদার লোককে বীমা করাবার চেষ্টা করছিলেন, সে-ক’টির বিষয়ে তিনি কৃতকার্য হয়েছেন। একদিন আপিস থেকে দু’টি-তিনটি বন্ধু নিয়েই তিনি বাড়ি ফিরলেন। তাদের মধ্যে সেই গাইয়ে ভদ্রলোকও ছিলেন। ঘণ্টা-দুয়েক খুব হুল্লোড় হল–ইরানীর দোকান থেকে চাঁদামাছ ও পাঁটার মাংস এলো। তারপর তাঁদের সামনেই আমাদের ডেকে কর্তা বললেন–একদিন বন্ধুবান্ধবদের ডেকে খাওয়াব। তোরা মাংস রাঁধতে পারবি? 

আমরা তো উৎসাহিত হয়ে উঠলুম। বললুম-আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব পারব। 

পাঁচ-ছয়জন লোক খাবে। ঠিক হল ইরানীর দোকান থেকে ভাজা মাছ কিনে আনা হবে আর মাংসটা ঘরেই রান্না হবে। পাঁউরুটি দিয়ে খাওয়া হবে; আর জারকরস বলো, সোমরস বলো, সে-তো আছেই। পাঁচ-ছ’জন নিমন্ত্রিত ও আমরা বাড়ির ক’জন। কত মাংস লাগবে হিসেব করে দেখা গেল অন্তত বোম্বাই দশ-সের মাংস আনতেই হবে। রাঁধবার পাত্র কোথায় পাওয়া যাবে? গুরুদেব যখন ছিলেন, তখন আমাদের ওপরতলার বাসিন্দে এক কর্তাগিন্নির সঙ্গে কিছু ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। বললুম–আলুর দম বানাব বলে একটা বড় পাত্র ওদের কাছ থেকে চেয়ে আনলেই হবে। তারপর ভালো করে মেজে দিলে কোনো গন্ধই থাকবে না। যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে আগে গিয়ে ওদের বাড়ির গিন্নির কাছ থেকে একটা বড় পাত্র চেয়ে আনা হল। আজকাল অ্যালুমিনিয়ামের যেমন গোল লম্বা চোঙের মতো ডেক্‌চি হয়েছে, সেইরকম একটা পেতলের ডেক্‌চি। ভেতর-দিকটা কলাই-করা। ওদের গিন্নি বলে দিলেন–দেখো কলাইটা যেন উঠে না যায়। 

সকালবেলা দুই বন্ধুতে গিয়ে মাংস কিনে আনলাম। কাপড়ে ও তার পরে কাগজে মুড়ে নিয়ে এলুম। সকালবেলা রান্নাবান্না শেষ করে মশলা বেটে দই নিয়ে এসে মাংসতে মসলার সঙ্গে মাখিয়ে চড়িয়ে দেওয়া গেল। এর আগে কিমা রাঁধার অভিজ্ঞতা ছিল-সে-সময়ে বিশেষ কিছু গন্ধ বেরোয়নি। কিন্তু মাংস চড়াবার কিছুক্ষণ পরে গন্ধে চারদিক ভরপুর হয়ে গেল। 

ঘণ্টাখানেক বাদে দেখি মাংসের ঝোল সাদা দুধের মতো হয়ে উঠেছে। একটুখানি চেয়ে দেখলুম দারুণ টক। তক্ষুণি তাতে কতকটা চিনি ঢাললুম–ঢেলে আবার চাখলুম; দেখলুম কিছু সাম্যভাব এসেছে বটে, কিন্তু মাংস সেদ্ধ হয়নি। 

পরিতোষ বললে–সুপুরি দিলে মাংস সেদ্ধ হয়। 

সুপুরি কোথায় পাওয়া যায়! পানের পাট তো বাড়িতে নেই। সংসার-খরচের টাকা আমাদের কাছেই থাকত। পরিতোষকে চার আনা দিয়ে বললুম–সুপুরি নিয়ে আয়। 

পরিতোষ পানওয়ালার দোকান থেকে একরাশ চিকিসুপুরি নিয়ে এলো। লাল-ট্রটকে তাদের চেহারা। সুপুরিগুলো ন্যাকড়ায় বেঁধে সেই পুঁটুলিটাও একটা ফালিতে বেঁধে মাংসের ঝোলে নামিয়ে দেওয়া গেল। দেখতে দেখতে সেই সুপুরির লাল রঙ বেরিয়ে মাংসের ঝোলের রঙ একেবারে খুনি লাল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি সুপুরির পুঁটুলি তুলে ফেললুম। মাংস ফুটতে লাগল কিন্তু সেদ্ধ আর হয় না! ওদিকে যত জল শুকোতে লাগল, ততই ঠান্ডা জল ঢালতে লাগলুম। পাঁচ-ছ’ঘণ্টা বাদ সেই অপূর্ব রান্না নামিয়ে আমরা হাঁপাতে লাগলুম। একটুখানি মাংস তারই মধ্যে চেখে ফেলা গেল–দেখলুম সেরকম মাংস জীবনে খাইনি! ইতিমধ্যে কর্তা একেবারে অভ্যাগতদের নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। সোডা আমরা আগেই এনে রেখেছিলুম, যজ্ঞ শুরু হতে বিশেষ দেরি হল না। মিনিট-দশেকের মধ্যেই চেঁচামেচি হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। 

অভ্যাগতদের মধ্যে জন-তিনেক বাঙালি আর দু’জন বোধ হয় মারাঠী ছিলেন। কাগজ ছিঁড়ে প্লেট তৈরি করে এক এক জনকে এক একটা মাছ দেওয়া হল। তাঁরা পরমানন্দে মাছের চাঁট দিয়ে আসব পান করতে লাগলেন। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই মাংসের তলব পড়ল। অতগুলো বাটি বাড়িতে ছিল না। পাত্র-অপাত্ৰ ঘটি-বাটি গামলা চায়ের পেয়ালা ইত্যাদি নিয়ে কোনোটিতে ঝোল কোনোটিতে মাংস নিয়ে দুই খানসামা ইন্দ্রসভায় গিয়ে উপস্থিত হলুম। পাত্রগুলি নামিয়ে রাখতে-না-রাখতে সপাসপ শুরু হয়ে গেল। আঃ উঃ–ইত্যাদি আরাম ব্যঞ্জক বিবিধ ধ্বনিতে গৃহ মুখরিত হয়ে উঠল। সকলেই বলতে লাগলেন–মাংস রান্না খুব চমৎকার হয়েছে। 

কর্তার বুক ফুলে দশখানা। তিনি বললেন–দুবেটা খায় বেশি বটে, কিন্তু রাঁধে যা ভাই—একেবারে অমৃত! 

আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে ধারণা ছিল তার উল্টো। আমরা খেতুম কম কিন্তু রাঁধতুম অতি বিশ্রী। কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্তার ডাক পড়ল। তিনি নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন–কি রে? আর আছে? 

নিজেদের জন্যে ও গিন্নির জন্যে খানিকটা মাংস আলাদা করে রেখেছিলুম। বললুম–সামান্য কিছু আছে। 

একজন অতিথি বললেন–তা হলে নিয়ে এসো সেটুকু। কার জন্যে রেখেছ? 

গিন্নিমাকে গিয়ে বললুম–আপনি এইবেলা খেয়ে নিন, না হলে কিছুই থাকবে না।

তাঁর জন্যে একটু রেখে বাকি সমস্তটি তাঁদের দিয়ে দিলুম। 

রাত্রি দশটা নাগাদ অভ্যাগতেরা চলে গেলে মাছের কাঁটা মাংসের হাড় যেখানে যত ছিল কাগজে পুঁটলি করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসা হল। মাছ কিংবা মাংস যেদিনে আসত সেদিনেই এই কার্যটি করতে হত। কয়েক টুকরো পাউরুটি পড়ে ছিল, তাই চিনি দিয়ে খেয়ে সে-রাত্রে শুয়ে পড়লুম। পরের দিন ভোরবেলা উঠেই ডেক্‌চি-মাজা শুরু হয়ে গেল। গন্ধ আর কিছুতেই ছোটে না। শেষকালে পাত্রটা উপুড় করে জ্বলন্ত উনুনের ওপর ধরতে মনে হল গন্ধটা চলে গেছে। ডেক্‌চিটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে এসেই ভাত চড়িয়ে দিলুম। মনে পড়ে সেদিনটা ছিল শনিবার। 

শনিবার দিন কর্তা একটু তাড়াতাড়ি আপিসে বেরুতেন। সেদিনও আমাদের তাড়া দিয়েছিলেন। ভাত আর একটু নিরামিষ তরকারি নামিয়ে ডাল চড়িয়েছি এমন সময় আমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যে খানিকটা জায়গা ছিল সেখানে বহুজনের গোলমাল ও বচসা শুনতে পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই শুনলুম আমাদের মনিব উচ্চকণ্ঠে আমাদের ডাকছেন। 

ডালটা তখনকার মতো নামিয়ে দু’জনে বাইরে গিয়ে দেখলুম বাড়িওয়ালা শেঠ ও ভাড়াটেদের অনেক স্ত্রীপুরুষ সেখানে এসে জমেছে। আমরা বাইরে যেতেই একজন সেই ভিড়ের থেকে বেরিয়ে এসে বললে–এই দুটোই কালকে মাংস কিনছিল। 

বাড়িওয়ালা শেঠ আমাদের মনিবকে বলতে লাগলেন–তুমি কথা দিয়েছিলে মাছ-মাংস তোমার এখানে হবে না; তাই তোমাকে বাড়িভাড়া দিয়েছিলুম। তুমি আজই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে চলে যাও। না হলে বিপদে পড়বে। 

কর্তা কাঁচুমাচু হয়ে বলতে লাগলেন–আমি তো সকালে আপিসে চলে যাই, ভিশিতে (হিন্দু হোটেলে) খাই। রাত্তিরে সেখান থেকেই আমার ও স্ত্রীর খাবার নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী রুগ্না। কোনোদিন খায়, কোনোদিন বা খায় না। এরা সারাদিন কি করে বলতে পারিনে তো! 

আমরা বললুম–মাছ-মাংস আমরা খাইও না–রাঁধিও না। 

আর একজন লোক বললে–এরা রোজ ইরানীর দোকানে ঢোকে। আমরা দেখেছি।

আমাদের মাথার ওপরে যে ভাড়াটেদের পাত্র আমরা নিয়ে এসেছিলুম তাদের বাড়ির কর্তার হাতে দেখলুম ডেক্‌চিটা রয়েছে। ইনি বললেন–এই পাত্রে মাংস রেঁধেছে, এখনও গন্ধ ছাড়েনি।

বাড়িওয়ালা শেঠ আমাদের কর্তাকে বললেন–এখুনি এদের তাড়িয়ে দাও। নচেৎ তুমি বিদেয় হও। 

আমাদের কর্তা বললেন–ওরা এখনও অভুক্ত আছে; আজই খেয়ে-দেয়ে চলে যাবে আপনাদের সামনেই বলছি- 

কর্তা আমাদের দিকে ফিরে বললেন-তোমরা আজই চলে যাও। 

এক মুহূর্তেই ভাগ্যের কাঁটা ঘুরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল–কিছুদিন পূর্বে মাংস খাওয়ার অপরাধে এক জায়গায় চাকরি গিয়েছিল। আজ মাংস রান্না করবার অপরাধে চাকরি চলে গেল। 

ফিরে এসে আধসেদ্ধ ডাল উনুনে চড়িয়ে দিলুম। কর্তা গোঁজ হয়ে চান সেরে গিন্নির ঘরে ঢুকে তাঁকে কি-সব বলে না-খেয়েই আপিসে চলে গেলেন। আমরা স্থির করেছিলুম বেলা তিনটে সাড়ে-তিনটের সময় চলে যাব। গিন্নিমাকে চান করে নিতে বললুম। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে চান করে খেয়ে নিলেন। ইদানীং সংসার-খরচের কিছু করে টাকা আমাদের কাছেই থাকত। তখনও গোটা পনেরো টাকা খরচ হয়নি। আমরা গিন্নিমাকে সেই টাকা ক’টা ফেরৎ দিতে গেলুম। তিনি বললেন–ও-টাকা তোদের কাছেই থাক। যদি কিছু দরকার লাগে খরচ করিস। স্নান সেরে খেতে বসেছি এমন সময় পিয়ন এসে প্রফুল্ল ঘোষের নামে একখানা খাম দিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি খুলে দেখলুম আগ্রা থেকে সত্যদা লিখেছেন–তোমরা কোথায় আছ? তোমাদের জন্য কাজ ঠিক করে রেখেছি, শিগগির এসে যোগ দেবে। 

আনন্দের চোটে ভালো করে খেতেই পারলুম না। 

আমাদের গ্যাড়াব্যাঙ্ক খুলে দেখা গেল সেখানে এই ক’মাসে প্রায় একশ’ তিরিশ টাকা জমেছে। তা ছাড়া গিন্নিমায়ের দেওয়া এই পনেরো টাকা যোগ হল। টাকাটা আধাআধি করে দু’জনের কাছায় বেঁধে নিলুম। জানি যদি চুরি যায় কিংবা কোনোরকমে খোয়া যায় তা হলে অন্তত অর্ধেক তো থাকবে! এই ক’মাসে আমাদের নিজেদেরও কিছু সম্পত্তি হয়েছিল। দু’খানা ছোট শতরঞ্চি, দুটো বিছানার চাদর, দুটো বালিশ, একজোড়া করে ধুতি আর দুটো জামা। আমরা ঠিক করেছিলুম রাত্তির ন’টায় জি. আই. পি.-র দিল্লিযাত্রীর গাড়িতে আগ্রায় যাব। বেলা তিনটের সময় আমাদের সম্পত্তি বাঁধা-ছাঁদা করছি এমন সময় ধপ ধপ করে কর্তা আপিস থেকে ফিরে এলেন। তিনি সিধে নিজের ঘরে না গিয়ে একেবারে আমাদের কাছে এসে বললেন –কি রে? তোরা যাবার জোগাড় কচ্ছিস? 

বললুম–হ্যাঁ। 

কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায় যাবি? 

কর্তার মুখ দিয়ে তখন ভুরভুর করে মধুর গন্ধ বেরুচ্ছে। বললুম–দেখি কোথায় যাই।

কর্তা একটুখানি চুপ করে থেকে ধরা-ধরা গলায় বললেন–তোদের বিনে দোষে তাড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কি করব বাবা–উপায় নেই। 

দেখলুম তাঁর দুই চোখে অশ্রু টলটল করছে। তিনি পকেট থেকে ব্যাগটা বার করে দু’খানা দশটাকার নোট আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–রেখে দে। যদি বোম্বাইয়ে থাকিস, তা হলে মাঝে মাঝে দেখা করিস। 

এই বলে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে গিন্নিমার ঘরে গেলুম। দেখলুম তিনি মুখে হাত দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছেন। বললুম–মা, আমরা যাচ্ছি। তিনি কোনো কথা বললেন না। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম; কিন্তু তখনও তিনি নীরব রইলেন দেখে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম। 

সারা জীবন তো চাকরি করেই খেতে হয়েছে। অন্যায়ভাবে তাড়িত হলেও এমন মনিব ও মনিব-পত্নী আর পাইনি। 

সেইদিনই রাত্রি ন’টার ট্রেনে দু’খানা রাজা-কি-মণ্ডির টিকিট কেটে আমরা আগ্রা রওনা হলুম। 

.

আগ্রায় পৌঁছে সত্যদাকে গিয়ে যখন প্রণাম করলুম তখন তিনি আমাদের দেখে কিছুই বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। দু’বছর আগে একদিন সেইভাবে অদৃশ্য হওয়ার কথা তো তুললেনই না, বরঞ্চ এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন কাল সন্ধেবেলাতেই আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়ে গেছে। 

সত্যদা বলতে লাগলেন–কোথায় থাকো? তোমাদের জন্য কাজকর্ম সব ঠিক করে রেখেছি আর তোমাদেরই দেখা নেই! এখন স্নান করে খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম কর-বিকেলবেলা তোমাদের কর্মস্থানে নিয়ে যাব। 

সত্যদার ওখানে একপেট ভাত ও মাছের ঝোল খেয়ে দ্বিপ্রহরে টেনে একটি ঘুম লাগানো গেল।

সন্ধেবেলা সত্যদার সঙ্গেই গেলুম আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মস্থলে। 

চশমার কারখানা। 

বলা বাহুল্য, সত্যদা যখন এর সঙ্গে জড়িত আছেন তখন বুঝতে হবে স্বদেশী চশমার কারখানা।

যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময় আমাদের দেশে কোনো কিছুই তৈরি হত না। দু’ একটা সাবানের কারখানা এখানে-সেখানে গজিয়ে উঠে কয়েক মাসের মধ্যেই ফেল্ পড়ছে। তখন দেশের এইরকম অবস্থা। অতি সুদূর প্রসারিত কল্পনাতেও দেশে ইঞ্জিন তৈরির কথা কেউ ভাবতেও পারেননি। 

স্বদেশী চশমার কথা শুনে সামান্য বিস্ময় প্রকাশ করা মাত্রই সত্যদা এক লম্বা লেকচার ঝাড়লেন। তারপর কতকগুলো ছোট ছোট ঢিপির মতো পাথর দেখিয়ে বললেন–এইগুলোর ওপর ঘষে ঘষে পাওয়ার দেওয়া হয়। 

আমাদের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছায়া ঘনিয়ে উঠতে দেখে সত্যদা হাঁক দিলেন–ফারজন্দ আলি! 

–আয়া হুজুর! বলেই ভেতরের ঘর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল। লম্বামতন, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স, চেহারা বেশ দৃঢ়, মুখ হাস্যময়। লোকটি এসে সেলাম করে দাঁড়াতেই সত্যদা বললেন–এই আমাদের ওস্তাদ। 

পরিচয় করিয়ে সত্যদা তাকে বললেন–বাবুরা এসেছে কলকাতা থেকে। এখানে যে পাথরে পাওয়ার দেওয়া হয় সে-কথা বিশ্বাসই করতে চাইছে না। 

ফারজন্দ আলি আমাদের উদ্দেশ করে বললেন–আর একটু বাদেই আমরা কাজ আরম্ভ করব। একটু অপেক্ষা করলেই আপনারা চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে পারবেন। 

সেকালে ‘ব্রেজিলের পাথরের চশমা’ নামে একটি বড়-গোছের ধোঁকা কলকাতায় চালু ছিল। পাথরের চশমা নইলে সেটা যে নিকৃষ্ট দরের চশমা হবে, এই আমরা জানতুম। কিন্তু পরে জানা গেল ওটা মস্ত ধোঁকা। 

পাথর কোত্থেকে আসে সে-কথা জিজ্ঞাসা করা মাত্রই সত্যদা আবার আরেকটা লেকচার দিলেন–ভারতবর্ষের নানান পাহাড়ে লক্ষ লক্ষ টন স্বচ্ছ পাথর রয়েছে। আমরা সেইসব জায়গা থেকে পাথর সংগ্রহ করি। 

কারখানা থেকে এবার আপিসে গিয়ে বসা গেল। আমাদের যিনি আসল মনিব, ধরা যাক তাঁর নাম হীরালাল–তাঁর আর কোনো কথা বলবারই দরকার হয় না। প্রতি কথাতেই সত্যদা একটা করে লেকচার দেন। 

অবশ্য সেই যুগই ছিল লেকচারের যুগ। স্বদেশী আমলে ছোট-বড় সকলেই লেকচার দিতেন। এঁদের অনেকের চাইতেই সত্যদা ভালো লেকচার দিতে পারতেন এবং মিথ্যেকথাকে গুছিয়ে সত্যের রূপ দেবার ক্ষমতা ছিল তাঁর অদ্ভূত। সেইখানে বসেই আমাদের চাকরি ঠিক হয়ে গেল। উভয়পক্ষে চিঠি বিনিময় হল এবং উপরি-পাওনার মধ্যে মনিবের বাড়িতে সান্ধ্য আহারের নিমন্ত্রণ পাওয়া গেল। 

সেদিন সন্ধ্যায় মনিবের বাড়িতে এক প্রায়ান্ধকার জায়গায় আমাদের জন্য আসন পাতা হল। সেখানে বসে গরম-গরম মোটা-মোটা পুরি, করলা, ওল ও উচ্ছের আচার দিয়ে ভোজন সমাধা হল। বোধহয় কিছু মিষ্টিও খেতে দিয়েছিল। 

একটা মেসে আমাদের থাকবার ও খাবার ব্যবস্থা হল। পরদিন থেকে আমাদের রীতিমতো তালিম দেওয়া হতে লাগল। সকালবেলা যাই–সত্যদা দশটা-এগারোটা অবধি তালিম দেন। তালিমের পর কারখানায় গিয়ে বসি। অন্যান্য ক্লাজ তো চলতই, সেইসঙ্গে আমাদের শিক্ষাও দেওয়া হত। একদিন লক্ষ পড়ল যে, কারখানার এক কোণে ছোট-বড় ক’টা টিনের ওপর একটি ভদ্রলোক ছবি এঁকে যাচ্ছেন–একই ছবি। ধুতি-পরা, কোঁচা উল্টে কোমরে গোঁজা, গায়ে শার্ট, এক কাঁধে চাদর ঝুলছে, এক হাতে একটা ছাতি, দাড়িওলা মূর্তি। এই এক ছবিই ভদ্রলোক এঁকে চলেছেন। তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারলুম তিনিও বাঙালি। জিজ্ঞাসা করলুম–এ কার ছবি আঁকছেন মশাই? 

ভদ্রলোক বললেন–এই তো বাবা, তোমাদের নেতাকে চিনতে পারলে না! এ হচ্ছে সুরেন বাঁড়ুজ্জের চেহারা। 

সুরেন বাঁড়ুজ্জের মূর্তির স্বদেশী চশমার ফ্যাক্টরিতে কি অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে তা চোখে না দেখে বিশ্বাস করা যায় না। শুনলুম এবং দেখলুমও। কতকগুলোতে লেখা রয়েছে– শ্রীসুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন : “এই চশমা স্বদেশে তৈরি হচ্ছে–এবং ইহা অতি বিশুদ্ধ ও পবিত্র!” শুনলুম প্রতিদিন ডজন ডজন এই প্ল্যাকার্ড চারিদিকে পাঠানো হচ্ছে এবং সেখানকার রাস্তায় রাস্তায় দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দেওয়া হচ্ছে। 

ইতিমধ্যে আমাদের চোখ-দেখা সম্বন্ধে তালিম দেওয়া হতে লাগল। বর্তমান সরকারি ভাষায় যাকে ‘প্রকৃষ্টরূপে প্রশিক্ষণ’ বলে তাই হতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে লেকচারের প্রশিক্ষণও চলতে লাগল। একরকম শ্রেণীর লোককে কিরকম ধাঁচের লেকচার দিলে কার্যকরী হবে, সত্যদা নিজে তার তালিম দিতে লাগলেন। আমার জন্য কোট-পেন্টুলান তৈরি হল–কালো কাপড়ের উপর সাদা-সুতোর ডোরা। যে কাপড়ের পেন্টুলান সেই কাপড়েরই কোট। শার্টের বদলে পাঞ্জাবি তৈরি হল যা ধুতিতেও চলবে, পেন্টুলানেও চলবে। একজোড়া জুতোও কেনা হল। যতদূর মনে পড়ছে ক্যানভাসের জুতো–একটাকা জোড়া। 

নানারকম পাথর-পূর্ণ বাক্স একটা দেওয়া হল। কোনোটা স্বচ্ছ, কোনোটা বা ঘষা কাঁচের মতো। প্রত্যেক পাথরের স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে। আর একটা বাক্স দেওয়া হল–তা লেন্স ও ফ্রেমে ভরা। এইসব সাজসরঞ্জাম নিয়ে একদিন সকালবেলা দুর্গা বলে যাত্রা করা গেল। 

.

বিকেল নাগাদ দিল্লি শহরে গিয়ে পৌঁছলুম। 

গ্রীষ্মকাল। শহর ঝিমিয়ে পড়েছে। 

ষাট বছর আগেকার দিল্লির সঙ্গে আজকের দিল্লির কোনো তুলনাই হয় না। 

তখনও দিল্লিবাসীর মন থেকে বাদশাহী নেশা একেবারে ছুটে যায়নি। তাদের আচারে ব্যবহারে তখনও বাদশাহী ঢঙের প্রাচুর্য আমার চোখে একটু অদ্ভুত ঠেকেছিল। 

স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে বাঁদিকে যে চওড়া রাস্তা একেবারে ফতেপুরী মসজিদের কাছে গিয়ে পড়েছে, তার মোড়েই পাশাপাশি যে-দুটো বড় সরাইখানা আছে তারই একটাতে গিয়ে আস্তানা গাড়লাম। 

এই সঙ্গে বলে রাখি, এর পরে সেদিন পর্যন্ত কতবার যে দিল্লিতে গিয়েছি তার ঠিকানা নেই। কিন্তু প্রতিবারই দেখেছি, সেই সরাইখানা তখনও রয়েছে। 

এখানে চার আনা দৈনিক হিসাবে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে জিনিসপত্তর তো রাখা গেল, কিন্তু ঘরের মধ্যে গরমে ঢেঁকা দুঃসাধ্য। সরাই-এর প্রাঙ্গণে অনেক দড়ির খাঁটিয়া পড়ে ছিল, সেখানে যার ইচ্ছা. সেই গিয়ে বসততা। আমি দরজায় তালা লাগিয়ে একটা খাঁটিয়ায় গিয়ে বসে পড়লুম। 

আজ ভারতবর্ষে যে-কোনো প্রদেশেই হোক না কেন, বাঙালিকে দেখলেই ‘মার জুতো–মার জুতো’ করে। সেদিন কিন্তু বাঙালির এ-অবস্থা ছিল না। তার ওপরে সদ্য ক্ষুদিরামের বোমা ফাটার জন্য বাঙালির খাতির চারদিকে খুবই বেড়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে বসতেই আমার চারপাশে লোক এসে বসতে লাগল। 

–বাবুজীর বাড়ি কোথায়? 

–বাংলার অবস্থা কিরকম? 

–কিরকম স্বদেশী চলছে?–ইত্যাদি নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়া বোমার কথা, আমাদের সামাজিক চালচলনের কথা–অনেক কিছুই আলোচনা হতে লাগল। আমার সামনের খাঁটিয়ায় সরাইয়ের মালিক এসে বসলেন। তিনি আমায় জানালেন যে আমি তাঁদের সরাইয়ে আসায় তাঁরা বেশ খুশিই হয়েছেন। 

কথাবার্তায় বেলা পড়ে এল। গ্রীষ্মকালের বিকেলবেলায় পশ্চিমে গরম অসহ্য হয়ে ওঠে। সবাইয়ের হাতে হাতপাখা ঘুরতে থাকে। 

সেইদিনই সন্ধেবেলায় কথাবার্তা যখন বেশ জমে উঠেছে এমন সময় একজন পাঠান এসে হাজির। মাথায় কুল্লা পাগড়ি ও পরিধানে শালোয়ার, ছ’ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। আমায় সেলাম করলে। আমি সেলাম করে অন্যদের সঙ্গে কথা বলছি এমন সময় সে বললে –বাবুসাহেব, আমাকে মনে আছে তো? 

আমি বললুম–কই, চিনতে পাচ্ছিনে তো। 

লোকটি মৃদু হেসে বললে–আজ চিনতে পারবেন কি করে? নেশা কেটে গিয়েছে যে!

আমি বিরক্ত হয়ে বললুম–কে তুমি, বলো? 

লোকটি হেসে বললে–কাল রাত্রে আপনি আমার কাছে শরাব কিনেছিলেন-ভুলে গেছেন? কথাটা শুনে ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করে উঠল। আমি হোটেলের মালিককে ডেকে বললুম–এই দেখুন, আমি তো এইমাত্র আপনার সরাইয়ে এসেছি, এ লোকটা কি বলছে শুনুন। আমার কথা শোনামাত্র আমার চারপাশের লোকেরা হো হো করে হেসে বললে –বহুরূপী হ্যায়–বহুরূপী। লোকটা আপনার কাছে কিছু চাইছে। 

আমার তখন রাগ চড়ে গিয়েছে। বললুম–একটি পয়সাও দেব না। 

সে-লোকটাও ছাড়বে না। শেষকালে সকলের কথামতো তাকে একপয়সা অর্থাৎ এক ডবল পয়সা দিয়ে নিশ্চিন্ত। 

কিন্তু নিশ্চিন্ত হবার জো কি? দিল্লি শহর। নতুন আগন্তুকের–বিশেষ করে সে যদি কোনো সরাই কিংবা হোটেলে আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে নানা উৎপাতে তার জীবনটি দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। অন্তত তখনকার রীতি এইরকম ছিল। 

বহুরূপী চলে গেল। সকলের কাছে কলকাতার ও বোমা ইত্যাদির গল্প করছি এমন সময় পেশোয়াজ-পরিহিতা এক তরুণী ঘুঙুর পায়ে ঝমঝম করে এসে আমার সামনে নাচতে ও সেই সঙ্গে গান গাইতে শুরু করল। সারেঙ্গীওলা পেছনেই ছিল। সেও ক্যা-অ্যাও করে সঙ্গত শুরু করে দিলে। 

আমি অন্যমনস্ক হবার ভান করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলুম, কিন্তু পরিত্রাণ কোথায়? চারপাশের লোকেরা বলতে লাগল–আপনার কাছেই এসেছে। 

তর্ক করে কোনো লাভ নেই বুঝেও আমি বললুম–একটি পয়সাও আমি দেব না।

শেষকালে চারটি পয়সা দিয়ে তবে রফা হল। চারটি পয়সা অর্থাৎ চার ডবল।

আর এখানে বসা উচিত নয় ভেবে হাত-মুখ ধুয়ে দিল্লি শহর দেখতে বেরিয়ে পড়া গেল। 

.

সে-সময় দিল্লিতে সৈয়দ হায়দার রেজার খুব নামডাক ছিল। তাঁর ‘আফ্‌তাব’ নামক কাগজে গভর্মেন্টের বিরুদ্ধে খুব কড়া সমালোচনা বের হত এবং বাংলাদেশের স্বদেশী আন্দোলনের অনুকূলে অনেক কিছুই তিনি লিখতেন। কাজেই সৈয়দ সাহেব পুলিশের চিহ্নিত ব্যক্তি। এই সম্পর্কে দু’একবার হয়তো তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছে। আমি আগ্রায় তাঁর নাম শুনেছিলুম এবং ‘আফ্‌তাব’ নামক পত্রিকায় তাঁর ঠিকানা জেনে নিয়েছিলুম। 

পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ‘আফ্‌তাব’ আপিসের দিকে রওনা হলুম। প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক ঘুরে ঘুরে একটা সরু গলির মধ্যে আক্তাব-আপিসে গিয়ে চড়াও হওয়া গেল। সৈয়দ-সাহেবের সঙ্গে সেইখানেই দেখা হল। বেঁটেসেঁটে রোগামতন লোকটি। বয়স তাঁর তিরিশের মধ্যেই হবে। আমি বাংলাদেশের লোক শুনেই যেন একটু বিশেষ রকমের খাতির করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায় আছেন? 

সরাইয়ে থাকি শুনে তিনি আঁতকে উঠে বললেন–ছি ছি, ওসব জায়গায় কোনো ভদ্রলোক থাকে? 

আমি বললুম–দিল্লিতে আমি কাউকে চিনি না, তাই বাধ্য হয়ে সরাইয়ে উঠতে হয়েছে। সৈয়দ-সাহেব বললেন–আপনার জিনিসপত্র সব এইখানেই নিয়ে আসুন। যদি আপত্তি না থাকে তা হলে এইখানেই থাকুন, আমার এখানে জায়গার অভাব নেই। 

সৈয়দ-সাহেবের পরিজনবর্গ থাকতেন অন্য মহল্লায় তাঁদের নিজেদের বাড়িতে। আর এই বাড়িটা হচ্ছে আপিস-বাড়ি। এখানকার একটা ঘরে একটা লিথোপ্রেস আছে–তাতে সাপ্তাহিক আফ্‌তাব ছাপা হয়। বাকি ঘরগুলো পড়েই থাকে। তিনি এই ঘরগুলোর মধ্যে একটা ভালো ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন–আপনার জিনিসপত্র এখুনি নিয়ে আসুন, আমি এখানে বেলা বারোটা অবধি আছি। আমি থাকতে থাকতে মালপত্র নিয়ে আসুন। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বাক্স ও বিছানা নিয়ে ফিরে এলুম। আমার জন্য একটা ঘর খুলে দেওয়া হল। ঘরের সামনে একটু বারান্দা। ঘরের ভেতরে যে নেয়ারের খাটটা ছিল সেটিকে বার করে দিয়ে বারান্দাতেই থাকবার ব্যবস্থা করে নেওয়া গেল। 

সৈয়দ সাহেব প্রেসের কয়েকজন লোককে ডেকে বলে দিলেন–ইনি এখানেই থাকবেন। বিধিমত যেন এঁর খিদমত করা হয়। 

যাবার সময় সৈয়দ-সাহেব হঠাৎ ফিরে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি খাওয়া-দাওয়া কোথায় করছেন? 

আমি বললুম–ওই ফতেপুরী মসজিদের দোকান থেকে মাংস-পরোটা কিনে নিয়ে গিয়ে তাই খেয়েছিলুম। 

সৈয়দ-সাহেব আঁতকে উঠে বললেন–ছি ছি, এ-কাজ আর করবেন না। ওখানকার খাবার খেলে দু’দিনে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনি ওখান থেকে খাবার কিনে খান–তা হলে আমার বাড়ির খাবার খেতেও বোধহয় আপনার কোনো আপত্তি হবে না। 

বললুম–কিছুমাত্র না। 

সৈয়দ-সাহেব বললেন–ঠিক আছে। ঠিক সময়ে আপনার জন্য খাবার আসবে। এই বলে তিনি বেরিয়ে চলে গেলেন। বেলা তখন প্রায় ন’টা। 

শুধু এক্ষেত্রে নয়। আমি আমার জীবনে বহুবার দেখেছি বিপদ যখন ঘনিয়ে আসে, সঙ্কটপূর্ণ আবহাওয়ায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে ওঠে, ঠিক সেই সময় মেঘদুয়ার মুক্ত হয়ে নেমে আসে আমার মিত্র, মা কিংবা ভাই। তার প্রশ্রয় হস্ত বিস্তারিত করে আমাকে রক্ষা করে। আজ মনে হচ্ছে দেশে দেশে কে ছড়িয়ে রেখেছে আমার বন্ধুর দল। নেয়ারের খাটে বসে এইসব নানা কথা চিন্তা করছি! 

বেলা তখন বেশি হয়নি। কিন্তু তা হলেও দিল্লির গ্রীষ্মকালে প্রভাতেই মনে হয় দ্বিপ্রহর। একবার উঠে বাইরে যাবার চেষ্টা করলুম কিন্তু গরমের চোটে ফিরে আসতে হল। বসে আছি, সৈয়দ-সাহেব চলে গেছেন অনেকক্ষণ। কিন্তু তখনও খাবারের কোনো চিহ্ন নেই। হঠাৎ চমক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে একটি লোক বারান্দায় এসে উপস্থিত হল। 

লোকটি বেশ লম্বা। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফে মুখখানা ভরা, মাথায় বাবরি চুল, গায়ে একটি সুতির শেরওয়ানি। তাতে লাল-নীল-সাদা-কালো নানা রঙের কাপড়ের তালি মারা, জামার একটা হাত ছিঁড়ে গিয়ে নীচের দিকে ঝুলছে। লোকটি গটগট করে এসে কোণে একটা মোড়া শতরঞ্চি ছিল ওটাকে পেতে বসে পড়ল। 

শতরঞ্চির মধ্যে একটা পোঁটলা-গোছের ছিল। সেটাকে খুলে খানকতক বই বার করে নিয়ে–সে তার মধ্য থেকে একটা বই বেছে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলে। 

আমি কিছুক্ষণ তাকে দেখে আবার আমার নিজের চিন্তায় মগ্ন হলুম। দু’দিন হল এখানে এসেছি–এখনও কাজকর্ম কিছুই আরম্ভ করতে পারিনি। 

এইসব ভাবছি এমন সময় হঠাৎ সেই লোক চিৎকার করে উঠে উর্দুতে কি সমস্ত বয়েৎ পড়তে আরম্ভ করলে। সেই অতি উচ্চ শ্রেণির ভাষার একটি বর্ণও আমার বোধগম্য হল না। তবে এটুকু বুঝতে পারলুম–অভিবাদন করছে। অর্থাৎ এতক্ষণ সে আমায় দেখতে পায়নি, এইবার তার চোখে পড়ায় সে আমায় অভিবাদন করলে। 

খানিক বাদে সে বললে-বাবুসাহেবের বাড়ি বাংলাদেশে তো? 

আমি বললুম–হ্যাঁ। 

সে বললে–কলকাতায় এখন খুব গোলমাল হচ্ছে শুনেছি। 

তখন কলকাতায় খুব স্বদেশীর হাঙ্গামা চলছিল। আমি বললাম –হ্যাঁ। 

সে বললে–বাবুসাহেব, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে আমাদের এই দিল্লিতে এই রকম স্বদেশীর হাঙ্গামা হয়েছিল। 

জিজ্ঞাসা করলুম–আপনি কি সে হাঙ্গামা দেখেছিলেন? 

সে বললে–না, আমি আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছে শুনেছি। তখন আমি জন্মেছিলুম বটে, কিন্তু সেসব কথা আমার স্মরণে নেই। 

কথাগুলো বলেই সে আবার পড়তে শুরু করে দিলে। 

সৈয়দ-সাহেব খাবার পাঠাবেন বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু খাবার পাঠাতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি খাটের ওপর শুয়ে পড়লুম। 

একটুখানি ঘুমের আমেজ এসেছিল, তারই মধ্যে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার শুনে চটকা ভেঙে গেল। দেখলুম, সেই ভদ্রলোক আগের মতোই হাঁটু গেড়ে দুই হাত আমার দিকে প্রসারিত করে আবার সেইরকম ভাষায় কি সব বলতে আরম্ভ করেছে। 

আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি ভেবে শুনতে লাগলুম তার সেই দুর্বোধ্য প্রশস্তি। ওরই মধ্যে একবার ‘খানা’, আরেকবার ‘ফরমাইয়ে’ শুনে উঠে বসলুম। 

দেখি মাথার কাছে একটি প্রিয়দর্শন বালক টিফিন-কেরিয়ারে করে আমার খাবার এনেছে। 

ছেলেটি দেখলুম খুবই চটপটে। 

আমি বসামাত্রই সে চারপায়ের ওপরেই দস্তরখান বিছিয়ে আমাকে খাবার পরিবেশন করলে। হাতে-গড়া রুটি, একটুখানি ডাল ও দু’রকম নিরামিষ তরকারি। অনেকদিন পরে বাড়ির খাবার খেয়ে ভারি তৃপ্তিবোধ হল। 

খাওয়া-দাওয়ার পর নিশ্চিন্ত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করলুম। সেদিনটা তো এমনি কেটে গেল। সৈয়দ সাহেব সেই যে সকালবেলায় চলে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি। 

রাত্রিবেলা যথারীতি খাবার এল। 

এবারে রুটি-মাংস। 

পরমানন্দে সেই খাদ্য শেষ করে বারান্দাতেই শুয়ে পড়া গেল। ছাপাখানার দু’একজন লোক দেখলুম এসে বারান্দার মেঝেতে শুলো। একবার মনে হল–একটা দিন কোনো কাজ হল না। কাল একবার কাজে বেরুতেই হবে। 

পরদিন সকালবেলা আবার সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে দেখা হল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–খাওয়া-দাওয়া-থাকার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? 

বললুম–মোটেই না, বরঞ্চ বেশ সুখেই আছি। 

একবার ভাবলুম–কাজকর্মের বিষয়ে কোনো সাহায্য করতে পারবেন কি না একবার জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু লজ্জা হল। বিশেষ করে তাঁর অযাচিত সৌজন্যের কথা স্মরণ করে। 

সৈয়দ-সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন–মীর-সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়েছে? 

বললুম–দুপুরবেলা যিনি এসেছিলেন, তাঁর নাম কি মীর-সাহেব? 

সৈয়দ-সাহেব বললেন–হ্যাঁ, তিনি। রোজ দুপুরবেলাটা এইখানেই কাটান। হালচাল একটু পাগলাটে ধরনের হলেও তিনি পণ্ডিত লোক। দিল্লি শহরের ইতিহাস তাঁর ভালো করে জানা আছে। আপনার সঙ্গে মিলবে ভালো। 

সৈয়দ-সাহেবকে বললুম–আজ এখন একটু কাজে বেরুব বলে মনে করছি। 

তিনি বললেন–হ্যাঁ, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে বেরিয়ে যান। ঠিক সময় আপনার খাবার আসবে। কিছু অসুবিধে হলে আমাকে জানাতে তকল্লুফ করবেন না যেন। 

কাজে তো বেরিয়ে পড়া গেল। 

একহাতে ব্যাগ, আর একহাতে কাঠের একটি সরু বাক্স। তার মধ্যে নানান নমুনার ফ্রেম আছে। শহরের রাস্তায় ঘুরতে লাগলুম। কোথায় যাই, কার কাছে যাই! সারে সারে সব দোকান। একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলুম, এমন সময় দোকানদার সামনে এসে বললে, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’ 

ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়েছিলুম। দোকানদার ডাকামাত্র ঘরে গিয়ে ফরাসে বসে পড়লুম। সে জিজ্ঞেস করলে–কি চাই, আপনার? 

আমি বললুম–আমার কিছু চাইনে। আমি চশমা ফেরি করি। আপনার চশমার দরকার আছে? 

সে বললে–না, না, আমার চোখ খুব ভালো আছে। আমি দিনের বেলাতেও তারা দেখতে পাই। 

বললুম–তা হলে তো চোখের অবস্থা খুবই খারাপ দেখতে পাচ্ছি। আপনার চোখটা–চশমা নেন না-নেন–একবার চোখ-দুটো পরীক্ষা করব? 

সে বললে- হ্যাঁ, হ্যাঁ–তাতে ক্ষতি কি? 

আমার কাছে চক্ষু পরীক্ষা করবার কার্ড ছিল। তাতে খুব ছোট অক্ষর থেকে বড় অক্ষর পর্যন্ত ছাপা। লোকটি কার্ডখানা হাতে নিয়ে দু’ তিনবার ঘাড় বেঁকিয়ে চতুর্থ স্তবক থেকে পড়তে আরম্ভ করলে। বললে–আগের তিনটি স্তবক কিছুই বুঝতে পারছি না। 

–এক্ষুনি বুঝতে পারবেন। বলে আমি জিজ্ঞাসা করলুম–আপনার কত বয়স হয়েছে?

সে বললে–পঁচাশ হুয়া। 

আন্দাজ করে তাকে পড়বার লেন্স দিলুম। খুশিতে মুখটা উদ্ভাসিত করে লোকটি বলে উঠল–হ্যাঁ, অব সব সাফ দিখাতা। 

যাই হোক, একটু নাড়াচাড়া করে তাকে লেন্স দিলুম। সে বললে–এবার বেশ পরিষ্কার দেখছি। 

তাকে বললুম–এবার অর্ডার দাও। 

দরদস্তুর ঠিক করে সে অর্ডার দিলে-আট আনা অগ্রিমও দিলে। তাকে রসিদ দিয়ে উৎসাহভরে আমি অন্য শিকারের সন্ধানে চললুম। 

ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করেও আর কারুকে বধ করতে পারলুম না। ওদিকে দিল্লির রোদ চড়বড় করে আকাশের মাঝখানে আসতে আরম্ভ করল, আমিও রণে ভঙ্গ দিয়ে চললুম বাসার দিকে। দিল্লিতে এসে একদিন মাত্র স্টেশনে ওয়েটিংরুমে ঢুকে স্নান করেছিলুম, এখানে আসবার পর দু’দিন অস্নাত অবস্থায় কেটেছে। তাই মনে করলুম আজ বেশ ভালো করে স্নান করা যাবে। বাসায় ফিরে দেখলুম সৈয়দ-সাহেব তখনও রয়েছেন। দু’একদিনের মধ্যেই তাঁর কাগজ বেরুবে কাজেই সেই সময়টা তাঁকে একটু ব্যস্ত থাকতে হয়। ওদিকে মীরসাহেব এসে গেছেন। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসে একমনে পড়ছেন। 

আমি জিনিসপত্র রেখে, জামা খুলে, তোয়ালে বার করে কলের দিকে আসছি এমন সময় সৈয়দ-সাহেব বললেন–কোথায় চললেন? 

আমি বললুম–দিন-দুয়েক স্নান হয়নি, আজ স্নান করব। 

সৈয়দ-সাহেব যেন আঁতকে উঠে বললেন–অ্যাঁ–বলেন কি! এখন স্নান করবেন? জলের অবস্থা দেখেছেন? কলটা খুলে একবার হাত দিন তো দেখি! 

কল খুলে হাতে জল দিয়ে দেখি–জলের বদলে তরল অনল বেরুচ্ছে! সৈয়দ সাহেব ললেন–আমরা সকালের দিকে জল তুলে রাখি, আর স্নান করি সেই রাত্রি দশটায়। 

এই অবধি বলেই তিনি চাকরদের হাঁক ডাক শুরু করলেন। দু’জন চাকর আসতেই তিনি হুকুম দিলেন–এক্ষুনি দু’ ড্রাম জল তুলে স্নানের ঘরে রেখে দাও। বাবুসাহেব রাত্রিবেলা স্নান করবেন। রোজ এঁর জন্য তোমরা সকালবেলাতেই জল তুলে রাখবে। ইনি আমার সম্মানিত মেহমান। সর্বদা এঁর খিদমতে হাজির থাকবে, আর যেন বলতে না হয়। 

তারপর মীর-সাহেবকে ডেকে বললেন–আমার এই মোনটির সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে? 

মীর-সাহেব বললেন–হাঁ, হাঁ, খুব। 

আমার দিকে ফিরে সৈয়দ সাহেব বললেন–দিল্লির ইতিবৃত্ত এঁর চেয়ে ভালো করে কেউই জানে না। 

তারপর মীর-সাহেবের দিকে ফিরে বললেন–আপনি আমার বন্ধুকে দিল্লি শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। 

মীর-সাহেব উৎসাহে একরকম লাফিয়ে উঠে বললেন–খুব — খুব। কালই আমার গাড়ি নিয়ে আসব, রোজই আপনাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দিল্লি শহর বেড়িয়ে আনব। 

সেদিন আরও কিছুক্ষণ গল্প করে সৈয়দ-সাহেব উঠে গেলেন। মীর-সাহেবের বক্তৃতার কিন্তু আর শেষ নেই। তিনি দিল্লি শহরের প্রশস্তি গাইতে লাগলেন–আপনি এমন শৌখিন লোক, অথচ কাল আমায় যদি বলতেন তা হলে কাল থেকেই কাজে লেগে যেতাম। কিন্তু যাক, কাল দুপুর থেকে আমরা কাজে বেরোব। 

সেদিনটা তো একরকম কাটল। পরের দিন খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু গড়াবার ব্যবস্থা করছি এমন সময় মীর-সাহেব হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন-দয়া করে তশরিফ তুলুন, আপনার গাড়ি হাজির। 

তশরিফ তুলে বাইরে দেখি এক অদ্ভুত জিনিস আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেটাকে গাড়ি বলব, না কী বলব–হাসব না কাঁদব, দস্তুরমতো বিড়ম্বনায় পড়া গেল। জমি থেকে হাত-দেড়েক উঁচু একটা তক্তা, তার নীচে চাকা বসানো। কোনো পুরাকালে একদা সেটি বোধ হয়. একটা এক্কা ছিল–এখন সেটি ফক্কায় দাঁড়িয়েছে। একটি ছাগলের আকৃতি ঘোড়া, দুটো বাঁশ দিয়ে তৈরি কম্পাস, জীর্ণ দড়ি ও জীর্ণ চামড়ায় গেরো বেঁধে বেঁধে তৈরি রাশ–এই হচ্ছে গাড়ির মাল-মশল্লা। ঘোড়ার কানের কাছে দু’দিকে দুটো ছেঁড়া ধুলধুকড়ি ন্যাকড়া ঝুলছে। সেই রকম ন্যাকড়া কম্পাসে ও আরও অনেক জায়গায় এখানে, ওখানে, সেখানে ঝুলতে দেখলুম। কাছে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করতে বুঝতে পারলুম, সেগুলো একসময় রঙিন কাপড়ের টুকরো ছিল এবং গাড়ি ও ঘোড়ার বাহার-স্বরূপে বাঁধা হয়েছিল। 

গাড়ির ছত্রী নেই। যে চারটে ডাণ্ডায় ছাত্রী লাগানো থাকে তাও নেই। অতএব কী ধরে যে গাড়িতে বসে থাকব আমার কাছে তা একটা সমস্যা হয়ে থাকল। 

গাড়ি ও ঘোড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গাড়োয়ানটির চেহারা। এদিকে মীর-সাহেব তো ‘তশরিফ রাখিয়ে’ ‘তশরিফ রাখিয়ে’ বলে তাড়া দিতে লাগলেন–তারপর নিজেই কিরকম করে রাস্তা থেকে লাফিয়ে উঠে ধপ করে গাড়িতে পড়লেন। কিন্তু আমি চাকার ‘গুলোতে পা দিয়ে এক হাতে গাড়োয়ানকে, অন্য হাতে মীর-সাহেবকে ধরে উঠে তো বসলুম। কিন্তু জায়গা এত সঙ্কীর্ণ যে তাতে তিনজনের সঙ্কুলান হয় না। তবুও যেখানে বসেছি সেই তক্তাটাকেই দু’হাতে ধরে রইলুম। ভাবলুম–রাস্তার লোকে হাসবে তো হাসুক এখন প্রাণটা বাঁচলে হয়। ওদিকে গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। 

ধীর সন্তর্পণে মরালগতিতে গাড়ির চাকা একবার এদিকে, একবার ওদিকে হ্যাঁকোচ-প্যাঁকোচ করতে করতে চলতে লাগল। চাক। তো চলতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে আমার অবস্থাও শোচনীয় হয়ে উঠল। সেই অল্প-পরিসর জায়গায় আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকবার উপায় নেই। মীর-সাহেবের মতন যে পা ঝুলিয়ে বসব তাও ভয়ে পারছিনে। ওদিকে মীর-সাহেব ক্রমেই ঠেলে ঠেলে আমাকে একেবারে ধারে এনে ফেলছেন। শেষকালে উবু হয়ে বসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলুম। কিন্তু তিনি মস্তলোক–তাঁর সেদিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। আমাদের গাড়ি চলতে লাগল চকের ভিতর দিয়ে। 

মনে করেছিলুম যে গাড়ি-ঘোড়া ও সওয়ারিদের অবস্থা দেখে রাস্তার লোক হাসাহাসি করবে, কিন্তু দেখলুম তারা কেউ ভ্রূক্ষেপই করছে না। দিল্লির এইসব রাস্তায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে-সব হাসিকান্নার স্রোত বয়ে গিয়েছে, যার নিশ্বাস এখানকার আকাশে-বাতাসে মিশিয়ে আছে, এখানকার পথের ধুলোর রেণুতে তা ছড়িয়ে আছে–দিল্লিবাসী সেদিনের জীর্ণতার মধ্যে পড়েও গত দিনের ঐশ্বর্য-সমারোহের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। কোথা দিয়ে একটা ভাঙা গাড়ি গেল কি না-গেল তা তারা গ্রাহ্যই করে না। আমাদের অশ্বিনীতনয় তাদের ঔদাসীন্যকে উপেক্ষা করে টুকটুক এগিয়ে চলেছে, এমন সময় হঠাৎ মীর-সাহেব প্রকাণ্ড এক চিৎকার দিলেন–রাক্কু-ও-ও-ও ও– 

ফট্ করে গাড়ি থেমে গেল। মীর-সাহেব লাফ দিয়ে পথে নেমে চিৎকার করতে লাগলেন–এই বাড়ি–এই বাড়ি– 

সেই দিবা-দ্বিপ্রহরে পথের লোক খুব কমই চলছিল। যা দু’একজন চলছিল তারা মীর-সাহেবের অভিনয় দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে পড়লুম 

সামনেই একটা বাড়ি। যতদূর মনে পড়ছে মোটা-মোটা থামও আছে সে-বাড়িতে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে। মীর-সাহেব বলতে লাগলেন–এই সিঁড়িতেই দিল্লির বাদশাহী শেষ হয়েছে। 

চুপ করে রইলুম। সিঁড়িতে বাদশাহী শেষ হয় কি করে তাই ভাবতে লাগলুম, এমন সময় মীর-সাহেব বলে উঠলেন–ভারতবর্ষের শেষ তিনজন রাজপুত্রকে হত্যা করে এই সিঁড়ির উপর ফেলে রাখা হয়েছিল দর্শনীয় বস্তুরূপে। 

বলতে বলতে মীর-সাহেব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে উঠতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন–হ্যারামজাদা মিছিমিছি বিনা-দোষে এই রাজপুত্রদের হত্যা করে এইখানে এনে ফেলে রেখেছিল। 

তিনি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সম্বন্ধে আরও অনেক সাংঘাতিক সাংঘাতিক কথা বলতে আরম্ভ করলেন। দিল্লি শহরে দিবা-দ্বিপ্রহরে সেই প্রচণ্ড রোদে তপ্ত পাথরের ওপর দিয়ে লোক-চলাচল তখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মীর-সাহেবের হালচাল দেখে দু’টি-একটি করে লোক দাঁড়াতে আরম্ভ করলেন। তিনি হয়তো মনে করেছিলেন–ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উবে গেছে, আবার মোগল যুগ ফিরে এসেছে। কিন্তু আমি তো কলকাতার লোক–আমি সে-কথা ভুলি কি করে! এবং এখানে দাঁড়িয়ে এইসব সাংঘাতিক বিশেষণাবলী শোনায় বিপদ আমারই সর্বাপেক্ষা বেশি। এই ভেবে মীর-সাহেবকে একরকম টেনে নিয়ে গাড়িতে চড়িয়ে দিলুম। 

গাড়ি মীর-সাহেবের নির্দেশক্রমে ঘুরে ঘুরে যে-পথ দিয়ে এসেছিল, আবার সেই পথ দিয়েই ফিরে চলল। কিছুদূর গিয়ে বাগানের সামনেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা ছোট্টমতো মসজিদ দেখিয়ে তিনি বলতে লাগলেন–এই সোনামসজিদে দাঁড়িয়ে নাদির শা এই মহল্লার হত্যাকাণ্ড দেখেছিলেন। প্রায় লক্ষ নরনারী ও শিশু হত্যা হবার পর দিল্লির বাদশা মহম্মদ শা মুখে কুটো নিয়ে হাত জোড় করে এসে নাদির শা-কে সেই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে অনুরোধ করায় নাদির শা-র হুকুমে সেই হত্যা বন্ধ হল। 

কিন্তু নাদির শা দিল্লি শহরের ছোট-বড় সমস্ত ‘রইস’-এর ওপর হুকুম জারি করলেন–তাদের ঘরে যত ধনরত্ন আছে সব নিয়ে আসতে হবে। দিল্লির বাদশাদের সাত-পুরুষ ধরে জমা-করা যে-সব ধনরত্ন দিল্লি ও আগ্রার দুর্গে জমা করা ছিল, সেইসব নিয়ে দিল্লির বাদশার একটি মেয়েকে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নাদির শা দেশে ফিরলেন। 

কিন্তু সে-সব ধনরাশি তিনি তাঁর দেশে নিয়ে যেতে পারেননি। পথে শিখ ও জাঠেরা সে-সব লুঠতরাজ করে নিলে। 

একে সেই প্রচণ্ড রোদ, তার ওপর কেঁপে-কেঁপে উঠে বলতে-থাকা মীর-সাহেবের মুখে এইসব বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে আমার চাঁদি গরুম হয়ে উঠতে লাগল। আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে বললুম–এবার চলুন যাওয়া যাক, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। 

আমার কথা শুনে তাঁর সংবিৎ ফিরে এল। তিনি গাড়োয়ানকে হুকুম দিলেন–ফিরে চল। বসায় ফিরে অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করতে লাগলুম। মীর-সাহেব কি সব বকে যাচ্ছিলেন–সেদিকে কান দেবার মতো সামর্থ্য আর খুঁজে পাচ্ছিলুম না। আমি সোজা লেটিয়ে পড়লুম। 

আমাকে শুয়ে পড়তে দেখে তিনি বললেন–আচ্ছা, আপনি আরাম করুন, আমি কাল বারোটায় গাড়ি নিয়ে আসব। 

মীর-সাহেব তো আমাকে আরাম করতে বলে চলে গেলেন–কিন্তু আমার মনে হতে লাগল, বুঝি সর্দিগর্মি হয়েছে। মাথার মধ্যে কিরকম যেন করতে লাগল। মনে হতে লাগল যে, দিল্লি শহরের অতীত ইতিহাসের সমস্ত ভূত আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। দেহের তো এই অবস্থা, আবার মনেও শান্তি পাচ্ছিলুম না, কারণ মীর-সাহেব বলে গেছেন–কাল বারোটার সময় আবার গাড়ি নিয়ে আসবেন। সময় বুঝে এক্ষুনি পালাতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত, কিন্তু শরীরের এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, ওঠবার মতন অবস্থা আর রইল না। বোধ হয় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম। 

.

সন্ধেবেলা উঠে ঠান্ডা জলে স্নান করে কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ হতে লাগল। প্রেসের দু’জন লোক এসে আমার কাছে শুয়েছিল, তাদের দেখে–যদিও তারা ঘুমিয়ে ছিল–আমার একটু ভর-সা হল। অনেকক্ষণ বাদে আমার খাবারটুকু খেয়ে–আবার লম্বা হওয়া গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *