৪.৬ শান্তিনিকেতন ও শিক্ষার দ্বন্দ্ব
শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা পুরনো অভিযোগ বহুদিন থেকে চলে আসছে। ওখানকার আশ্রম ও পরিপার্শ্ব সুন্দর, কিন্তু অবাস্তব। আমাদের হতশ্রী বৃহত্তর জগতের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে ছাত্রছাত্রীরা বাস্তবের মুখোমুখি হতে শেখে না। এই হল অভিযোগ।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা বিতৃষ্ণা কবির মনে ছেলেবেলা থেকেই জমে উঠেছিল। বলা বাহুল্য যে-সমাজ ও শিক্ষাপদ্ধতির বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ, শান্তিনিকেতনের শিক্ষায়তন তার অনুকরণে গড়ে তোলা হয় নি। বরং একটা আদর্শকে রূপদান করবার চেষ্টাতেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে আপ্রাণ নিযুক্ত করেছিলেন।
শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর কয়েকটি মৌল ধারণা ছিল। সেইসব ধারণার সঙ্গে অনেকেই অল্পবেশি পরিচিত। প্রকৃতির সঙ্গে সহজ যোগাযোগ মানবশিশুর পক্ষে স্বাভাবিক। সেই যোগ রক্ষা করেই শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। বিশ্বপ্রকৃতিতে প্রতিদিন নিয়মে বাঁধা অথচ অত্যাশ্চর্য কত ঘটনা ঘটে চলেছে। শুয়োপোকা থেকে যেন কোনো যাদুকরের। মন্ত্রে প্রজাপতি বেরিয়ে আসছে, পাখিরা আশ্চর্য নিপুণতায় বাসা বাঁধছে, মাটির তলার একটি মাটিরঙের বীজ থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর ডাকে সাড়া দিয়ে দুটি ছোট্ট সবুজ রঙের হাত তুলে শিশুগাছ জানিয়ে দিচ্ছে সে জেগে উঠেছে, আকাশের গায়ে সাতরঙা রামধনু আঁকা হচ্ছে, থমথম দুপুরের স্তব্ধতাকে চুরমার করে ঝড় ছুটে আসছে দিগন্ত থেকে। চোখ খুললেই বিস্ময়ের অন্ত নেই। এই সবের সংস্পর্শে শিশুমনের কল্পনা ও কৌতূহল দিনে দিনে বেড়ে ওঠে। এ থেকে বিচ্ছিন্ন করে যা কিছু শেখানো যায় সে সবই যান্ত্রিক, বিশ্বের সঙ্গে মানবহৃদয়ের যোগসাধনের শিক্ষা তাতে সম্পূর্ণ হয় না।
শুধু প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতা নয়, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন মানুষের একটি আত্মীয়সমাজ। সেই আত্মীয়তা রক্তের সম্পর্কে স্থাপিত নয়। বরং বিশ্বের নানা স্থান থেকে মানুষ এসে একটি উষ্ণ সহৃদয়তায় সংঘবদ্ধ হবে শান্তিনিকেতনের নীড়ে, এই ছিল কবির আশা। আত্মীয়সমাজের সঙ্গে যোগও শিক্ষার পূর্ণতার জন্য আবশ্যক।
দুঃখের আবরণ ভেদ করে মানুষ আবিষ্কার করতে চাইছে আনন্দকে। এটাই মানুষের শুদ্ধ স্বভাব। আনন্দ থেকেই সৃষ্টি। এইরকম রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন। আনন্দ বলতে এখানে বুঝতে হবে মিলনের আনন্দ, পীড়ন করে যে সুখ তার মূলে থাকে স্বভাবের। বিকৃতি। শান্তিনিকেতনের সাংবৎসরিক জীবনধারায় তাই মেলা ও ঋতু-উৎসবের একটা বিশেষ স্থান আছে। মেলা বলতে শুধু বেচা-কেনা নয়, মানুষে মানুষে মিলনের একটা ক্ষেত্র। ঋতু-উৎসবের মূল কথা, প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে মানুষের হৃদয়কে মিলিয়ে তারই আনন্দিত উচ্চরণ। আমাদের দেশে পুজোপার্বণের অভাব নেই। সেই সবের সঙ্গে কিন্তু সম্প্রদায়বিশেষের ধর্মের একটা যোগ স্থাপিত হয়ে গেছে। সাংবৎসরিক উৎসবকে সাম্প্রদায়িক ভেদ থেকে যথাসম্ভব মুক্ত করে শুদ্ধ আনন্দের প্রকাশরূপে তাকে সর্বমানবের জন্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ইস্কুল’ নামক জিনিসটাকে তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। তাঁর শিক্ষাদশের কেন্দ্রে আছে মানুষের আনন্দের সাধনা।
প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্ন এই যে আত্মীয়সমাজ আর উত্সবে অনুষ্ঠানে বৈশিষ্ট্যময় জীবনযাত্রা, আমাদের পরিচিত কলুষিত সংসারের সঙ্গে তার প্রভেদ অনেকখানি। আর এই থেকে আসে সেই পুরনো অভিযোগ, প্রথমেই যার উল্লেখ করেছি। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের তো ছড়িয়ে পড়তে হবে বাইরের জগতে, অন্তত অধিকাংশের পক্ষে আজীবন আশ্রমে বাস সম্ভব নয়। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা কি তাদের প্রস্তুত করতে পেরেছে বাইরের সেই জগতের নানা বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আত্মরক্ষার জন্য?
এখানে মূল প্রশ্নটা আসলে শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলি। অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলবার একটা ক্ষমতা অধিকাংশ মানুষের ভিতরই থাকে। সেই ক্ষমতাটাকে আরো একটু শিক্ষিত করে তোলাটাই কি শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য? না একটা আদর্শের সঙ্গে প্রাণের পরিচয় ঘটানো, সেই আদর্শ অনুযায়ী নিজেকে ও পরিপার্শ্বকে নতুন করে রচনা করবার আকাঙ্ক্ষা জাগানো, শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য? শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা, যারা নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, পরিপার্শ্বের সঙ্গে তারা সংগ্রাম করতে পারেনি, এমন প্রমাণ যথেষ্ট নেই। জীবনের নানা ঝড়ঝাঁপটার মধ্যেও শান্তিনিকেতনের শিক্ষা তাঁকে আত্মস্থ থাকবার শক্তি দিয়েছিল, এইরকম বলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কথাটা কি একেবারে ভুল? অক্সফোর্ড হোক নালন্দা হোক, পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থান সংসারের কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে। আজকের বাস্তবের অনুকরণে গঠিত হতে পারে না কোনো আদর্শ বিদ্যালয়।
তবু কথা ফুরোয় না, কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। বাঁচবার জন্য একটা জীবিকা চাই। ছাত্রছাত্রীরা যদি আত্মনির্ভর হতে চায় তবে তাদের কোনো না কোনো বৃত্তিতে পটুতা অর্জন করতে হবে। শান্তিনিকেতন কি এদিকে মনোযোগ দিয়েছে? প্রশ্নটা আরো একটু বিশদভাবে আলোচনার যোগ্য।
.
(খ)
ব্রিটিশ আমলে এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে চাকরির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। উনিশ শতক থেকে শুরু করে দেশের শাসনযন্ত্রে বিভিন্ন স্তরে কেরানী থেকে। ডেপুটি পর্যন্ত যেসব কর্মচারী প্রয়োজন হয়েছে তারা এই ইংরেজি স্কুল-কলেজ থেকে পাশ করা ছেলেমেয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরেক কাজ শিক্ষক তৈরি করা। তা ছাড়া ডাক্তার উকিল ইঞ্জিনিয়ার এইসবও প্রয়োজন। এদেশের নতুন মধ্যবিত্ত বাবুসম্প্রদায় ইংরেজি। শিক্ষাব্যবস্থারই সন্তান।
কর্মচারী তৈরি করা শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল না। উকিল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করবার কলেজ এখনো সেখানে হয়নি। সেই অর্থে বিশ্বভারতী একটি অসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় বলা ভালো, শন্তিনিকেতন পরিচিত ছাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে চায়নি। ব্রহ্মচর্যবিদ্যালয় দিয়ে ওখানকার শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন শিক্ষাদর্শের সঙ্গে এই ব্রহ্মচর্যবিদ্যালয়েরই সামঞ্জস্য সবচেয়ে বেশি। পরে। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতজনকে আমন্ত্রিত করা, পূর্ব ও পশ্চিমের ভাষা ধর্ম ও ইতিহাসে আগ্রহী কিছু গুণী মানুষের জন্য একটি মিলনক্ষেত্র প্রস্তুত করা, বিশ্বসংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যের ভিতর ঐক্যের সন্ধান করা, এই ছিল সেদিনের বিশ্বভারতীর একটি প্রধান লক্ষ্য। তা ছাড়া শান্তিনিকেতনের আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল সঙ্গীত সহ তার কলাভবন। তারও মূল সুর সমন্বয় ও সৃজনধর্মিত।
তবু চাকরির প্রশ্নটাকে শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই ডিগ্ৰীলাভের ব্যবস্থা হল। আর এই উদ্দেশ্যে যোগ স্থাপন করতে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এইবার শুরু হয়ে গেল শান্তিনিকেতনে দুই অসমঞ্জস ভাবের এক অস্থির সহাবস্থান। ডিগ্রীর সঙ্গে সঙ্গে গতানুগতিক পাঠ্যবস্তু, পরীক্ষাব্যবস্থা আর চাকরির বাজারের সঙ্গে যোগ একই সূত্রে এইসব এসে গেল। এইসবের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের মূল আদর্শের কোনো মিল ছিল না। শান্তিনিকেতনের মাটি থেকে এরা বিশেষ পুষ্টিলাভ করতেও পারেনি। বিদ্যাভবন বা শিক্ষাভবনের ডিগ্ৰীসংলগ্ন গতানুগতিক বিভাগগুলি তেমন উৎকৃষ্ট নয়। এদিক থেকে সমালোচকদের অভিযোগ একেবারে অবাস্তব নয়।
তবে কি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় জীবিকার প্রয়োজনের দিকটা উপেক্ষিত ছিল? তাও কিন্তু নয়। রবীন্দ্রচিন্তার এই দিকটা বুঝতে হলে আমাদের দৃষ্টি ঘোরাতে হয় প্রধানত শ্রীনিকেতনের দিকে। সেইখানে গড়ে উঠেছিল পল্লীসংগঠনবিভাগ। চাকরিজীবী নব। মধ্যবিত্তের জন্য নয়, পল্লীর দরিদ্র মানুষের জীবিকার প্রশ্ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার অন্ত। ছিল না। কবির পুত্র নিযুক্ত ছিলেন গ্রামীণ শিল্পের উন্নতির কাজে। এটা সম্ভব হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের নিজেরই আগ্রহে। কৃষি, সমবায় ও গ্রামীণ শিল্প নিয়ে তিনি যে-পরিমাণ চিন্তা করেছিলো সেটা তাঁর সমান কোনো কবির কাছে একেবারেই আশা করা যায় না। বস্তুত এসব ক্ষেত্রে তিনি এদেশের অগ্রণী নেতা ও চিন্তকদের ভিতর পড়েন।
এ বিষয়ে তাঁর চিন্তার ধরনটা প্রথমে বুঝে নিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে শিল্পসদনের কথা ধরা যাক। শিল্পসদন হবে একটি উৎপাদনকেন্দ্র যাতে গ্রামের কিছু মানুষ বাঁধাধরা চাকরি পাবে, রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনার মূলকথাটা এইরকম ছিল না। পল্লীবাসী নিজ পল্লীতেই শিল্পকর্মে নিযুক্ত থাকবে। সেখানে তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে উন্নত শিল্পকৌশল। যেমন চাষী নিযুক্ত থাকে কৃষিকর্মে নিজ গ্রামে, সেখানেই উন্নত চাষপ্রথা সম্বন্ধে জ্ঞান, কৌশল ও উপকরণ পৌঁছে দেওয়া আবশ্যক। শিল্পসদনের প্রধান কাজ হল গ্রামীণ শিল্পের ক্ষেত্রে বিদ্যা ও কৌশলের এই সম্প্রসারণ। প্রয়োজনমতো সমবায়ের সাহায্যও নিতে হবে। চাকরির সংখ্যা বাড়িয়ে গ্রামের আর্থিক সমস্যা দূর করা যাবে না। গ্রামোন্নয়নের জন্য চাই ভিন্ন পথ। শিক্ষা স্বাবলম্বন সমবায়, এইসবের ওপর রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন।
পল্লীসংগঠনবিভাগের কাজে প্রথম দিকে সুফল দেখা গিয়েছিল। রথীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে স্থানীয় গ্রামীণ শিল্পে কিছু উল্লেখযোগ্য নতুনত্ব দেখা যায়। কিন্তু সেই ধারা স্থায়ী হয়নি। শান্তিনিকেতনী শিল্পদ্রব্য এখন কলকাতায় তৈরি হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শ্রীনিকেতন পিছিয়ে যাচ্ছে। শিল্পসদনে আন্দোলন হচ্ছে স্থায়ী চাকরির দাবি নিয়ে। গ্রামে স্বনিযুক্ত বৃত্তি এবং উন্নত ধরনের উৎপাদন নয়, বিশ্বভারতীতে সরকারি টাকায় স্থায়ী চাকরির প্রতি গ্রামবাসীর প্রধান আকর্ষণ। রবীন্দ্রনাথের ‘পল্লীসঞ্জীবনী’ সাধনা ব্যর্থতায় আক্রান্ত।
শ্রীনিকেতনের নিজস্ব বিদ্যালয় শিক্ষাসত্র। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আসছে শহরের পরিবার থেকে। শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রী প্রধানত গ্রামবাসী। এদের সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমি আলাদা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, এদের শিক্ষা দিতে হবে গ্রামের জীবনের প্রয়োজনের সঙ্গে যোগ রক্ষা করে। তা নইলে শিক্ষার সঙ্গে অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্য থাকবে না, ফলে বিদ্যা আবারও হয়ে উঠবে কৃত্রিম বাইরের জিনিস। কিন্তু শিক্ষাসত্রের আদর্শ রক্ষা করে শিক্ষাবিতরণ করবার মতো শিক্ষকেরও অভাব আছে। এইখানে অন্য এক দ্বন্দ্ব। শহরের টানটাই বড় হয়ে উঠছে। এটা আশ্চর্য নয়, তবু দুঃখজনক।
.
(গ)
শিক্ষানীতির সঙ্গে অর্থনীতির একটা সম্পর্ক আছে। সেইদিকে আবারও একটু দৃষ্টিপাত করা যাক
আমাদের অর্থনীতি দুই ভাগে বিভক্ত দুয়ের ভিতর বিভেদ কিছুতেই দূর করা যাচ্ছে। একদিকে অনেকটা আধুনিক ধাঁচের সংগঠিত বৃত্তখণ্ড; অন্যদিকটা পুরনো ধাঁচের, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও অসংগঠিত। একদিকে বিমানযান, অন্যদিকে গোরুর গাড়ি। এই ভেদটা আরো বহুকাল চলবে, এর একটা সহজ কারণ আছে। অর্থনীতির আধুনিক বৃত্তখণ্ডে পুঁজির ঘনত্ব বহুগুণে বেশি, অর্থাৎ শ্রমিকপিছু পুঁজি লাগছে অনেকখানি। এক একটি বিমানবন্দরের খরচ অনেক, সেই তুলনায় কর্মী অথবা শ্রমিকের প্রয়োজন কম। আমাদের সীমাবদ্ধ পুঁজি নিয়ে অর্থনীতির আধুনিক খণ্ডে এদেশের বৃহৎ ও দ্রুত বৃদ্ধিশীল। শ্ৰমিকসংখ্যার অল্প অংশকেই নিয়োগ করা সম্ভব। অধিকাংশকে জীবিকা খুঁজতে হচ্ছে অর্থনীতির দরিদ্র ও অসংগঠিত অংশে। কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পের মতো অতিপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম এই সাবেকী অংশেরই অন্তর্ভুক্ত। প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা, বৃহৎ শিল্প, বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, এইসব নিয়ে অর্থনীতির আধুনিক অংশ। যেটা আধুনিক সেটার প্রচার বেশি; যেটা সাবেকী সেটার প্রসার বেশি, যদিও তার অনেকখানি বাইরের জগতের চোখের আড়ালে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মনোযোগ প্রধানত অর্থনীতির সংগঠিত এবং আধুনিক অংশের প্রতি নিবন্ধ। এইখানে অতি বড় অসম্পূর্ণতা। অসংগঠিত এবং সাবেকী অংশকে চলতে হচ্ছে প্রায় শিক্ষাব্যবস্থার সহায়তা ছাড়াই। তার মানে এই নয় যে, গ্রাম থেকে ছেলেরা কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে না। কিন্তু যারা ঢুকছে তারা বড় বেশি গ্রামে ফিরে যাচ্ছে না, তাদের গন্তব্যস্থল অর্থনীতির আধুনিক বৃত্তখণ্ড। প্রশাসনে অথবা ব্যবসায় ও শিল্পের সংগঠিত যন্ত্রে স্থানলাভ করাই তাদের বাসনা। বস্তুত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিজেই একটি বৃহৎ ব্যবসায়বিশেষ। রবীন্দ্রনাথ অন্তত সমস্যার মূল প্রকৃতিটা বুঝতে ভুল করেননি। আমাদের অর্থনীতির অসংগঠিত অংশকে কী করে সংগঠিত করা যায়, সেই পথ খুঁজেছে পল্লীসংগঠনবিভাগ।
সমস্যাটাকে এবার অন্য এক দিক থেকে দেখা যাক। এই শতাব্দীর প্রথমে বঙ্গভঙ্গের সময় যে জাতীয় শিক্ষাপরিষদ জন্মগ্রহণ করে এবং শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়, রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার ফলে এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল, এই বিচ্ছেদ রোধ করা প্রয়োজন, শিক্ষার সঙ্গে দেশের মানুষের, দেশের স্বার্থ ও সংস্কৃতির যোগস্থাপন করতে হবে, এইরকম একটা বোধ জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ভিতর শক্তির সঞ্চার করেছিল। এরই টানে অরবিন্দ ও রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষেরা সেদিন আন্দোলনের অংশীদার হন।
তারপর আট দশক কেটে গেছে। জাতীয় শিক্ষার নেতারা যে বিজাতীয়তার বিরোধী ছিলেন তাকে কি রোধ করা গেছে? মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুমাত্র বেড়েছে কি না বলা কঠিন। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশে যদি-বা মাতৃভাষার জন্য একটা বিশেষ সম্মানের স্থান থাকে, পশ্চিমবঙ্গে তেমন কিছু দাবি করা যায় না। কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্রদের ভিতর নানা কারণে ইংরেজীর আকর্ষণ প্রবল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিদেশে যাওয়া যদি উদ্দেশ্য হয় তবে বিদেশী ভাষায় দক্ষতাই বিশেষ প্রয়োজন। বিশ্বের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় অবশ্য কাম্য। স্বদেশপ্রীতি যদি মানুষকে বিশ্ববিমুখ করে তোলে তবে সেটা প্রশংসনীয় নয়। রবীন্দ্রনাথকে তো কিছুতেই বিশ্ববিমুখ বলা যায় না। কিন্তু তিনি জানতেন, অন্য কোনো ভাষাই মাতৃভাষার স্থান নিতে পারে না। যদি নিতে চায় তবে তাতে একদিকে দেশের ভিতর একটা গভীর বিভেদ এনে দেয়, অন্যদিকে আমরা চিত্তের স্বরাজ্য হারাই।
আমাদের ইংরেজী শিক্ষিত সম্প্রদায় যে-পরিমাণে মাতৃভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন, সেই পরিমাণে দেশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। এমন কি ছাত্রসমাজের অভ্যন্তরেই এখন একটা। বিপজ্জনক সাংস্কৃতিক বিভেদ এসে গেছে। বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি যারা প্রবলভাবে অনুরক্ত আর দেশের মাটির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, এই দুই গোষ্ঠী যেন দুই বিপরীত শিবিরে বিভক্ত। এটা উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। পারম্পরিক বিতৃষ্ণার আতিশয্যে একদল হয়ে উঠছে “মৌলবাদী”, অন্যদল স্বদেশের প্রতি শ্রদ্ধাহীন। এই সাংস্কৃতিক বিভেদ দেশকে ঠেলে দিচ্ছে এক নৈরাশ্যজনক। সংকটের দিকে।
এইসব দ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথকে অনেক সময় এপক্ষ অথবা ওপাক্ষের উকিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা তাঁর প্রতি অন্যায়। যদিও তিনি অবস্থাবিশেষে কখনো এদিক আবার কখনো ওদিকের কথাটা জোর দিয়ে বলেছেন, তবু দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে যাবার বুদ্ধি আর ঔদার্যেই তিনি অন্য অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র। তাঁর নানা বিচ্ছিন্ন উক্তির ভিতর থেকে এই মূল ভাবটা খুঁজে নেওয়া প্রয়োজন। যেমন ধরা যাক একটি বিতর্কিত বষয় শিক্ষায় ভাষার স্থান। শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিদ্যাবিস্তারের কথাটাকে যখন। ঠিকমত মন দিয়া দেখি তখন তার সর্বপ্রধান বাধাটা এই দেখতে পাই যে তার বাহনটা ইংরেজি।” তিনিই আবার শান্তিনিকেতনের সর্বাধ্যক্ষ জগদানন্দ রায়কে বিদেশ থেকে লিখেছেন, “সেদিনকার খবরের কাগজে পড়লুম মহাত্মা গান্ধী আমাদের মেয়েদের বলেছেন, তোমরা ইংরেজি পড়া বন্ধ কর, সেদিন বুঝেছি আমাদের দেশে দেয়াল গাঁথা শুরু হয়েছে, অর্থাৎ নিজের ঘরকে নিজের কারাগার করে ভোলাকেই আমরা মুক্তি বলে মনে করছি।” রবীন্দ্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য তার সমন্বয়ধর্মিতা।
দারিদ্রব্যাধি যেমন ভেষজে আরাম করা যায় না, আমাদের অর্থনীতির সব সমস্যা তেমনি শুধু শিক্ষানীতি দিয়ে দূর করা সম্ভব নয়। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাগুরুদের হাতে এত শক্তিসামর্থ্য ছিল না যে তাঁরা বোলপুর থেকে দারিদ্র্য দূর করতে পারেন। তাই বলে পল্লীসংগঠনের জন্য রবীন্দ্রনাথ যে চিন্তা করেছিলেন সেটা অসার্থক নয়। পরিস্থিতির অবশ্য পরিবর্তন হয়েছে, উপায় নিয়েও নতুন চিন্তা আবশ্যক। আজ যখন পঞ্চায়েতী শাসনের দিন এসেছে তখন রবীন্দ্রনাথের চিন্তাকে নিয়ে যেতে হবে পঞ্চায়েতের নেতাদের কাছে। আবার বেসরকারী সেবাপ্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা স্বীকার্য। বাধা আসবে। রাজনীতিও বাধা হতে পারে। তবু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজের ধারণা আজও মূল্যবান।
রাজনীতিই একমাত্র বাধা নয়। সাংস্কৃতিক বাধাটা তুচ্ছ করবার মতো নয়। একদিকে আমাদের পল্লীসমাজে এখনো চলছে জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণেও এসে পৌঁছেছে নতুন বিদেশী সংস্কৃতির ঢেউ, উত্তেজক দ্রুত তালে বাঁধা সংস্কৃতি। বিদেশী বলেই কিছু অশ্রদ্ধেয় নয়। কিন্তু এই নতুন সংস্কৃতির মধ্যে শুধু যে একটা মাদকতা আছে তাই নয়, এর যোগ এমন এক জীবনযাত্রার সঙ্গে, এই দরিদ্র দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রা যেটা হতে পারে না। এর আকর্ষণে একদিকে হতাশা বাড়ে ব্যক্তির মনে বলক্ষয়ী ভোগবাদিতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, অন্যদিকে বিভেদ বিস্তৃত হয় সমাজের অভ্যন্তরে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন মিলনের ভিতরই মঙ্গল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আজ এক নতুন দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। দ্বন্দ্বের স্বরূপ জেনে আমাদের নতুন করে মিলনের পথ খুঁজতে হবে। কিছুই একেবারে ফেলা যাবে না। একটা পূর্ণতার ভিতর কী করে তাকে স্থাপন করা যায় সেটাই প্রশ্ন।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রায় অর্ধশতাব্দী গত হয়েছে। তবু শান্তিনিকেতনের আজও একটা বাণী আছে। তাকে উপেক্ষা করলে দেশেরই তাতে ক্ষতি। এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি আজও যেসব বিরোধে চিহ্নিত, যেমন বৃত্তিভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে পূর্ণমনুষ্যত্বের জন্য শিক্ষার বিরোধ, পল্লী ও নাগরিকতার দ্বন্দ্ব, দুই অসমন্বিত সংস্কৃতির বৈপরীত্য, এইসব সম্বন্ধে শান্তিনিকেতন আমাদের আরো সাত্মকভাবে সচেতন ও সমীহিত করে তোলে এবং সমাধানের উপায় বিষয়ে অন্তত কিছু মূল্যবান চিন্তা ও প্রয়াসের সন্ধান দেয়। অভ্যস্ত। পদ্ধতিগুলি আজ অসমর্থ। রবীন্দ্রনাথের প্রোজ্জ্বল জীবনদর্শনে বিধৃত শিক্ষাচিন্তা। প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি।
তবু রবীন্দ্রপুজো যথেষ্ট নয়। মূল থেকে চিন্তা শুরু করতে হবে। বৃত্তিশিক্ষার সঙ্গে বৃহত্তর শিক্ষাকে কী করে মেলানো যায় এটাই প্রাথমিক প্রশ্ন। এইখানেই মূল দ্বন্দ্ব। এর কোনো একমাত্র কিংবা সর্বকালীন উত্তর নেই। স্থানে কালে দ্বন্দ্ব ও সমাধানের স্বরূপ বদলে চলে। এদেশের এবং এই সময়ের জন্য সমাধান আমরা এখনও খুঁজে পাইনি।
দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)