চতুর্থ খণ্ড – ষষ্ঠ অধ্যায়: ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ – গোপালের মার1 পূর্বকথা
গোপালের মার ঠাকুরকে প্রথম দর্শন
নবীন-নীরদ-শ্যামং নীলেন্দীবরলোচনম্।
বল্লবীনন্দনং বন্দে কৃষ্ণং গোপালরূপিণম্।
স্ফুরদ্বর্হদলোদ্বদ্ধ-নীল-কুঞ্চিত-মূর্ধজম্।
* * *
বল্লবীবদনাম্ভোজ-মধুপান-মধুব্রতম্॥
– শ্রীগোপালস্তোত্র
যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্॥
– গীতা, ৭/২১
“And whoso shall receive one such little child in my name receiveth me.”
– Matthew XVIII-52
গোপালের মা ঠাকুরকে প্রথম কবে দেখিতে আসেন, তাহা ঠিক বলিতে পারি না – তবে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের চৈত্র বা বৈশাখ মাসে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট যখন আমরা তাঁহাকে প্রথম দেখি, তখন তিনি প্রায় ছয় মাস ঠাকুরের নিকট যাতায়াত করিতেছেন ও তাঁহার সহিত শ্রীভগবানের বালগোপাল-ভাবে অপূর্ব লীলাও চলিতেছে। আমাদের বেশ মনে আছে – সেদিন গোপালের মা শ্রীশ্রীঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরের ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে যে গঙ্গাজলের জালা ছিল, তাহারই নিকটে দক্ষিণ-পূর্বাস্য হইয়া অর্থাৎ ঠাকুরের দিকে মুখ করিয়া বসিয়াছিলেন; বয়স প্রায় ষাট বৎসর হইলেও বুঝিতে পারা কঠিন, কারণ বৃদ্ধার মুখে বালিকার আনন্দ! আমাদের পরিচয় পাইয়া বলিলেন, “তুমি গি-র ছেলে? তুমি তো আমাদের গো। ওমা, গি-র ছেলে আবার ভক্ত হয়েছে! গোপাল এবার আর কাউকে বাকি রাখবে না; এক এক করে সব্বাইকে টেনে নেবে! তা বেশ, পূর্বে তোমার সহিত মায়িক সম্বন্ধ ছিল, এখন আবার তার চেয়ে অধিক নিকট সম্বন্ধ হলো” ইত্যাদি – সে আজ চব্বিশ বৎসরের কথা।
১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের অগ্রহায়ণ; আকাশ যতদূর পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হইতে হয়। এ বৎসর আবার কার্তিকের গোড়া থেকেই শীতের একটু আমেজ দেয় – আমাদের মনে আছে। এই নাতিশীতোষ্ণ হেমন্তেই বোধ হয় গোপালের মা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রথম দর্শন লাভ করেন। পটলডাঙ্গার ৺গোবিন্দচন্দ্র দত্তের কামারহাটিতে গঙ্গাতীরে যে ঠাকুরবাটী ও বাগান আছে, সেখান হইতে নৌকায় করিয়া তাঁহারা ঠাকুরকে দেখিতে আসেন। তাঁহারা, বলিতেছি – কারণ গোপালের মা সেদিন একাকী আসেন নাই; উক্ত উদ্যানস্বামীর বিধবা পত্নী, কামিনী নাম্নী তাঁহার একটি দূরসম্পর্কীয়া আত্মীয়ার সহিত, গোপালের মার সঙ্গে আসিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের নাম তখন কলিকাতায় অনেকের নিকটেই পরিচিত। ইঁহারাও এই অলৌকিক ভক্ত-সাধুর কথা শুনিয়া অবধি তাঁহাকে দর্শন করিবার জন্য লালায়িত ছিলেন। কার্তিক মাসে শ্রীবিগ্রহের নিয়ম-সেবা করিতে হয়, সেজন্য গোবিন্দবাবুর পত্নী বা গিন্নীঠাকুরানী ঐ সময়ে কামারহাটির উদ্যানে প্রতি বৎসর বাস করিয়া স্বয়ং উক্ত সেবার তত্ত্বাবধান করিতেন। কামারহাটি হইতে দক্ষিণেশ্বর আবার দুই বা তিন মাইল মাত্র হইবে – অতএব আসিবার বেশ সুবিধা। কামারহাটির গিন্নী এবং গোপালের মাও সেই সুযোগে রানী রাসমণির কালীবাটীতে উপস্থিত হন।
ঠাকুর সেদিন ইঁহাদের সাদরে স্বগৃহে বসাইয়া ভক্তিতত্ত্বের অনেক উপদেশ দেন ও ভজন গাহিয়া শুনান এবং পুনরায় আসিতে বলিয়া বিদায় দেন। আসিবার কালে গিন্নী শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে তাঁহার কামারহাটির ঠাকুরবাড়িতে পদধূলি দিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন। ঠাকুরও সুবিধামতো একদিন যাইতে প্রতিশ্রুত হইলেন। বাস্তবিক ঠাকুর সেদিন গিন্নীর ও গোপালের মার অনেক প্রশংসা করিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, “আহা, চোখমুখের কি ভাব – ভক্তি-প্রেমে যেন ভাসচে – প্রেমময় চক্ষু! নাকের তিলকটি পর্যন্ত সুন্দর।” অর্থাৎ তাঁহাদের চাল-চলন, বেশভূষা ইত্যাদিতে ভিতরের ভক্তিভাবই যেন ফুটিয়া বাহির হইতেছে, অথচ লোকদেখানো কিছুই নাই।
1. দিব্য-ভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুরকে বিশিষ্ট সাধক-ভক্তগণের সহিত কিরূপ লীলা করিতে দেখিয়াছি তাহারই অন্যতম দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত গোপালের মা-র অদ্ভুত দর্শনাদির কথা পাঠককে এখানে উপহার দিতেছি। যাঁহারা মনে করিবেন আমরা উহা অতিরঞ্জিত করিয়াছি, তাঁহাদের নিকট আমাদের বক্তব্য এই যে, আমরা উহাতে মুন্সীয়ানা কিছুমাত্র ফলাই নাই – এমনকি ভাষাতে পর্যন্ত নহে। ঠাকুরের স্ত্রী-ভক্তদিগের নিকট হইতে যেমন সংগ্রহ করিয়াছি প্রায় তেমনই ধরিয়া দিয়াছি। আবার উহা সংগ্রহও করিয়াছি এমন সব লোকের নিকট হইতে, যাঁহারা সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ যথাযথ বলিবার প্রয়াস পান, না পারিলে অনুতপ্তা হন এবং ‘কামারহাটির বামনীর’ স্তাবক হওয়া দূরে যাউক, কখনও কখনও তদনুষ্ঠিত কোন কোন আচরণের তীব্র সমালোচনাও আমাদের নিকট করিয়াছেন।
2. King James Version. – 8 December 2018, compiler.
পটলডাঙ্গার ৺গোবিন্দচন্দ্র দত্ত
পটলডাঙ্গার ৺গোবিন্দচন্দ্র দত্ত কলিকাতার কোন এক বিখ্যাত সওদাগরি আপিসে মুৎসদ্দি ছিলেন। সেখানে কার্যদক্ষতা ও উদ্যমশীলতায় অনেক সম্পত্তির অধিকারী হন। কিন্তু কিছুকাল পরে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হইয়া অকর্মণ্য হইয়া পড়েন। তাঁহার একমাত্র পুত্র উহার পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল। থাকিবার মধ্যে ছিল দুই কন্যা – ভূতো ও নারাণ1 এবং তাহাদের সন্তানসন্ততি। এদিকে বিষয় নিতান্ত অল্প নহে – কাজেই শেষ জীবনে গোবিন্দবাবুর ধর্মালোচনা ও পুণ্যকর্মেই কাল কাটিত। বাড়িতে রামায়ণ-মহাভারতাদি কথা দেওয়া, কামারহাটির বাগানে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণবিগ্রহ সমারোহে স্থাপন করা, ভাগবতাদি শাস্ত্রের পারায়ণ, সস্ত্রীক তুলাদণ্ডের অনুষ্ঠান করিয়া ব্রাহ্মণ দরিদ্র প্রভৃতিকে দান ইত্যাদি অনেক সৎকার্য তিনি করিয়া যান। বিশেষতঃ আবার কামারহাটির বাগানে শ্রীবিগ্রহের পূজোপলক্ষে তখন বার মাসে তের পার্বণ লাগিয়াই থাকিত এবং অতিথি-অভ্যাগত, দীন-দরিদ্র সকলকেই শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণজীউর প্রসাদ অকাতরে বিতরণ করা হইত।
1. যজ্ঞেশ্বরী ও নারায়ণী।
তাঁহার ভক্তিমতী পত্নী
গোবিন্দবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁহার সতী-সাধ্বী রমণীও শ্রীবিগ্রহের ঐরূপ সমারোহে সেবা অনেক দিন পর্যন্ত চালাইয়া আসিতেছিলেন! পরে নানা কারণে বিষয়ের অধিকাংশ নষ্ট হইল। তজ্জন্য শ্রীবিগ্রহের সেবার যাহাতে ত্রুটি না হয় তদ্বিষয়ে লক্ষ্য রাখিবার জন্যই গোবিন্দবাবুর গৃহিণী এখন স্বয়ং এখানে থাকিয়া ঐ বিষয়ের তত্ত্বাবধানে নিযুক্তা থাকিতেন। গিন্নী সেকেলে মেয়ে, জীবনে শোকতাপও ঢের পাইয়াছেন, কাজেই – ধর্মানুষ্ঠানেই শান্তি, এ কথা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু তবু পোড়া মায়া কি সহজে ছাড়ে – মেয়ে, জামাই, সমাজ, মান, সম্ভ্রম ইত্যাদিও দেখিয়া চলিতে হইত। স্বামীর মৃত্যুর দিন হইতে নিজে কিন্তু কঠোর নিয়ম, উপবাস, শ্রীবিগ্রহের সেবা, জপ, ধ্যান, দান ইত্যাদি লইয়াই থাকিতেন।
তাঁহার পুরোহিত-বংশ। বালবিধবা অঘোরমণি
কামারহাটির ঠাকুরবাড়ির অতি নিকটেই গোবিন্দবাবুর পুরোহিতবংশের বাস। পুরোহিত নীলমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। ‘গোপালের মাতা’ ইঁহারই ভগিনী – পূর্ব নাম অঘোরমণি দেবী – বালিকা বয়সে বিধবা হওয়ায় পিত্রালয়েই চিরকাল বাস। গিন্নী বা গোবিন্দবাবুর পত্নীর সহিত বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হওয়া অবধি অঘোরমণির ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরসেবাতেই কাল কাটিতে থাকে। ক্রমে অনুরাগের আধিক্যে গঙ্গাতীরে ঠাকুরবাড়িতেই বাস করিবার ইচ্ছা প্রবল হওয়ায় তিনি গিন্নীর অনুমতি লইয়া মেয়েমহলের একটি ঘরে আসিয়াই বসবাস করিলেন; পিত্রালয়ে দিনের মধ্যে দুই-একবার যাইয়া দেখাসাক্ষাৎ করিয়া আসিতেন মাত্র।
গিন্নীর যেমন কঠোর ব্রহ্মচর্য ও তপানুষ্ঠানে অনুরাগ, অঘোরমণিরও তদ্রূপ; সেজন্য উভয়ের মধ্যে মানসিক চিন্তা ও ভাবের অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল। বাহিরে কিন্তু বিষয়ের অধিকারিণী গিন্নীকে সামাজিক মানসম্ভ্রমাদি দেখিয়া চলিতে হইত, অঘোরমণির কিছুই না থাকায় সেসব কিছুই দেখিতে হইত না। আবার নিজের পেটের একটাও না থাকায় জঞ্জালও কিছুই ছিল না। থাকিবার মধ্যে বোধ হয় অলঙ্কারাদি স্ত্রীধনবিক্রয়ে প্রাপ্ত পাঁচ-সাত শত টাকা; তাহাও কোম্পানীর কাগজ করিয়া গিন্নীর নিকট গচ্ছিত ছিল। উহার সুদ লইয়া এবং সময়ে সময়ে বিশেষ অভাবগ্রস্ত হইলে মূলধনে যতদূর সম্ভব অল্পস্বল্প হস্তক্ষেপ করিয়াই অঘোরমণির দিন কাটিত। অবশ্য গিন্নীও সকল বিষয়ে তাঁহাকে ও তাঁহার ভ্রাতার পরিবারবর্গকে সাহায্য করিতেন।
অঘোরমণির আচারনিষ্ঠা
অঘোরমণি কড়ে রাঁড়ী – স্বামীর সুখ কোন দিনই জীবনে জানেন নাই। মেয়েরা বলে “ওরা সব যত্নী রাঁড়ী, নুনটুকু পর্যন্ত ধুয়ে খায়” – অঘোরমণিও বয়স প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত তাহাই। বেজায় আচার-বিচার! আমরা জানি, একদিন তিনি রন্ধন করিয়া বোক্নো হইতে ভাত তুলিয়া পরমহংসদেবের পাতে পরিবেশন করিতেছেন, এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণদেব কোন প্রকারে ভাতের কাঠিটি ছুঁইয়া ফেলেন। অঘোরমণির সে ভাত আর খাওয়া হইল না এবং ভাতের কাঠিটিও গঙ্গাগর্ভে নিক্ষিপ্ত হইল! তিনি যখন প্রথম প্রথম ঠাকুরের নিকট আসিতেছেন, ইহা সেই সময়ের কথা।
দক্ষিণেশ্বরে নহবতের ঘরে দুই-তিনটি উনুন পাতা ছিল। শ্রীশ্রীকালীমাতার ভোগরাগ সাঙ্গ হইতে অনেক বিলম্ব হইত, কখনও কখনও আড়াই প্রহর বেলা হইয়া যাইত। পরমহংসদেবের শরীর অসুস্থ থাকিলে – আর তাঁহার তো পেটের অসুখাদি নিত্য লাগিয়াই থাকিত – পরমারাধ্যা মাতাঠাকুরানী ঐ উনুনে সকাল সকাল দুটি ঝোলভাত তাঁহাকে রাঁধিয়া দিতেন। যেসকল ভক্তেরা ঠাকুরের নিকট মধ্যে মধ্যে রাত্রিযাপন করিতেন, তাঁহাদের নিমিত্ত ডালরুটি ঐ উনুনে তৈয়ারি হইত। আবার কলিকাতা প্রভৃতি স্থান হইতে অনেক ভদ্রমহিলারা ঠাকুরের দর্শনে আসিয়া মাতাঠাকুরানীর সহিত ঐ নহবতখানায় সমস্ত দিন থাকিতেন এবং কখনও কখনও সেখানে রাত্রিযাপনও করিতেন – তাঁহাদের আহারাদিও শ্রীশ্রীমা ঐ উনুনে প্রস্তুত করিতেন। অঘোরমণি – অথবা ঠাকুর যেমন তাঁহাকে প্রথম প্রথম নির্দেশ করিতেন, ‘কামারহাটির বামুনঠাকরুন বা বামনী’ – যেদিন ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিতেন সেদিন ঠাকুরের ঝোল-ভাত রাঁধার পর শ্রীশ্রীমাকে গোবর, গঙ্গাজল প্রভৃতি দিয়া তিনবার উনুন পাড়িয়া দিতে হইত, তবে তাহাতে ব্রাহ্মণীর বোক্নো চাপিত! এতদূর বিচার ছিল।
গোবিন্দবাবুর ঠাকুরবাটীতে বাস ও তপস্যা
‘কামারহাটির ব্রাহ্মণী’ আবার ছেলেবেলা হইতে বড় অভিমানিনী। কাহারও কথা এতটুকু সহ্য করিতে পারিতেন না – অর্থসাহায্যের জন্য হাত পাতা তো দূরের কথা। তাহার উপর আবার অন্যায় দেখিলেই লোকের মুখের উপর বলিয়া দিতে কিছুমাত্র চক্ষুলজ্জা ছিল না – কাজেই খুব অল্প লোকের সহিত তাঁহার বনিবনাও হইত। গিন্নী যে ঘরখানিতে তাঁহাকে থাকিতে দিয়াছিলেন, তাহা একেবারে বাগানের দক্ষিণপ্রান্তে। ঘরের দক্ষিণের তিনটি জানালা দিয়া সুন্দর গঙ্গাদর্শন হইত এবং উত্তরে ও পশ্চিমে দুইটি দরজা ছিল। ব্রাহ্মণী ঐ ঘরে বসিয়া গঙ্গাদর্শন করিতেন ও দিবারাত্র জপ করিতেন। এইরূপে ঐ ঘরে ত্রিশ বৎসরেরও অধিক কাল ব্রাহ্মণীর সুখে-দুঃখে কাটিয়া যাইবার পর তবে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রথম দর্শন তিনি লাভ করেন।
ব্রাহ্মণীর পিতৃকুল বোধ হয় শাক্ত ছিল – শ্বশুরকুল কি ছিল বলিতে পারি না – কিন্তু তাঁহার নিজের বরাবর বৈষ্ণবপদানুগা ভক্তি ছিল ও গুরুর নিকট হইতে গোপালমন্ত্র-গ্রহণ হইয়াছিল। গিন্নীর সহিত ঘনিষ্ঠতাও বোধ হয় তাঁহার ঐ বিষয়ে সহায়ক হইয়াছিল। কারণ, মালপাড়ার গোস্বামিবংশীয়েরাই গোবিন্দবাবুর গুরুবংশ এবং উঁহাদের দুই-একজন কামারহাটির ঠাকুরবাটী হওয়া পর্যন্ত প্রায়ই ঐ স্থানে অবস্থান করিতেন। কিন্তু মায়িক সম্বন্ধে সন্তান-বাৎসল্যের আস্বাদ এ জন্মে কিছুমাত্র না পাইয়াও কেমন করিয়া যে অঘোরমণির বাৎসল্যরতিতে এত নিষ্ঠা হয় এবং শ্রীভগবানকে পুত্রস্থানীয় করিয়া গোপালভাবে ভজনা করিতে ইচ্ছা হয়, তাহার মীমাংসা হওয়া কঠিন। অনেকেই বলিবেন পূর্বজন্ম ও সংস্কার – যাহাই হউক, ঘটনা কিন্তু সত্য।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের স্ত্রীলোকদিগের ধর্মনিষ্ঠা বিভিন্নভাবে প্রকাশ
বিলাত আমেরিকায় সংসারে দুঃখ-কষ্ট পাইয়া বা অপর কোন কারণে স্ত্রীলোকদিগের ভিতর ধর্মনিষ্ঠা আসিলেই উহা দান, পরোপকার এবং দরিদ্র ও রোগীর সেবারূপ কর্মের ভিতর দিয়া প্রকাশিত হয়। দিবারাত্র সৎকর্ম করা – ইহাই তাহাদের লক্ষ্য হয়। আমাদের দেশে উহার ঠিক বিপরীত। কঠোর ব্রহ্মচর্য, তপশ্চরণ, আচার এবং জপাদির ভিতর দিয়াই ঐ ধর্মনিষ্ঠা প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয়। সংসার-ত্যাগ এবং অন্তর্মুখীনতার দিকে অগ্রসর হওয়াই দিন দিন তাহাদের লক্ষ্য হইয়া উঠে। বিশেষতঃ শ্রীভগবানের এ জীবনে দর্শনলাভ করা জীবের সাধ্য এবং উহাতে যথার্থ শান্তি – এ কথা এ দেশের জলবায়ুতে বর্তমান থাকিয়া স্ত্রীপুরুষের অস্থিমজ্জায় পর্যন্ত প্রবিষ্ট হইয়া রহিয়াছে। কাজেই ‘কামারহাটির ব্রাহ্মণী’র একান্ত বাস ও তপশ্চরণ অন্য দেশের আশ্চর্যের বিষয় হইলেও এ দেশে সহজ ভাব।
অঘোরমণির ঠাকুরকে দ্বিতীয়বার দর্শন
প্রথম দর্শনের দিন হইতেই কামারহাটির ব্রাহ্মণী শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের দ্বারা বিশেষরূপে আকৃষ্ট হন – কেন, কি কারণে এবং উহা কতদূর গড়াইবে, সে কথা অবশ্য কিছুই অনুভব করিতেও পারেন নাই; কিন্তু ‘ইনি বেশ লোক, যথার্থ সাধু-ভক্ত এবং ইঁহার নিকট পুনরায় সময় পাইলেই আসিব’ – এইরূপ ভাবে কেমন একটা অব্যক্ত টানের উদয় হইয়াছিল। গিন্নীও ঐরূপ অনুভব করিয়াছিলেন, কিন্তু পাছে সমাজে নিন্দা করে এই ভয়ে আর আসিয়াছিলেন কিনা সন্দেহ। তাহার উপর মেয়ে-জামাইদের জন্য তাঁহাকে অনেক কাল আবার পটলডাঙ্গার বাটীতেও কাটাইতে হইত। সেখান হইতে দক্ষিণেশ্বর অনেক দূর এবং আসিতে হইলে সকলকে জানাইয়া সাজ-সরঞ্জাম করিয়া আসিতে হয় – কাজেই আর বড় একটা আসা হইত না।
ব্রাহ্মণীর ও-সব ঝঞ্ঝাট তো নাই – কাজেই প্রথম দর্শনের অল্পদিন পরে জপ করিতে করিতে ঠাকুরের নিকট আসিবার ইচ্ছা হইবামাত্র দুই-তিন পয়সার দেদো সন্দেশ কিনিয়া লইয়া দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিলেন, “এসেছ, আমার জন্য কি এনেছ দাও।” গোপালের মা বলেন, “আমি তো একেবারে ভেবে অজ্ঞান, কেমন করে সে ‘রোঘো’ (খারাপ) সন্দেশ বার করি – এঁকে কত লোকে কত কি ভাল ভাল জিনিস এনে খাওয়াচ্চে – আবার তাই ছাই কি আমি আসবামাত্র খেতে চাওয়া!” ভয়ে লজ্জায় কিছু না বলিতে পারিয়া সেই সন্দেশগুলি বাহির করিয়া দিলেন। ঠাকুরও উহা মহা আনন্দ করিয়া খাইতে খাইতে বলিতে লাগিলেন, “তুমি পয়সা খরচ করে সন্দেশ আন কেন? নারকেল-নাড়ু করে রাখবে, তাই দুটো একটা আসবার সময় আনবে। না হয়, যা তুমি নিজের হাতে রাঁধবে, লাউশাক-চচ্চড়ি, আলু বেগুন বড়ি দিয়ে সজনে-খাড়ার তরকারি – তাই নিয়ে আসবে। তোমার হাতের রান্না খেতে বড় সাধ হয়।” গোপালের মা বলেন, “ধর্মকর্মের কথা দূরে গেল, এইরূপে কেবল খাবার কথাই হতে লাগল; আমি ভাবতে লাগলুম, ভাল সাধু দেখতে এসেছি – কেবল খাইখাই; কেবল খাইখাই; আমি গরিব কাঙাল লোক – কোথায় এত খাওয়াতে পাব? দূর হোক, আর আসব না। কিন্তু যাবার সময় দক্ষিণেশ্বরের বাগানের চৌকাঠ যেমন পেরিয়েচি, অমনি যেন পেছন থেকে তিনি টানতে লাগলেন। কোন মতে এগুতে আর পারি না। কত করে মনকে বুঝিয়ে টেনে হিঁচড়ে তবে কামারহাটি ফিরি।” ইহার কয়েকদিন পরেই আবার ‘কামারহাটির ব্রাহ্মণী’ চচ্চড়ি হাতে করিয়া তিন মাইল হাঁটিয়া পরমহংসদেবের দর্শনে উপস্থিত! ঠাকুরও পূর্বের ন্যায় আসিবামাত্র উহা চাহিয়া খাইয়া “আহা কি রান্না, যেন সুধা, সুধা” বলিয়া আনন্দ করিতে লাগিলেন। গোপালের মার সে আনন্দ দেখিয়া চোখে জল আসিল। ভাবিলেন – তিনি গরিব কাঙাল বলিয়া তাঁহার এই সামান্য জিনিসের ঠাকুর এত বড়াই করিতেছেন।
এইরূপে দুই-চারি মাস ঘন ঘন দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত হইতে লাগিল। যে দিন যা রাঁধেন, ভাল লাগিলেই তাহা পরের বারে ঠাকুরকে দেখিতে আসিবার সময় ব্রাহ্মণী কামারহাটি হইতে লইয়া আসেন। ঠাকুরও তাহা কত আনন্দ করিয়া খান, আবার কখনও বা কোন সামান্য জিনিস, যেমন সুষনি শাক সস্সড়ি, কলমি শাক চচ্চড়ি ইত্যাদি আনিবার জন্য অনুরোধ করেন। কেবল ‘এটা এনো, ওটা এনো’ আর ‘খাইখাই’র জ্বালায় বিরক্ত হইয়া গোপালের মা কখনও কখনও ভাবেন, “গোপাল, তোমাকে ডেকে এই হলো? এমন সাধুর কাছে নিয়ে এলে যে, কেবল খেতে চায়! আর আসব না।” কিন্তু সে কি এক বিষম টান! দূরে গেলেই আবার কবে যাব, কতক্ষণে যাব, এই মনে হয়।
ঠাকুরের গোবিন্দবাবুর বাগানে আগমন
ইতোমধ্যে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবও একবার কামারহাটিতে গোবিন্দবাবুর বাগানে গমন করেন এবং তথায় শ্রীবিগ্রহের সেবাদি দর্শন করিয়া বিশেষ আনন্দপ্রকাশ করেন। সেবার তিনি সেখানে শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে কীর্তনাদি করিয়া প্রসাদ পাইবার পর পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়াছিলেন। কীর্তনের সময় তাঁহার অদ্ভুত ভাবাবেশ দেখিয়া গিন্নী ও সকলে বিশেষ মুগ্ধ হন। তবে গোস্বামিপাদদিগের মনে পাছে প্রভুত্ব হারাইতে হয় বলিয়া একটু ঈর্ষা-বিদ্বেষ আসিয়াছিল কিনা বলা সুকঠিন। শুনিতে পাই ঐরূপই হইয়াছিল।
অঘোরমণির অলৌকিক বালগোপাল-মূর্তি-দর্শনে অবস্থা
‘কামারহাটির ব্রাহ্মণী’র বহুকালের অভ্যাস – রাত্রি ২টায় উঠিয়া শৌচাদি সারিয়া ৩টার সময় হইতে জপে বসা। তারপর বেলা আটটা-নয়টার সময় জপ সাঙ্গ করিয়া উঠিয়া স্নান ও শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণজীর দর্শন ও সেবাকার্যে যথাসাধ্য যোগদান করা। পরে শ্রীবিগ্রহের ভোগরাগাদি হইয়া গেলে দুই-প্রহরের সময় আপনার নিমিত্ত রন্ধনাদিতে ব্যাপৃতা হওয়া। পরে আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিয়াই পুনরায় জপে বসা ও সন্ধ্যায় আরতিদর্শন করিবার পর পুনরায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত জপে কাটানো। পরে একটু দুধ পান করিয়া কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম! স্বভাবতই তাঁহার বায়ুপ্রধান ধাত ছিল – নিদ্রা অতি অল্পই হইত। কখনও কখনও বুক ধড়ফড় ও প্রাণ কেমন কেমন করিত। ঠাকুর শুনিয়া বলেন, “ও তোমার হরিবাই – ওটা গেলে কি নিয়ে থাকবে? যখন ওরূপ হবে তখন কিছু খেও।”
১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ – শীত ঋতু অপগত হইয়া কুসুমাকর সরস বসন্ত আসিয়া উপস্থিত। পত্র-পুষ্প-গীতিপূর্ণ বসুন্ধরা এক অপূর্ব উন্মত্ততায় জাগরিতা। ঐ উন্মত্ততার ইতরবিশেষ নাই – আছে কিন্তু জীবের প্রবৃত্তির। যাহার যেরূপ সু বা কু প্রবৃত্তি ও সংস্কার, তাহার নিকট উহা সেইভাবে প্রকাশিতা। সাধু সদ্বিষয়ে নব-জাগরণে জাগরিত, অসাধু অন্যরূপে – ইহাই প্রভেদ।
এই সময়ে ‘কামারহাটির ব্রাহ্মণী’ একদিন রাত্রি তিনটার সময় জপে বসিয়াছেন। জপ সাঙ্গ হইলে ইষ্টদেবতাকে জপ সমর্পণ করিবার অগ্রে প্রাণায়াম করিতে আরম্ভ করিয়াছেন এমন সময় দেখেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহার নিকটে বামদিকে বসিয়া রহিয়াছেন এবং ঠাকুরের দক্ষিণহস্তটি মুঠো করার মতো দেখা যাইতেছে! দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে যেমন দর্শন করেন এখনও ঠিক সেইরূপ স্পষ্ট জীবন্ত! ভাবিলেন, “এ কি? এমন সময়ে ইনি কোথা থেকে কেমন করে হেথায় এলেন?” গোপালের মা বলেন, “আমি অবাক হয়ে তাঁকে দেখছি, আর ঐ কথা ভাবছি – এদিকে গোপাল (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে তিনি ‘গোপাল’ বলিতেন) বসে মুচকে মুচকে হাসছে! তারপর সাহসে ভর করে বাঁ হাত দিয়ে যেমন গোপালের (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের) বাঁ হাতখানি ধরেছি, অমনি সে মূর্তি কোথায় গেল, আর তার ভিতর থেকে দশমাসের সত্যকার গোপাল, (হাত দিয়া দেখাইয়া) এত বড় ছেলে, বেরিয়ে হামা দিয়ে এক হাত তুলে আমার মুখ-পানে চেয়ে (সে কি রূপ, আর কি চাউনি!) বললে, ‘মা, ননী দাও’! আমি তো দেখে শুনে একেবারে অজ্ঞান, সে এক চমৎকার কারখানা। চিৎকার করে কেঁদে উঠলুম – সে তো এমন চিৎকার নয়, বাড়িতে জনমানব নেই তাই, নইলে লোক জড় হতো। কেঁদে বললুম, ‘বাবা, আমি দুঃখিনী কাঙালিনী, আমি তোমায় কি খাওয়াব, ননী ক্ষীর কোথা পাব, বাবা!’ কিন্তু সে অদ্ভুত গোপাল কি তা শোনে – কেবল ‘খেতে দাও’ বলে। কি করি, কাঁদতে কাঁদতে উঠে সিকে থেকে শুকনো নারকেল-লাড়ু পেড়ে হাতে দিলুম ও বললুম, ‘বাবা, গোপাল, আমি তোমাকে এই কদর্য জিনিস খেতে দিলুম বলে আমাকে যেন ঐরূপ খেতে দিও না।'”
ঐ অবস্থায় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট আগমন
“তারপর জপ সেদিন আর কে করে? গোপাল এসে কোলে বসে, মালা কেড়ে নেয়, কাঁধে চড়ে, ঘরময় ঘুরে বেড়ায়! যেমন সকাল হলো অমনি পাগলিনীর মতো ছুটে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পড়লুম। গোপালও কোলে উঠে চলল – কাঁধে মাথা রেখে! এক হাত গোপালের পাছায় ও এক হাত পিঠে দিয়ে বুকে ধরে সমস্ত পথ চললুম। স্পষ্ট দেখতে লাগলুম গোপালের লাল টুকটুকে পা দুখানি আমার বুকের উপর ঝুলচে!”
অঘোরমণি যে দিন ঐরূপে সহসা নিজ উপাস্য দেবতার দর্শনলাভে ভাবে প্রেমে উন্মত্তা হইয়া কামারহাটির বাগান হইতে হাঁটিতে হাঁটিতে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট প্রত্যূষে আসিয়া উপস্থিত হন সে দিন সেখানে আমাদের পরিচিতা অন্য একটি স্ত্রী-ভক্তও উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার নিকট হইতে আমরা যাহা শুনিয়াছি তাহাই এখন আমরা পাঠককে বলিব। তিনি বলেন:
“আমি তখন ঠাকুরের ঘরটি ঝাঁটপাট দিয়ে পরিষ্কার করচি – বেলা সাতটা কি সাড়ে সাতটা হবে। এমন সময় শুনতে পেলুম বাহিরে কে ‘গোপাল’, ‘গোপাল’ বলে ডাকতে ডাকতে ঠাকুরের ঘরের দিকে আসচে। গলার আওয়াজটা পরিচিত – ক্রমেই নিকট হতে লাগল। চেয়ে দেখি গোপালের মা! – এলোথেলো পাগলের মতো, দুই চক্ষু যেন কপালে উঠেছে, আঁচলটা ভূঁয়ে লুটুচ্চে, কিছুতেই যেন ভ্রূক্ষেপ নাই! – এমনিভাবে ঠাকুরের ঘরে পূর্ব দিককার দরজাটি দিয়ে ঢুকচে। ঠাকুর তখন ঘরের ভিতর ছোট তক্তাপোশখানির উপর বসেছিলেন।
“গোপালের মাকে ঐরূপ দেখে আমি তো একেবারে হাঁ হয়ে গেছি – এমন সময় তাঁকে দেখে ঠাকুরেরও ভাব হয়ে গেল। ইতোমধ্যে গোপালের মা এসে ঠাকুরের কাছে বসে পড়ল এবং ঠাকুরও ছেলের মতো তার কোলে গিয়ে বসলেন! গোপালের মার দুই চক্ষে তখন দরদর করে জল পড়চে; আর যে ক্ষীর সর ননী এনেছিল তাই ঠাকুরের মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্চে। আমি তো দেখে অবাক আড়ষ্ট হয়ে গেলুম, কারণ ইহার পূর্বে কখনও তো ঠাকুরকে ভাব হয়ে কোন স্ত্রীলোককে স্পর্শ করতে দেখি নাই; শুনেছিলাম বটে ঠাকুরের গুরু বামনীর কখনও কখনও যশোদার ভাব হতো আর ঠাকুরও তখন গোপালভাবে তার কোলে উঠে বসতেন। যা হোক, গোপালের মার ঐ অবস্থা আর ঠাকুরের ভাব দেখে আমি তো একেবারে আড়ষ্ট! কতকক্ষণ পরে ঠাকুরের সে ভাব থামল এবং তিনি আপনার চৌকিতে উঠে বসলেন। গোপালের মার কিন্তু সে ভাব আর থামে না! আনন্দে আটখানা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে ‘ব্রহ্মা নাচে বিষ্ণু নাচে’ ইত্যাদি পাগলের মতো বলে আর ঘরময় নেচে নেচে বেড়ায়! ঠাকুর তাই দেখে হেসে আমাকে বললেন – ‘দেখ, দেখ, আনন্দে ভরে গেছে। ওর মনটা এখন গোপাল-লোকে চলে গেছে!’ বাস্তবিকই ভাবে গোপালের মার ঐরূপ দর্শন হতো; ও যেন আর এক মানুষ হয়ে যেত! আর একদিন খাবার সময় ভাবে প্রেমে গদগদ হয়ে আমাদের সকলকে গোপাল বলে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল। আমি আমাদের সমান ঘরে মেয়ের বিয়ে দি নাই বলে আমায় মনে মনে একটু ঘেন্না করত – সেদিন তার জন্যেই বা গোপালের মার কত অনুনয়-বিনয়! বললে, ‘আমি কি আগে জানি যে তোর ভেতর এতখানি ভক্তি-বিশ্বাস! যে গোপাল ভাবের সময় প্রায় কাউকে ছুঁতে পারে না, সে কি না আজ ভাবাবেশে তোর পিঠের উপর গিয়ে বসল! তুই কি সামান্যি’!” বাস্তবিকই সেদিন ঠাকুর গোপালের মাকে দেখিয়া সহসা গোপালভাবাবিষ্ট হইয়া প্রথম এই স্ত্রী-ভক্তটির পৃষ্ঠদেশে এবং পরে গোপালের মার ক্রোড়ে কিছুক্ষণের জন্য উপবেশন করিয়াছিলেন।
অঘোরমণি ঐরূপ ভাবে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া ভাবের আধিক্যে অশ্রুজল ফেলিতে ফেলিতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে সেদিন কত কি কথাই না বলিলেন! “এই যে গোপাল আমার কোলে”, “ঐ তোমার (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের) ভেতরে ঢুকে গেল”, “ঐ আবার বেরিয়ে এল”, “আয় বাবা, দুঃখিনী মার কাছে আয়” – ইত্যাদি বলিতে বলিতে দেখিলেন চপল গোপাল কখনও বা ঠাকুরের অঙ্গে মিশাইয়া গেল, আবার কখনও বা উজ্জ্বল বালক-মূর্তিতে তাঁহার নিকটে আসিয়া অদৃষ্টপূর্ব বাল্যলীলাতরঙ্গতুফান তুলিয়া তাঁহাকে বাহ্যজগতের কঠোর শাসন, নিয়ম প্রভৃতি সমস্ত ভুলাইয়া দিয়া একেবারে আত্মহারা করিয়া ফেলিল! সে প্রবল ভাবতরঙ্গে পড়িয়া কেই বা আপনাকে সামলাইতে পারে!
ঠাকুরের ঐ অবস্থা দুর্লভ বলিয়া প্রশংসা করা এবং তাঁহাকে শান্ত করা
অদ্য হইতে অঘোরমণি বাস্তবিকই ‘গোপালের মা’ হইলেন এবং ঠাকুরও তাঁহাকে ঐ নামে ডাকিতে লাগিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব গোপালের মার ঐরূপ অপরূপ অবস্থা দেখিয়া কত আনন্দ প্রকাশ করিলেন, শান্ত করিবার জন্য তাঁহার বুকে হাত বুলাইয়া দিলেন এবং ঘরে যত কিছু ভাল ভাল খাদ্য-সামগ্রী ছিল সে সব আনিয়া তাঁহাকে খাওয়াইলেন। খাইতে খাইতেও ভাবের ঘোরে ব্রাহ্মণী বলিতে লাগিল, “বাবা গোপাল, তোমার দুঃখিনী মা এজন্মে বড় কষ্টে কাল কাটিয়েচে, টেকো ঘুরিয়ে সুতো কেটে পৈতে করে বেচে দিন কাটিয়েচে, তাই বুঝি এত যত্ন আজ করচো!” ইত্যাদি।
সমস্ত দিন কাছে রাখিয়া স্নানাহার করাইয়া কথঞ্চিৎ শান্ত করিয়া সন্ধ্যার কিছু পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণদেব গোপালের মাকে কামারহাটি পাঠাইয়া দিলেন। ফিরিবার সময় ভাবদৃষ্ট বালক গোপালও পূর্বের ন্যায় ব্রাহ্মণীর কোলে চাপিয়া চলিল। ঘরে ফিরিয়া গোপালের মা পূর্বাভ্যাসে জপ করিতে বসিলেন, কিন্তু সেদিন আর কি জপ করা যায়? যাঁহার জন্য জপ, যাঁহাকে এতকাল ধরিয়া ভাবা – সে যে সম্মুখে নানা রঙ্গ, নানা আবদার করিতেছে! ব্রাহ্মণী শেষে উঠিয়া গোপালকে কাছে লইয়া তক্তাপোশের উপর বিছানায় শয়ন করিল! ব্রাহ্মণীর যাহাতে তাহাতে শয়ন – মাথায় দিবার একটা বালিশও ছিল না। এখন শয়ন করিয়াও নিষ্কৃতি নাই – গোপাল শুধু-মাথায় শুইয়া খুঁতখুঁত করে! অগত্যা ব্রাহ্মণী আপনার বাম বাহূপরি গোপালের মাথা রাখিয়া তাহাকে কোলের গোড়ায় শোয়াইয়া কত কি বলিয়া ভুলাইতে লাগিল – “বাবা, আজ এইরকমে শো; রাত পোয়ালেই কাল কলকেতা গিয়ে ভূতোকে (গিন্নীর বড় মেয়ে) বলে তোমায় বিচি ঝেড়ে বেছে নরম বালিশ করিয়ে দেব”, ইত্যাদি।
পূর্বেই বলিয়াছি গোপালের মা নিজ হস্তে রন্ধন করিয়া গোপালকে উদ্দেশে খাওয়াইয়া পরে নিজে খাইতেন। পূর্বোক্ত ঘটনার পরদিন, সকাল সকাল রন্ধন করিয়া সাক্ষাৎ গোপালকে খাওয়াইবার জন্য বাগান হইতে শুষ্ক কাঠ কুড়াইতে গেলেন। দেখেন, গোপালও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া কাঠ কুড়াইতেছে ও রান্নাঘরে আনিয়া জমা করিয়া রাখিতেছে! এইরূপে মায়ে-পোয়ে কাঠকুড়ানো হইল – তাহার পর রান্না। রান্নার সময়ও দুরন্ত গোপাল কখনও কাছে বসিয়া, কখনও পিঠের উপর পড়িয়া সব দেখিতে লাগিল, কত কি বলিতে লাগিল, কত কি আবদার করিতে লাগিল! ব্রাহ্মণীও কখনও মিষ্ট কথায় তাহাকে ঠাণ্ডা করিতে লাগিলেন, কখনও বকিতে লাগিলেন।
ঠাকুরের গোপালের মাকে বলা – ‘তোমার সব হয়েছে’
পূর্বোক্ত ঘটনার কিছুদিন পর গোপালের মা একদিন দক্ষিণেশ্বরে আসিয়াছেন। ঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া নহবতে – যেখানে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী থাকিতেন – যাইয়া জপ করিতে বসিলেন। নিয়মিত জপ সাঙ্গ করিয়া প্রণাম করিয়া উঠিতেছেন এমন সময়ে দেখিলেন ঠাকুর পঞ্চবটী হইতে ঐ স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর গোপালের মাকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, “তুমি এখনও অত জপ কর কেন? তোমার তো খুব হয়েছে (দর্শনাদি)!”
গোপালের মা – জপ করব না? আমার কি সব হয়েছে?
ঠাকুর – সব হয়েছে।
গোপালের মা – সব হয়েছে?
ঠাকুর – হাঁ, সব হয়েছে।
গোপালের মা – বল কি, সব হয়েছে?
ঠাকুর – হাঁ, তোমার আপনার জন্য জপ তপ সব করা হয়ে গেছে, তবে (নিজের শরীর দেখাইয়া) এই শরীরটা ভাল থাকবে বলে ইচ্ছা হয় তো করতে পার।
গোপালের মা – তবে এখন থেকে যা কিছু করব সব তোমার, তোমার, তোমার।
এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া গোপালের মা কখনও কখনও আমাদিগকে বলিতেন, “গোপালের মুখে ঐ কথা সেদিন শুনে থলি মালা সব গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলুম। গোপালের কল্যাণের জন্য করেই জপ করতুম। তারপর অনেক দিন বাদে আবার একটা মালা নিলুম। ভাবলুম – একটা কিছু তো করতে হবে? চব্বিশ ঘণ্টা করি কি? তাই গোপালের কল্যাণে মালা ফেরাই!”
এখন হইতে গোপালের মা-র জপ-তপ সব শেষ হইল। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট ঘন ঘন আসা-যাওয়া বাড়িয়া গেল। ইতঃপূর্বে তাঁহার যে এত খাওয়া-দাওয়ায় আচার-নিষ্ঠা ছিল সেসবও এই মহাভাবতরঙ্গে পড়িয়া দিন দিন কোথায় ভাসিয়া যাইতে লাগিল। গোপাল তাঁহার মন-প্রাণ এককালে অধিকার করিয়া বসিয়া কতরূপে তাঁহাকে যে শিক্ষা দিতে লাগিলেন তাহার ইয়ত্তা নাই। আর নিষ্ঠাই বা রাখেন কি করিয়া? – গোপাল যে যখন তখন খাইতে চায়, আবার নিজে খাইতে খাইতে মার মুখে গুঁজিয়া দেয়! তাহা কি ফেলিয়া দেওয়া যায়? আর ফেলিয়া দিলে সে যে কাঁদে! ব্রাহ্মণী এই অপূর্ব ভাবতরঙ্গে পড়িয়া অবধি বুঝিয়াছিলেন যে, উহা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবেরই খেলা এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবই তাঁহার ‘নবীন-নীরদশ্যাম, নীলেন্দীবরলোচন’ গোপালরূপী শ্রীকৃষ্ণ! কাজেই তাঁহাকে রাঁধিয়া খাওয়ানো, তাঁহার প্রসাদ খাওয়া ইত্যাদিতে আর দ্বিধা রহিল না।
এইরূপে অনবরত দুই মাস কাল কামারহাটির ব্রাহ্মণী গোপালরূপী শ্রীকৃষ্ণকে দিবারাত্র বুকে পিঠে করিয়া একসঙ্গে বাস করিয়াছিলেন! ভাবরাজ্যে এইরূপ দীর্ঘকাল বাস করিয়া ‘চিন্ময় নাম, চিন্ময় ধাম, চিন্ময় শ্যাম’-এর প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ও দর্শন মহাভাগ্যবানেরই সম্ভবে। একে তো শ্রীভগবানে বাৎসল্যরতিই জগতে দুর্লভ – শ্রীভগবানের ঐশ্বর্যজ্ঞানের লেশমাত্র মনে থাকিতে উহার উদয় অসম্ভব – তাহার উপর সেই রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা-সহায়ে ঘনীভূত হইয়া শ্রীভগবানের এইরূপ দর্শনলাভ করা যে আরও কত দুর্লভ তাহা সহজে অনুমিত হইবে। প্রবাদ আছে, ‘কলৌ জাগর্তি গোপালঃ’, ‘কলৌ জাগর্তি কালিকা’ – তাই বোধ হয় অদ্যাপি শ্রীভগবানের ঐ দুই ভাবের এইরূপ জ্বলন্ত উপলব্ধি কখনও কখনও দৃষ্টিগোচর হয়।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব গোপালের মাকে বলিয়াছিলেন, “তোমার খুব হয়েছে। কলিতে এরূপ অবস্থা বরাবর থাকলে, শরীর থাকে না।” বোধ হয় ঠাকুরের ইচ্ছাই ছিল, বাৎসল্যরতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ এই দরিদ্র ব্রাহ্মণীর ভাবপূত শরীর লোকহিতায় আরও কিছুদিন এ সংসারে থাকে। পূর্বোক্ত দুইমাসের পর গোপালের মার দর্শনাদি পূর্বাপেক্ষা অনেকটা কমিয়া গেল। তবে একটু স্থির হইয়া বসিয়া গোপালের চিন্তা করিলেই পূর্বের ন্যায় দর্শন পাইতে লাগিলেন।