২৫. জিহাদ
কেন্দ্রে অবস্থিত একটা পানির হাউজে পানির নালাগুলো এসে মিলিত হবে, যেখানে ঝর্ণা আর পদ্মফুল থাকবে। আমি বাগানে আপেল, নাশপাতি গাছ লাগাই, যা আমাকে মাতৃভূমির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। মালীরা আমাকে বলে যে, এসব গাছ বাঁচাতে হলে প্রতিদিন পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এখানে মজুর প্রচুর পাওয়া যায় আর সহজলভ্যও বটে।
বাবর আর হুমায়ূন যমুনার উত্তর তীরে দাঁড়িয়ে যেখানে আগ্রা দূর্গ থেকে মাইলখানেক ভাটিতে নদীটার খয়েরী পানি সহসা ডানদিকে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। বাবর হুমায়ূনকে আগ্রায় তার আরম্ভ করা প্রথম বাগিচার অগ্রগতি দেখায়। “আর কি কি আপনি তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন?”
“সুগন্ধ ছড়াবে এমন অসংখ্য সুগন্ধি গাছপালা লাগাবো আমি- যাতে সন্ধ্যাবেলা উদ্যানে সময় কাটাবার আমার প্রিয় সময়ে জায়গাটা সুরভিতে ভরে থাকে। প্রধান মালী আমাকে বলেছে অনেক গাছ আছে যার ভিতরে রাতের বেলা ফোটো সাদা রঙের চম্পা আমার উদ্দেশ্যের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। লোকটা কাজ বোঝে। আর আমি কি চাই সেটা চটপট ধরতে পারে। যদিও সে এক সময়ে সুলতান ইবরাহিমের প্রধান মালীর কাজ করেছে।” বাবর দম নিতে থামে। “আমার একটাই আশা আমাদের সীমান্তের ভিতরে আর বাইরে বসবাসকারী লোকেরা দ্রুত আমাদের হিন্দুস্তানের নতুন প্রভু হিসাবে স্বীকার করে নিক। সুলতান ইবরাহিমের সাথে যাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো তাদের বৈরীতার কারণ –যদিও আমি সেটা বরদাশত করতে মোটেই প্রস্তুত নই আমি বুঝি। তার মা যা করেছে সেজন্য আমি তাকে দোষ দেই না- আমার ধারণা সেটা তিনি এক ধরণের আনুগত্য থেকেই করেছিলেন। আমি এই মুহূর্তে পারস্যের শাহ’কে নিয়েও খুব একটা চিন্তিত নই। যদিও আফগানিস্তানে আমাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তিনি সবসময়েই একটা ঘোঁট পাকাতে চেষ্টা করছেন, কোয়েটা আর কান্দাহারে নিজের সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে। আমাদের কাছে কৃপণ ইবরাহিমের উপচে পড়া রাজকোষে সঞ্চিত অর্থের জন্য এখন শাহের চেয়ে বেশি উৎকোচ দেবার ক্ষমতা রয়েছে অন্তত এখনকার মতো।”
“তাহলে আপনি কাদের নিয়ে বেশি চিন্তিত?”
“আগ্রার পশ্চিমে বসবাসকারী রাজপুতদের নিয়ে। পাহাড়ে অবস্থিত দূর্গ আর শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে তারা ইবরাহিমের সাথে একধরণের সশস্ত্র নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিলো। এমনকি মাঝে মাঝে তার অন্যসব অভিযানে তারা তাকে অর্থের বিনিময়ে সৈন্যও সরবরাহ করেছে। তারা ভীষণ, ভীষণ সাহসী সৈন্য- যোদ্ধার জাত যারা কখনও পরাভব স্বীকার না করা। আর যুদ্ধক্ষেত্রে পিছু না হটার বীরোচিত সাম্মানিক স্মারকে বিশ্বাস করে।”
বাবর আবার চুপ করে। “রাজপুত রাজ্যগুলোর ভিতরে সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী উদয়পুরের শাসক রানা শঙ্ক গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার ঔদ্ধত্যের খবর নিয়মিত আমার কাছে আসছে যে, সে আমাদের মত উঁইফোড় হামলাকারীদের হাত থেকে হিন্দুস্তানকে মুক্ত করে, তিনশ বছরের ভিতরে প্রথমবারের মতো একজন সত্যিকারের হিন্দুকে- সেটা অবশ্যই সে নিজেকে বুঝিয়েছে- এর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবে।”
“বাকী রাজপুত রাজ্যগুলো কি তাকে এ ব্যাপারে সমর্থন করবে?”
“সম্ভবত না। তারা স্বাধীনচেতা, একই সাথে ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ। নিজেদের সম্মানের ব্যাপারে যেমন খুঁতখুঁতে, তেমনি পরস্পরের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ। আর আফগান সর্দারদের মতো যেকোনো ছুতোয় যুদ্ধ শুরু করতে ওস্তাদ। অন্য রাজপুত শাসকরা তাকে আরও শক্তিশালী দেখতে পছন্দ করবে না।”
“সে নিজে তাহলে কতটা ঝামেলা করতে সক্ষম?”
“প্রচুর। তার অধীনে একটা বিশাল আর সুদক্ষ সেনাবাহিনী রয়েছে। যদিও তার বয়স হয়েছে। কিন্তু এখনও সে ভালো কৌশলজ্ঞ আর দক্ষ যোদ্ধা, যে সবসময়ে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করে। সে যতোবার যুদ্ধে আহত হয়, আর দেহের কোনো অংশ হারায়, সেটাকে সে পূণ্যের বিষয় হিসাবে বিবেচিত করে। আমি শুনেছি তার সভাকবি তার হয়ে বীরগাথা লিখেছে যে সে মানুষের একটা খণ্ডিতাংশ মাত্র, কিন্তু খণ্ডিতাংশই বটে। ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে তার এক চোখ নষ্ট হয়েছে। সুলতান ইবরাহিমের সাথে যুদ্ধে সে এক হাত হারিয়েছে। এবং পায়ে ভয়াবহ ক্ষত হবার কারণে এখন খুঁড়িয়ে হাঁটে। তার হাড্ডিসার দেহের অবশিষ্টাংশে আশিটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে এবং তার সভাকবি লিখেছে যে প্রতিটা ক্ষতচিহ্নের জন্য বুড়ো পাঠাটা একজন করে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে।”
“আমিও সেটা শুনেছি। তার নিশ্চয়ই অসংখ্য স্ত্রী আছে- আর দৃশ্যত তার দেহের একটা অংশ এখনও অক্ষত রয়েছে। তাকে মোকাবেলা না করে কতোদিন আমরা তাকে এভাবে বড়াই করতে দেবো?”
“এই প্রশ্নটার উত্তরই আমি মনে মনে খোঁজার চেষ্টা করছি। মাত্র নয় মাস হয়েছে। আমরা ইবরাহিমকে পরাজিত করেছি। আমাদের বিজয় এখনও সুরক্ষিত হয়নি এবং হিন্দুস্তানে আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ এখনও একটা দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। আমি চাই তুমি, তোমার অন্য ভাইয়েরা আর তোমাদের সন্তানেরা যেনো এই উদ্যানের শোভা উপভোগ করতে পারো। আজ সকালেই আমি জানতে পেরেছি বিদ্রোহী তাড়া করবার ছলে রানা শঙ্ক আমাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে আরেকদফা অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও এক সপ্তাহের ভিতরেই সে নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু এইবার সে আগেরবারের চেয়ে অনেক অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো…”
“তার ইচ্ছামতো আমরা তাকে আমাদের এলাকায় বিচরণ করতে দিতে পারি না। আমরা যদি তাকে নিজের রাজ্যের মতো তাকে বিচরণ করতে দেই, তবে সেটা আমাদের দুর্বলতা হিসাবে বিবেচিত হবে। আর সেটাই স্বাভাবিক। তাকে একটা শিক্ষা দেবার সময় হয়েছে।”
“যুদ্ধের প্রতি তোমার মতো উষ্ণ আবেগ আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমার কথাই ঠিক। এক সময়ে না একসময়ে তাকে আমাদের মোকাবেলা করতেই হবে। নিজেদের যোদ্ধা খ্যাতি রক্ষার্থে সেটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততোই ভালো। আর তার চেয়েও বড় কথা হিন্দুস্তানে মাস্কেট আর কামান ব্যবহারে যতোদিন কেবল আমাদেরই একচেটিয়া অধিকার রয়েছে। অদ্ভুত আরেকটা অভিযান আমাদের নিজেদের তরুণ যোদ্ধাদের অস্থিরতা অনেকটা প্রশমিত করবে। যুদ্ধ আর লুটপাটের সম্ভাবনা তাদের অন্য কিছু ভাবা থেকে বিরত রাখবে। আমাদের প্রস্তুতি আরম্ভ করার জন্য আমি আগামীকাল সকালেই এক যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি সভার আহবান করবো…”
*
বাবর তার ঘোড়ার পর্যানে নড়েচড়ে বসে। হুমায়ুন যদিও ঠিক তার পেছনেই রয়েছে, কিন্তু তার নিজের দেহরক্ষীর দল বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। সে গরমে দরদর করে ঘামছে। আর তার চোখের চারপাশের উন্মুক্ত অংশের চারপাশে প্রতিটা রোমকূপ ধূলোয় ঢাকা পড়েছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মাত্র আড়াই দিনে দেড়শ মাইল পথ ঘোড়ায় পাড়ি দিতে পেরে এবং পাহাড়ের উপরে এই সুবিধাজনক স্থানে তাদের আগে ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হতে পেরে সে নিজেই নিজের কৃতিত্বে উৎফুল্ল হয়ে উঠে।
এই পাথুরে শিলাস্তর থেকে নিচে রাজস্থানের শুকনো মরুভূমির একটা বেশ ভালো দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখানে প্রীত হবার মতো উপাদানের সংখ্যা বড়ই অল্প। সে দেড়শ মাইল ঘোড়া দাবড়ে এসেছে রানা শঙ্ককে ধাওয়া করে। কিন্তু তাকে বা তার লোকদের এমনকি দিগন্তে ধূলোর কোনো চিহ্নও এখনও পর্যন্ত সে দেখতে পায়নি। গত ছয় সপ্তাহ ধরে সে ধাওয়া করে চলেছে। পুরোটা সময়ে সে তার শত্রুপক্ষকে মুখোমুখি যুদ্ধে আবদ্ধ করতে পারেনি, যেখানে তার মাস্কেট বা কামান- বিশেষ করে তার নতুন তৈরি করা কামান, যার সাহায্যে পৌনে এক মাইল দূরত্বে গোলা নিক্ষেপ করা সম্ভব- দক্ষতার সাথে কাজে আসবে।
চতুর রানা বিচক্ষণতার সাথে দ্রুতগতির যুদ্ধ বেছে নিয়ে নিজের অধিক দ্রুতগামী বাহিনীর সহায়তায় বাবরের দূর্গ আর রসদ সরবরাহের পথে ঝটিকা আক্রমণ বজায় রেখেছে। অনেক দিন আগে বাবর যেমন আক্রমণ ফারগানার পাহাড়ী এলাকা থেকে তার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের লোকদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছিলো। আক্রমণের ফলে বাবরের বাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের অস্থির করে তুলেছে। এবং তারা এখন সবসময়ে আক্রমণের আশঙ্কায় তটস্থ থাকছে। ঝটিকা আক্রমণের ফলে বাবরকে ক্রমাগতভাবে তার শ্রেষ্ঠ বাহিনীর একটা বিশাল অংশকে মালামাল বহনকারী বহরের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত করতে হয়েছে।
হুমায়ুন এখন তার পাশে এসে পৌঁছায়। “দশ বছর আগে তোমার সেই সাদা টাট্ট ঘোড়াকে আমি যেমন পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতাম, এখনও তোমাকে সেভাবে আমি হারিয়ে দিতে পারি…”
“আপনার ঘোড়াটা সেরা। আর ফলাফল ভিন্ন হতো যদি আমরা নিজেদের পায়ের উপরে ভরসা করতাম।” নিজের বাবার সাথে বয়ঃসন্ধিক্ষণের প্রতিযোগিতা আর পরাজয় উপলব্ধি করে এই বয়সের স্পর্শকাতরতায় প্ররোচিত হয়ে খেপে গিয়ে, হুমায়ুন উত্তর দেয়।
“আমি ঠাট্টা করছিলাম। যাই হোক, আমরা দুজনেই আপাতদৃষ্টিতে রানাকে পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়েছি। সে যদিও আমাদের চেয়ে বয়সে বড় আর পঙ্গু। নিচের ঐ সমভূমি জনমানবশূন্য। আমাদের পুনরায় ভাবতে হবে। আজ রাতে আমরা একাকী আহার করবো, যাতে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারি।
*
সাদা জোব্বা আর ঢোলা পাজামা পরিহিত পরিচারক দু’জন খাবারের শেষ পদ নিয়ে আসবার জন্য তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে বের হয়ে যায়- কমলা, বাদাম আর আঠাল মিষ্ঠান্ন। বাবর আর হুমায়ূন নিচু টেবিল থেকে পেছনে সরে এসে, একদা ইবরাহিমের দিল্লীর প্রাসাদের শোভাবর্ধন করতো এমন হাতি আর ময়ূরের নকশা করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে। কাবুলের দক্ষিণে অবস্থিত গজনীর দ্রাক্ষাকুঞ্জ থেকে সদ্য আগত ওয়াইনে পূর্ণ দুটো সোনার পানপাত্র দুজনের হাতে।
“আমি ভাবছিলাম রানাকে কিভাবে আমরা যুদ্ধে প্রলুব্ধ করতে পারি।” হুমায়ূন তার পানপাত্র নামিয়ে রাখে। “আমরা দুজনেই জানি রাজপুতের কাছে সম্মানই- তার নিজের আর নিজের পরিবারের সম্মান- সবকিছু। আমরা রানার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান দখল করবো, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয় স্থানটা দ্রুত পূনর্দখল করতে না পারলে তার সম্মানহানি ঘটবে।”
“নীতিগতভাবে ভালো পরিকল্পনা। কিন্তু সেরকম কোনো স্থানের কথা কি তোমার জানা আছে?”
“আমি আমাদের স্থানীয় মিত্রদের ভিতরে বেশ কয়েকজন সর্দারের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে শঙ্কের মা আগ্রার উত্তর-পশ্চিমে তার এলাকা থেকে বিশ মাইল দূরে একটা ছোট গ্রাম খানুয়াতে জন্মেছিলেন- এখান থেকে জায়গাটা পঁচাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। মায়ের সম্মানে সে সেখানে তাদের কূলদেবতার মন্দির নির্মাণ করেছে এবং এখনও বছরে একবার পূজো দিতে যায়।”
“তুমি নিশ্চিতভাবেই এ বিষয়ে ভালোমতো ভাবনাচিন্তা করেছে। আমি আগামীকাল সকালেই খানুয়া আর এখানের মধ্যবর্তী এলাকা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠাবো এবং তাদের আরো দেখে আসতে বলবো এলাকা আমাদের লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত কিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে আমি আমার সৈন্যদের কয়েক দিনের ভিতরে সেখানে জড়ো হবার আদেশ দেবো। কিন্তু তুমিই কেবল এ বিষয়ে চিন্তা করছে না। আমি চিন্তিত রানা শঙ্কের ঝটিকা আক্রমণের ফলে মনোবল দুর্বল হয়ে পড়া আমাদের যোদ্ধাদের কিভাবে চাঙ্গা করে তুলবো।”
“আপনি ভেবে কি ঠিক করেছেন?”
“আমার সিদ্ধান্তটা একটু উদ্ভটই শোনাবে হয়তো। অতীতে আমার সব অভিযানই ছিলো এমন শত্রুর বিরুদ্ধে, যাদের ভিতরে সামান্য সংখ্যক হলেও কিছু লোক ছিলো যারা আমার ধর্মমতে বিশ্বাসী। এইবার আমার প্রতিপক্ষের সবাই হিন্দু- মানে বলতে গেলে কাফের। আমরা একটা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করবো- জিহাদ।”
“কিন্তু আমরা এখন হিন্দুস্তানে আর স্থানীয় শাসকদের ভিতরে আমাদের মিত্র যারা তাদের ভেতরে অনেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।”
“এইবারের যুদ্ধে তাদের মূল বাহিনী থেকে আগেই পৃথক করে ফেলতে হবে। আমি অবশ্য এখনকার মতো তাদের অনেকের আনুগত্য বা নিদেন পক্ষে, তার কার্যকারিতার বিষয়ে বেশি চিন্তিত। তারা পেছনের দিকে সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে।”
“এতে কাজ হতে পারে।”
“এতে কাজ হবেই…আমি ভেবে রেখেছি কিভাবে এই পরিবর্তন প্রতীকীভাবে প্রকাশ করবো। গজনীর এই লাল ওয়াইনই আমার স্পর্শ করা শেষ এ্যালকোহল। আমার লোকদের সামনে আমি বাকি মদ আগামীকাল মাটিতে ফেলে দিয়ে তাদের আমি জিহাদের ডাক দেবো।”
“কিন্তু আমি আপনাকে সারা জীবন পান করতে দেখে এসেছি…”
“হ্যাঁ, আর আমি জানি মদ, ভাঙ আর পপিগাছের ফল আফিমও আমি পছন্দই করি। আমরা, যাদের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত এবং চেঙ্গিসের মোল্লারা আমাদের কাছে সত্যিকারের ধর্ম প্রচার করার বহু আগে থেকেই কড়া পানীয় পানে অভ্যস্ত। গাঁজানো ঘোড়ার দুধ খাভাশ উঁচু তৃণভূমিতে চেঙ্গিসের লোকদের শীতকালে ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। কঠোর মোল্লারাও বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষকে পুরোপুরি আর সাথে সাথে বদলে ফেলাটা অসম্ভব। বিরত থাকাকে তারা আদর্শ বলে প্রচার করেন এবং ধার্মিক আর তপস্বীদের মদপান করা থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করেন। কিন্তু একই সাথে ভোগবিলাসীদের পানাহারের প্রবণতা মেনেও নেন। তারা আমাদের সামান্য সময়ের জন্য বিরত থাকতে উৎসাহিত করেন- যেমন রমজানের পবিত্র মাসে এবং বৃদ্ধ হবার পরে যখন স্রষ্টার সাথে মিলিত হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
বাবর আরেক চুমুক পান করে। “হ্যাঁ, মদটা ভালো এবং আমি তৃপ্তি করে এটা উপভোগ করতেও জানি। আর সে কারণেই আমি মদ ত্যাগ করলে সেটা মনোবলের উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আমি সেজন্য চাই তুমিও পানাহারের অভ্যেস পরিত্যাগ করো।”
হুমায়ুন ঢোক গিলে।
“তুমি অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও…আমি কয়েকদিনের ভিতরেই মোল্লাদের সাথে আলোচনা করে নিয়ে আমার সৈন্যদের সামনে এই ঘোষণা দিবো এবং আমাদের হিন্দু মিত্রদের অন্য কাজে নিয়োগ করবো।”
*
একটা চতুস্কোণাকৃতি শূন্যস্থানের চারপাশে বাবরের সেনাবাহিনী সুসজ্জিত অবস্থায় সন্নিবেশিত করা হয়, যার মাঝের শূন্যস্থানে একটা কাঠের মঞ্চ স্থাপিত করা হয়েছে। পুরোটা সোনালী কাপড়ে মোড়ানো এবং এখন তাদের সম্রাট সেখানে সবুজ আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার কোমরবন্ধে মুক্তাখচিত এবং গলায় আকাটা চুনি আর পান্নার গর্জেট শোভা পায়। তার মাথায় সোনার মুকুট আর কোমরে আলমগীর ঝুলছে। তার পাশে উপযুক্ত রাজকীয় পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে হুমায়ূন দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বয়োজ্যেষ্ঠ মোল্লার দল। সবার পরনে কালো আলখাল্লা আর ডান হাতে কোরান শরীফ।
বাবর কথা বলতে আরম্ভ করে: “ভাইয়েরা, আমাদের এলাকায় অনুপ্রবেশের দুঃসাহস দেখিয়েছে উদয়পুরের যে উঁইফোড় রানা। আগামীকাল আমরা তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। সে আমাদের ধর্মের অনুসারী না। সে সত্যিকারের এক আল্লাহ্র উপাসনা করে বহু দেবতার পূজা করে থাকে। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সে মনে করেছে পৃথিবীর বুকে বহুবার সে জন্ম লাভ করবে। আর এজন্যই বোধহয় সে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমরা তাকে আমাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আমাদের সাহস প্রমাণ করে দেখাবো। আমরা আমাদের একমাত্র জীবন ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র ভীত নই। তার কারণ কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলে আমাদের বেহেশত নিশ্চিত। আমি আমাদের মোল্লাদের সাথে, আমার চারপাশে যেসব জ্ঞানী আর পূণ্যবানদের তোমরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছো, আলোচনা করে দেখেছি। তারা একমত হয়েছে যে, আমরা যেহেতু কাফেরদের সাথে লড়াই করছি, আমাদের আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত সাহসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের নিমিত্তে, এই যুদ্ধকে আমরা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষণা করতে পারি। আমরা আল্লাহর জন্য, আমাদের বিশ্বাসের জন্য যুদ্ধ করবো। তার নামের মহীমায় ইনশাল্লাহ আমরা বিজয়ী হবো। আল্লাহু আকবর! আল্লাহ মহান!”
সৈন্যবাহিনীর সামনের সারি থেকে উচ্চকণ্ঠে সম্মতির আওয়াজ ভেসে আসে এবং মাত্রা আর উদ্দীপনায় বৃদ্ধি পেয়ে ধীরে ধীরে পুরো বাহিনীর ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা শূন্যে তাদের তরবারি তুলে ধরে এবং উন্মত্তের মতো ঢালে আঘাত করতে থাকে।
কয়েক মিনিট পরে, বাবর হাতের তালু নিচের দিকে করে অনবরত আন্দোলিত করে সবাইকে আরো একবার চুপ করতে বলে। উপস্থিত সবাই চুপ করতে সে পুনরায় বলতে শুরু করে: “তোমরা সবাই জানো আমি এমন একজন মানুষ, যে এখনও আল্লাহর নির্দেশ পুরোপুরি পালন করতে সমর্থ হয়নি। আমরা সবাই যেমন আমিও দুর্বলতার কারণে রিপুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। তোমরা জানো আমি মদ্যপান পছন্দ করি। তোমরা গজনীর সুরার কথা শুনে থাকবে- বছরের সেরা আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত- যা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে নিজের ভোগস্পৃহা চরিতার্থের জন্য আনিয়েছি। পবিত্র যুদ্ধের প্রতি আমার নিষ্ঠা প্রকাশের নিমিত্তে আমি আজ থেকে মদ্যপান ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করছি এবং আমার ছেলে হুমায়ূনও একই শপথ নিচ্ছে। আমার এই শপথের প্রতীকী প্রকাশ হিসাবে বহু কষ্টে হিন্দুস্তানে আমার নিয়ে আসা গজনীর সুরা আমরা এখন মাটিতে ঢেলে দেবো।”
বাবর কথা শেষ করার মাঝেই, সে আর হুমায়ূন মাথার উপরে কুঠার তুলে ধরে মঞ্চের সামনে সুরা রাখার কাঠের পিপেতে আঘাত করলে পিপে ফুটো হয়ে ভেতরের চুনির মতো লাল মদ বের হয়ে ধূলোর সাথে মিশে মাদকতাময় কাদার সৃষ্টি করে। এবারের উল্লাসের তীব্রতা প্রথমবারের চেয়েও বেশি। বাবরের অমাত্য আর সেনাপতিরা, সাথে অনেক সাধারণ সৈন্যও পরস্পরের সাথে চিৎকারে প্রতিযোগিতায় নামে যে তারাও নিজেদের বদলাতে ইচ্ছুক এবং মদপান থেকে বিরত থাকবে…যে পবিত্র আর পরিশুদ্ধ হয়ে তারা নিশ্চয়ই বিজয়ী হবে…
*
বাবর একটা নিচু টিলার উপরে দাঁড়িয়ে খানুয়ার নিকটবর্তী রাজস্থানের মরুভূমির লাল বালিরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঠিক পেছনেই রয়েছে, মূলত মাটির ইটের তৈরি বাড়িঘরসমৃদ্ধ খানুয়া গ্রামটা। গ্রামের মধ্যেখানে মায়ের পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে রানা শঙ্ক নির্মিত বেলেপাথরের উপরে জটিল কারুকার্যখচিত হিন্দুরীতির মন্দিরটা অবস্থিত। বাবর ন্যাড়া মাথার সাদা আলখাল্লা পরিহিত পুরোহিতদের দাঁড়িয়ে থেকে, মন্দির গায়ে রানা বা তার মায়ের স্মরণে খোদাই করা সব নিদর্শন তার লোকেরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে বা বিকৃত করেছে, দেখতে বাধ্য করেছে। তারপরে সে পুরোহিতদের গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। সে জানে যে তারা বেত্রাহত কুকুরের মতো সংবাদটা নিয়ে রানার কাছে ছুটে যাবে।
যেমন আশা করা হয়েছিলো, রানা শঙ্কের রাজপুত সম্মান এই অপমান বরদাশত করতে ব্যর্থ হয় এবং এই মুহূর্তে রানা বাবাজি নিচের সমতলে তিন মাইল দূরে এসে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করছে। তার শিবির এখনও যদিও ভোরের প্রথম কুয়াশার চাদরে মোড়া। কিন্তু ভোররাতে পাঠানো গুপ্তদূতের দল একটু আগে ফিরে এসে বাবরকে জানিয়েছে যে তারা শত্রু শিবিরে আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণের সুনিশ্চিত দৃশ্য আর আওয়াজ শুনতে পেয়েছে- রান্নার আগুন নেভানো হয়েছে, তরবারিতে শেষ মুহূর্তের শান দেয়া চলছে, ঘোড়াগুলোতে জিন চাপান হয়েছে এবং সারিবদ্ধ হবার সংকেত ধ্বনি হচ্ছে।
বাবরের নিজস্ব সেনাশিবির কয়েকদিন আগে ঠিক- খানুয়ায় তার বাহিনী হাজির হবার অব্যবহিত পরেই আগের মতোই তার লাল তাঁবুটা কেন্দ্রস্থলে রেখে বিন্যস্ত হয়েছে।
“আমার ধারণা পানিপথের মতো একই যুদ্ধকৌশল আমাদের অবলম্বন করা উচিত।” সে কথা শুরু করে, “কিন্তু আমাদের উচিত হবে পাহাড়ের উচ্চতা ব্যবহার করে আমাদের অবস্থান আরো সমুন্নত করা। আমরা কামানগুলো পাহাড়ের মাথায় স্থাপন করতে পারি এবং পাহাড়ের চারপাশে পরিখা আর মাটির বেষ্টনী নির্মাণ করে তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারি।”
বাবরের বহুদিনের পুরাতন সেনাপতি সাধারণত মিতভাষী, হাসান হিজারী, বদখশান থেকে আগত এক তাজিক। প্রায় বিশ বছর সে বাবরের অধীনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছে- তখন কথা বলে উঠে। “সেটা উত্তম প্রস্তাব, সুলতান, কিন্তু শঙ্কের কাছে আনুমানিক দুইশ’র মতো হাতি রয়েছে। আর সে মূলত তার অশ্বারোহী বাহিনীর উপরে নির্ভরশীল। পানিপথের চেয়ে এখানে আমাদের সেনাবিন্যাস অনেক লম্বা হবে। হিমবাহের মতো ধেয়ে আসা হাতির চেয়ে ঘোড়া অনেক বেশি দ্রুতগামী, যদিও কম ভীতিকর। কামানের গোলাতে রাজপুতদের অশ্বারোহী বাহিনী হতাহতের শিকার হলেও এর ফলে তাদের দমানো যাবে না। আমাদের সেনাবিন্যাসের কোথাও কোথাও তারা ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে, সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন। পাহাড়ের মাঝামাঝি তীরন্দাজ আর মাস্কেটধারীদের একটা সারি বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসাবে আমরা মোতায়েন করতে পারি।”
“আমাদের ওখানে অশ্বারোহী বাহিনীও প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রতিরক্ষা ব্যুহের কোথাও যদি ফাটল দেখা দেয়, তবে সেটা সামলাবার জন্য।” হুমায়ুন মন্তব্য করে। “আমাকে সেটা সামলাবার দায়িত্ব দেয়া হোক।” বাবর তাকে নিষেধ করতে পারে না।
গত কয়েকদিন বাবরের সৈন্যরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরিশ্রম করতে থাকে। পরিখা খনন করে, কামানগুলোকে ষাঁড় দিয়ে টেনে পাহাড়ের মাথায় তোলে। তারা মালবাহী গাড়িগুলোর পাশে কাঠের তক্তা দিয়ে চাকা আড়াল করে সেগুলোকে স্থানান্তরযোগ্য প্রতিবন্ধকতায় রূপান্তরিত করে।
হুমায়ুন কয়েক মিনিট আগে বাবরের সাথে পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এসে সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া কোনো খুঁত খুঁজে পায় না। বাবাকে আলিঙ্গন করে পাহাড়ের সামান্য নিচে অবস্থিত অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য নেমে যায়। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে বাবর আসন্ন যুদ্ধে হুমায়ূনের কুশল কামনা করে। হুমায়ূনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সে যুদ্ধবাজ তরুণের নিরাপত্তা জন্য তার সাথে একটা শক্তিশালী দেহরক্ষী বাহিনী দিয়েছে- হাসান হিজারীর তাজিকদের ভেতর থেকে বাছাই করা চল্লিশ জন যোদ্ধা। সে এর বেশি আর কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এরপরেও সে উদ্বিগ্ন থাকে- পানিপথের যুদ্ধের শেষে বাবুরীর মাটিতে ঘষটাতে থাকা হাতের স্মৃতি এখনও দগদগে হয়ে আছে…
কুয়াশার আবরণ কেটে যেতে শুরু করেছে এবং বাবর দেখতে পায় যে রাজপুতেরা পুরোপুরি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সারির পরে সারি অশ্বারোহী বাহিনী দেখা যায়। বাবরের গুপ্তচরেরা হিসাব করেছে যে রানার সৈন্যদের সাথে তাদের বাহিনীর অনুপাত কমপক্ষে চারজনে একজন।
সহসা এক লম্বা রাজপুত অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে বাবরের সৈন্যবাহিনীর দিকে এগিয়ে আসে। তার পরণে কমলা রঙের পোশাক, তার ঘোড়ার জিন আর লাগামও একই রঙের টাসেল দিয়ে সজ্জিত। তার সাদা ঘোড়াটার মাথা একটা চকচকে ইস্পাতের শিরোস্ত্রান দিয়ে সুরক্ষিত করা, যা সকালের রোদে রীতিমত চমকাচ্ছে। বাবরের প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে মাত্র একশ গজ দূরে সে ঘোড়াটা বৃত্তাকারে ঘোরাতে থাকে আর চিৎকার করে অনেকটা যুদ্ধ শুরুর ঘোষণার ভঙ্গিতে। বাবর তার মাস্কেটধারীদের অশ্বারোহীর ভবলীলা সাঙ্গ করার আদেশ দিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা নির্দেশ পালন করে। লোকটা গুলির আঘাতে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। কিন্তু তার পা রেকাবে আটকে যায় এবং ঘোড়াটা তাকে সেই অবস্থায় ছেচড়াতে ছেচড়াতে রাজপুত অবস্থানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পাথুরে মাটিতে ক্রমাগত আছড়াতে থাকার কারণে কমলা পাগড়ি পরিহিত মাথা শীঘ্রই রক্তাক্ত মণ্ডে পরিণত হয়।
বাবর ঠিক যা আশা করেছিলো, প্রথাগত আক্রমণ শুরুর আহবানের প্রতি তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ রাজপুতদের মাঝে বিশৃঙ্খল হঠকারী একটা আক্রমণ প্রবণতার সৃষ্টি করে। তাদের অশ্বারোহী বাহিনী শীঘ্রই রানা শঙ্কের মোতায়েন করা একশ রণহস্তির থেকে অনেকটাই এগিয়ে সামনে চলে আসে। বাবর তার তরবারি নামিয়ে গোলন্দাজ বাহিনী, মাস্কেটধারী আর তিরন্দাজদের সংকেত দেয় শত্রুপক্ষ পাল্লার ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র গুলিবর্ষণ করতে। পাহাড়ের উপরে তার অবস্থান থেকে, রাজপুত বাহিনীকে একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো মনে হয় তার অবস্থান গ্রাস করার জন্য ধেয়ে আসছে। এখানে সেখানে একটা ঘোড়া কি দুইটা সৈন্য মাটিতে আছড়ে পড়ে। কখনও কখনও কামানের গোলা আপাতদৃষ্টিতে গদাই লস্করী কিন্তু আসলে দ্রুতগতিতে ধাবমান হাতির গতি রুদ্ধ করে। কিন্তু কিছুতেই তাদের সামনে এগিয়ে আসবার গতি থামবার লক্ষণ দেখা যায় না, যতক্ষণ না তারা পরিখা আর বেষ্টনীর উপরে আছড়ে পড়ে। যার আড়াল থেকে বাবরের তীরন্দাজের দল যান্ত্রিক ভঙ্গিতে তীর নিক্ষেপ করে চলেছে।
বাবর পাহাড়ের ঢাল থেকে মাস্কেটধারীদের নল থেকে ধোঁয়া নিঃসরিত হতে দেখে এবং তার কাছে কামানের মুখ থেকে তীব্র কটুগন্ধযুক্ত সাদা ধোয়া নির্গত হয়। তার প্রতিরক্ষা ব্যুহের পশ্চিমবাহুর এক স্থানে বাবর দেখতে পায় রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল ভেতরে ঢুকে পড়েছে তার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে এবং বেষ্টনীর। সামনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পিছিয়ে যায় পুনরায় সংগঠিত হতে। অবশ্য পূর্বদিকের বাহুতে সে দেখে রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল মাটির বেষ্টনীর উপরে লাফিয়ে অবতরণ করে বা, ঘোড়া দাবড়ে ঢালে উঠে এসে সেখানে অবস্থিত মাস্কেটধারী আর তিরন্দাজদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বাবর বেশ কয়েকজনকে রাজপুতদের তরবারির ঘায়ে ভূমিশয্যা নিতে দেখে। যারা এরপরে কামানের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
বাবর সাথে সাথে, হুমায়ূনকে ইশারায় তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলে। হুমায়ূন, তার তাজিক দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে বিশৃঙ্খল ভঙ্গিতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাজপুতদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হুমায়ূনের আক্রমণের দাপটের সামনে টিকতে না পেরে অনেক রাজপুত অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। অন্যরা তার সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বেষ্টনীর পেছন থেকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সৈন্যরা সরে যেতে সেখান দিয়ে লাফিয়ে আরো রাজপুত সৈন্য এসে যোগ দেয়। হুমায়ূন বীরত্বের সাথে লড়াই করে। কিন্তু ধোয়ার আড়াল সরে যেতে বাবর তাকিয়ে দেখে রাজপুত সৈন্যরা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে। তারপরে আবার ধোয়া এসে তাকে আর তার দেহরক্ষীদের পুরোপুরি ঢেকে ফেলে।
বাবরের কাছে মনে হয় এক যুগ পরে যেনো আবার ধোয়ার আড়াল সরে যায়। কিন্তু বস্তুতপক্ষে ধোয়া কিছুক্ষণ পরেই সরে গিয়েছিলো। যখন সে দেখে যে রাজপুতরা পাহাড় বেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে এবং বেষ্টনীর ওপাশে সরে পড়ছে। পাঁচ মিনিট পরে হুমায়ূন ঢাল বেয়ে তার কাছে উঠে আসে।
“এতো ধোয়া আমি ঠিকমতো বুঝতে পারিনি, কি ওখানে কি ঘটছে?”
“আমাদের প্রথম আক্রমণের ঝাপটা তাদের সামান্যই পিছু হটিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা পুনরায় সংঘটিত হয় এবং আমাকে দলনেতা বুঝতে পেরে বাকিদের থেকে আলাদা করে দিতে চেষ্টা করে।”
“এই পর্যন্ত আমিও দেখেছি।”
“বেশ, আমার দেহরক্ষীরা তাদের প্রয়াস ব্যর্থ করে দেয়। আর আমি রাজপুতদের সুদে আসলে তাদের এই প্রয়াসের উত্তর দেই। আমরা জটলার ভেতর থেকে বের হয়ে এসে তাদের একজন সেনাপতিকে আক্রমণ করি- বিশাল কালো গোফঅলা এক যোদ্ধা যার পাগড়িতে ময়ূরের পালক গোঁজা ছিলো। আমি প্রথমে তার কাছে পৌঁছাই এবং তার গলা আর মুখ লক্ষ্য করে একবার তরবারি চালাতেই সে জিনের পিঠ থেকে উল্টে গিয়ে মাটিতে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকে। বাকি যোদ্ধারা কার্যত এর ফলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং মাস্কেটধারীরা পাশে নতুন অবস্থান গ্রহণ করায় তাদের সহায়তায় আমরা তাদের পিছু হটিয়ে দেই। শীঘ্রই আমাদের ব্যুহ আবার সুরক্ষিত হয় এবং সামনের বেষ্টনীতে আবারও সৈন্যবিন্যাস করা হয়।”
“তুমি দারুণ দেখিয়েছে।”
“আমাদের কি এগিয়ে গিয়ে তাদের আক্রমণ করা উচিত না?”
“এখনও সময় হয়নি। তাদের উদ্যম বা শক্তি কোনোটাই এখনও প্রশমিত হয়নি। দেখো? তারা পুনরায় আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। আমার লোকদের কাছে পানির থলি আর তীর পৌঁছে দিতে সরবরাহকারীদের নির্দেশ পাঠাও। যুদ্ধ কেবল শুরু হয়েছে।”
বাবরের আশঙ্কাই ঠিক প্রমাণিত হয়। সারা দিন প্রচণ্ড গরমের ভিতরে রাজপুত বাহিনী থেকে থেকেই আক্রমণ চালাতে থাকে। প্রতিবারই প্রতিরক্ষা ব্যুহে ফাটল ধরাবার আগেই তাদের প্রতিহত করা হয়। বেষ্টনীর কাছে মৃত, আহত মানুষ আর ঘোড়ার স্তূপ জমে উঠে। বাবর আহত এক রাজপুত যোদ্ধাকে আধা হামাগুড়ি আধা পায়ে হেঁটে রাজপুত শিবিরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে। ধীরে ধীরে প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে সে সাতশ গজ পেছনের দিকে এগিয়েছে যখন, রাজপুত অশ্বারোহী বাহিনীর একটা নতুন ঝটিকা আক্রমণ তাকে অগ্রাহ্য করে ধেয়ে আসে এবং বেচারার লাশ পাথুরে মাটিতে দুমড়েমুচড়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে। তার মাথার পাগড়ি অর্ধেক খুলে গিয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে বাতাসের আন্দোলনে একমাত্র সেটাকেই নড়াচড়া করতে দেখা যায়।
সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত হয়ে আসছে এমন সময় হুমায়ুন তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকটা আক্রমণের প্রস্তুতির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। “তারা সম্ভবত আরেকটা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে। হাতি আর অশ্বারোহী বাহিনী আগের মতোই সজ্জিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মাঝে পদাতিক বাহিনীর একটা বিশাল অংশ সমবেত হয়েছে। এমন আজ সারাদিনে দেখা যায়নি। আর এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে তারা সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে পরিচারক আর শিবিরে অস্ত্র ধরতে পারে এমন সবাই এসে জড়ো হয়েছে।”
“সম্ভবত তারা তাই। আমি শুনেছি মামুলি পানি বহনকারীও নাকি পরাজিত হয়ে ফিরে যাবার চেয়ে একটা শেষ আক্রমণ করে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পছন্দ করে। তারা এই আক্রমণকে বলে জহর। আক্রমণের আগে তারা পূজো করে এবং তাদের সংকল্প দৃঢ় করতে দেবতার সামনে বলি দেয়।”
“আমাদের এক হিন্দু মিত্র আমাকে বলেছে এই ধরনের আক্রমণের আগে তারা আফিম খেয়ে নেয় ভয় আর আঘাতের যন্ত্রণা লাঘব করতে… “
“কোনো সন্দেহ নেই। ঐ তারা এগিয়ে আসছে…”
তূর্যধ্বনি, ঢোলের সম্মোহনী বোল আর খোল, করতালের বিকট শব্দে রাজপুত বাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। এবার তাদের অগ্রসর হবার বেগ অনেক শ্লথ সাথে পদাতিক সৈন্য রয়েছে বলে।
“সহিসকে আমার ঘোড়া প্রস্তুত রাখতে বলল।” চিৎকার করে হুমায়ূনকে বলে। “সময় হলে এবার আক্রমণের নেতৃত্ব আমিই দেবো।”
“আমিও আপনার পাশে থাকতে চাই।”
“কিন্তু তার আগে আমাদের বাদ্যযন্ত্রীদের বলো যে রাজপুত বাহিনীর চেয়ে বেশি আওয়াজ করতে এবং আমাদের সব সেনাপতিকে জানিয়ে দাও যে রাজপুতরা প্রতিবার রণ হুঙ্কার দেয়ার সাথে সাথে তারাও যেন উত্তরে, আল্লাহু আকবর’ বলে চেঁচিয়ে উঠে- এটা তাদের মনোবল বৃদ্ধি করবে।”
অগোছালো রাজপুত বাহিনী সামনে এগিয়ে আসে। বাবরের গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা বর্ষণ করে তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। মাস্কেট আর তীরন্দাজের দল ঘোড়ার পিঠ খালি করতে থাকে। মাঝে মাঝে একটা হাতি হয়তো কাত হয়ে উল্টে পড়ে যায় বা আহত এবং আতঙ্কে ঘুরে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবাইকে বিপর্যস্ত করে তোলে। রাজপুত বাদকের দল এখনও তাদের সম্মোহনী বাজনা অব্যাহত রেখেছে। সারির মাঝে সৃষ্ট ফাঁকা স্থান পূর্ণ হওয়া বজায় থাকে। বাবরের মাথায় “মেওয়ার” আর “আল্লাহু আকবর ধ্বনি তালগোল পাকিয়ে যায়। কামানের শব্দ আর আহতদের আর্তনাদ যেনো তার নিচে চাপা পড়ে।
বেষ্টনী থেকে মাত্র দুশো গজ দূরে যখন রাজপুত বাহিনী। তাদের অশ্বারোহী বাহিনী পূর্ববর্তী আক্রমণে নিহতদের লাশের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে আসে। পদাতিক বাহিনী তাদের মৃত সহযোদ্ধাদের লাশ কোমল পাদানির মতো ব্যবহার। করে পরিখা অতিক্রম করতে এবং বেষ্টনী টপকে যেতে। পুরো প্রতিরক্ষা ব্যুহ জুড়ে ব্যক্তিগত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু বাবর আর হুমায়ূন যেখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক তার পাদদেশে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ শুরু হয়।
“আমরা ঐখানে আমাদের বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো।” কোষ থেকে আলমগীর টেনে বের করেবাবর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে আরো একবার সামনে এগিয়ে যেতে আদেশ দেয়। তারপরে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অবশিষ্ট বেষ্টনী অতিক্রম করে সরাসরি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এবার পাহাড়ের উপর থেকে তাদের ধেয়ে আসা আক্রমণের তোড়ের সামনে রাজপুত বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ঘোড়া পেছনে সরে গিয়ে পদাতিক বাহিনীকে পিষ্ট করে। সে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে এক রাজপুত তীরন্দাজ তাকে লক্ষ্য করে ধনুক উঠিয়েছে এবং সে এগিয়ে গিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করার আগেই ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর তার ঘোড়ার জিনের চামড়ার হাতলে এসে গেঁথে যায়। বাবর রাজপুত তীরন্দাজের অরক্ষিত দেহ লক্ষ্য করে তরবারি চালায়। অল্প সংখ্যক রাজপুত যোদ্ধাই সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ইস্পাতের তৈরি মিহি বর্ম পরিধান করে এবং সে বাবরের ঘোড়ার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে।
রাজপুত বাহিনীর ভিতর থেকে বের হয়ে এসে বাবর তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। যখন হুমায়ূন আর অন্য যোদ্ধারা, বাবর উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে হুমায়ূনের শিরস্ত্রাণ কোথায় যেনো পড়ে গেছে। তারা পাশে এসে একত্রিত হয়। তারপরে তারা আবার রাজপুত বাহিনীর দিকে ধেয়ে যায়, অবশ্য এবার পেছন থেকে। যদিও তারা বীরেরমতোই যুদ্ধ করে। কিন্তু কমলা রঙের পোশাক পরিহিত যোদ্ধার দল শীঘ্রই বেষ্টনীর ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে আটকে পড়ে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে। পাঁচজনের একটা দলকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হলে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে তরবারি বিদ্ধ করে। কিন্তু সর্বত্রই যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বাবর এবার বুঝতে পারে বিজয় তার কুক্ষিগত হয়েছে।
তারপরে সে খেয়াল করে তার একশ গজ ডানে, হুমায়ূন মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং তার তিনজন দেহরক্ষী তার দেহের নিম্নাংশের বস্ত্র কেটে সরিয়ে নিচ্ছে। সে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পিতৃসুলভ আশঙ্কা নিমেষে বিজয়ের আনন্দ ম্লান করে দেয়। সে হুমায়ূনকে সজাগ দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যদিও বেচারা ব্যাথায় কুঁচকে রয়েছে। “কিছু না উরু একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে- পলাতক রাজপুতদের কারো ছোঁড়া একটা তীর কপালগুণে এসে লেগেছে।”
তীরটা এখনও তার ছেলের পায়ে থেকে বের হয়ে রয়েছে এবং রক্ত তীরটার ধাতব ফলা বেয়ে চুঁইয়ে বের হচ্ছে, যদিও কেবল অর্ধেকটা হুমায়ুনের দেহের ভিতরে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা গভীরে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তারপরেও দ্রুত বের করতে হবে- বহু বছরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এটা আমি জেনেছি। আমি আমার ছেলের কাঁধ চেপে ধরছি।” বাবর হুমায়ূনের দেহরক্ষীদের বলে। “তোমাদের একজন তার গোড়ালি চেপে ধর। তোমাদের ভিতরে যে শক্তিশালী সে তীরটা বের করে আনবে। মনে রাখবে একদম সোজা টান দেবে কোনো ধরণের মোচড় দেবে না। হুমায়ূন শক্ত হও।”
বাবর তার ছেলের কাঁধ চেপে ধরে। সাথে সাথে আরেকজন তার পা চেপে ধরলে অন্যজন ঝুঁকে পড়ে দুহাতে তীরটার বাহু ধরে এবং একটানে বের করে আনে। রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয় কিন্তু শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যায়।
“একটা কাপড় শক্ত করে ক্ষতস্থানে বেঁধে দাও। আল্লাহ মেহেরবান, সে আমাদের সাথে বিজয় উদযাপনের জন্য উপস্থিত থাকতে পারবে। একটা খাঁটিয়া তৈরি করে তাকে তাঁবুতে পৌঁছে দাও।”
“না আব্বাজান, পটি বাঁধা হতে আর পরিষ্কার পোশাক পরা হলে আমি আপনার সাথে আমাদের বাহিনীর অবস্থা পর্যবেক্ষণে বের হতে চাই।”
আধ ঘণ্টা পরে, সন্ধ্যার আলো আঁধারির ভিতরে বাবর আর হুমায়ূন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়ায়। মশালের আলোতে বাবরের খাঁটিয়া বাহকের দল নিজেদের লোকদের উপরে ঝুঁকে পড়ে আহতদের মৃত যোদ্ধাদের থেকে আলাদা করে। শিবির অনুসরণকারী আর মুদ্দাফরাসের দল ময়দানের চারপাশে আঁধারের আড়াল ব্যবহার করে মৃত রাজপুত যোদ্ধাদের লাশ থেকে মূল্যবান সামগ্রী খুলে নেবার জন্য হায়েনার মতো কামড়াকামড়ি করতে থাকে। বাবর আর হুমায়ূন তাদের দলবল নিয়ে হাজির হতে তারা আঁধারে মিলিয়ে যায়।
পিতা ও পুত্র নিরবে তাদের আহত যোদ্ধাদের যেখানে রাখা হয়েছে সেইসব তাঁবুর কাছে উপস্থিত হয়। কেউ কেউ অসাড় হয়ে শুয়ে আছে, কেউবা ক্ষতস্থান থেকে মাছি তাড়ায়, কেউ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, কেউ আর্তনাদ করা থেকে বিরত থাকতে হাত কামড়াচ্ছে এবং অন্যরা সাহায্য প্রার্থনা করছে।
“আব্বাজান এটা তাহলে সত্যি মারাত্মক আহত যারা, তারা হয় মায়ের জন্য নতুবা আল্লাহর জন্য কান্নাকাটি করে।”
“তাদের মায়েরাই তাদের জন্য নিঃশর্ত আর প্রশান্তিদায়ক স্থান এবং আল্লাহ তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য বিরাট আশার স্থল।” বাবর চুপ করে থেকে কি ভাবে তারপরে আবার বলে, “আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, এই লোকগুলোর সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের কারণেই আমরা আজ হিন্দুস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হতে পেরেছি। আমরা তাদের এই বলিদানের বদলে তাদের পরিবার যেনো সুখে শান্তি তে থাকে তার ব্যবস্থা করবো এবং যারা বেঁচে আছে তাদের যথোপযুক্ত প্রতিদান দেবার ব্যবস্থা নেবো। সবচেয়ে বড় কথা আমরা এজন্য তাদের কাছে ঋণী এবং তাদের এই আত্মদান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু একই সাথে আত্মত্যাগ আর মৃত্যুর মাঝে আটকে থাকলে চলবে না। সবাই শাসক বা প্রজা নির্বিশেষে-সাম্রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে বেশি সচেতন হয়ে উঠবার অর্থ হল দুর্বল আর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠা। আজ রাতে আমরা আমাদের বিজয় উদযাপন করবো। আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রুকে পরাজিত করেছি। তার সমূলে ধ্বংস হবার খবর যখন অন্য শাসকরা জানতে পারবে, তখন তারা আমাদের। আক্রমণের কথা চিন্তাও করবে না। আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আজ আমরা একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছি।”
*
পরের দিন দুপুর নাগাদ ছায়া দীর্ঘ হতে শুরু করলে, বাবর আরও একবার তার চারপাশে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। অনেকের শরীরে পট্টি বাঁধা, কেউ আবার লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“ভাইয়েরা আল্লাহতালার কাছে হাজার শুকরিয়া। তিনি আমাদের ন্যায়সঙ্গত কারণের প্রতি তোমাদের বিশ্বাস আর তোমাদের সাহসের জন্য আমাদের মহান এক বিজয় দান করেছেন। আমরা আরো একবার তৈমূরের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে নিজেদের যথার্থতা প্রমাণ করেছি এবং ইতিহাস আমাদের এভাবেই স্মরণ করবে গতরাতে আমরা বিজয়োল্লাস করেছি এবং আগ্রায় ফিরে যাবার পরে, যা কেবল চারদিনের দূরত্বে অবস্থিত, আমি আরো একবার আমার কোষাগার উলঙ্গ করে তোমাদের সবাইকে উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করবো।
আমি গতরাতে এক বন্দির কাছে জানতে পেরেছি যে, যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায় রানা শঙ্ক- আমাদের উদ্ধত প্রতিপক্ষ যে, আমাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিলো- পেটে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হবার কারণে তাকে চারটা ঘোড়ার মাঝে একটা হাল্কা খাঁটিয়ায় করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আজ গুপ্তদূতেরা, রাজপুতেরা আবার যুদ্ধের জন্য একত্রিত হচ্ছে কিনা দেখতে গিয়ে এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা রাজকীয় অন্তেষ্টিক্রিয়ার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে দেখতে পায়। মাঠে কাজ করতে থাকা এক কৃষক তাদের জানায় যে, সেটা রানা। শঙ্কের জন্য নির্মিত হয়েছে। যিনি নিকটেই দেহত্যাগ করেছেন। আর তার দেহরক্ষীরা তার জন্য মঞ্চটা তৈরি করেছে। আমাদের গুপ্তদূতেরা ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে থেকে দেখে যে, সত্যি সত্যি তার দেহ মঞ্চের উপরে স্থাপন করা হয়েছে। কাঠের স্তূপের নিচে আগুন জ্বালাবার পরেই কেবল তারা সে স্থান ত্যাগ করে। পেছনে তাকিয়ে তারা কমলা আগুনে আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখেছে। রানা তার একাশিতম ক্ষতচিহ্ন উদযাপনের জন্য বেঁচে নেই। আগুনের শিখা আমাদের এই নতুন ভূমি থেকে উচ্ছেদের রাজপুতানা আশা ভষ্ম করে দিয়েছে।
“বাকি যারা বেঁচে আছে। যারা এখন আমাদের বিরুদ্ধে মনে মনে আমাদের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে। তারা আমাদের মোকাবেলা করার ফলে কি দুর্গতি হতে পারে এবার বুঝতে পারবে। আমরা আবারও তৈমূরের রীতি অনুসরণ। করবো। আমি শত্রুপক্ষের মৃত যোদ্ধাদের মাথা কর্তনের হুকুম দিয়েছি এবং এখান থেকে আগ্রা পর্যন্ত প্রতিটা চৌরাস্তায় একটা কর্তিত মুণ্ডের স্তূপ তৈরি করতে বলেছি। আশা করা যায় আমাদের শত্রুরা এর সাথে সাথে পচে মরবে।”
*
সেদিন সন্ধ্যাবেলা হুমায়ুন তার আব্বাজানের বিশাল লাল রঙের যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত তাঁবু যেখানে তার ব্যক্তিগত কামরা অবস্থিত সেখানে প্রবেশ করে। যুদ্ধের স্মৃতি এখন তার মনে তাজা এবং নতুন সাম্রাজ্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কে তার মনে উৎকণ্ঠা জন্ম নিয়েছে। তার উচিত আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হওয়া। কারণ সে বড় ছেলে- যদিও তৈমূরীয় প্রথা অনুযায়ী বড় ছেলে সবসময়ে অধিকার বলে উত্তরাধিকারী হয় না এবং বাবরের প্রিয় স্ত্রীর সন্তান। এখন যুদ্ধক্ষেত্রেও সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এখন হয়তো সময় হয়েছে আব্বাজানের সাথে উত্তরাধিকারীর বিষয়ে আলাপ করার। নিদেনপক্ষে নতুন কোনো দায়িত্ব যেখানে সে নিজের যোগ্যতা আরও প্রমাণ করতে পারবে।
বাবরের কামরার সোনার কারুকাজ করা ভারী পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সে। দেখে তার পিতা একটা নিচু ডিভানে সোনার কারুকাজ বেগুনী আর সাদা তাকিয়ায়। মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আর পাশেই একটা রূপার হুঁকো রাখা। হুমায়ূনের ভেতরে প্রবেশের শব্দ বা তাকে সে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হয় না। ভাবলেশহীন চোখে সে তাকিয়েই থাকে। হুমায়ূন কাছে এসে দেখে বাবরের চোখের তারায় দৃষ্টিহীন অভিব্যক্তি এবং তার সবুজ চোখের মণি প্রসারিত হয়ে আছে। সে বাবরের কাঁধে হাত রেখে আলতো করে তাকে একটা ঝাঁকি দিলে তার চোখের পাতা পিটপিট করে উঠে এবং সেখানে ভাষা ফিরে আসে। “হুমায়ুন বেটা, তুমি কখন এলে?”
“কিছুক্ষণ আগে।”
“রাতের আহারের পরে আমি ভাঙ আর আফিম মিশ্রিত একটা হুঁকো টেনে থাকি, যা আমাকে এই পোড়া মাটির দেশ আর এর অসংখ্য মানুষের ভীড় থেকে আর সব ধরণের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি আবার ফারগানার পার্বত্য এলাকায় ফিরে যাই। পান্নার মতো সবুজ ঘাসের দোলা, যার মাঝে মাঝে লাল টিউলিপ আর নীল আইরিস ফুটে আছে। আমি চঞ্চল নহরের স্বচ্ছ আর ঝকঝকে পানির ধারা বইতে দেখি- প্রতিটা ফোঁটায় একটা পৃথিবী ধারণ করে আছে। আমি আবারও তরুণ বয়সের মতো নির্ভার, আর বেপরোয়া হয়ে উঠি। আমার উপরে যেনো শান্তির বারিধারা বর্ষিত হয় এবং আমাকে সব ধরনের দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়। বাবর প্রশান্তিতে হাসে, সামান্য ক্লান্তির ছোঁয়া রয়েছে তার হাসিতে। “তুমি কি বলো? আমরা কি গোলাপপানির গন্ধযুক্ত সেই অসাধারণ মিষ্টি আরেকবার খেয়ে দেখবো?”
হুমায়ূন বুঝতে পারে তার স্বপ্নের কথা আলোচনার সময় এটা না। তার আব্বাজান এখন অতীত রোমন্থন করছেন। তারও হয়তো তাই করা উচিত। গজনীর লাল মদ আসলেও দারুণ। পুনরায় পান শুরু করার জন্য তাকে অন্তত বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমি কেবল বলতে এসেছিলাম আগামীকাল আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে আর অবশ্যই শুভরাত্রি জানাতে।” তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে বাবর তারকা খচিত রাতের আকাশের দিকে তাকায়। সে তাকিয়ে থাকলে বেহেশতের অন্যবদ্য নকশার জন্ম দিয়ে আরো তারা ফুটে উঠে। সহসা শিবিরের কোলাহল, মানুষ আর পশুর হাঁকডাক, আগুনের শিখার উজ্জ্বলতা আকাশের স্বর্গীর আলোর কাছে যাকে স্থূল মনে হয় তাকে অস্থির করে তোলে। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং নিরবে তারা নিচে অন্ধকারে একাকী ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যাবে বলে ঘোড়ায় চেপে বসে।