মানো মাজরায় আপনারা এখন অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন, টেবিলের এক পাশে চেয়ারে বসে সাধারণভাবেই কথাগুলো বললেন ইন্সপেক্টর সাহেব। টেবিলের অন্যদিকে ইকবাল সিং এবং জুগ্গা তাঁর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনি বসছেন না কেন বাবু সাহেব? ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন। এবার সাবইন্সপেক্টর সাহেব সরাসরি ইকবাল সিংকেই বললেন, দয়া করে একটা চেয়ার নিন। ওহে, কি যেন তোমার নাম? বাৰু সাহেবের জন্য একটা চেয়ার দাও না? তিনি একজন কনক্টেবুলকে লক্ষ্য করে বললেন। আমি জানি আপনি আমার ওপর রাগ করে আছেন। কিন্তু এতে আমার কোন দোষ নেই, তিনি বলে চললেন, আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আমি যদি মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করি। তাহলে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে তা একজন শিক্ষিত লোক হিসাবে আপনি ভাল করেই উপলব্ধি করতে পারেন।
কনষ্টেবিলটি ইকবাল সিং-এর জন্য একটি চেয়ার নিয়ে এল।
বসুন। চা বা অন্য কিছু আনবে আপনার জন্য? ইন্সপেক্টর সাহেব অতি মোলায়েমভাবে মৃদু হেসে বললেন।
আপনার দয়া। আমি বরং দাঁড়িয়ে থাকি। গত কিছুদিন সেলে আমি বসে বসেই কাটিয়েছি। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমি চলে যেতে চাই, ইকবাল সিং বললেন। ইন্সপেক্টর সাহেবের মৃদু। হাসির প্রতি উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজন তিনি বোধ করলেন না।
আপনি যখন ইচ্ছা যেখানে যেতে চান যেতে পারেন। আপনাকে মানো মাজরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি টাঙ্গা আনতে বলেছি। আমি সশস্ত্র কনস্ট্রেবল আপনার সাথে পাঠিয়ে দেব। চন্দননগরে এখন একা ঘোরাফেরা করা বা একা এক ভ্ৰমণ করা নিরাপদ নয়।
ইন্সপেক্টর সাহেব একখানি হলুদ রংয়ের কাগজ তুলে নিয়ে পড়লেন: জুগ্গাতু সিং, পিতা আলম সিং, বয়স চব্বিশ বছর, মানো মাজরা গ্রামের শিখ ধর্মাবলম্বী, দশ নম্বর বদমায়েশ।
ঠিক স্যার, কথার মধ্যে জুয়া হাসতে হাসতে বলল। পুলিশের কাছ থেকে সে যে ব্যবহার পেয়েছে তাতে তার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। কর্তৃপক্ষের সাথে তার সম্পর্ক অতি সাধারণ-সে সব সময় অন্যপক্ষের লোক। এর মধ্যে ব্যক্তিত্বের কোন সংঘাত নেই। সাব-ইন্সপেক্টর ও পুলিশ খাকি পোশাকে থাকে, ওরা প্রায়ই তাকে গ্রেফতার করে, সব সময় গালি দেয় এবং মাঝে মাঝে প্রহার করে। ক্ৰোধ বা ঘূণার বশবর্তী হয়ে তারা যেহেতু তাকে গালি দেয় না বা মারে না, সেহেতু তাদেরকে বিশেষ কোন নামের মানুষ বলে গণ্য করা যায় না। তারা একটা সম্প্রদায়মাত্র। তাদের কাছ থেকে কেউ কেউ ভাল আচরণ আশা করে। সেই প্রার্থিত আচরণ না পাওয়া গেলে দুর্ভাগ্যই বলতে হয়।
তোমাকে ছেড়ে দেয়া হলো। কিন্তু তোমাকে ১৯৪৭ সালের ১লা অক্টোবর সকাল ১০টায় ডেপুটি কমিশনার মিঃ হুকুম চাঁদের সামনে হাজির হতে হবে। এ কাগজটায় আঙ্গুলের ছাপ দাও।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব একটা স্ট্যাম্প প্যাড নিলেন। তিনি জুগ্গাত্ সিং-এর একটা আঙ্গুল নিজের হাতে নিয়ে স্ট্যাম্প প্যাডে ঘষলেন এবং পরে ঐ আঙ্গুলটা কাগজের ওপর রেখে চাপ দিলেন।
আমি এখন যেতে পারি? জুগ্গা জিজ্ঞাসা করল।
তুমি বাবুর সাথে টাঙ্গায় যেতে পোর। তা না হলে সন্ধ্যার আগে তুমি বাড়িতে পৌঁছতে পারবে না। জুগ্গার দিকে তাকিয়ে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, মানো মাজরা এখন আর আগের মতো নেই।
মানো মাজরার পরিস্থিতি নিয়ে সাব-ইন্সপেক্টরের কথায় দুজনের কেউ আগ্ৰহ প্রকাশ করল না। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব। আর একখণ্ড কাগজ নিয়ে পড়লেন: মি, ইকবাল সিং, সমাজকর্মী।
ইকবাল কাগজটার দিকে ঘূণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
মুসলিম লীগের সদস্য মোহাম্মদ ইকবাল নয়। আপনারা দেখছি ইচ্ছামতো তথ্য ও দলিল পরিবর্তন করেন।
সূর্ব-ইন্সপেক্টর সাহেব কপট হাসলেন। সবাই ভুল করে। মানুষ মাত্রই ভুল করে, ক্ষমা করা স্বগীয় গুণ, ইংরেজীতেই তিনি কথাগুলো বললেন। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।।
আপনার অসীম দয়া, ইকবাল বললেন, আমার ধারণা ছিল ভারতীয় পুলিশ ভুল করে না।
আপনি বোধ হয় আমাকে নিয়ে কৌতুক করছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না, আপনি আপনার মিশন অনুযায়ী বক্তৃতা করার সময় উন্মত্ত শিখদের হাতে ধরা পড়লে তারা আপনার মানত না। আপনার লিঙ্গের চর্ম কাটা হয়েছে কি না তা দেখতে তারা আপনার কাপড় খুলে ফেলত। দাড়ি ও লম্বা চুল নেই এমন লোককে পরীক্ষা করার জন্য তারা এ ধরনের পরীক্ষাই করে থাকে। এরপর তারা আপনাকে মেরে ফেলত। আমার প্রতি আপনার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
ইকবালের কথা বলার মন ছিল না। তাছাড়া ঐ বিষয়টা নিয়ে তিনি কারও সাথে আলোপও করতে চান না। ঐ বিষয়ে সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের উলঙ্গ আলোচনার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
মানো মাজরায় আপনারা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন! সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব আরও একবার তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। জুগ্গা বা ইকবাল কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহ প্ৰকাশ করলেন না। ইকবাল তাঁর হাতের বইখানি টেবিলের ওপর রেখে বিদায় বা ধন্যবাদ না জানিয়ে চলে গেলেন। জুগ্ন খালি পায়ে মেঝের ওপর ছিল। জুতা পায়ে দিয়ে সেও যাওয়ার উপক্রম করল।
মানো মাজরা থেকে সব মুসলমান চলে গেছে, নাটকীয়ভাবে সাব-ইন্সপেক্টর ঘললেন।
জুগ্গা তার অগ্রসরমান পা থামাল। তারা কোথায় গেছে?
গত রাতে তাদের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ রাতে তারা ট্রেনে করে পাকিস্তান যাবে।
গ্রামে কি গোলমাল হয়েছে? ইন্সপেক্টর সাহেব? তাদের চলে যেতে হলো কেন?
তারা গ্রাম ছেড়ে চলে না গেলে গোলমাল হতো। বাইরে থেকে বন্দুক হাতে বহু লোক এসে মুসলমানদের খুন করছে। মাল্লি ও তার দলের লোকেরা ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। মুসলমানরা মানো মাজরা ছেড়ে চলে না গেলে মাল্লি এতক্ষণে সবাইকে খুন করে ফেলত। তাদের সব জিনিসপত্র– গরু, মহিষ, ষাঁড়, খচ্চর, হাঁসমুরগি, তৈজসপত্র- মাল্লি গ্রাস করেছে। ভালই করেছে মাল্লি।
জুল্পার রাগ পঞ্চমে উঠে গেল। ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা! ও ওর মায়ের সাথে ঘুমায়, বোন আর মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দেয়। ও যদি মানো মাজরায় পা রাখে, ওর পাছায় বাঁশ ঢুকিয়ে উঁচু করে রাখব।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব ঠোঁট উল্টিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসলেন। তুমি বড় বড় কথা বল সর্দার। তুমি তাকে সুযোগ মতো চুল ধরে আটকে পিিটয়েছিলে বলে মনে করছ, তুমি একটা সিংহ। হাতে চুড়ি ও মেহেদী রং লাগানো মহিলা মাল্লি নয়। সে মানো মাজরায় গিয়ে তার ইচ্ছামতো সব কিছুই করায়ত্ত করেছে। ওখানে সে এখনও আছে। ফিরে গিয়ে তুমি তাকে দেখতে পাবে।
আমার নাম শুনলে সেশিয়ালের মতো পালিয়ে যাবে।
তার দলের লোকেরাও তার সাথে আছে, অন্য অনেকে আছে। সবার হাতে আছে বন্দুক ও পিস্তল। নিজের প্রাণের মায়া থাকলে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো।।
জুগ্গা মাথা নোয়ালো। ঠিক কথা ইন্সপেক্টর সাহেব। আবার আমাদের দেখা হবে। সে সময় মাল্লির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন। রাগে সে গরগর করতে লাগল। আমি যদি তার পাছায় থুথু না দেই আমার নাম জুগ্গাত্ সিং নয়। সে তার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ ঘষল। মাল্লির মুখে যদি আমি থুথু নিক্ষেপ না করি, আমার নাম জুগ্গাত্ সিং নয়। এ সময় জুয়াত্ সিং তার নিজের হাতে থুথু ফেলে উরুতে ঘষিল। তার ক্ৰোধ আরও চড়ে গেল। ঐ সময় খাকি পোশাক পরে আপনার পুলিশ যদি ওখানে না থাকে তাহলে বাপের বেটাকে দেখিয়ে দেব, জুগ্গাত্ সিং-এর সামনে চোখ উচু করে কথা বলার পরিণতি, একথা বলে সে তার বুক চওড়া করে মেলে ধরল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, সরদার জুগ্গাত্ সিং।। আমরা মানি, তুমি একজন অতি সাহসী লোক। অন্তত তুমি তাই মনে করা। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব হাসলেন। সন্ধ্যার আগেই তোমার বাড়ি ফেরা দরকার। বাবু সাহেবকে তুমি সাথে করে নিয়ে যাও। বাবু সাহেব, আপনার ভয়ের কিছু নেই। আপনার দেখাশোনার জন্য আপনার সাথে থাকছে। জেলার সবচেয়ে সাহসী লোক।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেবের ব্যঙ্গোক্তির জবাব জুগ্গাত্ দেয়ার আগেই একজন কনষ্টেবল এসে জানোল যে, সে টাঙ্গা যোগাড় করেছে।
বিদায় ইন্সপেক্টর সাহেব। মাল্লি কাঁদতে কাঁদতে এসে আপনার কাছে আমার বিরুদ্ধে যখন রিপোর্ট করবে, তখন আপনি বিশ্বাস করবেন, জুগ্গাত্ সিং শুধু ফাঁকা কথা বলে না।
সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব হাসলেন।
বিদায় জুগ্গাত্ সিং। বিদায় ইকবাল সিংজি।
ইকবাল আর ফিরে তাকালেন না। সোজা এগিয়ে গেলেন।