কালীর চেহারাটা সত্যিই খারাপ। এ নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কত হাসাহাসি করেছি। কালী বলত–তোরা আমার যেগুলোকে খারাপ বুঝিস আসলে সেইগুলোই হচ্ছে সুন্দর। এসব রূপের ব্যাপার তোরা বুঝবিনি।
কিন্তু আজ বাইরের ওই লোকটার কথা শুনে কালীর মুখখানাও ম্লান হয়ে গেল। চলতে চলতে আমরা হোটেলের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালুম। কালী বললে–তোরা যা, আমি নবাব-বিল্ডিং-এর ওই তেতলাতেই থাকব।
কালীকে বললুম–হ্যাঁ, তুই যা। আমাদের যে খাবার দেবে তা থেকে মেরে তোর জন্যে নিয়ে যাব।
কালী চলে গেল।
.
হোটেলের সামনে দাঁড়িয়েও হোটেলের মধ্যে ঢুকতে আমার আর ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু তবুও ঢুকে পড়লুম এবং আস্তে আস্তে তিনতলায় উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালুম।
কিছুক্ষণ পরে হোটেলের মালিক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল–এই যে, তোমরা এসেছ। তারপর আমাদের ভিতরে ডেকে নিয়ে বললে–তোমাদের কিছুই করতে হবে না–শুধু সকালবেলা স্টেশনে গিয়ে ক্যালকাটা মেল থেকে প্যাসেঞ্জার ধরে নিয়ে আসবে। দু’ চারদিন বাদে তোমাদের নামে লাইসেন্স করিয়ে দেব, তখন মাইনের কথা ঠিক হবে। এখন খালি খেতে পাবে। কি? করবে কাজ?
আমরা বললুম–আজ্ঞে, করব।
মালিক রান্নাঘরের দু’জন লোককে ডেকে নিয়ে এসে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে বললে–আজ থেকে এই দু’জন লোক দুবেলা খাবে, দুবেলা চা-ও খাবে। এদের পেট ভরে, যত খুশি এরা খেতে পারে, খাওয়াবে। বুঝলে? হোটেলের বাইরে একটুখানি বারান্দা-মতো ছিল। মালিক আমাদের সেইখানে নিয়ে এসে বললে–এইখানে রাত্তিরে শোবে। এগারোটার সময় হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে-তখন আর তোমরা ভেতরে ঢুকতে পাবে না।
বারান্দায় একখানা তক্তপোশ পাতা ছিল। আমরা দু’জনে বসে বসে ভাবতে লাগলুম কালীকে এইরকম একলা ছেড়ে দেওয়াটা ভালো হল কি না। ভাবতে ভাবতে একঘণ্টা-দু’ঘণ্টা কেটে গেল–কিছু ঠিক করতে পারলুম না।
ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে লোক এসে ডাকলে–চল, খাবে চল।
কথাটা কানে যেন মধুবর্ষণ করলে। তার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর অবধি পৌঁছনো গেল।
এইখানে রান্নাঘরের বিবরণ কিছু দেওয়া দরকার মনে করছি। আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে কোনো প্রথম শ্রেণীর হোটেলের রান্নাঘরে যদি কেউ হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হয়, তা হলে তার খাবার প্রবৃত্তি তখনকার মতো উবে যাবে। আর আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সেই হোটেলের রান্নাঘরের অবস্থা কি ছিল তা যতটুকু স্মরণে আছে তা বলছি।
রান্নাঘরটি বেশ বড় হলেও জিনিসপত্রে ঠাসা হয়ে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, দাঁড়াবার জায়গাটি নেই। ঘরটিকে আধা-আধি ভাগ করা হয়েছে। দেওয়ালের গায়ে চারটি উনুন–তাতে কাঠকয়লার আগুন গনগন করছে। চারটে বড় বড় ডেক তাতে চাপানো। অ্যালুমিনিয়াম জিনিসটা তখনও ওঠেনি কিংবা জাতে ওঠেনি। ডেক্চিগুলো সব পেতলের–তার ওপরে কলাই-করা।
একটা লোক রান্না করছে। সে যে কোন্ দেশের কিংবা কি জাতের, তা বুঝতে পারা গেল না। তিন-চারটে ছেলে তাকে সাহায্য করছে। ছেলেরা তাকে ‘মিস্তিরি’ বলে সম্বোধন করছে। একদিকে একতাড়া হাতে-গড়া রুটি পড়ে রয়েছে। তার ওপর ছোট-বড় লাল কালো সাদা আরশোলার দল ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। একটা ডেকে কিমা, আরেকটাতে ডাল, বিরাট একটা থালায় ট্যাড়সের তরকারি আর ওইরকম আর-একটা থালায় চাঁদামাছ-ভাজা স্তূপীকৃত। একটা ডেক্চিতে ভাতও চুড়োকরা, তাতে মাছি ভনভন করছে–সবগুলি ডেক্চিরই মুখ খোলা, গোটাকয়েক বেড়াল চোখ বুজে বসে আছে। ঘরের আর-একদিকে বিরাট কাঠকয়লার পাহাড়, বাসনপত্তর সাজানো, ঝাঁটা ইত্যাদি রাজ্যের জঞ্জাল ও জঞ্জালসাফের যন্ত্র।
যে ছেলেটি আমাদের ডেকেছিল, সে আমাদের বললে–একটা করে প্লেট নিয়ে বসে যাও। আমরা একটা করে প্লেট নিয়ে বসে গেলুম।
প্রথমেই দুটো করে চাপাটি আর এনামেলের চামচে-হাতার এক হাতা করে সিন্ধী ডাল আমি সবায়ের অলক্ষিতে আধখানা রুটি খানিকটা ডালে জড়িয়ে পকেটে পুরে ফেললুম।
পকেটে ভরে ফেলে আবার খাবার দিকে মন দিলুম। ওদিকে পাতে চাপাটি পড়ামাত্র পরিতোষ একটা চাপাটি পকেটে ভরে ফেললে। আমাদের যে-ছেলেটা পরিবেশন করছিল সে বোধহয় পরিতোষের কাণ্ড দেখতে পেয়েছিল, কেননা তার চোখে মুখে সন্দেহের ছায়া ফুটে উঠেছিল। যাই হোক, সেই রুটি আর ডাল—-তাতল সৈকতে বারিবিন্দু-সম’ উবে গেল। কতদিন যে এই খাবার খেতে পাইনি। তার ঠিকানা নেই। পাত খালি দেখে এবার তিনখানা করে চাপাটি ও আরও খানিকটা ডাল এল। মিস্তিরি ছেলেটাকে বললে–ওদের তরকারি, কিমা–এইসব দাও।
আরও চাপাটি, তরকারি, কিমা এসে হাজির হতে লাগল। ওদিকে হয়েছে কি, একটি ঝিমায়মান মার্জারতনয় গুটিগুটি অগ্রসর হতে হতে সকলের অলক্ষ্যে টপ্ করে একখানা মাছ তুলে নিয়ে দূরে পালিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মিস্তিরি উনুন থেকে রুটি তোলবার চিমটে খানা নিয়ে ছেলেটাকে এক ঘা বসিয়ে দিলে। বিনা বাক্যব্যয়ে আবার এখানকার সংসার চলতে লাগল।
আমরা সেখান থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকে কলে জল খেয়ে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লুম নবাব-বিল্ডিং-এর উদ্দেশে।
বেলা বারোটা–রোদ্দুর ঝাঁ-ঝাঁ করছে। নবাব-বিল্ডিং–এর তেতলায় উঠে দেখি কালী ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমোচ্ছে–বিষণ্ণ মলিন মুখ, শরীর প্রায় আধখানা হয়ে গিয়েছে। আমরা তাকে ডেকে পকেট থেকে খাবার বার করে দিলুম।
অনেকদিন পরে খাবার পেয়ে কালী একেবারে গোগ্রাসে গিলতে আরম্ভ করল। কিন্তু সে সবটা খেতে পারলে না। খান-দুয়েক রুটি ও কিছু তরকারি রেখে দিয়ে বললে-পরে খাব। বিকেলবেলা আমরা চা খেতে গেলুম, কালীকে বলে গেলুম–একেবারে খাবার নিয়ে আসব।
রাত্রি প্রায় দশটার সময় আমাদের খাবারের ডাক পড়ল। দুই বন্ধুতে দুই পকেট ভর্তি করে কালীর জন্য খাবার নিলুম। কিন্তু হোটেল থেকে বেরুতে গিয়ে দেখি–দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। চাবি মালিকের কাছে–সে খেয়ে ঘুমোচ্ছে। অতএব এবং অগত্যা সেই নিরাবরণ তক্তপোশে গা ঢেলে দিলুম।
পরের দিন যথাসময়ে স্টেশনে গিয়ে জন-চার-পাঁচ বাঙালি ভদ্রলোক নিয়ে এলুম। মালিক খুব খুশি। ভদ্রলোকদের থাকবার জায়গা-টায়গাগুলো ঠিকঠাক করে দিয়ে ছুটলুম কালীর কাছে। কালী বললে–রাত্রে কিছু কষ্ট হয়নি; ওই দু’খানা রুটি খেয়েই কাটিয়েছে।
নতুন রসদের ভাণ্ডার তার কাছে খুলে দেওয়া গেল। সে রেখে দিয়ে বললে–এখন থাক্ এগারোটা অবধি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে খাবার সময় হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলুম। দিনকয়েক এমনিভাবেই খেয়ে বেড়িয়ে কাটল।
কিন্তু ভাগ্যনদীতে দিনকয়েক জোয়ার এসেই আবার ভাটার টানে যে-কে-সেই হয়ে দাঁড়াল। কলকাতা-মেলে বাঙালি যাত্রী বিরল থেকে বিরলতর হয়ে উঠল। আমরা আর লোক ধরতেই পারি না।
দিন-কতক এইরকম দেখে হোটেলের মালিক আমাদের ডেকে বললে–একটু মন দিয়ে কাজকর্ম দেখ। লোক না আনতে পারলে হোটেল চলবে কি করে? বসিয়ে বসিয়ে তো আর খাওয়ানো চলবে না।
ভাবতে লাগলুম।
কিন্তু লোক আনি কোথা থেকে?
এইরকম চলেছে–এই সময় একদিন সকালবেলা আমরা হর্নবি রোড ধরে যাচ্ছি–এমন সময় অপর ফুটপাথ থেকে একটি পার্শী ভদ্রলোক হাততালি দিয়ে আমাদের দাঁড়াতে বললে। ভদ্রলোকটি কালীকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলে-তোমার নাম কি?
কালী নাম বললে। লোকটি বললে–তোমার কোনো ভাই কলকাতায় রেলীব্রাদ্রার্সে চাকরি করে?
–হ্যাঁ, করে।
–কি তার নাম?
কালী নাম বলতেই সে বললে–ঠিক আছে। তোমার ভাই ও আমি একসঙ্গে কাজ করি। বোম্বাই আসছি শুনে তোমার ভাই আমাকে বলেছিল তোমার সঙ্গে যদি দেখা হয় তো তাকে নিয়ে এসো। আমি তখন বললুম–তাকে আমি চিনব কেমন করে? সে তোমার চেহারার বিবরণ দিয়ে বলে দিলে যে, দেখলেই চিনতে পারবে। ঠিকই সে বলেছিল। তোমাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। কলকাতায় যাবে?
কালী ইতস্তত করছিল। আমরা তার হয়ে জবাব দিলুম–হ্যাঁ–যাবে যাবে –তা হলে কাল বেলা দশটা নাগাদ আমার বাড়িতে গিয়ে দেখা করবে। ভদ্রলোক তাঁর ঠিকানা দিয়ে গেলেন।
পরদিন সকালবেলায় স্টেশনের কাজ শেষ করে কালীকে নিয়ে চললুম সেই ভদ্রলোকের বাড়ি। ফোর্ট অঞ্চলে একটি নির্জন গলিতে বাড়ি। দোরগোড়ায় একজন লোকের সঙ্গে দেখা হতে সে বললে–চলে যান দোতলায়–তিনি ঘরে বসে আছেন।
পাশীর বাড়ি।
তক্তকে ঝক্ঝকে, কোথাও একটু মালিন্য নেই।
সিঁড়ি থেকে আরম্ভ করে ঘরের দরজা চৌকাঠ অবধি ছাপা আল্পনা দেওয়া। ঘরের বাইরে গিয়ে বললুম–ভেতরে আসতে পারি কি?
তখুনি সেই ভদ্রলোক দরজার কাছে এসে আমাদের অভিবাদন করে ভেতরে নিয়ে এলেন। ছোট্ট ঘর। কম আসবাবপত্রে সুন্দর করে সাজানো। দেওয়ালে এক জায়গায় ভগবান জরাথুস্ত্রের ছবি। তারই নীচে একটি অনির্বাণ দীপ জ্বলছে। খানকয়েক সোফা, তার একটিতে দু’টি মহিলা আর তারই পাশের একটি গদিআঁটা চেয়ারে একটি বৃদ্ধা বসে আছেন। আমাদের ভদ্রলোকটি ঘরের মধ্যে ঢুকেই গুজরাটী ভাষায় মহিলাদের বললেন–এই এঁরাই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন।
আমরা সেই সোফায় বসতে সঙ্কুচিত হচ্ছি দেখে মহিলাদের মধ্যে একজন বললেন–বোসো, বোসো।
বস্তুত আমাদের চেহারা ও বসন এই পরিবেশের মধ্যে খাপ খাচ্ছিল না বলে আমরা বসতে সঙ্কুচিত হচ্ছিলুম। আমরা বসতে-না-বসতেই প্রশ্নের বাণ বর্ষিত হতে শুরু হল–এরকম করে বাড়ি থেকে কখনও পালাতে আছে? বাড়ি থেকে পালালে কেন? কে কে আছেন বাড়িতে–ইত্যাদি।
ভদ্রলোক বললেন–কাল বেলা সাড়ে তিনটের সময় নাগপুরের গাড়িতে আমি কলকাতায় যাব। সকালবেলাতেই আমি টিকিট কিনে রাখব। তুমি এসে তোমার টিকিটখানা নিয়ে যাবে। তারপর ভদ্রলোক পাঁচটি টাকা কালীর হাতে দিয়ে বললেন–যদি এখানকার কিছু খরচপত্র থাকে তো এই নাও।
টাকা পেয়ে আমরা তখুনি উঠে ‘পড়লুম।
শেঠজীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কালী তিনটে টাকা আমাদের দিয়ে বললে–এটা তোরা রাখ্। পথের খরচা আমি এই দু’টাকাতেই চালিয়ে নেব।
মনে পড়ে সেদিন প্রথম কাঁচি-সিগারেটের প্যাকেট কিনে তিনজনে তিনটে আগেই ধরিয়ে ফেলা গেল। এই জাতকের গোড়াতেই বলেছি যে কালী হুঁকো টেনে নতুন কলকে ফাটিয়ে দিতে পারত। সেই কালী কতদিন সিগারেটের আস্বাদ পায়নি। সে পরমানন্দে এক এক টানে মুখ দিয়ে ইঞ্জিনের মতন ধোঁয়া বার করতে লাগল।
যাই হোক, পরদিন সকালবেলা স্টেশনের কর্তব্য সমাধা করে আমরা শেঠজীর ওখানে গেলুম। তিনি আগেই টিকিট কিনে রেখেছিলেন। একখানা থার্ড ক্লাসের বি. এন. আর.-এ হাওড়ার টিকিট কালীকে দিয়ে বললেন–যথাসময়ে গিয়ে ট্রেনে চড়বে। ওই ট্রেনে আমিও যাচ্ছি কলকাতায়–দেখা হবে। আর এই পাঁচটা টাকা নাও-পথে খাওয়া-দাওয়া ও অন্য খরচের জন্য।
এই পাঁচটাকা থেকেও কালী আমাদের তিনটে টাকা দিলে। বেলা প্রায় চারটের সময় কলকাতা-যাত্রী গাড়িতে কালীকে চড়িয়ে দিলুম। সেই গাড়িতেই সেকেন্ড ক্লাসে শেঠজীও গেলেন। ধীরে ধীরে চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনখানা প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে গেল।
কালী চলে যেতেই মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল। আমরা ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে পা চালিয়ে দিলুম।
কালীর কথাই থেকে-থেকে মনের মধ্যে উঠছিল। সে বরাবরই হাসিখুশি আত্মভোলা লোক কিন্তু কলকাতায় বাড়ির খাবার খেয়ে, বাড়ির যত্ন পেয়ে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে হাসিখুশি থাকা এক কথা, আর নিত্য অনাহার, অর্ধাহার, অপমান এবং যতরকম ক্লেশকর অবস্থা হতে পারে তা সহ্য করে হাসিখুশি থাকা আর এক কথা।
মনে পড়তে লাগল আমাদের অরণ্যবাসের সময় প্রতিদিন অর্ধাহার তো ছিল, কোনো কোনো দিন অনাহারেও কেটেছে। সন্ধেবেলায় কর্মাবসানে এক এক দিন শরীরের এমন অবস্থা হত যে, সেখান থেকে তিন মাইল দূরে ইস্টিশনে গিয়ে একমুঠো ছোলাসেদ্ধ ও চালভাজা খেয়ে রাত্তিরে ফেরবার সময় জঙ্গলে জানোয়ার বেরিয়ে পড়ত। সেই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ক্লান্ত ও অনাহারক্লিষ্ট গলায় কালী এক এক দিন গান ধরত–
“কি ছার আর কেন মায়া
কাঞ্চন-কায়া তো আর রবে না–
দিন যাবে তো দিন রবে না–
কি হবে তোর তবে–
আজ পোহাবে কাল কি রবে” ইত্যাদি।
কালীর সেই গান শুনে কান্নার বদলে আমরা হেসে ফেলতুম। ভাবতে ভাবতে অনেকখানি পথ চলে এসে আমরা সমুদ্রের ধারে এসে পড়লুম
বোম্বাইয়ে এসে এই জায়গাটির সঙ্গে আমাদের খুবই ভাব জমে গিয়েছিল। সমস্ত দিন, এমনকি রাত্তিরেও অনেকসময় আমরা এখানেই কাটাতুম। জুতোচুরির পর এদিক থেকে সরে পড়তে হয়েছিল।
তখনকার এই শান্ত সমাহিত ও জনবিরল সমুদ্রতটের সঙ্গে আজকের এই মুখর ও ঘটনাবহুল চৌপাটির কোনো তুলনাই হয় না। সমুদ্র-উপকূলে একটুখানি ঘাটের মতো করা ছিল আর পেছনেই ছিল সমুদ্রকে বেষ্টন করে বেড়ানোর জন্য একফালি সরু রাস্তা এবং এই রাস্তার ধারে ভারী লোহার বেঞ্চি সার বেঁধে সাজানো ছিল আর তারপরই ছিল চার্চগেট স্টেশন অবধি তৃণাচ্ছাদিত সুন্দর ময়দান।
সন্ধের পরই এইসব বেঞ্চিতে আমরা শুয়ে পড়তুম।
বোম্বাই এসে এই জায়গাটিকেই আমরা ঘরবাড়ি করে তুলেছিলুম। অন্ধকারে জনশূন্য প্রান্তরে সেই বেঞ্চিতেই শুয়ে শুনতুম একদিকে মহানগরীর ক্ষীণ জন-কল্লোল অন্যদিকে মহাসমুদ্রের সঙ্গীতময়ী কলধ্বনি–আর এদের সঙ্গে মিলিত হত আমাদের অন্তরের আশা ও ভবিষ্যতের চিন্তা। পায়ে পায়ে এসে সমুদ্রের ধারে সেই ঘাটের মতো জায়গাটিতে এবার আমরা বসে পড়লুম।
দেখতে দেখতে বেলা পড়ে যেতে লাগল। বৃদ্ধ ও প্রৌঢ় পার্শী নর-নারীরা সেই জায়গাটিতে এসে অস্তমান দিনমণিকে প্রণাম জানাতে লাগল। কোমর থেকে পৈতে খুলে জলে ভিজিয়ে আবার তা কোমরে জড়িয়ে নতুন গ্রন্থি দিয়ে আবার শহরের দিকে ফিরে যেতে লাগল। আমাদের পেছনে একদল ফুলের মতো শিশু খেলা করছিল–মাথায় তাদের জরির কাজ ভেলভেটের গোল টুপি–ছুটতে ছুটতে তারা হাসাহাসি করে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছিল আর তাদের পেছনের বেঞ্চিগুলিতে এখানে সেখানে দু’টি চারটি করে নরনারী বসে গল্প করছিল!
সেদিনের সেই সন্ধ্যাটি আমার স্মৃতির কোন্ অতলে লুকিয়েছিল; আজ ‘মানসপটে তা স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও মনে হচ্ছে যে সেদিন যাদের দিনমণিকে প্রণাম করতে দেখেছিলুম আজ তারা কোথায়! সেই যে ফুলের মতো ছোট ছোট শিশুগুলি আমাদের পিছনে কোলাহল করছিল তারাই বা আজ কোথায়! নিজের সম্বন্ধেও প্রশ্ন উঠেছে–ওরে স্থবির! তুই বা কোথায় এসেছিস্? পথের সন্ধান কি হয়েছে? কি আছে পথের শেষে?
বসে থাকতে থাকতে আমাদের চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতে লাগল। সময়ের কোনো জ্ঞানই ছিল না। কখন লোকজন সব ফিরে গিয়েছে–শহরের জন-কল্লোল ক্ষীণতর হয়েছে, তা বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ আমাদের চমকে দিয়ে দূরে রাজাবাই টাওয়ারের ঘণ্টা-ঘড়ি বেজে উঠে জানিয়ে দিলে–সময়মতো পৌঁছতে না পারলে হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
.
অবশ্য হোটেলের দরজা আমাদের জন্য বেশিদিন খোলা থাকেনি। প্রতিদিন সকালে উঠে কলকাতা-মেল ধরতে স্টেশনে ছোটা–তারপর খদ্দের জুটিয়ে না আনতে পারায় হোটেলের মালিকের মুখভঙ্গি আমাদেরও আর ভালো লাগছিল না। ইতিমধ্যে মিস্তিরির দরাজ হাতও ক্রমশ কমতে কমতে ক্রমে কিমা, ট্যাড়শের তরকারি, এমনকি রুটির ওপরেও কামড় বসালে। তারপর একদিন মালিকের নির্দেশেই আমাদের দরজা দেখিয়ে দিলে।
আমরাও বেঁচে গেলুম।
বেঁচে তো গেলুম–কিন্তু এখন আসল বাঁচার উপায় কি?
দুই বন্ধুতে মিলে নিত্যকার মতো সমুদ্রের ধারে এসে বসলুম পরামর্শ করতে।
.
আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে বোম্বাই শহর ছিল অন্যরকম। এই সময়ের মধ্যে তার আঙ্গিক, মানসিক ও সামাজিক পরিবর্তন যা হয়েছে তা দেখে সে-সময়ে কি ছিল তার আন্দাজ করা যাবে না। সে-সম্বন্ধে কিছু বললে হয়তো এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আজ যেখানে মেরিন ড্রাইভের চওড়া রাস্তা ও প্রাসাদের মতো বড় বড় বাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেসব জায়গা ছিল সমুদ্রগর্ভে। এত নাম-করা ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়াম–তাও ছিল জলের মধ্যে। বাড়ি-ঘরের এমন বাহার ছিল না বললেই হয়। বড় বড় পাঁচতলা-ছ’তলা হেলে-পড়া বাড়ি। মাথায় খোলার চাল। সেগুলোকে বলা হত চৌল। তাতে সব রকমেরই লোক অসংখ্য বাস করত। হিন্দুরা প্রকাশ্যে মাছ-মাংস খেত না, তা তিনি মহারাষ্ট্রীয়ই হন বা গুজরাটীই হন। কোনো হিন্দু ইরানীর দোকানে ঢুকত না।
তখনকার দিনে বোম্বাই শহরে হামেশাই এখানে-সেখানে আগুন লাগত। মাথায় টুপিবিহীন লোক রাস্তায় চলতে দেখলে লোকেরা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকত। আমাদের মাথায় টুপি নেই দেখে কতবার যে পুলিশ-কনস্টেবল ধরে নিয়ে গিয়েছে থানায় তার ঠিকানা নেই। আরও কত বলব!
আমরা একবার শুনলুম–কোনো বিশেষ একটি চৌলে একজন বাঙালি ভদ্রলোক থাকেন। তিনি এখানে বড় চাকরি করেন। ভদ্রলোক অত্যন্ত দয়ালু এবং কোনো বাঙালি সাহায্যপ্রার্থী হয়ে গেলে কখনও তাকে নিরাশ করেন না।
এমন দুর্লভ সংবাদ বহুদিন শুনিনি। রাত্রি পোয়াতে-না-পোয়াতে আমি আর পরিতোষ চললুম সেই বাড়ির উদ্দেশে। শহরের এক কোণে হেলে-পড়া একটা চৌল, তারই পাঁচতলায় থাকেন ভদ্রলোক সপরিবারে। বাড়িটাতে গুজরাটী বেশি। একতলায় দোকানপত্র আছে।
জিজ্ঞাসা করে করে পাঁচতলায় গিয়ে উঠলুম। দরজাটা খোলা ছিল। উঁকি মেরে দেখলুম দূরে একটা ঘুরে বোধ হয় একখানা ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’ পেতে তার ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে ভদ্রলোক কাগজখানা পড়ছেন।
আমরা দু’জন হা-পিত্যেশ করে সেই দিকে তাকিয়ে রইলুম। কালো রোগা লম্বা-মতন চেহারা। হঠাৎ একবার মুখ তুলে আমাদের দিকে চোখ পড়তেই তক্তপোশ ছেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলতে লাগলেন–এসেচো বাবা! এই ছ’মাস হল দুটোকে বিদেয় করেচি। আবার দুই মূর্তি হাজির। দেশে কি দুর্ভিক্ষ লেগেছে? কোথায় বাড়ি?
আমরা বললুম–আজ্ঞে, বর্ধমান জেলার কাটোয়া সাব-ডিভিসনে।
এমন সময় কোনো এক ঘর থেকে নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল। ভদ্রলোক সেইখান থেকেই চেঁচিয়ে উত্তর দিলেন–আজকাল জোড়ায় জোড়ায় আসচে।
এবার নারীকণ্ঠ স্পষ্টতর হয়ে উঠল–কোঁতায়? দেঁকি–ইদিকে পাঁটিয়ে দাও।
ভদ্রলোক বললেন–ওই ঘরে যাও। গিন্নি ডাকছেন।
গুটিগুটি সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। একটি নারী–বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। রঙ ফরসা, স্বাস্থ্যবতী বলেই মনে হল। কোঁকাতে কোঁকাতে প্রতিটি শব্দের আদিবর্ণে একটি করে অনুনাসিক যোগ করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন–কি জাত?
বললুম–আজ্ঞে, আমরা সচ্চাষী।
–দুইজনেই কি এক জাত?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, এ আমার মাসতুতো ভাই।
–রাঁধতে-বাড়তে জানো?
-আজ্ঞে হ্যাঁ, ডাল ভাত চচ্চড়ি–এই গেরস্ত বাড়ির রান্না।
–ব্যস! সোজা চলে যাও ওই রান্নাঘরে। চাল-ডাল আছে। মশলা-পাতি বেটে নাও। বাড়ির কর্তা দশটায় আপিস যান। ওঁকে রোজ ঠিক সময়ে ভাত দিতে পারবে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, পারব।
তো ব্যস্–গিয়ে শুরু কর। অন্য কথা পরে হবে। আমাকে যখন হয় খেতে দিও। ফ্ল্যাটের রান্নাঘর। বেশ গুছোনো উনুনের জায়গা রান্নাঘরের মধ্যেই। কল, ছোট চৌবাচ্চা, কয়লা রাখবার জায়গা–সবই বেশ গুছোনো। আমরা কেরোসিন তেল জোগাড় করে তখুনি উনুনে আগুন ধরিয়ে দিলুম। বাড়ির গিন্নি তখনো শুয়ে। গিয়ে বললুম-মা, চাল-ডাল মশলাপাতি কোথায় আছে?
হতভাগারা সেই ওটালে তবে ছাড়লে–বলে দশ মিনিট ধরে চেষ্টা করে উঠলেন। তারপর আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে এসে চাল-ডাল তেল-নুন ইত্যাদি সব দেখিয়ে দিয়ে ক্যাঁকাতে ক্যাঁকাতে পাশেই চানের ঘরে মুখ ধুতে লাগলেন।
কাঠকয়লার উনুন, ধরতে সময় লাগল না। চাল ধুয়ে চড়িয়ে দিয়ে মশলাবাটা ও অন্যান্য কাজে মন দিলুম। গিন্নি ততক্ষণে আবার শুয়ে পড়েছেন। খানিকক্ষণ বাদে গিন্নির গলায় আওয়াজ শুনতে পেলুম। চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে বলছেন– এই–এই–এই–
কাছে গিয়ে দেখি কর্তাও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে বললেন–ও কোথায় ডেকে নিয়ে এসো-
পরিতোষকে ডেকে আনলুম। কর্তা বললেন–দেখো, আমাদের সংসার ছোটো কিন্তু কাজ অনেক। রান্না-করা বাসন-মাজা ঘর-ঝাঁট-দেওয়া। সব এখন মনে পড়ছে না–সব কাজই করতে হবে। খাবে-দাবে আর ওইখানে বিছানা করে শুয়ে থাকবে। মাইনের নামটি কোরো না। বুঝলে? বুঝলুম, এবং বুঝে ফিরে যাচ্ছিলুম। এমন সময় গিন্নি আবার চ্যাঁ চ্যা করে জিজ্ঞাসা করলেন কি নাম–?
বললুম–আমার নাম প্রফুল্ল ঘোষ আর এর নাম বিশ্বনাথ সুর।
বন্ধু পরিতোষ নির্বিকার। সে তখন কানে একবারেই শোনে না। এই নামের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য একতলায় না গিয়ে আর উপায় নেই। তবে সে ছিল ইঙ্গিতজ্ঞ। দু’ চারবার ‘বিশে’ ‘বিশে’–’বিশ্বনাথ’ বলে ডাকতেই নতুন নামকরণ বুঝতে পারল।
ওদিকে ভাত ফুটে গেল। আলোচাল একটু তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। ডাল চাপিয়ে দেওয়া গেল, কাঁচামুগের ডাল। সে আর হতে কতক্ষণ! ততক্ষণে কর্তা চানটান করে জিজ্ঞাসা করলেন–কি রে, রান্না রেডি?
বললুম–আজ্ঞে রেডি। আপনি ঘরে বসুন, সেইখানেই নিয়ে যাচ্ছি।
-আচ্ছা।
কর্তা তাঁর কামরায় চলে গেলেন। ভাত বেড়ে বাটিতে ডাল আর গেলাসে জল নিয়ে ঘরে গেলুম। কর্তার দেখলুম এঁটো কিংবা সকড়ির বালাই নেই। তিনি তক্তপোশের ওপরে বসেই খেতে আরম্ভ করে দিলেন। প্রথমে গ্রাস মুখে তুলেই তিনি বললেন-এ তো বেড়ে রেঁধেছিস রে!
বললুম–আজ্ঞে ঘরে কিছু নেই–রাঁধতে পারলুম না। আজকে বাজারে গিয়ে তরকারি আর ডাল কিনে নিয়ে আসবো।
কর্তা বললেন–বলিস কি? তরকারি রাঁধবি?
–আজ্ঞে, চেষ্টা করে দেখবো। দেখুনই না।
কর্তা কোট পরে বিড়ি ধরিয়ে গিন্নির ঘরে ঢুকে কি-সব বলে আপিসে বেরিয়ে গেলেন। তিনি চলে যাবার পর রান্নাঘর গুছিয়ে দু’জনে গিন্নিকে গিয়ে বললুম,–মা, এখন কি খাবেন?
তিনি বললেন–না, চান করব, মুখ ধোব, আমার খেতে সেই বারোটা।
–তা হলে আমাদের কিছু পয়সা দিন, আমরা বাজার থেকে তরকারি কিনে নিয়ে আসি। গিন্নি বললেন–তরকারি রাঁধতে পারবি তো? কিসের তরকারি রাঁধবি?
–আলু-পটলের ডালনা।
গিন্নি কপালে করাঘাত করে বললেন–একি তোদের বর্ধমান পেয়েচিস? এদেশে কি পটল পাওয়া যায়?
— পটল না পাওয়া যায় অন্য তরকারি তো আছে?
গিন্নি মাথার তলা থেকে একটা টাকা বার করে দিয়ে বললেন–যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাস। আর দু’জনে যাচ্ছিস–একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস।
বাজার যেতে যেতে দু’জনে পরামর্শ করা গেল। ভগবান যখন দিন দিয়েছেন তখন তার সদ্ব্যবহার করতে হবে, আবার কবে তিনি পথে দাঁড় করাবেন কিছুই তার ঠিক নেই। পথে দু’জনে মিলে স্থির করলুম যে দৈনিকের নানান কাজে অন্তত আট আনা পয়সা সরিয়ে রাখতে হবে।
সেদিন বাজার করে ফিরে গিন্নিকে খাইয়ে নিজেরা খেয়ে সারা দুপুর ধরে ঘরদোর ঝেঁটিয়ে জিনিসপত্র ঝেড়ে ঝক্ঝকে তক্তকে করে ফেললুম। আমাদের কাজ দেখে গিন্নির সদাক্লিষ্ট মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর সেদিন রাত্রে কর্তাগিন্নি আমাদের আলুর দম খেয়ে প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন।
মোট কথা, ক’দিনেই আমরা তাঁদের একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে তো উঠলুমই, তার সঙ্গে আমাদের ব্যাঙ্কও বেশ মোটা হতে লাগল।
আমাদের অন্নদাতার নাম সদানন্দ বিশ্বাস। ভদ্রলোক সেখানে একটা বিলিতি ওষুধের আপিসে পাম্ফলেট লিখতেন। ইংরেজি বাংলা গুজরাটী ও হিন্দি ভাষায় তাঁর সমান দক্ষতা ছিল। আপিসে বেশ মোটা মাইনে পেতেন। তা ছাড়া ইন্সিওরেন্সের দালালি করতেন–তাতেও তাঁর ভালো রোজগার ছিল। ছুটির দিনে তাঁর আর নাইবার খাবার সময় থাকত না। কাপড়-চোপড়েরও কোনো বাবুয়ানি ছিল না। ধুতি কোট ও দু’জোড়া জুতো ছিল তাঁর–যাতে কখনও কালি পড়ত না। আমরা এসে তার সংস্কার করলুম। দুটো পেন্টুলান ছিল, বিশেষ বিশেষ দিনে সেগুলো পরতেন। সদানন্দ তাঁর নাম ছিল বটে, কিন্তু তিনি কেন জানি না সদাই নিরানন্দ থাকতেন। সন্ধেবেলা বোতল-গেলাস নিয়ে বসতেন। এই সময়টা তাঁকে একটু প্রফুল্ল দেখতে পাওয়া যেত। তাঁর এই সান্ধ্য-আসরে গুজরাটী, মারাঠী ও বাঙালি অনেকেই এসে জুটতেন। এইসব দিনে আমাদের অন্নদাতার প্রফুল্লতার মাত্রা একটু বেড়ে যেত।
এই আসরে একটি বাঙালি ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আসতেন এবং শ্যামা-সংগীত গাইতেন। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর ছিল মধুর এবং গানগুলিও আমাদের ভালো লাগত। প্রত্যেক গানের আগে · ভদ্রলোক ‘মা মা’ বলে খানিকক্ষণ ভীষণ চেঁচাতেন। আমরা যে পরিবেশে জন্মেছিলুম সেখানে শ্যামা-সংগীতের বিশেষ প্রচলন ছিল না। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখেছি–শ্যামা-সংগীত গাইবার আগে ওই রকম দুচারবার ‘মা মা’ বলে চিক্কুর পাড়া’র রীতি আজও প্রচলিত আছে।
কর্তার এইসব সান্ধ্যা-আসরের জন্য আমরা মাঝে মাঝে ইরানীদের দোকান থেকে মাছ-মাংস কিনে এনে দিতুম। এইসব আহার্যে গিন্নিও বঞ্চিত হতেন না। মৎস্য-মাংসে তো বটেই–নিষিদ্ধ-মাংসেও তাঁর অরুচি ছিল না।
আমাদের এইরকম কর্তাভাজা ভাব দেখে মনিব-মশাই খুশি হয়ে প্রথম মাসেই আমাদের দু’টাকা করে মাইনে ঠিক করে দিলেন। হোটেলে কাজ করবার সময় সকাল দশটা অবধি স্টেশনে থাকতে হত–তারপর সারাদিন ছিল ছুটি। এই অবসরের অধিকাংশ সময়ই আমরা রান্নাঘরে কাটাতুম। হোটেলে দুবেলা কিমা রান্না হত এবং এই বস্তুটি আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। রান্না দেখে দেখে আমরাও কিমা তৈরি করতে শিখেছিলুম।
একদিন গিন্নির কাছে কিমা রাঁধবার প্রস্তাব করে ফেললুম। গিন্নি তো প্রথমে শুনেই শিউরে উঠলেন এবং বললেন–ওরে বাবা, এ-বাড়িতে এসব চলবে না।
আমরা বললুম–কেউ টের পাবে না, কিছুই গন্ধ বেরুবে না।
কর্তা আমাদের প্রস্তাব শুনে নিমরাজি হয়ে গেলেন। ব্যস্, আর যায় কোথায়! একদিন কর্তাগিন্নিকে না জানিয়ে আমরা বোম্বাই-একসের অর্থাৎ আটাশ তোলা কিমা এনে দুপুরবেলা চড়িয়ে দিলুম।
সেদিন রাত্রে কিমা খেয়ে কর্তাগিন্নি যেমন অবাক হলেন তেমনি খুশিও হলেন। সেই থেকে কর্তাগিন্নিকে হঠাৎ অবাক এবং খুশি করে দেবার ইচ্ছে আমাদের মনের মধ্যে জমা হতে লাগল। বোম্বাই শহরকে মাছের দেশ বললেই চলে। সেখানকার বিখ্যাত মাছ—চাঁদামাছ–যিনি পমফ্রেট নামে সর্বদেশবিদিত এবং যেমন সুস্বাদু তেমন অপর্যাপ্ত। তা ছাড়া ইলিশ চিংড়ি ইত্যাদিও প্রচুর পাওয়া যায়। ইরানীর দোকানে চাঁদামাছগুলোকে সেদ্ধ করে একরকম নরম করে ভাজে। তাই খাবার জন্যে সন্ধের পর মাতালের দল সেখানে ভিড় জমায়। এইখান থেকে চাঁদামাছ মধ্যে মধ্যে নিয়ে যাওয়া হত বটে, কিন্তু আমাদের বাঙালির জিহ্বা তাতে পরিতৃপ্ত হত না। বেশ করে প্যাজ আর কাঁচা-লঙ্কা দিয়ে চাঁদামাছের তেল-ঝোল খাবার বাসনা মনের মধ্যে প্রায়ই গর্জে উঠত। একদিন কর্তামশায়ের কাছে এই মাছ নিয়ে আসবার প্রস্তাবও করে ফেললুম। কর্তা তো শুনে লাফিয়ে উঠে বললেন–না, না–অমন কাজও করিনি। এই ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার সময় আমাকে মুচলেকা দিতে হয়েছে–এখানে কখনও মাছ হবে না। যদি ধরা পড়ি তো তৎক্ষণাৎ এ-বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে।
ওখানকার কোনো এক শেঠ সস্তায় গরিব নিরামিষভোজীরা যাতে থাকতে পারে সেইজন্যে এই বাড়ি ঠিক করেছেন এবং নামমাত্র ভাড়ায় তাদের বাস করতে দেন। কাঁচা-লঙ্কা দিয়ে চাঁদামাছ খাবার বাসনা তাই পরিত্যাগ করতেই হল।
সকাল সাড়ে-ন’টার মধ্যেই কর্তামশাই খেয়ে-দেয়ে আপিসে চলে যেতেন। আমরা ইদিক-ওদিক একটু-আধটু কাজ শেষ করে ফেলতুম। গিন্নি শুয়ে গড়িয়ে এগারোটা সাড়ে-এগারোটার সময় উঠে স্নান করে খেয়ে-দেয়ে আবার ক্যাঁকাতে ক্যাঁকাতে বিছানা নিতেন।
সারা দুপুরে কিছু করবার নেই। পরিতোষের সঙ্গে যে একটু গল্প করব তার উপায় নেই, কারণ তিনি ছোট-কথা বড়-একটা কানে তুলতে চান না। বাড়িতে একখানা সাপ্তাহিক বাংলা কাগজ আসত, সেটা পড়বার ইচ্ছা হত বটে, কিন্তু চাকরে খবরের কাগজ পড়ছে–এ দৃশ্য মনিবেরা সহ্য করতে পারবে কি না সন্দেহ হত। কাজেই সে-সময়টা আমি খুঁটিনাটি কাজ করে বেড়াতুম।
সেদিন কি-একটা কাজে দুপুরবেলা গিন্নির ঘরে ঢুকে পড়েছিলুম; এ-সময়টা তিনি প্রায়ই নিদ্রাগত হতেন। সেদিন ঘরে যেতেই তিনি চোখ থেকে হাতখানা নাবিয়ে ফেললেন। দেখলুম তাঁর দুই চোখ থেকে অশ্রুধারা বয়ে চলেছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম–একি মা! আপনি কাঁদছেন কেন?
তিনি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন–হ্যাঁ রে, তুই গাঁজার দোকান চিনিস?
ভাবলুম–কি সর্বনাশ! গাঁজা দিয়ে কি হবে? কর্তা সন্ধেবেলা মাল টানেন, গিন্নি কি দুপুরবেলা গাঁজা টানবেন? জিজ্ঞাসা করলুম–গাঁজা দিয়ে কি হবে মা?
তিনি বললেন–গাঁজার দোকানে আপিং বিক্রি হয় না! আমি তোকে দশটা টাকা দিচ্ছি, তুই আমায় এক ভরি আপিং কিনে এনে দে। বাকি টাকা তুই নিয়ে নে।
–আপিং দিয়ে কি হবে মা?
ভদ্রমহিলা উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন–আমি আর এ-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না–আমি আপিং খেয়ে মরব।
একবার মনে হল এক-দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যাই। ভদ্রমহিলা বলে চললেন –এই নির্বান্ধব পুরীতে সমস্ত জীবন ধরে এই যন্ত্রণা সহ্য করা যে কি পাপ, তা আর কি বলব!
আমি জিজ্ঞাসা করলুম–গরম জলের সেঁক-ঢেঁক দিলে আরাম হয়?
গিন্নি বললেন–তা কখনও দিয়ে দেখিনি। তুই গরম জল করে দিতে পারিস?
কর্তার প্রসাদে বাড়িতে বোতলের অভাব ছিল না। তখুনি একটা বোতল ধুয়ে গরম জল করে বোতলের চারদিক ন্যাকড়া দিয়ে মুড়ে গিন্নির হাতে দিলুম। গিন্নি কাঁদতে কাঁদতে বোতলটা আমার হাত থেকে নিয়ে আমার সামনেই বোতলটা চেপে ধরলেন।
বললুম–রোগ পুষে রেখে লাভ কি মা! ডাক্তার ডেকে চিকিচ্ছে করান।
তিনি বললেন–দু’বার হাসপাতালে গিয়েছিলুম। সেখানে সব পুরুষ-ডাক্তার।
বললুম–সেখানে মেয়ে-ডাক্তারও আছে।
তিনি বললেন–হ্যাঁ, তারা দেখেছে, কিন্তু শেষকালে পুরুষ-ডাক্তার দেখবে। তারা বলে দিয়েছে অস্ত্র করাতে হবে। আর পুরুষ-ডাক্তার দিয়ে দেখানোর চেয়েও এই যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে মরে যাওয়াই শ্রেয়।
কর্তা যে-ঘরে থাকতেন, সে-ঘরে রাস্তার দিকে একটা জানলা ছিল। মাঝে মাঝে দুপুরবেলা আমি সেই জানলার ধারে গিয়ে বসতুম। নীচে বিপুল জনস্রোত বয়ে চলেছে–বোম্বাই শহরে কোনো জায়গায় ভিড়ের কমতি নেই। অত উঁচু থেকে লোকগুলোকে দেখে মনে হত কত ছোট। তারই ভেতর দিয়ে বিরাট সরীসৃপের মতো মন্থরগতিতে ট্রাম যাচ্ছে। এইসব রাস্তায় ট্রামের গতি একেবারে বাঁধা।
দেখতে দেখতে বাইরের চিন্তা চলে যেত। নিজের মনে ভাবতে থাকতুম–এই বাড়িতে প্রায় পঞ্চাশটা ফ্ল্যাট আছে; প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই একটা করে পরিবার। বিচিত্র তাদের সুখদুঃখের ইতিহাস। প্রত্যেক লোকেরই মনস্তত্ত্ব ভিন্ন। আমরা আজ যে পরিবারে আশ্রয় পেয়েছি তাদের কথা ভাবতুম।
কর্তাগিন্নির এই সংসারে কেউ নেই। কর্তার ইচ্ছা কাজকর্ম থেকে অবসরগ্রহণ করে স্বামী-স্ত্রীতে কাশীতে গিয়ে বাস করবেন। গিন্নির ইচ্ছা–অন্তত তিনি যা প্রকাশ করতেন–মৃত্যু এসে এখুনি তাঁকে গ্রাস করুক এবং কর্তা আর-একটি বিবাহ করে সুখী হোন।
সংসারের চেহারা আমার চোখে দিনদিনই অন্য রূপ ধারণ করছিল। যে নেশার ঘোরে আমি সংসারকে দেখতুম, ক্রমেই সেই নেশা কেটে যাচ্ছিল। আগে আমি এই দুনিয়াকে নিজের মনের মতন করে দেখতুম–সেটা ছিল আমার মনে পৃথিবীর ভাবমূর্তি। নেশা কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর নগ্ন চেহারা আমার চোখে ফুটে উঠত। বেশ বুঝতে পারছিলুম, অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা রূপকথাতেই থাকে, সংসারের কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। কোনো বড় ব্যবসাদারের চোখে পড়ে গিয়ে তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে ভবিষ্যতে সেই ব্যবসার মালিক হয়ে ওঠা–ওই আত্মজীবনীতেই পাওয়া যায়। বাস্তবে দেখতে লাগলুম–দেবার প্রবৃত্তি তাদের মধ্যেই প্রবল যাদের মধ্যে দেবার কিছু নেই! আর যাদের দেবার যথেষ্ট আছে নেবার প্রবৃত্তিই তাদের মধ্যে প্রবল। সংসারে রাজকন্যা ও রাজত্ব তো দূরের কথা, একমুঠি ভিক্ষান্নও পাওয়া মুশকিল। চিন্তা হত, যে-বয়সে মানুষের ভবিষ্যৎ-জীবনের ভিত্তি তৈরি হয় সে-বয়েস তো হেলায় ফুঁকে দিলুম। এখন কী করব! চিরকালই কি রান্না করে ও ঘর ঝাঁট দিয়েই জীবন কাটবে! তখন বুঝতে পারিনি আমার ভবিষ্যৎ-জীবনের ভিত্তি সেই অবস্থাতেই গড়ে উঠছিল।
বাড়ির আত্মীয়স্বজন ও গুরুজনদের কথামতো এবং ইচ্ছামতো নিজেকে তৈরি করবার শপথ কতবার মনে-মনে করেছি। কিন্তু কিছুতেই তা পারিনি। কী এক অদ্ভুত শক্তি আমাকে ঘরছাড়া করে বাইরের জনসমুদ্রে এনে ফেলত; এই শক্তিই আমার জীবনকে গড়ে তুলেছে তার মনের মতন করে। এই শক্তিকে আমি নিজের মনে যত স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি, অন্য কেউ তা পেরেছে কি না তা জানি না।
মাঝে মাঝে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দারুণ দুর্ভাবনা এই শক্তিকে চাপা দিত। একদিন পরিতোষের সঙ্গে পরামর্শ করে তাই আগ্রার সত্যদাকে আমাদের বর্তমান জীবনের কথা লিখে পাঠালুম এবং তিনি আমাদের এই পঙ্ক থেকে উদ্ধার করবেন এই আশাও জানালুম।
ওদিকে আমাদের গ্যাড়াব্যাঙ্ক বেশ স্ফীত হয়ে উঠছিল। তিন মাস সময়ের মধ্যে প্রায় শতখানেক টাকা আমরা জমিয়ে ফেলেছিলুম।
কিছুদিন থেকে কর্তা ও গিন্নি দু’জনের মুখেই শুনছিলুম যে, কর্তা তিন-চারটে বড় বড় মক্কেল ধরেছেন এবং তাদের দিয়ে অনেক টাকা জীবনবীমা করবার চেষ্টা করছেন; যদি খেলিয়ে তুলতে পারেন, তবে কয়েক হাজার টাকা একখুনি পাওয়া যাবে এবং পঁচিশ বছর ধরে মাসে বেশ মোটা রকমের আমদানি হবে। এইসব কাজে কর্তামশাই ইদানীং খুবই ব্যস্ত থাকতেন।