আপনারা জানেন মহম্মদ অল আমিন এবং অল মামুন এরা দু’জনে বৈমাত্রেয় ভাই। অল আমিন বেগম জুবেদার এবং অল মামুন খলিফার এক বাঁদী মারজিনের গর্ভে জন্মেছিলো।
দু’জনের মধ্যে ছিলো আজন্মের বৈরিতা।
এক মওকায় অল মামুনের সৈন্যবাহিনী প্রাসাদ আক্রমণ করে খলিফা অল আমিনকে নৃশংসভাবে নিহত করে। এরপর প্রাণভয়ে অল আমিনের সুবাদাররা একে একে অল মামুনের সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
অল মামুন নতুন খলিফা হয়ে মসনদে বসলো।
শাসনভার হাতে নিয়েই সে ঘোষণা করে দিলো, কারো ভীত হওয়ার কোনও কারণ নাই। সকলে নির্ভয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণ কর। আমি তোমাদের রক্ষা করবো। এজন্য কাউকে তাদের পূর্ব অপকর্মের জন্য কোনও রকম সাজা দেওয়া হবে না।
এইভাবে সে সকল বাধা অতিক্রম করে প্রজাদের প্রিয় বাদশাহ হতে চাইলো। যতদিন অল আমিন জীবিত ছিলো ততদিন সে কিছুতেই খলিফা হারুন অল রসিদের মন ভেজাতে পারেনি। তার উপর ছিলো বেগম জুবেদার কড়া দৃষ্টি।
পুত্রের মৃত্যু সংবাদ শুনে বেগম জুবেদা ভেঙ্গে পড়লেন। এবার তার সৎ ছেলে মামুনের হাতে তাকে হেনস্তা হতে হবে সন্দেহ নাই। কোনও দিনই তাকে তিনি সুনজরে দেখতে পারেননি, সে সব কথা কি অল মামুন বিস্মৃত হতে পারে? এবার মওকা মিলেছে। যথাযোগ্য প্রতিশোধ নিতে সে কসুর করবে না। সুতরাং এ প্রাসাদে না থেকে তিনি মক্কায় গিয়ে বাকী জীবন কাটাবেন ঠিক করলেন।
নতুন খলিফাকে একখানা চিঠি লিখলেন তিনি।
ধর্মাবতার, যদিও প্রমাদবশতঃ আপনি আমার প্রাণাধিক পুত্রকে হত্যা করেছেন, তবু আমি জানি আমার মতো আপনারও কোমল হৃদয় এই কারণে দগ্ধ হচ্ছে নিয়ত। আপনার মহত্ত্বের কাহিনী সুবিদিত। সুতরাং এই একটি মাত্র ভুল আপনার জীবনে কালিমা লেপে দিতে পারবে না। সে আজ নাই, জানি তার অপরাধ অসীম ছিলো, কিন্তু আপনি নিজগুণে তাকে মার্জনা করে দেবেন, এই আমার প্রার্থনা।
আপনি যদি আমার প্রতি একটু অনুকম্পা দেখান, ধন্য হবো আমি। যদিও আপনার করুণা পাওয়ার অধিকারিণী আমি নই, তবু প্রার্থনা করবো আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। আপনার পিতার কথা স্মরণ করুন, তিনি আমাকে মাথার মণি করে রেখেছিলেন, তাঁর প্রতি কিছু সম্মান
প্রদর্শনের জন্যও আপনি আমার প্রতি নির্মম হবেন না, এই প্রার্থনা করি।
বেগম জুবেদার এই কাকুতি-ভরা পত্রখানি পাঠ করে অল মামুন করুণায় আর্দ্র হয়ে কাঁদে। আহা, তিনি বড়ই অভাগিনী। একদিন যাঁর প্রতাপে সমস্ত সলনিয়ত টলমল করে কাঁপতে, তিনি আজ ভিখারিণী হয়ে গেছেন।
মাগো, আপনার চিঠির কথাগুলো আমাকে শূলের মতো বিদ্ধ করেছে। আপনি মা, আপনার আদেশই এতকাল মান্য করে এসেছি সভয়ে। আজ একি কথা লিখেছেন মা? আপনার কোন অসম্মান, সে তত আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আপনার অসীম ক্ষমতার একবিন্দু তো আমি হরণ করিনি? তবে আপনি কেন এমন দীন দরিদ্রের মতো আমার কৃপা প্রার্থনা করছেন। আপনি মহিয়সী মা, আপনার সঙ্গে অন্য কারো কোনও তুলনা হয় না, আপনি আপনার স্বীয় সম্মান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকবেন আজীবন। আপনি আমাকে আদেশ করবেন মা, পুত্র সব সময়ই জননীর আজ্ঞাবহ দাস মাত্র। আপনি আমার গর্ভধারিণী নন, কিন্তু আমার পিতা আপনার স্বামী। আপনি বিশ্বাস করুন, আমার মা-এর চেয়ে আপনাকে কখনও আমি ছোট নজরে দেখিনি।
মানুষ নিয়তির দাস। যা ঘটে গেছে তা ঘটবে বলেই অনিবার্য ভাবে ঘটেছে। এ নিয়ে শোকতাপ করে আর কী হবে! তার আত্মার মঙ্গল কামনা ছাড়া এখন আর করণীয় কিছু নাই। আপনার বুকভাঙ্গা দুঃখ বেদনা আমি অনুভব করতে পারি মা। আমাকে দিয়ে যদি সে দুঃখের কিছুটাও লাঘব হয়, আমি প্রাণপণ করে তা করার চেষ্টা করবো।
আপনার যে সব সম্পত্তি, ঘর বাড়ি প্রাসাদ ইমারত এবং জমি-জমা আমার দপ্তর বাজেয়াপ্ত করেছিলো, সেগুলো আবার যাতে আপনি ফিরে পান তার জন্য আগেই আমি হুকুম পাঠিয়ে দিয়েছি।
আপনি যদি সব সংশয় ভুলে আমাদের মধ্যে এসে বসবাস করেন তার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। আপনি জেনে রাখুন মা, আপনার একটি পুত্রের ইন্তেকাল হয়েছে, কিন্তু আরও এক পুত্র জীবিত, সে আপনার দাসানুদাস হয়েই থাকতে চায়। তার মুখের দিকে চেয়ে কি মৃত পুত্রের শোক কিছুটা ভুলতে পারবেন না?মা গো, এই অধম পুত্রকে অন্ততঃ একবার সুযোগ দিন, সে প্রমাণ করবে আপনার গর্ভজাত পুত্রের চেয়ে সে কোন অংশে কম মাতৃভক্ত নয়!
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
নয়শো চুরানব্বইতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
চিঠি পেয়ে বেগম জুবেদা এসে অল মামুনের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লেন। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলেন। অল মামুন দু’হাত বাড়িয়ে তাকে তুলে ধরে কর-চুম্বন করে বললো, ছিঃ মা, আপনি এ কি করলেন! আমি আপনার সন্তান, এতে কি আমার পাপ হবে না? আপনার কোনও রকম অমর্যাদা আমি হতে দেব না মা। এতে আমার মৃত পিতার আত্মা শান্তি পাবে না।
কিন্তু অল মামুনের ভরসা বাক্যেও আশ্বস্ত হতে পারে না জুবেদা বেগম। কেবলই তার মনে হতে থাকে শৈশবে কৈশোরে সে আপন গর্ভজাত পুত্র অল আমিনকে প্রাণভরা আদর ভালোবাসা দিয়েছে আর অল মামুনকে দিয়েছে ঘৃণা অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা। তার এই ব্যবহার বৈষম্য কি হঠাৎ আজ অল মামুন ভুলে যাবে? বিশ্বাস করা শক্ত।
এ ব্যাপারে খলিফা হারুন অল রসিদও জুবেদাকে বহুবারই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। দুই পুত্রকে সম দৃষ্টিতে দেখাই তার উচিত। কিন্তু জুবেদা সে তিরস্কারও গ্রাহ্য করেনি কখনও।
এরপর একদিন খলিফা অল মামুন বেগম জুবেদার ঘরে এসে দাঁড়িয়ে নজর করলো। বেগমসাহেবা অনুচ্চ কণ্ঠে বিড়বিড় করে কি যেন আওড়ালেন।
অল মামুন বললো, মা, আপনি আমাকে দেখে কি অভিশাপ দিলেন? কিন্তু বিশ্বাস করুন মা, আপনার ছেলের মৃত্যুর জন্য আমার কোনও হাত ছিলো না। পার্শিরা তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আপনার পুত্রকে নিহত করে আমাকে মসনদে বসিয়েছে।
জুবেদা জিভ কেটে বললেন, না বাবা না, ওসব কথা ঘূণাক্ষরেও আমার মনে আসেনি। তুমি আমার সন্তান, তোমাকে শাপ-শাপান্ত করবো আমি? সে কি করে ভাবলে বেটা?
—তা হলে বিড়বিড় করে কী বলছিলেন মা? থতমত খেয়ে গেলেন জুবেদা। ঠিক সেই মুহূর্তে মুখে কোনও জবাব জোগালো না। মাথাটা নিচু করে বললেন, সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না, বাবা।
কিন্তু অল মামুন তখন ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। না শুনে সে ক্ষান্ত হবে না। বার বার সে জুবেদাকে বলার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলো।
অবশেষে জুবেদা ফেটে পড়লেন, নিতান্তই যদি শুনতে চাও তবে শোনো বাবা, হা, আমি তখন অভিশাপই দিচ্ছিলাম। তবে তোমাকে নয়—আমি নিজেকে। সেদিনের একটিমাত্র নির্বুদ্ধিতার জন্য আজ এতো বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেলো আমার জীবনে। ঐ অভিশপ্ত ঘটনাটা যদি না ঘটতো সেদিন, তবে আজ আমার বুকের পাঁজর অল আমিনকেও হারাতে হতো না।
-কী সে ঘটনা মা?
অল মামুন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে জুবেদাকে।
–তবে শোনো, জুবেদা অশান্ত কণ্ঠে বলতে থাকে, সেদিন কি তিথি নক্ষত্র ছিলো জানি না, আমার স্বামী খলিফা হারুন অল রসিদ এলেন আমার ঘরে। এসেই আমার সঙ্গে দাবায় বসলেন। তুমি অবশ্যই জান, দাবাখেলার ওপর ওর একটা বিশ্রী রকমের ঝোক ছিলো। তবে ও খেলাটা তিনি অত্যন্ত আপনজন ছাড়া কারো সঙ্গে খেলতেন না।
খলিফা আমাকে হারাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। আমি ছেড়ে দেবার পাত্রী নই। কিন্তু আমি হেরে গেলাম। হারুন অল রসিদ আমাকে বললেন, তুমি হেরে গেছ যখন তোমাকে তার সাজা পেতে হবে। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে এই প্রাসাদ থেকে হেঁটে বাগানে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তোমাকে।
তখন প্রায় শেষ রাত। আমি লজ্জায় মরে যাই, একি খলিফার খামখেয়াল! তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করলাম কিন্তু তিনি আমার সব আবেদন নিবেদন এক কথায় খারিজ করে দিয়ে বললেন, না, না, আমি যা বলেছি তার নড়চড় হবে না।
সুতরাং আমি বাধ্য হয়ে তার খেয়াল চরিতার্থ করলাম সেই রাতে। যখন আমি বাগান থেকে ফিরে এলাম তখন আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। সারা শরীর আমার হিম হয়ে আসতে লাগলো। ঘরে এসে আধমরা হয়ে পড়ে রইলাম পালঙ্কশয্যায়।
পরদিন আবার দাবার আসর বসলো। সেদিন কিন্তু আমি জিতলাম। প্রতিশোধ-স্পৃহা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বললাম, আজ আমি সে সাজা দেব, তাই মাথা পেতে নিতে হবে আপনাকে। খলিফা বললেন, বান্দা প্রস্তুত। হুকুম করুন বেগমসাহেবা।
প্রতিহিংসায় তখন আমি দিশাহারা, বললাম, হারেমের রসুইখানায় ঐ কালো কুৎসিত নোংরা নফরাণী মারজিলকে জড়িয়ে ধরে আজকের রাতটা কাটাতে হবে আপনাকে।
খলিফা শিউরে উঠলেন, কিন্তু বুঝলেন আমার মত পালটানো যাবে না, তাই তিনি মুখে আর কিছু বললেন না। সোজা চলে গেলেন রসুইখানায়।
পরদিন সকালে খলিফার মুখের দিকে আর তাকাতে পারা গেলো না। সারা রাত ধরে যে অসহ্য যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছেন, তা তার চোখে-মুখেই প্রতিভাত হয়ে উঠেছিলো। খুব গম্ভীর মুখে একটিও কথা না বলে, আমার সামনে থেকে চলে গেলেন তিনি।
সেই আমার কাল হলো। ঐ জঘন্য নোংরা সহবাসের ফলে জন্ম হলো তোমার।
আমি কি আহাম্মক, নিজে ডেকে আনলাম আমার সর্বনাশ, সেই রাতেই আমার প্রিয় পুত্র অল আমিনের ঘাতকের ভ্রণ সৃষ্টি হলো।
আমার গোঁ ছাড়া এমনটা কিছুতেই ঘটতে পারতো না।
আমাকে যদি না তিনি উলঙ্গ করে বাগানে পাঠাতেন, তাহলে আমিও নিশ্চয়ই ঐ নীচ সহবাস করার জন্য তাকে রসুইঘরের এক নোংরা চাকরাণীর ঘরে পাঠাতাম না।
এজন্য নিজেকে ছাড়া আর কাকে দোষ দেব বাবা। এজন্য অভিশাপ যদি দিতে হয়, নিজেকেই দেব, তোমাকে নয়।
অল মামুন আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াতে পারলো না। ছুটে বেরিয়ে গেলো জুবেদার সামনে থেকে।
নিজের মনেই সে ভাবতে থাকে আজ যদি বার বার করে বেগমসাহেবার কাছ থেকে জানতে চাইতাম, তবে তো আমার নিজের জন্ম ইতিহাস অজ্ঞাতই থেকে যেত আমার কাছে।
কাহিনী শেষ করে ধনী যুবক, বন্ধুগণ, আমার মনে হয় আল্লাহর দোয়ায় আমি আপনাদের কিছু আনন্দের বিধান করতে পেরেছি এই গল্পগুলো শুনিয়ে। আজ আর নয়, অন্য একদিন আবার আপনাদের আরও ভালো কাহিনী শোনাবো।
এরপরে উপস্থিত প্রত্যেকের হাতে এক স্বর্ণমুদ্রা এবং অন্যান্য মূল্যবান উপহার সামগ্রী তুলে দিলো।
শাহরাজাদ গল্প শেষ করে অধোবদন হয়ে রইলো। সুলতান শাহরিয়ার খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, শাহরাজাদ, অপূর্ব তোমার কাহিনী। এসব গল্পের সার কথা জীবনের চলার পথের পরম পাথেয়। যাই হোক, এবার উজির জাফর সম্বন্ধে কিছু শোনাও। অনেক দিন ধরেই তার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী শোনার জন্য আমার খুব বাসনা। তার মতো বুদ্ধিমান বিচক্ষণ একজন প্রধান উজিরই আমি সন্ধান করছি বহুকাল যাবৎ। কিন্তু ঐ রকম গুণবান ব্যক্তি কি ভুরি ভুরি মেলে?
শাহরাজাদ মাথা হেঁট করে বললো, আপনি জাফরের জীবনের সব কাহিনী শোনার জন্য আমাকে হুকুম করবেন না, জাঁহাপনা, সে বড়ই মর্মান্তিক বেদনাদায়ক। চোখের পানিতে ভেসে যাবে বুক, ব্যথায় ভেঙ্গে যাবে পাঁজর।
সুলতান শাহরিয়ার বললেন, তা হোক, তুমি বলো, আমি শুনতে চাই।
শাহরাজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে খোদা আমাকে রক্ষা করুন।
তারপর শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :