মস্ত বড় সঙ্গীতসাধক হাসিম ইবন সুলেয়মানের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তখন। খলিফা হারুন অল রসিদ তাকে একদিন ডেকে পাঠালেন।
হাসিমের একখানা গান শুনে খুশিতে নেচে উঠলেন খলিফা।
—এমন সঙ্গীত আপনি কীভাবে কণ্ঠে ধারণ করলেন, ওস্তাদজী? এই বলে তিনি তার কণ্ঠের মহামূল্য রত্নহার পরিয়ে দিলেন হাসিমের গলায়।
এমন উপহারে উল্লসিত না হয়ে বিষাদ-বিষণ্ণ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, এ মণিহার আমাকে সাজে না, ধর্মাবতার!
দু-ফেঁটা অশ্রু জরে পড়লো তার কপোল বেয়ে।
-কেন? আর কেনই বা এই অশ্রু ওস্তাদজী? আমার উপহার কী আপনার পছন্দ হয়নি?
—খোদা হাফেজ! আল্লাহ আপনাকে আরও মহান করুন; আমার এই অন্তর বেদনা ওসব কোনও কারণে নয়। যদি অনুমতি করেন তবে এই হতভাগ্য তার জীবনের এক বেদনার কাহিনী শোনাতে পারে জাঁহাপনাকে।
খলিফা বলে, বেশ তাই শুনি। নিশ্চয়ই সে কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ। তা না হলে আপনার চোখ অশ্রুসজল হবে কেন?
হাসিম তার স্মৃতিকথা বলতে থাকে–
তখন আমি বয়সে নবীন। কিন্তু সেই যৌবনকালেই আমার গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছিলো।
একদিন আমি চলতে চলতে এক মনোহর উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করেছিলাম। সেখানে দেখলাম সুলতান ওয়ালিদ তার দলবল নিয়ে মৃগয়া করতে এসেছেন।
বাগানের মাঝখানে একটা বিশাল দীঘি। তার পাড়ে ঘাসের শয্যার ওপর মখমলের গালিচা বিছিয়ে মাইফেলের আসর বসেছে। সুলতানের দুপাশে দুটি পরমাসুন্দরী কিশোরী। তাদের হাতে তারের বাদ্যযন্ত্র। একজন গান গাইছে। কান পেতে শুনলাম, আমারই একখানা বহু প্রচলিত সঙ্গীত যথাসাধ্য দরদ দিয়ে গাইবার চেষ্টা করছে। কিন্তু গায়িকার দক্ষতার অভাবে মাঝে মাঝে বেসুরো হয়ে যাচ্ছে গানখানা।
কৌতূহল নিয়ে আরও একটু এগিয়ে যেতে সুলতান ওয়ালিদ তার এক সহচরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখ দেখ, তোমার গান শুনে লোকটা কেমন মাতোয়ালা হয়ে উঠেছে। ওকে এখানে ডেকে একটু মজা করা যাক্ কী বলে?
সুলতান ওয়ালিদ আমাকে কাছে আসতে ইশারা করলেন। আমি সামনে গিয়ে আভূমি আনত হয়ে যথাবিহিত কুর্নিশ জানালাম তাকে।
তিনি আমাকে বসতে বললেন, বস, গান শুনবে?
আমি সবিনয়ে মাথা নুইয়ে বললাম, শুনবো জাঁহাপনা। সুলতান এবার সেই সহচরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুরু কর।
গানের সুর কেটে গেলে মেজাজ বিগড়ে যায় আমার। আমি আর মুখ বুজে সহ্য করতে পারলাম না।
-কিছু অপরাধ নেবেন না মালকিন, গানটা কিন্তু যথাযথ গাওয়া হচ্ছে না। মাঝে মাঝে সুর কেটে যাচ্ছে।
মেয়েটি খিল খিল করে হেসে উঠলো, লোকটার কী মাথাটা খারাপ, জাঁহাপনা? আমার গানের তালে ভুল ধরছে?
সুলতান ওয়ালিদ বললেন, কী হে, তুমি কী ভেবেছ, তোমাদের রাখালদের কাছ থেকে শিখে এসেছে সে।
-না জাঁহাপনা, সে কথা আমি বলিনি। উনি নিশ্চয়ই নামী ওস্তাদের কাছেই তালিম পেয়েছেন। তবে ঠিকমতো রপ্ত করতে পারেননি এখনও।কিন্তু মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করবো, গলাটা ভালো আছে, মন দিয়ে শিখলে ভালো গান গাইতে পারবেন ভবিষ্যতে।
আমার কথায় বোধহয় কৌতুক বোধ করলেন সুলতান। বললেন, তা তুমিই সে তালিম দেবার ভারটা নাও না!
—তা মহামান্য শাহেনশাহ যদি সেরূপ আদেশ করেন, মাথা পেতে নিতে পারি?
এবার তিনি বেশ রুষ্ট হয়েই বললেন, তোমার ঔদ্ধত্ব দেখে অবাক হচ্ছি! ঠিক আছে, একটা গান শোনাও তো দেখি।
আমি আরও একটু এগিয়ে বসে বললাম, জো হুকুম জাঁহাপনা! তারপর ঐ মেয়েটিকে বললাম, তানপুরার তার আরও চড়া পর্দায় বেঁধে নিন।
মেয়েটি ক্রুদ্ধ এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো আমার দিকে। যেন ছোবল মারবে এই রকম ভাবে।
আমি ঐ গানটাই গেয়ে শোনালাম। এর পরের দৃশ্য বড় মধুর। মেয়েটি লুটিয়ে পড়লো আমার পায়ের ওপর। গোস্তাকি মাফ করবেন ওস্তাদজী, আপনাকে চিনতে পারিনি। আপনার গান আমি আমার গুরুর কাছ থেকে শিখেছি। তিনি আপনার গান ছাড়া আর কিছু শেখান না কাউকে।
সুলতান ওয়ালিদ আমাকে আলিঙ্গন করে বললেন, আপনিই ওস্তাদ হাসিম! আজ আমার মৃগয়া করতে আসা সার্থক হলো। এমন মানুষকে দেখেও আনন্দ।
মেয়েটি তার গলা থেকে একটি মহামূল্যবান রত্নহার আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো, আমার এই দীন উপহার, মেহেরবানী করে গ্রহণ করে ধন্য করুন আমাকে, ওস্তাদজী।
মালাটা আমি হাতে নিয়ে বললাম, কিন্তু এ যে অত্যন্ত মূল্যবান হার?
সুলতান বললেন, টাকা পয়সার দামের চেয়েও আরও অনেক বেশি দামী বস্তু। এক বিশেষ মুহূর্তে আমার গলা থেকে খুলে নিজের হাতে ওকে পরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। ওর কাছে এর চেয়ে দামী জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। সেই সবচেয়ে সেরা অমূল্য ধন দিয়ে গুরুদক্ষিণা দিলো। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে ওস্তাদজী! আপনি গ্রহণ করে ওকে কৃতাৰ্থকরুন।
এরপর সুলতান বললেন, আপনাকে যখন পেয়েছি, আজকের দিনটা স্মরণীয় করে রাখবার জন্য আজ আমরা নৌকোয় চেপে মাইফেলের আসর জমাবো। এই দীঘির কালো পানিতে ভাসতে থাকবে আমাদের নৌকোখানা। আর আমরা আপনার গান শুনে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দেব।
আমি বললাম, চমৎকার হবে, জাঁহাপনা। ঘাটে বাঁধা ছিলো একখানা ময়ুরপঙ্খী নৌকো। প্রথমে সুলতান উঠলেন। তারপর আমি উঠলাম, আমার পিছনে সেই কিশোরী। একখানা পা পাটানে রাখতেই দুলে উঠলো নৌকোটা। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেলো সেই চরম বিপর্যয়। পা হড়কে পড়ে গেলো সে কালো দীঘির পানিতে। মাঝি-মল্লারা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো দীঘির পানিতে। কিন্তু নিমেষে কোথায় যে সে তলিয়ে গেলো আর হদিশ করা গেলো না!
সারা রাত ধরে তল্লাসী চালানো হলো দীঘিতে, তোলপাড় করে ফেলা হলো তার পানি। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না তাকে।
সুলতান কাদতে লাগলেন। আমিও অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
নয়শো ছিয়াশিতম রজনী :
আবার সে বলতে থাকে–
সুলতান ওয়ালিদের সে মর্মবেদনা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না জাঁহাপনা। তিনি সানয়নে আমাকে বললেন, ওকে আমি বড় পেয়ার করতাম, ওস্তাদজী। ঐ রত্নহার আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম। ওরকম খানদানী বস্তু কেউ অন্যের হাতে তুলে দেয় না। কিন্তু ওকে আমি একান্ত আপন বলে গ্রহণ করেছিলাম। তাই দিতে আর দ্বিধা হয়নি এতটুকু।
একটু থেমে আবার তিনি বলতে থাকেন আজ ও আমাকে শোকসাগরে ভাসিয়ে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। এখন কী নিয়ে থাকবো আমি। ওর কোনও স্মৃতিই আমার কাছে নাই। এই মালাটি ওর গলায় দুলতো, আর তার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো ওর সারা মুখ। চোখ বন্ধ করে সে মুখচ্ছবি এখনও আমি স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারছি। কালের কবলে সবই তো একদিন ধুয়ে মুছে ঝাপসা হয়ে আসবে। তখন হয়তো আর আজকের প্রিয়ার এই ছবি ধরা দেবে না। সেই কারণে আপনাকে উপহার দেওয়া ঐ মালাটি আমি কাছে রাখতে বাসনা করছি ওস্তাদজী। কিন্তু এ মালা যে সে গুরুদক্ষিণা দিয়ে গেছে আপনাকে। আমি তো তা ওয়াপস করে নিতে পারি না। আপনি যদি আমার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে হারটা উচিত মূল্যে আমার কাছে বিক্রি করেন, চির কৃতজ্ঞ থাকবো আমি। মূল্য হিসেবে আমি আপনাকে তিরিশ হাজার দিরহাম দেব, আপনি ওটা আমার কাছে বিক্রি করে দিন।
বলা বাহুল্য, তক্ষুণি সে মালা আমি সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
তারপর কত কাল কেটে গেছে। বয়সের ভারে আমার দেহ ন্যুজ হয়ে পড়েছে। সারাটা জীবনের অসংখ্য ঘটনা একটি মাত্র মালায় গাঁথা হয়ে গেছে। আজ আর ওদের সবগুলোকে আলাদা আলাদা করে ইয়াদ করতে পারি না।
আজ আপনার দেওয়া এই রত্নহারটি দেখে আমার যৌবনকালের এই শোকাবহ ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। বিধাতা-পুরুষের এমনই যে পরিহাস, সেদিনের সেই মালাটাই আজ আবার আমার হাতে ফিরে এলো। সুলতান ওয়ালিদ গত হয়েছেন। তার সলতানিয়ত এখন আপনার অধিকারে। বুঝতে পারলাম, সুলতানের অন্যান্য ধনরত্নের সঙ্গে এই মালাটিও আমার হাতে এসেছিলো। আপনি যে আমাকে এই মহামূল্য রত্নহারটি উপহার দিয়েছেন সে আমার পরম পাওয়া সন্দেহ নাই। কিন্তু পুরনো স্মৃতির ক্ষতটায় আবার নতুন করে দারুণ ব্যথার প্রলেপ লাগিয়ে দিয়ে গেলো।
স্মৃতি সতত সুখের হয় না জাঁহাপনা, কখনও কখনও সে নতুন করে বুক ভেঙ্গে দিয়ে যায়।
এরপর যুবকটি আর এক কাহিনী শুরু করে—