৪.৪ শিক্ষার সমস্যা – ১
শিক্ষার কিছু তত্ত্ব আছে চিরকালের, আর কিছু সমস্যা সমকালের। সমকালীন অথচ শুধুই সমকালের নয়, এইরকম সমস্যা নিয়ে কয়েকটি কথা বলাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য।
সমস্যার অবতারণার আগে প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি মূল পার্থক্যের উল্লেখ করে নিলে পরবর্তী আলোচনার কিছুটা সুবিধা হতে পারে। প্রাচীন সমাজে বৃত্তিপ্রশিক্ষণের স্থান ছিল প্রধানত পরিবারে, আর উচ্চশিক্ষার স্থান গুরুগৃহে। কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে সেই গুরুগৃহ, গুরু সেখানে পিতৃতুল্য। আধুনিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আকারে অনেক বৃহৎ। এখানে এক একটি বিষয় পড়াবার জন্য আছেন এক একজন অধ্যাপক, এমনকি একই বিষয় খণ্ড খণ্ড করে একাধিক অধ্যাপকের ভিতর ভাগ করে দেওয়া হয়। ওস্তাদ কারিগর একটি সম্পূর্ণ মূর্তি অথবা শিল্পবস্তু নিজে প্রস্তুত করেন, তিনি শিল্পী। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমগ্র কাজ বহু খণ্ডে বিভক্ত; শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞদের ভিতরে। সেই কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রাচীন ব্যবস্থায় ছাত্রের সমগ্র শিক্ষার ভার এবং তাকে মানুষ করে তুলবার দায়িত্ব ছিল গুরুর হাতে। এযুগে অনিবার্য কারণে এক রকমের যান্ত্রিক কর্মবিভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ লাভ করেছে। আজকে অধ্যাপক গুরু নন, বরং বিশেষজ্ঞ। এ সব কথার কিছু ব্যতিক্রম দেখানো অসম্ভব নয়, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। মূল ঝোঁকটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা চলে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পুরনো ব্যবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। পটভূমিকার এই পার্থক্য মনে রাখলে আজকের দিনের একাধিক সমস্যার অর্থ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়।
.
১
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন নিয়ে কিছুকাল যাবৎ আলোচনা চলছে।
সেকালে রাজা করতেন রাজার কাজ, গুরু গুরুর কাজ। একে অন্যের কাজে সাধারণত হস্তক্ষেপ করতেন না। আজকাল রাজনীতির যে সর্বব্যাপী যে সর্বগ্রাসী ভূমিকা দেখা যায় তার সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্যের এইখানে একটা গভীর অমিল আছে।
ধর্ম যেমন সরকারের সৃষ্ট বস্তু নয়, রাজা মহারাজার ইচ্ছায় চলে না অথবা চলা উচিত নয়, অন্তত আমাদের প্রাচীন চিন্তায় রাজা মহারাজারাই ধর্মের অনুশাসনের অধীন, উচ্চশিক্ষাও তেমনই রাজনীতির ধ্বজাধারী হবে না, সরকারের আজ্ঞাবাহী হবে না, বরং তার নিজস্ব আদর্শ নিয়ে সে স্বাধীন, এই রকম একটা চিন্তা আমাদের অনেকের কাছে। শ্রদ্ধেয়। এই শতকের প্রথম ভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের সপক্ষে মত গঠনের একটা বিশেষ কারণও ছিল। আমাদের দেশ যখন বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিযুক্ত তখন স্যার আশুতোষ এবং অন্যান্য শিক্ষাগুরুদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের চিন্তা সাধারণভাবে এদেশে স্বীকৃতিলাভ করেছিল। রাজনীতিক স্বাধীনতা লাভের পর এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি মোটামুটি এই রকম। যখন যে দল সরকারী ক্ষমতায় আসীন তখন সেই দল শিক্ষার ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণের সমর্থক। বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা। করেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতে এলে তাঁরাই আবার শিক্ষার ওপর সরকারী শাসন প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। গত দশ বছরে রাজনীতির হেরফেরের ভিতর দিয়ে এই ব্যাপারটা নিমর্মভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অন্য সব ধর্ম পরিত্যাগ করে দলীয় রাজনীতিরই যাঁরা অনুসরণ করেন তাঁদের কাছে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু দলীয়তার বাইরেও শিক্ষার একটা স্বতন্ত্র মূল্য আছে। সেই মূল্যে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের কথাটা যদি অনুচ্চারিত থাকে, সংগঠিত না হয়, তবে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র সমাজ। রাজনীতিতে প্রধান জিনিস ক্ষমতা নিয়ে লড়াই। কোনো এক দল আজ বিজয়ী, কাল অন্য কোনো দল। এই লড়াই এবং হারজিতের খেলায় যখন শিক্ষা জড়িয়ে পড়ে তখন তার নিজস্ব নীতি এবং লক্ষ্য বিপন্ন হতে বাধ্য। এই বিপদ আজ অত্যন্ত স্পষ্ট বলেই এ বিষয়ে খানিকটা তলিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।
সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান সম্বন্ধে কোনো সরল চিত্ৰই আজ আর সম্পূর্ণ সত্য নয়। শিক্ষাবিষয়ক আলোচনায় কখনও কখনও শোনা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হল বিদ্যা নামক একটি দ্রব্যের উৎপাদন, মান নির্ধারণ এবং পরিবেশন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় একটা বিশেষ ধরনের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তুল্য। পরন্তু এটা এমন এক প্রতিষ্ঠান যাতে সরকারী অনুদানের পরিমাণ বেশ বড়। এর পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যে-প্রতিষ্ঠানে জনসাধারণের অর্থের একটা বিরাট পরিমাণ এইভাবে নিয়োগ করা হয়েছে তাতে অর্থের অপচয় বন্ধ করবার দায়িত্ব কি সরকারের নেই? আন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যেমন উৎপাদনের মান রক্ষার জন্য নানা রকম আইনকানুন হয়, উৎপাদনকর্মে যাঁরা নিযুক্ত তাঁদের জন্য নানা রকম আচরণবিধি প্রণয়ন করা হয়, জনসাধারুণ যাতে বেআইনীভাবে বঞ্চিত না হয় সেজন্য সাবধানী ব্যবস্থা গৃহীত হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে কি সেই রকম ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই?
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, শুধু হ্যাঁ তা এই সব প্রশ্নের যথেষ্ট উত্তর হয় না। একথা বলাই যথেষ্ট নয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাধারণ ব্যবসায়কেন্দ্র নয়, বিদ্যা পণ্যদ্রব্য মাত্র নয়, ছাত্র ও অধ্যাপকের ভিতর এমন একটা সম্পর্ক থাকে যার সঙ্গে তুলনীয় কিছুই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসব কথাই ঠিক; তবু জনসাধারণ এটাও জানে যে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে এযুগে অনেকটা ব্যবসায়কেন্দ্রের মতো ব্যবহার করা হয়েছে, আজকের শিক্ষকেরা ব্যবসায়বুদ্ধি থেকে মুক্ত নন এবং তার কারণও আছে।
এর পরও বলা হবে যে,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ম বা আচরণবিধি যদিও প্রয়োজন তবু সেই সব বিধি অধ্যাপকেরা নিজেরা প্রণয়ন করলে তবেই সেটা ভালো। বিধিপ্রণয়নের এটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এতেও কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। গণতন্ত্রের নিয়ম এই যে, কোনো বিষয়ের সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ জড়িত তাঁদের সবাইকে যথাসম্ভব সেই বিষয়ে সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় যে কাজে নিযুক্ত তার সঙ্গে অধ্যাপক, ছাত্র, কর্মী, অভিভাবক সকলেরই স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। কাজেই ঐ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। অথবা রীতিনীতি প্রণয়নের ব্যাপারে এঁদের সবাইকে যুক্ত করে নিতে পারলেই পদ্ধতিটা গণতান্ত্রিক বলা যায়। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেও কিছু সীমারেখার ভিতর কার্যকরী করা আবশ্যক হয়। অধ্যক্ষ অথবা অধ্যাপক যদি ছাত্রদের দ্বারা নির্বাচিত হন তবেই কি শিক্ষার ধর্মরক্ষা হবে? এ প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। আরও একটা কথা আছে। শিক্ষায়তনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায়টা এমন হওয়া দরকার যাতে পদ্ধতির জটিলতায় ও দীর্ঘসূত্রতায় অথবা দলীয় কলহে সব কাজ বার বার আটকে না যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আচরণবিধি কী রকম হবে এই মৌল সিদ্ধান্তের সঙ্গে অভিভাবক অথবা জনসাধারণের শিক্ষিত প্রতিনিধিদের যুক্ত না করবার কোনো গণতান্ত্রিক কারণ নেই। তবে সেই সব বিধির দিনানুদৈনিক প্রয়োগের পদ্ধতিটা অপেক্ষাকৃত সরল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিছু দায়িত্ব আছে যা বিশেষ ব্যক্তির হাতে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ছেড়ে না দিলে কোনো কাজই এগোয় না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় অধ্যাপক ও কর্মচারীদের যুক্ত করবার দাবি যত জোরের সঙ্গে ও বারেবারে শোনা যায় অভিভাবকদের সমভাবে যুক্ত করবার দাবি তেমন শোনা যায় না, এর একটা সহজ কারণ আছে। সেই কারণের সঙ্গে শিক্ষার প্রকৃতির ততটা সম্পর্ক নেই যতটা আছে সংগঠনশক্তির। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত কর্মচারীদের সহজে সংগঠন করা যায়, অধ্যাপকদের তো বটেই। অভিভাবকেরা ছড়িয়ে থাকেন নানা স্থানে নিজ নিজ জীবিকার প্রয়োজনে, তাঁদের একত্র করা কঠিন। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দের তাঁরাও ভুক্তভোগী। অধ্যাপকেরা সমাজের জন্য যে-সেবার কাজ করেন তারই ভিত্তিতে সমাজের কাছ থেকে তাঁরা কিছু প্রতিদান চাইতে পারেন, সেটাই তাঁদের সমস্ত দাবির নৈতিক ভিত্তি। অভিভাবকদের বাদ দিয়ে কিন্তু এই সেবার যথার্থ বিচার ও মূল্যায়ন সম্ভব নয়। অভিনয়ের বিচারক অভিনেতা একা নন, দর্শকও বটে। পাঠককে বাদ দিয়ে লেখকের বিচার সম্পূর্ণ হয় না। শিক্ষাদান করেন যদিও শিক্ষক, তার বিচারক শিক্ষক একা হতে পারেন না; ছাত্র অভিভাবক ও সাধারণভাবে শিক্ষিতসমাজের অভিমত তুচ্ছ করবার মতো নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বায়ত্বশাসনের নামে অধ্যাপক ও কর্মচারীরা যদি এমন অধিকার দাবি করেন যে, তাঁদের দোষগুণের বিচারক হবেন শুধু তাঁরাই, তবে সেটাকে অন্যায় দাবি বলা ছাড়া উপায় থাকবে না। শিক্ষা ও শিক্ষকের মূল্য নির্ধারণে বৃহত্তর সমাজের একটা ন্যায্য স্থান অস্বীকার করা যায় না।
এইবার দলীয় রাজনীতির কিছু প্রবক্তা হয়তো উৎসাহিত হয়ে বলবেন, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণে আপত্তি কোথায়? সরকার তো বৃহত্তর সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কথাটা সাবধানে বিচার করবার যোগ্য। সমাজ ও সরকারকে সমার্থক মনে করা ভুল। যেমন কোনো একটা ব্যাপক অর্থে সমাজই সাহিত্যের বিচারক, কিন্তু সেই কারণেই যদি সাহিত্যের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণকে আমরা বিনাপ্রশ্নে মেনে নিই তবে সেটা হবে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতি শত্রুতা। দলীয় রাজনীতির সৃষ্ট যে সরকার, তার কর্তৃত্বের যেমন একটা সাময়িক সীমা আছে তেমনই তার যোগ্যতা ও নৈতিক অধিকারেরও একটা সীমা মেনে না নিলে সমাজের পক্ষে সেটা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। মন্ত্রী মাত্রই কোনো একটা অর্থে জনতার প্রতিনিধি। একটা নিধারিত সময়ের জন্য শাসন পরিচালনার দায়িত্ব ও অধিকার তাঁর আছে। কিন্তু রাজার অধিকারের যেমন একটা নৈতিক সীমা আছে, যেটা মেনে না নিলে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বৈরাচার, সরকারের অধিকারের বেলাতেও একই কথা সত্য। গণতান্ত্রিক সমাজ এই রকম একটা সচেতনতা দিয়ে চালিত হয়। রাষ্ট্রের অধিকার সম্বন্ধে এই সীমাবোধ লোপ পেলে স্বাধীনতা বিপন্ন হয়, জন্ম হয় স্বৈরাচারী সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের।
শাসন পরিচালনার যেমন একটা দিক আছে যেখানে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, অবিলম্বে কর্ম সম্পন্ন করতে হয়, তেমনি আবার মানুষের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অন্য একটা দিক আছে যেখানে পরিবর্তন ঘটে ধীরে, সময়ের নিজস্ব নিয়মে। শাসকের সিদ্ধান্ত স্থানে কালে আবদ্ধ, দ্ব্যর্থহীন ও একমুখী। সময়ের বিচার অর্থের বৈচিত্র্যে চিহ্নিত, যেমন একই কবিতা অথবা মন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অর্থ। নানা বিপরীতের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের ভিতর দিয়ে বৃহৎ সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন এগিয়ে চলে। এই বহুত্বের ভিতর ঐক্যবিধানের শেষ দায়িত্ব যে সময়েরই হাতে, রাষ্ট্রনায়কের হাতে নয়, এই রকম একটা চেতনা সুস্থ সমাজের পক্ষে প্রয়োজন। মানুষের যে মননশীলতা অনেকান্তমুখী তাকে ঔদার্যের সঙ্গে লালন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রধান কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের জন্যই আবার প্রয়োজন শাসকদের দলীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা।
সরকার বিদেশীই হোক আর স্বদেশীই হোক, রাজনীতির ধর্ম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বধর্ম এক বস্তু নয়। রাজনীতি প্রধানত সাময়িক উদ্দেশ্য দিয়ে চালিত, ক্ষমতা রক্ষার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত। বিদ্যালয়ের আদর্শগত প্রতিষ্ঠা সময়ের অন্য এক বিস্তৃত প্রাঙ্গণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্যকে রাজনীতির সঙ্গে আবদ্ধ করলে তাকে পরধর্ম আচরণে বাধ্য করা হয়। আজ এ কথা স্পষ্ট।
.
২
বিদ্যার একটা ব্যবহারিক দিক আছে। আবার যথার্থ জ্ঞানের লক্ষণ এই যে, সে ভয় থেকে মুক্তি দেয়। সার্থক শিক্ষায় জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনকে কোনো এক স্তরে স্বীকার করেও অন্য এক স্তরে তাকে অতিক্রম করে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি ও অতিক্রম, সতর্ক অথচ গ্রহিষ্ণু বুদ্ধির সঙ্গে দুয়েরই বিচার বিবেচনা আবশ্যক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা দিয়ে আলোচনার এই অধ্যায়টি শুরু করা যাক। বিজ্ঞান আমাদের আজও ভয় থেকে মুক্তি দেয়নি। বিজ্ঞানের শক্তি আমরা কিছু কিছু চারপাশে দেখি বটে। বিজ্ঞানের বলে কত কিছু ঘটছে, পাহাড় কেটে পথ তৈরি হচ্ছে, মরুভূমির মাঝখানে নগরের দর্শন পাওয়া যাচ্ছে, মানুষের বুকের মাঝে নতুন হৃৎপিণ্ড বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা মানুষ চাঁদের পথে যাত্রা করছে, এই সব আমরা দেখছি এবং শুনছি। আমরা বিজ্ঞান পাঠ করছি স্কুলে কলেজে, কাজ চলছে গবেষণাগারে। তবু বিজ্ঞানের ওপর আমাদের আস্থা দুর্বল। পরিবেশ সম্বন্ধে আমাদের মনের গভীরে একটা অন্ধ ভয় এখনও প্রবল। এর অনেক কারণের ভিতর একটা নিশ্চয়ই এই যে, এদেশের জীবনে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক শক্তি এখনও ব্যাপক হয়ে প্রবেশ করেনি, বরং অনেকটা ওপর তলায় আবদ্ধ আছে। এদেশের যে অগণিত মানুষ দরিদ্র এবং গ্রামবাসী, তাদের অভাব দূর করবার কাজে বিজ্ঞানের ব্যবহার সীমাবদ্ধ।
শিল্পোন্নত দেশ থেকে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আমরা আহরণ করি দেশের উপযোগী করে তার প্রয়োগ কিছুই যে হয় না এমন নয়, কিন্তু যতটুকু হয় সেটা মোটেই যথেষ্ট নয়। এদেশে যে প্রাচীন চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল আধুনিক দৃষ্টিতে তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হয়তো দুর্বল; কিন্তু দেশের মাটির সঙ্গে তার একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। হাতের কাছে যে সব বনৌষধি এবং অন্যান্য উপাদান ছড়িয়ে আছে সেই সব ব্যবহার করে গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা তাতে হত। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের যোগ অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ। আমাদের কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই চিকিৎসাবিদ্যারই ব্যবস্থা হয়েছে। এই চিকিৎসকেরা বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে অনেকখানি পরিচিত। কিন্তু যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে তাঁরা নিপুণ, বড় হাসপাতালের বাইরে সে সব সহজে পাওয়া যায় না; যে সব ঔষধের ওপর তাঁরা নির্ভরশীল সে সব অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য বড় শহরের বাইরে। ফলে এদেশের আধুনিক ডাক্তারেরা বিদেশে আদৃত, কিন্তু এদেশের গ্রামে তাঁরা অসহায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এখনও বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যাকে এদেশের উপযোগী করে তুলবার কাজে বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি।
বিজ্ঞানকে পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করা আজ আমাদের বিদ্যালয়ে ও উচ্চশিক্ষায় একটা প্রধান কর্তব্য। পরিবেশ বলতে যে শুধু নাগরিক পরিপার্শ্ব বোঝায় না, বরং পল্লীই আমাদের অধিকাংশ দেশবাসীর স্বাভাবিক পরিবেশ, একথাটা সহজ সত্য হলেও আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এখনও তার স্বীকৃতি পরিস্ফুট নয়। অথচ এই শতকের প্রথম দিকেই পল্লী উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিবেশের যোগসাধনের কথা মর্মস্পর্শী ভাবে বলে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সরকারী নীতিতে ও গবেষণা পরিকল্পনায় পরিবেশ বিজ্ঞানের উল্লেখ বাড়ছে। বোঝা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে এর গুরুত্ব আরও বেশী করে স্বীকৃত হবে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কিন্তু পরিবেশবিজ্ঞানের প্রবেশ এখনও কুণ্ঠিত। সেখানে শিক্ষা ও পরীক্ষার উদ্দেশ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আমরা বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে ভাগ করেছি, দেয়াল গেঁথে এদের স্বতন্ত্র করা হয়েছে। প্রাণতত্ত্ব ও রিবেশবিজ্ঞানকে নিয়ে যখন জ্ঞানের ধারাকে নবদিগন্তের সন্ধানে প্রসারিত করবার দিন এসেছে তখন ঐ পুরোনো দেয়ালগুলি নতুন প্রচেষ্টার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে যোগের সাধনাটাই মুখ্য। সাংসারিক স্বার্থে দেখি আমাদের সাবধানী বৃত্তি প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু শুধু সেটাকে অবলম্বন করে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সারা বিশ্বের জন্য একটা উদার আমন্ত্রণের সুর যদি প্রধান হয়ে বাজে তবেই বিশ্ববিদ্যালয় নামটি সার্থক হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতীর উদ্বোধন করেন তখন এই আদর্শটি নিঃসন্দেহে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আজ দিকে দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সেই আদর্শের পরাভবের প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। দেয়াল তুলে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। কোনো কোনো উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পাণ্ডিত্যের বিচারের চেয়ে জাতের বিচার বড় হয়ে উঠেছে। যেখানে তা নয় সেখানেও আঞ্চলিকতার বেড়া লঙ্ঘন করা কঠিন। সর্বত্রই দাবি যে, ভেতর থেকে লোক নিতে হবে। মনুষ্যত্বের যে দাবিতে ভেতর আর বাইরের ব্যবধান নগণ্য হয়ে যায় তাকে আমরা মানতে চাইছি না। এই বিচ্ছিন্নতামুখী দাবির সপক্ষেও বলবার কথা নিশ্চয়ই কিছু আছে। তবু মূল প্রশ্নটি থেকেই যায়। অন্যসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পার্থক্য থাকা আবশ্যক। আঞ্চলিকতার দাবি অন্যত্র সঙ্গত হতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলভাবের সঙ্গে এই সব ভেদাভেদ মেলানো যায় না। এই বৃহৎ সমাজে আমরা কি এমন একটি ক্ষেত্রও অন্তত রক্ষা করতে চাইব না, যেখানে জ্ঞান হবে মুক্ত, যেখানে মানুষের বিচার হবে একান্তভাবে তার সত্যকামতা দিয়ে? এটাই প্রধান প্রশ্ন। এর যদি কোনো সদর্থক উত্তর না থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শেরও কোনো অর্থ থাকে না। সাংসারিক স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাচীন ও উদার আদর্শকে আমরা যে-পরিমাণে খর্ব করতে উদ্যত হই সেই পরিমাণে ইতিহাসের কাছে নিজেদের অপরাধী করে তুলি।
এর পরও একটা সাবধানী বাক্য যোগ করা প্রয়োজন। খণ্ড স্বার্থ যেখানে আমাদের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শের সঙ্গে তার বিরোধ। তা নইলে নীড়ের সঙ্গে বিশ্বের বিরোধের কোনো প্রশ্ন নেই। জ্ঞানের চর্চায় অথবা গবেষণায় নিকট পরিবেশের প্রতি একটা বিশেষ দৃষ্টি অথবা আগ্রহ যেমন স্বাভাবিক তেমনই আবশ্যক। নিকটের ভিতর দিয়েই আমরা দূরকেও ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে শিখি। খণ্ডকে উপেক্ষা করে নয় বরং খণ্ডের বৈচিত্র্যের সামঞ্জস্য সাধনের চেষ্টাতেই আমরা অখণ্ড সত্যের আভাস পাই। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার একটা মূল পার্থক্য এখানেই। বিশেষ একটি বৃত্তিতে পটুত্ব অর্জনই বৃত্তিমূলক শিক্ষার উদ্দেশ্যে। উচ্চশিক্ষায় কিন্তু সেটাই আমাদের শেষ লক্ষ্য নয়; বিশেষের ভিতর দিয়ে সাধারণ সত্যে গিয়ে পৌঁছনটাই লক্ষ্য।
উচ্চশিক্ষাকে রোজগার অথবা জীবিকার উপযোগী করে তুলবার একটা দাবি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। জীবিকার প্রয়োজন প্রশ্নাতীত এবং অত্যন্ত জরুরী। কোনো এক কালে সনাতন সমাজব্যবস্থায় পুত্র স্বাভাবিকভাবে পিতার কাছ থেকে পারিবারিক বৃত্তিতে দীক্ষিত হত। এখনও অনেক কৃষকের ছেলে এমনি ভাবেই কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করে, যেমন মায়ের কাছ থেকে মেয়েরা গৃহকর্মে নৈপুণ্য লাভ করে। কিন্তু অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সেই সনাতন ব্যবস্থা আর কালোপযোগী নয়। গৃহ যদিও সন্তানের শিক্ষার অন্যতম ক্ষেত্ৰ তবু গৃহ এবং শিক্ষায়তনের ভিতর দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নতুন বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা এদেশে এখনও দুর্বল, এজন্য আরো সুনিশ্চিত ও ব্যাপক আয়োজন আবশ্যক। অষ্টম শ্রেণীর পর থেকেই কিছু ছাত্রছাত্রীর জন্য এই ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
একথাটা মেনে নেওয়াই ভালো যে, নিছক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ অথবা জীবিকার জন্য শিক্ষা এক বস্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা ভিন্ন বস্তু। এ দুয়ের লক্ষ্য এক নয়, একের দ্বারা অন্যের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। দুয়ের ভিতর একটা সম্পর্ক আছে বটে; কিন্তু দুটোকে এক করতে গেলে অনেক সময় দুয়েরই ক্ষতির সম্ভাবনা। অধ্যাপক ও গবেষকের কাজের জন্য বিশেষভাবে যে-ধরনের অভ্যাস ও নৈপুণ্য প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার সঙ্গে তারই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অবশ্য আছে যাকে বলা যেতে পারে আধা-বিশ্ববিদ্যালয় আধা-প্রশিক্ষণভবন। প্রশিক্ষণের উচ্চনীচ বিভিন্ন স্তর আছে। উচ্চতর প্রশিক্ষণের গৌরব কম নয়। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে যে-ভাবটি রক্ষা করা আবশ্যক সেটি স্বতন্ত্র। নিছক বৃত্তিমূলক কাজের জন্য যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার মোগ্যতম স্থান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। সৈনিক তৈরি করার জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। কারিগর কর্মচারী অথবা প্রশাসক তৈরি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সুপরিকল্পিত ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রাখা সম্ভব এমনকি বাঞ্ছনীয়। সরকারী ও বেসরকারী নিয়োগনীতিতে একথাটা পরিষ্কার করে দিতে পারলেই ভালো হয় যে, এসব কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রীর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে অন্য কাজে যাঁরা নিযুক্ত থাকবেন তাঁরাও পরে কখনও তাঁদের সময়, সুবিধা ও রুচি অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যাতে আবার যোগসাধন করতে পারেন, সেই পথ খোলা থাকা বাঞ্ছনীয়। জীবনের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত আমাদের নাগরিকেরা যেন তাঁদের অভিজ্ঞতা ও পরিণত বুদ্ধি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নানাভাবে ফিরে আসতে পারেন সেই সুযোগ যথাসম্ভব বাড়াতে হবে। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন ঘটা উচিত সরকারী অথবা বেসরকারী কাজে পদোন্নতির আকাঙ্ক্ষায় নয়, বরং মূলত বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে সংযোগ সাধনেরই আগ্রহে।
কথাটা এবার অন্যভাবে বলা যাক। সরকারী শাসনক্ষেত্রে চাকরির জন্য বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায় ও বর্ণের ভিতর একটা দ্বন্দ্ব চলছে এদেশে বহুকাল থেকে। ইংরেজ আমলের প্রথম যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে পুঁজি করে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে যায়। ক্রমে মুসলমানদের ভিতরও ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়। হিন্দু ও মুসলমান নতুন মধ্যবিত্তের ভিতর সরকারী চাকরির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব তখন প্রবল হয়ে ওঠে। দেশ স্বাধীন হবার পর কলেজী শিক্ষা হিন্দু উচ্চবর্ণ থেকে নিম্নবর্ণের ভিতর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে সরকারী চাকরি নিয়ে দ্বন্দ্বটাও তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন বর্ণের ভিতর। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নবর্ণের ছাত্রদের ভর্তির প্রশ্ন নিয়ে যে সংঘর্ষ বিশেষত উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আজ তীব্র আকার ধারণ করেছে তার সামাজিক ও রাজনীতিক পটভূমিকা এই দিক থেকে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না। উচ্চশিক্ষাকে এই দ্বন্দ্বের বাইরে যতটা রাখা যায় ততটাই ভালো। সেটা কী ভাবে করা যায়? উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরই ছাত্র বাছাই করে নিয়ে সরকারী চাকরিতে নিয়োগের জন্য আলাদা দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর সঙ্গে প্রশাসনিক পদের যোগটা ঐতিহাসিক, কিন্তু সেই পুরোনো ব্যবস্থা আজও সমানভাবে রাখতে হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্ব ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যার প্রতি আগ্রহ এখানে মূল কথা। গবেষণা ও স্বাধীন আলোচনার ভিতর দিয়ে পরীক্ষিত জ্ঞানের সীমা বিস্তৃত করা, বিদ্যা বিতরণ করা, এইসবই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। সাহিত্যে হোক, দর্শনে হোক অথবা বিজ্ঞানে হোক, অধ্যাপনা ও গবেষণায় প্রবেশাধিকারের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর অভিজ্ঞানপত্র অর্থবহ। এই ধারণাটা যদি আমরা কাজে পরিণত করতে পারি তবেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারী চাকরির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে এনে তার স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবে। চাকরির জন্য তালিম দেওয়া নয়, বিশ্ববিদ্যার ক্রমপ্রসারিত সীমানার সঙ্গে যোগরক্ষা এবং তদনুযায়ী বিদ্যাচচা ও গবেষণার মান রক্ষা করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দায়িত্ব।
.
৩
ভাষা শিক্ষার প্রশ্ন নিয়ে ইদানীং অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার অতিরিক্ত আরও দুয়েকটি ভাষা শিখে থাকে। ইংরেজীভাষা দেশের বাইরেও অনেক দেশেই আজ ইংরেজীর চর্চা হচ্ছে। পোল্যাণ্ডের নিকটতম দেশ যদিও সোভিয়েত যুক্তরাজ্য তবু রুশভাষার চেয়েও ইংরেজীর প্রতি ওদেশের ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণ বেশী। জাপানেও তাই। ভারত যদি কখনও ব্রিটিশ শাসনে না থাকতো তবু আজ মাতৃভাষার পরে ইংরেজীর চচাই প্রাধান্য পেত এমন অনুমান করা যায়। ইংরেজী সাম্রাজ্যবাদীদের চাপানো ভাষা, এই যুক্তিটা তা হলে অবান্তর হত। আসলে ওটা পুরোপুরি যুক্তি নয়। ভাষাবিশেষকে সাম্রাজ্যবাদী নাম দেওয়া ঠিক নয়, সেটা ইংরেজী অথবা ফরাসী, রুশ অথবা জাপানী, যে ভাষাই হোক না কেন। বাস্তব ঘটনা এই যে, ইংরেজী আজকের পৃথিবীতে নানা কারণে যতটা ব্যাপ্তি লাভ করেছে অন্য কোনো ভাষা ততটা করেনি। বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে যোগ রক্ষা করবার পক্ষে ইংরেজী আজ বিশেষ সহায়ক বলেই চীন ও সোভিয়েত দেশ সহ পৃথিবীর বহু দেশেই শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজী একটা বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছে।
ভারতের অবস্থা অবশ্য সর্বাংশে অন্য দেশের মতো নয়। ঐতিহাসিক কারণে এদেশে ইংরেজী শিক্ষার একটা ভিত্তি, আগে থেকেই আছে। ইংরেজ চলে যাবার পরও সেটা অনেক পরিমাণে থেকে গেছে, যেমন থেকে গেছে পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের আরও অনেক কিছু। এর বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াটি বোঝা সহজ, কিন্তু বামপন্থী প্রতিক্রিয়া সমান সরব। একথা ঠিক, ইংরেজী ভাষাকে আশ্রয় করে এদেশে গত দেড়শ বছর ধরে একটা বাবু শ্রেণী গড়ে উঠছে। আমরা যারা শিক্ষিত তারা প্রায় সবাই এর অন্তর্গত। আত্মসমালোচনা ভালো, কিন্তু এই সামাজিক আত্মসমালোচনার শক্তিও অনেক পরিমাণে আমরা পাশ্চাত্ত্য ঐতিহ্য থেকে লাভ করেছি। ইংরেজী ভাষা এদেশ থেকে তুলে দিলেই বাবু শ্রেণী উঠে যাবে এমন সম্ভাবনা কম, বরং অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল গোষ্ঠী এতে আরও শক্তিশালী হবে এমন আশংকাও আছে।
যাই হোক, শিক্ষার দিক থেকে মূল প্রশ্নটা এই। মাতৃভাষার চর্চা আরও বেশী করে হওয়া উচিত এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু মাতৃভাষার সঙ্গে যদি আরও একটি ভাষা যোগ করতে হয়, যাকে আমরা বলব বৃহত্তর যোগাযোগের ভাষা, তবে সেটি কোন ভাষা হবে? একটা ত্ৰিভাষাসুত্রের কথা আমরা জানি; অহিন্দীভাষীদের জন্য মাতৃভাষা, হিন্দী ও ইংরেজী নিয়ে সেই সূত্র। শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়া ভালো। কিন্তু আরও একটি অথবা দুটি ভাষা ছাত্রছাত্রীরা শিখবে। এই রকমই অন্তত গত বিশ পঁচিশ বছর ধরে আমরা চিন্তা করে এসেছি। এটাকে অবাস্তব অথবা ভ্রান্ত চিন্তা বলে সম্পূর্ণ ত্যাগ করবার যথেষ্ট কারণ বোধ করি দেখা দেয়নি।
মুশকিল একটা দেখা দিয়েছে অবশ্য। সেটা এই যে, ভাষাশিক্ষা ব্যাপারটাই অবহেলিত। শুধু ইংরেজী নয়, মাতৃভাষাও ছাত্রছাত্রীরা ভালোভাবে শিখছে না। ভাষাশিক্ষার মান কী করে উন্নত করা যায় সেটাই আমাদের চিন্তার ব্যাপার হওয়া উচিত। আমরা তা করছি না। আমরা ভাষাশিক্ষার মান জেনেশুনে আরও নামিয়ে দিচ্ছি। এখন এমন অবস্থায় পৌঁছন গেছে যে, পাঠ্যবিষয়ের ভিতর ভাষা থাকবে বটে, তবে ঐ বিষয়টিতে পাশ না করলেও চলবে। এটা শিক্ষাবিরোধী নীতি। ভাষা জিনিসটা শ্রদ্ধার সঙ্গে শিখতে হয়। ভাষার ভিতর দিয়ে আমাদের আত্মপ্রকাশের শক্তি বিকশিত হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষার অসম্মান সংস্কৃতির অমর্যাদার সমতুল্য। ভাষা একটা আছে বটে, কিন্তু ওটাতে পাশ না করলেও চলবে, একথা বললে ছাত্রছাত্রীদের মনে প্রথম থেকেই ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়।
এদেশে আরও অনেক বছর পর্যন্ত প্রাথমিক অথবা মাধ্যমিক পর্যায়ের শেষেই অনেক ছাত্রছাত্রীর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হবে। এদের অনেকের পক্ষে একটির বেশী ভাষা ভালো করে শেখা সম্ভব হবে না। উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে যারা পৌঁছবে তাদের পক্ষে অন্তত আরও একটি ভাষা ভালো করে শেখা বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়। তিনটি ভাষায় সমান দক্ষতা অর্জন অনেকের পক্ষে কঠিন, কাজেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। অধিকাংশ ছাত্রের পক্ষে মাতৃভাষার সঙ্গেইংরেজীর চচাঁই, অন্তত উচ্চশিক্ষার বিচারে, অধিক ফলপ্রদ হবার সম্ভাবনা। বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে যোগাযোগটাই যদি লক্ষ্য হয় তবে বাংলার সঙ্গে হিন্দী যোগ করে যতটা ফল লাভ করা। যাবে বাংলার সঙ্গে ইংরেজী যোগ করে তার চেয়ে ফল পাওয়া যাবে বেশী।
যাই হোক, এসব ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষায়তনকে যথাসম্ভব স্বাধীনতা দেওয়াই ভালো। প্রাথমিক অথবা মাধ্যমিক কোন স্তরে কোন ভাষায় শিক্ষা শুরু হবে, এ নিয়ে অনেক তর্ক হয়েছে। আপাতত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে কিছু বৈচিত্র্য রক্ষা করে ভাষানিবাচনের ব্যাপারে অভিভাবকদের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া যেতে পারে। মাতৃভাষা সহ ভাষাশিক্ষার মান উন্নয়নের প্রয়োজনটাই সবচেয়ে জরুরী। সরকার যদি সেদিকে আরো বেশী করে দৃষ্টি দেন তবেই সেটাকে সবাই একটা সদর্থক প্রচেষ্টা বলে মেনে নেবে। ভাষাশিক্ষার অনেক নতুন পদ্ধতি দেশ ও বিদেশে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভাবিত হয়েছে। আমাদের স্কুলে ও কলেজে তার সার্থক প্রয়োগের যথেষ্ট আয়োজন নেই। এটা একটা বড় অভাব যেটা সরকারী সহায়তা ছাড়া দূর করা যাবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের তেমন উৎসাহ দেখা যায় না। এখানেই আমাদের ভাষাশিক্ষানীতিরও বিষম ব্যর্থত।
.
৪
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যাকে খণ্ড খণ্ড করে দেখা হয়নি, যেমন হয়েছে আধুনিককালে। যদিও এর কারণ আছে তবুও এই যান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রটি গুরুতর। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে, বিদ্যালাভের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের শুধু চরিত্রগঠন হবে তাই নয়, তারা এই বিশ্ব থেকে আনন্দ সংগ্রহ করতে শিখবে। এরই ভিতর দিয়ে ঘটবে মনুষ্যত্বের বর্ধন। জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্বেষণ এবং আত্মপ্রকাশের শক্তি মনুষ্যত্বের পূর্ণতায় সহায়ক বলে মূল্যবান। আমাদের বহু খণ্ডে খণ্ডিত উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার বাজারমূল্য যাই হোক না কেন, এর সঙ্গে মনুষ্যত্বের যোগ দুর্বল। এই দিক থেকে এর পুনর্বিচার প্রয়োজন।
আমাদের পাঠক্রমে নীতিশিক্ষার স্থান নেই। এই রকম একটা অভিযোগ কখনও কখনও শোনা যায়। প্রাচীনকালে এই অভাবটা পূর্ণ হত ধর্মশিক্ষার ভিতর দিয়ে। এখন সেটা হয় না। কোনো কোনো দেশে ধর্মের স্থান নিয়েছেআইডিওলজি। কিছুদিন আগে চীনে গিয়েছিলাম। এখানে পাঠক্রমের অনেকটা স্থান অধিকার করে আছে মার্কসবাদ-মাওবাদ। এরই ভিতর দিয়ে ওদেশের ছাত্রছাত্রীরা শুধু একটা বিশ্বদর্শন লাভ করে তাই নয়, দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা এইসব শিক্ষাও একই সঙ্গে হয়। তবু চীনের দেশপ্রেমে একটা সংকীর্ণতা আছে। চিন্তার স্বাধীনতা ওদেশে শৃঙ্খলিত। আমাদের রাষ্ট্র ঐ রকম ধরাবাঁধা মতবাদে বিশ্বাসী নয়। আমাদের সাধারণ বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষা বা মতাদর্শ কোনোটিরই স্থান নেই। অনেকেই মনে করেন যে, আমাদের স্কুলে কলেজে নীতিশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা আদৌ সম্ভব নয়। ছাত্রছাত্রীরা নীতির নামে কোনো উপদেশ শুনতেও চাইবে না। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনে নানা নৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় অনিবার্যভাবে। জীবনেরই প্রয়োজনে চরিত্রেরও প্রয়োজন। অতএব নীতিশিক্ষা আবশ্যক। জীবন থেকে আহৃত নানা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে যোগ করে নৈতিক সমস্যার আলোচনায় ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ থাকবে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখবার যোগ্য বিষয়।
আসল বাধাটা অন্যত্র। মামুলী নীতিশিক্ষায় বিশেষ ফল নেই। আমরা অনেকেই নীতিশিক্ষা দেবার অধিকারী নই। সেই অধিকার অর্জন করা সহজ নয়। তবু একটা কথা না বললে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা নিতান্ত অসম্পূর্ণ থাকে। মাতৃত্বের যেমন বিদ্যালয়েরও তেমনি একটা আদর্শ রূপ আছে। শিক্ষকের সমস্ত অক্ষমতা নিয়েও সেই কথাটা বারবার স্মরণ করা কর্তব্য। যে-দুটি প্রধান উপাদানে বিদ্যালয়ের আদর্শ গঠিত তার একটির নাম অনুশীলন, অন্যটি আনন্দ। বিদ্যালয়ে শিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বিদ্যালয়ের শিক্ষার গুরুত্ব বেশী।
রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছিলেন যে, আমাদের বিদ্যালয় নিরানন্দ। শান্তিনিকেতনে তিনি শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের যোগসাধন করতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের যোগ সাধিত না হলে শিক্ষা ব্যর্থ কারণ জীবনের মূল লক্ষ আনন্দ। যে-শিক্ষা আমাদের আনন্দের শক্তি দেয় না সে শিক্ষা আমাদের জীবনকে অর্থময় করে না। এই আনন্দের মূল কথা আমাদের মনকে বৃহত্তর কিছুর সঙ্গে যুক্ত করা। শান্তিনিকেতন ছাত্রছাত্রীর মনকে একদিকে নানা উৎসব অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সুরের ঐক্যে মিলিয়েছে, অন্যদিকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমে প্রসারিত বৃহৎ মানবিক আতিথ্যের একটা আদর্শ তুলে ধরেছে।
এই আনন্দের তত্ত্বের সঙ্গে অনুশীলনের যোগ না হলে বিদ্যালয়ের আদর্শ পূর্ণতা লাভ করে না। সত্য যে কঠিন। এই বিশ্ব যে-নিয়মে বাঁধা তাকে বিজ্ঞানের ভিতর দিয়েই হোক, আর শিল্পের অথবা চরিত্রের ভিতর দিয়েই তোক, কঠিন অনুশীলন ছাড়া লাভ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ নিজে নিরলস পরিশ্রমের বিরল উদাহরণ। অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে সত্যকে পাওয়া যায় না, আনন্দকেও নয়। সহজে লভ্য সাময়িক আরামের জন্য তো বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। যে-আনন্দ জীবনের বহু ক্ষয় ক্ষতি থেকে আমাদের। উদ্ধার করতে পারে, বহু ব্যর্থতার ভিতর দিয়েও প্রাণশক্তিকে অপরাজিত রাখতে পারে, বহু। পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে সত্যের অনুসন্ধানে আমাদের অবিচলিত রাখে, তাকে লাভ করবার জন্যই শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বভারতীর এক। সভাতে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তরুণ বয়সে শান্তিনিকেতন থেকে তিনি যা পেয়েছিলেন তার একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা দেন। তিনি বলেন যে, বাইরে যখন উত্তেজনা, আন্দোলন ও কর্মব্যস্ততার ঝড় তখনও মনের গহনে কী করে একটি নিভৃত শান্তির আশ্রয় _____, শান্তিনিকেতন তাঁকে সেই শিক্ষা দিয়েছে। আমাদের বিদ্যালয়গুলিতে আজ অনুশীলন ও আনন্দ দুয়েরই অভাব। অথচ এই দুই আপাতবিরোধী তত্ত্বের ভিতর সমন্বয়ের প্রচেষ্টাতেই বিদ্যালয়ের সার্থকতা। শিক্ষার যদি কোনো নীতি থাকে, কোনো ধর্ম থাকে, তবে এই সমন্বয়ই তার সবোচ্চ নীতি ও ধর্ম। পূর্ণতা অবশ্য অপ্রাপণীয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী করে কিছু নিয়মিত অনুশীলন এবং কিছু আনন্দের উপকরণ রক্ষা করা যায়, এটা এমনই একটা মৌল প্রশ্ন যাকে কোনো মতেই অগ্রাহ্য করা চলে না। আমাদের অবস্থা যতই দীন হোক, পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক, তারই ভিতর এই সমন্বয়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
অনুশীলনের সঙ্গে বিনয়ের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। বিনয়কে বলা হয়েছে বিদ্যার ভূষণ। সেই উদ্ধৃতিটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত যেখানে সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বলছেন যে, জ্ঞানসমুদ্রের ধারে তিনি শুধু নুড়ি কুড়োচ্ছেন। আমাদের আত্মত জ্ঞানের তুলনায় অনাবিষ্কৃত রহস্যময় বিশ্ব যে কত বড় তারই আভাস দেওয়া হয়েছে ঐ উপমার ভিতর দিয়ে। তবু উপমাটি যেন বড় স্থাণু, বড় চিত্রার্পিত। নিউটনের বক্তব্যের গভীরে নিহিত একটা গতিময়তা আছে যেটা স্পষ্ট করা দরকার। মানুষের জ্ঞান স্বল্প কিন্তু সে দাঁড়িয়ে নেই, সে চলমান। জ্ঞান যে মানুষের কাছে লভ্য এই ধারণা থেকে আমাদের আত্মবিশ্বাস আসে। আবার আমাদের জ্ঞান যে অত্যন্ত অসম্পূর্ণ, তার যে নিরন্তর। সংশোধনের প্রয়োজন আছে, এই বোধের ভিতর দিয়ে আসে বিনয়। বিদ্যার্থীর পক্ষে এই আত্মবিশ্বাস ও বিনয় দুই-ই আবশ্যক। বিনয় ছাড়া আহৃত বিদ্যার সংশোধন সম্ভব নয়।
এই বিনয়ের সঙ্গে দৃঢ়তার কোনো বিরোধ নেই। যে-মানুষ কোনো কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করতে জানে না, সুযোগের সন্ধানে অথবা স্তবকতার বশে সর্বত্র মাথা নত করে, তাকে বিনয়ী বলা যায় না। বিনয় যদি বিদ্যার ভূষণ হয় তবে তার মূলে সত্যের প্রতি একটা সদাগ্রহ থাকে। বিজ্ঞানের সত্য সর্বক্ষণই নতুন তথ্য ও যুক্তির আলোতে নিজেকে সংশোধন করতে আগ্রহী। এই সত্যাগ্রহই বিদ্যার ক্ষেত্রে বিনয়ের রূপে দেখা দেয়। কোনো মতাদর্শ যখন এই বিনয় থেকে ভ্রষ্ট হয় তখনই সেটা সত্যের পথে একটা বিষম বাধা হয়ে দেখা দেয়।
আধুনিক জগতে বিজ্ঞান বলে যে-জিনিসটাকে আমরা জানি সেটা যে ক্রমাগতই বিবর্তিত হয়ে চলেছে, শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকেরও আজকের আবিষ্কার যে কাল অংশত ভ্রান্ত প্রমাণিত হবেই, এ কথাটা বিশেষত গত কয়েক শ বছরের ভিতর দিয়ে এমনই স্পষ্ট প্রমাণিত যেকোনো পণ্ডিত যদি আজ তাঁর মতবাদ সম্বন্ধে অভ্রান্ততা দাবি করেন তবে বিনা দ্বিধায় তাঁকে আমরা অবৈজ্ঞানিক বলে চিনে নিতে পারি। আধ্যাত্মিক সত্য সম্বন্ধে এই কথাটা আরো একভাবে সত্য। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেছিলেন যে, সত্যকে বারবার আবিষ্কার করতে হয়, তখন সেই সূক্ষ্ম বোধের কথাই তার উক্তির মূলে ছিল। আমাদের জীবনের মহত্তম বোধও মৃত শীতল শব্দমাত্রে পরিণত হয়, যদি-না জগতের নিত্য নূতন পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করে বহু ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে বারবার হারিয়ে তাকে আমরা নতুন করে ফিরে ফিরে পাই। বিনয় আমাদের শেখায় যে, সত্যকে একটা স্থায়ী সম্পত্তির মতো লাভ করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচচার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের আরো একটা কথা মনে রাখা আবশ্যক। বিদ্যা ও সংস্কৃতির অনেকখানিই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেয়ালের বাইরের উন্মুক্ত সমাজের ফসল। সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে; অধ্যাপকেরা প্রধানত ভাষ্যকার মাত্র। প্রযুক্তিবিদ্যার অনেকখানিই উদ্ভাবিত হচ্ছে, জীবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নতুন সত্যোপলব্ধি হচ্ছে, মানুষের ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে চলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের বাইরে বৃহত্তর সমাজে। কোনো পুরনো সত্য অথবা আদর্শকে বাইরের সংস্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে যথাপূর্ব রক্ষা করতে যে-বিদ্যায়তন অথবা প্রতিষ্ঠান একান্তভাবে নিযুক্ত সে নিজের সত্যকে দিনে দিনে নির্জীব করে তোলে, ইতিহাসের পক্ষে সেটা ক্রমে বর্জনীয় হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অনুশীলনের সঙ্গে সেই বিনয়ের যোগ রক্ষা করা আবশ্যক যাতে বাইরের থেকে শিক্ষা গ্রহণের ধারায় ছেদ না পড়ে। এই যোগ যখন ছিন্ন হয় তখন অনুশীলন তার চরিত্র হারায়, সেখানে অধিষ্ঠিত হয় অহংকার।
দুঃখের বিষয় অনেকে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সংস্পর্শকে মেনে নিয়েছেন একটা বিপরীতার্থে। আমার অনেক সহকর্মীকে বলতে শুনেছি, সমাজে যখন এতো অন্যায়, কেউই যখন নিজের কর্তব্য করছেন না, তখন অধ্যাপকদের কাছ থেকে আদর্শের নামে কিছু আশা করা ঠিক নয়। আমাদের যা কিছু ব্যর্থতা তার জন্য সমাজকে দায়ী করে আমরা বিবেকের কাছে দায়মুক্ত হতে চাইছি। সমাজে বহু অন্যায় আছে বটে। উনিশ শতকের সমাজেও অন্যায় কম ছিল না। অজ্ঞতা ও অবিচারে দৃষিত সমাজের ভিতরই কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে গৌরবের স্থান অধিকার করেছিল। আজও কিছু কিছু অধ্যাপক নিঃসন্দেহে সম্মানের যোগ্য। সমাজের ওপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেওয়ার ভিতর একই সঙ্গে একটা আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং অবিনয়ের ভাব প্রকাশ পায়। আত্মসমালোচনার মধ্যে যে বিনয় আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘবদ্ধ জীবনে তারও প্রয়োজন আছেই। এই দোষে ভরা বেদনাহত সমাজেও শিশুরা জন্মগ্রহণ করছে, চোখে নতুন আলো নিয়ে। তারা বেড়ে উঠছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য। তাদেরও দাবি আছে, অধিকার আছে শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু আদর্শের কথা শুনবার, কিছু আদর্শনিষ্ঠার সঙ্গে পরিচিত হবার! সেই অধিকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যাঁরা যথাসাধ্য কাজ করতে সম্মত তাঁরাই তো শিক্ষক হবার যোগ্য। এ যদি না হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যারও কোনো সমাধান আশা করা যাবে না।
কমলা বক্তৃতা ও অন্যান্য ভাষণ (১৯৮৪)