রক্ত চাই
ইসলামী দুনিয়ার যে ভূখন্ডে আজ সিরীয় মুসলমানরা লেবাননী খৃস্টানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিনী মুক্তি কর্মীদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, আটশত বছর পূর্বে সেই ভূখন্ডে বহু মুসলমান আমীর, শাসক ও সুলতান জঙ্গীর বালক পুত্র খৃস্টানদের মদদে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মুসলমান মুসলমানের রক্ত ঝরাচ্ছিল। ফিলিস্তীন তখন খৃষ্টানদের কজায়। সুলতান আইউবী প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসের সেই ভূখন্ডটিকে কাফেরদের হাত থেকে মুক্ত করার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে ময়দানে নেমেছেন। ফিলিস্তীন উদ্ধারে তাঁর সফল হওয়াও নিশ্চিত ছিল। কিন্তু একদল মুসলমান-ই তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বসে। ফিলিস্তীন আজো কাফেরদের কজায় এবং স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনীরা যায়নবাদী হায়েনাদের ট্যাংকের চাকায় নিষ্পিষ্ঠ হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের মার্চ মাস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সেই ভূখন্ডের-ই আলরিস্তান পর্বতমালার কোন এক স্থানে তার হেডকোয়ার্টারে বসে উপদেষ্টা ও কমান্ডারদের নিয়ে পরবর্তী যুদ্ধপরিকল্পনা সম্পর্কে কথা বলছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, সুলতান আইউবী হাল অবরোধ করে পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তার কারণ, আল-মালিকুস সালিহ খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডের সঙ্গে যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, সে মোতাবেক সম্রাট রেমন্ড সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপর পিছন থেকে হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে এসে পড়েছিলেন। সুলতান আইউবী যথাসময়ে অবরোধ তুলে নেন এবং কৌশল অবলম্বন করে রেমন্ডের রাহিনীর পিছনের চলে যান এবং রেমন্ড যুদ্ধ ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানো শ্রেয় মনে করেন।
হালব মুসলিম অধ্যুষিত নগরী। কিন্তু এখন তা ইসলাম ও ইসলামী রাজ্যের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মুমিন সুলতান আইউবীর দুশমন মুসলমান আমীর ও খৃস্টানদের পুতুল খলীফা আল-মালিকুস সালিহ-এর সামরিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। খলীফা ও আমীরদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে হাবের মুসলমান সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে মাঠে নামে।
সুলতান আইউবী হাবের উপর পুনরায় আক্রমণ করে গাদ্দার ও ঈমান বিক্রেতাদের এই আড্ডাটি গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা প্রস্তুত করছিলেন। ঠিক এমন সময় মিশর থেকে সংবাদ আসে যে, মিশরে তার এক সেনা অধিনায়ক আল-কি খৃস্টানদের মদদে মিশরের মাটিতে সুদানী সৈন্যের সমাবেশ ঘটাচ্ছেন। তার লক্ষ্য, সুলতান আইউবীর অনুপস্থিতির সুযোগে মিশর আক্রমণ করবে এবং সুলতান আইউবীর হাত থেকে মিশরের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু সুলতান আইউবীর ভাই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সুদানী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন এবং আল-কি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। তবে এই সাফল্যের সংবাদ এখনো সুলতান পাননি। তিনি আলরিস্তানের পার্বত্য এলাকায় চিন্তিত মনে বসে আছেন।
ইসলামের এই মহান সেনানী চারদিক থেকে সমস্যা ও সংকটে নিপতিত হয়ে পড়েছেন। একদিকে কয়েকজন মুসলিম আমীরের সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। অপরদিকে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র। এসবের মোকাবেলায় সুলতানের হাতে যে সৈন্য আছে, তা নগন্য। কিন্তু তিনি এমন কৌশল ও কৃতিত্বের সঙ্গে সেসব সমস্যার মোকাবেলা করেন, যা কারো কল্পনায় ছিল না। তাঁর দুশমনদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শীতের মওসুমে এই পাহাড়ী ভূখন্ডে যুদ্ধ করার কল্পনাও কেউ করবে না। উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোতে বরফ পড়ছে। কিন্তু সুলতান আইউবী তাঁর বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এমন এক সময় আক্রমণ পরিচালনা করেন, যখন শীত তুঙ্গে। এই দুঃসাহসী ও অপ্রত্যাশিত অভিযান পরিচালনা করে তিনি তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীটি দ্বারা শত্রু বাহিনীকে যে কোন সুবিধাজনক স্থানে টেনে নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত করাতে পারেন। তার সৈন্যসংখ্যা এতই কম যে, পরম আত্মবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও মাঝে-মধ্যে তাঁর পরাজয়ের আশংকা অনুভূত হত। কিন্তু তারপরও শত্রুপক্ষ তাঁর ভয়ে তটস্থ। সুলতান আইউবীর আশংকা, রেমন্ড পরিকল্পনা ও রাস্তা বদল করে তার উপর হামলা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে রেমন্ডের অবস্থা হল, তিনি এই ভয়ে নিজ এলাকা ত্রিপোলীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্ত করে তোলেন যে, সুলতান আইউবী হামলা করতে পারেন।
সুলতান আইউবী রেমন্ডকে যে প্রক্রিয়ায় বিতাড়িত করেন, তাতে খৃস্টান সেনাদের ধাওয়া করে সাফল্য অর্জন করার চেষ্টা করাই ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সৈন্য কম হওয়ার কারণে তিনি সে ঝুঁকি নেননি। বড় কারণ হল, মিশরে আল কি-এর বিদ্রোহ ও গাদ্দারী তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিল। তিনি আশংকা করছিলেন যে, মিশরের পরিস্থিতি গুরুতর রূপ লাভ করবে। সে পরিস্থিতিতে তাঁকে মিশর ফিরে যেতে হবে। আর যদি তাঁকে মিশর যেতেই হয়, তাহলে মুসলিম আমীরগণ ইসলামী দুনিয়াকে খৃস্টানদের কাছে নীলাম করে দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। এখন সবকিছু নির্ভর করছে, মিশর থেকে কী সংবাদ আসে, তার উপর।
আলরিস্তানের হেডকোয়ার্টারে বসে উপদেষ্টামন্ডলী ও কমান্ডারদের নিকট মিশরের ব্যাপারেই তাঁর উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করছিলেন সুলতান। এমন সময় তিনি সংবাদ পান যে, কায়রো থেকে দূত এসেছে। খবরটা পেয়ে সুলতান রাজা বাদশাদের ন্যায় বললেন না, তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও। বরং সংবাদটা শোনামাত্র তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং দৌড়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যান। দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত দূত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে। সুলতান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, কোন সুসংবাদ নিয়ে এসেছ তো?
সংবাদ খুবই ভাল মহামান্য সুলতান- দূত জবাব দেয়- মাননীয় আল আদেল হাবশী সেনা বাহিনীটিকে আসওয়ানের পার্বত্য এলাকায় এমনভাবে পরাস্ত করেছেন যে, সুদানের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের জন্য আংশকা দূর হয়ে গেছে।
সুলতান আইউবী দুহাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। তাঁবুর ভিতর থেকে অন্যান্যরাও বেরিয়ে আসে। সুলতান তাদেরকে সুসংবাদটা শোনান এবং দূতকে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে যান। তাঁবুতে তার জন্য আহারের ব্যবস্থা করেন। সুলতান দূতের মুখ থেকে আসওয়ান যুদ্ধের বিস্তারিত শুনে তাকে জিজ্ঞেস করেন- আমাদের কতজন সৈন্য শাহাদাতবরণ করেছে?
তিনশত সাতাশজন- দূত জবাব দেয়- আর আহত হয়েছে পাঁচশরও বেশি। দুশমনের সম্পূর্ণ যুদ্ধ সামগ্রী আমাদের দখলে এসে গেছে। এক হাজার দুশত দশজন হাবশী সেনা বন্দী হয়েছে। খৃস্টান ও সুদানী নেতা-কমান্ডার যারা বন্দী হয়েছে, তারা এই সংখ্যার বাইরে। আল-আদেল বন্দীদের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছেন।
খৃস্টান ও সুদানী সালার-কমান্ডারদেরকে কয়েদখানায় ফেলে রাখ- সুলতান আইউবী বললেন- তিনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর বলতে শুরু করেন- আর যে হাজারেরও বেশি হাবশী সেনাকে বন্দী করেছ, তাদেরকে আসওয়ানের পাহাড়ী এলাকায় নিয়ে যাও। তারা মিশরে অনুপ্রবেশ করে পর্বতমালার যে গুহাগুলোতে আত্মগোপন করেছিল, তাদের দ্বারা সেগুলোকে পাথর দিয়ে ভরে দাও। ওখানে ফেরাউনদের যেসব পাতালপ্রাসাদ আছে, সেগুলোকে পাথর দ্বারা পূর্ণ করে দাও। যদি পাহাড় খনন করার প্রয়োজন পড়ে, তাও ঐ হাবশীদের দ্বারা করাও। ওখানে কোন গুহা এবং পাতালপ্রাসাদ যেন অবশিষ্ট না থাকে। আল-আদেলকে বলবে, বন্দীদের সঙ্গে যেন মানবিক আচরণ করা হয়। দৈনিক তাদের দ্বারা ঠিক অতটুকু কাজ করাবে, যতটুকু কাজ সাধারণত একজন মানুষ করতে পারে। কোন কয়েদী যেন খানা-পানিতে কষ্ট না পায় এবং কারো উপর যেন শুধু এজন্য অত্যাচার করা না হয় যে, সে বন্দী। আসওয়ানের সন্নিকটে খোলামেলা জায়গায় জেলখানা তৈরী করে নাও। তোমাদের হাতে যদি অন্য কোন কাজ থাকে, তাহলে সে কাজটাও কয়েদীদের দ্বারা করাও। সুদানীরা যদি তাদের বন্দীদের ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে আমাকে অবহিত করবে। আমি স্বয়ং তাদের সঙ্গে বুঝা-পড়া করব।
এই বার্তা প্রদানের পর সুলতান আইউবী দূতকে বললেন- আল-আদেলকে বলবে, আমার সাহায্যের তীব্র প্রয়োজন। নিজের প্রয়োজনের দিকেও লক্ষ্য রাখবে। সেনাভর্তির গতি বাড়িয়ে দাও। সারাক্ষণ সামরিক মহড়া অব্যাহত রাখ। গোয়েন্দা জাল আরো বিস্তৃত কর। আল-কিনৃদ-এর ন্যায় নির্ভরযোগ্য সালার-ই যদি গাদ্দারীর পথ বেছে নিতে পারে, তাহলে তোমরাও গাদ্দারও হয়ে যেতে পার, আমিও পারি। এখন থেকে কাউকে বিশ্বাস করবে না। আলী বিন সুফিয়ানকেও বলবে, সে যেন আরো সতর্ক ও তৎপর হয়।
***
মিশর থেকে সাহায্য এসে না পৌঁছা পর্যন্ত কোন অভিযান পরিচালনা না করাই ভাল হবে- দূতকে বিদায় দিয়ে সালার ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে সুলতান আইউবী বললেন- সে পর্যন্ত আমরা এতদিনের সাফল্য ধরে রাখার কাজে নিয়োজিত থাকব। তোমরা বর্তমান পরিস্থিতিটার উপর একটু দৃষ্টি দাও। তোমাদের ভাই-ই তোমাদের বড় দুশমন! তোমাদের শক্তিশালী দুশমন তিনজন। এক, আল-মালিকুস সালিহ, যিনি হাবে জেঁকে বসে আসেন। দুই. তার কেল্লাদার গোমস্তগীন, যিনি হাররানে সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে সময়ের অপেক্ষা করছেন এবং তিন, মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীন। এ তিনটি বাহিনী যদি সংঘবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাদের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সহজ হবে না। তোমরা রেমন্ডকে হটিয়ে দিয়েছ ঠিক; কিন্তু সে এই অপেক্ষায় আছে যে, মুসলিম বাহিনী পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়বে আর সে পিছন দিক থেকে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি অবরুদ্ধ হয়েও যুদ্ধ করতে জানি; কিন্তু সেই পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চাই।
আচ্ছা, আল-মালিকুস সালিহ, গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনকে ইসলাম ও কুরআনের দোহাই দিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা চালালে কেমন হয়? এক সালার বললেন।
না- সুলতান আইউবী বললেন- যারা নিজেদের মন-মস্তিষ্ককে সত্যের আওয়াজের জন্য সীল করে রাখে, আল্লাহর কহর ও গজব ছাড়া তাদের মন মস্তিষ্ক উন্মুক্ত হয় না। আমি কি চেষ্টা করিনি? তার জবাবে আমি নানা রকম হুমকি-ধামকি লাভ করেছি। এখন যদি আবার আমি সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে দূত প্রেরণ করি, তারা ভাববে, সালাহুদ্দীন ভয় পেয়ে গেছে। এখন আমি তাদের উপর আল্লাহ গজব হয়ে নিপতিত হয়ে চাই, যা তাদের বিবেক-বুদ্ধির বদ্ধ দুয়ার খুলে দেবে। সেই গজব হচ্ছে তোমরা এবং এই ফৌজ।
সুলতান আইউবী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন—
তোমরা হাল অবরোধ করার পর হাবের মুসলমানরা যে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করল, তা তোমরা কখনো ভুলবে না। তারা নিশ্চয় আমাদের বিপক্ষে লড়াই করেছে। কিন্তু আমি তাদের প্রশংসা করি, এমন দুঃসাহসী লড়াই কেবল মুসলমানই লড়তে পারে। হায়! যদি এই চেতনা ও এই শক্তি ইসলামের পক্ষে ব্যবহৃত হত! তোমরা তো জান, আমি রাজা হতে চাই না। আমার লক্ষ্য হল, ইসলামী দুনিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক এবং মুসলমানদের বিক্ষিপ্ত শক্তিগুলো কেন্দ্রীভূত হয়ে খৃস্টানদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হোক এবং ফিলিস্তীনকে মুক্ত করে আমরা সালতানাতে ইসলামিয়াকে বিস্তৃত করি।
আমরা নিরাশ নই মাননীয় সুলতান!- এক সালার বললেন- নতুন সেনা ভর্তি চলছে। এ অঞ্চলেও বিপুলসংখ্যক যুবক ভর্তি হচ্ছে। মিশর থেকেও বিশেষ সাহায্য আসছে। আমরা আপনার প্রতিটি বাসনাকে পূর্ণ করব ইনশাল্লাহ।
কিন্তু তোমরাই বল, আমি কতদিন বেঁচে থাকব?- সুলতান আইউবী বললেন- তোমরা-ই বা কদিন জীবিত থাকবে? শয়তানী শক্তি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। তাদের সীমানার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। যে বন্ধুদের উপর আমার পূর্ণ আস্থা ছিল, তারা খৃস্টানদের হাতে খেলছে আর আমার হাতে খুন হচ্ছে। আল-কিদ তোমাদের-ই মধ্যকার একজন বিশ্বস্ত সালার ছিল। সেই আল কি সুদান থেকে হাবশী সৈন্যদের ডেকে এনে মিশর হামলা করার চেষ্টা করেছে শুনে কি তোমরা অবাক হওনি? লোকটা আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছে যে, সে নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে। আমি তাকে মৃত্যুদন্ড দেইনি। ক্ষমতার নেশা, সম্পদের লোভ আর নারীর মোহ ভাল ভাল মানুষকেও অন্ধ করে দেয়। ঈমান সোনার ন্যায় চমকায় না। ঈমান নারীর ন্যায় বিলাসিতার বস্তু নয়। ঈমান মানুষকে রাজা ও ফেরাউনে পরিণত হতে দেয় না। আত্মার দ্বার বন্ধ করে দেখ, ঈমান নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। তারপর বিবেকের উপর আবরণ পড়ে যাবে।
স্পেন থেকে তোমাদের পতাকা হারিয়ে গেল কেন? ইতিহাস বলছে, স্পেনের মুসলমানদের এই পতন ছিল কাফেরদের ষড়যন্ত্রের ফল। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র সফল হল কেন? কারণ, মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদেরকে কাফেরদের ক্রীড়নকে পরিণত করেছিল। তারা তাদের ঈমান নীলাম করে দিয়েছিল। স্পেন ছিল তাদের, যারা সমুদ্র পার হয়ে পারাপারের নৌকাগুলো পুড়ে ফেলেছিল, যাতে পালাবার কিংবা ফিরে যাওয়ার চিন্তা-ই মাথায় না আসে। স্পেনের মূল্য তারা-ই বুঝে, যারা বাহন পুড়ে ফেলেছিল। স্পেন ছিল শহীদদের। খুনের নজরানা আদায় করে যারা রাজ্য জয় করে, তাদের দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সেই লোকগুলো দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, যারা এক ফোঁটাও রক্ত ঝরায়নি। ভবিষ্যতেও এমনই ঘটবে। তারা যেহেতু দেশটা বিনামূল্যে পেয়ে যায়, তাই দেশটাকে তারা বিলাসিতার উপকরণে পরিণত করে এবং সিংহাসনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য ঈমানদার দেশপ্রেমী লোকদের জবান বন্ধ করে দেয়, তাদের গলা টিপে ধরে রাখে।
স্পেনেও এটাই ঘটেছে। কাফেররা আমাদের রাজা-বাদশাহদেরকে হীরা জহরত ও ইউরোপের সুন্দরী মেয়েদের বিনিময়ে হাত করে নিয়েছিল। তাদেরকে তাদের-ই সৈন্যদের বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছিল। মুজাহিদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল। এভাবে স্পেনের ইসলামী রাজ্য ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সহচরগণ দেহের রক্ত দ্বারা বাতি জ্বালিয়ে আধা পৃথিবীকে সত্যের আলোয় আলোকিত করেছিলেন। সেই চেরাগ এখন কোথায়? সেই চেরাগ এখন একটি একটি করে নিভে যাচ্ছে। সেই চেরাগ এখন রক্ত চায়। কিন্তু রক্ত দেয়া যাদের কর্তব্য ছিল, তারা খৃস্টানদের মদ ও নারীর নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম কেবলা মুসলমানের হাতছাড়া। আর আমরা মুসলমানরা একজন আরেকজনের রক্ত ঝরাচ্ছি। . কাফেরদের আগে গাদ্দারদের হত্যা করা আবশ্যক- একজন উপদেষ্টা বললেন আমরা যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি, তাহলে আমরা ব্যর্থ হব না।
আমি দেখতে পাচ্ছি, এই ভূখন্ড খুনের মাঝেই ডুবে থাকবে- সুলতান আইউবী বললেন- শাসনক্ষমতা হয়ত মুসলমানদের-ই হাতে থাকবে; কিন্তু তাদের মন-মস্তিষ্কের উপর খৃস্টানরা শাসন করবে।
***
সুলতান আইউবী তাঁর বাহিনীকে এমন এক পজিশনে বিভক্ত ও বিন্যস্ত করে রাখেন যে, কোন একটি দুর্গ জয় হওয়ার পর শত্রুপক্ষ তার উপর সরাসরি হামলা চালাতে পারবে না। তিনি বিজিত দুর্গগুলোতে স্বল্পসংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছেন। কারণ, তিনি দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে লড়াই করার পক্ষপাতী নন। পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিটি পবর্তচূড়ায় তিনি তীরন্দাজ বসিয়ে রেখেছেন। যে পথটি সংকীর্ণ, তার উপর পাহাড়ে বড় বড় পাথরসহ কিছু লোক নিয়োজিত রেখেছেন। তাদের দায়িত্ব হল, দুশমন এই পথ অতিক্রম করার সময় উপর থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলে দিবে। দামেস্ক থেকে আসা পথটিকে তিনি কমান্ডো ধরনের টহল সেনাদের দ্বারা নিরাপদ করে রেখেছেন, যাতে দুশমন তার রসদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। একটি জায়গা এমন যে, সেটি হামাতের শিং নামে খ্যাত। প্রশস্ত একটি উপত্যকা। তাতে বেশ উঁচু একটি পাথর বিদ্যমান। পাথরটির মাথা শিং-এর ন্যায় দুভাগে বিভক্ত হয়ে আছে বলে তাকে হামাতের শিং বলা হয়। সুলতান আইউবী পার্বত্য এলাকায় এই উপত্যকাটিকে ফাঁদ হিসেবে নির্বাচিত করেন। তিনি তার সালারদেরকে কৌশল শিখিয়ে দেন যে, দুশমন যদি বাইরে থেকে এসে যুদ্ধ করতে চায়, তাহলে এই উপত্যকায় টেনে নিয়ে এসে যুদ্ধ করাবে।
সুলতান আইউবী সমগ্র এলাকায় এমন জায়গাগুলোতে পজিশন গ্রহণ, করেছেন যে, সেসব জায়গা থেকে দুশমনকে পছন্দমত যে কোন স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাড়াছাও তার গেরিলা যোদ্ধারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দূর দূরান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে ফিরছে। গুপ্তচরবৃত্তির ব্যবস্থাপনা এতই শক্তিশালী যে, দুশমনের দুর্গগুলোতে পর্যন্ত আইউবীর চর রয়েছে। তারা খবরা-খবর প্রেরণ করছে। সুলতান তথ্য পেয়েছেন, আল-মালিকুস সালিহ তার গভর্নর গোমস্তগীন ও মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীনকে সাহায্যের জন্য তলব করেছেন এবং তারা শর্তসাপেক্ষে সাহায্য দেবেন বলে জানিয়েছেন। গুপ্তচররা সুলতানকে আরো অবহিত করে যে, মুসলমান শাসক ও আমীরগণ বাহ্যত আল-মালিকু সালেহের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলেও তাদের মাঝে পরস্পর মনের মিল নেই। তারা প্রত্যেকেই যুদ্ধ করে অধিক থেকে অধিকতর ভূখণ্ডে নিজ নিজ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। খৃস্টানরা তাদেরকে যত না সাহায্য দিচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে তার চে বেশি। তারা তাদের পারস্পরিক মতবিরোধকে জিইয়ে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত।
আচ্ছা, শামসুদ্দীন এবং শাদবখত-এর কোন সংবাদ আসেনি, না? সুলতান আইউবী হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন।
না, তাজা কোন সংবাদ আসেনি- হাসান বিন আব্দুল্লাহ জবাব দেন তারা। বড় সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। গোমস্তগীন কোন পদক্ষেপ নিলে তারা তাদের যোগ্যতার পরাকাষ্ঠা দেখাবে। তাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, তারা পরিস্থিতি অনুপাতে অভিযান পরিচালনা করবে।
হাসান বিন আব্দুল্লাহ সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব। আলী বিন সুফিয়ান বর্তমানে মিশরে অবস্থান করছেন। সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। মিশরে তাকে একান্ত প্রয়োজন।
সুলতান আইউবী হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর সঙ্গে বাইরে পায়চারি করছেন। হঠাৎ করেই তিনি শামসুদ্দীন ও শাদবখত-এর প্রসঙ্গটা উল্লেখ করেন। এরা দুজন বর্তমানে গোমস্তগীনের সেনাঅধিনায়ক। গোমস্তগীন নামে মুসলমান হলেও শয়তান চরিত্রের একজন লোক। পদমর্যাদায় আল-মালিকুস সালিহ-এর গভর্নর। অবস্থান করছেন হাররান-এর দুর্গে। এই দুর্গের ভিতরে ও বাইরে তিনি বিপুলসংখ্যক সৈন্য সমবেত করে রেখেছেন। লোকটা তথাকথিত খেলাফতের অধীন এবং খলীফার অনুগত। কিন্তু বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার বলে সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন অবস্থান তৈরি করে রেখেছেন যে, কাউকে তিনি পাত্তা ই দিচ্ছেন না। কেন্দ্রকে উপেক্ষা করে খৃস্টানদের সঙ্গে রয়েছে তার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। তার দুর্গে নুরুদ্দীন জঙ্গীর ধৃত খৃস্টান কয়েদী ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন কমান্ডারও ছিল। জঙ্গীর মৃত্যুর পর কারো সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করেই তিনি তাদেরকে মুক্ত করে দেন। এটা করেছেন তিনি খৃস্টানদের সন্তুষ্টি ও সুদৃষ্টি লাভের আশায়। গোমস্তগীন এখন খৃস্টানদের বিরোধী নয়। বরং তাদের সাহায্য নিয়ে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
গোমস্তগীনের দুজন বিশেষ সালার রয়েছে। বিচক্ষণতা ও সামরিক যোগ্যতার কারণে তারা তার অত্যন্ত আস্থাভাজন। তারা দুজন আপন ভাই। একজনের নাম শামসুদ্দীন, অপরজনের নাম শাদবখত। দুজন ভারতীয় মুসলমান। ইরাকের তৎকালীন ঐতিহাসিক কামালুদ্দীন হালবের ইতিহাস নামক একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- শামসুদ্দীন ও শাদবখত সহোদর ভাই ছিলেন এবং সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর জীবদ্দশায় ভারত উপমহাদেশ থেকে তার নিকট গিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করে হাররান প্রেরণ করেছিলেন।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদও তাঁর রোজনামচায় এদের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এও লিখেছেন- আরবে যেহেতু মানুষের নামের সঙ্গে পিতার নামও উল্লেখ করার নিয়ম ছিল, তাই এই দুভাই-এর নাম শামসুদ্দীন আলী বিন জিয়া এবং শাদবখত আলী বিন জিয়া বলে উল্লেখ করা হত। কিন্তু এই জিয়া কে ছিলেন, তার কোন বিবরণ ইতিহাসে উল্লেখ নেই। তারা ইতিহাসে আলোচিত হওয়ার পিছনে একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটা এরকম
গোমস্তগীন ছিলেন স্বাধীনচেতা, তথা স্বেচ্ছাচারী চরিত্রের মানুষ। হাররানে কার্যত তারই শাসন চলত। তিনি ইবনুল খাশিব আবুল ফজল নামক তার অনুগত এক ব্যক্তিকে কাজী তথা বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ইবনুল খাশিব ছিল চাটুকার ও দুশ্চরিত্র মানুষ। ইসলামের কাজীগণ তাদের ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞার কারণে মানুষের কাছে প্রসিদ্ধ। কিন্তু জনসমাজে ইবনুল খাশিবের খ্যাতি ছিল অবিচার ও গোমস্তগীনের চাটুকারিতার কারণে। শামসুদ্দীন ও শাদবখত তার অন্যায়-অবিচারের কাহিনী সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তারা কিছু বলতেন না। তারা দেশের সামরিক শাখার কর্মকর্তা। কাজীর বিচার ফয়সালা ও নাগরিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। গোমস্তগীনের উপর কাজী সাহেবের বেশ প্রভাব ছিল। প্রভাব তিনি সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। গোমস্তগীন তাকে কিছু বলতে সাহস করতেন না।
নুরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের পর শত শত সৈন্য নিয়ে সুলতান আইউবী যখন দামেস্ক আসেন, তখন তিনি অত্র অঞ্চলগুলোতে তাঁর বহু গুপ্তচর ছড়িয়ে দেন। তাদের একজনের নাম আনতানুন। আনতানুন তুর্কী বংশোদ্ভূত সুদর্শন এক যুবক। তুর্কী ভাষা ছাড়াও আরবীতে কথা বলতে পারে অনর্গল। দায়িত্ব পালনার্থে আনতানুন চলে যায় হাররান। সাক্ষাৎ করে গোমস্তগীনের সঙ্গে। গোমস্তগীনকে নিজের কাহিনী শোনায় গড়া কাহিনী।
আমি জেরুজালেমের বাসিন্দা। খৃস্টানরা সেখানকার মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা আমার দুটি যুবতী বোনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে এবং ভাই ও পিতাকে আটক করে রেখেছে। আমি পালিয়ে আপনার নিকট চলে এসেছি। আমি খৃস্টানদের থেকে এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীতে যোগ দিতে চাই।
আনতানুন এমন একটা বেশ ধারণ করে রেখছিল যে, তাতে মনে হচ্ছিল, সে জেরুজালেম থেকে পায়ে হেঁটে এসেছে এবং ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে শোচনীয় অবস্থা। গোমস্তগীন তার প্রতি সেনানায়কের দৃষ্টিতে তাকান। তার দৈহিক গঠন তার পছন্দ হয়। তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি ঘোড়সওয়ারী ও তীরন্দাজী জান? জবাবে আনতানুন বলল, এ মুহূর্তে আমার খানিক বিশ্রাম ও খাবার প্রয়োজন। তারপর দেখাব, আমি কী জানি। গোমস্তগীন তাকে খানা খাইয়ে শুইয়ে দেন। দীর্ঘক্ষণ পর ঘুম থেকে জাগ্রত হলে তাকে গোমস্তগীনের দরবারে হাজির করা হয়। গোমস্তগীন একটি ঘোড়া তলব করেন। আনতানুনকে বাইরে নিয়ে গিয়ে তাকে এক দেহরক্ষীর ধনুক ও একটি তীর দিয়ে বললেন, তুমি তোমার খুশীমত কোথাও নিশানা করে যোগ্যতার প্রমাণ দাও। তারপর ঘোড়া দৌড়াও।
নিকটেই একটি বৃক্ষ ছিল। তার ডালে নানা প্রজাতির কতগুলো পাখি বসা। সবচে ছোট পাখিটি হল চড়ুই। আনতানুন চড়ুইটিকে নিশানা করে তীর ছোঁড়ে। তীর পাখিটির গায়ে বিদ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আনতানুন আরো একটি তীর চেয়ে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে এবং বলে, আমি ফিরে আসলে তোমরা কোন একটি বস্তু আকাশে ছুঁড়ে মারবে। গোমস্তগীনের এক দেহরক্ষী সেখানে দাঁড়ান ছিল। সে দৌড়ে গিয়ে তার খাওয়ার থালাটা নিয়ে আসে। আনতানুন ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে যায়। বেশ কিছুদূর গিয়ে আবার পিছন দিকে মোড় নেয়। এবার ধনুকে তীর সংযোজন করে। এক দেহরক্ষী থালাটা শূন্যে নিক্ষেপ করে। আনতানুন ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে থালাটা লক্ষ করে তীর ছোঁড়ে। তীরের আঘাত খেয়ে থালা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে পড়ে। সে ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে অশ্বচালনার আরো কিছু কৃতিত্ব প্রদর্শন করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। উপস্থিত কারুর-ই জানা ছিল না যে, আনতানুন একজন অভিজ্ঞ গুপ্তচর ও কমান্ডো সেনা।
আনতানুনের দৈহিক কাঠামো, গাত্রবর্ণ ও যোগ্যতা দেখে গোমস্তগীন অত্যন্ত প্রীত ও প্রভাবিত হন এবং তাকে তারই দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেন। গোমস্তগীনের বাসভবন পাহারা দেয়ার দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত হয়।
একবারের ঘটনা। আনতানুন গোমস্তগীনের বাসভবন প্রহরায় নিয়োজিত। এ দায়িত্ব তাকে লাগাতার আট-দশদিন পালন করতে হবে। বিলাসপ্রিয় মুসলিম শাসকদের ন্যায় গোমস্তগীনের হেরেমও জাঁকজমকপূর্ণ। বার-চৌদ্দটি সুন্দরী মেয়ে বাস করে তার হেরেমে। আনতানুন ডিউটিতে গিয়েই প্রথমে ভবনের প্রতিটি দরজা-জানালা ও. প্রতিটি কোণ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। ভবনের সকল চাকর-চাকরানী ও মেয়েদের বলল, যেহেতু এই ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমার কর্তব্য, তাই এর প্রতিটি স্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়া আমার আবশ্যক। ঘরের প্রতিটি কক্ষের কোথায় কী আছে, আমার জানা থাকতে হবে। আনতানুন অত্যন্ত চতুর মানুষ। কথার যাদু চালাতে পারঙ্গম। হেরেমের সর্বত্র অবাধ যাতায়াতে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকতে দিল না সে। বারান্দায় একটি মেয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল। মেয়েটি গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কী করছ?
আমি এই ভবনের মোহাফেজ সৈনিক- আনতানুন জবাব দেয়- ভবনে প্রবেশ-নির্গমনের দরজা কটি, কিরূপ ও কোথায় কোথায়, তা ঘুরে-ফিরে দেখছি। এও দেখছি যে, আপনি ছাড়া এখানে আর কারা থাকে।
এখানে মোহাফেজ তো এর আগেও ছিল- মেয়েটি খানিক বিস্মিত কণ্ঠে বলল- তাদের কেউ-ই তো কখনো ভিতরে প্রবেশ করেনি! এই রীতি আমি পছন্দ করি না।
এটা আমার কর্তব্য- আনতানুন বলল- হেরেম থেকে একটি মেয়েও যদি হারিয়ে যায়, তার জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।
ও, তার মানে তুমি তোমার বোনের হেফাজতের জন্য এসেছ- মেয়েটি মুচকি হেসে বলল।
আজ তার হেফাজত যদি আমি করতে পারতাম, তাহলে আজ একটি মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারত না, তুমি কে? এখানে কী করছ?- আনতানুন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- আমি আমার বোনটাকে রক্ষা করতে পারিনি। তাই আপনার রক্ষণাবেক্ষণে আমি পূর্ণ সাবধানতা অবলম্বন করছি। সেও দেখতে আপনার-ই মত ছিল। আপনি আমার কর্মতৎপরতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না।
আনতানুন অন্ধকারে যে তীর ছুঁড়ল, সেটি নিশানায় গিয়ে আঘাত হানল। সে মেয়েটির আবেগের উপর তীর ছুঁড়েছিল। মেয়েটিও যুবতী। সে জিজ্ঞেস না করে পারল না, তুমি তোমার যে বোনকে রক্ষা করতে পারনি, তার কী হয়েছিল? তোমার বোনকে কি কেউ অপহরণ করেছিল?
অপহরণকারীরা যদি মুসলমান হত কিংবা যদি নিজে কোন মুসলমানের সঙ্গে পালিয়ে যেত, তাহলে আমার এত দুঃখ হত না- আনতানুন বলল- অন্তরকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম, কেউ না কেউ তাকে বিয়ে করে নেবে নতুবা কোন মুসলিম আমীরের হেরেমে পৌঁছে যাবে। আমার বোনটাকে অপহরণ করেছে খৃস্টানরা। একটি নয়- দুটি বোন। আমি তাদেরকে রক্ষা করতে পারিনি!
মেয়েটি জিজ্ঞেস করল- তারা কোথা থেকে কিভাবে অপহৃত হয়েছে? আনতানুন সেই জেরুজালেমের কাহিনী শোনায় এবং নিজের পালিয়ে বাঁচার ও এখানে আসার কাহিনী এমন আবেগময় ভঙ্গিতে বিবৃত করে যে, মেয়েটির চেহারা বলছে, সে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে, যেন আনতানুনের ছোঁড়া তীর তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। আনতানুন বলল- আমি জেরুজালেম থেকে পায়ে হেঁটে এখানে এই প্রত্যয় নিয়ে এসেছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজে যোগ দিয়ে শুধু নিজের বোনদের-ই নয়, ঐ সমস্ত বোনেরও প্রতিশোধ নেব, যাদেরকে খৃস্টানরা অপহরণ করেছে। দুর্গপতি আমাকে তার মোহাফেজ বাহিনীতে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।
আনতানুন আরো এমন কিছু আবেগময় কথা বলল, যা মেয়েটির অন্তরে গেঁথে গেছে।
আনতানুন ভালভাবেই জানে, হেরেমের মেয়েদের আবেগ-চেতনা স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে তারা দুর্বল। কারণ স্পষ্ট। একজন পুরুষের যদি এক ডজন কিংবা আরো বেশি বউ বা রক্ষিতা থাকে, তাহলে একজনও দাবি করতে পারে না, স্বামী আমাকেই কামনা করে। আর যখন রক্ষিতাগুলোকে বিবাহ ব্যতীত হেরেমে আবদ্ধ করে রাখা হয়, তাহলে তো তারা স্বামীর ভালবাসার কল্পনাও করতে পারে না। যুবতী মেয়েদের আলাদা কিছু আবেগ থাকে। হেরেমের মেয়েরা জানে, বছর কয়েক পর তার কোন মূল্য থাকবে না। আনতানুন জানে, হেরেমের মেয়েরা তাদের স্বপ্ন-সাধ চাপা দিয়ে রাখে এবং স্বামী কিংবা মনিবের কোন যুবক বন্ধু, অন্য কোন যুবক বা কোন সুদর্শন চাকরের সঙ্গে প্রেম-ভালবাসার নেশা পূর্ণ করে।
এই মেয়েটি ঘটনাক্রমে আনতানের সম্মুখে এসে পড়ে। তাই সে তার আবেগ নিয়ে খেলা করার চেষ্টা করে। সফল গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তাকে হেরেমের একটি মেয়ের সঙ্গে খাতির পাতানো আবশ্যকও বটে। প্রশিক্ষণের সময় তাকে জানানো হয়েছে যে, গোমস্তগীনের ন্যায় বিলাসী গভর্নর ও আমীরগণ নাচ-গান ও মদের আসর বসিয়ে থাকে। তাতে হেরেমের মেয়েরাও যোগ দেয়। মদ আর নারীর নেশায় তাদের জবান নিয়ন্ত্রণ হারিয় ফেলে। ফলে এই আসরগুলোতে গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায়। আনতানুন আলী বিন সুফিয়ানের হাতেগড়া গুপ্তচর। দায়িত্ব পালনের স্বার্থে সুলতান আইউবী তাকে পর্যাপ্ত অর্থ ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রেখেছেন।
আনতানুন মেয়েটির উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করে ফেলে যে, তার চেহারা থেকেই তা প্রতিভাত হচ্ছে। তার মনে আশাবাদ জাগতে শুরু করে, মেয়েটি তার জালে আটকা পড়বে। কথোপকথন শেষে সে স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হলে মেয়েটি তাকে চাপাকণ্ঠে বলল–
মহলের পিছনে একটি বাগান আছে। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে ওখানে গিয়েও তদারকি করে নিও। ওদিক থেকে কেউ মহলে প্রবেশ করতে পারে। মেয়েটির ঠোঁটে মুচকি হাসি। মনের কথা ব্যক্ত করে ফেলেছে সে।
***
রাতে পাহারা দেয়া বডিগার্ডদের দায়িত্ব নয়। তারা মূল্যবান পোশাক পরিধান করে চকমকে তরবারী কিংবা বর্শা হাতে নিয়ে প্রধান ফটকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বডিগার্ডদের কর্তব্য মনিবকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। তাদের আসল কাজ হল যুদ্ধের ময়দানে মনিবের সঙ্গে থাকা।
আনতানুন রাতের দ্বিতীয় প্রহরে মহলের পিছনের বাগিচায় গিয়ে পায়চারি করতে শুরু করে। মহলের ভিতর থেকে গান-বাজনা ও নাচের শব্দ কানে আসছে। আনতানুন আগত মেহমানদেরকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের দু-তিনজন খৃস্টান। বেশ কিছুক্ষণ বাগিচায় হাঁটাহাঁটি করার পর পিছন দরজা দিয়ে মেয়েটি বের হয়ে তার নিকট চলে আসে।
আপনি কেন এসেছেন? আলতানুন যেন কিছুই জানে না।
তুমি কেন এসেছ?- মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
আপনার নির্দেশ পালন করার জন্য- আনতানুন জবাব দেয়- আপনি আদেশ করেছিলেন, রাতের দ্বিতীয় প্রহরে বাগিচায় এসে দেখতে, মহলের পিছন দিক থেকে অনুপ্রবেশের কোন সুযোগ আছে কিনা। আচ্ছা, আপনি এত সরগরম আসর ছেড়ে বাইরে আসলেন কেন?
ওখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে- মেয়েটি জবাব দেয়- মদের ঘ্রাণে আমার মাথা ধরে যায়।
আপনি মদপান করেন না?- আনতানুন জিজ্ঞেস করে।
না- মেয়েটি জবাব দেয়- এখানকার কোন কিছুতেই আমি অভ্যস্ত নই। তুমি বস। মেয়েটি একটি পাথরের উপর বসতে বসতে বলল।
আমি একজন রাণীর সমান হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারি না- আনতানুন বলল- কেউ যদি দেখে ফেলে?
যারা দেখবে, তারা মদে মাতাল হয়ে আছে- মেয়েটি বলল- তুমি বস এবং বোনদের কাহিনী শোনাও।
আনতানুন তার বিদ্যার পরাকাষ্ঠা দেখাতে শুরু করে। মেয়েটি তার ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। আনতামুনের বোনদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সে নিজের কথা বলতে শুরু করে। আনতানুন তার মনের সব গরিমা পানি করে দিয়েছে। এক পর্যায়ে আনতানুন তাকে পরিমাপ করার জন্য বলল- এবার আপনার চলে যাওয়া উচিত। দুর্গপতি আপনার সন্ধানে লোক পাঠাতে পারেন। তখন চরম বিপত্তি দেখা দেবে। মেয়েটি বলল- আমার অনুপস্থিতি কেউ টের পাবে না। ওখানে মেয়ের অভাব নেই।
আনতানুন আগামী রাতে আবার দেখা হবে বলে চলে যায়।
মেয়েটি আনতানুনকে নিজের ব্যাপারে যা বলেছে, তা হল, সে মদ-মাদকতাকে ঘৃণা করে। তাকে যে ভোগের উপকরণ বানানো হয়েছে, তাতেও তার ঘৃণা। সে হাবের বাসিন্দা। তার পিতার এক বন্ধু তাকে গোমস্তগীনের জন্য নির্বাচন করেছেন এবং নামমাত্র বিবাহ পড়িয়ে পিতা তাকে বিদায় করে দিয়েছেন।
পরদিন রাতেও দুজনের সাক্ষাৎ হয়। এবার আগে আসে মেয়েটি। এসে আনতামুনকে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ে সে। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আনতানুন এসে হাজির হয়। মেয়েটি প্রথমেই বলল- যদি তুমি আমাকে একটি রূপসী মেয়ে মনে করে অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসে থাকে, তাহলে ফিরে যাও। তোমার নিকট আমার এরূপ কোন মনোবাসনা নেই।
যদি কখনো আমি তোমার নিকট অসৎ মনোবাসনা প্রকাশ করি, তখন তুমি আমার মুখে থু থু নিক্ষেপ করে চলে যেও- আনতানুন বলল- আমি তোমাকে আমার বোনদের-ই ন্যায় পবিত্র মনে করি।
না, আমাকে তুমি তোমার বোনদের সঙ্গে তুলনা কর না- মুখের গাম্ভীর্যকে মুচকি হাসিতে পরিবর্তন করে মেয়েটি বলল- কখন কী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি বলা যায় না।
তার মানে তুমি আমার সঙ্গে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার মতলব আঁটছ? আনতানুন বলল।
এটা নির্ভর করে তোমার উপর- মেয়েটি বলল- চিরজীবন তো আর লুকিয়ে চলা যাবে না। এখানে তুমি আট-দশদিনের জন্য এসেছ। চলে যাওয়ার পর তোমার মুখটা মনে পড়লে আমি বেজায় কষ্ট পাব।
এক রাতেই তারা একজন অপরজনের হৃদয়রাজ্যে আসন গেড়ে ফেলে। পরদিন মেয়েটি এতই অস্থির ও বেচাইন হয়ে পড়ে যে, আনতানুনকে দিনের বেলায়ই তার কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। সেদিন গোমস্তগীন মহলে ছিলেন না। হাররানের বাইরে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎ তাদের উভয়ের জন্য ই ছিল বিপজ্জনক। মেয়েটি আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে ভুলে গেছে, এই মহলে ষড়যন্ত্র চলে এবং হেরেমের মেয়েরা একজন অপরজনকে স্বামী থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সুযোগের সন্ধানে থাকে। কিন্তু আনতানুনের ব্যক্তিত্ব ও তার যাদুমাখা বক্তব্য তাকে অন্ধ করে ফেলে। এ হল প্রেম-পিপাসার ফল। আনতানুন তাকে কল্পনা করতেও সুযোগ দেয়নি যে, তার দেহ নিয়ে তার কোন আগ্রহ আছে। মেয়েটির জন্য সে আপাদমস্তক হৃদ্যতার রূপ ধারণ করে। আনতানুন যখন কক্ষ থেকে বের হয়, তখন মেয়েটির মানসিক অবস্থা এই ছিল, যেন এক্ষুণি সে তার সঙ্গে বেরিয়ে যাবে।
দুপুর রাতে তাদের পুনরায় মিলন হওয়ার কথা।
আনতানুন যখন মেয়েটির কক্ষ থেকে বের হয়, তখন অপর একটি মেয়ে তাকে দেখে ফেলে। এই মেয়েটি কক্ষে প্রবেশ করার সময়ও তাকে দেখেছিল।
***
গোমস্তগীন রাতেও ফিরে আসেননি। মেয়েটি নির্দিষ্ট সময়ে বাগানে চলে যায়। আনতানুনও এসে পড়ে। এবার তাদের মাঝে কোন অন্তরায় নেই, না কোন প্রতিবন্ধকতা। খোলামেলা কথা বলছে দুজন।
তুমি বলেছিলে, তোমার বোনদের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তুমি সুলতান আইউবীর ফৌজে যোগ দিতে এসেছ- মেয়েটি বলল- তাহলে এই বাহিনীতে ভর্তি হলে কেন?
এটা কি সুলতান আইউবীর ফৌজ নয়?- আনতানুন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, যেন সে কিছুই জানে না- এটাও তো ইসলামী ফৌজ। সুলতান আইউবী ছাড়া আর কার হতে পারে এ বাহিনী?
এ ফৌজ ইসলামী বটে- মেয়েটি বলল- কিন্তু এদেরকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তাই নাকি?- আনতানুনের কণ্ঠে বিস্ময়, কপালে ভাজ- এতো বড় দুঃসংবাদ! তোমার ধারণা কী? যে ফৌজ সুলতান আইউবীর বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, আমার কি সে বাহিনীতে থাকা ঠিক হবে? তুমি হয়ত জান না, খৃষ্টানরা জেরুজালেমসহ যেসব অঞ্চল দখল করে আছে, সেসব অঞ্চলের মুসলমানরা সুলতান আইউবীকে মাহদী বলে বিশ্বাস করে। তাদের সর্বক্ষণ খৃষ্টানদের অত্যাচারের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। মসজিদের ইমামগণ বলছেন- এ জাতি তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করছে। দামেস্ক থেকে সালাহুদ্দীন আইউবীর রূপ ধারণ করে মাহদী আমাদেরকে মুক্ত করতে আসছেন। তুমি বল, এমতাবস্থায় আমি কী করব?
যদি সাহস হয়, আমাকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাও- মেয়েটি বলল আমি তোমাকে সুলতান আইউবীর বাহিনীর নিকট নিয়ে যাব। এই ফৌজে থাকা তোমার ঠিক হবে না। তবে আমাকে এখানে ফেলে তুমি পালিয়ে যাবে, তা হতে দেব না।
তুমি এখান থেকে পালাতে চাও কেন?- আনতানুন জিজ্ঞেস করে স্বামী তোমাকে দাসীর মত করে রেখেছে, সেজন্য, নাকি স্বামী বৃদ্ধ, সেকারণে? নাকি লোকটি সুলতান আইউবীর বিরোধী, সেজন্য?
আমি লোকটাকে ঘৃণা করি- মেয়েটি জবাব দেয়- যে কটি কারণে আমি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা তুমি নিজেই বলে ফেলেছ। লোকটা আমাকে দাসীর ন্যায় হেরেমে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া সে বৃদ্ধও। সবচে বড় কারণ, গোমস্তগীন সুলতান আইউবীর দুশমন, খৃস্টানদের, দোস্ত। তার হেরেমে আসার আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি বিয়ে করব না। নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট গিয়ে বলব, আপনি আমাকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করুন। আমি খৃস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর নাম জানতাম। তীরন্দাজী এবং নিশানামত বর্শা নিক্ষেপ করা শিখেছি। কিন্তু দেশদ্রোহী ও ইসলাম বিরোধী এই লোকটার হেরেমে আবদ্ধ করে আমার সেই চেতনাকে মদের পেয়ালায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। আশা করি, তুমি বিশ্বাস করবে, এই দুর্গে এসে প্রথমে আমি খুশী হয়েছিলাম যে, আমি এমন একজন বীর যোদ্ধার স্ত্রী হয়ে এসেছি, যিনি খৃস্টানদের বিরুদ্ধে নিজের জীবনকে কোরবান করে দিয়েছেন। কিন্তু নুরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের পরক্ষণেই লোকটা সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
তিনি কি কখনো সুলতান আইউবীর মুখোমুখি হয়েছেন আনতানুন জিজ্ঞেস করে।
হননি- মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন- মেয়েটি জবাব দেয় লোকটা গভীর পানির মাছ। খলীফা আল-মালিকুস সালিহ ও তার দরবার আমীরগণ তার বন্ধু। তারা সবাই সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। গোমস্তগীন তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন যে, তিনি তাদেরকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবেন। তিনি চাচ্ছেন, খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে স্বাধীনভাবে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। যুদ্ধ করে বিপুল এলাকা দখল করে নিতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী। তা-ই যদি হয়, তাহলে তিনি হাররান এর অন্যান্য বিজিত এলাকার সম্রাট হয়ে যাবেন।
তুমি কি কখনো তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছ?
বলেছি- মেয়েটা জবাব দেয়। তিনি আমাকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন। আমি সুলতানকে আমার পীর বলে মান্য করি। গোমস্তগীনের বক্তব্য আমার মধ্যে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফলে তারপর থেকেই তিনি আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেন। তিনি আমাকে মারধরও করতেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন- তুমি সুলতান আইউবীর এলাকায় চলে যাও। তুমি যুবতী মেয়ে, রূপসীও। আইউবীর তিন-চারজন সালারকে তোমার রূপের ফাঁদে ফেলে তার বিপক্ষে দাঁড় করাও। তিনি আরো বললেন- আমি তোমার সঙ্গে আরো দুটি বিচক্ষণ ও সুন্দরী মেয়ে দেব। তারা হবে খৃস্টান। চেষ্টা করলে তিনজন মিলে পাহাড়কেও অনুগত বানিয়ে ফেলতে পারবে। তিনি আমাকে কৌশল শিখিয়ে দিয়ে বললেন- যাও, তুমি গিয়ে গোয়েন্দাগিরি কর। যদি সাফল্য দেখাতে পার, তাহলে তোমার পরিবারকে আমি বিপুল সোনা-দানা দান করব। তারা তোমাকে এখন মুক্ত করে নিয়ে সম্ভ্রান্ত কোন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিবে। কিন্তু আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি।
কেন, তুমি প্রস্তাবটা মেনে নিতে! আনতানুন বলল- এখান থেকে বেরিয়ে তুমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট চলে যেতে।
ঐ শয়তানটা আর তার খৃস্টান বন্ধুরা- মেয়েটি বলল- এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, কোন মেয়ে কিংবা পুরুষ গুপ্তচর যদি তাদের শত্রুর এলাকায় গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে তাকে হয়ত অপহরণ করে নিয়ে আসে নতুবা ওখানেই খুন করে ফেলে। হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক দলের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক আছে। আমার আত্মা মরে গিয়েছিল। রয়ে গিয়েছিল শুধু দেহটা। একবার ভেবেছিলাম, তুমি যা বলেছ, সে ভাবেই মরব। কিন্তু সাহস হয়নি। অবশেষে আমি তোমাকে দেখলাম। তুমি আমার ঘনিষ্ঠ হয়েছ। এখন আমার আত্মা পুনরায় জীবন লাভ করল। তোমার অনুগ্রহ আমি জীবনেও ভুলব না যে, তুমি আমাকে তোমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছ। কিন্তু এতটুকুই যথেষ্ট নয়। আস, আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাই।
তুমি এখানেই- এই দুর্গেই খৃস্টান ও সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পার।
তা কিভাবে?
তোমার মনিব গোমস্তগীন যেমন তোমাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এলাকায় পাঠাতে চান, দ্রুপ সুলতান আইউবীরও গুপ্তচর প্রয়োজন, যারা এখানে অবস্থান করে তাকে এদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করবে।
তুমি কিভাবে জানলে যে, সুলতান আইউবীর গুপ্তচর প্রয়োজন? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
আমি স্বয়ং সুলতান আইউবীর প্রেরিত গোয়েন্দা। আনতানুন বলল। শুনে মেয়েটি এমনভাবে চমকে উঠে, যেন কেউ তার বুকে খঞ্জরের আঘাত হেনেছে।
কী, অবাক্ হলে? মিথ্যা বলিনি। আমি জেরুজালেম থেকে নয়- কায়রো থেকে এসেছি। আমার কোন বোনও অপহরণ হয়নি।
তাহলে তো যেখানে তুমি এতগুলো মিথ্যা বলেছ, সেখানে তোমার এই দাবিও মিথ্যা যে, তুমি আমাকে ভালবাসা দিয়েছ!- মেয়েটি বলল- তোমার প্রেম, তোমার প্রতিশ্রুতি সবই মিথ্যা!
আমি যে তোমাকে ভালবাসি, তার প্রমাণ হল, আমি আমার গোপনীয়তা তোমাকে ফাঁস করে দিয়েছি- আনতানুন বলল- এক কথায় বলতে পার, আমি আমার জীবনটা তোমার দুহাতে অর্পণ করেছি। এখন তুমি গোমস্তগীনকে আমার আসল পরিচয় বলে দিয়ে আমাকে খুন করাতে পার। কোন গুপ্তচর তার আসল পরিচয় ফাঁস করে না। কিন্তু তোমার আবেগ ও ভালবাসা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে আমার আসল পরিচয়টা বলে দিতে। আমি তোমার প্রতি আমার ভালবাসার দ্বিতীয় প্রমাণ তখন দেব, যখন আমি এখানকার কর্তব্য সম্পাদন করে ফিরে যাব। আমি একা যাব না- তোমাকে নিয়ে যাব। তবে একটি কথা স্পষ্ট শুনে রাখ, যদি কখনো তোমার ভালবাসা আর আমার কর্তব্যের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যদি আমি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ি যে, হয়ত তোমাকে বরণ করে নেব, নতুবা দায়িত্ব পালন করব, তাহলে আমি দায়িত্বকেই প্রাধান্য দেব। তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণা করব না- তোমার ভালবাসাকে কোরবান করে দেব। তুমি হয়ত জান না, একজন গুপ্তচরের কর্তব্য তার নিকট থেকে কিরূপ কোরবানী দাবি করে। একজন সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করে জীবন দেয়। বন্ধুরা তার লাশটাকে পরিজনের নিকট পৌঁছিয়ে দেয় এবং সম্মানের সাথে দাফন করে। কিন্তু গোয়েন্দা নিহত হয় না- বন্দী হয়। দুশমন তাকে কয়েদখানায় নিয়ে এমন সব নির্যাতন করে, যা শুনলে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে। গুপ্তচর মরেও না, বাঁচেও না। গুপ্তচরের জন্য লোহার ন্যায় শক্ত ঈমান আবশ্যক। আমি তেমনই ঈমান নিয়ে এসেছি। আমি তোমার সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করেছি বটে; কিন্তু আমি লোহার ন্যায় শক্ত থাকব, ঈমান থেকে একবিন্দু নড়তে পারব না।
মেয়েটি আনতানুনের ডান হাতটা নিজের দুহাতে চেপে ধরে টেনে নিয়ে চুমো খায়। তারপর আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল- তুমি আমাকেও দ্রুপ শক্ত পাবে। বল, আমি কী করব?
আনতানুন মেয়েটিকে সবক দিতে শুরু করে- তুমি গান-বাদ্য ও মদের প্রতিটি আসরে উপস্থিত থাকবে। খৃস্টানদের ঘনিষ্ট হয়ে তাদের কথা-বার্তা শুনবে। প্রয়োজন হলে দু-এক চুমুক পানও করবে। তাদের সামনে সুলতান আইউবীকে মন্দ বলবে। এভাবে এই সালারদের মনের কথা বের করে আনবে যে, তাদের সামরিক পরিকল্পনা কী। খৃস্টানদের কথা-বার্তা মনোযোগ সহকারে শুনবে।
আনতানুন তাকে হিন্দুস্তান থেকে আসা দুসালার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে।
শামসুদ্দীন আলী ও শাদবখত আলীকে আমি ভালভাবেই চিনি- মেয়েটি। বলল- গোমস্তগীন তাদের ছাড়া এক পাও হাঁটতে পারেন না। তারা প্রায়ই এখানে আসেন এবং রং-তামাশায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তারা মদপান করেন না।
তুমি তাদের ঘনিষ্ট হয়ে যাও- আনতানুন বলল- কথা প্রসঙ্গে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, আলরিস্তানে বরফ গলছে কি? তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি আলরিস্তান যাচ্ছ নাকি? তুমি মুচকি হেসে বলবে, ইচ্ছা আছে। তারপর তারা তোমাকে আরো কিছু কথা জিজ্ঞাসা করবে। সম্ভবত জিজ্ঞাসা করবে, ওদিক থেকে কে এসেছে? তুমি বলবে, তিনি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
আমি কিছুই বুঝলাম না- মেয়েটি বলল।
সবই বুঝবে- আনতানুন বলল- আমি তোমাকে কখনো এসব ঝামেলায় ফেলতাম না সাদিয়া! কিন্তু কর্তব্যের দাবি, প্রিয়তম বস্তুটিকেও কর্তব্যের পথে কোরবান করে দেই। তুমি আমাকে কোরবানী করে দাও, আমি তোমাকে কোরবান করে দেব। ভয় পেও না সাদিয়া! জানা নেই, ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কিরূপ বিপদ ও কিরূপ পরীক্ষা নিয়ে আসছে। আমরা দুজন যদি বন্দীশালার জাহান্নামে চলে যাই, কিংবা যদি নিহত হই, তবু আমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ভুলবেন না। মনে রেখ, রক্ত ছাড়া ইসলামকে হেফাজত করা যায় না।
তুমি আমাকে দৃঢ়পদ পাবে- সাদিয়া বলল- তুমি আমার সেই চেতনাটাও জীবিত করে দিয়েছ, যার ব্যাপারে আমি মনে করতাম, সে মরে গেছে।
***
আনতানুন ফিরে যায়। সাদিয়া তার প্রতি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আনতানুন দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সাদিয়া অনুভব করল, এখানে সে একা নয়- তার পার্শ্বে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সাদিয়া। হেরেমের-ই একটি মেয়ে দন্ডায়মান। সাদিয়ার-ই ন্যায় রূপসী যুবতী সে। মেয়েটি বলল- সাদিয়া! তুমি কি এই ভালবাসার পরিণতি চিন্তা করে দেখেছ? তুমি স্বাধীন নও। আমার আবেগ-চেতনাও তোমারই ন্যায়। আমিও খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যেতে চাই। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। আমাদের ভাগ্যে যা লেখা ছিল, আমরা পেয়ে গেছি। আমাদের মনের বাসনাকে অবদমিত করে চলতে হবে। আর চিত্তবিনোদনের একটা উপায় যদি বের করতেই হয়, তাহলে লোক অনেক আছে। একজন রক্ষীসেনাকে তুমি এত বড় মর্যাদা দিও না।
কোন্ রক্ষীসেনার কথা বলছ?- সাদিয়া মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে- তুমি কী বলছ?
দেখ, আমি তোমাদের কথোপকথন পুরোটাই শুনেছি- মেয়েটি বলল আমার থেকে কিছুই লুকাবার চেষ্টা কর না। তার সঙ্গে তুমি যে সওদা করেছ, তার মূল্য অনেক।
মেয়েটি চলে যায়। সাদিয়া চিন্তিত মনে ওখানেই অন্ধকারে পায়চারি করতে থাকে।
সাদিয়ার মনে পড়ে যায়, আনতানুন তাকে বলে গেছে, আজ থেকেই কাজ শুরু করে দাও। তার একথাটিও মনে পড়ে যায় যে, সে আনতানুনকে বলেছিল, তুমি আমাকে দৃঢ়পদ পাবে। কিন্তু সাদিয়া একটি অনভিজ্ঞ মেয়ে। তার জানা নেই যে, পাপের এই রহস্যময় ভূবনে সে কত বড় ঝুঁকি মাথায় তুলে নিয়েছে।
দু-তিনদিন পর সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখত-এর সঙ্গে সাদিয়ার সাক্ষাৎ ঘটে। গোমস্তগীন নাচ-মদের আসরে দুনিয়ার স্বাদ উপভোগ করছেন। সালার, খৃস্টান উপদেষ্টামন্ডলী ও ঊর্ধ্বতন অফিসারদেরকে হাতে রাখার জন্য গোমাগীন এই আসরের আয়োজন করে থাকেন। এই দু-তিন দিনের সাক্ষাতে আনতানুন সাদিয়াকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছে। বিনোদনের এই আয়োজনটা তাকে করতে হয়।
আজকের আসরে সাদিয়া বেজায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। গোমস্তগীন যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত যে, মেয়েটার মধ্যে পরিবর্তন এসে গেছে। সাদিয়া আসরের বাইরে হাসিমুখে একজনের সঙ্গে কথা বলছে। পরক্ষণে সালার শামসুদ্দীনের নিকট গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং এ-কথা ও-কথা বলার পর জিজ্ঞেস করে আলরিস্তানে বরফ গলছে কি?
সালার শামসুদ্দীন চমকে ওঠেন। গোমস্তগীনের ন্যায় অতিশয় বিচক্ষণ ও কঠিনপ্রাণ দুর্গপতির হেরেমের কোন মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা বের হতে পারে, শামসুদ্দীনের ধারণা ছিল না। কেননা, বাক্যটা সুলতান আইউবীর গুপ্তচরদের সাংকেতিক বাক্য। এই কোড বাক্য দ্বারা তারা পরস্পর পরিচয় লাভ করে থাকে। গোয়েন্দা ছাড়া অন্য কারো এই বাক্যটি জানা থাকার কথা নয়। শামসুদ্দীনের এও জানা আছে যে, এই দুর্গে কোন গোয়েন্দা বন্দী নেই, যে এই গোপন সংকেত বলে দিতে পারে। তিনি সংকেতের পরবর্তী বাক্য উচ্চারণ করলেন- তুমি আলরিস্তান যাচ্ছ নাকি?
সাদিয়া মুচকি হেসে বলল- ইচ্ছা তো এমনই।
শামসুদ্দীন কথা বলতে বলতে সাদিয়াকে নির্জনে নিয়ে যায়। অন্য সবাই মদ নারীতে ডুবে আছে। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি কি জান, আমি সালার?
আমি আরো কিছু জানি- সাদিয়ার হাসিতে তিরষ্কার নয়- ঘনিষ্ঠতার ভাব।
কে এসেছে?- শামসুদ্দীন অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করে- তুমি কি জান, আমার সঙ্গে প্রতারণা করলে তোমায় কী সাজা হবে?
প্রতারণা নয়- সাদিয়া জবাব দেয়- আপনি হাঁটতে হাঁটতে প্রধান ফটকের নিকট চলে যান। সেখানে দুজন রক্ষীসেনা দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করবেন, জেরুজালেম থেকে কে এসেছে?
শামসুদ্দীন ফটকের নিকট চলে যান। ওখানে দুজন মোহাফেজ দাঁড়িয়ে আছে। শামসুদ্দীন তাদেরকে চিনেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন- জেরুজালেম থেকে তোমাদের কে এসেছে? আনতানুন সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি। শামসুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন- তুমি যদি আলরিস্তান থেকে এসে থাক, তাহলে ওখানে বরফ গলছে।
আপনি আলরিস্তান যাচ্ছেন নাকি? আনতানুন জিজ্ঞেস করে।
ইচ্ছা তো এমনই। শামসুদ্দীন মুচকি হেসে জুবাব দেন।
শামসুদ্দীন নিশ্চিত হন যে, আনতানুন সত্যিই আইউবীর গোয়েন্দা। তিনি জিজ্ঞেস করেন- মেয়েটি ধোকা দিচ্ছে না তো?
না- আনতানুন জবাব দেয়- সাক্ষাতের সুযোগ করে দিন, সব কথা খুলে বলব।
***
সাক্ষাতের সুযোগ সৃষ্টি করে নেয়া হল। শামসুদ্দীন একজন সেনা অধিনায়ক। সুযোগ সৃষ্টি করা তার পক্ষে কোন ব্যাপার নয়। তিনি আনতানুনকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি সাদিয়াকে কিভাবে ফাঁদে ফেলেছ এবং তাকে কিভাবে বা বিশ্বাস করে আমাদের সাংকেতিক বাক্য বলে দিলে? আনতানুন তাকে ঘটনাটা ইতিবৃত্ত শোনায় যে, মেয়েটির সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ কিভাবে হয় এবং তার সঙ্গে কি কি কথা হয়।
আমি একটি আশংকা অনুভব করছি- শামসুদ্দীন বললেন- তুমি যুবক। সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান। মেয়েটিও যুবতী এবং অতিশয় সুন্দরী। আমি কর্তব্যের উপর আবেগের জয়ী হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আবেগের বশবর্তী হয়ে দিনের বেলা এভাবে তার কক্ষে যাওয়া তোমার ঠিক হয়নি। তুমি সাবধানতা অবলম্বন করনি। মেয়েটির মনে ভালবাসা ও ঘনিষ্ঠতার পিপাসা আছে। তুমি তাকে ভালবাসাও দিয়েছ, ঘনিষ্ঠতাও দিয়েছ। এরূপ মেয়েদের আবেগ স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক হয়ে থাকে। আমার ভয় হচ্ছে, তুমি তোমার কর্তব্যকে আবেগের আতিশয্যে ধ্বংস করে দেবে। আমি তোমার ঈমানের পরীক্ষা নিতে চাই।
আমি আমার উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষে তাকে আসক্ত বানিয়েছি- আনতানুন বলল- তবে আমি মিথ্যা বলব না। এই মেয়েটি আমার মন জয় করে নিয়েছে। আমি আপনাকে আল্লাহ ও তার রাসূলের শপথ করে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এই ভালবাসা আমার কর্তব্যের উপর জয়ী হতে পারবে না।
তারপর শামসুদ্দীন ও আনতানুনের মাঝে কিছু কাজের কথা হয়। সালার শামসুদ্দীন গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ দিয়ে আনতানুনকে বিদায় করে দেন।
সেদিনই শামসুদ্দীন তার ভাই শাদবখতকে জানালেন, সুলতান আইউবী এখানে একজন লোক পাঠিয়েছেন। তার নাম আনতানুন। সে এই মহলের-ই মোহাফেজ দলে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়েছে।
শামসুদ্দীন ও শাদবখতের ব্যক্তিগত দুই রক্ষীসেনা, তাদের আরদালী এবং দুজন চাকরও সুলতান আইউবীর যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা। সালারদ্বয় তাদেরকে জানায়, তোমাদের আরো একজন সঙ্গী এখানে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু লোকটা নিজেই নিজেকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দুর্গপতির ব্যক্তিগত বাসভবনের একটি মৎস শিকার করে নেয়া তার বিরাট সাফল্য। কিন্তু সে বিপদমুক্ত নয়। শামসুদ্দীন তার সঙ্গীদেরকে বিষয়টা বিস্তারিত বুঝিয়ে দিয়ে বললেন- এখন পর্যন্ত হাররানে আমাদের কোন গোয়েন্দা ধরা পড়েনি। আমার ভয় হচ্ছে, আনতানুন ধরা পড়ে যাবে। তার প্রতি আমাদের নজর রাখতে হবে। আর আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। লোকটা যদি ধরা পড়ে যায়, তাহলে আমাদের জন্য অপমান। তাছাড়া নির্যাতনে বাধ্য হয়ে সে আমাদের সকলের নামও বলে দিতে পারে। আমি বেশি চিন্তা করি সুলতান আইউবীর কথা। তিনি বলবেন, দুজন সালার আর ছয়জন যোদ্ধা গোয়েন্দা একটা লোককে রক্ষা করতে পারলে না!
আপনারা এবং আমরা থাকতে আরেকজন লোক পাঠাবার কী প্রয়োজন ছিল? এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে।
প্রয়োজন তা-ই ছিল, যা সে পূরণ করেছে- শামসুদ্দীন জবাব দেয় আমাদের গোমস্তগীনের হেরেম পর্যন্ত পৌঁছানো প্রয়োজন ছিল। যা হোক, এসব বাদ দাও। আমি জানি, এটা হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর সিদ্ধান্ত, যা সম্পূর্ণ সঠিক। আমি তোমাদেরকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিলাম। তোমরা প্রস্তুত থাকবে। মেয়েটিকে অপহরণ করে আমাদের উধাও হওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। তোমরা তার জন্য প্রস্তুত থাকবে।
আমরা প্রস্তুত- সবাই বলল- প্রয়োজন শুধু সময়মত সংবাদ পাওয়া।
না, সময়মত সংবাদ পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে- শামসুদ্দীন বললেন এমনও হতে পারে, আমিও তখন টের পাব, যখন আনতানুন পিঞ্জিরায় আবদ্ধ থাকবে এবং তার হাড়-গোড় চুরমার হতে থাকবে।
***
কারো থেকে সাহায্য না নিয়ে আমাদের লড়াইটা আমরা স্বাধীনভাবে লড়তে চাই। তোমরা কী বল?- গোমস্তগীন সালার শাসসুদ্দীন ও শাদবখতকে জিজ্ঞেস করেন- তোমরা তো জান, আমরা যারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, সংখ্যায় নগন্য। আমরা বাহ্যত যদিও ঐক্যবদ্ধ; কিন্তু মূলত একজনের মন এক দিকে। খলীফা আল-মালিকুস সালিহ বাচ্চা মানুষ। তিনি কতিপয় আমীরের কথায় উঠাবসা করছেন। তারা সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করো তাকে ছুঁড়ে ফেলতে এবং নিজেরা স্বাধীন শাসকে পরিণত চাচ্ছে। মসুলের শাসনকর্তা সাইফুদ্দীন আমার বন্ধু এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর শক্র। কিন্তু তিনি একটি স্বতন্ত্র রাজ্যের স্বাধীন শাসক হতে চান। আপনারা তো জানেন, আমি হাররানের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক সৈন্য রিকুট করেছি। আমি খৃস্টান সম্রাট রেজিনাল্ট এবং তার সকল যুদ্ধবন্দীকে এই শর্তে মুক্তি দিয়েছিলাম যে, আমি যখন সালাহুদ্দীন আইউবীর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হব, তখন তারা সরাসরি আমার সহযোগিতা না করলেও পিছন কিংবা পার্শ্ব থেকে সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর হামলা করবে অথবা তাকে আক্রমণের ধোকা দিয়ে তার দৃষ্টি আমার থেকে অন্যদিকে সরিয়ে দেবে। আমি আশা করছি, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করতে পারব। তিনি খৃস্টানদেরকে পিছনে হটিয়ে দিতে পারেন। কেননা, খৃস্টানরা তার রণকৌশল জানে না। আমরা তো বুঝি। আমরাও মুসলমান। তার বাহিনী যদি প্রাণপণ লড়তে পারে, তো আমরাও তদপেক্ষা বেশি বীরত্বের প্রমাণ দিতে পারব। আইউবী প্রথমবার যখন হাব আক্রমণ করেছিলেন, তখন হাবের মানুষ তাকে চরম শিক্ষা দিয়েছিল। তা থেকেই আমার সাহস বেড়ে গেছে।
সালার শাসসুদ্দীন ও শাদবখত গোমস্তগীনকে একথা বললেন না, যে, মুসলমানের বিরুদ্ধে মুসলমানের লড়াই না করা উচিত আর খৃস্টানরা মূলত আমাদের দুশমন। তারা আমাদেরকে সাহায্য করার কথা বলে বলে প্রতারণা করবে-সাহায্য দেবে না। তারা একথাও স্মরণ করিয়ে দিল না যে, আল মালিকুস সালিহ খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডকে সোনা-দানী দিয়ে চুক্তি করেছিল, সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে রেমন্ড আইউবীর উপর পিছন দিক থেকে হামলা করবেন। সুলতান যখন হাল্ব অবরোধ করেন, তখন রেমন্ড বাহিনী এসে পড়ে। কিন্তু সুলতান আইউবীর কমান্ডো বাহিনী তাকে প্রতিহত করে এবং তিনি যুদ্ধ না করেই ফিরে যান।
শাসসুদ্দীন ও শাদবখত কোন প্রসঙ্গেই গোমস্তগীনের সঙ্গে দ্বিমত করলেন না। বরং তাকে সমর্থন জানালেন এবং পরামর্শ দিলেন যে, এ সময়ে সুলতান আইউবী আলরিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় বসে আছেন। এই পর্বতমালায় হামাতের শিং নামক যে উপত্যকা আছে, তাকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানো গেলে আইউবীকে পরাজিত করা যেতে পারে। তারা পরামর্শ দেয়, হ্যাঁ, আমরা স্বাধীনভাবেই লড়াই করব; কিন্তু খৃস্টানদের থেকে সাহায্যও গ্রহণ করব।
আমি সংবাদ পাচ্ছি, আমার এখানে নাকি সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর আছে এবং তারা আমাদের প্রতিটি সংবাদ তাকে পৌঁছিয়ে দিচ্ছে- গোমস্তগীন বললেন- আপনারা সতর্ক থাকুন, চারদিক কান রাখুন এবং তদন্ত করুন।
সে কথা আপনার বলতে হবে না- শাদবখত বললেন- সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কত শক্ত ও বিস্তৃত, আমাদের জানা আছে। এখানে আমরাও আমাদের গোয়েন্দা ছড়িয়ে রেখেছি। কোন সন্দেহ দেখা দিলেই তারা আমাদেরকে অবহিত করবে।
এ ক্ষেত্রে আমি বড় কঠিন মানুষ- গোমস্তগীন বললেন- যদি আমার পুত্রের ব্যাপারেও সন্দেহ জাগে যে, সে শত্রুর হয়ে গোয়েন্দাগিরি করছে, তাহলে তাকেও আমি পিঞ্জিরায় বন্দি করব- এক বিন্দু দয়া করব না।
গোমস্তগীন যে দুসালারের সঙ্গে এত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন, তারা যে সুলতান আইউবীর গুপ্তচর, তা তার কল্পনায়ও নেই। এরা দুজন অত্যন্ত বিপজ্জনক গোয়েন্দা। অথচ, এরা গোমস্তগীনের সেনা অধিনায়ক। গোমস্তগীনের বাহিনীর কমান্ড তাদের হাতে।
গোমস্তগীন থেকে আলাদা হয়ে শামসুদ্দীন ও শাদবখত পরিকল্পনা ঠিক করেন, তারা যখন ফৌজ নিয়ে সুলতান আইউবীর মোকাবেলায় যাবেন, তখন তারা তাদের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে আগেই সুলতানকে জানিয়ে দিবেন। আইউবী উপযুক্ত স্থানে তাদেরকে ঘিরে ফেলবেন এবং তারা আত্মসমর্পন করবে।
দুভাই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পরিকল্পনা করতে থাকেন এবং খুটিনাটি প্রতিটি দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। গোমস্তগীন কোনদিন আক্রমণ চালাবেন, তা এখনো তারা জানেন না। তাকে দ্রুত হামলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
***
গোমস্তগীনের বাসভবন প্রহরার দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে আনতানুনের। এখন আর এখানে নেই সে। সাদিয়া তাকে কিছু কাজের কথা বলেছিল। এখন সাদিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা দুরুহ হয়ে পড়েছে তার। অথচ, মেয়েটির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রতি মুহূর্ত অস্থিরতার মধ্যে কাটাচ্ছে সে। তার কারণ দুটি। প্রথমত, কর্তব্য পালন। দ্বিতীয়ত, হৃদয়ের টান।
মহলের এক চাকরানীকে হাত করে নিয়েছে সাদিয়া। একদিন তার মাধ্যমে সে আনতানুনকে সংবাদ পাঠায়, যেন আজ রাতে সে ঠিক আগের সময় উক্ত বাগানে চলে আসে। প্রধান ফটক অতিক্রম করে বাগানে প্রবেশ করা অসম্ভব। বাগানের পিছনে একটি উঁচু দেয়াল আছে। সাদিয়া আলতানুনকে বলে পাঠায়, দেয়ালের বাইরে একটি রশি ঝুলান থাকবে। সেই রশি বেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়বে।
সে রাতে মহলে নিমন্ত্রণের আয়োজন ছিল। যুদ্ধে সহযোগিতা করতে পারে এজাতীয় বহু লোককে গোমস্তগীন দাওয়াত করেছেন। তাদের মধ্যে আছে বেশ কজন খৃস্টান কমান্ডার। মসুল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকজন মুসলিম সেনা অফিসারও এসেছেন। গোমস্তগীন এমন কজন বেসামরিক লোককেও দাওয়াত করেছেন, যাদের কাছে বিপুল অর্থ আছে। এই মেহমানদের থেকে যুদ্ধের জন্য সহযোগিতা নিতে চাইছেন গোমস্তগীন। সালার শামসুদ্দীন এবং শাদবখতও ভোজসভায় উপস্থিত আছেন গোমস্তগীনের কাজী ইবনুল খাশিব আবুল ফজলও।
আসরটাকে পুরোপরি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সাদিয়া। এজাতীয় আসর-সভায় তার গুরুত্ব অপরিসীম। সে তার ইচ্ছার বিপরীতে এমনভাবে সাজগোজ করে, যা উপস্থিত মেহমানদেরকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করছে। এমনিতেই মেয়েটির রূপ-যৌবনের স্বতন্ত্র এক আকর্ষণ আছে। তার উপর এত সাজসজ্জা! নারীলোলুপ পুরুষদেরকে পাগল করে তুলছে সাদিয়া। মেয়েটি এখান থেকে সেখানে হরিণীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেক মেহমানের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে। এরই মধ্য দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে চলছে সে। কোন খৃস্টান কিংবা মুসলিম সেনা অফিসারকে কথা বলতে দেখলেই তার পার্শ্বে গিয়ে কান পেতে এমনভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যে, তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। সাদিয়া শামসুদ্দীন এবং শাদবখতের নিকটও গিয়ে দাঁড়ায় এবং একইভাবে হাসিমুখে কথা বলে। তারা সাদিয়াকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, কোন গোপন তথ্য পেয়ে গেলে আমাদেরকে জানাবে। আনতানুনের সঙ্গে বেশী দেখা-সাক্ষাৎ করবে না। কিন্তু আজ রাতই যে আনতানুনের সঙ্গে বাগানে তার সাক্ষাৎ হওয়ার কথা এবং সে মিলনটা একটু পরই ঘটতে যাচ্ছে, সে কথা গোপন রাখে সাদিয়া।
এখন গভীর রাত। ঘোর অন্ধকার। সাদিয়া চাকরানীকে দিয়ে দেয়ালের রশিটা বেঁধে রাখে। দেয়ালের ভিতর দিকে একটি গাছ আছে। আনতানুন বাহির থেকে রশি বেয়ে উপরে উঠে আবার সেই রশির অপর মাথা বেয়ে দেয়ালের ভিতর নীচে নেমে গাছটার আড়ালে লুকিয়ে থাকবে।
এই আসরে বাহির থেকে অনেক উন্নত নর্তকী আনা হয়েছে। আমদানী করা হয়েছে অল্প বয়স্ক কটি সুশ্রী বালককে। তারা অর্ধ উলঙ্গ হয়ে বিশেষ ধরনের নাচ নাচছে। হেরেমের সব কটি মেয়ের প্রতি গোমস্তগীনের নির্দেশ, যে কোন মূল্যে হোক, সব কজন মেহমানকে পুরোপুরি আয়ত্ত্বে নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। তাদেরকে এই আসরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। মদের মটকার মুখ খুলে দেয়া হয়েছে। সাদিয়াও স্বাধীনভাবে যে কারো সঙ্গে মিশছে ও হাসিমুখে কথা বলছে।
আসরের রওনক ও আনন্দ-ফুর্তির মাত্রা বেড়ে চলছে। পাশাপাশি সাদিয়ার অস্থিরতাও বাড়ছে। কারণ, আনতানুনের এসে পড়ার সময় হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে সে একজন খৃষ্টান কমান্ডারের সঙ্গে আলাপে মত্ত। এই খৃস্টান লোকটা অনর্গল আরবী বলতে পারে। সাদিয়া সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে কথা বলছে, যাতে তার মনের কথা বের করা যায়। হয়েছেও তা-ই। তারা সুলতান আইউবীকে কিভাবে খতম করবে, তার বিবরণ দেয় সাদিয়াকে। এই সুযোগে সে সাদিয়ার ঘনিষ্ঠতা লাভ করার চেষ্টা করে। সাদিয়া তাতে বাধা দেয়নি। মূল্যবান তথ্য হাসিল করছে সে। খৃস্টান লোকটা কথা বলতে বলতে আসর থেকে উঠে তাকে আড়ালে নিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে সে সাদিয়াকে নিয়ে বাগানে চলে যায়। বাগানটা অন্ধকার। সেখানে গিয়ে সাদিয়া অনুভব করে, আনতানুন এসে পড়েছে। সাদিয়া লোকটাকে বলল, চলুন ফিরে যাই। কিন্তু সে এখনই যেতে চাচ্ছে না।
খৃস্টান লোকটা সাদিয়ার বাহু জড়িয়ে ধরে টেনে ঘাসের উপর বসিয়ে দেয় এবং তার রূপের প্রশংসা করতে শুরু করে। সাদিয়া তাকে ঠেকাবার চেষ্টা করে। লোকটা নেশাগ্রস্ত। সে সাদিয়ার সঙ্গে যথেচ্ছ আচরণ করার চেষ্টা করলে সাদিয়া হাসিমুখে বলল- জান, আমি কার?
তার অনুমতি নিয়েই আমি এই দুঃসাহস দেখাচ্ছি- খৃস্টান বলল এবং সাদিয়াকে টেনে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলল- তুমি যাকে তোমার স্বামী বলছ, সে তোমার স্বামী নয়, এই সত্যটা তুমিও জান। সে সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করে নিজে রাজা হওয়ার মানসে তার কথিত সবগুলো স্ত্রীকে এ রাতের জন্য আমাদেরকে হালাল করে দিয়েছে।
লোকটার কোন আত্মমর্যাদাবোধ নেই। সাদিয়া মনের ক্ষোভ দমন করে মুখের হাসি বহাল রেখে মনে মনে বলল। তার জানা আছে, এই খৃস্টান লোকটা যা বলছে, সবই সঠিক।
যে লোক নিজের ঈমান বিক্রি করতে পারে, সে নিজের স্ত্রী-বোন এবং কন্যার ইজ্জতও নীলাম করতে পারে। তুমি একটা বোকা মেয়ে। ফুর্তি করতে আপত্তি করছ কেন? আবার কিনা বলছ, মদপান কর না?
দুটি বিষয় সাদিয়াকে ভাবিয়ে তুলছে। এক. আনতানুন এসে পড়েছে। দুই. এই খৃস্টানটার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। গোমস্তগীন যদি মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হতেন, তাহলে সাদিয়া তার নিকট ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিত এবং বলত, অমুক আমার প্রতি হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো। যে কোন মূল্যে মেহমানদের সন্তুষ্ট করা গোমস্তগীনের হেরেমের মেয়েদের কর্তব্য। কোন মেহমানকে। বিশেষত, কোন খৃস্টান কমান্ডারকে অখুশী করা গোমস্তগীনের নির্দেশ অমান্য করার নামান্তর। লোকটা তার স্ত্রীদের ইজ্জতের বিনিময়ে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য গ্রহণ করছে। এমতাবস্থায় সাদিয়া খৃস্টান, লোকটার মুখে থু থু ছিটাতেও পারছে না, তাকে ত্যাগ করে পালাতেও পারছে না। কিন্তু এসব বাধ্য-বাধকতা সত্ত্বেও সাদিয়া তার সম্ভ্রম বিকাতে পারে না। কি, করবে, সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে সাদিয়ার পক্ষে।
আনতানুনের বিষয়টা প্রচন্ডভাবে ভাবিয়ে তুলছে সাদিয়াকে। চরম আকার ধারণ করেছে সাদিয়ার অস্থিরতা। তার এই মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেই লোকটা তার সঙ্গে অসদাচরণ শুরু করে দেয়। সাদিয়া লাফিয়ে ওঠে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় তার। মেয়েটা ঘাসের উপর বসা ছিল। সে খৃস্টানটাকে সজোরে ধাক্কা মারে। লোকটা চীৎ হয়ে পড়ে যায়।
নারীরা অবলা। কিন্তু যদি তার মধ্যে আত্মমর্যাবোধ জেগে ওঠে, তাহলে সে বিশাল পাথরখন্ডকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে। খৃস্টান লোকটা নেশাগ্রস্ত। সে সাদিয়ার এই আচরণকে ঠাট্টা মনে করে খিলখিল করে হেসে ওঠে। নিকটে মাটির বড় একটি পাত্র রাখা ছিল। রাগে-ক্ষোভে পাগলের মত হয়ে গেছে সাদিয়া। সে পাত্রটি হাতে তুলে নেয়। অত্যন্ত ভারি বস্তু। সাদিয়া সেটা উপরে তুলে লোকটার মুখের উপর ছুঁড়ে মারে। চীৎ হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায়-ই খিলখিল করে হাসছিল সে। ভারি গামলাটা তার কপালে গিয়ে আঘাত হানে। সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসি থেমে যায়। সাদিয়া গামলাটা আবার তুলে নেয়। লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সাদিয়া পাত্রটা তার মাথার উপর ধরে আস্তে করে ছেড়ে দেয় এবং নিজে সেখান থেকে সরে গিয়ে পিছনের বাগিচায় চলে যায়।
আসরে মদপানের ধারা চলছে। নাচ-গান এখন তুঙ্গে। কে বেঁচে আছে আর খুন হল, সে খবর কারো নেই। সাদিয়া এখন এই ঝামেলা থেকে মুক্ত। আনতানুনের ভালবাসার নেশা তাকে ভুলিয়ে রেখেছে যে, সে এক ব্যক্তিকে খুন করে এসেছে এবং লোকটা খৃস্টান। সে অত্যন্ত গর্বের সাথে আনতানুনকে এসংবাদটা দেয়ার জন্য উদগ্রীব যে, আমি আমার ইজ্জত রক্ষার্থে একজন খৃস্টানকে খুন করে এসেছি।
আনতানুন যেখানে থাকার কথা, সেখানে নেই। সাদিয়া ভাবে, সে এসে তাকে না পেয়ে ফিরে গেছে। সে বৃক্ষটার পিছনে গিয়ে দেখে রশিটা দেয়ালের বাইরে না ভিতরে। রশি দেয়ালের ভিতরে। তার অর্থ হচ্ছে, আনতানুন এসেছে। কিন্তু লোকটা গেল কোথায়! ফিরে গেলে তো রশি বাইরেই থাকত।
সাদিয়া ওখানেই দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটি ছায়া নড়াচড়া করছে দেখতে পায় সে। সাদিয়া গভীরভাবে লক্ষ করে। বোধ হয় চাকরানী হবে। সে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাক দেয়। ওদিক থেকেও ফিসফিস কণ্ঠে জবাব আসে। ও তার চাকরানী-ই। সে সাদিয়ার দিকে ছুটে এসে বলল- তাকে এখানে খুঁজে লাভ নেই। তিনি এসেছিলেন। আমি তার অপেক্ষায় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তাকে দেয়ালের উপর দেখেছি। তিনি রশিটা ভিতরে ছুঁড়ে ফেলে নামতে শুরু করেন। ওদিক থেকে দুজন লোক আসতে দেখলাম। তখন তিনি নীচে নামছিলেন। তোক দুজন নিকটে এসে পড়ে। আমি তাকে সতর্ক করার সুযোগ পাইনি। আমি আপনাকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু মেহমানদের মধ্যে আসরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সাদিয়ার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। তার মনে পড়ে যায়, সে একজন খৃস্টানকে হত্যা করে এসেছে। তার হুশ-জ্ঞান লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়। এটি আলফ লায়লার রহস্যময় ও তেলেসমাতি জগত, যা সাদিয়ার মত মেয়ের বোধগম্যের বাইরে। তাকে হেরেমের একটি মেয়ে সাবধানও করেছিল যে, একজন রক্ষীসেনার সঙ্গে এই প্রেমখেলা তোমার জন্য অকল্যাণ ডেকে আনবে।– একটি ভাবনা সাদিয়াকে অস্থির করে তুলতে শুরু করে যে, আনতানুনকে কে গ্রেফতার করাল? যে দুজন ব্যক্তি তাকে গ্রেফতার করল, তারা নিশ্চয় পূর্ব থেকেই জানত যে, আনতানুন এখানে আসবে। তারা বিষয়টা কিভাবে জানল? সাদিয়ার মনে আশংকা জাগতে শুরু করে, সেও গ্রেফতার হয়ে যাবে। চাকরানীর প্রতিও তার সন্দেহ জাগে যে, সেও গোয়েন্দাগিরি করতে পারে।
সাদিয়ার কিছুই বুঝে আসছে না। চাকরানীকে দিয়ে সে রশিটা খোলায় এবং লুকিয়ে ফেলতে বলে। তারপর চরম উৎকণ্ঠা ও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় সালার শামসুদ্দীন ও শাদবখত-এর উদ্দেশ্যে ছুটে যায়। নাচ-মদের আসর তখনো গরম। সাদিয়া শাদবখতকে পেয়ে যায়। আসরের অবস্থা দেখে তার মনে হল, খৃস্টান লোকটার খুন হওয়ার বিষয়টা এখনো কেউ টের পায়নি। সাদিয়া পা টিপে টিপে শাদবখত-এর নিকট চলে যায় এবং তাকে ইংগিতে ডাক দেয়। সাদিয়া তাকে আলাদা নিয়ে গিয়ে জানায়, আমি একজন খৃষ্টানকে খুন করে এসেছি। খুনের হেতুও জানায় সাদিয়া।
শাদবখত শংকিত হয়ে উঠেন যে, সাদিয়াকে খৃস্টান লোকটার সঙ্গে যেতে কেউ না কেউ নিশ্চয় দেখেছে! তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তিনি বললেন- তোমার আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। যদি তুমি গ্রেফতার হয়ে যাও, তাহলে গোমস্তগীন তোমার ন্যায় রূপসীকেও বন্দিশালায় কি দশা ঘটাবে, তা আমার অজানা নয়। একজন খৃস্টানের খুনী যদি তার পিতাও হন, তবুও তিনি তাকে সামান্য ছাড় দেবেন না। তিনি একজন খৃস্টান কমান্ডারের মৃত্যুর ভয়ানক প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।
আমি যাব কোথায়? সাদিয়া কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
কিছু সময় এখানে ঘোরাফেরা কর- শাদবখত বললেন- শামসুদ্দীন ভাই আসলে তার সঙ্গে কথা বলব।
তিনি কোথায় আছেন? সাদিয়া ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
কিছুক্ষণ আগে আমরা সংবাদ পেলাম, কে একজন রশি বেয়ে পিছনের দেয়াল অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। লোকটা কে এবং কী উদ্দেশ্যে ঢুকেছে, জানতে পারিনি। শামসুদ্দীন তাকে দেখতে এবং তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে না আসলে আমি নিজে যাব। তুমি মনটা শক্ত রাখ। আমরা তোমাকে যেভাবে হোক লুকিয়ে ফেলব। শাদবখত জবাব দেন।
সাদিয়া ভাবে, ধৃত লোকটা আনতানুন ছাড়া আর কেউ নয়। সে কিছুটা নিশ্চিত হয় যে, আনতানুনকে সালার শামসুদ্দীনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এবং তিনি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করবেন।
লোকটা আনতানুন-ই। দুজন সিপাহী তাকে গ্রেফতার করেছে। এ ধরনের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা শামসুদ্দীনের বিভাগের দায়িত্ব। তাই সংবাদটা তাকেই দেয়া হয়েছে যে, দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করা অবস্থায় এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শামসুদ্দীন আসর থেকে উঠে বাইরে গিয়ে দেখেন, ধৃত লোকটা আনতানুন। শামসুদ্দীন তাকে চিনেন না ভান ধরে জিজ্ঞেস করেন- তুমি সম্ভবত রক্ষী বাহিনীর জওয়ান। দেয়াল অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকলে কেন? সত্য সত্য বলে দাও; অন্যথায় মৃত্যুদন্ড হবে তোমার শাস্তি।
আনতানুন নীরব। শামসুদ্দীন তার প্রতি এ কারণে ক্ষুব্ধ যে, তিনি বলেছিলেন, সতর্ক থাকবে এবং আবেগকে কর্তব্যের উপর জয়ী হতে দেবে না।
কিন্তু আনতানুন সিনিয়রের এই নির্দেশনা মান্য করেনি। সে একদিকে যেমন যোগ্যতা দেখিয়েছে যে, এক চেষ্টায়-ই গোমস্তগীনের রক্ষী বাহিনীতে ঢুকে পড়েছে এবং পরক্ষণেই হেরেম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অপরদিকে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে অল্পতেই ধরা পড়ে গেল। আনতানুন যে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ল, একজন গুপ্তচরের জন্য তা গুরুতর অপরাধ। কিন্তু তাকে সেই অপরাধের শাস্তি এখন দেয়া যাবে না। এ মুহূর্তে তাকে এখান থেকে রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি সাদিয়াকেও এখান থেকে বের করতে হবে। কেননা, আনতানুন সাদিয়ার ডাকে এসেছে এবং সাদিয়া-ই রশি ঝুলানোর ব্যবস্থা করেছে, এ তথ্য ফাস হয়ে যেতে পারে।
শামসুদ্দীন সিপাহীদেরকে একটি জায়গার নাম উল্লেখ করে বললেন, আসামীকে ওখানে নিয়ে যাও; আমি ওকে কয়েদখানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। সিপাহীরা আলতানুনকে নিয়ে যায়। শামসুদ্দীন মহলের ভিতরে চলে যান। তিনি তার ভাই শামসুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেন।
আসরে নাচ-গান চলছে। মেহমানগণ চরম আনন্দ উপভোগ করছেন আর গায়ক-নর্তকীদের বাহবা দিচ্ছেন। মটকার পর মটকা মদ খালি হচ্ছে। মশালের কিরণ আর ফানুসের রং-বেরং আলো নর্তকীদের গায়ের মূল্যবান ফিনফিনে পোশাকে এমন চমক সৃষ্টি করছে যে, তা আলফ লায়লার যাদুকেও হার মানায়। সবাই অচেতন-মাতাল। খৃস্টান লোকটার মৃতদেহটা ওখানে-ই পড়ে আছে। এমনি তেলেসমাতি পরিবেশে শামসুদ্দীন ও শাদবখতের মাঝে আনতানুন ও সাদিয়ার প্রসঙ্গে কথোপকথন হয়। শাদবখত শামসুদ্দীনকে অবহিত করেন, সাদিয়া এক খৃস্টান মেহমানকে খুন করে ফেলেছে।
তারা সাদিয়াকে তাদের কক্ষে নিয়ে যায় এবং বেশ-ভূষা পরিবর্তন করে সেখান থেকে পালাবার কৌশল শিখিয়ে দেয়। সাদিয়া পরিকল্পনা মোতাবেক ধীর পায়ে মহল থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর দারোয়ান এসে শামসুদ্দীনকে সংবাদ জানায়, বাইরে অমুক কমান্ডার দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আপনাকে ডাকছেন। শামসুদ্দীন বাইরে চলে যায়। ভীত-সন্ত্রস্ত এক কমান্ডার দন্ডায়মান। সে রিপোর্ট দেয়- আনতানুন নামক যে রক্ষীসেনাকে দেয়াল ডিঙ্গানো অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে, সে পালিয়ে গেছে।
কী বললে?- আগুনের মত গরম হয়ে যান শামসুদ্দীন- সিপাহী দুটা কি মরে গিয়েছিল?
মনে হচ্ছে, কাজটা একা আনতানুনের নয়- অনেক লোকের- কমান্ডার বলল- সিপাহী দুজন সেখানে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে।
শামসুদ্দীন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সিপাহীদ্বয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে। তারা জানায়, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে পিছন দিক থেকে কে যেন আমাদের মাথায় একটি করে আঘাত হানে। আমরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
শামসুদ্দীন দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দেন। ঠিক সে সময়ে আপাদমস্তক কালো রেশমী চাদরে আবৃত- যার দুটি চোখ ছাড়া আর কোন অংশ দেখা যায় না–গোমস্তগীনের বাসভবন থেকে প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায়। সে রাতে মেহমানদের আসা-যাওয়া অব্যাহত ছিল। আপাদমস্তক পোশাকাবৃত করে বের হওয়া লোকটা কে, দারোয়ান ও রক্ষীসেনারা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনই অনুভব করল না।
মধ্যরাতের পর যখন আসর ভাঙ্গে, তখন দুর্গের দরজা খুলে যায়। ঘোড়া ও ঘোটকযান ফটক অতিক্রম করতে শুরু করে। এক অশ্বারোহী ফটক অতিক্রম করে, যার মুখটা নেকাবে ঢাকা। তার সঙ্গে অপর একটি ঘোড়ায় সেই চাঁদরাবৃতা মহিলা, যে গোমস্তগীনের বাসভবন থেকে একাকী বেরিয়ে এসেছিল।
ব্যবস্থাটা শামসুদ্দীন ও শাদবখতের। শামসুদ্দীন উক্ত সিপাহীদ্বয়কে একটি জায়গার নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, আনতানুনকে ওখানে নিয়ে গিয়ে আমার অপেক্ষা কর। অপরদিকে তিনি তার বডিগার্ডকে বলে দিলেন, তুমি আনতানুনকে মুক্ত করে আমার কক্ষে লুকিয়ে রাখ। আগেই বলেছি, শামসুদ্দীন ও শাদবখতের বডিগার্ড, দুজন আরদালী ও দুজন চাকর সুলতান আইউবীর কমান্ডো গোয়েন্দা। তারা যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং আনতানুনকে মুক্ত করে ফেলে। ওদিক থেকে সাদিয়াও সাফল্যের সাথে বেরিয়ে শামসুদ্দীনের ঘরে চলে যায়। সেখানে আয়োজন পূর্ব থেকেই সম্পন্ন করা ছিল। মেহমানরা যখন বের হতে শুরু করে, তখন তাদেরকে দুটি ঘোড়া দিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয়া হল।
নাচ-গান আর মদ-নারীতে রাতটা কেটে যায়। পরদিন সকালে খৃস্টান লোকটার লাশ চোখে পড়ে। গোমস্তগীনের মহলের একটি মেয়েও নিখোঁজ। গোমস্তগীন নির্দেশ দেন, যে দুজন সিপাহীর প্রহরা থেকে আনতানুন পালিয়েছে, তাদেরকে আজীবনের জন্য কয়েদখানায় নিক্ষেপ কর।
***
আনতানুন ও সাদিয়ার পলায়নের কথা ভুলে গেছে সবাই। গোমস্তগীনের খৃস্টান বন্ধুরা তাদের একজন কমান্ডারের খুনের ঘটনায় তোলপাড় শুরু করে দেয়। তাদের মূলত একজন সহকর্মীর মৃত্যুতে ততটা দুঃখ নেই, যতটা তারা হুলস্থুল সৃষ্টি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হল, অসন্তোষ প্রকাশ করে গোমস্তগীন থেকে আরো সুবিধা আদায় করা এবং অতিশীঘ্র সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করার জন্য গোমস্তগীনকে ক্ষেপিয়ে তোলা। খৃস্টানরা জানে, মুসলমানদের হেরেমগুলোতে এমন ড্রামা খেলা হয়ে থাকে, যাতে একটা মেয়ে অপহৃতও হয়, স্বেচ্ছায় উধাও হয়ে যায় এবং দু-একটা খুনের ঘটনাও ঘটে থাকে। তারা গোমস্তগীনকে অসহায় করে ফেলতে চাইছে, যাতে তিনি তাদের কাছে সম্পূর্ণরূপে নতি স্বীকার করেন। মানুষ যার প্রতি সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করে, তার দাম বেড়ে যায় এবং সাহায্য প্রার্থনাকারীর অসহায়ত্বের সুযোগে নিজের সব শর্ত আদায় করে নেয়ার এবং অসহায়কে গোলামে পরিণত করার চেষ্টা করে। খৃস্টানরাও সেই একই নীতি অবলম্বন করছে।
ঘটনাটা গোপন রাখা গেল না। হাল্ব পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সংবাদ। সেখানকার দরবারীগণ্যারা সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত গোমস্তগীনকে তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। আল-মালিকুস সালিহ-এর পক্ষ থেকে তারা গোমস্তগীনের নিকট দূত প্রেরণ করে। সঙ্গে রীতি অনুযায়ী মূল্যবান উপটোকনও পাঠায়। উপহারের মধ্যে আছে দুটি যুবতী মেয়ে।
গোমস্তগীন বিশ্রাম করছিলেন। দূত এবং মেয়ে দুটোকে শামসুদ্দীনের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। গোমস্তগীনের পর সালার শামসুদ্দীন-ই রাষ্ট্রীয় কাজ দেখা শুনা করে থাকেন। শামসুদ্দীন মেয়েগুলোকে তার ঘরে আলাদা বসিয়ে রেখে দূতকে জিজ্ঞেস করেন- বল, কী বার্তা নিয়ে এসেছ?
দূত যে দীর্ঘ বার্তা নিয়ে আসে, তার সারমর্ম হল, সুলতান আইউবী হাব অবরোধ করার পর সম্রাট রেমন্ড বাহিনী নিয়ে আসেন। ফলে আইউবী অবরোধ তুলে নেন। কিন্তু রেমন্ড যুদ্ধ না করেই বাহিনী নিয়ে ফিরে যান। খৃস্টানরা ভবিষ্যতেও আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবে। আমরা যদি এভাবে আলাদা আলাদাভাবে আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করি, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই পরাজিত হব। আইউবীকে চিরতরে খতম করার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা একান্ত আবশ্যক।
বার্তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করার একটি পরিকল্পনাও ছিল। তা এরকম
আলরিস্তানের পাহাড়ে বরফ গলতে শুরু করেছে। আমরা গুপ্তচর মারফত জানতে পেরেছি, সুলতান আইউবীর সৈন্যরা পাহাড়ের উঁচুতে অবস্থান করতে পারছে না। কারণ, সেখানে গলিত বরফের পানি তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আমাদের জন্য এটি মোক্ষম সুযোগ। আমরা সব দল যদি একত্রিত হয়ে আইউবীর বাহিনীকে ঘিরে ফেলি, তাহলে অতি সূহজেই তাকে পরাজিত করতে পারব।
পরিকল্পনায় এ-ও ছিল যে, খৃস্টান সম্রাট রেজিনাকে আমাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে নিতে হবে। তা এভাবে যে, আপনি (গোমস্তগীন) তাকে পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করুন এবং যে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আপনি তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন, সেকথা স্মরণ করিয়ে দিন।
শামসুদ্দীন পয়গামটা শাদবখতের কানে দেন। দুভাই বসে মতবিনিময় করেন। তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বার্তাটি গোমস্তগীনকে জানতে দেয়া যাবে না। আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, গোমস্তগীন সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াইটা যেন একাকী করেন। তাহলে তার পরাজয় সহজতর হবে। তারা জানতেন, আইউবীর সৈন্যসংখ্যা কম। তা দিয়ে তিনি গাদ্দার মুসলিম শাসনকর্তাদের আলাদা আলাদাভাবে খতম করতে পারবেন।
শামসুদ্দীন ও শাদবখত নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রাখার ব্যাপারে পুরোপুরি সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কিন্তু এ মুহূর্তে তারা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাদের আবেগকে উস্কে দিয়েছে উপহার হিসেবে আসা মেয়ে দুটো। তারা মেয়েদেরকে তাদের ধর্মপরিচয় জিজ্ঞেস করেন। জবাবে তারা জানায়, আমরা মুসলমান। বয়সে তারা যুবতী। শামসুদ্দীন ও শাদবখতের মনে অনুশোচনা জাগে, একদিকে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে এই দুর্বলতা সৃষ্টি করে নিয়েছে যে, তারা সুন্দরী মেয়েদের বিনিময়ে ঈমান বিকিয়ে ফেলছে। অপরদিকে যেখানে মুসলিম মেয়েদের সম্ভ্রান্ত পরিবারের শোভা বর্ধন করার কথা, সেখানে তাদেরকে তাদের-ই বাবা-মা আমীরদের হেরেমে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
তোমরা কোথাকার বাসিন্দা এবং এদের হাতে পড়লে কিভাবে?- শাদবখত জিজ্ঞেস করেন- তোমাদের পিতারা কি জীবিত? ভাই আছে?
এসব প্রশ্নের জবাবে মেয়েরা যা বলল, তাতেই শামসুদ্দীন ও শাদবখতের চেতনা ক্ষেপে ওঠে। যেসব অঞ্চলে খৃস্টানদের কর্তৃত্ব চলছে, সেসব এলাকার মুসলমানদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। একজন মুসলমানের ইজ্জতেরও কোন নিরাপত্তা ছিল না। ফলে সেসব মুসলমান বাসিন্দারা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হলে দলবদ্ধভাবে চলত। কাফেলায় মেয়েরাও থাকত এবং মাল-সম্পদও থাকত। অপরদিকে খৃস্টানরা কাফেলা লুট করার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকত। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, কোন কোন খৃস্টান ম্রাট- যারা মধ্যপ্রাচ্যের কোন না কোন অঞ্চল শাসন করতেন সেনাবাহিনী দ্বারা মুসলমানদের কাফেলা লুণ্ঠন করাত। লুটেরারা যুবতী মেয়ে, পশুপাল ও অর্থ-সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যেত। তারা মেয়েদেরকে বাজারে নিয়ে বিক্রি করত কিংবা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মুসলিম আমীরদের হাতে তুলে দিত। কিছু কিছু মেয়েকে খৃস্টানরা নিজেদের কাছে রেখে দিত এবং তাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তি ও চরিত্র বিধ্বংসী কাজের জন্য গড়ে তুলত। তাদেরকে তারা মুসলমানদের এলাকায় ব্যবহার করত।
এই মেয়ে দুটোকেও একটি কাফেলা থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। তখন তাদের বয়স ছিল তের-চৌদ্দ বৎসর। তারা ফিলিস্তীনের কোন এক অধিকৃত অঞ্চল থেকে পরিবারের সঙ্গে কোন নিরাপদ এলাকার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। কাফেলাটা ছিল বিশাল। খৃস্টান দস্যুরা রাতের বেলা কাফেলার উপর হামলা চালায় এবং অনেকগুলো মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। এরা দুজন অস্বাভাবিক। সুন্দরী ছিল বিধায় এদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে বিশেষ যত্নে লালন পালন করতে শুরু করে। প্রথম দিকে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হলেও পরে তাদের সঙ্গে এমন সদ্ব্যবহার শুরু হয়, যেন তারা রাজকন্যা। আসলেই তাদেরকে রাজকন্যা রূপে গড়ে তোলা হয়েছিল। তাদেরকে মদপানে অভ্যস্ত করে তোলা হয় এবং অত্যন্ত উন্নত পন্থায় তাদের চিন্তা-চেতনাকে খৃস্টানদের ধাঁচে গড়ে তোলা হয়। চারু-পাঁচ বছর পর যখন সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মৃত্যুবরণ করেন, তখন এদেরকে খৃস্টানদের পক্ষ থেকে উপহারস্বরূপ দামেস্ক প্রেরণ করা হয়। উদ্দেশ্য, খলীফা আল-মালিকুস সালিহ ও তার আমীরদেরকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে এবং নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা।
মেয়েরা জানায়, —
আমাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে ধর্ম ও চরিত্র বের করে দেয়া হয়েছিল। আমরা এক একটি সুদর্শন খেলনায় পরিণত হয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমাদেরকে দামেস্ক পাঠানো হল, তখন আমাদের মস্তিষ্কে ধর্ম ও সচ্চরিত্রতা পুনরায় জেগে ওঠে। আমাদের রক্তে যে ইসলামী ঐতিহ্য ছিল, তা ফিরে এসে আমাদের আত্মাকে জাগ্রত করে। তখন আর আমাদের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের ফিরে পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা মুসলিম শাসনকর্তা ও রাজা-বাদশাহদেরকে পিতা ও ভাই হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের একজনও আমাদেরকে কন্যা কিংবা বোনের চোখে দেখেনি। খৃস্টানদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে আমরা ততটুকু কষ্ট পায়নি, যতটুকু কষ্ট এই মুসলিম ভাইদের নিকট এসে পেয়েছি। কারণ, খৃস্টানরা আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তা প্রত্যাশার বাইরে ছিল না। কিন্তু খৃস্টানরা আমাদেরকে যে মুসলমানদের নিকট প্রেরণ করেছিল, আমরা তাদের হাতে ধরেছি পায়ে ধরেছি। ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূলের দোহাই দিয়েছি যে, আমরা আপনাদের কন্যা। আমরা নির্যাতিতা। আমরা আপনাদের মর্যাদার প্রতীক। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। মদ ও শয়তান তাদের চোখে চাঁদ-তারা আর ক্রুশের মাঝে কোন ব্যবধান থাকতে দেয়নি…।
আমাদের ভিতরে প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে ওঠে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দামেস্ক আগমনের সংবাদ শুনে আমরা অত্যন্ত আনন্দি হই। খৃস্টানদের এলাকায় মুসলমানরা সুলতান আইউবীর পথপানে চেয়ে আছে। আইউবীকে তারা ইমাম মাহদী মনে করে। তিনি যখন দামেস্ক আসেন, তখন আমরা প্রতিজ্ঞা নেই, যেভাবে হোক, আমরা তাঁর নিকট যাব। তাঁকে বলব, আপনি আমাদেরকে আপনার ফৌজে রেখে দিন এবং আমাদের কিছু একটা কাজ দিন। কিন্তু আমাদেরকে সেখান থেকে জোরপূর্বক হাব নিয়ে আসা হল। এখন আমরা আপনাদের হাতে। আমরা আপনাদের নিকট এই প্রত্যাশা রাখতে পারছি না, আপনারা আমাদেরকে কন্যা হিসেবে বরণ করে নেবেন। তবে আমরা এটুকু অবশ্যই বলব যে, আমাদের সম্ভ্রম তো ছিন্নভিন্ন, ঈমানটুকু যেন নষ্ট না হয়।
আমরা যখন খৃস্টানদের নিকট ছিলাম, সেখানেও সুলতান আইউবী ও ইসলাম বিরোধী পরিকল্পনা হতে দেখেছি, তেমনি যখন মুসলমানদের নিকট ছিলাম, তখনও আইউবী বিরোধী তৎপরাত-ই দেখেছি। এখন আপনাদের পরীক্ষা নেয়ার পালা। আমরা শুনেছি, খৃস্টান মেয়েরা এখানে গুপ্তচরবৃত্তি করতে আসে। আপনারা আমাদেরকে খৃস্টানদের এলাকায় পাঠিয়ে দিন। আমাদের এ ভয় তো নেই যে, আমাদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হবে। তাতে লুট হয়েই গেছে। আপনারা আমাদেরকে ইসলামের সুরক্ষা ও প্রসারের জন্য সুযোগ দিন।
মেয়ে দুটোর উপাখ্যান ও জীবন কাহিনী সালার শামসুদ্দীন ও সাদবখতকে চরম প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। তাদের আবেগ ও চেতনায় প্রচন্ড একটা ধাক্কা দেয়। সব শুনে তারা মেয়েদেরকে বললেন, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক, এখন আর তোমাদেরকে কোন বিলাস পুজারী দুশ্চরিত্র শাসকের হাতে তুলে দেয়া হবে না।
***
শামসুদ্দীন ও শাদবখত বসে কথা বলছেন। হঠাৎ এক দেহরক্ষী ভিতরে প্রবেশ করে বলল, কাজী সাহেব এসেছেন। দুভাই অভ্যর্থনা কক্ষে চলে যান। কাজী সাহেব ইবনুল খাশিব আবুল ফজল বসে আছেন। লোকটা মধ্যবয়সী। তিনি বললেন- শুনেছি, হাল্ব থেকে দূত এসেছে এবং পয়গামের সঙ্গে উপহারও এসেছে।
হ্যাঁ- শাদবখত বললেন- দুর্গপতি ঘুমিয়ে আছেন বলে দূতকে আমাদের কাছে বসিয়ে রেখেছি।
আমি উপহার দুটো দেখতে এসেছি- ইবনুল খাশিব চোখ টিপে বললেন তাদেরকে এক ঝলক দেখাও তাড়াতাড়ি।
কাজী সাহেব কেমন চরিত্রের মানুষ দুভাইয়ের জানা আছে। লোকটা গোমস্তগীনকে মুঠোর মধ্যে রেখেছে। শামসুদ্দনি মেয়ে দুটোকে অভ্যর্থনা কক্ষে ডেকে পাঠান। তাদেরকে দেখে কাজী সাহেবের চোখ আটকে যায়। তিনি বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বললেন- শাবাশ! …এত রূপ!
শামসুদ্দীন এক ঝলক দেখিয়েই মেয়ে দুটোকে কক্ষে পাঠিয়ে দেন। কাজী সাহেব বললেন- এদেরকে আমার হাতে তুলে দাও। আমি নিজে এদেরকে দুর্গপতির নিকট নিয়ে যাব। মনে হচ্ছে, যেন তার দুচোখ থেকে দুটি শয়তান উঁকি মারছে।
আপনি একজন বিচারক- শামসুদ্দীন বললেন- জাতির নিকট আপনার মর্যাদা গোমস্তগীনের চেয়েও উচ্চে। মানুষের ন্যায় বিচার আপনার হাতে।
কাজী সাহেব খিলখিল করে হেসে ফেললেন এবং বললেন- তোমরা সৈনিকরা আসলেই বোকা হয়ে থাক। নাগরিক জীবনের ব্যাপার-স্যাপার তোমরা কিছু বুঝ না। আরে, যে কাজির হাতে আল্লাহর আইন ও আদল ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হত, সেই কাজী মারা গেছেন। তিনি শাসনকর্তাকে নয় আল্লাহকে ভয় করতেন। শাসনকর্তা বরং তার ভয়ে মানুষের উপর অবিচার করা থেকে বিরত থাকতেন। এখন শাসনকর্তারা সেই ব্যক্তিদেরকে কাজী নিয়োগ করছেন, যারা অবিচারকে বৈধ সাব্যস্ত করেন এবং সংবিধানকে নয় শাসককে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে থাকেন। আমি আমার আল্লাহর নয় শাসনকর্তার কাজী।
আর তারই ফলে কাফেররা তোমাদের হৃদয়ের উপর জেঁকে বসেছে শাদবখত বললেন- ঈমান নীলামকারী শাসকের কাজী ঈমান নীলামকারীই হয়ে থাকে। তোমাদের ন্যায় বিচারকগণ-ই আল্লাহর রাসূলের উম্মতকে এই অধঃপাতে নামিয়ে এনেছে যে, আমাদের আমীর-শাসকগণ আপন কন্যাদের সম্ভ্রম নিয়ে পর্যন্ত তামাশা করছে। এরা আপনার মুসলিম কন্যা, যাদেরকে আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন।
গোমস্তগীনের এই কাজীটার উপর শয়তান এমনভারে জেঁকে বসেছে যে, তিনি শামসুদ্দীন ও শাদবখতের বক্তব্যকে ক্রিপে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন এবং হেসে বললেন- আসলে হিন্দুস্তানী মুসলমানরা হৃদয়মরা মানুষ। আচ্ছা, তোমরা হিন্দুস্তান থেকে এদেশে কেন এসেছ?
মন দিয়ে শোন বন্ধু!- শামসুদ্দীন বললেন- আমি তোমাকে শুধু এ কারণে শ্রদ্ধা করি যে, তুমি বিচারক। অন্যথায় তোমার আসল পরিচয় তো আমার জানা আছে। তুমি আমার একজন অধীন কমান্ডার ছিলে। তুমি এই পদমর্যাদা অর্জন করেছ তোষামোদ আর চাটুকারিতার বলে। তোমার আত্মমর্যাদাকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে আমরা হিন্দুস্তান থেকে কেন এসেছি, তার হেতু বলছি। ছয়শত বছর আগের কথা। মোহাম্মদ বিন কাসিম নামক এক যুবক সেনাপতি একটি নির্যাতিত মেয়ের আর্তনাদে সাড়া দিয়ে এই ভূখণ্ড থেকে হিন্দুস্তান গিয়ে হামলা করেছিলেন। তুমি তো জান, এখান থেকে হিন্দুস্তানের দূরত্ব কতটুকু। তুমি কি অনুমান করতে পারছ, যুবকটি তার বাহিনীকে কিভাবে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন? তুমি নিজেও একজন সৈনিক। লোকটা এত দূরত্ব পথ অতিক্রম করে রসদ ও পিছনের সাহায্যপ্রাপ্তির আশা ব্যতীত কিভাবে যুদ্ধ করল, তুমি তো তা বুঝ। আবেগের জগত থেকে বেরিয়ে বাস্তবতা একটু ভেবে দেখ…।
মোহাম্মদ বিন কাসিম এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বিজয় অর্জন করলেন যে, ঐ পরিস্থিতিতে তার পরাজয় বরণ করার সম্ভাবনাই ছিল বেশী। তিনি শুধু রাজ্য জয়-ই করেননি, হিন্দুস্তানীদের হৃদয়গুলোও জয় করে নিলেন এবং কোন জুলুম নির্যাতন ছাড়া সেই কুফরের মাটিতে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করলেন। তারপর একদিন তিনি মারা গেলেন। যে লোকগুলো এত পথ অতিক্রম করে একটি মেয়ের ইজ্জতের প্রতিশোধ নিলেন এবং ইসলামের আলো ছড়ালেন, তারা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। দেশটা এমন রাজা-বাদশাহদের হাতে চলে যায়, যারা মুজাহিদদের কাফেলায় ছিল-ই না। বিনা মূল্যে প্রাপ্ত দেশটায় তারাও সেসব কর্মকান্ড করতে শুরু করল, যা আজ এখানে চলছে। হিন্দুরা সে দেশের মুসলমানদের উপর জয়ী হতে শুরু করল, যেমন এদেশে খৃস্টানরা জয়ী হচ্ছে। সালতানাতে ইসলামিয়া নিঃশেষ হতে শুরু করল। আমরা যৌবনে পদার্পন করে দেখি, মোহাম্মদ বিন কাসিম ও তার যোদ্ধারা রক্ত দ্বারা যে রাজ্যটিকে জয় করেছিলেন, তার গোড়া শুকিয়ে গেছে। মুসলমান শাসকগণ আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে। আমরা দুভাই- যাদের বংশ লড়াকু বংশ বলে খ্যাত- নিরাশ হয়ে দেশ ছেড়ে এদেশে চলে এসেছি। আমরা ভারতীয় মুসলমানদের দূত হয়ে এসেছি। ছিন্ন সম্পর্ক জুড়তে এসেছি…।
এসে আমরা সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি বললেন, কিভাবে আমি ভারতবর্ষের কথা ভাবতে পারি! কিভাবে আমি ভারত অভিযানের চিন্তা করতে পারি! আমার গোটা আরব ভূখন্ড গাদ্দারদের দ্বারা পরিপূর্ণ!
মরহুম জঙ্গী দূরের কোন অভিযানে এ কারণে যেতেন না যে, তার অবর্তমানে এখানে বিদ্রোহ ঘটে যাবে, যার দ্বারা উপকৃত হবে খৃস্টানরা। তিনি বললেন, আমার বড় আফসোস হয়, ভারতবর্ষে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর জয়ী হচ্ছে আর এখানে জয়ী হচ্ছে খৃস্টানরা!
সুলতান জঙ্গী আমাদেরকে তার বাহিনীতে ভর্তি করে নেন। পরে গোমস্তগীন, সাইফুদ্দীন ও ইজুদ্দীন প্রমুখ যখন গোপনে গোপনে খৃস্টানদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে শুরু করেন, তখন জঙ্গী আমাদেরকে এ লক্ষ্যে গোমস্তগীনের বাহিনীতে প্রেরণ করেন, যেন আমরা তার গোপন তৎপরতার প্রতি নজর রাখি।
তার মানে তোমরা দুজন গুপ্তচর। তিরস্কারের সুরে কাজী ইবনুল খাশিব বললেন।
তুমি আমার বক্তব্য বুঝবার চেষ্টা কর- শামসুদ্দীন বললেন- তুমি তো দেখছ, আমাদের মুসলিম আমীরগণ সেই মর্দে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যার লক্ষ্য ইসলামকে ক্রুশের হাত থেকে রক্ষা করা। আজকের দূত অত্যন্ত বিপজ্জনক বার্তা নিয়ে এসেছে। শামসুদ্দীন বার্তাটি শুনিয়ে বললেন গোমস্তগীনের উপর তোমার প্রভাব আছে। তুমি তাকে ঠেকাতে পার। তুমি যদি আমাদের মতে একমত হও, তাহলে এস, আমরা গোমস্তগীনকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে, আপনি গাদ্দারদের সঙ্গে ঐক্য গড়ার পরিবর্তে সুলতান আইউবীর সঙ্গে যোগ দিন। অন্যথায় তিনি এমন শোচনীয় পরাজয়বরণ করবেন যে, তাকে আজীবন কয়েদখানায় কাটাতে হবে।
তার আগে আমি তোমাদেরকে কয়েদখানায় আবদ্ধ করার ব্যবস্থা করছি ইবনুল খাশিব বললেন- মেয়ে দুটোকে আমার হাতে তুলে দাও।
ইবনুল খাশিব বসা থেকে ওঠে মেয়েরা যে কক্ষে অবস্থান করছে, সেই কক্ষের দিকে পা বাড়ায়। শাদবখত তারা বাহু ধরে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে আসেন। বললেন- কোথায় যাচ্ছেন? ইবনুল খাশিব শাদবখতকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেন। শাদবখত তার মুখের উপর সজোরে এক ঘুষি মারেন যে, ইবনুল খাশিস পেছন দিকে চীৎ হয়ে পড়ে যান। শামসুদ্দীন কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে ইবনুল খাশিরের ধমনীতে পা রেখে এমনভাবে চেপে ধরেন যে, লোকটা কিছুক্ষণ ছটফট করে নির্জীব হয়ে যান।
ইবনুল খাশিব মারা গেলেন। তাকে হত্যা করা দুভাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা ভাবলেন, এবার আমাদের ধরা পড়া নিশ্চিত। তারা তাদের আরদালী দুজনকে ডেকে চারটি ঘোড়া প্রস্তুত করতে বললেন। ঘোড়া প্রস্তুত হয়ে গেল। শামসুদ্দীন ও শাদবখত মেয়ে দুটোকে দুটি ঘোড়ায় বসিয়ে দেন। আরদালীদেরকে তরবারী ও তীর-ধনুক দিয়ে অপর ঘোড়ায় সাওয়ার হতে বললেন। তারা সঙ্গে গিয়ে দুর্গের ফটক খুলিয়ে চারজনকে পালিয়ে যেতে বললেন। তাদেরকে বলে দেয়া হল, তোমরা সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে যাবে। তারা আরদালীদেরকে গোমস্তগীনের পরিকল্পনাটা বিস্তারিত বলে দেন।
চারটি ঘোড়া ফটক অতিক্রম করেই ছুটে চলে। শামসুদ্দীন এবং শাদবখতেরও বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কি যেন ভেবে তারা ফিরে আসেন।
গোমস্তগীন ঘুম থেকে জেগে বেরিয়ে এসেছেন। দূতকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে এবং কোথা থেকে এসেছ? দূত তার পরিচয় প্রদান করে। দূত উপহারস্বরূপ নিয়ে আসা মেয়ে দুটোর কথাও বলল। কিন্তু গোমস্তগীন মেয়েদেরকে দেখতে পেলেন না। শামসুদ্দীন ও শাদবখত বললেন- তারা চলে গেছে। কারণ, তারা মুসলমান। যেখানে তাদের ইজ্জত নিরাপদ থাকবে, আমরা তাদেরকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা গোমস্তগীনকে জানালেন, কাজী সাহেবের লাশ ভিতরে পড়ে আছে।
গোমস্তগীন লাশটা দেখলেন। তিনি জ্বলে ওঠলেন। সালার শামসুদ্দীন আলী ও শাদবখত আলীকে বন্দী করে ফেললেন।
চারজন অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উদ্দেশ্যে ছুটে চলছে। সুলতান আইউবী আলরিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় বসে হাসান বিন আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করছেন- শামসুদ্দীন ও শাদবখতের পক্ষ থেকে কোন সংবাদ এসেছে কি?