২৩. প্রথম মোঘল নৃপতি
সূর্যের আলোর ধাতব দীপ্তি বাবরের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। বৃষ্টিহীন শুষ্ক ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে যেখানে ঝোপঝাড়ের উপরে ধূলোর ভারী প্রলেপ পড়ে আছে। বাবর তার চারপাশে চার অশ্বারোহীর হাতে ধরা সোনালী দণ্ডের উপরে স্থাপিত হলুদ আর সবুজ জরির কাজ করা শামিয়ানার ছায়ার জন্য সে, কৃতজ্ঞ বোধ করে। একটা তীব্র বাতাস মাটি থেকে চাবকে ধূলো তুলে- সে ইতিমধ্যে জেনেছে তার নতুন প্রজারা একে আন্ধি বলে আর এর মানে বৃষ্টি হতে বেশি দেরি নেই।
পানিপথের যুদ্ধ সমাপ্ত হবার সাথে সাথে, বাবর হমায়ুন আর তার চার সেনাপতিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র রেখে নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে দ্রুত গতিতে ইবরাহিমের আগ্রায় অবস্থিত রাজধানী অভিমুখে পাঠিয়ে দিয়েছে। শহরটা যমুনার তীরে দিল্লী থেকে একশ বিশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সেখানে অবস্থিত সেনাবাহিনী নিজেদের সংঘটিত করার আগেই দূর্গ আর রাজকোষ দখল করতে। এখন তিন দিন পরে, বাবর তার বিজয়ী বাহিনী নিয়ে দিল্লীর দক্ষিণে রওয়ানা দিয়েছে। সবশেষে, ধূলোর মেঘের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে। রয়েছে রণহস্তীর দল- এখনও লাল রঙে রঞ্জিত- তার লোকজন যুদ্ধ শেষে প্রাণীগুলোকে আটক করেছে।
বাবরের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ বাবুরীর মৃত্যুতে অনেকটাই মলিন হয়ে গিয়েছে। তার। মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে সে নিজের তাঁবুতে ফিরে গিয়ে একাকী বসেছিলো। হিন্দুস্তানের নতুন সম্রাট হিসাবে কারো সাথে দেখা করতে বা কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে সে অপারগতা প্রকাশ করে। বাবুরীর মৃত্যুতে সে কেবল একজন ভালো বন্ধুকেই হারায়নি- তার মনে হচ্ছে একটা যাপিত জীবনের যেনো সমাপ্তি ঘটেছে। সে আর কখনও কখনও তার মতো বন্ধু পাবে না যে তার যৌবনের সহচর, আর ভাগ্য বিড়ম্বনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশীদার ছিলো।
বাবুরীর সাথে যখন তার প্রথম দেখা হয় তখন তার নিজের বয়স বিশ বছরও হয়নি। ফারগানার একটা ছোট অংশের শাসক, সুলতানের চেয়ে যার সাথে যুদ্ধবাজ সর্দারের মিল বেশি। এখন সে সন্তানের পিতা আর এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট। যাকে সবসময়ে নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং অন্যদের সাথে তার সামাজিক মর্যাদা যাই হোক সবসময়ে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখন। থেকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হবে তার সন্তানেরা। সে তাদের খুবই ভালোবাসে, কিন্তু বাবুরীর মতো সম্পর্ক তাদের সাথে হবে না। তাদের ভিতরে বয়স আর অভিজ্ঞতার পার্থক্য। তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আর সন্তানোচিত আনুগত্য। আর সেই সাথে তাদের আগলে রাখার জন্য তার অনবদ্য প্রয়াস এবং কিভাবে জীবনযাপন আর শাসন করতে হবে সেসব তাদের শিক্ষাদানের প্রয়াস এসবই তাদের সম্পর্কের ভিতরে অমোঘভাবে অবস্থান করবে। তারা কখনও তার বিরোধিতা করতে বা তাকে তাচ্ছিল্য করার তার সাথে রসিকতা করার সাহস পাবে না- যা বাবুরী প্রায়ই করতো…
বাবরের মনে সহস্র ভাবনা, অনুভূতি আর কল্পনার বেনোজলে প্লাবিত হয়ে উঠে। বাবুরীর কাটা কাটা চেহারা আর তীব্র নীল চোখ প্রথমবার দেখার সময় যখন সে বাবরের ধাবমান ঘোড়ার খুরে পিষ্ট হবার হাত থেকে একটা বাচ্চাছেলেকে বাঁচাতে লাফ দিয়েছিলো; বাবুরীর প্রথমবার ঘোড়ায় চড়ার চেষ্টা; তাদের যৌবনের প্রথম স্বাধীনতা; ফারগানার বেশ্যালয়ে তাদের বুনো মাতাল রাত কাটানো; বন্ধুত্ব আর সাহচর্যে কাটানো এতগুলো বছর। তাঁবুর ভেতরে শীতের বাতাসের তীব্রতার হাত থেকে বাঁচার জন্য পরস্পরকে জড়িয়ে থাকা, যুদ্ধ আর অভিযানের স্মৃতি যার কোনোটা সাফল্যমণ্ডিত আবার কোনোটা…
এসব ঘটনা এমন একটা প্রেক্ষাপটে ঘটেছে বাবুরী আর তার সেটা জন্মভূমি, শীতল, চঞ্চল, সর্পিল নদী, পরস্পরকে জড়িয়ে থাকা পাহাড়ের সারি, তীক্ষ্ণ-পার্শ্বদেশযুক্ত উপত্যকা এবং অবারিত সমভূমির দেশ। যেখানের বাতাস গ্রীষ্মকালে লবঙ্গের গন্ধ ভাসে আর শীতের সময়ে জমে ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে থাকে। সবুজ আর ফিরোজা মিনার এবং গম্বুজে সমৃদ্ধ শহর। প্রাচীন মাদ্রাসা আর পাঠাগার যেখানে তৈমূরীয় রীতি সবাই বোঝে, আর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এখন বন্ধুহীন অবস্থায় বাবর এমন একটা নতুন জায়গায় উপস্থিত হয়েছে, যেখানে তাকে কেউ চেনে না। আর সেও এখানকার রীতিনীতি কিছুই বোঝে না। কেবল একটা বিষয়েই সে নিশ্চিত যে, এখানকার আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি। ঘামে মুখ সবসময়ে ভিজে থাকছে, আর ভারী বাতাসে শ্বাস নেয়াটাই একটা কষ্টসাধ্য প্রয়াস। তার পালকশোভিত পাগড়ীর নিচে মাথা দপদপ করে।
তারা এগিয়ে যাবার সময়ে অন্তত আর কোনো বিরূপতার মোকাবেলা করতে হয় না। মাঝে মাঝে বাবর তার অশ্বারোহী বাহিনী আর মালবাহী গাড়ির বিশাল বহর এগিয়ে চলার সময়ে দূরে ছোট ছোট দলকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এখন চোখের উপরে হাত দিয়ে তারা যে চওড়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তার একপাশে মাটির তৈরি বাড়িঘর দেখতে পায়। সূর্যের আলোয় গোবরের স্তূপ পড়ে আছে। লোমহীন, হাড্ডিসার কুকুরের দল সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে বিশ্রাম করছে। এবং হাড্ডিসার মুরগীর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িগুলোতে বা আশেপাশের মাঠে কোনো লোকজন দেখা যায় না। সেখানে কেবল সরু পায়ের সাদা সারসের দলকে মহিষের পিঠ থেকে হলুদ ঠোঁট দিয়ে পোকামাকড় খুঁটে খেতে দেখা যায়।
আপাতদৃষ্টিতে একটা হতদরিদ্র গ্রাম। বাবর মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে সে নিচু দেয়াল পরিবেষ্টিত অবস্থায় একটা বিশাল বেলেপাথরের অদ্ভুতদর্শন ভবন দেখতে পায়। গ্রামের তুলনায় ভবনটাকে বিসদৃশ্য দেখায়। সে কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখে মূল ভবনের সামনের প্রান্ত হাত, পা আর অবয়বের পরস্পর সংবদ্ধ খোদাই। করা একটা নিদর্শন চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। পানিপথের দীর্ঘ পথে বহুবার সে এধরণের ভবন দেখতে পেয়েছে। কিন্তু তখন তার সময় বা ইচ্ছা কোনো ছিলো না কাছে গিয়ে ভালো করে দেখবার।
সে ইশারায় থামতে বলে। সে তার কচিকে বলে, “দেখে এসো ওটা কি?”
পনের মিনিট পরে তার কর্চি এক ছোটখাট লোককে নিয়ে ফিরে আসে, যার মুখটা আখরোটের মতো কুঞ্চিত আর ভাঁজপড়া এবং চোখে বয়সের ছাপ। তাদের সাথে রয়েছে বাবরের এক সেনাপতি জুনায়েদ বারলাস। কাবুলে বসবাসকারী এক হিন্দুস্তানী কার্পেট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জুনায়েদ তরুণ বয়সে হিন্দুস্তানী ভাষা শিখেছিলো। ভালো কাউকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে তাকেই তার দোভাষীর পদে নিয়োগ করেছে।
“সুলতান, এই লোকটা বলছে ওটা একটা হিন্দু মন্দির।” জুনায়েদ ব্যাখ্যা করে।
“আমার মনে হয় সে ঐ মন্দিরের একজন পুরোহিত।”
“আমি দেখতে চাই।” বাবর ঘোড়া থেকে নেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরোহিতের দিকে তাকায়। লোকটার কোমরে কেবল একটা নেংটি পরা রয়েছে যা তার কোমরে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা আর পুরো গায়ে কোনো কাপড়ের বালাই নেই। তার বাম কাঁধের উপর দিয়ে এসে ডান বাহুর নিচে দিয়ে একটা লম্বা সুতির সূতোর ফাঁস ঝুলছে। তার রুক্ষ্ম সাদা চুল আর দাড়ি লম্বা এবং জটপাকানো আর কপালে ছাইয়ের মতো কিছু একটা লেপটে রয়েছে। তার ডান হাতে একটা লাঠি ধরা আছে, তার মতোই গ্রন্থিযুক্ত।
পুরোহিত ধীর পায়ে তাকে ভেতর নিয়ে আসে। মূল ভবনটার মতো কিছু বাবর আগে কখনও দেখেনি। ভবনটার সামনের দিকটা সাত তলা বিশিষ্ট একটা কাঠামো, যার নিচের দিকটা ত্রিশ ফিট চওড়া আর উপরের দিকে উঠে সেটা একটা বর্গাকার চূড়ার আকৃতি নিয়েছে। খোদাই করা মানুষের নারী এবং পুরুষ- বিশালাকৃতি দেহ এবং বড় বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের পরনে আপাতদৃষ্টিতে দেহের সাথে আঁটসাঁট অর্ধস্বচ্ছ পোশাক, কপালে, গলায় আর বাহুতে অলঙ্কার পুরো দেয়াল জুড়ে খোদাই করা। এসবের মাঝে মাঝে অদ্ভুত, ভয়ঙ্করদর্শন, আর যুদ্ধবাজ চরিত্র যাদের কেউ কেউ মনে হয় নাচছে আবার কেউ রমণে লিপ্ত- মূর্তি খোদাই করা। কারো কারো পশুর মাথা- বানর এবং হাতির।
বাবর তাকিয়ে থাকে। জীবন আর প্রাণশক্তির উপাদানবাহী ইঙ্গিত। কিন্তু এসবের মানে কি? একটা দরজা দিয়ে তারা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে। একপাশে একসারি সংকীর্ণ সিঁড়ি ওপরের তলায় উঠে গিয়েছে। ভেতরে অপরিচিত তীব্র একটা গন্ধ, চন্দনকাঠের চেয়ে তীব্র ভারী আর মিষ্টি একটা গন্ধ। পুরোহিত কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে তাকায়। বাবরকে পেছনেই দেখতে পেয়ে পাথরের উপরে হাতের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সে সামনের দিকে আবার এগিয়ে যেতে শুরু করে। বাবর তাকে অনুসরণ করে ভেতরের বর্গাকার আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ায়। যার চারপাশ দিয়ে বেষ্টনী দেয়া বারান্দা রয়েছে। দেয়ালগুলোকে হিন্দু কিংবদন্তী বা লোকগাথার দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে। বানরের মতো দেখতে যোদ্ধার দল, হাতে ধরা খাটো তরবারি আন্দোলিত করে একটা সেতু অতিক্রম করে যুদ্ধের জন্য একটা দ্বীপে গমন করছে।
বারান্দায় ধারণ করে থাকা বেলেপাথরের স্তম্ভে আরও সুগঠিত দেহের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে- চার, ছয় কি আট হাতবিশিষ্ট। আঙ্গিনার একপাশে একটা সাদা পাথরের হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ষাঁড়ের মূর্তি। গলায় গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। আর সামনে রাখা পিতলের ধূপদানে ধূপ পোড়ার গন্ধ আসছে। কাছেই একটা মামুলি কালো পাথরের- সম্ভবত কষ্টিপাথর- স্তম্ভের চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো রয়েছে যার উপরের দিকটা গোলাকার এবং কিছু কিছু স্থান এমন মসৃণ যে পাথরটা মার্বেলের দীপ্তি ছড়াচ্ছে। স্তম্ভটার সামনে তেল, খাবার আর পদ্মফুলের নৈবেদ্য সাজান রয়েছে।
“ওটা কি?” বাবর জানতে চায়।
জুনায়েদ বারলাস পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় উত্তরটা বুঝতে তার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে সে বলে, “তারা এটাকে লিঙ্গম বলে থাকে, সুলতান। এটা দিয়ে পুরুষাঙ্গ বোঝানো হয় আর এটা উর্বরতার প্রতীক।” কিন্তু বাবরের দৃষ্টি ততোক্ষণে আঙ্গিনার অন্যপ্রান্তে একটা চাদোয়ার নিচে আসনপিড়ি অবস্থায় হাত উঁচু করে রেখে উপবিষ্ট এক শক্তিশালী লোকের প্রমাণ আকৃতির চেয়ে বড় মূর্তির দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। তার অলঙ্কৃত মুকুটের নিচে কঠোর মুখের ভীষণদর্শন, স্থিরপ্রতিজ্ঞ চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“এটা তাদের একটা দেবতা- তারা একে শিব বলে,” পুরোহিতের সাথে আরো একবার আলোচনা করে নিয়ে দোভাষী জানায়। কিন্তু দৃশ্যত পুরোহিতের আরো কিছু বলবার রয়েছে। কারণ সে তখনও বিড়বিড় করতে থাকে। জুনায়েদ বারলাস ঝুঁকে তার কথা শুনতে চেষ্টা করে। “পুরোহিত তাদের এক পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ কিছু শ্লোক আপনাকে বলতে চায়, সাবধান, আমি স্বয়ং প্রলয়। আমি শিব, ধ্বংসের বাহক…”
পুরোহিত আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাটা কি বলতে চায়? বাবর ধবংসকারী যে এখানে তাদের মাঝে এসে হাজির হয়েছে নাকি হিন্দু আর তাদের দেবতারা তাকে ধ্বংস করবে…?”
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেতরের আঙ্গিনা থেকে প্রধান ভবনের ভিতর দিয়ে বাইরে বের হয়ে এসে মন্দিরের এলাকা ত্যাগ করে। সে ঘোড়ায় চেপে বসে তার পরিচারকের বাড়িয়ে ধরা পাত্র থেকে পানি পান করে ইশারায় জানায় পুনরায় যাত্রা শুরু করার জন্য সে প্রস্তুত। নিজের দেহরক্ষীদের পেছনে রেখে সে একবার পেছনের মন্দির বা তার রহস্যময় মূর্তির দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে রওয়ানা দেয়।
কয়েক গজ সামনে যাবার পরে তাদের ঠিক পথের উপরে একটা গরু মাটিতে থেবড়ে বসে রয়েছে দেখতে পায়। লম্বা পাপড়িযুক্ত চোখের চারপাশে ভনভন করতে থাকা মাছির দঙ্গলে তার খুব একটা অসুবিধা হয় না। লম্বা শিংযুক্ত একটা। প্রাণী এবং বাবরের মাতৃভূমির গরুর তুলনায় হাড্ডিসার, ফ্যাকাশে খয়েরী চামড়ার নিচে পাছা আর পাজরের হাড় পরিষ্কার গোনা যায়। বাবরের দেহরক্ষী দলের একজন সামনে এগিয়ে গিয়ে বর্শার হাতল দিয়ে তাকে একটা গুতো দেয়। গরুটা হাম্বা রবে প্রতিবাদ জানায় কিন্তু উঠে দাঁড়াবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। লোকটা এবার বর্শাটা ঘুরিয়ে নেয় এবং তীক্ষ্ণ দিক দিয়ে খোঁচা দিতে চায় যাতে বেয়াদব গরুটা অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, এমন সময় বাবরের পেছন থেকে কুদ্ধ চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে।
চারপাশে তাকিয়ে সে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতকে তার হাড় জিরজিরে দেহের তুলনায় বিদ্যুৎ বেগে দৌড়ে আসতে দেখে। চিৎকার করার কারণে বুড়ো লোকটার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। দৌড়াবার ফাঁকে লাঠি ধরা হাত তুলে প্রবল বেগে আন্দোলিত করছে। বাবরের দু’জন দেহরক্ষী লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং বাবরের কাছাকাছি পৌঁছাবার আগেই তাকে আটকে দেয়।
বাবর জুনায়েদ বারলাসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। “কি চায় সে?”
“সুলতান সে আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে।”
“তার এই স্পর্ধার জন্য আমি চাবকে তার পিঠের চামড়া তুলে নেবো।”
“সুলতান আপনি বুঝতে পারেননি, সে বলতে চাইছে হিন্দুরা গরুকে পবিত্র প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করে যা যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে। সে ভয় পেয়েছে যে আপনি বোধহয় গরুটাকে আঘাত করবেন…”
বাবর বুড়ো লোকটার দিকে তাকায়। “ওকে ছেড়ে দাও। আর তাকে বলল যে আমি বুঝতে পারিনি। তাকে আরো বলো যে তার ধর্মকে অসম্মান করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।”
জুনায়েদ বারলাসের ভাষান্তরিত কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটার অভিব্যক্তি স্বাভাবিক হয়ে আসে। গরুটাও ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে পড়েছে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়িয়ে দূরে একটা গাছের ছায়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। বাবরের সেনাবাহিনী তাদের সদ্য দখল করা ভূখণ্ডের উপর দিয়ে আবারও অবাধে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
*
চারদিন পরে, বাবর আর তার বাহিনী দিল্লী পৌঁছালে সেখানের শাসনকর্তা কোনো প্রতিরোধ প্রদর্শন করে না। তার দেখা এটা সবচেয়ে জনবহুল আর বড় শহর। সমরকন্দ বা হিরাতের মতো আভিজাত্য নেই বটে শহরটার, কিন্তু কিছু কিছু অংশ দেখতে খারাপ না। সে বিশাল বেলেপাথরের তৈরি মসজিদ, সূক্ষ খিলানযুক্ত প্রাসাদ, এবং কৌতূহলকর খোদাইযুক্ত দুইশ চল্লিশ ফিট উঁচু উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া স্তম্ভ- কুতুব মিনার পরিদর্শন করে। শতাব্দি পূর্বে কোনো অজানা কারণে নির্মিত হয়েছিলো। রাজকীয় সমাধিস্থল- গম্বুজযুক্ত, খিলানসংবলিত, স্ত যুক্ত- সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এসব দেখে বাবর ভাবতে বাধ্য হয়- দিল্লীর সুলতানেরা যেমন জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করেছিলেন, মৃত্যুর পরে তেমনি আড়ম্বরপূর্ণ সমাধিস্থলের ভক্ত ছিলেন। এখন মৃত্যু নগরীর কেবল বাসিন্দা হিসাবেই তারা স্মৃতিতে বেঁচে আছে…
বাবর শহরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে না- জুম্মা মসজিদে তার নামে খুতবা পড়ানো শেষ হতে সে শাহী কোষাগার পরিদর্শন করে। মণিমুক্তো আর মোহর ভর্তি সিন্দুকগুলো তার হিন্দুস্তানের অভিযানের সার্থকতা প্রতিপন্ন করে। অবশ্য দিল্লীতে ইবরাহিমের প্রাক্তন পরিচারকের ভীতসন্ত্রস্ত দল- বাবরের সামনে তাদের হাজির করা হলে- বাবরের ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে নিজেরাই বলে উঠে মূল কোষাগার আগ্রায় অবস্থিত। সে হুমায়ুনকে সেখানে পাঠিয়ে ভালোই করেছে। কোষাগারের হিসাব নেবার পরে নিজের একজন সেনাপতিকে শহরের নতুন শাসক হিসাবে নিয়োগ করে আগ্রায় হুমায়ুনের সাথে যোগ দেবার জন্য সে যমুনার তীর বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রওয়ানা দেয়।
আবহাওয়ায় উষ্ণতা এতো বেশি যে বাবর অবাক হয় এই গরমে জীবিত কিছু চলাফেরা করে কি করে। অবশ্য তার যাত্রা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে লোকজন দেখতে পাওয়া যায়। শীঘ্রই রাস্তাঘাট আর মাঠে তাদের নির্ভীকভাবে চলাফেলা করতে আর তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। সে যে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা আরোপ করেছে তার প্রভাব নিশ্চয়ই পড়েছে…তার নতুন প্রজারা- ছেলেদের পরনে নেংটির মতো কাপড় আর মেয়েদের পরনে রঙচঙে লম্বা কাপড় তাদের শরীরে পেচিয়ে মাথার উপর গিয়ে শেষ হয়েছে। আর কপালে লাল চিহ্ন আর নাকে সোনার নাকফুল- তাদের নিশ্চিতভাবেই ভীত মনে হয় না। সূর্যের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া গ্রামের ভিতর দিয়ে বাবর তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে তারা কৌতূহলী ভঙ্গিতে চারপাশে এসে ভীড় করে। গ্রামগুলোতে শুকনো গোবর, মশলা আর ধূপের মিষ্টি সুগন্ধে ভরা। তারা বস্তা ভর্তি শস্য, ফলমূল আর সজি নিয়ে এসে বাবরের সৈন্যদের কাছে বিক্রিও করে।
দিন অতিক্রম করার সাথে সাথে সূর্যের অবিরাম আলোর নিচে সমতল, খয়েরী আর শুষ্ক ভূপ্রকৃতি আর তার গিজগিজ করতে থাকা লোকের ভীড় বাবরকে অস্থির করে তোলে। প্রাণশক্তি আর উদ্যমের অভাব সে অনুভব করতে থাকে। রাতের বেলাতেও স্বস্তি নেই। তখন শুরু হয় মশার গুঞ্জন এবং তার পরিচারকের দল শীতের দেশের জন্য নির্মিত তাঁবু আবহাওয়া কিছুতেই শীতল করতে পারে না। মন্থরগতি যমুনাও তার চোখকে বিন্দুমাত্র আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয়। যমুনার তীরের শুকনো জমাট কাদার দিকে তাকিয়ে সিন্ধু নদের ওপাশে নিজের দেশের খরস্রোতা নদী আর বলকারী বাতাসের জন্য তার মনটা আনচান করতে থাকে।
ষষ্ঠদিন সন্ধ্যাবেলা। কাবুল থেকে আগত এক বার্তাবাহক একটা উপহার নিয়ে উপস্থিত হয়। ধাতব আস্তরণ দেয়া কাঠের বাক্সটার ভেতরে, যাত্রার শুরুতে নিশ্চিতভাবেই বরফ দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিলো। সে দেখে তরমুজ রয়েছে, খানজাদা তার প্রিয় ফল পাঠিয়েছে। নিজের তাঁবুর ভেতরে একাকী বসে সে তরমুজটা কেটে সেটার রসাল মিষ্টি শাশের স্বাদ নিতে তার চোখ জ্বালা করতে থাকে। নিজের দেশত্যাগের অনুভূতি তার ভিতরে প্রবল হয়ে উঠে। খানজাদা তাকে সামান্য আনন্দ দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার পাঠানো উপহার কেবল তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে।
বাবর হাত বাড়িয়ে কালি, কলম আর রোজনামচার খাতা তুলে নেয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সে লেখার সময়ই পায়নি। বাবর লিখতে শুরু করে:
হিন্দুস্তান দেশটায় কোনো বৈচিত্র নেই। এখানকার লোকজনও দেখতে সুদর্শন না…এখানে ভালো ঘোড়া, বা শিকারী কুকুর, মাংস, আঙ্গুর, সুস্বাদু তরমুজ বা অন্য কোনো স্বাদু ফল পাওয়া যায় না। এখানে নেই কোনো বরফের বা শীতল পানির বন্দোবস্ত। বা বাজারেও ভালোকিছু জিনিসের বড় অভাব। গরম পানির হাম্মাম বা মাদ্রাসাও নেই। তাদের নদী বা ছোট স্রোতস্বিনী, যেগুলো গিরিন্দর দিয়ে প্রবাহিত, এখানের বাগানে বা বাসস্থানে পানি প্রবাহের কোনো বন্দোবস্ত নেই…
সে লেখা থামায়। বাবুরী যে তাকে হিন্দুস্তান বিজয়ী উপাত্ত এনে দিয়েছিলো সে। তাকে কি বলতো? সে এই মাত্র যা লিখেছে তাতে কেবলই তিক্ততা আর ছিদ্রান্বেষণের অভিপ্রায় প্রকট। যেকোনো ধরণের আত্ম-করুণার লক্ষণের প্রতি বাবুরীর ছিল চরম বিতৃষ্ণা এবং শীঘ্রই সে এই লক্ষণ খুঁজে পেতো। সে থাকলে বাবরকে হয়তো বলতো এটা থেকে বের হয়ে আসতে…বলতো সে একটা দারুণ সুযোগ পেয়েছে এবং তার দায়িত্ব হলো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। কিন্তু সম্ভবত বাবুরী এখন তার সাথে থাকলে সে হয়তো এমন বিষণ্ণ বোধ করতো না…।
নিজের জোব্বার ভেতর হাত ঢুকিয়েসে নরম চামড়ার থলিতে বন্দি কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত বের করে। তাবুর আধো আলোতেও পাথরটা চমকাতে থাকে। এই নতুন দেশের শক্তিশালী প্রতীক, যা তার মাঝে শক্তি আর প্রতিজ্ঞার নব ফরুধারা প্রবাহিত করছে। আক্ষেপ করার সময় এটা নয়। হিন্দুস্তান যদি সে যেমন দেশ পছন্দ করে তেমনটা না হয়েও থাকে, তবে সে আর তার সন্তানেরা তাকে তাদের মনের মতো দেশে পরিণত করবে। তারা এমন একটা সাম্রাজ্যের জন্ম দেবে যা নিয়ে মানুষ সম্ভ্রমের সাথে শতাব্দির পরে শতাব্দি আলোচনা করবে।
ডায়েরীর একটা নতুন পাতা খুলে বাবর আবার লিখতে শুরু করে:
কাবুলে আমি যখন প্রথমবার আসি সেই বছর থেকে আমি মনে মনে কেবল হিন্দুস্তানের জপ করেছি। এখন আল্লাহতালার পরম করুণায়, আমি পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ সুলতান ইবরাহিমকে পরাস্ত করেছি এবং আমার সাম্রাজ্যের জন্য একটা নতুন রাজত্ব জয় করেছি।
আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে লিখে।
হিন্দুস্তানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দেশটার বিশালত্ব। সেই সাথে সোনা আর অন্য সম্পদের প্রাচুর্য…
একজন মানুষ ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই এখানে করা সম্ভব…
*
দক্ষিণ-পূর্বদিকে ক্রমাগত অগ্রসর হওয়া অব্যাহত থাকলে বাবরের মেজাজ কিছুটা প্রফুল্ল হয়। সে এবার লক্ষ্য করে যে দেশটা সে যতটা বিরাণ ভেবেছিলো ততোটা বিরাণ না। শুষ্কতা আর উষ্ণ বাতাস সত্ত্বেও, এখানে দারুণ সব ফুল ফোটে, যেমন ডালিম ফুলের চেয়ে গাঢ় লাল রঙের গুদাল, এবং পীচ ফুলের মতো পাঁচ পাপড়িযুক্ত মৃদু কিন্তু অপূর্ব গন্ধযুক্ত করবী।
তার এই নতুন আশাবাদী মনোভাবের সাথে আরেকটা ভাবনা তাকে চিন্তিত করে তোলে- সে যদি সত্যিই নিজেকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়- তাকে তাহলে এই নতুন দেশ আর তার রীতিনীতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। দোভাষী জুনায়েদ বারলাসের সহায়তায় সে রাস্তায় যাকে দেখতে পায় তাকেই ডেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যা দেখে সে বিষয়ে কৃষক বা বণিককে প্রশ্ন করে। একদিন সে একটা জলাধারের উপরে রাখা একটা পিতলের তৈরি দুই আঙ্গুল পুরু বাসনে মস্তুর দিয়ে বেগুনী পাগড়ী পরিহিত এক লোকতে বাড়ি দিতে দেখে। সে জানতে পারে এদের বলা হয় ঘড়িয়ালী- সময়রক্ষক। বাবরের মাতৃভূমিতে প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টায় বিভক্ত আর প্রতি ঘণ্টায় আছে ষাট মিনিট। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখে হিন্দুস্তানে তার। নতুন প্রজারা দিনরাতকে ষাটটা অংশে–ঘড়িতে বিভক্ত করেছে, চব্বিশ মিনিটে এক ঘড়ি, দিনরাতে রয়েছে চারটা সময়ভাগ যাকে বলা হয় প্রহর। ঘড়িয়ালদের কাছে এক ধরণের পাত্র আছে যার নিচে ছিদ্র করা। প্রতিঘণ্টায় এটা পানিতে ভর্তি করা হয়। ঘড়িয়ালী এই পাত্রের পানির উপর নজর রাখে। পাত্র ভরা মাত্র সে ঘড়িয়ালের উপরে কাঠের ছোট মস্তুর দিয়ে বাড়ি দেয়, ক্রমে পানি পড়া শেষ হয়ে যায়। তারপরে পাত্রে আবার পানি দেয় এবং ঘড়িয়ালে বাড়ি দেয়। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হলে ঘড়িয়ালী খুব দ্রুত কয়েকটা বাড়ি দিয়ে শেষে জোরে একটা বাড়ি দেয়। রাত দুই প্রহর হলে একইভাবে দ্রুত কয়েকটা আঘাত করে জোরে দুটা বাড়ি দেয়। এভাবে তিন প্রহর আর চার প্রহর ঘোষণা করা হয়।
একজন অর্থ-ব্যবসায়ীর কাছে থেকে বাবর বাজারে মুদ্রাগণনা হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় হিন্দুস্তানীদের হিসাব করার সুস্পষ্ট নিয়ম আছে: একশ হাজারে তাদের এক লাখ; একশ লাখে এক কোটি; একশ কোটিতে এক অর্ব এভাবে গণনার মাত্রা বাড়তে থাকে। কাবুলে গণনার জন্য তাদের এমন সংখ্যারীতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হিন্দুস্তানে, যেখানে সম্পদ- অন্তত তার শাসকদের কাছে মাত্রাহীন, সেখানে এটা চালু আছে। ভাবনাটা বেশ প্রীতিকর।
বাবর কৃষকদের শ্রমসাধ্য প্রয়াসে তাদের কৃষিজমিতে সেচ দিতে দেখে। কুঁয়ো থেকে ষাড় দিয়ে চামড়ার মশকে পানি টেনে উপরে তোলা হয় এবং খেজুর আর তাল গাছের মিষ্টি মাদকতাময় পানীয় সে পান করেছে, তাল গাছ সে আগে কখনও দেখেনি। সে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে হিন্দুস্তানের ধর্মের সারবস্তু বুঝতে। জানতে পারে হিন্দুরা পূর্ণজন্মে বিশ্বাস করে এবং তাদের ভীতিকর দেখতে অসংখ্য দেবতা যাদের ভিতরে বহুভূজা নারী রয়েছে। নরমুণ্ডে সজ্জিত রয়েছে জালার মতো পেটের হাতির মুখঅলা দেবতা- সবাই আসলে একটা কেন্দ্রীয় ত্রিমূর্তির বহিপ্রকাশ, ব্রহ্মা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা; বিষ্ণু, ভারসাম্যের দেবতা আর শিব ধ্বংসের প্রতিভূ। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই কেমন ঘোলাটে, বিভ্রান্তকর আর কেমন বিব্রতকর। সুলতান ইবরাহিম তার মতোই একজন মুসলমান- এসব থেকে কি বুঝেছিলেন? বাবর আবার সেই মন্দিরের পুরোহিতের কথা ভাবে: “আমিই সেই ধ্বংসকারী…”।
সে শীঘ্রই আবিষ্কার করে যে কেবল তার কাছেই হিন্দুস্তান বিব্রতকর বলে প্রতিয়মান হয়নি। একরাতে তাঁবুর বাইরে বাতাসের আশায় বসে আছে সে, বাবা ইয়াসাভালকে এগিয়ে আসতে দেখে।
“সুলতান।” তার সেনাপতি হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে ভক্তি প্রদর্শনপূর্বক দাঁড়িয়ে থাকে।
“কি ব্যাপার?”
বাবা ইয়াসাভালকে ইতস্তত করতে দেখা যায়।
“বলো।”
“সুলতান আমার লোকেরা অস্থির হয়ে উঠেছে…এই নতুন অঞ্চলটা তারা একেবারেই পছন্দ করছে না…এতো গরম আর বিরামহীন বাতাস এখানে…অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে…” সে দম নেবার জন্য থামে, তার মশার কামড়ে দগদগে মুখটা মশালের আলোতে চকচক করে। “আমরা কাপুরুষ নই যুদ্ধে কখনও আমরা পিছপা হই না। কিন্তু এই এলাকাটা আমাদের কাছে অপরিচিত…আমরা কাবুলে ফিরে যেতে চাই। আমি কেবল আমার নিজের কথাই বলছি না, অন্য সেনাপতিদের তরফ থেকে আমি কথা বলছি। তারা তাদের পক্ষ হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার সাথে কথা বলতে।”
“সবাইকে এখনই এখানে আসতে বলো।”
বাবা ইয়াসাভাল নিজের মনে কথাই বলেছে। কয়েকদিন আগে বাবরের মনেও এই সব কথাই খেলা করতো। কিন্তু অন্য মানুষের মুখে নিজের মনের কথা উচ্চারিত হতে দেখে সে টের পায় কি গভীরভাবে সে যা দখল করেছে সেটা নিজের অধিকারে রাখতে চায়। অপেক্ষা করার সময়টায় সে মনে মনে গুছিয়ে নেয় কি বলবে। সেনাপতিরা তার তাঁবুর সামনে জড়ো হতে, কেউ কেউ তার চোখের দিকে সরাসরি তাকানো থেকে বিরত থাকে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকে।
“যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া বিজয় ও সাম্রাজ্য অর্জন সম্ভব না। রাজপদ ও আমীর রঈস অধীনস্ত রাজা-প্রজা ছাড়া টিকতে পারে না। বহু বছরের সাধনায় বহু দুঃখ-কষ্ট সয়ে, বহু বিপদের সম্মুখীন হয়ে, বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। বুকের রক্ত দিয়ে যে সাফল্য আমরা অর্জন করেছি আজ কি এমন অঘটন ঘটেছে যে সেই পরম আরাধ্য বিজয় হেলায় ফেলে রেখে আমরা দেশে ফিরে যেতে এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছি? আমরা কি তবে মহত্ত্ব অর্জনের যোগ্য নই…” বাবর একটু থামে অপেক্ষা করে সময় দেয় কথাগুলো তাদের মর্মমূলে প্রবেশ করার। “যে কেউ চাইলে তার প্রাপ্য অংশ নিয়ে সিন্ধু অতিক্রম করে দেশে ফিরে যেতে পারে। আমি একটা কথা বলে রাখছি। যখন বৃদ্ধ অবস্থায় নাতি নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে আগুনের পাশে বসে থাকবে এবং তারা যখন তোমার কাছে জানতে চাইবে কি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তুমি ছিলে। তখন দেখবে বলার মতো কিছুই তোমার থলেতে জমা নেই। তুমি লজ্জিত হবে বলতে যে, তোমার সুলতানকে তুমি ত্যাগ করেছিলে- না, তোমার সম্রাটকে- যে তোমাদের সুযোগ দিয়েছিলো বিশ্ব জয় করার…তুমি তখন মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকবে। আর তোমার নাতি নাতনিরা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে…”।
চোখে অস্বস্তি নিয়ে সেনাপতিরা একে অন্যের দিকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ পুরো জটলাটায় নিরবতা বিরাজ করে। তারপরে বাবা ইয়াসাভালের নেতৃত্বে, একটা গুনগুনে গুঞ্জন শুরু হয়। এমন একটা গুঞ্জন ফারগানায় কিশোর সুলতান হিসাবে সেই দিনগুলোর পরে সে আর কখনও শোনেনিঃ “বাবর মির্জা! বাবর মির্জা!” গুঞ্জনটা ক্রমেই জোরালো হতে থাকে, ভারী বাতাস মথিত করে। তারা তৈমূরের উত্তরসূরী আর নিজেদের সুলতান হিসাবে তার প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করছে। তারা তাকে ছেড়ে যাবে না। অন্তত এখনই না।
*
নিজের সেনাপতিদের পেছনে নিয়ে হুমায়ূন দূর্গপ্রাঙ্গনে তার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। কয়েকদিন পরে যখন বাবর ঢালু পথটা দিয়ে শক্তিশালী আগ্রা দূর্গে প্রবেশ করে। সে ঘোড়া থেকে নামতে তার ছেলে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। কিন্তু বাবর সাথে সাথে তাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।
“আব্বাজান, কোষাগার সুরক্ষিত রয়েছে। হারেমে আমরা সুলতান ইবরাহিমের মা বুয়া, তার স্ত্রী আর উপপত্নীদের পেয়েছি। বুয়া আমাদের বর্বর বলেছে- সে বলেছে সে আমাদের ঘৃণা করে…” আমি তার অপমানজনক কথাবার্তা আমলে না নিয়ে তাকে আর হারেমের অন্য বাসিন্দাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলেছি…স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে কোনো প্রতিরোধের আমরা সম্মুখীন হইনি। বস্তুতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তারা বরং স্বস্তির শ্বাস নিয়েছে। প্রথম যখন খবর আসে যে আপনার কাছে সুলতান ইবরাহিম পরাস্ত হয়েছে। ডাকাতের দল অবস্থার সুযোগ নিয়ে চেষ্টা করেছে গ্রামে লুটতরাজ চালাবার। তাদের মেয়ে, শস্য আর ভেড়ার পাল চুরি চেষ্টা করেছে। আমাদের হাতে কিছু ধরা পড়তে আমরা তাদের প্রকাশ্যে প্রাণদণ্ড দেই। এখানেই ঐ কুচকাওয়াজ ময়দানে, দূর্গের সকল অংশ থেকে যেনো সবাই ফাঁসি দেয়াটা দেখতে পায়।
“তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছে। রাজকোষে কি খুঁজে পেলে?”
হুমায়ুনের কান পর্যন্ত হাসিতে ভরে উঠে। “আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি সবগুলো সিন্দুকই সোনার মোহর আর দামী পাথরে পরিপূর্ণ…এতো পাথর রয়েছে। যে আমার বিশ্বাসই হতে চায়নি যে পৃথিবীর মাটি খুঁড়ে এতো পাথর বের করা সম্ভব। সবকিছুর হিসাব নিয়ে নথীবদ্ধ করে ওজন করা হয়েছে…”
“বেশ। আমি কাবুলে আমার লোকদের তাহলে অকৃপণ হাতে উৎসব করার জন্য দান করতে পারবো। কয়েক দিনের ভিতরে আমরা বিজয় উপলক্ষে একটা ভূড়িভোজের আয়োজন করবে। কিন্তু তার আগে আপনাদের সাথে আমি কিছু আলোচনা করতে চাই এবং কিছু বিষয় জানতে চাই আপনাদের কাছে। দিল্লী আসবার পথে আমি ভাববার অনেক সময় পেয়েছি…আমাদের মতো আরো অনেক মহান যোদ্ধা, যারা হিন্দুস্তানে এসেছিলো আমি তাদের কথা ভেবেছি মেসেডোনিয়ার সিকান্দার, যিনি সিন্ধু অতিক্রম করে তার বাহিনী নিয়ে এপারে এসেছিলো কিন্তু পরে ফিরে যায় এবং তৈমূর যিনি দিল্লী আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু সেখানে অবস্থান করেননি…আমি ভাবছি আমরা এখানে উন্নতি করতে পারবো কিনা…আমার অনেক সেনাপতি যাদের সাহস প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাদের মনেও এই একই প্রশ্ন উদয় হতে শুরু করেছে…তারা এই অঞ্চলটা পছন্দ করছে না…আমরা এইসব সম্পদ মালবাহী খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমরা যদি এখানে অবস্থান করি তাহলে অনেক বিপদ আর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
“পানিপথে আমরা বিশাল বিজয় অর্জন করেছি কিন্তু সেটা ছিলো কেবল সূচনা। এই অঞ্চলের কেবল সামান্য অংশ আমরা দখল করেছি- সত্যি বলতে দুইশ মাইল চওড়া এক ফালি ভূখণ্ডের চেয়ে বেশি কিছু না। যদিও এলাকাটা খাইবার গিরিপথ থেকে হাজার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। পানিপথের যুদ্ধের পরে আমরা তেমন কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হইনি। কিন্তু তার কারণ অন্য কিছু না হিন্দুস্তানের বাকি সব ক্ষমতাবান নৃপতিরা নিজেদের শক্তিশালী দূর্গে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে। তারা আমাদের বর্বর ডাকাতের দল বলে ভেবেছে যাযাবরের দল। যাদের শাসন ভোরের সূর্যালোকে শিশির বিন্দুর মতো উবে যাবে। তারা ইতিমধ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনার সাথে এখান থেকে আমাদের বিতাড়নের পাঁয়তারা কষতে শুরু করেছে। আজ আমি সবার সামনে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। আমাদের কি যুদ্ধে পর যুদ্ধ করার মানসিকতা রয়েছে, যার ফলে এক সময়ে আমরা নিজেদের এখানে নিরাপদ বলে মনে করতে পারি। আমার মতো এখানে উপস্থিত সবার ভিতরে সেই ইচ্ছা সেই দৃঢ়তা কি আছে?”
“আব্বাজান আমার আছে।” হুমায়ূন তার বাদামী চোখে অপলক দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে।
“তাহলে আমরা ব্যর্থ হবো না, আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত। আমি আমাদের নতুন সাম্রাজ্য আর ভূখণ্ডের জন্য একটা নাম পছন্দ করেছি। দিল্লী আসবার পথে, পারস্যের শাহের লেখা একটা অবিবেচক বার্তা আমার হস্তগত হয়। বার্তাটা আমাদের পানিপথের বিজয় অর্জনের আগে লিখিত হয়েছিলো। তিনি তাতে লিখেছেন যে আমার অভিযানের কথা তিনি শুনেছেন তিনি একে ‘তস্করদের হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আমাকে ‘মোঘল’ নামে অভিহিত করেছেন বার্তাটায়- ফার্সীতে শব্দটার মানে মোঙ্গল’- আমাকে অসভ্য হানাদার হিসাবে অপমান করার অভিপ্রায়ে। কিন্তু আমি তাকে লিখে পাঠাই যে চেঙ্গিস খানের, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মোঙ্গলের, বংশধর হিসাবে, যেমন আমি গর্ববোধ করি, তেমনি তৈমূরের বংশধর হিসাবেও আমি গর্বিত। মোঙ্গল’ সম্বোধনের ভিতরে কোনো অপমান নেই। আমি তাকে বলেছি যে আমি গর্বের সাথে এই সম্বোধনটা ধারণ করবো। আর আল্লাহতা’লার কৃপায় শীঘ্রই আমাদের নতুন সাম্রাজ্য তার নিজের সাম্রাজ্যকেও আকার আর সমৃদ্ধিতে ছাড়িয়ে যাবে।”
***
উদ্যত আনুষ্ঠানিক তরবারি হাতে দুই প্রহরীর পেছনে বাবর ধীরে ধীরে সোনার কারুকাজ করা চামড়া দিয়ে মোড়া দুই দরজাবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। যা সুলতান ইবরাহিমের কামরা থেকে দরবার কক্ষে প্রবেশের একান্ত প্রবেশপথ। যেখানে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য আয়োজিত ভূড়িভোজে অংশ নেবার জন্য তার সেনাপতিরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার লোকেরা ইতিমধ্যে নদীর তীর বরাবর স্থাপিত তাঁবুগুলোতে আর নিচের আঙ্গিনায় উৎসব আরম্ভ করেছে। যুদ্ধে জয়লাভে সাহায্য করেছে এমন একজনও আজ রাতে বঞ্চিত হবে না।
মশালের আলোতে বাবরের পাগড়িতে সংবদ্ধ পান্না থেকে আলো ঠিকরে আসে। তার গলায় আরও মূল্যবান পান্নার সাথে মাঝে মাঝে মুক্তা দেয়া তিনছড়া বিশিষ্ট একটা মালা ঝুলছে এবং তার হাতে অবশ্যই তৈমূরের অঙ্গুরীয় শোভা পায়। তার জরির কারুকাজ করা সবুজ জোব্বাটা একপাশে মুক্তার ছড়া দিয়ে বাঁধা এবং একটা ভারী সোনার চেনের সাথে আটকানো আলমগীর তার কোমরে ঝুলছে। কয়েক মিনিট আগে নিজের ঝকঝকে অবয়বের দিকে সে সন্তুষ্ট চিত্তে তাকিয়ে ছিলো ক্ষমতা আর জৌলুসের মূর্তিমান প্রতিভূ।
তূর্যনাদের সাথে পরিচারকের দল দরজা খুলে দেয় এবং বাবর ভেতরে প্রবেশ করে। সাথে সাথে ভেতরে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। তার চৌকষভাবে সজ্জিত সেনাপতির দল মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রথামাফিক আনুগত্য প্রকাশ কুর্নিশে আনত হয়। বাবরের ঠিক সামনে কামরাটার ঠিক মধ্যেখানে একটা স্তরবিশিষ্ট সাদা মার্বেলের বেদী দেখা যায়। একদম উপরের স্তরে সবুজ আর হলুদ চাদোয়ার নিচে রত্নখচিত সোনালী সিংহাসন শোভা পায়। তার সেনাপতিরা মঞ্চের সামনে সারিবদ্ধ অবস্থায় প্রণত হয়ে থাকে। বাবর তাদের মাঝ দিয়ে মাথা উঁচু করে, পিঠ সোজা রেখে, মঞ্চে আরোহন করে এবং নির্ধারিত আসনে উপবিষ্ট হয় এবং হুমায়ূনকে এক স্তর নিচে তার ডান পাশে নীল মখমলের একটা আসনে ইঙ্গিতে বসতে বলে।
“আপনারা এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সবার চোখ আবার নিজের উপর অনুভব না করা পর্যন্ত বাবর চুপ করে থাকে। “মহান আল্লাহতালা পানিপথে আমাদের প্রতি বিশেষ মেহেরবান ছিলেন। তিনি আমাদের বিজয়ী করেছেন। কারণ আমাদের যুদ্ধের কারণ ন্যায়সঙ্গত ছিল। হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আমাদের জন্মগত অধিকার। সুলতান ইবরাহিম আমাদের বাধা দিতে চেষ্টা করে যুদ্ধে মারা গেছেন। আমরা সবাই আমার সব সেনাপতি, যারা আমাকে আগুন আর পানির মাঝ দিয়ে অনুসরণ করে এসেছেন। সবাই বিজয়ী। আমাদের ইতিহাসের এটা একটা নতুন অধ্যায়। আমার লোকদের নতুন নিয়তি যখন আমরা নিজেদের হিন্দুস্তানের প্রভু প্রতিপন্ন করেছি। কিন্তু এখনও আরও মহান গৌরব আমাদের সামনে হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু আজ রাতে আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে কেবল আমাদের বিজয়ের মধুর স্বাদ উপভোগ করবো…” বাবর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথার উপরে তুলে ধরে এবং চিৎকার করে উঠলে, “আমাদের নতুন সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে!” তার চারপাশে সম্মতির একটা গমগম আওয়াজ দরবারের দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চায়।
সুলতান ইবরাহিম বেশ সৌখিন জীবনযাপন করতেন। কিছুক্ষণ পরে বাবর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে ভাবে। নিখুঁতভাবে খোদাই করা লাল বেলেপাথরের স্তম্ভ, মাঝের ক্ষুদ্র গম্বুজ, লালচে-গোলাপী সিল্কের পর্দায় শোভিত এই কামরাটার মতো চমকপ্রদ কিছু সমরকন্দের বাইরে সে দেখেনি। মঞ্চের দুপাশে ময়ূরের মতো দেখতে দুটো সোনালী রঙের লম্বা ধূপদানি থেকে সুগন্ধি ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে। ময়ুর দুটোর ছড়ানো পেখমে আবার পান্না আর নীলার কারুকাজ করা। বাবরের ডানপাশে একটা কারুকাজ করা চন্দনকাঠের বেষ্টনী পার্শ্ববর্তী হারেমকে দরবার থেকে পৃথক করেছে।
বাবর আর তার পরিশ্রান্ত বাহিনীর আগ্রায় আগমনের পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাতাস বইতে শুরু- সম্ভবত বৃষ্টি শুরু হবার আগে এমনই বাতাস বয়, অথবা এটা তাদের সৌভাগ্য। বাবর ঝুলন্ত রেশমের পর্দা মৃদু ভঙ্গিতে আন্দোলিত হতে দেখে।
তাকে আর তার অতিথিদের পাঙ্খ দ্বারা, কারুকাজ করা রেশমের আয়তাকার টুকরো লম্বা রেশমের দড়ির সাহায্যে ঝুলছে। দড়িটা আবার ছাদে স্থাপিত একসারি লোহার রিঙের ভিতর দিয়ে গিয়ে দেয়ালের উঁচুতে স্থাপিত একটা ফোকর গলে বের হয়ে গিয়েছে। পাঙ্খ ওয়ালারা দেয়ালের ওপাশে যারা অবস্থান করছে, তাদের টানবার জন্য, যাতে খাবার সময়ে কাপড়ের টুকরোটা ধীরে ধীরে আহাররত অতিথিদের মাথার উপরে ধীরে ধীরে আন্দোলিত হয়ে তাদের শীতল রাখতে পারে। বাবরের দেয়াল বরাবর স্থাপিত নিচু টেবিলে ঝলসানো ভেড়ার মাংস, রান্না করা মুরগী এবং চাপাটি স্তূপ করে রাখা। সবই তাদের মাতৃভূমির খাবার। কিন্তু এর সাথে আরো রয়েছে হিন্দুস্তানের ফলমূল: কমলা রঙের আশযুক্ত আম, রসে টইটুম্বর, আর নরম রসালো পেঁপে আর খেজুর।
তার মতো অনেকেই তৈমূর আর চেঙ্গিস খানের বংশধর। সবাই তাকে দারুণ সাহায্য করেছে। ভোজ শুরু হবার আগে, সে সবার মাঝে উপহার বিতরণ করে লাল রেশমের খিলাত, স্যাবেলের চামড়ার তৈরি জ্যাকেট যার সামনের দিকটা নীল রঙের, রত্নখচিত খঞ্জর, তরবারি, কারুকাজ করা সোনার পর্যান। বাবর তাদের চোখেমুখে সন্তুষ্টির ছায়া দেখতে পায়। সে দেখে বাবা ইয়াসাভাল হাতলে পান্না খচিত একটা বাঁকানো তরবারির হাতল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।
তারা খেতে শুরু করতে বাবর আড়চোখে একবার তার ডানপাশের পর্দার দিকে তাকায়। সাধারণত রাজকীয় ভোজসভার সময়ে রাজপরিবারের মেয়েরা তার পেছনে। অবস্থান করেন। এবং নিজেরা খেতে খেতে জাফরীর ওপাশে কি ঘটছে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। বুয়া কি নিজের কক্ষে বসে তার মৃত সন্তানের কামরা থেকে ভেসে আসা এই আনন্দ উল্লাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে? বাবর কামনা করে যেনো না পায়। তার সাহস আর দুঃখবোধ আর সেই সাথে রক্তের কারণে সে তাকে সম্মান করে। তিনি হুমায়ুনকে যেসব কটুবাক্য বলেছেন সেজন্য তাকে শাস্তি দেবার কোনো মানে। হয় না। বাবর নিহত হলে এবং তার সিংহাসন অন্য কেউ দখল করলে এসান। দৌলতও কি একই আচরণ করতেন না। সে আদেশ দিয়েছে যে বুয়া তার অলংকার এবং পরিচারিকাদের রাখতে পারবে এবং সে তার জন্য একটা ভাতার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সে আশা করে সময়ের সাথে তার এই উদারতা তাকে প্রশমিত করবে।
সেদিন সকালের দিকে, নদীর তীরে, বাবর সুলতান ইবরাহিমের হাতিশালার দুটো মর্দা হাতির, যাদের নাম যথাক্রমে পর্বতবিদারক আর অনন্ত সাহসী, মাঝে লড়াই উপভোগ করে। বিশেষভাবে নির্মিত মাটির ঢালু পথের উপরে বিশাল রঙ করা জন্তুগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুত তাদের পরস্পরের দিকে ধাবিত হতে উৎসাহিত করলে, তারা শুড় আন্দোলিত করে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই ততোক্ষণই চলে। যতোক্ষণ না একটা হাতি পিছুহটে আসে। তার ভিন্ন কিছু উপভোগের সময় আসে বাবর হাততালি দিয়ে ইবরাহিমের প্রাসাদের নিয়মিত দড়াবাজ আর বাঈজিদের আসতে ইঙ্গিত করে।
দু’জন তরুণ, তাদের তেলচকচকে দেহে কেবল কমলা রঙের নেংটি রয়েছে, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল মাথার উপরে চুড়ো করে বাঁধা বাবরের মঞ্চের সামনে পরিষ্কার করা। স্থানের দিকে দৌড়ে আসে। তারা দুজনে হলুদ রঙের একটা আয়তাকার বাক্স বয়ে আনে। বাক্সটা তিন ফিট লম্বা আঠার ইঞ্চি চওড়া এবং উভয়পাশে রহস্যময় একটা চোখ লাল রঙে আঁকা রয়েছে। তারা বাক্সটা রেখে চলে যায়। বাবরের লোকেরা। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে- বাক্সের ঢাকনিটা যেনো নিজে থেকেই খুলে যেতে শুরু করেছে। ভেতর থেকে একটা ছোট হাত বের হয়ে আসে। তারপরে আরেকটা এবং তারপরে এক ঝটকায় ঢাকনিটা পুরো খুলে গিয়ে ভেতর থেকে একটা ছেলে বের হয়ে আসে যার পা দুটো উল্টো করে কাঁধের উপরে আঁকড়ে রয়েছে। অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার যে কোনো মানুষের পক্ষে হোক না সেটা একটা বাচ্চা ছেলে নিশ্চিতভাবেই তার কোমরের কাছটা দু’ভাজ করা যায়- এত ছোট একটা স্থানে নিজেকে প্রবেশ করানো সম্ভব। নিজেকে বের করে এনে ছেলেটা বাক্স থেকে বের হয়ে দাঁড়ায় এবং অন্য দুই দড়াবাজ এবার তাদের কপালে, হাঁটুতে, হাতে আর পায়ের উপরে বল ঘোরাতে ঘোরাতে ঘরের ভিতরে ডিগবাজি খেতে থাকে। তাদের চিকন পা এতো দ্রুত আন্দোলিত হয় যে ঝাপসা একটা দৃশ্যকল্পের জন্ম হয়।
এরপরে একজন দড়াবাজ লাফিয়ে আরেকজনের কাঁধে উঠে পড়ে এবং ছেলেটা তারপরে আপেল গাছে উঠবার মতো অনায়াসে তাদের দেহ বেয়ে উঠে যায়। উপরের লোকটার মাথায় ভর দিয়ে সে নিজের মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে এবং মুখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে দেয়। বাবরের সেনাপতিরা চেঁচিয়ে নিজেদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। চোখের পলকে ছেলেটা আবার মাটিতে নেমে আসে। নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়ে সে বাক্সে ঢুকে পড়ে এবং বিদায় সম্ভাষণ জানাবার ভঙ্গিতে সে নিজেই বাক্সের ঢাকনিটা বন্ধ করে দেয়। বাকি দুজন দড়াবাজ বাবরের সামনে মাথা নত করে সম্মান জানালে সে তাদের দিকে সোনার মোহর ছুঁড়ে দেয়। তারপরে তারা বাক্সটা তুলে নিয়ে তুমুল হাততালির ভিতরে কামরা ত্যাগ করে।
ধিনিক তাতা আওয়াজ আর ছন্দোবদ্ধ পদাঘাতে নিজেদের আগমন ঘোষণা করে। পরিচারকদের প্রবেশের দরজা দিয়ে খালি পায়ে আটজন মেয়ে নাচতে নাচতে কামরায় প্রবেশ করে। আরেকটা প্রবেশ পথ দিয়ে বাদ্যযন্ত্রীর দল প্রবেশ করে। মেয়েরা বাবরের সামনে একটা বৃত্ত তৈরি করে। তাদের ঘন কালো চুল মিষ্টি গন্ধযুক্ত সাদা ফুল দিয়ে বেণী করে বাঁধা। লাল আর বেগুনী রঙের অনেক স্তর বিশিষ্ট ঘাঘড়ার উপরে তাদের উদরের অংশটা নগ্ন। আঁটসাঁটো রেশমের কাচুলি তাদের স্তনের অধিকাংশই ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের কব্জি আর পায়ের গোড়ালীতে ছোট ছোট ঘণ্টা সারিবদ্ধভাবে আটকানো। ঢোলা সাদা পাজামা আর বুক ভোলা সোনালী রঙের আটসাট বান্ডি পরিহিত ছয়জন বাদকের দল তাদের গলা। থেকে ঝোলানো সরু ঢোলে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে তালে তালে দুলতে আর লাফাতে থাকে। বাঈজি মেয়েদের দেহ বাজনার সাথে সাথে আন্দোলিত হতে শুরু করে। শীঘ্রই তারা দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকে, ঘাঘড়া উঠে গিয়ে তাদের সুন্দর সুগঠিত পা উন্মুক্ত করে তুলে, আর হাত হেলান মাথার পিছনে দেয়া। নাচের তালে তালে তারা গান গাইতে থাকে। তাদের সুরেলা কিন্নরী কণ্ঠ ঢেউয়ের মতো উঠতে আর নামতে থাকে।
অন্য বাদ্যযন্ত্রীরা এবার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যোগ দেয়। এসব বাদ্যযন্ত্র বাবর কখনও দেখেনি- বীণার মত দেখতে। কিন্তু মাথার দিকটা এক মিটার লম্বা। বাবর শুনেছে একে তানপুরা বলা হয়। আরেকটা তারের বাদ্যযন্ত্র যার উপরে নিচে দুটো বোল লাগানো এর নাম রুদ্রবীণা। আরেকটা বাঁশির মত যন্ত্র দেখতে অনেকটা ছোটখাট সূর্যের মতো দেখতে, একে বলে সানাই। বাবর অনুভব করে সাবলীল, তরুণী নাচিয়ে, ছন্দোবদ্ধ ঢোলের আওয়াজ, সুরেলা তন্ত্রীর মূচ্ছনা, আর সুরেলা কণ্ঠের উত্থানপতন সব মিলিয়ে পুরো নাচটার আবেদন তার নান্দনিকতার মতো কোনো কিছু তার মাতৃভূমিতে সে দেখেনি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবর বুঝতে পারে যে তার লোকদের রক্তে কাঁপন ধরিয়েছে বাঈজির দল, তারা এবার নাচতে শুরু করেছে। কেউ কেউ তাদের ছেড়ে আসা পাহাড় আর তৃণভূমির গান হেড়ে গলায় গাইতে শুরু করে। বাকিরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত হাত আঁকড়ে বুনো উদ্দাম নাচ শুরু করে পা দিয়ে তাল ঠুকে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বিজয় আর আনন্দের মুহূর্ত উদযাপদ করতে থাকে। হুমায়ুন অনেকক্ষণ উসখুস করে শেষে সেও গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়।
বাবর এসব এসব কিছু দেখে না। সে নিজের ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। সে বিজয়ের চেয়েও বড় কিছু একটা উদযাপন করছে। আজ রাতে তার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। যখন সে এতোদিন যা কিছু শিখেছে, যা কিছু অর্জন করেছে। সবকিছুকে একটা চূড়ান্ত রূপ দান করছে। কিন্তু উল্লাসের মাঝে একটা বিষাদের সুর ধ্বনিত হয়। এই ভোজসভায় আরেকজনেরও উপস্থিত থাকবার কথা ছিলো। সবকিছু উপভোগ করার কথা ছিলো তার সত্যিকারের বন্ধু এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতি। বাবর তার হাতের পানপাত্রটা তুলে নিয়ে সেই অনুপস্থিত বন্ধুর স্মরণে নিরবে একচুমুক পান করে।