নারীসমকামী
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৪ –গঠনের বছরগুলো। পরিচ্ছেদ ৪
নারীসমকামীর কথা ভাবতে গিয়ে আমরা সাধারণত ভাবি এমন এক নারীর কথা, যে পরে একটা সাদাসিধে ফেল্ট হ্যাট, যার ছোটো চুল, ও পরে একটা নেকটাই; তার পুরুষধরনের আকৃতি যেনো নির্দেশ করে হরমোনের কোনো অস্বাভাবিকতা। বিপর্যস্তকে ‘পুরুষালি’ নারীর সঙ্গে এভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলার থেকে কিছুই আর বেশি ভ্রান্তিপূর্ণ হতে পারে না। হারেমের বাসিন্দা, বেশ্যা, স্বেচ্ছাকৃতভাবে ‘নারীধর্মী’ নারীদের মধ্যে আছে বহু সমকামী; এর বিপরীতে বিপুল সংখ্যক ‘পুরুষালি’ নারী বিষমকামী। যৌনবিজ্ঞানী ও মনোবিশ্লেষকেরা এ সাধারণ পর্যবেক্ষণকে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছেন যে অধিকাংশ নারী ‘হোমো’ই ধাতে অন্য নারীদের মতোই। তাদের কাম কিছুতেই কোনো দেহসংস্থানগত ‘নিয়তি’ দ্বারা নির্ধারিত নয়।
তবে সন্দেহ নেই যে শারীরবৃত্তিক বৈশিষ্ট বিশেষ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। দুটি লিঙ্গের মধ্যে কোনো কঠোর জৈবিক স্বাতন্ত্র নেই : কিছু হরমোন ক্রিয়াকরে একটি অভিন্ন দেহের ওপর, যার অভিমুখ–পুরুষত্ব বা নারীত্বের দিকে নির্ধারিত হয় জিনসত্তা দিয়ে, তবে ভ্রূণের বিকাশের সময় এর গতিপথ কম-বেশি পাল্টে দেয়াসম্ভব, যার ফলে দেখা দেবে এমন ব্যক্তিরা, যারা কিছু কিছু ব্যাপারে পুরুষ ও নারীর মাঝামাঝি। কিছু পুরুষের মধ্যে থাকে নারীর বৈশিষ্ট্য, কেননা তাদের পুরুষাঙ্গ বিকাশে বিলম্ব ঘটেছিলো : এজন্যেই আমরা মাঝেমাঝে দেখতে পাই মেয়ে বলে গণ্য কিছু মেয়ে তাদের অনেকে বিশেষভাবে জড়িত থাকে খেলাধুলোয়-পরিবর্তিত হয়ে ছেলে হয়েওঠে। হেলেন ডয়েটশ এক তরুণী মেয়ের রোগের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, যে ব্যথভাবে প্রেম নিবেদন করে এক বিবাহিত নারীর কাছে, হরণ করে নিয়ে তার সাথে জীবন যাপন করতে চায়। পরে দেখা যায় সে আসলে ছিলো উভলিঙ্গ, এবং সে ওই নারীটিকে বিবাহবিচ্ছেদের পর বিয়ে করতে পেরেছিলো এবং অস্ত্রোপচারের পর তার অবস্থা স্বাভাবিক পুরুষের অবস্থা হয়ে উঠলে সে সন্তানও জন্ম দিতে পেরেছিলো। তবে কিছুতেই এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে প্রতিটি বিপর্যস্ত নারীই জৈবিকভাবে পুরুষ, যে উড়িয়ে চলছে প্রতারণামূলক পতাকা। উভলিঙ্গ, যার আছে উভয় লিঙ্গেরই কামপ্রত্যঙ্গ সংয়ের উপাদান, দেখাতে পারে নারীসুলভ কাম : আমি নিজেই চিনতাম এক নারীকে, নাটশিদের দ্বারা যে বহিষ্কৃত হয়েছিলো ভিয়েনা থেকে, তার দুঃখ ছিলো বিষমকামী পুরুষেরা বা সমকামীরা তার দিকে আকৃষ্ট হতো না, তবে সে নিজে আকর্ষণ বোধ করতো শুধু পুরুষদের প্রতি।
পুরুষ হরমোনের প্রভাবে ‘পুরুষালি’ বলে কথিত নারীদের মধ্যে দেখা দেয় পুরুষের অপ্রধান লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য, যেমন মুখে পশম গজায়; বালধর্মী নারীদের মধ্যে উনতা থাকতে পারে স্ত্রী হরমোনের এবং তাই তাদের বিকাশ সম্পূর্ণতা লাভ করে না। এসব বিশিষ্টতা কম-বেশি সরাসরিভাবে বিকাশ ঘটাতে পারে নারীসমকামী প্রবণতার।তেজস্বী, আক্রমণাত্মক, প্রাণোচ্ছল জীবনশক্তিসম্পন্ন নারী পছন্দ করে নিজেকে সক্রিয়ভাবে প্রদর্শন করতে এবং সাধারণত অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করে অক্রিয়তা; অনুগ্রহবঞ্চিত, বিকলাঙ্গ কোনো নারী তার নিকৃষ্টতার ক্ষতিপূরণ করতে পারে পুরুষধর্মী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে; যদি তার কামানুভূতি অবিকশিত থাকে, তাহলে সে পুরুষেরস্পর্শাদর কামনা করে না।
তবে দেহসংস্থান ও হরমোন শুধু প্রতিষ্ঠা করে একটি পরিস্থিতি এবং কোন দিকে পরিস্থিতিটির সীমাতিক্রমণ ঘটাতে হবে, তার লক্ষ্য নির্দেশ করে না। হেলেন ডয়েটশ প্রথম মহাযুদ্ধের পোলীয় অনীকিনীর এক তরুণ সৈনিকের কথা উল্লেখ করেছেন, যে আহত হয়ে তার কাছে আসে চিকিৎসার জন্যে এবং যে আসলে ছিলোসুস্পষ্টভাবে পুরুষের অপ্রধান লিঙ্গ-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক মেয়ে। সেবিকা হিশেবে সে যোগ দেয় সৈন্যবাহিনীতে, এবং তারপর সে সফল হয় তার লিঙ্গ গোপন করে সৈনিক হতে। তবে সে প্রেমে পড়ে এক সঙ্গীর, এবং পরে সে সম্পন্ন করে এক অনুকূল উপযোজন। তার আচরণে তার সঙ্গীদের মনে হয় যে সে এক পুরুষ সমকামী, তবে বাস্তবিকভাবে তার পুরুষধর্মী জাক সত্ত্বেও তার নারীত্ব আবার দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে নিজেকে। পুরুষ অবধারিতভাবে নারী কামনা করে না; পুরুষ সমকামীর যে থাকতে পারে একটি সুগঠিত পুরুষের দৈহিক গঠন, এটাই বোঝায় যে পুরুষধর্মী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো নারী সমকামিতার জন্যে অবধারিতভাবে দণ্ডিত নয়।
কখনো কখনো দাবি করা হয় যে বেশ স্বাভাবিক শারীরবৃত্তসম্পন্ন নারীদের মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে ‘ভগাঙ্গুরীয়’ ও ‘যোনীয়’ ধরনের নারী, এদের প্রথমটির নিয়তি সমকামী প্রেম। তবে আমরা দেখেছি সমস্ত শৈশব কামই ভগাঙ্কুরীয়; এটা এ-স্তরেই স্থিত হয়ে থাকুক বা রূপান্তরিত হোক, তা অঙ্গসংস্থানের ব্যাপার নয়; প্রায়ই যা বলা হয়ে থাকে যে শৈশবের হস্তমৈথুনের ফলে পরে প্রধান হয়ে ওঠে ভগাঙ্কুর, তাও সত্য নয় : আজকাল যৌনবিজ্ঞান শিশুর হস্তমৈথুনকে বেশ স্বাভাবিক ও ব্যাপক প্রপঞ্চ বলেই গণ্য করে। নারীর কামের বিকাশ, আমরা দেখেছি, একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, যা প্রভাবিত হয় শারীরবৃত্তিক ব্যাপার দিয়ে, তবে এটা নির্ভর করে অস্তিত্বের প্রতি ব্যক্তির মনোভাবের ওপর। মারানো মনে করতেন যে কাম এক সম্মিলিত গুণ এবং পুরুষের মধ্যে এটা যেখানে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে, সেখানে নারীর মধ্যে এটা থাকে অর্ধবিকশিত স্তরে; শুধু একটি নারীসমকামীরই থাকতে পারে পুরুষের মতো সমৃদ্ধ একটি লিবিডো, এবং সুতরাং সে নির্দেশ করে এক ‘শ্রেষ্ঠতর’ নারী-ধরন। তবে সত্য হচ্ছে যে নারীর কামের আছে এক নিজস্ব সংগঠন, এবং তাই পুরুষের ও নারীর লিবিডো প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠতা বা নিকৃষ্টতার কথা বলা নিরর্থক; কামের সামগ্রিরূপে সে কী বেছে নেবে, তা কিছুতেই নারীটির কর্মশক্তির ওপর নির্ভর করে না।
ফ্রয়েডের মতে, নারীর কামের পরিপক্বতার জন্যে ভগাঙ্কুরীয় স্তর থেকে যোনীয় স্তরে বদল দরকার, এ-পরিবর্তনটি শিশুর মায়ের প্রতি ভালোবাসা পিতার প্রতি ভালোবাসায় পরিবর্তিত করার সাথে প্রতিসম। নানা কারণে এ-বিকাশপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে; নারীটি তার ‘খোজা’ অবস্থা মেনে নাও নিতে পারে, তার শিশ্নের অভাবগোপন করে রাখতে পারে নিজের কাছেও এবং স্থিত হয়ে থাকতে পারে মায়ের ওপর, যার বিকল্প সে নিরন্তর খুঁজে চলে।
অ্যাডলারের মতে, এ-বিকাশ স্থগিত হওয়া অক্রিয়ভাবে ভোগ-করা দুর্ঘটনা নয় : এটা কামনা করেছে ব্যক্তিটিই, ক্ষমতাপ্রয়োগের ইচ্ছের মাধমে যে স্বেচ্ছায়প্রত্যাখ্যান করে তার অঙ্গহানি এবং পুরুষটির অধীনতা না মেনে অভিন্ন হয়ে উঠতে চায় তার সাথে। শিশুসুলভ সংবন্ধনের ব্যাপারই হোক বা হোক পুরুষালি প্রতিবাদের ব্যাপার, সমকামকে গণ্য করা হয় বিকাশরুদ্ধতার ব্যাপার বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমকামী নারী ‘উৎকৃষ্টতর’ নারীর থেকে অধিকতর ‘অবিকশিত’ নারী নয়। ব্যক্তির ইতিহাস কোনো নিয়তিনির্ধারিত অগ্রসরণ নয়। সমকামিতা নারীর কাছে হতে পারে তার পরিস্থিতি থেকে পলায়নের একটি রীতি বা একে স্বীকার করে নেয়ার ধরন। প্রথাগত নৈতিকতা অনুসরণের ফলে মনোবিশ্লেষকদের মহাভুলটি হচ্ছে সর্মমকে কখনোই একটি অস্বাভাবিক প্রবণতা ছাড়া অন্য কিছু বলে গণ্য না করা।
নারী এমন এক অস্তিত্বশীল সত্তা, যার প্রতি আহ্বান জানানো হয় নিজেকে একটি বস্তু করে তোলার জন্যে; কর্তা হিশেবে তার কামে আছে আক্রমণাত্মক উপাদান, যা পুরুষের শরীর দিয়ে পরিতৃপ্ত হয় না : তাই দেখা দেয় বিরোধ, যা কোনো উপায়ে মিটমাট করতে হয় তার কামের। সে-রীতিটিকেই স্বাভাবিক বা ‘প্রাকৃতিক’ বলে গণ্য করা হয় যেটি, তাকে কোনো পুরুষের কাছে শিকার হিশেবে ছেড়ে দিয়ে, তার কোলে একটা শিশু তুলে দিয়ে পুনরুদ্ধার করে তার সার্বভৌমত্ব : তবে এ-কল্পিত স্বাভাবিকত্ব তৈরি হয় কম-বেশি স্পষ্টভাবে উপলব্ধ সামাজিক স্বার্থে। এমনকি বিষম কামেও থাকে আরো নানা উপায়। নারীর সমকামিতা হচ্ছে তার মাংসের অক্রিয়তার সাথে তার স্বায়ত্তশাসলের বিরোধের মীমাংসা করার অন্যতম উদ্যোগ। এবং যদি প্রকৃতিকেই আবাহন করা হয়, তাহলে বলা যায় যে সব নারীই প্রাকৃতিকভাবে সমকামী। নারীসমকামীকে, প্রকৃতপক্ষে, চিহ্নিত করা হয় সে পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করে বলে এবং সে নারীদেহ পছন্দ করে বলে; তবে প্রতিটি তরুণী ভয় পায় বিদ্ধকরণ ও পুরুষাধিপত্য, এবং পুরুষের দেহের প্রতি বোধ করে এক রকম ঘৃণা; অন্যদিকে, নারীদেহ, তার কাছে, যেমন পুরুষের কাছে, এক কামনার বস্তু।
প্রায়ই চিহ্নিত করা হয় দু-ধরনের নারীসমকামী : ‘পুরুষধর্মী’, যারা ‘পুরুষের অনুকরণ করতে চায়’, ও ‘নারীধর্মী’, যারা ‘পুরুষকে ভয় পায়’। এটা সত্য যে সার্বিকভাবে শনাক্ত করা যায় বিপর্যস্ততার দুটি প্রবণতা; কিছু নারী অক্রিয়তা মেনে নেয় না, আর অন্য কিছু নারী চায় নারীর বাহু, যার ভেতরে তারা নিজেদের সমর্পণ করতে পারে অক্রিয়ভাবে। অনেক কারণে আমার ওপরের শ্রেণীকরণকে নিতান্তই খামখেয়ালি ব্যাপার বলে মনে হয়।
‘পুরুষধর্মী’ নারীসমকামীকে তার ‘পুরুষকে অনুকরণ করার’ ইচ্ছের সাহায্যে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে তাকে অস্বাভাবিক বলে নির্দেশ করা। ইতিমধ্যেই আমি দেখিয়েছি যে সমাজ এখন পুরুষধর্মী-নারীধর্মী বলে নির্দেশ করে থাকে যে-সব শ্ৰেণী, সেগুলো মেনে নিয়ে মনোবিশ্লেষকেরা সৃষ্টি করে থাকেন কতো অজস্র দ্ব্যর্থকতা। সত্য হচ্ছে যে পুরুষ আজ বোঝায় ধনাত্মকতা ও নিরপেক্ষতা–অর্থাৎ পুরুষ ও মানুষ। আর সেখানে নারী শুধুই ঋণাত্মক, স্ত্রীলিঙ্গ। যখনই নারী মানুষের মতো আচরণ করে, তখনই ঘোষণা করা হয় যে সে পুরুষের সাথে নিজেকে অভিন্ন করে তুলছে। খেলাধুলো, রাজনীতি, ও মননশীল ব্যাপারে তার কর্মকাণ্ড, অন্য নারীদের প্রতি তার যৌন কামনা, সব কিছুকে ব্যাখ্যা করা হয় ‘পুরুষধর্মী প্রতিবাদ’ বলে।
এ-ধরনের ব্যাখ্যার পেছনের প্রধান বিভ্রান্তিটি হচ্ছে যে স্ত্রীলিঙ্গ মানুষের পক্ষে নিজেকে নারীধর্মী নারী করে তোলাই প্রাকৃতিক : এ-আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে বিষমকামী হওয়া, এমনকি মা হওয়াও, যথেষ্ট নয় : ‘খাঁটি নারী’ সভ্যতার তৈরি এক কৃত্রিম বস্তু, যেমন আগের দিনে তৈরি করা হতো খোজা। ছেনালিপনা, বশমানার জন্যে তার প্রবৃত্তিগুলো আসলে প্রতিবোধনের ফল, যেমন প্রতিবোধনের ফল পুরুষের শিশ্নগর্ব। পুরুষ, প্রকৃতপক্ষে, সব সময় তার পুরুষপ্রবৃত্তিকে মেনে নেয় না; এবং নারীর জন্যে যে-প্রকৃতি নির্দেশ করা হয়, সেটিকে নারীর পক্ষে একটু কম বশ্যতার সাথে গ্রহণ করার বিশেষ কারণ রয়েছে। ‘হীনম্মন্যতা, গূঢ়ৈষা’ ও ‘পুরুষধর্মী গূঢ়ৈষা’ ধারণা আমাকে মনে করিয়ে দেয় দেনিস দ্য রজম এর পার দি দিবল-এর গল্প : এক মহিলা মনে করে পল্লীগ্রামে ঘোরাঘুরির সময় কিছু পাখি তাকে আক্রমণ করেছিলো; কয়েক মাস মানসিক চিকিৎসার পরও তার আবিষ্টতা কাটে না, ডাক্তার একদিন তার রোগীকে নিয়ে ক্লিনিকের বাগানে যান এবং দেখতে পান যে পাখি সত্যিই তাকে আক্রমণ করেছিলো! নারী হীনতা বোধ করে, কেননা আসলে নারীত্বের চাহিদাগুলো তাকে হীন করে তোলে। সে স্বতস্ফূর্তভাবে হয়ে উঠতে চায় একটি পরিপূর্ণ মানুষ, একজন কর্তা, একটি স্বাধীন সত্তা, যার সামনে খোলা আছে বিশ্ব ও ভবিষ্যৎ এবাসনাকে যে পুরুষধর্মিতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, তার কারণ হচ্ছে আজ নারীত্ব বোঝায়অঙ্গহানিত্ব। চিকিৎসকদের কাছে বিপর্যস্তরা যে-সব বিবৃতি দিয়েছে, সেগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে তাদের যা প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে, এমনকি শৈশবেও, তা। হচ্ছে তাদের নারীধর্মী বলে গণ্য করা। তারা বালিকাসুলভ কাজ করতে অপমান বোেধ করে, চায় ছেলেদের খেলা ও খেলার সামগ্রি; তারা করুণা করে নারীদের, তারা ভয় পায়রমণীয় হয়ে উঠতে, বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে তারা অস্বীকৃতি জানায়।
এ-বিদ্রোহ কিছুতেই কোনো পূর্বনির্ধারিত সমকামিতার দ্যোতনা করে না। কলেৎ অদ্রি বারো বছর বয়সে যখন আবিষ্কার করেন তিনি কখনো নাবিক হতে পারবেন না, তখন তিনি প্রচণ্ড আঘাত পান। তার লিঙ্গ তার ওপর যে-সীমাবদ্ধতা চাপিয়ে দেয়, তার জন্যে ভবিষ্যৎমুখি নারীর পক্ষে ক্রোধ বোধ করা খুবই স্বাভাবিক। সে কেনোএসব প্রত্যাখ্যান করবে, সেটা আসল প্রশ্ন নয় : বরং সমস্যাটি হচ্ছে একথা বোঝা যে কেননা সে মেনে নেবে এসব। নারী বশ্যতা ও ভীরুতার মাধ্যমে খাপ খাওয়ায়; কিন্তু এ-মেনে নেয়া সহজেই রূপান্তরিত হয় বিদ্রোহে, যদি সমাজ এর জন্যে যে-ক্ষতিপূরণ দেয়, সেগুলো অপ্রতুল হয়। এটাই ঘটবে সে-সব ক্ষেত্রে যেখানে কিশোরী বোধ করে যে সে নারী হিশেবে হীনভাবে সজ্জিত; বিশেষ করে এভাবেই দেহসংস্থানগত সম্পদগুলো হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ; যে-নারী মুখাবয়বে ও দেহকাঠামোয় কুৎসিত, বা নিজেকে সে অমন মনে করে, সে প্রত্যাখ্যান করে নারীধর্মী নিয়তি, ওই নিয়তির জন্যে নিজেকে তার মনে হয় অনুপযুক্ত। তবে একথা বলা ভুল হবে যে পুরুষধর্মী। প্রবণতা আয়ত্ত করা হয় নারীধর্মী বৈশিষ্ট্যগুলোর অভাবের ক্ষতিপূরণের জন্যে; বরং সত্য হচ্ছে পুরুষের সুবিধাগুলো বিসর্জনের বিনিময়ে কিশোরীকে যে-সব সুযোগসুবিধা দেয়া হয়, সেগুলো খুবই অকিঞ্চিৎকর।
এমনকি যদি তার একটি চমৎকার দেহ ও সুন্দর মুখও থাকে, তবুও যে-নারী মগ্ন নিজের উচ্চাভিলাষী কাজে বা যে-নারী নিতান্তই সাধারণভাবে মুক্তি পেতে চায়, আরেকটি মানুষের জন্যে নিজের কাজ ছেড়ে দিতে সে অস্বীকার করবে; সে নিজেকে উপলব্ধি করে নিজের কাজে, শুধু নিজের সীমাবদ্ধ দেহে নয় : পুরুষের যে-বাসনা তাকে ক্ষীণ করে আনে তার দেহের সীমানার মধ্যে, তা তাকে তোটাই আহত করে যতোটা আহত করে তরুণ ছেলেকে; সে বশীভূত নারীদের প্রতি ততোটা ঘেন্না বোধ করে একজন পৌরুষসম্পন্ন পুরুষ যতোটা ঘেন্না বোধ করে এটি অক্রিয় বালকসংসর্গকারীর প্রতি। এ-ধরনের নারীর সাথে দুষ্কর্মে তার সহযোগিতা আছে আংশিকভাবে এ-ধারণা অস্বীকার করার জন্যে সে নেয় পুরুষধর্মী মনোভাব; সে নেয় পুরুষের পোশাক, আচরণ, ভাষা; নারীধর্মী কোনো নারীসাথীর সঙ্গে সে গড়ে তোলে যুগল, যাতে সে নেয় পুরুষ মানুষের ভূমিকা : সত্যিই সে অভিনয় করে ‘পুরুষধর্মী প্রতিবাদ’-এর। কিন্তু এটা এক গৌণ প্রপঞ্চ; যা মুখ্য তা হচ্ছে মাংসল শিকারে রূপান্তরিত হওয়ার কথা ভাবতেই বিজয়ী ও সার্বভৌম কর্তা বোধ করে এক লজ্জাপূর্ণ প্রবল অনীহা। বহু নারী ক্রীড়াবিদ সমকামী, শরীর জ্ঞাপন করে পেশি, সক্রিয়তা, সাড়াদানপ্রবণতা, প্রচণ্ড বেগে ধারণ, তারা ওই শরীরকে অক্রিয় মাংস বলে গণ্য করে; এটা ঐন্দ্রজালিকভাবে প্রণয়পর্শ জাগায় না, এটা বিশ্বের সাথে কাজের একটি উপায়, বিশ্বে এটি নিতান্তই একটি বস্তুধর্মী জিনিশ নয় : নিজের-জন্যে-দেহ ও অন্যদের-জন্যে-দেহের মাঝখানে আছে যে-বিরাট ব্যবধান, এক্ষেত্রে তা দুস্তর মনে হয়। সদৃশ প্রতিরোধ দেখতে পাওয়াযাবে নির্বাহী ও মননশীল ধরনের নারীদের মধ্যে, যাদের পক্ষে সমর্পণ, এমনকি দেহও, অসম্ভব।
নারী চিত্রকর ও লেখকদের অনেকেই সমকামী। ব্যাপারটি এমন নয় যে তাদের যৌন-বিশিষ্টতা তাদের সৃষ্টিশীল শক্তির উৎস বা এ নয় যে এটা নির্দেশ করে শ্রেষ্ঠতর ধরনের শক্তি; বরং ব্যাপারটি হচ্ছে তারা গুরুত্বপূর্ণ কাজে মগ্ন বলে তারা একটা নারীধর্মী ভূমিকা পালন করে বা পুরুষের সাথে লড়াই করে সময় নষ্ট করতে চায়। পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার না করে তারা একে মেনে নেয়ার ভান করতে চায় না বা নিজেদের ক্লান্ত করতে চায় না প্রতিবাদ করে। তারা কামসুখের মধ্যে চায় শমন, প্রশমিতকরণ, ও বিনোদন : তারা এড়িয়ে চলে এমন সাথী, যে দেখা দেয় প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে; এবং এভাবে তারা নিজেদের মুক্ত রাখে নারীত্বের মধ্যে দ্যোতিত বেড়ি থেকে।
তবে নারীটি যদি হয় আধিপত্যধর্মী ব্যক্তিত্বের, তাহলে তার কাছে সমকামিতাকে সব সময় পুরোপুরি সন্তোষজনক সমাধান বলে মনে হয় না। সে যেহেতু চায়আত্মপ্রতিষ্ঠা, তাই তার নারীধর্মী সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না করা তার কাছে অসন্তোষজনক মনে হয়; বিষমকামী সম্পর্ককে তার একই সঙ্গে মনে হয় হীনকর ও সমৃদ্ধিকর; তার লিঙ্গের মধ্যে দ্যোতিত রয়েছে যে-সীমাবদ্ধতা, তা অস্বীকার করে তার মনে হয় সে নিজেকে সীমিত করছে অন্যভাবে। ঠিক যেমন কামশীতল নারী চায়কামসুখ যখন সে তা প্রত্যাখ্যান করে, ঠিক তেমনি নারীসমকামীও চাইতে পারে স্বাভাবিক ও পরিপূর্ণ নারী হতে, যদিও সে অমন না হওয়াই পছন্দ করে।
নারীসমকামী সানন্দে মেনে নিতে পারে তার নারীত্বের ক্ষতি, যদি এটা করে সে লাভ করে এক সফল পুরুষত্ব; যদিও কৃত্রিম উপায়ে সে দয়িতার সতীত্বমোচন করতে পারে ও তাকে অধিকার করতে পারে, তবুও সে খোজা ছাড়া আর কিছু নয়, এবং এবোধ থেকে সে পেতে পারে নিদারুণ কষ্ট। সে নারী হিশেবে অপরিপূর্ণ, পুরুষরূপে নপুংসক, এবং তার ব্যাধি পরিণত হতে পারে মনোবৈকল্যে। দালবিজকে এক রোগী বলেছিলো : ‘যদি বিদ্ধকরণের জন্যে আমার একটা কিছু থাকতো, তাহলে অনেক ভালো হতো’। আরেকজন চেয়েছিলো তার স্তন শক্ত হোক। নারীসমকামী প্রায়ই তার পুরুষত্বের নিকৃষ্টতার ক্ষতিপূরণ করতে চায় ঔদ্ধত্য দিয়ে, দেপ্রদর্শন করে, যা দিয়ে সে অস্বীকার করে একটা আন্তর ভারসাম্যহীনতাকে।
এর ওপর জোর দেয়া অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ যে নিজেকে বস্তুতে পরিণত করতে অস্বীকার সব সময় নারীকে সমকামিতার দিকে নিয়ে যায় না; উল্টোভাবে, অধিকাংশ নারীসমকামী চর্চা করতে চায় তাদের নারীত্বের সম্পদগুলোর। একটি অক্রিয় বস্তুতে পরিণত হতে ইচ্ছুক হওয়া ব্যক্তিতার সব দাবি অস্বীকার করা নয় : নিজেকে বস্তুর গুণবিশিষ্ট করে এভাবে নারী পোষণ করে করে তার আত্মসিদ্ধির আশা; তবে তখন সে নিজেকে লাভ করতে চেষ্টা করবে নিজের অপরত্বের মধ্যে, তার বিকল্প সত্তার মধ্যে। যখন সে একলা, তখন সে সত্যিই তার ডবল সৃষ্টি করতে সফল হয় না; যদি সে মর্দন করে নিজের স্তন, তবুও সে জানে না একটা অচেনা হাতের কাছে তার স্তন কেমন লাগতো, এও জানে না একটি অচেনা হাতের ছোঁয়ায় কেমন লাগতো তার স্তনের; একটি পুরুষ তার কাছে তার জন্যে প্রকাশ করতে পারে তার মাংসের অস্তিত্ব অর্থাৎ, সে নিজে তার দেহটিকে যেভাবে বোধ করে, সেভাবে, এটা অন্যদের কাছে যেমন, সেভাবে নয়। শুধু যখন তার আঙুল ধীরেধীরে চলে অন্য কোনো নারীর শরীরে এবং অন্য নারীর আঙুল ধীরেধীরে চলে তার শরীরে, তখনই সম্পন্ন হয় দর্পণের। অলৌকিক কাণ্ড। পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রেম একটি কর্ম; এতে প্রত্যেকে অপর হয়ে ওঠে নিজের থেকে ছিন্ন হয়ে। নারীদের মধ্যে প্রেম ধ্যানমগ্নতা; এ-প্রণয়স্পর্শের লক্ষ্য অন্যকে অধিকার করা নয়, এর লক্ষ্য ধীরেধীরে অন্যের মধ্য দিয়ে নিজেকে পুনর্মুষ্টি করা; লুপ্ত হয়ে যায় বিচ্ছিন্নতা, কোনো সগ্রাম নেই, জয় নেই, পরাজয় নেই; যথাযথ পারস্পরিকতায় একই সময়ে প্রত্যেকেই কর্তা ও কর্ম, প্রভু ও দাস; দ্বৈততা হয়ে ওঠে পারস্পরিকতা।
এ-প্রতিবিম্বন নিতে পারে একটা মাতধর্মী ছাঁচ; মা নিজেকে দেখতে পায় ও প্রক্ষেপ করে মেয়ের মধ্যে, এবং প্রায়ই মেয়ের প্রতি থাকে তার একটা যৌন আকর্ষণ; নারীসমকামীর সাথে তার আছে একটি অভিন্ন কামনা যে একটি নরম মাংসের বস্তুকে সে নিজের বাহুতে রক্ষা করবে এবং দোলাবে। কলেৎ প্রকাশ করেন এ-সাদৃশ্যটি, যখন তিনি ব্রিলে দ্য ল ভিন-এ লেখেন : ‘তুমি আনন্দ দেবে আমাকে, আমার ওপর বেঁকে পড়ে, যখন, মায়ের উদ্বেগে দু-চোখ ভরে, তুমি তোমার প্রতি সংরক্তজনের মধ্যে খোজো সে-শিশুকে, যাকে তুমি জন্ম দাও নি’; এবং রেনি ভিভিয়ে তার আরেকটি কবিতায় বিকাশ ঘটিয়েছেন একই ভাবাবেগের : ‘… তোমাকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে আমার বাহু দুটিকে করা হয়েছে উৎকৃষ্টতর… উষ্ণ দোলনার মতো যেখানে তুমি পাবে বিশ্রাম’।
সব প্রেমেই তা কামধর্মীই হোক বা হোক মাতৃধর্মী একই সঙ্গে আছে স্বার্থপরতা ও মহত্ত্ব, অপরকে অধিকার করার এবং অপরকে সব কিছু দেয়ার বাসনা; তবে মা ও নারীসমকামী একই রকম বিশেষ করে যতোটা মাত্রায় তারা উভয়েই আত্মরতিপরায়ণ, যতোটা অনুরক্ত তারা যথাক্রমে মেয়ের প্রতি বা বান্ধবীর প্রতি, তাদের প্রত্যেকের কাছে মেয়ে বা বন্ধু হচ্ছে নিজের প্রক্ষেপণ বা প্রতিফলন।
তবে আত্মরতি–মায়ের প্রতি সংবন্ধনের মতোই সব সময় সমকামিতার দিকে নিয়ে যায় না, উদাহরণস্বরূপ, এটা যেমন প্রমাণ হয়েছে মারি বাশকির্তসেভের বেলা, যাঁর লেখায় নারীর প্রতি প্রীতির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। তিনি ইন্দ্রিয়কাতর ছিলেন না, ছিলেন বুদ্ধিপ্রধান, এবং ছিলেন চরম আত্মভিমানী, বাল্যকাল থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন যে পুরুষেরা তাঁকে দেবে উচ্চমর্যাদা; তিনি শুধু তার প্রতিই আগ্রহী ছিলেন, যা বাড়াতে পারে তার গৌরব। যে নারী দেবতারূপে পুজো করে শুধু নিজেকে এবং যার লক্ষ্য সাধারণভাবে সাফল্য, সে অন্য নারীর প্রতি উষ্ণ অনুরাগ পোষণ করতে ব্যর্থ হয়; সে তাদের মধ্যে দেখতে পায় শুধু শক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বী।
সত্য হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী হেতু কখনোই মাত্র একটি নয়; সব সময়ই এটা এক পছন্দের ব্যাপার, যাতে পৌছোতে হয় একটা জটিল সামগ্রিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে, এবং একটা স্বাধীন সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে; কোনো যৌন নিয়তি নারীর জীবন নিয়ন্ত্রণ করেন বরং তার কামের ধরন জীবন সম্পর্কে তার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
তবে পছন্দের ওপর থাকে পারিবেশিক পরিস্থিতির বিশেষ প্রভাব। আজ দুটি লিঙ্গ সাধারণত যাপন করে বিচ্ছিন্ন জীবন : মেয়েদের আবাসিক বিদ্যালয়ে ও শিক্ষাআশ্রমে দ্রুত ঘটে অন্তরঙ্গতা থেকে যৌনতা; যে-সব পরিবেশে ছেলেমেয়েদের সংসর্গের ফলে বিষমকামী অভিজ্ঞতার সুযোগ বেশি, সেখানে নারীসমকামীর সংখ্যা অনেক কম। বহু নারী, যারা কারখানায় ও অফিসে নারীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে কাজ করে, যারা পুরুষ দেখতে পায় খুবই কম, তারা কামনাপূর্ণ বন্ধুত্ব গড়ে তোলে নারীদের সাথেই : তারা দেখতে পায় যে নিজেদের জীবন জড়িয়ে ফেলা তাদের জন্যে বস্তুগত ও নৈতিকভাবে সহজ। বিষমকামী সম্পর্কের অভাবে বা ওটা লাভ কঠিন হলে তারা বাধ্য হয় বিপর্যস্ত হতে। হাল-ছাড়া-ভাব ও অনুরাগের মধ্যে সীমারেখা টানা কঠিন : পুরুষ তাকে নিরাশ করেছে বলে কোনো নারী অন্য নারীদের প্রতি অনুরক্ত হতে পারে, তবে অনেক সময়ই পুরুষ তাকে নিরাশ করেছে এজন্যে যে পুরুষের মধ্যে সে আসলে খুঁজেছিলো নারী।
এসব কারণে সমকামী ও বিষমকামী নারীর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য করা ভুল। যখন একবার পার হয়ে যায় কৈশোরের অনিশ্চিত সময়, স্বাভাবিক পুরুষ নিজেকে আর সমকামী প্রমোদ আহরণ করতে দেয় না, কিন্তু স্বাভাবিক নারী প্রায়ই ফিরে আসে সেই প্রেমে–প্লাতোয়ী বা অপ্লাতোয়ী–যা মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো তার যৌবনকে। পুরুষ তাকে হতাশ করেছে বলে নারীর মধ্যে সে খুঁজতে পারে এমন একটি প্রেমিককে, যে স্থান নেবে সে-পুরুষের, যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তার সাথে। নারীর জীবনে নিষিদ্ধ সুখ প্রায়ই যে সান্ত্বনার কাজ করে, কলেৎ তা নির্দেশ করেছেন তার ভাগাবদ-এ : কিছু নারী তাদের সম্পূর্ণ জীবন কাটিয়ে দেয় এমন সান্তনায়।
অন্য দিকে, যে-নারী তার নারীত্ব উপভোগ করতে চায় নারীর বাহুবন্ধনে, সে গর্ববোধ করতে পারে যে সে কোনো প্রভুর আদেশ মানছে না। রেনি ভিভিয়েন ভীষণ ভালোবাসতেন নারীর সৌন্দর্য, এবং তিনি রূপসী হতে চাইতেন; তিনি নিজেকে সাজাতেন, গর্ববোধ করতেন নিজের দীর্ঘ চুলের; কিন্তু সুখ পেতেন স্বাধীন থাকতে, রক্ষণীয় থাকতে। তাঁর কবিতায় তিনি তিরস্কার করেছেন সে-সব নারীকে, যারা বিয়ের মাধ্যমে পুরুষের দাসী হতে রাজি হয়। কড়া পানীয়র প্রতি তাঁর অনুরাগ, কখনোকখনো তার অশ্লীল ভাষা প্রদর্শন করে তাঁর পৌরুষকামনা। অধিকাংশ যুগলেই প্রণয়স্পর্শ পারস্পরিক। তাই দুজন সঙ্গীর বিশেষ ভূমিকা কোনোক্রমেই সুনির্দিষ্টভাবে সুস্থিত নয় : শিশুসুলভ প্রকৃতির নারীটি ভুমিকা নিতে পারে সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত যুবকের, যে জড়িত আছে একজন নিরাপত্তাদাত্রী মাতৃর সাথে বা ভূমিকা নিতে পারে প্রেমিকের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ কোনো দয়িতার। তারা তাদের প্রেম উপভোগ করতে পারে সমান অবস্থানে থেকে। সঙ্গীরা যেহেতু সদৃশ, মূলত একই রকম, তাই সম্ভব সব ধরনের সমবায়, স্থানবিন্যাস, বিনিময়, রঙ্গ। দু-বন্ধুর প্রত্যেকের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি অনুসারে তাদের সম্পর্ক হয়ে ওঠে ভারসাম্যপূর্ণ। যদি তাদের একজন অপরকে সাহায্য ও ভরণপোষণ করে, সে নেয় পুরুষের ভূমিকা : স্বৈরাচারী রক্ষক, শোষিত ছলনাকারী, শ্রদ্ধেয় প্রভু ও মনিব, এবং কখনো কখনো বেশ্যার দালালের; নৈতিক, সামাজিক বা মননগত শ্রেষ্ঠত্ব তাকে দিতে পারে কর্তৃত্ব।
তবে এমন দৃষ্টান্ত বেশ দুর্লভ। অধিকাংশ নারীসমকামীই, যেমন আমরা দেখেছি, বাকসংযমের সাথে পুরুষদের এড়িয়ে চলে : কামশীতল নারীদের মতো তাদের। মধ্যেও আছে একটা বিরক্তি, ভীরুতা, গর্বের বোধ; তারা নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ বলে বোধ করে না; তাদের নারীসুলভ বিরক্তির সাথে যুক্ত হয় একটা পুরুষসুলভ হীনম্মন্যতাবোধ; পুরুষেরা এমন প্রতিপক্ষ, যারা পটিয়ে সম্ভোগের, অধিকারের, ও তাদের শিকারকে কবলে রাখার জন্যে উৎকৃষ্টতর রূপে সজ্জিত; পুরুষ নারীকে যেভাবে দূষিত করে, তা তারা অপছন্দ করে। পুরুষ পাচ্ছে সামাজিক সুযোগসুবিধা, এটা দেখে এবং পুরুষ তাদের থেকে শক্তিশালী, এটা অনুভব করেও তারা ক্রুদ্ধ হয় : প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে না পারা, এটা জানা যে সে তোমাকে এক মুষ্টাঘাতে ধরাশায়ী করতে পারে, এটা জ্বালা দেয়ার মতো অবমাননা। এ-জটিল শত্রুতার কারণেই কিছু নারীসমকামী নিজেদের করে তোলে দৃষ্টিআকর্ষক; তারা একসঙ্গে জড়ো হয়; সামাজিকভাবে ও কামে তাদের কোনো দরকার নেই পুরুষের, এটা দেখানোর জন্যে তারা গড়ে তোলে এক ধরনের সংঘ। এ থেকে শূন্যগর্ভ বড়াই ও অভিনয়ের স্তরে নেমে যাওয়া সহজ, যা উৎসারিত হয় আন্তরিকতাহীনতা থেকে। নারীসমকামী প্রথমে অভিনয় করে যে সে পুরুষ; তারপর নারীসমকামী হওয়ায় সে পরিণত হয় একটা শিকারে; পুরুষের পোশাক, প্রথমে যা ছিলো একটি ছদ্মবেশ, তা পরে হয়ে ওঠে উদি; এবং পুরুষের পীড়ন এড়ানোর নামে সে দাসী হয়ে ওঠে সেচরিত্রটির, যেটির সে অভিনয় করে; নারীর পরিস্থিতিতে বন্দী থাকতে না চেয়ে সে বন্দী হয়ে পড়েনারীসমকামীর পরিস্থিতিতে।
সত্য হচ্ছে সমকামিতা যতোটা ভাগ্যের অভিশাপ ততোটা স্বেচ্ছাকৃত বিকৃতি নয়। এটা এক বিশেষ পরিস্থিতিতে পছন্দ করা মনোভাব–অর্থাৎ, এটা একই সময়ে। প্রণোদিত ও স্বাধীনভাবে গৃহীত। এ-পছন্দকরণের সাথে জড়িত যে-সব ব্যাপার, সেগুলোর কোনোটিই–শারীরবৃত্তিক অবস্থা, মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস, সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান নয়, যদিও সবগুলোই এর ব্যাখ্যার জন্যে দরকার। নারীর পরিস্থিতি সাধারণভাবে যে-সমস্যা সৃষ্টি করে, এবং তার যৌন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যেবিশেষ সমস্যা, এটা তার সমাধানের অন্যতম উপায়। সমস্তু মানবিক আচরণের মতোই সমকামিতা নিয়ে যায় ভান, ভারসাম্যহীনতা, হতাশা, মিথ্যাচারের দিকে, বা উল্টোভাবে, এটা হয়ে ওঠে মূল্যবান অভিজ্ঞতাপুঞ্জের উৎস।