৪.৩ স্ট্রিলিং সেক্টরের কাছাকাছি

২৫.

“দেখ, স্ট্যাটিন,” বললেন সেলডন।

দুজনেই স্ট্রিলিং সেক্টরের কাছাকাছি একটা আবাসিক এলাকায় বৈকালিক পদভ্রমণে বেরিয়েছে। সেলডন রাস্তায় পড়ে থাকা কিছু পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ দেখালেন। কোনো গ্রাউণ্ড-কার থেকে খুলে পড়ে গেছে–অথবা অসতর্ক কোনো পথচারী ফেলে গেছে। “আগে এমন কোনো কিছু চোখেই পড়ত না। সিকিউরিটি অফিসাররা কড়া নজর রাখত আর পৌরসভার কর্মীরা দিন রাত আবাসিক এলাকাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে কোনো মানুষই এভাবে রাস্তায় নোংরা ফেলার কথা স্বপ্নেও ভাবত না। ট্র্যানটর আমাদের বাসস্থান; এই গ্রহ নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। আর এখন–“ বিষণ্ণ এবং হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন সেলডন–“এটা–“ আচমকা থেমে গেলেন।

“এই ছেলে!” রোগা এক ছেলের উদ্দেশ্যে চীৎকার করলেন তিনি। ছেলেটা কিছুক্ষণ আগেই উল্টো দিকে থেকে তাদেরকে অতিক্রম করে যায়। কোনো একটা খাদ্যদ্রব্য মুখে দিয়ে মোড়ানো রাংতা কাগজটা ফেলেছে রাস্তায়। “কাগজটা তুলে জায়গামতো ডিজপোজ কর।” আদেশ দিলেন তিনি।

ছেলেটা রাগত দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনে তুলেন।” তারপর চলে গেল নির্বিকার চিত্তে।

“সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আরেকটা উদাহরণ, আপনার সাইকোহিস্টোরি যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, প্রফেসর সেলডন।” মন্তব্য করল পালভার।

“হ্যাঁ, স্ট্যাটিন। আমাদের চারপাশে এম্পায়ার ভেঙ্গে পড়ছে, একটু একটু করে। সত্যি কথা বলতে কি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আর মেরামতের কোনো উপায় নেই। উদাসীনতা, অবক্ষয়, লোভ একদা গৌরবান্বিত এম্পায়ার ধ্বংসের জন্য তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেছে। কি হবে এখন? কেন–“

পালভারের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন সেলডন। তরুণ মনে হলো গভীর মনযোগ দিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করছে–সেলডনের কথা নয়, অন্য কিছু। একটা নির্দিষ্ট দিকে মাথা ঘুরিয়ে রেখেছে, সুদূরে হারিয়ে যাওয়ার মতো মুখভঙ্গী। যেন পালভার এমন কোনো শব্দ শোনার চেষ্টা করছে যা অন্যদের কানে পৌঁছবে না।

আচমকা বর্তমানে ফিরে এল সে। দ্রুত চারপাশে তাকাল, সেলডনের বাহু ধরে পালভার বলল, “হ্যারি, জলদি, আমাদের সরে পড়তে হবে। এসে পড়েছে…।” আর ঠিক তখনই অগ্রসরমান পায়ের শব্দে সন্ধ্যার নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে গেল। দ্রুত একটা চক্কর দিলেন সেলডন আর পালভার, কিন্তু দেরী হয়ে গেছে। একদল গুণ্ডা ঘিরে ফেলেছে তাদের। তৈরি ছিলেন সেলডন, ছড়িটা তুলে বৃত্তাকারে ঘোরালেন। আক্রমণকারীরা দুইজন ছেলে, একজন মেয়ে–তাতে হেসে উঠল।

“সহজে ধরা দিবেন না, তাইলে, বুড়া মিঞা?” গুণ্ডাদলের নেতা বলল। প্রত্যেকেরই বয়স কম, সবে কৈশোর পেরিয়েছে। “আমি আর আমার সঙ্গীরা মিল্যা দুই সেকেণ্ডে আপনারে শোয়াইয়া ফালামু। আমরা-” দলনেতা হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল, পেটে জোড়ালো এক লাথির স্বীকার। আক্রমণাত্মক ভঙ্গী নিল বাকী দুজন। কিন্তু পালভার আরো বেশী দ্রুত। কিসের আঘাত তা বোঝার আগেই মাটিতে শুয়ে পড়ল তারাও।

ছড়ির উপর দেহের পুরো ভার চাপিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন সেলডন, কতবড় বিপদ থেকে বাঁচলেন ভাবছেন তাই। পালভার উত্তেজনায় একটু হাঁপাচ্ছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ঘণায়মান অন্ধকার গম্বুজের নিচে জনশূন্য ফুটপাতে অচেতন শুয়ে আছে হামলাকারী তিনজন।

“চলুন, জলদি এখান থেকে কেটে পড়ি!” তাগাদা দিল পালভার। অবশ্য হামলাকারীদের ভয়ে পালাতে চাইছে না।

“স্ট্যাটিন, আমরা যেতে পারব না,” আপত্তি করলেন সেলডন। অচেতন তিনজনকে দেখিয়ে বললেন “এরা বাচ্চা ছেলে মেয়ে। মারা যাচ্ছে। এই অবস্থায় ফেলে রেখে কিভাবে যাই। কাজটা অমানবিক–আর মানবতা রক্ষার জন্যই আমি সারা জীবন কাজ করেছি।” বক্তব্যের জোর বোঝানোর জন্য মেঝেতে ছড়ি ঠুকলেন সেলডন।

“বোঝার চেষ্টা করুন,” বিরক্ত সুরে বলল পালভার। “এই গুণ্ডাগুলো আপনার মতো নিরীহ নাগরিকদের যে অত্যাচার করছে তাই অমানবিক। ওরা আপনাকে সুযোগ দিত? পেটে ছুড়ি ঢুকিয়ে সব ক্রেডিট নিয়ে যেত–যাওয়ার সময় আপনার মৃত দেহে লাথি মেরে যেত! কিছুই হবে না ওদের। জ্ঞান ফিরলে নিজেদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে নিজেরাই অথবা কেউ ওদেরকে এই অবস্থায় দেখে সেন্ট্রাল অফিসে খবর দেবে।

“কিন্তু, হ্যারি, চিন্তা করার সময় নেই। গতবার যা হয়েছে, আবার মারামারির দায়ে অভিযুক্ত হলে আর বাঁচবেন না। প্লীজ, হ্যারি, আমাদেরকে দ্রুত পালাতে হবে।” সেলডনের বাহু খামচে ধরল পালভার আর সেলডন শেষবারের মতো পিছনে তাকিয়ে পালভারের সবল হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন।

তাদের পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যেতেই গাছের আড়াল থেকে একটা ছায়া বেরিয়ে এল। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে রাগত চোখের ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল, “আমারে অনেক ভালোমন্দ শিখাইছেন, প্রফেসর।” তারপর সিকিউরিটি অফিসারদের ডেকে আনার জন্য ছুটল সে।

.

২৬.

“অর্ডার! অর্ডার।” গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বিচারক টেজান পপজেন্স লী আদেশ দিলেন। প্রফেসর র‍্যাভেন সেলডন এবং তার তরুণ সহকর্মী স্ট্যাটিন পালভারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শুনানী ট্রানটরের জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এই মানুষটিই দীর্ঘদিন থেকে এম্পায়ার ধ্বংসের এবং সভ্যতার পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছে, এই মানুষটিই সবাইকে সভ্যতার স্বর্ণযুগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে আসছে–এই সেই ব্যক্তি, একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য অনুযায়ী, যে বিনা উস্কানীতে ট্রানটরের নিরীহ তিনজন তরুণকে নৃশংসভাবে আহত করার আদেশ দেয়। ও হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে এটা হবে জমকালো একটা শুনানী এবং তারচেয়েও জমকালো বিচার অনুষ্ঠান।

বিচারক তার বেঞ্চের গর্তে ঢোকানো একটা বোম চাপলেন। জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে সুরেলা ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল। “অর্ডার,” হঠাৎ থমকে যাওয়া জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। প্রয়োজন হলে সবাইকে বের করে দেয়া হবে। দ্বিতীয়বার সাবধান করব না আমি।”

বিচারক একজন মহিলা। টকটকে লাল বর্ণের আলখাল্লা তাকে সত্যিই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। তার জন্ম লিস্টেনিয়ায়, গাত্রবর্ণ হালকা নীলাভ, যখন ব্যায়াম করেন তখন গায়ের রং আরো গাঢ় আকার ধারণ করে, আর যখন ভীষণ রেগে যান তখন বাস্তবিকই রক্তবর্ণ ধারণ করে। গুজব শোনা যায় যে, দীর্ঘ কর্মজীবনে দক্ষ আইনবিদ হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও ইম্পেরিয়াল আইনের একজন সংগঠক হওয়ার মতো যোগ্যতা সে কখনোই অর্জন করতে পারে নি, লীর সবুজাভ নীল মসৃণ ত্বকের সাথে গাঢ় লাল বর্ণের আলখাল্লা শুধুই অসার বহিঃপ্রকাশ।

তা সত্ত্বেও, ইম্পেরিয়াল আইনভঙ্গকারীদের শায়েস্তা করার ব্যাপারে লীর সুনাম আছে; সে অবশিষ্ট হাতে গোনা কয়েকজন বিচারকের একজন যারা এখনো সিভিল কোড বজায় রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট।

“আপনার কথা আমি শুনেছি, প্রফেসর সেলডন, এবং আমাদের অনিবার্য ধ্বংস নিয়ে আপনার তত্ত্ব। সেই ম্যাজিস্ট্রেটের সাথেও কথা বলেছি যার কাছে আরেকটা ঘটনার শুনানী হয়েছিল। আটজন গুণ্ডার হাত থেকে আপনার ছেলে আপনাকে বাঁচিয়ে আনে তাও শুনেছি। আমার যোগ্য সহকর্মীদের আপনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সবই ছিল নিখাদ আত্মরক্ষা। এবার, প্রফেসর সেলডন, আপনাকে আরো জোরালো প্রমাণ হাজির করতে হবে।”

যে তিন গুণ্ডা সেলডন এবং পালভারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে তারা বাদীর আসনে বসে আছে। আজকে তাদের চেহারা একেবারেই অন্যরকম। ছেলে দুজনের পরনে ঢিলা ইউনিট, মেয়েটা পড়েছে কুঁচি দেয়া টিউনিক। প্রথম দর্শনে সবাই তাদেরকে ট্র্যানটরিয়ান তারুণ্যের উজ্জ্বল প্রতীক ধরে নেবে।

সেলডনের আইনজীবী সিভ নোভকর (পালভারের জন্যও কাজ করছে সে) সামনে এগিয়ে এল। “ইওর অনার, আমার মক্কেল ট্র্যানটরিয়ান সমাজের সম্মানিত সদস্য। স্বনামধন্য প্রাক্তন ফার্স্ট মিনিস্টার। মহামাণ্য সম্রাট ষোড়শ এজিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তরুণদের উপর হামলা করে তার কি লাভ? ট্র্যানটরিয়ান তরুণদের সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ দানে তার কণ্ঠ সর্বদাই সোচ্চার। তার সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে বহু তরুণ শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে; স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফ্যাকাল্টি সদস্য তিনি।

“তাছাড়া–“ এখানে এসে বিরতি দিল নোভকার, জনাকীর্ণ আদালতে নজর বোলাল, যেন বলতে চাইছে, আমার কথা না শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা কর, তারপর তোমরা নিজেরাই লজ্জিত হবে। “প্রফেসর সেলডন হাতে গোণা অল্প কয়েকজন মর্যাদাবান ব্যক্তির একজন, যিনি অফিশিয়ালি গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর সাথে যুক্ত। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ সুসম্পন্ন করার খাতিরে লাইব্রেরীর যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারেন। কাজটা হলো এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা তৈরির কাজ, ইম্পেরিয়াল সভ্যতার যথার্থ বিজয় ইতিহাস।

“আমি বুঝতে পারছি না এমন সম্মানী মানুষের বিরুদ্ধে জঘন্য অভিযোগ কিভাবে উঠে?”

হাত দিয়ে নোকর বিবাদীদের আসনের দিকে ইঙ্গিত করল, যেখানে পালভারকে সাথে নিয়ে সেলডন বসে আছেন। অস্বস্তিতে গাল লাল হয়ে গেছে। এই ধরনের প্রশংসা শুনে তিনি অভ্যস্ত নন (তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তার নাম সবার মনে শুধু ঘৃণার উদ্রেক করেছে)। বিশ্বস্ত ছড়ির হাতলে মৃদু চাপড় মারলেন।

জাজ লী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, নোভকরের বক্তব্যে মোটেই প্রভাবিত হন নি। “কি লাভ হতে পারে, কাউন্সেলর। নিজেকেই অনেকবার প্রশ্নটা করেছি। যুক্তিসঙ্গত জবাবের খোঁজে গতরাতে আমি ঘুমাতে পারি নি। প্রফেসর সেলডনের মতো একজন মানুষ কেন বিনা উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হবেন যেখানে তিনি আমাদের সমাজ ব্যবস্থার তথাকথিত ‘পতনের একনিষ্ঠ প্রচারক।

“তারপর আচমকা জবাব পেয়ে যাই। যেহেতু তার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না তাই হতাশাগ্রস্ত সেলডন ধরে নেন যে সর্বনাশা বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করতে হবে। এই ব্যক্তি সারাজীবন এম্পায়ারের পতনের কথা প্রচার করে আসছে অথচ প্রমাণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন গম্বুজের কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া লাইট, মাঝে মাঝে নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট, দুই একটা জায়গায় বাজেটের কমতি তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। কিন্তু তার জীবনের উপর একবার বা দুবার আক্রমণ নিঃসন্দেহে বিবেচনার বিষয়।”

জোড়া হাত সামনে রেখে হেলান দিয়ে বসলেন লী। চেহারায় সম্ভষ্টি। টেবিলে পুরো র চাপিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সেলডন। অসম্ভব পরিশ্রম করে সামনে এগোলেন। হাতের ঠেলায় আইনজীবীকে একপাশে সরিয়ে বিচারকের কঠিন স্থির দৃষ্টির মুখোমুখী হলেন।

“ইওর অনার, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন দয়া করে।”

“নিশ্চয়ই, প্রফেসর সেলডন। হাজার হোক এটা তো কোনো ট্রায়াল নয়, একটা শুনানী। তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অভিযোগটাকে ট্রায়ালের পর্যায়ে নেয়া হবে কি হবে না। আমি আমার একটা যুক্তি উপস্থাপন করেছি। আপনার কি বলার আছে তা শুনতেও আমি আগ্রহী।”

শুরু করার আগে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন সেলডন। “আমি এম্পায়ারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। বিশ্বস্ততার সাথে সম্রাটদের সেবা করেছি। আমার আবিস্কৃত বিজ্ঞান ধ্বংসের বার্তাবাহক নয়, বরং পুনর্গঠনের প্রতিনিধি। এর সাহায্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব মানবসভ্যতাকে কোন পথে এগিয়ে যেতে হবে। যদি, আমার বিশ্বাস অনুযায়ী, এম্পায়ার ভাঙতেই থাকে, তাহলে পুরনো এম্পায়ারের সকল ভালো উপাদানকে ভিত্তি করে আরো উন্নত এক সভ্যতা গড়ে তোলার কাজে আমার সাইকোহিস্টোরি অবদান রাখবে। আমাদের বিশ্বগুলোকে আমি ভালোবাসি; জনগণকে ভালোবাসি, এম্পায়ারকে ভালোবাসি–আইন শৃঙ্খলার যে অবনতি প্রতিদিন এর ভিত্তি আরো দুর্বল করে দিচ্ছে তা আরো বাড়িয়ে আমার কি লাভ?

“এইটুকুই বলার ছিল। শুধু আশা করি আপনি বিশ্বাস করবেন। আমি বোধবুদ্ধি, সমীকরণ আর বিজ্ঞানের মানুষ–যা বলছি তা অন্তর থেকেই বলছি।” ঘুরে ধীর পায়ে পালভারের কাছে নিজের আসনে ফিরে এলেন সেলডন। বসার সময় দর্শকদের সারিতে ওয়ানডাকে খুঁজলেন। ওয়ানডা চোখ পিট পিট করে ফ্যাকাশে ভঙ্গীতে হাসল।

“অন্তর থেকে বলুন আর যাই বলুন, প্রফেসর সেলডন, ঘটনাটা আমাকে আরো গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য আমরা শুনেছি; আপনার এবং মি. পালভারের বক্তব্য শুনেছি। আর শুধু একজনের স্বীকারোক্তি আমার দরকার। মি. রিয়াল নিভাস, ঘটনাটার একজন প্রত্যক্ষ্যদর্শী।”

নিভাসকে দেখে সেলডন আর পালভার সতর্ক দৃষ্টি বিনিময় করলেন। হামলার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এই ছেলেটাকেই হ্যারি ধমক দিয়েছিলেন।

লী একটা প্রশ্ন করলেন। “মি. নিভাস, আমাদের একটু খুলে বলবে ঐ রাতে ঠিক কি দেখেছিলে তুমি?”

সেলডনের দিকে একবার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিভাস তার বক্তব্য শুরু করল, “আমি নিজের মনে হাঁটছিলাম, হঠাৎ ওই দুজনকে দেখি,”–আঙ্গুল তুলে সেলডন আর পালভারকে দেখাল সে–“রাস্তার অন্য পাশ থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। তারপর ওই তিনজনকে দেখি।” (এবার বাদীর আসনে বসা তিনজনকে আঙ্গুল তুলে দেখাল।) “বড় দুজন ওই তিনজনের পিছনে ছিল। আমাকে দেখে নি, কারণ আমি রাস্তার অন্যদিকে ছিলাম, তাছাড়া স্বীকারের প্রতিই ওদের নজর ছিল। তারপর ধুম। বুড়ো লোকটা লাঠি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় আর কম বয়স্ক লোকটা লাথি মেরে সবাইকে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর বুড়ো লোকটা তার সঙ্গীকে নিয়ে চলে যায়।”

“মিথ্যে কথা!” চীৎকার করলেন সেলডন। “ইয়ং ম্যান, তুমি আমাদের জীবন নিয়ে খেলছ!” নিভাস নির্বিকার ভঙ্গীতে তাকাল।

“জাজ,” অনুনয়ের সুরে বললেন সেলডন, “আপনি বুঝতে পারছেন না এটা নির্জলা মিথ্যা? হামলার মাত্র কয়েক মিনিট আগে রাস্তায় নোহরা ফেলার জন্য ছেলেটাকে ধমক দিয়েছিলাম। স্ট্যাটিনকে বলেছিলামও যে এটা সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার, জনগণের উদাসীনতার আরেকটা উদাহরণ—”

“যথেষ্ট হয়েছে, চাবুকের মতো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দিলেন বিচারক। “আর চীৎকার করলে আপনাকে আদালত থেকে বের করে দেয়া হবে। মি. নিভাস,” সাক্ষীর দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘটনাটা ঘটার সময় তুমি কি করছিলে?”

“আমি, লুকিয়ে ছিলাম। গাছের আড়ালে। দেখে ফেললে আমারও ক্ষতি করত। তাই পালিয়েছিলাম। ওরা চলে যাওয়ার পর দৌড়ে সিকিউরিটি অফিসারদের ডেকে আনি।”

ঘামতে শুরু করেছে নিভাস, ইউনিটের কলারে আঙ্গুল ঢোকালো। সাক্ষীর উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সে। এক পা থেকে আরেক পায়ের উপর দেহের ওজন বদলাচ্ছে অনরবত। জনতার দৃষ্টি যে তার উপর এটা বুঝতে পেরে অস্বস্তি বোধ করছে; চেষ্টা করছে দর্শকদের দিকে না তাকানোর, কিন্তু কিভাবে যেন তার চোখ সামনের সারিতে বসা চমৎকার সুদর্শনা সোনালী চুলের এক মেয়ের স্থির দৃষ্টির উপর আটকে যাচ্ছে। যেন মেয়েটা তাকে একটা প্রশ্ন করেছে, জবাবের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে, তাকে দিয়ে কথা বলাতে চাইছে।

“মি. নিভাস, প্রফেসর সেলডনের মন্তব্যের ব্যাপারে কি বলার আছে তোমার? ঘটনার পূর্ব মুহূর্তে সত্যিই তোমার সাথে ওদের কথা হয়েছিল?”

“আহ্, না। যা বলেছি… আমি হাঁটছিলাম এবং “ অভিযুক্তদের দিকে তাকাল নিভাস। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটাকে দেখলেন সেলডন যেন বোঝাতে চাইলেন সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেলডনের সঙ্গী শ্বাপদের দৃষ্টিতে তাকাল, চমকে উঠল নিভাস, কেঁপে উঠল শব্দটা শুনে–সত্যি কথা বল!–যেন পালভার তাকে নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু পালভার কোনো কথা বলে নি। দ্বিধাগ্রস্ত নিভাস ঝট করে সোনালী চুলের মেয়েটার দিকে মাথা ঘোরাল; মনে হলো মেয়েটা তাকে বলছে–সত্যি কথা বল! অথচ মেয়েটা কোনো কথা বলে নি।

“মি. নিভাস, মি. নিভাস,” কিশোরের এলোমেলো চিন্তা আরো গুলিয়ে দিল বিচারকের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। “তোমার বক্তব্য অনুযায়ী প্রফেসর সেলডন এবং মি. পালভার ছিল পিছনে, বাদী তিনজন ছিল সামনে। এগিয়ে আসছিল তোমার দিকে। তাহলে বাদী তিনজনকে প্রথমে না দেখে ওই দুজনকে প্রথমে দেখলে কিভাবে তুমি?”

খ্যাপাটে দৃষ্টিতে আদালত কক্ষের চারপাশে তাকাল নিভাস। মনে হলো কারো দৃষ্টি থেকে সে পালাতে পারবে না, প্রতি জোড়া চোখ যেন তার উদ্দেশ্যে চীৎকার করছে–সত্যি কথা বল। সেলডনের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে রিয়াল নিভাস বলল, “আমি দুঃখিত” এবং জনাকীর্ণ আদালতের প্রত্যেককে বিস্মিত করে চৌদ্দ বছরের বালক ভেঙে পড়ল কান্নায়।

.

৭.

চমৎকার একটা দিন, বেশী গরম না, বেশী ঠাণ্ডা না, বেশী উজ্জ্বল না বেশী মলিনও না। যদিও বহুবছর আগেই সমতল রক্ষণাবেক্ষণের বাজেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে ঢোকার চারপাশে আপনি গজিয়ে উঠা কিছু বারমেসে উদ্ভিদ সকালটাতে আরো খুশির আমেজ ছড়িয়ে দিয়েছে। (লাইব্রেরী ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যশৈলিতে তৈরি, সামনের বিশাল সিঁড়ির ধাপগুলো পুরো এম্পায়ারের মধ্যে সবচেয়ে বেশী জাঁকজমকপূর্ণ, যদিও ইম্পেরিয়াল প্যালেসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি। অধিকাংশ দর্শনার্থীই গ্লাইডরেইল ব্যবহার করতে বেশী পছন্দ করে) আজকের দিনটা নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী সেলডন।

তার আর পালভারের বিরুদ্ধে আনীত সাম্প্রতিক অভিযোগের সবগুলোই মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ায়, নিজেকে তার নতুন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। অভিজ্ঞতাটা বেদনাদায়ক হলেও এই ঘটনা মানুষকে তার প্রতি কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল করে তুলবে। জাজ টেজান পপজেন্স লী যদিও ট্রানটরের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিচারক নন, কিন্তু রিয়াল নিভাস এর আবেগময় স্বীকারোক্তির পরের দিন তার দেয়া বক্তব্য ব্যাপক সাড়া ফেলে।

“যখন আমাদের সভ্য সমাজ’ এমন এক প্রান্তে এসে দাঁড়ায়,” জাজ তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “যখন শুধুমাত্র নিজের বিশ্বাস এবং ধ্যানধারণার কারণে প্রফেসর হ্যারি সেলডনের মতো একজন সম্মানী নাগরিককে মিথ্যে অভিযোগে অপমানিত হতে হয়, তখন বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাদের এম্পায়ারের জন্য তা চরম দুর্দিন। স্বীকার করছি যে আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো নিজের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণ করার জন্য প্রফেসর সেলডন এই কূট কৌশল অবলম্বন করছেন। কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম।” ভুরু কুঁচকালেন জাজ, তার গলা এবং গালে গাঢ় নীল আভা ফুটে উঠল। “আমি প্রফেসর সেলডনকে এমন এক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য দোষারোপ করেছিলাম যে সমাজব্যবস্থায় সততা, ভদ্রতা এবং সুনামের কারণে একজন মানুষকে খুন হতে হয়, যে সমাজে নীতিহীনতা আর প্রতারণাই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।

“আমরা আমাদের নৈতিকতা থেকে কত দূরে সরে গেছি। ট্র্যানটরের প্রিয় নাগরিকবৃন্দ, আমরা ভাগ্যবান। আমাদের প্রকৃত স্বরূপ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য প্রফেসর সেলডন ধন্যবাদ পাওনা হয়েছেন; তার এই অবদানকে উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখে আসুন আমরা সবাই একত্রিত হয়ে আমাদের ভেতরের অশুভ সত্ত্বাকে প্রতিহত করি।”

তার পরপরই একটা হলো ডিস্কে করে অভিনন্দন বার্তা পাঠান সম্রাট এবং এই আশাও ব্যক্ত করেন যে এবার সেলডন তার প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য পেয়ে যাবেন।

গ্লাইড রেইল উপরে তোলার ভঙ্গীতেই সাইকোহিস্টোরির বর্তমান অবস্থা নিয়ে সেলডনের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু–প্রাক্তন চীফ লাইব্রেরীয়ান ল্যাস জিনো–অবসর নিয়েছেন। জিনো বরাবরই ছিলেন সেলডনের কাজের জোরালো সমর্থক, যদিও বোর্ডের বিরোধিতার কারণে তার হাত পা বাধা ছিল। কিন্তু সেলডনকে তিনি নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে নতুন চীফ লাইব্রেরীয়ান ট্রিমা এ্যাকার্নিও তার মতোই প্রগতিশীল, এবং বোর্ডের অনেক সদস্যের কাছে জনপ্রিয়।

“হ্যারি, মাই ফ্রেণ্ড,” ট্র্যানটর ছেড়ে নিজের হোম ওয়ার্ল্ড ওয়িনসরিতে যাওয়ার প্রাক্কালে জিনো বলেছিল, “এ্যাকার্নিও ভালো মানুষ, অসম্ভব জ্ঞানী এবং খোলা মনের। আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রজেক্ট এবং তোমাকে সাহায্য করার জন্য সব করবে সে। সাইকোহিস্টোরি এবং তোমার পুরো ডাটা ফাইল আমি ওর কাছে রেখে যাচ্ছি। আমি জানি মানব সভ্যতায় এর অবদান যে কি হবে তা ভেবে আমার মতোই সেও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। নিজের প্রতি যত্ন নিও, মাই ফ্রেণ্ড তোমার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে।”

এবং আজকে প্রথমবারের মতো নতুন চীফ লাইব্রেরীয়ানের সাথে অফিশিয়াল মিটিং-এ বসছেন সেলডন। ল্যাস জিনোর নিশ্চয়তা পেয়ে তিনি ভীষণ উফুল্ল এবং প্রজেক্ট আর এনসাইক্লোপিডিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খুলে বলার জন্য অধীর হয়ে আছেন।

সেলডনকে দেখে ট্রিমা এ্যাকার্নিও উঠে দাঁড়াল। চীফ লাইব্রেরীয়ানের অফিসে এরই মধ্যে সে নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এসেছে। যেখানে জিনো প্রতিটি ফাঁক ফোকর ভরে রেখেছিলেন ট্র্যানটরের বিভিন্ন সেক্টরের হল-ডিস্ক আর ত্রিমাত্রিক জার্নাল দিয়ে, তাছাড়া ঠিক মাঝখানে শূন্যে ঝোলানো ছিল একটা ভিজিগ্লোব, এম্পায়ারের প্রতিটি গ্রহ চিহ্নিত করা থাকত তাতে। এ্যাকার্নিও পাহাড় প্রমাণ তথ্যের বোঝা সব সরিয়ে ফেলেছে। একটা দেয়ালে আধিপত্য বিস্তার করেছে বিশাল এক হলোক্কীন, যেখানে সেলডনের ধারণা এ্যাকানিও ইচ্ছে হলেই যে কোনো সংস্করণ বা সম্প্রচার দেখতে পারে।

এ্যাকার্নিও বেটে কিন্তু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, খানিকটা ট্যারা দৃষ্টি–ছোট বেলার কোনো অপারেশন হয়তো ভুল পথে চলে গিয়েছিল। ফলে তার দৃষ্টিতে অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা এবং চারপাশের ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাবলীর উপর সীমাহীন সতর্কতা ফুটে উঠেছে।

“আসুন, আসুন, প্রফেসর সেলডন। বসুন।” ডেস্কের সামনে রাখা একটা খাড়া পিঠের চেয়ার দেখিয়ে বলল সে। “আপনি এই মিটিং-এর অনুরোধ করেছেন এটা আমার সৌভাগ্য। আমিও ভেবে রেখেছিলাম যে একটু গুছিয়ে বসার পর প্রথমেই আপনার সাথে দেখা করব।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। চীফ লাইব্রেরীয়ান এত ব্যস্ততার মাঝেও তার বিষয়টা মনে রেখেছেন বুঝতে পেরে খুশি হলেন।

“কিন্তু আমি প্রথমেই জানতে চাই, প্রফেসর সেলডন, কেন আপনি আগেই দেখা করতে চেয়েছেন?”

গলা পরিষ্কার করে সামনে ঝুকলেন সেলডন। “চীফ লাইব্রেরীয়ান, ল্যাস জিনো নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়েছে এখানে আমার কাজ এবং এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা তৈরির পরিকল্পনার কথা। ল্যাস যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন এবং যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। তিনি আমাকে একটা অফিসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লাইব্রেরীর প্রতিটি সুযোগ সুবিধা ইচ্ছেমতো ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি এনসাইক্লোপিডিয়া প্রজেক্টের ঘাঁটি কোথায় হবে সেটা তিনিই খুঁজে বের করেছেন। টার্মিনাস নামের একটা প্রত্যন্ত আউটার ওয়ার্ল্ডে।

“কিন্তু একটা সাহায্য ল্যাস আমাকে করতে পারেন নি। প্রজেক্টের শিডিউল ঠিক রাখার জন্য আমার কয়েকজন সহকর্মীরও এখানে অফিস এবং প্রতিটি সুযোগ সুবিধার প্রয়োজনমতো ব্যবহারের অনুমতি দরকার। এনসাইক্লোপিডিয়া সুসম্পন্ন করার মূল কাজ শুরুর পূর্বে প্রতিটি তথ্য কপি করে টার্মিনাসে পাঠানো, সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ।

“লাইব্রেরী বোর্ডের মাঝে ল্যাস জিনোর জনপ্রিয়তা ছিল না, আপনিও জানেন। কিন্তু আপনার আছে। তাই, চীফ লাইব্রেরীয়ান আমার অনুরোধ : আপনি কি আমার সহকর্মীদের এখানে এসে কাজ করার ব্যবস্থা করে দেবেন?”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন সেলডন। গতরাতে এই বক্তব্য মনে মনে বারবার অনুশীলন করেছেন এবং আশানুরূপ ফলাফলের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। এ্যাকার্নিওর জবাবের জন্য আত্মবিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

“প্রফেসর সেলডন,” এ্যাকার্নিও শুরু করল। সেলডনের প্রত্যাশার হাসিটা মলিন হয়ে গেল। চীফ লাইব্রেরীয়ানের কণ্ঠে এমন একটা ইঙ্গিত ছিল যা সেলডন আশা করেন নি। “আমার শ্রদ্ধেয় পূর্বসূরী আপনার গবেষণার ব্যাপারে সকল তথ্য–বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ আমাকে দিয়ে গেছেন। আপনার কাজের ব্যাপারে তিনি প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। আপনার সহকর্মীদেরও এখানে এসে স্থায়ীভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি, প্রফেসর সেলডন–“ বিরতি নেয়াতে ঝট করে তাকালেন সেলডন–“প্রথমে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একটা স্পেশাল মিটিং ডেকে সেখানে আপনি এবং আপনার এনসাইক্লোপেডিস্টদের জন্য বড় একটা অফিস অনুমোদনের প্রস্তাব করব। কিন্তু প্রফেসর সেলডন, পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।”

“পাল্টে গেছে। কিভাবে?”

“সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক আলোচিত সহিংস ঘটনার আপনি ছিলেন প্রধান অভিযুক্ত।”

“কিন্তু আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি,” ভাঙ্গা গলায় বললেন সেলডন। “অভিযোগটা এমনকি বিচারের উপযুক্তও বিবেচিত হয় নি।”

“তারপরেও, প্রফেসর, সাম্প্রতিক ঘটনাটা আপনাকে প্রমাণ করেছে–কিভাবে বলা যায়?–অশুভ বার্তাবাহক। হ্যাঁ, আপনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। কিন্তু সেজন্য আপনার নাম, আপনার অতীত, আপনার বিশ্বাস, আপনার গবেষণা ধাপে ধাপে প্রতিটি বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। একজন প্রগতিশীল বিচক্ষণ বিচারক আপনাকে নির্দোষ বলে রায় দিলেও লাখ লাখ–সম্ভবত কোটি কোটি সাধারণ জনতার কি হবে? জনতা দেখেছে যে সাইকোহিস্টোরির জনক তার সভ্যতার গৌরব ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম না করে বরং উন্মাদের মতো চিৎকার করে তা ধ্বংসের কথা বলছে।

“আপনি, আপনার কাজের দ্বারা এম্পায়ারের মূল ভিত্তিতে আঘাত করছেন। আমি নামহীন, পরিচয়হীন, নিষ্প্রাণ, বিশাল এম্পায়ারের কথা বলছি না। না, বরং এম্পায়ারের হৃদয় এবং আত্মার কথা বলছি–এর জনগণ, যখন আপনি বলছেন যে এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তখন আপনি আসলে তাদেরই ধ্বংসের কথা বলছেন। এই ব্যাপারটা, মাই ডিয়ার প্রফেসর, সাধারণ নাগরিকরা কখনোই মেনে নিতে পারবে না।

“সেলডন, পছন্দ হোক বা না হোক, আপনি উপহাসের বিষয়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বস্তু এবং হাস্যস্পদে পরিণত হয়েছেন।”

“মাফ করবেন, চীফ লাইব্রেরীয়ান, কিন্তু শুরু থেকেই আমি কয়েক শ্রেণীর মানুষের কাছে হাসির বিষয়।”

“হ্যাঁ, কয়েক শ্রেণীর মানুষের কাছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাটা–এবং যেভাবে মানুষের সামনে খোলাখুলি সংঘটিত হয়েছে তাতে আপনি প্রতিটি বিশ্বের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন। যদি আমরা আপনাকে একটা অফিস বরাদ্দ দেই তাহলে আপনার কাজে সরাসরি সমর্থন যোগানো হবে। ফলশ্রুতিতে আমরাও হাসির খোরাকে পরিণত হব। আপনার ধারণা এবং এনসাইক্লোপিডিয়া যত গভীরভাবেই বিশ্বাস করি না কেন, ট্র্যানটরের গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর চীফ লাইব্রেরীয়ান হিসেবে

আমাকে প্রথমে লাইব্রেরীর কথা ভাবতে হবে।

“কাজেই, প্রফেসর সেলডন, আপনার সহকর্মীদের এখানে নিয়ে আসার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হলো।”

প্রচণ্ড আঘাতে ঝট করে সোজা হয়ে বসলেন সেলডন।

“তাছাড়া,” এ্যাকার্নিও তখনো বলছে, “আগামী দুই সপ্তাহের জন্য লাইব্রেরীর সকল সুযোগ সুবিধা ব্যবহারের অনুমতি সাময়িকভাবে আপনার জন্য স্থগিত করা হলো। বোর্ডের স্পেশাল মিটিং হবে কিছুদিনের মধ্যেই। সেখানেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব আপনার সাথে চুক্তি নবায়ন করা হবে না শেষ করে দেয়া হবে।”

বিরতি নিল এ্যাকার্নিও। ডেস্কের চকচকে পৃষ্ঠদেশে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। “এই পর্যন্তই, প্রফেসর সেলডন–আপাততঃ।

হ্যারি সেলডনও উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু ভঙ্গীটা ট্রিমা এ্যাকার্নিওর মতো সবল এবং দ্রুত ছিল না।

“বোর্ডের সামনে কথা বলার সুযোগ পাব? সাইকোহিস্টোরি এবং এনসাইক্লোপিডিয়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলতে পারলেই–“

“সম্ভব নয়, প্রফেসর,” আন্তরিক সুরে বলল এ্যাকার্নিও। ল্যাস জিনোর বর্ণিত মানুষটাকে পলকের জন্য খুঁজে পেলেন সেলডন। কিন্তু আবেগহীন কর্মকর্তা মুহূর্তের মধ্যেই শীতল চাদরে নিজের মনোভাব লুকিয়ে ফেলল। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল সেলডনকে।

দরজা খোলার পর এ্যাকার্নিও বলল, “দুই সপ্তাহ, প্রফেসর সেলডন।”

এখন আমি কি করব? প্রচণ্ড হতাশার সাথে ভাবলেন সেলডন। সব কি তাহলে এখানেই শেষ হয়ে যাবে?

.

২৮.

“ওয়ানডা, কি নিয়ে এত ব্যস্ত তুমি?” স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ানডার অফিসে এসেছেন হ্যারি সেলডন। এটা ছিল প্রতিভাবান গণিতবিদ ইউগো এমারিলের অফিস। তার মৃত্যু সাইকোহিস্টোরির অগ্রগতি স্তব্ধ করে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে ইউগোর তৈরি করে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হয় ওয়ানডা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সে প্রাইম রেডিয়্যান্ট আরো নিখুঁত এবং কার্যকরী করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

“আমি সেকশন ৩৩-এইডি১৭-এর সমীকরণগুলো নিয়ে কাজ করছি। দেখ, নতুন ভাবে সাজিয়েছি।” মাঝের ছোট বেগুনী রং-এর অংশের দিকে ইশারা করল সে–“প্রচলিত ভাগফল বিবেচনা করে এবং এই যে! ঠিক যা ভেবেছিলাম।” পিছিয়ে দুহাতে চোখ ডলল।

“কি এটা, ওয়ানডা?” সমীকরণটা দেখার জন্য হ্যারি আরো কাছে এগিয়ে গেলেন। “এটা টার্মিনাস সমীকরণ অথচ… ওয়ানডা, এটা টার্মিনাস সমীকরণের বিপরীত সমাধান, তাই না?”

“হ্যাঁ, দাদু। সংখ্যাগুলো টার্মিনাস সমীকরণে ঠিকমতো কাজ করছিল না দেখ।” দেয়ালের একটা কন্টাক্ট চাপতেই কামরার অপর প্রান্তে বিবিধ লাল বর্ণের আরেকটা অংশ জীবন্ত হয়ে উঠল। সেলডন আর ওয়ানডা তা দেখার জন্য সেদিকে হেঁটে গেলেন। “দেখ এখন কেমন সুন্দর ভাবে মিলে গেছে। কয়েক সপ্তাহ লেগেছে সমাধানটা বের করতে।”

“কিভাবে করলে?” সমাধানটা খুটিয়ে দেখে প্রশংসার সুরে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“প্রথমে আমি এই অংশের উপর মনযোগ দেই। বাকী সবগুলো বন্ধ করে দেই। টার্মিনাসকে কাজে লাগাতে হলে টার্মিনাসের উপরই কাজ করতে হবে–এটাই যুক্তিসিদ্ধ, তাই না? কিন্তু তারপর বুঝতে পারি যে এই সমীকরণটা ইচ্ছে হলেই প্রাইম রেডিয়্যান্টে ঢুকিয়ে আশা করতে পারি না যে বাকীগুলোর সাথে খাপে খাপে মিলে যাবে। নতুন একটা সংযুক্তি মানে অন্য কোথাও বিচ্যুতি। প্রতিটি ওজনেরই একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।”

“তুমি যে ধারণার কথা বলছ প্রাচীন যুগে সম্ভবত এটাকেই বলা হতো ইন অ্যাণ্ড ইয়াং।”

“হ্যাঁ, মোটামুটি তাই, ইন অ্যাণ্ড ইয়াং। টার্মিনাসের ইন নিখুঁত করার জন্য আমাকে এর ইয়াং খুঁজে বের করতে হয়েছে। এবং তা করেছি ওখানে।” অপর প্রান্তের বেগুনী অংশের কাছে ফিরে এল সে। “সংখ্যাগুলো এখানে সমন্বয় করতেই টার্মিনাস সমীকরণ জায়গামতো বসে যায়। ছন্দের মতো।” ওয়ানডাকে সন্তুষ্ট দেখাল, যেন এম্পায়ারের তাবৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে।

“চমৎকার। পরে আমাকে বুঝিয়ে বলবে প্রজেক্টে এই সমীকরণের তাৎপর্য কি হতে পারে। এখন আমার সাথে হলোস্ক্রীণের সামনে চল। সান্তানী থেকে জরুরী সংবাদ পেয়েছি। তোমার বাবা যোগাযোগ করতে বলেছে।”

ওয়ানডার মুখের হাসি মুছে গেল। সান্তানীর সাম্প্রতিক লড়াইয়ের খবর সে জানে। ইম্পেরিয়াল বাজেট হ্রাস কার্যকরী হওয়ার সাথে সাথে, আউটার ওয়ার্ল্ডের জনগণকেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বেশী। জনবহুল সমৃদ্ধশালী ইনার ওয়ার্ল্ডে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়েছে। তাদের গ্রহের উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানী বর্তমানে অনেক কঠিন। অল্প কয়েকটা ইম্পেরিয়াল হাইপারশিপ সান্তানিতে যেতে পারছে বা সাতানী থেকে আসছে। দূরবর্তী গ্রহটা ধরে নেয় যে এম্পায়র থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। গ্রহের স্থানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

“দাদু, সব ঠিক আছে তো?” ওয়ানডার কণ্ঠেই তার মনের ভয় প্রকাশ পেয়ে গেল।

“দুঃশ্চিন্তা করো না। রাইখ যখন যোগাযোগ করতে পেরেছে তাহলে কোনো বিপদ হয় নি।”

সেলডনের অফিসে হলোস্ক্রীণের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দুজনে। স্ক্রীণের পাশের কী প্যাডে নির্দিষ্ট সংখ্যাগুলো ঢোকালেন সেলডন। ইন্টার গ্যালাকটিক যোগযোগ স্থাপনের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। মনে হলো স্ক্রীণটা ধীরে ধীরে দেয়ালে প্রসারিত হচ্ছে, যেন কোনো টানেলের প্রবেশ পথ। আর সেই টানেলের মুখে প্রথমে ঝাপসাভাবে ছোটখাটো সবল এক পুরুষের আকৃতি ফুটে উঠল। যোগাযোগ আরো নিখুঁত হতেই আকৃতিটাও পরিষ্কার হলো। সেলডন আর ওয়ানডা যখন রাইখের অতি পরিচিত ডালাইট গোঁফ চিনতে পেরেছে ততক্ষণে পুরো স্ক্রীণটা জীবন্ত হয়ে উঠল।

“বাবা! ওয়ানডা!” সান্তানি থেকে ট্র্যানটরে প্রক্ষেপিত রাইখের ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাম বলল। “শোন, হাতে বেশী সময় নেই।” তার পুরো দেহটা সংকুচিত হয়ে গেল, যেন প্রচণ্ড কোনো শব্দে ভয় পেয়েছে। এখানে অবস্থা ভীষণ খারাপ। সরকারকে হটিয়ে স্থানীয় একটা বিদ্রোহী দল ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। মানীলা আর বেলিসকে এ্যানাক্ৰিয়নের একটা হাইপারশিপে তুলে দিয়েছি। ওখানে পৌঁছে তোমাদের সাথে যোগাযোগ করবে, শিপের নাম আর্কেডিয়া V11।

“মানীলাকে যদি দেখতে, বাবা। যদি দেখতে, বাবা। উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র বেলিসের নিরাপত্তার কথা বলেই ওকে রাজী করাতে পেরেছি।

“আমি জানি তোমরা কি ভাবছ। সম্ভব হলে আমিও যেতাম–কিন্তু জায়গা ছিল না। মানীলা আর বেলিসকে শিপে উঠানোর জন্য কি যে করেছি যদি দেখতে।” ঠোঁট বাঁকিয়ে দেতো হাসল রাইখ। তার এই হাসিটা সেলডন আর ওয়ানডা ভীষণ পছন্দ করে। তারপর আবার শুরু করল, “তাছাড়া, আমি যেহেতু এখানে আছি তখন বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষার জন্য সাহায্য করতে পারব–আমরা হয়তো ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের অংশ কিন্তু আমরা জ্ঞান এবং নির্মাণের ধারক, ধ্বংসের নই। মাথামোটা সান্তানি বিদ্রোহীদের কেউ যদি ধারে কাছে আসে–“

“বাবা, তোমার কোনো বিপদ হবে না তো?” ওয়ানডা জিজ্ঞেস করল।

তাদের কথাগুলো গ্যালাক্সির নয় হাজার পারসেক দূরত্ব পাড়ি দিয়ে জায়গামতো পৌঁছতে সময় লাগল কিছুটা।

“আমি–আমি তোমাদের কথা শুনতে পারছি না।” হলোগ্রাম জবাব দিল। “ছোটখাটো লড়াই চলছে। বেশ উত্তেজনা।” রাইখ আবার দেতো হাসল। “আমি এখনই নাম লেখাচ্ছি। আর্কেডিয়া V11 এর কি হয়েছে খোঁজ নেবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার যোগাযোগ করব আমি। মনে রাখবে, আমি–“ হলোগ্রাম মুছে গেল কারণ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সেলডন আর ওয়ানডা তাকিয়ে রইলেন ফাঁকা দেয়ালের দিকে।

“দাদু, বাবা কি বলতে চেয়েছিল?”

“বুঝতে পারছি না। তবে একটা ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে তোমার বাবা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। যে বিদ্রোহীরা ওর কাছাকাছি যাবে তাদের জন্য আমার করুণা হচ্ছে! চল, সমীকরণগুলো আমাকে বুঝিয়ে দাও। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এসে আর্কেডিয়া V11 এর খোঁজ নেব।”

.

“কমাণ্ডার, ওই শিপের কি হয়েছে আপনার কোনো ধারণা নেই?” আবার ইন্টার গ্যালাকটিক যোগাযোগ স্থাপন করেছেন হ্যারি সেলডন। তবে এবার এ্যানক্রিয়নে দায়িত্বরত ইম্পেরিয়াল নেভীর একজন কমাণ্ডারের সাথে। এই যোগাযোগের জন্য হলোস্ক্রীণের বদলে ভিজিস্ক্রীণ ব্যবহার করছেন–যা অনেক কম বাস্তবসম্মত এবং অনেক বেশী সরল।

“প্রফেসর, এ্যানক্রিয়ন বায়ুমণ্ডলে ঢোকার জন্য ওই নামের কোনো শিপ অনুরোধ জানায় নি। অবশ্য সান্তানীর সাথে যোগাযোগ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। শিপটা হয়তো সান্তানি-বেজড চ্যানেলে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।

“না, বরং আমার মনে হয় আর্কেডিয়া V11 গন্তব্য পরিবর্তন করেছে। হয়তো ভোরেগ অথবা স্যারিপ। ওই দুটো গ্রহে খোঁজ নিয়েছেন, প্রফেসর?”

“না, ক্লান্ত সুরে জবাব দিলেন সেলডন। “কিন্তু শিপটা এ্যানাক্ৰিয়নের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে কেন সেখানে যাবে না আমার মাথায় আসছে না। শিপটাকে খুঁজে বের করা আমার ভীষণ প্রয়োজন।”

“হয়তো,” আগ বাড়িয়ে বলল কমাণ্ডার, “শিপটা পারে নি। মানে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারে নি। বিদ্রোহীরা কাকে উড়িয়ে দিচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। লেজার বের করেই এমন ভাব করছে যেন সম্রাট এজিসকে মারছে। প্রফেসর, সীমান্তের জীবন আসলেই কঠিন।”

“ওই শিপে আমার ছেলের স্ত্রী আর তার মেয়ে আছে, কমাণ্ডার।” কঠিন সুরে বললেন সেলডন।

“ওহ্, আমি দুঃখিত প্রফেসর,” কমাণ্ডার লজ্জিত হলো। “কোনো সংবাদ পেলে সাথে সাথে আপনাকে জানাব।”

হতাশ হয়ে ভিজিঞ্জীণ বন্ধ করে দিলেন সেলডন। ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছেন। চল্লিশ বছর ধরেই তিনি জানতেন যে এমনটাই হবে–এই কথা মনে হওয়ায় খানিকটা মজাও পেলেন।

তিক্ত চাপা হাসি ফুটল মুখে। কমাণ্ডার হয়তো ভেবেছে যে সীমান্তের কঠিন জীবনের কথা বলে সেলডনকে চমকে দিতে পেরেছে। কিন্তু সীমান্তের কথা সবই জানেন সেলডন। নিখুঁত বুননের প্রান্তে আলগা সুতা থাকলে যেমন হয়, সুতাতে টান পড়লে পুরো বুননটাই খুলে যায়। তেমনিভাবে সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোর যুদ্ধবিগ্রহ আস্তে আস্তে বুনন খুলে কেন্দ্র–ট্র্যানটরের দিকে এগিয়ে আসবে।

মৃদু একটা শব্দে সচেতন হলেন সেলডন। ডোর সিগন্যাল। “কে?”

“দাদু,” ওয়ানডা ভেতরে ঢুকলল। “আমার ভয় করছে।”

“কেন?” উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন সেলডন। এ্যানাক্ৰিয়নের কমাণ্ডারের কাছ থেকে যা জেনেছেন–বা জানতে পারেন নি–তা এখনই ওয়ানডাকে বলতে চান না।

“যদিও ওরা অনেক দূরে থাকত, বাবা, মা আর বেলিসকে আমি অনুভব করতাম–অনুভব করতাম এখানে”–নিজের মাথার দিকে ইশারা করল–“এবং এখানে”–বুকের উপর হাত রাখল। “কিন্তু এখন, আজকে, ওদেরকে আমি অনুভব করতে পারছি না–অনুভূতিটা কমে গেছে, মনে হয় যেন আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে, গম্বুজের আলোগুলোর মতো। আমি এটা থামাতে চাই। ওদেরকে ফিরিয়ে আনতে চাই, কিন্তু পারছি না।”–“ওয়ানডা, এটা পরিবারকে নিয়ে তোমার দুঃশ্চিন্তা ছাড়া আর কিছু না। তুমি তো জানই এই ধরনের ঘটনা এম্পায়ারে প্রায়ই ঘটে চলেছে–একটা ছুতো পেলেই হলো। রাইখ, মানীলা আর বেলিসের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তোমার বাবা যে কোনোদিন যোগাযোগ করে বলবে যে সব ঠিক আছে। মানীলা আর বেলিস এ্যানক্রিয়নে মজার ছুটি কাটাবে। কপাল খারাপ আমাদের এখানে আমরা গলা পর্যন্ত কাজে ডুবে আছি। যাও, ঘুমাতে যাও আর ভালো চিন্তা কর। দেখো আগামীকাল গম্বুজের সূর্যালোকে সবকিছু অন্যরকম মনে হবে।”

“ঠিক আছে, দাদু,” কণ্ঠেই বোঝা গেল ওয়ানডা আশ্বস্ত হতে পারে নি। “কিন্তু আগামীকাল–যদি কোনো সংবাদ না পাই–আমাদেরকে–“

“ওয়ানডা, অপেক্ষা ছাড়া আর কি করতে পারি আমরা?” নরম সুরে বললেন সেলডন।

চলে গেল ওয়ানডা। দুঃশ্চিন্তার ভারে তার কাঁধ ঝুলে পড়েছে। সে চলে যাওয়ার পর নিজের উৎকণ্ঠায় ডুবে গেলেন হ্যারি।

রাইখ যোগাযোগ করার পর তিনদিন পেরিয়ে গেছে। তারপর আর কোনো খবর নেই। আর আজকে এ্যানক্রিয়নের ন্যাভাল কমাণ্ডার জানিয়েছে আর্কেডিয়া V11 নামের শিপের কোনো খবর পায় নি সে।

সকালের দিকে হ্যারি কয়েকবার সান্তানিতে যোগযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। যেন সান্তানি আর আর্কেডিয়া V11 এম্পায়ার থেকে ঝরে পড়েছে, ফুলের পাপড়ির মতো।

সেলডন জানেন এখন তাকে কি করতে হবে। এম্পায়ার হয়তো পরাজিত হয়েছে কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। তার ক্ষমতা এখনো অসীম। সম্রাট ষোড়শ এজিসের সাথে জরুরী যোগাযোগের বোম চাপলেন তিনি।

.

২৯.

“অবাক ব্যাপার–হ্যারি!” সেলডনের হলোস্ক্রীণের ভেতর থেকে এজিস বললেন। “যোগাযোগ করায় আমি খুশি হয়েছি। যদিও তুমি সবসময় আরো ফরমালি সামনাসামনি দেখা করতে চাও। যাই হোক, কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছ। জরুরী বিষয়টা কি?”

“সায়ার, আমার ছেলে তার স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে সান্তানিতে ছিল।”

“আহ্, সান্তানি,” বলার সময় সম্রাটের মুখ মলিন হয়ে গেল। “একদল বিপথগামী জঘন্য নীচ–“

“সায়ার, প্লীজ,” ইম্পেরিয়াল প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করেই মাঝখানে বাধা দিলেন সেলডন। তাতে সম্রাট যতটা না অবাক হলেন নিজে অবাক হলেন আরো বেশী। “আমার ছেলে মানীলা এবং বেলিসকে একটা হাইপারশীপে তুলে দিতে সক্ষম হয়, আর্কেডিয়া V11, গন্তব্য এ্যানক্রিয়ন। সে নিজে সান্তানিতে থেকে যায়। এটা তিনদিন আগের খবর। ওই শিপ এ্যানক্রিয়নে এখনো পৌঁছায় নি। আর আমার ছেলেরও কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। সান্তানিতে যোগাযোগ করে কোনো জবাব পাই নি। আর এখন তো সান্তানির সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে।

“প্লীজ, সায়ার, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?”

“হ্যারি, অফিশিয়ালি সান্তানির সাথে ট্রানটরের সকল যোগাযোগ বন্ধ। কিন্তু ওই গ্রহের কয়েকটা সেক্টরে আমার অনুগত এজেন্ট আছে যারা এখনো ধরা পড়ে নি। সরাসরি এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না আমি, কিন্তু ওদের কাছ থেকে যে সংবাদ পাচ্ছি তোমাকে জানানো যায়। যদিও সংবাদগুলো অতি মাত্রায় গোপনীয়, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব এবং তোমার অবস্থা বিবেচনা করে তোমাকে সেগুলো জানানোর ব্যবস্থা করব।

“এক ঘণ্টার ভেতর আরেকটা সংবাদের আশা করছি। পৌঁছানোর সাথে সাথে তোমাকে জানাব। এর মাঝে একজন এইডকে দায়িত্ব দিচ্ছি গত তিনদিনে সান্তানি থেকে আসা সকল তথ্য খুঁজে দেখবে রাইখ, মানীলা এবং বেলিস সেলডনের কোনো খবর আছে কিনা।”

“ধন্যবাদ, সায়ার। আমি কৃতজ্ঞ।” সম্রাটের প্রতিচ্ছবি অদৃশ্য হয়ে গেল হলোস্ক্রীণ থেকে। মাথা গুঁজে বসে রইলেন সেলডন।

“ধন্যবাদ, সায়ার। আমি কৃতজ্ঞ।” সম্রাটের প্রতিচ্ছবি অদৃশ্য হয়ে গেল হলোস্ক্রীণ থেকে। মাথা গুঁজে বসে রইলেন সেলডন।

ষাট মিনিট পরে, হ্যারি সেলডন তখনো ডেস্কে বসে সম্রাটের খবরের অপেক্ষা করছেন। গত এক ঘণ্টা ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় কঠিনতম মুহূর্ত। প্রথমটা হচ্ছে। ডর্স ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়।

হলোস্ক্রীণে মৃদু একটা শব্দ হলো। কন্টাক্ট চাপলেন সেলডন। এজিস এর চেহারা ভেসে উঠল।

“হ্যারি,” সম্রাট শুরু করলেন। কণ্ঠে হালকা বিষণ্ণতা মেশানো। “তোমার জন্য দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।”

“আমার ছেলে।”

“হ্যাঁ। সান্তানি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে বোমা হামলায় আজ সকালে রাইখ নিহত হয়। আমার সোর্সের মতে রাইখ জানত বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হবে কিন্তু নিজের দায়িত্ব ছেড়ে নড়তে রাজী হয় নি সে। বিদ্রোহীদের অধিকাংশই ছিল শিক্ষার্থী। রাইখ ধরে নিয়েছিল শিক্ষার্থীরা যদি বুঝতে পারে যে সে তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আছে তাহলে কখনোই… কিন্তু ঘৃণা সকল যুক্তিবোধকে হারিয়ে দিয়েছে।

“বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইম্পেরিয়াল। বিদ্রোহীরা ধরে নেয় যে নতুন ভাবে শুরু করার আগে ইম্পেরিয়াল সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে হবে। বোকা! কেন–“ থামলেন এজিস, হঠাৎ বুঝতে পারলেন সান্তানি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা নিয়ে সেলডনের কোনো মাথাব্যথা নেই। অন্তত এই মুহূর্তে।

“হ্যারি, এই কথা চিন্তা করে নিজেকে হয়তো সান্ত্বনা দিতে পারবে যে তোমার ছেলে জ্ঞান রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এম্পায়ারের জন্য লড়াই করে জীবন দেয় নি সে বরং জীবন দিয়েছে মানবজাতির জন্য।”

কাঁদছেন সেলডন। দুর্বল সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “মানীলা আর বেলিস? ওদের কি হয়েছে? আর্কেডিয়া V11 এর খোঁজ পেয়েছেন?”

“কোনো খোঁজ পাই নি, হ্যারি। আর্কেডিয়া V11 সান্তানি ত্যাগ করেছে ঠিকই কিন্তু তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। হয়তো বিদ্রোহীরা হাইজ্যাক করেছে অথবা বাধ্য হয়ে অন্য কোনো গ্রহে চলে গেছে–এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। ধন্যবাদ, এজিস। যদিও দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছেন কিন্তু যাই হোক একটা খোঁজ দিতে পেরেছেন। কিছু জানতে না পারাটা আরো কষ্টকর। আপনি সত্যিকারের একজন বন্ধু।”

“আর তাই, মাই ফ্রেণ্ড,” সম্রাট বললেন, “তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি–তোমার ছেলের স্মৃতির কাছে।” সম্রাটের প্রতিচ্ছবি স্ক্রীণ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হাতের উপর মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন সেলডন।

.

৩০.

ইউনিটের কোমরবন্ধনী আরো শক্ত করে বাঁধল ওয়ানডা। একটা হাত নিড়ানী তুলে আক্রমণ চালাল তার যত্নের বাগানে গজিয়ে উঠা আগাছার উপর। ছোট বাগানটা স্ট্রিলিং-এর সাইকোহিস্টোরি ভবনের বাইরে। সাধারণত তার বেশীরভাগ সময় কাটে নিজের অফিসে প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে। গণিতের জটিলতায় সে শান্তি খুঁজে পায়, এম্পায়ারের বর্তমান উম্মাদনার মাঝে সমীকরণগুলো তাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু যখন বাবা, মা আর ছোট বোনকে হারানোর কষ্ট তাকে অস্থির করে তুলে, যখন গবেষণার কাজও এই অসহনীয় কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে না, সে এখানে চলে আসে। কিছু উদ্ভিদ জন্মানোতে কোনোভাবে, এবং অতি সামান্য হলেও কষ্ট দূর করতে পারে।

ওয়ানডা বরাবরই ছিল হালকা পাতলা চমৎকার দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। কিন্তু একমাস আগে বাবার মৃত্যু এবং মানীলা আর বেলিসের অন্তর্ধানের পর সে দ্রুত ওজন হারাচ্ছে। হ্যারি সেলডন প্রাণপ্রিয় নাতনীর এই অনীহাতে হয়তো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেন কিন্তু নিজেই প্রচণ্ড শোকে মুহ্যমান হয়ে থাকাতে কিছুই লক্ষ্য করছেন না।

হ্যারি এবং ওয়ানডা সেলডনের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সেইসাথে সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের অবশিষ্ট সদস্যদের মাঝে। হাল ছেড়ে দিয়েছেন হ্যারি। স্ট্রিলিং সোলারিয়ামে একটা আর্মচেয়ারে বসে সময় কাটান তিনি, উদাস হয়ে চেয়ে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউঞ্জে দিকে, গায়ে মাখেন উজ্জ্বল বাতি থেকে ছড়িয়ে পড়া উষ্ণতা। প্রজেক্টের সদস্যরা ওয়ানডাকে জানিয়েছে যে, তার দেহরক্ষী, স্ট্যাটিন পালভার নামের এক তরুণ প্রায়ই সেলডনকে গম্বুজের নীচে হাঁটতে যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করে অথবা প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী করে তোলার চেষ্টা করে।

ওয়ানডা প্রাইম রেডিয়্যান্টের জটিল সমীকরণের মাঝে নিজেকে আরো গভীরভাবে ডুবিয়ে রেখেছে। সে অনুভব করতে পারে তার পিতামহ আজীবন সাধনা করে যে ভবিষ্যত নির্মাণ করতে চেয়েছেন এখন তা আকৃতি পাচ্ছে এবং পিতামহের কোনো ভুল হয় নি। এনসাইক্লোপেডিস্টদের টার্মিনাসেই যেতে হবে : ওরাই হবে ফাউণ্ডেশন।

আর সেকশন ৩৩২ডি১৭–ওয়ানডা জানে দ্বিতীয় অথবা গোপন ফাউণ্ডেশন বলতে সেলডন কি বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু কিভাবে? সেলডনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ওয়ানডা এই প্রজেক্ট এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। পরিবারের সবাইকে হারানোর শোক এতই প্রবল যে নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করার সামর্থ তার নেই।

প্রজেক্টের সদস্যরা। পঞ্চাশ বা তারও কম কয়েকজন হবে–যতদূর সম্ভব কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অধিকাংশই এনসাইক্লোপেডিস্ট। টার্মিনাসে যাওয়ার সময় কোন উপাদানগুলো নিয়ে যাবে তার ক্যাটালগ তৈরি করছে। অবশ্য যদি কখনো গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে পূর্ণ প্রবেশাধিকার পায়। এই মুহূর্তে কেবল বিশ্বাসের উপর ভর করেই কাজ করে যাচ্ছে। প্রফেসর সেলডন লাইব্রেরীতে তার ব্যক্তিগত অফিস হারিয়েছেন। সুতরাং অন্য কোনো সদস্য বিশেষ প্রবেশাধিকার। পাবে সেই আশা নেই বলতে গেলে।

অবশিষ্ট সদস্যরা (এনসাইক্লোপেডিস্টদের বাদ দিয়ে) ইতিহাস বিশ্লেষক এবং গণিতবিদ। ইতিহাসবিদরা মানুষের অতীত এবং বর্তমান আচরণ আর ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে গণিতবিদদের হাতে তুলে দেয়। গণিতবিদরা প্রাপ্ত ফলাফল বিশাল সাইকোহিস্টোরিক্যাল সমীকরণে বসানোর চেষ্টা করে। সময় সাপেক্ষ এবং ঘামঝরানো কঠিন কাজ।

বেশীরভাগ সদস্য চলে গেছে কারণ প্রতিদান অতি সামান্য সাইকোহিস্টোরিয়ানরা ট্র্যানটরে উপহাসের বিষয়। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে সেলডন বাধ্য হয়েছেন ব্যাপকহারে বেতন কমাতে। কিন্তু সেলডনের সক্রিয় উপস্থিতি সর্বদাই সদস্যদের আশ্বস্ত করত। নিঃসন্দেহে যে কয়েকজন সদস্য এখনো আছে তারা শুধু একটা কারণেই আছে : হ্যারি সেলডনের প্রতি তাদের অসম্ভব ভক্তি শ্রদ্ধা।

থাকবেই বা কেন? তিক্ত মনে ভাবল ওয়ানডা। মৃদু বাতাসে সোনালী চুলের কয়েক গোছা চোখের উপর চলে এসেছে। আনমনে সেগুলো সরিয়ে আবার আগাছা তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“মিস সেলডন, আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?” ঘুরে তাকাল ওয়ানডা। এক তরুণ–অনুমান করল বিশের কোঠায় হবে বয়স–সামনের শান। বাঁধানো পথে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথেই তরুণের বলিষ্ঠতা এবং অসম্ভব তীক্ষ্ণ মেধা অনুভব করতে পারল সে।

“চিনতে পেরেছি। তুমি দাদুর বডিগার্ড, তাই না? স্ট্যাটিন পালভার।

“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, মিস সেলডন,” জবাব দিল পালভার, তার গালে লাল আভা তৈরি হলো, যেন এই চমৎকার মেয়েটা তার নাম মনে রাখায় ভীষণ খুশি হয়েছে সে। “মিস সেলডন, আপনার দাদুর ব্যাপারেই কথা বলতে চাই। তাকে নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত। আমাদের কিছু একটা করতে হবে।”

“কি করতে হবে, মি. পালভার? আমার সব শেষ হয়ে গেছে। বাবার “ বড় ঢোক গিলল সে, মনে হলো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে–“মৃত্যু এবং মা আর ছোট বোন হারিয়ে যাওয়ার পর আমি শুধু প্রতিদিন সকালে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারি। সত্যি বলছি, ঘটনাটা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে, বুঝতে পারছ, তাই না?” তরুণ যে বুঝতে পেরেছে সেটা তার চোখের দিকে তাকিয়েই নিশ্চিত হয়ে গেল ওয়ানডা।

“মিস সেলডন, নরম সুরে বলল পালভার, “আপনার যে অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্ত আপনি আর সেলডন এখনো বেঁচে আছেন এবং আপনাদেরকেই প্রজেক্ট এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রফেসরকে দেখে মনে হয় হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আমার ধারণা, হয়তোবা আপনি আমরা–মিলে তার মনে নতুন আশা জাগিয়ে তুলতে পারব। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো অনুপ্রেরণা খুঁজে দিতে পারব।

আহ্, মি. পালভার, মনে মনে ভাবল ওয়ানডা। দাদু হয়তো ঠিক কাজটাই করছেন। আমার মনে হয় না সামনে এগোনোর আর কোনো অনুপ্রেরণা আছে। কিন্তু মুখে বলল, “দুঃখিত, মি. পালভার, আমার মাথায় তেমন কিছু আসছে না।” নিড়ানির ইশারায় গ্রাউণ্ডের দিকে দেখাল। “আমাকে হাতের কাজটা শেষ করতে হবে।”

“আমার মনে হয় না আপনার দাদু ঠিক কাজ করছেন। সামনে এগোনোর জন্য কোনো না কোনো অনুপ্রেরণা অবশ্যই আছে। আমাদেরকে শুধু তা খুঁজে বের করতে হবে।”

কথাগুলো পূর্ণ শক্তিতে ওয়ানডাকে আঘাত করল। সে কি ভাবছিল তা পালভার জানল কেমন করে? যদি না–“তুমি মাইণ্ড হ্যাঁণ্ডল করতে পার, তাই না? প্রশ্নটা করেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, যেন পালভারের জবাব শুনতে ভয় পাচ্ছে।

“হ্যাঁ, পারি,” জবাব দিল পালভার। “বোধহয় সবসময়ই পারতাম। অন্তত কখনো করি নি এমন মনে পড়ে না। অধিকাংশ সময়ই আমি সচেতন ভাবে করি না–কিভাবে যেন বুঝে ফেলি মানুষ কি ভাবছে–বা ভেবেছিল।

“মাঝে মাঝে,” ওয়ানডার কাছ থেকে বোধগম্যতার যে প্রবাহ ছুটে আসছে তা অনুভব করে দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে বলতে লাগল সে, “আরেকজনের কাছ থেকে একই তরঙ্গের একটা ঝলক টের পাই। যদিও সবসময় ভীড়ের মাঝে থাকার কারণে কখনো বুঝতে পারি নি সে কে। তবে আমি জানি আমার মতো আরো অনেকেই আছে–চারপাশে।”

প্রচণ্ড উত্তেজনায় পালভারের হাত আঁকড়ে ধরল ওয়ানডা। বাগানের যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে আছে পাশে, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। “তুমি বুঝতে পারছ, এর গুরুত্ব কতখানি? দাদুর জন্য, সাইকোহিস্টোরির জন্য? আমাদের একজনই অসাধ্য সাধন করতে পারে, দুজনে একসাথে–“ পালভারকে পথের উপর দাঁড় করিয়ে রেখে হন হন করে সাইকোহিস্টোরি ভবনের দিকে হাঁটা শুরু করল সে। ঠিক প্রবেশ পথের কাছে পৌঁছে ঘুরে বলল, “এসো, মি. পালভার। দাদুকে সব জানাতে হবে।” কথাগুলো ওয়ানডা বলল মুখ না খুলেই।

“হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।” ঠিক একই ভঙ্গীতে জবাব দিয়ে তার সাথে যোগ দিল পালভার।

.

৩১.

“অর্থাৎ ট্র্যানটরে পাগলের মতো যা খুঁজছি গত কয়েকমাস ধরেই তা আমাদের সাথে রয়েছে।” হ্যারি সেলডন বিশ্বাস করতে পারছেন না। হালকা নিদ্রা থেকে তুলে ওয়ানডা আর পালভার বিস্ময়কর তথ্যটা জানিয়েছে তাকে।

“হ্যাঁ, দাদু। ভেবে দেখ। স্ট্যাটিনের সাথে আমার কখনো দেখা হয় নি। তোমার সাথে বাইরে ঘুরত সে। আমি সবসময় নিজের অফিসে প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। কখন আমাদের দেখা হয়? সত্যি কথা বলতে কি যখন আমাদের দুজনের পথ পরস্পরকে অতিক্রম করে, ফলাফল ছিল তুলনাহীন।”

“কখন?” স্মৃতি হাতড়ে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“জাজ লী’র সামনে তোমার শেষ হিয়ারিং-এর সময়।” সাথে সাথে জবাব দিল ওয়ানডা। “মনে আছে, প্রত্যক্ষদর্শী কিভাবে হলফ করে বলেছিল তুমি আর স্ট্যাটিনই প্রথম হামলা কর? মনে আছে কিভাবে সে ভেঙ্গে পড়ে এবং সত্য স্বীকার করে–যদিও জানত না কেন। কিন্তু আমি আর স্ট্যাটিনই তা সম্ভব করেছি। আমরাই রিয়াল নিভাসকে সত্য কথা বলতে বাধ্য করেছি। নিজের মন্তব্যে সে দৃঢ় ছিল : শুধু একজন তার উপর জোর দিতে পারতাম কিনা আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু দুজনে মিলে–“ লাজুক চোরা চাহনীতে একটু দূরে দাঁড়ানো পালভারের দিকে তাকাল সে–“আমাদের শক্তি অসীম।”

বিষয়টা আত্মস্থ করতে একটু সময় নিলেন সেলডন। তারপর কথা বলার ভঙ্গী করলেন। কিন্তু তার আগেই ওয়ানডা বলল, “আজকে বিকালে আমাদের মেন্টালিক ক্ষমতা পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করেছি, পৃথকভাবে এবং একসাথে। যতদূর বুঝতে পেরেছি স্ট্যাটিনের শক্তি আমার চেয়ে কিছুটা কম। আমার রেটিং স্কেল অনুযায়ী। হয়তো পাঁচ মাত্রার। কিন্তু ওর পাঁচ আর আমার সাত যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে বারো। চিন্তা করে দেখ, তুলনাহীন।”

“বুঝতে পারছেন, প্রফেসর?” পালভার কথা বলল। “ওয়ানডা আর আমিই সেই ব্রেক থু যা আপনি খুঁজছিলেন। মহাবিশ্বের সামনে সাইকোহিস্টোরির উপযুক্ততা তুলে ধরার কাজে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারব; আমাদের মতো অন্যদের খুঁজে বের করার কাজে সাহায্য করতে পারব; সাইকোহিস্টোরি সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কাজে সাহায্য করতে পারব।”

সামনে দণ্ডায়মান দুই তরুণের দিকে তাকালেন হ্যারি সেলডন। তাদের মুখমণ্ডল তারুণ্য আর উৎসাহের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। বুঝতে পারলেন এই ঘটনা তার বৃদ্ধ হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে। হয়তো এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায় নি। ভাবেন নি যে বর্তমান দুঃখজনক ঘটনাটা তিনি সামলে উঠতে পারবেন, সন্তানের মৃত্যু, পুত্রবধূ এবং নাতনীর হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন রাইখ বেঁচে আছে ওয়ানডার মাঝে। ওয়ানডা আর পালভারের মাঝে বেঁচে আছে ফাউণ্ডেশনের ভবিষ্যৎ।

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।” প্রচণ্ড জোরে মাথা নেড়ে বললেন সেলডন। “ধর আমাকে। দাঁড় করাও। অফিসে যেতে হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে।”

.

৩২.

“আসুন, প্রফেসর সেলডন।” শীতল কণ্ঠে আমন্ত্রণ জানাল চীফ লাইব্রেরীয়ান ট্রিমা এ্যাকার্নিও। ওয়ানডা আর পালভারকে সাথে নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অফিসে ঢুকলেন হ্যারি সেলডন। বিশাল ডেস্কের বিপরীত পাশে চীফ লাইব্রেরীয়ানের মুখোমুখি বসলেন।

“ধন্যবাদ, চীফ লাইব্রেরীয়ান। পরিচয় করিয়ে দেই। আমার নাতনী ওয়ানডা সেলডন এবং আমার বন্ধু স্ট্যাটিন পালভার। ওয়ানডা সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তার বিশেষত্ব গণিত। আর স্ট্যাটিন–আসলে স্ট্যাটিনের মূল দায়িত্ব আমার বডিগার্ড। কিন্তু এর ফাঁকে ফাঁকে সে প্রথম শ্রেণীর জেনারেল সাইকোহিস্টোরিয়ান হয়ে উঠছে।” আমুদে ভঙ্গীতে মুচকি হাসলেন সেলডন।

“বেশ, শুনে খুশি হলাম, প্রফেসর।” এ্যাকার্নিও বলল, সেলডনের আচরণে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত। ধারণা করেছিল যে কাকুতি মিনতি করে লাইব্রেরীতে বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির অনুরোধ জানাবে আবার।

“কিন্তু বুঝতে পারছি না আপনি কেন এসেছেন। আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল : জনগণের নিকট ভীষণ রকম অপ্রিয় এমন কোনো ব্যক্তিকে আমরা লাইব্রেরীতে কাজ করার সুযোগ দিতে পারি না। হাজার হোক এটা একটা পাবলিক লাইব্রেরী এবং জনগণের অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে।” হেলান দিয়ে বসল এ্যাকার্নিও বোধহয় এবার কাকুতি মিনতি শুরু হবে।

“বুঝতে পেরেছি যে আপনাকে আমি বোঝাতে পারি নি। যাই হোক মনে হলো। যে আপনি যদি প্রজেক্টের তরুন সদস্য–ভবিষ্যতের সাইকোহিস্টোরিয়ান–তাদের মুখ থেকে শোনেন, তখন হয়তো পরিষ্কার অনুধাবন করতে পারবেন এই প্রজেক্ট বিশেষ করে এনসাইক্লোপিডিয়া–আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দয়া করে ওয়ানডা আর স্ট্যাটিনের বক্তব্য শুনুন।”

শীতল দৃষ্টিতে দুই নব্য সাইকোহিস্টোরিয়ানের দিকে তাকাল এ্যাকার্নিও। “বেশ, ঠিক আছে।” দেয়ালের টাইমস্ট্রিপের দিকে ইশারা করে বলল, “পাঁচ মিনিট। তার বেশী না। আমাকে একটা লাইব্রেরী চালাতে হয়।”

“চীফ লাইব্রেরীয়ান,” ওয়ানডা শুরু করল, “নিশ্চয়ই আমার দাদু আপনার কাছে ব্যাখ্যা করেছে যে সাইকোহিস্টোরি আমাদের সভ্যতা সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাতিয়ার। হ্যাঁ,” সংরক্ষণ শব্দটা শুনে চীফ লাইব্রেরীয়ানের দৃষ্টি কিছুটা প্রশস্ত হওয়ায় পুনরাবৃত্তি করল সে। “এম্পায়ার ধ্বংসের উপর অযৌক্তিক গুরুত্ব আরোপ করে সাইকোহিস্টোরির সত্যিকার মূল্য এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কারণ, সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে আমরা যেমন সভ্যতার অবশ্যম্ভাবী পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করতে সফল হয়েছি তেমনি তা সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেয়ার যোগ্যতাও অর্জন করেছি। আর তাই এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা তৈরি করতে হবে। এই কারণেই আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন এবং এই মহান লাইব্রেরীর।”

এ্যাকার্নিও না হেসে পারল না। তরুণীর মাঝে আলাদা এক আকর্ষণ আছে। ভীষণ আন্তরিক, চমৎকার কথা বলার ভঙ্গী। সোনালী চুলগুলো পিছন দিকে শক্ত ঝুটি বাঁধা, স্কলারদের মতে, এতে তার সৌন্দর্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্ব চাপা না পড়ে বরং আরো প্রকাশ হয়েছে। বক্তব্যটাও এখন ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। সে হয়তো সমস্যাটাকে ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছিল। বিষয়টা যদি হয় সংরক্ষণ, ধ্বংস নয়…

“চীফ লাইব্রেরীয়ান,” শুরু করল স্ট্যাটিন পালভার, “এই মহান লাইব্রেরী সহস্রাধিক বছর ধরে তার গৌরব সমুন্নত রেখেছে। সম্ভবত এম্পায়ারে ইম্পেরিয়াল প্যালেসের চাইতেও অনেক বেশী ক্ষমতার অধিকারী এই লাইব্রেরি। কারণ, প্যালেস শুধুমাত্র এম্পায়ারের নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু লাইব্রেরী হলো এম্পায়ারের অর্জিত সমস্ত জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সংরক্ষণাগার। এর মূল্য অসীম।

“এই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত নয় কি? আর এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকাই হবে যোগ্য প্রতিদান লাইব্রেরীর দেয়ালগুলোর ভেতরে ধারণকৃত জ্ঞানের বিশাল সারসংক্ষেপ। ভেবে দেখুন।”

হঠাৎ করেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল এ্যাকার্নিওর কাছে। কিভাবে সে বোর্ডের (বিশেষ করে মাথামোটা জিনারো মামেরির) কথায় প্রভাবিত হয়ে সেলডনের বিশেষ সুযোগগুলো বন্ধ করে দেয়? ল্যাস জিনো, যার বিচারবুদ্ধির উপর এ্যাকার্নিওর সীমাহীন আস্থা, সেও সেলডনের এনসাইক্লোপিডিয়ার সোচ্চার সমর্থক ছিল।

তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়রত তিনজনের দিকে তাকাল সে। সেলডনের সাথে যারা কাজ করছে এই অল্পবয়স্ক দুজন যদি তাদেরই নমুনা হয়ে থাকে তাহলে প্রজেক্টের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলতে বোর্ডকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

আসন ছেড়ে অফিসের অপর প্রান্তে চলে গেল। ভুরু কুঁচকানো, ভাবনাগুলোকে আকৃতি দেয়ার চেষ্টা করছে। দুধসাদা ক্রিস্টালের একটা বল হাতের তালুতে মুঠো করে ধরল।

“নটর,” চিন্তিত কণ্ঠে শুরু করল এ্যাকার্নিও। “এম্পায়ারের চালকের আসন, পুরো গ্যালাক্সির কেন্দ্র। যেহেতু আপনার এনসাইক্লোপিডিয়া প্রজেক্ট এখন আমার সামনে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত”–তরুণ সদস্য দুজনের উদ্দেশ্যে ছোট করে মাথা নাড়ল–“আমি বুঝতে পারছি এখানে আপনাকে কাজ করতে দেয়াটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এবং অবশ্যই আপনার সহকর্মীদেরও এখানে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।”

কৃতজ্ঞ হেসে ওয়ানডার হাতে মৃদু চাপড় দিলেন সেলডন।

“শুধুমাত্র এম্পায়ারের গৌরবের জন্যই আমি এই প্রস্তাব করব না, আবার বলা শুরু করল এ্যাকার্নিও। প্রচণ্ড উৎসাহী। “আপনি বিখ্যাত, প্রফেসর সেলডন। মানুষ আপনাকে উন্মাদ বা জিনিয়াস যাই ভাবুক না কেন, প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত আছে। আপনার মতো একজন বিদ্বান মানুষ লাইব্রেরীতে যোগ দিলে জ্ঞানী সমাজে আমাদের মর্যাদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে। আপনার সহযোগীতায় আমরা প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারব, আমাদের সংগ্রহ সমৃদ্ধ করতে পারব, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করতে পারব, লাইব্রেরীর দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে পারব…।

“আর এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকার পরিণতি কি অসাধারণ এক প্রজেক্ট। ভেবে দেখুন মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে আমাদের সভ্যতার মাহাত্ম–ইতিহাসের গৌরব, অসাধারণ অর্জন, অতি উন্নত সংস্কৃতি ধরে রাখার এই বিশাল কর্মযজ্ঞে লাইব্রেরীও যুক্ত ছিল। আর আমি, চীফ লাইব্রেরীয়ান ট্রিমা এ্যাকার্নিও এই কর্মযজ্ঞ শুরু করতে সাহায্য করেছি।” স্বাপ্নিক দৃষ্টিতে মুঠোয় ধরে রাখা ক্রিস্টাল বলের দিকে তাকাল এ্যাকার্নিও।

“হ্যাঁ, প্রফেসর সেলডন,” জোর করে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল এ্যাকার্নিও। “আপনি এবং আপনার সহকর্মীদের লাইব্রেরীতে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেয়া হবে।” ক্রিস্টাল বলটাকে আগের জায়গায় রাখল। বিশাল আলখাল্লায় ঢেউ তুলে নিজের ডেস্কে এসে বসল।

“বোর্ডকে রাজী করানোর জন্য ছোট দুই একটা কাজ করতে হবে। চিন্তা করবেন না। সব আমার হাতে ছেড়ে দিন। ওদেরকে রাজী করাতে পারব।

সেলডন, ওয়ানডা আর পালভার একে অপরের দিকে বিজয়ীর দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যেকের ঠোঁটের কোণে হাসি। তার অধীনে লাইব্রেরী কি পরিমাণ গৌরব আর সম্মান অর্জন করবে সেই স্বপ্নের মাঝে ট্রিমা এ্যাকার্নিওকে ফেলে রেখে বেরিয়ে এল তিনজন।

“বিস্ময়কর,” গ্রাউণ্ডকারে উঠে সেলডন বললেন। “প্রথম মিটিং এর সময় যদি ওকে দেখতে। অনেক কথাই বলেছিল তখন। আজকে তোমাদের দুজনের সামনে কয়েক মিনিটের মধ্যেই–“

“তেমন কঠিন কিছু ছিল না, দাদু, গ্রাউণ্ড কার মূল সড়কে তুলে এনে ওয়ানডা বলল। অটোম্যাটিক প্রপেল চালু করে হেলান দিয়ে বসল। গন্তব্যের কো-অর্ডিনেটস পাঞ্চ করে দিয়েছে আগেই। “নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার আকাঙ্ক্ষা তার মাঝে তীব্র। আমরা শুধু এনসাইক্লোপিডিয়ার সুবিধাগুলো তুলে ধরেছি আর তার ইগো বাকী কাজ করেছে।”

“আমি আর ওয়ানডা ঢোকার পরমুহূর্তেই সে আমাদের কজায় চলে আসে।” পিছন থেকে বলল পালভার। “আমাদের দুজনের মিলিত জোরে কাজটা ছিল কেক কাটার মতো সহজ।” ওয়ানডার কাঁধে হাত রাখল পালভার, আর ওয়ানডা মৃদু হেসে পালভারের হাত ধরল।

“এনসাইক্লোপেডিস্টদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাতে হবে। যদিও মাত্র বত্রিশজন আছে। কিন্তু তারা সবাই চমৎকার এবং নিবেদিত প্রাণ কর্মী। ওদেরকে লাইব্রেরীতে ঢুকিয়ে পরবর্তী সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাব–ক্রেডিটস। হয়তো মানুষকে বোঝানোর জন্য লাইব্রেরীর সাথে আমার এই নতুন চুক্তিটাই প্রয়োজন ছিল। টেরেপ বিনড্রিস এর সাথে আবার যোগাযোগ করা দরকার। এবার তোমাদের দুজনকে সাথে নিয়ে যাব। প্রথমে অন্তত সে আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। তখন সাহায্য না করলেও এখন তোমাদের ঠেকাবে কেমন করে।

স্ট্রিলিং-এর সাইকোহিস্টোরি ভবনের সামনে এসে থামল গ্রাউণ্ড কার। সাইড প্যানেল পিছলে সরে গেল, কিন্তু সেলডন সাথে সাথে নামলেন না। ওয়ানডার দিকে ঘুরলেন।

“ওয়ানডা, তুমি আর স্ট্যাটিন এ্যাকার্নিওর কাছ থেকে কি আদায় করেছ ভালো করেই জান; আমি নিশ্চিত যে কয়েকজন ধনবান ব্যক্তির কাছ থেকে তোমরা কিছু ক্রেডিট আদায় করে আনতে পারবে।

“আমি জানি প্রাইম রেডিয়্যান্ট ছেড়ে যেতে তুমি পছন্দ কর না। কিন্তু এতে তোমাদের অনুশীলন হবে, দক্ষতা বাড়বে, নিজেদের ক্ষমতা পরিষ্কার বুঝতে পারবে।”

“ঠিক আছে দাদু। যদিও আমার মনে হয় লাইব্রেরীর সম্মতি পাওয়ার পর কেউ আর তোমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।”

“আরো একটা উদ্দেশ্য আছে। স্ট্যাটিন, তুমি অনেকবারই বলেছ যে মাঝে মাঝেই তোমার মতো আরেকটা মাইণ্ড ‘অনুভব করেছ। কিন্তু খুঁজে পাও নি।”

“হ্যাঁ,” জবাব দিল পালভার। “একটা ঝলকের মতো। কিন্তু প্রতিবারই ছিলাম ভীড়ের মাঝে। এবং আমার চব্বিশ বছরের জীবনে এমন ঝলক মাত্র চার বা পাঁচবার অনুভব করেছি।”

“কিন্তু স্ট্যাটিন, প্রতি ঝলকের মানে তোমার আর ওয়ানডার মতো আরেকজন ব্যক্তির মাইণ্ড আরেকজন মেন্টালিক। ওয়ানডা কখনো এই ঝলক অনুভব করে নি। কারণ তাকে আমরা সবসময় আড়াল করে রাখতাম। সে কয়েকবার মানুষের ভীড়ে এসেছে। তখন হয়তো আশে পাশে কোনো মেন্টালিক ছিল না।

“এটা আরেকটা কারণ সম্ভবত তোমাদের দুজনকে মানুষের ভীড়ে ঘুরে বেড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ–আমার সাথে অথবা আমাকে ছাড়া। আরো মেন্টালিক আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তোমাদের দুজনের মিলিত ক্ষমতা একজন মানুষকে চালিত করার মতো শক্তিশালী। তোমাদের পুরো একটা দলের মিলিত ক্ষমতা এম্পায়ার চালিত করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠবে।”

কথা শেষ করে গ্রাউণ্ড কার থেকে নামলেন সেলডন। ওয়ানডা আর পালভার যখন তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সাইকোহিস্টোরি ভবনে উঠতে দেখছে তখনো পরিষ্কার বুঝতে পারে নি যে তাদের তরুণ কাঁধে কি বিশাল এক দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গেছেন সেলডন।

.

৩৩.

মাঝ দুপুর। বিশাল গ্রহটাকে ঢেকে রাখা ধাতব ত্বকের উপর ট্র্যানটরিয়ান সূর্যের প্রতিফলিত আলো চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা তৈরি করেছে। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অবজারভেটরি ডেকের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছেন হ্যারি সেলডন। হাত দিয়ে আড়াল করে কর্কশ সূর্যালোক থেকে চোখ দুটো বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বহু বছর হয়ে গেল, গম্বুজের নীচ থেকে বাইরে আসা হয় না। অবশ্য প্যালেসে যাওয়া হয়েছে, তাও হাতে গোনা কয়েকবার। সেটা হিসাবে না ধরলেও চলে। কারণ প্যালেস গ্রাউণ্ডেও নিজেকে আবদ্ধ মনে হবে।

কেউ স্বেচ্ছায় সঙ্গী হতে চাইলে আলাদা কথা, তাছাড়া সেলডন এখন একাই ঘুরে বেড়ান। প্রথম কারণ পালভার এখন বেশীরভাগ সময় কাটায় ওয়ানডার সাথে। প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে কাজ করে, মেন্টালিক রিসার্চ এর কাজ অথবা তাদের মতো অন্যদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। অবশ্য তিনি চাইলে, অন্য কোনো তরুণকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা প্রজেক্টের কোনো সদস্য–বডিগার্ড হিসেবে নিতে পারতেন।

যাইহোক, সেলডন ভালো করেই জানেন যে এখন আর বডিগার্ডের প্রয়োজন। নেই। যেহেতু বহুল আলোচিত হিয়ারিং এবং গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, এইসব কারণে কমিশন অব পাবলিক সেফটি তার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সেলডন জানেন যে প্রতিনিয়ত তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে । গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবারই অনুসরণকারীদের দেখেছেন। অফিসে লিসেনিং ডিভাইস বসানো হয়েছে এই ব্যাপারেও তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। জরুরী আলোচনার সময় তিনি অবশ্য একটা স্ট্যাটিক ডিভাইস চালু করে নেন।

সেলডন নিশ্চিত নন কমিশন অব পাবলিক সেফটি তাকে নিয়ে কি ভাবে সম্ভবত তারা নিজেরাও নিশ্চিত নয়। তবে মহামানব অথবা উন্মাদ যাই ভাবুক না কেন, সেলডনের প্রতিটি বিষয় জানাটাই এখন তাদের প্রধান কাজ। অর্থাৎ, কমিশন সিদ্ধান্ত না পাল্টানো পর্যন্ত তিনি সর্বক্ষণ নিরাপদ।

মৃদু বাতাসে ইউনিটের উপর জড়ানো চাদর আর মাথার অবশিষ্ট কয়েকগাছি সাদা চুল এলোমেলো হয়ে পড়ল। রেলিং-এর উপর দিয়ে নীচের সীমাহীন বিস্তৃত ধাতব চাদরের দিকে তাকালেন, বিস্তৃত চাদরের কোথাও কোনো জোড়া নেই, তার নীচেই রয়েছে অসম্ভব জটিল এক বিশ্বের কলকজা। গম্বুজগুলো স্বচ্ছ হলে যে কেউ দেখতে পারত গ্রাউণ্ড কার ছুটছে, পরস্পর সংযুক্ত কল্পনাতীত জটিল টানেলের ভিতর দিয়ে হুশ শব্দে ছুটে চলা গাভি ক্যাব। এম্পায়ারের প্রতিটি গ্রহে পাঠানোর জন্য হাইপারশিপে তোলা হচ্ছে শস্য, রাসায়নিক দ্রব্য, মূল্যবান অলংকার, অথবা হাইপারশিপ থেকে নামানো হচ্ছে এম্পায়ার-এর প্রতিটি বিশ্ব থেকে আমদানী করা পণ্যদ্রব্য।

চকচকে ধাতব আবরণের নীচে নিরবচ্ছিন্ন বয়ে চলেছে চল্লিশ বিলিয়ন মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জীবনের প্রাত্যহিক নাটকীয়তার কোনো কমতি নেই। এই ছবিটা তিনি ভীষণ ভালোবাসেন–মানবজাতি যা অর্জন করতে পেরেছে তার জীবন্ত ছবি–এবং বুকটা খচ করে উঠে যখন মনে পড়ে যে আগামী কয়েক শতাব্দীর মাঝেই সবকিছু পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপে। বিশাল গম্বুজগুলো দুমড়ে মুচড়ে যাবে। ধাতব আবরণ তুলে ফেলে একদা এক অতি উন্নত জাতির আবাসস্থল আবার পরিণত হবে পতিত জমিতে। বিমর্ষ চিত্তে মাথা নাড়লেন, কারণ জানেন যে এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে পারবেন না। কিন্তু, গম্বুজের ধ্বংসস্তূপ যেমন মানশ্চক্ষে দেখছেন সেলডন তেমনি এটাও জানেন যে এম্পয়ারের সর্বশেষ যুদ্ধ এই গ্রহের মাটি উন্মুক্ত করে দিলেও যেভাবেই হোক ট্র্যানটর নতুন এম্পায়ারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে আবার আবির্ভূত হবে। পরিকল্পনায় বিষয়টা নিশ্চিত করা হয়েছে।

কাছাকাছি একটা বেঞ্চে বসলেন সেলডন। পায়ের ব্যথাটা অসহ্য ঠেকছে; ভ্রমণটার জন্য পরিশ্রম হয়েছে অনেক। কিন্তু আরেকবার উপর থেকে ট্রানটরের দিকে তাকানো, উন্মুক্ত বাতাস অনুভব করা, মাথার উপরে সীমাহীন আকাশ দেখার যে আনন্দ তার তুলনায় এই কষ্ট কিছুই না।

ওয়ানডার কথা ভেবে মন আরো খারাপ হলো। নাতনীর সাথে এখন বলতে গেলে দেখাই হয় না। অল্প যে কয়েকবার দেখা হয়েছে সাথে তখন পালভার ছিল। তিনমাস আগে ওয়ানডা আর পালভারের দেখা হওয়ার পর দুজনকে আর বিচ্ছিন্ন করা যায় নি। ওয়ানডা অবশ্য বলেছে যে প্রজেক্টের স্বার্থে তাদের দুজনের অধিকাংশ সময় একসাথে থাকাটা জরুরী কিন্তু সেলডনের মতে বিষয়টা আরো গভীর।

ডর্সের সাথে তার প্রথম দিককার আচরণের কথা ভালোই মনে আছে। তাদের দুজনের মাঝেও তিনি সেই একই আচরণ লক্ষ্য করেছেন। শুধুমাত্র মেধার কারণেই তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় নি, এখানে আবেগেরও ব্যাপার আছে।

তাছাড়া, বিশেষ প্রকৃতির কারণেই অন্য মানুষের সান্নিধ্যের চেয়ে ওয়ানডা আর পালভার নিজেদের সান্নিধ্যেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সত্যি কথা বলতে কি, সেলডন লক্ষ্য করেছেন যখন আশেপাশে কেউ থাকে না ওয়ানডা আর পালভার এমনকি মুখেও কথা বলে না। তাদের মেন্টালিক এতই শক্তিশালী যে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য শব্দের প্রয়োজন হয় না।

প্রজেক্টের অন্য সদস্যরা ওয়ানডা আর পালভারের এই বিশেষ গুণের কথা জানে না। সেলডনের মতে গোপন থাকাই বাঞ্চনীয় অন্তত পরিকল্পনায় তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত না হওয়া পর্যন্ত। আসলে পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেছে কিন্তু তা শুধু সেলডনের মাথাতেই। আর দু একটা বিষয় জায়গামতো বসানো হয়ে গেলেই ওয়ানডা আর পালভারকে সব খুলে বলবেন এবং যদি প্রয়োজন হয়। ভবিষ্যতে আরো দুএকজনকে।

ধীরে ধীরে আড়ষ্ট ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ালেন সেলডন। এক ঘণ্টার ভেতরে স্ট্রিলিং এ ফিরতে হবে। ওয়ানডা আর পালভার আসছে তার জন্য একটা সারপ্রাইজ নিয়ে। হয়তো আরেকটা জটিল ধাঁধা। শেষবারের মতো তাকালেন ট্রানটরের দিকে। ঘুরে গ্র্যাভিটিক রিপালশন এ্যালিভেটরের দিকে এগোনোর সময় মুখে স্মীত হাসি ফুটিয়ে গভীর মমতায় বললেন, “ফাউণ্ডেশন।”

.

৩৪.

নিজের অফিসে ঢুকলেন হ্যারি সেলডন। ওয়ানডা আর পালভার আগেই এসেছে। বসে আছে কনফারেন্স টেবিলের শেষ মাথায়। দুজনের বেলায় যা স্বাভাবিক, কেউই কথা বলছে না।

তারপর থমকে দাঁড়ালেন সেলডন। কামরায় আরো একজন আছে। অবাক কাণ্ড–ভদ্রতার খাতিরে ওয়ানডা আর পালভার অন্য মানুষদের সামনে প্রচলিত ভঙ্গীতে কথা বলে। অথচ এখানে তিনজনই নিশ্চুপ।

আগন্তুককে খুটিয়ে দেখলেন সেলডন–দেখতে কিছুটা অদ্ভুত, পয়ত্রিশের মত বয়স, প্রচুর সময় পড়াশোনা করে কাটায় এমন মানুষের মতো ক্ষীণদৃষ্টি চোখে, চোয়ালে অদ্ভুত দৃঢ়তার আভাস না থাকলে সেলডন তাকে অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে ধরে নিতেন, কিন্তু সেটা হতো মারাত্মক ভুল। তার চেহারায় রয়েছে একইসাথে দৃঢ়তা আর সহৃদয়তা। ভরসা করার মতো মানুষ, সিদ্ধান্ত নিলেন সেলডন।

“দাদু,” চমৎকার ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল ওয়ানডা। সেলডনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কয়েক মাস আগে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে অনেক বদলে গেছে সে। আগে যখন তখন খিল খিল করে হেসে উঠত; কিন্তু এখন মার্জিত হাসিতে তার গভীর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তবে আগের মতোই–এখনো অসম্ভব সুন্দর এবং কেবলমাত্র তার অসাধারণ মেধাই সেই সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যেতে পারে।

“ওয়ানডা, পালভার,” বললেন সেলডন, প্রথমজনের গালে চুমু দিলেন, দ্বিতীয়জনের পিঠ চাপড়ে দিলেন।

“হ্যালো,” আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বললেন সেলডন, “আমি হ্যারি সেলডন।”

“আপনার সাথে দেখা হওয়া আমার পরম সৌভাগ্য, প্রফেসর।” আগন্তক জবাব দিল। “আমি বোর এ্যালুরিন।” প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো হাত বাড়াল হাত মিলানোর জন্য।

“বোর একজন সাইকোলজিস্ট, হ্যারি,” পালভার বলল, “এবং আমাদের কাজের প্রতি ভীষণ আগ্রহী।”

“আসল ব্যাপার হচ্ছে, দাদু,” ওয়ানডা বলল, “বোর আমাদেরই একজন।”

“তোমাদেরই একজন?” অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে পালাক্রমে দুজনের দিকে তাকালেন সেলডন। “অর্থাৎ…” তার দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

“হ্যাঁ, দাদু। গতকাল আমি আর স্ট্যাটিন ইরি সেক্টরে হাঁটছিলাম। তোমার পরামর্শ অনুযায়ী খুঁজছিলাম অন্যদের। তারপর হঠাৎ–ধুম!–ওকে খুঁজে পাই।”

“থট প্যাটার্নটা সাথে সাথেই চিনতে পারি। খুঁজতে থাকি আর যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি।” গল্পের রেশ ধরল পালভার। “বাণিজ্যিক এলাকায় ছিলাম, স্পেসপোর্টের কাছে। ক্রেতা, পর্যটক, আউটওয়ার্ল্ডের বণিকে গিজ গিজ করছিল জায়গাটা। তাল হারানোর মতো অবস্থা, এমন সময় ওয়ানডা থেমে সংকেত দেয়–বেরিয়ে এসো আর ভীড়ের মাঝ থেকে বোর আমাদের সামনে এসে সংকেত দেয়-হ্যাঁ?”

“বিস্ময়কর,” ওয়ানডার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালেন সেলডন। “আর ডক্টর–আপনি ডক্টর, তাই না?–এ্যালুরিন, আপনার কি মন্তব্য?”।

“বেশ,” চিন্তিত সুরে কথা শুরু করল সাইকোলজিস্ট। “আমি খুশি। সবসময়ই নিজেকে অন্যরকম মনে হতো। এখন জানি কেন? এবং যদি আমি কোনো সাহায্যে আসতে পারি,–“ সাইকোলজিস্ট চোখ নামিয়ে নিল, যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছে যে বেশী আশাবাদী হয়ে পড়েছে সে। “বলতে চাইছি ওয়ানডা আর পালভার জানিয়েছে যে আমি হয়তো কোনো না কোনোভাবে আপনার সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে সাহায্য করতে পারব, প্রফেসর। আমার জন্য এর চেয়ে খুশির বিষয় আর কিছু হতে পারে না।

“নিশ্চয়ই, ওরা সত্যি কথাই বলেছে ড. এ্যালুরিন। আমার মতে, প্রজেক্টে আপনি অনেক বড় অবদান রাখতে পারবেন–যদি আপনি কাজ করতে আগ্রহী হন। অবশ্য তার জন্য এখন যে কাজ করছেন সেটা ছেড়ে দিতে হবে, শিক্ষকতা বা প্রাইভেট প্র্যাকটিস যাই হোক না কেন। সম্ভব?”

“অবশ্যই, প্রফেসর। আমার স্ত্রীকে বোঝানো হয়তো একটু কঠিন হবে-” এই পর্যন্ত বলে বিরতি নিল সে, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। লাজুক ভঙ্গীতে পালাক্রমে তাকাল তিনজনের দিকে। তবে রাজী করিয়ে ফেলব।”

“তাহলে সব ঠিক হয়ে গেল,” উল্লসিত কণ্ঠে বললেন সেলডন। “আপনি সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে যোগ দিচ্ছেন। কথা দিচ্ছি, এই সিদ্ধান্তের জন্য কখনো আপনাকে অনুতাপ করতে হবে না।”

.

বোর এ্যালুরিন চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। বাকী দুজনের উদ্দেশ্যে সেলডন বললেন, “ওয়ানডা, স্ট্যাটিন, চমৎকার অগ্রগতি এটা। কত দ্রুত আরো খুঁজে বের করতে পারবে তোমরা?”

“দাদু, বোরকে খুঁজে বের করতে আমাদের একমাস লেগেছে–কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে অন্যদের পাওয়া যাবে আমরা জানি না।”

“সত্যি কথা বলতে কি, এভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণে আমরা প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে কাজ করতে পারছি না ঠিকমতো। এতে ক্ষতিও হচ্ছে অনেক। যেহেতু এখন। কথা বলার জন্য স্ট্যাটিন আছে, মৌখিক যোগাযোগ অনেক বেশী কর্কশ, জোরালো।”

সেলডনের হাসি মুছে গেল। এই ভয়ই করছিলেন তিনি। যেহেতু ওয়ানডা আর পালভার তাদের মেন্টালিক দক্ষতা নিপুণ করে তুলতে চাইছে সাধারণ জীবনের উপর তাদের আগ্রহ ক্রমেই হ্রাস পাবে সেটাই স্বাভাবিক। মেন্টালিক চালিকাশক্তিই তাদেরকে পৃথক করে রাখবে।

“ওয়ানডা, স্ট্যাটিন, বোধহয় তোমাদেরকে এখন সব খুলে বলা দরকার। বহুবছর আগে ইউগো একটা ধারণা দিয়েছিল এবং সেই ধারণার উপর ভিত্তি করে আমি একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছি। এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত আমি নিজেও বিস্তৃতভাবে বলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না কারণ এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় জায়গামতো ছিল না।

“তোমরা তো জানই, ইউগো দুটো ফাউণ্ডেশন তৈরি করার কথা বলেছিল একটা আরেকটার প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করবে। এটা ছিল যুগান্তকারী ধারণা, বেঁচে থাকলে ইউগো সেটা নিশ্চয়ই অনুধাবন করত।” থেমে বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সেলডন।

“অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছি। ছয় বছর আগে যখন নিশ্চিত হই যে ওয়ানডার মেন্টালিক অথবা মাইণ্ড-টাচিং ক্ষমতা আছে, আমার মনে হয় ফাউণ্ডেশন যে শুধু দুটো হবে তাই নয় বরং তাদের প্রকৃতিও হবে ভিন্ন। একটা হবে ফিজিক্যাল সায়েন্টিস্টদের নিয়ে টার্মিনাসে এনসাইক্লোপেডিস্টরা হবে তাদের অগ্রবর্তী দল। দ্বিতীয়টা তৈরি হবে সত্যিকারের সাইকোহিস্টোরিয়ানদের নিয়ে;–তুমি। আর সেজন্যই তোমার মতো অন্যদের খুঁজে বের করতে আমি এত আগ্রহী।

“কিন্তু দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের অস্তিত্ব গোপন থাকবে। তার মূল শক্তি হবে গোপনীয়তা এবং অসীম টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা।

“কয়েক বছর আগে যখন আমার বডিগার্ডের প্রয়োজন দেখা দেয় তখনই বুঝতে পারি যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন হবে প্রথম ফাউণ্ডেশনের অসীম ক্ষমতাধর, নীরব, গোপন বডিগার্ড।

“সাইকোহিস্টোরি অভ্রান্ত নয়–এর ভবিষ্যদ্বাণীর সবগুলোই অতিমাত্রার সম্ভাবনা। ফাউণ্ডেশন তার শৈশব অবস্থায় অসংখ্য শত্রুর সম্মুখীন হবে, যেমন আমার বর্তমানে অনেক শত্রু।

“ওয়ানডা, তুমি আর পালভার হবে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের পথিকৃত, টার্মিনাস ফাউণ্ডেশনের অভিভাবক।”

“কিন্তু কিভাবে, দাদু? আমরা মাত্র দুজন–বেশ, তিনজন, বোরকে ধরলে। পুরো ফাউণ্ডেশন রক্ষা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন–“

“শত শত হাজার হাজার? যতজন প্রয়োজন খুঁজে বের কর। তুমি পারবে। এবং তুমি জান কিভাবে।”

“বোর এ্যালুরিনকে যে পদ্ধতিতে খুঁজে বের করলে তাতে কিছু বুঝতে পার নি? প্রথম থেকেই আমি বলছিলাম মানুষের ভীড়ে ঘুরে বেড়াও, অন্যদের খুঁজে বের কর। কিন্তু কাজটা তোমার জন্য কঠিন, এবং যন্ত্রণাদায়ক। এখন বুঝতে পারছি যে। তোমাকে আর পালভারকে আড়ালে চলে যেতে হবে, দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের নিউক্লিয়াস গড়ে তোলার জন্য। ওখান থেকেই সীমাহীন বিশাল মানব সমুদ্রের উপর তোমরা জাল বিস্তার করে চলবে।”

“দাদু, কি বলছ তুমি?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ওয়ানডা। নিজের আসন ছেড়ে সেলডনের চেয়ারের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। “তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?”

“না, ওয়ানডা,” আবেগে সেলডনের গলা কাঁপছে। “আমি চাই না তুমি যাও, কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তুমি আর স্ট্যাটিন অবশ্যই ট্রানটরের বাস্তবতা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তোমাদের মেন্টালিক ক্ষমতা যতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, অন্যদের তোমরা আকৃষ্ট করতে পারবে–নিঃশব্দ এবং গোপন ফাউণ্ডেশন বেড়ে উঠবে ধীরে ধীরে।

“আমাদের যোগাযোগ হবে। অবশ্যই মাঝে মাঝে। আমাদের সবার কাছেই প্রাইম রেডিয়্যান্ট থাকবে। তুমি বুঝতে পেরেছ, আমি যা বললাম তার প্রকৃত সত্য–অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা, তাই না?”

“হ্যাঁ, পেরেছি, দাদু। অত্যন্ত মেধাবী পরিকল্পনা। এবার তুমি নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নাও; আমরা তোমাকে ব্যর্থ হতে দেব না।”

“আমি জানি,” ক্লান্ত সুরে বললেন সেলডন। কিভাবে পারলেন–প্রিয় নাতনীকে দূরে ঠেলে দিতে? সুখের দিনগুলো, ডর্স ইউগো, এবং রাইখের সাথে তার শেষ বন্ধন। গ্যালাক্সিতে তার একমাত্র বংশধর।

“তোমার কথা আমার ভীষণ মনে পড়বে, ওয়ানডা,” বললেন সেলডন। চোখের পানি মসৃণ গাল বেয়ে নামছে।

“কিন্তু দাদু,” ওয়ানডা উঠে দাঁড়িয়েছে। পালভারের সাথে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। “আমরা কোথায় যাব? কোথায় হবে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন?”

মাথা তুললেন সেলডন, “প্রাইম রেডিয়্যান্ট তোমাকে বলেছে, ওয়ানডা।”

সেলডনের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্মৃতি হাতড়াতে লাগল ওয়ানডা।

হাত বাড়িয়ে নাতনীর হাত স্পর্শ করলেন সেলডন।

“আমার মাইণ্ড টাচ কর, ওয়ানডা। উত্তর পাবে।”

সেলডনের মাইণ্ডে পৌঁছে ওয়ানডার দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেল।

“পেয়েছি,” ফিসফিস করে বলল সে।

সেকশন ৩৩এ২ডি১৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *