৪.৩ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ
এমন একটি ব্যক্তি অথবা সত্তাকে যদি কল্পনা করা যায় যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর তবে তাঁর শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁদেরই শিক্ষার প্রয়োজন আছে যাঁরা সম্পূর্ণ নন। আবার এমন একটি ব্যক্তি অথবা সত্তাকে যদি চিন্তা করা যায় যিনি অসম্পূর্ণ এবং নিজেকে নতুন করে গড়বার শক্তি যাঁর একেবারেই নেই, তবে তাঁর শিক্ষাগ্রহণের শক্তিও নেই। কাজেই তাঁর পক্ষেও শিক্ষা নিষ্প্রয়োজন। একদিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ আর অন্যদিকে সেই অপূর্ণ মানুষ, যে নিজেকে গড়বার শক্তিও লাভ করেনি, নিজেকে নতুন করে ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি করবার শক্তি যার নেই, এই দুই প্রান্তে শিক্ষা অনুপস্থিত। এর মাঝামাঝি জায়গাতে শিক্ষার স্থান। যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ নন, নিজেকে পূর্ণ করবার জন্য তাঁর অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। কাজেই শিক্ষার মূলে এইরকম একটা সম্পর্কের কথা আছে, সেই সম্পর্ককে বিশেষ পদ্ধতিতে গড়ে তুলবার, রূপদান করবার, প্রশ্ন আছে।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের মূলেও এই রকম কিছু সম্পর্ক সম্বন্ধে ধারণা আছে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে বিশ্বমানবের সম্পর্ক, এইসবই তাঁর শিক্ষাদর্শনের উপাদান।
প্রকৃতি নিয়েই কথাটা শুরু করা যাক, কারণ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এমন একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারবে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক, অথবা মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে শিক্ষার যে ধারণা, সেই সম্পর্ক অথবা ধারণার আবার দুটি প্রান্ত আছে। সেই দুটি প্রান্ত নিয়ে একটু ভাবা যাক। একদিকে প্রকৃতিকে ভাবা যায় যেন সে নিয়মের দ্বারা চালিত এক যন্ত্র। ভাবা যায় যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এইটেই বের করতে চায় যে, প্রকৃতির যন্ত্রটা কীভাবে কাজ করে বা কীভাবে তাকে দিয়ে কাজ করানো যায়। প্রকৃতিকে যদি আমরা যন্ত্র হিসেবে ভাবি তা হলে শিক্ষার ঝোঁক হবে ঐদিকে। শিক্ষা ব্যাপারটা অবশ্য আরো বেশি যান্ত্রিক ও বোধশূন্যও হতে পারে। শিক্ষক অনেক সময় গতানুগতিক বিদ্যালয়ে অতি বোধহীন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে থাকেন। তাতে বুদ্ধি জিনিসটাই অনুপস্থিত। এবার আসা যাক দ্বিতীয় কথায়। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক তাতে অন্য একটি প্রান্ত আছে। এক প্রান্তে যেমন যান্ত্রিকতা অন্য প্রান্তে তেমনি প্রকৃতি এমন একটি অবয়ব, যার ভিতর দিয়ে মানুষের প্রেম বিস্তার লাভ করতে পারে। এই কথাটা যদি শিক্ষায় ধরা না পড়ে তবে সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, রাবীন্দ্রিক নয়। একটা কথা কবি শিক্ষক সহজ অথচ গভীরভাবে বুঝেছিলেন–সেটা শিশুর ভালোবাসার ধরন সম্বন্ধে। আর মনে রাখতে হবে যে শিশু এখানে মানুষেরই প্রতিভূ। একটু দূর থেকে শিশুকে যখন দেখি তখন এই জিনিসটা লক্ষ করা যায়। শিশুর কান্নার সাধারণত কোনো কারণ থাকে–ক্ষিদে পেয়েছে, কোনো অস্বাচ্ছন্দ্য, কি যা হোক কিছু। শিশুর খুশীর মধ্যে কিন্তু একটা অকারণ আনন্দ আছে। অকারণে পুলকিত হয়ে ওঠে শিশু, অকারণে নাচতে থাকে। এটা একটা মূল কথা। এই বিশ্ব সম্বন্ধে, প্রকৃতি সম্বন্ধে, মানুষের একটা অকারণ আনন্দবোধ আছে। আমরা যতটুকু মানুষ সেই পরিমাণে আমাদের সকলের মধ্যে এটা আছে।
সাংসারিক অর্থে যাকে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ বলে, আমরা যখন তাই হয়ে উঠি, তখন এই অকারণ আনন্দটাকে পাগলামি মনে করি। আমরা কতগুলো কাজের কথা শুধু যে শিখি তাই নয়, সেটাকেই যেন একমাত্র শিক্ষণীয় মনে করি। এই পৃথিবীকে দেখবার এই দুটো ধরন আছে। একটা হলো, এটাকে কাজের বিষয় ভাবা। আরেকটা অকাজের বিষয়, অকাজের বিষয় মানে আনন্দের বিষয়। অর্থাৎ উদ্দেশ্যরহিত আনন্দের বিষয়, অহেতুকী প্রীতির বিষয়। রবীন্দ্রনাথ শিশুর শিক্ষায় কাজের কথাটা বাদ দিতে চেয়েছিলেন তা নয়। কিন্তু ঐ অকাজের কথাটাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের এটা একটা প্রধান কথা–একটা মৌল দার্শনিক ভিত্তি বলা যেতে পারে।
আরেকটা কথা এই সঙ্গে এসে পড়ে। এই যে আমরা প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজনের জানার মধ্যে একটা পার্থক্য করেছি, এই পার্থক্যটা করবার পরও এ দুয়ের মধ্যে একটা সম্পর্কের কথাও মনে রাখা দরকার। প্রকৃতির দ্বারা আমাদের কিছু প্রয়োজন সিদ্ধ হয়; প্রকৃতি আমাদের ধারণ করে, লালন করে। আবার প্রকৃতি আমাদের আনন্দের ক্ষেত্র, যেমন শিশুর কাছে, যেমন শিল্পীর কাছে। মা তো শিশুর কাছে এই রকমই। মা শিশুর কিছু প্রয়োজন মেটান, আবার মায়ের মধ্যে শিশু কিছু অকারণ আনন্দের ক্ষেত্র খুঁজে পায়। উল্টো করেও বলা যায়, শিশুর মধ্যে মা একটা অকারণ আনন্দের ক্ষেত্র খুঁজে পান, তা নইলে তিনি মা নন। এখন এ দুটোর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। যে মা শিশুর প্রয়োজন একেবারেই মেটাতে পারেন না সে মায়ের পক্ষে শিশুর কাছে অকারণ আনন্দের ক্ষেত্র হয়ে ওঠাটাও কঠিন। অতএব শিক্ষার ব্যাপারেও মানুষ এবং প্রকৃতির সম্পর্কের এমন একটা আদল গড়ে তুলতে হয় যাতে প্রকৃতি মানুষের কিছু প্রয়োজন পূর্ণ করবে, আবার প্রকৃতিকে মানুষ শিল্পীর মন নিয়ে, শিশুর মন নিয়ে, আনন্দের আর ভালোবাসার। সামগ্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে।
প্রয়োজন পূর্ণ করার দিকটাও তাহলে গুরুত্বপূর্ণ। সেই কথাটা রবীন্দ্রনাথ ভালো করেই বুঝেছিলেন। ভালো করেই বুঝেছিলেন তখনই, বিশেষত যখন গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য তিনি চোখের সামনে দিনের পর দিন দেখলেন। এই অসহায় এবং দরিদ্র মানুষদের এমন শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন যাতে প্রকৃতির সহায়তায় মানুষের অভাব দূর করবার পথ প্রশস্ত। হয়। বিজ্ঞানের সেটা একটা লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, বিশেষত দরিদ্র পল্লীবাসীর অভাব দূর করবার কাজে। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের দিকে তাকালে যেমন আমরা শিশু এবং প্রকৃতির মধ্যে আনন্দের সম্পর্কটাই প্রথম দেখি, শ্রীনিকেতনের দিকে তাকালে তেমনি দরিদ্র গ্রামবাসী এবং প্রকৃতির মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রয়োজন মেটাবার প্রয়াসের দিকটা স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করি।
প্রথমেই বলেছিলাম যে, প্রকৃতি একদিকে নিয়মে আবদ্ধ, অন্য দিকে প্রকৃতি অকারণ ভালোবাসার ক্ষেত্র–এ দুয়ের মধ্যে কোনোটাকেই তুচ্ছ করবার মতো কথা মনে করা যায় না। প্রকৃতি যে-নিয়মে আবদ্ধ সেই নিয়মকেও জানা চাই। শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ সেই কথাটা পরিষ্কারভাবে বলেছেন। প্রকৃতি যে-নিয়মে আবদ্ধ, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে-নিয়মে চলে, সেটা যদি আমরা না জানি, না বুঝি, তবে আমাদের মনে নানা কুসংস্কার সহজে আশ্রয় পায়। এই বিশ্বপ্রকৃতি নিয়মে আবদ্ধ একথা জানলে সেইসব কুসংস্কার ধীরে ধীরে দূর হয়। এইসব কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে অনেক অন্ধ ভয় জমে ওঠে। প্রকৃতি যে নিয়মে চলে সে কথা জানলে সেইসব অন্ধ ভয় ধীরে ধীরে দূর হয়। মনের মুক্তির জন্য এটা প্রয়োজন। আবার প্রকৃতির নিয়ম _____ আমরা প্রকৃতিকে নিজের প্রয়োজনে আরো পরিপূর্ণভাবে লাগাতে পারি, _____ ব্যাপারেও। মাটিতে কী সার দিতে হবে, কী করে ফলন ফলবে, এইসবের মূলেও তো বিজ্ঞান এবং নিয়ম আছে। শ্রীনিকেতনের পল্লীসংগঠনবিভাগ গড়বার কাজে প্রথম যুগে এলমহার্স্ট ছিলেন নেতৃস্থানীয়। তাঁর সঙ্গে পত্রালাপে এবং অন্যান্য লেখায় রবীন্দ্রনাথ খুবই পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, বিজ্ঞানকে প্রয়োজন পল্লীসংগঠনের কাজে এই দুই উদ্দেশ্যেই এক, মানুষের মনকে অন্ধতা থেকে মুক্ত করবার জন্য, আর দুই, বিজ্ঞানসম্মত কৃষিপ্রথা ও উৎপাদনব্যবস্থার জন্য।
এইখানে ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্কের কথাটাও এসে যায়। এতক্ষণ বলছিলাম প্রধানত ব্যক্তি বা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের কথা। এখন আসছি প্রতিবেশীর সম্পর্কের বিষয়ে। প্রতিবেশীর ভিতর ব্যক্তি নিজের আত্মাকে প্রসারিত করে। আক্ষরিক অর্থে এবং দার্শনিক অর্থে আত্মীয়তার এটাই অর্থ। যদিও আত্মীয়তার গ্রাম্য অৰ্থ রক্তের সম্পর্ক নিয়ে, তবুও তার বৃহত্তর দার্শনিক অর্থ, যার ভিতর আত্মার সম্পর্ক প্রসারিত হয়েছে। যার ভিতর আমাদের আত্মার সম্পর্ক প্রসারিত হয়নি সে রক্তের সম্পর্কে যদিও আত্মীয় হয়, তবুও গভীরতর অর্থে সে আত্মীয় নয়। আর যাকে আমরা বন্ধু প্রতিবেশী বলে জেনেছি সেই আত্মীয়।
আমাদের ভাষায় পাতানো দাদা দিদি, পাতানো মাসি পিসী, এইরকম অনেক সম্পর্ক থাকে। সেসব রক্তের সম্পর্ক নয়, কিন্তু সেগুলো অনেক সময় আসল সম্পর্ক–যদি না সেগুলো মামুলী নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। প্রতিবেশীও ঐরকম। যীশুখ্রীষ্ট এক সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন, কে তোমার প্রতিবেশী? এ নিয়ে অনেক আলোচনা সম্ভব। প্রতিবেশীর একটা আদর্শ রূপ ও সংজ্ঞা আছে। তাকেও আবার দুইভাবে ব্যবহার করা যায় প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের মতোই। এক হল কাজের দিনে কাজের ভিতর, আরেক হল উৎসবের দিনে আনন্দের ভিতর। কাজের দিনে কাজের ভিতর প্রতিবেশী সম্পর্কের সবচেয়ে সার্থক রূপায়ণ হচ্ছে সমবায়ে। সমবায়ের ভিতর দিয়ে প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে যাতে সকলের প্রয়োজন সুষমভাবে ন্যায়সংগতভাবে সৃজনশীলভাবে পূর্ণ হতে পারে এমন প্রচেষ্টা করে। আবার উৎসবের দিনে মানুষ আনন্দের জন্যে, শুধু আনন্দের কারণে মিলিত হয়। এই দুই মিলে প্রতিবেশী, এই দুই মিলে আদর্শ পল্লীসমাজ। আমাদের দেশে প্রাচীন মেলাতেও এই দুই একসাথে এসে মিলেছিল, প্রয়োজন আর আনন্দের সেটা মিলনক্ষেত্র।
পল্লী কথাটার শেষ পর্যন্ত অর্থ ঐ। এই যে পৃথিবীজোড়া মানুষ, এদের সকলের সঙ্গে তো আমাদের সোজাসুজি পরিচয় ঘটে না, আমরা প্রত্যেকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না, প্রত্যেকের সঙ্গে তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। এ ওকে চেনে, একে অন্যকে আত্মীয় বলে মানে, এই নিয়ে পল্লীসমাজ। বাস্তবে অবশ্য তার ভিতর অনেক কলহ কলঙ্ক থাকে, হিংসা দ্বন্দ্ব সবই থাকে। বাস্তবটা জানা নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু শুধু বাস্তব যদি আমরা জানি, আদর্শ যদি না জানি, তবে শিক্ষার প্রশ্ন নেই। আদর্শ যদি না জানি তবে কিসের দিকে আমরা এগোবার চেষ্টা করছি? কিসের জন্য আমরা নিজেকে নতুন করে গড়বার চেষ্টা করবো। আগেই বলেছি, যদিও শিক্ষার শুরু অপূর্ণতাতে তবু শিক্ষা তখনই সম্ভব এবং সার্থক যখন একটা পূর্ণতার দিকে যাবার ধারণাও সেই সঙ্গে থাকে। কাজেই বাস্তব পল্লীসমাজকে জানতে হয়, কিন্তু একটা আদর্শ। পল্লীসমাজের চিত্রও সেই সঙ্গে প্রয়োজন। বাস্তব পল্লীকে রবীন্দ্রনাথ জানতেন না এমন নয়। গ্রামকে তিনি ভিতর থেকে দেখেছেন। তাঁর ছোটো গল্পগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে তিনি বাস্তব পল্লীকে ভালোভাবেই জানতেন। তবে বাস্তব পল্লী তো আরো অনেকের লেখাতে রূপায়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে আরো পাই একটা আদর্শ চিত্র, যেমন ‘স্বদেশী সমাজ’ নামে সেই বিখ্যাত লেখায়। বাস্তব থেকে আদর্শে যাবার পথে বিজ্ঞান ও সমবায় এবং কোনো একটা গভীর অর্থে আত্মীয়তা অথবা আত্মবিধৃত আনন্দের ধারণা, এইসব মিলে তিনি পল্লীকে স্থান দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাচিন্তার ভিতর। বিশ্বভারতীর অংশ যেমন শান্তিনিকেতন তেমনি শ্রীনিকেতন। আর শ্রীনিকেতনের প্রথম কথাটাই পল্লীসংগঠন নিয়ে। পল্লীসংগঠন–অথবা রবীন্দ্রনাথ কখনো পল্লীসঞ্জীবন কথাটাও ব্যবহার করেছেন–তারই সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বিদ্যালয়ের শিক্ষা। অনেকেই জানেন, শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ই একমাত্র নয়, শ্রীনিকেতনে আরও একটি বিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেছিলেন এবং একদিন এমন সিদ্ধান্তেও এসেছিলেন যে, শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের চেয়েও শ্রীনিকেতনের বিদ্যালয়ের তাৎপর্য বেশি, দেশের গভীরতর প্রয়োজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক।
এরপর আসছে মানুষের সঙ্গে বিশ্বমানবের সম্পর্কের কথা। যাকে আমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক বলেছি সেটা অনেক সময় একটা সীমাবদ্ধ গোষ্ঠীর সম্পর্ক। পল্লীসমাজ হাতের কাছের উদাহরণ, কিন্তু আরো বড় বড় গোষ্ঠীকেও আত্মীয়তার সম্পর্কের আদলেই চিন্তা করা হয়। জাতি বা ধর্মকে ভিত্তি করে যেসব সম্পর্ক সেখানেও এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্ককে মৌল বস্তু বলেই মনে করা হয়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু সতর্ক হবার প্রয়োজন আছে। কারণ এই ধরনের সীমাবদ্ধ আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো অতি সহজে অনাত্মীয় শত্রু খুঁজে নেয়। তখন সেটা বিরোধী আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিতর যুদ্ধের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। সেটাই আত্মীয়সম্পর্কের আদর্শরূপের বিপরীত। আমরা যখনই কোনো আদর্শরূপ নিয়ে চিন্তা করি তখনই তার বিপরীতটা সম্পর্কেও সতর্ক হতে হয়। রবীন্দ্রনাথ। দেখেছিলেন কীভাবে জাতীয়তাবাদ একটা জঙ্গীরূপ ধারণ করে, চীনকে আক্রমণ করে জাপান, ইউরোপের নানা জাতি মেতে ওঠে যুদ্ধের অমানুষিক উত্তেজনায়। এইসব দেখে এই কথাটাই তিনি বুঝেছিলেন যে, তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে যে ধারণা তাতে যদিও স্বদেশী সমাজের কথা থাকবে তবুও সমানভাবেই রাখা প্রয়োজন বিশ্বমানবতার কথাও। আর সেই জন্যই তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেন তার নাম দিলেন বিশ্বভারতী। এইখানে স্বদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েও তিনি আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন বিশ্বকে। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ও শিক্ষাচিন্তায় একদিকে রইলো পাশের গ্রাম সুরুল, যার উন্নয়নের জন্য শ্রীনিকেতন, আর অন্য দিকে বিশ্বমানব, সমস্ত বিশ্ব। সারা বিশ্ব থেকে জ্ঞানীগুণী মানুষকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর ছোটো শান্তিনিকেতনে, যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্। চীন থেকে, জাপান থেকে, ইউরোপ আমেরিকার নানা দেশ থেকে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষকে তিনি টেনে এনেছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতনে। এই বিশ্বমানবতা তাঁর শিক্ষাদর্শের পূর্ণতার জন্য আবশ্যিক।
কথাগুলোকে এবার একত্র সংগ্রহ করে দেখা যাক। শিক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক পূর্ণ হয়ে ওঠে। একদিকে সেটা আনন্দের সম্পর্ক, অন্যদিকে জ্ঞানবিজ্ঞানের সম্পর্ক। শিক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষ আরো শেখে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সার্থকভাবে যুক্ত হতে। বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমবায়ের বাহনে দূর হয় দারিদ্র্য। শিক্ষার ভিতর দিয়ে মানুষ একটা স্বাভাবিক আনন্দকে উৎসবের পর্যায়ে তুলে নিতে শিখুক এটাও ছিল কবির আকাঙ্ক্ষা, যার কিছু পরিকল্পিত অনিন্দ্যসুন্দর রূপও তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। আবার ছোটো গোষ্ঠী যেন কোনো বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের ভিতরই তার চরম অর্থ খুঁজতে না যায়, ছোটো গোষ্ঠীকে যাতে শেখানো হয় যে, সব গোষ্ঠীরই। সার্থকতা বৃহত্তর কোনো মানবসমবায়ের জন্যে নিজেকে সেবা ও আনন্দে সার্থক করে তোলার ভিতর, এই দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। সেই জন্য স্বদেশী সমাজের ধারণার সঙ্গে যোগ করতে হয় মানুষের ধর্মের ধারণাকে।
শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিকে সহজে ঢুকতে দিতেন না। তারও একটা কারণ ছিল। রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিসচেতন ছিলেন না এমন তো নয়। তাঁর রাজনীতি বিষয়ক নানা ভাষণ ও কর্ম দেশবাসীর অজানা নয়। তাঁর জীবনের শেষ চল্লিশ বছরে এর উদাহরণের অভাব নেই। নানা তেজস্বী ভাষণ এবং কর্মের উল্লেখ করা যায় সহজেই। অথচ অতখানি রাজনীতিসচেতন হয়েও শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণে তিনি দলীয় রাজনীতিকে ঢুকতে দিতে চাইতেন না। তার একটা কারণ অবশ্য এই যে, রাজনীতির সঙ্গে প্রায় অনিবার্যভাবে বড় বেশি দলাদলি এসে যায়। আশ্রম প্রাঙ্গণকে সেই দলাদলি থেকে তিনি মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। আরও একটা কথা আছে। রাজনীতির প্রধান কাজটা হল ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব। প্রথমে সেটা ছিল বিদেশীর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবার প্রশ্ন। তারপর একদলের হাত থেকে অন্য দলের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াটাই প্রধান হল। ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব রাজনীতির একটা মৌল ব্যাপার। সেই দ্বন্দ্বের ভালোমন্দ যাই থাকুক, প্রয়োজন যাই থাকুক, রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে তার বাইরেও একটা বড় কাজ আছে। গান্ধীর যেমন রাজনীতির পাশে ছিল গঠনমূলক কার্যক্রম, রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ছিল পল্লীসংগঠন। আরো ছিল মানুষের জীবনে কতগুলো আদর্শকে মূল্যবান বলে শুধু দার্শনিকভাবে প্রচার করা নয়, জীবনচর্যার ভিতরেও প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প। এই ধরনের কিছু কাজকে তিনি গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, যে কাজ কখনো রাজনীতির ভিতর দিয়ে পূর্ণ হয় না। যাঁরা রাজনীতি করবেন, সক্রিয় রাজনীতি, তাঁরা তো সে-কাজের জন্য আছেনই। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন যে, তাঁর যেটা বিশেষ প্রতিভা তাকে তিনি মানুষের কাজে নিযুক্ত করতে পারবেন অন্য এক গঠনমূলক ও সৃজনশীল কর্মের ভিতর দিয়ে, যেটাকে রাজনীতির আবর্ত থেকে অনেকখানি দূরে রাখাই ভালো। প্রশ্নটা এই নয় যে, শিক্ষা ভালো কি রাজনীতি ভালো; প্রশ্নটা এই যে, শিক্ষাকে রাজনীতির হাতে তুলে দেওয়া ভালো কি না। রবীন্দ্রনাথ স্থির করেছিলেন যে, শিক্ষাকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থেকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখাই মঙ্গলজনক। শান্তিনিকেতনে তিনি। সেটাই যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিলেন!
শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ কাজ শুরু করেছিলেন এই শতকের গোড়ায়। আজ শতাব্দী অবসিত হতে চলেছে। তাঁর শিক্ষাচিন্তা তবু প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। বরং কালের এই ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আমরা আরো নিশ্চিতভাবে জানি, ঐসব চিন্তা শুধু অতীতের নয়, বর্তমান আর ভবিষ্যতেরও। পল্লী ও নগরের ভিতর বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বাধীনতালাভের পর এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাতে ছাত্রসমাজের ভিতর একটা গভীর বিভেদ ক্রমে দৃঢ় হচ্ছে। একদিকে আছে সেই অতিনাগরিক ছাত্রগোষ্ঠী, স্বদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের যোগ অতি সামান্য, এদেশটাকে গড়ে তুলবার চিন্তা যাদের উদ্বুদ্ধ করে না, বরং বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই যাদের অভিলাষ। অন্যদিকে পাই গ্রাম ও ছোটো শহর থেকে আগত সদ্যশিক্ষিত গোষ্ঠী, ইংরেজীর সঙ্গে যাদের পরিচয় কম, বিশ্বের সঙ্গেও সেই মতো, যাদের চিন্তার দিগন্ত নিতান্ত আঞ্চলিক। আগামী শতকের ভারত গড়বার কাজে নেতৃত্ব তবে আসবে কোন পথে? সমস্যার এই এক রূপ। সত্যের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে মানুষের, বিচ্ছিন্নতা আরো নানা রূপে ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা তত সমাজের ভিতর আছেই। কিন্তু শিক্ষা যখন তাকে আরো বাড়িয়ে তোলে তখন শিক্ষাব্রতীর কাছে সেটা বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। সেটাকে তখন বলি, শিক্ষার বিকার। কোথাও আনন্দ ও সৃজনশীলতার পথরোধ করে দাঁড়ায় বিদ্যালয়, মানুষের ব্যক্তিত্বকে করে পঙ্গু, যা থেকে আসে ধ্বংসাত্মক আক্রোশ। কোথাও শেখানো হয় স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্ব, বিজাতি ও বিধর্মীর প্রতি সন্দেহ, নিহিত আছে যাতে মানবতারই প্রতি অবিশ্বাস।
বিচ্ছিন্নতা দূর করবার পথ রচনা করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে সমম্বয়সাধন তাঁর শিক্ষাদর্শের মূল কথা সেটা শুধুই কবির কল্পনা নয়। এ যুগের সংকটের সঙ্গে তার যোগ। এইখানে তার বাস্তবতা, তার গভীরতর প্রাসঙ্গিকতা।
.
ঢাকায় বাংলা একাডেমীর বিশেষ সভায় ২৪শে মে ১৯৮৬ সালে প্রদত্ত মৌখিক ভিত্তিতে লিখিত প্রবন্ধ।
সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)