৪.৩ ভয়াবহ ষড়যন্ত্র

ভয়াবহ ষড়যন্ত্র

মিশরের সে এলাকায় বর্তমানে আসওয়ান ডেম অবস্থিত, আটশত বছর আগে সেখানে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ আইউবী আমলের সেই যুদ্ধের কথা উল্লেখই করেননি। ইতিহাসে শুধু এতটুকু উল্লেখ পাওয়া যায় যে, সুলতান আইউবীর একজন সেনাপতি বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার ডায়েরীতে সেই সেনাপতির নামও লিখে রেখেছেন। নামটা হল, আল-কানাজ বা আল-কি। লোকটা ছিল মিশরী মুসলমান। তার মা ছিলেন সুদানী। সম্ভবত সুদানী রক্ত-ই তাকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উস্কে দিয়েছিল। সে যুগের ঐতিহাসিকদের প্রকাশিত পান্ডুলিপিতে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে তার বিদ্রোহের পটভূমি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১১৭৪ সালের শেষ এবং ১১৭৫ সালের শুরুর সময়। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মিশরে অনুপস্থিত। নুরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলায় তিনি এখন দামেস্ক অবস্থান করছেন। ষড়যন্ত্র-শিকার অপ্রাপ্ত বয়স্ক আনাড়ী খলীফার হাত থেকে দামেস্ক দখল করার পর হেস ও হামাত দুর্গও জয় করেছেন। হাব দুর্গ অবরোধ করতে গিয়ে তিনি অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। সেই সঙ্গে ত্রিপোলীর খৃস্টান ম্রাট রেমন্ডের আক্রমণের শিকার হন তিনি। সুলতান আইউবী হাবের অবরোধ প্রত্যাহার করে পিছনে সরে গিয়ে খৃস্টান বাহিনীকে পথেই প্রতিহত করার কৌশল অবলম্বন করেন। সুলতান আইউবী তার কৌশলে সফল হন এবং রেমন্ড লড়াই ত্যাগ করে পিছনে সরে যায়। কিন্তু সেখানে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি; বরং সেখান থেকেই মূল যুদ্ধের সূচনা হয়।

সুলতান আইউবী আলরিস্তান পর্বতমালায় তার বাহিনীকে ছড়িয়ে রেখেছেন। একই সময়ে তাকে তিনটি শত্রুর মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এক. আস-সালিহ ও তার সহচরগণ। দুই. খৃস্টান বাহিনী। তিন. ঋতু। পরিস্থিতিটা ১১৭৫ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসের, যখন পাহাড়ের চূড়াগুলো সাদা রফে ঢাকা এবং জনবসতিগুলো শীতে কাঁপছে থর থর করে। সুলতান আইউবী সেখানে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, যেন তিনি লোহার শিকলে বাঁধা পড়েছেন।

মিশরের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নন সুলতান। তিনি সেখানকার সেনাকমান্ড আপন ভাই আল-আদেলের হাতে অর্পণ করে এসেছেন। সেখান থেকে কিছু ফৌজ তিনি পরে তলব করে নিয়েও এসেছেন। মিশরের উপর সমুদ্রের দিক থেকে খৃস্টানদের এবং দক্ষিণ দিক থেকে সুদানীদের হামলার আশংকা বিদ্যমান। তার চেয়েও বেশী শংকা খৃস্টান ও সুদানীদের গোপন নাশকতামূলক তৎপরতা। মিশরে দুশমনের গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতা অনেকটাই দমন করা হয়েছে বটে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে বলা যায় না। এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে কায়রো রেখে এসেছেন। ভাই আল-আদেলকেও তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক করে এসছেন। কিন্তু আল-আদেল ও আলী বিন সুফিয়ান দুজনে মিলেও সুলতান আইউবীর শূন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হননি।

মিশর ত্যাগ করার সময় মিশরের সীমান্তে ও উপকূলীয় রক্ষীবাহিনীর ব্যাপারে সুলতান তাঁর ভাই আল-আদেলকে নির্দেশ প্রদান করে যান, সুদানী সীমান্তে যদি সামান্যতম গন্ডগোলও দেখা দেয়, তাহলে যেন কঠোর হাতে তার মোকাবেলা করা হয় এবং প্রয়োজন হলে যেন সুদানের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে যুদ্ধ করা হয়। কিন্তু অতি জরুরী একটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে ভুলে যান সুলতান। তাহল, সীমান্ত বাহিনীর বদলি। সে সময়ে সীমান্ত বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য ও কমান্ডার এমন ছিল যে, তারা দুবছরের বেশি সময় ধরে সীমান্তে নিয়োজিত রয়েছে। এরা সেই বাহিনী, যারা দুশমনের সঙ্গে জানবাজি লড়াই লড়ে এসেছে। কাজেই তাদের হৃদয় দুশমনের ঘৃণায় পরিপূর্ণ। তারা সুদানীদের কিছুই মনে করে না। তাদের আগে সীমান্ত প্রহরায় যে বাহিনী ছিল, তারা ভাল ছিল না। তাদের উপস্থিতিতেই মিসরের বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী চোরাচালান হয়ে সুদান চলে যেত। সুলতান আইউবী ময়দান থেকে ফিরে এসে সেই বাহিনীকে বদলী করে ময়দান থেকে আনা বাহিনীকে সীমান্তে নিয়োজিত করেন। তারা সীমান্তে পৌঁছেই ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই তারা মিশরের সীমান্তকে সুরক্ষিত করে ফেলে।

এটি দু-আড়াই বছর আগের ঘটনা। শুরুতে তাদের মনে জোশ ও জযবা ছিল এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর তারা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়ে। এই বেকারত্ব তাদের চেতনাকে উই পোকার ন্যায় খেয়ে ফেলতে শুরু করে। সুলতান আইউবী ছিলেন একজন দূরদর্শী মানুষ। তিনি প্রতিটি দিক, প্রতিটি কোণ ও প্রতিটি ক্ষেত্রের উপর সমানভাবে দৃষ্টি রাখতেন। কিন্তু সীমান্ত বাহিনীর বদলির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির প্রতি ব্যক্তিগতভাবে তিনি দৃষ্টি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। সীমান্ত বাহিনীর বিভাগটাই ছিল আলাদা, যার কমান্ডার ছিল সেনাপতি পদমর্যাদার এক ব্যক্তি, যার নাম আল-কি। বছরে তিনবার না হোক অন্তত দুবার সেনাবদলি ছিল তার দায়িত্ব। কিন্তু লোকটা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটা করল না। ফলে এই অবহেলার পরিণতি ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে।

একই পরিবেশ, একই আবহাওয়া এবং একই ভূখন্ডে অবস্থান করে ও দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রহরার দায়িত্ব পালন করতে করতে এই সৈন্যরা বিরক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। সুদান নিশ্চুপ। চোরাচালানী বন্ধ। বেকারত্ব ও অলসতা সৈন্যদের মন-মানসিকতার উপর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া ফেলতে শুরু করেছে। তাদের হাতে এখন না আছে কোন কাজ, না আছে বিনোদনের কোন উপায় উপকরণ। ঋতুতেও কোন পরিবর্তন নেই। বালির সমুদ্র, বালির টিলা ছয়মাস আগে যেমন, এখনো তেমন। আকাশের বর্ণেও কোন পরিবর্তন নেই। এই পরিস্থিতি ও সৈন্যদের বিরক্তির প্রথম ক্রিয়া এই দেখা দেয় যে, টহলরত অবস্থায় কোন পথিককে পেলে তুমি কে, কোথায় যাচ্ছ, তোমার সঙ্গে কী? এসব প্রশ্ন করার পরিবর্তে থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিচ্ছে এবং এটা ওটা বলে চিত্তরঞ্জন করছে। যেসব চৌকির সন্নিকটে জনবসতি আছে, তারা গ্রামে ঢুকে পড়ে লোকদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, গল্প-গুজব করছে।

একটি দেশের সীমান্ত প্রহরীদের এই আচরণ দেশের জন্য ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালনে অতিষ্ঠ সৈনিক। কোন না কোন উপায়ে কোন না কোন স্থানে গিয়ে মনোরঞ্জন করা এখন তাদের মানবিকতার দাবি। তাদের কমান্ডারও তাদের-ই ন্যায় মানুষ। তিনিও সময় কাটানোর এবং বিনোদনের উপায় অন্বেষণে ব্যস্ত।

***

সুলতান আইউবী যখন দামেস্ক রওনা হন, তখন তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, সীমান্ত বিষয়ে সকল প্রকার নিদের্শনা প্রদান করা সত্ত্বেও তাঁর মাথায় আসেনি যে, সীমান্তের পুরাতন বাহিনীর বদলির নির্দেশ প্রদান করে যেতে হবে। সম্ভবত তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন, তাঁর কমান্ডার আল-কি সব দায়িত্ব-ই পালন করে থাকবে। সুলতান আইউবীর চলে যাওয়ার পর যখন আল-আদেল সিপাহসালারের দায়িত্ব বুঝে নেন, তখন তিনি আল-কিনদকে জিজ্ঞেস করেন, সীমান্তে যে বাহিনী রয়েছে, তারা কতদিন যাবত দায়িত্ব পালন করছে? আল কি জবাব দেন, বহুদিন যাবত।

সীমান্তে আরো সৈন্য প্রেরণের প্রয়োজন আছে কি?- আল-আদেল জিজ্ঞেস করেন- আর পুরাতন বাহিনীকে প্রত্যাহার করে কায়রো নিয়ে এসে সেখানে নতুন বাহিনী প্রেরণ করার আবশ্যক রয়েছে কিনা?

না– আল-কিনদ জবাব দেন- এরা সেই বাহিনী, যারা দেশ থেকে তরি তরকারী, খাদ্যদ্রব্য, পশু এবং অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি বিদেশে চোরাচালান হওয়াকে প্রতিহত করেছে। তারা এখন সীমান্ত এবং আশপাশের এলাকায় থাকতে অভ্যস্ত। তারা দূর থেকে সন্দেহভাজন লোকের ঘ্রাণ শুঁকে-ই তাকে গ্রেফতার করে ফেলতে সক্ষম। তাদের স্থলে নতুন সৈন্য প্রেরণ করলে নতুনদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতেই অন্তত এক বছর সময় লেগে যাবে। এমন ঝুঁকি মাথায় তুলে নেয়া আমাদের পক্ষে ঠিক হবে না।

আল-কিনদ-এর জবাবে আল-আদেল নিশ্চিন্ত হন। তাকে একথাও বলার মত কেউ ছিল না যে, এই আল- কিনদ রাতে নিজ ঘরে বসে বলছিলেন, আমার এই সীমান্ত বাহিনীটা অকর্ম হয়ে পড়েছে। আমার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে যে, আমি তাদের বদলি হতে দেইনি। তারা সীমান্ত এলাকার লোকদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করে নিয়েছে। তাদের বর্তমান অবস্থা হল, তাদের পেট সবসময় ভরা থাকে-খাওয়ার ব্যাপারে তাদের কোন অভিযোগ নেই। আমি তাদের জন্য প্রয়োজনের চেয়েও বেশী খাদ্য সরবরাহ করি। কিন্তু তারা প্রবৃত্তির যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে আছে। কোন কাফেলা পথ অতিক্রম করতে দেখলে তারা কাফেলার মহিলাদের মুখ উদোম করে তাকিয়ে থাকে। এবার আমি আমার কাজ করতে পারি।

আল-কিনদ যার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সে একজন সুদানী। মেহমানের বেশে আল-কি-এর ঘরে সে এসেছে। সুদান থেকে তার জন্য উপটোকন নিয়ে এসেছে। সঙ্গে ছিল একটি বার্তা। লোকটি আল-কিনৃদকে জানায়, সুদানীরা প্রস্তুত। কিন্তু সেনাসংখ্যা এখনো ততবেশী সংগৃহীত হয়নি। লোকটি জানতে চায়, সুদানী সৈন্যরা কিভাবে মিসরে প্রবেশ করবে? সীমান্ত অতিক্রম করা তার দৃষ্টিতে একটি কঠিন ব্যাপার। তারই জবাবে আল- কিনদ উপরোক্ত তথ্য পেশ করে।

আল-কিনদ সেই সালারদের একজন, যাদের উপর সুলতান আইউবীর পূর্ণ আস্থা আছে। তিনিও কারো মনে এই সন্দেহ জাগতে দেননি যে, তিনি মিশরের অনুগত নন। আলী বিন সুফিয়ানকে পর্যন্ত তিনি ধোকায় ফেলে রেখেছেন। দু-আড়াই বছর আগে তিনি যে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানী রোধ করেছিলেন এবং সীমান্তকে সম্পূর্ণরূপে সীল করে দিয়েছিলেন, সেই ইমেজই তাকে বেশ কাজ দিচ্ছে। তিনি যে দেশের একজন গাদ্দারে পরিণত হয়েছেন, তা কেউ টেরই পেলনা।

সুলতান আইউবীর চলে যাওয়ার পর আল-কিদ আদেলকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন, আপনি সুদানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকুন। সুদানের একটি পাখিও মিশরে প্রবেশ করতে পারবে না। আলী বিন সুফিয়ানকেও তিনি একই নিশ্চয়তা প্রদান করতে থাকেন। অথচ সুদানে হাবশীদের একদল সৈন্য মিশর আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তাদের পরিকল্পনা হল, তারা ছোট ছোট দলে মিশরে ঢুকে চুপিচুপি কায়রোর নিকটে পৌঁছে যাবে এবং রাতের বেলা হামলা করে রাতেই মিশরের ক্ষমতা দখল করে নিবে।

***

সুদানের গা ঘেঁষে মিসরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে নীল দরিয়া। কিছুটা অগ্রসর হয়ে মিশরীয় এলাকায় প্রশস্ত একটি ঝিলের রূপ ধারণ করেছে নদীটি। আরো সামনে গিয়ে ঢুকে পড়েছে পার্বত্য এলাকার ভেতর। তারপর সম্মুখের দিকে এগিয়ে গেছে নালার রূপ ধারণ করে। তারই নিকটে অবস্থিত আসওয়ান ডেম।

সুলতান আইউবীর আমলে আসওয়ান ডেমের চারপাশের ভৌগলিক অবস্থা ছিল ভিন্ন রকম। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত টিলা আর পাহাড়। ফেরাউনদের বিশেষ সুদৃষ্টির প্রমাণ বহন করছে টিলা ও পাহাড়গুলো। তারা পাহাড় কেটে কেটে তৈরী করেছিল বিশাল বিশাল মূর্তি। সবচে বড় মূর্তিটির নাম আবু সম্বল। কোন কোন পর্বতের চূড়া কেটে কেটে উপাসনালয়ের গম্বুজ কিংবা কোন এক ফেরাউনের মুখের আকৃতি তৈরী করা হয়েছে। পর্বতমালার পাদদেশে তৈরী করা হয়েছে গুহা। অভ্যন্তর অতিশয় প্রশস্ত ও বিস্তৃত। কোন গুহা এমনও তৈরী করা হয়েছে, যার ভিতরে অসংখ্য কক্ষ ও রাস্তা-ঘাট বিদ্যমান।

ফেরাউনরা এই রহস্যময় জগতটা কেন আবাদ করেছিল, তা বলা মুশকিল। পাহাড় কেটে কেটে এই মূর্তি নির্মাণ ও গুহা ইত্যাদি তৈরী করতে অতীত হয়েছে তিনটি বংশধারা। ফেরাউনরা ছিল সে যুগের খোদা। জনসাধারণের কাজ ছিল ফেরাউনদের সেজদা করা এবং তাদের যে কোন আদেশ-নিষেধ মান্য করে চলা। সেই মজলুম ও ক্ষুধা-পীড়িত প্রজাদের দ্বারাই খোদাই করা হয়েছে এই পাহাড়, পর্বত। আজ সেখানে কোন মূর্তি নেই। নেই কোন গুহা বা পাহাড়। বর্তমানে সে স্থানে বিরাজ করছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত আসওয়ান ডেম। এই ডেম তৈরীর আগে পাহাড়ের ন্যায় বৃহৎ বৃহৎ মূর্তিগুলোকে মেশিনের সাহায্যে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ডিনামাইটের সাহায্যে পাহাড়গুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ফেরাউনরা যদি মানুষের হাতে এসব পাহাড়-পর্বতকে এভাবে উড়ে যেতে ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে দেখত, তাহলে তারা খোদা হওয়ার দাবি থেকে হাত গুটিয়ে নিত।..

সুলতান আইউবীর আমলে এই পার্বত্য এলাকাটার চিত্র ছিল অন্য রকম। সে যুগে এই পর্বতমালার উপত্যকা ও গুহায় পৃথিবীর সব সৈন্য লুকিয়ে থাকতে পারত। সীমান্তের যে স্থান দিয়ে নীলদরিয়া মিশরে প্রবেশ করেছে, সুলতান আইউবীর সে এলাকাটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ ছিল। সুদানীরা নৌকায় করে এস্থান দিয়ে মিশর ঢুকে যেতে পারত। এই নদী পথটির উপর দৃষ্টি রাখার জন্য নদী থেকে বেশ দূরে সুলতান আইউবী একটি সেনাচৌকি বসিয়েছিলেন। চৌকি থেকে নদী দেখা যেত, নদী থেকে চৌকি দেখা যেত না। সুলতান আইউবী পরিকল্পিতভাবেই এই দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, যাতে অনুপ্রবেশকারীরা এই আত্মপ্রবঞ্চণায় লিপ্ত থাকে যে, তাদেরকে দেখার ও ধরার মত কেউ নেই। গোপন প্রহরার মাধ্যমে নদীতে চলাচলকারী নৌযানের প্রতি নজর রাখা হত। দুজন অশ্বারোহী প্রতিক্ষণ টহল দিয়ে ফিরত।

সুলতান আইউবীর মিশরে অনুপস্থিতির সময়কার ঘটনা। একদিন দিনের বেলা সীমান্ত চৌকির দুঅশ্বারোহী ডিউটিতে বের হয় এবং প্রতিদিনের ন্যায় দূরে চলে যায়। নদীর কূলে একস্থানে কতটুকু সবুজ-শ্যামল এলাকা। বড় বড় ছায়াদার বৃক্ষ আছে সেখানে। জায়গাটা খুবই মনোরম। টহল সেনারা সুযোগ পেলে এখানে এসে বিশ্রাম নেয়, সময় কাটায়। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা কোন সুদানীকে নদী পার হয়ে এপার আসতে দেখেনি। প্রথমদিকে তারা অনেক লোককে গ্রেফতার করেছে। তাদের অনেকে ছিল নাশকতাকারী ও গুপ্তচর। তারপর থেকে এই নদীপথে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সান্ত্রীরা আসে শুধু ডিউটি পালন করার জন্য এবং চৌকির দৃষ্টির বাইরে চলে এসে কোথাও বসে আরাম করে সময় কাটায়।

এই দু’অশ্বারোহীর নিয়মও একই ছিল। এখন তারা বিরক্ত ও অতিষ্ঠ। নদীকূলের এমন সবুজ-শ্যামল জায়গাও এখন তাদের কাছে ভাল লাগে না। প্রতিদিন নদী দেখে দেখে তারা তার সৌন্দর্যের প্রতি নির্মোহ হয়ে পড়েছে। বহিঃজগতের কোন বস্তু এখানে চোখে পড়ে থাকলে তাহল মরু শিয়াল। ওরা নদীতে পানি পান করতে আসে আর সান্ত্রীদের দেখে পালিয়ে যায়। আর দেখা যেত দু-চারজন মৎস্যশিকারী। সুলতান আইউবীর সান্ত্রীরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করত, তোমরা কোথাকার লোক। পরে তারা এই প্রশ্ন করাও ছেড়ে দিয়েছে আর এক সময় ওরাও আসা বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিন সান্ত্রীরা টহল এলাকায় পৌঁছে বলাবলি করতে শুরু করে। আমাদের সঙ্গীরা কায়রো, ইস্কান্দারিয়া ও অন্যান্য শহরে বসে আয়েশ করছে আর আমরা এই জঙ্গল–বিয়াবানে পড়ে রয়েছি। তাদের কণ্ঠে ক্ষোভ ও অস্থির আভাস।

সান্ত্রীরা দূর থেকেই দেখতে পায়, সবুজ এলাকায় চার-পাঁচটি উট বাঁধা রয়েছে। পার্শ্বে এক স্থানে উপবিষ্ট আট-দশজন লোক। চারজন মানুষ নদীতে গোসল করছে। অশ্বারোহী সান্ত্রীদ্বয় কতটুকু সামনে অগ্রসর হয়ে থমকে দাঁড়ায়। গোসলরত প্রাণীগুলো সম্ভবত মানুষ নয়। তারা পরী। গায়ে হালকা কাপড়। কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে গোসল করছে তারা। তাদের গায়ের রং মিশরী নারীদের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়। তারা গোসল করছে আর হাসাহাসি করছে। সান্ত্রীদ্বয় এই ভেবে ঘাবড়ে যায় যে, ওরা কি জলপরী, আকাশপরী, নাকি ফেরাউনদের রাজকন্যাদের প্রেতাত্মা! সান্ত্রীদ্বয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। তারা আর সামনে অগ্রসর না হয়ে সেখান থেকেই ফিরে যাওয়ার মনস্থ করে। কিন্তু এমন সময় উটের পার্শ্বে উপবিষ্ট লোকগুলোর দু ব্যক্তি উঠে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েরাও তাদেরকে দেখে ফেলে। তারা নদী থেকে উঠে কূলবর্তী ডাঙ্গায় একস্থানে লুকিয়ে যায়। সান্ত্রীদের ভয় কিছুটা কেটে যায়। তারা অগ্রসরমান ব্যক্তিদ্বয়ের নিকট এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কারা? এখানে কী করছ? তারা মাথা ঝুঁকিয়ে সান্ত্রীদের সালাম করে। লোকগুলো মরুবাসীর পোশাক পরিহিত। তার বলল, আমরা কায়রোর ব্যবসায়ী। সীমান্তবর্তী এলাকায় মাল বিক্রি করে ফিরে যাচ্ছি।

কায়রো যাওয়ার পথ তো এটা নয়। এক সান্ত্রী বলল।

আমাদের সঙ্গে কয়েকটা মেয়ে আছে। তাদের শখ, তারা নদীর কূলে কূলে যাবে- একজন জবাব দেয়- আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কোন তাড়া নেই। দু-তিনদিন এখানেই অবস্থান করব। আপনাদের যদি সন্দেহ হয়, তাহলে আসুন, আমাদের মাল-পত্র পরীক্ষা করে দেখুন। আমাদের নিকট প্রচুর অর্থ আছে। তাও দেখুন। তাতেই আপনারা নিশ্চিত হবেন যে, আমরা সত্যিই মিশরী ব্যবসায়ী।

অশ্বারোহী সান্ত্রীদ্বয় তাদের সঙ্গে হাঁটা দেয় এবং তাদের তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছে। দেখে অন্য সবাই ওঠে দাঁড়িয়ে তাদের সম্মান প্রদর্শন করে। সবাই মাথানত করে সালাম জানিয়ে তাদের সঙ্গে হাত মিলায়। একজন সরলমনে জিজ্ঞেস করে, আমাদের মাল-পত্র খুলে দেখবেন কি? সান্ত্রীদ্বয় পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এবং বলে, না, দেখার প্রয়োজন নেই। একজন সুলতান আইউবীর ফৌজের প্রশংসা করতে শুরু করে। তারপর তারা সান্ত্রীদের যৌবন, বীরত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠার তারিফ করে। তারা মুখে এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করল না, যার ফলে তাদের ব্যাপারে সান্ত্রীদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে।

ইত্যবসরে মেয়ে চারটি পোশাক পাল্টিয়ে ও মাথার চুল ঝেড়ে তাঁবুতে এসেছে। কিন্তু তারা সরাসরি সামনে না এসে লাজুক মুখে আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সান্ত্রীরা এই বিরানভূমিতে দু-আড়াই বছরে এই প্রথম কয়েকজন মানুষের মজমা দেখতে পেল এবং এই দীর্ঘ সময়ে এই প্রথমবারের মত তারা নারীর মুখ দেখল। তারা মেয়েগুলোর মধ্যে নারীর সব রূপ-ই দেখতে পেল। মা, বোন, স্ত্রী এবং সেই নারী, যে না বোন, না মা, না স্ত্রী। সান্ত্রীদের চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে গেছে যেন মেয়েগুলো। মেয়েগুলো তাদের প্রতি তাকিয়ে তাকিয়ে লজ্জা প্রকাশ করছে এবং মুখ লুকিয়ে হাসছে। তাদের লাজ-শরম প্রমাণ করছে, তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা।

লোকগুলোর সহজ-সরল কথামালা আর মেয়েগুলোর রূপের জাদুতে ফেঁসে যায় সুলতান আইউবীর দুই সীমান্ত প্রহরী। কর্তব্যের কথা ভুলে যায় তারা। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় পড়ে থাকা এবং কাজ-কর্ম না থাকার প্রতিক্রিয়ায় ভয়াবহ এই যৌন পিপাসা তাদের ঘায়েল করে ফেলছে। এক ব্যক্তি নদীর কূলে দাঁড়িয়ে বঁড়শি দ্বারা মাছ ধরছিল। লোকটা অনেকগুলো মাছ শিকার করেছে। একজন মেয়েদের বলল, যাও মাছগুলো রান্না কর। নির্দেশ পাওয়ামাত্র চারটি মেয়ে ছুটে যায়। তারা মাছগুলো কেটে রান্না করে ফেলে।

***

অশ্বারোহী সীমান্ত প্রহরীদ্বয় তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও ত্যাক্ত বিরক্ত। তাদেরকে উন্নত খাবার পরিবেশন করা হয় বটে; কিন্তু প্রতিদিন একই খাবার খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। নীল নদের কূলে যখন তাদের সামনে ভুনা মাছ আর রান্না করা শুকনো গোশত পরিবেশন করা হল, দেখেই তাদের জিহ্বায় পানি এসে গেল। তার উপর যখন সবাই একসঙ্গে খাওয়া শুরু করে, খাবার আরো সুস্বাদু হয়ে ওঠে। আহারের মাঝে তারা দেখল, একটি মেয়ে তাদের একটি ঘোড়ার ঘাড় ও শিং-এ হাত বুলাচ্ছে এবং ঘোড়াটাকে আদর করছে। মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে খেতে বসেনি। এই ঘোড়াটা যে সান্ত্রীর, সে মেয়েটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। মেয়েটিও তার উপর চোখ পড়ামাত্র মুচকি একটা হাসি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সান্ত্রীরা এত রূপসী মেয়ে আগে কখনো দেখেনি।

এক বৃদ্ধ সান্ত্রীদের বলল- আমাদের এই মেয়েরা কখনো ঘোড়ায় চড়েনি। যে মেয়েটা ঘোড়ার নিকট দাঁড়িয়ে আছে, ওর ঘোড়ায় চড়ার বড় শখ। কিন্তু কখনো-ই তার ঘোড়ার পিঠে বসার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

আমরা চারজনের-ই শখ পূরণ করব। এক সান্ত্রী বলল।

আহার শেষে সান্ত্রী উঠে তার ঘোড়ার নিকট চলে যায়। মেয়েটি মাথানত করে লাজুক মুখে একদিকে সরে দাঁড়ায়। সান্ত্রী তাকে বলল- আস, আমি তোমার ঘোড়ার পিঠে চড়ার শখ পুরণ করব। একজন একজন করে সবাইকে ঘোড়ায় চড়াব।

পিছন দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এল- লজ্জা কর না; এরা তোমাদের ইজ্জত ও দেশের মোহাফেজ। এরা না থাকলে খৃস্টান ও সুদানীরা তোমাদের কী দশা ঘটাবে, আল্লাহ-ই ভাল জানেন।

মেয়েটি মাথার ওড়নাটা নীচের দিকে টেনে নিয়ে ঘোমটার মত করে পা টিপে টিপে ঘোড়ার নিকটে চলে যায়। সান্ত্রী তার পা রেকাবে তুলে দিয়ে পাজাকোলা করে তাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দেয়। এমন সময় কে একজন পিছন থেকে সান্ত্রীকে ডাক দিয়ে কি যেন বলতে শুরু করে। সান্ত্রী সে দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। হঠাৎ ঘোড়াটা একদিকে ছুটতে শুরু করে। মেয়েটা চীৎকার জুড়ে দেয়। সান্ত্ৰী ঘাড় ফিরিয়ে দেখে ঘোড়া দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছে এবং পিঠে বসা মেয়েটি এদিক-ওদিক দুলে পড়ছে আর সামলে বসে থাকার চেষ্টা করছে। সবাই হৈ-হুঁল্লোড় জুড়ে দেয় যে, ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে পড়েছে মেয়েটা পড়ে মরে যাবে। সান্ত্রীর নিকটে তার সঙ্গীর ঘোড়াটা দাঁড়ান ছিল। সে এক লাফে তাতে চড়ে বসে চারুক মেরে ছুটে চলে। মেয়েকে বহনকারী ঘোড়া চোখের আড়ালে চলে গেছে। সান্ত্রী তার ঘোড়ার গতি যতটুকু সম্ভব বাড়িয়ে দেয়। তার জানা মতে এতক্ষণে মেয়েটি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেছে, তার পা দুটো রেকাবের সঙ্গে আটকে গেছে। হাড়-গোড় ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে এবং ঘোড়া তাকে টেনে-হেঁচড়ে হাড়-মাংস আলাদা করে ফেলছে।

সান্ত্রী ছুটে চলছে। এখন তার সম্মুখে ভোলা মাঠ। কিন্তু না, মেয়েটার তো কিছু-ই হয়নি! ঔ তো ঘোড়া তাকে নিয়ে ছুটে চলছে! কতটুকু অগ্রসর হয়ে তার ঘোড়া একদিকে মোড় নিয়েই আবারো চোখের আড়ালে চলে যায়। সান্ত্রী মেয়েটির চীৎকার ও ঘোড়ার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু ঘোড়া দেখা যাচ্ছে না। কতদূর অগ্রসর হয়ে সেও একদিকে মোড় ঘুরায়। কিন্তু এখন না ঘোড়া দেখা যাচ্ছে, না মেয়েটির চীৎকার শোনা যাচ্ছে। সান্ত্রী ভাবে, সম্ভবত ঘোড়া কোন গর্তে পড়ে গেছে। সে ঘোড়ার গতি কমিয়ে দেয়। এগিয়ে যায় আরো কতটুকু সামনে। এবার মেয়েটির ডাক তার কানে আসে- এদিকে আস, জলদি আমার কাছে আস।

সান্ত্রী সেদিক তাকায়। অবস্থা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। একি! ঘোড়াটা বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে, আর মেয়েটি দিব্যি তার পিঠে বসা! তার চেহারায় ভয়-ভীতির কোন ছাপ নেই; বরং দুঠোঁটে মুচকি হাসি! সান্ত্রী একবার ভাবে, ঘোড়া হাঁকিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাই। সে নিশ্চিত, মেয়েটি মানুষ নয়- জিন-পরী কিংবা ভূত-প্রেত। ফাঁকি দিয়ে তাকে এই নির্জন জায়গায় নিয়ে এসেছে আর এখন তার রক্ত পান করবে। কিন্তু মেয়েটির মুখের মুচকি হাসি আর দেহের রূপ-লাবণ্যে এতই শক্তি যে, সিপাহীকে ঘোড়াসহ কাছে টেনে নিয়ে যায়।

তুমি সৈনিক- তুমি পুরুষ- মেয়েটি বলল- তুমি আমাকে ভয় করছ?

মেয়েটি সান্ত্রীর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল- ঘোড়া বে-লাগাম হয়নি। আমি ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছি আর চীৎকার করে বুঝাবার চেষ্টা করেছি, ঘোড়া বে-লাগাম হয়ে গেছে এবং আমি পড়ে যাচ্ছি। আমার জানা ছিল, তুমি আমার পিছনে পিছনে ছুটে আসবে। আমি আনাড়ি নই- দক্ষ ঘোড়সওয়ার।

এই ধোকাটা তুমি কেন দিয়েছ? সান্ত্রী জিজ্ঞেস করে।

আমাকে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন- মেয়েটি বলল- কথাটা সকলের সামনে বলা সম্ভব ছিল না। ঐ লোকগুলোর মধ্যে তুমি একজন বৃদ্ধলোক দেখেছ। তিনি আমার স্বামী। তুমি তার বয়স দেখ আর আমার যৌবনও দেখ। লোকটা আমাকে খুশী রাখার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

অপর মেয়েরা কারা? সান্ত্রী জিজ্ঞেস করে।

ওরা দুজনই বিবাহিতা মেয়েটি জবাব দেয়। তাদের স্বামীরা যুবক। বিনোদনের জন্য তারা ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি আমাকে সাহায্য কর।

লোকটা যদি তোমাকে অপহরণ করে নিয়ে আসত, তাহলে আমি তাকে ধরে চৌকিতে নিয়ে যেতাম- সান্ত্রী জবাব দেয়। কিন্তু তুমি তো তার স্ত্রী।

আমি তাকে স্বামী বলে স্বীকার করি না। তাছাড়া তোমাকে দেখার পর তার প্রতি আমার ঘৃণা আরো বেড়ে গেছে- আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মেয়েটি বলল- তোমাকে প্রথমবার দেখামাত্র আমার অন্তর থেকে আওয়াজ আসল, এই যুবক-ই তোমার স্বামী। আল্লাহ তোমাকে এই সুদর্শন যুবকটির জন্যই সৃষ্টি করেছেন।

আমি অত সুশ্রী নই, যতটা তুমি বলছ- সান্ত্রী বলল- তুমি কেন আমাকে ধোকা দিচ্ছ? তোমার মনে কী আছে, খুলে বল।

আল্লাহ জানেন আমার অন্তরে কী আছে- দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ কণ্ঠে মেয়েটি বলল- তিনিই হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক করবেন। তুমি যদি আমার হৃদয়ের আওয়াজকে প্রতারণা মনে করেও থাক, তারপরও আমি আর বুড়োটার কাছে ফিরে যাব না। ঘোড়া হাঁকিয়ে ঘোড়াসহ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আল্লাহর নিকট গিয়ে বলব, তুমি আমাকে হত্যা করেছ।

সান্ত্রী সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী, আলী বিন সুফিয়ান কিংবা আল আদেলের ন্যায় ব্যক্তিত্ব নয়- একজন ত্যাক্ত-বিরক্ত সাধারণ সৈনিক। তদুপরি টগবগে যুবক। মেয়েটির রূপ-যৌবন ও চলন-বলন তাকে মোমে পরিণত করে ফেলেছে। তবে তার এতটুকু অনুভূতি আছে যে- আমি একজন সাধারণ সৈনিক আর তুমি রাজকন্যার সমান। কোমল গালিচা থেকে নেমে এসে আমার সঙ্গে এই বালুকাময় প্রান্তর আর পাহাড়-উপত্যকায় টিকতে পারবে না।

নরম গালিচা ও ধন-দৌলত আমার লক্ষ যদি হত, তাহলে ঐ বৃদ্ধ অপেক্ষা ভাল স্বামী আর হতে পারে না- মেয়েটি বলল- লোকটা তো তার সমুদয় ঐশ্বৰ্য্য আমার পায়ের উপর ফেলে রেখেছে। আমার একান্ত আকাংখা, আমি একজন সৈনিকের স্ত্রী হব। আমার পিতাও সৈনিক। বড় দুভাইও সৈনিক। তারা সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে দামেস্ক ও সিরিয়ার ময়দানে যুদ্ধ করছে। আমার মা আমাকে এই বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমরা গরীব মানুষ। আমার রূপ-সৌন্দর্যই আমাকে এই দুভাগ্যের পথে ঠেলে দিয়েছে। আমি একজন দক্ষ অশ্বারোহী। কিন্তু আমার স্বামী বিষয়টা জানেন না। আমি বহুবার আকাংখা করেছি, আমি সুলতান আইউবীর বাহিনীতে যোগ দেব। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে একজন সৈনিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করব। তুমি আমাকে বালুকাময় প্রান্তর আর পাহাড়-উপত্যকার ভয় দেখিও না। মরুভূমিতে আমার জন্ম। মরুভূমির উত্তপ্ত বালি যখন আমার রক্ত চুষে নিবে, তখন-ই কেবল আমার আত্মা নিশ্চিন্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে।

আমি কিভাবে তোমার সাহায্য করতে পারি বল। সান্ত্রীর পরাজিত কণ্ঠ।

 ওঠ, আমরা ধীরে ধীরে ফিরে যাই। ওরা আমাদের পিছনে পিছনে এসে থাকবে হয়ত। পথে তোমাকে বলব, আমি কী ভাবনা ভেবে রেখেছি। মেয়েটি বলল।

সান্ত্রী ও মেয়েটি যার যার ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে পাশাপাশি চলছে। মেয়েটি বলছে, আমি তোমাকে বলব না যে, তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। এটা আইনত অপরাধ হবে। আমার স্বামী আদালতে মামলা করবে, আমরা উভয়ে শাস্তি ভোগ করব। আমাকে আগে স্বামীটা থেকে মুক্ত হতে হবে। তার পন্থা হল, তাকে এমনভাবে হত্যা করতে হবে, যা মূলত হত্যা বলে মনে হবে না। তুমি না পারলে কাজটা আমি করব। একটা পদ্ধতি এই হতে পারে যে, মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তাকে পান করাব আর রাতের বেলা নদীর কিনারে নিয়ে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দেবে। মানুষ মনে করবে, লোকটা নিজেই নেশা করে পানিতে পড়ে গেছে। এর জন্য দু-চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। তার জন্য আমি তাকে এখানেই রেখে দেব।

তোমার সঙ্গে কি বিষ আছে? সান্ত্রী জিজ্ঞেস করে।

থাকতে হবে না- খিলখিল করে হেসে উঠে মেয়েটি বলল- তুমি আসলে আস্ত একটা বন্ধু সৈনিক। আমি কায়রো থেকে অনেক দূরে এক উঁচু এলাকার বাসিন্দা এই নদীটা যেখান থেকে এসেছে ঠিক সেখানে আমার বাস। আমাদের প্রধান খাদ্য হল মাছ। মাছের পিত্ত বিষে পরিপূর্ণ থাকে। তুমি দেখেছ, আমরা এখানেও মাছ শিকার করে থাকি। রান্না করার সময় আমি মাছের একটা পিত্ত লুকিয়ে রাখব আর তার কয়েক ফোঁটা বিষ নিয়ে মদের সঙ্গে মিশিয়ে বুড়োকে খাইয়ে দেব। তারপর ভ্রমণের নাম করে নদীর কূলে নিয়ে গিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বেটাকে নদীত ফেলে দেব।

তারপর আমি তোমাকে কিভাবে নিয়ে যাব? সান্ত্রী জানতে চায়।

বৃদ্ধ মরে গেলে আমি স্বাধীন হয়ে যাব- মেয়েটি জবাব দেয়- আমি সকলকে বলব, তোমরা কেউ আমার অভিভাবক নও যে, তোমরা আমার পছন্দের বিয়ে প্রতিহত করবে। তারপর আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব। তুমি আমাকে আমার বাড়ী পৌঁছিয়ে দেবে। আর শোন, মাঝে-মধ্যে আমার খোঁজ খবর নেবে কিন্তু। আচ্ছা, এখন চলে গেলে তুমি আবার কবে আসবে?

আমি শুধু টহলের সময়টায় আসতে পারব- সান্ত্রী জবাব দেয়- চৌকি এখান থেকে অনেক দূরে। টহলের ডিউটি ছাড়া ঘোড়া ব্যবহার করা যায় না। আগামী কাল দুপুরে এই সঙ্গীর সাথেই এখানে আমার ডিউটি পড়বে। তখন আসব।

এখান থেকে একটু দূরে থেক- মেয়েটি বলল- আমি পথে তোমার সঙ্গে দেখা করব। তারপর কোথাও লুকিয়ে বসে কথা বলব।

মেয়েটি সান্ত্রীর একটি হাত তার মুঠোয় নিয়ে নেয়। সান্ত্রী তার প্রতি তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিও তার চোখে চোখ রাখে। সান্ত্রীর সব সংশয় দূর হয়ে যায়। সে মেয়েটির ডান হাতটা টেনে নিয়ে নিজের বুকে লাগিয়ে চেপে ধরে রাখে।

***

মেয়েটি যেখান থেকে পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছিল, সান্ত্রী ও মেয়েটি সেখানে গিয়ে পৌঁছে। কাফেলার মানুষগুলো তাদের চোখে পড়ে। তারা এদিকে তাকিয়ে রয়েছে। সান্ত্রী ও মেয়েটি সেদিকে ছুটে যায়। দুজন ঘোড়া থেকে অবতরণ করে। মেয়েটির বৃদ্ধ স্বামী উঠে এগিয়ে এসে সান্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে। মুখ দিয়ে কথা সরছে না তার। ঠোঁট কাঁপছে। অন্য লোকেরাও আপুত কণ্ঠে সান্ত্রীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। মেয়েটি তাদেরকে মিথ্যা কাহিনী শোনায়- এই সান্ত্রী নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে আমাকে উদ্ধার করে এনেছে। অন্যথায় ঘোড়া আমাকে গর্তে নিক্ষেপ করে মেরেই ফেলেছিল।

নাটকের প্রথম পর্ব এখানেই শেষ হয়। সান্ত্রীদ্বয় চৌকির অভিমুখে ফেরত রওনা হয়। পথে এই সান্ত্রী তার সঙ্গীকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে। সঙ্গীও জানায়, তুমি চলে যাওয়ার পর অন্য একটি মেয়ে আমাকে প্রেম নিবেদন করে। মেয়েটি প্রথমে আমার প্রতি এক বিস্ময়কর ভঙ্গিমায় তাকাতে থাকে। কাফেলার পুরুষ লোকগুলো অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলছে। আমি তোমার সন্ধানে উঠে কিছুদূর অগ্রসর হই। কিন্তু পায়ে হেঁটে গিয়ে তোমাকে ধরা সম্ভব ছিল না বলে বেশীদূর এগুয়নি। দুটি মেয়ে আমার পিছনে পিছনে এগিয়ে আসে। একজন আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। কথায় কথায় মেয়েটি আমার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি এদিকে আবার কবে আসবে? তোমার সঙ্গে আমার আবার কোনদিন দেখা হবে? আমি বললাম, আগামীকাল দুপুরের সময় এখানে আমাদের ডিউটি থাকবে। মেয়েটি বলল, আমার স্বামী একজন বৃদ্ধ লোক। আমি তাকে ছেড়ে পালাতে চাই।

দুই সৈনিকের একই কাহিনী। তারা ভাবতে শুরু করে, মেয়ে দুটোকে কিভাবে সঙ্গে করে নেয়া যায়। তারা ভাবছে, মেয়েরা যদি তাদের স্বামীকে খুন করতে না পারে, তাহলে আমরা-ই তাদেরকে খুন করব। সুদর্শন এক কল্পনার জাল বুনতে বুনতে চৌকিতে গিয়ে পৌঁছে সুলতান আইউবীর দুই সিপাহী।

তারা চৌকির কমান্ডারকে রিপোর্ট করে- অমুক জায়গায় কায়রোর একটি বণিক কাফেলা অবস্থান নিয়ে আছে। আমরা তাদের তল্লাশী নিয়েছি। তাদের নিকট সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।

সিপাহীরা কমান্ডারকে মেয়েদের সম্পর্কেও অবহিত করে। কমান্ডার রিপোর্টের প্রথম অংশটি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ না করলেও তিনটি রূপসী যুবতী মেয়ের উল্লেখে চমকিত হয়ে ওঠে। মেয়েগুলোর সংখ্যা, বয়স, গঠন আকৃতি, উচ্চতা, রং-রূপ ইত্যাদি সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নেন তিনি।

চৌকিতে অন্য এক চৌকির এক সৈনিক অবস্থান করছিল। সে চৌকিটা এখান থেকে আট-দশ মাইল দূরে অবস্থিত। তার কমান্ডার এই সৈনিককে একটি বার্তা দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন- আজ সন্ধ্যার পর আমার চৌকিতে আসবেন; জরুরী কাজ আছে। একসঙ্গে যাওয়ার জন্য কমান্ডার বার্তাবাহক সৈনিককে বসিয়ে রেখেছেন।

সূর্যাস্তের পর কমান্ডার সিপাহীর সঙ্গে রওনা হয়ে যান। আট-দশ মাইল পথ অতিক্রম করে তারা যখন অপর চৌকিতে পৌঁছেন, তখন অনেক রাত।

চৌকিটা সবুজ-শ্যামল মনোরম একটা এলাকায় অবস্থিত। আজ অতিরিক্ত আরো কিছু জাকজমক চলছে। চৌকির সকল সৈনিক- যাদের এখন ডিউট নেই- চৌকির বাইরে বৃত্তাকারে বসে আছে। স্থানে স্থানে বাতি জ্বলছে। কমান্ডার এখানে নেই। মেহমান কমান্ডার তার তাঁবুতে যান। তাঁবুতে কমান্ডারের সঙ্গে উপবিষ্ট দুটি মেয়ে ও তিনজন মরুবাসী পুরুষ। তাদের সন্নিকটে পড়ে আছে বাদ্যযন্ত্র।

মেহমান কমান্ডারের তাবুতে প্রবেশ করেন। অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়ার আয়োজন করা হল। সবাই খানা খেলেন। আহার শেষে কমান্ডারের নির্দেশে বাদক পুরুষ ও মেয়েরা বেরিয়ে যায়। মেহমান কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন, এরা কারা? বাইরে কী হচ্ছে?

|||||||||| মেয়েগুলো নর্তকী- কমান্ডার জবাব দেন- সঙ্গের পুরুষরা বদক, তারা এ পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। পানি পান করার জন্য অবতরণ করলে আমি ডেকে এনে বসাই এবং কথা বলি। মেয়েগুলোকে আমার ভাল লেগেছে। আমি তাদেরকে খানা খাওয়ালাম। এই রাত তাদেরকে এখানেই রাখব। ওরা বড় ভাল মানুষ।

এই ধারা আমার পছন্দ হয় না- মেহমান কমান্ডার বললেন- এই বিলাসিতা সৈনিকদেরকে নষ্ট করে ফেলবে।

এসব ছাড়া সৈনিকরা নষ্ট হচ্ছে আরো বেশি- মেজবান কমান্ডার বললেন আমাদের সহকর্মীরা শহরে-নগরে আয়েশ করছে আর আমরা এখানে দেউলিয়ার ন্যায় ঘুরে মরছি। এই বিড়ম্বনা থেকে কবে নাগাদ নিস্তার পাব, জানি না। এভাবে জীবন কাটানো যায় না। তোমার সৈনিকরা কি তোমাকে কখনো বলেনি, আমাদেরকে বদলি করা হোক? আমার সৈনিকরা তো আমাকে অস্থির করে ফেলছে।

তা বটে, আমার চৌকিতে তো এ নিয়ে দুসৈনিকের মধ্যে মারপিটও হয়ে গেছে- মেহমান কমান্ডার বললেন- এখন তো সৈনিকরা সামান্য ব্যাপারেও রেগে ওঠে।

আমি আমার সালার আল-কিনৃদ-এর নিকট আবেদন প্রেরণ করেছি যে, এবার আমাদের প্রতি রহম করুন এবং আমাদেরকে প্রত্যাহার করে নিন মেজবান কমান্ডার বললেন- কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি। আমি বলেছি, আমাদেরকে সেই ময়দানে পাঠিয়ে দিন, যেখানে ঘোরতর লড়াই চলছে। যেখানে কোন কাজ নেই, সেখান থেকে আমাদের সরিয়ে নিন। এখানে যে কাজ ছিল, তা আমরা সম্পন্ন করেছি। এখানে অন্য বাহিনী প্রেরণ করা হোক।

অপর চৌকি থেকে আসা কমান্ডারের ভাবনাও একই। উভয় কমান্ডার ও তাদের অধীন সৈনিকরা একই পরিস্থিতির শিকার। উপরের সামান্য অবহেলা ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে দেশটাকে। দুশমনের উপর বিদ্যুতের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ত অকুতোভয় যে ফৌজ, তারা আজ চরম মানসিক বিপর্যয়, নৈতিক অধঃপতন ও বিশৃংখলার শিকার। তারা আজ বিনোদনের উপায় খুঁজে ফিরছে এবং কর্তব্য পালনের পরিবর্তে নাচ-গান ও বাদ্য-বাজনা দ্বারা মন ভুলানোর চেষ্টা করছে।

***

রাত কেটে যাচ্ছে। মেয়েরা পালাক্রমে নাচছে-গাইছে। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে গানের সুর ধরে বাদকরা। সৈনিকরা চীৎকার ও করতালি দিয়ে তাদের প্রশংসা করছে, উৎসাহ প্রদান করছে। তিন-চারজন সৈনিক মেয়েদের দিকে পয়সা ছুঁড়ে মারে। কিন্তু মেয়েরা এই বলে সেগুলো ফিরিয়ে দেয় যে, আমরা দেশের অতন্দ্র প্রহরী মোহাফেজদের নিকট থেকে পয়সা নেই না। বাদকরা দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে বলে, আমরা বিনিময় নেব না। আমাদের নাচ গানে যদি আপনারা আনন্দ পেয়ে থাকেন, তাহলে আবার তলব করবেন। যখনই বলবেন, আমরা এসে যাব। কোন বিনিময় ছাড়াই আমরা আপনাদের আনন্দ দিয়ে যাব।

দর্শনাথীদের দুজন কমান্ডার। পদমর্যাদায় উচ্চ না হলেও দায়িত্বশীল লোক তো বটে। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্বের কথা ভুলে গেছে। এই গায়ক-নর্তকীরা কোথা থেকে আসল এবং কোথায় যাবে এবং নিজেদের যে পরিচয় প্রদান করল, তা সঠিক কিনা, তাও তারা জানবার চেষ্টা করল না। কমান্ডারগণ এ ও দেখল না যে, আসরে শ্রোতা-দর্শনার্থীদের মাঝে মিশরের মরুবাসীর পোশাকে যে কজন অপরিচিত লোক এসে বসল, তারা কারা এবং কোথা থেকে এসেছে। তারা এটাও লক্ষ্য করল না, চৌকির চারজন সৈনিক টহল প্রহরা থেকে আগে-ভাগে ফিরে আসল এবং তাদের পরিবর্তে অন্য সৈনিক পাঠানো হল না।

চৌকি থেকে দূরবর্তী একটি স্থান। অমাবশ্যার রাতের ন্যায় কালো চেহারার অন্তত পঞ্চাশজন লোক একজন অপরজনের পিছনে দল বেঁধে সুদানের দিক থেকে এদিকে আসছে। কাফেলার অনেক সম্মুখে অবস্থান করছে আরো দুব্যক্তি। কাফেলা সামান্য পথ অগ্রসর হয়ে থেমে যাচ্ছে। সম্মুখের লোক দুজন এদিক-ওদিক দেখে কাফেলাকে পথনির্দেশ করছে। কখন কোন্ দিকে যাবে, কোন্ পথে চলবে, স্থির করে তারা শকুনের ন্যায় শব্দ করছে আর তাদের সংকেত অনুসারে পিছনের কাফেলা অগ্রসর হচ্ছে। কাফেলাকে থামাতে হলে তারা শিয়ালের ন্যায় রা করছে।

চৌকির বাদ্য-রাজনার উচ্চ শব্দমালা মিশর সীমান্তের নীরব পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

সম্মুখে পার্বত্য এলাকা। কাফেলার কালো মানুষগুলো ঘোড় অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্বতমালার ফাঁকে ঢুকে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে বর্শা, তীর-ধনুক, তরবারী ও খঞ্জর। তাদেরকে স্বাগত জানানোর লক্ষ্যে সেখানে অবস্থান করছে জনাচারেক মানুষ। তাদের একজন আগত কাফেলার সরদারকে অভিবাদন জানিয়ে হাসিমুখে বলল মেয়েরা কাজ করে ফেলেছে স্যার।

হ্যাঁ, খবর পেয়েছি- সরদার বলল- আমরা বাদ্যের সুর শুনতে এসেছি। দশ-বারজন লোককে আমরা আগেই সেখানে পাঠিয়ে রেখেছিলাম। তাদের একজন এসে সংবাদ দিয়ে গেল, আসর তুঙ্গে উঠে গেছে এবং রাস্তা পরিষ্কার। টহলদার সিপাহীরাও আসরে চলে এসেছে।

নীল নদ থেকেও ভাল সংবাদ এসেছে- অভ্যর্থনাকারীদের একজন বলল তারা মেয়েদের দ্বারা ঠিক ঠিক কাজ নিয়েছে। আগামীকাল রাতে ওখানে যে দুসিপাহীর ডিউটি থাকবে, তাদেরকে ফাঁদে আটকে ফেলা হয়েছে। আমি সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছি। আগামীকাল রাত পর্যন্ত কমপক্ষে তিনটি বড় নৌকা এসে যাবে।

তারা সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সম্মুখে সারি সারি পাহাড়। দলনেতা দাঁড়িয়ে যায় এবং কাফেলার সবাইকে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়। সে অভ্যর্থনাকারীদের সঙ্গে কানে কানে বলে- একথা ভুলে যেওনা, এরা সবাই হাবশী। তাদের ধর্ম অত্যন্ত বিস্ময়কর। তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি তোমাদেরকে অবাক করে ফেলবে। তোমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে। তারা যদি চরম হাস্যকর কোন আচরণও করে ফেলে, তবু তাদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে চলতে হবে। আমরা তাদেরকে ধর্মের নামে নিয়ে এসেছি। তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়েছি, তোমাদেরকে যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে খোদা অবস্থান করে থাকেন- সেই খোদা, যিনি বালুকারাশিকে পিপাসু রাখেন, সূর্যকে আগুন দান করেন এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তোমরা একটি সমস্যার সম্মুখীন হবে। তাহল, এরা মানুষ বলি দিতে চাইবে। এরা মানুষ বলিদানে অভ্যস্ত।

বলি পুরুষের হবে নাকি নারীর, নাকি একজন পুরুষ ও একজন নারীর হবে, তা তাদের সরদার বলে দেবে। আমরা যদি তাদের এই রীতি পালন করার সুযোগ করে দেই, তাহলে যুদ্ধের ময়দানে দেখবে, তারা কিভাবে মিশরের ইট পাথরগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী তাদের মোকাবেলায় একদিনের বেশি টিকতে পারবে না।

সরদার সকলকে বলল- তোমরা সেজদায় লুটিয়ে পড়; তোমরা খোদার ঘরে এসে পড়েছ।

সবাই সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। তারপর সরদারের নির্দেশে উঠে দাঁড়ায় এবং সরদারের পিছনে পিছনে হাঁটা দেয়।

এরা সুদানী হাবশী, যাদেরকে সুদান থেকে এনে মিশরে অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে। তাদেরকে লুকিয়ে রাখার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে এই পার্বত্য ভূখন্ডকে। ফেরাউন আমলের গুহাসমূহ- যা মূলত পাতালপ্রাসাদ- উট ঘোড়াসহ বিশাল সেনাবাহিনীকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব।

সুদানে রক্তখোর হাবশীদেরকে ধর্ম ও কুসংস্কারের নামে ঐক্যবদ্ধ করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। তারা যুদ্ধে অতিশয় পারদর্শী। গোত্রে গোত্রে লড়াই চলে তাদের। তীরান্দাজী ও অব্যর্থ বর্শাবাজীতে তারা পারঙ্গম। সুদানের শাসকরা খৃস্টানদের সঙ্গে চুক্তি করে অনেক খৃস্টান সেনাঅফিসারকে ডেকে এনেছিল। তারাই এই হাবশীদেরকে সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ইতিপূর্বে সুদানী বাহিনী দুবার পরাজিত হয়েছিল। তৃতীয় যুদ্ধ সেসময় সংগঠিত হয়, যখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই তকিউদ্দীন সুদান হামলা করেছিলেন। এই হামলাকে ব্যর্থ করে সুদানীরা তকিউদ্দীনের বাহিনীকে তছনছ করে দিয়েছিল। তকিউদ্দীন সুলতান আইউবীর সহায়তায় তার অবশিষ্ট সৈন্যকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। সে যুদ্ধে সুদানীদের ব্যর্থতা এই ছিল যে, তারা তকিউদ্দীনকে ধাওয়া করেনি এবং মিশর আক্রমণ করেনি। যদি তখন সুদানীরা। সাহস করে তকিউদ্দীনের বাহিনীকে ধাওয়া করত এবং মিশর আক্রমণ করে বসত, তাহলে তকিউদ্দীনের বাহিনী এতই পরিশ্রান্ত ছিল যে, তারা সুদানীদের হাত থেকে মিশরকে রক্ষা করতে পারত না।

এসব ব্যর্থতাকে সামনে রেখে খৃস্টানরা সুলতান আইউবীর যুদ্ধকৌশল পরীক্ষা করে দেখার পরিকল্পনা হাতে নেয়। তারা প্রত্যক্ষ করছিল যে, সুলতান আইউবী স্বল্প থেকে স্বল্পতম সৈন্য দ্বারা অধিক থেকে অধিকতর সৈন্যের উপর গেরিলা হামলা চালান এবং এক স্থানে স্থির হয়ে লড়াই করার পরিবর্তে বিক্ষিপ্ত হয়ে লড়াই করেন এবং বিশাল বিশাল বাহিনীকে ছিন্ন করে পর্যদস্ত করে ফেলেন। তাদের জানা আছে যে, এ জাতীয় আক্রমণ পরিচালনার জন্য কঠোর প্রশিক্ষণ ও বিশেষ প্রকৃতির সৈন্যের প্রয়োজন। সাধারণ সৈন্যরা জানে হুজুগের মধ্যে যুদ্ধ লড়তে। এ পেক্ষাপটেই তারা হাবশী কাবায়েলীদের মধ্যে যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র একটি বাহিন গঠন করে নিয়েছে এবং তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে। তারা কায়রোবাসীকে রাতের আঁধারে ঝাঁপটে ধরতে চাচ্ছে। সুলতান আইউবী এখন মিশরে অনুপস্থিত। তাদের বিশ্বাস, এই সুযোগে তারা ময়দান বাজিমাত করে ফেলতে সক্ষম হবে।

এই আক্রমণের কমান্ডের জন্য তাদের এমন একজন সেনা অধিনায়কের প্রয়োজন, যিনি হবেন মিশরী ফৌজের লোক, যাতে সময় ও শক্তি ব্যয় হবে কম এবং আঘাত হানবে ঠিকানামত। তাদের এই প্রয়োজন পূরণ করে দিলেন সুলতান আইউবীর সালার আল-কিন্দ। সুদানের হাবশী সৈন্যদের লুকানোর ব্যবস্থা আল-কি-ই করে দিয়েছিলেন। তিনি মিশরী ফৌজের চার পাঁচজন কমান্ডারকেও সঙ্গে ভিড়িয়ে নিয়েছেন। তিনি গোয়েন্দা মারফত সুদানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। সেই বাহিনী-ই এখন মিশরে অনুপ্রবেশ করছে।

***

গভীর রাত পর্যন্ত চৌকিতে নাচ-গান চলতে থাকে। অপর চৌকির কমান্ডার বিদায় নেয়ার সময় মেজবান কমান্ডারকে বললেন, ওদেরকে বলুন, আগামী রাতে যেন আমার চৌকিতে আসে। বাদকদল আনন্দচিত্তে কমান্ডারের আবদার মেনে নেয়। তারা আর যাবেই বা কোথায়। তারা তো সুদানী তথা আল কিদের প্রেরিত লোক। তারা যে বলেছিল, কারো আমন্ত্রণে এক গ্রামে গান গাইতে যাচ্ছিল, সে ছিল মিথ্যা কথা। তাদের কর্তব্য-ই ছিল, পানি পান করার নামে এই চৌকি দুটিতে অবতরণ করবে এবং কথা দ্বারা কমান্ডারদেরকে ফাঁদে আটকে ফেলবে। নর্তকী মেয়েরা ছিল অতিশয় চিত্তাকর্ষক। কমান্ডার তাদের জালে আটকে যান। বেজায় আবেগতাড়িত হয়ে তিনি অপর চৌকির কমান্ডারকেও ডেকে আনলেন। এই সুযোগে পঞ্চাশজন হাবশী সীমান্ত পার হয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

পরবর্তী রাত বাদক ও নর্তকীদল অপর চৌকিতে গিয়ে পৌঁছে। সেখানেও জাঁকজমকপূর্ণ আসর জমে যায়। দুপুর রাতে নদীর কূলে টহলদানকারী দুসৈনিক ফিরে আসে। তাদের স্থানে অপর দুসৈনিক রওনা হতে উদ্যত হয়। কিন্তু তাদের সঙ্গীরা বাধা দিয়ে বলল, পাগল হয়েছ? এই আমোদ ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ? কমান্ডার তখন মেয়েদের নাচ-গানের আসরে মত্ত হয়ে আছেন। কিন্তু সৈনিকদ্বয় সঙ্গীদের আবদার উপেক্ষা করে বলল, না যেতে হবে; ওটা আমাদের কর্তব্য। এরা সেই দুসৈনিক, যাদেরকে মেয়েরা প্রেম নিবেদন করে বলেছিল, আমরা আমাদের স্বামীদেরকে খুন করে তোমাদের সঙ্গে চলে যাব। দায়িত্বের প্রতি তাদের অতটুকু গুরুত্ব নেই, যতটুকু আগ্রহ মেয়েদের মিলন লাভের প্রতি। মেয়েরা প্রেম নিবেদন করে বলেছিল, পরে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।

ইতিপূর্বে তারা ডিউটিতে যেত ধীর পদক্ষেপে, থেমে থেমে অসর্তকতার সাথে। কিন্তু আজ রাত চৌকি থেকে বেরিয়ে সামান্য দূরে গিয়েই ঘোড়া থামিয়ে অবতরণ করে এবং কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে একসঙ্গে হেঁটে দুজন দুদিকে আলাদা হয়ে যায়। মেয়ে দুটো পৃথক দুজায়গায় তাদের অপেক্ষা করছে।

মেয়েদের সঙ্গে সুলতান আইউবীর সৈনিকদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। মেয়েরা তাদেরকে নদী থেকে দূরবর্তী এক পার্বত্য এলাকায় নিয়ে যায়। উভয় মেয়ে সৈনিকদের উপর তাদের রূপ-যৌবন ও ভালবাসার তেলেসমাতি প্রয়োগ করে এবং স্বামীদের হত্যার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। তারা সৈনিকদের জানায়, আমরা স্বামীদেরকে মদের সঙ্গে নিদ্ৰাজনক পাউডার মিশিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। সৈনিকদের একজন তার ভালবাসার পাত্রীকে নিয়ে টিলার একদিকে এবং অপরজন তার বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। শুধু কর্তব্য-ই নয়- আশ-পাশ এবং জগতের সব কিছু-ই ভুলে গেছে তারা।

সুলতান আইউবীর এই সৈনিকদ্বয় যেস্থানে মিশরী বণিক পরিচয়দানকারী লোকদেরকে অবস্থান করতে দেখেছিল, সেখান থেকে সামান্য দূরে নদীর কূলে চারটি ছায়া এদিক-ওদিক নড়াচড়া করছে। নদীতে হালকা তরঙ্গ বইছে। লোকগুলো অন্ধকারের মধ্যে নদীর দিকে দূরপানে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু। একটা অবলোকন করার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছে তারা। একজন বলল- তাদের তো এতক্ষণে এসে পড়ার কথা? আরেকজন বলল তাদেরকে সংবাদ তো পৌঁছানো হয়েছে, বুঝলাম না এখনো এসে পৌঁছল না কেন। একজন কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, পাল দেখা যাচ্ছে মনে হয়! বলেই বাতি জ্বালিয়ে লোকটি ডানে-বাঁয়ে নাড়াতে শুরু করে। পরক্ষণে দূর নদীতে দুটি প্রদীপ জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়।

কিছুক্ষণ পর একটি পালতোলা নৌকা নদীর কূলে এসে ভিড়ে। কিনারায় দন্ডায়মান এক ব্যক্তি বলল, কোন শব্দ যেন না হয়। পূর্ণ নীরবতার সাথে কৃষ্ণকায় হাবশী লোকগুলো নৌকা থেকে তীরে নেমে আসতে শুরু করে। মুহূর্ত পর তার পাশে এসে ভিড়ে আরেকটি নৌকা। তার মধ্য থেকেও হাবশী লোক নেমে আসে। উভয় নৌকা-ই বিশাল। দুনৌকা থেকে কমপক্ষে দুশ লোক মিশরের ভূখন্ডে অবতরণ করে। তারপর ভিতর থেকে মালামাল নামাতে শুরু করে। সবই সামরিক সরঞ্জাম। মাল খালাস হওয়ামাত্র মাঝিদের নির্দেশ দেয়া হল, বিলম্ব না করে তোমরা এক্ষুণি ফিরে যাও। মাঝিরা পাল নামিয়ে গতি বদল করে নোঙ্গর তুলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। হাবশীদের এই চালানটিও পার্বত্য এলাকায় অদৃশ্য হয়ে যায়।

এই সৈনিকদ্বয় যখন ফিরে আসে, তখন চৌকির নাচ-গানের আসার ভেঙ্গে গেছে। আসর থেকে উঠে সৈনিকরা যার যার তাঁবুতে ফিরছে। কমান্ডার নর্তকীদের জন্য আলাদা একটি তাঁবু স্থাপন করে দিয়েছেন। একটি মেয়েকে তার খুবই ভাল লাগে। নিষ্পাপ মিষ্টি মুখ মেয়েটির। কমান্ডারের দৃষ্টিতে তারা পেশাদার মেয়ে। তিনি বাদকদের বললেন, তোমরা অমুক মেয়েটাকে আমার তাঁবুতে পাঠিয়ে দাও।

লোকগুলো মূলত শত্রুর গোয়েন্দা ও নাশকতাকারী। তাদের মিশন-ই হল, সুলতান আইউবীর এই দুটি সেনাচৌকিকে ফাঁদে আটকিয়ে রাখা এবং কমান্ডারদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করা, যাতে এই সুযোগে সুদানের হাবশী সৈন্যরা মিশরে ঢুকে যেতে পারে। এমতাবস্থায় এই চৌকির কমান্ডার যখন তাদের একটি মেয়ের সঙ্গ লাভের ইচ্ছা পোষণ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তার আকাংখা পূরণ করে দেয়া হল। নর্তকী কমান্ডারের সঙ্গে তার তাঁবুতে ঢুকে পড়ে।

কমান্ডার মধ্য বয়সী পুরুষ আর মেয়েটা তাগড়া যুবতী। তাঁবুতে ঢুকেই মেয়েটি গম্ভীর হয়ে যায়। বাইরের আলো-প্রদীপ নিভে গেছে। তাঁবুর মধ্যে টিম টিম করে একটি বাতি জ্বলছে। কমান্ডার মেয়েটির প্রতি মুখ করে বসে গভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখতে শুরু করে।

আমি কোনদিন মদপান করিনি। কমান্ডার বললেন।

আমার পিতাও কখনো মদপান করেননি- মেয়েটি বলল- কিন্তু আপনি মদের উল্লেখ কেন করলেন? আমি তো বলিনি মদপান করব? আপনি সম্ভবত ভেবেছেন, আমাদের সঙ্গে মদ আছে আর আমি এনে আপনাকে পান করাব?

কথায় বলে মদ ছাড়া নারী আর নারী ছাড়া মদ জমে না- কমান্ডার মুচকি হেসে বললেন- আমি মদের স্বাদ সম্পর্কে অবহিত নই এবং পরনারীর সুখ। সম্পর্কেও অনবহিত।

তবে তো তুমি নতুন পাপী- মেয়েটি অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলল- আমি তোমার থেকে কোন নগদ বিনিময় নেব না। তুমি আমার একটি দাবি মেনে নাও, তাহলে আমি সারারাত তোমার সঙ্গে অতিবাহিত করাকেই তার বিনিময় মনে করব। কথা হল, পাপ করার মধ্যে সেই স্বাদ নেই, যে স্বাদ আছে পাপ করার মধ্যে। তুমি পুরুষ। নির্জন পরিবেশে আমার মত একটি যুবতীর সম্মুখে উপস্থিত থাকা অবস্থায় আমার কথাগুলো তোমার নিকট বিস্ময়কর ঠেকবে। তুমি আমার কথা মানবে না। একটু ভাব, তোমার চেহারা বলছে, তুমি এই আজ প্রথমবার পাপ করার মনস্থ করেছ। এমন শীতের রাতে আমি তোমার কপালে ঘামের ফোঁটা লক্ষ করছি।

তুমি ঠিকই বলছ- কমান্ডার বললেন- আমাদেরকে যখন সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, তখন পাপ থেকে বেঁচে থাকার সবক শেখানো হয়েছিল। আমাদেরকে সামরিক ও দৈহিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি আত্মিক এবং চারিত্রিক প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। একারণেই সুলতান আইউবীর একশত সৈনিকের কাছে খৃস্টান বাহিনীর এক হাজার সৈনিকও হার মানতে বাধ্য হয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা অবলা মেয়ে তোমাকে নিরস্ত্র করে ফেলেছে! নর্তকী বলল- তোমার রূহানী ও আখলাকী শক্তি কেড়ে নিয়ে গেছে!

মেয়েটির কথায় কমান্ডার হতভম্ব হয়ে যান। তিনি অগত্যা বলে উঠেন আমার বিলকুল ধারণা ছিল না যে, এখানে এসে তুমি এ ধরনের কথা বলবে। আমি ধারণা করেছিলাম, নির্জনে এসে তুমি আমাকে প্রেম-ভালবাসা দিয়ে মাতিয়ে তুলবে। তোমার ঠোঁটের সেই হাসি কোথায়, যা আমাকে বাধ্য করেছিল, তোমার লোকদের থেকে তোমাকে ভিক্ষা চাইতে? আমি বিনিময় হিসাবে তোমাকে দুটি আরবী ঘোড়া দিতে প্রস্তুত আছি।

আর তোমার তরবারীটাও দেবে?- মেয়েটি বলল- বর্শা, ঢাল এবং খঞ্জরটাও।

হা- কিন্তু কমান্ডার নিশ্চুপ হয়ে যান। পরক্ষণে অস্থির কণ্ঠে বললেন– না, সৈনিক কখনো অস্ত্রমুক্ত হয় না।

কমান্ডার বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যান। তারপর দ্রুত পদক্ষেপে কিছুক্ষণ পায়চারী করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে রাগত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- একটি নর্তকীর মুখে এসব কথা আমার ভাল লাগছে না। তুমি কি আমার থেকে রক্ষা পেতে চাও? তুমি কি ভাবছ, আমি তোমার দেহে হাত লাগাব না?

হ্যাঁ- নর্তকী বলল- আমি তোমার থেকে আমার দেহকে রক্ষা করতে চাই।

 তুমি কি তোমার দেহটাকে পবিত্র মনে করছ?

না- নর্তকী বলল- আমি আমার দেহটাকে নাপাক-ই মনে করি। তবে তোমার দেহটাকে আমি নাপাক করতে চাচ্ছি না।

মেয়েটির বক্তব্য কমান্ডারের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনি। তিনি বোকার ন্যায় হা করে নর্তকীর প্রতি তাকিয়ে থাকেন। নর্তকী বলল-কোন কন্যা তার পিতার দেহকে অপবিত্র করতে চায় না।

উহ!- কমান্ডার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আমি বৃদ্ধ আর তুমি যুবতী। তিনি বসে পড়েন এবং মাথাটা নত করে ফেলেন।

নর্তকী একটু সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কমান্ডারের চিবুক ধরে মাথাটা উপরের দিকে তুলে বলল, এত হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি পালাব না, তোমাকে ধোকাও দেব না। তুমি যদি একজন পুরুষ পরিচয় ধারণ করেই থাকতে চাও, তাহলে আমিও নর্তকী ও বেশ্যা হয়েই থাকব। তারপর বলল, আমি তোমাকে পিতার রূপে দেখছি। তুমি আমার দু-একটি কথা শুনে নাও। তারপর যা ইচ্ছে হয় কর, আমি পাথর হয়ে যাব আর তুমি তাকে নিয়ে খেলা করতে থাক। আচ্ছা, তোমার কি কোন মেয়ে আছে?

একটি আছে। কমান্ডার জবাব দেন।

তার বয়স কত?

 বার বছর।

আচ্ছা, তুমি যদি মৃত্যুবরণ কর আর তোমার স্ত্রী অভাবের জ্বালায় বাধ্য হয়ে তোমার মেয়েটাকে গায়ক-নর্তকীদের কাছে বিক্রি করে দেয়, তাহলে তোমার আত্মার কী দশা হবে? তোমার আত্মা কি তখন এসব মরু বিয়ামবান ও পাহাড়ে-জঙ্গলে চীৎকার করে ফিরবে না?

কমান্ডার মেয়েটার প্রতি আড় চোখে তাকাতে শুরু করেন। তার কপালের উপর আরো কয়েক ফোঁটা ঘাম ফুটে উঠেছে।

তুমি একটু কল্পনা কর- মেয়েটা বলল- মনে কর, তুমি মৃত্যুবরণ করেছ এবং তোমার কন্যা এক পাপিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে তাঁবুতে বসে আছে এবং লোকটা তাকে বলছে, মদ আন; মদ ছাড়া নারী আর নারী ছাড়া মদ জমে না।

কমান্ডারের ওষ্ঠাধর কেঁপে ওঠে। হঠাৎ করে গর্জে উঠে বললেন, বেরিয়ে যাও তুমি এখানে থেকে। কুলটা, বেশ্যা!

মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- আমার পিতা যদি আমাকে ও তোমাকে দুজনকেই খুন করে ফেলতেন!

মেয়েটির দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। কমান্ডার বসা থেকে উঠে তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতে শুরু করেন। মেয়েটি তার মানসিক অবস্থা ও ক্ষোভ উপেক্ষা করে বলল- বৃদ্ধ বলে আমি তোমাকে ঘৃণা করছি না। আমি এমন এমন বৃদ্ধ লোকদের তাঁবুতে রাত যাপন করেছি, বার্ধক্য যাদেরকে ভিতর থেকে ফোকলা করে ফেলেছে। তারা ঐশ্বর্যের বলে তাদের মৃতদেহে আত্মার সঞ্চারণ করতে চাইত। সে তুলনায় তুমি অতটা বৃদ্ধ নও। আসল কথা হল, তোমার গঠন-আকৃতি ঠিক আমার পিতার মত। আমি তোমাকে যে কথাগুলো বললাম, তা আগে আমার মাথায় ছিল না। আমি শুধু নাচতে আর অঙ্গুলি হেলনে নাচাতে জানতাম। তুমি নিজেই ভেবে দেখ, আমার মত একটা বেশ্যা নর্তকীর মাথায় এমন সব কথা আসল কেন, যা তোমাকে বিস্মিত করে তুলেছে।

কমান্ডার মেয়েটির প্রতি তাকান। তার রাগ পানি হয়ে গেছে। মেয়েটি বলল- আমার পিতা-মাতার চেহারা ও দৈহিক গঠন আমার ভালভাবে স্মরণ আছে। তাদের গায়ের গন্ধও আমার মনে আছে। তোমার কন্যার বয়স বার বছর। আমার বয়স যখন নয়-দশ বছর ছিল, তখন বাবা মারা যান। তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। মিশরের সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন। তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই মারা যান। তখন আমার মা যুবতী এবং নিতান্ত অসহায়। তিনি পেটের দায়ে আমাকে অর্থের বিনিময়ে এক ব্যক্তির হাতে তুলে দেন। বিনিময়টা তিনি আমার চোখের সামনে গ্রহণ করেছিলেন। লোকটা যখন আমার মাকে বলেছিল, উঁচু পর্যায়ের একজন ভাল মানুষের সঙ্গে আমি তোমার মেয়েকে বিয়ে দেব। আমি কাঁদতে শুরু করলে মা বললেন, কাঁদিনে মা, ইনি তোর চাচা। ইনি তোকে তোর পিতার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। তারপর আমি বার বছর পর্যন্ত পিতাকে সন্ধান করে ফিরছি। আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাচ শেখানো হয়েছে যে, তোমাকে তোমার পিতার নিকট নিয়ে যাব। বয়স বাড়ার পর আমি বুঝে ফেলি যে, আমাকে যা কিছু বলা হয়েছে ও হচ্ছে, সবই প্রতারণা। ওরা কিভাবে আমাকে আমার পিতার নিকট নিয়ে যাবে? তিনি তো মারা গেছেন! ততক্ষণে নাচ-গান আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমাকে জীবনে কেউ প্রহার করেনি। পিতার নামে আমি নাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমার ওস্তাদ ও মনিব আমার সঙ্গে ভাল আচরণ করতেন এবং ভাল ভাল খাবার খাওয়াতেন। তারপর একদিন আমার যৌবন আসে। তখন আমি আমার মূল্য আন্দাজ করতে সক্ষম হই। সেই মূল্য আমার সব চেতনাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আমি একটি সুদর্শন পাথরে পরিণত হয়ে যাই। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমার মৃত চেতনা আবার জেগে উঠেছে।

মেয়েটির দুচোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে অশ্রু ঝর ঝর নেত্রে বলতে শুরু করল, এ মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, আমার পিতার আত্মা এই ভাবুটার চার পার্শ্বে ঘুরে ফিরছে। এই তাবুতে প্রবেশ করার আগে কখনো আমার এমনটা মনে হয়নি। মাঝে-মধ্যে মনে হত, যেন আমার অস্তিত্ত্বটা-ই আমার পিতার আত্মা, যিনি দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

তুমি যদি একটি মূল্যবান নর্তকী-ই ছিলে, তাহলে এই পাহাড়-জঙ্গলে কী অর্জন করতে এসেছ? কমান্ডার জিজ্ঞাসা করেন।

আমি ভাড়ায় এসেছি- নর্তকী জবাব দেয়- আমি ওদেরকে চিনিনা। অন্যান্য নর্তকীদেরও পূর্বে চিনতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল, সীমান্ত এলাকায় যেতে হবে এবং ওখানকার সেনাচৌকিতে যদি প্রয়োজন পড়ে, বিনা পরিশ্রমে নাচতে হবে। মিশরের ইজ্জত ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী সৈনিকদেরকে খুশী করে আমি যে আনন্দ পাচ্ছি, অন্য কিছুতে আমি ততটা আনন্দ পেতাম না। আমার অনেক সময় মনে হয়, আমার নাচে আমার মুজাহিদ পিতার, আত্মাও খুশী হন। আমি একটি প্রতারণা– নিজের জন্যও, অন্যের জন্যও। কিন্তু আমি স্বদেশের মুজাহিদদের দেহকে অপবিত্র করতে পারি না। আগের চৌকির কমান্ডার আমাকে তার তাঁবুতে ডেকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমি তার আবেগ প্রত্যাখ্যান করেছি। তোমার কাছে শুধু এজন্য এসেছি যে, চেহারা সুরতে তোমাকে আমার পিতার মত মনে হয়েছিল।

নর্তকী কমান্ডারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। কমান্ডারের একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তুলে চোখের সঙ্গে লাগায়। তারপর সেই হাতে চুম্বন করে। কমান্ডার নিজের অপর হাতটা তার মাথায় রেখে জিজ্ঞাসা করেন তোমার নাম কী?

আমার মনিব আমাকে বারক নামে ডাকেন। আব্বা ডাকতেন যোহরা নামে। নর্তকী জবাব দেয়।

যাও, যোহরা!-কমান্ডার স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন- নিজ তাঁবুতে চলে যাও।

তুমি ঘুমিয়ে পড়- যোহরা বলল- আগে তুমি ঘুমাও, আমি তারপর যাব।

***

রাত কেটে যাচ্ছে। বাদক দলের দুসদস্য তাঁবুতে জাগ্রত বসে আছে। অন্যান্য নর্তকী ও অবশিষ্ট বাদকরা গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে। জাগ্রতদের একজন অপরজনকে বলল, আমাদের কর্মপদ্ধতি সঠিক বলে মনে হচ্ছে না। আমরা মেয়েগুলোকে এই বলে এনেছিলাম যে, তারা নেচে-গেয়ে সৈন্যদের মনোরঞ্জন করবে। তাদেরকে বলে দেয়া আবশ্যক ছিল, আমাদের আসল উদ্দেশ্য কী।

একজন নর্তকীকে বিশ্বাস করা যায় না- অপরজন বলল- যে মেয়েটি এখন কমান্ডারের তাঁবুতে অবস্থান করছে, সে আবেগের বশবর্তী হয়ে আলাদা পুরস্কার গ্রহণ করে কমান্ডারকে বলে দিতে পারে, আমরা সীমান্ত চৌকিগুলোর জন্য ধোকা ও প্রতারণা হয়ে এসেছি। এজন্যে কোন নর্তকীকে আসল রহস্য বলা ঠিক হবে না। আমাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে বিনিময় পাওয়া-ই ওদের জন্য যথেষ্ট। আমরা তাদেরকে দাবি অনুপাতে পারিশ্রমিক দিয়েছি। কাজ আমাদের হয়ে গেছে।

আমাদের উদ্দেশ্য কী, যদি মেয়েটাকে বলে দিতাম, তাহলে সে কমান্ডারকে ভালভাবে অন্ধ করে ফেলত। তাকে সে এমনভাবে ফেঁসে ফেলত যে, তারই সহযোগিতায় আমরা হাবশীদেরকে ভিতরে নিয়ে আসতাম।

ওস্তাদ আমাদের চেয়ে ভাল বুঝেন। এই মেয়েগুলো আমাদের হাতিয়ার কেউ হাতিয়ারকে রহস্য জানায় না। এটা নিরাপদ নয়। কমান্ডার এই চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন যে, মেয়েটি তাকে পাপ থেকে রক্ষা করেছে এবং তার হৃদয়ে পিতৃবোধ জাগিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তার মাথার কাছে বসে থাকে। তারপর এক সময়ে ধীর পায়ে বের হয়ে নিজের তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

এখন ভোর। নায়ক-নর্তকীরা যখন জাগ্রত হয়, তখন সূর্য উপরে ওঠে গেছে। মেয়েরা জানেনা, এখন তাদের গন্তব্য কোথায়। বাদক পুরুষরা যখন তাদেরকে একদিকে নিয়ে রওনা হয়, কমান্ডার তখন তাঁর তাঁবুর বাইরে দন্ডায়মান। যোহরা দৌড়ে তার নিকট এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল- আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। কমান্ডার আর মাথায় হাত রাখেন। যোহরা কমান্ডারের অপর হাতটি ধরে টেনে নিয়ে নিজের চোখের সঙ্গে লাগায় এবং আদ্র চোখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে।

তারা নদীর দিকে রওনা হয়ে যায়। পথে একদিক থেকে দুটি উট এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। দুউটের দুআরোহী নীচে অবতরণ করে উটগুলোকে বসিয়ে নর্তকী মেয়ে দুটোকে উটের পিঠে বসিয়ে রওনা হয়ে যায়। এই উষ্ট্ৰোরোহীদ্বয় তাদের-ই দলের মানুষ। তারা নিকটেই কোথাও তাদের অপেক্ষায় লুকিয়ে ছিল।

চারটি মেয়েসহ বণিক কাফেলা যে স্থানে অবস্থান করেছিল, এরা সেখানে গিয়ে পৌঁছে। উভয় দল পরস্পর এমনভাবে মিলিত হয়, যেন কারো সঙ্গে কারো পরিচয় নেই। বণিক কাফেলার মেয়েরা গায়কদলের মেয়েদেরকে পুরুষদের থেকে সরিয়ে নদীর কূলে নিয়ে যায়। বণিক কাফেলার মেয়েরা যোহরা ও তার সঙ্গী মেয়েকে জানায়, আমরা তাদের স্ত্রী-কন্যা; ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তাদের সঙ্গে এখানে এসেছি।

ওদিকে পুরুষদের আসরে আসল মিশন নিয়ে আলোচনা চলছে। বাদকরা তাদের দুরাতের কারগুজারী শোনায়। বণিক কাফেলার লোকেরা জানায়, তোমাদের নাচ-গানের আসরের সুযোগে অত্তত একশত হাবশী মিশর ঢুকে পড়েছে। আর আমাদের মেয়েরা দুজন সৈনিককে ফাঁদে ফেলে ঢুকিয়েছে। দুশ-রও বেশি হাবশীকে।

নিজ নিজ দলের কারগুজারী শোনানোর পর তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এই নাচ গান দ্বারা তেমন বেশি হাবশীকে ভিতরে ঢুকানো যাবে না। নদীর পথটা-ই বেশি উপযোগী। নৌকায় করেই অধিক থেকে অধিকতর লোক ভিতরে ঢুকতে পারবে। তাই সিদ্ধান্ত হল, মেয়েরা এই দুসৈনিক ছাড়াও আরো দু-চারজন সান্ত্রীর সঙ্গে অনুরূপ খেলা খেলবে, যাতে প্রতি রাতে নৌকা আসতে পারে। এ-ও সিদ্ধান্ত হল যে, যোহরা ও তার সঙ্গী নর্তকীকে এখানেই এক স্থানে রাখা হবে। কিন্তু তাদের কোন রহস্য জানতে দেয়া হবে না।

বৈঠক শেষ হয়ে গেছে। বাদক পুরুষরা তাদের মেয়েদের ডেকে এনে বলল, তোমাদের আপাতত কোন কাজ নেই। এ জায়গাটা খুবই মনোরম। তোমরা কয়েকটা দিন এখানে-ই অবসর কাটাও। তারা মেয়েদেরকে এমনভাবে উৎসাহিত করে যে, তারা সম্মত হয়ে যায়। অপর দলের মেয়েরা তাদেরকে আপন ও ঘনিষ্ট বানিয়ে নেয়। কিন্তু খানিকটা দূরে আলাদাভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

এখন রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু যোহরার চোখে ঘুম আসছে না। তার বারবার কেবল কমান্ডারের কথা মনে পড়ছে। কমান্ডারের ব্যক্তিত্ব যোহরাকে প্রভাবিত করে ফেলেছে। প্রথমত একারণে যে, কমান্ডারের মধ্যে সে তার পিতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই কমান্ডার-ই প্রথম পুরুষ, যে তাকে খেলনা মনে করার পরিবর্তে তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়েছে। তৃতীয়ত, কমান্ডার তাকে বারক নয়- যোহরা নামে ডেকেছে।

যোহরা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে তাঁবু থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। রাস্তা তার আগে থেকেই চেনা। এবার দ্রুতপায়ে চৌকি অভিমুখে হাটা দেয় সে। যোহরা এত দ্রুত আর এত দীর্ঘ পথ হাঁটায় অভ্যস্ত নয়। কিন্তু তার আবেগ তাকে শক্তি জুগিয়ে চলেছে।

যোহরা চৌকিতে পৌঁছে যায়। কমান্ডারের তাবু তার আগে থেকেই চেনা। তাবুতে ঢুকে পড়ে সে। কমান্ডার গভীর ঘুমে অচেতন। কারো আগমন টের পেয়ে তার চোখ খুলে যায়। যোহরা অন্ধকারের মধ্যে কমান্ডারের মুখে হাত রাখে। কমান্ডার চোখ খুলেই বিড়বিড় করে উঠে হাত ধরে ফেলে। তুলতুলে নরম ছোট্ট হাত। কমান্ডার বুঝে ফেলে, এ হাত নারীর। তিনি কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন কে?

যোহরা।

কমান্ডার ধড়মড় করে উঠে বসেন। যোহরা বলল- তোমাকে দেখতে এসেছি। শুড়ে পড়, আমি চলে যাচ্ছি।

কমান্ডার বাতিটা জ্বালিয়ে দেন। যোহরাকে জিজ্ঞেস করেন, কোথা থেকে এসেছ? তার কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। যোহরা তার মনের কথা খুলে বলল। কমান্ডার বাইরে বেরিয়ে আসেন। দুটি ঘোড়া প্রস্তুত করেন এবং যোহরাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে একটিতে তাকে চড়ান এবং অপরটিতে নিজে চড়ে বসেন। ঘোড়া চলতে শুরু করে।

দুটি ঘোড়া পাশাপাশি চলছে। যোহরা আবেগের ভাষায় কথা বলছে। কমান্ডার মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকেন। গন্তব্য থেকে কিন্তু দূরে থাকতেই যোহরা কমান্ডারকে থামতে বলে এবং তাকে ফিরে যেতে বলে। কমান্ডার ভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিরে যান।

যোহরা তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছে। তার দলের এক ব্যক্তি সজাগ বসে আছে। যোহরাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, কোথায় গিয়েছিলে? যোহরা বলল, একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। লোকটি যোহরাকে ধমকাতে শুরু করে। তার মনে সন্দেহ জাগে। যোহরা বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

আমাদের অনুমতি ছাড়া তোমরা কোথাও যেতে পারবে না। লোকটা নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

আমি তোমাদের ক্রীতদাসী নই- যোহরা বলল- আমি যে পারিশ্রমিক নিয়েছি, তার বিনিময়ে কাজ যা করার ছিল, করে ফেলেছি। এখন আর আমি কারো আদেশ-নিষেধ পালন করতে বাধ্য নই।

তোমরা সম্ভবত মালিকের নিকট জীবিত ফেরত যেতে চাও না- লোকটা বলল- এখান থেকে আমাদের অনুমতি ছাড়া কোথাও গিয়ে দেখ।

***

সুলতান আইউবীর সীমন্ত রক্ষী সৈনিকদ্বয় প্রতিদিন ডিউটিতে বেরিয়ে নদীর কূলে এসে পড়ছে আর তাদের প্রেয়সী মেয়ে দুটো তাদেরকে ভালবাসার মূলা দেখিয়ে দেখিয়ে একদিকে সরিয়ে নিচ্ছে। এই সুযোগে সুদানী হাবশী বোঝাই পালতোলা নৌকা এসে কূলে ভিড়ছে এবং সৈন্যরা তীরে নেমে পর্বতমালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বণিক কাফেলার চারটি মেয়ে আরো দুজন মিশরী সৈন্যকে নিজেদের বৃদ্ধ স্বামীদের স্ত্রী বানিয়ে এবং তাদের সঙ্গে চলে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে আটকে ফেলে।

মিশরের এই সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে এত অধিক সুদানী হাবশী সৈন্য এসে জড়ো হয়েছে যে, তারা ইচ্ছে করলে রাতের বেলা সীমান্ত চৌকিগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে মিশরী সৈন্যদেরকে অতি অনায়াসে খতম করে ফেলতে পারে। কিন্তু তাদের কমান্ডারগণ ভেবে রেখেছেন অন্য কিছু। সীমান্ত চৌকি হামলার সংবাদ কায়রো পৌঁছে যাবে। তার ফল এই দাঁড়াবে যে, কায়রো থেকে সৈন্য এসে যাবে এবং খৃস্টানদের আকষ্কিকভাবে কায়রো আক্রমণের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেবে।

নীল নদের উপকূলীয় পার্বত্য এলাকায় সুদানী হাবশী সৈন্যসংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলছে। কায়রো আক্রমণ পরিচালনা করা যে খৃস্টান কমান্ডারদের দায়িত্ব, সুদানে খৃষ্টান উপদেষ্টাগণ তাদের কর্তব্য বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা কিছুদিনের মধ্যে মিশরের সীমান্ত অতিক্রম করে পাহাড়ী এলাকায় অনুপ্রবেশ এবং হামলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। সালার আল-কিন্দ এখনো কায়রোতে বহাল তবিয়তে তার দায়িত্ব পালন করছেন। তার কোন আচরণে কারো মনে সন্দেহ জাগেনি যে, তিনি বড় রকমের একটি বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত। রাতে ঘরে বসেই তিনি রিপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন, গত রাতে কতজন হাবশী মিশরের সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং এযাবত তাদের সংখ্যা কতোয় দাঁড়িয়েছে। আক্রমণের মূল নেতৃত্ব তাকেই দিতে হবে। তিনি পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছেন।

মিশরের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় হাজার হাজার সুদানী হাবশী সৈন্যের সমাগম। এবার তাদের ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী বলি দেয়ার পালা- মানুষ বলি। প্রথমে তাদের পরস্পরে কানাঘুষা চলে। তাদের দাবি, মানুষ বলি দিতে হবে। আল-কিনৃদ-এর লোকেরা তাদেরকে এ দাবি প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু হাবশীদের পুরোহিত দাবিতে অটল। হাবশীরা তাকে বিরক্ত করে তোলে যে, বলুন, মানুষ বলী কবে হবে? তাদের স্পষ্ট কথা, অন্যথায় আমরা ফিরে যাব। পুরোহিতদের বলা হল, আপনারা আপনাদেরই মধ্য থেকে একজনকে ধরে বলি দিয়ে দিন। তারা জবাব দেয়, না, এই বলি কবুল হয় না। বলির জন্য সেই অঞ্চলের মানুষ হতে হয়, যেখানে হামলা হবে। যারা আক্রমণ করে, তারা নিজেদের লোক বলি দেয়ার নিয়ম নেই।

অবশেষে তাদেরকে বলা হল, হামলার একদিন আগে মিশরের কোন এক ব্যক্তিকে ধরে এনে তোমাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। হাবশীদের পুরোহিতগণ বলল- না, আমরা মানুষ এখনই চাই। অনেকদিন পর্যন্ত তাকে বিশেষ ধরনের খাবার খাইয়ে পুষতে হবে, মোটাতাজা করতে হবে এবং তার উপর বিশেষ আমল প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি এই বলি উপলক্ষে আমাদেরও পূজা অর্চনা করতে হবে। আরো কথা আছে। আমাদের হিসাব-নিকাশ করতে হবে, বলি পুরুষের দিতে হবে, না নারীর নাকি উভয়ের।

সে রাতে-ই আল-কিনদকে সংবাদ পাঠানো হয়, হাবশীরা বলি দেয়ার জন্য মানুষ দাবি করছে। জবাবে আল-কি বললেন- এতে ভাবনার কী আছে। একটা মানুষ ধরে নিয়ে তাদের হাতে তুলে দাও।

কিন্তু তারা এখনো বলেনি যে, বলি একজন পুরুষের হবে নাকি নারীর কিংবা উভয়ের।

তারা যা-ই দাবি করে পূরণ কর- আল-কি বললেন- কদিন পর যখন আমরা কায়রোতে হামলা চালাব, তখন কতগুলো মানুষ প্রাণ হারাবে, তার ঠিক নেই। তার আগেই যদি দু-একজন মেরে ফেলা হয়, তাতে ক্ষতির কী আছে!

আল-কিনদ গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান। এমন সময়ে এক খৃস্টান কমান্ডার ভিতরে প্রবেশ করে। লোকটির পরনে মিশরী পোশাক। ভিতরে প্রবেশ করেই সে মুখের কৃত্রিম দাড়ি খুলে ফেলে। সে আল- কিনদকে জিজ্ঞেস করে, আপনাকে অস্থির এবং চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

হাবশীরা তাদের রীতি পালন করতে চাচ্ছে- আল-কিনৃদ জবাব দেয় তারা বলি দেয়ার জন্য মানুষ চাচ্ছে।

তা আপনি ভাবছেন কী?

 আমি ভাবছি, হামলার একদিন আগে একজন মানুষ তাদের হাতে তুলে দেব।

 না- খৃস্টান কমান্ডার বলল- তারা যদি এখনই বলি দিতে চেয়ে থাকে, আপনি তাদের দাবি পূরণ করুন। এখন-ই তাদের প্রথা পালনের ব্যবস্থা করুন। আপনি সুদান যাননি। আমরা তাদেরকে ধর্মের নামে এ পর্যন্ত এনেছি। আপনি সম্ভবত মানুষকে কাজে লাগাতে জানেন না। সালাহুদ্দীন আইউবী আপনাকে শুধু লড়াই করতে শিখিয়েছেন। কিন্তু মানুষকে বিনা তলোয়ারে কিভাবে খুন করা যায়, তা আপনাকে আমাদের নিকট শিখতে হবে। একজন লোককে কাজে লাগাতে হলে তার ধর্মকে ব্যবহার করুন। তাদের মধ্যে তাদের ধর্মীয় উন্মাদনা উস্কে দিয়ে তাদের বিবেককে মুঠোয় নিয়ে আসুন। তাদের কাজে এবং অর্থহীন প্রথা-পার্বনের বিরোধিতা না করে বরং তার অনুসরণ করুন। সাধারণ মানুষের মন-মস্তিষ্ক ধর্ম আর কুসংস্কার বেশি। প্রভাবিত হয়ে থাকে। আমরা বহু মুসলমানকে হাতে এনেছি এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি। সবাইকে ধর্ম ও কুসংস্কারের অস্ত্র দ্বারা হাত করেছি। মুসলমান ধর্মের নামে অতি তাড়াতাড়ি আমাদের জালে এসে ধরা দেয়। এই হাবশীরা তো জংলী। আমরা তাদেরকে এক বছরেরও অধিক আগে দুই সুদানীকে ধরে তাদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছি, এরা মিশরী। তারা তাদেরকে যবাই করে মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল।

তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, তারা বলির জন্য পুরুষ চায়, না নারী। আল কিন্দ বললেন।

এই মুহূর্তে আপনার কিন্তু ওখানে যাওয়া খুবই জরুরী- খৃস্টান কমান্ডার বলল- কিন্তু আমি আপনাকে তাদের সম্মুখে অন্য এক পন্থায় নিয়ে যাব। ওরা অত্যন্ত জংলী ও রক্তপিপাসু যোদ্ধা। এ মুহূর্তে মিশরে তাদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। আমরা যদি তাদের উপর ধর্মের ভুত চাপিয়ে রাখি এবং তাদেরকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করি যে, এটা আমাদের নয়- তোমাদের-ই যুদ্ধ, তাহলে তাদের মাত্র এক হাজার যোদ্ধা-ই কায়রোর সব সৈন্যকে লাশে পরিণত করে ফেলতে সক্ষম হবে। আমরা তাদেরকে এই বলে এনেছি যে, আমরা তাদেরকে তোমাদের খোদার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি এবং তোমাদের দুশমনরা তোমাদের খোদার ভূখন্ড কজা করে আছে।

আমি যাব। আল-কিনদ বললেন।

আল-কিনদ মিশরের উপর সুদানীদের শাসন কামনা করতেন। কিছুদিন আগে তিনি একজন গাদ্দারের নিকট তার এই মনোবাঞ্চার কথা প্রকাশ করে বসেন। গাদ্দার তার আকাঙ্খকে দৃঢ় প্রত্যয়ে পরিণত করে দেয় এবং খৃস্টানদের সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেয়।

খৃস্টানরা তার সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, মিশরকে দুভাগে বিভক্ত করে এক অংশ তোমাকে দিয়ে দেব আর অবশিষ্টাংশ সুদানকে দেব। ঐতিহাসিকগণ আল-কিনৃদ-এর বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের কাহিনী বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেননি। সে যুগের মহান ব্যক্তিত্ব কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় এ বিষয়টা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আল-কি খৃস্টান ও সুদানী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় সভ্যতা-বিবর্জিত হিংস্র হাবশীদের উপর তাদের ধর্মের ভুত সাওয়ার করে তাদের উপর যুদ্ধ-উন্মাদনা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন এবং তিনি স্বয়ং তাদের ধর্মগুরুতে পরিণত হন। হাবশীদেরকে বলা হয়েছিল, ইনি তোমাদের খোদার সেই দূত, যিনি শত শত বছর ধরে খোদার নিকট আসা-যাওয়া করছেন।

***

সে রাতটা ছিল অন্ধকার। মিশরের আকাশ ছিল তারায় তারায় উজ্জ্বল। কায়রো শহর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। দিন কয়েক পরই তাদের উপর কী মহাপ্রলয় সংঘটিত হতে যাচ্ছে, তা কারো জানা ছিল না। মিশরের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শুধু কয়েকজন টহলসেনা। তারাও জেগেই আছে শুধু কর্তব্যের প্রতি তাদের কোনই মনোযোগ নেই।

নদীপথে আগ্রাসন রোধকল্পে নীল নদের কোল ঘেঁষে যে চৌকিটি স্থাপন করা হয়েছিল এবং তার থেকে মাইল চারেক দূরে অপর যে চৌকিটি পার্বত্য এলাকাকে নিরাপদ করার জন্য বসানো হয়েছিল, সেই দুটি চৌকির দুজন করে চারজন টহলসেনা চারটি মেয়ের রূপের জালে আটকে আছে। মেয়েগুলো তাদেরকে আলাদা আলাদা নিয়ে যাচ্ছে। আজ তারা আরো বেশি তৎপর।

যোহরা ও তার সঙ্গী নর্তকীর দল থেকে কিছু দূরে একটি তাঁবুতে শুয়ে আছে। দলের বাদক পুরুষরা বাহ্যত ঘুমিয়ে থাকলেও মূলত তারা সজাগ। তাদেরকে বলা আছে, আজকের রাতটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তোমরা জেগে থাকবে। উভয় দলের প্রতি নির্দেশ, বাইরের কোন মানুষ যেন নদীর কূলে এবং এই পার্বত্য এলাকার কাছে আসতে না পারে। কেউ এসে পড়লে তাকে যেন ধরে ভিতরে নিয়ে আসা হয়।

কিছুক্ষণ পর এক বাদক শোয়া থেকে উঠে পড়ে। সে প্রথমে তাবু থেকে বের হয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করে। তারপর মেয়ে দুটো যে তাঁবুতে আছে, তার ভিতরে উঁকি দিয়ে তাকায়। কিন্তু ভিতরে কিছুই দেখা গেল না। বাদক ভিতরে ঢুকে পড়ে। গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করে। তার মনে সন্দেহ জাগে। এবার দেয়াশলাই জ্বালিয়ে দেখে। যোহরা নেই। অপর মেয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। বাদক তাকে জাগাল না। তার জানা আছে, যোহরা কোথায় গিয়ে থাকতে পারে। চৌকির কমান্ডার ছাড়া আর কোথায় যাবে সে! এখন সমস্যা, এই হতে পারে যে, কমান্ডার যোহরার সঙ্গে এদিকে আসবে আর তার প্রহরীদের না পেয়ে অনুসন্ধান করবে। এমনও হতে পারে, তিনি নদীর কূলে সেই জায়গাটায় পৌঁছে যাবেন, যাকে আজ রাত বাইরের জগত থেকে লুকিয়ে রাখা আবশ্যক।

বাদক তার দুজন সঙ্গীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানায়, আমাদের একটি মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। সম্ভবত সে চৌকিতে গিয়ে থাকবে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, নদী থেকে দূরে কোথাও ওঁত পাততে হবে এবং কমান্ডার যদি মেয়েটির সঙ্গে এদিকে আসে, তাহলে উভয়কে ধরে আমাদের কমান্ডারের হাতে তুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে দুজনকে হত্যা করে লাশ দুটো নদীতে ফেলে দেয়া হবে।

এই পার্বত্য এলাকার ভিতরের জগত জেগে আছে। বিশাল-বিস্তৃত এই এলাকা সম্পর্কে বাইরের মানুষ সম্পূর্ণ অনবহিত। প্রথমত, ভূখন্ডটা লোকালয় থেকে বহুদূরে এবং আশ-পাশ দিয়ে মানুষ চলাচলের কোন রাস্তা নেই। আরো একটি কারণ হল, জনমনে প্রসিদ্ধ আছে, পাহাড়গুলোর মধ্যে প্রেতাত্মারা লড়াই করে বেড়ায় এবং কোন মানুষ যদি তার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে, তাহলে তার শরীরের গোস্ত উধাও হয়ে কংকালটা শুধু অবশিষ্ট থাকে। আরো কথিত আছে, এই পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে পাহাড় কেটে কেটে ফেরাউনদের বিরাট বিরাট প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে এবং পাহাড়গুলোকে ভিতর থেকে ফোকলা করে প্রাসাদোপম ভবন তৈরী করা হয়েছে।

আজ রাতে পাতাল প্রাসাদগুলো আলোয় জ্বলমল করছে। চারদিক পাহাড় বেষ্টিত একটি ময়দান। হাজার হাজার সুদানী হাবশী সমবেত আজ। তাদেরকে উঁচু শব্দে কথা বলতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। আজ তাদেরকে তাদের খোদাকে দেখানো হবে।

হাবশীরা ভয়ে প্রকম্পিত ও আবেগে আপ্লুত। ভয়ে তারা পরস্পর কানাঘুষাও করছে না। এই পাহাড়-পর্বত সম্পর্কে তারা সম্যক অবহিত। তারা জানে, এই মুহূর্তে তারা যে পাহাড়টির প্রতি মুখ করে বসে আছে, তার মধ্যভাগে উঁচুতে বিশাল এক মূর্তি বিদ্যমান। এটি আবু সম্বল মূর্তি। এই মূর্তি সম্পর্কে-ই হাবশীদের জানানো হয়েছিল, এটি তাদের খোদার প্রতিকৃতি এবং কোন এক রাতে তাদের এই খোদা মানুষের রূপে তাদের সম্মুখে এসে উপস্থিত হবেন।

সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে সারা মাঠে। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ শোনা গেল, যেন বজ্রপাত হয়েছে। হাবশীরা পূর্ব থেকেই নীরব। এই গর্জন তাদের নিঃশ্বাসও বন্ধ করে দেয়। তার পরক্ষণেই একটি শব্দ ভেসে আসে- খোদা জাগ্রত হচ্ছেন। তোমরা সামনের পাহাড়ের দিকে তাকাও- উপর দিকে দৃষ্টিপাত কর। বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত পর্বতমালার অভ্যন্তরে শব্দটা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে বাজতে থাকে। আকাশে দুটি আগুনের গোলা উড়তে দেখা যায়। শূন্যে কয়েকটা চক্কর কেটে গোলা দুটো সম্মুখের পাহাড়ের দিকে ছুটে যায় এবং পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। গোলা দুটো পাহাড়ের যে অংশের সঙ্গে ধাক্কা খায়, সেখান থেকে একটি অগ্নিশিখা তৈরী হয়ে যায়। আবু সম্বল মূর্তিটির অবস্থান শিলাটির পিছনে এবং কিছু উপরে। শিখার কম্পমান আলো মূর্তিটির ভয়ানক চেহারায় নিপতিত হলে দেখা যাচ্ছে, যেন মূর্তিটি দুচোখের পাতা ও মুখ খুলছে আর বন্ধ করছে। এমনও মনে হচ্ছে, যেন তার চেহারাটা ডানে-বাঁয়ে দুলছে।

সমবেত হাবশী জনতা সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। তাদের পুরোহিতগণ সেজদা থেকে মাথা তোলেন। তারা হাত উপরে তুলে বাহু প্রসারিত করে প্রার্থনা করতে শুরু করেন। প্রধান পুরোহিত উচ্চশব্দে বলে উঠেন- আগুন ও পানির। খোদা! আগুন দ্বারা কাঠ ভষ্মকারী ও নদী-সমুদ্রকে পানি দানকারী খোদা! আমরা তোমাকে দেখে ফেলেছি। বল, আমরা তোমার পায়ে কটি মানুষ অর্পণ করব? বল, পুরুষ চাই না নারী?

একটি পুরুষ একটি নারী- পর্বতমালার অভ্যন্তর থেকে আওয়াজ আসে তোমরা এখনো আমাকে দেখনি। আমি মানুষের রূপে তোমাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করব। তোমরা যদি আমার দুশমনের বৃক্ত না ঝরাও, তাহলে তোমাদের প্রত্যেককে আমি এই পর্বতমালার পাথরের ন্যায় পাথরে পরিণত করে দেব। তারপর চিরদিন তোমরা রোদে পুড়তে থাকবে। তোমাদের কেউ যদি যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কর, উত্তপ্ত মরুভূমির বালি তাকে চুষে খেয়ে ফেলবে। তোমরা অপেক্ষা কর- আমার অপেক্ষা করতে থাক।

নীরবতা আরো গম্ভীর হয়ে যায়। শিখাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। পাহাড়ের ভিতর থেকে হাবশীদের ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর ভেসে আসতে শুরু করে। এটা তাদের সেই সঙ্গীত, যাকে তারা ধর্মীয় উৎসবগুলোতে উপাসনার সময় গেয়ে থাকে। এখন সঙ্গীতটি গাওয়া হচ্ছে সম্মিলিত কণ্ঠে। সঙ্গে বাজছে সারো। মাঠে উপবিষ্ট হাজার হাজার হাবশী জনতা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। সবাই নিশ্চিত, সঙ্গীতটা তাদের মধ্য থেকে কেউ গাইছে না। সুরটা অদৃশ্য থেকে আসছে।

***

যোহরা চৌকির কমান্ডারের নিকট বসে আছে। আগের চেয়ে বেশী আবেগ ঝরছে তার কথা থেকে। সে কমান্ডারকে বলল- তোমার সঙ্গে যদি আমার সাক্ষাৎ না ঘটত, তাহলে আমি অবশিষ্ট জীবনও নাচ-গানে অতিবাহিত করতাম। তোমাকে দেখার পর আমার মনে পড়ে যায়, আমি কারো কন্যা নর্তকী বা বেশ্যা নই। এখন হয়ত তুমি আমাকে মেরে ফেল; না হয় আশ্রয় দাও না হয় আমাকে আমার ঘরে পৌঁছিয়ে দাও। আজ তুমি আমাকে ফেরত যেতে দিও না।

আজ তুমি চলে যাও- কমান্ডার জবাব দেন- আমি তোমাকে আমার চৌকিতে রাখতে পারি না। ওয়াদা করছি, আমি তোমাকে তোমার ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব। আর এখান থেকে যদি তুমি চলেও যাও, তো কায়রোতে কোথায় উঠবে, ঠিকানা দিয়ে যাও, আমি সেখান থেকে তোমাকে নিয়ে যাব।

কিছুক্ষণ পর কমান্ডার দুটি ঘোড়া প্রস্তুত করেন এবং যোহরাকে বললেন, চল রওনা হই। দুজন ঘোড়ায় চড়ে রওনা হন। পথে যোহরা কমান্ডারকে বলল- আচ্ছা, রাতের বেলা এখানে নৌকা আসে কেন- অনেক নৌকা?

নৌকা?- কমান্ডার বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- কোন্ দিক থেকে আসে?

ওদিক থেকে- সুদানের প্রতি ইংগিত করে যোহরা বলল- কদিন যাবত রাতে আমার তেমন ঘুম হয় না। মধ্যরাতে উঠে তাঁবুর বাইরে বসে থাকি। আমি ঘটনাটা দুরাত দেখছি। এক রাতে তিনটি ও এক রাতে দুটি নৌকা এসে কূলে ভিড়েছে। নৌকাগুলোর সাদা পাল অন্ধকারের মধ্যেও দেখা যায়। এখান থেকে একটু সামনের জায়গাটায় তীরে ভিড়েছে। আমি কান খাড়া করে বিষয়টা বুঝবার চেষ্টা করি। মনে হল, নৌকাগুলো থেকে অনেক মানুষ নামছে। তারপর গাছের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরে ঢুকে যাচ্ছে।

আচ্ছা, তুমি কি আমাদের দুজন সৈনিককে কখনো দেখেছ?- কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন তারা ঘোড়ায় চড়ে ডিউটিতে আসে। তদের তো নদীর তীরে থাকার কথা।

না– যোহরা জবাব দেয়- কখনো তো আমি কোন সৈনিক দেখিনি! তবে দিনের বেলা দেখেছি দুজন সৈনিক আসে। সম্মুখে একটি কাফেলা অবস্থান করছে। তারা তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া গল্প-গুজব করে সময় কাটায়। একদিন তাদের একজনকে কাফেলার একটি মেয়ের সঙ্গে টিলার আড়ালে বসে প্রেম-নিবেদন করতে দেখেছি।

যোহরা জানে না। মিসরের এই সীমান্ত এলাকায় কী হচ্ছে এবং কী হতে পারে। সীমান্তে নিয়োজিত সৈনিকেঁদের দায়িত্ব-ই বা কী, তা-ও তার অজানা। রাতে কিংবা দিনে সুদানের দিক থেকে কোন নৌকা এদিকে আসার তাৎপর্য কী, তাও জানেনা যোহরা। যা বলেছে, সবই তার সহজ-সরল কথা। কিন্তু কমান্ডারের জন্য এটি বিরাট এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যোহরা যা বলেছে, তা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কমান্ডারকে সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। কমান্ডার এই দীর্ঘ ডিউটি এবং সীমান্ত এলাকার পরিবেশে বিরক্ত বটে; কিন্তু যোহরার বক্তব্য তাকে সজাগ করে তুলেছে। তিনি যোহরাকে বললেন- আস, আজ নদীর কূলে কূলে হাঁটব। তিনি ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দেন।

কমান্ডার যোহরাকে নিয়ে নদীর কূলে পৌঁছে যান। তারা কূল ধরে হাঁটতে শুরু করেন। নদীর পানিতে সাঁতার কাটছে কমান্ডারের দৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর মাঝ নদীতে দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে আলো চোখে পড়ে কমান্ডারের। তারপর আরো একটি আলো। কিন্তু পরক্ষণই আলোটা নিভে যায়। এ সময়ে এ এলাকায় যে সান্ত্রীদের ডিউটি করার কথা, কমান্ডার তাদেরকে হাঁক দেন। কিন্তু কোন জবাব এল না। তিনি কণ্ঠ উঁচু করে আবারো ডাক দেন। এবারো কোন জবাব নেই। তিনি আরো উচ্চকণ্ঠে ডাক দেন। তিনি নদীতে দুটি নৌকার পাল দেখতে পান। তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। কমান্ডার যোহরার উপস্থিতি ভুলে যান এবং ঘোড়ায় চড়ে নদীর কূলে কূলে সামনের দিকে এগিয়ে যান। যোহরাও তার পিছনে পিছনে অগ্রসর হয়। সান্ত্রীদের ডেকে চলছেন কমান্ডার।

সান্ত্রীরা কমান্ডারের ডাক-চীৎকার শুনতে পাচ্ছে। তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে দুজন দুটি টিলার আড়ালে বৃদ্ধ স্বামীদের যুবতী স্ত্রীদের জালে আটকে আছে। তারা তাদের কমান্ডারদের কণ্ঠস্বর চিনে ফেলে এবং সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারা যেখানে ঘোড়া বেঁধে রেখে গিয়েছিল, সেখানে ফিরে আসে। কিন্তু ঘোড়া উধাও। তারা ওখানেই অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে একস্থানে দুটি ঘোড়া দৌড়াচ্ছে দেখতে পায় তারা।

কমান্ডার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যোহরার ঘোড়া তার পাশাপাশি দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ তারা শুনতে পায়- তোমরা যাদেরকে ডাকছ, তারা অনেক দূরে- সম্মুখে।

তোমরা কারা?- কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন। এদিকে এস।

আমরা পথিক- তারা জবাব দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দুটি ঘোড়া কমান্ডারের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। পরক্ষণেই আরো একটি আওয়াজ আসে –আপনারা সামনের দিকে অগ্রসর হোন; আমরা আপনাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।

কমান্ডার তরবারী হাতে নেন। রাতের বেলা মুসাফিরদের ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া এবং এই এলাকায় অবস্থান করা সন্দেহজনক। তারা কমান্ডারের নিকটে চলে আসে। একজন কমান্ডারকে বলল- ওদিকে দেখুন, ওরা আসছে। কমান্ডার যেই মাত্র ওদিকে তাকালেন, সঙ্গে সঙ্গে লোকটি এক হাতে কমান্ডারের ঘাড়টা ঝাঁপটে ধরে এবং অপর হাতে তার তরবারীধারী হাতের কনুই ধরে ফেলে। অপর ব্যক্তি মেয়েটিকে ঝাপটে ধরে। কমান্ডারকে পাকড়াওকারী লোকটি তার ঘোড়া হাঁকায়। ফলে কমান্ডার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময়ে অন্ধকার ভেদ করে আরো দুজন লোক দৌড়ে আসে। তারা কমান্ডারকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত্বে নিয়ে নেয়।

লোকগুলো বাদকদল, যারা মূলত প্রশিক্ষিত গেরিলা সৈনিক। যোহরা তাঁবু থেকে বের হলে তাদের-ই দু-তিনজন লোক তার পিছু নিয়েছিল। তারা পরিকল্পনা মাফিকই কমান্ডার ও যোহরাকে ধরে ফেলেছে। তাদের একজন বলল- এদেরকে জীবিত নিয়ে চল। এরূপ সন্দেহভাজন লোক ধরা পড়লে জীবিত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

তারা কমান্ডার ও যোহরাকে পাহাড়ের দিকে নিয়ে রওনা হয়। কমান্ডার দেখতে পান, সমুদ্রতীরে বেশ কটি নৌকা থেকে হাবশীরা নামছে এবং কি যেন মাল-পত্র খালাস করছে। লোকগুলো সুদানী হাবশী যোদ্ধা এবং মাল পত্রগুলো তাদের যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ।

***

পাহাড়ের অভ্যন্তরে হাজার হাজার হাবশী এখনো নিশ্চুপ বসে আছে। পাহাড়ের গায়ে প্রজ্বলিত শিখাঁটি নিভে গেছে অনেক আগে। হাবশীদের ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর মুছনা শোনা যাচ্ছে। তারা ধীরে ধীরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছে। তারা নিজেদেরকে সেই হাবশীদের তুলনায় মর্যাদাসম্পন্ন ভাবতে শুরু করেছে, যারা সুদানে পড়ে রয়েছে।

সঙ্গীতের সুর থেমে গেছে। হঠাৎ সম্মুখের পাহাড়টির গায়ে আলোর ঝিলিক চমকে ওঠে, যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবার আলো চমকায়। আলোটা আৰু সম্বল মূর্তিটির গায়ে গিয়ে পড়ছে। আলোটা কোথা থেকে আসছে, বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, যেন মূর্তিটির চেহারা নিজ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

আলো নিভে গেছে। কিছুক্ষণ পর আবার আলো জ্বলে উঠে। সবাই দেখছে, পাহাড়সম মূর্তিটির কোল থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এসে সামনের দিকে হাঁটছে। মূর্তিটির পিছন থেকে আত্মপ্রকাশ করে চারজন মানুষ। প্রত্যেকের গায়ে মাত্র একটি করে সাদা চাদর। সেই চাদরে তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত। মূর্তির কোল থেকে বেরিয়ে আসা লোকটিকে রাজার মত দেখাচ্ছে। তার মাথায় রাজমুকুট। মুকুটের উপর একটি কৃত্রিম সাপের ফনার ছায়া। গায়ের চোগাটা লাল। অজ্ঞাত স্থান থেকে আসা আলোকরশ্মিটি তার উপর পতিত হয়ে চলছে। চোগার গায়ে অসংখ্য তারকা। আলোর চমকে সেগুলো চমকাচ্ছে ও মিটমিট করে জ্বলছে। লোকটার এক হাতে বর্শা, অপর হাতে নাঙ্গা তরবারী। সাদা চাদর পরিহিত লোকগুলো তার পিছনে পিছনে হাঁটছে।

তারা পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসছে এবং আলোটাও তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। এবার সম্মুখের লোকটি দাঁড়িয়ে যায়। পিছনের লোকগুলো সমস্বরে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠে- আমাদের খোদা ধরায় নেমে এসেছেন। তোমরা সেজদায় লুটিয়ে পড়। তারপর মাথা তুলে তোমাদের খোদাকে মন ভরে দেখ।

সব মানুষ সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। তারপর মাথা তুলে খোদাকে দেখে। খোদা একটি তরবারী উচ্চে তুলে ধরে রেখেছেন। তিনি ঢালু বেয়ে নীচে নামছেন। ময়দানে এমন নীরবতা বিরাজ করছে, যেন একজন মানুষও নেই। লোকটি নামতে নামতে জনতার ভীড়ের সন্নিকটে একটি উঁচুস্থানে এসে দাঁড়ায়। জায়গাটা প্রশস্ত। আলোটা শুধু তার এবং তার লোকদের উপর-ই পড়ছে। হঠাৎ চারটি মেয়ে সেই আলোর ভিতরে ঢুকে পড়ে। মেয়েগুলো আধা উলঙ্গ। গায়ের রং গৌর। পিঠের উপর কাঁধ থেকে সামান্য নীচে পাখির পালকের ন্যায় পালক। মাথার চুল খোলা। তারা এমনভাবে নড়াচড়া করছে, যেন তারা উড়ছে। তারা নাচের ভঙ্গিমায় হাবশীদের খোদার চার পায়ে কিছুক্ষণ চক্কর কেটে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়।

চার ব্যক্তি কমান্ডার ও যোহরাকে একটি গুহায় নিয়ে যায়। তাদেরকে গুহার একটি কক্ষে রেখে একজন বাইরে বেরিয়ে যায়। লোকটি আরো এক ব্যক্তিকে সঙ্গে করে ফিরে আসে। তাকে জানানো হল, এই লোকটিকে নদীর কূল থেকে এমন এক সময় ধরে আনা হয়েছে, যখন সুদান থেকে আগত নৌকা থেকে মালামাল খালাস করা হচ্ছিল এবং নতুন আগত হাবশীরা অবতরণ করছিল। লোকটি কমান্ডার ও যোহরার প্রতি তাকায়। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি। পরক্ষণেই এক ব্যক্তিকে সঙ্গে করে সে বাইরে বেরিয়ে আসে।

তোমরা এদেরকে বড় উপযুক্ত সময় ধরে এনেছ- লোকটি বলল হতভাগ্য হাবশীরা মানুষ বলির দাবি করছে। আল-কিদ-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী খোদার ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে, একজন পুরুষ ও একজন নারী বলি দিতে হবে। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে এক পুরুষ ও এক নারীকে অপহরণ করে এনে তাদের হাতে তুলে দিতে হত। তোমরা আমাদের বিরাট এক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছ। আমাদেরকে চিন্তামুক্ত করেছ। মনে হচ্ছে, আমরা সফল হব। আমাদের প্রতিটি কাজই পূর্ণ সফলতার সঙ্গে আঞ্জাম হয়ে যাচ্ছে। বলির জন্যও দুজন মানুষ আপনা-আপনি-ই এসে গেল।

হাবশীরা তাদের খোদাকে দেখেছে কি?- একজন জিজ্ঞেস করল।

তুমি যদি উপস্থিত থাকতে, তাহলে দেখতে আমরা কিরূপ বিচক্ষণতার সাথে তাদেরকে খোদা দেখিয়েছি- লোকটি জবাব দেয়- মূর্তির সম্মুখের পাহাড় থেকে প্রজ্বলমান সলিতাওয়ালা দুটি তীর নিক্ষেপ করা হয়। তীরন্দাজরা অন্ধকারের মধ্যে এমন নিশানা করে যে, তীর গিয়ে ঠিক জায়গায় বিদ্ধ হয়। আমরা বেশ কিছু জায়গা জুড়ে জ্বালানী ছড়িয়ে রেখেছিলাম। শুরুতেই দুটি তীর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এন্ড্রোসন একজন অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি বলেছিলেন, আগুনের শিখায় মূর্তিটি হাসছে ও দুলছে দেখা যাবে। আমাদেরই নিকট তো মনে হচ্ছিল, যেন মূর্তিটি মুখ ও ঠোঁট নাড়াচাড়া করছে। বরং মুখটাও ডানে-বাঁয়ে নাড়াচ্ছে।

 তখন হাবশীরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাল?

 তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিল- লোকটি জবাব দেয়- অভ্যন্তরে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তার গুঞ্জন চলতে থাকে। আমি অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাইনি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হাবশীরা ভয়ে কেঁপে থাকবে। আল-কি এর নাটক সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছে। আলো নিভে গেলে আমরা আল দিকে পোশাক পরিয়ে মূর্তিটির কোলে বসিয়ে দেই। চারজন লোক পূর্ব থেকেই সেখানে একস্থানে লুকিয়ে বসেছিল। সম্মুখের পাহাড় থেকে মূর্তির গায়ে আলো বিচ্ছুরণের ধারাও বেশ সফল হয়। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের গায়ে যে আগুন জ্বালানো হয়, তা নীচ থেকে কেউ দেখেনি। তার সন্নিকটে বড় একটি আয়না রেখে মূর্তির উপর আলোর প্রতিবিম্ব নিক্ষেপ করা হলে মনে হল, যেন এটি মূর্তির চেহারার নূর। তারই মধ্য থেকে যখন আল-কি খোদা সেজে নেমে আসেন, তখন আমাদের মেয়েরা সবাইকে নিশ্চিত করে যে, ইনিই খোদা এবং তারা পরী। আমরা এ যাবত কোন পদক্ষেপে ব্যর্থ হয়নি। এখন আল-কিনদকে এক স্থানে বসিয়ে রেখে সকল হাবশীকে তার সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করা হবে এবং বলা হবে ইনি-ই তোমাদের খোদা, যিনি যুদ্ধে তোমাদের সঙ্গে থাকবেন।

 আচ্ছা, এ দুজনকে (কমান্ডার ও যোহরার প্রতি ইংগিত করে) কি আজই বলি দেয়া হবে।

সে সিদ্ধান্ত নেবে হাবশীরা। সম্ভবত তারা তাদেরকে তিন-চারদিন লালন পালন করবে এবং কিছু রীতি-নীতি পালন করবে।

তারা কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পায়- সেনাপতিকে এমন একটা নাটক সাজাতে হবে, আমার জানা ছিল না। অপর একজন বলল- এছাড়া হাবশীদের দ্বারা যুদ্ধ করানো সম্ভবও ছিল না। এই নাটক বেশ কাজ দিচ্ছে।

কণ্ঠস্বরটা আল-কিদ ও তার সহযোগী লোকদের। তারা নিকটে এগিয়ে এলে ব্যক্তিদ্বয় বলল, এজজন পুরুষ ও একজন মেয়ে ঘটনাক্রমে আমাদের হাতে এসে গেছে। তাদেরকেই হাবশীদের হাতে তুলে দেয়া যায়। আল-কিনদ তারা কারা জিজ্ঞেস না করেই মাথা থেকে মুকুটটা সরিয়ে ফেলে কমান্ডার ও যোহরাকে যে কক্ষে রাখা হয়েছে, সে কক্ষে ঢুকে পড়েন। সে কমান্ডারকে চিনতে না পারলেও কমান্ডার তাকে চিনে ফেলেন। বাইরে কী কথা-বার্তা হয়েছিল, কমান্ডার সেসব শুনে ফেলেছেন। তিনি একাধিকবার আল-কি এর নামও শুনেছেন। তিনি এও জেনে ফেলেছেন যে, তাকে ও যোহরাকে বলি দেয়া হবে। কাজেই আল-কিদ কক্ষে প্রবেশ করার পর তিনি মোটেই বিষ্মিত হননি যে, তার সালার এখানে কেন এবং কিভাবে এলেন।

আল-কিনদ এই বলে বাইরে বেরিয়ে যায় যে, এদেরকে হাবশীদের পুরোহিতদের হাতে তুলে দাও।

***

তিন-চারদিন পর। কায়রোতে আল-আদেল আলী বিন সুফিয়ানকে ডেকে বললেন- তিন-চার দিন হল, আল-কিনৃদকে পাওয়া যাচ্ছে না। যখন-ই তলব করি, জবাব আসে, তিনি নেই। তার ঘর থেকেও একই জবাব আসছে। লোকটা কোথায় গিয়ে থাকতে পারে?

সীমান্ত বাহিনীর পরিদর্শনে যদি সীমান্ত সফরে গিয়ে থাকে, তাহলে তো আপনাকে জানিয়ে যেত। আলী বিন সুফিয়ান বললেন- এ মুহূর্তে আমার যা ধারণা, তাহল, তাকে সন্ত্রাসীরা অপহরণ কিংবা খুন করে থাকতে পারে।

এও তো হতে পারে যে, সে নাশকতাকারী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আল-আদেল বললেন।

তার ব্যাপারে এমন সন্দেহ তো অতীতে কখনো জাগেনি- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আচ্ছা, আমি তার ঘরে গিয়ে খবর নিচ্ছি।

আলী বিন সুফিয়ান আল-কিনদ-এর ঘরে চলে যান। বারজন দেহরক্ষী উপস্থিত। রক্ষী কমান্ডারকে জিজ্ঞাসা করেন, আল-কিনৃদ কোথায়? কমান্ডার অজ্ঞতা প্রকাশ করে। একজন দেহরক্ষীও বলতে পারে না, আল-কিনৃদ কোথায় গেছে। পরিচারিকাকে বাইরে ডেকে এনে বললেন, আল-কিনৃদ-এর স্ত্রীদেরকে জিজ্ঞেস কর, সে কোথায় গেছে। পরিচারিকা আলী বিন সুফিয়ানকে ভিতরে নিয়ে একটি কক্ষে বসতে দেয়। বৃদ্ধা মহিলা বলল, আপনি ঘর থেকে আল-কিনৃদ-এর সন্ধান পাবেন না। আমি আজ বেশ কিছুদিন পর্যন্ত এখানে যা কিছু দেখছি, তা আপনাকে বলে দিচ্ছি। আমার জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার। তবে আমি মরে গেলেও তেমন কিছু আসবে যাবে না। আমি বিধবা। স্বামী মারা গেছেন বহু আগে। আমার একটি মাত্র পুত্র ছিল। সুদানের লড়াইয়ে সে শাহাদাতবরণ করেছে। নিরূপায় হয়ে আমি এখানে চাকুরী নিয়েছিলাম। এরা আমাকে গরীব এবং সহজ-সরল মহিলা মনে করে। তাদের জানা ছিল না, একজন শহীদের মা দেশ ও ধর্মবিরোধী কোন তৎপরতা সহ্য করতে পারে না, যার জন্য তার পুত্র জীবন দিয়েছে। এ ঘরে দীর্ঘদিন যাবত সন্দেহভাজন লোকদের আনাগোনা চলছিল। এক রাতে এক ব্যক্তি আসিল। লোকটা আরবী পোশাক পরিহিত। মুখে দাড়ি। আমাকে ডেকে বলা হল, মদের ব্যবস্থা কর। লোকটা ভিতরে প্রবেশ করে মুখের কৃত্রিম দাড়ি ও গোঁফ খুলে ফেলে। তার আগে থেকেই-ই এখানে এমন সব লোকদের আসা-যাওয়া চলছিল, যাদের প্রতি আমার সন্দেহ ছিল যে, এদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। আমার কানে আমি অর্ধেক মিশর সুদানের-মিশরের রাষ্ট্রক্ষমতা- এক রাতেই কাজ হয়ে যাবে- ইত্যাদি বাক্যও শুনেছি। সালার আল-কিদ রাতে বের হতেন। তার সঙ্গে দুজন অপরিচিত লোক থাকত। আমি সালারকে রক্ষী কমান্ডারের সঙ্গেও কানে কানে কথা বলতে দেখেছি।

বৃদ্ধা পরিচারিকা আরো কিছু কথা বলে আলী বিন সুফিয়ানকে স্বপ্রমাণিত করে দেয়, সালার আল-কিনৃদ না অপহরণ হয়েছে, না খুন, না সে রাষ্ট্ৰীয় দায়িত্ব পালন করতে কোথায় গিয়েছে। মিশরে নাশকতা ও গাদ্দারী এতই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বেড়ে চলছে যে, একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকেও সন্দেহ না করে পারা যাচ্ছিল না। কিন্তু তথাপি আল-কিনৃদ-এর উপর কখনো কারো সন্দেহের চোখ পড়েনি। লোকটা তার সন্দেহজনক সকল অপতৎপরতা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে আলী বিন সুফিয়ানও অতিশয় দূরদর্শী গোয়েন্দা। এক্ষেত্রে তার জন্য সমস্যা হচ্ছে, সালার পদমর্যাদার ব্যক্তির ঘরে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া তল্লাশী নেয়া যায় না। এ কাজের জন্য মিশরের অস্থায়ী সুপ্রীম কমান্ডার আল-আদেল-এর অনুমতি আবশ্যক। তাই তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে নিজের একজন রক্ষীসেনাকে প্রেরণ করে তিন চারজন গোয়েন্দা ডেকে আনেন এবং তাদেরকে আল-কি-এর ঘরে এদিক ওদিক লুকিয়ে রাখেন। তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেন, কোন পুরুষ কিংবা নারী ঘর থেকে বের হলে তার পিছু নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে।

আল-কিনদ-এর ঘর থেকে বের হয়ে আলী বিন সুফিয়ান রক্ষী কমান্ডারকে নির্দেশ দেন, তোমার নিজের এবং অধীন সকল রক্ষীসেনার অস্ত্র ভিতরে রেখে দাও এবং সবাই আমার সঙ্গে চল। বার সদস্যের রক্ষী বাহিনীটিকে নিরস্ত্র করে আলী বিন সুফিয়ান সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং আল-আদেলকে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদান করেন। আল-আদেল তাঁকে আল-কিনৃদ-এর ঘরে হানা দিয়ে তল্লাশী নেয়ার অনুমতি দিয়ে দেন। আলী বিন সুফিয়ান সময় নষ্ট না করে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।

ওদিকে ইতিমধ্যে আল-কিনদ-এর ঘরে ঘটে গেছে আরেক ঘটনা। আলী বিন সুফিয়ান যখন সেখান থেকে বের হয়ে আসেন, তখন আল-কিনৃদ-এর এক স্ত্রী- যে বয়সে যুবতী- পরিচারিকাকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আলী বিন সুফিয়ান তোমাকে কী বললেন এবং তুমি কী জবাব দিলে? উত্তরে বৃদ্ধা বলল, তিনি আমাকে সালার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন এবং আমি বলেছি, আমি গরীব মানুষ, এই ঘরের একজন চাকরানী। তিনি কোথায় গেছেন, আমি তা জানিনা।

তোমার অনেক কিছু জানা আছে- স্ত্রী বলল- তাকে তুমি অনেক তথ্য বলে দিয়েছ।

বৃদ্ধা তার বক্তব্যে অটল থাকে। স্ত্রী এক চাকরকে ডেকে তাকে সব ঘটনা শুনিয়ে বলল- এই বৃদ্ধার মুখ থেকে কথা বের কর। বলছে, ও নাকি কিছুই বলেনি।

চাকর বৃদ্ধার মাথার চুল মুঠি করে ধরে এমন ঝটকা টান মারে যে, বৃদ্ধা চক্কর খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। চাকর তার ধমনিতে পা রেখে চাপ দেয়। বৃদ্ধার চোখ দুটো বাইরে বেরিয়ে আসে। চাকর দাঁতে দাঁত পিষে বলল, বল, ওকে কী কী বলেছিস? সে পা সরিয়ে নেয়।

বৃদ্ধা নিথর-নিস্তব্ধ পড়ে আছে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। চাকর তার পাজরে লাথি মারে। বৃদ্ধা ছটফট করতে শুরু করে। চাকরের নির্যাতনে বৃদ্ধা আধমরা হয়ে পড়ে থাকে। এবার সে বলল- আমাকে জীবনে মেরে ফেল। আমি আমার শহীদ পুত্রের আত্মার সঙ্গে গাদ্দারী করতে পারব না। তুমি একজন ঈমান-বিক্রেতার অসৎ স্ত্রী। আমি তোমাকে পরোয়া করি না।

একে পাতাল কক্ষে নিয়ে শেষ করে দাও- স্ত্রী বলল- রাত হলে লাশ গুম করে ফেলবে। আমরা এখনো বিপদমুক্ত নই। লোকটা আমাদের রক্ষী সেনাদেরকে নিরস্ত্র করে সঙ্গে নিয়ে গেছে। এই হতভাগা বৃদ্ধার অনেক তথ্য জানা আছে। একে তথ্যসহ মাটিতে পুঁতে ফেল।

বৃদ্ধা মেঝেতে পড়ে আছে। অবস্থা তার মৃতপ্রায়। চাকর তাকে গাষ্টির মত করে কাঁধে তুলে নেয়। কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দা অভিমুখে পা বাড়ায়। এমন সময় আওয়াজ আসে- থাম। লোকটি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। অনেক সৈন্য ধেয়ে আসছে। ঘর তাদের অবরুদ্ধ। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশে তারা মহলের সমস্ত কক্ষ ও বারান্দায় ছড়িয়ে পড়ে। চাকর পালাতে ব্যর্থ হয়। তার কাঁধ থেকে বৃদ্ধাকে নামানো হল। বৃদ্ধার মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। সে চোখ খুলে তাকায়। সম্মুখে আলী বিন সুবিয়ানকে দেখামাত্র তার চেহারায় হাসি ফুটে ওঠে। সে বলল- ইতিপূর্বে আমার ঠিক জানা ছিল না, এই ঘরে কী হচ্ছে। তুমি আসার পর আমার সন্দেহ পোক্ত হয়ে যায় যে, সমস্যা একটা আছে।

বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। সে বড় কষ্টে বলল যে, আল-কিদ-এর নতুন বেগম এবং তার এই চাকর আমার মুখ থেকে বের করবার চেষ্টা করেছে যে, আমি তোমাকে কী বলেছি। ওরা আমাকে পিটিয়ে শেষ করে ফেলেছে।

আলী বিন সুফিয়ান এক সিপাহীকে বললেন- একে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। বৃদ্ধা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল- আমাকে কোথাও পাঠিও না। আমি আমার শহীদ পুত্রের নিকট চলে যাচ্ছি। তোমরা আমাকে বাঁধা দিও না।

বৃদ্ধা চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে যায়।

আল-কিনদ-এর বাসগৃহের প্রতিটি কোণ তল্লাশী নেয়া হল। পাতাল কক্ষে গিয়ে থ খেয়ে যান গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান। যেন এক অস্ত্রগুদাম। ঘর থেকে উদ্ধার হল বিপুল পরিমাণ সোনা ও নগদ অর্থ। পাওয়া গেল আল-কিদ-এর নামাংকিত একটি সীল, যাতে আল-কিনৃদকে ভূষিত করা হয়েছে সুলতানে মেসের অভিধায়। বিজয়ের ব্যাপারে আল কিনৃদ এতই নিশ্চিত যে, মিশরের সুলতান হিসেবে নিজ নামে সীল মোহরও তৈরী করে রেখেছেন! এই সীলমোহর আলী বিন সুফিয়ানের সব। সন্দেহকে দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত করে দেয়।

আল-কিনদ-এর ঘরে দুজন স্ত্রী ছিল। ছিল মদ-মাদকতার বিপুল আয়োজন। আল-কিনৃদ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ছিল, তিনি মদপান করেন না। এখন প্রমাণ পাওয়া গেল, রাতে ঘরে বসে তিনি মদপান করতেন। আলী বিন সুফিয়ান স্ত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মূল তথ্য হাসিল করেন। নতুন যে যুবতী স্ত্রী বৃদ্ধা পরিচারিকাকে চাকর দ্বারা খুন করিয়েছে, তার জবানবন্দী ছিল সবচে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য সব স্ত্রীর একই কথা, আপনার যত তথ্যের প্রয়োজন, সব নতুন বেগমের বুকে লুক্কায়িত। তথ্য পাওয়া গেল, এই নতুন স্ত্রী মিশরী নয় সুদানী এবং বাহির থেকে অপরিচিত লোকজন আসলে শুধু এ মেয়েটি-ই তাদের সঙ্গে কথা-বার্তা বলত, খোলামেলা চলত এবং মদপান করত। অন্যান্য স্ত্রীদের সরল-সহজ কথায় বুঝা গেল, তারা আর কিছু জানে না।

আল-কিনদ-এর স্ত্রীকে আলাদা করে ফেলা হল। আলী বিন সুফিয়ান বৃদ্ধা চাকরানীর খুনী চাকরকে বললেন- এখন আর কিছু লুকাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। যা জানা আছে, বলে ফেল। আমাকেও কষ্ট দিও না, নিজেও কষ্ট পেও না।

চাকর জানে, লুকোচুরি করতে গেলে পরিণতিটা কী হবে। বলল, হুজুর! আমি একজন চাকর মাত্র। আমি হুকুমের গোলাম। দুপয়সা পাওয়ার আশায় মনিবের সব নির্দেশ মেনে চলতাম। এখন আমি আপনার অনুগত। কিছু লুকাব না; যা জানি সবই বলে দেব। শুনুন–

দেশের একজন সেনা অধিনায়কের গোপন পরিকল্পনা এক গৃহভৃত্যের জানা থাকার কথা নয়। তবু চাকর বলল, আল-কিনৃদ যাওয়ার সময় বলে গেছেন, আমার আসতে অনেকদিন বিলম্ব হবে এবং কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, তিনি কোথায় গেছেন, আমরা জানিনা। ভৃত্য আসলেই জানত না, আল-কিনৃদ কোথায় গেছেন।

আলী বিন সুফিয়ান আল-কিনদ-এর নতুন স্ত্রীকে দুজন লোকের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পাতাল কক্ষে পাঠিয়ে দেন। নিজে আরো কিছু তত্ত্ব-তালাশ নিয়ে এবং আল-কিনৃদ-এর ঘরে প্রহরা বসিয়ে নিজ দফতরে চলে যান, যেখানে আল কিনৃদ-এর নিরস্ত্র দেহরক্ষীরা কঠোর প্রহরায় বসে আছে। আলী বিন সুফিয়ান এসে-ই তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন- তোমরা মিশর ও সিরিয়ার সম্মিলিত বাহিনীর সৈনিক। কিছু গোপন রাখবার চেষ্টা করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। আর যদি আমার নির্দেশ পালনপূর্বক সালার আল-কি-এর তৎপরতার কথা প্রকাশ করে দাও, তাহলে মুক্তি পেতে পার।

রক্ষী কমান্ডার বলতে শুরু করে। তার বক্তব্যে প্রমাণিত হয়ে যায়, আল কিদ-এর নিকট খৃস্টান ও সুদানী লোকজন আসা-যাওয়া করত এবং তিনি গাদ্দারীতে লিপ্ত। তবে আল-কিদ কোথায় গেছেন, তা তারও জানা নেই।

দুপুর রাতে আলী বিন সুফিয়ান পাতাল কক্ষে যান। আল-কিনৃদ-এর নতুন স্ত্রী সংকীর্ণ একটি প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ। তাকে সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যে তার কক্ষে অন্য এমন এক পুরুষ কয়েদীকে রাখা হয়েছে, যে লাগাতার নির্যাতন অত্যাচারে জর্জরিত। লোকটা খৃস্টানদের গুপ্তচর। নিজে ধরা পড়লেও সতীর্থদের সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে না। অলি-কিদ-এর স্ত্রী সেই দুপুর থেকে তার সঙ্গে এক প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ। তার তড়পানি ও ছটফটানি প্রত্যক্ষ্য করেছে সে।

এখন মধ্যরাত। মেয়েটা রাজকন্যা। এই সংকীর্ণ পাতাল কক্ষের গন্ধই তাকে পাগল বানাবার জন্য যথেষ্ট। তদুপরি বন্দি লোকটার শোচনীয় অবস্থা দেখে দেখে তার রক্ত শুকিয়ে গেছে। আলী বিন সুফিয়ান যখন সম্মুখে গিয়ে উপস্থিত হন, তখন সে হাউমাউ করে চীৎকার জুড়ে দেয়। আলী তাকে সেখান থেকে বের করে অন্য একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। সেটিও একটি অপ্রশস্ত প্রকোষ্ঠ। কৃষ্ণকায় এক হাবশী তাতে আটক রয়েছে। লোকটার ভয়ানক দেহ। মহিষের মত শরীর। সে সীমান্ত বাহিনীর এক কমান্ডারকে খুন করেছিল। আলী বিন সুফিয়ান মেয়েটিকে বললেন, বাকী রাতটুকু তোমাকে এর সঙ্গে কাটাতে হবে। মেয়েটি চীৎকার করে উঠে আলীর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে।

আপনার যা যা জানার প্রয়োজন, আমাকে জিজ্ঞেস করুন। আলীর দুপা জড়িয়ে ধরে মেয়েটি বলল।

আল-কিনদ কোথায় গেছে? কেন গেছে? তার লক্ষ্য কী? আলী জিজ্ঞেস করলেন। তার সম্পর্কে আরো যা যা তোমার জানা আছে, সব বলে দাও।

আল-কিনদ-এর স্ত্রী মাথা তুলে দাঁড়ায়। স্বামী সম্পর্কে যা কিছু জানা ছিল, সবই বলে দেয়। তবে আল-কিদ কোথায় গেছে, সেও জানেনা। মেয়েটি জানায়, সুদান থেকে হাবশী সৈন্য আনা হচ্ছে। তারা কোন এক রাতে কায়রো আক্রমণ করে সমগ্র মিশর দখল করে নেবে।

মেয়েটি মদপান করানোর দায়িত্ব পালন করত। সেই সুবাদে আল-কি এর ঘরে গমনাগমনকারী খৃস্টান ও সুদানী মেহমানরা তার সম্মুখেও কথা-বার্তা বলত। সুদানের ধনাঢ্য কোন এক ব্যক্তির কন্যা আল-কিনৃদ-এর এই স্ত্রী। আল-কিদ-এর জন্য তাকে উপহার স্বরূপ পাঠানো হয়েছিল। আল-কিনৃদ তাকে বিয়ে করে নিয়েছিল। মেয়েটা বেশ সতর্ক ও দুরন্ত। সুদানীদের লক্ষ্য তার ভালভাবেই জানা আছে। আল-কিনৃদ-এর বাসভবনে যে বিপুল পরিমাণ সোনা ও নগদ অর্থ পাওয়া গিয়েছিল, তার বর্ণনামতে সেগুলো সুদান থেকে এসেছে। এগুলো যুদ্ধের ব্যয় এবং মিশরের সেনাবাহিনী থেকে গাদ্দার ক্রয়ের মূল্য। বিপুল সংখ্যক হাবশী সৈন্য এসে কোথায় জমায়েত হয়েছে, মেয়েটি সে ব্যাপারে অবহিত নয়। সে এতটুকু জানে যে, সমুদ্র পথে এসে তারা তীরবর্তী কোন একস্থানে অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের হামলা হবে গেরিলা ধরনের।

যে পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভবপর ছিল, আলী বিন সুফিয়ান তা করে ফেলেছেন। তিনি আল-আদেলকে বিস্তারিত রিপোের্টও প্রদান করে প্রস্তাব পেশ করেছেন যে, পর্যবেক্ষণের জন্য দুজন দুজন ও চারজন চারজন করে সৈন্য চতুর্দিক ছড়িয়ে দেয়া হোক। তারা সুদানী ফৌজের অবস্থান খুঁজে বের করবে এবং তথ্য সংগ্রহ করবে, সুদানী হাবশী বাহিনী সত্যিই যদি ভিতরে ঢুকে গিয়ে থাকে, তাহলে তারা কোন্ দিক থেকে এল। তিনি আল-আদেলকে এই পরামর্শ প্রদান করেন যে, সুলতান আইউবীকে বিষয়টা না জানানো হোক। কেননা, সংবাদটা পেয়ে তিনি পেরেশান হওয়া ছাড়া কোন সাহায্য করতে পারবে না। কিন্তু আল-আদেলের মতে সুলতানকে বিষয়টা অবহিত করা আবশ্যক। তার আশংকা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন সুলতান আইউবীর উপস্থিতি আবশ্যক হয়ে পড়বে। তাই তিনি পূর্ণাঙ্গ একটি রিপোর্ট লিখে চারজন রক্ষীসহ এক সিনিয়র কমান্ডারকে সুলতানের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেন এবং তাকে নির্দেশ প্রদান করেন, প্রতিটি চৌকি থেকে ঘোড়া বদল করে নেবে এবং কোথাও দাঁড়াবে না।

***

রণাঙ্গনে সুলতান আইউবীর হেডকোয়ার্টার স্থির থাকছে না। তিনি দিনে এক জায়গায় থাকছেন, তো রাতে অবস্থান করছেন অন্য জায়গায়। ঘুরে-ফিরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কিন্তু তিনি এমন ব্যবস্থা কর রেখেছেন যে, প্রয়োজনে তাকে পাওয়া সহজ ব্যাপার। স্থানে স্থানে লোক বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারা জানে, সুলতান কখন কোথায় অবস্থান করছেন। সুলতান আইউবীর অবস্থান একটি গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নির্দেশক লোকগুলোকে নির্বাচন করা হয়েছে বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান দেখে।

তিনদিন পথ অতিক্রম করে আল-আদেলের বার্তাবাহক কমান্ডার চার রক্ষীসহ দামেস্ক পৌঁছে যায়। সুলতান এখন আলরিস্তানের পার্বত্য এলাকায় অবস্থান করছেন। প্রচন্ড শীত পড়ছে। লাগাতার দীর্ঘ পথচলার কারণে বার্তাবাহী কমান্ডার ও তার রক্ষীদের অবস্থা শোচনীয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অনিদ্রা ও অবিরাম চলার ফলে তাদের মুখমন্ডল লাশের ন্যায় শুকিয়ে গেছে। তবু তারা এক্ষুণি- এই মুহূর্তে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে উদগ্রীব। সামান্য পানাহার করে কালবিলম্ব না করে তারা আলরিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

***

ত্রিপোলীর খৃস্টান সম্রাট খলীফা আল-মালিকুস সালিহ-এর সাহায্যে এসেছিলেন এবং যুদ্ধ না করেই ফিরে গিয়েছিলেন। কারণ, সুলতান আইউবীর বাহিনী তার বাহিনীর উপর অপ্রত্যাশিতভাবে গেরিলা হামলা চালায় এবং পিছন থেকে রসদ সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পিছনে সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে রেমন্ড তার বাহিনীকে অন্য দিক দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়। সুলতান আইউবী তার পশ্চাদ্ধাবন সংগত মনে করলেন না। কেননা, তাতে সময় ও শক্তি দু-ই নষ্ট হত। তিনি অধিকাংশ গেরিলা সৈন্যকে রেমন্ডের রসদ দখল কিংবা ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বর্ষাও শুরু হয়ে গেছে। খৃস্টানদের রসদ বহর ছিল বিশাল।

রাতের বেলা। রেমন্ডের রসদ রক্ষণাবেক্ষণকারী সৈন্যরা ঘোড়াগাড়ির নীচে ও তাঁবুতে নিশ্চিন্তে শুনে আছে। এই রসদ তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আগামীকাল ভোরে রওনা হবে। দিন থেকেই যে কয়েক জোড়া চোখ পাহাড় ও পাথরের আড়াল থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছে, তা তারা জানে। না। সম্ভবত তাদের ধারণা, এই শীত আর বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে কেউ তাদের উপর হামলা করতে আসবে না। কিন্তু রাতে হঠাৎ তাদের ক্যাম্পের একদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ক্যাম্পে আগুন ধরে যায়। তাঁবুগুলো জ্বলছে। বিষয়টা সুলতান আইউবীর গেরিলা যোদ্ধাদের অভিযানের ফসল। তারা প্রথমে ছোট ছোট মিনজানীক দ্বারা দাহ্য পদার্থভর্তি পাতিল নিক্ষেপ করে। তারপর জ্বলন্ত সলিতাওয়ালা তীর ছোঁড়ে। ক্যাম্পে আগুন ধরে যাওয়ার পর জ্বলন্ত আগুনের আলোতে তারা হামলা করে বসে। বর্শা ও তীরের আক্রমণে বহু খৃস্টান সেনাকে খতম করে তারা পর্বতমালার অভ্যন্তরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

দ্বীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত সন্নিকটস্থ পাহাড় থেকে খৃস্টানদের ক্যাম্পের উপর তীর বর্ষিত হতে থাকে। তারপর হামলা চালায় অপর একটি কমান্ডো দল। সকাল নাগাদ দেড় মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সুবিশাল ক্যাম্পটিতে যা কিছু পড়ে আছে, তা খৃস্টানদের ফেলে যাওয়া রসদ, নিহতদের লাশ আর গুরুতর আহত ক্রুসেডসেনা। অনেকগুলো ঘোড়া হাঁকিয়ে নিয়ে গেছে খৃস্টানরা। ফেলেও গেছে বহুসংখ্যক। কমান্ডোদের বিরতির সময়টায় খৃস্টানরা কিছু ঘোড়াগাড়ি নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে। ফেলে যাওয়া রসদ ও ঘোড়াগুলো সুলতান আইউবীর সৈন্যরা কজা করে নিয়ে যায়।

হালবের অবরোধ তুলে নেয়া হয়েছিল। সুলতান আইউবী এই গুরুত্বপূর্ণ নগরীটিকে পুনরায় অবরোধ করার পরিকল্পনা করেছেন। দিনের বেলা গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার সুলতানকে বিগত রাতের কমান্ডো অভিযানের রিপোর্ট প্রদান করছে। এমন সময় দারোয়ান তাঁবুতে প্রবেশ করে সুলতানকে সংবাদ দেয়, কায়রো থেকে এক কমান্ডার বার্তা নিয়ে এসেছেন। বার্তা বহন করে থাকে দূত। সে জায়গায় কমান্ডারের নাম শুনে সুলতান আইউবী দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন- খরব ভাল তো?….তুমি কেন এসেছ?

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়গাম নিয়ে এসেছি- কমান্ডার বলল- আল্লাহ পাকের নিকট মুমিনের ভালোর-ই আশা রাখা উচিত।

সুলতান আইউবী কমান্ডার থেকে পত্ৰখানা বুঝে নিয়ে তাকে নিয়ে ভিতরে চলে যান। তিনি বার্তাটি পাঠ করে গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান।

এখনো কি জানা যায়নি যে, সুদানী সৈন্যরা মিশরে প্রবেশ করে কোন্ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেছে? সুলতান জিজ্ঞেসা করেন।

তথ্য সগ্রহের জন্য গুপ্তচর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কমান্ডার জবাব দেয়।

আমার অবর্তমানে মিশরে অবশ্যই কোন না কোন সমস্যা সৃষ্টি হবে, সে আশংকা আমার ছিল- সুলতান আইউবী বললেন- আমার ভাইকে বলবে, ভয় পেও না। কায়রোর প্রতিরক্ষা শক্ত কর। তবে শুধু প্রতিরক্ষা যুদ্ধ-ই লড়বে না। বেশির ভাগ সৈন্য নিজের কাছে রাখবে এবং জবাবী হামলার জন্য তাদের মধ্যে থেকে অভিজ্ঞ লোকদের বাছাই করে রাখবে। কিন্তু তাদেরকে শহরের বাইরে যেতে দেবে না। আমাদের বাহিনীর কোন তৎপরতা যেন শত্রুপক্ষ টের না পায়, যাতে তারা এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত থাকে যে, তারা আমাদের অসর্তকতার মধ্যে মিশর দখল করতে সক্ষম হবে। বুঝতে হবে, কায়রো আক্রান্ত হচ্ছে, সে খবর কায়রোবাসী জানে না। শক্ররা যাতে শহরকে অবরোধ করতে না পারে। তার আগেই পাল্টা হামলা করবে। আক্রমণ হওয়ার আগেই দুশমনের অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। যদি তাদের অবস্থানের সন্ধান মিলে যায়, তাহলে বেশি সৈন্য দ্বারা হামলা করাবে না। বরং যথাসম্ভব অল্প সৈন্য দিয়ে গেরিলা হামলা চালাবে। সীমান্ত বাহিনীতে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি কর, যাতে শত্রুরা পালাতে না পারে। আমি ভেবে পাচ্ছিনা, এত বিপুলসংখ্যক সৈন্য সীমান্ত অতিক্রম করে কোন্ দিক থেকে প্রবেশ করল! কোন না কোন সীমান্ত চৌকির সহযোগিতা কিংবা উদাসীনতা ছাড়া এ ঘটনা ঘটতে পারে না। আল্লাহ তোমাদের সাফল্য দান করুন। দুশমন রসদ ও পিছন থেকে সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ করতে পারবে না। তুমি. সীমান্তকে শক্তভাবে সীল করে দাও। যুদ্ধ যাতে দীর্ঘতর হয়, সে চেষ্টা করতে হবে, যাতে দুশমন না খেয়ে মরতে বাধ্য হয়। আমি তো তোমাদেরকে হাতে-কলমেই শিখিয়েছি, দুশমনকে বিক্ষিপ্ত করে কিভাবে যুদ্ধ করতে হয়। বিপুল সৈন্যের মোকাবেলা বিপুল সৈন্য দিয়ে মুখোমুখি যুদ্ধ করা আবশ্যক নয়।

আল-কিনদও একদিন গাদ্দার প্রমাণিত হবে, আমি কখনো ভাবিনি। তারপরও আমি বিষ্মিত নই। মানুষের ঈমান বিক্রি করতে সময় লাগে না। রাজত্বের শুধু কল্পনাই মানুষকে ঈমানহারা করতে পারে। ক্ষমতার নেশা কুরআনকে গেলাবদ্ধ করে সরিয়ে রাখে। আমার আফসোস আল-কিনৃদ-এর জন্য নয়- আমি ইসলামের ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির। আমার ভাইয়েরা একের পর এক খৃস্টানদের হাতে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমার ভাইয়েরা আমার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমার পীর ও মুরশিদ নুরুদ্দীন জঙ্গী দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। কাল-পরশু আমরাও চলে যাব। তার কী হবে? এই প্রশ্নটাই আমাকে অস্থির করে তুলছে। যা হোক, আমাদের চেষ্টা করতে হবে, যে কদিন বেঁচে থাকি, ইসলামের পতাকা অবনমিত হতে দেব না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা আমাকে নিয়মিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করবে।

সুলতান আইউবী বার্তাবাহক কমান্ডারকে বিদায় করে দেন।

***

যে চৌকির কমান্ডার যোহরার সঙ্গে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, তার এক সিপাহী কায়রো এসে রিপোর্ট করে, চৌকির কমান্ডারকে কয়েকদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। চৌকিতে যে নাচ-গানের আসর বসেছিল এবং এক নর্তকী কমান্ডারের তাঁবুতে ঢুকেছিল, সে তথ্য জানায়নি সিপাহী। এ তথ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়, কমান্ডার দুশমনের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিতে পারে এবং শক্র বাহিনী তার ই সহযোগিতায় সীমান্ত অতিক্রম করেছে। আলী বিন সুফিয়ান অভিমত ব্যক্ত করেন, চৌকিটি যেহেতু নদীপথ পাহারার জন্য স্থাপিত, সেহেতু দুশমন সেই নদীপথেই এসে থাকবে। সিদ্ধান্ত হল, একজন বিচক্ষণ কমান্ডারকে একদল রক্ষীসেনাসহ এই চৌকির দায়িত্ব পালনে প্রেরণ করা হবে।

চৌকির কমান্ডার ও যোহরা হাবশীদের হাতে আবদ্ধ। কিন্তু বন্দি হয়েও তারা বন্দি নয়। এখন তাদের পরনে রং-বেরংয়ের পক্ষীপালকের তৈরি পোশাক। তাদেরকে যে কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিও পাখির পালক ও ফুল দ্বারা সজ্জিত। বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়ানো হচ্ছে তাদের। হাবশীদের পুরোহিত তাদের সামনে সেজদা করছে ও বিড়বিড় করে কি যেন পাঠ করছে। অন্য কাউকে তাদের সম্মুখে আসতে দেয়া হচ্ছে না। একবার তাদেরকে গাছের শক্ত ডাল ও লতার তৈরি পালকিতে করে নদীতে গোসল করিয়ে আনা হয়েছে। তারা ভেবেছিল, তাদেরকে বলী দেয়া জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাতে তারা একা থাকছে। কিন্তু বাইরে আট-দশজন হাবশী পাহারা দিচ্ছে। কমান্ডার একাধিকবার পালাবার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন সুযোগ মিলেনি।

এক রাতে হাবশীদের দুজন পুরোহিত তাদের কক্ষে আসে। কমান্ডার ও যোহরা তখন ঘুমিয়ে ছিল। তাদেরকে জাগানো হল। তারা ভাবে, তাদের মৃত্যু, এসে গেছে। পুরোহিতগণ তাদের সম্মুখে সেজদাবনত হয়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাইরে দুটি পালকি রাখা আছে। তার একটিতে কমান্ডারকে, অপরটিতে যোহরাকে তুলে বসানো হল। দুজন করে হাবশী পালকি দুটি কাঁধে তুলে নেয়। পুরোহিতদ্বয় সামনে হাঁটতে শুরু করে। তারা সমকণ্ঠে কি যেন পাঠ করছে। পালকির পিছনে আরো দুজন হাবশী। তাদের হাতে বর্শা। তারা রক্ষীসেনা। কমান্ডার ও যোহরা নীরব। পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে তারা নদীর দিকে এগিয়ে যায়। সময়টা মধ্য রাত। জোসনার আলোয় চারদিক ফক ফক করছে।

নদীর কূলে পৌঁছে বেহারারা কাঁধ থেকে পালকি দুটি নামাল। পুরোহিতগণ এগিয়ে এসে কমান্ডার ও যোহরার পরিধানের পোশাক খুলতে শুরু করে। কমান্ডার চাঁদের আলোতে দেখতে পেলেন, বর্শাধারী রক্ষীদ্বয় ও পালকি বহনকারী হাবশী বেহারারা তাদের প্রতি পিঠ দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেছে। সম্ভবত এমনটা করা তাদের প্রতি নির্দেশ। কমান্ডার হঠাৎ সিংহের ন্যায় এক হাবশীর হাত থেকে তার বর্শাটা ছিনিয়ে নেন। লোকটা একজন অভিজ্ঞ সৈনিক। তিনি পিছনে সরে গিয়ে বর্শাধারী অপর হাবশীর পাজরে বর্শার আঘাত হানেন। আঘাতের ধাক্কায় তার হাতের বর্শাটাও ছিটকে পড়ে যায়। কমান্ডার চীৎকার করে বলে উঠলেন- দৌড়ে এস যোহরা। বর্শাটা তুলে নাও। যোহরা ছুটে আসে। কমান্ডার পড়ে যাওয়া বর্শাটায় পা দ্বারা লাথি মারেন। সেটি যোহরার সম্মুখে চলে যায়। যোহরা বর্শাটা হাতে তুলে নেয়। কমান্ডার বললেন- এবার তুমি পুরুষ হয়ে যাও। হাবশীরা খালী হাতে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা বর্শার মোকাবেলা করতে পারল না। পুরোহিতগণ পালাতে উদ্যত হয়। কমান্ডার তাদেরকে দূরে যেতে দিলেন না। যোহরাও কমান্ডারের সঙ্গ নেয়। উভয় পুরোহিত খতম হয়ে যায়। অন্যরা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। কমান্ডারের বর্শা ঠান্ডা করে দেয় সকলকে। কমান্ডার যোহরাকে নিয়ে চৌকি অভিমুখে রওনা হন। বেশ কিছু পথ অগ্রসর হওয়ার পর দুজন অশ্বারোহী শান্ত্রী দেখতে পান। কমান্ডার তাদেরকে হাঁক দেন জলদি এদিকে এস।

সান্ত্রীরা তাদের কমান্ডারকে চিনে ফেলে। কমান্ডার তাদেরকে বললেন- ঘোড়া দুটো আমাদেরকে দাও। আমরা কায়রো যাচ্ছি। তোমরা চৌকিতে ফিরে যাও। কেউ যদি আমাদের সন্ধানে আসে, বলবে, আমরা তাদেরকে দেখিনি।

সিপাহীদ্বয় পায়ে হেঁটে চৌকিতে ফিরে যায়। কমান্ডার যোহরাকে একটি ঘোড়ার পিঠে তুলে বসান এবং নিজে অপরটিতে সাওয়ার হয়ে যোহরাকে বললেন, তোমার যদি অশ্বচালনার অভিজ্ঞতা নাও থাকে, তবু ভয় নেই। ঘোড়া তোমাকে ফেলবে না। কমান্ডার ঘোড়া হাঁকান। ঘোড়া ছুটতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে যোহরা ভয়ে চীৎকার জুড়ে দেয়। কমান্ডার ঘোড়া থামিয়ে যোহরাকে তার ঘোড়া থেকে নামিয়ে নিজের ঘোড়ার পিছনে বসিয়ে নেন এবং অপর ঘোড়াটির বাগ নিজের ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে যোহরাকে বললেন, তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখ।

ঘোড়া পুনরায় ছুটে চলে। কমান্ডার পাহাড়ী এলাকা এড়িয়ে বেশ দূর দিয়ে এগিয়ে চলছেন। কায়রোর দিক ও পথ তার চেনা। এখনো তিনি দুমাইল পথ অতিক্রম করেননি, একদিক থেকে আওয়াজ আসে- থাম, কে তুমি? কমান্ডার থামলেন না। এক সঙ্গে চারটি ঘোড়া তাকে ধাওয়া করতে শুরু করে। কমান্ডার তার ঘোড়ার গতি আরো তীব্র করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তার। তিনি অপর ঘোড়াটিকে পাশে নিয়ে এসে তাতে সাওয়ার হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু চলন্ত অবস্থায় যোহরাকে নিয়ে ঘোড়া বদল করবেন কিভাবে। আকাশের চাঁদটা এখন ঠিক মাথার উপরে। জোসনার আলোয় অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ধাওয়াকারী লোকগুলো অনেক কাছে চলে এসেছে।

দুটি তীর ধেয়ে এসে কমান্ডারের পাশ দিয়ে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাঁক আসে,- থাম বলছি। অন্যথায় তীর তোমার মাথায় বিদ্ধ হবে।

কমান্ডার ভাবছে, থামলেও মৃত্যু অবধারিত। এরা আমাদেরকে হাবশীদের হাতে তুলে দেবে আর হাবশীরা আজই আমাদেরকে যবাই করে ফেলবে। বাঁচতে হলে পালাবারই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তিনি ঘোড়াটিকে ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দৌড়াতে শুরু করেন, যাতে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

কমান্ডারের বুঝটা ছিল ভুল। তার ও ধাওয়াকারীদের দূরত্ব কমে গেছে। কমান্ডার তাদের বেষ্টনীতে আটকা পড়ে গেছেন। পালকের পোশাক পরিহিত হওয়ার কারণে কমান্ডারকে পাখি বলে মনে হচ্ছে। যোহরার অবস্থাও একই। কমান্ডার চার ব্যক্তির দিকে তাকান। তার মনে সন্দেহ জাগে। তাদের একজন জিজ্ঞেস করে- তোমরা কারা? এই মেয়েটি কে? একজন বলল- কী জিজ্ঞেস করছ? দেখেই তো বুঝা যাচ্ছে, এরা সুদানী। পরেছে কি দেখ।

কমান্ডার হেসে ফেললেন এবং বলে উঠেন- দোস্তরা! আমি তোমাদের-ই ফৌজের একজন কমান্ডার। তিনি যোহরার পরিচয় প্রদান করেন এবং পুরো ঘটনা খুলে বলেন।

এরা চারজন মিশরের টহলসেনা। সুদানী ফৌজের অবস্থান খুঁজে ফিরল তারা। তারা কমান্ডার ও যোহরাকে নিয়ে কায়রো অভিমুখে রওনা হয়ে যায়।

***

দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ছয়জনের কাফেলা পরদিন রাতে কায়রো গির পৌঁছে। তাদেরকে সর্বপ্রথম আলী বিন সুফিয়ানের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। আল-আদেলকে রাতেই ঘুম থেকে জাগিয়ে জান্নানো হয়, চার হাজারের বেশি সুদানী হাবশী ফৌজ অমুক স্থানে লুকিয়ে আছে এবং সালার আল-কিনদ তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আল-আদেল তৎক্ষণাৎ তার বাহিনীকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। সুলতান আইউবীর রণকৌশল মোতাবেক তিনি সম্মুখে অশ্বারোহী বাহিনীকে রাখেন। বাহিনীর পিছন অংশে দুপার্শ্বে রাখেন দুটি দল। নিজে অবস্থান নেন বাহিনীর মধ্যখানে। তিনি জানেন, এলাকাটা পাহাড়ী। তিনি ফৌজকে দুর্গ অবরোধের বিন্যাসে বিন্যস্ত করেন এবং কমান্ডারদের স্থানটা বুঝিয়ে দিয়ে অবরোধের-ই ন্যায় নির্দেশনা প্রদান করেন। পাহাড়ে উঠার জন্য তিনি আলাদা কমান্ডো দল ঠিক করে তাদেরকে নিজের কমান্ডে রাখেন।

ওদিকে রাত পোহাবার পর এক ব্যক্তি দেখতে পেল, নদীল কূলে হাবশীদের দুজন ধর্মগুরু ও চারজন হাবশীর মৃতদেহ পড়ে আছে। আল-কিদ ও তার খৃস্টান উপদেষ্টাদেরকে সংবাদ জানানো হল। তারা ঘটনাটা কোন হাবশীকে জানতে দেয়নি। আল-কিনৃদকে এ তথ্য জানানো হয়েছে যে, যে পুরুষ ও মহিলাকে বলির জন্য রাখা হয়েছিল, তারা পালিয়ে গেছে। আল-কিদ এবার জিজ্ঞেস করেন, ওরা কারা ছিল? তাকে জানানো হল, তাদের পুরুষ লোকটি নিকটবর্তী চৌকির কমান্ডার। শুনে আল-কিনৃদ চমকে ওঠেন। তার মনে পড়ে যায়, লোকটা তাকে দেখেছিল।

লোকটা সোজা কায়রো চলে গিয়ে থাকবে- আল-কি বললেন তাকে চৌকিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন আমাদের আর একটি মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। আমরা অতর্কিতভাবে কায়রোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। সে সুযোগ আমাদের শেষ হয়ে গেছে। আমরা সময় নষ্ট করে ফেলেছি। এখন উল্টো আমরা-ই বেঘোরে প্রাণ হারাব। আমি আমার বাহিনীকে জানি। তারা সংবাদ পাওয়ামাত্র উড়ে এসে পৌঁছে যাবে…। আচ্ছা, একটা কাজ কর, এক্ষুণি নিহত হাবশীদের লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দাও। হাবশীরা যদি জানতে পারে, তাদের পুরোহিত ও কয়েকজন লোক খুন হয়েছে এবং তারা যাদেরকে বলি দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেছে, তারা পালিয়ে গেছে, তাহলে উপায় থাকবে না।

পুরোহিত ও হাবশীদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে দেয়া হল, নদীর কিনারে বলির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। খোদা আদেশ করেছেন, এবার তোমরা দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়। কমান্ডারগণ সংখ্যা অনুপাতে যার যার অধীন হাবশী সেনাদের আলাদা করে ফেলে। তীরন্দাজগণ আলাদা হয়ে যায়। যুদ্ধ পরিকল্পনা মোতাবেত তাদেরকে বিন্যস্ত করা হয়। তাদেরকে পাহাড়ের ভিতর থেকে বের করে নদীকূলের যে স্থানে পুরোহিত ও হাবশী রক্ষীরা খুন হয়েছে, তার নিকট দিয়ে অতিক্রম করানো হল। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত ও দুটি পালকি পড়ে আছে। এক ব্যক্তি সেখানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে- এই রক্ত সেই পুরুষ ও নারীর, যাদেরকে বলি দেয়া হয়েছে।

বাহিনীটি নদীর কূল ঘেঁষে কায়রো অভিমুখে রওনা হয়ে পড়ে। রণসঙ্গীত গাইছে হাবশীরা। দিন শেষে রাত নামে। রাত যাপনের জন্য কাফেলা ছাউনি ফেলে। পরদিন ভোরে আবার রওনা হয়। তারা পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে অনেক দূর এসে গেছে। কেটে যায় এদিনটিও। আসে আরেকটি রাত। বাহিনী এক স্থানে ছাউনি ফেলে। তারা খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে। অনেকটা নিশ্চিন্ত তারা।

মাঝরাতে বাহিনীর পিছন অংশের উপর আল-আদেলের একটি গেরিলা দল আক্রমণ করে বসে। কয়েকটি ঘোড়া দ্রুত ছুটে এসেই অদৃশ্য হয়ে যায়। হৈ চৈ ও তোলপাড় শুরু হয়ে যায় হাবশী ফৌজের মধ্যে। দীর্ঘক্ষণ পর এরূপ আরেকটি হামলা হয়। এবার আক্রমণকারীরা বহু হাবশী সেনাকে দলে-পিষে বেরিয়ে যায়। আল-কি বাহিনীর আগে আগে অবস্থান করছেন। সংবাদ পেয়ে তিনি পদিনের অগ্রযাত্রা মুলতবী করে দেন।

এই গেরিলা আক্রমণ প্রমাণ করছে, আমরা মিশরী বাহিনীর নজরে পড়ে গেছি- আল কি বললেন- এটা সালাহুদ্দীন আইউবীর বিশেষ রণনীতি। আমরা আর সম্মুখে অগ্রসর হতে পারব না। যতই সাহস করনা কেন, তোমরা মিশরী সৈন্যদের সঙ্গে খোলা মাঠে লড়াই করে টিকতে পারবে না। এখন আমাদেরকে পিছনে সরে গিয়ে পাহাড়ী এলাকায় লড়তে হবে। আমাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। কায়রোবাসী শুধু টেরই পেয়ে যায়নি- তারা বাহিনীও পাঠিয়ে দিয়েছে!

আমরা কি মিশরী সৈন্যদের খুঁজে বের করে খোলা মাঠে যুদ্ধ করতে পারব?- এক খৃস্টান কমান্ডার জিজ্ঞেস করে- তোমরা যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীকে মুখোমুখি এনে লড়াই করাতে পারতে, তাহলে মিশর অন্য তোমারদেই থাকত- আল-কি বললেন- আমি সেই বাহিনীরই একজন অধিনায়ক। তাদের সঙ্গে কিভাবে লড়াই করতে হবে, আমার চেয়ে তোম। ভাল জানবেনা।

***

শেষ রাতে হাবশী ফৌজ ফেরত রওনা হয়। ছাউনির এলাকাটায় চারদিকে সর্বত্র হাবশীদের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। আল-কিনদ ঠিকই বুঝেছেন যে, তার বাহিনী মিশরী ফৌজের নজরে এসে গেছে। মিশরী ফৌজের তথ্যানুসন্ধানী দল আল-কিদ এর প্রতিটি গতিবিধি প্রত্যক্ষ করছে। সুদানী বাহিনীকে পেছনে সরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল-আদেল বুঝে ফেললেন আল কিনৃদ পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধ করতে চান। তিনি তখনি অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনীটিকে দূর পথ দিয়ে পাহাড়ী এলাকা অভিমুখে রওনা করিয়ে দেন। প্রেরণ করা হল পদাতিক বাহিনীও। তবে অধিকাংশ সৈন্যকে তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। তিনি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেই বাহিনীকে নিয়ে হাবশী ফৌজের পিছনে পিছনে এগিয়ে চলতে শুরু করেন।

পথেই রাত হয়ে যায়। হাবশী ফৌজ ছাউনি ফেলে। আল-আদেলের কমান্ডো সেনারা তৎপর হয়ে ওঠে। একদল হাবশীসেনা জেগে আছে। তারা তীরন্দাজ বাহিনী। তারা বিপুল পরিমাণ তীর ছুঁড়ে। তাতে কিছুসংখ্যক কমান্ডোসেনা শহীদ হয়ে যায়। কিন্তু তারা সুদানী বাহিনীর যে পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে যায়, তা অসামান্য। সবচে বেশি ক্ষতিটা এই যে, তাতে হাবশী ফৌজের যুদ্ধ করার শক্তি-সাহস ও মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। তারা কল্পনা করে এসেছিল অন্যকিছু। তারা মুখোমুখি লড়াই করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এখানে দুশমন তাদের চোখেই পড়ছে না। অথচ, তারা প্রলয় ঘটিয়ে ফিরে যাচ্ছে। হাবশী ফৌজ দিকহারা হয়ে পড়ে।

রাত পোহাবার পর বেলা হলে হাবশী ফৌজ তাদের সঙ্গীদের লাশ দেখে। বিপুল লাশ! লাশ আর লাশ!! তারা পিছনে সরে যায়।

সূর্য অস্ত যেতে এখনো বেশ বাকি। তারা পাহাড়ী এলাকায় ঢুকে পড়ে। বাহিনীর অর্ধেক সৈন্য এখনো ভিতরে ঢুকেনি, এরই মধ্যে তাদের গায়ে উপর থেকে তীর বর্ষিত হতে শুরু করে। আল-আদেল-এর তীরন্দাজ বাহিনী আগেই সেখানে পৌঁছে ওঁত পেতে বসে থাকে। হাবশী কমান্ডারগণ হাঁক- ডাক দিয়ে সৈন্যদেরকে আড়ালে নিয়ে যায় এবং তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দেয়। অবশিষ্ট অর্ধেক সৈন্য এখনো বাইরে। তাদেরকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আল-কিন্দ তাদেরকে পাহাড়ে উঠিয়ে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং উপর থেকে তীর নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা আঁটে। তার এই পরিকল্পনা বেশ সফলও হয়। বহু হাবশীসেনা পাহাড়ে উঠে যেতে সক্ষম হয় এবং তারা সফল তীরন্দাজী করে। তাতে আল-আদেল-এর অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। কিন্তু তার পরিকল্পনা বেশ চমৎকার। তিনি সেখান থেকে তার বাহিনীকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যান। তার আগাম নির্দেশনা মোতাবেক অপর দিক থেকে তীরন্দাজ ও অন্যান্য বাহিনী পাহাড়ের উপরে উঠে যাচ্ছে। অশ্বারোহী বাহিনীর একটি ইউনিটকে নদীর তীরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

আসওয়ানের এই পাহাড়ী অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হল। উপত্যকা ও পর্বতপৃষ্ঠে অনেক তীর ছোঁড়াছুঁড়ি হল। তারপর অশ্বারোহী বাহিনী উপত্যকায় প্রলয় সৃষ্টি করার নির্দেশ পেল। রাতে হাবশীরা লুকিয়ে থাকে বটে; কিন্তু আল আদেল তার মিনজানীক বাহিনীকে নির্দেশ দেন, স্থানে স্থানে এদিক-সেদিক সর্বত্র দাহ্য পদাথ্য ভর্তি পাতিল ছুঁড়ে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে থাক। কিছুক্ষণ পরই পর্বতমালার ঢালুতে ও পাদদেশে অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে এবং চতুর্দিক আলোকিত হয়ে যায়। এই আলোতে সারা রাত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। যখন ভোর হল, তখন হাবশীরা সর্বশান্ত-নীরব। তাদের কিছু লোক পাতাল ঠিকানায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।

দিনের বেলা আল-কি-এর লাশ পাওয়া গেল। কারো তীর কিংবা তরবারীর আঘাতে নয়- লোকটি নিজের তরবারীর আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। তারই তারবারীটা তার লাশের হৃদপিন্ডের উপর গেঁথে আছে। অর্থাৎ আল-কি আত্মহত্যা করেছেন। কয়েকজন খৃস্টান ও সুদানী কমান্ডার জীবিত বন্দি হল। বন্দি হল এক হাজারেরও বেশি হাবশী যোদ্ধা।

আল-আদেল সেখান থেকেই সুলতান আইউবীর নিকট পয়গাম লিখে দূত প্রেরণ করেন। তাকে নির্দেশ দেন, যত দ্রুত সম্ভব সুলতানের নিকট পৌঁছে যাও; তিনি চরম অস্থিরতার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *