৪.৩ পানিপথ

২২. পানিপথ

দিল্লীর উত্তর-পশ্চিমের সমভূমিতে পানিপথের ছোট গ্রামটার কাছে বাবর তার বাহিনী নিয়ে দুদিন আগে শিবির স্থাপন করার সময়ে তার লোকেরা শিবিরের ঠিক মাঝখানে তার বিশাল লাল রঙের নিয়ন্ত্রক তাঁবুটা স্থাপন করেছে। বাবর আর তার চারপাশে সমবেত সামরিক পর্ষদের সদস্যদের এপ্রিল মাসের তীব্র দাবদাহের হাত থেকে তাবুটা সামান্যই স্বস্তি দান করতে পারছে। তাবুর পর্দা টেনে দেয়া হলে ভেতরের পরিবেশ নিমেষেই শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠে। চামড়ার দড়ি দিয়ে বেঁধে পর্দা সরিয়ে দেয়া হলে তীব্র বাতাসের সাথে বয়ে আসা ধূলিকণা চোখে খোঁচা দিয়ে নাকে গুতো মেরে নিমেষেই অস্থির করে তোলে। বাতাসের গতি রোধ করতে তাবু থেকে কয়েক গজ দূরে স্থাপিত মোটা খয়েরী চাদরের বেড়া দিয়ে পরিবেশের সামান্যই উন্নতি হয়।

বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে বাবর তার নির্ধারিত সোনার গিল্টি করা আসনে উপবিষ্ট। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন লেবুর সাথে পানি এবং পাহাড় থেকে নামবার সময়ে যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে নিয়ে আসা বরফের বেঁচে থাকা অংশের কিছুটা মিশিয়ে তৈরি শরবতে চুমুক দেয়। বাবুরী বাবরের বামপাশে আসনপিড়ি হয়ে শরবতের পেয়ালা হাতে বসে আছে এবং প্রতিবার চুমুক দেবার আগে ধূলোর হাত থেকে বাঁচতে মুখের নিম্নাংশে সে যে পাতলা হলুদ কাপড়ের গালপাট্টা বেঁধে রেখেছে সেটা সাবধানে তুলে ধরে।

আঠারতম জন্মদিন পালনের মাত্র একমাস পরে হুমায়ূন তার বাবার ডানপাশে বসবার জন্য একটা টুল পেয়েছে। পাতলা তুলো দিয়ে তৈরি সুতির সবুজ রঙের কাপড়ে তৈরি একটা জোব্বা আর একই কাপড়ের তৈরি ঢোলা চোগা তার পরনে। তাঁবুতে উপস্থিত আরো অনেক সেনাপতিদের মতো তার মাথার উপরেও ময়ূরের পালকের তৈরি একটা বিশাল টানা পাখা, কোমর পর্যন্ত নগ্ন। কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে টানতে থাকা পরিচারকের দল, অনবরত বাতাস করছে। “বাবুরী, আমাদের গুপ্তদূতেরা সুলতান ইবরাহিমের সেনাবাহিনীর অগ্রসর হবার কি খবর নিয়ে এসেছে?”

 “তারা এখনও আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে কিন্তু বড় গদাইলস্করী চালে। একদিন অন্তর তারা তাঁবু গুটিয়ে নেয় কিন্তু তারপরেই পাঁচ কি ছয় মাইল পরে আবার শিবির স্থাপন করে। যার একটা কারণ হতে পারে তাদের মালপত্রের বিপুল পরিমাণ। কিন্তু আমার মনে হয় তারা আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করতে খুব একটা ইচ্ছুক না। তাদের ইচ্ছা আমরা আমাদের রসদপত্র সব শেষ করে ফেলি কিংবা অস্থির হয়ে উঠে নিজেরাই তাদের আগে আক্রমণ করার নির্বুদ্ধিতা দেখাই।”

“আমি আশা করি সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা তাদের প্রথমে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করবো, যাতে কামান আর মাস্কেট দিয়ে সুরক্ষিত অবস্থান থেকে তাদের উপরে পাল্টা আক্রমণ করা যায়। আর তাদের সংখ্যাধিকের সুবিধা যতোটা সম্ভব হ্রাস করা যায়। আচ্ছা আলোচনা যখন হচ্ছে, তাদের সর্বশেষ লোকবলের পরিমান কত?” বাবর শরবতের গ্লাস নামিয়ে রেখে জানতে চায়।

 “প্রায় এক লক্ষ- সত্তর হাজার অশ্বারোহী আর বাকি পদাতিক। পদাতিক সৈন্যরা যতোটা না লুটপাটে আগ্রহী, যুদ্ধ করতে ততোটা নয়। আর তাদের রণহস্তির কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের চরেরা বলেছে প্রায় এক হাজার হবে তাদের সংখ্যা, একেকটা পাহাড়ের মতো পাকাঁপোক্ত। সবগুলোই যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত আর বর্ম দ্বারা আবৃত। এদের নিয়েই আসল দুশ্চিন্তা। আমরা রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকলেও, আমাদের কাছাকাছি আসবার আগেই তাদের হামলা আমাদের প্রতিহত করতে হবে। অন্যথায়, তারা যদি আমাদের ভিতরে একবার এসে উপস্থিত হতে পারে, তাদের সামলে রাখাই তখন আমাদের লোকদের মুশকিল হয়ে পড়বে। আমাদের বেশিরভাগ লোকই জীবনে কখনও হাতি কি জিনিস দেখেনি, তার সাথে লড়াই করা তো দূরের কথা-”।

 “আমরা কামানের সাহায্য নেবো, হুমায়ূন কথার মাঝে বলে উঠে।

“হ্যাঁ, কিন্তু আমরা যদি গোলাবর্ষণের পরে তাদের পুনরায় প্রস্তুত করতে চাইলে আর যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রভাব ফেলতে চাইলে কামানগুলোকেও আমাদের আগলে রাখতে হবে। কয়েক পশলা গোলা বর্ষণের পরেই যেনো সেগুলো বেহাত হয়ে না যায়।”

“নিরাপত্তার জন্য আমাদের ছাউনির ঠিক মাঝখানে, যেমন এই তাঁবুটা স্থাপন করা হয়েছে আমরা কামানগুলোকেও তেমনিভাবে আমাদের সমরসজ্জার একেবারে কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত করতে পারি।” হুমায়ূন বলতে চেষ্টা করে।

 “কিন্তু গোলা বর্ষণের জন্য পরিষ্কার নিশানা পথ প্রয়োজন…” বাবুরীও বলতে থাকে।

“আমার কথা শোনো।” বাবর বাবুরী আর হুমায়ূনকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলে। “বাবুরী তোমার সেই বৃদ্ধার কথা মনে আছে- রেহানা- বহু বছর আগে আমাদের কি বলেছিলো, যখন আমাদের বয়স হুমায়ুনের এখনকার বয়সের মতোই ছিলো, তৈমূরের দিল্লী বিজয়ের কৌশল সম্পর্কে? গত রাতে আমি আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা আর আমার মহান পূর্বপুরুষ এমন পরিস্থিতিতে কি করতেন ভাবতে গিয়ে আমার রেহানার কথা মনে পড়ে এবং আমার সৌভাগ্য বলতে হবে আমি তার ভাষ্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম এবং আজও আমি যেখানে গুরুত্বপূর্ণ শাহী দস্তাবেজসমূহ আর আমার রোজনামচা রাখি সেই সিন্দুকে রাখা আছে…।

“সেটা আবার পড়তে গিয়ে আমি সেখানে হাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল কৌশল খুঁজে পেয়েছি। তৈমূর পরিখা খনন করেছিলেন এবং সেই মাটি দিয়ে তার সৈন্যবাহিনীর সামনে মাটির গড় নির্মাণ করেছিলেন। তারপরে তিনি গাড়ি টানার বলদগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আরেকপ্রস্থ নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ করেন। আমি ভেবেছি আমরাও পরিখা খনন করে সেই মাটি দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করবো। কিন্তু গাড়ি টানার বলদগুলোকে না বেঁধে মালবহনের গাড়িগুলোকে দড়ি দিয়ে পরস্পরের সাথে বেঁধে দেবো। তবে মাঝে মাঝে ফাঁক থাকবে যেখানে দিয়ে আমাদের কামানগুলো তোমার পরামর্শ অনুযায়ী স্থাপন করা হবে, আমাদের অবস্থানের কেন্দ্রে গোলাবর্ষণ করতে পারবে। আর আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীও প্রয়োজনের সময়ে হামলা করতে পারবে। এই মালবাহী গাড়ির মধ্যবর্তী শূন্যস্থানগুলো রক্ষা করার জন্য আমরা আমাদের কিছু মাস্কেটধারী সৈন্য আর অশ্বারোহী তীরন্দাজদের মোতায়েন করবো। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে তারা তীর আর গুলিবর্ষণ করবে।”

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় কিন্তু বাবুরী সন্তুষ্ট হয় না। “সবই বুঝলাম, কিন্তু আপনি কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে ব্যাটারা আমাদের আক্রমণ করবেই। আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে আমাদের পিছু হটতে বাধ্য করার পরিবর্তে।”

“আমরা একবার আমাদের অবস্থান সুসংহত করি। তারপরে কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরে তারা যদি আক্রমণ না করে তবে তখন আমরা তাদের প্ররোচিত করবো। আমরা দু’পাশ থেকে তাদের শিবির বা সেখানের কোষাগার লক্ষ্য করে আপাত ভঙ্গিতে অগ্রসর হবো- তারচেয়েও ভালো হয়- সীমিত পরিসরে আক্রমণ করে তারপরে পিছিয়ে আসবার ভান করলে। আমরা তাদের ভাবতে বাধ্য করবো যে তারা আমাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে এবং এখন পাল্টা আক্রমণ করলে তারা অনায়াসে বিজয়ী হবে…”

*

পরবর্তী কয়েকটা দিন। বাবরের সৈন্যরা, ভোরের শীতল পরিবেশে কাজ আরম্ভ করে, দিনের উষ্ণতম অংশটায় এক নাগাড়ে কাজ করতে থাকে। যখন দাবদাহের কারণে দিগন্তে ঢেউ খেলে যায়। যততক্ষণ না সন্ধ্যা নেমে আসে, শুকনো মাটি কুপিয়ে পরিখার আদল তৈরি করে। আর সেই মাটি দিয়ে গড় নির্মাণ করে। মন্থর এবং পরিশ্রান্ত করে তোলা একটা কাজ। কেউ কেউ সূর্যের প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনেকেই প্রলাপ বকতে শুরু করে- জিহ্বা জড়িয়ে আসে, চোখ উল্টে যায়- যেখান থেকে তারা আর কখনও সুস্থ হবে না।

নিজের লোকদের মনোবল বৃদ্ধি করতে, বাবর আর হুমায়ূন দু’জনে কোদাল হাতে নিয়ে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কাটে। সেটা ঝুড়িতে ভর্তি করে সেই ঝুড়ি কাঠের জোয়ালের দুপাশে ঝুলিয়ে গড়ের উপরে উঠে যায়। তিনদিন পরে গড় সন্তোষজনক উচ্চতা লাভ করে। মাটির এই বেষ্টনীর পেছনে গাড়িগুলোকে পরস্পরের সাথে ভালো করে বাঁধা হয় এবং তাদের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় যত্ন করে নির্ধারিত অবস্থানে কামানগুলো ষাড় দিয়ে টেনে আনা হয়। প্রতিটা কামানের পাশে ভারী পাথরের গোলার একটা স্তূপ তৈরি করা হয় এবং তূর্কী গোলন্দাজের দল তাদের লোকদের নিয়ে গোলাবর্ষণের কুচকাওয়াজ করে। কামারের নেহাইয়ের আওয়াজ এবং অসংখ্য কণ্ঠস্বরের মিশ্রিত কোলাহল- শঙ্কিত আর উত্তেজিত শিবিরের চারপাশে গুঞ্জন তোলে।

 বাবুরীকে পাশে নিয়ে বাবর ঘোড়ায় চেপে শিবির পরিদর্শনে বের হলে, কণ্ঠস্বরগুলো নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় এবং সৈন্যরা মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাবুরী বাবরের দিকে ঝুঁকে আসে। “সর্বশেষ খবর অনুযায়ী দিল্লীর সেনাবাহিনী যদিও আর মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থান করছে। কিন্তু এখনও তাদের ভিতরে আক্রমণ করার কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।”

 “কিন্তু নিদেন পক্ষে- আমাদের সংবাদদাতারা যদি ঠিক খবর নিয়ে এসে থাকে অসন্তোষ দানা বাঁধছে এবং ইবরাহিম তার সৈন্যদের বেতন দিতে কার্পণ্য করছে এই অভিযোগে প্রতিদিন শিবির ত্যাগের সংখ্যা বাড়ছে। আর ভবিষ্যত পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করতেও সে গড়িমসি করছে। একতাবদ্ধ বাহিনীর চেয়ে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে পরাস্ত করাটা সহজ এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাদের হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করা সম্ভব।”

 “সত্যি কথা।”

 “ইবরাহিমের জানা উচিত যে আরো অপেক্ষা করলে মনোবল ভেঙে যাবে এবং অভিযোগ আর কোন্দলের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং সম্ভবত তাতে শিবির ত্যাগের ঘটনাই কেবল বাড়বে।”

 “কিন্তু আমরা বিলম্বের কারণ যতোই ব্যাখ্যা করি এবং আমাদের লোকেরা যতোই শৃঙ্খলাবদ্ধ হোক না কেন তাদের বেশিদিন আর সামলে রাখা যাবে না।”

“একটা ঝটিকা হামলার পরিকল্পনা করো, যাতে সে আমাদের আক্রমণ করে।”

 “কবে?”

 “আগামীকাল। সামরিক মন্ত্রণা সভা আহ্বান করো।”

*

পরের দিন সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে, বাবর তার বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, তার বাছা বাছা চারহাজার সৈন্যকে অর্ধেকই যার অশ্বারোহী তীরন্দাজ। জড়ো হতে দেখে এবং তারপরে সেনাপতিদের চিৎকার আর ঘোড়ার চিহি রব, নাক ঝাড়ার আওয়াজের মাঝে, যেনো ঘোড়াগুলোও তাদের আরোহীদের উত্তেজনা আর স্নায়বিক চাপ অনুভব করতে পারছে। তারা সারিবদ্ধ হয়ে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হয়ে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। তারা প্রস্তুত হতেই বাবর পরিখা আর বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে তার এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে নিয়ে শিবির থেকে বের হয়ে এসে বৃত্তাকারে ঘুরে পশ্চিম দিক থেকে সুলতান ইবরাহিমের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বাবর অস্তমিত সূর্যের দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে ঘোড়ার খুরের ঘায়ে সৃষ্ট ধূলোর মেঘ আর সূর্যের শেষ রশ্মির আভা মিলেমিশে প্রতিপক্ষকে আক্রমণকারীদের সঠিক সংখ্যা অনুধাবন করতে বাধা দেয়। সুলতান ইবরাহিমের ছাউনির পশ্চিম দিকের সীমারেখার মাইলখানেকের ভিতরে উপস্থিত হতে, বাবর তার লোকদের দাঁড় করায় এবং বাবুরীর দিকে ঘুরে তাকায়। “তুমি কি কিছু শত্রুকে বন্দি করার জন্য সৈন্যদের দায়িত্ব দিয়েছো?”

 “হ্যাঁ, আমি নিজে সেই দলের নেতৃত্ব দেবো।”

 “তাহলে চলো শুরু করা যাক।”

 “চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য নিজেকে হেফাজত করবেন।”

 হাতের একটা ইশারায় বাবর আক্রমণ শুরু করার আদেশ দেয়। তার কালো ঘোড়ার পেটের চকচকে চামড়ায় গোড়ালী দিয়ে খোঁচা দিয়ে সে দ্রুত তার লোকদের থেকে সামনে এগিয়ে যায়। শীঘ্রই তাকে একশ গজ সামনে থেকে ঘোড়া দাবড়াতে দেখা যায়। সে বুঝতে পারে তার ভিতরে কোনো ভয় কাজ করছে না। কেবল ধাবমান ঘোড়ার গতিময়তার শিহরণ এবং এখনও যুবক বয়সের মতো বলশালী অনুভব করার আনন্দ। তারপরে বাবুরীর শেষ কথাগুলো তার মনে পড়ে: তার নিয়তি নির্ধারক চুড়ান্ত যুদ্ধ এটা না, কেবল তাকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটা হামলা। তাকে নিজের অসহিষ্ণুতা আর উদ্দীপনার রাশ দমন করতে হবে এবং তাকে অনুসরণকারী যোদ্ধারা যাতে তার কাছ থেকে আদেশ গ্রহণ করতে পারে সেই সুযোগ তাদের দিতে হবে। সে ঘোড়ার গতি কমাবার ফাঁকে সামনে ইবরাহিমের বিভ্রান্ত লোকদের অস্ত্রের খোঁজে হুড়োহুড়ি করতে দেখে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসেছে এবং তার সৈন্যদের লক্ষ্য করে তীরের প্রথম ঝাপটা উড়ে আসতে শুরু করেছে।

 নিমেষের ভিতরে বাবরের কালো ঘোড়াটা তাকে শত্রুদের মাঝে নিয়ে হাজির করে এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে যুদ্ধের উন্মাদনায় আলমগীর দিয়ে ডানে বামে নির্বিচারে আঘাত হানতে থাকে। যুদ্ধটা তার কাছে মুহূর্তের ভিতরে পরস্পর সংযুক্ত চিত্রকল্পের একটা ঝাপসা কোলাজে পরিণত হয়: নীল পাগড়ি পরিহিত এক হিন্দুস্তানী তার ঘোড়ার খুরের নিচে পিষ্ট হয়ে যায়। মুখের ক্ষতস্থান থেকে, যা দিয়ে ভেতরের দাঁত দেখা যায়। গলগল করে রক্ত ঝরে পড়ে; একটা বাদামী রঙের তাঁবু সহসা সামনে ভূতের মতো দেখা যেতে সে তাঁবুর সাথে যাতে তারা জড়িয়ে না যায় সেজন্য নিজের ঘোড়ার মুখ সরিয়ে নেয়; বাতাস কেটে একটা রণকুঠার উড়ে এসে তার পাশের একটা ঘোড়ার গলায় আমূল বিদ্ধ হতে, সেটা ধীরে তার আরোহীর দেহ নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়তে একটা ভোঁতা শব্দ ভেসে আসে।

বাবর সহসা নিজের সামনে খানিকটা খোলা স্থান দেখতে পায়।

সে শত্রুপক্ষের প্রথম সারি অতিক্রম করেছে। তার লোকদের এখন আরও ভেতর প্রবেশ করার বদলে ফিরতি পথে ঘুরে যাওয়া উচিত। নতুবা প্রতিপক্ষের বেষ্টনীর ভিতরে আটকে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। নিজের উত্তেজিত ঘোড়ার লাগাম বহুকষ্টে টেনে ধরে সে ফিরে যাবার জন্য। আগে থেকে নির্ধারিত সংকেত ঘোষণা করে এবং তাদের ঘোড়ার কারণে সৃষ্ট ধূলোর মেঘের ভিতর দিয়ে যা ইবরাহিমের লোকদের পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে, দুলকিচালে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে চলে।

বাবর জানে ফিরে যাবার জন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়াটা সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। যখন তার ধাবমান সৈন্যরা ঘোড়ার মুখ ঘোরাতে গিয়ে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ইবরাহিমের তীরন্দাজদের সহজ নিশানায় পর্যবসিত হতে পারে। অবশ্য, আশার কথা, তার অশ্বারোহী বাহিনী যথেষ্ট প্রশিক্ষিত এবং দুই একজন যদিও আচমকা ঘোড়ার গতিমুখ পরিবর্তন করতে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে বেশিরভাগই সাফল্যের সাথে ঘোড়ার মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং বাবরকে অচিরেই ধূলো আর বিভ্রান্ত শত্রুসেনার মাঝ দিয়ে পেছনে ধেয়ে আসা তীরের ঝাপটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের ছাউনির দিকে ঘোড়া ছোটাতে দেখা যায়। আক্রমণ শুরু করার আগে সে যেমন আদেশ দিয়েছিলো, তার লোকেরা অনতিবিলম্বে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আতঙ্কিত হবার ভান করে ঢাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি ঘোড়া ছোটায়।

সমভূমিতে যেমন হয়ে থাকে, বাবর তার ছাউনির গড়ের আড়ালে যখন ঘোড়া থেকে। নামে। ততক্ষণে দ্রুত চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। বাবুরী সন্ধ্যার আঘো-অন্ধকারের ভেতর থেকে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার বাম হাতের আঙ্গুলের গাঁটে একটা সাদা কাপড়ের ফালি শক্ত করে বাঁধা আর সেটাতে রক্তের দাগ ফুটে থাকায় স্পষ্টই বোঝা যায় বেচারা হিন্দুস্তানের তরবারির ধার পরখ করে এসেছে। অবশ্য সে সব পাত্তা না দিয়ে কান পর্যন্ত হাসি নিয়ে সে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে।

 “তুমি বন্দি নিয়ে এসেছো?”

“এরচেয়ে ভালো নির্ধারণ আর হতে পারে না- কোনো পানির্বাহক না আমি অশ্বারোহী যোদ্ধার একটা দল তাদের দলনেতাসহ নিয়ে এসেছি যাকে পরাস্ত করতে আমাদের ঘাম ছুটে গিয়েছিলো।”

“সেই তাহলে আমাদের বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করবে। পাঁচ মিনিটের ভিতরে তাকে আমার তাঁবুতে হাজির করো। আর দেখো সে আর তার লোকদের চোখ যেনো বাঁধা থাকে। আমি চাই না ফিরে গিয়ে তারা আমার শিবিরের বর্ণনা দিয়ে বেড়াক।”

 পাঁচ মিনিট পরে বাবুরী বন্দিকে বাবরের সামনে নিয়ে আসে। বন্দি কালো বর্ণের বিশাল আকৃতির পেষল দেহের একটা লোক। সে তার দিকে এগিয়ে আসতে, বাবর খেয়াল করে দেখে হিন্দুস্তানীদের প্রিয় ঝাকড়া গোফ রয়েছে লোকটার এবং ভাবে যে তার মাতৃভূমির অনেক লোকের যার ভেতরে সেও অন্তর্ভূক্ত- গোফ রাখার উপযুক্ত দাড়ি রয়েছে।

 “তার চোখের বাঁধন অপসারিত করো। তোমার নাম কি?”

 “আসিফ ইকবাল।”

“বেশ, আসিফ ইকবাল, আমাকে বলা হয়েছে যে তুমি ভাগ্যবান আর সেই সাথে সাহসীও বটে। সুলতান ইবরাহিমের কাছে একটা বার্তা তুমি বয়ে নিয়ে যাবে।” লোকটার ভেতরে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। সে যে কথাটা বুঝেছে সেটা বোঝাবার জন্যও মাথা নত করে কি করে না।

“আজ আমরা যদিও আমাদের আক্রমণ থেকে পিছু হটে এসেছি এবং আমাদের অনেক হতাহত হয়েছে। কিন্তু তুমি তাকে বলবে যে আমরা তাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছি। আমাদের কাছে সে একটা কাপুরুষ। কারণ সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আক্রমণ করতে তার সাহস হয়নি। তার কাছে জানতে চাইবে সেনাপতিরা তার কথা শুনবে না বলেই কি তার এই আক্রমণে অনীহা- তুমি তাকে আরও বলতে পারো তার সেনাপতিদের অনেকেই পুরস্কারের বিনিময়ে আমার সাথে যোগ দিবে বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নাকি সে জানে যে তার সেনাবাহিনীতে কাফেরের সংখ্যা প্রকৃত বিশ্বাসীদের চেয়ে বেশি হবার কারণে সে জানে যে আল্লাহতালা তার প্রতি সহায় হবে না? তাকে বলবে ‘হয় আক্রমণ করুক নতুবা আজীবন কাপুরুষ নামটা তাকে তাড়া করে ফিরবে।”

বন্দি সেনাপতির চোখে আবার কালো কাপড় বেঁধে দেয়া হয় এবং ইবরাহিমের ছাউনির কাছে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসে, বাবুরী বাবরের তাঁবুতে ফিরে আসে। “আশা করা যায় আমাদের আজকের হামলায় পালিয়ে আসবার ভনিতা করে আমরা যে দুর্বলতা অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে চেয়েছি, আর এই বার্তা ইবরাহিমকে আক্রমণে উৎসাহিত করে তুলবে।”

 “দুটোতেই কাজ হবে। কেউ কাপুরুষ সম্বোধন শুনতে পছন্দ করে না। ইবরাহিম ভালো করেই নিজের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কথা জানে। আর তার সেনাপতিদের কেউ কেউ গোপনে পক্ষত্যাগ করতে চাইছে এই আভাস পাবার পরে সে তার সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে সংখ্যাধিক্যের সুবিধা নাকচ হয়ে যাবার আগেই আক্রমণ করবে।”

 “আমি মানছি সে কথা। আমার লোকদের সকালের আলো ফোঁটার একঘণ্টা আগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলবে। ইবরাহিম আক্রমণ করলে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার আগেই করবে।”

 বাবুরী চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে, তারপরে কি মনে হতে সহসা বাবরকে আলিঙ্গন করে। “আগামীকাল আমাদের দুজনের জন্যই একটা ঘটনাবহুল দিন হবে। আমি অনুভব করতে পারছি।”

“ভালোমতো ঘুমিয়ে নাও। আমি নিশ্চিত, ভালোমতো বিশ্রাম নিলে ভাগ্য তাকে সহায়তা করে।”

বাবুরী কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁবু থেকে বের হয়ে যায় এবং বাইরের অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে যায়।

*

ভোর হবার সাথে সাথে সুলতান ইবরাহিমের শিবিরে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়- চিৎকার, হাতির ডাক আর ঘোড়ার চিঁহি রবে চারপাশ প্রকম্পিত হতে থাকে। কয়েক মিনিট আগেই ইবরাহিমের বাদক দল ঢাকে যুদ্ধের বোল তুলতে শুরু করেছে।

বাবর ভাবে, সে সত্যিই আক্রমণ করবে। যদি তাই হয়, তবে বাবরের জীবনে আজকের দিনটা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আর বিজয় লাভের জন্য সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি সে নিয়েছে। রাতে সে সামান্যই ঘুমিয়েছে, সারা রাত জেগে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনার দুর্বলতা বা খুঁত খুঁজে বের করতে চেয়েছে। কিন্তু কিছুই পায়নি। তার আর কিছু করার নেই…।

 সে বাবুরী আর হুমায়ুনের সাথে শেষবারেরমতো আলাপ করার জন্য তাদের ডেকে পাঠায়। হুমায়ূন আজকের যুদ্ধে ডানপাশের সমরসজ্জার সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে। আর বাবুরী থাকবে বামপাশের দায়িত্বে। যুদ্ধ একবার ভালোমতো শুরু হলে এবং ইবরাহিমের সৈন্যরা বাবরের নির্মিত মাটির প্রতিবন্ধকতা আর গাড়ির বহরের বাধা আক্রমণে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তারা দু’পাশ থেকে বৃত্তাকারে তাদের ঘিরে ফেলার জন্য অগ্রসর হবে। তারপরে আল্লাহ সহায় থাকলে বিজয় তাদের নাগালের ভিতরে আসলে তারা তখন পলায়নপর সৈন্যদের নিরন্তর ধাওয়া করে তাদের পুনরায় সংগঠিত হতে বাধা দেবে।

তার সন্তান আর একমাত্র বান্ধব তাদের নিজনিজ অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে, বাবর মাটির দেয়াল রক্ষায় নিয়োজিত সৈন্য পরিদর্শনে বের হয় এবং তাদের ছোট ছোট দলের সাথে কথা বলে। সে সবাইকে একটা কথাই ভালো করে বোঝাতে চায়: “তোমাদের অবস্থানটা সবচেয়ে গৌরবের। তোমরাই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। মনে সাহস রাখো। নিজের উপরে আর নিজের সুলতানের উপরে বিশ্বাস রাখো। আমাদের নতুন অস্ত্র, কামান আর মাস্কেটের সামর্থ তোমরা দেখেছো। শত্রুর হাত থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তোমাদের উপরে, যাতে সেগুলো ধ্বংস উগরে দিতে পারে।”

একবার সে একদল তরুণ বিচলিত অশ্বারোহী সৈন্যদের একটা জটলা লক্ষ্য করে নিজেদের ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে বারবার অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করছে। প্রথমবার যুদ্ধযাত্রার কালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে আছে। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার লিলা যুদ্ধ শুরু হবার জন্য অপেক্ষা করাটা। আমি জানি যখন সময় হবে তোমরা সবাই বীরের মতোই লড়বে। সামনের শত্রুর প্রতি মনোনিবেশ করবে, জানবে হযযাদ্ধারা পাশ থেকে তোমাকে ঠিকই আগলে রাখবে।”

প্রতিরক্ষা ব্যুহের আরেক স্থানে সে মাটির প্রতিবন্ধকতার একটা দেয়ালের পাশে ঘোড়া থেকে নামে এবং চুলবিহীন চাদিতে ক্ষতচিহ্ন যুক্ত শক্তপোক্ত দেখতে এক পোড়খাওয়া তীরন্দাজের ধনুকের ছিলা পরখ করে দেখে যে মাটির দেয়ালের পেছনে নিজের অবস্থানে প্রস্তুত রয়েছে। “এই ধনুক দিয়ে কতোদূরে তুমি তীর ছুঁড়তে পারো?”

“সুলতান, পাঁচশ গজ।”

 “দারুণ, তোমার মতো পোড়খাওয়া যোদ্ধাকে আমার নিশ্চয়ই অপেক্ষা করার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, শত্রু সেনা চারশ নিরানব্বই গজ কাছে আসবার পরে তুমি তাদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়বে। কিন্তু আমার বোধহয় তোমাকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে, আমি শুনেছি ওখানে হাতির পাল প্রস্তুতি নিচ্ছে আর তাদের কানের পেছনে বসে থাকা আরোহীদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তুমি আমাকে দারুণ সহায়তা করতে পারো। লোকগুলো মারা গেলে, বিশালাকৃতি প্রাণীগুলো দিকভ্রান্ত হয়ে পড়বে আর নিজেদের লোকদেরই পিষে দিতে শুরু করবে।”

প্রতিবন্ধকতার কেন্দ্রে নিজের নির্ধারিত স্থানে সে ফিরে যাবার আগে তূর্কী গোলন্দাজদের সর্দার আলী কুলীর সামনে শেষবারেরমতো থামে। “নিজের মাতৃভূমি থেকে এতোদূরে ভ্রমণ করে এসে আমার পক্ষে লড়াই করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি জানি যতোই ভীতিকর দেখাক, প্রতিপক্ষের পঞ্চাশটা হাতির সমান আপনার একেকটা অস্ত্র। তাদের পরাস্ত করুন আর আমি আপনাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করবো।”

 বাবর নিজের অবস্থানে ফিরে এসে ঘোড়া থেকে নামে এবং তাঁবুতে প্রবেশ করে নফল নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষ হতে, তার মরহুম আব্বাজান, আম্মিজান, নানীজান, এসান দৌলত, ওয়াজির খান, আর বাইসানগারের চেহারা তার মানসপটে ভেসে উঠে। কেবল এসান দৌলতের অভিব্যক্তিই তার কাছে যোদ্ধার উপযুক্ত মনে হয়। সে নিরবে প্রতিজ্ঞা করে, আজ আমি আপনাদের সবাইকে সম্মানিত করবো। আর প্রমাণ করবো আমি আপনাদের আর তৈমূর এবং চেঙ্গিস খানের উপযুক্ত বংশধর।”

 “সুলতান, তারা নিশ্চিতভাবেই এবার আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে।”

বাবরের নিশানবাহক কর্চি তার ভাবনায় ছেদ ঘটায় এবং নিজের নিয়তিকে বরণ করতে সে শান্ত আর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। তার পরিচারক তাকে ইস্পাতের বর্ম পরিয়ে, কোমরে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি ঝুলিয়ে দেয় এবং হাতে হলুদ আর সবুজ পুচ্ছযুক্ত গম্বুজাকৃতি শিরস্ত্রাণ ধরিয়ে দিয়ে চামড়ার খাপে মোড়ানো একটা খঞ্জর এগিয়ে দেয়। বাবর সেটা তার খয়েরী রঙের চামড়ার ঘোড়সওয়ারের জুতোর উপরের অংশে গুঁজে রাখে।

সে এবার সামনের দিকে তাকিয়ে ইবরাহিমের সৈন্যবাহিনীকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, রণহস্তির দলকে সামনে নেতৃত্ব দিতে দেখে। বেশিরভাগই মনে হয় দুই মানুষ পরিমাণ উঁচু আর তাদের একপাশে প্রসারিত হয়ে অংশত আবৃত ইস্পাতের বর্ম সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে। বাঁকান তরবারির সারি- প্রতিটা ছয় ফিট লম্বা- লাল রঙ করা শুড়ের সাথে বাঁধা। তাদের পরিচালনাকারীরা হাতে ধরা লম্বা কাঠের লাঠিতে ফুঁ দিয়ে হাতিগুলোকে আরও দ্রুত অগ্রসর হবার তাগিদ দেয়। হাওদায় হাতির পিঠে স্থাপিত অনেকটা দূর্গের মতো দেখতে একটা স্থাপনা অবস্থানরত তীরন্দাজের দল ইতিমধ্যে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তীরগুলো লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে ভূপাতিত হয়। তারা এখনও পাল্লার বাইরে অবস্থান করছে।

বাবর আশা করে তার লোকেরা তার আদেশ মান্য করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারার মতো দূরত্ব সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তীর নিক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু তার আগে ইবরাহিমের লোকেরা আর পশুর পাল বাবরের পশ্চিম থেকে নিয়ে আসা নতুন অস্ত্রের প্রতিক্রিয়া অনুভব করবে: কামান। বাবর আলমগীর মাথার উপরে তুলে দু’বার আন্দোলিত করে- আলী কুলী আর তার লোকদের গোলা বর্ষণ শুরু করার জন্য এটা একটা পূর্বনির্ধারিত সংকেত। সে স্পর্শ-রন্ধের বারুদে গোলন্দাজ সেনাদের একজনকে ঝুঁকে জ্বলন্ত শলাকা স্পর্শ করাতে দেখে। তারপরে একটা ঝলক, একটা গর্জন এবং কামানের নল থেকে সাদা আলো বের হয়ে এসে কামানের গোলাটা শক্ত অবস্থানের দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাকী কামানগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে আলোর ঝলক দেখা যায় এবং মাটির তৈরি পুরো প্রতিবন্ধকতা মাঝ দিয়ে ধোয়ার একটা মেঘ ভাসতে থাকে।

 বাবর ধোয়ার মেঘের মাঝ দিয়ে সামনের সারির একটা হাতিকে হাওদাসহ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে এবং এর আরোহীরা মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ে। তারপরে আহত প্রাণীটা টলোমলো করতে করতে আবার সটান উঠে ঘুরে দাঁড়ায়, শুড়টা ব্যাথার তূরীর মতো শূন্যে তুলে ধরে এবং পাশের হাতির দিকে উন্মত্তের মতো ছুটে গিয়ে তাকে নিয়ে পুনরায় মাটিতে আছড়ে পড়ে। সামনের আহত পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসছে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় বিশাল মাথাটা যন্ত্রণায় আছড়াতে থাকলে এর শুড়ের সাথে আটকানো তরবারি। পেছন থেকে এগিয়ে আসা আরেকটা হাতিকে আঘাত করলে ভয়ে আর ব্যাথায় সেটা দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু যদিও আগুয়ান সারির প্রস্থ বরাবর এমন ঘটনা ঘটতে থাকে কিন্তু সুলতান ইবরাহিমের সেনাবাহিনী সামনের দিকে চাপ প্রয়োগ করা অব্যাহত রাখে।

বাবর সহসা মাস্কেটের গুলিবর্ষণের মড়মড় আওয়াজ শুনতে পায়। তার আরও শত্রু ভূমিশয্যা নেয়। এবার তার তীরন্দাজের দল তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কেউ কেউ মাটির দেয়ালের আড়াল ছেড়ে লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এগিয়ে যায়- হাতির সাদা রঙ করা কানের পেছনে বসে থাকা চালকগুলো তাদের নিশানা। ইবরাহিমের সামনের সারি এবার এলোমেলো হয়ে পড়ে। ভয়ে আরও অনেক হাতি শুড় তুলে নিয়ে পেছনের দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে এবং পেছনে থাকা লোকগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের থামিয়ে দিয়ে আরও আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং তারা পালাতে থাকলে তাদের বিশাল পায়ের চাপে নিজেদের লোকেরাই অসহায়ের মতো পিষে যেতে থাকে।

বাবর আরও অশ্বারোহী তীরন্দাজদের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে দ্রুত পলায়নপর শত্রুদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়। সে যখন এই আদেশ দিচ্ছে। তখন তার খুব কাছেই সে একটা বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পায় এবং তার চারপাশে ধাতুর উত্তপ্ত টুকরো এসে আছড়ে পড়ে আর তার মুখে নরম কিছু একটা আঘাত করে। বিভ্রান্ত আর আংশিক বধির অবস্থায়, সে বুঝতে পারে না ঠিক কি ঘটেছে। তারপরে সে টের পায় তার একটা কামান বিস্ফোরিত হয়েছে এবং আলী কুলী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। সে গালে হাত দিয়ে টের পায় সেটা ওস্তাদ গোলন্দাজের মাংসের টুকরো। পৃথিবীতে না, আলী কুলী বেহেশতে তার প্রাপ্য গ্রহণ করবে। কিন্তু সে তার কাজ ভালোমতোই সম্পন্ন করে গিয়েছে। মওকা বুঝে সুলতান ইবরাহিমের সৈন্যরা আরো আরো বেশি সংখ্যায় পালাতে শুরু করেছে। যাদের ভেতরে খালি পায়ের কোমরে কেবল একটা নেংটি পরিহিত পদাতিকদের সংখ্যাই বেশি। বর্শা ছাড়া আক্রমণের বা আত্মরক্ষার কোনো অবলম্বন তাদের নেই।

নিজেকে সুস্থির করে নিয়ে, বাবর তার সেরা অশ্বারোহীদের এবার অগ্রসর হবার ইঙ্গিত করে এবং নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে ধূলো আর ধোঁয়ার মেঘের মাঝে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আধ মাইল দূরে আতঙ্কিত পলায়নপর লোকদের কোলাহলপূর্ণ জটলার দিকে ধেয়ে যায়।

 ইবরাহিমের বাহিনীর কিছু অংশ অনেক বেশি প্রশিক্ষিত আর তারা নিজেদের রক্ষণাত্মক অবস্থানে সন্নিবেশিত করে সত্যিকারের বীরের মতো আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। বাবর একটা টিলার উপরে এমনই একটা অশ্বারোহী দলকে সংখ্যায় শতাধিক হবে। সবার মাথায় সোনালী পাগড়ি- সাফল্যের সাথে সব আক্রমণ প্রতিহত করতে দেখে।

“ইবরাহিমের দেহরক্ষী বাহিনী। তার এক সৈন্য চিৎকার করে বলে। বাবর এবার সরাসরি তাদের মাঝে লম্বা এক যোদ্ধার দিকে এগিয়ে যায়। যাকে এই ক্ষুদে দলটার নেতৃত্ব দানকারী সেনাপতি বলে প্রতিয়মান হয়। শেষমুহূর্তে বাম পাশে সরে গিয়ে বাবর তাকে পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে দিয়ে, তার ডান হাত লক্ষ্য করে তরবারি চালায়। কিন্তু সোনালী পাগড়ি পরিহিত সেনাপতি সময়মতো ঢাল তুলে তার আঘাত প্রতিহত করে এবং অন্য হাতে ধরা তরবারি দিয়ে বাবরের কালো ঘোড়ার পাছায় একটা মোক্ষম কোপ বসিয়ে দেয়। ঘোড়াটা যন্ত্রণায় পিছনে সরে আসে এবং বাবরকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করার ফাঁকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে পায় শত্রু সেনাপতি নিজের সাদা ঘোড়াটাকে এগিয়ে যেতে ইশারা করে সামনে ঝুঁকে রয়েছে বাবরকে শেষ করে দেবার অভিপ্রায়ে।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবর অনড় দাঁড়িয়ে থাকে তারপরে লাফিয়ে একপাশে সরে যায় এবং একই সাথে তীব্র বেগে আলমগীর দিয়ে কোপ বসানোর ভঙ্গিতে আঘাত করে। সাদা ঘোড়ার গলার বাম পাশে তার তরবারি আড়াআড়িভাবে আঘাত করে এবং তারপরে তার আরোহীর উরুতে গভীর একটা ক্ষত তৈরি করে। বোঝাই যায় লোকটা আদতেই দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং আঘাতের ভয়াবহতা সত্ত্বেও সে জিনের উপরে অধিষ্ঠিত থাকে। ঘোড়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়- সাদা চামড়া এখন লাল রক্তে ভিজে উঠেছে- বাবরকে আরো একবার আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসে।

এই দফা, শত্রু সেনাপতি তাকে কবন্ধ করার অভিপ্রায়ে তরবারি চালাতে সে নিচু হয়ে আঘাতটা এড়িয়ে যায় এবং আলমগীর দিয়ে ধাবমান ঘোড়ার সামনের পায়ের শিরা কেটে দিতে চেষ্টা করে। সে তার নিশানা ভেদ করতে সমর্থ হয় এবং ঘোড়াটা তার আরোহীর উপরে আছড়ে পড়লে বেচারার মুঠি থেকে তরবারিটা ছুটে যায়। লোকটা তার তরবারির কাছে পৌঁছাবার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকলে বাবর এগিয়ে এসে তার কব্জিতে পা রেখে আলমগীরের ডগা তার গলায় স্পর্শ করে। “আত্মসমর্পণ করো। তোমার সাহসিকতার জন্যই তুমি বেঁচে থাকার দাবিদার।” সে তার সাথে কথা বলার সময়ে বাবরের আরো লোক এসে তার পাশে দাঁড়ায়। সোনালী পাগড়ি পরিহিত যোদ্ধাদের অধিকাংশই হয় তাদের হাতে মারা পড়েছে। কিংবা পালিয়েছে। প্রতিরোধের চেষ্টা করা বৃথা বুঝতে পেরে, লোকটা চুপচাপ শুয়ে থাকে। “আমি কথা দিচ্ছি আমার তরফ থেকে আর যুদ্ধের কোনো প্রয়াস নেয়া হবে না।” সে বলে।

“তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো… তুমি আর তোমার লোকেরা এতো মরিয়া হয়ে কি রক্ষা করতে চেষ্টা করছিলে?”

“সুলতাম ইবরাহিম লোদির মৃতদেহ। টিলার মাথায় রাখা আছে। আপনার নতুন অস্ত্রের ছোবলে তিনি শুরুতেই মারাত্মকভাবে আহত হন। সাহসিকতার কোনো মূল্যই নেই এর সামনে।”

 “কোনো অস্ত্রই সেটা যে নিশানা করছে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হতে পারে না।” তারা যখন কথা বলছে সেনাপতির সাদা ঘোড়াটা তখন যন্ত্রণায় ঝটফট করতে থাকে আর আর্তনাদ করে। গলার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছে। সামনের পায়ে বাবরের আঘাতের ফলে সেখানকার শিরা কেটে যেতে বেচারা সামনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। এখন মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকলে এবং কথা বলটা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠতে- সম্ভবত নিজের ঘোড়ার নিচে চাপা পড়ার ফল সেনাপতি কোনোমতে বলে, “আমাকে আমার ঘোড়াটার যন্ত্রণা লাঘব করার অনুমতি দিন। আমার সাথে অনেক যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে। অনেক শান্তভাবে সে মৃত্যুকে বরণ করবে যদি সেটা আমার কাছ থেকে আসে।”

 বাবর তার লোকদের একজনকে সেনাপতির তরবারি ফিরিয়ে দিতে বলে। সেনাপতি- উরুর ক্ষতের কারণে হাঁটতে তার নিজেরই কষ্ট হয় আর শ্বাস নিতে অপারগতার মাঝে- ঘোড়াটার কাছে এগিয়ে যায়। সোনার কারুকাজ করা চামড়ার লাগাম ধরে সে ঘোড়াটার নাকে আলতো করে চাপড় দেয়। মাথাটা আঁকড়ে ধরে এবং কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দেয়। তারপরে দ্রুত তরবারিটা গলার উপরে আড়াআড়িভাবে রেখে সে এক পোচে শ্বাসনালী আর ধমনী কেটে দিলে গলগল করে আরও রক্ত বের হয়ে আসে। ঘোড়াটা সাথে সাথে নেতিয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণের ভিতরেই নিথর হয়ে যায়। গলার কাটা জায়গা থেকে রক্ত বের হয়ে এসে ধূলোয় জমতে থাকে। অবশ্য সেনাপতির কাজ তখনও শেষ হয়নি। সে তার হাতের তরবারি দিয়ে এবার নিজের পেট চিরে দেয়। “আমার ঘোড়ার চেয়ে পঙ্গু অবস্থায় আমি বেঁচে থাকতে চাই না।”

“আল্লাহতালা তোমার বেহেশত নসীব করুন।”

“আমিও সেই দোয়াই করছি। কিন্তু মনে রাখবে হিন্দুস্তানকে পদানত করতে হলে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি সাহসী লোকদের পরাভূত করতে হবে।”

তার গলায় রক্তের বুদবুদের মাঝে শেষ কথাগুলো অস্পষ্ট শোনা যায়। সেও মারা যায়। তার দেহটা বহুদিনের সঙ্গী ঘোড়াটার পাশে এলিয়ে পড়ে থাকে এবং সোনালী পাগড়ি পরিহিত মাথাটা রক্ত রঞ্জিত মাটিতে নুইয়ে আসে।

 “সুলতান, যুদ্ধে আপনার জয় হয়েছে।”

 নিশানবাহক কর্চির কথাগুলো বাবরকে তার সামনের দৃশ্যাবলীর সম্পর্কে গভীর ভাবনা থেকে বাস্তবে নিয়ে আসে। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্র নিরব হয়ে এসেছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে…সে বিজয়ী হয়েছে। “সব প্রশংসা আল্লাহ’র।” একটা স্বস্তির পরশ ঝড়ের মতো এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপরে নিজের জয়লাভের মাহাত্ব বুঝতে পেরে সে খুশিতে শূন্যে ঘুষি চালাবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ায়। সে- তৈমূরের মতো- দিল্লীতে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে পারবে…

নিজের মনকে আবার সে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বাবর তার চারপাশের অশ্বারোহীদের উদ্দেশ্যে নিজের প্রথম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। “আমরা দারুণ একটা কাজ করেছি। এখন আশা করি হুমায়ুন আর বাবুরীও ইবরাহিমের পলায়নপর সৈন্যদের আমূল বিনাশসাধন করে বা তাদের বন্দি করতে সক্ষম হবে। তাদের সুলতান মৃত হবার কারণে তারা সহসাই অন্য কারো নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে পারবে না। ইবরাহিম আর- এই সাহসী যোদ্ধাটাকে- যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করবে। আমি এবার শিবিরে ফিরে গিয়ে পিছু ধাওয়া করার ফলাফল জানবার জন্য অপেক্ষা করবো।”

 বিজয় এত দ্রুত অর্জিত হয়েছে যে তখনও দুপুরই হয়নি। বাবর যখন নিজের ঘোড়ার মুখ শিবিরের উদ্দেশ্যে ঘুরিয়ে নেয় এবং অতিকায় পাথরের টুকরোর মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা হাতির পাল আর তাদের পিঠের উপরের হাওদার ধবংসাবশেষ আর তাদের পতনের ফলে পিষ্ট হয়ে যাওয়া সৈন্যদের মৃতদেহের একটা দঙ্গলের ভিতর দিয়ে সে শিবিরে ফিরে চলে। গরমের মাঝে, তার লোকেরা ইতিমধ্যে নিজেদের আহত যযাদ্ধাদের কোনোমতে তৈরি করা খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিতে শুরু করেছে এবং পানি দিয়ে বা অন্য যেভাবে পারে তাদের শুশ্রূষা করার চেষ্টা করছে।

নিজের লাল তাঁবুর ভিতরে আরো একবার বাবর অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। বাবুরী আর হুমায়ূনের কি খবর? সে নিজের পোড়খাওয়া বন্ধুর চেয়ে তার অনভিজ্ঞ ছেলের জন্যই বেশি উদ্বিগ্ন বোধ করে। হুমায়ূনের যদিও এর আগে খণ্ড যুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু এবারই সে একটা বড় যুদ্ধে নিজে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডানপাশের সৈন্যদের নেতৃত্ব দেয়াটা তার জন্য একটা বিশাল আর অনুপম দায়িত্ববোধ।

বাবর দুশ্চিন্তা ভুলে থাকবার জন্য আহতদের দেখতে যায় এবং বিশেষ সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে এমন যোদ্ধাদের পুরস্কৃত করে এবং একই সাথে ইবরাহিমের শিবির থেকে জব্দ করা মালামালের বিবরণ শোনে। এখনই মনে হচ্ছে স্বর্ণমুদ্রা আর মূল্যবান পাথরের একটা বিশাল সংগ্রহ তার কুক্ষিগত হয়েছে।

আরো ছয় ঘণ্টা উৎকণ্ঠায় কাটার পরে একজন প্রহরী ভিতরে প্রবেশ করে ঘোষণা করে, “ শাহজাদা হুমায়ূনের নিশান আর ঝাণ্ডা বহনকারী সৈন্যবাহিনী শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছে।”

প্রহরীর কথা শেষ হবার আগেই পরিশ্রান্ত হুমায়ুন তাবুতে প্রবেশ করে, তার পিতার দিকে দৌড়ে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে। “আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা এখন হিন্দুস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় দশ মাইল ইবরাহিমের একটা বিশাল বাহিনীকে ধাওয়া করতে অবশেষে তারা নদীর তীরে একটা মাটির দূর্গে অবস্থান নিয়ে আমাদের মুখোমুখি হয়। এক ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে আমরা তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করি। আরো খানিকটা পশ্চিমে আমরা অভিজাতদের একটা দলের একসারি তাবু আবিষ্কার করি। মুষ্টিমেয় সংখ্যক প্রহরী বা পরিচারকের দল এর পাহারায় নিয়োজিত ছিলো। দেখতে ডাকাত বা লুটেরাদের মতো দেখতে কোনোভাবেই তাদের সৈন্যবাহিনীর সদস্য বলা যাবে না। এমন একদল ঠ্যাঙাড়ের মোকাবেলা করছে।

 “আক্রমণকারীদের আমরা হত্যা করলে তাঁবুর ভিতর থেকে আমার আম্মিজানের বয়সী একজন মহিলাকে দুধসাদা রঙের আর ঘিয়ে এবং সোনালী কাপড়ের শামিয়ানা টাঙানো একটা তাঁবুর ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখি। তার পরনে হিন্দুস্তানীরা যাকে শাড়ি বলে তেমন একটা পরিধেয়। সেটা উত্তম রেশমের তৈরি আর অসংখ্য মুক্তা আর অন্যান্য দামী পাথর তাতে সেলাই করে লাগানো রয়েছে। তিনি জানতে চান কে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং আমার নাম আর পরিচয় জানতে পেরে তিনি আমার কাছে তাকে নিয়ে যেতে বলেন। আমার কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন যে তিনি গোয়ালিয়রের, দিল্লীর দক্ষিণে অবস্থিত একটা সমৃদ্ধ রাজ্য, শাসকের মাতা। তিনি জানতে পেরেছেন ইবরাহিমের পক্ষে বীরের মতো লড়াই করে তার পুত্র মারা গিয়েছে।

“খবরটা শোনার পরে তিনি পালিয়ে না গিয়ে ছেলের অন্তেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য তার মৃতদেহ গ্রহণ করবেন বলে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা পৌত্তলিক, যারা বেদীর উপরে মৃতদেহ রেখে আগুনে পুড়িয়ে থাকে। তারপরে এক পলায়নপর সৈন্য তাদের শিবিরের পাশ দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় বলে যায় যে আমাদের সৈন্যরা বন্দিদের হত্যা করছে। তখন মুষ্টিমেয় সাহসী কয়েকজন সৈন্য ছাড়া বাকিরা তাকে সেখানে ফেলে পালিয়ে যায়। এবং দস্যুর দল- তার ভাষায় ডাকাত- যাদের আমরা পরাজিত করেছি সুযোগ টের পেয়ে তার শিবির আক্রমণ করে। তিনি নিজের জীবন আর সম্ভ্রমের চেয়েও তার ছয় মাসের নাতি, আর তার তরুণী মাতা, মৃত শাসকের প্রিয়তমা স্ত্রী, যে তার সাথেই শিবিরে অবস্থান করছিলো, তাদের নিরাপত্তার জন্য বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন।

 “আমি তাকে ভয় পেতে মানা করি। বলি যে আমরা সুসভ্য, সংস্কৃতিবান মানুষ, এই ডাকাতদের মতো বর্বর নই। কৃতজ্ঞতার অশ্রুবিন্দুতে তার মুখ সিক্ত হয়ে উঠে এবং তিনি আমাকে এটা দেন যা আমি আপনাকে আমাদের মহান বিজয়ের স্মারক হিসাবে এখন আপনাকে দিচ্ছি।” কথার মাঝেই হুমায়ূন বাবরের দিকে লাল চামড়ার একটা থলি এগিয়ে দেয় যেটার মুখ সোনালী জরির কাজ করা চামড়ার দিয়ে বাঁধা। বাবর মুখের বাঁধনটা খুলে এবং ভেতর থেকে একটা বেশ বড় পাথর বের করে আনে, পাথরটা তাঁবুর আধো-অন্ধকারের ভিতরে অপরূপ বিভায় ঝলসে উঠে। “আব্বাজান এটা একটা হীরক খণ্ড এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে গোলকুণ্ডার খনিতে কেবল এই পাথর পাওয়া যায়। আমি এতো বড় হীরকখণ্ড আগে দেখিনি। গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের রত্নাকর একবার এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিলো যে পুরো পৃথিবীর অর্ধদিনের ব্যয় নির্বাহ করা যাবে এটা দিয়ে। একে তারা বলে কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত…”

 বাবর পাথরটার বিশুদ্ধতা আর উজ্জ্বলতা দেখে মুগ্ধ হয়। একটা নক্ষত্রের মতো পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে আসছে। ঠিক যেনো ক্যানোপাস। বাবর ভাবে, নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে…তারপরেও পাথরটার তীব্র উজ্জ্বলতা দেখে একে বেহেশতের প্রস্তরখণ্ড বলে মনে হয়। পৃথিবীর মাটি খুঁড়ে এটা পাওয়া গেছে। বলে মনেই হয় না….

 “বাছা, তুমি আসলেই তোমার সৌভাগ্যবান নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছে। আশা করি আরো বহুদিন এই ধারা বজায় থাকবে-” বাবর তার কথার মাঝেই থেমে যায়। তাঁবুর উন্মুক্ত প্রবেশপথ দিয়ে সে দু’জন পরিচারককে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা খাঁটিয়া তার তাঁবুর দিকে বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। চারপাশ থেকে ভেসে আসা চিৎকার আর কোলাহলের শব্দে বোঝা যায় বাবুরীর বাহিনীও ফিরে এসেছে। কোথায় সে? বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার জন্য সে নিজে কেন আসছে না? তারপরে তার চাদরের নিচে থেকে ধূলোতে লুটাতে থাকা হাতের সোনার ভারী কাজ করা রুবি বসানো আংটিটার দিকে তার দৃষ্টি আটকে যায়। বহুবছর আগে বাবুরিকে। সে এই আংটিটা দিয়েছিলো তাদের একটা অভিযানে জয়লাভের স্মারক হিসাবে। পরিচারক দুজন আলতো করে খাঁটিয়াটা মাটিতে নামিয়ে রাখার সময় বাবর তাদের বাবুরীর পরিচারক বলে চিনতে পারে।

বাবর যান্ত্রিক ভঙ্গিতে ঝুঁকে এসে কম্পিত হাতে রক্তে ভেজা চাদরটা সরিয়ে দিয়ে তার সহযোদ্ধা ভাইয়ের দলামোচড়ানো দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

 “আমরা সামনে পেছনে চল্লিশটা করে হাতির বহর নিয়ে দিল্লীর দিকে পলায়নপর ইবরাহিমের একটা বিশাল সুশৃঙ্খল বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছিলোম। আমাদের প্রভু বাবুরী সাথে সাথে আক্রমণের আদেশ দেন। আর আমাদের দাপট সহ্য করতে না পেরে তারা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে মুখে আমূল প্রোথিত হয়ে ক্রুদ্ধ আর আহত একটা হাতি তাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিয়ে পিষে ফেলে।” পরিচারকদের একজন বলে।

বাবুরীর মুখটা কেবল প্রাণহীন আর ফ্যাকাশে হয়ে আছে- অক্ষত রয়েছে। তার তীব্র নীল চোখের পাতা ভোলা অবস্থায় তখনও বাবরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি তখনও ফুটে আছে। বাবর নিজের কান্না চাপবার কোনো চেষ্টাই করে না, খাঁটিয়ার উপরে ঝুঁকে সে তার আধখোলা চোখের পাতা বন্ধ করে দেয় এবং কপালে আলতো করে চুমু খায়। “বিদায়, ভাই আমার…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *