কামদীক্ষা
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৪ –গঠনের বছরগুলো। পরিচ্ছেদ ৩
এক অর্থে, নারীর কামদীক্ষা, পুরুষের মতোই, শুরু হয় তার আদি শৈশবে। মৌখিক, পায়ুগত, ও কামপ্রত্যঙ্গগত পর্ব থেকে বয়ঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত একটা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাগ্রহণ ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে। তবে তরুণীর কামের অভিজ্ঞতাগুলো শুধুই তার আগের যৌন কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ নয়; প্রায়ই সেগুলো অপ্রত্যাশিত ও বিসদৃশ; এবং সেগুলোর সব সময়ই থাকে নতুন ঘটনার প্রকৃতি, অতীতের সাথে ঘটায় বিচ্ছিন্নতা। যখন সে বাস্তবিকভাবে যেতে থাকে এসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে, তখন তরুণীর সমস্ত সমস্যা লাভ করে তীক্ষ্ণ ও জরুরি প্রতীকরূপ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহজেই কেটে যায় এ-সংকট, কিন্তু আছে নানা বিয়োগান্তক উদাহরণ যেগুলোতে পরিস্থিতির সমাধান ঘটে শুধু মৃত্যুতে উন্মত্ততায়। সব ক্ষেত্রেই এসময়ে তার মধ্যে জাগে যে-প্রতিক্রিয়া, তা দিয়ে তীব্রভাবে প্রভাবিত হয় নারীর ভবিষ্যৎ। নারীর প্রথম কামাভিজ্ঞতার চরম গুরুত্ব সম্পর্কে সব মনোচিকিৎসকই একমত : সেগুলোর প্রতিক্রিয়া অনুভূত হয় নারীর বাকি জীবন ভরে।
বিবেচ্য পরিস্থিতিটি—জৈবিক, সামাজিক, ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে–গভীরভাবে ভিন্ন। পুরুষ ও নারীর বেলা। পুরুষের জন্যে শৈশব কাম থেকে প্রাপ্তবয়স্কতায় উত্তরণ আপেক্ষিকভাবে সহজ:এতে কামসুখ হয়বস্তু-আশ্রিত, কেননা কামনা নিজের সীমার মধ্যে বাস্তবায়িত না করে চালনা করা হয় আরেকটি ব্যক্তির দিকে। লিঙ্গের দাঁড়ানো হচ্ছে এ-প্রয়োজনের অভিব্যক্তি; শিশ্ন নিয়ে, হাত, মুখ, তার সারা শরীর নিয়ে পুরুষ এগোয় তার সঙ্গিনীর দিকে, তবে সে নিজে থাকে এ-কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে, সব কিছু। মিলিয়ে সে থাকে কর্তা, এর বিপরীতে থাকে কর্মগুলো, যেগুলোকে সে উপলব্ধি করে এবং যে-করণগুলোকে সে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে; সে নিজের স্বাধীনতা না হারিয়ে নিজেকে প্রক্ষেপ করে অপরের দিকে তার কাছে নারীর দেহ একটি শিকার, এবং এটির মাধ্যমে সে প্রবেশাধিকার পায় তার কাম্য গুণাবলিতে, যেমন পায়প্রতিটি বস্তুতে। একথা সত্য যে সে নিজের জন্যে বাস্তবিকভাবে সফল হয় না ওগুলো। অধিকার করতে, তবে অন্তত সে ওগুলোকে আলিঙ্গন করে। প্রণয়স্পর্শ, চুমমা বোঝায় একটা আংশিক পরীক্ষা; তবে এ-পরীক্ষা নিজেই এক ধরনের উদ্দীপক ও আনন্দ। সঙ্গমের কাজটি সম্পূর্ণতা লাভ করে কামপুলকে, যা সঙ্গমের স্বাভাবিক পরিণতি। সঙ্গমের আছে এক নির্দিষ্ট জৈবিক পরিণতি ও লক্ষ্য; বীর্যপাতের ফলে পুরুষ মুক্তি পায় কিছু অস্বস্তিকর নিঃসরণ থেকে; কামোত্তেজনার পর সে লাভ করে সম্পূর্ণ উপশম, যাতে সব সময়ই থাকে চরম সুখ। একথা সত্য যে এ-সুখই একমাত্র লক্ষ্যবস্তু নয়; প্রায়ই এর পর থাকে হতাশা : প্রয়োজনটা মিটে গেছে, যদিও পুরুষটি সব দিকে তৃপ্তি পায় নি। যা-ই ঘটুক না কেননা, একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম সম্পন্ন হয়েছে। এবং পুরুষটির দেহ টিকিয়ে রেখেছে তার সংহতি : প্রজাতির প্রতি তার দায়িত্ব পালনের সাথে মিলেছে তার ব্যক্তিগত সুখ।
নারীর কাম আরো অনেক বেশি জটিল, এবং এটা প্রতিফলিত করে নারীর পরিস্থিতির জটিলতা। আমরা দেখেছি ব্যক্তিগত জীবনে প্রজাতির শক্তিশালী প্রবর্তনাগুলো সুসমঞ্জস করার বদলে নারী হচ্ছে তার প্রজাতির শিকার, এবং প্রজাতির স্বার্থগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া হয়েছে ব্যক্তি হিশেবে নারীর স্বার্থগুলো থেকে। এবিপরীতার্থকতা চূড়ান্তে পৌছে মনুষ্য নারীর মধ্যে; এর অভিব্যক্তি ঘটে, একদিকে, দুটি প্রত্যঙ্গের : ভগাঙ্কুর ও যোনির বৈপরীত্যের মধ্যে। শৈশবে আগেরটি হচ্ছে নারীর কামানুভূতির কেন্দ্র। যদিও কিছু মনোচিকিৎসক মনে করেন যে কিছু কিছু ছোটো মেয়েও যোনীয় স্পর্শকাতরতা অনুভব করে, তবে এটা বিতর্কের বিষয়, তা যা-ই হোক, এর গুরুত্ব নিতান্তই গৌণ। ভগাঙ্কুরীয় সংশ্রয় অপরিবর্তিত থাকে প্রাপ্তবয়স্ক নারীতে, এবং নারী সারাজীবন রক্ষা করে তার এ-কামস্বাধীনতা; ভগাঙ্কুরীয় পুলক, পুরুষের পুলকের মতোই, এক ধরনের স্ফীতিহ্রাসকরণ, যা অর্জিত হয় কিছুটা যান্ত্রিকভাবে; তবে এটা স্বাভাবিক সঙ্গমের সাথে নিতান্তই পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত, এবং সন্তান জন্মদানে এর কোনো ভূমিকা নেই।
নারীকে বিদ্ধ ও উর্বর করা হয় যোনি দিয়ে, আর পুরুষের মধ্যবর্তিতায়ই যোনি হয়ে ওঠে একটি কামকেন্দ্র, এবং এটা সব সময়ই এক ধরনের বলাকার। আগের দিনে একটা বাস্তবিক বা ছদ্মধর্ষণেরমাধ্যমে শিশুকে ছিনিয়ে নেয়া হতো তার শৈশবের জগত থেকে এবং ছুঁড়ে দেয়া হতো স্ত্রীর জীবনে একটা হিংস্র কাজের মধ্য দিয়েই বালিকাকে পরিণত করা হয় নারীতে : আমরা আজো বলি বালিকার কুমারীত্ব নেয়ার কথা, তার ফুল ‘ছিড়ে নেয়া’র কথা, বা তার কুমারীত্ব ‘ভাঙা’র কথা। এ-সতীত্বমোচন কোনো ধারাবাহিক বিবর্তনের ফলে ধীরেধীরে অর্জিত পরিণতি নয়, এটা হচ্ছে অতীতের সাথে হঠাৎ সম্পর্কচ্ছেদন, একটি নতুন চক্রের সূচনা। এরপর থেকে কামসুখ লাভ ঘটে যোনির দেয়ালের সংকোচনের ফলে; এ-সংকোচন কি কোনো যথাযথ ও নির্দিষ্ট কামপুলক ঘটায়? এটা এখনো বিতর্কিত বিষয়। শরীরসংস্থানগত উপাত্তগুলো অস্পষ্ট। কিন্সে রিপোর্টে ব্যাপারটি নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে :
বিপুল পরিমাণে শরীরসংস্থানগত ও নিদানিক প্রমাণ রয়েছে যে যোনির অভ্যন্তর ভাগের বেশি অংশই স্নায়ুহীন। যোনির অভ্যন্তর ভাগে বেশ পরিমাণে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব অনুভূতিনাশক ছাড়াই। যোনির ভেতরে শুধু অগ্ৰদেয়ালের এক এলাকায়, ভগাঙ্কুরের মূলের সন্নিকটস্থলে স্নায়ু দেখা যায়।
তবে, ওই স্নায়ুরহিত অঞ্চলে উদ্দীপনার অতিরিক্ত,
নারী যোনিতে কোনো বস্তুর প্রবেশ টের পেতে পারে, বিশেষ করে যদি যোনির পেশিগুলো কষানো হয়; তবে এতে যে-তৃপ্তি পাওয়া যায়, তা সম্ভবত যতোখানি যৌনস্নায়ুর উদ্দীপনার সঙ্গে জড়িত তার থেকে বেশি সম্পর্কিত পেশির আততির সঙ্গে
তবু কোনো সন্দেহ নেই যে যোনীয় সুখের অস্তিত্ব আছে; এবং যোনীয় হস্তমৈথুন, সেদিক থেকে দেখতে গেলে প্রাপ্তবয়স্ক নারীতে–কিন্সে যা নির্দেশ করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি ঘটে। তবে যা নিশ্চিত, তা হচ্ছে যোনীয় প্রতিক্রিয়া খুবই জটিল জিনিশ, যাকে বলা যেতে পারে মনোশারীরতাত্ত্বিক, কেননা এতে শুধু সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রই জড়িয়ে পড়ে না, এটা নির্ভর করে ব্যক্তিটির সমগ্র অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির ওপরও : এটা নারীর কাছে দাবি করে তার সর্বস্ব।
প্রথম সঙ্গমের ফলে সূচিত হয় যে-নতুন কামচক্র, সেটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে দরকার পড়ে স্নায়ুতন্ত্রে এক ধরনের মন্তাজ বা পুনর্বিন্যাস, এমন একটি বিন্যাস যার রূপরেখা আগে বিশদ করা হয় নি, যার ভেতরে ভগাঙ্কুরীয় দেহতন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত; এটা ঘটতে কিছুটা সময় নেয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে এটা কখনোই সফলভাবে সাধিত হয় না। এটা চমকপ্রদ যে নারীর ভেতরে আছে দুটি সংশ্রয়, এগুলোর একটি স্থায়িত্ব দেয় কৈশোরিক স্বাধীনতাকে, আরেকটি নারীকে অর্পণ করে পুরুষ ও সন্তানধারণের কাছে। স্বাভাবিক যৌনকর্ম তাই নারীকে করে তোলে পুরুষ ও তার প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল। পুরুষই–যেমন ঘটে অধিকাংশ প্রাণীতে–নেয় আক্রমণাত্মক ভূমিকা, নারী ধরা দেয় তার আলিঙ্গনে। সাধারণত, নারীকে যে-কোন সময়ই পুরুষ সঙ্গমের জন্যে ব্যবহার করতে পারে, সেখানে পুরুষ নারীর সাথে শুধু তখনই সঙ্গম করতে পারে যখন তার লিঙ্গ থাকে দাঁড়ানো অবস্থায়। শুধু যোনিসংকোচনের বেলা ছাড়া, যখন নারী সতীচ্ছদের দ্বারা রুদ্ধ থাকার থেকেও দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ থাকে, নারীর অনিচ্ছাকে পরাভূত করা যায়; এবং এমনকিযোনিসংকোচনের সময়ও এমন কিছু উপায় আছে, যা দিয়ে পুরুষ নিজের পেশিশক্তির বলে নারীর শরীরের ওপর নিজের কামের উপশম ঘটাতে পারে। যেহেতু সে বস্তু, তাই তার দিক থেকে কোনো জাড্য তার স্বাভাবিক ভূমিকাকে বিশেষ প্রভাবিত করে না : বহু পুরুষ ভাবেই না যে তারা যে-নারীদের সাথে শোয় তারা সঙ্গম করতে চায়, না কি নিতান্তই নিজেদের সঙ্গমে সমর্পণ করে। এমনকি শবের সাথেও সঙ্গম সম্ভব। পুরুষের সম্মতি ছাড়া সঙ্গম হতে পারে না, এবং পুরুষের পরিতৃপ্তিই এর স্বাভাবিক সমাপ্তি। নারী কোনো সুখ না পেয়েও গর্ভবতী হতে পারে। তবু তার পক্ষে গর্ভবতী হওয়া নির্দেশ করে কামপ্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি; এর বিপরীতে, প্রজাতির প্রতি তার দায়িত্ব পালন শুরু হয় এখানেই : এটা ধীরেধীরে ও যন্ত্রণাকরভাবে পূর্ণতা লাভ করে গর্ভধারণ, সন্তানপ্রসব, ও স্তন্যদানের মধ্যে।
পুরুষ ও নারীতে ‘দেহসংস্থানগত নিয়তি’ তাই সুগভীরভাবে ভিন্ন, এবং তাদের নৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতেও কম ভিন্ন নয়। পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা নারীকে উত্সর্গ করেছে সতীত্বের কাছে; এবং কম-বেশি প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিয়েছে পুরুষের কামস্বাধীনতা, আর নারীকে আবদ্ধ করা হয়েছে বিবাহে। যৌনকর্মকে যদিও বিধানের দ্বারা পবিত্র বলে পৃথক করে রাখা হয় নি, তবু একটি সংস্কার বলে এটা নারীর জন্যে একটি দোষ, একটি পতন, একটি পরাজয়, একটি দুর্বলতা; নারীকে রক্ষা করতে হয় তার সতীত্ব, তার সম্মান; যদি সে ‘আত্মসমর্পণ করে’, যদি সে ‘পতিত হয়’, তাহলে তাকে তিরস্কার করা হয়; তার সম্ভোগকারীকে কিছুটা দোষী করা হলেও তাতে মিশে থাকে প্রশস্তিবোধ। আদিম কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত সব সময়ই সঙ্গমকে গণ্য করা হয়েছে একটি ‘সেবাদান’ বলে, যার জন্যে উপহার দিয়ে বা তার ভরণপোষণের অঙ্গীকার করে পুরুষ ধন্যবাদ জানায় নারীকে; কিন্তু সেবাদান হচ্ছে নিজেকে একটি প্রভুর কাছে দান করা; এ-সম্পর্কের মধ্যে কোনো পারস্পরিকতা নেই। বিয়ের প্রকৃতি, এবং তার সাথে বেশ্যাদের অস্তিত্ব থাকা, এর প্রমাণ : নারী নিজেকে দান করে, পুরুষ তাকে টাকা দেয় এবং তাকে ভোগ করে। কিছুই পুরুষকে প্রভুর ভূমিকা নিতে, নিকৃষ্ট প্রাণীদের ভোগ করতে নিষেধ করে না। দাসীদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক মেনে নেয়া হয়েছে সব সময়ই, আর সেখানে যদি কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী দেহ দান করে গাড়ির চালককে বা বাগানের মালিকে, তাহলে সে হয় শ্রেণীচ্যুত। লোকাচার সব সময়ই বর্বরভাবে জাতিবিদ্বেষী আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের পুরুষদের অনুমতি দিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গিনীদের সাথে শুতে, গৃহযুদ্ধের আগে যেমন তেমনি আজো, এবং তারা। প্রভুসুলভ স্পর্ধার সাথে এ-অধিকারটি ভোগ করে; কিন্তু দাসপ্রথার কালে যদি কোনো শ্বেতাঙ্গিনী দেহসম্পর্ক করতো কোনো কৃষ্ণকায় পুরুষের সাথে, তাহলে তাকে দেয়া হতো মৃত্যুদণ্ড, এবং আজ সম্ভবত তাকে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলোনো হবে।
একটি নারীর সাথে সে সঙ্গম করেছে, একথা বলার জন্যে পুরুষ বলে যে সে নারীটিকে ‘দখল’ করেছে, বা সে তাকে ‘পেয়েছে’; যে-নারী কোনো পুরুষকে জানে নি গ্রিকরা তাকে বলতো অপরাভূতা কুমারী; রোমানরা মেসালিনাকে বলতো ‘অপরাজিতা’ কেননা তার কোনো প্রেমিকই তাকে পুরো সুখ দেয় নি। তাই প্রেমিকের কাছে। প্রণয়কর্ম হচ্ছে জয়, বিজয়। পুরুষদের কামবিষয়ক শব্দসম্ভার নেয়া হয়েছে সামরিক পরিভাষা থেকে : প্রেমিকের আছে সৈনিকের তেজ, তার লিঙ্গ ধনুকের মতো টানটান, বীর্যপাত হচ্ছে ‘গুলি ছোঁড়া’; সে বলে আক্রমণ, হামলা, বিজয়ের কথা। তার যৌন উত্তেজনায় আছে বীরত্বের কিছুটা স্বাদগন্ধ। ‘প্রজননকর্মে,’ ল্য রাপর দুরিএ-তে বেন্দা লিখেছেন :
একজন মানুষ অধিকার করে আরেকজন মানুষকে, এটা একদিকে আরোপ করে একজন বিজয়ীর ধারণা, অন্যদিকে কোনো কিছু জয় করার ধারণা। বস্তুত, তাদের প্রেমের সম্পর্কের কথা বলার সময়চরম সভ্যরা বলে জয়, আক্রমণ, হামলা, অবরোধ, এবং প্রতিরোধ, পরাজয়, আত্মসমর্পণের কথা, তারা স্পষ্টভাবেই প্রেমের ধারণাটিকে রূপায়িত করে যুদ্ধের ধারণার আদলে। এ-কর্মটিতে একজন দূষিত করে আরেকজনকে, এবং এতে দূষণকারীকে ভূষিত করা হয় কিছুটা গৌরবে, এবং দূষিতকে কিছুটা অবমাননায়, এমনকি যখন সে সম্মতি দেয়।
এ-ভাষাশৈলি সূচনা করে একটি নতুন কিংবদন্তির : যথা, পুরুষটি নারীটির ওপর চাপিয়ে দেয় একটা কলুষ। বাস্তবিকপক্ষে, বীর্য বিষ্ঠাপ্রকৃতির নয়; ‘স্বপ্নদোষ’-এর কথা বলা হয়, কেননা এতে স্বাভাবিক উদ্দেশ্য সাধিত হয় না; কিন্তু কফি যদিও দাগ ফেলে হাল্কা-রঙের পোশাকে, তবু একে কেউ ময়লা বলে না, বলে না যে পাকস্থলিকে এটা ময়লা করবে। বরং, উল্টোভাবে, মনে করা হয় যে নারীই অশুচি, কেননা তার থেকে বেরোয় ‘নোংরা স্রাব’ এবং সে দূষিত করে পুরুষকে। যে কলুষিত করে, এমন একজন হওয়া একটা অত্যন্ত সন্দেহজনক শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষ তার বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত অবস্থান লাভ করে তার জৈবিকভাবে আক্রমণাত্মক ভূমিকার সঙ্গে নেতা বা প্রভু হিশেবে তার সামাজিক কর্মকাণ্ডকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার মধ্য দিয়ে; তার এ-সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যেই শারীরবৃত্তিক পার্থক্যগুলো লাভ করে সব তাৎপর্য। বিশ্বে পুরুষ যেহেতু শাসনকর্তা, সে মনে করে যে তার কামনাগুলোর হিংস্রতা হচ্ছে তার সার্বভৌমত্বের একটি লক্ষণ; অতিশয় কামশক্তিসম্পন্ন পুরুষকে মনে করা হয় শক্তিশালী, বীর্যবান–এ-অভিধাগুলো নির্দেশ করে সক্রিয়তা ও সীমাতিক্ৰমণতা। অন্য দিকে, নারী যেহেতু একটি বস্তু, তাই তাকে বর্ণনা করা হয় উষ্ণ বা শীতল বলে, এর অর্থ হচ্ছে সে কখনো অক্রিয় গুণাবলি ছাড়া আর কোনো গুণ প্রকাশ করবে না।
যে-পরিবেশে, যে-আবহাওয়ায় জেগে ওঠে নারীর কাম, তা তাই বেশ ভিন্ন তার থেকে, যাতে পরিবৃত থাকে বয়ঃসন্ধির পুরুষ। তাছাড়া, নারী যখন প্রথমবার মুখোমুখি হয় পুরুষের, তখন নারীর কামের মনোভাব থাকে খুবই জটিল। অনেক সময় যে মনে করা হয় কুমারী মেয়ে কামবাসনার সাথে অপরিচিত এবং তাই পুরুষকে জাগাতে হবে তার কামাবেগ, তা ঠিক নয়। এ-কিংবদন্তিটি আবার প্রকাশ করে ফেলে পুরুষের আধিপত্য করার নৈপুণ্যের সত্য, যার মধ্যে পুরুষ প্রকাশ করে যে নারী কোনো উপায়েই, এমনকি তার জন্যে আকুলতার মধ্যেও, স্বাধীন হবে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে বিপরীত লিঙ্গের সাথে সংস্পর্শই জাগায় প্রথম কামনা, এবং উল্টোভাবে কোনো কামনাপরায়ণ হাতের ছোঁয়া পাওয়ার অনেক আগে থেকেই অধিকাংশ তরুণী স্পর্শাদরের জন্যে বোধ করে উত্তেজিতভাবে আকুলতা।
সত্য হচ্ছে কুমারীর কামনা কোনো যথাযথ প্রয়োজন হিশেবে প্রকাশিত হয় না : কুমারী ঠিকমতো জানে না সে কী চায়। শৈশবের আক্রমণাত্মক কাম আজো টিকে আছে তার মধ্যে, তার প্রথম প্রণোদনাগুলো ছিলো পরিগ্রাহী, এবং সে এখনো চায় জড়িয়ে ধরতে, অধিকার করতে। কাম যেহেতু কোনো বিচ্ছিন্ন এলাকা নয়, এর ভেতরে চলতে থাকে প্রথম বয়সে ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্বপ্ন ও আনন্দগুলো; উভয়লিঙ্গের শিশুকিশোেররাই পছন্দ করে মসৃণ, মাখনের মতে, সাটিনের মতে, রসালো, নমনীয় স্থিতিস্থাপক জিনিশ : ভেঙে না পড়ে বা বদলে না গিয়ে চাপে যা নমিত হয়, চোখের সামনে বা আঙুলে নিয়ে যা গলে পড়ে। পুরুষের মতো নারীও সুখ পায় বালিয়াড়ির কোমল উষ্ণতায়, যা কখনো কখনো দেখায় স্তনের মতে, সুখ পায় রেশমের কোমল স্পর্শে, তুলতুলে পালকভরা লেপের কমনীয়তায়, ফুল বা ফলের ওপরের শ্বেতচূর্ণে; তরুণী সাধারণত ভালোবাসে অনুজ্জ্বল প্যাস্টল রঙ, টুল ও মসলিনের অস্বচ্ছতা। সে পছন্দ করে না কর্কশ বস্ত্র, কাঁকর, শিলাকর্ম, তিক্ত স্বাদ, এসিডের গন্ধ; তার ভাইয়ের মতোই যা সে প্রথম আদর করেছে, তা হচ্ছে তার। মায়ের শরীর। তার আত্মরতির মধ্যে, তার সমকামী অভিজ্ঞতার ভেতরে, স্পষ্ট হোক অস্পষ্ট হোক, সে কাজ করে কর্তারূপে এবং অধিকার করতে চায় কোনো নারীর দেহ। সে যখন মুখোমুখি হয় পুরুষের, তার হাতে ও তার ঠোটে সে কামনা বোধ করে একটি শিকারকে সক্রিয়ভাবে স্পর্শ করার। কিন্তু স্কুল পুরুষ, যার পেশি শক্ত, যার ত্বক প্রায়ই কর্কশ ও লোমশ, যার গন্ধ কটু, যার গঠনমোটা, তার কাছে কাম্য মনে হয় না, তার মনে আবেদন জাগায় না; তাকে এমনকি ঘৃণ্য মনে হয়।
যদি পরিগ্রাহী, অধিকারপ্রবণ, প্রবণতা বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়ে টিকে থাকে নারীর মধ্যে, তাহলে রেনি ভিভিয়ের মতো সে এগোবে সমকামের দিকে। বা সে শুধু সে-পুরুষদেরই বেছে নেবে, যাদের সে নারীদের মতো ব্যবহার করতে পারে : এটাই ঘটে রাশিলদের মশিয় ভিনাস-এর নায়িকার ক্ষেত্রে, যে নিজের জন্যে কেনে এক যুবককে; সে সংরক্তভাবে আদর করে যুবকটিকে, কিন্তু তার সতীত্বমোচন করতে দেয় যুবকটিকে। অনেক নারী আছে, যারা তেরো-চোদ্দো বছরের বালকদের, এমনকি শিশুদের, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে পছন্দ করে, এবং এড়িয়ে চলে বয়স্ক পুরুষদের। তবে আমরা দেখেছি যে অধিকাংশ নারীর মধ্যেই শৈশব থেকেই বিকশিত হয় অক্রিয় কাম : নারী পছন্দ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে, স্পর্শাদর পেতে, এবং বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির পর সে মাংস হতে চায় পুরুষের বাহুবন্ধনে; কর্তার ভূমিকা সাধারণত দেয়া হয় পুরুষকে; নারী তা জানে; তাকে বারবার বলা হয়েছে পুরুষের সুদর্শন হওয়ার কোনো দরকার নেই; পুরুষের মধ্যে বস্তুর জড় গুণাবলি খুঁজতে হবে, খুঁজতে হবে শক্তি ও পৌরুষ।
এভাবে নারী বিভক্ত হয়ে পড়ে নিজের বিরুদ্ধে; সে কামনা করে দৃঢ় আলিঙ্গন, যা তাকে পরিণত করবে শিউরে-ওঠা বস্তুতে, তবে পুরুষতা ও বুল এমন অসহ্য। নিরোধক, যা ক্ষুন্ন করে নারীকে। তার ত্বক ও তার হাত উভয় স্থানেই থাকে তার অনুভূতি, এবং এক এলাকার চাহিদা আংশিকভাবে অন্যটির চাহিদার বিরোধী। যতোটা সম্ভব সে আপোষ করে; সে একটি পৌরুষসম্পন্ন পুরুষের কাছে নিজেকে দান করে, তবে কাম্য বস্তু হওয়ার জন্যে পুরুষটিকে হতে হয় তরুণ ও আকর্ষণীয়; একটি সুদর্শন যুবকের মধ্যে সে পেতে পারে তার কাম্য সব আবেদন। পরমগীতে স্ত্রী ও স্বামীর আনন্দভোগের মধ্যে একটা প্রতিসাম্য আছে : নারীটি পুরুষটির মধ্যে তাই পায় পুরুষটি যা খোঁজে নারীটির মধ্যে। পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল, মূল্যবান রত্নরাজি, স্রোতস্বিনীগুলো, নক্ষত্ররাজি। কিন্তু নারীটির এসব সম্পদ অধিকারের উপায় নেই; তার দেহসংস্থান তাকে বাধ্য করে খোজার মতো এলোমেলো ও নপুংসক থাকতে : একটি প্রত্যঙ্গ যাতে মূর্ত হয়ে ওঠে অধিকারের ইচ্ছে, সেটির অভাবে নিষ্ফল হয়ে ওঠে অধিকারের ইচ্ছে। যাই হোক না কেননা, পুরুষ অক্রিয় ভূমিকা নিতে অস্বীকার করে। প্রায়ই পরিস্থিতি এমন হয় যে তরুণী ধরা দেয় এমন কোনো পুরুষের কাছে, যার আদর র্তাকে আলোড়িত করে, যদিও সে পুরুষটির দিকে তাকিয়ে বা তাকে স্পর্শাদর করে কোনো সুখ পায় না। নারীকে কামসুখ পেতে হয় তার ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্বতস্ফূর্ত উদ্বেলনের বিপক্ষে, আর সেখানে ছোঁয়া আর দেখার আনন্দের মধ্যেই পুরুষ পায় কামসুখ।
তবে এমনকি অক্রিয় কামের উপাদানগুলোও দ্ব্যর্থবোধক। স্পর্শের থেকে কিছুই বেশি দ্ব্যর্থবোধক নয়। বহু পুরুষ, যারা ঘৃণা না করেই নাড়াচাড়া করে সব ধরনের জিনিশ, তারাও উদ্ভিদ ও পশুর সংস্পর্শে আসতে ঘৃণা করে। নারীর শরীর রেশম বা মখমলের ছোঁয়ায় সুখে কেঁপে উঠতে পারে বা পারে ঘেন্নায় থরথর করে উঠতে : মনে পড়ছে আমার তরুণ বয়সের এক বান্ধবীর কথা, শুধু একটা পিচ দেখেই যার গায়ে। কাঁটা দিয়ে উঠতো। তার বিসঙ্গত পরিস্থিতির জন্যে এ-দ্ব্যর্থবোধ টিকে থাকে কুমারীর ভেতরে : যে-প্রত্যঙ্গে তার রূপান্তর ঘটবে, সেটি রুদ্ধ। যেখানে সঙ্গম ঘটবে, শুধু সেখানটিতে ছাড়া তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তার মাংসের অস্পষ্ট ও উত্তপ্ত ডাক। কুমারীর সক্রিয় কামপরিতৃপ্তির জন্যে কোনো প্রত্যঙ্গ নেই; এবং তার কোনো বাস্তবিক অভিজ্ঞতা নেই সেটির সাথে, যেটি তাকে করে তোলে অক্রিয়।
তবু, এ-অক্রিয়তা শুধু জাড্য নয়। নারীকে কামোত্তেজিত হওয়ার জন্যে কিছু সদর্থক প্রপঞ্চ উপস্থিত থাকা দরকার : উত্তেজিত হতে হবে তার কিছু কামস্পর্শাতুর এলাকা, স্ফীত হয়ে পারে খাড়া হতে পারে এমন কিছু কে উত্তেজিত হতে হবে, ঘটতে হবে নিঃসরণ, বাড়তে হবে দেহতাপ, এবং দ্রুততর হতে হবে নাড়ির স্পন্দন ও নিশ্বাস। কামনা ও কামসুখ পুরুষের মতোই নারীর মধ্যেও চায় যে এতে ব্যয় হবে কিছুটা জীবনশক্তি; যদিও স্বভাবে গ্রহণধর্মী, তবু নারীর কামক্ষুধা এক অর্থে সক্রিয়, এটা প্রকাশ পায় স্নায়ুতন্ত্রের ও পেশির উত্তেজনায়। উদাসীন ও হতোদ্যম নারীরা সব সময়ই শীতল।
যদি জীবনশক্তি ব্যয় হয়ে যায় খেলাধুলোর মতো স্বেচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ডে, তাহলে তা কামের দিকে চালিত হয় না : স্ক্যান্ডিনেভীয় নারীরা স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী, এবং শীতল। তারাই অতিশয় ব্যগ্র নারী, যারা অবসন্নতাকে মিশ্রিত করে অগ্নির সাথে, ইতালি ও স্পেনের নারীদের মতো–অর্থাৎ, যাদের ব্যগ্র জীবনশক্তি মুক্তিলাভ করে শুধু দৈহিকভাবে। নিজেকে বস্তু করে তোলা, নিজেকে অক্রিয় করে তোলা খুবই ভিন্ন জিনিশ অক্রিয় বস্তু হওয়ার থেকে : প্রেমে পড়া নারী নিদ্রিতও নয় মৃতও নয়; তার ভেতরে ধেয়ে চলে এমন তরঙ্গ, যার ঘটতে থাকে নিরন্তর ভাটা ও জোয়ার : ভাটা তৈরি করে এমন যাদুমন্ত্র, যা সজীব রাখে কামনাকে। তবে উৎসাহ এবং প্রবৃত্তির কাছে সমর্পিত বেপরোয়া স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করা সহজ। পুরুষের কামনা হচ্ছে উত্তেজনা; এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে সারা শরীর জুড়ে, যার স্নায়ু ও পেশিগুলোউত্তেজিত; যে-সব আসন ও অঙ্গসঞ্চালন তার দেহটিকে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণে উদ্যোগী করে তোলে, সেগুলো এর বিপক্ষে চলে না, বরং প্রায়ই বাড়িয়ে চলে এগুলো। এর বিপরীতে, সমস্ত স্বেচ্ছা প্রবৃত্ত উদ্যোগ নারীর দেহকে বাধা দেয় অধিগত হওয়া থেকে; এজন্যেই নারী স্বতস্ফূর্তভাবে বাধা দেয় সে-ধরনের সঙ্গমে, যেগুলোতে তাকে নিতে হয় উদ্যোগ, হতে হয় উত্তেজিত; আসনের আকস্মিক এবং খুব বেশি বদল, সচেতনভাবে কিছু করার জন্যে কোনো আহ্বান–ভাষায়ই হোক বা আচরণেই হোকনষ্ট করে দেয় যাদুমন্ত্র। বেপরোয়া আকুলতার চাপে সৃষ্টি হতে পারে দাহ, সংকোচন, কাঠিন্য : কিছু নারী খামচায় বা কামড়ায়, তাদের দেহ হয়ে ওঠে শক্ত এবং ভরে ওঠে অনাভ্যাসিক শক্তিতে; তবে এ-প্রপঞ্চ শুধু তখনই দেখা দেয় যখন পৌছোননা হয়। কোনো আকস্মিক বিস্ফোরণের অবস্থায়, এবং এতে তখনই পৌছোনো হয়যখনযেমন শারীরিক তেমনি নৈতিক–কোনো সংকোচের অনুপস্থিতির ফলে জীবনের সমস্ত শক্তি জড়ো হয় যৌনকর্মে। এটা বোঝায় যে তরুণীর জন্যে শুধু নিজেকে দান করাই যথেষ্ট নয়; বশীভূত, নিস্তেজ, অন্য কোথাও পড়ে আছে তার মন, এমন অবস্থায় সে নিজেকেও তৃপ্ত করে না সঙ্গীটিকেও করে না। একটি রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ডের জন্যে তার দরকার সক্রিয় অংশগ্রহণ, কিন্তু সেটা সদর্থকভাবে তার কুমারীশরীরও চায় না তার মনও চায় না, কেননা এটি পরিবৃত হয়ে আছে ট্যাবু, নিষেধ, সংস্কার, ও অতিরিক্ত দাবি দ্বারা।
দেহসংস্থানগতভাবে ও প্রথাগতভাবে দীক্ষাদাতার ভূমিকা নেয়া যুবকের কাজ। একথা সত্য যে কুমার যুবকের প্রথম দয়িতাও তাকে দেয় দীক্ষা; তা সত্ত্বেও তার আছে কামগত স্বাধীনতা, যা স্পষ্টভাবে দেখা দেয় তার লিঙ্গের দাঁড়ানোতে; তার দয়িতা বাস্তবে শুধু যোগায় তার কাম্য বস্তুটি : একটি নারীদেহ। তরুণীর দরকার হয় একটি পুরুষ, যে তার দেহ প্রকাশ করবে তার কাছে : তরুণী এর থেকেও অনেক গভীরভাবে নির্ভরশীল। তার আদি অভিজ্ঞতাগুলো থেকেই পুরুষ সাধারণত সক্রিয়, নিম্পত্তিকারক। প্রেমিক বা স্বামী যে-ই হোক, সে-ই নারীকে নিয়ে যায় বিছানায়, যেখানে নারীর কাজ শুধু নিজেকে দান করা এবং পুরুষের কথামতো কাজ করা। যদিও সে মানসিকভাবে এ-আধিপত্য মেনে নেয়, তবু যখন বাস্তবিকভাবেই আসে আত্মসমর্পণের মুহূর্ত, তখন সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
প্রথমত, সে পরিহার করে সে-স্থিরদৃষ্টি, যা তাকে ঢেকে ফেলতে পারে। তার শালীনতাবোধ এক আংশিকভাবে অগভীর অর্জন, তবে এরও শেকড় গভীর। পুরুষ ও নারী সবাই তাদের মাংস নিয়ে লজ্জিত। অনেক পুরুষ আছে যারা বলে যে শিশ্নের দাঁড়ানো অবস্থায় ছাড়া তারা কোনো নারীর সামনে নগ্ন হওয়া সহ্য করতে পারে না; সত্যিই দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে এ-মাংস হয়ে ওঠে সক্রিয়তা, বীর্যশীলতা, যৌনাঙ্গটি আর জড় বস্তু থাকে না, বরং হাত বা মুখের মতো হয়ে ওঠে কর্তার এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক প্রকাশ। শালীনতাবোধ কেননা নারীদের থেকে অনেক কম বিহ্বল করে যুবকদের, এটা তার অন্যতম কারণ; তাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকার জন্যে তাদের দিকে কেউ স্থিরদৃষ্টিতে থাকায় না; এবং তাকালেও, কেউ তাদের বিচার করছে এ-ভয় তাদের বিশেষ থাকে না, কেননা তাদের দয়িতাদের তাদের কাছে জড় গুণ কামনা করে না : তাদের গূঢ়ৈষাগুলো বরং নির্ভর করে তাদের আশ্লেষের ক্ষমতা এবং তাদের প্রমোদ দেয়ার দক্ষতার ওপর; অন্তত তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে, সংঘর্ষে জয়লাভের চেষ্টা করতে পারে। নারী ইচ্ছে করলেই তার মাংসকে বদলাতে পারে না : যখন সে আর এটিকে গোপন করে না, তখন সে বিনা প্রতিরোধে এটি সমর্পণ করে; এমনকি সে যদি স্পর্শাদরের জন্য ব্যাকুলতাও বোধ করে, তবুও কেউ তাকে দেখছে ও স্পর্শ করছে, এ-ভাবনা তারসনে জাগিয়ে তোলে ঘৃণাভীতির শিহরণ; বিশেষ করে তার স্তনযুগল ও পাছা যেহেতু বিশেষভাবে মাংসল এলাকা; অনেক বয়স্ক নারী পোশাকপরা অবস্থায়ও তাদের কেউ পেছন থেকে দেখছে, এটা ঘৃণা করে; এবং এ থেকেই ধারণা করা সম্ভব প্রেমে নবদীক্ষিত কোনো তরুণীকে কতোটা বাধা পেরোতে হয় তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাতে দিতে। সন্দেহ নেই একজন ফ্রাইনের কোনো ভয় নেই পুরুষের স্থিরদৃষ্টির সামনে; সে নিজেকে নগ্ন করে উদ্ধত গর্বে–সে পরে আছে তার সৌন্দর্য। সে ফ্রাইনের সমতুল্য হলেও তরুণী মেয়ে কখনো এ-সম্পর্কে নিশ্চয়তা বোধ করে; সে তার দেহ নিয়ে উদ্ধত অহমিকাপোষণ করতে পারে না যদি না পুরুষের অনুমোদন দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করে তার যৌবনের অহমিকাকে। এবং এটাই তাকে ভরে দেয় ভয়ে; তার প্রেমিক স্থিরদৃষ্টির থেকেও অনেক বেশি দুর্ধর্ষ : সে একজন বিচারক। তার প্রেমিক তার কাছে তাকে প্রকাশ করবে সত্যিকারভাবে; যদিও তারা সংরক্তভাবে মোহিত থাকে তাদের প্রতিফলন দিয়ে, তবু প্রতিটি মেয়ে নিজের সম্বন্ধে পুরুষের রায়ের ব্যাপারে থাকে অনিশ্চিত; তাই সে চায় আলো নেভে যাওয়া, লুকোতে চায় বিছানার চাদরের নিচে। যখন সে আয়নায় দেখে প্রশংসা করে নিজের, তখন সে
শুধু স্বপ্ন দেখছে নিজেকে, স্বপ্ন দেখছে তার নিজেকে কেমন দেখাবে পুরুষের চোখে; এখন এসে উপস্থিত হয়েছে সে-চোখ; প্রতারণা অসম্ভব, লড়াই অসম্ভব; সিদ্ধান্ত নেবে একটি রহস্যপূর্ণ স্বাধীন সত্তা এবং কোনো পুনর্বিচার নেই। অনেক তরুণী অস্বস্তি বোধ করে তাদের বেশি মোটা গুল্ফ নিয়ে, খুব কৃশ বা খুব বেশি বড়ো আকারের স্তন নিয়ে, সরু উরু নিয়ে, জড়ল নিয়ে; এবং প্রায়ই তারা ভয়ে থাকে কোনো গুপ্ত ত্রুটিপূর্ণ গঠন নিয়ে। স্টেকেলের মতে সব তরুণীই ভরাট থাকে হাস্যকর ভীতিতে, তারা মনে করে তারা হয়তো দৈহিকভাবে অস্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, একজন মনে করতো নাভি হচ্ছে যৌনাঙ্গ এবং এটা বন্ধ বলে সে খুবই কষ্টে ছিলো। আরেকজন মনে করতো যে সে উভলিঙ্গ।
তাকে কেউ একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে, এটা এক বিপদ, তাকে কেউ প্রহার করছে, সেটা আরেক বিপদ। সাধারণভাবে নারীরা হিংস্রতার সাথে অপরিচিত, তারা পুরুষদের মতো শৈশব বা যৌবনের ধস্তাধস্তির ভেতর দিয়ে যায় না এবং এখন মেয়েটি বাহুতে আটকা পড়ে ভেসে গেছে এক শারীরিক লড়াইয়ে, যাতে পুরুষটি। অধিকতর শক্তিশালী। তার এখন আর স্বপ্ন দেখার, দেরি করার, কৌশল গ্রহণ করার স্বাধীনতা নেই : তরুণী এখন পুরুষের দখলে, তার নিয়ন্ত্রণে। এসব আলিঙ্গন, যা অনেকটা হাতে-হাতে ধস্তাধস্তির মতো, তাকে সন্ত্রস্ত করে, কেননা সে কখনো ধস্তাধস্তি করে নি। এটা বিরল ঘটনা নয় যে তরুণীর প্রথম অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে একটা প্রকৃত ধর্ষণ এবং পুরুষটি কাজ করে কদর্য বর্বরের মতো; পল্লী অঞ্চলে এবং যেখানেই আচারব্যবহার রুক্ষ, সেখানেই প্রায়ই ঘটে যে–আধা-রাজি আধা-বিদ্রোহী–চাষীকন্যা তার কুমারীত্ব হারায় কোনো খানাখন্দে, ভয়ে আর লজ্জায়। তা যা-ই হোক, সব সমাজে ও শ্রেণীতে যা প্রায়ই ঘটে, তা হচ্ছে কুমারী মেয়েটিকে হঠাৎ সম্ভোগ করে তার প্রেমিক, যে প্রধানত তার নিজের সুখের কথাই ভাবে, বা কোনো স্বামী, যে তার বৈবাহিক অধিকার সম্বন্ধে নিশ্চিত, যে তার স্ত্রীর প্রতিরোধে অপমান বোধ করে এবং সতীত্বমোচনের কাজটি কঠিন হলে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
অধিকন্তু, পুরুষটি যতোই শ্রদ্ধাশীল ও ভদ্র হোক না কেনো, প্রথম বিদ্ধকরণ সব সময়ই বলাৎকার। কারণ তরুণী চায় ঠোটে ও স্তনে স্পর্শাদর, বা কামনা করে তার জ্ঞাত বা কল্পিত কোনো বিশেষ কামসুখ, কিন্তু যা ঘটে, তা হচ্ছে পুরুষটির যৌনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে তরুণীকে এবং অনুপ্রবেশ করে সে-অঞ্চলে, যেখানে সেটিকে কামনা করা হয় নি। বহু লেখক বর্ণনা করেছেন কুমারী মেয়ের বেদনার্ত বিস্ময়, প্রেমিক বা স্বামীর বাহুর মধ্যে মুগ্ধ হয়ে পড়ে থেকে যে বিশ্বাস করে অবশেষে সে পূরণ করছে তার ইন্দ্রিয়সুখাবহ স্বপ্ন এবং তার গোপন যৌনাঙ্গে বোধ করে অভাবিত যন্ত্রণা : তার স্বপ্ন অন্তর্হিত হয়, তার শিহরণ ধীরেধীরে বিলীন হয়ে যায়, এবং প্রেম রূপ নেয় এক ধরনের অস্ত্রোপচারের।
এ-ক্ষেত্রে চ্ছদছিন্নকরণ ছিলো এক ধরনের ধর্ষণ। তবে স্বেচ্ছায় ঘটলেও এটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। আইসাডোরা ডাংকান আমার জীবন-এ বর্ণনা করেছেন তিনি। কতোটা উত্তেজনাগ্রস্ত হয়েছিলেন। একটি সুদর্শন অভিনেতার সাথে তার দেখা হয়, প্রথম দর্শনেই তিনি তার প্রেমে পড়েন এবং লাভ করেন আকুল প্রেমনিবেদন।
আমিও কামোত্তেজিত এবং বিহ্বল ছিলাম, যখন তাকে কাছে থেকে আরো কাছে চেপে ধরার অপ্রতিরোধ্য ব্যাকুলতা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে আমার মধ্যে, তারপর একরাতে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ও অসংযত আবেগে সে আমাকে সোফায় নিয়ে যায়। সন্ত্রস্ত তবে পরমানন্দিত এবং যন্ত্রণায় আর্তনাদের মধ্যে আমি দীক্ষিত হয়েছিলাম প্রেমের ক্রিয়ায়। স্বীকার করি যে আমার প্রথম অনুভূতি ছিলো ভয়াবহ বিভীষিকার ও অসহ্য ব্যথার, যেনো কেউ হঠাৎ তুলে নিয়েছে আমার কয়েকটি দাত; কিন্তু সে অত্যন্ত দরদ বোধ করছিলো দেখে আমি দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারি নি তা থেকে, যা প্রথমত ছিলো নিতান্তই অঙ্গচ্ছেদন ও পীড়ন… পরদিনও আমার শহিদ হওয়ার আর্তনাদ ও চোখের জলের মধ্যে তা চলতে থাকে, যা তখন আমার কাছে একটা যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। আমার মনে হয় যেনো আমাকে কেটে ছিঁড়ে ফেড়ে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।
অচিরেই তিনি উপভোগ করতে থাকেন, প্রথমে এ-প্রেমিকটির, পরে অন্যদের সাথে, সেই ভূরীয় আনন্দ, যা তিনি গীতিময়ভাবে বর্ণনা করেছেন।
তবে আগে যেমন ছিলো কুমারীর স্বপ্নঘোরের মধ্যে, তেমনি বাস্তবিক অভিজ্ঞতায় যন্ত্রণাটিই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নয় : বিদ্ধকরণের ঘটনাটি অনেক বেশি গুরুতর। সঙ্গমে পুরুষ ব্যবহার করে শুধু একটি বাহ্যিক প্রত্যঙ্গ, আর নারী তখন আক্রান্ত হয় তার গভীর মর্মমূলে। সন্দেহ নেই যে বহু যুবক নারীর গোপন আঁধারে উদ্বেগহীনভাবে প্রবেশ করতে পারে না, পুনরায় সে বোধ করে গুহা বা সমাধির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানোর বাল্যের ত্রাস, তার চোয়ালের, কাস্তে দিয়ে কাটার, ফাঁদের ভয়; তারা ভাবে স্ফীত শিশ্নটি আটকে যাবে শ্লেষ্মল খাপে। নারীর আর, একবার বিদ্ধ হওয়ার পর, এমন ভীতিবোধ থাকে না; তবে সে বোধ করে তার দেহে কেউ অনধিকার প্রবেশ করেছে।
স্বত্বাধিকারী তার জমির ওপর মালিকানা জ্ঞাপন করে, গৃহস্থ জ্ঞাপন করে তার বসতবাড়ির ওপর ‘অনধিকার প্রবেশ নিষেধ!’ তার সীমাতিক্ৰমণতার ব্যর্থতার হতাশা থেকে নারী বিশেষ করে তার নিজের জিনিশপত্র রক্ষা করার ব্যাপারে হয় খুবই ঈর্ষাকাতর; তার ঘর, বস্ত্রের আলমারি, তার বাক্সপত্র পবিত্র। এক বৃদ্ধা বেশ্যা একদা কলেৎকে বলেছিলো : ‘মাদাম, কোনো পুরুষ কখনো আমার ঘরে ঢোকে নি; পুরুষদের সাথে আমাকে যা করতে হয়, তার জন্যে প্যারিস বেশ বড়ো’। দেহটিকে না হলেও, সে একটি ছোটো জায়গা রেখেছে, যা অন্যদের জন্যে নিষিদ্ধ।
কিন্ত তরুণীর নিজের দেহটি ছাড়া নিজের বলতে আর কিছু নেই : এটা তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ; যে-পুরুষ তার ভেতরে ঢোকে সে এটি নিয়ে নেয় তার কাছে থেকে; সাধারণ ভাষারীতিটির সত্যতা প্রতিপন্ন হয়বাস্তব অভিজ্ঞতাটিতে। যে-অবমাননা সে আশঙ্কা করেছিলো, তা ঘটে গেছে : তাকে পরাভূত করা হয়েছে, জোর করে রাজি করানো হয়েছে, জয় করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রীলিঙ্গের মতোই, সঙ্গমের সময়নারী থাকে পুরুষটির নিচে। এর ফলে যে-হীনম্মন্যতাবোধ জন্মে, অ্যাডলার একে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করেছেন। শৈশব থেকেই শ্ৰেষ্ঠতা ও নিকৃষ্টতার ধারণাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ; গাছের অনেক ওপরে ওঠা কৃতিত্বের কাজ; স্বর্গ পৃথিবীর ওপরে, নরক নিচে; পড়া, পিছলে পড়া, হচ্ছে ব্যর্থ হওয়া, এবং ওপরে ওঠা হচ্ছে সাফল্য; কুস্তিতে জেতার জন্যে প্রতিপক্ষের কাঁধ ভূমিতে চেপে ধরে রাখতে হয়। নারীটি পড়েথাকে পরাজিতের ভঙ্গিতে; এর চেয়েও খারাপ হচ্ছে পুরুষটি এমনভাবে ওঠে নারীটির ওপরে যেভাবে সে লাগাম লাগিয়ে বলগা ধরে উঠতো কোনো পশুর ওপর। নারী সব সময় বোধ করে অক্রিয়তা : তাকে আদর করা হয়, তাকে বিদ্ধ করা হয়; তাকে রমণ করা হয়, আর সেখানে পুরুষ নিজেকে জ্ঞাপন করে সক্রিয়ভাবে। এটা সত্য, পুরুষের প্রত্যঙ্গটি কোনো রেখাঙ্কিত, স্বেচ্ছাচালিত পেশি নয়; এটা লাঙ্গলের ফালও নয় তলোয়ারও নয়, এটা শুধুই মাংস; তবুও, পুরুষ এতে সঞ্চালিত করে এমন গতিশীলতা, যা স্বতপ্রবৃত্ত; এটা সামনের দিকে যায় পেছনের দিকে যায়, থামে, আবার হয়ে ওঠে গতিশীল, তখন নারী একে গ্রহণ করে অনুগতভাবে। পুরুষটিই ঠিক করে কামে নেয়া হবে কোন আসন–বিশেষ করে নারীটি যদি এ-খেলায় নতুন হয় এবং সে-ই ঠিক করে কাজটির সময়কাল এবং পৌঁনপুনিকতা। নারীটি বোধ করে যে সে।একটি উপকরণ মাত্র; স্বাধীনতা পুরোপুরি অন্যজনের। একেই কাব্যিকভাবে বলা হয় নারী হচ্ছে বেহালা, আর পুরুষ হচ্ছে ছড়, যা স্পন্দিত করে নারীকে। ‘শৃঙ্গারে,’ বালজাক বলেছেন, ‘আত্মার কথা ছেড়ে দিলে, নারী হচ্ছে বীণা-যে তার গুপ্তকথা জানায় শুধু তাকে, যে জানে এটি কীভাবে বাজাতে হয়’। পুরুষ নারীকে সম্ভোগ করে, পুরুষ নারীকে সুখ দেয়, এ-শব্দগুলোই বোঝায় পারস্পরিকতার অভাব।
নারী পুরোপুরি প্রতিবুদ্ধ সে-সব প্রচলিত ধারণায়, যা পুরুষের সংরাগকে করে তোলে মহিমান্বিত এবং লজ্জাজনকভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য করে নারীর কামানুভূতির দাবি : নারীর অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করে এ-অপ্রতিসমতার ঘটনাটি। ভুললে চলবে না যে কিশোর ও কিশোরী তাদের দেহ সম্পর্কে সচেতন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতিতে : কিশোর তার কামনার মধ্যে একে গ্রহণ করে সহজে ও সগর্বে; কিশোরীর জন্যে, তার আত্মরতি সত্ত্বেও, এটা এক অদ্ভুত ও উদ্বেগজাগানো বোঝা। পুরুষের যৌনাঙ্গটি একটি আঙুলের মতো সরল ও পরিচ্ছন্ন; এটা স্পষ্ট দেখা যায় এবং প্রায়ই সগর্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এটা প্রদর্শন করা হয় সঙ্গীদের কাছে; কিন্তু নারীর যোনিটি এমনকি নারীর কাছেও রহস্যময়, এটা লুকোনো, শ্লেষ্মল, ও আর্দ্র প্রতিমাসে এটা থেকে রক্ত বেরোয়, এটা প্রায়ই গুমোট হয়ে থাকে দেহের তরল পদার্থে, এটির নিজেরই আছে একটা গোপন ও বিপজ্জনক জীবন। নারী এটির মধ্যে নিজেকে চিনতে পারে না, এবং এটাই অনেকাংশে ব্যাখ্যা করে কেনো নারী এটির কামনাকে নিজের। কামনা বলে বুঝতে পারে না। এসব দেখা দেয় ব্রিতকরভাবে। পুরুষ ‘শক্ত হয়’, কিন্তু নারী ‘ভিজে যায়’; এ-শব্দটিতেই ধরা আছে শৈশবের বিছানা ভেজানোর, প্রস্রাবের কাছে অপরাধ ও অনিচ্ছার মধ্যে ধরা দেয়ার স্মৃতি। পুরুষও একই রকম ঘেন্নাবোধ করে স্বপ্নদোষের প্রতি একটা তরল পদার্থ, প্রস্রাব হোক বা ধাতু হোক, নির্গত করা লজ্জাজনক নয় : এটা এক সক্রিয় কর্ম; কিন্তু তরল পদার্থটি যদি। অক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে, তখন তা লজ্জাজনক, কেননা শরীরটি তখন আর থাকে না মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রিত ও এক সচেতন কর্তার প্রকাশরূপ পেশি ও স্নায়ুসম্বলিত জীব, বরং সেটি হয়ে ওঠে জড়বস্তুতে গঠিত একটি পাত্র, একটি আধার, যা খামখেয়ালি যান্ত্রিক শক্তিরাশির ক্রীড়নক। যদি কোনো শরীরের ছিদ্র দিয়ে বেরোয় তরল পদার্থ যেমন তরল পদার্থ বেরোতে পারে একটা প্রাচীন দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে বা মৃতদেহ থেকেতখন মনে হয় যেনো এটি তরল পদার্থ নির্গত করছে না, বরং তরল হয়ে যাচ্ছে : এটা একটা বিকট পচন।
নারীর কামবাসনা হচ্ছে মলাস্কের কোমল ধপধপানো। পুরুষ যেখানে প্রবৃত্তিতাড়িত, নারী সেখানে অধৈর্য মাত্র; নারীর প্রত্যাশা অক্রিয় থেকেও হয়ে উঠতে পারে ব্য; পুরুষ ইগল ও বাজপাখির মতোঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের ওপর; নারী প্রতীক্ষায় পড়ে থাকে মাংসাশী উদ্ভিদের মতো, জলাভূমির মতো, যাতে গ্রস্ত হয় পতঙ্গ ও শিশুরা। নারী হচ্ছে শোষণ, চোষণ, উদ্ভিজ্জমৃত্তিকা, পিচ ও আঠা, এক অক্রিয়অন্তঃপ্রবাহ, ধীরেধীরে-সুকৌশলে প্রবেশকারী ও চটচটে : অন্তত অস্পষ্টভাবে নারী নিজেকে অনুভব করে এভাবেই। তাই তার ভেতরে পুরুষের অধীনতাকরণের অভিপ্রায়কে প্রতিরোধ করার ইচ্ছেই শুধু নেই, বিরোধ আছে তার নিজের ভেতরেও। তার শিক্ষা ও সমাজ তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে-ট্যাবু ও সংবাধ, তার সাথে অতিরিক্ত যুক্ত হয় কামানুভূতির অভিজ্ঞতা থেকে আগত বিরক্তি ও অস্বীকৃতি : এপ্রভাবগুলো পরস্পরকে এতো দূর বাড়িয়ে তোলে যে প্রথম সঙ্গমের পর প্রায়ই নারী তার কামনিয়তির বিরুদ্ধে অনেক বেশি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আগের থেকে।
পরিশেষে, আছে আরো একটি ব্যাপার, যা পুরুষকে দেয় একটি বৈরীবৈশিষ্ট্য এবং যৌনক্রিয়াকে করে তোলে এক ভয়ঙ্কর বিপদ : এটা হচ্ছে গর্ভধারণের ঝুঁকি। অবিবাহিত নারীর জন্যে একটি অবৈধ সন্তান এমন এক সামাজিক ও অর্থনীতিক প্রতিবন্ধকতা যে মেয়েরা যখন বুঝতে পারে তারা গর্ভবতী হয়ে পড়েছে, তখন তারা আত্মহত্যা করতে পারে, এবং কিছু তরুণী মা হত্যা করে তাদের নবজাতক শিশুদের। এমন বিশাল মাত্রার একটা বিপদ অনেক মেয়েকে বাধ্য করে লোকাচারের নির্দেশিত বিবাহপূর্ব সতীত্ব বজায় রাখার জন্যে কামকে নিয়ন্ত্রিত করতে। যখন এ-নিয়ন্ত্রণ অপ্রতুল হয়ে ওঠে, তখন তরুণী মেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে সে-ভয়ে, যা ওত পেতে আছে তার প্রেমিকের শরীরে। স্টেকেল এমন সব ঘটনার উল্লেখ করেছেন যাতে সচেতনভাবে বোধ করা হয়েছে এ-ত্রাস এবং প্রকাশ করা হয়েছে সঙ্গমের সময়েই এসব উক্তিতে : ‘কিছু যেনো না ঘটে! এটা কি নিরাপদ!’ এবং বিয়ের মধ্যেও শারীরিক ও আর্থিক কারণে একটি শিশু বাঞ্ছিত নাও হতে পারে।
নারীটি যদি তার সঙ্গীটির ওপর পূর্ণ আস্থা পোষণ না করে, সে প্রেমিকই হোক বা হোক স্বামী, তাহলে তার সতর্কতাবোধের জন্যে বিবশ হয় তার কামানুভূতি। সে। হয়তো উদ্বেগের সাথে চোখ রাখবে পুরুষটির কর্মকাণ্ডের ওপর, বা সঙ্গমের পরপরই উঠে যাবে এবং রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা নেবে সে-জীবন্ত বীজাণু থেকে, তার সঙ্গীটি যা তার ভেতরে জমা করেছে। এ-স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা রূঢ়ভাবে বিপরীত স্পর্শাদরের ইন্দ্রিয়াতুর যাদুর; যে-দেহ দুটি সম্প্রতি সংযুক্ত হয়েছিলো পারস্পরিক সুখের মধ্যে, এটা তাদের সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে। এ-সময়ে পুরুষটির শুক্রগুলোকে অশোভন। বস্তুর মতোই ক্ষতিকর জীবাণু বলে মনে হয়; একটা নোংরা পাত্র বোয়ার মতো সে নিজেকে পরিষ্কার করে, আর তখন চরম অখণ্ডতার মধ্যে বিশ্রাম করে পুরুষটি। এক তরুণী বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারী আমাকে বলেছিলেন তাঁর বিরক্তির কথা, বিয়ের রাতের দ্বিধাগ্রস্ত সুখের পর যখন তাঁকে যেতে হয়েছিলো স্নানাগারে, তখন তাঁর স্বামী নির্লিপ্তভাবে টানছিলো সিগারেট : তার মনে হয় যেনো ওই মুহূর্তেই নিশ্চিত হয়ে যায় তার বিয়ের বিপর্যয়। যান্ত্রিক জন্মনিরোধ প্রক্রিয়ার প্রতি প্রবল অনীহাও নিঃসন্দেহে প্রায়সই হয়ে থাকে নারীর কামশীলতার কারণ।
জন্মনিরোধের অধিকতর নিশ্চিত ও কম অস্বস্তিকর পদ্ধতি নারীর যৌনমুক্তির দিকে একটি মহাপদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, যেখানে উন্নততর পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত, সেখানে বিয়ের সময়কুমারী মেয়ের সংখ্যা ফ্রান্সের থেকে কম। নিঃসন্দেহে এসব পদ্ধতি যৌনক্রিয়ার সময় মনকে ভাবনাহীন রাখে। তবে এখানেও আবার নিজের দেহটিকে একটি বস্তুরূপে ব্যবহারের আগে তরুণীকে জয় করতে হয়কিছু অনীহা : পুরুষ দিয়ে বিদ্ধ হওয়ার ভাবনাকে সে সানন্দে মেনে নেয় না, আর। হাসিমুখে সে মেনে নেয় না পুরুষটির সুখের জন্যে ‘ছিপিবদ্ধ’ হওয়াকে। তার জরায়ু সে রুদ্ধই করুক বা ভেতরে একটা শুক্রনাশক ট্যাম্পন ঢুকুক, যে-নারী দেহ ও কামের অনিশ্চিত মূল্য সম্পর্কে সচেতন, সে অসুবিধায় পড়বে এরকম ঠাণ্ডা পূর্বপরিকল্পনায়এবং বহু পুরুষও আছে, যারা এমন রক্ষাকবচ অপছন্দ করে। সম্পূর্ণ কামপরিস্থিতি যাথার্থ্য প্রতিপাদন করে প্রতিটি ভিন্ন উপাদানের : এক বিশ্লেষণে যে আচরণকে মনে হবে আপত্তিকর, তাকেই মনে হয় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক যখন লিপ্ত দেহ দুটি রূপান্তরিত হয় তাদের কামবৈশিষ্ট্য দিয়ে; তবে বিপরীতভাবে, যখন দেহ আচরণকে বিশ্লিষ্ট করা হয় পৃথক ও নিরর্থক উপাদানে, তখন এ-উপাদানগুলো হয়ে ওঠে অমার্জিত, অশ্লীল। যে-বিদ্ধকরণকে গণ্য করা হয় মিলন বলে, দয়িতের সাথে একীভবন বলে, যা প্রণয়িনী নারীকে সুখ দেয়, তা-ই আবার পরিগ্রহ করে তার অস্ত্রোপচারধর্মী, অমার্জিত বৈশিষ্ট্য, যদি তা ঘটে কামোত্তেজনা, বাসনা, ও সুখ ছাড়া, যেমন ঘটতে পারে নিরোধকের পরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে। তা যাই হোক, এ-নিরোধকগুলো সব নারীর কাছে সুলভ নয়; বহু তরুণীই গর্ভধারণের বিপদ থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় সম্পর্কে অজ্ঞ, এবং তীব্র উদ্বেগের সাথে তারা মনে করে তাদের নিয়তি নির্ভরশীল ওই পুরুষটির সদিচ্ছার ওপর, যাকে তারা দান করেছে দেহ।
এটা মনে করা ঠিক হবে না যে অতিশয় আকুল ধরনের নারীদের ক্ষেত্রে হ্রাস পায় সব রকম বিপদের তীব্রতা। ঘটতে পারে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। নারীর কামোত্তেজনা পৌঁছোতে পারে এতো তীব্রতায়, যা পুরুষের অজানা। পুরুষের কামোত্তেজনা তীক্ষ্ণ তবে বিশেষ স্থানে সীমিত, এবং সম্ভবত শুধু পুলকলাভের মুহূর্তে ছাড়া পুরুষ রক্ষা করে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ; নারী, এর বিপরীতে, প্রকৃতপক্ষেই হয়ে ওঠে আত্মহারা; অনেকের জন্যে এটি হচ্ছে দৈহিক প্রেমের সবচেয়ে নির্দিষ্ট ও ইন্দ্রিয়সুখাবহ মুহুর্ত, তবে এরও আছে একটি যাদুধর্মী ও ভীতিকর বৈশিষ্ট্য। পুরুষ কখনো কখনো ভয় পেতে পারে তার আলিঙ্গনাবদ্ধ নারীটিকে, তাকে মনে হতে পারে আপন বিকৃতির শিকার; পুরুষটির আক্রমণাত্মক ক্ষিপ্ততা পুরুষটিকে যতোটা রূপান্তরিত করে তার থেকে অনেক বেশি আমূলভাবে রূপান্তরিত হয় নারীটি তার বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতা দিয়ে। এ-জ্বর তাকে মুহূর্তের জন্যে রেহাই দেয় লজ্জা থেকে, কিন্তু পরে এর কথা ভাবতেও সে লজ্জা ও বিভীষিকা বোধ করে। এটা যদি সে সাদরে গ্রহণ করতে চায় অথবা এমনকি সগর্বে–তাহলে সুখের উষ্ণতার মধ্যে তাকে থাকতে হয় আনন্দিত চিত্তে; সে তার কামনাবাসনাকে শুধু তখনি স্বীকার করে নিতে পারে যদি তা পরিতৃপ্ত হয় উপভোগ্যভাবে : নইলে সে ওগুলোকে ক্রোধের সাথে অস্বীকার করে।
এখানেই আমরা আসি নারীর কামের সংকটপূর্ণ সমস্যায় : নারীর কামজীবনের সূচনায় তীক্ষ ও নিশ্চিত উপভোগের মধ্য দিয়ে তার আত্মসমর্পণের ক্ষতিপূরণ ঘটে। সে সানন্দে তার সংযম ও তার অহমিকা বিসর্জন করবে, যদি এটা করে সে খুলতে পারে তার স্বর্গের পথ। কিন্তু ছদছিন্নকরণ, আমরা যেমন দেখেছি, তরুণী প্রেমিকার কাছে প্রীতিকর ব্যাপার নয়; প্রীতিকর হওয়াই বরং অত্যন্ত অস্বাভাবিক;যোনীয় সুখ অবিলম্বে পাওয়া যায় না। স্টেকেলের পরিসংখ্যান অনুসারে অসংখ্য যৌনবিজ্ঞানী ও মনোবিশ্লেষক যা সমর্থন ও অনুমোদন করেছেন–খুব বেশি হলে চার শতাংশ নারী শুরু থেকেই পায় পুলকসুখ; পঞ্চাশ শতাংশ যোনীয় পুলক লাভ করে বহু সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছরের পর।
এতে মানসিক ব্যাপার পালন করে অপরিহার্য ভূমিকা। নারীদেহ বিশিষ্টরূপেই মননাদৈহিক : অর্থাৎ প্রায়ই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে মানসিকের সঙ্গে দৈহিকের। নারীর নৈতিক সংবাধ বাধা দেয় কামাবেগ জেগে উঠতে; সুখে সেগুলোর সমতাবিধান না ঘটলে সেগুলো চিরস্থায়ী হতে থাকে এবং সৃষ্টি করে ক্রমশক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা। বহু ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে একটা দুষ্টচক্র : প্রথম দিকে পুরুষটির কোনো বিশ্রী আচরণ, একটা কথা, একটা স্কুল ভঙ্গি, একটা শ্রেষ্ঠত্বের হাসির প্রতিক্রিয়া ঘটতে থাকে মধুচন্দ্রিমা, এমনকি সারা বিবাহিত জীবন ভরে। অবিলম্বে সুখ না পেয়ে হতাশ হয়ে তরুণী বোধ করে চিরস্থায়ী বিরক্তি, যা পরে কোনোসুখকর সম্পর্কের প্রতিকূল হয়ে ওঠে।
স্বাভাবিক পরিতৃপ্তির অভাবে, একথা সত্য, পুরুষটি সব সময়ই ভগাঙ্কুরটিকে উদ্দীপিত করার উদ্যোগ নিতে পারে, যা, নীতিবাদী মিথ্যে বিবরণ সত্ত্বেও, এমন সুখ যোগাতে পারে যাতে নারীটি লাভ করতে পারে কামপুলক ও শমন। তবে বহু নারী এটা প্রত্যাখ্যান করে, কেননাকে এটাকে তাদের কাছে যোনীয় সুখের মতো মনে না হয়ে মনে হয় আরোপিত বলে, তাই নারী যেমন কষ্ট পায় যখন পুরুষ ব্যগ্র থাকে শুধু তার নিজের স্বস্তিলাভের জন্যে, তেমনি তাকে সোজাসুজি সুখ দেয়ার চেষ্টাতেও সে কষ্ট পায়। ‘অন্যকে সুখের অনুভূতি দেয়ার অর্থ হচ্ছে,’ স্টেকেল বলেন, ‘অন্যের ওপর আধিপত্য করা; নিজেকে অন্যের কাছে সমর্পণ করা হচ্ছে নিজের ঈপ্সার দাবি ত্যাগ করা’। নারী কামসুখকে তখনি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে যখন তা স্বাভাবিকভাবে বয়ে হয়ে আসে পুরুষটির অনুভূত কামসুখ থেকে, যেমন ঘটে সফল স্বাভাবিক সঙ্গমে। স্টেকেল আবার যেমন বলেছেন : ‘নারীরা তখনই সানন্দে নিজেদের সমর্পণ করে যখন তারা বোধ করে যে তাদের সঙ্গীরা তাদের পরাভূত করার ইচ্ছে পোষণ করে না’; অন্য দিকে, যখন তারা বোধ করে যে তারা ওই ওই ইচ্ছে পোষণ করছে, তখন বিদ্রোহ করে নারীরা। হাতের সাহায্যে উত্তেজিত হওয়াকে অনেকে অপছন্দ করে, কেননা হাত এমন একটি হাতিয়ার, সেটি যে-সুখ দেয় তাতে সেটি অংশ নেয় না, এটি মাংস নির্দেশ না করে নির্দেশ করে কর্মপরায়ণতা। এমনকি পুরুষের যৌনাঙ্গটিকেও যদি এটি কামনাময় মাংস বলে মনে না হয়ে একটি দক্ষভাবে ব্যবহৃত হাতিয়ার বলে মনে হয়, তাহলেও নারী বোধ করবে একই বিকর্ষণ। বহু পর্যবেক্ষণের পর স্টেকেল সিদ্ধান্তে পৌচেছেন যে কামশীতল বলে কথিত নারীদের সমগ্র কামনার লক্ষ্য হচ্ছে। স্বাভাবিকতা : ‘তারা কামপুলক বোধ করতে চায় (যাকে তারা গণ্য করে) স্বাভাবিক নারীর রীতিতে, অন্যান্য রীতি তাদের নৈতিক দাবিগুলো তৃপ্ত করে না’।
পুরুষটির মনোভাব তাই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষটির কামনা যদি হয় প্রচণ্ড ও নৃশংস, তাহলে তার সঙ্গিনীটির মনে হয় যে পুরুষটির আলিঙ্গনের মধ্যে সে হয়ে উঠছে নিতান্তই একটি বস্তু; তবে পুরুষটি যদি হয় অতিরিক্ত আত্মসংযমী, অতিরিক্ত নির্বিকার, তখন তাকে আর মাংস বলে মনে হয় না; সে চায় যে নারীটি নিজেকে করে তুলবে একটি বস্তু, তবে এর বিনিময়ে তার ওপর নারীটির থাকবে না কোনোঅধিকার। উভয় ক্ষেত্রেই নারীর অহমিকা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; কেননা নিজেকে একটি রক্তমাংসের বস্তুতে রূপান্তরণ ও নিজের ব্যক্তির দাবির মধ্যে মিটমাট করার জন্যে তার দরকার পড়ে যে পুরুষটিকেও সে করে তুলবে তার শিকার, যখন সে নিজে হয়ে উঠছে পুরুষটির শিকার। এ-কারণেই নারীরা এতো ঘন ঘন থাকে একগুয়েভাবে। কামশীতল। যদি তার প্রেমিকটি মনোমোহনের শক্তিহীন হয়, যদি সে হয় নিরুত্তাপ, তাচ্ছিল্যপরায়ণ, অদক্ষ, তাহলে সে নারীটির কাম জাগাতে ব্যর্থ হয়, বা সে তাকে রাখে অতৃপ্ত; তবে যদি সে পৌরুষপূর্ণ এবং দক্ষও হয়, তাহলেও জাগাতে পারে প্রত্যাখ্যান করার প্রতিক্রিয়া; নারীটি ভয় পায়তার আধিপত্যকে : অনেক নারী কামসুখ পায় শুধু সে-সব পুরুষের সাথে, যারা ভীরু, নির্গুণ, অথবা এমনকি আধা নপুংসক এবং যাদের থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
এটা নিশ্চিত সত্য যে নারীর কামসুখ পুরুষের কামসুখের থেকে বেশ ভিন্ন। আমি ইতিমধ্যেই বলেছি যে যোনীয় অনুভূতি কোন নির্দিষ্ট কামপুলক জাগায় কি না, তা অনিশ্চিত : এ-ব্যাপারে নারীদের মত খুবই বিরল, এবং যখন যথাযথভাবে ব্যাপারটি বর্ণনার চেষ্টা করা হয়, তখনও তা থাকে খুবই অস্পষ্ট; দেখা যায় যে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে ভিন্ন। কিন্তু সন্দেহ নেই যে পুরুষের কাছে সঙ্গমের আছে এক সুনির্দিষ্ট জৈবিক উপসংহার; বীর্যপাত। এবং নিশ্চয়ই এ-লক্ষ্যের সাথে জড়িত থাকে। আরো নানা জটিল অভিপ্রায়; কিন্তু একবার এটা ঘটলে একেই মনে হয় একটি নির্দিষ্ট ফলাফল বলে; এবং এতে যদি কামনার পূর্ণ পরিতৃপ্তি নাও ঘটে, তবে কিছু সময়ের জন্যে কামনার সমাপ্তি ঘটে। নারীর মধ্যে, উল্টোভাবে, শুরু থেকেই লক্ষ্য অনিশ্চিত, এবং এটা যতোটা শারীরবৃত্তিক তার চেয়েও বেশি মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির; সাধারণভাবে নারী কামনা করে কামোত্তেজনা ও সুখ, কিন্তু তার দেহ এ-রমণের কোনো যথাযথ পরিসমাপ্তির প্রতিশ্রুতি দেয় না; এবং এজন্যেই তার জন্যে সঙ্গম কখনোই সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত হয় না : এটা কোনো সমাপ্তি মানে না। পুরুষের কামানুভূতি তীরের মতো। জেগে ওঠে, যখন এটা পৌঁছে বিশেষ উচ্চতায় বা সীমায়, এটা পূর্ণতা লাভ করে এবং কামপুলক লাভের মধ্যে হঠাৎ মারা যায়; তার রমণকর্মের ভঙ্গিটি সসীম ও ধারাবাহিকতাহীন। নারীর সুখ বিকিরিত হয় সারা শরীর জুড়ে; এটা সব সময় যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোতে কেন্দ্রীভূত হয় না; এমনকি যখন হয়ও, যোনীয় সংকোচন একটি প্রকৃত কামপুলক সৃষ্টির বদলে তৈরি করে একটা তরঙ্গসংশ্রয়, যা জেগে ওঠে। ছন্দস্পন্দনে, বিলীন হয় ও পুনর্গঠিত হয়, থেকে থেকে লাভ করে এক আকস্মিক বিস্ফোরণের অবস্থা, হয়ে ওঠে অস্পষ্ট, এবং কখনোই লুপ্ত না হয়ে স্তিমিত হয়। যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত নেই, নারীর কামানুভূতি সম্প্রসারিত হয় অনন্তের দিকে; কোনো বিশেষ পরিতৃপ্তিবশত নয়, বরং প্রায়ই স্নায়ুতন্ত্রের বা হৃৎপিণ্ডের অবসাদের ফলে বা মানসিক পূর্ণপরিতৃপ্তির ফলেই সীমায়িত হয় নারীর কামের সম্ভাবনা; এমনকি সে যখন অভিভূত, অবসন্ন, তখনও সে কখনো পরিপূর্ণভাবে নিস্তার লাভ করে না : লাসাতা ননদুম সাতিয়াতা, যেমন বলেছেন জুভেনাল।
কোনো পুরুষ যখন সঙ্গিনীটির ওপর চাপিয়ে দেয় তার ছন্দোস্পন্দ বা সময়সীমা এবং তাকে একটা কামপুলক দেয়ার জন্যে প্রাণপণে খাটে, তখন সে অত্যন্ত ভুল করে : নারীটি নিজের যে-বিশেষ রীতিতে পুলকের যে-রূপের দিকে এগোচ্ছিলো, তখন সে সফল হয় শুধু তা চুরমার করে দিতে। এটা এমন এক নমনীয় রূপ যে এর শর্তগুলো নির্ধারণ করা কঠিন : মংসপেশির কিছু খিচুনি যোনিতে সীমিত থেকে বা সমগ্রভাবে কামসংশ্রয়ের ভেতরে, বা সারা শরীরে জড়িত থেকে ঘটাতে পারে সমাপ্তি; কিছু নারীতে এগুলো খুবই তীব্র এবং নিয়মিতভাবে ঘটে যে এগুলোকে গণ্য করা যায় কামপুলক বলে; তবে প্রণয়িনী নারী তার পুরুষটির কামপুলকের মধ্যেও পৌছোতে পারে উপসংহারে, যা দেয় প্রশমন ও পরিতৃপ্তি। এবং এও সম্ভব যে কামের অবস্থাটি প্রশমিত হতে পারে ধীরশান্তভাবে, হঠাৎ রাগমোচন ছাড়াই। সাফল্যের জন্যে অনুভূতির গাণিতিক এককালবর্তীকরণ দরকার পড়ে না, যেমন আছে খুঁটিনাটির প্রতি অতিযত্নশীল বহু পুরুষের অতি-সরলীকৃত বিশ্বাসে, এর জন্যে দরকার একটা জটিল কামবিন্যাস প্রতিষ্ঠা। অনেকে মনে করে যে নারীদের কামসুখের অনুভূতি দেয়া একটা সময় ও কৌশলের ব্যাপার মাত্র, এটা এক হিংস্র কর্ম বটে; তারা বোঝে না নারীর কাম কতোটা মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হয় সমগ্র পরিস্থিতি দিয়ে।
নারীর কামসুখ, আমি আগেই বলেছি, এক ধরনের যাদুমন্ত্র; এটা চায় প্রবৃত্তির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমপূর্ণ; কোনো কথা বা নড়াচড়া স্পর্শাদরের যাদুর বিপক্ষে যায়, তাহলে ভেঙে যায় মন্ত্রটি। এটাই অন্যতম কারণ কেননা নারী চোখ বোজ; শারীরবৃত্তিকভাবে এটা চোখের মণির প্রসারণের ক্ষতিপূরণ করার জন্যে একটি প্রতিবর্তী ক্রিয়া; কিন্তু এমনকি অন্ধকারেও নারীর চোখের পাতা নেমে আসে। সে লুপ্ত করে দিতে চায় সমগ্র পরিপার্শ্ব, লুপ্ত করে দিতে চায় ওই মুহূর্তের, তার নিজের, এবং তার প্রেমিকের এককত্ব, সে হারিয়ে যেতে চায় মাতৃগর্ভের মতো ছায়াচ্ছন্ন মাংসের রাত্রির ভেতরে। আরো বিশেষভাবে সেলোপ করে দিতে চায় তার ও পুরুষটির মধ্যবর্তী বিচ্ছিন্নতা; সে চায় পুরুষটির সাথে গলে এক হয়ে যেতে।
দুটি শরীরের বিচ্ছিন্ন হওয়ার মুহূর্তটি কেননা প্রায় সব সময়ই নারীর জন্যে বেদনাদায়ক, এটাই ব্যাখ্যা করে তার কারণ। প্রকৃতির ছল বা নারীর বিজয়ী পুরুষ সঙ্গমে সুখ পাক বা হতাশ হোক, সঙ্গমের পর সে সব সময়ই বর্জন করে দেহ; সে আবার হয়ে ওঠে একটি সৎ শরীর, সে ঘুমোতে চায়, স্নান করতে চায়, সিগারেট খেতে চায়, মুক্ত বায়ুর জন্যে বাইরে যেতে চায়। কিন্তু নারী বিলম্বিত করতে চায় মাংসের সংস্পর্শ যতোক্ষণ না পুরোপুরি কাটে সে-যাদুমন্ত্র, যা তাকে মাংসে পরিণত করেছিলো; বিচ্ছিন্ন হওয়া তার জন্যে নতুন করে মায়ের দুধ ছাড়ার মতো এক বেদনাদায়ক মূলোৎপাটন; যে-প্রেমিক তাকে ছেড়ে হঠাৎ উঠে যায়, তার ওপর তার রাগ হয়। তবে সে আরো বেশি আহত বোধ করে সে-সব কথায়, যা বিপক্ষে যায় তার সে-মিলনের, যাতে সে মুহূর্তের জন্যে হলেও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছে। ‘ওটা যথেষ্ট হয়েছে? আরোলাগবে? ওটা ভালো লেগেছে?’–এ-ধরনের জিজ্ঞাসা জোর দেয় বিচ্ছিন্নতার ওপর, সঙ্গমের কাজটিকে রূপান্তরিত করে পুরুষের পরিচালিত একটি যান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে। নারীর অনেক বিপদ দূর হতো যদি পুরুষ তার চিন্তাধারায় না বইতো অজস্র গূঢ়ৈষা, যার ফলে সে সঙ্গমকে যুদ্ধ হিশেবে গণ্য করে; তাহলে নারীও শয্যাকে আর যুদ্ধক্ষেত্র বলে মনে করতো না।
তবু দেখা যায় আত্মরতি ও গর্ববোধের সাথে তরুণীর মধ্যে আছে শাসিত হওয়ার বাসনা। কিছু মনোবিশ্লেষকের মতে মর্ষকাম নারীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এবং এটাই তাকে তার কামনিয়তির সাথে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করে। তবে মর্ষকামের ধারণাটি অতি গোলমেলে, এবং ব্যাপারটি ভালোভাবে বিচার করে দেখা দরকার।
ফ্রয়েডের অনুসরণে মনোবিশ্লেষকেরা তিন প্রকার মর্ষকাম নির্ণয় করেন : একটিতে আছে যন্ত্রণা ও কামসুখের সম্মিলন, আরেকটি হচ্ছে নারীর কামগত পরনির্ভরশীলতা মেনে নেয়া, আর তৃতীয়টি নির্ভরশীল আত্মপীড়নের এক কার্যসাধনপদ্ধতির ওপর। এ-দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী মর্ষকামী, কেননা তার মধ্যে সুখ ও বেদনা মিলিত হয় সতীত্বমোচন ও সন্তানপ্রসবে, এবং যেহেতু সে মেনে নেয় অক্রিয় ভূমিকা।
সর্বপ্রথম আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে বেদনার ওপর একটা কামগত মূল্য আরোপ আদৌ বোঝায় না যে আচরণটি অক্রিয়ভাবে আত্মসমর্পণমূলক। বেদনা প্রায়ই বাড়ায় পেশির সংকোচনপ্রসারণ, কামোত্তেজনা ও কামসুখের হিংস্রতার ফলে ভোতা হয়ে যাওয়া স্পর্শকাতরতাকে আবার জাগিয়ে তোলে; এটা মাংসের রাত্রির ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি; যাতে তাকে আবার নিক্ষেপ করা যায়, তাই এটা প্রেমিককে উঠিয়ে আনে সে-বিস্মৃত অবস্থা থেকে, যেখানে সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে ছিলো। বেদনা সাধারণত কামোন্মত্ততার একটা অংশ। কামজ প্রেমে সব সময়ই থাকে নিজের থেকে ছিঁড়ে আনা, আবেগে আত্মহারা হওয়া, পরমানন্দ; বেদনাভোগ ভেঙেচুড়ে ফেলে অহংয়ের সীমানাও, এটা সীমাতিক্ৰমণতা, আবেগের আকস্মিক বিস্ফোরণ; বেদনা সব সময়ই বড়ো ভূমিকা পালন করেছে বন্য-আনন্দোৎসবে, এবং এটা সুপরিজ্ঞাত যে তীব্র সুখ ও বেদনা খাপ খায় পরস্পরে সাথে : প্রণয়স্পর্শ হয়ে উঠতে পারে পীড়ন, যন্ত্রণা দিতে পারে সুখ। আলিঙ্গন সহজেই নিয়ে যায় দংশন, নখাঘাত, আঁচড় দেয়ার দিকে; এমন আচরণ সাধারণত ধর্ষকামী নয়; এটা মিলেমিশে যাওয়ার বাসনা, ধ্বংস করার নয়; এবং যে-ব্যক্তিটি এটা ভোগ করে সে প্রত্যাখ্যান ও অবমাননা খোঁজে না, খোঁজে মিলন; এছাড়া, এটা বিশেষভাবে পুরুষের আচরণ নয়আদৌ তা নয়। প্রকৃতপক্ষে তখনই বেদনার থাকে মর্ষকামী তাৎপর্য, যখন একে গ্রহণ করা হয় ও চাওয়া হয় দাসত্বের প্রমাণ হিশেবে। সতীত্বমোচনের বেদনা সুখের সাথে পরস্পরসম্পর্কিত নয়; এবং সন্তানপ্রসবের বেদনাকে ভয় পায় সব নারীই এবং তারা আনন্দিত যে আধুনিক ধাত্রীবিদ্যার পদ্ধতি এটা দূর করছে। নারীর কামে বেদনার ভূমিকা পুরুষের থেকে বেশিও নয়, কমও নয়।
নারীর বাধ্যতা, অধিকন্তু, একটি খুবই দ্ব্যর্থক ধারণা। আমরা দেখেছি যে তরুণী সাধারণত কল্পনায় মেনে নেয় কোনো নরদেবতার, কোনো বীরের, কোনো পুরুষের আধিপত্য; তবে এটা আত্মরতিমূলক খেলার থেকে বেশি কিছু নয়। বাস্তবে তরুণীকে এটা কোনোভাবেই এমন কোনো প্রভুর দৈহিক চর্চার কাছে সমর্পণ করে না। এর বিপরীতে, প্রায়ই সে প্রত্যাখ্যান করে সে-পুরুষটিকে, যাকে সে পছন্দ ও শ্রদ্ধা করে, এবং নিজেকে দান করে এমন কোনো পুরুষের কাছে, যার নেই কোনো বিশিষ্টতা। উদ্ভট কল্পনার মধ্যে বাস্তব আচরণের চাবি খোজা ভুল; কেননা উদ্ভট কল্পনাগুলো সৃষ্টি ও পোষণ করা হয় উদ্ভট কল্পনারূপেই। আমরা আবার উদ্ধৃত করতে পারি মারি বাশকিসেভকে : ‘সারাজীবন আমি নিজেকে কোনো প্রাতিভাসিক আধিপত্যের কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছি, কিন্তু যে-সব পুরুষ নিয়ে আমি এ-চেষ্টা করেছি, তারা আমার তুলনায় এতো তুচ্ছ যে আমি শুধু ঘৃণা বোধ করেছি’।
তবু, ঠিক যে কামে নারীর ভূমিকা প্রধানত অক্রিয়; তবে পুরুষের স্বাভাবিক আক্রমণাত্মক আচরণ যতোটা ধর্ষকামী ওই অক্রিয়া ভূমিকার বাস্তবিক রূপায়ণ তার থেকে বেশি মর্ষকামী নয়; সুখ পাওয়ার জন্যে প্রণয়স্পর্শ, উত্তেজনা, ও বিদ্ধকরণকে অতিক্রম করে গিয়ে নারী রক্ষা করতে পারে তার ব্যাক্তিতা, নারী তার প্রেমিকের সাথে সম্মিলন চাইতেও পারে এবং নিজেকে দানও করতে পারে তার কাছে, এটাবোঝায় অহংয়ের সীমাতিক্ৰমণতা, দাবি ছেড়ে দেয়া নয়। তখনই থাকে মর্ষকাম, যখন কেউ চায় যে অন্যদের সচেতন ইচ্ছেয় সে হয়ে উঠবে একটি যথার্থ বস্তু, যখন সে নিজেকে দেখতে চায় বস্তুরূপে, বস্তু হওয়ার ভান করে। ‘মর্ষকাম আমার বস্তুতন্ত্রতা দিয়ে অন্যকে মুগ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নয়, তবে এটা হচ্ছে অপরের দৃষ্টিতে নিজেকে নিজে হয়ে ওঠার উদ্যোগ, যা আমার বস্তুতন্ত্রতায় মুগ্ধ’ (জে,পি, সার্ত, ল’এতর এৎ ল্য নিআ)।
এটা এক পুরোনো কুটভাষ যে পুরুষ বাস করে এক ইন্দ্রিয়ানুভূতির জগতে, যেখানে আছে মধুরতা, প্রীতি, দ্রতা, এক নারীসুলভ জগতে, আর সেখানে নারী ঢোকে পুরুষের জগতে, যা কঠিন ও কর্কশ; নারীর হাত এখনো কামনা করে কোমল, মসৃণ মাংসের সংস্পর্শ : কিশোর, নারী, পুষ্প, পশম, শিশু; তার ভেতরের একটি সম্পূর্ণ এলাকা থেকে যায় অনধিষ্ঠিত এবং সে কামনা করে এমন সম্পদ অধিকার করতে, যা সে দেয় পুরুষকে। বহু নারীর মধ্যে যে বিদ্যমান থাকে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট সমকামিতার প্রবণতা, এটা ব্যাখ্যা করে এ-ব্যাপারটি। এক ধরনের নারী আছে, বহু জটিল কারণে, যাদের মধ্যে এ-প্রবণতা প্রকাশ পায় অস্বাভাবিক শক্তিতে। সব নারী। তাদের যৌন সমস্যাগুলো মানবদ্ধ রীতিতে, সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত একমাত্র পদ্ধতিতে, সমাধান করতে সমর্থও নয় এবং ইচ্ছুকও নয়। আমরা এখন মনোযোগ দেবো তাদের দিকে, যারা বেছে নেয় নিষিদ্ধ পথ।