একদিন গভীর রাতে খলিফা হারুন অল রসিদের হঠাৎ নিদ্রা টুটে গেলো। কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। তারপর ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি পায়চারি করলেন খানিকক্ষণ। কিন্তু বুকের বোঝা হালকা হলো না। চোখে আর ঘুম নেমে এলো না। দেহরক্ষী মাসরুরকে তলব করলেন।
মাসরুর হাজির হলে তাকে বললেন, শোন্ বান্দা, আজ আর ঘুম আসবে না মনে হচ্ছে। বুকে যেন পাষাণ চেপে বসেছে। যাহোক একটা উপায় বের কর।
মাসরুর বললো, তাহলে আর প্রাসাদে থেকে কাজ নাই। চলুন পথে বেরিয়ে পড়ি। মুক্ত বাতাসে হয়তো হাল্কা হতে পারবেন কিছুটা।
কিন্তু হারুন অল রসিদ মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন, না, আজ রাতে আর বাইরে বেরুতে ইচ্ছে করছে না।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পরদিন আটশো পঁচানব্বইতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
মাসরুর বলে, জাঁহাপনা, আপনার হারেমে তিনশো ষাটটি বাঁদী আছে। আপনি যদি ইচ্ছে করেন, তাদের কারো ঘরে গেলে হয় না?
কিন্তু হারুন অল রসিদ তাতেও সায় দিলেন না, না না, তুই এক কাজ কর। ছুটে যা, জাফরকে নিয়ে আয়।
অল্পক্ষণের মধ্যেই জাফর এসে হাজির হলো। খলিফা বললেন, জাফর, বড়ই অস্বস্তি বোধ করছি, ঘুম আসছে না। একটা কিছু ব্যবস্থা কর, যাতে আমার কষ্টের লাঘব হয়।
জাফর বলে, জাঁহাপনা, যখন নারীসঙ্গ বা প্রাকৃতিক শোভা মনকে প্রফুল্ল করতে পারে না তখন একটি মাত্র পথই খোলা থাকে—কিতাব পাঠ।
সুলতান ঘাড় দুলিয়ে বলেন, তুমি যথার্থই বলেছ, জাফর। কিন্তু কোন কিতাব পড়বো? কোথায় আছে সে বই যা পড়ে মনের ক্লেদ দূর হবে? নিয়ে এসো সে কিতাব।
মাসরুর আলো ধরলো, আর জাফর বইয়ের আলমারীতে বই খুঁজতে লাগলো। অনেকগুলো তাক খুঁজেপেতে কতকগুলো বই বের করে এনে খলিফার সামনে, রাখলো জাফর। সুলতান এক একখানা বই হাতে নিয়ে দু’চার পাতা ওলটাতে থাকেন, দু’চার ছত্র পড়েন। পড়তে পড়তে কখনও হো হো করে হেসে ওঠেন, কখনও বা পড়তে পড়তে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে, চোখে ভরে আসে অশ্রু। বই-এর পাতা ঝাপসা হয়ে যায়। আর পড়া হয় না। পড়া যায় না! কিতাব বন্ধ করে আবার শয্যায় ফিরে আসেন।
জাফর বুকে সাহস এনে জিজ্ঞেস করে, জাঁহাপনা, এইমাত্র আপনি অমন করে হাসলেন আবার এখনই আপনার চোখে দেখছি পানি—কী ব্যাপার?
জাফরের এ কথায় খলিফা রুষ্ট হলেন।
-তুমি তো দেখছি ভারি বেয়াদব হে! আমি হাসি বা কঁদি তাতে তোমার কী কুত্তার বাচ্চা?
একটুক্ষণ থেমে আবার তিনি বললেন, শোনো এখন তোমার একমাত্র কাজ হচ্ছে এমন একজন লোককে এখানে হাজির করা যে বুঝিয়ে বলতে পারবে কেন আমি একই সময়ে হেসেছি। এবং কেঁদেছি। কী আছে ঐ বই-এ যা একই সঙ্গে কাঁদাতে এবং হাসাতে পারে মানুষকে? যাও, নিয়ে এসো সেই সূত্রধরকে—যে বুঝিয়ে দিতে পারবে আমাকে সে কথা। কিন্তু শোনও জাফর, তেমন গুণী ব্যক্তিকে যদি হাজির না করতে পার তবে তোমার গর্দান যাবে নির্ঘাৎ-এ আমি আগাম বলে রাখলাম।
জাফর আনত হয়ে বলে, বান্দার গোস্তাকি মাফ করবেন, জাঁহাপনা।
খলিফা বললেন, মাফ করার কোনও প্রশ্ন নাই। আমার সামনে সেই লোককে হাজির কর, নতুবা তোমার গর্দান যাবেই।
জাফর বিনয়ের অবতার হয়ে বলে, সর্বশক্তিমান খোদাতালা ইচ্ছে করলে এক লহমায় এই তামাম দুনিয়া পয়দা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি, সারা বিশ্ব সৃষ্টি করতে পুরো দু’টি দিন সময় অতিবাহিত করেছেন। আর আমি এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ নর, এতো বড় বিশ্বে কোথায় কোন প্রান্তে তেমন গুণীজন আছে খুঁজে বের করতে অন্তত তিনটি দিন সময় দিন আমাকে।
হারুন অল রসিদ বললেন, মঞ্জুর। ঠিক আছে তিন দিনই সময় দিলাম তোমাকে।
জাফর বললো, তাহলে আমি আর বিলম্ব করবো না হুজুর, আজ্ঞা করুন এখনই তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি।
হারুন অল রসিদ বললেন, অবশ্যই যেতে পার।
জাফর বিষণ্ণ বদনে ঘরে ফিরে এসে তার বৃদ্ধ বাবা ইয়াহিয়া এবং ভাই অল-ফাদলকে তার সঙ্কটের কথা জানালো।
যারা শুধু হাতে তীক্ষ্ণ তরবারীর সঙ্গে লড়তে যায় তাদের হাতই কাটা যায়। আর যারা ক্ষীণবল হয়ে সিংহের সঙ্গে যুঝতে দুঃসাহসী হয় তারা নিজেদের তাল হারায়। তোমরা জান খলিফার সিংহবিক্রম। তাকে সামাল দেওয়া আমার অসাধ্য। সুতরাং আমার বুদ্ধিতে বলে একমাত্র পালিয়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।
কিন্তু জাফরকে বাবা এবং ভাই দু’জনেই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে বারণ করলো।
—তোমার অত ভয় পাওয়ার কিছু নাই। দুদিন বাদে খলিফা নিজগুণেই তোমাকে মার্জনা করে দেবেন।
জাফর বললো, না না, তোমরা বুঝতে পারছ না, তিনি কসম খেয়েছেন। তার জবান দু’রকম হয় না। ভেবে দেখ, তার যা বায়নাক্কা তা পূরণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং মৃত্যু অনিবার্য।
বাবা বললো, তুমি ঠিক বলেছ, জাফর। আর দেরি না করে সোজা দামাসকাসে চলে যাও।
– কিন্তু বাবা, আমার বিবি বাচ্চাদের কী হবে?
—সেজন্যে তুমি চিন্তা করো না, বাবা। তাদের নসীবে যা লেখা আছে তা কেউ খণ্ডন করতে পারবে না। ওসব ভেবে লাভ নাই। তুমি আর কালবিলম্ব না করে এখুনি বেরিয়ে পড়।
রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
আটশো ছিয়ানব্বইতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
বাবার উপদেশ শিরোধার্য করে জাফর দামাসকাস রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। সঙ্গে নিলো হাজারখানেক স্বর্ণমুদ্রা। কোমরে বেঁধে নিলো তলোয়ার। সঙ্গে কোনও চাকর নফর না নিয়ে একাই একটা খচ্চরে চেপে রওনা হয়ে গেলো সে।
একটানা দশ দিন ধরে নানা শহর, মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে অবশেষে একদিন দামাসকাসের কাছে মার্জনামক এক শস্যশ্যামল গ্রামে এসে পৌঁছলো জাফর।
মার্জপল্লীর অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো সে। সুন্দরী সব দেহাতি মেয়েরা পানি ভরতে নদীর ঘাটে যাচ্ছে। গাছে গাছে কতরকম নাম না জানা পাখির নাচানাচি। যে দিকে তাকায় শুধু সবুজের মেলা; নানা রঙের ফুলের কি বিচিত্র সমারোহ।
আরও কিছুটা এগোতে একটি ছোট্ট প্রাচীন শহর। এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জাফর আচ্ছা ভাইসাব, এ শহরটার কী নাম?
-এর নাম পুরানা জিল্লিক। এইটেই আদি দামাসকাস। আরও আদি নাম শাম—সারা দুনিয়ার সেরা সুন্দর দেশ।
যে দিকে তাকায় চোখ জুড়িয়ে যায় জাফরের। সত্যিই সুন্দরী শাম; তুলনা হয় না এ রূপের। মনের সব বোঝা নিমেষে হালকা হয়ে যায় ওর। খচ্চর থেকে নেমে শহরের পথ ধরে হাঁটতে থাকে সে। দু’পাশে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি, মসজিদ।
চলতে চলতে একসময় সে দেখতে পেলো, কুয়ো থেকে জল তুলে রাস্তা ভেজাচ্ছে কিছু লোক। কিছুটা দূরে একটা বিরাট বাগান। আর সেই বাগানের ঠিক মাঝখানে একখানি মনোহর তবু পাতা। আরও কাছে যেতে নজরে পড়লো তাঁবুর ভিতরটা দামী খুরাসনের গালিচায় মোড়া। নানারকম বাহারী আসবাব পত্রে ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো গোছানো।
তাঁবুটার ভিতরে একটি প্রিয়দর্শন যুবক সঙ্গী-সাথী পরিবৃত হয়ে মৌজ করে মৌতাত করতে বসেছে। যুবকের প্রায় গা ঘেঁষে বসেছে একটি ডানাকাটা তরুণী! তার হাতে এক বাদ্যযন্ত্র, সুললিত কণ্ঠে গান গেয়ে চলেছে। সে গানের মূৰ্ছনায় আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে।
জাফর তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে সেই সুমধুর সঙ্গীত। পায়ে পায়ে আরও দু’চার কদম এগিয়ে যায় তাঁবুর দিকে।
হঠাৎ একবার যুবকের নজরে পড়ে যায় জাফর। সে তার এক সঙ্গীকে বলে, দেখ তো বাইরে মনে হচ্ছে এক বিদেশী মুসাফির এসে দাঁড়িয়েছে। যাও, ওকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসো এখানে।
ছেলেটি তৎক্ষণাৎ ছুটে বাইরে এসে জাফরকে বললে, গোস্তাকি মাফ করবেন মালিক, আমাদের সাহেব আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। মেহেরবানী করে যদি একবার তাঁবুর ভিতরে চলেন
তাঁবুর ভিতরে যেতেই যুবক উঠে দাঁড়িয়ে জাফরকে স্বাগত জানিয়ে বললো, অনুগ্রহ করে আসন গ্রহণ করুন, মালিক। আমার কি পরম সৌভাগ্য, আপনি এসেছেন আমাদের তাঁবুতে।
নানারকম খাদ্য ও পানীয়ে পরিতৃপ্ত করলো সে জাফরকে। বিনয় করে বললো; আপনি হঠাৎ এসে পড়েছেন গরীবের আস্তানায়। তাই যোগ্য সমাদর করতে পারলাম না, আপনার। আগে যদি জানতাম আপনি আসবেন তবে নিজের কলিজা অথবা আমাদের সন্তানের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতাম আপনাকে।
খানাপিনা শেষ হলে নিজ হাতে জল ঢেলে দিলো সে জাফরের হাতে। তারপর মদের পেয়ালা পূর্ণ করে এগিয়ে দিলো সামনে।
আবার শুরু হলো গান বাজনা। একটানা অনেকক্ষণ চললো৷
আদর আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো জাফর। মনের বোঝা অনেকটা লাঘব হয়ে এসেছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝে খলিফার সেই কথা স্মরণ করে কেমন যেন মুষড়ে পড়তে লাগলো সে।
যুবকের দৃষ্টি এড়ালো না কিছুই। সে নানাভাবে জাফরকে উৎফুল্ল রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকলো।
মালিক, আমাদের অক্ষমতা, দীনতা আ স্বীকার করছি। এমন কোন আয়োজন এখানে নাই যা দিয়ে আপনাকে তৃপ্ত করতে পারি। তবু আমার একান্ত অনুরোধ, সব দোষত্রুটি ক্ষমা করো আপনি একটু প্রফুল্ল হয়ে উঠুন।
রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
পরদিন আটশো সাতানব্বইতম রজনী :
আবার সে বলতে করে।
সব গান শেষ হলে যুবকটি জাফরকে সঙ্গে নিয়ে দামাসকাসের সুলতানের প্রাসাদে এলো। জাফর দেখলো বেহেস্তের মতো অনুপম এক উদ্যান। তাঁর মাঝখানে এক মনোরম প্রাসাদ।
যুবক বললো, এই প্রাসাদ আপনার নিজের প্রাসাদ জ্ঞান করবেন, মালিক। আপনার এ শহরে আগমনের কি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য আছে জনাব? আপনার নামটা কি জানতে পারি।
জাফর বলে, আমি খলিফা হারুণ অল রসিদের এক সেনাপতি। থাকি বসরাহয়। সম্প্রতি খলিফার সঙ্গে আমার কিছু মতের অমিল হওয়ায় তার কাছে ইস্তফা দিয়ে দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছি। অন্য কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য আমার নাই। আমার নাম আর আপনার নাম একই।
যুবক বললো, তা হলে আপনার নামও হাসান অল দিন! বাঃ চমৎকার হলো। এরপর থেকে আপনাকে মিতা বলেই ডাকবো! নিন এখন বিশ্রাম করুন, কোনও অসুবিধে বোধ করলে তুড়ি বাজাবেন, বান্দা হাজির থাকবে আপনার পাশেই।
পরদিন সকালে জাফর শয্যাত্যাগ করে ওঠেনি দেখে যুবক এসে দাঁড়ালো ওর পালঙ্কের পাশেই।
কাল রাতে কি আপনার ঘুম হয়নি মালিক? জাফর বললো, না, কেন জানি না অসহ্য যন্ত্রণা হয়েছে বুকে, কিছুতেই ঘুম আসেনি। যুবক উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে, সে কি! আমি এখুনি হাকিমকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
নামকরা হাকিম এলো। নাড়ী পরীক্ষা করে দেখলো সে। তারপর বললো, না, দেহে কোনও ব্যাধি নাই। যা কিছু সবই দুশ্চিন্তার জন্য। মন থেকে চিন্তা ভাবনা সরিয়ে ফেলে হাসিখুশির মধ্যে থাকতে হবে। সুন্দরী রমনী সঙ্গ, মদ্যপান এবং আনন্দ বিহারই এর একমাত্র দাওয়াই। অন্য কোনও দাওয়াই-এ কোনও কাজ হবে না।
হাকিমের ব্যবস্থাপত্র শুনে যুবক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যাক্ বাবা বাঁচা গেলো, আমি তো ভয়ে মরি, না জানি কি কঠিন অসুখে পড়লেন আপনি!
জাফর ভাবে, না, আর লুকিয়ে রাখা উচিত নয়, এমন পরম সুহৃদের কাছে অন্তরের সব ১ গোপন কথা খুলে বলা দরকার।
শোনও মিতা, আমি তোমাকে আজ আমার মনের কথা খুলে বলছি। আমি বুঝতে পেরেছি তোমার মতো বন্ধু পাওয়া পরম ভাগ্যের। তাই কিছুই লুকাবো না তোমার কাছে।
জাফর নিজের পরিচয় জানালো হাসানকে। কিন্তু অন্য কাউকে জানাতে বারণ করে দিলো। হাসানের একমাত্র চেষ্টা কী উপায়ে জাফরকে উৎফুল্ল রাখা যায়। প্রায় সব সময়ই সে তার সঙ্গে সঙ্গে কাটায়। খানাপিনা নাচ গান হৈ-হল্লার মধ্যে ভুলিয়ে রাখতে চায় সে জাফরকে।
একদিন বাগানের একপাশে বসে দুই বন্ধু বাক্যালাপ করছিলো, এমন সময় এক পরমাসুন্দরী তরুণী জলের ঝারি হাতে বাগানে ঢুকে ফুলগাছের গোড়ায় জল সিঞ্চন করতে লাগলো। মেয়েটিকে দেখামাত্র জাফরের সারা অঙ্গে এক শিহরণ খেলে গেলো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে তরুণীর দিকে।
হাসান বললো, কী দেখছেন মিতা?
-বাঃ কি সুন্দর, যেন বেহেস্তের পরী।
-আপনার খুব পছন্দ ওকে?
জাফর বলে, পছন্দ হলেই বা কী? আমি পরদেশী। আমার হাতে দেবে কেন এমন মেয়েকে?
হাসান বলে, সে আমি ব্যবস্থা করে দেব। আপনি রাজি কিনা বলুন।
জাফর বলে, এ নারীর সঙ্গ সহবাস পেলে দুনিয়ার সব দুঃখ কষ্ট তুচ্ছ মনে হবে আমার।
হাসান বলে, আপনি কোনও খেদ করবেন না, মালিক। আমি কথা দিচ্ছি ঐ নারী আপনারই অঙ্কশায়িনী হবে।
জাফর অবাক হয়ে বলে, এমন জোর দিয়ে একথা বলছেন কি করে দোস্ত? ও আপনার কে?
হাসান বলে, ঐ রূপসী আমার নিজের বিবি। কিন্তু আপনি আমার মেহেমান। দুনিয়াতে তার চেয়ে বড় বস্তু আর কিছু নাই। আমি ওকে তিন তালাক দিয়ে দেব। আমার চাচাকে বলে রাজি করাবো, সে যাতে আপনার হাতে তুলে দেয় তাকে। আপনি নিকা করে দেশে নিয়ে যাবেন তাকে।
জাফর কেমন আড়ষ্ট, অপ্রস্তুত হয়ে যায়, এ কেমন কথা হলো দোস্ত, তোমার শাদী করা বিবিকে তালাক দেবে তুমি? কেন? কী তার অপরাধ?
অপরাধ? সে কোন অপরাধ করতে পারে না মালিক। অপাপবিদ্ধ সে, আমাকে জান প্রাণ দিয়ে মহব্বত করে।
তবে তাকে কেন পরিত্যাগ করবেন? হাসান হাসে, অতিথি সৎকারের চেয়ে বড় কাজ কিছু থাকতে পারে না কোনও মুসলমানের। আপনি আমার পরম প্রভু। আপনার আত্মা অতৃপ্ত হলে দোজকেও ঠাই হবে না আমার। এই মাত্র ঠিক করলাম, বিবিকে তালাক দিয়ে আমি সংসার ধর্ম ত্যাগ করে মক্কায় চলে যাবো চিরদিনের মতো। সেখানে কাবাহ আশ্রয় করে পড়ে থাকবো। আল্লাহ যদি প্রসন্ন হন, আমাকে কোলে টেনে নেবেন।
জাফর বাধা দিয়ে বলে, তা হয় না হাসান। তুমি ক্ষান্ত হও।
এ ছাড়া আর কিছুই সম্ভব নয় মালিক। আপনাকে তৃপ্ত করতে পারাই একমাত্র লক্ষ্য আমার। আপনি আর না’ করবেন না। আমি আপনার শাদীর ব্যবস্থা করছি।
জাফর বলে, আমি মুসাফীর। শাদীর দেনমোহর কোথায় পাবো এখানে? হাসান বলে, সে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার প্রচুর অর্থ আছে, আমি দেব আপনাকে। ঋণ নয়, দান নয় এ আমার অতিথি সৎকারের দক্ষিণা আপনাকে গ্রহণ করতে হবে।
হাসান তার শ্বশুরকে সমস্ত খুলে বললো। সব শুনে সে জামাতাকে নানা ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাসান তার সিদ্ধান্তে অবিচল হয়ে রইলো।
সুতরাং অনন্যোপায় হয়ে শ্বশুর রাজি না হয়ে পারলো না। সেইদিনই হাসান তার বিবিকে তিন তালাক দিয়ে দিলো। তার তিনদিন পরে সকলের অগোচরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে তার তালাক দেওয়া বিবির সঙ্গে জাফরের শাদী হয়ে গেলো।
হাসান বললো, আপনার বিবিকে নিয়ে আপনি কি এখানেই থাকবেন, না বাগদাদে ফিরে যাবেন।
জাফর বললো, আমি খলিফার উজির, এখানে বসে থাকলে তো চলবে না ভাই। আমাকে এখনি দেশে ফিরতে হবে।
হাসানই যাত্রার সব ব্যবস্থা করে দিলো। নতুন বিবিকে সঙ্গে করে বাগদাদের পথে রওনা হয়ে গেলো সে।
কয়েকদিনের মধ্যে বাগদাদে এসে পৌঁছলো জাফর। সংবাদ পেয়ে খলিফা স্বয়ং নিজে দেখা করতে এলেন জাফরের সঙ্গে। বিলম্বের কারণ কী, জানতে চাইলেন। তখন জাফর তার দামাসকাস সফরের আদ্যোপান্ত কাহিনী শোনালো খলিফাকে। সব শুনে হারুন অল রসিদ গম্ভীর হয়ে ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, না-না, জাফর কাজটা ভালো করনি মোটেই। যে তোমাকে এতো আদর অভ্যর্থনা করেছে, তার ঘরের বিবিকে বেহাত করে নিয়ে আসা তোমার মত বিচক্ষণ বিবেচক ব্যক্তির উচিত হয়নি জাফর। আমার ইচ্ছা যার জিনিস তাকে তুমি ফেরত পাঠিয়ে দাও।
জাফর বললো, আপনার হুকুম শিরোধার্য, জাঁহাপনা। কিন্তু এখনই আমি আবার দামাসকাসে যাবো কি করে? তার চেয়ে বরং হাসানকে আমি ডেকে পাঠাই। ও এলে ওর হাতে তুলে দেব ওর বিবিকে। যতদিন সে এসে না পৌঁছয় ততদিন মেয়েটি আমার হেফাজতেই থাক।
এদিকে জাফরকে বিদায় দেবার পর সারা দামাসকাস শহরে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো, যিনি এসে হাসানের মেহেমান হয়েছিলেন তিনি আর কেউ নয় স্বয়ং খলিফার উজির জাফর। জাফরের সঙ্গে হাসানের যা দোস্তি হয়েছে তাতে নায়েবের নায়েবী আর বেশি দিন থাকবে না। খুব শিগ্নিরই বাগদাদ থেকে ফরমান আসবে হাসানকে নায়েব করার। সে-ই পরবর্তী নায়েব হবে, সে বিষয়ে কারো আর সন্দেহ রইলো না।
কথাটা ঘুরতে ঘুরতে একসময়ে নায়েবের কানে গেলো। রেগে আগুন হয়ে সে সিপাইদের হুকুম করলো, লোকটাকে বেঁধে নিয়ে এসো আমার সামনে।
হাসানকে দেখামাত্র নায়েব গর্জে উঠলো, শয়তান বদমাইশ, তোমার পেটে এতো বুদ্ধি। আমাকে গদি থেকে নামাতে চাও? তোমার নায়েব হওয়ার সাধ হয়েছে। দাঁড়াও সাধ তোমার মিটিয়ে দিচ্ছি।
নায়েব হুকুম দিলো, লোকটার গর্দান নাও।
নায়েবের সিপাইরা হাসানের অঙ্গবাস ছিঁড়ে-খুঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিলো। কালো কাপড় দিয়ে চোখ দুটো কষে বেঁধে দিলো ওরা। তারপর তরবারী উদ্যত হলো হাসানের ধড়মুণ্ডু আলাদা করার জন্য। এই সময় এক আমির নায়েবকে পরামর্শ দিলো, আমার মনে হয় তাড়াহুড়ো করে এখনি এ কাজটা না করাই ভালো। হাজার হলেও সে উজির জাফরের দোস্ত। এর ফল কী শুভ হবে আপনার পক্ষে? আপনাকে যারা একাজে উৎসাহ দিচ্ছে, আপনি ভেবে দেখুন, তারা আপনার বন্ধুরূপী শত্ৰু ছাড়া কিছু নয়। এও ঠিক, আজ হোক কাল যোক আপনার এই কার্যকলাপ জাফরের কর্ণগোচর হবেই। তখন তার ঠেলা কি সামলাতে পারবেন আপনি? সেদিন যদি আপনার ঘাড় থেকে মাথা নেমে যায় তখন কি আপনার এইসব শুভানুধ্যায়ীরা ঠেকাতে পারবে?
রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
নয়শো দুইতম রজনী :
আবার সে বলতে থাকে–
আমিরের কথায় চৈতন্য হলো ক্রোধ-উন্মত্ত নায়েবের। তৎক্ষণাৎ সে জাদকে অসি সংবরণ করতে বললো, থাক, এখন থাক। ওকে বরং ফাটকে আটক রাখ।
হাসানের পায়ে শিকল বেঁধে শহরের পথ দিয়ে হিড়হিড় কর টানতে টানতে নিয়ে চললো সিপাইরা। সারা দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ তুললো হাসান। কিন্তু কে শোনে তার কান্না? অন্ধকার কারাকক্ষে হাসানকে নিক্ষেপ করলো তারা।..
প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় কয়েকটা শুকনো রুটি আর খানিকটা জল দিয়ে যায় প্রহরী। তাই খেয়ে হাসান দিন কাটায়। আর আল্লাহর কাছে আকুল হয়ে আবেদন জানায়, তুমি তো জান প্রভু, জীবনে কখনও আমি কারো অনিষ্ট চিন্তা করিনি। তবে—তবে কেন এ শাস্তি বিধান করলে আমার জন্য।
খোদাতালা বোধহয় নিরপরাধ হাসানের আবেদন শুনছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় যথারীতি খানাপিনা রেখে গেছে। হাসান লক্ষ্য করলো লোকটা রোজকার মতো ফটকের দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গেছে।
রাত্রি গভীর হয়ে এলো। সবাই যে যার মতো নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু হাসানের চোখে ঘুম নাই। সদরের প্রহরীটা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত পায়চারী করে পাহারা দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে, পাহারাদার অন্য প্রান্তে চলে যেতেইটুক করে সে দরজা ঠেলে বেরিয়ে পড়েই গুটি গুটি এপাশ ওপাশ কাটিয়ে বেমালুম সটকে পড়তে পারলো।
বাকী রাতটা গা-ঢাকা দিয়ে কাটিয়ে দিলো হাসান। তারপর ভোরে শহর প্রান্তের প্রধান ফটক খোলামাত্র আর পাঁচজন পথচারীর ভিড়ে গা ভাসিয়ে দিয়ে শহরের বাইরে বেরিয়ে এলো সে।
এরপর আর পিছনে নয়, সোজা সে আলেন্সের পথে ছুটে চলতে থাকলো! বহু কষ্টে অনেক পথ পার হয়ে এক সময় আলেঙ্গীতে এসে পৌঁছাল হাসান। সেখানে একদল বাগদাদ যাত্রীর দেখা পেয়ে তাদের দলে ভিড়ে গেলো সে।
একটানা কুড়িটা দিন চলার পর অবশেষে বাগদাদ শহরে এসে পৌঁছতে পারলো। যাক, এতদিনের দুঃখ-কষ্টের অবসান হবে তার। এখানকার খলিফার দরবারের প্রধান উজির তার প্রাণের বন্ধু। সে নিশ্চয়ই হাসানকে বুকে টেনে নেবে।
পথচারীদের জিজ্ঞেস করে করে জাফরের প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ালো হাসান। ফটকের প্রহরী হাসানের দীন ভিখিরির মতো ছিন্ন-ভিন্ন সাজ-পোশাক দেখে তাকে দূর করে দিতে চাইলো, এই ব্যাটা কে তুই? সদরে ঢুকতে চাস কোন সাহসে? জানিস এটা কার প্রাসাদ।
হাসান বিনীত কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ ভাই জানি, উজির জাফর বারমাচীর প্রাসাদ। তবে? কী মতলবে ঢুকতে চাস? ভাগ—
হাসান বলে, বিশ্বাস কর, কোনও বদ মতলব আমার নাই। শুধু একবার তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
-বামন হয়ে দেহাত! তুই একটা রাস্তার ভিখিরি, খলিফার পেয়ারের উজির সাহেব তোর সঙ্গে দেখা করে ধন্য হয়ে যাবে ভেবেছিস নাকি? যা ভাগ শিগ্নির, নইলে মেরে হাড় ভেঙ্গে দেব।
শুধু মুখের কথা নয়, সত্যি সত্যিই লোকটা একটা পোত্তা বসিয়ে দিলো হাসানের পিঠে। নিরুপায় হয়ে হাসান আবার পথে নামলো। সামনেই একটা কাগজের দোকান দেখতে পেয়ে দোকানীর কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়ে জাফরকে উদ্দেশ করে। একখানা চিঠি লিখলো সে।
ও দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগলো।
জাফর ভাই,নসীবের ফেরে আজ আমি সর্বহারা। অত্যাচারিত হয়ে তোমার দরজায় এসেছি। যদি মেহেরবানী করে একটিবার দর্শন দাও বড় ভালো হয়।
তোমার ভাই এরপর আবার সে ফিরে এলো জাফরের প্রাসাদ-প্রহরীর সামনে। চিঠিখানা তার হাতে দিয়ে বললো, যদি একবার তার কাছে পৌঁছে দাও ভাই, খুব উপকার হয়।
চিঠিখানায় চোখ বুলিয়ে রাগে ফেটে পড়লো প্রহরী, কী এতবড় সাহস তোর, উজীর সাহেব তোর ভাই?
এই বলে সে বেদম প্রহার করতে লাগলো হাসানকে। মারের চোট সামলাতে না পেরে হাসান লুটিয়ে পড়লো পথের ধূলোয়। সারা অঙ্গ কেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগলো।
এই দৃশ্য দেখে অন্য এক প্রহরী ছুটে র এলো ফটকে, আহা বেচারাকে অমন হু করে মারছো কেন? মরে যাবে যে মারবো না, এই রাস্তার ভিখিরিটা বলে কি না সে উজির জাফরের ভাই, এতবড় আস্পর্ধা—
দ্বিতীয় প্রহরী বলে, তাতে দোষ কী, সব মানুষই সব মানুষের ভাই। এই তো খোদার বিধান!
তারপর হাসানকে হাতে ধরে তুলে দাঁড়িয়ে সে বললো, কী তোমার প্রয়োজন, বলো তো ভাই।
হাসান বলে, এই চিঠিখানা শুধু জাফর ভাই-এর হাতে পৌঁছে দাও, আর কিছু চাই না আমি। দ্বিতীয় প্রহরী বলে, ঠিক আছে তুমি দাঁড়াও এখানে, আমি এখুনি তাকে দিচ্ছি তোমার চিঠি।
লোকটা অন্দরে চলে গেলো।
জাফর তখন তার ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে বসে মৌতাত করছিলো। সাঙ্কী ঢেলে দিচ্ছিল সরাব। সুন্দরী বাদী সুললিত কণ্ঠে গান গেয়ে চলেছে। আর জাফর জাঁকিয়ে জীবনের পরম অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাচ্ছে বন্ধুদের। সেই দামাসকাস বাসের সুখস্মৃতির দিনগুলোর কাহিনী।
জাফর বলছিল, হাসান আমার ভাই, হাসান আমার বন্ধু, তার মতো সৎ মহান মানুষ সারাজীবনে আমি আর দু’টি দেখিনি। আমি কেন, বাজি রেখে বলতে পারি, কেউই দেখেনি। হাসানের মতো উদার মহৎ প্রাণ তামাম দুনিয়ায় আর দুটি আছে কিনা সন্দেহ।
জাফর কথা শেষ করে বেশ বিরক্ত হয়েই প্রহরীর দিকে তাকালো, কী, কী ব্যাপার! তোদের কি সময় অসময় জ্ঞান নাই। যখন তখন এসে মৌতাতটা মাটি করে দিবি।
প্রহরী চিঠিখানা বাড়িয়ে দিলো জাফরের দিকে। জাফর চিঠিখানা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলালো। কিন্তু মদের নেশায় তখন সে অন্য জগতের মানুষ, অতটা তলিয়ে দেখতে পারলো না। চাইলোও না। চিঠিখানার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে এক রকম প্রায় ক্ষিপ্তই হয়ে উঠলো সে।
-কী খাতা নিয়ে এসেছিস, মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। হাতের পেয়ালাটা সে ছুঁড়ে মারলো দেওয়ালে। মুহূর্তে টুকরো হয়ে গেলো। একখানা টুকরো ছিটকে এসে লাগলো জাফরের কপালে। কেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। হাতের চিঠিখানা ছুঁড়ে দিয়ে কপালটা দুহাতে চেপে ধরলো জাফর। ক্রোধ এবার শতগুণ হয়ে গর্জে উঠলল, এই ঘোড়ার ডিমের চিঠিখানার জন্যই এমনটা ঘটলো। যা ঐ লোকটাকে এখুনি গিয়ে পাঁচশো ঘা বেত লাগিয়ে কোতোয়ালের হাতে তুলে দে। কয়েদ করে রাখুক ওকে।
– উজিরের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হলো। বেত্রাঘাতে জর্জরিত হলো হাসানের দেহ। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো সারা অঙ্গ। কোতোয়াল তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলো।
দু’টি মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। হাসান কারাগারে পচছিলো। হঠাৎ একদিন কোতোয়াল এসে কয়েদখানার সমস্ত বন্দীকে খালাস করে দিয়ে বললো, যা তোদের বরাত ভালো ছাড়া পেয়ে গেলি। খলিফা পুত্রসন্তান লাভ করেছে। সেই উপলক্ষে তোদের রেহাই করে দিয়েছেন তিনি।
ছাড়া পেয়ে হাসান আরও সমস্যায় পড়লো। সে এখন কোথায় যাবে কী খাবে? নিজের দেশ বিশ দিনের পথ। সেদিকে রওনা হলে পথেই মরে পড়ে থাকবে সে। কিন্তু এই বিদেশী শহর বাগদাদে সে বাঁচার মতো রুটি জোগাড় করবে কী করে? ভিক্ষা? কিন্তু সে পরদেশী, তাকে তো এ শহরে ভিক্ষে করতে দেবে না কেউ। তবে? তবে কী উপায় হবে।
সারাটা দিন সে শহরের এক মসজিদ-প্রাঙ্গণে বসে নানাভাবে প্রাণে বেঁচে থাকার উপায় উদ্ভাবন করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনুই কূল কিনারা করতে পারলো না।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।
মসজিদে রাত্রিবাস নিষিদ্ধ। একমাত্র আল্লাহর উপাসকরাই সেখানে অবস্থান করতে পারে। সুতরাং রাতের মতো কোনও একটা ডেরায় চলে যেতে হবে তাকে।
হাসান মসজিদ থেকে বেরিয়ে শহর-প্রান্তের একটা পোড়া বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়িটায় কোনও জনমানুষ বাস করে না। একেবারে পরিত্যক্ত। সে ঠিক করলো রাতটা এই বাড়ির মধ্যে কোনও রকমে কাটাবে।
অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ একটা মানুষের দেহে হাত ঠেকতে চমকে উঠলো, হাসান। একি, একটা লোক, সারা দেহে রক্ত কেন এতো? তবে কি কেউ একে খুন করে রেখে গেছে? একখানা রক্তমাখা ভোজালী পায়ে ঠেকলো। ভয়ে শিউরে উঠলো হাসান।
ইতিমধ্যে হাসানের হাত রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। সেই হাত সে তার অঙ্গের পোশাকে মুছলো।
এ অবস্থায় কী করা উচিত ভাবতে থাকে হাসান। শেষে ঠিক করলো ঝামেলায় জড়ানোর চেয়ে পথে বেরিয়ে পড়াই শ্রেয়। কিন্তু পথে আর বেরুনো হলো না তার। মশালের আলো দেখে চমকে উঠলো সে!
কয়েকজন সিপাই ঢুকে পড়েছে সেখানে। হাসানের রক্তমাখা পোশাক, মৃত মানুষের লাস এবং ভোজালীখানা দেখে তাদের বুঝতে অসুবিধে হলো না খুনী কে?
-এ্যাঁই বদমাশ, বল, কেন একে খুন করেছিস? হাসানের পিঠে ডাণ্ডার বাড়ি পড়লো। একথার কী জবাব দেবে হাসান? আর দিলেই বা বিশ্বাস করবে কে? বিশ্বাস করার মতো ব্যাপার তো নয়।
আবার কারাগার। কিন্তু মাত্র একটি রাতের জন্য। পরদিন সকালে কোতোয়াল উজির জাফরের সমীপে গত রাতের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিলো। এবং বললো মুজরিমকে আমি ধরে ফাটকে রেখেছি, হুজুর। এখন আপনি বিচার করে বলুন কী করতে হবে।
জাফর দ্বিধা না করে বললো, গর্দান নেবে লোকটার।
দরবারের সময় হয়ে এসেছে। জাফর প্রাসাদ অভিমুখে চলেছে। চৌমাথার কাছে আসতে হাজার লোকের জমা দেখে জাফর অবাক হয়ে ভিড়ের কাছে এগিয়ে গেলো। কোতোয়াল তখন ঘাতককে হুকুম দিচ্ছিল মুজরিমকে দাঁড় করিয়ে তার চোখ বেঁধে দাও, তারপর আমার ইশারা পাওয়া মাত্র মুণ্ডু নামিয়ে দেবে এক কোপে।
হাসানের চোখ বাঁধা শেষ, এবার জহ্লাদ তরবারী বাগিয়ে ধরে কোতোয়ালের ইশারার অপেক্ষায় অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এমন সময় জাফর এগিয়ে এসে কোতোয়ালকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার, এখানে এতো জমায়েত কেন?
কোতোয়াল কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, কালকের রাতের ঐ খুনীটাকে কোতল করা হচ্ছে হুজুর। জাফর বললো দাঁড়াও একটুখানি সবুর কর। আমি লোকটাকে একবার দেখতে চাই।
জাফর এগিয়ে যেতেই উৎসুক জনতার ভীড় সরে গেলো। আসামীকে প্রত্যক্ষ করলো জাফর।
—কে তুমি? মনে হচ্ছে পরদেশী? হাসান নয় কোতোয়াল জবাব দেয়, জী হুজুর, লোকটা দামাসকাস থেকে এসেছে! কাল রাতে এই লোকটাই একটি যুবককে খুন করেছে। হাতে নাতেই ধরেছে আমার লোক। কিন্তু ব্যাটার মুখ থেকে একটি বাতও বের করতে পারা যায়নি! বলবে কী, বলার আছেই বা কী। সাক্ষী প্রমাণ তত ওর পোশাক-আশাকেই দেখতে পাচ্ছেন, হুজুর।
জাফর কিন্তু হাসানকে চিনতে পারলো না। কি করেই বা পারবে। যে হাসানকে দেখেছিলো সে, এ হাসান তো তার প্রেতাত্মা। এমন দীনহীন ক্লিষ্ট চেহারা তার হতে পারে জাফর ভাববে কী করে?
-তোমার দেশ কোথায়? জাফর প্রশ্ন করে। হাসান বলে, দামাসকাস।
—সদর শহরে, না গ্রামাঞ্চলে?
-শহরেই।
-আচ্ছা সেখানে হাসান নামে কোনও ব্যক্তিকে তুমি চেন? সেখানকার প্রতিটি মানুষ হাসানকে চেনে। তার মতো উদার মহৎ অতিথিপরায়ণ দয়ালু ব্যক্তি খুব একটা জন্মায় না জগতে।
আপনি যখন দামাসকাসে তার আতিথ্যে কাটিয়েছিলেন তখন আমি তাকে চিনতাম বই কি। যখন আপনারা দু’জনে প্রাণের দোস্ত হয়ে তার বাগানের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন তখন আমি তাকে চিনতাম। যখন সে আপনাকে খুশি করার জন্য তার নিজের বিবিকে তালাক দিয়ে আপনার সঙ্গে শাদী দিয়েছিলো তখন আমি তাকে ভালো করেই চিনতাম। সে যখন আপনাকে বিদায় জানাতে আলেন্সো পর্যন্ত সঙ্গে এসেছিলো তখন আমি তাকে অবশ্যই চিনতাম। আর সেই সব স্মৃতি সুখকর মধুর মুহূর্তগুলি যা একই মদের পেয়ালার চুমুক দিয়ে মূর্ত হয়েছিলো তখন আমি হাসানকে ভালো করেই চিনতাম।
জাফর বলে, আচ্ছা বলতে পার, আমি চলে আসার পর হাসান ভাই কেমন ছিলো বা এখন সে কেমন আছে, কোথায় আছে।
হাসান বলে, মালিক, ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে আজ সে অত্যাচারিত। প্রাণভয়ে সে স্বদেশ পরিত্যাগ করে এই বাগদাদ শহরে এসেছিলো একটু আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু বিধি বাম, তার কপালে আর সুখ ছিলো না, তাই সে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আজ ফাঁসীর আসামী হয়েছে। নিয়তির লেখা কে খণ্ডন করতে পারে বলুন।
এর পরও জাফর যখন চিনতে পারলো না, তখন হাসান চিৎকার করে উঠলো, জাফর ভাই এখনও কি তুমি আমাকে ইয়াদ করতে পারছ না?
এতক্ষণ সংশয়ে দোলায় দুলছিলো জাফর। হাসানের চিৎকারে সব স্বচ্ছ হয়ে গেলো তার চোখের সামনে। হাসানকে সে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিতে থাকলো।
সে কি অভূতপূর্ব দৃশ্য। কে বর্ণনা দিতে পারে তার?
এই সময় একটি প্রৌঢ় লোক জাফর-এর সামনে এসে স্বীকার করলো, গত রাত্রে যে ছেলেটি খুন হয়েছে তার জন্য সেই একমাত্র দায়ী। এই ব্যক্তির কোনও অপরাধ নাই। সুতরাং একে ছেড়ে দিয়ে যা সাজা দেবার আমাকে দিন, হুজুর।
জাফর বললো, এমন নৃশংস কাজ করেছ, তোমার কী ধর্মের ভয় মনে জাগেনি।
প্রৌঢ় বলে, ঐ ছেলেটি প্রতিদিনই আমার যা-কিছু রোজগার কেড়ে-কুড়ে নিয়ে নিত। তা নিক, তাতেও আমার তেমন দুঃখ ছিলো না। কিন্তু হুজুর ঐ পয়সা নিয়ে সে জুয়া খেলতো, মদ খেত, মেয়েমানুষের কাছে যেত। এসব আমি বরদাস্ত করতে পারতাম না। কিন্তু কিছুতেই দাঁও পাচ্ছিলাম না। কাল সন্ধ্যায় ওকে বেকায়দায় পেয়ে আমি আমার জ্বালা জুড়িয়েছি হুজুর। এতো বড় পাপ জিন্দা থাকা উচিত নয় বলে আমার মনে হয়েছিলো, তাই আমার নিজের ঔরসের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আমি ওর জান খতম করেছি।
জাফর ভাবলো ক্ষণকাল। তারপর বললো, যাও তোমাকে রেহাই দেওয়া হলো। কারণ মামলা শুনে আমার মনে কিছু সংশয় জেগেছে। সন্দেহবশে কাউকে সাজা দেওয়া উচিত মনে করি না। সত্যিই যদি তোমার কিছু অপরাধ ঘটে থাকে, আল্লাহ তার নিখুঁত বিচার করবেন।
প্রৌঢ় চলে গেলে হাসানকে সঙ্গে নিয়ে জাফর হামামে গেলো। খুব ভালো করে গোসলাদি করিয়ে নতুন সাজ-পোশাক পরিয়ে খলিফার সামনে এনে হাজির করলো।
ধর্মাবতার, এই সেই মহানুভব হাসান। এর কথাই আপনাকে আমি বলেছিলাম।
খলিফা হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু তোমাকে এমন কৃশ এবং অসুস্থ মনে হচ্ছে কেন?
এই কথায় কেঁদে ফেললো হাসান। তার ভাগ্য-বিড়ম্বনার আদ্যোপান্ত সমস্ত কাহিনী বিবৃত করলো সে। খলিফা এবং জাফর হতবাক হয়ে শুনলো সব। খলিফা বললেন, ঐ নায়েবটাকে গ্রেপ্তার করে হাজির কর আমার সামনে। আমি ওকে উচিত শিক্ষা দেব।
উজিরকে উদ্দেশ করে বললেন, এর কি বিষয়-আশয় দেনা-পাওনা ছিলো সেখানে?
জাফর বললো, আমি ব্যক্তিগতভাবে এর কাছে তিরিশ লক্ষ দিনার ঋণী। সে টাকা অমি ওকে দিয়ে দিচ্ছি আজই। আর ওর প্রিয়তমা বিবি যে আমার কাছে অক্ষত অবস্থাতেই আছে তাকেও তুলে দেব এর হাতে।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
নয়শো চারতম রজনী। আবার সে বলতে শুরু করে :
খলিফার আদেশে দামাসকাসে এক সেনাপতিকে পাঠানো হলো। নায়েবকে বন্দী করে হাজির করা হলো তার সামনে। খলিফা হুকুম দিলেন, লোকটাকে কারাগারে নিক্ষেপ কর।
এরপর বহুদিন বাগদাদে সুখ-বিলাসের মধ্যে অতিবাহিত করার পর হাসান তার নিজের দেশ দামাসকাসে নায়েবের পদে বহাল হয়ে চলে গেলো।
বিচারে আগের নায়েবের প্রাণদণ্ড হলো।
শাহরাজাদ গল্প শেষ করে বললো, এরপর, জাঁহাপনা, আপনাকে শাহজাদা হীরার কাহিনী শোনাবো।
শাহরাজাদ বলতে থাকে—