একদিন এক সুলতান তার দোতলার খোলা ছাদের উপর বসে মুক্তবায়ু সেবন করেছিলেন। উপরে নীল আকাশ। সামনে বাগিচা-সহস্র ফুলের বর্ণাঢ্য সমারোহ। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
হঠাৎ অন্য বাড়ির ছাদের অপর প্রান্তে দণ্ডায়মান এক অলোক-সামান্যা সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে সুলতান অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন রূপসী নারী ইতিপূর্বে তিনি কখনও দেখেন নি। আশে পাশের তাঁবেদারদের জিজ্ঞেস করলেন সুলতান, ও বাড়িটা কার হে?
জী হুজুর, আপনার দাসানুদাস নফর ফিরুজের। আর ঐ রমণীটি ওর বিবি।
সুলতান টলতে টলতে নিচে নেমে গেলেন। যেন এক মদমত্ত মাতাল। ফিরুজকে ডেকে বললেন, তোমাকে আজই এক্ষুণি আমার খৎ নিয়ে পাশের কয়েকটা দেশে যেতে হবে, তৈরি হয়ে নাও।
ফিরুজ তৎক্ষণাৎ কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, বান্দা প্রস্তুত, জাঁহাপনা।
চিঠিপত্র বুঝে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো ফিরুজ। সে রাতটা সে বিবিকে নিয়েই ঘুমালো। তারপর পরদিন খুব সকালে উঠে বিদেশ রওনা হয়ে গেলো।
ফিরুজ চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই সুলতান ছদ্মবেশ ধারণ করে ফিরুজের দরজায় এসে করাঘাত করলেন।
কে?
অন্দর থেকে ফিরুজের বিবির প্রশ্ন আসে।সুলতান জবাব দেন,দরজা খোলো। আমি তোমার স্বামীর মনিব।
দরজা খুলে দেয় ফিরুজ বিবি। সুলতান ঘরে ঢুকে একখানা কুর্শিতে বসলেন।
—আমি বেড়াতে এলাম তোমাদের বাড়িতে। সুলতানের কথায় ফিরুজ বিবি প্রসন্ন হতে পারে না। বলে, আমার স্বামীর অবর্তমানে আপনার আগমনে আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি। আমার আশঙ্কা এর দ্বারা কোনও শুভ হতে পারে না।
সুলতান আকুল হয়ে বলে, তুমি বুঝতে পারছ না কেন সুন্দরী, আমি তোমার স্বামীর মনিব, তোমাদের অন্নদাতা! মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে আন্দাজ করতে পারছে না বোধহয়!
মেয়েটি কিন্তু এবার কঠিন কণ্ঠে জবাব দিলো, না হুজুর, আমি আপনাকে বিলক্ষণ চিনতে পেরেছি। সেদিকে আমার একবিন্দু ভুল হয়নি। কিন্তু কিছুতেই আমি বুঝে উঠতে পারছি না, কেন আপনি এসেছেন আমার ঘরে? কী আপনার অভিপ্রায়? জাঁহাপনা, আপনি ঝরনার এঁটো পানি গণ্ডুষ ভরে পান করতে অভিলাষী?
সুলতান হতবাক হয়ে গেলেন ফিরুজবিবির কথায়। আর একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারলেন না। যেমন এসেছিলেন তেমনই ক্ষিপ্রবেগে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পায়ের জুতোজোড়াও পরে নিতে ভুল হয়ে গেলো তার।
কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর হঠাৎ ফিরুজের খেয়াল হলো রাত্রে শোবার সময় সুলতানের চিঠিপত্রগুলো সব বালিশের তলায় রেখে দিয়েছিলো, তাড়াহুড়ো করে বেরুবার সময় সেগুলো সঙ্গে নিতে সে ভুলে গেছে।
সুতরাং আবার তাকে ফিরতে হলো।
বিদেশযাত্রার ইনাম স্বরূপ একশো স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলেন সুলতান। ফেরার পথে বাজার থেকে ঐ মুদ্রায় একটি সুন্দর জড়োয়া হার কিনে নিলো সে বিবির জন্য। গহনাটা দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেছে। বিবির গলায় পরিয়ে দিলে নিশ্চয়ই সে আল্লাদে ঢলে পড়বে তার বুকে।
এই রকম নানা সুখচিত্র আঁকতে আঁকতে সে একসময় বাড়িতে ফিরে এলো। বিবির গলায় হারটা পরিয়ে দিয়ে বললো, ওহহ, বেহেস্তের পরীর মতো লাগছে তোমাকে বিবিজান। কিন্তু এমন দামী গহনা আর তোমাকে এ বাড়িতে একা রেখে বিদেশ যেতে আমার সাহস হচ্ছে না গো। তুমি এক কাজ কর, আমি যদ্দিন না ফিরি তোমার বাবার কাছে গিয়ে থাক। সরকারী কাজ, ফিরতে কত দেরি হবে কে জানে। অতদিন তুমি এ বাড়িতে একা থাক, আমি চাই না। চারদিকে লোভী কুকুরের দল ঘুরঘুর করছে। ফিরুজ বিবি বলে তা মন্দ বলনি। বাবাকে অনেক কাল দেখিনি। এই এ সুযোগে তার কাছে ক’দিন বেড়িয়ে আসা যাবে।
যাবার পথে ফিরুজ বিবিকে তার বাবার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বিদেশ রওনা হয়ে গেলো।
গোটা একটা মাস কেটে যায়। কিন্তু ফিরুজ ফিরে আসেনা এবং কোনও খবর পাঠায় না।
অবশেষে ফিরুজের শ্যালক সন্ধান করতে করতে এক শহরে ভগ্নিপতির সন্ধান পেলো। কিন্তু ফিরুজ তখনও ঘরে ফিরতে নারাজ দেখে সে জানতে চাইলো, আসল ব্যাপারটা কি বলতো, ভাইসাব। মনে হচ্ছে আমার বহিনের সঙ্গে তোমার যেন বনিবনাও-এর অভাব ঘটেছে? কেন, কী কারণে তোমার গোসা হয়েছে, আমাকে খুলে বলবে?
তবু তাকে নিরুত্তর দেখে আবার শ্যালক বললো, ঠিক আছে আমাকে বলতে না চাও বলো না। কিন্তু দেশে ফিরে চলো, সুলতানের দরবারে পেশ কর তোমার আর্জি। তিনি ন্যায্য বিচার করে দিতে পারবেন।
ফিরুজ বলে, তোমাদের যদি অভিপ্রায় জাগে তোমরা এ নিয়ে সওয়াল করতে পার। কিন্তু আমি কোনও জবাব দিতে পারবো না।
এবার শ্যালকটি রাগে ফেটে পড়ে। ঠিক আছে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে যদি তোমার অহঙ্কারে বাধে, আমি কোনও প্রশ্ন করবো না তোমাকে। কিন্তু কী কারণে আমার নিরীহ নিরপরাধ বোনটিকে পরিত্যাগ করবে, সুলতানের দরবারে তার জবাবদিহি তোমাকে করতেই হবে, ফিরুজ।
সুলতান সভা পরিষদ পরিবৃত হয়ে দরবারে বসেছিলেন। এমন সময় শালা ভগ্নীপতি হাজির হলো সেখানে। আভূমি অবনত হয়ে কুর্নিশ জানালো দু’জনে।
শ্যালকটি যখন জানালো, তার বোনের প্রতি অকারণে বিরূপ হয়েছে ফিরুজ। তার জন্য সে সওয়াল জবাব প্রার্থনা করছে, তখন সুলতান বললেন, দরবারে কাজী হাজির আছে, তোমাদের অর্জি তার কাছে পেশ কর।
তখন শ্যালকটি যুক্তকরে কাজীকে উদ্দেশ্য করে নিবেদন করলো। আপনি আমাদের পুণ্যাত্মা জাঁহাপনার ন্যায়াধিকার। অধীনের বিনীত নিবেদন এই :
আমাদের এক সুন্দর ফুলবাগিচা ছিলো। চারদিক ঘেরা, সুদৃঢ় সুরক্ষা ছিলো। সযত্নে লালন করেছি তাকে। বহু বিচিত্রবর্ণের ফুলের সুবাসে সদাই ভরপুর হয়ে থাকতো। কিছুকাল আগে এই যুবকের হাতে সে বাগিচা রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পণ করা হয়েছিলো। কিন্তু অতি অল্প কালের মধ্যেই ঐ বাগিচার সব ফুল আহরণ করে নিয়েছে এ। সব ফল ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। এখন তা বলতে গেলে, নিঃস্ব রিক্ত হয়ে পড়ে আছে। দেখে মনে হয় কোনও এক কালবৈশাখীর তাণ্ডবে সব যেন বিধ্বস্ত তছনছ হয়ে গেছে। এখন এই যুবক তার শর্ত ভেঙ্গে ফেলে ঐ রিক্ত বাগিচা ফেরত দিতে উদ্যত হয়েছে। আমাদের দাবি ফেরত দাও আপত্তি নাই। কিন্তু যেমন কচিকাঁচা সুন্দর সবুজটি দিয়েদিলাম ঠিক তেমনটি চাই।
কাজী জিজ্ঞেস করে, এবার তোমার কী বলার আছে যুবক?
ফিরুজ জবাব দেয়, আমি রাজি হুজুর। ফুলবাগিচাটি যে অবস্থায় পেয়েছিলাম, তারও চেয়ে ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে দেব আমি।
কাজী প্রশ্ন করলো, তোমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কি তুমি স্বীকার কর?
—বিলকুল না, হুজুর। আমি ফিরে তাকে প্রশ্ন করতে চাই, কেনই বা সে ঐ বাগিচা ওয়াপশ নিতে চায়। আমি ঐ বাগিচায় প্রবেশ করতে এখন ভীত শঙ্কিত। কারণ একদা এক অসতর্ক মুহূর্তে এক প্রবল বিক্রম সিংহ সেখানে প্রবেশ করেছিলো। আমার আশঙ্কা, আবার সে কখনও বা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি সামান্য হীনবল মানুষ, সিংহের থাবার সঙ্গে লড়বো কি করে? সেই কারণে নিজের অধিকার আঁকড়ে না থেকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি ওটা ফিরিয়ে দিতে চাই।
এই সময় রাত্রি ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো চুরানব্বইতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?
এতক্ষণ সুলতান সবই শুনে যাচ্ছিলেন। এবার তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফিরুজ আমি তোমাকে ইসলামের নামে শপথ করে বলেছি, তোমার বাগিচা নির্মল পবিত্র। আজ পর্যন্ত কেউ তার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। অমন সুরক্ষিত সুরভিত ফুলবাগিটা আমার সারা সলতানিয়তে আর দু’টি নাই। মনে কোনও সন্দেহ অবিশ্বাস পুষে রেখ না। ও বাগিচার ফুল ফল লতাপাতায় একমাত্র তোমারই অধিকার। অন্য কেউ শত চেষ্টা করেও তার একটি পাপড়ি ছিঁড়তে পারবে না। আমি তোমাকে ভরসা দিচ্ছি, নিঃশঙ্ক নির্ভয়ে তুমি তোমার বাগানের মালী হয়ে থাকতে পার।
সুলতানের ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না ফিরুজের। খুশি মনে সে বিবির কাছে ফিরে যায়।
কিন্তু না কাজী, না উজির আমির কেউই আসল ঘটনা আঁচ করতে পেরেছিলো। শুধু জেনেছিলো সুলতান, ফিরুজ আর শ্যালক এই তিন ব্যক্তি মাত্র।
এ কাহিনীর এখানেই ইতি। কিন্তু শাহরাজাদ অন্য এক নতুন গল্প ফেঁদে বসলো!