এক সময়ে কাইরো শহরে এক সুদর্শন মেধাবী যুবক জন্মেছিলো। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তথাকার এক পুলিশ বাহিনীর সর্দারের বিবি তাকে ভালোবাসা করে রেখেছিলো। এই পুলিশ সর্দারের বীর্য এবং বিক্রম ছিলো অনন্যসাধারণ। তার পৌরুষ দেখে কাইরোর বিবি বেগমরা পাগল হয়ে উঠতো। কিন্তু সর্দারের নষ্টচরিত্রা বিবি এ হেন স্বামীসঙ্গ পেয়েও তৃপ্ত ছিলো না। উঠতি বয়সের জোয়ান ছেলে দেখলেই সে খলখল করে উঠতো। এবং যেন তেন প্রকারে তাকে শয্যাসঙ্গী করে নিত।
একদিন পুলিশ সর্দার গুজবাসি তার বিবিকে বললো, শোনও আজ আমরা কয় ইয়ার দোস্ত মিলে এক বাগানবাড়িতে বনভোজন করতে যাচ্ছি, ফিরতে কিছু রাত হতে পারে, সাবধানে থেক। যদি বিশেষ কোনও কারণে আমাকে তোমার প্রয়োজন হয় তবে চাকরটাকে বলো। সে জানে আমি কোথায় যাচ্ছি, আমাকে খবর দেবে।
গুজবাসি-বিবি এক গাল হাসি ছড়িয়ে বললো, তুমি যাচ্ছ ফুর্তি করতে, ঘরের ভাবনা মাথায় রেখ না, আমি তোমাকে কোনও কারণেই বিরক্ত করবো না, তাতে তোমার আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে তুমি যদি খানিকটা আমোদ আহ্লাদই কর সে তো আমারই করা হবে।
বিবির সোহাগে গদগদ হয়ে গুজবাসি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এবং প্রায় তক্ষুণি ভ্রষ্টা রমণীটি বাচ্চা নফরটাকে বললো, যা ছুটে যা, ওকে ডেকে নিয়ে আয় শিগ্নির। উফঐ বুনো শূয়ারটার হাত থেকে একটা বেলাও অন্তত নিষ্কৃতি পাওয়া গেছে।
খুদে খোজা নফরটা মালকিনের বাধ্য ছিলো। হুকুম পাওয়া মাত্র ছুটলো ছেলেটির বাড়িতে। কিন্তু সেখানে তাকে পেলো না সে। চাকরটা কিন্তু দমলো না। শহরের সম্ভাব্য জায়গাগুলো তল্লাশ করে করে ফিরতে লাগলো। অবশেষে তার দেখা পেলো সে এক নাপিতের দোকানে।
যুবক তখন মাথাটা বাড়িয়ে দিয়েছে নাপিতের ক্ষুরের নিচে। চাকরটাকে দেখেই তার সারা শরীরে এক শিহরণ খেলে যায়। সে বুঝতে পারে সংবাদ শুভ।
—আপনি আর দেরি করবেন না সাহেব, বাড়ি খালি। মালকিন আপনাকে এখুনি যেতে বলেছেন।
চাকরটা কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলো। যুবক অধীর হয়ে নাপিতকে বললো, আজ থাক শেখ, এখন আমাকে যেতে হবে।
নাপিত বলে, কিন্তু এ যে আধা খ্যাচড়া হয়ে রইলো!
যুবক বলে, তা থাক, কাল আসবোকাল বেশ মিল করে দিও। আজ আর দেরি করতে পারবো না, এক্ষুনি যেতে হবে আমাকে।
এই বলে সে গোটা একটা দিরহাম গুঁজে দিলো নাপিতের হাতে। তারপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নফরটাকে সঙ্গে নিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
না কামিয়েই গোটা একটা দিরহাম পেয়ে নাপিত-এর চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে।ওরে বাস, এ কোন আমির বাদশাজাদা এসেছিলো তার দোকানে। এমন মক্কেলকে তো হাতছাড়া করা চলে না। খদ্দেরটাকে খুশি রাখতে পারলে অনেক ইনাম মিলতে পারে।
সুতরাং আর কালবিলম্ব না করে নাপিতটা দোকান ফেলে যুবকের পিছু ধাওয়া করলো। উদ্দেশ্য তার বাড়িটা চিনে আসা। সময় মতো তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। খদ্দেরটা বাঁধা হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে যুবকটি গুজবাসির বাড়িতে এসে পৌঁছলো। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গুজবাসি-বিবি আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার হাত ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে যেতে ব্যস্ত হলো।
কেউ দেখে ফেলতে পারে এই ভেবে যুবকটি কিছুটা বিব্রত হয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই ঐ নাপিতটাকে রাস্তার ওপারে দণ্ডায়মান দেখে তাজ্জব হয়ে গেলো! এখানে সে এলো কী করে? কেনই বা এলো?
নাপিতটা কিন্তু হাত তুলে তাকে আদাব জানালো, খুদা হাফেজ, গরীবকে ইয়াদ রাখবেন মালিক। আমার দোকানে যাবেন আমি আপনাকে শাহজাদার মতো কামিয়ে দেব।
– নিশ্চয়ই যাবো। কালই যাবো। তোমার হাতের কাজ তো সারা শহরের লোক প্রশংসা করে। নিশ্চয়ই যাবো। তোমার দোকান ছাড়া আমি আর অন্য কোথাও কামাবোই না শেখ।
নাপিত বলে, পণ্ডিত ব্যক্তি বলে গেছেন, যে জায়গাটা তোমার মনের মতো হয়েছে সেটা ফেলে অন্য একটার ধান্দায় বেরিও না। আশা করি আপনি আমার দোকানটা চিনতে ভুল করবেন না।
যুবক তখন কাম-যন্ত্রণায় কাতর, কোনও রকমে নাপিতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। গলা চড়িয়ে বলে, তোমার দোকান তো আমার নখদর্পণে। আঁধার রাতেও চলে যেতে পারি। যাক, এবার তুমি এসো, কেমন?
নাপিতের মুখের সামনে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে।
দোকানে ফিরে না এসে নাপিতটা ঐখানে বসে পড়লো। এমন আমিরি খদ্দের কি হাত ছাড়া করতে পারে সে! আমার দোকানে ঢুকবে বলে হঠাৎ যদি আর-কোনও নাপিতের দোকানে ঢুকে পড়ে? তবে কি সে বাচোৎ ওকে ছেড়ে দেবে আর?
গুজবাসি যথাসময়েই বাগানবাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো। তার বন্ধু তাকে যথেষ্ট আদর অভ্যর্থনা করে বসিয়ে বললো, এমন দিনে তোমাকে ডাকলাম—একটু আমোদ-প্রমোদ করতে পারলাম, দোস্ত। কিছুক্ষণ আগে আমার মা ইন্তেকাল করেছেন। তার কবরের কাজে যেতে হবে আমাকে, তোমাকে তখলিফ দিলাম বলে অত্যন্ত দুঃখিত।
গুজবাসি বলে, এ তুমি কি বলছ ইয়ার, ফুর্তির দিন তো শেষ হয়ে যাচ্ছে না। মায়ের শেষ কাজটাই এখন সবচেয়ে বড়। যাও, সব যাতে নিখুঁতভাবে সমাধা হয় তার ব্যবস্থা কর তো। তোমার বৃদ্ধ মা-এর আত্মার শান্তি হোক, ভাই! আচ্ছা এবার তাহলে আমি ঘরে চলি—
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো তিরানব্বইতম রজনী :
আবার সে বলতে থাকে–
বাড়ির সামনে এসে গুজবাসি দেখলো একটা নাপিত জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে তার ঘরের জানালার দিকে।
—এ্যাঁই কুত্তা কা বাচ্চা অমন হাঁ করে কী দেখছিস ওদিকে।
গুজবাসিকে দেখে নাপিতটা আভূমি আনত হয়ে সালাম ঠুকে।
–-সালাম হুজুর,সালাম বড় সাহেব—সালাম সালাম।
–থাক থাক অত ভণ্ডামীতে দরকার নাই। এখন সাফ সাফ বল, এখন এখানে আমার বাড়ির জানলার দিকে কেন তাকিয়ে আছিস? বেয়াদপ বাঁদর কাঁহিকা—এক গোত্তায় তোর কাল্লা ফাটিয়ে দেব, শয়তান–
নাপিত করজোড়ে কাকুতি করে, অপরাধ নেবেন না হুজুর, নেহাতই আমার রুটির ব্যাপার। তা না হলে এখানে কেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবো।
-রুটির ব্যাপার মানে? এখানে তোকে খাওয়াবে কে?
—জী আমার এক শাসালো মক্কেলকে চোখে চোখে রাখছি। যা ছুলুপনা চলছে আমাদের কারবারে হুজুর। এর খদ্দের ও ভাগাচ্ছে, ওর খদ্দেরকে আর একজন টানাটানি করছে। তাই এমন আমিরি মক্কেলকে আমি চোখের আড়াল করতে পারি না, বড় সাহেব।
এবার গুজবাসি সাহেব ক্রোধে ফেটে পড়ে, উজবুকের মতো কী সব বলছিস? তোর শাঁসালো মক্কেলের খোঁজে আমার বাড়ির জানলায় ওৎ পেতেছিস কেন?
-জী উনি তো অন্দরেই আছেন—
-চোপরাও বেতমিজ বদমাশ। মুখ সামলে কথা বল, দাঁত খুলে নেব তোর।
দোহাই হুজুর, অমন করে ধমকাবেন না, আমার পিলে চমকে যাচ্ছে। আপনার বিশ্বাস না হয় ভিতরে ঢুকে নিজের চোখেই যাচাই করে দেখুন, আমি ঝুট বলছি কিনা। আপনি পুলিশের বড় সাহেব, আপনার সঙ্গে চালাকি করে আমি কি জানে বাঁচবো। আপনি কি আমাকে এমনই বুড়বাক ভাবলেন হুজুর। ভিতরে গেলে দেখতে পাবেন এক খুবসুরৎ নওজোয়ান একেবারে আমির বাদশাহর ছেলের মতো।
গুজবাসি নাপিতটার ঘাড় মটকে ধরেছিলো, ঘুসি চালাবে বলে। কিন্তু না মেরে ছেড়ে দিয়ে দরজায় গিয়ে জোরে জোরে ঘা মারতে লাগলো।
গুজবাসি আর নাপিতের মধ্যে যখন কথা চালাচালি চলছিলো তখন জানলার ফুটোয় চোখ রেখে সবই প্রত্যক্ষ করেছিলো বৌটা। বিপদ আসন্ন দেখে সে চটপট যুবকটিকে পায়খানার সানকীর মধ্যে বসিয়ে শিকল তুলে লুকিয়ে রাখলো।
একটু পরে স্বামীর করাঘাতে দরজা খুলে অবাক হওয়ার ভান করে বললো এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে, তবিয়ৎ ঠিক আছে তো?
গুজবাসি গম্ভীর কণ্ঠে বলে, আমার শরীর ভালোই আছে। তোমার হাল কি রকম, অন্দরে কি অন্য কোনও লোক আছে?
এই কথা শোনামাত্র ছলনাময়ী দু’ কানে আঙ্গুল দিয়ে বলে, তোব তোবা, একি বেশরমকা বাত! একি তোমার বিবির ইজ্জতের কথা হলো। তুমি কি এই সাতসকালে নেশাভঙ্গ করে বেহেড হয়ে গেছ নাকি?
গুজবাসি কিন্তু সে কথার জবাব না দিয়ে গটগট করে অন্দরে ঢুকে গেলো। এ ঘর ওঘর এদিক ওদিক কি যেন তলাশ করলো। কিন্তু অভিনব কিছুই; নতুন কোনও মানুষকেই, দেখতে না পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। পরমুহূর্তেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে গেলো বাইরে। শয়তান নাপিতটাকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার।
ওরে ছুঁচো বেল্লিক, একটা খানদানের ওপর ঐ রকম নোংরা কথা বললি কি করে তুই? তোকে আমি আজ জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব।
গুজবাসি নাপিতটার টুটি চেপে ধরে। লোকটা ঢোক গিলে বলে, কিন্তু বড় সাহেব, খোদা কসম, আমি মিথ্যে বলিনি। নিজের চোখে দেখেছি আমার, এক সুপুরুষ নওজোয়ান খদ্দের এই দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছে! তারপর আমি একভাবে এই দিকে তাকিয়ে আছি। দরজাও খোলেনি, সেও বেরোয় নি। জানি না আপনার বাড়ির অন্য কোন খিড়কী দরজা আছে কি না।
বেস নাই। দরজা এই একটাই। বুঝতে পারছি, তুই আমার সঙ্গে দিল্লাগী করছিস। কিন্তু আমাকে তুই চিনতে পারিস নি। এর পরিণাম অনিবার্য মৃত্যু। তা থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু তোকে জানে মারার আগে আর একবার ভালো করে খানাতল্লাসি করে দেখতে হবে। আমার বিচারে কোনও ভুল রাখবো না আমি। ঠিক আছে, আমার সঙ্গে চল।
প্রায় ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতেই নাপিতকে বাড়ির ভিতর ঢোকালো গুজবাসি। বাড়িটার আদ্যপান্ত খানাতল্লাসি করে দেখতে থাকলো। এক এক করে সব ঘরদোর আঙ্গিনা বারান্দা তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। কিন্তু অন্য কোনও পুরুষের সন্ধান মিললো না। গুজবাসির চোয়াল কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে আসে চোখ। নাপিত বুঝতে পারে, এখনই গর্জে উঠবে গুজবাসি! কিন্তু নাপিত নিশ্চিত তার মক্কেল এই বাড়ির কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে।
—সবই দেখা হয়েছে বড়সাহেব, কিন্তু পায়খানার সানকীটা পরীক্ষা করা হলো না! বৌটা দেখলো বিপদ ঘনায়মান। পাশের ঘর থেকে সে মারমুখী হয়ে তেড়ে এলো, তুমি কি গো, একটা বেজন্মা বজ্জাত তখন থেকে তোমার খানদানে চুনকালি মাখাবার চেষ্টা করছে আর হাবার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই তুমি হজম করে যাচ্ছ। তোমার শরীরের খুন কী টগবগ করে উঠছে না ওর যাচ্ছেতাই নোংরা কথাগুলো শুনে। লোকটাকে তুলে একটা আছাড় দিতে পারছো? তুমি পুলিশের বড় সাহেব? ছোঃ।
গুজবাসি ঘাড় নেড়ে বলে, তুমি ঠিকই বলেছ, বিবিজান। লোকটাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার, নাঃ, আর সহ্য করা যায় না এসব।
শোন রে খানকির বাচ্চা, তোর জন্যই আজ আমার খানদানে বদনাম হলো। আমার সতীসাধ্বী বিবির চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক দেবার চেষ্টা করেছিস, আমি তোকে রেয়াৎ করবো না। কিছুতেই।
বৌটা রসুইঘরে গিয়ে একখানা ছুরি উনুনে পুড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো। গুজবাসি নাপিতটাকে এক ঘুষিতে মাটিতে ফেলে দিয়ে সেই ছুরি দিয়ে ওর বিচি দু’টো কুচ করে কেটে নিলো।
লোকটা ত্রাহিত্রাহিডাক ছেড়ে ককিয়ে উঠলো। কিন্তু ততক্ষণে যথাকর্তব্য সমাধা হয়ে গেছে। নাপিতটার অধঃ অচৈতন্য দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে রাস্তার একপাশে ফেলে দিয়ে এলো গুজবাসি।
এরপর হয়তো কোনও পথচারী দয়াপরবশ হয়ে ওকে ওর দোকানে পৌঁছে দিয়েছিলো একসময়।
এদিকে গুজবাসি দপ্তরে চলে গেলে বৌটা তার নাগরকে সানকী থেকে বের করে বাড়ির বাইরে পার করে দিয়েছিলো সুযোগ বুঝে।