এক সময়ে বাগদাদ শহরে দুটি প্রায় সমবয়সী তরুণ-তরুণী গভীর প্রেমে দিন কাটাচ্ছিল। সম্পর্কে তারা খুড়তুতো ভাইবোন। তাদের মা বাবারও খুব ইচ্ছে ওদের দুটির শাদী হোক। ওরা হেসে খেলে এক সঙ্গে মানুষ হচ্ছে ছোট থেকে। ওদের দু’জনের মধ্যে খুব ভাব সাব। শাদী দিলে সুখেই থাকবে ওরা।
এইভাবে আরও বছরখানেক কেটে গেলো। ইতিমধ্যে সময়ের ফেরে ছেলেটির বাবা ব্যবসায় সর্বস্ব খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লো। মেয়ের বাবা মেয়ের শাদীর জন্য পয়সাওলা পাত্রের সন্ধান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে ভুলে গেলো তার জবানের কথা।
অবশেষে বাগদাদের এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ সওদাগরের সঙ্গে পাকাও হয়ে গেলো শাদীর কথা। কিন্তু কন্যা হাবিবা তার প্রিয় হাবিবের সঙ্গে একবার শেষ বারের মত দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। প্রিয়তমের বিরহে দু’নয়নে অবিরত অশ্রু ‘রতে থাকলো তার। নিভৃত কক্ষের বন্দীশালায় সে তার দয়িতের উদ্দেশে আকুতি জানাতে লাগলো, তুমি তো জান, হাবিব, জন্মাবধি তোমাকে বই অন্য কাউকে আমি ভাবতে শিখিনি। আমার বাবা মাও তোমার হাতেই তুলে দেবেন, কথা ছিলো। কিন্তু আজ তারা সে-সব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অন্য এক অজানা পাত্রের সঙ্গে আমাকে শাদী দিতে উঠে পড়ে লেগে গেছে। ওরা যাই করুক, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না সোনা। জীবনে মরণে আমি তোমারই।
হাবিবার আকুল আহ্বান বুঝি শুনতে পেয়েছিলো হাবিব। শাদীর আগের দিন সে গোপনে হাবিবার সঙ্গে দেখা করলো। তার অন্তরের বাসনা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লো হাবিব। কিন্তু এই মুহূর্তে কীই বা উপায়। হাবিবাকে সে বললো, শাদী যেমন ঠিক হয়েছে হয়ে যাক। তারপর আমি তোমার স্বামীর ঘরে গিয়ে দেখা করবো। তারপর কি করে আমরা আবার মিলিত হতে পারি তার ফিকির করবো।
শাদীর রাতে বাসরঘরে ঢুকে বৃদ্ধ সওদাগর দেখলো তার সদ্য শাদী করা বিবি হাপুস নয়নে কাঁদছে।
আহা বেচারী লাজুক মেয়ে। মা বাবাকে ছেড়ে এসে মন খারাপ করছে বোধহয়। তাই কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। যাই হোক, এরকম হয়, দুদিনেই সব সয়ে যাবে। তখন স্বামী ছেড়ে বাপের ঘরে যেতে চাইবে না আর। আদর আর ভালোবাসার মলম দিলে সব আপসে মোলায়েম হয়ে আসবে।
একি নয়নতারা কেঁদে কেঁদে তোমার সুন্দর ডাগর ঐ চোখ দুটো যে ফুলিয়ে ফেলেছ! ছিঃ কাঁদে না মণি! দুঃখের কি আছে। এই তো তোমার ঘর, আসল জায়গা। এখানেই তো তোমাকে থাকতে হবে চিরকাল, আপন করে নিতে হবে সব। দেখবে কত ভালো লাগবে তোমার। আর আমি? আমি কি তোমার ভালোবাসার পাত্র হবো না? বাজি রেখে বলতে পারি, বিবিজান, এমন দিন খুব শিগ্নিরই আসবে, এক দণ্ড তুমি আমাকে চোখের আড়াল করতে চাইবে না।
সওদাগরের কথা শুনে আরও উচ্চৈস্বরে কেঁদে ওঠে হাবিবা! বৃদ্ধা বৃথা সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে তাকে, তুমি যদি চাও তোমার মা বাবার সঙ্গে দেখা করবে, এখুনি আমি তাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, চলো।
হাবিবা মাথা নেড়ে বলে, না না সেজন্য নয়।
-তবে? তবে তোমার ভাইবোন কারও জন্য মন খারাপ করছে? হাবিবা আবার মাথা নেড়ে বলে, না সে জন্যও নয়।
বৃদ্ধ সওদাগর আবার বলে, তা হলে কি তোমাদের বাড়ির কোনও পোষা পাখি বা কোনও জন্তু জানোয়ারের জন্য মন খারাপ করছে?
হাবিবা এবারও আগের মতো নাথা নেড়ে বলে, না ওসব কিছুর জন্যে নয়।
তবে কিসের জন্য? এই ঘর সংসার নতুন বলে তোমার মন বসতে চাইছে না?না আমি বুড়ো হাবড়া বলে তোমার মন বিরূপ হয়েছে। তা আগে কেন তোমার মা বাবার কাছে বলে নি মণি, আমি জানতে পারলে তোমাকে কি জোর করে শাদী করতাম।
হাবিবা বিচলিত হয়ে বলে, দোহাই আল্লাহ, সে জন্যে নয়। আপনার মতো সদাশয় স্বামী পাওয়া ভাগ্যের কথা।
-তা হলে কি কারণে কাদছো, সোনা? আমাকে খুলে বললো, আমার কাছে সঙ্কোচ করার কোনও কারণ নাই, তোমার। এটুকু বিশ্বাস কর কোনও কারণেই আমি তোমার মনে দুঃখ দিতে চাই না।
হাবিবা কুষ্ঠিত হয়, সে কথা আপনাকে বলতে পারবো না আমি। আপনি ক্রুদ্ধ হবেন।
-খোদা কসম, তোমার কোনও কথাতে বিন্দুমাত্র রুষ্ট হবো না আমি। বরং যদি প্রাণ খুলে বলো, তার একটা সহজ সমাধান করে দিতে পারবো।
হাবিবা ভরসা পেয়ে বলতে থাকে, আমার চাচার ছেলে হাবিবের সঙ্গে ছোট থেকে হেসে খেলে এক সঙ্গে মানুষ হয়েছি আমি। আমাদের দু’জনেরই মা বাবারও ইচ্ছে ছিলো দু’জনের শাদী হবে। কিন্তু নসীবের ফেরে হাবিব আজ বড় গরীব হয়ে গেছে। তাই আমার মা বাবা আর তাদের ওয়াদা পূরণ করলেন না। আপনার সঙ্গে শাদী দিয়ে দিলেন আমার। এখন আপনিই বলুন, এতটা বয়স পর্যন্ত যাকে ধ্যান জ্ঞান করে এসেছি স্বামী হিসেবে পাবো বলে, তাকে যদি হারাতে হয় তা হলে কেমন লাগে? হাবিব ছাড়া আমার জীবনে দ্বিতীয় কোনও পুরুষ আমি কল্পনাও করিনি।
হাবিবার কথা শুনে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো বৃদ্ধ। তারপর বললো এসব কথা তো আমার জানা ছিলো না হাবিবা। যাই হোক, আমি জীবনে কখনও কোনও অধর্ম করিনি। আজ তোমাকে শাদী করে ঘরে এনেছি বলে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে এখানে কয়েদ করে রাখবো না। তাতে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না।
একটু থেমে আবার সে বললো, আজ থেকে তুমি আমার আর বিবিনও,হাবিবা। এখন থেকে তোমাকে আমি নিজের কন্যা বলে গ্রহণ করলাম। আমি অপুত্রক। আমার মৃত্যুর, পর আমার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির একমাত্র তুমিই মালিক হবে। যদিও শাদী করেছি তবু তুমি অপাপবিদ্ধ; আমি তোমাকে স্পর্শ করিনি। আমার ইচ্ছা এই রাত ভোর হবার আগেই সকলের অলক্ষ্যে তুমি এ বাড়ি ছেড়ে। তোমার প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে। তোমাদের মিলনেই প্রকৃত ধর্মরক্ষা হবে আমার।
এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। পরদিন প্রত্যুষে হাবিবা বৃদ্ধ সওদাগরের ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে।
হাবিব শোকে দুঃখে কেঁদে কেঁদে নিজেকে শেষ করতে উদ্যত হয়েছিলো। হাবিবাকে ফিরে পেয়ে আবার সে নতুন করে বাঁচার আশায় আনন্দে লাফিয়ে উঠলো।
এর পর শাহরাজাদ আর একটা গল্প বলতে শুরু করে।