৪.২ হৃদয়ের আয়নায় তাওহীদের আলো
কনৌজের চারপাশে ছিল ঘন-বনজঙ্গল। এ জঙ্গল কোন কোন স্থানে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জায়জায় জায়গায় ছিল পাহাড়, টিলা ও সমতল ভূমি। যমুনা নদীর তীরেই ছিল কনৌজ শহরের অবস্থান। কনৌজ দুর্গকে এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিলো যে দুর্গের এক প্রান্তের দেয়াল ঐতিহাসিকদের ভাষায় যমুনার পানি বিধৌত হতো। সেই যুগে কনৌজ দুর্গ ছিল একটি বিখ্যাত দুর্গ। দূর-দূরান্তের মানুষ কনৌজের দুর্গ শহরের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতো।
১০১৮ সালে সুলতান মাহমূদ মথুরা থেকে রওয়ানা হয়ে মুনাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। মুনাজ থেকে কনৌজের দূরত্ব ছিল প্রায় সোয়াশো মাইল। কনৌজ থেকে চার পাঁচ মাইল দুরে ঘন জঙ্গলের পাশে জনমানবহীন এলাকার একটি পাহাড়ের ঢালে উপজাতীয় পোশাকে দু’জন লোক বসেছিল। এদের এক জনের নাম তালাল আর অপরজনের নাম সালেহ। তখন পশ্চিমাকাশে সূর্য শেষ আলো বিকিরণ করে অস্ত যেতে শুরু করেছে। এমন সময় দু’জনের একজন তার সঙ্গীকে বললো রাতটা আমরা এখানেই কাটিয়ে দেবো।
আমরা কনৌজ থেকে এলাম আজ তিন দিন হলো। কিন্তু কোথাও আমরা কনৌজ কিংবা কোন হিন্দু রাজা মহারাজার সৈন্যদের দেখা পেলাম না। তার মানে কি এটা যে, আমাদের সৈন্যদের আগমনের খবর পাওয়ার পর কনৌজের সৈন্যরা দুর্গের বাইরে আসবে? বললো তালাল।
আমাদের সৈন্যরা আসা পর্যন্ত আমাদেরকে এই অঞ্চলেই থাকা উচিত তালাল ভাই। বললো তালালের সঙ্গী সালেহ।
সে তালালের উদ্দেশ্যে আরো বললো, হায় আমাদের এ অঞ্চলেই থাকতে হবে এবং কনৌজের সেনাবাহিনীর বাইরে আসা দেখে এখান থেকে যেতে হবে। সুলতানকে বলা হয়েছে, তিনি যদি মুনাজ আক্রমণ করেন, তাহলে কনৌজের সৈন্যরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে। সুলতানকে একথাও বলা হয়েছে, আমাদের মূল লড়াইটা হবে মুনাজ ও কনৌজের মাঝামাঝি স্থানে। তাই আমাদেরকে দেখতে হবে কনৌজের কোন সৈন্যরা আমাদের সৈন্যদের উপর পেছন দিক থেকে আঘাত হানে!….. আরে তালাল ভাই! মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
নারে সালেহ! এতো জলদী ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার লোক আমি না। আমার মনে হচ্ছে দুর্গের বাইরে এসে লড়াই করার মতো সাহস কনৌজ রাজার নেই।
এটাইতো আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, আসলেই কি কনৌজ রাজার এই সাহস আছে কি না, বললো সালেহ। আমরা হলাম গযনী সুলতানের দুটি চোখ। আমাদেরকে দেখতে হবে এই জঙ্গল ঝুঁকিমুক্ত না এখানে কোন ঝুঁকি আছে।
তাহলে এসো এখানেই শুয়ে পড়ি। ঠান্ডাটা একটু বেশী। তবুও রাতটা কোনমতে কাটিয়ে দেয়া যাবে, বললো তালাল।
তালাল ও সালেহ ছিল হিন্দুস্তানী মুসলমান। সালেহ ছিলো সেইসব আরবদের বংশধর যারা মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সাথে হিন্দুস্তানে এসে আর আরব দেশে ফিরে যায়নি। আর তালালের পূর্ব পুরুষরা ছিল অমুসলিম। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সময় তার পূর্ব পুরুষরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
সুলতান মাহমূদ যখন ভারত অভিযান শুরু করলেন, তখন ভারতের অভ্যন্তরীন অবস্থা জানার জন্যে তার স্থানীয় বিশ্বস্ত লোকের দরকার হলো। একাজে তিনি স্থানীয় মুসলমানদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার বৈদেশিক গোয়েন্দা শাখায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিলেন।
দেশের ভেতরে থেকে বিদেশী শক্তির জন্যে গোয়েন্দাদের দায়িত্ব পালন করা সাধারণ সৈনিকের মতো সহজ ছিলো না। তরবারী ও অশ্বচালনায় পারদর্শিতা দেখাতে পারলেই সেনাবাহিনীতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যেতো। কিন্তু গোয়েন্দার কাজের জন্যে সৈনিকের মতো অশ্বচালনা ও তরবারীতে পারদর্শিতার পাশাপাশি অত্যন্ত মেধাবী ও দূরদর্শিতা থাকতে হতো। কারণ, গোয়েন্দাকে হতে হয় চলন-বলনে বিশেষ পারদর্শী, থাকতে হয় যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা। সেই সাথে যে কোন প্রাকৃতিক ও সামাজিক বৈরী পরিবেশে ও পাহাড়, জঙ্গল, মরু, পানি, চরম শীত, প্রচণ্ড গরম তথা সকল প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে কয়েক দিন পর্যন্ত টিকে থাকার মতো দৈহিক সামর্থও তার থাকতে হয়।
গোয়েন্দা কাজের জন্য সব চেয়ে বড় যোগ্যতার ব্যাপার ছিল, গোয়েন্দাকে হতে হতো লোভ লালসাহীন, আবেগ বিরাগ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী। গোয়েন্দাদেরকে ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন এবং চিতা বাঘের মতো ক্ষিপ্রতার অধিকারী হতে হয়। সবচেয়ে বেশী থাকতে হতো নির্ভেজাল ঈমান।
হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে আবেগের প্রাবল্য বিদ্যমান ছিল। তখনকার হিন্দুস্তান ছিলো বহু রাজামহারাজাদের শাসনে বিভক্ত হিন্দুস্তানের প্রায় সকল শাসক শ্ৰেণীই ছিল হিন্দু। হিন্দু শাসকরা কখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম অধিবাসীদের বিশ্বাস করতো না।
গযনীর সুলতান মাহমূদ যখন ভারত অভিযান শুরু করেন, তখন থেকে ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেক মুসলমানকেই হিন্দু শাসকরা গযনী সুলতানের গোয়েন্দা হিসেবে সন্দেহ করতে শুরু করে।
এমন সংশয় সন্দেহের মধ্য থেকেও ভারতে বসবাসকারী তৎকালীন মুসলমানদের কেউ কেউ সুলতান মাহমূদের পক্ষে গোয়েন্দা কাজে অংশ গ্রহণ করে এবং সুযোগ মতো মুসলমানদের সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে। অবশ্য তাদের মধ্য অনেকেই হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের জালে আটকে যায় কিংবা আবেগ তাড়িত হয়ে অথবা লোভকে সংবরণ করতে না পেরে তথ্য ফাঁস করে দেয়।
তালাল মাহমূদ ও সালেহ নামের দুই হিন্দুস্তানী ছিলো সুলতান মাহমূদের নিয়মিত গোয়েন্দা দলের সক্রিয় সদস্য। সুলতান মাহমূদকে তার স্থানীয় গোয়েন্দারা জানিয়ে দিয়েছিলো, মথুরা যতো সহজে জয় করা সম্ভব হয়েছে এতোটা সহজে কনৌজ জয় করা সম্ভব হবে না। কারণ, যমুনা নদীর তীরবর্তী মুনাজ নামের রাজপুত অধ্যুষিত দুর্গে যখন আক্রমণ করা হবে, তখন পিছন দিক থেকে কনৌজের সৈন্যরা আঘাত হানতে পারে। তাই মুসলিম বাহিনীকে গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থান করে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে। ফলে মুসলিম সৈন্যদের পরাজিত হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। অপর দিকে লাহোরের মহারাজা ভীমপাল এই অঞ্চলের ছোট বড় সকল রাজা মহারাজাকেই জোটবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। এমনও হতে পারে ভীমপাল নিজেও তার সৈন্যদেরকে এখানে নিয়ে এসে লড়াইয়ে লিপ্ত হবেন।
সুলতান মাহমূদের সৈন্যরা অব্যহত লড়াইয়ে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বহু সৈন্য ছিল আহত এবং নিহিত হয়েছিল প্রচুর। তা ছাড়া এরা নিজ ভূমি গযনী থেকে প্রায় তিন মাস সফরের দূরত্বে অবস্থান করছিল। এ পর্যায়ে এসে গযনী বাহিনী মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। তাদের গোয়েন্দাদের প্রেরিত তথ্য মতে তারা গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী হিন্দু ঘনবসতিপূর্ণ চতুর্দিকে শত্রু বেষ্টিত একটি জায়গায় এসে পৌঁছে। যেখানে তাদেরকে উজ্জীবিত-অক্লান্ত বিপুল সংখ্যক শক্রসেনার বিরুদ্ধে বৈরী পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে লড়াই করতে হবে।
সুলতান যখন মথুরা থেকে কনৌজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন সালেহ ও তালালকে আগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল তারা যেন কনৌজের সৈন্যদের তৎপরতা সম্পর্কে সময় মতো সুলতানকে অবহিত করে।
সালেহ ও তালাল তিন দিন ধরে ছন্নছাড়া উপজাতীয় ছদ্মবেশে কনৌজের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করেছে। তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে উঁচু গাছ ও পাহাড়ের টিলার উপরে উঠেও কনৌজের সৈন্যদের তৎপরতা প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোথাও কনৌজের কোন সৈন্যের তৎপরতা তাদের নজরে পড়েনি। গঙ্গা নদীর তীরে গিয়ে নদীতে চলাচলকারী নৌকাগুলোকেও তারা পর্যবেক্ষণ করেছে কিন্তু কিছুই তাদের চোখে ধরা পড়েনি।
দু’জনের মধ্যে তালাল কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সালেহ অন্যদিনের মতোই ছিল উজ্জীবিত চনমনে। সালেহ তার কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে সামান্যতম ক্রুটিও করতে প্রস্তুত নয়।
সময়টা ছিল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। প্রচণ্ড ঠান্ডা। ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্যে তারা একটি টিলার আড়ালে যেখানে বাতাস নেই এমন জায়গায় রাত কাটানোর জন্যে শুয়ে পড়ল।
রাতের এক প্রহরের পর সালেহর ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোন কিছুর আওয়াজেই মূলত ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। ঘুম ভেঙ্গে যেতেই উল্কর্ণ হয়ে কানে ভেসে আসা শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করল সালেহ। তারা যে পাহাড়ের ঢালুতে শুয়েছিল সেই পাহাড়ের নীচ দিয়ে কিছু সংখ্যক মানুষের চলাফেরার আওয়াজ শুনতে পেল সে। সে স্পষ্ট বুঝতে পেল ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। মাথা উঁচু করে সে দেখতে পেলো। কিছু সংখ্যক লোক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। অবস্থা বুঝার জন্য সে হামাগুড়ি দিয়ে কয়েকগজ এগিয়ে এমন জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকল যেখান থেকে অশ্বরোহীদের পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কাফেলার আগে আগে এক লোক মশাল হাতে যাচ্ছে। অনেকগুলো লোক অশ্বরোহী। তাদের সাথে কয়েকটি উটের উপর কি যেন বোঝাই করা হয়েছে।
সালেহ দেখতে পেল কাফেলার মাঝামাঝি একজন দীর্ঘ দেহী স্বাস্থ্যবান লোক। লোকটির পোশাক পরিচ্ছদ দেখতে পুরোহিতের মতো। পুরোহিতের পিছনে পাঁচটি ঘোড়া বোঝাই করা। একটি অপরটির সাথে রশি দিয়ে বাধা। প্রথম ঘোড়াটির লাগাম পুরোহিতে হাতে। সবার পেছনের ঘোড়াটির সাথে দীর্ঘ রশি বাধা এবং সেই রশির সাথেই বাধা আরো আটদশজন লোক। তাদের প্রত্যেকের দু’হাত সামনের লোকের কাঁধে এবং সবার চোখেই পট্টি বাধা। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল পুরোহিত ছাড়া কারো চোখ খোলা ছিলো না। সবাই খুব ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল।
পুরোহিত ক্ষীণ আওয়াজে বলেছিল, চলো চলো, আমি দেখতে পাচ্ছি। চলতে থাকো, পথ পরিস্কার আছে কোন অসুবিধা নেই।
চোখ বাধা এই কাফেলা ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসন হচ্ছিল। সালেহ এ ঘটনা দেখে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে সঙ্গী তালালের কাছে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল এবং কানে কানে বললো, কোন শব্দ না করে হামাগুড়ি দিয়ে আমার সাথে এসো।
এবার তারা দুজনেই চোখ বাধা এই কাফেলার গমন পথ দেখল। কিন্তু তারা এর কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না কারা কোন উদ্দেশ্যে কোথায় কেন এভাবে যাচ্ছে।
সালেহ ও তালাল একটি সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নিয়ে কাফেলাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। কয়েকশ গজ অগ্রসর হয়ে পুরোহিতের নেতৃত্বাধীন এই কাফেলা থেমে গেল। ওখানে একটি খাড়া দেয়ালের মতো পাহাড় সোজা উপরেরর দিকে উঠে গেছে। সালেহ ও তালাল পা টিপে টিপে পাহাড়ের উপর দিয়ে সোজা খাড়া টিলার উপরে গিয়ে দাঁড়াল। তারা যেখানে দাঁড়াল, কাফেলাটি তাদের ঠিক নীচে থেমেছে। তখন নীচের মশালের আলো আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মশালের আলোয় তারা দেখতে পেলো, দেয়ালের মতো বাড়া টিলার বিপরীতে অপর একটি টিলার ভেতর অনেকটা গর্তের মতো ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা জায়গাটা এমন যে একটি ঘোড় অনায়াসে তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।
পুরোহিত মশাল বাহকের কাছ থেকে মশাল নিয়ে বললো, তোমরা সবাই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে আমি এসে তোমাদের নিয়ে যাবো
পুরোহিত মশাল নিয়ে বিপরীত টিলার ভেতরের ফাঁকা জায়গায় প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর পুরোহিত আবার মশাল হাতে নিয়ে পাহাড়ের গর্তসম ফাঁকা জায়গার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
কেউ পট্টির ফাঁক দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করবে না। কেউ যদি চোখের পট্টি সরিয়ে কিছু দেখতে চেষ্টা করো তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। পুরোহিত চোখবাঁধা লোকগুলোকে হাত ধরে ঘোড়ার পিঠ থেকে কাঠের তৈরী কিছু বাক্স নামানোর কাজে লাগিয়ে দিল। পুরোহিত একটি মশাল জ্বালিয়ে নিজের হাতে নিলো এবং আরো দুটি মশাল জ্বালিয়ে সে সুবিধা মতো জায়গায় দুজনকে দাঁড় করিয়ে দিল। ঘোড়ার পিঠ থেকে চোখবাধা লোজন বাক্স উঠিয়ে পুরোহিতের নির্দেশ মতো পাহাড়ের মধ্যকার ফাঁকা জায়গায় ঢুকাতে লাগলো, তারা বাক্স রেখে আবার অন্য বাক্স নিতে ফিরে আসতো। তাদের কেউ কেউ চোখ বাধা থাকার কারণে বাক্স নিয়ে পড়ে যেতো আবার উঠে পুরোহিতের নির্দেশ মতো চলতো। এভাবে একে একে সবগুলো বোঝাই করা ঘোড়ার পিঠ থেকে বান্ত্রগুলো নামানো হলো এবং চোখ বাধা লোকগুলোর প্রায় সবাই গর্তের মধ্যেই হারিয়ে গেল। অবস্থা দৃষ্টে তালাল ও সালেহর বুঝতে কষ্ট হলো না, এগুলো অবশ্যই কারো ধন-সম্পদ যা গোপনে লুকানো হচ্ছে। কিন্তু লোকগুলোর চোখ বেধে রাখার ব্যাপারটি তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না।
তালাল বললো, পুরোহিত বেশধারী লোকটি কোন ডাকাতদলের সর্দার হবে। আর চোখবাঁধা এই লোকগুলো হয়তো এই ডাকাত ধরে আনার মজদুর। হতে পারে ডাকাত সর্দারের অন্য লোকেরা আরো কোথাও লুটতরাজ করার জন্য চলে গেছে।
তালাল সালেহকে বললো, সালেহ ভাই! এই ডাকাত সর্দার যদি এখানে পাহারা না বসায়, তাহল আমরা দু’জনে যে পরিমাণ উঠাতে পারি সেই পরিমাণ সম্পদ নিয়ে নিতে পারি, কি বলো তুমি?
তালাল ভাই মন ঠিক করে নাও, তালালকে বললো সালেহ। এ সব চোরাই ধনসম্পদ দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। যে কর্তব্য পালনে আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে সেই কাজের প্রতি আমাদের মনোযোগ রাখা বেশী দরকার।
আরে তাতো আছেই। আমি কি কর্তব্যে অবহেলা করছি নাকি বললো তালাল। রাতে তো আর আমরা কোন কাজ করছি না। কোন না কোন ভাবে রাতটা তো আমাদের এখানে কাটাতেই হবে। কাজ যা করার তা তো আগামীকাল দিনের বেলায় করতে হবে। রাতের এই কর্মহীন সময়টা এ কাজে লাগাতে পারি। রাতেই যদি এই লোকগুলো এখান থেকে চলে যায় তবেই না আমরা কাজে হাত দেবো। আমার মনে হয় গুহার ভেতরে কেউ নেই। থাকলে নিশ্চয়ই তারা বা নেয়ার জন্যে গুহার বাইরে আসতো।
না, লুটের সম্পদ নেয়ার জন্যে আমরা কিছুতেই রাতের অন্ধাকারে অজানা হাতে প্রবেশ করবো না। বললো সালেহ। তালাল ভাই! সম্পদ আর নারীর লোভ বহু রাজার রাজত্ব ধ্বংস করে দিয়েছে। ধন-সম্পদের প্রতি লোভ করো ্না। ধুত্তরী! তুমি মানুষ না একটা পাথর। পাগলের মতো কথাবার্তা বলল। তিরস্কারের সুরে সালেহকে বললো তালাল।
সালেহ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় পুরোহিত বেশধারী লোকটি মশাল হাতে নিয়ে গুহার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।
পুরোহিত চোখ বাধা লোকগুলোকে হাত ধরে ধরে ঘোড়ার পাশে আনল এবং এক এক করে সবাইকে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করিয়ে দিল। ঘোড়া ছিল কম লোক ছিল বেশী। দুজন দু’জন করে এক একটি ঘোড়ার উপর বসিয়ে সবার আগের উটে সওয়ার হয়ে পুরোহিত বেশধারী ফিরতি পথ ধরলো।
লোকগুলো যখন অনেক দূরে চলে গেল তখ তালাল সালেহর উদ্দেশ্যে বললো, চলো, ব্যাপারটি কি দেখে আসি।
সালেহ তালালকে একাজে অগ্রসর হতে নিষেধ করলো। শুধু নিষেধই করলো না সে বলতে বাধ্য হলো, তুমি যদি ওখানে যেতে চাও তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করতে বাধ্য হবো।
সালেহর দৃঢ়তা ও কঠোর কথা শুনে তালাল হাসল এবং কথা না বাড়িয়ে উভয়েই শুয়ে পড়ল তখন রাত আর বেশী বাকী নেই।
ভোরের অন্ধকার থাকতেই পুরোহিত কনৌজের রাজা রাজ্যপালের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল। এ সময়ে রাজার জেগে থাকার কথা নয়। রাজার শয়ন কক্ষের দরজায় একজন বাদী দাঁড়ানো ছিল। সে পুরোহিতকে দেখেই রাজার শয়নকক্ষের ভেতরে প্রবেশ করল এবং ফিরে এসে পুরোহিতকে বললো, আপনি ভেতরে আসুন।
পুরোহিত রাজার কক্ষে প্রবেশ করলে রাজা পুরোহিতকে বললেন, কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আপনি আমার পাশে বসুন।
রাতেই ধন-সম্পদের শেষ বাক্সটিও সেই জায়গায় রেখে এসেছি মহারাজ!
যারা বাক্স বহন করেছিল এদের সবাইকে কি কারাগারে বন্দী করা হয়েছে।
এদেরকে কারাগারে বন্দী করার দরকার ছিল না মহারাজ! কারণ, তাদের সবার চোখ আমি কাপড় দিয়ে বেধে দিয়েছিলাম। তারপরও আপনার নির্দেশ পালনার্থে সবাইকেই বন্দী শালায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। অবশ্য ‘আমি কারারক্ষীদের বলে দিয়েছি তাদেকে যাতে আরামে রাখা হয় এবং খাতির যত্ন করা হয়।
পণ্ডিত মশাই! এখন আপনি ছাড়া আর কেউ আমার এই বিশাল সম্পদের খবর জানে না। আপনাকে আমি কোথা থেকে কোন পর্যায়ে তুলে এনেছি এবং কতোটা সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছি এ ব্যাপারটি নিশ্চয়ই বুঝে! আমি আমার সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই জানাইনি। আমার ছোট বিবি শকুন্তলাকে আমি কতোটা ভালবাসি আপনি জানেন, কিন্তু তাকেও আমি বুঝতে দেইনি, রাজপ্রাসাদের সকল সোনাদানা আমি দুর্গের বাইরে সরিয়ে দিচ্ছি।
আমার ব্যাপারে মহারাজের পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত।
আমি সেই দিন থেকেই আপনার সহায় সম্পদ দুর্গের বাইরে নিতে শুরু করেছি যখন শুনেছি, সুলতান মাহমূদ মথুরা দখল করে নিয়েছে এবং তার পরবর্তী লক্ষ হচ্ছে কনৌজ দুর্গ।
আমি যে জায়গায় আপনার সম্পদ লুকিয়েছি রাজ মহলের সবার চোখের আড়ালে এক রাতে আপনি আমার সাথে গিয়ে সেই জায়গা দেখে এসেছেন। গত রাতে আমি আপনার ধন-ভাণ্ডারের শেষ বাক্সও সেখানে রেখে এসেছি।
তার মানে কি আমার সোনাদানা সংরক্ষণের বিষয়টি নিরাপদে রয়েছে? পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন কনৌজের মহারাজা ।
হ্যাঁ, এমনই সুরক্ষিত হয়েছে যে, আপনি একাকী সেখানে গেলে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন না। কারণ, আমি সেখানে কোন মানুষকে নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখিনি, আমি ওখানকার নিরাপত্তায় রেখেছি সাপ।
আরেকটি কথা আপনাকে আমার বলতেই হচ্ছে, বললেন রাজা। যদি কোন কারণে এ বিষয়টা ফাঁস হয়ে যায় তবে সেই দিনটিই হবে আপনার জীবনের শেষ দিন। আর যদি আপনার আগে আমার মৃত্যু এসে যায়, তবে আমার সাথে আপনাকেও মরতে হবে।
রাজার এ কথায় পুরোহিতের ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো। তিনি স্মিত হেসে রাজার উদ্দেশে বললেন,
ধন-সম্পদের লোভ মানুষকে পাষাণ বানিয়ে ফেলে। সম্পদের লোভে অনেকেই স্ত্রী সন্তান এবং ধর্মীয় গুরুকেও শত্রু ভাবতে শুরু করে। মহারাজ! আমার কাছে যে সম্পদ আছে এর কাছে আপনার এ সব ধনসম্পদ খুবই তুচ্ছ। আমার ভজন, আমার পার্থনা, অহোরাত্রী শ্রীকৃষ্ণের চরণে আমার আত্ম নিবেদন এমন মুল্যবান সম্পদ যে, আপনাদের মতো রাজা মহারাজা, রাজ্যপাট, সেনাবাহিনীর দাপট আমার কাছে পিপিলিকার গড়ে তোলা আহার্যের স্তূপ মনে হয়।
হ্যাঁ, তাই ঠিক! এজন্যই তো আমি আপনাকে আমার এই গোপন রহস্যের ভেদ পুরুষ বানিয়েছি। বললেন রাজা রাজ্যপাল।
***
ঐতিহাসিক আল বিরুনী ও ফারিতা লিখেছেন, সুলতান মাহমূদকে তার গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, কনৌজে গযনী বাহিনীর সাথে হিন্দুরা ভয়ংকর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কনৌজ রাজার নানা কাহিনী শুনে সুলতান মাহমূদ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, ক্রমশ সদস্য সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকা সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার জন্যে গযনী থেকে তার জন্যে কোন রসদ ও জনবল সরবরাহের উপায় ছিলো না। তিনি গভীর ভাবে চিন্তা করছিলেন, কনৌজ রাজাকে পরাজিত করতে হলে তাকে খুবই সতর্ক ও সার্থক চাল চালতে হবে। অবশ্য মথুরা জয়ের পর তিনি তার সৈন্যদের কিছুদিন বিশ্রাম দিয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন বিজিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পথে পথে তার অনেক সৈন্যকে রেখে আসতে হয়েছে এবং অব্যাহত যুদ্ধে তার বহু সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় তার জনবল যথেষ্ঠ কম। এ অবস্থায় সৈন্যদের কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ দিলেও সেনাপতি ডেপুটি সেনাপতি ও কমান্ডারদের তিনি ক্ষণিকের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেননি। তাদের প্রতিনিয়ত নিচ্ছিদ্র পরিকল্পনা গ্রহণ এবং শত্রুপক্ষের অবস্থা জানার কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। সেই সাথে সাধারণ সৈনিকদেরকে মানসিকভাবে চাঙ্গা করার জন্য ইমাম ও খতীবদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একের পর এক দুর্গ জয় করার পর সৈন্যসংখ্যা অর্ধেকের চেয়ে নীচে নেমে এলেও তিনি আরো কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছা করলেন। আরো কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছা করলেন এটা ছিল সুলতান মাহমুদের এক প্রকার উন্মাদনা বিজয় এবং কৌশলী চালের সাফল্যের উপর অত্যধিক আস্থার কারণ।
মজার ব্যাপার হলো, যে কল্লৌজ নিয়ে সুলতান মাহমূদ এতটা চিন্তিত বাস্তবে সেই কনৌজের অবস্থা ছিল তার ধারণার সম্পূর্ণ উল্টো। যুদ্ধ না করার বাসনায় মহারাজা রাজ্যপাল তার রাজকোষের গোটা সম্পদ রাজধানীর বাইরে পাহাড়ী এক গোপন জায়গায় সরাতে শুরু করেন। সুলতান মাহমূদের অব্যহত বিজয় এবং তার একের পর এক দুর্গ জয়ের ঘটনায় রাজ্যপাল তাকে হারানোর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কনৌজের প্রধান পুরোহিত রাজা রাজ্যপালকে লড়াইয়ের জন্য উৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু ১০১৮ সালের সেই ভোর বেলায় কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল প্রধান পুরোহিতকে এর কারণও বলেদিলেন। প্রধান পুরোহিত যখন প্রত্যূষে রাজার শয়নকক্ষে গিয়ে জানালেন
মহারাজ! আপনার সকল ধণভাণ্ডার এখন সুরক্ষিত। এখন আপনি ধনরাজী হারানোর আশংকামুক্ত হয়ে দৃঢ়ভাবে মাহমূদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন। আর যদি তা না করেন তাহলে কনৌজের প্রধান মন্দিরও মসজিদে পরিণত হবে। আপনার ভুলে গেলে চলবে না, মুসলমানরা যাকে মূর্তি বলে সেগুলোই আমাদের দেবদেবী। এরই মধ্যে আমাদের দেবদেবীদের সাংঘাতিক অবমাননা করা হয়েছে। আপনাকে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি, দেবদেবীদের অভিশাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা আপনাকে করতেই হবে।
ভ্রুকুঞ্চিত করে মহারাজা রাজ্যপাল প্রধান পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
আপনি যাদেরকে দেবদেবী বলছেন, এগুলো আসলে মূর্তি। তারা যদি অভিশাপ দিয়ে কাউকে ধ্বংস করতে পারে, তবে অসংখ্য দেবদেবীর অপমান ও অমর্যাদার প্রতিশোধ নিতে মুসলিম সৈন্যদের ধ্বংস করে না কেন? মথুরার মন্দিরের মূর্তি ধ্বংস করে যারা আযান দিতে শুরু করেছে, তাদের উপর তারা বজ্রপাত হয়ে ভেঙ্গে পড়ে না কেন? এই মুসলমানরাই আসলে দেবদেবীদের অভিশাপ। এরাই অভিশাপ হয়ে হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজাদের উপর হামলে পড়ছে।
যে রাজা মহারাজা ধর্মের অমর্যাদা হওয়ার পর কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না, তাদের উপর অভিশাপতো পড়বেই। দেখুননা, আপনার মতো শক্তিশালী মহারাজাও তো নিজের ধন ভাণ্ডার নিয়ে ব্যস্ত। বললো প্রধান পুরোহিত।
ধনভাণ্ডার আমি লুকিয়েছি সত্য। কারণ, সুলতান মাহমূদ ধনরত্ন লুট করে গযনী নিয়ে যাবে। আমি তাকে কনৌজের ধনভাণ্ডার গযনী নিয়ে যেতে দেবো না। সে এখানে এসে ধনরত্নও পাবে না, আমাকেও খুঁজে পাবে না। সে আমাকে বন্দী করবে তো দূরে থাক আমার টিকিটিও পাবে না। সে পাগলের মতো আমাকে এবং আমার ধনভাণ্ডার তালাশ করবে। কিন্তু সে কিছুই খুঁজে পাবে না। আমাকেও পাবে না, আমার ধনভাণ্ডার পাবে না। সে যখন কনৌজ পৌঁছাবে আমি তখন এমন জায়গায় থাকবো, যেখানে তার সকল সৈন্য মিলেও আমাকে খুঁজে পাবে না।
আপনাকে না পাক, কিন্তু মন্দিরতো তারা ঠিকই পাবে। তারা মন্দিরগুলো ধ্বংস করবে আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ধ্বংসযজ্ঞ দেখবো।
মহারাজ! ধনসম্পদের ভালোবাসা আপনাকে কাপুরুষ বানিয়ে ফেলেছে। এজন্য আপনি গযনী সুলতানকে ধোকা দেয়ার চিন্তা করছেন। অথচ আপনি এটা ভাবছেন না, মাহমূদের ভয়ে যদি আপনি এখান থেকে লুকিয়ে পালিয়ে যান, কনৌজের সেনাবাহিনী ও লোকেরা আপনাকে ঘৃণা করবে। আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাবে। মহারাজ! আমি আপনাকে ভগবানের দোহাই দিয়ে বলছি, আপনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করুন। কনৌজের আবাল-বৃদ্ধ প্রত্যেকেই লড়াই করে মরতে প্রস্তুত। গোটা দেশের মানুষকে আমি অগ্নিস্ফুলিঙে পরিণত করার দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি কনৌজের লোকদেরকে জলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করবো।
আমাকে ভাবতে দিন পুরোহিত মশাই! আমাকে ভাবতে দিন। অস্থির হয়ে গেলেন মহারাজা রাজ্যপাল। পুরোহিতের কথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়লো। তার পরিকল্পনা পুরোহিতের প্ররোচনায় এলোমেলো হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অবশেষে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মহারাজা রাজ্যপাল বললেন
শুনুন পণ্ডিত মহাশয়! আমি অনেক ভেবে চিন্তে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আপনি চলে যান। আপনাকে সব কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া সব ব্যাপার আপনার পক্ষে বুঝে উঠাও মুশকিল।
পুরোহিত হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে চলে গেল। পুরোহিত চলে যাওয়ার পর মহারাজা রাজ্যপাল তার সেনাবাহিনীর সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন,
“দৃশ্যত মনে হতে পারে আমি কাপুরুষের পরিচয় দিচ্ছি আমি সুলতান মাহমূদের মোকাবেলা না করে আত্মগোপনে চলে যাবো। এটা হবে মাহমূদের জন্যে সব চেয়ে বেশী আঘাত। সে আমার খুঁজে গোটা কনৌজ জুড়ে পাগলের মতো আমাকে খোঁজাখুজি করবে। না পেয়ে সে তাড়াতাড়ি কনৌজ ছাড়ার চিন্তা করবে না। কারণ এখন পর্যন্ত শক্তভাবে হিন্দুস্তানে তার কারো মোকাবেলার সম্মুখীন হতে হয়নি। সহজেই সব জায়গায় সে বিজয়ী হয়ে গেছে। আমি ভাবছি একের পর এক লড়াই করে এবং বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করে সে যখন মনে করবে হিন্দুস্তানে তার মোকাবেলা করার কেউ নেই এবং তার জনবল বিভিন্ন জায়গায় ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে কমে যাবে তখণ অন্যান্য রাজাদের নিয়ে আমি একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলবো এবং এই কনৌজকেই মাহমূদ ও তার সৈন্যদের জন্যে কবরস্থানে পরিণত করবো।
কনৌজ রাজা রাজ্যপাল সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে লড়াই না করার নানা যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন; কিন্তু তার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা নীরবে তার বক্তৃতা শোনা ছাড়া কেউ কোন মন্তব্য করছিলো না। তাদের চেহারার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল, তারা মহারাজা রাজ্যপালের সিদ্ধান্তে মোটেও সুন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবে তারা কেউ রাজার সিদ্ধান্তের বিপরীতে কিছুই বললো না।
এক পর্যায়ে রাজা রাজ্যপাল সকল সেনাকর্মকর্তার উদ্দেশ্যে বললেন, কি ব্যাপার? তোমরা কেউই কোন কথা বলছে না। আমর সিদ্ধান্ত তোমাদের মনপুত হয়েছে তোক।
আমাদের সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির ব্যাপার নয়। আমাদের কাজ আপনার নির্দেশ পালন করা। আমরা আপনার নির্দেশ পালন করবো, বললো তার প্রধান সেনাপতি। কিন্তু আমাদের মধ্য থেকে কেউ লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানাবে না।
মহারাজ! আসলে কনৌজে আপনার সশরীরে উপস্থিত থাকা না থাকার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে প্রধান নয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, দুটি ধর্মের লড়াই। হিন্দু রাজারা যদি একের পর এক ময়দান ছেড়ে পালাতে থাকেন, তাহলে একদিন গোটা হিন্দুস্তানই মুসলমানদের দখলে চলে যাবে এবং এখানকার সকল মানুষই মুসলমান হয়ে যাবে।
সেনাপতির কথা শোনার পর মহারাজা রাজ্যপাল সেনাপতির দিকে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটি সবাইকে পড়ে শোনাও।
কাগজটি ছিল লাহোরের মহারাজা ভীমপালের লেখা একটি চিঠি। যে চিঠিটি তিনি মুনাজের রাজা রায়চন্দ্রের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। সেই চিঠি মুনাজের রাজা কনৌজ রাজার কাছে পাঠিয়ে দেন।
রাজা ভীমপাল রাজা রায়চন্দ্রের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, সুলতান মাহমুদ হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজাদের মতো নয়। সে কোন শ্যামলা বাদামী মানুষের নেতা নয়। কিংবা কিছু সংখ্যক মেরুদণ্ডহীন অনুগত মানুষের শাসক নয়। তার কথা শুনলেই বহু তেজস্বী যোদ্ধাও তরবারী ফেলে পালিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে তার ঘোড়ার জীন আপনার ঘোড়ার জীনের চেয়ে অবশ্যই মজবুত। সে কখনো এক আঘাতে তৃপ্ত হয়ে যায় না এবং একটি টিলা দখল করেই সে বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে না। আপনি যদি তার আক্রমণ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে চান, তবে আমি আপনাকে সতর্ক অনুরোধ করবো, আপনি লুকিয়ে পড়ুন।
রাজা রায়চন্দ্র এই চিঠি কনৌজ রাজার কাছে এই পয়গাম দিয়ে পাঠালেন যে, আমি লড়াই করে মৃত্যুবরণ করাকেই প্রাধান্য দেবো। এ ব্যাপারে আপনার করণীয় কি হবে সেটি আপনি ভেবে চিন্তে ঠিক করুন।
আমি জানি, সুলতান মাহমূদ কনৌজকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। কিন্তু এই ধ্বংসপ তার জন্যেই কবরস্থানে পরিণত হবে এবং এই ধ্বংসস্তূপের উপর আবার নতুন কনৌজের জন্ম হবে। সেই কনৌজই হবে গোটা হিন্দুস্তানের নিরাপত্তার প্রহরী।
আমি তোমাদের বলা জরুরী মনে করছি, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ বিষয়টি যাতে সাধারণ সৈনিক ও লোকেরা জানতে না পারে।
রাজার সিদ্ধান্তের কথা শুনে সকল সেনা কর্মকর্তা মাথা নীচু করে রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে এলো।
এ ঘটনার পরের রাতের ঘটনা। কনৌজের প্রধান পুরোহিত মন্দিরের মূর্তির সামনে পুজা অর্চনায় মগ্ন। তখন রাত প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। সাধারণত মধ্য রাতে পুরোহিত পূজা অর্চনায় লিপ্ত থাকে না। কিন্তু কনৌজ রাজার সিদ্ধান্ত পুরোহিতকে পেরেশান করে তুলে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে, সুলতান মাহমূদ আসছে। এসেই প্রথমে মন্দিরের মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করছে। এই আশংকায় শংকিত পুরোহিত তার পূজনীয় দেবদেবীদের পায়ে পড়ে আবেদন নিবেদন করছিল, দেবী ঐশ্বরিক শক্তি প্রয়োগ করে যেনো সুলতান মাহমূদকে কনৌজে পৌঁছার আগেই খতম করে দেয়। বিপর্যস্ত মনে দীর্ঘ সময় ধরে পুরোহিত মূর্তির সামনে কান্নাকাটি করে আবেদন নিবেদন করল এবং চিৎকার করে ভজন আওড়িয়ে নানা তন্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ করল।
ঠিক এমন সময় মন্দিরের একেবারে গোপন প্রকোষ্ঠে পৌঁছার দরজা সশব্দে খুলে গেল। কিন্তু একান্ত মনে মূর্তির সামনে আত্মনিবেদনকারী পুরোহিতের কানে দরজা খোলার শব্দ পৌঁছাল না।
দরজা খোলে একজন নারী পুরোহিতের পেছনে এসে বসল। কিন্তু তখনও পুরোহিত কিছুই টের পেলো না। নারীটি যখন পুরোহিতের কাঁধে হাত রাখল তখন গা ঝাড়া দিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে পুরোহিত দেখতে পেল তার পেছনে রাজার ছোট রাণী শকুন্তলা দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখেছে।
অবাক বিস্ময়াভিভূত পুরোহিত মধ্যরাতে শুকুন্তলাকে মন্দিরে দেখে অবাক কণ্ঠে বললো; আরে! ছোট রাণী! আপনি….. এই গভীর রাতে! অবশ্য পরক্ষণেই বিস্ময় কাটিয়ে পুরোহিত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,… ঠিক আছে আগে দেবীর চরণে মাথা রেখে পদধুলি নিন।
পুরোহিত কি বললো না বললো সে দিকে শকুন্তলা মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। মনে হলো তার কানে পুরোহিতের কথা ধ্বনিতই হয়নি। সে গভীর দৃষ্টিতে পুরোহিতের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। শকুন্তলার তীব্র দৃষ্টিতে পুরোহিতের শরীরে একটা মৃদু কম্পন বয়ে গেল। কারণ পুরোহিত জানতো, শকুন্তলা খুবই দাপটে রাণী এবং রাজার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও প্রিয় রাণী।
তাছাড়া অনিন্দ সুন্দরী শকুন্তলা। শকুন্তলার সৌন্দর্যে যাদুমাখা। পুরোহিতের বুঝতে বাকী রইলো না, এই গভীর রাতে রাণী মন্দিরে পূজা অর্চনা করতে আসেনি। এতোটা ধার্মিক মেয়ে শকুন্তলা নয়। তার আসার ধরন এবং চাহনীর ভাব দেখেই পুরোহিত বুঝে ফেলেছিলেন। শকুন্তলা নিশ্চয়ই কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এই গভীররাতে মন্দিরে এসেছে।
কী ব্যাপার? আপনি আমাকে দেখে এমন ঘাবড়ে গেলেন কেন পণ্ডিত মশাই? এমন সুন্দরী নারী কি আপনি আর দেখেন নি? আপনি যে সব কুমারী মেয়েদের মন্দিরে এনে নিজে ভোগ করেন এবং মানুষদের বলেন, এই কুমারী এখন পবিত্র হয়ে গেছে, ওদের রূপ সৌন্দর্য ও আকর্ষণের চেয়ে আমি মোটেও বেশী আকর্ষণীয় নই।
এসব কথা রেখে আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন সে কথা বললেই বেশী ভালো হয় মহারাণী। আপনি দেখছেন না আমি পূজায় ভজনে লিপ্ত?
পণ্ডিত মহারাজ? যদি আমরা পরস্পর পরস্পরকে ধোকা দিতে চেষ্টা না করি, তাহলে উভয়ের জন্যই তা মঙ্গল হবে। দৃঢ় কণ্ঠে বললো শকুন্তলা। আপনি এসব কিসের পূজা করছেন? এসব দেবদেবীর। যারা দুদিনের মেহমান মাত্র। আপনার হরেকৃষ্ণ আর বাসুদেব মুসলমানদের তো কিছুই করতে পারলো না। কোথায় গেলো আপনার সেই কুমারী বলিদানের ফলাফল? কি লাভ হলো নিরপরাধ এই কুমারীগুলোর জীবন সংহার করে?
আপনিও কি মহারাজের মতো আমাকে ধর্মের ব্যাপারে বিভ্রান্ত করতে এসেছেন?
না, আমি আপনাকে ধর্মের ব্যাপারে জ্ঞান দিতে আসিনি। আমি এসেছি আপনাকে মহারাজা বানাতে। আপনি শুধু আমাকে বলে দিন, রাজ্যের ধনভাণ্ডার আপনি কোথায় রেখেছেন? আপনি আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন। আপনি আর আমি সমস্ত ধনভাণ্ডার নিয়ে কোথাও চলে যাবো। এমনও হতে পারে, আমি আপনাকে কনৌজের রাজ সিংহাসনে বসিয়ে দিতে পারি।
কিসের ধনভাণ্ডার? আমি কোন ধনভাণ্ডারের খবর জানি না।
হ্যাঁ, আমি জানি, আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চেষ্টা করবেন কিন্তু আমি জানি আপনি কি করেছেন, ধনভাণ্ডারের খবর আমাকে দিতেই হবে। আমাকে ধর্ম ও দেবদেবীদের অভিশাপের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ধর্মকে আমি ধোকাবাজি ছাড়া আর কিছু মনে করি না। আমি শুধু ধনভাণ্ডার নিতে আসিনি। আপনাকেও সাথে করে নিয়ে যেতে এসেছি।
ধর্ম যাই হোক, ধর্মকে যারা ধোকা মনে করে তারা দুনিয়াতে সুখে থাকতে পারে না বললো পুরোহিত। জানেন, গযনীর সুলতান কেন একটির পর একটি বিজয় অর্জন করছে। এর কারণ শুধুই ধর্মের প্রতি ভালোবাসা। সে তো গোটা হিন্দুস্তানের সকল মানুষকেই ইসলামে দীক্ষা দিতে চায়। কিন্তু সে আমাদের ধর্মকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করে।
আমাদের ধর্ম ঘৃণা করার মতোই, বললো শুকুন্তলা। পণ্ডিত মহারাজ! আপনি আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। আমি জানি বিগত বিশ পঁচিশ দিন যাবত আপনি রাজ্যের ধনভাণ্ডার কোন অজানা জায়গায় স্থানান্তরিত করেছেন। আপনি ভেবেছেন, আপনি আর মহারাজা ছাড়া এ ব্যাপারটি আর কেউ জানে না। আপনি হয়তো জানেন না, এই রাজ্যের কোন কিছুই আমার কাছে গোপন থাকে না। আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা না করেন, তবে আপনাকে অনেক বেশী মূল্য দিতে হবে।
আপনি কি আপনার স্বামীকে ধোকা দিতে চাচ্ছেন?
কিসের স্বামী? মহারাজা শুধু আমার মতো এক জনের স্বামী নয়। গিয়ে দেখুন, আজ রাত তিনি আর কারো স্বামী। এজন্যই তো আমি আপনার কাছে আসার সুযোগ পেয়েছি। যতক্ষণ আমার রূপ সৌন্দর্য ঠিক আছে ততোক্ষণ পর্যন্ত মহারাজা আমার স্বামী। পণ্ডিত মহারাজ! আপনি জানেন, মানুষ যখন রাজসিংহাসনে বসে মাথায় রাজমুকুট ধারণ করে তখন আর তার মধ্যে মানবীয় আবেগ ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে না। এসব রাজা মহারাজা ধনসম্পদ ও ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুকেই ভালোবাসে না। আমার মতো সুন্দরী কনৌজ কন্যা ও বধুদেরকে গযনীর সুলতান বাদী বানিয়ে নিয়ে যাবে এনিয়ে মহারাজের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তিনি তার ক্ষমতা ও ধনভাণ্ডার রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। আপনার আমার জীবন ও ধর্মের ব্যাপারে তার কোন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই।
ওসব কথা থাক। মহারাজা যা করার তিনি তা করেছেন। আপনি আমি আমাদের চিন্তা করি। আপনি নিজের প্রতি ও আমার প্রতি মনোযোগ দিন। আপনি যাই বলুন মহারাণী! আপনাকে আমি ধন ভাণ্ডারের খোঁজ দিতে পারবো না।
তাহলে তো আপনাকে অপহরণ করা হবে, বললো শকুন্তলা। কিন্তু আমি আপনাকে হত্যা করতে চাই না। প্রয়োজনে আমি আপনার দু’চোখ উপড়ে শরীরের চামড়া খসিয়ে গহীন জঙ্গলে ফেলে দেবো। আপনি সেই করুন মৃত্যুর কথা একটু ভেবে দেখুন, কি ভয়ংকরভাবে ধুকে ধুকে আপনাকে এই সুখের দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে।
আপনাকে আমি সহজে মরতে দেব না। আপনার শরীরে বিষধর পিপড়া, পোকা ছেড়ে দেবো, আপনার জীবন্ত শরীরটাকে শিয়াল, কুকুর, কাক, শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। আপনাকে ধুকে ধুকে মরতে হবে।
নীরব নির্বাক অবস্থায় পুরোহিত শকুন্তলার নির্মমতার পরিকল্পনা শুনছিল। এ সব কথা শুনে তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, তার শরীরটা অবশ হয়ে এলো। যে শকুন্তলা ছিল কনৌজের কিংবদন্তিতুল্য সুন্দরী, সেই সুন্দরী শকুন্তলা সাক্ষাত পেত্নীর রূপ ধরে পুরোহিতের সম্মুখে হাজির হলো। ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম কিন্তু কঠোর ভাষায় ধনভাণ্ডার কজা করার জন্য সে পুরোহিতকে গোপন রহস্য বলে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে লাগল।
শকুন্তলা বললো–
হ্যাঁ, অবশ্য আমি যদি আপনার জীবন সংহার না করতেই চাই তবে অন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবো। আমি এখান থেকে সোজা মহারাজার কাছে গিয়ে বলবো, আপনি আমাকে মন্দিরে ডেকে এনে আমার অসম্মান করেছেন, আমার সম্ভ্রমহানির অপচেষ্টা করেছেন। এ জন্য আমি প্রমাণও জোগার করে নেবো। নিজের নখ দিয়েই সারা শরীরে আঁচড় কেটে বলবো, আমি ধস্তাধস্তি করে আমার শরীরে নখের আঘাতে ক্ষত সৃষ্টি করেছেন আপনি।
এমনটি হলে মহারাজা আপনার কোন কথাই শুনবে না। কারণ মহারাজা জানেন, আপনার মন্দিরে কি হয়। মহারাজা জানেন, মন্দিরের প্রত্যেক পণ্ডিত পুরোহিত একেকজন নারীখেকো ….। ধর্মের দোহাই দিয়ে এখানে কুমারী বালিকাদের ধরে এনে তাদেরকে ভোগ করা হয়। প্রতিটি পুরোহিতই একেকটি নারী খাদক। তাই আপনি আমার বিরুদ্ধে কোন যুক্তিই খাড়া করতে পারবেন না। মহারাজা তার প্রিয় নারীর গায়ে হাত দেয়ার অপরাধে সোজা আপনাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেবেন। অবশ্য এই মৃত্যুটা হবে আপনার জন্যে খুব সহজ মৃত্যু।
না রাণী! আমার প্রতি আপনি এতো নিষ্ঠুর হবেন না। আমি আপনাকে অবশ্যই ধনভাণ্ডারের কাছে নিয়ে যাবো। কখন কোন দিন যাবেন আপনি?
এখনই যাবো। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে মহারাজার কাছে যদি আমার এখবর পৌঁছে তবুও কিন্তু আপনার পরিণতি তাই হবে যা আমি এততক্ষণ আপনাকে বলেছি। আমি দশজন পুরুষ ও দশজন নারীকে মহারাজার সামনে দাঁড় করিয়ে বলবো: আপনি আমাকে ধনভাণ্ডারের লোভ দেখিয়ে আপনার সাথে আমাকে পালানোর প্রস্তাব করেন, আমি আপনাকে হাতে নাতে পাকড়াও করার জন্যে আমার লোকজন নিয়ে ধনভাণ্ডার পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
ধনভাণ্ডার নিয়ে যাওয়ার জন্যে তো বহু লোকের দরকার। এই বিশাল কাজ কি এতোটা কম সময়ে এমন গোপনে করা সম্ভব?
আজ আমি শুধু ধনভাণ্ডার দেখে আসবো, এর পর বাকী কাজ গোপনেই করবো আমি। তা কিভাবে করবো, সে চিন্তা আমার। সেই কাজে আপনাকে আমি সঙ্গেই রাখবো। আপনার সাথে আমি প্রতারণা করবো না।
পুরোহিত উঠে দাঁড়াল।
* * *
তালাল ইবরাহীম সেই রাতটি পাহাড়ের ঢালেই কাটাল। সকাল বেলা তালাল সালেহকে বললো, সে পাহাড়ের সেই গুহাটা দেখতে চায়। কিন্তু সালেহ বললো, সবার আগে সে সেই কাজ করতে চায়, যে জন্যে তাদেরকে এখানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তালাল গুহায় যাওয়ার জন্যে জিদ ধরল। শেষ পর্যন্ত তালালের জেদই বিজয়ী হলো। পুরোহিত যে পাহাড়ী গুহায় চোখ বাধা লোকদের নিয়ে গিয়েছিল। দিনের আলোয় সেই জায়গাটি ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল। গুহার কাছের পাহাড়ী ঢালটি ছিল অবাক করার মতো। ঢালের উপরের অংশটি ছিল খাড়া দেয়ালের মতো। চতুর্দিকে যেন পরিকল্পিত খাড়া দেয়াল। দেয়ালের উপরে নানা গাছ গাছালী ও ঝোঁপ ঝাড়। ঝোঁপ ঝাড়ের লতাপাতাগুলো খাড়া হয়ে উপড়ের দিকে না উঠে গর্তের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। ফলে গুহার দিকে ছায়া পড়ে জায়গাটি একটি পরিত্যাক্ত কুয়ার মতো দেখাচ্ছে।
তালাল ও সালেহ গুহার ভেতরে চলে গেল। বাস্তবেও যেন এটি একটি কুয়া। যা প্রাকৃতিক ভাবে পাহাড়ের ভেতরে তৈরী হয়ে রয়েছে। কুয়ার মতো জায়গাটিতে কিছু পানি ছিল কিন্তু সেখানে পানির চেয়ে কাদাই বেশী। কূয়ার পাড় দিয়ে চলাচলের জন্যে কিছুটা শুকনো মাটির তৈরী পথের মতো ছিল। তালাল ও সালেহ সেই পথ দিয়ে আরো অগ্রসর হলো। কিছুটা অগ্রসর হয়ে তারা দেখতে পেল এটি মাটির তৈরী টিলার মতো। পুরোহিতের লোকেরা এই টিলার আড়ালেই হারিয়ে গিয়েছিল।
উভয়েই মাটির টিলার উপর উঠে দেখল, টিলার ঢালুতে একটি দরজার মতো। দরজাটি ঝুলন্ত লতাপাতা ও গাছ গাছালীতে প্রায় ঢাকা রয়েছে। তারা সেই দরজার মতো জায়গা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পেল কক্ষের মতো একটি জায়গা। তাতে যে কোন মানুষ খাড়া হয়ে প্রবেশ করতে পারবে। ঘর সদৃশ জায়গাটি ছিল অন্ধকার। অন্ধকার ঘরের মতো জায়গাটিতে উভয়েই হাতড়ে হাতড়ে গুপ্তধন তালশ করল কিন্তু মাটি পাথরের অস্তিত্ব ছাড়া তাদের হাতে আর কোন জিনিসের অস্তিত্ব ধরা পড়ল না।
এই ঘরের মধ্যেই একটি গুহার মতো সুড়ং দেখতে পেল তারা। সুড়ং পথটি এতোটাই অন্ধকার যে সেখানে কি রয়েছে তা আন্দাজ করা অসম্ভব। অনেক্ষণ এখানে কাটানোর পর সালেহ বিরক্ত হয়ে তালালকে বললো, তুমি যদি এখানে থাকতে চাও তো থাকো, আমি চললাম।
ক্ষুব্ধ সালেহকে আর বিরক্ত না করে তালালও একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সালেহর অনুগামী হলো। কিন্তু বার বার সে পিছনে ফিরে ফিরে গুহাটি দেখছিল। তালালের অবস্থা দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল, কর্তব্য পালনের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। বনের এই কোনটি ছিল অনেকটা ভূতুড়ে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। সালেহ তালালকে নিয়ে প্রায় চারপাঁচ মাইল দূরে চলে এলো এবং সেখানে একটি পাহাড়ের উপড়ে উঠে দাঁড়ালো। এখান থেকে তারা কন্নৌজ দুর্গের ভেতরকার অবস্থা পরিস্কার দেখতে পাওয়া যায়। দীর্ঘক্ষণ তারা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কনৌজ দুর্গ ও শহরে সৈন্যদের তৎপরতা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু তারা সৈন্যদের কোন তৎপরতা দেখতে পেল না।
সুলতান হয়তো তখন মুনাজের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এখনো আমরা জন্নৌজের কিছুই দেখতে পেলাম না। সালেহ তার সঙ্গী তালালের উদ্দেশ্যে বলল।
দু’জন মানুষ আমরা। আমাদের পক্ষে পায়ে হেঁটে আর কতটুকু এলাকা দেখা সম্ভব, বললো তালাল। এমনও হতে পারে, কনৌজের সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে অন্য কোন পথে মুনাজ চলে গেছে।
সব জায়গায়ই আমাদের লোক আছে’ বললো সালেহ। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, কনৌজ থেকে কোন সেনাবাহিনী দুর্গের বাইরে বের হয়নি।
সারা দিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে রাতের বেলায় তালাল ও সালেহ পুনরায় আগের জায়গায় রাত কাটানোর জন্যে চলে এলো। সালেহ তালালকে বললো, সে রাত সেখানে কাটাবে সত্য? তবে অর্ধেক রাত ঘুমাবে এবং বাকী অর্ধেক রাতে সে কনৌজের আরো কাছে চলে যাবে। কারণ, রাতের বেলায় কনৌজের সৈন্যরা তৎপরতা চালাতে পারে। তারা উভয়েই আগের রাতের জায়গায় শুয়ে পড়ল। সারা দিনের ঘোরাঘুরিতে উভয়েই ছিল ক্লান্ত। ফলে শোয়র সাথে সাথে উভয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
অর্ধরাতের কিছুটা আগে ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজে সালেহের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্কতার প্রয়োজনে সে তালালকে জাগিয়ে দিল। এদিকে তাদের কানে আরো জোরালো হয়ে উঠলো ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ। একটু পরেই এক অশ্বারোহী নজরে পড়ল। সেই সাথে আলোর মশাল।
মনে হচ্ছে আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেছে। দুই তিনটি ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এদের পেছনে হয়তো সেনাবাহিনী আসছে।
তারা উভয়েই হামাগুড়ি দিয়ে এমন একটা জায়গা চলে এলো, যেখানে তাদেরকে কারো পক্ষে দেখা সম্ভব নয় কিন্তু তারা পাহাড়ের ঢালের পাহাড়ের নীচ দিয়ে যাতায়াতকারী সবাইকে পরিস্কার দেখতে পাবে।
কিছুক্ষণ পর তারা দু’জন অশ্বরোহীকে দেখতে পেল। একজনের হাতে একটি মশাল। অশ্বরোহী লোক দু’জন যখন তাদের আরো কাছে এলো, তখন তালাল বললো, মনে হচ্ছে এই লোকটি গত রাতের সেই লোক এবং তার সাথে আসা লোকটি কোন নারী।
হতভাগার দল। সেনাবাহিনীর সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। বললো সালেহ। আগন্তুক অশ্বরোহী কৃয়ার মতো পাহাড়ের গুহার কাছে এসে থামল এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে ফাঁকা জায়গায় প্রবেশ করল । আগন্তুকের একজন ছিল পুরোহিত আর অপরজন রাজ্যপালের কনিষ্ঠা স্ত্রী রাণী শকুন্তলা।
তারা উভয়েই ফাঁকা জায়গার ভেতরে গিয়ে দরজার মতো ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকল।
সালেহ ভাই! আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, চলো না ব্যাপারটি কি দেখে আসি, বললো তালাল।
এটা দেখার কি আছে। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছো, একজন নারী আর একজন পুরুষ। নারী লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোন সাধারণ মহিলা নয় কোন শাহজাদী হবে হয়তো। জবাব দিল সালেহ।
রাতের এই আগন্তুক নারী কিংবা পুরোহিত কারো প্রতি সালেহর কোন আকর্ষন ছিল না। কিন্তু তালালের মন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না। সে সালেহর কথার তোয়াক্কা না করে হঠাৎ করে দৌড়ে নীচে নেমে গেল। সালেহ তাকে আটকাতে পারল না। বাধ্য হয়ে সেও নীচে নেমে এলো।
তারা উভয়েই তাদের পরিধেয় কাপড়ের নীচে একটি করে খঞ্জর ও তরবারী লুকিয়ে রাখতো। উভয়েই তরবারী বের করে অত্যন্ত সন্তর্পনে কাদা পানির কিনারা দিয়ে গুহার একেবারে দরজার মতো ফাঁকা জায়গাটির কাছে। চলে গেল।
পুরোহিতের হাতে রাখা প্রজ্জ্বলিত মশাল গুহার ভেতর থেকে বাইরে কিঞ্চিত আলো বিকিরণ করছিলো। পুরেহিত ও শকুন্তলা কেউই কল্পনা করতে পারেনি, এই গভীর রাতে এখানে তারা দু’জন ছাড়া আর কোন মানুষের অস্তিত্ব থাকতে পারে। পুরোহিত ও শকুন্তলা পরস্পর যে কথাবার্তা বলছিল তালাল ও সালেহ গর্তের বাইরে থেকে তা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল।
রানী। এখানেই ধনভাণ্ডার রাখা হয়েছে। আমি আপনাকে আবারো অনুরোধ করছি, আপনি এই লোভে না পড়ে চলে যান। শকুন্তলার উদ্দেশ্যে বললো পুরোহিত।
এখানে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, বললো শকুন্তলা। কি ব্যাপারে? ধনভাণ্ডার কি এই বিছানার নীচে? জিজ্ঞেস করলো শকুন্তলা।
শুনুন রানী! এখন আমি ইচ্ছা করলে আপনাকে হত্যা করতে পারি। আপনি আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ছিলেন এবং আমাকে কঠোর শাস্তির ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এখন যদি আমি আপনাকে হত্যা করি, তাহলে বলেন কে আমার হাত থেকে আপনাকে বাঁচাবে? আপনাকে আমি হত্যা করে মরদেহ এমন জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে পারি, শতবার তালাশ করেও আপনার মরদেহের কোন চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবে না।
খবরদার পণ্ডিত মশায়! হুমকির সুরে বললো রাণী। মনে করবেন না এই নির্জনে আপনি আমাকে অবলা নারী ভেবে প্রতিশোধ নিয়ে নেবেন। পণ্ডিতজী মহারাজ! আমি আবারো আপনাকে বলছি, নিজেকে ধোকায় ফেলবেন না।
মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও রাণী! যদি কাউকে ডাকার প্রয়োজন হয় তবে খুব জোরে চিৎকার করতে পারো, তবে কোন লাভ হবে না।
দোহাই পণ্ডিতজী মহারাজ! খঞ্জর বের করবেন না। দয়া করে আমার একটি কথা শুনুন। হাত দরাজ করে প্রার্থনার সুরে বললো শকুন্তলা।
এ সময় গুহার ভেতর থেকে ধস্তাধস্তি ও অস্বাভাবিক কিছু আওয়াজ শোন গেলো। পুরোহিত শকুন্তলার উপর আক্রমণ করছিলো আর শকুন্তলা বাঁচার জন্যে চেষ্টা করছিলো এবং পুরোহিতের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে শকুন্তলা গুহার ফাঁকা জায়গায় দৌড়াচ্ছিলো।
পলায়নপর শকুন্তলাকে ধরার জন্যে পুরোহিত ছুটাছুটি করছিলো। জ্বলন্ত মশালটি তখন এক জায়গায় মাটিতে গেড়ে দেয়া হয়েছিল। বড় একটি ঘরের মতো গুহাটি ছিল মশালের আলোয় আলোকিত।
পুরোহিত শকুন্তলাকে দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে গুহায় প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। এদিকে শকুন্তলাও পালানোর জন্যে গুহার প্রবেশ মুখের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে থেমে গেল। তারা উভয়েই দেখতে পেল ভবঘুরে বেদুঈনের বেশে ময়লা ছেঁড়া পোশাকের দুটি লোক খোলা তরবারী নিয়ে গুহা দাঁড়ানো।
অবস্থা দেখে পুরোহিত ও শকুন্তলা উভয়েরই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। এদিকে তালাল সালেহ ও নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। কোন কথা বলছিল না।
নিজেকে সামলে নিয়ে খুবই দৃঢ়তা ও গম্ভীর কণ্ঠে পুরোহিত বললেন, কে তোমরা? এখানে কিসের জন্য দাঁড়িয়ে আছো? চলে যাও এখান থেকে। এখানে আমাদের অনেক লোক আছে। ওরা এলে তোমাদের টুকরোও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হাতের খঞ্জর ফেলে দাও, দৃঢ় অথচ সহজ গলায় বললো তালাল। খঞ্জর ফেলে দিয়ে উভয়েই আমাদের সামনে এসো। এখানে তোমরা কি করছো, কি আছে এখানে?
পুরোহিত স্মিত হেসে বললেন, আমরা মুসাফির। আমরা কনৌজ যাবো। এই মহিলা আমার বিবি। বাইরে আমাদের ঘোড়া দাঁড়ানো রয়েছে। রাতটা কাটানোর জন্যে আমরা এখানে যাত্রা বিরতি করেছি।
সালেহ নীরবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তালাল কিছুটা অগ্রসর হয়ে এক ঝটকায় পুরোহিতের হাত থেকে খঞ্জরটা ছিনিয়ে নিয়ে তার তরবারীর আগা পুরোহিতের ঘাড়ে ঠেকিয়ে বললো
জীবন বাঁচাতে চাও তো সত্য বলো, এখানে কি আছে? ইচ্ছা করলে আমরাও তা খুঁজে দেখতে পারি, কিন্তু তখন আর তুমি বেঁচে থাকবে না এবং এই নারী থাকবে আমাদের দখলে। তালাল শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি কি বলছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। অতএব পরিণতি কি হতে পারে একটু চিন্তা কর।
এখানে ধনভাণ্ডার আছে। তোমরা যা চাও, তাই আমি তোমাদের দিয়ে দেবো। তোমরা তা নিয়ে চলে যাবে। বললো শকুন্তলা।
হ্যাঁ, এখানে ধনভাণ্ডার লুকানো রয়েছে। সে যা বলেছে তাই সত্য। বললেন পুরোহিত।
এই পাহাড়ে ধনভাণ্ডার কোত্থেকে এলো। আর তোমাদের পরিচয় কি? জানতে চাইলো তালাল।
আমি কনৌজের প্রধান মন্দিরের প্রদান পুরোহিত। আর সে কনৌজ রাজার স্ত্রী রাণী। তোমরা যদি পুরস্কার নিতে চাও, তবে আমি তোমাদের পুরস্কার দিয়ে দেবো। কিন্তু তোমাদেরকে পুরস্কার নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তালালের উদ্দেশ্যে বললো পুরোহিত।
চলে যাবো না থাকবো সেটা আমরা ভেবে দেখবো। এর আগে বলো ধনভাণ্ডার কোথায়? পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলো তালাল। এসো। বলে রাণী শকুন্তলা তালালের বাজু ধরে তাকে নিয়ে গুহার কাছে চলে গেল এবং বললো, আমি তোমাকে ধনভাণ্ডার দেখিয়ে দিচ্ছি।
শকুন্তলার আহ্বানে তালাল তার সঙ্গে চলে গেল। সালেহ তাকে বাধা দিল কিন্তু তালাল বাধা মানল না। সালেহ তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে কি করবে। সে তালালের অনুসরণও করতে পারছে না, আবার পুরোহিতকেও ছেড়ে যেতে পারছে না। কারণ, পুরোহিতকে ছেড়ে দিলে সে হয়তো তার অন্য লোকদের ডেকে নিয়ে আসতে পারে। এদিকে শকুন্তলার মতো সুন্দরী নারীর সাথে তালালের চলে যাওয়াটাকেও সে মেনে নিতে চাচ্ছে না। কিংকর্তব্য বিমূঢ় অবস্থায় সালেহ হাতের তরবারী উঠিয়ে পুরোহিতের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালেহ আশংকা করছিল, তালাল জীবিত ফিরে এলেও এই সুন্দরী নারীর কুপ্রভাব তার উপর পড়বেই পড়বে।
শকুন্তলা ও তালাল কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। তালালের চেহারা ও তার ভাবভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল, সে আর গযনী বাহিনীর দৃঢ়চেতা কর্তব্য পরায়ন গোয়েন্দা নয়; সে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন তালাল।
তালাল এসেই পুরোহিতকে বললো, সে যেন বলে দেয় আসলে ধণভাণ্ডার কোথায় আছে?
এ সময় সালেহ হুংকার দিয়ে বললো; তালাল! বেরিয়ে এসো ওখান থেকে।
তালাল সালেহ’র দিকে একবার তাকিয়ে পুরোহিত ও শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমরা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসো। এর পর তালাল সালেহকে ওখান থেকে একটু দূরে নিয়ে বললো,
সালেহ ভাই! আমার কথাটি মনোযোগ দিয়ে শোন। আমি মোটেও কর্তব্য ভুলে যাইনি এবং কর্তব্য পালনে কোনরূপ অবহেলা করছি না। আমি তোমাকে ধোকা দিচ্ছি না। এখান থেকে আমরা দুজনে যদি কিছু নিয়ে নেই তাতে ক্ষতি কি?
তালাল! তোমার শরীর থেকে আমি এই মহিলার দুর্গন্ধ পাচ্ছি, সেই সাথে তোমাকে অপবিত্র মনে হচ্ছে। নারীর সবচেয়ে বড় শক্তিই হচ্ছে তার নারীত্ব আর পুরুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তার পৌরুষত্ব। আমার তখনই সন্দেহ হচ্ছিল ওই মহিলা তোমাকে কোন মন্দ উদ্দেশ্যে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি দাবি করছে, আমাকে তুমি কোনরূপ ধোকা দিচ্ছে না।……..
কিন্তু আমি মনে করছি এই নারী ও গুপ্তধন তোমার ও আমার মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে কেন্দ্র করে তুমি ও আমি এক সময় একে অন্যের প্রতিপক্ষে পরিণত হতে পারি। তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়, সুলতান মাহমূদের জয় পরাজয় তোমার ও আমার কর্তব্য পালনের উপরই নির্ভর করে।
সালেহ ভাই! আমার কথাটি একটু শোন। আমরা হিন্দুস্তানের মানুষ। গযনীর লোকেরা আমাদের কি দেয়? গযনী সেনাবাহিনীর কাছ থেকে আমরা যে সামান্য পারিশ্রমিক পাই, মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে এই জটিল কাজের এতটুকু বিনিময় কি যথেষ্ট।
যে দায়িত্ব আমরা কাঁধে তুলে নিয়েছি, এর প্রতিদান দেবেন মহান আল্লাহ। তালাল! তুমি কেন নিজেক গযনী সেনাদের কর্মচারী মনে করছে। আমরা গযনী বাহিনীর কর্মচারী নই; ইসলামের সৈনিক।
সালেহ ভাই! হাতের কাছে এতো বিপুল সম্পদ পেয়েও তা ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না।
নিজের লক্ষ্যের কথাটি একবার স্মরণ করো তালাল। আমরা কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে শপথ করে ছিলাম কর্তব্য পালনে প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দেবো। কিন্তু কর্তৃপক্ষকে ধোকা দেবো না। আমরা শপথ করেছিলাম, আমাদের পায়ের নীচে যদি স্বর্ণমুদ্রার স্তূপ ঢেরে দেয়া হয় তবুও সেদিকে তাকাবো না। সর্ববস্থায় নিজের ঈমানকে রক্ষা করবো। প্রিয় তালাল! কখন কার মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। এমনও হতে পারে ঈমানের বিপরীতে এই সম্পদ জীবনে ভোগ করার সময়ই পাওয়া যাবে না, এর আগেই মৃত্যু এসে যাবে।
ঠিক আছে সালেহ ভাই! আমাকে সময় মতো পরীক্ষা করে নিও। এখন তুমি একটু এখানে দাঁড়াও, আমাকে ওখান থেকে কিছু নিয়ে আসার সুযোগ দাও। এই বলে তালাল সালেহর কথায় প্রক্ষেপ না করেই আবার পুরোহিতের কাছে চলে গেল।
তালাল পুরোহিতকে বললো, আমাকে ধনভাণ্ডারের কাছে নিয়ে চলো।
হ্যাঁ, পণ্ডিত মহারাজ! এখন আর আমাদের অপেক্ষা করার সময় নেই। চলুন! তালালের সুরে সুর মিলিয়ে শকুন্তলাও পুরোহিতকে ধনভাণ্ডার দেখিয়ে দেয়ার তাগাদা দিল।
পুরোহিত বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে ফাঁকা দেয়ালের এক জায়গায় আঙুল রেখে তালাল ও সালেহর উদ্দেশ্যে বললো, তোমরা উভয়েই তোমাদের তরবারী বর্শার মতো করে এখানে আঘাত করো।
পুরোহিতের কথায় সালেহ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে ঠায় নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল। তালাল অগ্রসর হয়ে সেখানে তরবারী দিয়ে আঘাত করলে তরবারী অর্ধেকেরও বেশী সেখানে দেবে গেল। এবার তালাল সালেহকে আসার জন্যে ডাকল। কিন্তু সালেহ বললো, তোমাদের এই ধনভাণ্ডারের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। সালেহ তরবারী তালালের দিকে নিক্ষেপ করে বললো, এই নাও তরবারী। যা করার তুমিই করো।
পুরোহিত তরবারী উঠিয়ে নিয়ে তালালের তরবারীর পাশে বিদ্ধ করে তালালকে বললো, এখন তরবারী দুটো আরো ডানদিকে দাবিয়ে দাও।
উভয় তরবারী যখন ডান দিকে দাবিয়ে দিল, তখন মাটির একটি চাকার মতো ধীরে ধীরে সরে আসতে শুরু করল। এখানে নিশ্চয় আলগা মাটির কোন দেয়াল আছে। তালাল মাটির দেয়ালটিকে শক্ত করে টান দিলে সেটি গড়িয়ে পড়ে গেল এবং একটি সুড়ং এর মতো ফাঁকা জায়গা বেরিয়ে এলো।
রাণী! তুমি এই সুড়ং পথে ঢুকে পড়ে। রাণীর উদ্দেশ্যে একথা বলে পুরোহিত তালালের উদ্দেশ্যে বললো
তুমিও এর মধ্যে প্রবেশ কর। আমি মশাল নিয়ে তোমার পেছনে পেছনে আসছি।
সালেহর দিকে তাকিয়ে পুরোহিত বললো, তুমি! তুমি কি ভেতরে যাবে?সালেহ মাথা নেড়ে বললো–
না, আমি ঢুকবো না।
সালেহর অনাগ্রহ দেখে পুরোহিতের ঠোঁটের কোণায় স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
রাণী শকুন্তলা, পুরোহিতের কথা শোনেই মাথা নীচু করে সুড়ং এর মধ্যে ঢুকে পড়ল। তার পিছু পিছু তালালও প্রবেশ করল। পুরোহিত তাদের উদ্দেশে বললো, অন্ধকার দেখে তোমরা ভয় করো না।
সালেহ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছিল, পুরোহিত হয়তো মশাল নিয়ে ওদের পিছু পিছু যাবে। কিন্তু ওরা ভেতরে প্রবেশ করার পর পুরোহিত মশালের দিকে ভ্রূক্ষেপই করল না।
একটু পরেই সুড়ং এর ভেতর থেকে কোন কিছু পিছলে পড়ার শব্দ শোনা গেল। এরপর দুবার ধমকের আওয়াজ শোনা গেল। এরই মধ্যে কানে ভেসে এলো শকুন্তলার ক্ষীণ চিৎকার। এ সময় পুরোহিত আড় চোখে সালেহর দিকে তাকাল। পুরোহিতের ঠোঁটের স্মিত হাসি তখন আরো প্রলম্বিত হয়েছে।
ততক্ষণে সুড়ং এর ভেতরে শোনা গেল তালালের চিৎকার।
সালেহ ভাই! আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো।
তালালের চিৎকার শুনে কোন বিপদ মনে করে সালেহ সুড়ং এর ভেতরের দিকে দৌড় দিতে চাচ্ছিল ঠিক তখনই পুরোহিত তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলল–
তুমি বলেছিলে এ সব ধনভাণ্ডারে প্রতি তোমার কোন আগ্রহ নেই। তাই তুমি এখানেই থাকো। তোমার মতো মানুষের বেচে থাকার দরকার আছে।
সুড়ং এর ভেতর থেকে ক্রমান্বয়ে শকুন্তলা ও তালালের আর্তচিৎকার আরো প্রকট ভাবে আসতে লাগল। চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল তারা সুড়ং এর মধ্যে কোন গভীর গর্তে পড়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সালেহ করণীয় কি বুঝে উঠতে পারছিল না। সে এটাও বুঝতে পারছিল না আসলে ভেতরে ওরা কেন চিৎকার করছে। সে নীরবে পুরোহিতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। কিছুক্ষণ পর সালেহ পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল, ওরা ভেতরে চিৎকার করছে কেন? পুরোহিত জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়ে সালেহকে বললো,
তুমি আমার পেছনে পেছনে এসো। তোমাকে চিৎকারের কারণ দেখাচ্ছি।
পুরোহিত মশাল নিয়ে আগে আগে সুড়ং পথে প্রবেশ করল। সালেহ পুরোহিতকে অনুসরণ করল। পনেরো বিশ কদম অগ্রসর হয়ে পুরোহিত থেমে গেল এবং সালেহর উদ্দেশ্যে বলল, তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াও! সাবধান সামনে অগ্রসর হবে না।
পুরোহিত এবার হাতের মশালটিকে নীচের দিকে তাক করাল। সালেহ উঁকি দিয়ে দেখতে পেল, সামনে একটি গভীর কূপ। সেই গভীর কূপ থেকে শকুন্তলা ও তালালের আর্তচিৎকতার ভেসে আসছে। ততক্ষণে তাদের আর্তচিৎকার অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
পুরোহিত সালেহর উদ্দেশ্যে বলল, চলো, এবার এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। উভয়েই যখন সুড়ং এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, তখন পুরোহিত মাটিতে ক্লান্তিতে বসে পড়ল এবং সালেহর উদ্দেশে বলল, এসো, এখানে বসো। এখন বন্ধুর মতো তোমাকে আমি দুটি কথা বলবো।
সালেহ পুরোহিতের কাছে জানতে চাইলো, আগে আমাকে বলো, যা দেখলাম, তা আসলে কি? তুমি তো তাদেরকে ধনভাণ্ডার দেখতে পাঠিয়ে ছিলে?
আরে দোস্ত! আগে বলো, তোমার পরিচয় কি? সালেহকে জিজ্ঞেস করলো পুরোহিত। তুমি যদি পরিচয় দিতে না চাও। তবে আমি তোমার পরিচয় বলে দিতে পারি। আসলে তুমি মুসলমান। অবশ্য মুসলমান হলেও তুমি হিন্দুস্তানী মুসলমান। তবে তোমরা উভয়েই গযনী বাহিনীর গোয়েন্দা। কি? আমি ঠিক বলিনি?
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছে। পুরোহিতের কথায় সায় দিলো সালেহ। কিন্তু আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
যে গভীর কুপ তুমি দেখেছে, এই কূপের মধ্যে হিন্দুস্তানের সবচেয়ে ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ রয়েছে। যে সাপে এদের ধ্বংস করেছে।
এ গর্ত আমি খুঁড়েছি এবং এর মধ্যে সাপও আমিই রেখেছি। গর্তের উপড়ে খড়কুটা বিছিয়ে তাতে মাটির আবরণ দিয়েছি। এরা সাথে মশাল নিয়ে গেলেও বুঝতে পারতো না, মাটির নীচে গভীর গর্ত রয়েছে, আর সেই গর্তে অপেক্ষা করছে ওদের মরণ! বললো, পুরোহিত।
তাহলে ধনভাণ্ডার কোথায় রেখেছো? পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলো সালেহ।
ওখানেই আছে, তবে ধনভাণ্ডারে যেতে হলে গুহার উপরে কোন পাটাতন রেখে সেটি পেরিয়ে যেতে হবে। অবশ্য এছাড়াও নিরাপদ আরেকটি পথ আছে।
যাক আমাকে আর সেই পথের কথা বলোনা, পুরোহিতকে থামিয়ে দিল সালেহ। তাহলে হয়তো আমিও কর্তব্য ভুলে পথচ্যুত হয়ে যাবো।
অচেনা বন্ধু! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমাকে আমি মূল্যবান তথ্য দিচ্ছি। কারণ, তোমার মধ্যে আমি ধনসম্পদের লোভ দেখিনি। লোকে বলে যেখানে ধনরত্ম লুকানো থাকে সেখানে নাকি অবশ্যই সাপ বিচ্ছু থাকে। যে সাপ বিচ্ছ ধনরত্মকে পাহারা দেয়। কথাটি মোটেও সত্য নয়। লোকেরা এও বলে, গুপ্তধন বিষাক্ত সাপের মতো বিষাক্ত হয়ে থাকে। কেউ যদি গুপ্তধন পেয়েও যায় তবে সাপে পরিণত হয়। একথার কারণ হলো, কেউ যাতে গুপ্তধন ছিনিয়ে নেয়ার সাহস না করে।….
দোস্ত! তুমি এখনো যুবক! তুমি এই দুনিয়ার অনেক কিছুই দেখোনি। আমি অনেক কিছু দেখেছি। অনেক কিছু শুনেছি। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেক কিছু আছে। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পেরেছি যার ভেতরে ধনসম্পদের লোভ লালসা বাসা বাধে সে আর মানুষ থাকে না। এই গুহায় যে সাপগুলো রয়েছে মনে করতে পারো এগুলো মানুষের পাপের ফসল। সাপের একটি দিক হলো লোভ, অপর দিকটি হলো লালসা। আর তৃতীয় আরেকটি দিক আছে যাকে বলা হয় খ্যাতি। প্রতিটি পাপই একটি সাপ। এ সাপগুলো মানুষের পায়ের নীচেই গড়াগড়ি করে। ধর্ম কর্ম ত্যাগ করে ধনসম্পদ পেয়ে যদি মানুষ সব কিছু পেয়ে গেছে বলে উল্লাসিত হয় এবং মনে মনে যদি ভাবে আমি পৃথিবী জয় করে ফেলেছি, তাহলে তার বিবেক অন্ধ হয়ে যায়। বিবেকের অন্ধত্বের কারণে একটু ইঙ্গিতেই
সে এ ধরনের সাপের গুহায় গিয়ে স্বেচ্ছায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর তার অতি লোভ তার জীবনকেই কেড়ে নেয়। দোস্ত! আমিও ইচ্ছা করলে এই ধনভাণ্ডার হাতিয়ে নিতে পারতাম। আমি ছাড়া আর কেউ এই ধনভাণ্ডারের খবর জানে না। এই ধনভাণ্ডারের যে প্রকৃত মালিক সেই জানে না, ধনভাণ্ডার কোথায় রাখা হয়েছে। কিন্তু যে দিন থেকে এই ধনভাণ্ডার হেফাযতের দায়িত্ব আমার উপর এসেছে আমি পথ ভ্রষ্ট হওয়ার আশংকায় সারারাত পূর্জা অর্চনা করে কাটিয়েছি।
তোমার ধর্ম সত্য হলে এই ধনরাজী তোমাকে বিভ্রান্ত করতে পারতো না বললো সালেহ। আমাকে দেখ না। তুমি আমাকে বলেই দিয়েছো, সাপের গুহার উপরে কোন পাটাতন রেখে গর্ত পেরিয়ে গেলেই ধনভাণ্ডার পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতেও এই ধনভাণ্ডারের প্রতি আমি মোটেও আগ্রহবোধ করছি না। আমি আমার কর্তব্য পালনের ব্যাপারেই চিন্তা করছি। সালেহ পুরোহিত আরো বললো, আমার একটি কথা মন দিয়ে শোন পণ্ডিত! তোমাকে দিয়ে আমি আমার কর্তব্য কর্ম পূর্ণ করতে চাই। আমি পবিত্র কুরআন হাতে নিয়ে শপথ করেছি, কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমি জীবন বিলিয়ে দেবো, কখনো কোন লোভ লালসার শিকার হবো না। এখন তোমার প্রাণ আমার হাতে তুমি যদি আমার প্রশ্নের জবাব না দাও, তাহলে বাধ্য হয়েই আমি তোমাকে সাপের গুহায় নিক্ষেপ করবো।
তুমি কি নিজেকে এতোটাই বুদ্ধিমান মনে করো? এই বলে তীর্যক দৃষ্টিতে সালেহর দিকে তাকিয়ে বললো পুরোহিত,
পুরোহিতের কথায় সালেহ হেসে ফেললো। পরক্ষণেই তার হাসি মিলিয়ে গেল পুরোহিতের চেহারায় বিস্ময়কর আত্মবিশ্বাস দেখে। কারণ, পুরোহিত এক হাতে মশাশল নিয়ে নিয়েছে এবং অপর হাতে তরবারী। পুরোহিতের হাতের মশালের হাতল ছিল তরবারীর চেয়েও অনেক দীর্ঘ। পুরোহিত হঠাৎ এমন দ্রুত উঠে গেল যে, সালেহ তার অবস্থান থেকে নড়তেই পারল না।
এবারে পুরোহিত সালেহকে হুমকি দিল, তোমার হাতেও তরবারী আছে এবার এসো, তুমি তোমার কর্তব্য পালন কর, আর আমি আমার কর্তব্য পালন করি।
সালেহ যখন তরবারী উঠিয়ে পুরোহিতের দিকে অগ্রসর হলো, তখন পুরোহিত দীর্ঘ হাতলধারী জ্বলন্ত মশাল দিয়ে সালেহর চেহারায় আঘাত করল এবং সালেহর চেহারা ঝলসে গেল এবং তার দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো। এবার পুরোহিত চিৎকার দিয়ে বললো, পারলে আমার আঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাও।
পুরোহিতের চিৎকার শুনে সালেহ লাফ দিয়ে সেখান থেকে সরে গেল।
পুরোহিত আবারো হুমকি দিয়ে বললো, আমি তোমাকে মোকাবেলা করার পূর্ণ সুযোগ দেবো তুমি তোমার কর্তব্য পালন করতে পার।
সালেহ কৌশল বদল করে পুরোহিতের উপর আঘাত করতে চেষ্টা করছিল কিন্তু প্রতিবারই পুরোহিত মশাল দিয়ে সালেহের আঘাত ঠেকিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু পুরোহিত সালেহর উপর কোন আঘাত হানল না। সালেহ একের পর এক আঘাতের চেষ্টা করে হাফিয়ে উঠলো। সালেহর কয়েকটি আঘাত গর্তের দেয়ালে গিয়ে আঘাত করল। এক পর্যায়ে পুরোহিত এক হাতে মশাল ও অন্য হাতে তরবারী নিয়ে সালেহর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করতে শুরু করল। সালেহ পুরোহিতের প্রতিটি আঘাতই তরবারী দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু পুরোহিতের প্রচণ্ড এক আঘাতে সালেহর তরবারী হাত থেকে দূরে ছিটকে পড়ল। এবার পুরোহিতের মশালের উত্তাপের চাপে সে পিছু হটতে লাগল । যেই সালেহ পিছিয়ে গিয়ে তরবারী উঠাতে চাইল, তখন পুরোহিত তরবারী দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করল। এবার বাঁচার জন্যে সালেহ বসে গেল। এবার পুরোহিত মশাল দিয়ে সালেহর চেহারায় আঘাত করতে চাইলে সে বসে বসেই আরো পেছনে সরে গেল এবং বসে বসেই পিছনের দিকে সরতে লাগল। পেছন ফিরে সালেহর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না যে, সে সাপের গুহার পাড়ে চলে এসেছে।
এবার পুরোহিত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, দেখে নাও, তুমি এখন কোথায় এসে পৌঁছেছে। তোমার পেছনেও মরণ আগেও মরণ। বলো, বাঁচতে চাও না মরতে চাও।
মরণে আপত্তি নেই, বললো সালেহ। কারণ, আমি ধনরত্নের লোভে মরছি না। কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মরছি। এসো, আঘাত করো পণ্ডিত। মরতে মরতেও লড়ে যাবো।
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে পণ্ডিত বললো, না তোমার মরার দরকার নেই, বাইরে বেরিয়ে এসো। একথা বলে পুরোহিত মশাল নিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলো।
রণক্লান্ত বিধ্বস্ত পরাজিতের মতোই গুহার বাইরে বেরিয়ে এলো সালেহ।
পণ্ডিত গুহা থেকে বাইরে বের হয়ে মশালের হাতল মাটিতে গেড়ে দিয়ে তরবারীটি ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে বসে পড়ল। পণ্ডিত যেন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, সালেহ আর তার উপর হামলা করবে না।
এখানে বসো, অনেকটা নির্দেশের ভঙিতেই সালেহকে বললো পণ্ডিত।
কাবুতে পেয়েও তুমি আমাকে কেন হত্যা করোনি? কেন আমাকে তুমি সাপের গুহায় গড়িয়ে পড়তে পিছু হটতেবাধ্য করেননি? বসতে বসতে সালেহ পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমার দৃষ্টিতে হত্যা করার মতো কোন অপরাধ তুমি করোনি। বরং তোমার কর্তব্য পালন আমাকে মুগ্ধ করেছে’ বললো পুরোহিত। তুমি আমার মতোই কর্তব্যপরায়ণ এবং নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তোমার মধ্যে লোভ-লালসা নেই। যুদ্ধ বিগ্রহকে আমি ঘৃণা করি। আমি ধর্মের সেবক বটে কিন্তু এক সময় আমি সৈনিক ছিলাম। এর প্রমাণ তুমি হাতে নাতে পেয়েছে। যে ভাবে তুমি আমাকে জব্ধ করতে চেয়েছিলে তা কোন সাধারণ লোকের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব হতো না। ধনভাণ্ডারকে তুমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে । এজন্য আমি তোমাকে পুরস্কৃত করতে চাই।
তুমি যদি আমাকে পুরস্কৃত করতেই চাও, তাহলে সেই জিনিস তুমি আমাকে দাও, যা আমি তোমার কাছে চাই, বললো সালেহ। তোমার এই ধনভাণ্ডার থেকে আমার কিছুই দরকার নেই।
কি চাও তুমি? জিজ্ঞেস করল পুরোহিত।
কনৌজে সৈন্যরা কোথায় সুলতান মাহমুদের সাথে মোকাবেলা করার পরিকল্পনা করেছে? তারা কি দুর্গবন্দী হয়ে লড়াই করবে, না দুর্গের বাইরে গিয়ে গযনী বাহিনীর মোকাবেলা করবে?
শোন দোস্ত! আমরা একে অন্যের শত্রু। আমাকে তুমি এমন কোন প্রশ্ন করো না যে প্রশ্নের জবাব দিলে আমার দেশ ও জাতির ক্ষতি হতে পারে এবং তাতে সুলতান মাহমূদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে পারে। তুমি একজন বিশ্বস্ত দেশ প্রেমিক। এজন্য আমি তোমাকে একটি জরুরী কথা বলে দিতে চাই। শোন বন্ধু! আমি যে কথা তোমাকে বলবা সেটি তোমার জন্যে বিরাট পুরস্কার। তুমি এখান থেকেই চলে যাও এবং ফিরে গিয়ে তোমার সুলতানকে বলো, তিনি যেন কনৌজের দিকে অগ্রসর না হোন। আমাদের মহারাজা প্রতীজ্ঞা করেছেন, কনৌজে এলে সুলতান মাহমূদকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারবেন এবং গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী জায়গাটিকে তিনি গযনী বাহিনীর জন্যে কবরস্তানে পরিণত করবেন।
তোমাদের মহারাজার কাছে কি এমন শক্তিশালী সেনাবাহিনী আছে? পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলো সালেহ।
যদি কোন সেনাবাহিনী শত্রুকে সম্পূর্ণ ধবংস করার দৃঢ় সংকল্প করে তখন সে তার সামর্থ ও শক্তির দিকে তাকায় না। বললো পুরোহিত। পুরোহিত আরো বললো, কনৌজের প্রতিটি নারী শিশু পর্যন্ত গযনী সুলতানের উপর মূর্তি ও মন্দির ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। তাছাড়া কনৌজের মহারাজা শুধু একা নন, তার সাথে লাহোরের মহারাজা ভীমপালও রয়েছেন। তার সেনাবাহিনী এখানে পৌঁছে গেছে।
ভীমপাল এখন কোথায়? তার সৈন্যরাই বা কোথায়?
একথা আমি তোমাকে বলতে পারবো না দোস্ত বললো পুরোহিত। আমি তোমাকে যে কথাটা বলতে চাচ্ছি তুমি এখান থেকে ফিরে গিয়ে তোমার সুলতানকে সতর্ক করো। তাহলে তিনি হয়তো খুশী হয়ে তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। তাকে বলল, এই জঙ্গলাকীর্ণ গোটা এলাকা জুড়ে তার জন্যে মৃত্যুর জাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে, এই জাল ছিন্ন করে তিনি বেরিয়ে যেতে পারবেন না। এখানে এলে তার বাহিনীরও সেই অবস্থা হবে, তার বাহিনীর হাতে মহাবনের সৈন্যদের যে অবস্থা হয়েছিল। মহাবনের সৈন্যরা যমুনায় ডুবে মরেছিল, এখন গযনী বাহিনীকেও সেই নদীতেই ডুবে মরতে হবে। ভীমপালের সৈন্যরা ছাড়াও এখানে রয়েছে মথুরা বুলন্দ শহরও মহাবনের পালিয়ে আসা সৈন্যরা। এ সব ফেরারী সৈন্যদের সমন্বয়ে আরেকটি সেনা দল তৈরী করা হয়েছে। এরা সবাই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে। এখানে এলে তোমাদের সুলতানের পক্ষের দুর্গ অবরোধ করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। ……।
দোস্ত! বাস্তবে সুলতান মাহমূদকে এখনো সাত্যিকার প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। অথচ তার বাহিনী এখন কোন কঠিন মোকাবেলা করার উপযুক্ত নয়। আমাদের মহারাজারা তাকে সুযোগ দিয়েছেন, যাতে তিনি কনৌজের জালে এসে পা দেন। তিনি কিন্তু এই জালেই পা দিতে আসছেন। তাই তুমি দ্রুত ফিরে যাও এবং তাকে ফেরাও। তাকে গিয়ে বলো, অনর্থক মানুষের জীবন হানি ঘটানো এবং বিদেশে এনে নিজ দেশের সৈন্যদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া থেকে তিনি যেন বিরত থাকেন। এখানে এসে জীবন্ত পুড়ে মরার চেয়ে গযনী গিযে রাজার বেশে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়।
এ কথার পর তারা দু’জনই পাহাড়ের কাছেই সমতলে বেঁধে রাখা ঘোড়ার কাছে এলো। দুটি ঘোড়া পাশাপাশি বাধা ছিল। একটিতে সওয়ার হয়ে এসেছিল শকুন্তলা অপরটিতে এসেছিল পুরোহিত।
পুরোহিত সালেহকে একটি ঘোড়া দেখিয়ে বললো, এই ঘোড়াটি শুকুন্তলার। যে গর্তে তোমার সঙ্গীর সাথেই মরেছে। তুমি ওর ঘোড়াটি নিয়ে যাও।
রাতের পর দিনের প্রথম প্রহরে পুরোহিত মহারাজা রাজ্যপালের রাজপ্রাসাদে মহারাজার সামনে উপবিষ্ট। পুরোহিত মহারাজাকে জানালেন, তার অতি প্রিয় রাণী শকুন্তলাকে ধনভাণ্ডার গ্রাস করে ফেলেছে। পুরোহিত গত রাতের শকুন্তলা ও তার মধ্যকার ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা মহারাজাকে বললেন। শকুন্তলার মৃত্যুর ঘটনা শুনেও রাজার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। মহারাজা এই ঘটনা শুনে স্মিত হাসলেন এবং পুরো ব্যাপারটি বুদ্ধিমত্তার সাথে সামাল দেয়ার জন্যে পুরোহিতকে ধন্যবাদ জানালেন।
আমি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি মহারাজ! উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো পুরোহিত। রাণী শকুন্তলার সাথে গয়নীর এক গোয়েন্দাকেও সাপের গর্তে নিক্ষেপ করেছি। আর এক গোয়েন্দাকে প্রতারিত করে জীবন ভিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্ত করে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাকে বলে দিয়েছি, তুমি গিয়ে বলবে, তোমাদের সুলতান যেন কনৌজের দিকে পা না বাড়ায়।
পুরোহিত সালেহকে যা কিছু বলেছিলেন সবই মহারাজা রাজ্যপালকে বলল। তিনি আরো বললো, মহারাজ! আমি আপনার মর্যাদা ও সম্মানের জন্য মন্দিরের সম্মান রক্ষার্থে এবং আপনার বিজয়ের জন্যে মিথ্যা বলেছি। আপনি আমার এই মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে দেখাবেন।
ধনভাণ্ডারের চিন্তা করার দরকার নেই। ভগবানের দয়ায় ধনভাণ্ডার পর্যন্ত কেউ পৌঁছাতে পারবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, যে কথা আমি গোয়েন্দাকে বলে দিয়েছি এর ফলে সুলতান মাহমূদ আতংকিত হয়ে পড়বে। এখন আপনি কিছু সৈন্য শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিন। লড়াই করুন মহারাজ! লড়াই করুন!
পণ্ডিত মহারাজ! আপনি এক গোয়েন্দার মাধ্যমে সুলতান মাহমূদকে বিভ্রান্তিকর খবর দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন বললেন মহারাজা রাজ্যপাল। মহারাজা তখন তার কাছে রক্ষিত ভীমপালের চিঠি পুরোহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই চিঠিটি ভীমপাল রায়চন্দ্রকে লিখেছিলেন, রায়চন্দ্র সেটি আমার কাছে একটি নোটসহ পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একি? এটি সেই ভীমপালের চিঠি যাকে লোকে নির্ভিক অকুতোভয় বলে ডাকে! তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে বললেন পুরোহিত। ভীতু, কাপুরুষ। এজন্যই তো
সে আমাদের এলাকায় ঘুরছে তার ভাইও এখানেই রয়েছে। কিন্তু তার সেনাবাহিনী দিয়ে আমাদের সাহায্য না করে শুধু শুধু গযনী বাহিনীর বিরুদ্ধে উষ্কানী দিচ্ছে। আবার ভয়ও দেখাচ্ছে।
এই চিঠি পড়ে আপনি ভয় পাবেন না মহারাজ!
এই চিঠিতে যা কিছু লেখা আছে তার সবই বাস্তব পণ্ডিত মশাই! বললেন রাজা রাজ্যপাল। আপনি সুলতান মাহমূদকে ভুল তথ্য দিয়েছেন গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী স্থানে তার জন্যে কঠিন জাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এখন দেখতে পাবেন সে আরো কোন অসাধারণ কৌশলে তার সৈন্যদেরকে কনৌজে পাঠায়।
দেখবেন, সে সাধারণ অভিযাত্রীদের মতো করে তার সৈন্যদের অগ্রসর হতে দেবে না। এখন তার সৈন্যরা বিশাল এলাকা নিয়ে পাশাপাশি সামনে অগ্রসর হবে। তার সৈন্যদের দুই বাহু বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকবে। তার গোটা সৈন্যবাহিনী এক সাথে সামনে এগুবে না। আপনি মাহমূদের রণকৌশল সম্পর্কে জানেন না পণ্ডিত মশাই! মাহমূদ ভয়ংকর চিতাবাঘ! আপনি তার উপস্থিতি তখন টের পাবেন, যখন আপনার ঘাড় তার দাঁতে আটকে যাবে এবং আপনার শরীর তার পাঞ্জার ভেতরে চলে যাবে। আক্রান্ত হওয়ার আগে কেউ বলতে পারে না, মাহমূদ মাটির নীচ থেকে আক্রমণ করেছেন না গাছের উপর থেকে হামলে পড়েছে।
মহারাজার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে জানানো হলো, একজন দূত এসেছে। সে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বয়ে এনেছে।
মহারাজা তাকে তাৎক্ষণিক তার কাছে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন।
দূত এসে জানাল, গযনীর সৈন্যরা মুনাজ অবরোধ করতে শুরু করেছে।
আমরা যদি ওদের পেছনে দিক থেকে আক্রমণ করি তাহলে ওদের ক্ষতি সাধন করার কি কোন সম্ভাবনা আছে? দূতের কাছে জানতে চাইলেন রাজ্যপাল।
না, মহারাজ! এমন সুযোগ নেই। গযনী বাহিনীর একটি অংশ মুনাজ অবরোধ করছে, আর একটি অংশ মুনাজ ও কনৌজের মধ্যবর্তী স্থানে তাঁবু না খাঁটিয়ে সম্পূর্ণ রণপ্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করছে। রাতের বেলায়ও তারা তাদের ঘোড়াগুলোকে সাথেই রাখে। আমাদের লোকেরা উপজাতীয় লোকদের বেশ ধারণ করে দেখে এসেছে মুসলিম সৈন্যরা বহুদূর পর্যন্ত টহল দিচ্ছে। আমরা সেখানকার প্রতিটি উঁচু গাছ ও উঁচু টিলার উপরে মুসলিম সৈন্যদের অবস্থান নিতে দেখেছি।
এর অর্থ হলো, আমরা যদি মুনাজের সাহায্যে সেনা পাঠাই, তাহলে গযনীবাহিনী পথিমধ্যেই তাদের আটকে দে?ে জিজ্ঞেস করলেন মহারাজা।
জী হ্যাঁ, মহারাজ! আমাকে বলে দেয়া হয়েছে, আমি যেন আপনাকে মুনাজের দিকে সৈন্য না পাঠাতে বলি, বললো দূত।
পণ্ডিতজী মহারাজ! নিজের কানেই তো অবস্থা শুনলেন, পুরোহিতের উদ্দেশ্যে বললেন কনৌজরাজ।
পুরোহিতকে একথা বলে রাজ্যপাল তার সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠালেন। সেনা কর্মকর্তারা এলে তিনি গযনী বাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে তাদের অবহিত করে বললেন-তোমরা যদি কনৌজকে বাঁচাতে চাও, তাহলে মুনাজের রাজপুতেরা কি করে সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। দেখতে হবে, তারা লড়াই করে না হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্ণ করে। তারা যদি শক্তভাবে অবরোধের মোকাবেলা করে এবং দুর্গ থেকে বাইরে এসে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হয় তাহলে তাদের সাহায্য করবে। আর যদি তা না হয় তবে তোমাদেরকে কনৌজ বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে।
১০১৮ সালের নভেম্বরে সুলতান মাহমূদ মুনাজ দুর্গ অবরোধ করেন। তাকে আগেই গোয়েন্দারা খবর দিয়েছিল মুনাজের রাজপুতেরা তাদের স্বজাতির মর্যাদা রক্ষায় জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত। এদেরকে যুদ্ধে কাবু করা সহজ ব্যাপার নয়। সারা ভারতে এরা লড়াকু জাতি হিসেবে খ্যাত।
সুলতান যে আবরোধ বেষ্টনী গড়ে তুলেন, তা ছিল তিন দিক থেকে বেষ্টিত। এক দিকে ছিল প্রবাহমান যমুনা নদী। সুলতানকে জানানো হয়েছিল, অবরোধকালে কনৌজের সৈন্যরা আক্রমণ করতে পারে। কনৌজবাহিনীর আক্রমণ আশংকায় তিনি সৈন্যদের একটি অংশকে মুনাজ ও কনৌজের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন।
সুলতান যখন তিন দিকের অবরোধ কাজ সম্পন্ন করেন, তখন সালেহ সেই পুরোহিতের ভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে সেখানে হাজির হলো।
সালেহ সেখানে পৌঁছারপর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সুলতানকে জানাল, গোয়েন্দা সালেহ এই খবর নিয়ে এসেছে। সালেহ খবর পেয়ে সুলতান মাহমুদ মথুরায় খবর পাঠালেন, ওখানে যে সৈন্যদের রেখে আসা হয়েছে অর্ধেক সেখানে রেখে বাকী সৈন্য অতি দ্রুত মুনাজে পাঠিয়ে দেবে। সেই সাথে সেখানে রেখে আসা সকল জঙ্গী হাতিকেও এরা সাথে নিয়ে আসবে। সে সময় সুলতানের হাতে প্রায় সাড়ে তিনশ জঙ্গি হাতি ছিল। মথুরার রিজার্ভ সৈন্যরা মুনাজ পৌঁছালে তাদেরকে তিনি মুনাজ ও কল্লৌজের মধ্যবর্তী এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন।
অধিকাংশ ইতিহাসগ্রন্থে সুলতান মাহমুদের সতেরো বারের ভারত অভিযানের মধ্যে মুনাজের উল্লেখ নেই। কোন কোন ইতিহাস গ্রন্থে সামান্য ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও মুনাজে যে তার এযাবতকালের ভারত অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন লড়াই লড়তে হয়েছিল এর বিস্তারিত আলোচনা অনুপস্থিত। মুনাজে ছোট্ট একটি দুর্গজয়ে তার যে শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছিল মথুরা মহাবন এবং বুলন্দ শহরের মতো বড় বড় তিনটি লড়াইয়েও এত শক্তিক্ষয় হয়নি। মুনাজের রাজপুতদের অবস্থা এমন ছিল যে, সৈন্য ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে পার্থক্য করাই মুশকিল হচ্ছিলো। ছোট ছোট ছেলেরাও সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল।
ঐতিহাসিক উলবী লিখেছেন, যুদ্ধকালে মুনাজের রাজপুতদের অবস্থা ছিল দড়ি ছেঁড়া উটের মতো এবং অজেয় দৈত্যের মতো ভয়ংকর।
মুনাজ যুদ্ধের কমান্ড ছিল সুলতানের নিজের হাতে। তিনি সরাসরি রণাঙ্গনে কমাণ্ড দিচ্ছিলেন। তিনি যে দিক দিয়েই তার লোকদেরকে দুর্গ ফটক ভাঙ্গা কিংবা দুর্গ প্রাচীরে ফাটল ধরানোর জন্য পাঠাতেন, দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে তাদের উপর বৃষ্টিরমতো তীর ও বর্শা নিক্ষিপ্ত হতো। গযনীবাহিনীর তীরন্দাজরা অগ্রসর হয়ে দুর্গপ্রাচীরের উপর দণ্ডায়মান তীরন্দাজ ও বর্শাধারীদের উপর তীর বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করল গযনীর তীরন্দাজদের তীর বিদ্ধ হয়ে যে রাজপুতেরা দুর্গপ্রাচীর থেকে গড়িয়ে পড়তো সাথে সাথে শূন্যস্থান অন্য রাজপুতেরা পূর্ণ করে ফেলতো। দুর্গ প্রাচীর থেকে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে হুমকি ভেসে আসছিল।
‘মাহমূদ! বাঁচতে চাইলে ফিরে যাও।‘
‘হে গযনীর ডাকাতেরা! তোমরা কবরস্থানে এসে গেছো।‘
এসব হুমকি ধমকির পাশাপাশি নানা অশ্রাব্য গালি গালাজও ভেসে আসছিল দুর্গপ্রাচীর থেকে।
দিনের প্রায় অর্ধেক চলে গেল। অবস্থা দৃষ্টে সুলতান বললেন–
এই দুর্গ সহজে করায়ত্ত করা যাবে না। এজন্য নতুন করে চিন্তা করতে হবে।
অবরোধের প্রথম দিন শেষ হলো। এ দিনে মুসলমানরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলো। মুনাজ দুর্গের ভেতরের পরিস্থিতি এমন ছিল যে, সেখানকার অধিবাসী নারী পুরুষ আবাল বনিতা এমনকি ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত তীর কামান বর্শা তরবারী হাতে নিয়ে দুর্গপ্রাচীরের উপরে এবং দুর্গের সর্বত্র মহড়া দিচ্ছিল। তারা স্লোগান দিচ্ছিল, আমাদেরকে দুর্গের বাইরে গিয়ে গযনী বাহিনীর উপর আক্রমণের অনুমতি দেয়া হোক। মুনাজের রাজা রায়চন্দ্র ছিলেন দূরদর্শী ও জাত লড়াকু। তিনি আনাড়ী ছেলে মেয়েদেরকে দুর্গের বাইরে এমনকি দুর্গপ্রাচীরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিলেন না। তিনি আবেগী লোকদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি ছাড়া শুধু আবেগের জোরে যুদ্ধ করা যায় না। অবশ্য তোমরা মুনাজের সম্মান। কিন্তু তোমরা জানো না গযনীর সৈন্যরা চোর ডাকাতের দল নয়। ওরা এমন ভয়ংকর যোদ্ধা যাদের সামনে পাহাড়ের মতো শক্ত প্রাচীর কাঁপতে থাকে। তোমাদের প্রশিক্ষিত সৈন্যরা দুর্গপ্রাচীরে রয়েছে। কোন কারণে শত্রু সৈন্যরা যদি দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়ে তখন মুনাজের ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব হবে তোমাদের উপর। মথুরা ও মহাবনের কাপুরুষরা যে ভাবে গযনী সৈন্যদের হাতে দুর্গ তুলে দিয়েছে আমরা সে ভাবে তাদের হাতে দুর্গ তুলে দেবো না।
রাজা রায়চন্দ্রের কথা শোনে সমবেত জনতা শ্লোগান দিতে লাগলো, আমাদেরকে দুর্গের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক, আমরা চরমভাবে প্রতিশোধ নেবো।
নগরবাসীর আবেগ ও উচ্ছ্বাস দেখে রাজা রায়চন্দ্র সমবেত লোকদের থেকে কিছু সংখ্যক লোককে বাছাই করে তার কাছে থাকতে বললেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন, তোমাদেরকে প্রয়োজনের সময় দুর্গের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। রাজার আশ্বাসে জনতার ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলো।
এদিকে রাজা রায়চন্দ্রের রাজপ্রাসাদে নারীরাও অস্ত্র সজ্জিত হয়ে গেলো। তারা শহরের অন্যান্য নারীদেরকে লড়াইয়ের জন্য সংগঠিত করতে শুরু করল।
রাজপ্রাসাদের মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া আর সবার মধ্যেই বিরাজ করছিল যুদ্ধ উন্মাদনা। কিন্তু রাজা রায়চন্দ্রের উর্বশী কন্যা রাধার মধ্যে এই যুদ্ধের কোনই প্রতিক্রিয়া ছিল না। তার অবস্থা অনেকটা এমন ছিল, এই মাটি মানুষের হানাহানির সঙ্গে যেন তার কোনই সম্পর্ক নেই।
আগেই বলা হয়েছে, রাজা রায়চন্দ্রের বোন শিলা ও কন্যা রাধা রাজা রাজ্যপালের ছেলে লক্ষণপালের সাথে সুলতান মাহমূদকে হত্যা করার জন্য অভিযানে বের হয়েছিল। শিলা ও রাধার রূপ সৌন্দর্য ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তারা ভেবেছিল তাদের রূপসৌন্দর্যের যাদুকরী আকর্ষণে মুগ্ধ করে তারা সুলতানকে হত্যা করতে সক্ষম হবে।
কিন্তু পথিমধ্যে এক কুমির শিলাকে শিকারে পরিণত করল। যে দৃশ্য দেখে রাধা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। অতঃপর লক্ষণ ও রাধা উভয়কেই গযনীর টহলরত গোন্দোদের হাতে গ্রেফতার হয়ে মথুরায় সুলতান মাহমূদের কাছে পেশ করা হয়।
সুলতান তাদেরকে কোন প্রকার শাস্তি না দিয়ে সসম্মানে নিজ নিজ বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন থেকেই রাধা আমূল বদলে যায়।
ছোট বেলা থেকে রাধা মুলমানদের সম্পর্কে যা শুনে এসেছিল, গযনীর সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে বাড়ীতে ফিরে আসা পর্যন্ত তাদের আচার-আচরণ দেখে রাধার এতো দিনের ধারণা ধারণা বিশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হলো।
সেই শৈশব থেকেই হিংস্র জন্তুর মতোই রাধার মনে ছিল মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা। সে মুসলমানদের হাতে গ্রেফতারী এড়াতে বিষপানে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। কারণ সে জানতো, তার মতো সুন্দরী তরুণীকে মুসলিম সৈন্যরা শিকারী হিংস্র জন্তুর মতোই ক্ষতবিক্ষত করে ফেলবে। জানতে মুসলিম সৈন্যরা খুবই হিংস্র এবং নারীখেকো।
কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পর অবাক বিস্ময়ে রাধা প্রত্যক্ষ করলো, তাকে ও লক্ষণপালকে গ্রেফতারকারী দলনেতা নিজ কন্যা ও ছেলের মতোই মর্যাদা দিয়েছে। তার চেয়েও বিস্ময়ের ব্যাপার, চরম শত্রু জেনেও সুলতান মাহমুদ তাদের প্রতি সামান্যতম উন্মা পর্যন্ত প্রকাশ করেননি বরং তাদের জাতীয়তাবোধের ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন এবং কোন প্রকার শাস্তি না দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদেরকে তার সেনাসদস্যকে দিয়ে সসম্মানে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
রাধার বিশ্বাস ছিল মুসলমানরা বাস্তবিকই অসভ্য, তাদের কোন নীতি ধর্ম নেই। রাধার কাছে পৌত্তলিকতার বাইরে কোন ধর্ম মতের অস্তিত্ব ছিল না। আত্মমর্যাদাবোধ ও সম রাজপুতদের কাছে ছিল জীবনের চেয়ে দামী। কিন্তু ধর্মের শত্রুদের ধ্বংস করার জন্যে জাত্যাভিমানী এই রাজপুত কন্যা নিজের সমকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ইচ্ছাপোষণ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় সে মুসলমানদের হাতে গ্রেফতার থাকার পরও তার এই অপরূপ রূপ সৌন্দর্য নিয়ে কেউ টুশব্দটি পর্যন্ত করেনি। অথচ গোটা অঞ্চল জুড়ে রাধার রূপের প্রশংসা করে না এমন মানুষ একজনও ছিল না।
লক্ষণ গ্রেফতার হওয়ার পর দলনেতাকে তাদের সাথে রক্ষিত সোনাদানা দিতে চাইলো এবং তাদের মুক্তির বিনিময়ে ঘোড়া বোঝাই করে ধন-রত্ন দেয়ার প্রস্তাব করলো। কিন্তু মুসলমান সৈন্যরা বিপুল এই ধনভাণ্ডারের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণবোধ করলো না। বরং তারা লক্ষণের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে কর্তব্য পালনে অবিচল রইলো।
রাধাকে যখন সুলতান মাহমূদের সামনে হাজির করা হলো, তখন সুলতানের চেহারার দিকে তাকিয়ে রাধার মনে প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মে ছিল। সে আশঙ্কা করছিল নিশ্চয়ই সুলতান কোন ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু রাধার সব আশঙ্কা ও কল্পনার বিপরীতে সুলতান তখন বললেন
“আমরা এই জাত্যাভিমানী শত্ৰুকন্যাকে সম্মান করি। আমরা তাদের সংকল্পকে মোবারকবাদ জানাই।”
সুলতান মাহমূদ যখন তার সৈন্যদের নিয়ে মুনাজ দুর্গ অবরোধ করলেন, তখন রাধার কানে সুলতানের সেই কথা ধ্বনিত হতে লাগল–
“আমাকে হত্যা করার চেষ্টা তোমাদের অবশ্যই থাকা উচিত। এই চেষ্টার সফলতা ব্যর্থতা তোমাদের কৃষ্ণদেবী বা বাসুদেবের হাতে নয়, সফলতার চাবিকাঠি আমাদের আল্লাহর হাতে। তিনি হলেন সেই প্রভু, যার পয়গাম নিয়ে আমরা ভারতে এসেছি।”
এরপর সুলতান তার সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন–
“এদেরকে সসম্মানে ওদের শহরের কাছে রেখে আসার ব্যবস্থা করো এবং তাদের ঘোড়া, সোদানা সবই দিয়ে দাও।”
সাথে সাথে সুলতানের নির্দেশ কার্যকর করা হলো। রাধা ও লক্ষণপালকে শাহী অতিথির মতোই সেনাপ্রহরায় তাদের শহরের কাছে রেখে আসা হলো।
***
সুলতান মাহমূদকে হত্যার মিশনে যাওয়ার আগে রাধা যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু ফিরে এসে যখন সে তার বাবাকে মিশনের ব্যর্থতা সম্পর্কে অবহিত করছিলো তখনকার অভিব্যক্তি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। রাধা তার বাবাকে ভিন্ন এক সুরে বললো, আমরা যখন মুসলিম সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হয়ে সুলতান মাহমুদের সামনে নীত হলাম, তখন সুলতান মাহমুদ আমাকে নিজ কন্যার মতোই সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে কথা বললেন। রাধা তার বাবাকে তার গ্রেফতারী এবং লক্ষণ ও তার সাথে সুলতানের কথোপকথনের পুরো ইতিবৃত্ত জানালো। কিন্তু রাধার বাবা রায়চন্দ্র রাধার মানসিক পরিবর্তনের ব্যাপারটি বুঝতে পারেননি। ফলে তিনি রাধাকে বললেন
আমরা আমাদের এই বেইজ্জতির কঠিন প্রতিশোধ নেবো।
রাধা অন্য দশটি কুমারী মেয়ের মতো ছিল না। সে যেমন ছিল সুন্দরী তেমনই বুদ্ধিমতি। কিন্তু মিশনের ব্যর্থতা ও গযনী বাহিনী সম্পর্কে তার পরিবর্তিত বাস্তব ধারনার পর তার বাবা যখন মুসলমানের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ের হুংকার দিলেন, তা শুনে রাধার মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়ল।
স্বভাবগতভাবে রাধা ছিল খুবই আত্মপ্রত্যয়ী এবং সাহসী। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি তার সবকিছু ওলট পালট করে দিল। দুনিয়ার সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলল রাধা। একাকী নীরব নিঃশব্দে দিন কাটাতে লাগল সে।
রাজ দরবার রাজমহল শহরের অলিগলি ভেতর বাহির সবখানে তখন যুদ্ধের সাজ-সাজ রব, গযনী বাহিনীকে প্রতিরোধের হুংকার, রণপ্রভূতি। যে কোন দিন গযনীর সৈন্যরা দুর্গ প্রাচীর ভেদ করতে পারে। রাজা রায়চন্দ্র এখন লড়াই ছাড়া আর কোন বিষয়ে কোন কথাই বলেন না।
মন্দিরগুলোতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছিল এবং রক্তাক্ত লড়াই করে মুসলমানদের পরাজিত করার জন্যে জনগণকে প্ররোচনা দেয়া হচ্ছিল। এর ফলে মুনাজের নারী মহলের মধ্যে সৃষ্টি হয় যুদ্ধ উন্মাদনা। তারা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
রাজমহলে রায়চন্ত্রের রক্ষিতারাও পর্যন্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্যতিক্রম শুধু রাধা। সে সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাজমহলে একাকী শুয়ে থাকতো। নয়তো দুর্গ প্রাচীরের উপরে ওঠে গযনী সৈন্যদের আগমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো।
এক দিন সন্ধ্যার আগে দুর্গ প্রাচীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাধা। সম্পূর্ণ উদাস মন। দূরের আকাশের লালিমায় স্থির তার দৃষ্টি। এমন সময় রাধার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো।
“সে এদিক দিয়ে আসবে! জানি না কবে আসবে সে।”
“কে আসবে?” তার পাশের কেউ জিজ্ঞেস করল।
কারো দিকে না তাকিয়ে উদাস মনেই সে জবাব দিল- “মুসলমান; গযনীর সৈন্যরা!”
একথা বলেই হঠাৎ কেঁদে উঠলো রাধা। আশ-পাশে তাকিয়ে নীরব হয়ে গেল তার কণ্ঠ। রাধা পাশে তাকিয়ে দেখল, এক ঋষী তার পাশেই দাঁড়ানো। এবং সে রাধার কাছে জানতে চাচ্ছিল কে আসবে? অথচ রাধা এমনই উদাস-আনমনা ছিল যে, এতো কোলাহল ও হট্টগোলের মধ্যেও সে নিজেকে একাকী ভেবে ছিল।
এই ঋষি সম্পর্কে রাধা জানতো। অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদাবান লোক এই ঋষি। মুনাজের প্রধান পুরোহিতও তাকে দেখলে দু’হাত জড়ো করে কুর্ণিশ করে। ঋষি ধর্মীয় গুরু হওয়ার পাশাপাশি খ্যতিমান একজন চিকিৎসকও। মানুষকে ধর্মের দীক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তিনি মানসিক রোগী ও ভূত-প্রেতের আছর করা লোকদের চিকিৎসা করেন। মানুষকে ভূত-প্রেতের অত্যাচার প্রভাব থেকে হেফাযত করেন। এমন একজন মহামনীষীকে কাছে দেখেও যে রাধার উল্লাসিত হওয়ার কথা ছিল সেই রাধার কাছে ঋষির উপস্থিতি অসহ্য মনে হলো। মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো রাধা।
“রাজকুমারী কি মুসলমানদের আগমনের অপেক্ষা করছেন?”
বিনীত কণ্ঠে রাধাকে জিজ্ঞেস করলেন ঋষি।
আমি যার জন্যেই অপেক্ষা করি? আপনি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন কেন?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো রাধা।
হস্তক্ষেপ করিনি রাজকুমারী! এসেছি আপনার দুঃখে শরীক হতে। আমি জেনেছি, আমাদের রাজকুমারীর উপর ভৌতিক আছর পড়েছে যার চিকিৎসা আমাকে করতে হবে। মহারাজ আমাকে বলেছেন, আপনি মথুরা থেকে ফিরে আসার পর থেকেই মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবশ্য হওয়ারই তো কথা।
আমি জানি রাজকুমারী! মুসলমানরা মানুষ নয়, হায়েনার মতো হিংস্র। এরা মানুষ খাওয়ার জন্যই এদেশে আসে। আপনি না বললেও আমি জানি, ওরা আপনার সঙ্গে কি আচরণ করেছে। এরা সোনা-দানা হীরা জহরত আর নারীর জন্যে পাগল। এই নারী আর ধনরত্নের জন্যেই এরা বারবার হিন্দুস্তানে আসে।
মিথ্যা কথা! সবই মিথ্যা। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো রাধা।
আপনি যা বলছেন, তারা আমার সাথে এমন কোন আচরণ করেনি। তারা নারী লোভী নয়। গযনী সুলতানের দরবারে আমি একজনও নারী দেখিনি। আমার বাবার মতো রাজা মহারাজাদের দরবারেই নারী বেশী থাকে। বাবার মতো রাজাদের পেছনে দাঁড়িয়ে সুন্দরী তরুণীরা পাখা দোলায়। তাদের সেবা করে তরুণীরা। সুন্দরী তরুনীরাই তাদের ঘুম পাড়ায়, ঘুম থেকে জাগায়। মিথ্যা কথা। মুসলমানরা হিংস্র জন্তু নয় প্রকৃতই মানুষ। বরং ভালো মানুষ। তারা আমাদের দেয়া সোনাদানা গ্রহণ করেনি।
ঋষি জ্ঞানী লোক, পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ। সে রাধার কথার বিরোধিতা না করে বরং তার সাথে সহানুভূতি ও স্নেহমাখা কথা বলতে শুরু করলেন। মায়া ও মমতার পরশ দিয়ে ঋষি রাধার ক্ষোভকে কিছুটা প্রশমিত করে ফেললেন। অবস্থা এমন হলো যে, কয়েক দিনের নীরব নিস্তব্ধ হয়ে ওঠা রাধা কথা বলতে বলতে ঋষির সাথে হাঁটতে শুরু করল।
এরপর থেকে প্রতিদিন ঋষি রাধার কাছে আসতে শুরু করলেন। দীর্ঘ সময় রাধা ঋষীর সাথেই ব্যয় করে। তার সাথে নানা বিষয়ে কথা বলে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলে ঋষি বুঝতে পারলেন, রাধা ঠিকই মুসলমান আছরে আক্রান্ত। তা ছাড়া রাধার মধ্যে একটা প্রচণ্ড ভীতিও কাজ করছে।
রাধা ঋষিকে জানাল, প্রতি রাতেই সে সেই কুমিরকে স্বপ্নে দেখে, কুমিরের মুখে শিলার মরদেহ ঝুলছে এবং কুমিরের মুখ থেকে তাজা রক্ত ঝরছে। তখন আতংকিত হয়ে রাধা চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়।
রাধার এই আতংক দূর করার চিকিৎসা ছিল তার সাথে কথা বলে মনের আতংক দূর করে ফেলা। ঋষী নানা বিষয়ে রাধার সাথে কথা বলে তার মন থেকে কুমিরের ভয় এবং মুসলমান প্রীতি দূর করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রাধার শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে আরো খারাপ হতে লাগল। রাজা রায়চন্দ্র যুদ্ধের ব্যস্ততার জন্যে রাধার প্রতি মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। তিনি রাধার সুচিকিৎসার জন্যে ঋষীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন।
ঋষী ছাড়াও রাধার চিকিৎসার জন্যে আরো খ্যাতিমান অভিজ্ঞ বৈদ্য আনা হলো। কিন্তু রাধার শারীরিক অবস্থার আরো অবণতি ঘটল। এক পর্যায়ে রাধা ওষুধ পথ্য খাওয়া ছেড়ে দিল। ঋষি ছাড়া আর কাউকেই সে কাছে ঘেষতে দিতো না। ঋষিই হয়ে উঠলেন তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। একদিন রাধা ঋষিকে বললো–
ঋষীজী! মুসলমানদের সুলতান আমাকে বলেছিল, জয় পরাজয় তোমাদের কৃষ্ণদেবী ও বাসুদেবের হাতে নয়, জয় পরাজয় আমাদের আল্লাহর হাতে…..।
এখন তো আমি তার প্রতিটি কথারই বাস্তব প্রতিফলন দেখছি। আচ্ছা, ওই ঝিলের জল কুমিরটি কি মুসলমানদের আল্লাহ? যে শিলাকে খেয়ে ফেলেছে।
আমাদের দুই সৈনিককে কে হত্যা করলো। আমরাই বা কেন গ্রেফতার হলাম?
হরিকৃষ্ণের জন্ম ভূমির ধ্বংসস্তূপ আমি দেখে এসেছি। সেখানকার মূর্তিগুলোর ভাঙা টুকরো আমি দেখেছি। এরাই না আমাদের দেবদেবী, আমাদের ভগবান! এদের যদি কোন শক্তি থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই মুসলমানরা তাদের আক্রমণ করার আগেই ধ্বংস হয়ে যেতো।
রাধার ইসলাম ধর্মের সতোর প্রতি আকর্ষণ এবং পৌত্তলিকতার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখে ঋষি নানা যুক্তি ও ঘটনা বলে রাধাকে পৌত্তলিকতার বিশুদ্ধতা বোঝাতে লাগলেন। তিনি রাধাকে এমন সব ঘটনাবলী শোনালেন, যেগুলো কোন সচেতন ও চিন্তাশীল মানুষের কাছে যৌক্তিক ও সত্য বলে মনে হয় না। পৌত্তলিকতার বিপরীতে ঋষি ইসলাম ধর্মকে অসত্য এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য নানান অযৌক্তিক কথা কাহিনী বর্ণনা করতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে ঋষি বলতে লাগলেন, মুসলমানরা মিথ্যুক, লুটেরা প্রতারক, ধোকাবাজ, হিংস্র।
আপনি তাদের যাই বলুন, আমি নিজ চোখে যা দেখেছি, তাকে তো আর মিথ্যা বলতে পারি না।’ ঋষির কথার জবাবে বললো রাধা। আমার সাথে লক্ষণপাল ছিল। একপর্যায়ে সেও বলেছিল, রাধা! আমি মুসলমানদের অব্যাহত বিজয়ের রহস্য বুঝে ফেলেছি। সে বলেছিল, আমি মুসলমানদের মধ্যে নারী ও মদের ব্যবহার দেখিনি। এটাই তাদের বিজয়ের অন্যতম কারণ।
রাধা ঋষিকে জানালো, যে দিন মুসলমানরা আমাদের বিদায় করে দেয়, সে দিন খুব ভোরে আমাকে ও লক্ষণকে জাগিয়ে দিয়ে ছিল। আমরা ঘুম থেকে জেগে দেখি তখনো সূর্য উঠতে অনেক দেরী। চারদিকে তখনো অন্ধকার। ঠিক সেই সময় কোত্থেকে জানি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমরা ভেবেছি, এটা হয়তো তাদের ভাষার কোন সঙ্গীত হবে। আওয়াজটা আমার কাছে খুবই চমৎকার লাগছিল।
আমি আমার পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলাম—
কেউ কি গযনীর ভাষায় গান করছে?
পাহারাদার আমাকে জানাল, এটি গানের আওয়াজ নয়। এটি আযানের আওয়াজ। এই শব্দগুলো আমাদের আল্লাহর শব্দ।
আমি আযানের কোন শব্দই বুঝতে পারিনি কিন্তু আযানের ধ্বনী যেন আমাকে যাদুর মতো মুগ্ধ করল। একটু পরে আমি দেখলাম, মথুরায় অবস্থানকারী সকল সৈন্য একটি ভোলা জায়গায় সমবেত হলো এবং সারি বেধে দাঁড়াল। একলোক সবার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো ঝুকছে, কখনো দাঁড়াচ্ছে আবার কখনো মাটিতে মাথা আনত করে রাখছে। আর বাকীরা তাকে অনুসরণ করছে। আমি পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করলাম, সবাই ওখানে এমন করছে। কেন? প্রহরী জানাল, এটাই আমাদের ইবাদত।
ঋষিজী! মুসলমানদের এই ইবাদত আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। পাহারাদারকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কার ইবাদত কর? তোমাদের সামনে তো কোন মূর্তি নেই?…..।
পাহারাদার বললো, আমরা যার ইবাদত করি, তিনি থাকেন আমাদের হৃদয়ে। তিনি সব জায়গাই বিরাজ করেন। তিনি আমাদের রব। তিনিই আমাদের জয়ী করেন। আমরা যখন তার ইবাদতে ক্রটি করবে, তার নির্দেশ পালন করা থেকে বিরত থাকব তখন সব ক্ষেত্রেই আমাদের পরাজয় ঘটতে থাকবে।’
ঋষি রাধার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। রাধা অনবরত কথা বলেই যাচ্ছিল। রাধা বললো,
তোমাদের সুলতান হয়তো এই ইবাদত করেন না। কারণ, তিনি তো সুলতান।
পাহারাদার জানাল, সুলতানও এই ইবাদতে রয়েছেন। তিনি হয়তো সৈনিকদের মধ্যে কোথাও রয়েছেন। তিনিও সাধারণ সৈনিকদের মতোই মাথা নত করে ঝুঁকে সিজদা দেন। ইবাদতের সময় তিনি আর সুলতান থাকেন না।
ঋষিজী! আমরা ছোট বেলা থেকেই দেখছি, আমাদের পিতা মহারাজ যদি কখনো মন্দিরে যান তখন সবাইকে মন্দির থেকে বের করে দেয়া হয়।
ঋষিজী! বলুন তো? আসলে সত্য কোনটি?…আমাদের কি কোন রব নেই।
রাধার প্রশ্নের জবাবে ঋষি বলতে লাগলেন, পৌত্তলিক ধর্মে কাকে রব মনে করা হয়। কিন্তু রাধা ঋষির কথায় অনাস্থা প্রকাশ করে বললো, তাহলে কুমিরই কি আমাদের রব? না, কুমির আমাকে প্রতি রাতেই ভয় দেখায়, সে রব হতে পারে না। রব আমার অন্তরে বিরাজ করছেন।
* * *
মহারাজ! রাজকুমারী পাগল হয়ে গেছে। রাধার কাছ থেকে উঠে গিয়ে রাজা রায়চন্দ্রকে জানালেন ঋষি। মনে হয় মথুরায় মুসলমানরা তাকে এমন কিছু পান করিয়েছে, যার প্রভাব তার শরীর থেকে এখনও যায়নি। এই রোগের চিকিৎসা আমার সাধ্যের বাইরে মহারাজ! রাজকুমারী তার ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে গেছে। এখন সে নানান অহেতুক কথা বলতেই থাকে। অনেক সময় কথা বলতে বলতে নীরব হয়ে যায়। অনেক সময় বিকট চিৎকার দিয়ে তার চেহারা কাপড় বা হাতে ঢেকে ফেলে। অধিকাংশ সময়ই বলতে থাকে, আমার রব আমার হৃদয়ে এসে গেছে। এটা সেই মুসলমানদের আছর মহারাজ!
ঠিক আছে। তাকে আর আপনার চিকিৎসা করার দরকার নেই। তাকে তার অবস্থাতেই থাকতে দিন।’ বললেন রাজা রায়চন্দ্র। আমি সুলতান মাহমূদের মাথা কেটে এনে তার সামনে ফেলে দেবো। তখন ঠিকই দেখবেন তার মন থেকে মুসলমানদের রব চলে যাবে। এখন এসব নিয়ে ভাববার অবসর আমার নেই ঋষিজী! গযনী বাহিনী অনেক কাছে চলে এসেছে।” বলে রাজা রায়চন্দ্র রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রাজার সাথে যখন ঋষি রাধার ধর্ম বিদ্বেষী হওয়ার কথা বলেছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিল আরো দু’জন বৈদ্য ও দু’জন সেবিকা। রাধার ধর্ম বিদ্বেষের কথা শুনে তারা কানে আঙ্গুল দিলো।
ঠিক এ সময় রাধা হঠাৎ করে বিছানা থেকে উঠে বাইরের দিকে ছুটতে লাগল। রাধাকে দৌড়ে বেশী দূর যেতে দেয়া হয়নি। তাকে ধরে ফেলা হলো। তখন রাজারায় চন্দ্র রাজ প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছেন।
রাধার মা’কে রাধার বাইরে চলে যাওয়ার কথা জানানো হলো। এই খবর শুনে রাধার মা খুবই উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ, তখন মুসলমানরা অবরোধ করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় রাধা বেরিয়ে গেল নির্ঘাত সে নিহত হবে। তিনি মেয়ের এই অবস্থা দেখে বৈদ্যকে বললেন,
আপনারা ওকে এমন কোন ওষুধ দিন, যা সেবনে সে অচেতন হয়ে থাকবে। হুশ হলে আবার সেই ওষুধ খাইয়ে তাকে অচেতন করে রাখা হবে। রানীর নির্দেশে বৈদ্যরা রাধাকে একটি ওষুধ খাইয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে রাধা অচেতন হয়ে গেল। তারপর কক্ষের দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে সবাই রাধার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।
* * *
অবরোধের প্রথম দিন অতিবাহিত হলো। দিন রাতের মধ্যে এক মুহূর্তও বিশ্রাম করেননি সুলতান মাহমুদ। এক সময় তিনি দুর্গের পিছনে নদীর পাশে চলে গেলেন। নদী দুর্গের প্রাচীর স্পর্শ করে প্রবাহিত হচ্ছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে সুলতান তার কমান্ডারদের বললেন, প্রতিটি পদাতিক ইউনিট থেকে দুই বা চারজন করে দক্ষ ও সাহসী সৈনিককে বাছাই করো এবং তাদের সমন্বয়ে ভিন্ন একটি দল গঠন করে তাদেরকে রিজার্ভ সৈন্যদের সাথে অবস্থান করতে বলো।
অবরোধের দ্বিতীয় দিন গযনীর সৈন্যরা আবারো দুর্গের প্রধান ফটক ভাঙার জন্যে আক্রমণ চালালো। কিন্তু দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে রাজপুতেরা বর্শা বল্লম ও তীরের তুফান ছুটিয়ে দিলো। বিপুল ক্ষয় ক্ষতি হলো মুসলিম বাহিনীর। কিন্তু দুর্গ ফটক ভাঙার কোনই অগ্রগতি করা সম্ভব হলো না। এরপরও ফটক ভাঙার চেষ্টায় বিরত দিলেন না সুলতান। এভাবে টানা সাত দিন চললো ফটক ভাঙার চেষ্টা আর রক্তাক্ত আক্রমণ প্রতি আক্রমণ।
সপ্তম দিন শেষে সন্ধ্যার পর সকল পদাতিক ইউনিট থেকে বাছাইকরা রিজার্ভ সৈন্যদেরকে তার অনুগামী হতে নির্দেশ দিলেন সুলতান। এই বাহিনীতে সৈন্য ছিল তিনশ’য়ের কিছু বেশী। সুলতান এই যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বললেন
গযনী ও ইসলামের মর্যাদার প্রশ্নে তোমাদেরকে আজ কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ইসলাম এখন তোমাদের জীবন প্রত্যাশা করে। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে তবে সে তার ইউনিটে ফিরে যেতে পারো। রাতের এই অন্ধকারে আমি ফেরত যাত্রীকে দেখতে পাবো না। আমি এজন্য কারো প্রতি সামান্যতম বিরাগভাজনও হবো না।……
হে আল্লাহর সৈনিকেরা! আল্লাহ ছাড়া রাতের এই অন্ধকারে তোমাদের কেউ চিনতে পারছে না। কেয়ামতের দিন আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তোমাদের চিনতে পারবে না।’ একথা বলে সুলতান দীর্ঘক্ষণ নীরব হয়ে গেলেন। এরপর বললেন,
এখন কি আমি ধরে নিতে পারি, তোমরা সবাই আমার সাথে রয়েছে?
ভারত অভিযান ১০৬
সমস্বরে আওয়াজ ওঠলো, “আমরা সবাই আপনার সাথে আছি সুলতানে মুহতারাম! আমরা তো জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্যই আপনার সাথে এসেছি। আপনি নির্দেশ করুণ সুলতান! আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।
আজ তোমরা আমার নির্দেশে নয়, আল্লাহর নির্দেশে লড়াই করবে।” বললেন সুলতান। আজ রাতের এ লড়াইয়ে এই কুফরিস্তানে আল্লাহর নাম প্রচারিত হবে। শোন বন্ধুরা! এই দুর্গের পেছনে যে দুর্গ প্রাচীর রয়েছে, সেটি একেবারে পানি ছুঁয়ে রয়েছে। তোমাদের হাতে দুর্গ প্রাচীর ভাঙা এবং সুড়ঙ্গ খননের সরঞ্জাম দেয়া হচ্ছে, তোমাদের মধ্য থেকে পঞ্চাশজন পানিতে নেমে দুর্গ প্রাচীরের নীচ দিয়ে সুড়ং করবে।
এখন সেখানে বেশী পানি নেই। এ সময়ে বেশী পানি থাকে না। কিন্তু পানি ঠাণ্ডা থাকে। যারা সাঁতার জান না, তারা নদীতে নামবে না। তোমাদের ঝুঁকি হলো, দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে শত্রুরা যদি তোমাদের দেখে ফেলে তাহলে তোমাদের উপর বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করবে।
দুর্গ প্রাচীর কতটুকু চওড়া তা আন্দাজ করতে তোমাদের কষ্ট হবে না । অর্ধেক প্রাচীর পর্যন্ত যদি তোমরা সুড়ং করতে পারা দেখবে বাকী অর্ধেক পানিই করে ফেলবে।
প্রায় তিন শতাধিক মৃত্যুঞ্জয়ী পদাতিক সৈন্য থেকে সুলতান পঞ্চাশজনকে আলাদা করলেন। রাতে লড়াইয়ের তীব্রতা থেমে গিয়েছিল। অন্ধকারের কারণে তীরন্দাজরা তীর নিক্ষেপে ক্ষান্ত হয়ে পড়েছিল। অবশ্য দুর্গ প্রাচীরের উপরে এবং বুরুজগুলোতে রাতেও তৎপরতা ছিল।
সুলতান ছিলেন দুর্গ প্রাচীর থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে। তিনি বীর সৈন্যদের আল্লাহর উপর সোপর্দ করে তাদেরকে দুর্গ প্রাচীর ঘেষে নদীর কিনারা দিয়ে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
***
রাজপুতেরা নদীর দিক থেকে আক্রমণের আশংকামুক্ত ছিল। কারণ, গযনী বাহিনীর কাছে নদী পথে আক্রমণের কোন সাজ সরঞ্জাম ছিল না। এ পর্যন্ত তারা নদীপথে কোন আক্রমণ পরিচালনা করেনি। ফলে রাজপুতেরা এদিক থেকে আক্রমণের ব্যাপারে পূর্ণ-ঝুঁকি মুক্ত ছিল।
অথচ গযনী বাহিনীর পঞ্চাশজন জীবন ত্যাগী যোদ্ধা নদীর দিক থেকেই আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হচ্ছিল। এই পঞ্চাশ অভিযাত্রী উঁচু নলখাগড়া ও গাছগাছালীর আড়াল দিয়ে দুর্গ প্রাচীর কিছুটা দূরে থাকতেই নদীতে নেমে পড়ল। ধনুক তরবারী ছাড়াও তাদের সাথে ছিল শাবল আর খুন্তি কোদাল। নদীর পানি ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। নদীর তীরের কাছে পানি কোমর পর্যন্ত। মাঝে মধ্যে গর্তের মতো ছিল, যেখানে পানির পরিমাণ গলা বা বুক পর্যন্ত ছিল। যযাদ্ধারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হচ্ছিল।
এক সময় তারা ঠিকই দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেল। নদীর তীরবর্তী দেয়ালটি খাড়া ছিল না, ছিল ঢালু। ফলে দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে নীচের সবকিছু পরিষ্কার দেখা যেতো। কিন্তু রাতের অন্ধকারে উপর থেকে প্রাচীরের নীচের কোন কিছু দেখার উপায় ছিল না।
আল্লাহর নাম দিয়ে পঞ্চাশজন যোদ্ধা পানিতে দাঁড়িয়ে দুর্গ প্রাচীরের পাথর খোলার চেষ্টা শুরু করে দিল। কিন্তু একদম নিঃশব্দে কোনকিছু করার উপায় ছিল না। শাবল ও খুন্তির আঘাতের আওয়াজ দুর্গ প্রাচীরের উপর পর্যন্ত চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সুড়ংকারীদের সুবিধা এই ছিল যে, পানিতে প্রাচীরে শাবল মারার আওয়াজ প্রতিধ্বনীত হয়ে এমন তরঙ্গ শব্দ সৃষ্টি হচ্ছিল, সেখানে আসলে কি হচ্ছে তা সহজে কারো পক্ষে বোঝার উপায় ছিল না।
দুর্গ প্রাচীর ভাঙতে গেলে খুন্তি শাবলের আওয়াজ হবে এ বিষয়টি সুলতান আগেই আন্দাজ করেছিলেন। তিনি পঞ্চাশজনের বাহিনীকে ওখানে পাঠানোর পরই তাদের প্রাচীর ভাঙার আওয়াজকে ছাপিয়ে দেয়ার জন্যে লড়াইরত সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিয়ে রেখে ছিলেন, তারা সবাই যাতে এক সাথে হৈ-হুল্লা করে উঠে এবং দফ-নাকাড়া বাজাতে শুরু করে।
সম্মুখ ভাগে মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড শোরগোল, দফ নাকাড়ার বাজনা ও শ্লোগান শোনে দুর্গের সকল রাজপুত এদিকে এসে জড়ো হলো। তাদের ভাব ছিল নিশ্চয় এদিক থেকে গযনী বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানছে। এই হৈ-হুল্লা আক্রমণের পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। ওদিকে কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার না হওয়ায় পঞ্চাশজন যোদ্ধা নিশ্চিন্ত মনে দুর্গপ্রাচীর থেকে পাথর খুলতে লাগল। ঘন্টা খানিক পরেই তারা প্রাচীর ভেদ করে মাটির স্পর্শ পেয়ে গেল। সুড়ং খনন করে এর আয়তন বড় করা তেমন মুশকিল ছিল না; কিন্তু অসুবিধা সৃষ্টি করল পানি। পাথর খোলার সাথে সাথে খালি জায়গা নদীর পানিতে ভরে যাচ্ছিল।
পঞ্চাশজন লোক এক সাথে খনন করার কারণে সুড়ং ছিল যথেষ্ট বড়। তারা দ্রুত খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। খননের এক পর্যায়ে বিশাল একটি পাথর দেখা দিল। খননকারীদের কাছে শক্ত ও মজবুত শাবল ছিল। তারা সেই শাবল দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে সেই পাথরকেও মূল কাঠামো থেকে খুলে ফেলল। বিশাল পাথর খোলার সাথে সাথেই দুর্গের আলো দেখা গেল। এ সময় খননকারীরা দ্রুততার সাথে অন্য পাথর খুলে দিলে প্রায় পনেরো বিশ হাত চওড়া সুড়ং তৈরী হয়ে গেল। সুড়ং এতোটা উঁচু হলো যে, একজন মানুষ সোজা দাঁড়িয়ে অনায়াসে এর ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
শেষ পাথরটি খোলে ফেলার সাথে সাথেই দুর্গের ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করল।
এমন সময় দুর্গের ভেতরের কেউ পানি দেখে চিৎকার শুরু করে দিল। ততক্ষণে খননকারীদের খননকাজ শেষ। তারা শত্রুদের উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু হটতে শুরু করল।
কিন্তু রাজপুতেরাও ছাড়ার পাত্র নয়। শত্রুর উপস্থিতি টের পেয়ে তারা মশাল উঁচু করে এদিকে দৌড়ে এলো। রাজপুতেরা ছিল বর্শা ও তরবারী সজ্জিত। তখনই উভয় পক্ষের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল। গযনীর সৈন্যরা তো পানিতেই ছিল রাজপুতেরা দলে দলে এসে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করল। পানির মধ্যে শুরু হয়ে প্রচণ্ড লড়াই। এ সময়ের মধ্যে সুড়ং পথে দিয়ে রাজপুতেরা মশাল হাতে নিয়ে আসতে শুরু করলে মশালের আলোয় শত্রু মিত্র পরিষ্কার দেখা যেতে লাগল।
এ দিকে সুলতান মাহমুদ সুড়ং খননকারীদের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। তিনি তাদের অবস্থা জানার জন্য কয়েকজন সৈন্যকে প্রেরণ করলেন। তারা এসে খবর দিল নদীর মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
খবর শুনে সুলতান একটু অগ্রসর হয়ে দেখলেন, নদীর মধ্যে অসংখ্য মশাল জ্বলছে, যেন নদীতে চলছে মশাল মিছিল। এ সময় তিনি বাকী সৈন্যদেরকে নদীতে নামিয়ে দিলেন এবং তাদের সাথে মশালও দিয়ে দিলেন। এ সময় সুলতান মাহমূদ কমান্ডারদের বললেন
মনে হচ্ছে আমার যোদ্ধারা সুড়ং খনন কাজ শেষ করে ফেলেছে, এই সুড়ং পথেই হয়তো রাজপুতেরা নদীতে নেমেছে। যাও, তোমরা গিয়ে বাস্তব অবস্থা দেখে আমাকে জানাও।
নদীর পানি সুড়ং পথে তীব্র বেগে দুর্গে প্রবেশ করছিল। আর সেই পথ দিয়ে রাজপুতেরা দুর্গের বাইরে আসছিল। কমান্ডারগণ এগিয়ে দেখল, নদীতে অসংখ্য মশাল নাচছে এবং আহত নিহত সৈন্যরা নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
এদিকে সুলতান মাহমূদ ভাবছিলেন, সুড়ং পথে দুর্গের ভেতর তার সৈন্যদের প্রবেশ করানো যায় কিনা। এমন সময় সুড়ং খননকারী এক আহত যোদ্ধা ফিরে এসে সুলতানকে জানাল।
সুড়ং পথে ভেতরে সৈন্য পাঠানো যাবে না সুলতান! এমনটি করলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।”
বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে নদীতে যুদ্ধরত সকল যোদ্ধাকে তিনি ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী ইতিহাসিকগণ যারা প্রতিদিনের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ লিখেছেন তা অনেক দীর্ঘ।
সেসব বর্ণনার সারমর্ম হলো, গয়নীর অকুতোভয় যোদ্ধারা ব্যাপক রক্তক্ষয় করে দুর্গ প্রাচীরের দু’জায়গায় ভাঙন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু রাজপুতেরা এমন বীরত্ব ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যা দেখে সুলতানের কণ্ঠে ইশ ইশ ধ্বনী উচ্চারিত হলো। তিনি রাজপুতদের বীরত্বও ত্যাগের মহোৎসব দেখে বিস্মিত হলেন।
সেখানে গযনীর সৈন্যরা ভাঙা প্রাচীর দিয়ে দুর্গের ভেতরে গিয়ে আক্রমণের কথা ছিলো সেখানে রাজপুতেরা বাইরে বেরিয়ে এসে গযনী সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে আবার দুর্গে ফিরে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয়, রাজপুত সৈন্যরা এক পর্যায়ে দুর্গে ফটক খোলা রেখেই বাইরে এসে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে আবার দুর্গে ফিরে যেতো।
এই অবস্থা দেখে এক পর্যায়ে সুলতান মাহমূদ কমান্ডারদের বললেন, এরা বাহাদুর কিন্তু কিছুটা নির্বোধ। এরা নির্বিচারে নিজেদের শক্তি খরচ করছে। তাই আক্রমণ না করে এখন শুধু প্রতিরোধ করো। আর তাদের শক্তিক্ষয় করতে দাও।
দুই প্রতিপক্ষে মধ্যে যখন এমনই মরণপণ যুদ্ধ চলছে, রাজা রায়চন্দ্রের কুমারী কন্যা রাধাকে তখন একাধারে ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে রাখা হচ্ছিলো। যখনই রাধা হুঁশ ফিরে পেতো, তার কণ্ঠে অতি ক্ষীণ আওয়াজে উচ্চারিত হতো! আল্লাহ আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে রাজকীয় বৈদ্য পুনরায় রাধাকে সংজ্ঞাহীনের ওষুধ খাইয়ে দিতেন।
এভাবে চব্বিশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পঁচিশতম দিনে সুলতান মাহমূদ সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, দুর্গের প্রাচীরের উপরে এবং ভাঙা অংশগুলোতে তীব্র আক্রমণ করে দুর্গের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করবে এবং দুর্গ ফটক খোলে রাজপুতেরা বাইরে এলে প্রচণ্ড আক্রমণ করে দুর্গ ফটক খোলা রাখার চেষ্টা করবে।
পঁচিশতম দিনের লড়াই ছিল চূড়ান্ত লড়াই। ইতোমধ্যে রাজপুতেরা তাদের বিপুল শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছে। গযনীর সৈন্যরা যখন সব কয়টি দুর্গফটকের ভাঙা অংশ এবং দুর্গ প্রাচীরের উপর একযোগে আক্রমণ করে বসল, তখন রাজপুতেরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। মুসলমানরা দুর্গে প্রবেশ করে দেখতে পেল শক্রদের জনবল একেবারেই কম।
রাজপুতেরা তখন মোকাবেলা করার চেয়ে আত্মহত্যাকেই বেশী প্রাধান্য দিচ্ছিল। অনেক রাজপুত পরিবার পরিজন সবাইকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিল এবং আত্মীয় স্বজন ও পরিবার-পরিজনসহ আগুনে আত্মহুতি দিল। বাইরের রাজপুতদের সামনে কোন হিন্দু নারী নজরে পড়লেই হল সে দৌড়ে গিয়ে তাকে হত্যা করছিল। মুনাজের বহু সৈন্য উঁচু দুর্গপ্রাচীর ও বুরুজ থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করল।
সুলতান মাহমূদ যখন দুর্গে প্রবেশ করলেন, তখন এক কথায় দুর্গের ভেতরের সবখানে আগুন জ্বলছে এবং সেই আগুনে রাজপুতেরা ভষ্ম হচ্ছে। বলা চলে মুনাজের সব অধিবাসী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। শুধু রাজমহলটি ছিল অক্ষুণ্ণ রাজমহলে কেউ অগ্নি সংযোগ করেনি।
গযনীর সৈন্যরা রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করে দেখতে পেল জায়গায় জায়গায় মরদেহের স্তূপ। রাজপুতেরা একে অন্যকে হত্যা করেছে। খুব ঠাণ্ডা মাথায় তারা এই পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচার জন্যে আত্মহুতির পথ বেছে নিয়েছে। রাজমহলের রক্ষিতা ও নর্তকীদের দেহেও খঞ্জর তরবারী বিদ্ধ অবস্থায় দেখা গেল। রাজমহল তল্লাশী করে রাজা রায়চন্দ্র এবং রানীর মরদেহ তাদের শয়নকক্ষের পালঙ্কের উপর পাওয়া গেল।
গযনীর সৈন্যরা রাজমহলের প্রতিটি কক্ষ তল্লাশী করলো। কোথাও জীবন্ত কাউকে পাওয়া যায় কি-না। কিন্তু সব কক্ষেই তারা দেখতে পেলো মৃত মানুষের মরদেহ। সব কক্ষই ছিল খোলা। কিন্তু একটি কক্ষ ছিল বাইরের দিক থেকে বন্ধ। ছিটকিনী খুলে সৈন্যরা দেখতে পেলো এক তরুণী মৃতপ্রায় অবস্থা বিছানায় শুয়ে আছে। মানুষের আওয়াজ পেয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ মেললো এবং ক্ষীণ একটি আওয়াজ করল।
আওয়াজ শুনে উপস্থিত সৈন্যরা তার কাছে গিয়ে বুঝলো তরুণীটি মৃত নয়, তবে মারাত্মক অসুস্থ।
অসুস্থ রাধা অস্পষ্ট আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো–
তোমরা কি মুসলমান সৈনিকা তোমাদের সুলতান কোথায়? তাকে ডেকে আনন। আমি তার কাছে বলতে চাই, আমি তার আল্লাহর নাম নিয়েই মরছি। আমি তার হাতে চুমু খেয়ে মরতে চাই।
জীবনৃত তরুণীর কণ্ঠে একথা শুনে গযনীর যোদ্ধারা বিস্মিত হলো। একটি অসুস্থ শত্র মেয়ের জন্যে এই অবস্থায় সুলতানকে এখানে আনা ঠিক হবে না মনে করে সৈন্যরা রাধার কথায় তেমন গুরুত্ব দিল না। রাধা যখন দেখতে পেলো তার কথায় এদের কাছে কোন গুরুত্বপাচ্ছে না, তখন হতাশাগ্রস্থ হয়ে তাদের দিকে কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। এরই মধ্যে তার মাথা নীচের দিকে ঢলে পড়লো। সাথে সাথেই নিথর হয়ে গেলো রাধার হৃদকম্পন। বস্তুত রাধা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে গযনী বাহিনীর সৈন্যদের সাক্ষী রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় হলো।
***
ব্যাপক রক্তপাত জীবনহানির পর গণ আত্মহত্যার মাধ্যমে মুনাজের রাজপুতেরা দুর্গ মুসলমানদের কজায় ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাই অগ্নি সংযোগ করে দুর্গের সকল বাড়ী ঘর ধ্বংস করে দিল। রাজপুতদের কাছ থেকে মুনাজ দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নিতে সুলতান মাহমূদকে লড়তে হলো জীবনের অন্যতম কঠিনতম লড়াই। এতে ব্যাপক জনশক্তিও কুরবানী দিতে হলো ।
মুনাজ দুর্গ দখলের পর সুলতান মাহমূদের লক্ষ ছিল কনৌজ দুর্গ। কিন্তু কনৌজ সম্পর্কে তার কাছে পরস্পর বিরোধী খবর আসছিল। উভয়বিদ সংবাদের মধ্যে কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা তা যাছাই করা মুশকিল বিষয় হয়ে উঠছিল।
গোয়েন্দা সালেহ সুলতানকে জানিয়ে ছিল, মুনাজ ও কনৌজের মধ্যবর্তী জায়গায়ই হবে তাদের সাথে কঠিন মোকাবেলা। কিন্তু পরে যা খবর আসছিল তাতে জানা যাচ্ছিল মুনাজ ও কনৌজের মধ্যবর্তী স্থানের কোথাও হিন্দু সৈন্যদের কোন চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না।
মুনাজ যুদ্ধে সুলতানকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এজন্য তিনি তাৎক্ষণিক অগ্রাভিযানের নির্দেশ না দিয়ে কিছুটা সময় নিতে চাচ্ছিলেন। যাতে ক্লান্ত ও আহত যযাদ্ধারা একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারে।
কয়েকদিন মুনাজে অবস্থান করার পর সেনাপতিগণ সুলতানকে পরামর্শ দিলেন, অভিযানের নির্দেশ দিয়ে দেয়া হোক! বিলম্ব করলে অবশেষে ভীম পালের সৈন্যরা এসে শত্রু বাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে দিতে পারে।
বাস্তবতা ও ঝুঁকির আশংকা বিবেচনা করে সুলতান কনৌজের দিকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন। তিনি গোটা বাহিনীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে একটি অংশকে যমুনা নদীর তীরে ঘেষে এবং অপর একটি অংশকে গঙ্গা নদীর তীর ঘেষে সামনে অগ্রসর হতে বললেন। অগ্রবর্তী দলকে খুবই শক্তিশালী করা হলো। মাঝে থাকলেন তিনি নিজে বেশীরভাগ সৈন্য নিয়ে; আর পেছনে রাখলেন একটি রিজার্ভ বাহিনী। প্রতিটি ইউনিট পূর্ণ রণপ্রস্তুতি নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল।
১০১৮ সালের ২০ ডিসেম্ভর মোতাবেক ৪০৯ হিজরী সনের ৮ শাবান কনৌজ পৌঁছলেন সুলতান। তিনি গোটা দুর্গ অবরোধ করলেন। কিন্তু খুবই হাল্কা প্রতিরোধের মুখোমুখি হলো মুসলিম সৈন্যরা। অনেকটা নির্বিঘ্নে অবরোধ আরোপ করতে দেয়াকে তিনি কনৌজ শাসকদের একটা কূটচাল মনে করে রিজার্ভ সৈন্যদেরকে পূর্ণ সতর্ক থাকতে বললেন। বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন এবং বাইরের আক্রমণ সম্ভাবনা যাছাই করার জন্যে বহুদূর পর্যন্ত তিনি পর্যবেক্ষক ও গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিলেন। তার প্রবল আশংকা ছিল হিন্দুরা অবশ্যই পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। কিন্তু সুলতান মাহমূদের সকল আশংকা-উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে অবরোধের দ্বিতীয় দিনই কনৌজের দুর্গবাসী সাদা পতাকা উড়িয়ে দিল।
* * *
সুলতান মাহমুদ প্রথমে চৌকস একটি ইউনিটকে দুর্গের ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর একই সাথে আরো দুটি সেনা ইউনিটকে ভেতরে পাঠালেন। এরা ভেতরে যাওয়ার সাথে সাথেই ভেতরের অবস্থার খবর এসে গেলো যে, ভেতরে কোন ধরনের সংঘর্ষ বাধার সম্ভাবনা নেই। তখন সুলতান নিজে কনৌজ দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
সুলতান ভেতরে প্রবেশ করলেন। কনৌজ সৈন্যদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল অবরোধ আরোপের আগেই কনৌজের মহারাজা পরিবার পরিজন নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন। সুলতান মাহমুদের নির্দেশে হিন্দু সেনাপতি ও কমান্ডারদের জিজ্ঞেস করা হলো, রাজ্যের ধন-ভাণ্ডার কোথায়? তারা তাদের জানা মতে ধনভাণ্ডারের অবস্থান জানালো; কিন্তু সেখানে তল্লাশী করে কিছুই পাওয়া গেল না।
সুলতান রাজমহলকে ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং প্রধান মন্দিরের সব মূর্তি ভেঙে ফেলার হুকুম দিলেন।
খাজানা না পাওয়ার কথা চাউড় হলে সালেহ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে গ্রেফতার করিয়ে আনলো। পুরোহিতকে যখন ধনভাণ্ডারের কথা জিজ্ঞেস করা হলো তখন তিনি সুলতানকে জানালেন- ধন-ভাণ্ডারের খবর আপনার সালেহ নামক গোয়েন্দা জানে। কিন্তু সেখানে হয়তো এখন আর কিছুই নেই। মহারাজা হয়তো সবই সাথে নিয়ে গেছেন।
ঐতিহাসিক আবুল কাসিম ফারিশতা লিখেছেন, “সুলতান মাহমূদের এই বিজয় কোন সাধারণ বিজয় ছিল না। কনৌজ বিজয় ছিল রাজনৈতিক বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কনৌজ বিজয়ের ফলে ভারতের বিশাল অংশ সুলতানের দখলে চলে এলো।