৪.২ সম্রাট ষোড়শ এজিস

১১.

সম্রাট ষোড়শ এজিস, এটা তার আসল নাম নয়। সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর এই নামটা তিনি বেছে নেন এজিস পরিবারের সাথে একটা ক্ষীণ যোগাযোগ বোঝানোর জন্য। এই পরিবার দুহাজার বছর পূর্বে এম্পায়ার শাসন করত, তাদের অধিকাংশই ছিল সফল সম্রাট–বিশেষ করে ষষ্ঠ এজিস, তার বেয়াল্লিশ বছরের শাসনকালে এম্পায়ার যথেষ্ট উন্নতি করে অথচ সে রক্তলোলুপ স্বৈরশাসক ছিল না মোটেই।

পুরনো এজিসদের কারো সাথেই ষোড়শ এজিসের কোনো মিল নেই–যদি হলোগ্রাফিক রেকর্ডের সত্যিকার কোনো মূল্য থেকে থাকে। আবার সত্যি কথাটা না বললেই নয়, জনগণের মাঝে যে হলোগ্রাফ বিতরণ করা হয়েছে তার সাথেও ষোড়শ এজিসের কোনো মিল নেই।

সত্যি কথা বলতে কি সেলডনের মতে, অসংখ্য দোষ এবং দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সম্রাট ক্লীয়ন নিঃসন্দেহে প্রতাপশালী রাজসিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।

ঘোড়শ এজিস মোটেই তা নন। সেলডন তাকে এত কাছ থেকে আগে দেখেন নি এবং যে কয়েকটা মাত্র হলোগ্রাফ দেখেছেন সেগুলোও অতিরঞ্জিত। ইম্পেরিয়াল হলোগ্রাফার তার কাজ ভালোই জানে এবং করেছেও নিখুঁতভাবে।

ঘোড়শ এজিস বেটে, অনাকর্ষণীয় চেহারা, খানিকটা ফোলা চোখ এবং তাতে বুদ্ধিমত্তার কোনো ছাপ নেই। সিংহাসনে বসার জন্য তার একমাত্র যোগ্যতা হলো তিনি ক্লীয়নের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।

একটা কৃতিত্ব অবশ্য তাকে দিতেই হবে, তিনি কখনো প্রবল প্রতাপশালী দয়ালু সম্রাট হিসেবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন নি। তিনি “জনগণের সম্রাট” হতে চান। ইম্পেরিয়াল প্রটোকল আর ইম্পেরিয়াল গার্ডের বাধার কারণেই তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গম্বুজের নীচে ট্র্যানটরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে পারেন না। সবাই জানে তিনি প্রতিটি নাগরিকের সাথে হাত মিলাতে চান, ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রতিটি সমস্যার কথা শুনতে চান।

কুর্নিশ করে বিড়বিড়িয়ে সেলডন বললেন, “সাক্ষাতের অনুমতি দেয়ায় আমি কৃতজ্ঞ, সায়ার।”

যোড়শ এজিসের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার এবং আকর্ষণীয়, শারীরিক কাঠামোর সাথে বেমানান। “একজন ফার্স্ট মিনিস্টার সবসময়ই কিছু বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন, যদিও কৃতিত্বটা আমার নিজেকেই দেয়া উচিত তোমার সাথে দেখা করার অসম্ভব সাহসের জন্য।”

তার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণ রসবোধ এবং সেলডন অনুধাবন করলেন যে চেহারায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকলেও একজন মানুষ বুদ্ধিমান হতে পারে।

“সাহস, সায়ার?”

“নিশ্চয়ই। তোমাকে সবাই র‍্যাভেন সেলডন বলে, তাই না?”

“মাত্র গতকালকেই নামটা শুনেছি, সায়ার।”

“নিঃসন্দেহে তোমার সাইকোহিস্টোরির উদ্দেশ্যেই এই অপবাদ, যা এম্পায়ারের পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছে।”

“শুধুমাত্র সম্ভাবনাই নির্ণয় করেছে, সায়ার–“

“তাই পৌরাণিক যুগের দুর্ভাগ্য ডেকে আনার অশুভ পাখির সাথে তোমাকে তুলনা করা হচ্ছে। তবে আমার মতে তুমি নিজেই সেই অশুভ সংকেত।”

“মনে হয় না, সায়ার।”

“রেকর্ড সব পরিষ্কার। ক্লীয়নের প্রথম ফার্স্ট মিনিস্টার ইটো ডেমারজেল তোমার কাজে আগ্রহী ছিল, কি ঘটেছে তার তাকে বরখাস্ত করে নির্বাসন দেয়া হয়। সম্রাট ক্লীয়ন নিজেও আগ্রহী ছিল এবং তার কি হয়েছে–ঘাতকের হাতে খুন হয়। সামরিক জান্তা তোমার কাজে আগ্রহী ছিল। কি হয়েছে তাদের ধুলায় মিশে যায়। এমনকি বলা হয়ে থাকে জোরামাইটরাও নাকি তোমার কাজে আগ্রহী ছিল এবং তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর এখন র‍্যাভেন সেলডন, তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছ। আমি কি আশা করতে পারি।”

“দুর্ভাগ্যজনক কিছুই না, সায়ার।”

“আমিও সেটাই আশা করি। কারণ যাদের কথা বললাম, আমি তাদের মতো তোমার কাজে আগ্রহী নই। এখন বল তুমি আমার কাছে কি চাও?”

ব্যাখ্যা করে বললেন সেলডন। যদি ভয়ংকর দুর্যোগ ঘটেই যায় তাহলে মানবজাতির সমুদয় জ্ঞান সংরক্ষণের জন্য একটা এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করবেন তিনি, এবং প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য সম্রাটের সাহায্য প্রয়োজন। মনযোগ দিয়ে এবং মাঝখানে কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য না করেই শুনলেন সম্রাট।

“আচ্ছা,” ঘোড়শ এজিস বললেন, “তুমি তাহলে সত্যিই বিশ্বাস কর যে এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে।”

“জোরালো সম্ভাবনা, সায়ার এবং সেটা বিবেচনা না করে উপায় নেই। যেভাবেই হোক আমি তা ঠেকাতে চাই, যদি সম্ভব হয় বা অন্তত পরবর্তী দুর্যোগের পরিমাণ কমিয়ে আনতে চাই।”

“র‍্যাভেন সেলডন, যদি এভাবে প্রচার করতে থাক তাহলে এম্পায়ার ধ্বংস হবেই, কোনোকিছুই তা ঠেকাতে পারবে না।”

“না, সায়ার। আমি শুধু কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি চাই।”

“সেই অনুমতি তোমার আছে, কিন্তু বুঝতে পারছি না আমার কাছে তুমি কি চাও। এনসাইক্লোপিডিয়ার কথা আমাকে বলছ কেন?”

“কারণ, আমি গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে কাজ করতে চাই, সায়ার, বা সঠিক ভাবে বলতে গেলে, আমার সহকর্মীদেরও লাইব্রেরীতে নিয়ে আসতে চাই।”

“নিশ্চিত থাকো আমি তাতে বাধা দেব না।”

“এইটুকুই যথেষ্ট নয়, সায়ার। আমি আপনার সাহায্য চাই।”

“কি সাহায্য, প্রাক্তন ফার্স্ট মিনিস্টার।”

“আর্থিক সাহায্য। পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে লাইব্রেরী সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং আমাকেও বের করে দেয়া হবে।”

“ক্রেডিটস!” সম্রাটের কণ্ঠে বিস্ময়। “তুমি আমার কাছে ক্রেডিট এর জন্য এসেছ?”

“জ্বি, সায়ার।”

ঘোড়শ এজিস অস্থির ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ালেন। সেলডনও সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু এজিস হাত নেড়ে তাকে বসে থাকতে বললেন।

“বসো। আমাকে এত সম্মান দেখানোর দরকার নেই। আমি সম্রাট নই। এই দায়িত্ব আমি চাই নি, কিন্তু ওরা আমাকে বাধ্য করল। আমিই ইম্পেরিয়াল পরিবারের সবচেয়ে নিকটতম বস্তু আর সবাই মিলে আমাকে বোঝাল এম্পায়ারে একজন সম্রাট প্রয়োজন। আমি বাধ্য হলাম আর ওদেরও অনেক উপকার হলো।

“ক্রেডিট! তুমি আমার কাছে ক্রেডিট চাইছ। তুমিই প্রচার করছ যে এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিভাবে ভাঙবে? তুমি কি ভাবছ বিদ্রোহ? গৃহ যুদ্ধ? বিশৃঙ্খলা?

“না। বরং ভাববা ক্রেডিট এর কথা। তুমি কি জানো আমি এম্পায়ারের অর্ধেকের বেশী প্রদেশ থেকে কোনো কর আদায় করতে পারি না। ওগুলো এখনো এম্পায়ারের অংশ–‘ইপেরিয়াম দীর্ঘজীবি হোক!’

“সম্রাটকে সালাম!–কিন্তু ওরা কর দেবে না এবং তা আদায় করার প্রয়োজনীয় লোকবল আমার হাতে নেই। আর যদি ওদের কাছ থেকে ক্রেডিট আদায় না করা যায় তাহলে ওরা তো এম্পায়ারের অংশ নয়, তাই না?”

“ক্রেডিটস! এম্পায়ার ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে ভুগছে। আমার কাছে দেয়ার মতো কিছু নেই। তুমি কি জানো যে ইম্পেরিয়াল প্যালেস গ্রাউঞ্জে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও পর্যাপ্ত অর্থ নেই? গ্রাউণ্ডটাকে ছোট করে ফেলতে হবে। প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। লোক সংখ্যা কমাতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই।

“প্রফেসর সেলডন, তুমি যদি ক্রেডিট চাও, আমার কাছে কিছু নেই। লাইব্রেরীর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য আমি কোথায় পাব। ওদের বরং কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এই কারণে যে প্রতিবছর অতি সামান্য হলেও, একটা ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারছি।” কথা শেষ করে সম্রাট করতল ঊর্ধ্বমুখী করে ইম্পেরিয়াল কোষাগারের শূন্যতা আরো পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন।

সেলডন বিমূঢ়। বললেন, “যাইহোক, সায়ার আপনার কাছে ক্রেডিট না থাকলেও ইম্পেরিয়াল সম্মান এখনো আছে। আপনি নিশ্চয়ই লাইব্রেরীকে আদেশ দিতে পারবেন যেন আমি আমার অফিস ধরে রাখতে পারি এবং সহকর্মীদের নিয়ে আসতে পারি?”

আবার বসলেন ষোড়শ এজিস, যেন ক্রেডিটের আলোচনা থেমে যেতেই তার অস্থিরতাও দূর হয়ে গেছে।

“গ্যালাকটিক লাইব্রেরী স্বাধীন ভাবে নিজেদের পরিচালনা করে। ইম্পেরিয়াল প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এটা। তারা নিজেরাই নিজেদের আইন কানুন তৈরি করে এবং এই নিয়ম পালন করে আসছে ষষ্ঠ এজিসের আমল থেকে”–মুচকি হাসলেন সম্রাট–“লাইব্রেরী নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন ষষ্ঠ এজিস। তোমার কি মনে হয় আমি সফল হবো?”

“আমি আপনাকে শক্তি প্রয়োগ করতে বলছি না, সায়ার। শুধু একটু দ্রভাবে আপনার ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে বলছি। যদি লাইব্রেরীর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব না ফেলে তাহলে তারা খুশি হয়েই সম্রাটের ইচ্ছা পালন করবে।”

“প্রফেসর সেলডন, লাইব্রেরীর ব্যাপারে তুমি আসলে কিছুই জান না। শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করব। সেটা যতই নম্র আর বিনীত হোক না কেন, ওরা করবে ঠিক উল্টোটা। ইম্পেরিয়াল নিয়ন্ত্রণের সামান্য আভাস পেলেও খেপে উঠবে। এই বিষয়ে ওরা ভীষণ স্পর্শকাতর।”

“তাহলে আমি কি করব?”

“আমি বলে দিতে পারি কি করবে। বুদ্ধিটা এইমাত্র মাথায় এল। আমি জনগণেরই একজন এবং ইচ্ছে হলেই গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে যেতে পারি। যেহেতু লাইব্রেরীটা প্যালেস গ্রাউরে ভেতরে সেহেতু আমি ওখানে গেলে প্রটোকলও ভাঙবে না। তুমি থাকবে আমার সাথে। আমরা দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো আচরণ করব। আমি ওদের কাছে কিছুই চাইব না, কিন্তু ওরা যদি আমাদের দুজনকে কাঁধে হাত রেখে হেঁটে যেতে দেখে তখন হয়তো বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য তোমার প্রতি সদয় হবে। কিন্তু এর বেশী কিছু আমি করতে পারব না।”

হতাশ সেলডন নিশ্চিত হতে পারলেন না এতে কতটুকু লাভ হবে।

.

১২.

ল্যাস জিনোর কণ্ঠে নিঃসন্দেহে সৰ্ষম। “আমি জানতাম না আপনি সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রফেসর সেলডন।”

“সম্রাট হলেও তিনি যথেষ্ট আন্তরিক। তাছাড়া তিনি আমার অভিজ্ঞতাকে মূল্য দেন। যেহেতু আমি ক্লীয়নের ফার্স্ট মিনিস্টার ছিলাম।”

“এই ঘটনা আমাদের সবার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। বহুদিন আমাদের হলগুলোতে কোনো সম্রাটের পদধূলি পড়ে নি। সাধারণত: লাইব্রেরীর কোনো সাহায্য সম্রাটের প্রয়োজন হলে

“আমি জানি। তিনি সেটা জানান এবং ভদ্রতা হিসেবে তাকে সেটা পৌঁছে দেয়া হয়।”

“একবার একটা প্রস্তাব উঠেছিল,” খোশ গল্পের সুরে জিনো বলল, “সম্রাটকে কম্পিউটারাইজড প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে দেয়া হবে যা সরাসরি লাইব্রেরীর সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকবে। যেন কোনো কিছু প্রয়োজন হলে তাকে অপেক্ষা। করতে না হয়। তখন ছিল সুখের দিন যখন ক্রেডিট কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু জানেন, প্রস্তাবটা পাস হয় নি।”

“তাই? কেন?”

“সবাই এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। সবাই মনে করেছিল এতে সম্রাট লাইব্রেরীর সাথে বেশী যুক্ত হয়ে পড়বেন এবং লাইব্রেরীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে।”

“আর এই বোর্ড, যারা সম্রাটকে পর্যন্ত মাথা নুইয়ে সম্মান করে না, তারা কি আমাকে এখানে কাজ করতে দেবে?”

“এই মুহূর্তে, হ্যাঁ, সবার মনেই আশার সঞ্চার হচ্ছে–আমিও সেটাকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছি–যদি আমরা সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সহায়তা করি তাহলে হয়তো আর্থিক সাহায্য বাড়ার সম্ভাবনা আছে।”

“অর্থাৎ ক্রেডিট–ক্রেডিটের সামান্য সম্ভাবনাই–কথা বলবে।”

“আমারও তাই মনে হয়।”

“আমি সহকর্মীদের নিয়ে আসতে পারি?”

জিনোকে বিব্রত দেখাল। “বোধহয় না। সম্রাটকে আমরা আপনার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে দেখেছি–আপনার সহকর্মীদের সাথে নয়। দুঃখিত, প্রফেসর।”

অসহায় ভঙ্গীতে কাঁধ নাড়লেন সেলডন। হতাশা আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরল তাকে। সহকর্মীদের তিনি নিয়ে আসতে পারবেন না। ওয়ানডার মতো অন্যদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। পর্যাপ্ত অনুসন্ধানের জন্য তার নিজেরও বিপুল পরিমাণ ক্রেডিট প্রয়োজন। এবং তার কাছেও কিছু নেই।

.

১৩.

আটত্রিশ বছর আগে হ্যাঁলিকনের হ্যারি সেলডন হাইপারশিপ থেকে ট্র্যানটরে পা রেখেছিলেন। তারপর থেকে এম্পায়ারের রাজধানী, বিশ্ব-নগরী ট্র্যানটরের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বারংবার মানশ্চক্ষে ট্র্যানটরের পুরনো জৌলুস ফুটে উঠা কি বৃদ্ধ একজন মানুষের স্মৃতি কাতরতা। অথবা এটা হয়তো তার তরুণ বয়সের উচ্ছ্বাস হ্যাঁলিকনের মতো প্রাদেশিক আউটার ওয়ার্ল্ড থেকে আগত এক তরুণ ট্র্যানটরের চকচকে টাওয়ার, ঝলমলে গম্বুজ, বহুবর্ণের জনসমুদ্র দেখে হতচকিত না হয়ে কি পারবে।

আর এখন, পরিপূর্ণ দিনের আলোতেও রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। গুণ্ডা বদমাশরাই শহরের বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, দখলদারিত্ব বাড়ানোর জন্য নিজেদের ভেতরে মারামারি করে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার কিছুই অবশিষ্ট নেই। যা আছে তারাও কেন্দ্রীয় অফিসে হাজার হাজার অভিযোগ সামলাতে ব্যস্ত। জরুরী প্রয়োজনে নিরাপত্তা কর্মীদের পাঠানো হয় কিন্তু তা অপরাধ ঘটে যাওয়ার পরে–ট্র্যানটরের নাগরিকদের রক্ষা করার ন্যূনতম আগ্রহ তাদের আর নেই। কেউ যদি রাস্তায় বেরোয় সেটা নিজের ঝুঁকিতে করতে হবে এবং তা ভয়ানক ঝুঁকি। তারপরেও সেলডন ঝুঁকিটা নিলেন, যেন যারা তার প্রিয় এম্পায়ার ধ্বংস করছে তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন সেলডন–আর ভাবছেন।

কোনো ভাবেই লাভ হচ্ছে না। কোনো ভাবেই না। ওয়ানডার জেনেটিক প্যাটার্ন তিনি পৃথক করতে পারেন নি এবং এটা ছাড়া তার মতো অন্যদের খুঁজে বের করাও সম্ভব নয়।

ইউগো এমারিলের প্রাইম রেডিয়্যান্টে ত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার পর গত ছয় বছরে ওয়ানডার মাইন্ড রিডিং ক্ষমতা আরো তীক্ষ্ণ হয়েছে। তার বিশেষত্ব অনেকরকম। যখনই সে বুঝতে পেরেছে যে তার মেন্টাল এ্যাবিলিটি অন্যদের থেকে আলাদা সে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে এই বিশেষ পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য, এই শক্তিটাকে হাতের মুঠোয় নেয়ার জন্য, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কৈশোরকাল পেরোনোর সময় আরো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠছে সে। তার বালিকা বয়সের খিল খিল হাসি ভীষণ পছন্দ করতেন সেলডন। এখন আর সেই হাসি বড় একটা দেখা যায় না। সে হ্যারি সেলডনের আরো বেশী প্রিয় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি প্রদত্ত “উপহার” দ্বারা তাকে সাহায্য করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার জন্য। কারণ হ্যারি সেলডন ওয়ানডাকে সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনের পরিকল্পনার কথা বলেছেন এবং ওয়ানডা নিজেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই লক্ষ্য অর্জনে সে হ্যারি সেলডনকে সাহায্য করবে।

আজকে হ্যারি সেলডনের মনটা আরো বেশী খারাপ। তিনি উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ওয়ানডার মেন্টালিক এ্যাবিলিটি তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে না। কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত ক্রেডিট তার নেই–ওয়ানডার মতো অন্যদের খুঁজে বের করার মতো ক্রেডিট তার নেই, স্ট্রিলিং-এ সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে কর্মীদের বেতন দেয়ার মতো ক্রেডিট তার নেই, গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এনসাইক্লোপিডিয়া প্রজেক্ট শুরু করার মতো ক্রেডিট তার নেই।

কি হবে এখন?

গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলেন। যদিও একটা গ্র্যাভিক্যাব নিতে পারতেন, কিন্তু হাঁটাই পছন্দ করলেন তিনি চিন্তা করার জন্য সময় দরকার তার।

একটা চীৎকার শুনলেন–“ওই যে ব্যাটা যাচ্ছে!” কিন্তু আগ্রহ দেখালেন না।

আবার শুনলেন। “ওই যে ব্যাটা যাচ্ছে! সাইকোহিস্টোরি!”

শব্দটা তাকে চোখ তুলতে বাধ্য করল।–সাইকোহিস্টোরি।

একদল তরুণ চারপাশে ঘিরে তার কাছে এগিয়ে আসছে।

স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলডন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ছড়ি উঁচিয়ে ধরলেন। “কি চাও তোমরা?”

সবাই হেসে উঠল। “ক্রেডিট, বুড়া মিয়া। তোমার কাছে ক্রেডিট আছে?”

“থাকতে পারে, কিন্তু আমার কাছে চাইছ কেন? তোমরা সাইকোহিস্টোরি বলেছ। জানো আমি কে?”

“নিশ্চয়ই, তুমি র‍্যাভেন সেলডন,” নেতা গোছের তরুণ বলল। তাকে আত্মবিশ্বাসী এবং খুশি মনে হলো।

“তুমি একটা উন্মাদ,” চীৎকার করে বলল আরেকজন।

“ক্রেডিট না দিলে তোমরা কি করবে?”

“তোমাকে পিটিয়ে কেড়ে নেব,” নেতা জবাব দিল।

“আর যদি ক্রেডিট দেই?”

“তারপরেও পিটাব!” হেসে উঠল সবাই।

হ্যারি সেলডন ছড়িটা আরো উঁচু করলেন। “সরে যাও। সবাই।”

এর মধ্যে তিনি গুণেও ফেলেছেন। আটজন।

নিরাশ হয়ে পড়লেন। একবার তিনি, ডর্স আর রাইখ দশজন গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছিলেন। তখন ওদেরকে সামলাতে কোনো অসুবিধা হয় নি। তার বয়স ছিল বত্রিশ আর ডর্স ডর্সের তো কোনো তুলনাই ছিল না।

এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। ছড়ি নাড়লেন তিনি।

গুণ্ডাদের নেতা বলল, “হেই, বুড়া আমাদের মারতে আসছে। কি করব আমরা?”

দ্রুত চারপাশে তাকালেন সেলডন। নিরাপত্তাকর্মীদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার আরেকটা উদাহরণ। দুএকজন পথচারীকে দেখলেন। কিন্তু ওদেরকে ডেকে লাভ নেই। সবাই দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। নিজের প্রাণের উপর ঝুঁকি নেয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।

“যে সামনে আসবে তারই মাথা ফাটিয়ে দেব।” সেলডন বললেন।

“তাই?” দ্রুত সামনে বেড়ে ছড়িটা ধরে ফেলল নেতা। কিছুক্ষণ লড়াই করে হার মানলেন সেলডন। নেতা সেটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

“এবার কি করবে, বুড়া মিয়া?”

দেয়ালের সাথে আরো ঠেসে দাঁড়ালেন সেলডন। আঘাতের অপেক্ষা করছেন। সবাই মিলে তাকে ঘিরে ফেলেছে, প্রত্যেকেরই হাত নিশপিশ করছে মারার জন্য। তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্য আত্মরক্ষার ভঙ্গীতে হাত তুললেন। এখনো তিনি খালি হাতে বাধা দিতে পারবেন–খানিকটা হলেও। যদি শক্র মাত্র একজন বা দুজন হতো তাহলে তিনি হয়তো শরীর বাঁকিয়ে আঘাত এড়িয়ে যেতে পারতেন, পাল্টা আঘাত করতে পারতেন। কিন্তু আটজনের বিরুদ্ধে অসম্ভব।

চেষ্টা করলেন এক পাশে সরে গিয়ে আঘাত এড়ানোর কিন্তু ডান পায়ের অক্ষমতার কারণে পড়ে গেলেন। বুঝলেন এবার আর কিছু করার নেই।

তখন আরেকটা চীৎকার শুনলেন। “কি হচ্ছে এখানে? ভাগ, বদমাশের দল। নইলে খুন করে ফেলব।”

“আরেক বুড়ো মিয়া।” নেতা বলল।

“অত বুড়ো নই,” জবাব দিল আগন্তুক। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নেতার মুখে জোরালো আঘাত হানল, সাথে সাথে মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল।

“রাইখ, তুমি,” বিস্মিত হয়ে বললেন সেলডন।

“সরে যাও, বাবা। সরে যাও।” এখনো হাত চালাচ্ছে রাইখ।

চোয়াল ঘষতে ঘষতে নেতা বলল, “তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।”

“না, তুমি কিছুই করবে না,” বলল রাইখ, লম্বা ফলার চকচকে দুটো ছুরি বের করে বাগিয়ে ধরল।

“এখনো সাথে ছুরি রাখো, রাইখ?” দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“সবসময়ই। কোনোকিছুই আমাকে থামাতে পারবে না।”

“আমি থামাব,” নেতা বলল, তার হাতে ব্লাস্টার।

চোখের পলকের চেয়েও দ্রুত, রাইখের একটা ছুরি বাতাসে ভেসে সোজা গিয়ে নেতার গলায় বিধল। একটা অস্ফুট আর্তনাদ আর গরগর শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেল সে। বাকি সাতজন ঘটনাটা দেখছে।

“আমার ছুরি ফেরত চাই,” বলতে বলতে সামনে এগোল রাইখ। গুণ্ডাটার গলা থেকে ছুরি বের করে তারই পোশাকে রক্ত মুছে নিল একইসাথে ব্লাস্টারটা তুলে ঢুকিয়ে রাখল পকেটে।

“আমি ব্লাস্টার পছন্দ করি না,” বাকীদের উদ্দেশ্যে বলল রাইখ। কারণ ব্লাস্টার আমার মিস হতে পারে। কিন্তু ছুরি কখনো মিস হয় না। কখনোই না। এই ব্যাটা মরে গেছে। তোমরা সাতজন দাঁড়িয়ে আছ। দাঁড়িয়ে থাকবে না ভাগবে?”

“ধর, ব্যাটাকে,” চীৎকার করে বলল গুণ্ডাদের একজন। হামলা করার জন্য সাতজনই ছুটে এল এক সাথে।

একে একে রাইখের দুই ছুরিই ঝলকে উঠল, আরো দুই গুণ্ডা পড়ে গেল মাটিতে। দুজনেরই পেটে ছুরি বিধে আছে।

“আমার ছুরি ফিরিয়ে দাও,” বলল রাইখ, কাটার ভঙ্গীতে দুজনের পেট থেকে ছুরি বের করে রক্ত মুছে নিল।

“এই দুজন এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু বেশীক্ষণ থাকবে না। বাকী থাকলে তোমরা পাঁচজন। মারামারি করার শখ আছে না ভাগবে?”।

পালানোর জন্য ঘুরল গুণ্ডাদল। পিছন থেকে রাইখ বলল, “সঙ্গীদের নিয়ে যাও। ওদের আমার দরকার নেই।”

তিন সঙ্গীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে লেজ গুটিয়ে পালাল গুণ্ডাবাহিনী।

মাটি থেকে সেলডনের ছড়িটা তুলে নিল রাইখ। “হাঁটতে পারবে, বাবা?”

“মনে হয় পারব না। পা মচকে গেছে।”

“ঠিক আছে, আমার গাড়িতে উঠো, কিন্তু তুমি হেঁটে যাচ্ছিলে কেন?”

“সমস্যা কি? আমার তো কখনো কিছু হয় নি।”

“তাই কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছিলে। গাড়িতে উঠো। তোমাকে স্ট্রিলিং-এ নিয়ে যাই।”

শান্ত ভঙ্গীতে গ্রাউণ্ড কার প্রোগ্রাম করল রাইখ, তারপর বলল, “ডর্স আমাদের সাথে নেই। মা একাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবগুলোকে মেরে ফেলত।”

চোখ ভিজে উঠল সেলডনের। “আমি জানি, রাইখ। আমি জানি। আমিও তার অভাব ভীষণভাবে বোধ করি।”

“দুঃখিত,” নিচু গলায় বলল রাইখ।

“আমি বিপদে পড়েছি তুমি জানলে কিভাবে?”

“ওয়ানডা বলেছে। সে এসে বলল যে কিছু খারাপ লোক তোমার জন্য ওত পেতে বসে আছে, কোথায় সেই জায়গাটাও দেখিয়ে দেয়। সাথে সাথে আমি ছুটে আসি।”

“তোমার কোনো সন্দেহ হয় নি?”

“মোটেই না। আমরা এখন ভালো করেই জানি যে তোমার মাইণ্ড এবং তোমার আশেপাশের বস্তুগুলোর সাথে ওয়ানডার কোনো না কোনো ভাবে যোগাযোগ আছে।”

“কতজন ছিল সেটা বলেছে?”

“না, শুধু বলেছে কয়েকজন।”

“আর তুমি একাই চলে এসেছ, তাই না, রাইখ?”

“একটা পসি নিয়ে আসার মতো সময় আমার হাতে ছিল না। তাছাড়া আমি একাই যথেষ্ট।”

“হ্যাঁ, যথেষ্ট। ধন্যবাদ, রাইখ।”

.

১৪.

একটা নরম গদির উপর পা তুলে আরাম করে বসেছেন সেলডন। স্ট্রিলিং-এ ফিরে এসেছেন কিছুক্ষণ আগে।

রাইখের দৃষ্টি গম্ভীর। “বাবা, এখন থেকে তুমি ট্রানটরের রাস্তায় একা বের হবে না।”

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। “কেন? একটা ঘটনার জন্যই?”

“একটা ঘটনাই যথেষ্ট। এখন আর তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। তোমার বয়স সত্তর। প্রয়োজনের মুহূর্তে ডান পা কোনো কাজেই আসবে না। তাছাড়া তোমার অনেক শত্রু–“

“শত্রু?”

“হ্যাঁ। ওই বদমাশগুলো কোনো পথচারীর উপর সুযোগ নেয়ার অপেক্ষায় ছিল । তোমাকে দেখেই ওরা সাইকোহিস্টোরি’ বলে চীৎকার করে উঠে। তোমাকে বলেছে উন্মাদ। কেন?”

“আমি জানি না কেন?”

“কারণ তুমি তোমার নিজের দুনিয়াতে বাস কর, বাবা, এবং জান না ট্রানটরে কি হচ্ছে। তুমি কি ধরে নিয়েছ ট্রানটরিয়ানরা জানে না যে তাদের সাজানো বিশ্ব দ্রুত গতিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? তুমি কি ধরে নিয়েছ যে ওরা জানে না তোমার সাইকোহিস্টোরি দীর্ঘ দিন ধরেই এই কথা প্রচার করছে? তোমার কি মনে হয় নি যে এর জন্য তারা বার্তাবাহককেই দোষ দেবে? যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠে–আর বাস্তবিকই খারাপ হচ্ছে–অনেকেই মনে করে এর জন্য তুমিই দায়ী।”

“আমি বিশ্বাস করি না।”

“কেন গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর একটা অংশ তোমাকে তাড়াতে চায়? কাজেই তুমি আর একা বাইরে যেতে পারবে না। সাথে আমি থাকব অথবা দেহরক্ষী। এটাই শেষ কথা, বাবা।”

ভয়ংকর রকম বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন সেলডন।

সুর নরম করে রাইখ বলল, “কিন্তু বেশীদিনের জন্য নয়, বাবা, আমি একটা নতুন চাকরী পেয়েছি।”

চোখ তুললেন সেলডন। “নতুন চাকরী?”

“বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা।”

“কোন বিশ্ববিদ্যালয়?”

“সান্তানি।”

ঠোঁট কাঁপল সেলডনের। “সান্তানি! ট্র্যানটর থেকে নয় হাজার পারসেক দূরে। গ্যালাক্সির অপর প্রান্তে একটা প্রাদেশিক বিশ্ব।”

“ঠিক, সেজন্যই আমি ওখানে যেতে চাইছি। সারাজীবন ট্র্যানটরে কাটিয়েছি, বাবা, এখন আমি বিরক্ত। এম্পায়ারের আর কোনো বিশ্ব ট্রানটরের মতো এত দ্রুত হারে বিপর্যস্ত হচ্ছে না। অপরাধের স্বর্গরাজ্য এবং আমাদের রক্ষা করার জন্য কেউ নেই। অর্থনীতি ধ্বসে পড়েছে, প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে। অন্যদিকে সান্তানি এখনো যথেষ্ট সভ্য। আমি ওখানে মানীলা, ওয়ানডা আর বেলিসকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই। দুমাসের মধ্যেই আমরা সবাই ওখানে চলে যাচ্ছি।”

“সবাই!”

“এবং তুমি, বাবা। এবং তুমি। আমাদের সাথে তুমিও সান্তানি যাচ্ছ।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “অসম্ভব, রাইখ। তুমি জানো।”

“কেন অসম্ভব?”

“কারণটা তুমি জানো। প্রজেক্ট। আমার সাইকোহিস্টোরি। আমার সারাজীবনের সাধনা আর শ্রম ত্যাগ করতে বলছ?”

“কেন নয়? সাইকোহিস্টোরি তোমাকে ত্যাগ করেছে।”

“তুমি পাগল।”

“না, আমি পাগল নই। এই গবেষণা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? তোমার ক্রেডিটস নেই। পাবেও না। ট্রানটরের কেউ আর তোমাকে সমর্থন দেবে না।”

“প্রায় চল্লিশ বছর–“

“স্বীকার করছি। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় সাধনা করেও তুমি ব্যর্থ হয়েছ। ব্যর্থ হওয়াটা অপরাধ নয়। তুমি চেষ্টা করেছ, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমাকে একটা মৃত অর্থনীতি আর ধ্বংসোখ এম্পায়ারে কাজ করতে হবে। দীর্ঘদিন থেকে তুমি এই কথাই প্রচার করছ আর এটাই তোমাকে শেষ পর্যন্ত থামিয়ে দেবে। কাজেই–“

“না, আমি থামব না। যেভাবেই হোক কাজ চালিয়ে যাব।”

“ঠিক আছে, বাবা, এতই যদি জেদ ধর, তাহলে সাইকোহিস্টোরিও সাথে নিয়ে চল। সান্তানিতে গিয়ে নতুনভাবে শুরু করবে। ওখানে ক্রেডিটস হয়তো সমস্যা হবে না–হয়তো অনেক সমর্থনও পাবে।”

“আর যে মানুষগুলো এতদিন আমার জন্য বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করল, তাদের কি হবে?”

“গোল্লায় যাক ওরা সব। বাবা, ওরা তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে কারণ তুমি ওদের বেতন দিতে পারবে না। সারাজীবন এখানে থাকলে একা হয়ে যাবে। বোঝার চেষ্টা কর। তোমার সাথে এভাবে কথা বলতে কি আমার ভালো লাগছে, বাবা? আসলে কেউ কখনোই চায় নি–আসলে কারোরই বিশ্বাস করার সাহস ছিল না। এই কারণেই তোমার বর্তমান দুর্দশা। আমাদের দুজনের কাছে পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। শুধুমাত্র হ্যারি সেলডন বলেই তোমার উপর যখন আক্রমণ হয়, তখন তোমার কি মনে হয় না যে এখন সময় এসেছে বাস্তব মেনে নেয়ার?”

“বাস্তব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমি ট্রানটর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”

মাথা নাড়ল রাইখ। “আমি জানতাম তুমি রাজী হবে না, বাবা। মত পাল্টানোর জন্য দুমাস সময় আছে। একটু ভেবে দেখবে?”

.

১৫.

হ্যারি সেলডন হাসতে ভুলে গেছেন। গতানুগতিকভাবেই প্রজেক্টের কাজ করে চলেছেন : সাইকোহিস্টোরি সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা, ফাউণ্ডেশনের পরিকল্পনা করা, প্রাইম রেডিয়্যান্ট পর্যবেক্ষণ, সবই করছেন।

কিন্তু তিনি হাসেন না। যা করছেন তা হলো বিরামহীন কাজ, সাফল্যের প্রত্যাশা না করেই। বরং ব্যর্থতা মেনে নিয়েছেন।

এই মুহূর্তে যখন তিনি স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অফিসে বসে আছেন, ওয়ানডা এসে ঢুকল। তাকে দেখেই সেলডনের মন ভালো হয়ে গেল। ওয়ানডা সবসময়ই ছিল অন্যরকম। সেলডন মনে করতে পারেন না ঠিক কখন থেকে তিনি এবং অন্য সকলেই ওয়ানডার উপস্থিতিতে অস্বাভাবিক স্বস্তি বোধ করা শুরু করেন; সবসময়ই তাই হতো। অনেক ছোটবেলাতেই অস্বাভাবিক গুণ দ্বারা সেলডনের জীবন বাঁচায় সে এবং তার ছোটবেলাতেই কেমন করে সবাই যেন বুঝে ফেলে যে সে অন্যদের চেয়ে আলাদা।

যদিও ড, এন্ডলেকির মতে ওয়ানডার জেনোম পুরোপুরিই স্বাভাবিক, সেলডন নিশ্চিত যে তার নাতনীর মেন্টাল এ্যাবিলিটি আর সব মানুষদের চেয়ে অনেক গুণ বেশী। এবং তিনি এই বিষয়েও নিশ্চিত যে গ্যালাক্সিতে ওয়ানডার মতো আরো অনেকেই আছে–এমনকি ট্রানটরেও। যদি এই মেন্টালিকদের তিনি খুঁজে বের করতে পারতেন, ফাউণ্ডেশনে তাদের অবদান হতো অকল্পনীয়। আর সেই বিশাল সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হতো তার নাতনী। দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ানডার দিকে তাকালেন তিনি। বুকটা হাহাকার করে উঠল। আর কয়েকদিন পরেই সে চলে যাবে।

কেমন করে সহ্য করবেন? চমৎকার একটা মেয়ে–আঠার বছর বয়স। লম্বা সোনালী চুল, কিছুটা প্রশস্ত মুখ, মনে হয় যেন এখনই হেসে উঠবে। এই মুহূর্তে বাস্তবিকই হাসছে। স্বাভাবিক। সান্তানিতে নতুন এক জীবন শুরু করতে যাচ্ছে সে।

“তো, ওয়ানডা, আর মাত্র কয়েকটা দিন।” বললেন তিনি।

“না, দাদু, আমার তা মনে হয় না।”

অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন সেলডন। “কি?”

ওয়ানডা এগিয়ে এসে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরল। “আমি সান্তানি যাচ্ছি না।”

“তোমার বাবা মা সিদ্ধান্ত পাল্টেছে?”

“না, তারা যাচ্ছে।”

“কিন্তু তুমি যাচ্ছ না? কেন? তুমি কোথায় যাবে?”

“আমি এখানেই থাকছি। তোমার সাথে।” সেলডনকে জড়িয়ে ধরল সে।

“কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কেন? ওরা রাজী হবে?”

“মানে বাবা মা। সহজে রাজী হয় নি। পুরো সপ্তাহ ওদের সাথে তর্ক করেছি, শেষ পর্যন্ত আমিই জিতেছি। রাজী হবে না কেন, দাদু? ওরা দুজন দুজনের জন্য রয়েছে এবং বেলিসও ওদের সাথে থাকছে। কিন্তু আমি যদি তোমাকে এখানে ফেলে চলে যাই, তোমার সাথে কে থাকবে। আমি এটা সহ্য করতে পারব না।”

“ওদেরক রাজী করালে কিভাবে?”

“তুমি তো জানই জোর দিয়েছি।”

“মানে?”

“আমার মাইন্ড। তোমার এবং অন্যদের মাইন্ডে কি আছে আমি দেখতে পারি । সময় যতই গড়াচ্ছে দেখার ক্ষমতা আরো পরিষ্কার হচ্ছে। এবং আমি যা চাই তা করার জন্য জোর প্রয়োগ করতে পারি।”

“কিভাবে কর?”

“জানি না। কিছু সময় পরেই ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং আমার সিদ্ধান্তে রাজী হয়ে যায়। কাজেই আমি তোমার সাথে থাকছি।”

“চমৎকার, ওয়ানডা। কিন্তু বেলিস-”

“বেলিসকে নিয়ে চিন্তা করো না। ওর মাইন্ড আমার মতো না।”

“তুমি নিশ্চিত,” নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন সেলডন।

“পুরোপুরি। তাছাড়া বাবা মার সাথেও তো একজনকে থাকতে হবে।”

খুশিতে নেচে উঠতে ইচ্ছে হলো সেলডনের কিন্তু উল্লাসটা গোপন রাখলেন। তিনি। রাইখ এবং মানীলার কথাও ভাবতে হবে।

“ওয়ানডা, তোমার বাবা মার কি হবে? ওদের সাথে এত নিষ্ঠুর হতে পারবে তুমি?”

“আমি নিষ্ঠুর নই। ওরা মেনে নিয়েছে। বুঝতে পেরেছে যে আমাকে তোমার সাথেই থাকতে হবে।”

“কিভাবে ব্যবস্থা করলে?”

“জোর দিয়েছি, স্বাভাবিক সুরে ওয়ানডা বলল। “আর ওরা আমার মতো ভাবতে শুরু করে।”

“তুমি করতে পার?”

“সহজ না।”

“আর করেছ কারণ–“ বিরতি দিলেন সেলডন।

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবং কারণ–“

“হ্যাঁ?”

“আমি সাইকোহিস্টোরি শিখতে চাই। অনেক কিছু এরই মাঝে শিখেছি।”

“কিভাবে?”

“তোমার মাইন্ড থেকে। প্রজেক্টের অন্যদের মাইন্ড থেকে, বিশেষ করে আঙ্কল ইউগো। কিন্তু তার সবটাই এলোমেলো, ছাড়া ছাড়া। আমি পুরোটা শিখতে চাই, দাদু। আমি নিজের জন্য একটা প্রাইম রেডিয়্যান্ট চাই।” প্রচণ্ড উৎসাহে তার মুখ এবং চোখে অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। “সাইকোহিস্টোরি আমি বিস্তারিত জানতে চাই। তোমার বয়স হয়েছে এবং ক্লান্ত। আমি তরুণ এবং আগ্রহী। যতদূর পারি শিখতে চাই যেন কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পরি যখন–“

“বেশ, চমৎকার হবে–যদি শিখতে পার। কিন্তু কারো কাছ থেকেই আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। আমি যা জানি সবই তোমাকে শেখাব, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারব না।”

“দেখা যাবে, দাদু। দেখা যাবে।”

.

১৬.

রাইখ, মানীলা আর বেলিস অপেক্ষা করছে স্পেসপোর্টে।

উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে হাইপারশিপ। তাদের মালপত্র আগেই তোলা হয়েছে।

“বাবা, চল আমাদের সাথে।” রাইখ বলল।

মাথা নাড়লেন সেলডন। “পারব না।”

“যদি কখনো সিদ্ধান্ত পাল্টাও, মনে রেখ আমরা সবসময় তোমার জন্য একটা কামরা আলাদা করে রেখে দেব।”

“জানি রাইখ। চল্লিশটা বছর আমরা এক সাথে কাটিয়েছি সুখের দিন কেটেছে আমাদের। আমি আর ডর্স ভাগ্যবান বলেই তোমাকে পেয়েছিলাম।”

“ভাগ্যবান আসলে আমি।” রাইখের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। “মার কথা আমার সবসময় মনে পড়ে।”

অন্যদিকে তাকালেন সেলডন। বেলিসকে নিয়ে খেলছিল ওয়ানডা। এমন সময় যাত্রীদের হাইপার শিপে উঠার ঘোষণা দেয়া হলো।

চোখে পানি নিয়ে ওয়ানডাকে শেষবার আলিঙ্গন করে তার বাবা মা হাইপারশিপে উঠল। শেষ মুহূর্তে ঘুরে হাত নাড়ল রাইখ। চেষ্টা করল মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার।

সেলডনও হাত নাড়লেন আরেক হাতে ওয়ানডাকে জড়িয়ে ধরলেন।

তার একমাত্র বন্ধন। এই দীর্ঘ জীবনে যারা তার বন্ধু ছিল, যাদেরকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন তারা সবাই একে একে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ডেমারজেল চলে গেছে আর ফিরে আসে নি; সম্রাট ক্লীয়ন; প্রিয়তমা ডর্স; বিশ্বস্ত বন্ধু ইউগো এমারিল; আর একমাত্র সন্তান রাইখ।

বাকী থাকল শুধু ওয়ানডা।

.

১৭.

“বাইরে কি চমৎকার একটা সন্ধ্যা।” হ্যারি সেলডন বললেন। “যেহেতু গম্বুজের নিচে বাস করি, আমার মনে হয় প্রতিটা দিনই এমন চমৎকার হওয়া উচিত।”

“একঘেয়ে লাগবে, দাদু,” অভিব্যক্তিহীন সুরে জবাব দিল ওয়ানডা, “যদি সবসময় সুন্দর থাকে। প্রতিদিন খানিকটা পরিবর্তন আমাদের জন্য ভালো।”

“তোমার জন্য, ওয়ানডা, কারণ তোমার বয়স কম। তোমার সামনে অনেকগুলো সন্ধ্যা পড়ে আছে। আমার তা নেই। আমি এমন চমৎকার সন্ধ্যা আরো বেশী বেশী চাই।”

“শোন, দাদু, তুমি এখনো বুড়ো হও নি। তোমার পায়ের অবস্থা এখন যথেষ্ট ভালো আর তোমার মাই আগের মতোই তীক্ষ্ণ। আমি জানি।”

“নিশ্চয়ই। আরো বল। আমার মনটাকে ভালো করে দাও।” তারপর খানিকটা বিরক্ত সুরে বললেন, “আমি হাঁটতে চাই। এই ছোট ঘরের চার দেয়ালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হেঁটে লাইব্রেরীতে যেতে চাই। চমৎকার সন্ধ্যাটা উপভোগ করতে চাই।”

“লাইব্রেরীতে গিয়ে কি করবে?”

“কিছুই না। শুধু হাঁটতে চাই। কিন্তু–“

“কিন্তু কি?”

“রাইখকে কথা দিয়েছি যে বডিগার্ড ছাড়া ট্র্যানটরের রাস্তায় একা বের হব না।”

“রাইখ এখানে নেই।”

“জানি,” বিড়বিড় করে বললেন সেলডন। “কিন্তু কথা দিলে তা রাখতে হয়।”

“সে তো আর বলে নি কে হবে বডিগার্ড। তৈরি হয়ে নাও। আমিই তোমার বডিগার্ড।”

“তুমি?” দাঁত বের করে হাসলেন সেলডন।

“হ্যাঁ, আমি। তোমার সেবায় নিয়োজিত। তৈরি হয়ে নাও।”

ভীষণ খুশি হলেন সেলডন। তার মনের অর্ধেক অংশ বলছে ছড়ি বাদেই হাঁটতে যেতে। কারণ পায়ের ব্যথাটা এখন বলা যায় পুরোপুরিই সেরে গেছে। কিন্তু অন্য অংশ বলছে নতুন ছড়িটা নিয়ে বের হতে। এটার হাতলের ভেতর শিসা ঢোকাননা। ফলে নতুন ছড়িটা পুরনোটার চেয়ে অনেক বেশী মজবুত আর ভারী। যেহেতু ওয়ানডা সাথে থাকছে সেহেতু নতুন ছড়িটাই হাতে রাখা উচিত বলে মনে হলো তার।

সান্ধ্য ভ্রমণটা ভীষণ ভালো লাগছে সেলডনের, বিরক্তি দূর হয়ে যাওয়াতে বেশ খুশিও হলেন–অন্তত একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত।

ছড়ি উঁচু করে দেখালেন সেলডন। রাগ এবং অসহায়ত্ব মেশানো একরকম সুরে বললেন, “ওই দেখ।”

মাথা উঁচু করে উপরে তাকাল ওয়ানডা। গম্বুজে উজ্জ্বল রক্তিম আভা, প্রতিদিনের মতোই, গোধূলি বেলা বোঝানোর জন্য। যতই রাত বাড়ে রক্তিমাভা ক্রমশই গাঢ়তর হতে থাকে।

সেলডন যা দেখালেন তা হলো, গম্বুজের লম্বা একটা অংশ অন্ধকার। ওই অংশের লাইট নষ্ট হয়ে গেছে।

“আমি যখন প্রথম ট্র্যানটরে আসি তখন এই অবস্থা ছিল অকল্পনীয়। লাইটগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োজিত থাকত। পুরো শহরটাই কাজ করত আর এখন তা এইভাবে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার অবাক লাগে এটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ইম্পেরিয়াল প্যালেসে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে না কেন? কেন সবাই একজোট হয়ে প্রতিবাদ করছে না? মনে হয় যেন ট্রানটরের জনগণ এই শহরের ধ্বংস মেনেই নিয়েছে আর তাদের ক্ষোভ ঢালছে আমার উপর। কারণ আমিই তাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি।”

“দাদু, আমাদের পিছনে দুজন লোক।” মৃদু কণ্ঠে বলল ওয়ানডা।

গম্বুজের ভাঙ্গা লাইটগুলোর নিচের ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন দুজন। “ওরা কি শুধু । হাঁটছে?” জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“না।” ওয়ানডা ওদের দিকে তাকায় নি, প্রয়োজনও নেই। “ওরা তোমার পিছনে লেগেছে।”

“থামাতে পারবে–জোর দিতে পারবে?”

“চেষ্টা করছি। কিন্তু ওরা দুজন এবং বেশ আত্মবিশ্বাসী। কাজটা অনেকটা অনেকটা শক্ত নিরেট দেয়ালে ধাক্কা দেয়ার মতো।”

“কতদূরে আছে?”

“প্রায় তিন মিটার।”

“এগিয়ে আসছে?”

“হ্যাঁ।”

“এক মিটার দূরে থাকতে আমাকে বলবে।” ছড়িটাকে উল্টো করে ধরলেন সেলডন। ভারী অংশটা বাতাসে ঝুলিয়ে রেখে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

“এবার, দাদু!” হিসহিস করে ওয়ানডা বলল। ঘুরলেন সেলডন, ছড়িটাকে ঘুরিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানলেন পিছনের লোকটার কাঁধে। প্রচণ্ড চীৎকার করে পড়ে গেল সে, পেভম্যান্টের উপর ছটফট করছে।

“আরেকটা কই?” জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

“পালিয়েছে।”

আহত দুস্কৃতিকারীর বুকের উপর পা তুলে সেলডন বললেন, “ওর পকেটে দেখ, ওয়ানডা। কেউ না কেউ ওকে ভাড়া করেছে। যে করেছে তার ক্রেডিট ফাইল হয়তো পাওয়া যাবে পকেটে। হয়তো বুঝতে পারব কোত্থেকে আসছে।” তারপর চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, “আমি মাথায় মারতে চেয়েছিলাম।”

“লোকটাকে তাহলে খুন করে ফেলতে দাদু।”

“তাই-ই চেয়েছিলাম। কাজটা উচিত হতো না। ভাগ্য ভালো যে মিস করেছি।”

একটা কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল। “কি হচ্ছে এখানে?” ঘর্মাক্ত কলেবরে দৌড়ে এল ইউনিফর্ম পরিহিত সিকিউরিটি অফিসার। “ছড়িটা আমাকে দাও।”

“অফিসার,” মৃদু কণ্ঠে বললেন সেলডন।

“তোমার গল্প পরে শোনা যাবে। আগে এই অসহায় লোকটার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে।”

“অসহায়,” রেগে গেলেন সেলডন। “লোকটা আমাকে মারতে যাচ্ছিল। আমি শুধু আত্মরক্ষা করেছি।”

“আমি দেখেছি,” সিকিউরিটি অফিসার বলল। “এই লোকটা তোমার দিকে আঙ্গুলও তোলে নি। তুমি ঘুরেই আঘাত করেছ। এটা আত্মরক্ষা নয় বরং তুমিই লোকটাকে মেরে আহত করেছ।”

“অফিসার, আমি বলছি–“

“আমাকে কিছু বলার দরকার নেই। যা বলার আদালতে বলো।”

ওয়ানডা মিষ্টি সুরে বলল, “অফিসার, আমাদের কথাটা একটু কষ্ট করে শুনলে–”

“তুমি বাড়ি যাও, ইয়ং লেডী।”

“যাব না, অফিসার। দাদুকে যেখানে নিয়ে যাবেন আমিও সেখানে যাব।” তার। চোখ রাগে জ্বলে উঠল আর অফিসার বিড়বিড় করে বলল “চল তাহলে।”

.

১৮.

প্রচণ্ড রেগেছেন সেলডন। “জীবনে কখনো জেলে যেতে হয় নি আমাকে। কয়েক মাস আগে আটজন গুণ্ডা আমার উপর হামলা করে। আমার ছেলে না থাকলে সেদিন আর বেঁচে ফিরতে পারতাম না। কিন্তু তখন কোনো সিকিউরিটি অফিসার ছিল আশেপাশে? রাস্তায় আরো পথচারী ছিল তারা কি আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল? না। আর এবার আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। লোকটা যখন আমাকে মারতে আসে আমি তাকে প্রতিহত করি। তখন কোনো সিকিউরিটি অফিসার কাছাকাছি ছিল? অবশ্যই। কিন্তু মহিলা উল্টো আমাকেই অভিযুক্ত করে। আশে পাশে আরো অনেক পথচারী ছিল। তারা একজন বৃদ্ধ মানুষকে গুণ্ডামীর দায়ে গ্রেপ্তার হতে দেখে বেশ মজা পায়। কোন দুনিয়ায় বাস করছি আমরা?”

সিভ নোভকর, সেলডনের আইনজীবী, দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত কণ্ঠে বলল, “নীতিহীন দুনিয়ায়, কিন্তু চিন্তা করো না, তোমার কিছুই হবে না। আমি জামিনের ব্যবস্থা করে ফেলব। কিছুদিন পরে শুনানীর জন্য জুরিদের সামনে দাঁড়াতে হবে। তারা খুব বেশী হলে আবারো বলছি খুব বেশী হলে–দুই একটা কড়া কথা বলে তোমাকে ছেড়ে দেবে। তোমার বয়স এবং সুনাম–“

“সুনামের কথা ভুলে যাও,” বললেন সেলডন, রাগ কমে নি। “আমি একজন সাইকোহিস্টোরিয়ান এবং বর্তমানে এটা অত্যন্ত নোংরা একটা শব্দ। আমাকে জেলে ঢোকাতে পারলে ওরা খুশি হবে।”

“না, হবে না,” নোভকর বলল। “মাথা গরম দুএকজন আছে যারা তোমাকে পছন্দ করবে না। কিন্তু আমি চেষ্টা করব যেন ওদের কেউ জুরির সদস্য না হয়।”

“দাদুকে এত ঝামেলার মধ্যে ফেলার কোনো দরকার আছে?” ওয়ানডা জিজ্ঞেস করল। “উনি বৃদ্ধ মানুষ। সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যাওয়া যায় না?

“যদি তোমাদের মাথায় গোলমাল দেখা দেয় তাও করা যাবে। ম্যাজিস্ট্রেটরা সব ক্ষমতার দাপট দেখানেঅলা অধৈর্য মানুষ। কথা শোনার আগেই তারা মানুষকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো উচ্চবাচ্য করা যায় না।”

“আমার মনে হয় চেষ্টা করে দেখা উচিত।”

“ঠিক আছে, ওয়ানডা, আমার মনে হয় সিভের কথা শোনা উচিত।” সেলডন বললেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে উল্লসিত হলেন। বুঝতে পারছেন ওয়ানডা তার “জোর প্রয়োগ করছে। বললেন, “বেশ, সিভ–তুমি যখন বলছ।”

“এই কাজ আমি তোমাকে করতে দেব না,” আইনজীবী বলল।

“আমার দাদু আপনার মক্কেল। তিনি যেভাবে চান আপনাকে সেভাবেই করতে হবে।”

“আমি ইচ্ছে হলে তার কাজ ছেড়ে দিতে পারি।”

“তাহলে চলে যান,” ধারাল কণ্ঠে বলল ওয়ানডা। “ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমরা একাই যাব।”

কিছুক্ষণ চিন্তা করে নোকর বলল, “ঠিক আছে, তোমরা যখন এত করে চাইছ। দীর্ঘদিন হ্যারির কাজ করছি এখন তাকে ছেড়ে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি যে জেল নিশ্চিত এবং তা থেকে মুক্ত করার জন্য

আমাকে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করতে কবে–যদি সম্ভব হয়।”

“সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না,” ওয়ানডা বলল।

আইনজীবী সেলডনের দিকে ঘুরে বলল, “তুমি কি ভাবছ? ওয়ানডার সাথে একমত?”

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আইনজীবীকে অবাক করে সেলডন বললেন, “হ্যাঁ, আমি একমত।”

.

১৯.

বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে সেলডনের বক্তব্য শুনল ম্যাজিস্ট্রেট।

তারপর জিজ্ঞেস করল, “কিভাবে বুঝলেন, যে লোকটাকে আহত করেছেন সে আপনাকে মারার জন্যই এসেছিল? সে কি আপনার গায়ে হাত দিয়েছে? আপনাকে। হুমকি দিয়েছে? শারীরিক ক্ষতি করার ভয় দেখিয়েছে?”

“আমার নাতনী ওকে দেখেই বুঝতে পারে যে সে আমাকে মারতে আসছে।”

“নিশ্চয়ই, বুঝতে পারছেন, স্যার, প্রমাণ হিসেবে এইটুকু যথেষ্ট নয়। রায় দেয়ার আগে আপনার আর কিছু বলার আছে?”

“একটু সময় দিন,” অধৈর্য হয়ে বললেন সেলডন। “এত দ্রুত রায় দেবেন না। কয়েক মাস আগে আটজন দুস্কৃতিকারী আমার উপর হামলা করে। আমার ছেলের সাহায্যে তখন ওদের হাত থেকে বেঁচে যাই। কাজেই বুঝতে পারছেন যে আবারো হামলার স্বীকার হতে পারি এমন ভয় পাওয়ার পিছনে কারণ আছে।”

ম্যাজিস্ট্রেট সামনের কাগজগুলো শাফল করল। “আটজন হামলা করেছিল? আপনি রিপোের্ট করেছিলেন?”

“কাছাকাছি কোনো সিকিউরিটি অফিসার ছিল না। একজনও না।”

“পরে রিপোর্ট করেছিলেন?”

“না, স্যার।”

“কেন?”

“প্রথম কারণ, দীর্ঘস্থায়ী আইনী প্রক্রিয়ায় যেতে চাই নি। যেহেতু আটটা গুণ্ডাকে আমরা তাড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম এবং নিজেরাও নিরাপদ ছিলাম, তখন আর অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে চাই নি।”

“আটজন গুণ্ডার মোকাবিলা কিভাবে করলেন আপনি আপনি আর আপনার ছেলে।”

ইতস্তত করলেন সেলডন, “আমার ছেলে এখন সান্তানিতে এবং ট্রানটরিয়ান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওর কাছে ডাহুলাইট ছুরি ছিল এবং সে ওগুলো ব্যবহারে ভীষণ দক্ষ। একজন গুণ্ডাকে সে খুন করে, দুজনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। বাকীরা মৃত এবং আহত সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যায়।”

“কিন্তু একটা খুন এবং দুজনকে আহত করার ঘটনা আপনি রিপোর্ট করেন নি?”

“না, স্যার। কারণটা আগেই বলেছি। আর আমরা যা করেছি তার পুরোটাই আত্মরক্ষা। যদি মৃত এবং আহত তিনজনের খোঁজ নেন তাহলে আপনি প্রমাণ পাবেন যে আমাদের উপর হামলা করা হয়েছিল।”

“একজন মৃত এবং দুজন আহত নামহীন, পরিচয়হীন ট্র্যানটরিয়ানের খোঁজ নেব? আপনি কি জানেন যে প্রতিদিন ট্র্যানটরে কমপক্ষে দুহাজার মানুষ খুন হচ্ছে শুধু ছুরির আঘাতে। যদি এই ঘটনাগুলো রিপোর্ট না করা হয় তাহলে আমরা অসহায়। আগেও একবার হামলা হয়েছে আপনার এই গল্পে কাজ হবে না। সুতরাং আজকের ঘটনাটাই বিবেচনা করতে হবে, যা রিপোর্ট করা হয়েছে এবং তার সাক্ষী একজন সিকিউরিটি অফিসার।

“সুতরাং আরেকবার প্রথম থেকে শুরু করা যাক। কেন ভেবেছিলেন যে লোকটা আপনাকে আঘাত করবে? শুধুমাত্র এই কারণে যে আপনি রাস্তায় হাঁটছিলেন? কারণ আপনি বৃদ্ধ এবং অসহায়? কারণ আপনার কাছে অনেক ক্রেডিট ছিল? কেন?”

“সম্ভবত, ম্যাজিস্ট্রেট, কারণটা আমার পরিচিতি।”

হাতে ধরা কাগজটা দেখল ম্যাজিস্ট্রেট। “আপনি হ্যারি সেলডন, প্রফেসর এবং গবেষক। শুধু এই কারণেই আপনার উপর হামলা হবে কেন?”

“কারণ আমার বিশ্বাস, মতবাদ।”

“আপনার বিশ্বাস।” আরো কয়েকটা কাগজ নেড়ে চেড়ে দেখল ম্যাজিস্ট্রেট। হঠাৎ থেমে তীক্ষ্ণ চোখে সেলডনের দিকে তাকাল। “দাঁড়ান–হ্যারি সেলডন। আপনি সেই সাইকোহিস্টোরিয়ান, তাই না?”

“হ্যাঁ, ম্যাজিস্ট্রেট।”

“দুঃখিত। আমি এই বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। শুধু জানি যে এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বা এমনই কিছু একটা প্রচার করছেন।”

“ঠিক এইভাবে বলি নি কিন্তু আমার মতবাদ মানুষকে খেপিয়ে তুলছে কারণ দিনে দিনে তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। তাই আমার ধারণা যে অনেকেই আমাকে খুন করতে চায়। অনেকেই ভাড়াটে খুনি লাগিয়েছে আমার পেছনে।”

সিকিউরিটি অফিসারকে ডাকল ম্যাজিস্ট্রেট। “আহত লোকটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছ? তার পুরনো রেকর্ড আছে?”

“জ্বী, স্যার। ছিনতাই রাহাজানির জন্য সে অনেকবার গ্রেপ্তার হয়েছে।”

“অর্থাৎ দাগী আসামী, তাই না? আর প্রফেসরের কোনো পুরনো রেকর্ড আছে?”

“না, স্যার।”

“অর্থাৎ বৃদ্ধ এবং নির্দোষ একজন মানুষ পরিচিত এক দুস্কৃতিকারীর হাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে আর তুমি নির্দোষ মানুষটাকেই গ্রেপ্তার করেছ, তাই না?”

সিকিউরিটি অফিসার জবাব দিল না। “আপনি যেতে পারেন প্রফেসর।”

“ধন্যবাদ, স্যার। আমার ছড়িটা ফেরত পাব?”

ম্যাজিস্ট্রেট আঙ্গুল তুলে আদেশ করতেই সিকিউরিটি অফিসার ছড়িটা সেলডনকে ফিরিয়ে দিল।

“কিন্তু একটা কথা, প্রফেসর,” ম্যাজিস্ট্রেট বলল, “ছড়িটা যদি আবার ব্যবহার করেন, তাহলে লক্ষ্য রাখবেন যেন প্রমাণ করতে পারেন যে তা ছিল আত্মরক্ষা। অন্যথায়–“

“জ্বী, স্যার,” জবাব দিলেন সেলডন। তারপর ছড়ির উপর ভর দিয়ে কিন্তু মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এলেন ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে।

.

২০.

কেঁদে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে ওয়ানডা। পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সেলডন।

“দাদু, আমি ব্যর্থ, কিছুই করতে পারি না। মনে করেছিলাম মানুষের উপর জোর প্রয়োগ করতে পারব–পারি যদি তারা কিছু মনে না করে, যেমন বাবা, মা–কিন্তু তাতেও অনেক সময় লাগে। আমি দশ মাত্রার একটা রেটিং সিস্টেমও তৈরি করেছি। অনেকটা মেন্টাল পুশিং পাওয়ার গেজ এর মতো। বোধহয় একটু বেশীই অনুমান করে ফেলেছিলাম। মনে হয়েছিল যে আমার মাত্রা দশ বা অন্তত নয়। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে তা সাত এর বেশী নয়।”

ওয়ানডার কান্না থামলেও মাঝে মাঝে ফোঁপাচ্ছে। তার হাতে আলতো পরশ বোলাচ্ছেন সেলডন। সাধারণত:–সাধারণত:–কোনো সমস্যা হয় না, যদি একটু মনযোগ দেই তাহলে মানুষের চিন্তা শুনতে পারি এবং চাইলে তাদেরকে ইচ্ছেমতো চালাতে পারি। কিন্তু ওই গুণ্ডাগুলো ওদের মনের চিন্তা আমি বুঝতে পারি ঠিকই কিন্তু জোর খাঁটিয়ে তাড়াতে পারি নি।”

“তুমি যথেষ্ট করেছ, ওয়ানডা।”

“কিছুই করি নি। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ তোমার ক্ষতি করতে আসলে আমি প্রচণ্ড জোর প্রয়োগ করে তাদেরকে তাড়িয়ে দেব। এভাবেই তোমাকে আমি রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। তোমার বডিগার্ড হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারি নি। ওই দুই গুণ্ডাকে থামানোর জন্য কিছু করতে পারি নি।”

“করেছ। প্রথম লোকটাকে তুমি দ্বিধাগ্রস্ত করে দাও আর তাই আমি ঘুরে আঘাত করার যথেষ্ট সময় পাই।”

“না, না। এখানে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। আমি শুধু তোমাকে সতর্ক করে দেই। বাকীটা তুমি করেছ।”

“দ্বিতীয় লোকটা পালিয়ে যায়।”

“কারণ প্রথম জনকে তুমি আহত করে মাটিতে শুইয়ে দাও। এখানেও আমার কোনো কৃতিত্ব নেই।” আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে। “তারপর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাওয়ার পরামর্শ ছিল আমার। ভেবেছিলাম আমি একটু জোর প্রয়োগ করলেই সে তোমাকে সাথে সাথে ছেড়ে দেবে।”

“আমাকে ছেড়ে দেয় সে এবং বলা যায় সাথে সাথেই।”

“না, ধরাবাধা অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করে তোমাকে। শুধুমাত্র তোমার পরিচয় পাওয়ার পরেই সে মূল সত্যটা বুঝতে পারে। সবক্ষেত্রেই আমি ব্যর্থ। তোমার আরো বড় বিপদ হতে পারত।”

“আমি মানতে পারলাম না, ওয়ানডা। তোমার জোর কাজ করে নি তার কারণ তোমাকে জরুরী অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। ওয়ানডা, আমি একটা বুদ্ধি করেছি।”

তার কণ্ঠের উত্তেজনা লক্ষ্য করে মুখ তুলল ওয়ানডা। “কি বুদ্ধি, দাদু?”

“তুমি হয়তো জান যে আমার প্রচুর ক্রেডিট প্রয়োজন। এছাড়া সাইকোহিস্টোরি আর এগোতে পারবে না আর আমিও মেনে নিতে পারব না যে এতগুলো বছরের কঠিন পরিশ্রম সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।”

“আমিও মানতে পারব না। কিন্তু ক্রেডিটের ব্যবস্থা হবে কিভাবে?”

“আমি সম্রাটের সাথে আরেকবার দেখা করার অনুমতি চাইব। আগেও দেখা করেছি। ভালো মানুষ, আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু তার কাছেও আমাকে সাহায্য করার মতো ক্রেডিট নেই। যাই হোক, তুমি যদি সম্রাটের উপর তোমার জোর প্রয়োগ কর–মোলায়েমভাবে–সে হয়তো আমাকে ক্রেডিট সংগ্রহের অন্য কোনো উৎসের কথা বলতে পারবে। তখন নতুন কোনো পথ না পাওয়া পর্যন্ত কিছুদিন কাজ চালিয়ে নিতে পারব।”

“তোমার কি মনে হয় এভাবে কাজ হবে?”

“তোমাকে ছাড়া হবে না। কিন্তু তুমি সাথে থাকলে হতেও পারে। চেষ্টা করতে দোষ কি?”

হাসি ফুটল ওয়ানডার মুখে। “তোমার জন্য আমি সব করতে পারি, দাদু। তাছাড়া এটাই আমাদের শেষ আশা।”

.

২১.

সম্রাটের সাথে দেখা করাটা খুব একটা কঠিন হলো না। চোখে হাসির দ্যুতি নিয়ে সেলডনকে অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। “কি খবর, বন্ধু। আমার জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছ?”

“মনে হয় না,” জবাব দিলেন সেলডন।

বিশাল আলখাল্লা খুলে ক্লান্ত ভঙ্গীতে ছুঁড়ে ফেললেন ঘরের এক কোণে। বললেন, “মিথ্যে কথা।”

সেলডনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। “এই জিনিসটা আমি ঘৃণা করি। এটা পাপের মতো ভারী, আগুনের মতো উত্তপ্ত। অপ্রয়োজনীয় সব কারণে এই পোশাক আমাকে পরতে হয়। ভয়ংকর। ক্লীয়ন এই পোশাক পরিধানের যোগ্যতা নিয়েই জন্মেছিল, তার সেই ব্যক্তিত্বও ছিল। আমার নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমি তার মায়ের দিকের কাজিন আর তাই সম্রাট হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি। অতি সামান্য মূল্য পেলেই এই পদ আমি বিক্রী করে দেব। তুমি স্মাট হতে চাও, হ্যারি?”

“না। স্বপ্নেও আমি এই কথা ভাবি না, কাজেই আপনিও বেশী আশা করবেন না,” হাসতে হাসতে জবাব দিলেন সেলডন।

“তোমার সাথে এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি কে?”

লজ্জা পেল ওয়ানডা। সম্রাট আরো সৌজন্যের সাথে বললেন, “তোমাকে বিব্রত করার সুযোগ আমাকে দেয়া উচিত না, মাই ডিয়ার। সম্রাটের ক্ষমতাগুলোর একটা হচ্ছে যা খুশি তাই বলা। কেউ প্রতিবাদ বা তর্ক করবে না। শুধু বলবে, “জ্বী, সায়ার। যাই হোক তোমার কাছ থেকে আমি সায়ার’ শুনতে চাই না। এই শব্দটা আমি ঘৃণা করি। শুধু এজিস বলবে। যদিও এটা আমার আসল নাম নয়। আমার ইম্পেরিয়াল নাম এবং এই নামে আমাকে অভ্যস্ত হতে হবে। তো… কেমন চলছে, হ্যারি। শেষবার দেখা হওয়ার পর কি কি ঘটেছে?”

“আমার উপর দুবার হামলা হয়েছে।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন হ্যারি। রসিকতা কিনা বুঝতে পারলেন না সম্রাট। “দুবার? তাই নাকি?”

সেলডনের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেলেন সম্রাট। “আটজন গুপ্তা যখন তোমাকে হামলা করে নিশ্চয়ই আশে পাশে কোনো সিকিউরিটি অফিসার ছিল না।”

“একজনও না।”

উঠে দাঁড়ালেন সম্রাট কিন্তু বাকী দুজনকে বসে থাকার ইশারা করলেন। পায়চারী শুরু করলেন, যেন রাগ কমানোর চেষ্টা করছেন। তারপর সেলডনের মুখোমুখী দাঁড়ালেন।

“হাজার হাজার বছর ধরে,” শুরু করলেন তিনি, “এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে মানুষ শোরগোল তুলত, সম্রাটের কাছে অভিযোগ করা হচ্ছে না কেন? অথবা, ‘সম্রাট কিছু করছেন না কেন? ফলশ্রুতিতে সম্রাট কিছু একটা প্রতিকার করতে পারতেন এবং করতেনও, যদিও সবসময় তা বুদ্ধিমানের মতো হতো না। কিন্তু আমি… হ্যারি, আমি ক্ষমতাহীন। পুরোপুরি ক্ষমতাহীন।

“ও হ্যাঁ, তথাকথিত কমিশন অব পাবলিক সেফটি রয়েছে, তারা জনগণের নিরাপত্তার চেয়ে আমার নিরাপত্তা নিয়েই বেশী উদ্বিগ্ন। আমাদের যে আজকে দেখা হয়েছে সেটা অবাক করার মতো বিষয়, কারণ কমিশনের কাছে তুমি মোটেও জনপ্রিয় নও।

“আমি আসলে কিছুই করতে পারি না। তুমি জান সম্রাটের মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জান্তার পতনের পর–হাহ? ইম্পেরিয়াল পাওয়ার?”

“বোধহয়।”

“বাজী ধরে বলতে পারি তুমি জান না–পুরোটা। এখন আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি। গণতন্ত্র কি তুমি জান?”

“নিশ্চয়ই।”

ভুরু কুঁচকালেন এজিস। “বাজী ধরে বলতে পারি তুমি বিশ্বাস কর এটা ভালো পদ্ধতি।”

“আমি বিশ্বাস করি পদ্ধতিটা ভালো হতে পারে।”

“বেশ, এখানেই তোমার ধারণা ভুল। মোটেই ভালো পদ্ধতি নয়। বরং এম্পায়ারকে আরো বিপর্যস্ত করে তুলছে।

“মনে করো, আমি ট্র্যানটরের রাস্তায় আরো সিকিউরিটি অফিসার নিয়োগ করার আদেশ দিতে চাই। আগের দিনে, ইম্পেরিয়াল সেক্রেটারীর তৈরি করে দেয়া এক টুকরো কাগজে সই করে দিলেই হতো–আমার আদেশ বাস্তবায়িত হতো তৎক্ষণাৎ।

“এখন আমি সেরকম কিছু করতে পারি না। বিষয়টা আমার পরিষদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। সাড়ে সাত হাজার নারী পুরুষ তৎক্ষণাৎ সীমাহীন আলোচনায় বসবে। প্রথমত: ফাণ্ড আসবে কোত্থেকে। দশ হাজার নতুন সিকিউরিটি অফিসারের জন্য তোমাকে অন্তত দশ হাজার ক্রেডিট বেতন বাড়াতে হবে। নিয়োগের ব্যাপারে সবাই একমত হলেও সমস্যা থেকে যায়। কে নতুন অফিসারদের বাছাই করবে? কে তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে?

“পরিষদের সদস্যরা আলোচনা করবে, তর্ক করবে, একে অপরকে দোষারোপ করবে, উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না। এমনকি গম্বুজের ভাঙ্গা লাইট মেরামত করার মতো সামান্য একটা কাজও আমি করতে পারি না। কত খরচ হবে? কে দায়িত্ব নেবে? লাইটগুলো মেরামত হবে ঠিকই, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই পেরিয়ে যাবে কয়েক মাস। এই হলো গণতন্ত্র।”

“আমার মনে আছে সম্রাট ক্লীয়নও অভিযোগ করে বলতেন যে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারেন না।”

“সম্রাট ক্লীয়ন,” অধৈর্য সুরে বললেন এজিস, “অত্যন্ত বুদ্ধিমান দুজন ফাস্ট মিনিস্টার পেয়েছিলেন–ডেমারজেল এবং তুমি–তোমরা দুজন ক্লীয়নকে বোকার মতো কোনো কাজ করতে দাও নি। আমার সাড়ে সাত হাজার ফার্স্ট মিনিস্টার। তাদের প্রত্যেকেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত বোকা। কিন্তু, হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই হামলার ব্যাপারে আমার কাছে অভিযোগ করতে আস নি।”

“না। বরং আরো খারাপ বিষয় নিয়ে এসেছি। সায়ার–এজিস–আমার ক্রেডিট প্রয়োজন।”

সম্রাট স্থির দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। “এত কিছু বলার পরেও, হ্যারি? আমার কাছে ক্রেডিট নেই। ও হ্যাঁ, এই এস্টাবলিশম্যান্ট চালানোর জন্য কিছু ক্রেডিট আছে। কিন্তু তা পেতে হলে পরিষদের সাড়ে সাত হাজার সদস্যের প্রত্যেকের কাছে ধর্না দিতে হবে। তুমি যদি ভেবে থাক যে ওদেরকে গিয়ে বললাম, ‘আমার বন্ধু হ্যারি সেলডনের জন্য কিছু ক্রেডিট চাই,’ এবং সাথে সাথে তা পেয়ে যাব, তাহলে তোমার মাথায় দোষ আছে, কোনোদিনই হবে না।”

অসহায় ভঙ্গীতে কাঁধ নেড়ে নরম সুরে বললেন, “আমাকে ভুল বুঝো না, হ্যারি। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। তোমার নাতনীর খাতিরে যত ক্রেডিট প্রয়োজন তার সবটাই দিতাম–কিন্তু আমি নিরুপায়।

“এজিস, ফাণ্ড না পেলে সাইকোহিস্টোরি শেষ হয়ে যাবে–প্রায় চল্লিশ বছর পরিশ্রমের পর।”

“চল্লিশ বছরে কোনো ফল পাও নি। তাহলে ভাবছ কেন?”

“এখন আর থামার উপায় নেই, এজিস। আমার উপর হামলার মূল কারণ আমি সাইকোহিস্টোরিয়ান। মানুষ আমাকে মনে করে ধ্বংসের বার্তাবাহক।”

“তুমি আসলেই অপয়া, র‍্যাভেন সেলডন। আগেই বলেছি।”

“কোনো উপায় নেই তাহলে?” নিরাশ সেলডন উঠে দাঁড়ালেন। ওয়ানডা দাঁড়িয়ে আছে পাশে। লম্বায় সে পিতামহের কাঁধ বরাবর। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে।

ফিরে যাওয়ার জন্য সেলডন ঘুরলেন, সম্রাট বললেন, “দাঁড়াও। দাঁড়াও। অনেকদিন আগে একটা কবিতা পড়েছিলাম :

“যখন অশুভে ছেয়ে যায় মাটি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় শিকার যেখানে গড়ে উঠে সম্পদের পাহাড় আর ক্ষয়ে যায় মনুষ্যত্ব।”

“অর্থ কি?” হতাশ সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।

“অর্থাৎ অব্যহত গতিতে ভেঙ্গে পড়ছে এম্পায়ার, কিন্তু তাতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের ধনী হওয়া থেমে থাকে নি। সম্পদশালী ব্যবসায়ীদের কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়? ওদের কোনো পরিষদ নেই। ইচ্ছে করলেই তোমাকে

একটা ক্রেডিট ভাউচার সই করে দিতে পারবে।”

“চেষ্টা করে দেখব।” সেলডন বললেন।

.

২২.

“মি. বিনড্রিস,” হ্যাঁণ্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন সেলডন। “সময় দেয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

“কেন নয়?” উৎফুল্ল স্বরে বলল টেরেপ বিনড্রিস। “আপনাকে আমি চিনি। অথবা বলা ভালো যে আপনার কথা জানি।”

“আমার সৌভাগ্য। তাহলে ধরে নিচ্ছি আপনি সাইকোহিস্টোরির কথাও জানেন?”

“নিশ্চয়ই। শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জানে। যদিও আমি কিছুই বুঝি না। আপনার সাথে এই ভদ্রমহিলাটি কে?”

“আমার নাতনী, ওয়ানডা।”

“আকর্ষণীয় তরুণী, কেন যেন মনে হচ্ছে এই সুশ্রী মহিলার কাছে আমি নরম কাদার মতো।”

“আপনি আসলে বাড়িয়ে বলছেন, স্যার।” ওয়ানডা বলল।

“না, সত্যি বলছি। বসুন দয়া করে। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য।” হাত ছড়িয়ে কারুকার্যময় বিশাল দুটো চেয়ার দেখাল সে। তার অলংকৃত ডেস্ক, চেয়ার, তীক্ষ্ণ বাকওয়ালা স্লাইডিং ডোর, যা ঢোকার সময় নিঃশব্দে খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়, বিশাল অফিসের কালো চকচকে মেঝে, সবকিছুই সেরা মানের। কিন্তু যদিও প্রতিটি বস্তুই আকর্ষণীয় এবং সীমাহীন প্রাচুর্যে ভরপুর–বিনড্রিস নিজে কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। প্রথম দর্শনে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে বিনয়ে বিগলিত এই ছোটখাটো মানুষটাই ট্রানটরের সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তি।

“সম্রাটের পরামর্শে আপনার কাছে এসেছি, স্যার।”

“সম্রাট?”

“তিনি আমাদের সাহায্য করতে পারছেন না, কিন্তু আশা করছেন যে আপনার মতো একজন ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন। বিষয়টা অবশ্যই ক্রেডিট। বিনড্রিসের মুখের হাসি দপ করে নিভে গেল। “ক্রেডিটঃ বুঝতে পারছি না।”

“প্রায় চল্লিশ বছর সাইকোহিস্টোরি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। কিন্তু সময় পাল্টে গেছে এবং এম্পায়ারও আগের অবস্থায় নেই।”

“আমি জানি।”

“আমাদের সমর্থন করার মতো ক্রেডিট সম্রাটের কাছে নেই, থাকলেও পরিষদকে ডিঙিয়ে তিনি সেটা আমাদের দিতে পারছেন না। তাই পরামর্শ দিয়েছেন আমরা যেন নামকরা ব্যবসায়ীদের সাথে দেখা করি। প্রথম কারণ, ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর ক্রেডিট আছে। দ্বিতীয় কারণ, তারা চাইলেই আমাকে ক্রেডিট ভাউচার লিখে দিতে পারে।”

দীর্ঘ নীরবতার পর বিনদ্রিস বলল, “বলতে বাধ্য হচ্ছি, সম্রাট ব্যবসায়ের কিছুই বোঝেন না।–আপনার কত ক্রেডিট প্রয়োজন?”

“মি. বিনদ্রিস, কাজটা সুবিশাল। আমার মিলিয়ন মিলিয়ন ক্রেডিট দরকার।”

“মিলিয়ন, মিলিয়ন!”

“জ্বী, স্যার।”

ভুরু কোঁচকালো বিনড্রিস। “আপনি ধার চাইছেন? কতদিনে ফেরত দিতে পারবেন?”

“সত্যি কথা বলতে কি. মি. বিনদ্রিস, মনে হয় না কোনোদিন ফেরত দিতে পারব। আমি আসলে অনুদান চাইছি।”

“আমি আপনাকে ক্রেডিট দিতে চাইলেও–এবং স্বীকার করছি যে কোনো এক অদ্ভুত কারণে আপনাকে সাহায্য করতে আমি ভীষণ আগ্রহী কিন্তু আমি নিরুপায়। সম্রাটের রয়েছে পরিষদ আর আমার আছে বোর্ড মেম্বার। বোর্ডের অনুমতি ছাড়া এত বড় অনুদান আমি করতে পারব না এবং তারা রাজীও হবে না।”

“কেন? আপনার ফার্ম অসম্ভব সম্পদশালী। সামান্য কয়েক মিলিয়ন আপনার কাছে কিছুই না।”

“শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু ফার্মের অবস্থা এখন ভালো না। ভয়ানক না হলেও আমাদের দুঃশ্চিন্তায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। এম্পায়ার যেহেতু ভেঙ্গে যাচ্ছে সেহেতু এর কোনো অংশই ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। কয়েক মিলিয়ন ক্রেডিট উপহার দেয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। আমি দুঃখিত।”

চুপ করে বসে রইলেন সেলডন আর বিনদ্রিসকে মনে হলো বিরক্ত। মাথা নেড়ে সে বলল, “দেখুন, প্রফেসর সেলডন, আমি সত্যি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। বিশেষ করে এই তরুণীর খাতিরে। কিন্তু আমার সামর্থ নেই। যাই হোক, ট্র্যানটরে আমরাই একমাত্র ফার্ম নই। অন্যদের কাছে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ভাগ্যে লেগেও যেতে পারে।”

“বেশ,” অসম্ভব পরিশ্রম করে উঠে দাঁড়ালেন সেলডন, “চেষ্টা করে দেখব।”

.

২৩.

ওয়ানডা কাঁদছে, দুঃখে নয়, রাগে।

“আমি বুঝতে পারছি না, দাদু। কিছুতেই বুঝতে পারছি না। চারটা ফার্মে গেলাম। একটার চেয়ে আরেকটা বেশী দুর্ব্যবহার করেছে। চতুর্থ ফার্ম তো আমাদের প্রায় গলা ধাক্কা দিয়েই বের করে দিল। তারপর আর কোনোটাতেই ঢুকতে পারি নি।”

“এখানে কোনো রহস্য নেই, ওয়ানডা। আসল উদ্দেশ্য জানার আগমুহূর্ত পর্যন্ত বিনদ্রিস আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। ক্রেডিটের কথা তুলতেই তার আচরণ পাল্টে যায়। সম্ভবত আমাদের উদ্যেশ্যের কথা সবাই জেনে ফেলেছে। তাই আর কেউ দেখা করতে চাইছে না। কেন করবে? ক্রেডিট তারা আমাদেরকে দেবে না, কাজেই সময় নষ্ট করবে কেন?”

ওয়ানডার রাগ এবার নিজের উপর এসে পড়ল। “আর আমি কি করেছি। বসে থাকা ছাড়া।”

“মানতে পারলাম না। বিনড্রিস তোমার দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমার মনে হয়েছিল সে ক্রেডিট দিয়ে দেবে, প্রধান কারণ তুমি। তুমি জোর প্রয়োগ করছিলে এবং কিছু একটা হচ্ছিল।”

“যথেষ্ট নয়। তাছাড়া আমি আকর্ষণীয় শুধু এই কথাটাই ভাবছিল সে।”

“শুধু আকর্ষণীয় নও,” বিড় বিড় করে বললেন সেলডন, “সুন্দর। ভীষণ সুন্দর।”

“এখন কি হবে, দাদু? এতগুলো বছরের সাধনার পর সাইকোহিস্টোরি শেষ হয়ে যাবে।”

“সেরকমই মনে হচ্ছে। চল্লিশ বছর ধরে আমি প্রচার করছি যে এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে। এখন আসলেই ভাঙছে সেই সাথে সাইকোহিস্টোরি।”

“কিন্তু সাইকোহিস্টোরিই এম্পায়ার রক্ষা করবে। অন্তত আংশিক।”

“আমি জানি করবে, কিন্তু এগোনোর পথ পাচ্ছি না।”

“তুমি এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যেতে দেবে?” মাথা নাড়লেন সেলডন। “আমি বাঁচানোর চেষ্টা করব কিন্তু স্বীকার করছি যে জানি না কিভাবে তা হবে।”

“আমাকে আরো অনুশীলন করতে হবে,” ওয়ানডা বলল। “আমার জোর আরো শক্তিশালী করে তোলার কোনো উপায় নিশ্চয় আছে, মানুষকে নিজের ইচ্ছেমতো চালানোর কাজটা সহজ করার জন্য।”

“আশা করি তুমি পারবে।”

“তুমি কি করবে, দাদু?”

“কয়েকদিন আগে গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে তিনজন তরুণের সাথে আমার দেখা হয়। ওরা সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কথা বলছিল। কেন জানি না তাদের একজন আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছে। আজ বিকেলে সে দেখা করতে রাজী হয়েছে। আমার অফিসে।”

“তুমি ওকে প্রজেক্টে কাজ করতে বলবে?”

“ইচ্ছা ছিল–যদি বেতন দেয়ার মতো ক্রেডিট আমার কাছে থাকত। কিন্তু কথা বলতে দোষ কি। অন্তত আমার তো হারানোর কিছু নেই।”

.

২৪.

ঠিক চার টি. এস. টিতে (ট্র্যানটরিয়ান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম) তরুণ হাজির হলো। সেলডন খুশি হলেন। সময়ের মূল্য দেয় যেসব মানুষ তাদেরকে তিনি পছন্দ করেন। ডেস্কে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হতেই তরুণ বলল, “প্লীজ, প্রফেসর, আপনার পায়ের অবস্থা ভালো নয়। দাঁড়াতে হবে না।”

“ধন্যবাদ, ইয়ং ম্যান। যাই হোক, তার মানে এই না যে তুমি বসতে পারবে না। বসো।”

তরুণ তার জ্যাকেট খুলে বসল। সেলডন বললেন, “প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সেদিন তোমার নাম জানা হয় নি…”

“স্ট্যাটিন পালভার।”

“আহ্। পালভার! পালভার। পরিচিত মনে হচ্ছে।”

“হওয়া উচিত। আমার দাদা আপনাকে চিনতেন এবং এটা নিয়ে সবসময় গর্ব। করতেন তিনি।”

“তোমার দাদা। তার মানে জোরামিস পালভার। সম্ভবত আমার চেয়ে দুবছরের ছোট ছিল। সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে তাকে নেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে রাজী হয় নি। বলত যে এই প্রজেক্টে কাজ করার মতো যথেষ্ট গণিত সে কোনোদিনই আয়ত্ব করতে পারবে না। কেমন আছে সে?”

“বুড়ো মানুষদের যে পথে যেতে হয় জোরামিসও সেই পথে চলে গেছে। মারা গেছে।” গম্ভীর ভঙ্গীতে জবাব দিল পালভার।

দুঃখ পেলেন সেলডন। তার চেয়ে দুবছরের ছোট কিন্তু মারা গেছে। পুরনো বন্ধু অথচ যোগাযোগ এমনভাবে ছিন্ন হয়ে যায় যে মৃত্যু সংবাদটাও পান নি। বিড়বিড় করে বললেন, “আমি দুঃখিত।”

“জীবনটা তিনি উপভোগ করেছেন।” কাঁধ নেড়ে জবাব দিল তরুণ।

“আর তুমি, ইয়ং ম্যান, কোথায় পড়ালেখা করেছ?”

“ল্যাঙ্গানো বিশ্ববিদ্যালয়।”

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। “ল্যাঙ্গানো? ট্র্যানটরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নয় এটা, তাই না?”

“না। আমি অন্য কোনো বিশ্বে যেতে চেয়েছিলাম। আপনি ভালো করেই জানেন যে ট্রানটরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিড় অনেক বেশী। এমন কোথাও যেতে চেয়েছি যেখানে নিরিবিলিতে পড়ালেখা করতে পারব।”

“কোন বিষয় নিয়ে পড়েছ?”

“তেমন কিছু না। ইতিহাস। এমন কোনো ভালো ফলাফলও করি নি যাতে সম্মানজনক একটা কাজ পাওয়া যায়।”

(এবার আগের চেয়ে বেশী দুঃখ পেলেন সেলডন, কারণ ডর্স ভেনাবিলি ছিল ইতিহাসবিদ।)।

“কিন্তু ট্রানটরে ফিরে এসেছ কেন?”

“ক্রেডিট। চাকরী।”

“ইতিহাসবিদের চাকরী?”

হাসল পালভার। “মাথা খারাপ। ভারী বস্তু উঠানো নামানোর একটা যন্ত্র চালাই। তেমন উঁচুদরের কোনো কাজ নয়।”

কিছুটা ঈর্ষা নিয়ে পালভারের দিকে তাকালেন সেলডন। শার্টের উপর দিয়েই তার প্রশস্ত বুক এবং সবল বাহুর অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। পেশীবহুল। সেলডন কখনোই এত পেশীবহুল ছিলেন না।

“তুমি বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্সিং টীমে ছিলে।”

“কে, আমি? কখনোই না। আমি একজন ট্যুইস্টার।”

“ট্যুইস্টার!” উচ্ছ্বসিত হলেন সেলডন। “তুমি হ্যাঁলিকন থেকে এসেছ?”

পরিষ্কার রাগের সাথে জবাব দিল তরুণ, “ভালো টুইস্টার হওয়ার জন্য হ্যাঁলিকন থেকে আসার দরকার নেই।”

না, তা দরকার নেই। ভাবলেন সেলডন। কিন্তু ওখানকার ট্যুইস্টাররাই সবার সেরা।

অবশ্য এই প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে জিজ্ঞেস করলেন, “বেশ, তোমার দাদা আমার সাথে কাজ করতে রাজী হয় নি। তুমি করবে?”

“সাইকোহিস্টোরি?”

“সেদিন তুমি বেশ বুদ্ধিমানের মতোই সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কথা বলছিলে। কাজ করবে আমার সাথে?”

“আগেই বলেছি, প্রফেসর, আমি একটা কাজ করছি।”

“মাল টানার কাজ। এটা কোনো কাজ হলো।”

“বেতন ভালো।”

“ক্রেডিটই সবকিছু নয়।”

“তারপরেও অনেক কিছু। অন্যদিকে আপনি ভালো বেতন দিতে পারবেন না। আমি নিশ্চিত যে আপনি বেশ ভালোরকম আর্থিক সমস্যায় আছেন।”

“এই কথা কেন মনে হলো?”

“অনুমান করছি। কিন্তু, আমার ভুল হয়েছে কি?”

“না, ভুল হয় নি। দুঃখিত। আমাদের আলোচনা তাহলে এখানেই শেষ।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান। এত দ্রুত শেষ করে দেবেন না। আপনার সাথে কাজ করলে আমাকে সাইকোহিস্টোরি শেখাবেন, ঠিক?”

“নিশ্চয়ই।”

“সেক্ষেত্রে, ক্রেডিট আসলেই সবকিছু নয়। আমি আপনার সাথে একটা চুক্তি করতে চাই। সাইকোহিস্টোরি আপনি যা জানেন তার সব আমাকে শেখাবেন এবং বেতন যখন যা পারেন দেবেন। কেমন শোনাচ্ছে?”

“এর চেয়ে ভালো চুক্তি আর হতেই পারে না।” উফুল্ল কণ্ঠে সেলডন বললেন। “আর একটা ব্যাপার।”

“কি?”

“মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আমার উপর দুবার হামলা হয়েছে। প্রথমবার আমার ছেলে আমাকে রক্ষা করে। কিন্তু তারপর সে সান্তানিতে চলে যায়। দ্বিতীয়বার আমি আমার ভারী ছড়িটা ব্যবহার করি। ফলশ্রুতিতে হিংসাত্মক কার্যকলাপের দায়ে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে–“

“হামলা হয়েছিল কেন?” মাঝখানে বাধা দিল পালভার।

“আমি জনপ্রিয় নই। দীর্ঘদিন থেকেই এম্পায়ার ধ্বংসের কথা প্রচার করছি। আর যেহেতু এখন তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে সবাই দোষ দিচ্ছে আমাকে।”

“বুঝলাম। কিন্তু এর সাথে আপনার সেই আরেকটা ব্যাপারের কি সম্পর্ক?”

“তোমাকে আমার বডিগার্ড হিসেবে চাই। তুমি তরুণ, শক্তিশালী, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তুমি একজন ট্যুইস্টার। ঠিক তোমাকেই আমার প্রয়োজন।”

“আমার মনে হয় তাতে কোনো সমস্যা হবে না,” হাসিমুখে জবাব দিল পালভার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *