সন্ন্যাসী চলে যাবার অল্পক্ষণ পরেই দলে দলে লোক আসতে লাগল। সমস্ত দিন ধরে দলে দলে লোক এসে সেই যে রহস্যময় প্রশ্ন করছিল এতক্ষণে তার সমাধান হল–আজ এদের মাছ রান্না হয়েছে। বোম্বাই শহরে সে-সময়ে বাঙালিদের বাড়ি ভাড়া দেবার সময় শর্ত করিয়ে নিত যে, তারা বাড়িতে কোনোরকমের আমিষ রান্না করবে না। এরা মাঝে মাঝে লুকিয়ে-চুরিয়ে মাছ রান্না করত। সে-সময়ে বোম্বাইয়ে সরষের তেলে রান্নার রেওয়াজ ছিল না। সব রান্নাই হত বাদামের তেলে। বাদামের তেলে মাছ রাঁধলে তেমন গন্ধ ছোটে না। কিন্তু বাড়িওয়ালা ও প্রতিবেশীরা টের না পেলেও দূর-দূরান্তরবাসী বাঙালির নাকে ঠিক গিয়ে পৌঁছত সে-গন্ধ এবং অনেকে লৌকিকতার অপেক্ষা না করেই মাছের লোভে এসে পড়তো এখানে।
যাই হোক, আগন্তুকদের মধ্যে অনেকেই আমার সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করতে লাগলেন। আমি সদ্য বাংলাদেশ থেকে আসছি শুনে, ‘স্বদেশী আন্দোলন’ সম্বন্ধে অনেকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই দশ-বারো বছর পর্যন্ত দেশের মুখ দেখেননি। প্রাণপণে খেটে পয়সা জমিয়ে হয় দেশে ফিরবেন, না-হয় এখানেই কারবার খুলবেন–এই আশায় এখানকার সব কষ্ট সহ্য করে দিন যাপন করছেন।
বসে বসে আমার অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। সেই দুপুরে এসেছি, এদিকে রাত্রি প্রায় আটটা বাজল অথচ কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্রহ্মানন্দজী কিংবা বন্ধুদের কারুরই দেখা নেই। ক্ষিদেও বেশ পেয়েছে। কি করি ভাবছি–এমন সময়ে খাবার ডাক পড়ল। সবাই ঘরের সেই চাঙে উঠে গেল–আমি কি করব ভাবছি, এমন সময় সেই অযোধ্যাদা আমাকে বললেন–ঠাকুরমশায় চলুন খেতে।
দোতলায় উঠলুম। গোল-গোল কাঁচা শালপাতায় কাঁড়ি-প্রমাণ ভাত দেওয়া হয়েছে এক-একজনকে। সকলে ভাত ভেঙে নিয়ে বসে আছে কখন মাছ পড়বে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে সেই বহুপ্রত্যাশিত ‘জলচর’ পাতে পড়ল।
দেখলুম–ছোট ছোট ঘেঁচি ট্যাংরা মাছ, তাও আবার দু’খানা করা হয়েছে। মাছ কোটা হয়নি, তার মুখের দাড়ি গোঁফ সবই রয়েছে–এমনকি গায়ের নাল পর্যন্ত। তার ওপরে কোনো মশলা নেই, বোধহয় ভাজাও হয়নি–সামান্য হলুদ দেওয়া হয়েছে কি না-হয়েছে। যিনি রেঁধেছেন, তিনি আবার নুন দেননি। নুন না দেবার কারণস্বরূপে তিনি বললেন–নুন যদি বেশি হয়ে যায় তা হলে এমন জিনিসটি অখাদ্য হয়ে যেতে পারে–বরঞ্চ খাবার সময় যে যে-রকম নুন খায় সেইরকম দিয়ে নিতে পারবে।
যাই হোক, পাতে পড়া-মাত্ৰ সকলে হৈ হৈ করে খেতে আরম্ভ করে দিলে। সকলেই বলতে লাগল-রান্নাটি বেড়ে হয়েছে। আমি তো ভাত মুখেই তুলতে পারলুম না। আঁশটে গন্ধের চোটে ঠেলে বমি আসতে লাগল। কোনোরকমে শুকনো ভাত নুন দিয়ে ডেলা পাকিয়ে মুখের মধ্যে ঠেলে দিতে লাগলুম বমি আটকাবার জন্য। যিনি রান্না করেছিলেন তিনি একটু পরে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন- ঠাকুরমশায়, রান্না কেমন হয়েছে?
মনে হল–ঠেসে একটি চড় কষিয়ে বুঝিয়ে দিই, রান্না কেমন হয়েছে! কিন্তু ভিক্ষার অন্ন–কাড়া-আঁকাড়া বিচার করতে নেই, এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে বললুম, বেশ হয়েছে–চমৎকার হয়েছে।
খাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে যাবার পর মাছের কাঁটাগুলো একটা কাগজে মুড়ে একজন বেরিয়ে গেল সেগুলোকে দূরে কোনো রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে।
আবার আমরা নীচে এসে বসলুম।
নিমন্ত্রিতেরা কিছুক্ষণ গল্পস্বল্প করে যে যার ডেরায় চলে গেল। বসে বসে ভাবতে লাগলুম–আমার কি ব্যবস্থা হবে! দু’ একজন সেই মাদুরের ওপর বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল। আরও কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর ব্রহ্মানন্দ উপস্থিত হলেন।
খাওয়া হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করে আমাকে ব্রহ্মানন্দ বললেন–এসো আমার সঙ্গে।
.
তখন বেশ রাত্রি হয়েছে। ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা এ-গলি সে-গলি ঘুরে ঘুরে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পল্লীতে একটা বড় বাড়ির মধ্যে ঢুকলুম। দোতলায় উঠে ব্রহ্মানন্দের পিছু পিছু একটা বড় ঘরের মধ্যে ঢুকলুম। ঢুকেই দেখি কালীচরণ ও পরিতোষ দু’জনেই সেখানে বসে আছে। তাদের দেখে এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ এল।
ঘরখানি দিব্যি সাজানো। দেওয়ালে বড় বড় রবিবর্মার বাঁধানো ছবি টাঙানো। মেঝের খানিকটা গদি-পাতা। গদির সামনে দুটো শাল পালিশ করবার চক্র রয়েছে। মেঝের বাকি অংশটুকুও চিত্র-বিচিত্র লিনোলিয়াম বিছানো। ঘরের এক কোণে খানকয়েক চেয়ারও রয়েছে। এই কারবারের মালিক যদুবাবু একাই কারিগর।
আমি যেতেই ভদ্রলোক স্মিতহাস্যে আমাকে অভিবাদন করে বললেন –বসুন, আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো?
বললুম–হ্যাঁ, হয়েছে।
দেখলুম, যদুবাবু ব্রহ্মানন্দজীর খুবই অনুগত এবং বেশ বোঝা গেল যে, তাঁরই ইচ্ছায় তিনি আমাদের তিনজনকে সেখানে রাখতে রাজি হয়েছেন। অবিশ্যি ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধে তাঁর কি কথা হয়েছিল তা আজও আমাদের অজ্ঞাত। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে ব্রহ্মানন্দজী বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যদুবাবু বললেন–এবার শুয়ে পড়ুন।
পরদিন সকালবেলা উঠে স্নান সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম শহর-পরিক্রমার উদ্দেশ্যে। প্রথমেই স্টেশনের কাছে এসে এক ইরানীর দোকানে ঢুকে চা খেলুম। সে-যুগে মুসলমান, গোয়ানিজ, ক্রিশ্চান ও পার্শী সম্প্রদায়ের লোক ছাড়া ইরানীর দোকানে কেউ ঢুকত না। আমরা ঢোকামাত্র দোকানের চাকর-বাকর থেকে আরম্ভ করে খরিদ্দার পর্যন্ত সকলেই অবাক হয়ে দেখতে লাগল। একজন ছোকরা চাকর এসে আমাদের বললে–তোমরা বোধহয় ভুল করে এখানে ঢুকেছ–এখানে হিন্দুরা ঢোকে না, কারণ এখানে মাংস রান্না হয়।
দোকানে ঢুকেই চমৎকার মাংস-রান্নার গন্ধ পাচ্ছিলুম বটে!
পরিচারকের কাছে মাংসের খবর পেয়ে আমরা উৎসাহিত হয়ে বললুম–ঠিক আছে, আমরা এখানে ইচ্ছে করেই ঢুকেছি। মাংস-টাংস আছে?
ছেলেটি বললে–সকালবেলায় ডাল-গোস্ত পাওয়া যাবে।
–ডাল-গোস্তই সই–নিয়ে এস তিন প্লেট।
ডাল-গোস্ত এল। ডালের সঙ্গে মাংস রান্না হয়েছে। চমৎকার খেতে–এ জিনিসটির তখনো বাঙালি সমাজে প্রসারলাভ করেনি। অন্তত আমরা তিনজনেই ডাল-গোস্ত এর আগে কখনও খাইনি।
দেখলুম, ইরানীদের দোকানে রান্না ভালো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাসনপত্র ও ঘর–অন্যান্য গুজরাটী ও মারাঠী দোকানের চেয়ে এদের দোকান অনেক উন্নত ধরনের। যাই হোক, খেয়েদেয়ে বেলা প্রায় এগারোটা অবধি শহর ঘুরে ঘুরে আমরা যদুবাবুর দোকানে ফিরে এলুম। যদুবাবু লোকটি দেখলুম অত্যন্ত স্বল্পভাষী। কাজ করতে করতে একবার মুখ তুলে আমাদের দেখে আবার আপনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন–আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি খেয়ে আসি।
ঘণ্টাখানেক পরে যদুবাবু একটি লোক সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন। লোকটার হাতে দুপ্লেট খাবার। পাশের একটা ঘরে গিয়ে যদুবাবু দুপ্লেট খাবারকে তিন প্লেটে সাজিয়ে আমাদের বললেন–নিন্, খেয়ে নিন।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার বেরুনো গেল শহর পরিক্রমা করতে। সন্ধ্যা অবধি ঘুরে ঘুরে ডেরায় ফিরে এলুম।
সন্ধের পরে দেখলুম যদুবাবুর ঘরে একে একে অনেকেই এসে উপস্থিত হতে লাগলেন। এঁরা সকলেই গয়না-তৈরির কাজ করতেন। দেখলুম আমাদের তিনজনের কথা প্রায় সকলেই জানেন। এঁদের মধ্যে এক ভদ্রলোক ছিলেন খুবই উৎসাহী–তিনি এখানকার বাঙালিদের নিয়ে একটা ক্লাব করবার উদ্যোগ করছিলেন। তিনি দুটো তিনটে গান গাইলেন। আমাদের বললেন–আপনারা এসে পড়ায় আমাদের ক্লাবের খুবই সুবিধা হল। মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করবার মতন ছেলে আমাদের নেই।
তারপর বিশেষভাবে আমাকে ও পরিতোষকে বললেন–আপনাদের দ্বারা চমৎকার ফিমেল-পার্ট হবে।
আমরা বললুম–একটা কাজকর্ম না জুটলে এখানে থাকাই যে মুশকিল হবে। ভদ্রলোক বললেন–কাজকর্ম একটা-না-একটা জুটেই যাবে।
ভদ্রলোকের কথা শুনে আশ্বস্ত হওয়া গেল। ভাবলুম, আর কালীমুখ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে না। একটা কাজকর্ম নিশ্চয়ই জুটে যাবে।
যদুবাবুর ওখানে দিন কাটতে লাগল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে যাই। ঘুরে-টুরে বেলা এগারোটা আন্দাজ ফিরে এসে খেয়ে-দেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে পড়ি। শহরময় ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াই কোথাও কোনো কাজ মেলে কি না। মাঝে মাঝে ভদ্ৰলোক দেখে জিজ্ঞাসা করি–কোথাও চাকরি-বাকরি মেলে কি না। সন্ধের সময় ফিরে আসি। কোনো-কোনো দিন সে-সময় ব্রহ্মানন্দজী এসে আমাদের খুব বকাবকি করেন। সন্ধ্যার সময় যদুবাবুর ওখানে যাঁরা আসেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথম দিন আমাদের খুবই উৎসাহ দিয়েছিলেন। কাজকর্ম একটা নিশ্চয়ই লেগে যাবে–এইরকম আশাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরাও আমাদের সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়লেন। ওদিকে আমাদের অন্নদাতা যদুবাবু স্বল্পবাক্ হলেও তাঁর মুখের চেহারা ক্রমেই বদলাতে আরম্ভ করতে লাগল। বেশ বুঝতে পারলুম অচিরেই এখানকার অন্ন বন্ধ হবে।
একদিন এইরকম পথে পথে কাজের জন্য ঘুরছি, এমন সময় এক জায়গায় শুনতে পেলুম যে ডকে গেলে কাজ মিলতে পারে। সেখানেই রোজই দিন হিসাবে ঠিকে লোক নেয়। কথাটা শুনেই ছুটলুম ডকে। তারপর এ-দরজা নয় ও-দরজা, এমনিই করে প্রায় তিন-চারটে দরজা ঘুরলুম–কিন্তু আমাদের বরাতে সব দরজাই বন্ধ। শেষকালে একটা দরজা খোলা পেয়ে ফট্ করে ঢুকে পড়া গেল। শুনেছিলুম ডকে একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার কাজ করেন এবং তাঁর অধীনে অনেক কুলি আছে। তিনি ইচ্ছা করলে কুলি হিসাবে আমাদের নিতে পারেন।
ডকে ঢুকে আমরা এদিক-ওদিক করছি এমন সময়ে হৈ হৈ করে দু’জন পুলিশ-কনস্টেবল এসে একেবারে আমাদের গ্রেফতার করলে। কনস্টেবলদ্বয় আমাদের টানতে টানতে একেবারে গেটের কাছে নিয়ে গেল। তারা জিজ্ঞাসা করলে–কি চাই তোমাদের?
আমরা বললুম–এখানে বাঙালি ইঞ্জিনীয়ার আছেন, আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
গেটের দরোয়ান বললেন–আচ্ছা, বোসো।
দরোয়ান বসতে বলায় কনস্টেবল দু’জন আমাদের ছেড়ে দিয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলে। আমরা বসে রইলুম। দরোয়ান ভেতরে চলে গেল ইঞ্জিনীয়ার-সাহেবকে খবর দিতে। কিছুক্ষণ পরে সে-ব্যক্তি ফিরে এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল ভেতরে।
আমরা ইঞ্জিনীয়ার-সাহেবের সম্মুখীন হতেই তিনি রেগে চিৎকার করে উঠলেন–কি চাই তোমাদের?
বললুম–আপনার কাছে এসেছি কাজের আশায়। বিদেশে এসে বড় বিপদে পড়েছি। কাজ–যে-কোনো কাজ–কুলির কাজ করতেও আমরা রাজি আছি।
ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব রেগে বললেন–এখানে কাজ-টাজ কিছু নেই।
তারপর দরোয়ানকে হিন্দিতে বললেন–এদের বাইরে বার করে দাও।
অভদ্রের মতো সে-ব্যক্তি আমাদের দূর করে তাড়িয়ে দিলেও সেদিন কিন্তু মনে মনে লোকটাকে ধন্যবাদই দিয়েছিলুম। কারণ তিনি যদি আমাদের ডেকে না পাঠাতেন তা হলে ডকে বিনা-অনুমতিতে প্রবেশ করার অপরাধে আমাদের থানায় যেতে হত। তারপরে জীবনধারণের কোনো ন্যায্য উপায় দর্শাতে না পারলে কতদূর কি হত তা বলা যায় না।
এইরকম সারাদিন ধরে চারদিক ঘুরে রাত্রিবেলা ডেরায় ফিরে এসে আমরা সেদিনের ঘটনাবলী যদুবাবুর কাছে বলতুম। আগেই বলেছি–তিনি কথাবার্তা খুবই কম বলতেন। আমাদের কথা শুনে তাঁর মুখে যে ভাব ফুটে উঠত তাকে আর যাই হোক প্রসন্ন মুখচ্ছবি বলা যায় না। সত্যি বলতে কি, প্রতিদিন দুবেলায় তিনজন লোকের খোরাক জোটানো একজন সামান্য ব্যবসায়ীর পক্ষে কঠিন ব্যাপার। শুধু ব্রহ্মানন্দজীর খাতিরে তখনো যদুবাবু আমাদের বিদায় করে দেননি। তবে আর বেশিদিন যে সেখানে আমাদের অন্ন নেই তা বেশ টের পেতে লাগলুম। পথে পথে চাকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াই, চায়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি–কাপ প্লেট ধোওয়ার লোকের দরকার আছে কি না। সকলেই বলে–”না”। সকলেই সন্দেহের চোখে চায় যেন আমরা জেলে ভেঙে পালিয়ে এসেছি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, আমেরিকার পথে পথে ঘুরলে এর চেয়ে সহজে কাজ জুটতে পারে। কী করে সেই দেশে পৌঁছনো যায়–হ্যায় রে দুরাশা!
একদিন দুপুরবেলা এইরকম অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক ছাতার কারখানা দেখে দাঁড়িয়ে গেলুম। দেখলুম অনেক কারিগর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসে এক এক রকমের কাজ করে চলেছে। ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ির কাছেই একটা ছাতার বাঁটের কারখানা ছিল। কারিগরেরা বেঁকানো লোহার ছাঁচ গরম করে তলতা বাঁশকে কত সহজে বেঁকিয়ে ফেলত–আমরা সময় পেলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিস্তিরিদের সেই কারিগরি দেখতুম আর ভাবতুম–আমাদের দিলে আমরাও ওরকম করতে পারি। এখানেও দেখলুম এক জায়গায় বসে অনেকগুলি কারিগর একটার পর একটা বাঁশ ওইরকম বেঁকিয়ে চলেছে।
কিছুক্ষণ বাদেই বুঝতে পারলুম–কারিগরদের মধ্যে আমাদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমরা সেখান থেকে আস্তে আস্তে সরে পড়ব কি না ভাবছি এমন সময় শুনতে পেলুম–কবে আসা হয়েছে?
অপ্রত্যাশিতভাবে মাতৃভাষা শুনে চমক লাগল। কোথা থেকে প্রশ্নটা এল তারই খোঁজ করছি এমন সময় একজন কারিগর আঙুল দিয়ে একজনকে দেখিয়ে দিলে। দেখলুম দূরে একজন অল্পবয়স্ক কারিগর আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমরা তিনজনই উনুন, হাজার স্তূপাকার বাঁশের পাহাড় এড়িয়ে এড়িয়ে লোকটির কাছে গেলুম। অত্যন্ত রোগা, মাথায় বড় বড় চুল–আমাদের বয়সি ছেলেটি। সে বললে–বোসো এখানে। এই পাণ্ডববর্জিত দেশে কি করতে এসেছ? বেশ বুঝতে পারছি ভেগেছ।
জিজ্ঞাসা করলুম–তোমার বাড়ি কোথায়?
সে বললে–আরে ভাই, বাড়িঘর থাকলে কি কেউ এখানে আসে? আমার বাড়িঘর কিছু নেই, পৃথিবীতে আপনার বলতেও কেউ নেই, তাই এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই।
এমন করুণ সুরে সে কথাগুলো বলল যে, মনে গিয়ে লাগল। বললুম–আমরা এসেছি ভাগ্যের সন্ধানে।
–তা ভাগ্যে কি কিছু জুটেছে?
–এখনও জোটেনি। এক জায়গায় খাওয়া-শোওয়া চলছে বটে, কিন্তু আর বেশিদিন সেখানে চলবে বলে মনে হয় না।
ছেলেটি হেসে বললে–আমরা এই ঘরে জনকয়েক মিলে শুই, তা রাত্রি ন’টার পর শেঠ চলে যায়, তখন তোমরা এসে অনায়াসে শুতে পার। রতনেই রতন চেনে বুঝলে ভাই! আশ্ৰয় না থাকার কষ্ট সারাজীবন ধরে ভুগছি কিনা!
জিজ্ঞাসা করলুম–ভাই, তোমাদের এই কারখানায় তো দেখছি অনেক লোক কাজ করছে, তা আমাদের কোনো কাজ-টাজ হয় না এখানে?
খানিকক্ষণ আমাদের মুখের দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে–কাজ করবে? কিছু কাজ জানা আছে?
বললুম–কাজ তো কিছুই জানি না, তবে মনে হয় এই তলতা-বেঁকানো কাজ খুবই সহজ। সে বললে–হ্যাঁ, এ কাজ খুবই সহজ। আর এর জন্য মজুরিও ভালো পাওয়া যায়–প্রত্যেক বাঁশের জন্য একপয়সা। আমি মাস গেলে প্রায় চল্লিশ টাকা কামাই। একটি পয়সাও থাকে না–সবই খরচ হয়ে যায়।
ছেলেটি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কাজ করে চলল। কিছুক্ষণ পরে সে বলল–এই বাঁশ-বেঁকানো কাজ করতে পারবে?
বললুম–ও আর কি! নিশ্চয়ই পারব।
আরও কিছুক্ষণ নীরবে কাটবার পর সে চুপি চুপি আমাদের বললে–দেখ, তোমাদের শেঠের কাছে নিয়ে গিয়ে বলব, এরা কলকাতা থেকে এসেছে, খু-উ-ব ভালো কারিগর। শেঠ জিজ্ঞাসা করবে–কলকাতায় তোমরা কোথায় কাজ করতে? বলবে–মহেন্দ্র দত্তের ছাতার কারখানায়। চল, যাওয়া যাক শেঠের কাছে।
ওখানে যাবার আগে সে বললে–আমার নাম যোগেন মল্লিক। তোমাদের নাম কি? আমরা নাম বললুম–তারপর দুরুদুরু বক্ষে শেঠের কাছে গিয়ে হাজির হওয়া গেল। যোগেন বললে–এরা খুব ভালো কারিগর। সম্প্রতি বোম্বাইয়ে বেড়াতে এসেছে, দু’দিন পরেই চলে যাবে। আমি বলছি–পয়সা যদি রোজগার করতে চাও তো বোম্বাইয়ের তুল্য আর স্থান নেই।
শেঠ জিজ্ঞাসা করলে–কাজ করবে?
ঘাড় নেড়ে জানালুম–করব।
-এর আগে কোথায় কাজ করতে?
-মহেন্দ্র দত্তর কারখানায়।
শেঠ আবার জিজ্ঞাসা করলে–সেখানে বাঁশ-প্রতি কত দেয়?
ব্যস্! বাঁশ-প্রতি কত দেয় তাই ভাবতে লাগলুম। আমাদের অবস্থা দেখে যোগেন উত্তর দিল–দু’বাঁশে তিন পয়সা।
শেঠ যোগেনকে জিজ্ঞাসা করল–পারবে তো?
যোগেন বললে–হুঁজুর এরা খুব ভালো কারিগর। আমরা সব পাশাপাশি বসে কাজ করেছি। শেঠ আমাদের বললে–আমার এখানে একটা বাঁশে একপয়সা পাবে–রাজি আছ?
বলা বাহুল্য তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলুম। শেঠ লোক ডেকে বলে দিলেন আমাদের জন্য একটা উনুন ও হাপর ঠিক করে দিতে। তিনজনকে তিনটে তাতল অর্থাৎ বাঁশ বেঁকাবার ফর্মা ও তাতল ঠান্ডা করবার জন্য এক গামলা জলও দেওয়া হল। পরমোৎসাহে কাজও আরম্ভ করে দেওয়া গেল। কারখানার মুন্সী আমাদের তিনজনকে গুনে পঞ্চাশখানা করে তলতা বাঁশ দিয়ে গেল।
ও কাজের আমরা কিছুই জানতুম না, কিন্তু কাজ অত্যন্ত সহজ। একদিন কি দু’দিন শিখতে পেলে আমরা অন্য কারিগরদের চেয়ে হয়তো ভালোই করতে পারতুম। কিন্তু পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমেই আমি পাঁচ-ছ’খানা বাঁশ একেবারে পুড়িয়ে ফেললুম। তারপরে আর পাঁচ-ছ’খানাকে বেঁকিয়ে ফেললুম বটে, কিন্তু তা দিয়ে ছাতার বাঁট হওয়া সম্ভব নয়। আমি তো যা হয় একরকম করে চলেছিলুম, ওদিকে পরিতোষ ও কালীচরণ একেবারে অগ্নিকাণ্ড করে ফেললে। তারা এক-একজনে আট-দশগাছা করে বাঁশ নষ্ট তো করলেই, তাছাড়া অনবধানতায় সেই অগ্নিবর্ণ তাতল বাঁশের স্তূপের ওপর রাখায় শুকনো বাঁশে ধরে গেল আগুন
কারিগরেরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল। প্রত্যেকের কাছেই একটা করে গামলায় জল ছিল, তারা এসে সেই জল দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেললে। ওদিকে হৈ হৈ শুনে শেঠ ও আরও অনেক লোক ছুটে এসে কলকাতার ভালো কারিগরদের কারিগরি দেখে একেবারে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠল। শেঠ আমাদের ও সেই সঙ্গে যোগেনকে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল; যোগেনকে বললে–তুমি এখুনি তোমার এই জাতভাইদের নিয়ে বেরিয়ে যাও–নইলে আমি পুলিশ ডাকব। যোগেন বললে–আমিও তোমার মতো শেঠের কাছে কাজ-কর্ম করতে চাইনে। আমার হপ্তা চুকিয়ে দাও।
শেঠ বললে-তোমার জন্য আমার প্রায় দশ টাকা লোকসান হয়েছে–আবার হপ্তা! কিছু পাবে না, যা ইচ্ছে হয় তোমার কর।
আরও কিছুক্ষণ বকাবকির পর যোগেন বললে–আচ্ছা, কি করে টাকা আদায় করতে হয় তা দেখিয়ে দেব।
কারখানার এক কোণে যোগেনের সংসার পড়ে ছিল–খান-দুয়েক ধুতি, একটা না দুটো শার্ট-গোছের জামা, একজোড়া ছেঁড়া জুতো আর একটা বিছানার চাদর-গোছের জিনিস। সব ক’টা মিলিয়ে একটা পুঁটুলি বেঁধে যোগেন বললে–চল।
বাইরে বেরিয়ে এসে সে বলতে লাগল–আট মাস এখানে রুটি বাঁধা ছিল–ক’দিন থেকেই এ-কাজ আর ভালো লাগছিল না। ভাবছিলুম–কি করে রেহাই পাওয়া যায়।
আমরা আর কি বলব! বেচারা বিদেশে কোনো রকমে অন্নসংস্থানের জোগাড় করেছিল, আমাদের জন্যই সেটা নষ্ট হল–এই চিন্তা আমাদের তিনজনকেই পীড়া দিতে লাগল।
পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এল। চারিদিকের দোকানে আলো জ্বলে উঠতে লাগল। একটা গলির মোড় বরাবর এসে যোগেন বললে–আচ্ছা ভাই, চলি এবার।
যোগেনকে জিজ্ঞাসা করলুম–কোথায় যাবে?
সে বললে–কোথায় যাব তা কি করে বলি। চলতে তো আরম্ভ করি তারপরে যেখানে অন্ন মাপা আছে সেইখানেই যাব।
আমাদের কাছে তখনো গোটা পনেরো টাকা ছিল; তা থেকে পাঁচটা তাকে দিলুম। যোগেন বিনা দ্বিধায় টাকা পাঁচটা ট্যাকে পুরতে পুরতে বললে–তোমাদের কিছু আছে তো?
বললুম–আছে কিছু।
যোগেন বললে–আচ্ছা, আবার দেখা হবে।
এখনও যেন দেখতে পাচ্ছি, পুঁটুলি-বগল-দাবা যোগেন সেই সরু রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে অনির্দিষ্টের সন্ধানে–যেখানে তার ভবিষ্যতের অন্ন মাপা আছে। দেখতে দেখতে সে পথের জনস্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। আর তাকে দেখতে পেলুম না। বিচিত্র এক রহস্যসূত্রে কয়েক ঘণ্টার জন্য সে বাঁধা পড়েছিল আমার জীবনের সঙ্গে; আর তার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। কোথায় জন্মভূমি তার বাংলাদেশের কোন্ এক পল্লীতে, কোন্ দূর দেশে এসে সে দুটি অন্নের সংস্থান করেছিল–কোথা থেকে আমরা এসে তার কর্মচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়ালুম। এর সবটাই কি হঠাতের খেলা, না সবটাই পূর্বনির্ধারিত! সারা জীবন ধরেই এই রহস্যের জট ছাড়াবার চেষ্টা করছি।
.
একদিন যদুবাবুকে মুখ ফুটে বলে ফেলা গেল–এরকম করে আপনি কতদিন আর আমাদের খাওয়াবেন। আমাদের কিছু কিছু করে কাজ দিন নয়তো আপনি একটু একটু কাজ শেখান, যাতে ভবিষ্যতে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আপনার কারবারও বড় হবে।
আমাদের কথা শুনে যদুবাবু আরও মৌন হয়ে পড়লেন।
সে-সময় হর্নবি রোডের ওপরে সলভেশন আর্মিদের একটা বড় আস্তানা ছিল। কলকাতায় সলভেশন-আর্মিদের চেহারা ও কার্যকলাপ আমাদের জানা ছিল। একদিন কিরকম খেয়াল হল নিজেদের মধ্যে ঠিক করা গেল যে, ওদের কাছে গিয়ে বলব যে তোমরা যদি আমাদের কাজ দাও, তা হলে আমরা ক্রিশ্চান হতে রাজি আছি।
মতলব ঠিক করে একদিন বেলা এগারোটার সময় সলভেশন-আমির বাড়িতে ঢুকে পড়া গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই কাঠের পার্টিশন দেওয়া এক ঘরের মধ্যে জনকয়েক সাদা-চামড়ার লোক গেরুয়া রঙের লুঙ্গি পরে টেবিলে বসে ছিল। আমাদের ‘বাবা কালী’ ছিল আগে–বোধহয় তার চেহারা দেখে একজন লোক প্রায় তাড়া করে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলে, কি, কি চাই তোমাদের?
বাবা কালী সোজা বলে ফেললে–আমরা তিনজনে ক্রিশ্চান হতে এসেছি। তিন-তিনটে আত্মা ব্যাকুল হয়ে উদ্ধারের আশায় এসেছে দেখে লোকটি প্রথমে হচকিয়ে গেল। তারপর আমাদের এক জায়গায় বসতে বলে সেই টেবিলে ফিরে গিয়ে তাদের কি বললে। ওদের মধ্যে একজন মুরুব্বি-গোছের লোক উঠে এসে আমাদের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললে হ্যাঁ, কি চাই তোমাদের?
আমরা বললুম–আমরা শুনেছি, ক্রিশ্চান হলে নাকি আপনারা কাজকর্ম দেন। চাকরির অভাবে আমরা বড় কষ্ট পাচ্ছি-চাকরি পেলে আমরা ক্রিশ্চান হতে রাজি আছি।
লোকটি ধীরভাবে আমাদের কথা শুনে অত্যন্ত মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করলে- তোমরা কোথাকার লোক?
–কলকাতার।
যাঁহাতক কলকাতার নাম শোনা–অমনি সে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। একেবারে রেগে টেবিলের ওপর ঘুষো মেরে বললে–তোমরা কোথায় শুনেছ যে আমরা চাকরি দিয়ে লোককে ক্রিশ্চান করি?–কে বলেছে তোমাদের এইসব গল্প?
বললুম–পৃথিবী-সুদ্ধ লোক এই কথা বলে।
আমাদের কথা শুনে লোকটা আরও রেগে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে
আমাদের বললে–যাও যাও এখান থেকে–
বলা বাহুল্য আর দ্বিরুক্তি না করে একরকম ছুটেই আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। আমরা চাকরি পাবার আশায় ক্রিশ্চান হবার জন্য সলভেশন আর্মির ওখানে গিয়েছিলুম শুনে সেদিন সন্ধ্যার পর ব্রহ্মানন্দজী বললেন-দশ বছরের মধ্যে ওই সলভেশন আর্মির দলকে বোম্বাই-ছাড়া করে দেব।
পাঁচ বছর পরে বোম্বাই গিয়ে দেখি সলভেশন আর্মির ক্ষেত জন্মে গেছে–ব্রহ্মানন্দজীর খোঁজ করেছিলুম কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাইনি
সেদিন ব্রহ্মানন্দজীকে অত্যন্ত উত্তেজিত দেখা গেল। তাঁর বকুনিগুলোও যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যদুবাবুও দু’একটা কথা বলতে লাগলেন। বেশ বুঝতে পারা গেল যে, আমাদের হাতে নিয়ে তিনি বেশ মুশকিলে পড়ে গেছেন। অনেকক্ষণ বকাবকির পর তিনি আমাকে পরীক্ষা করবার জন্য এক-পাতা বাংলা লিখে বললেন–ইংরিজিতে তর্জমা কর তো দেখি?
অত্যন্ত সোজা কয়েকটি বাক্য তাতে লেখা ছিল–খুব সহজেই তা নির্ভুল তর্জমা করে ফেললুম। আমার হাত থেকে কাগজখানা নিয়ে পড়ে ব্রহ্মানন্দজী বললেন–কাল সকালে তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে কাজে লাগিয়ে দেব। মন দিয়ে কাজ করলে ভবিষ্যতে উন্নতি করতে পারবে।
ব্রহ্মানন্দজী বেরিয়ে গেলেন। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়লুম–যাক, এতদিনে দুঃখের অন্ত হল। একজনের জুটলে আস্তে আস্তে আর দু’জনেরও জুটে যাবে।
সকালবেলা উঠে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বসে রইলুম–ব্রহ্মানন্দজীর আশায়। বলা বাহুল্য সেদিন আর সকালবেলায় চরতে বেরুলুম না। বসে অপেক্ষা করতে লাগলুম–ব্রহ্মানন্দজী আর আসেনই না। পরিতোষ ও কালীর সঙ্গে কথা হয়ে রইল যে ব্রহ্মানন্দজী আমাকে যখন নিয়ে যাবেন তখন তারাও দূর থেকে আমাদের পেছনে পেছনে এসে আমার কর্মস্থানটি দেখে যাবে। বেলা প্রায় এগারোটার সময় ব্রহ্মানন্দজী এসে আমাকে বললেন–তৈরি আছ, আচ্ছা চল। বলা বাহুল্য তৈরিই ছিলুম–বলামাত্র উঠে তাঁর সঙ্গ নিলুম।
ব্রহ্মানন্দজী আমাকে নিয়ে অনেক রাস্তা ভেঙে বেশ একটা বড় রাস্তার ওপরে একখানা বড় বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন। সেই বাড়ির তিন কি চারতলায় একখানা বড় ঘরে গিয়ে আমরা ঢুকলুম।
প্রকাণ্ড আলো-হাওয়া-ওয়ালা ঘর। ঘরের মধ্যে বোধহয় দশ-বারোটি কারিগর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসে কাজ করছে– কারিগরদের চেহারাও অন্য জায়গার কারিগরদের চেয়ে অনেক ভালো। আমরা সেখানে ঢোকামাত্র ঘরের প্রায় সকলেই হর্ষধ্বনি করে উঠল। বুঝতে পারা গেল যে, তারা আমাদের প্রতীক্ষা করছিল। সেখানকার একজন মুরুব্বি-গোছের লোক এগিয়ে এসে ব্রহ্মানন্দজীকে বললে–এই ছেলেটি বুঝি?
ব্রহ্মানন্দজী বললেন—-হ্যাঁ, এর কথাই বলেছিলুম তোমাদের। একে তোমাদের কাজ শেখাও। ব্রাহ্মণের ছেলে–সব কাজই চলবে।
লোকটি আমাকে খাতির করে এক জায়গায় বসালে। দু’একজন কারিগর কাজ ফেলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল কলকাতার খবর- স্বদেশী আন্দোলনের খবর।
এরা বাংলাদেশের ছেলে। অনেকদিন দেশে যায়নি। সপ্তাহে একখানা করে বাংলা সংবাদপত্র আসে বটে, কিন্তু তা পড়ে মন ভরে না। নানারকমের কথা–তার মধ্যে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর কথাই বেশি। একজন বললে–ক্ষুদিরামের যে চেহারা কাগজে বেরিয়েছে তার সঙ্গে আপনার চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলবার পর ব্রহ্মানন্দজী বিদায় নিলেন।
তখন বেলা বোধ হয় বারোটা। কারিগরেরা একে একে উঠে স্নান করতে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সেই মুরুব্বি-মতন লোকটি এসে আমাকে বললে–চলুন ঠাকুরমশায়, খেয়ে নেবেন চলুন।
পাশেই একখানা ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখলুম সেখানে অনেকেই খেতে বসেছে। এনামেলের থাল জুড়ে এক-একজন ভাত নিয়ে বসেছে–অন্নকূট দেখবার পুণ্য সেইখানেই হয়ে গেল। আমার পাত্রের তিনভাগ ভাত তুলে দিতে তারা সকলেই হৈ হৈ করে উঠল–ওই ক’টা ভাত খেয়ে বাঁচবেন কি করে!
ইতিমধ্যে পাতে ডাল আর তরকারি এসে পড়ল। সে রান্নার স্বাদ আজও আমার রসনায় লেগে আছে। ডাল নামে যে ময়লা জল পাতে এসে পড়ল তা দেখতেই ময়লা কিন্তু তাতে ভাতে রঙ ধরল না। তার বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদে কিছুতেই বোঝা গেল না সেটা কি ডাল। তরকারি নামে যে পদার্থটি দেওয়া হল তার সম্বন্ধেও ওই কথাই বলা চলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে ডাল কিংবা তরকারিতে কোনো স্বাদ নেই। বেসুরো গান সকলেই গায়, কিন্তু প্রত্যেক পর্দায় বেসুরো আওয়াজ বার করা যার-তার কর্ম নয়। তেমনি বিস্বাদ রান্না রাঁধা যায়, কিন্তু একেবারে স্বাদহীন রান্না এর পরে আর কোথাও খাইনি।
যাই হোক, আহারাদি সেরে আবার সবাই এসে বড় ঘরে বসল। তাদের পেছনে পেছনে আমি এলুম। একটা-দুটো বিড়ি ওড়বার পর, আগে যে মুরুব্বি-মতন লোকটির কথা বলেছি, এগিয়ে এসে আমাকে বেশ চেঁচিয়ে বললে–ঠাকুরমশায়! এবার আপনার সঙ্গে কথাটা কয়ে নেওয়া যাক।
তাঁর কথা শুনে দেখলুম আরও অনেকে ঘেঁষে কাছে সরে এলেন। লোকটি বললে–ব্রহ্মানন্দজী আপনাকে কিছু বলেছেন কি?
আমি বললুম–কৈ, ব্রহ্মানন্দজী তো কিছুই বলেননি!
লোকটি বিস্মিত হয়ে বললে–সে কি! আমাদের এখানে কেন নিয়ে এলেন সে-সম্বন্ধে কোনো কথা হয়নি? আপনিও তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি?
বললুম–না, তিনিও কিছু বলেননি, আমিও কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। তবে আমার মনে হয়, আপনাদের এখানে কাজ শেখাবার জন্য আমাকে আনা হয়েছে।
লোকটি আরও বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল –কি কাজ?
-এই যে কাজ আপনারা করেন–গয়না-তৈরির কাজ।
আমার কথা শুনে লোকটি হো হো করে হেসে উঠল। তার দেখাদেখি আরও অনেকে কেউ সশব্দে কেউ-বা দেঁতো হাসি হাসলে। হাসির পর্ব চুকে গেলে লোকটি বললে–বেশ তো, আপনি ব্রাহ্মণ, আপনি আমাদের কাছে কাজ শিখবেন, এ তো আমাদের ভাগ্যের কথা। কিন্তু কাজ শেখবার আগে অন্তত দু’এক বছর আমাদের রেঁধে খাওয়াতে হবে। ও-বেলা থেকেই কাজে লেগে যান।
লোকটির কথা শুনে তো আমার মাথা চক্কর খেতে আরম্ভ করলে। বেশ বুঝতে পারা গেল, আমার গলায় পৈতে দেখে আমাকে দিয়ে পাঁচকের কাজ করাবার জন্য আনা হয়েছে এখানে। চুপ করে ভাবতে লাগলুম–এখন কি প্যাঁচে এদের কাত করা যায়।
কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর লোকটি জিজ্ঞাসা করলে–কি বলছেন ঠাকুরমশায়? কৈ কিছু বললেন না তো?
আমি বললুম–আপনারা ক’জন আছেন? ক’জনের রান্না আমায় রাঁধতে হবে? –আমরা জন-দশেক আছি, আরও মাঝে মাঝে দু’ একজন বাড়তে পারে। আমি বললুম–বেশ। রাঁধতে আমি রাজি আছি, কিন্তু জন-প্রতি আমায় তিন টাকা দিতে হবে–অর্থাৎ দশজনের জন্য ত্রিশ টাকা–লোক যেমন বাড়বে, জনপ্রতি তিন টাকা বাড়বে।
বলব কি–আমার কথা শুনে তারা প্রায় শুয়ে পড়ল–বলেন কি! জনপ্রতি তিন–ন–টা–কা!!
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
তখন সেই মুরুব্বি বললে–আর আপনি যে দুবেলা খাবেন এখানে, তার দাম কে দেবে? বললুম-আপনি কি ক্ষেপেছেন! আপনাদের এখানে ওই খাওয়া খেয়ে আর আমাকে দশজনের রান্না রাঁধতে হবে না। আমি অন্যত্র খাব। তা ছাড়া আপনাদের ওই স্টাইলের রান্না রাঁধতে আমি জানি না; তবে দু’ একদিন দিলে নিশ্চয় পারব।
একজন জিজ্ঞাসা করলে–কি স্টাইলের রান্না আপনি রাঁধতে পারেন? বললুম–মুরগি-টুরগি রান্নার অভ্যেস আছে। খাসির মাংসও রাঁধতে পারি I মুরগির নাম শুনে বোধহয় পাঁচজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল–আপনি মুরগি খান! –মুরগি খাই বই কি। পেলেই খাই। কালও খেয়েছি।
মুরুব্বি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার জিজ্ঞাসা করলে–এখানে মুরগি পেলেন কোথায়?
–কেন ইরানীদের দোকানে যথেষ্ট পাওয়া যায়।
–সর্বনাশ! আপনারা ইরানীদের দোকানে যান!
–তা ক্বচিৎ পানেচ্ছা হলে যাই বইকি।
-অ্যাঁ!! ওরা মোচলমান–তা জানেন কি?
বিনীতভাবে বললাম–আজ্ঞে না, আপনারা জানেন না, ইরানীরা মুসলমান নয়, ওরা অগ্নি-উপাসক–হিন্দুরাও আগুনকে দেবতা বলে মানে। আর আপনারা বোধহয় জানেন না, স্বদেশী আন্দোলনের পর বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানে আর ভেদ নাই।
আমার এই কথা শুনে সবাই চুপ করে গেল–কেউ কেউ বিড়ি বার করে ফুঁকতে আরম্ভ করে দিলে। কিছুক্ষণ এইভাবে চুপচাপ কাটবার পর একজন নিজের মনেই বললে–ব্রহ্মানন্দজী খুব লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন যা হোক!
আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। মনে করলুম–আর বসে থেকে কি হবে, এবার উঠে পড়া যাক। এমন সময় সেই মুরুব্বি লোকটি বললে–দেখুন ঠাকুরমশায়! আমরা লেখাপড়া জানি না বটে, কিন্তু সিধে লোক। আপনাকে নিয়ে এসেছিলুম এইজন্য যে, আপনিও কাজ শিখবেন, আমাদেরও অনেক সুবিধা হবে। কিন্তু আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে যে, আপনাকে দিয়ে আমাদের সুবিধে হবে না।
আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে উঠে পড়া গেল। রাস্তায় নেমে মনে হল এখন যদুবাবুর ওখানে গেলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না। কাজেই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার সময় তারা ফিরলে সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া যাবে।
সন্ধ্যার একটু পরে যদুবাবুর ওখানে গিয়ে হাজির হলুম। বন্ধুরা তখন চরা করে ফিরেছেন। দেখলুম সেখানে আরও অনেকগুলি বাঙালি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ব্রহ্মানন্দজীও আছেন। আমরা যে মুরগি খাই সে-কথা সেখানকার কারিগর সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে এবং যাঁরা আমাদের কখনও দেখেননি, তাঁরাও অনেকে দেখতে এসেছেন। আমি সেখানে গিয়ে দেখলুম, আমার বন্ধুদ্বয় জেরায় জেরবার হয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করেছেন– পক্ষান্তরে আমাদের চিরমৌন যদুবাবু মুখ খুলেছেন। আমি সেখানে উপস্থিত হওয়ামাত্র তাঁরা কালী ও পরিতোষকে ছেড়ে আমায় আক্রমণ করলেন। যাঁরা আমাকে রন্ধনকার্যে নিয়োগ করবার জন্য সেদিন দুপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন, দেখলুম তাঁদেরও দু’ তিনজন লোক সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। আমি বসতেই ব্রহ্মানন্দজী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-তোমরা মুরগি খাও?
বললুম,–হ্যাঁ, পেলেই খাই।
একজন বললে–লজ্জা করে না হিন্দুর ছেলে হয়ে মুরগি খেতে?
আমি ঠেস দিয়ে বললুম–হিন্দুর ছেলে হয়ে ব্যবসার নামে লোকে চুরি-জচুরি করছে–আমরা তো সামান্য মুরগি খেয়েছি।
আমার এই মন্তব্য শুনে সেখানে উপস্থিত সবাই একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। যদুবাবু স্পষ্টই বলে দিলেন–দেখুন, আমার এখানে আপনাদের আর স্থান হবে না। এখান থেকে বেরিয়ে যান।
অকস্মাৎ আমাদের ওপর এই চরম দণ্ড উচ্চারিত হওয়ামাত্র সভাক্ষেত্র নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। আমাদের সামান্য জিনিসপত্র যা ছিল, গুটিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম।
তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। একদিন অনেক রাত্রে ব্রহ্মানন্দজীর সঙ্গে সেই জলচর খেয়ে এসে যদুবাবুর আস্তানায় ঢুকেছিলুম–সেই সময়টুকু ছাড়া রাতের বোম্বাই দেখবার সুবিধে আর হয়নি। যদুবাবুর ওখানে থাকতে পাছে তিনি কিছু মনে করেন, সেইজন্য সন্ধ্যা হবার আগেই আমরা ফিরে আসতুম। রাস্তায় নেমে চলতে আরম্ভ করে দিলুম। পথের সঙ্গে আমার পরিচয় খুবই ঘনিষ্ঠ, পরিতোষের কাছেও পথ খুব অপরিচিত ছিল না। মুখে কিছু না বললেও, দেখলুম, আমাদের কালীচরণ একটু বিব্রত হয়ে পড়েছে, কিন্তু সে-কথা স্বীকার না করে বলতে লাগল–দেখাই যাক না, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়!
.
আবার পথ চলার শুরু হল। তখন কলকাতায় বছর-কয়েক হল বিজলিবাতির প্রচলন হলেও ধনীর প্রাসাদ বা চৌরঙ্গীর বা লালদিঘির বড় বড় দোকান ছাড়া বিজলিবাতি দিশিপাড়ায় কমই দেখা যেত। কিন্তু সেদিন বোম্বাইয়ের পথে দেখলুম–দু’পাশের সমস্ত দোকান, এমনকি পানের দোকানেও বিজলিবাতি জ্বলছে আর তারই আলোয় সমস্ত পথঘাট ঝলমল করছে। ধনশালী-বণিক-প্রেয়সী বোম্বাই নগরীর সেই সন্ধ্যাবেলার সজ্জা আমাদের সদ্য-আশ্রয়চ্যুত মনকেও আকর্ষণ করে নিলে। তখনো আমাদের কাছে কয়েকটা টাকা ছিল–ছাতার কারখানায় কুড়িয়ে-পাওয়া বন্ধু যোগেনকে পাঁচটা টাকা দেবার পর থেকে আমরা পয়সা খরচ করা একদম বন্ধ করে দিয়েছিলুম। কারণ এ-দিন যে আসবেই তা আমি ও পরিতোষ দু’জনেই জানতুম। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমাদের পরামর্শ চলতে লাগল। আমরা শুনেছিলুম যে, মালাবার পাহাড়ের সর্বোচ্চ স্থান থেকে রাত্রিবেলা বোম্বাই নগরীর দৃশ্য অতি সুন্দর। পথ চলতে চলতে ঠিক করা গেল–মালাবারে যাওয়া যাক। যাঁহাতক মনে হওয়া অমনি’ সেদিকে পা চালিয়ে দিলুম।
প্রায় তিন ঘণ্টা পথ অতিক্রম করে উঠলুম মালাবারে। সত্যিই সেখান থেকে বোম্বাই শহরের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলুম। দেখতে দেখতে মনে হয় যেন একখানা ছবি দেখছি। রাত্রির অন্ধকারে বড় বড় বাড়িগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছে। তারই মধ্যে খোলা জানলাগুলো দিয়ে দেখা যাচ্ছে আলো–ঠিক যেন জ্যোতির বিন্দু! অনেকক্ষণ ধরে দেখে দেখে আমরা পাহাড়ের নীচে নেমে এসে এক ইরানীর দোকানে ঢুকে বেশ করে পেট ঠেসে খেলুম। ঠিক হল কাল থেকে যত কম সম্ভব অর্থাৎ প্রাণ-ধারণের জন্য যেটুকু না খেলেই নয়–ততটুকু খাওয়া হবে। খাবারের দোকান থেকে বেরিয়ে আবার ঘোরা শুরু হল। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে, এবার একটু আশ্রয়-রাত্রে শোবার মতো একটু জায়গা। এর আগে অভিজ্ঞতা হয়েছে পথে শুলেই পুলিশে ধরে। আর ধর্মশালায় যাবার জো নেই–সেদিন সেখান থেকে একরকম পালিয়েই এসেছি।
ক্রমে রাস্তা জনবিরল হয়ে আসতে লাগল। তখনকার দিনে মোটর-গাড়ি খুবই কম ছিল–মোটর গেলে তখনও লোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখত। ক্রমে ভাড়াটে ফিটন ছাড়া বাড়ির ঘোড়ার গাড়ি চলা বন্ধ হয়ে এল। মাঝে মাঝে কোনো ধনীর মোটর-গাড়ি পথিককে চমকে দিয়ে ছুটে যায়,–ট্রামগুলোও অস্বাভাবিক দ্রুত-গতিতে ছুটতে লাগল।
এদিকে আমাদের গতিও ক্রমে মন্থর হয়ে আসতে লাগল। প্রথম দিনের মতন রাস্তায় শুয়ে পড়তে আর ভরসা পাই না–ধর্মশালাতেও ভয়ে যেতে পারি না। সেদিন তো সেখান থেকে একরকম পালিয়েই এসেছিলুম। পুলিশের ভয়ে কি শেষকালে শহর থেকেই ভাগতে হবে!
নানা চিন্তার সঙ্গে পা ছুটে চলেছে। কোথায় চলেছি জানি না, কোথায় আশ্রয় পাই, রাত্রিটুকুর মতন মাথা গুঁজে পড়ে থাকব, সকাল হতে-না-হতে চলে যাব। কে আশ্রয় দেবে! এই অপরিচিতদের কে আশ্রয় দেবে?
চলতে চলতে আমরা ক্রফোর্ড-মার্কেটের কাছে যখন এসে উপস্থিত হলুম, তখন বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারের বাইরের দোকানগুলি সব বন্ধ। দোকানের আলো নিভে যাওয়ায় রাস্তাগুলি অপেক্ষাকৃত অন্ধকার। দেখলুম বাজারের গা-ঘেঁষে একটা লোক শুয়ে আছে। একবার ভাবলুম–এইখানেই শুয়ে পড়ব নাকি! আশেপাশে পুলিশ-কনস্টেবল নেই, পথে যা দু’ একটি লোক চলছে, সেদিকে কারুর নজর নেই। কি জানি, মনে হল আর একটু ঘুরে দেখা যাক–অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান মেলে কি না।
মার্কেটের আশেপাশে আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। দেখলুম –দু’একজন লোকও এদিক-ওদিক শুয়ে আছে। হঠাৎ নাকে একটা তীব্র আঁশটে গন্ধ এসে লাগায় বুঝতে পারলুম কাছেই মাছের বাজার।
এড়িয়ে সরে যাচ্ছি, এমন সময় দেখা গেল, একটা জায়গায় পাহাড়ের মতন স্তূপাকার আবর্জনা রয়েছে–একদল লোক সেগুলো তুলে কয়েকটা গাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলছে-ওঃ, কী বিশ্রী গন্ধ! কিছুক্ষণ আগেই ইরানীর দোকানে যা খেয়েছিলুম তা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে আরম্ভ করলে।
নাকে কাপড় দিয়ে সেই আবর্জনার গাড়িকে এড়িয়ে আরও একটা স্বপ্নালোকিত গলিপথ দিয়ে ছুটতে গিয়েই চোখের সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য ফুটে উঠল। দেখলুম–ফুটপাতের ওপর সারি সারি ঘুমন্ত নরদেহ পড়ে রয়েছে। সেই অন্ধকারে যতদূর দৃষ্টি যায়–বোধহয় তিন-চারশ হবে। দেখলেই মনে হয়–তারা ভিখিরি শ্রেণীর লোক, বালিশ-বিছানা–কিছুরই ধার ধারে না। সেই ঘুমন্ত দেহগুলির পাশ দিয়ে আমরা চলতে লাগলুম। চলতে চলতে দেখতে পেলুম, তারা সকলেই ঘুমায়নি, কেউ-বা উবু হয়ে বসে বিড়বিড় ক্রছে, কেউ-বা বসে আকাশের দিকে হাত ছুঁড়ছে–স্পষ্টই বোঝা গেল, তারা পাগল। এদের মধ্যে অনেক স্ত্রীলোকও রয়েছে–শিশু বালিকা কিশোরী যুবতী প্রৌঢ়া বৃদ্ধা সব শ্রেণীরই। কেউ বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ, কেউ-বা অর্ধ উলঙ্গ–শতচ্ছিন্ন, অপর্যাপ্ত বসন দিয়ে লজ্জা-নিবারণের কোনো প্রয়াস নেই। এরা নির্বিচারে নিদ্রার কবলে আত্মসমর্পণ করেছে–শুধু প্রকৃতিদেবী চক্ষুলজ্জার খাতিরে তাদের দেহের ওপরে স্বচ্ছ অন্ধকারের আবরণ টেনে দিয়েছেন। আমরা বিস্ময়ে হতবাক্ হয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলতে লাগলুম।
আরও খানিকটা অগ্রসর হবার পর যেখানে লোক আর নেই, সেইরকম একটু জায়গা দেখে ঝেড়ে-ঝুড়ে নিয়ে আমরাও শুয়ে পড়লুম। পরিতোষ হেসে বললে–ভিখিরিদের পল্টনে আজ আরও তিনজন সৈন্য ভর্তি হল।
কিন্তু ভিখিরিদের পল্টনে ভর্তি হলেই বা রাস্তায় শুলেই ঘুম হয় না! রাস্তায় ঘুমোবার সাধনা করতে হয়। সে-সাধনা অভ্যাসের অপেক্ষা রাখে। একদিক থেকে মাছের ও অন্যদিক থেকে সেই আবর্জনার গন্ধে ঘুম ছুটে পালিয়ে গেলেন। অনেক সাধ্য-সাধনার পর ঘুম যখন এলেন, তখন আর রাস্তায় ঘুমোনো চলে না–ভোর হয়ে গিয়েছে।
রাস্তা ছেড়ে উঠে পড়লুম। আবার পথ-চলা শুরু হল। সারারাত্রি ঘুম হয়নি। অবসাদে শরীর ঝিমিয়ে পড়তে লাগল। মুখে চোখে একটু জল দিলে হয়তো সুস্থ হতে পারব, এই আশায় জলের কল খুঁজতে লাগলুম, কিন্তু কলকাতার মতন রাস্তায় টেপা কল কোথাও খুঁজে পেলুম না। এক জায়গায় একটা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেখে কালীচরণ বললে–দাঁড়াও আমি কল খুঁজে বার করছি।
কালীচরণ তো সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। খানিক বাদে সে মুখটুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল। বললে–ইট ভেজাবার কলে মুখ ধুয়ে এলুম।
কালীচরণ আমাদেরও নিয়ে গেল সেখানে। বোম্বাইয়ে কলকাতার মতন ময়লাজলের কারবার নেই, সবই পরিশ্রুত জল। সত্যিই দেখলুম, ইট ভিজোবার কলে জল পড়ছে–আমরা বেশ করে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলুম, কেউ গ্রাহ্যও করলে না।
তারপর এক দোকানে চা খেয়ে বড় মাঠের এক জায়গায় পড়ে লাগানো গেল ঘুম সেই বেলা একটা অবধি। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করতে করতে দেখলুম এক জায়গায় পোলো খেলা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে গেলুম খেলা দেখতে। পোলো-খেলা শেষ হয়ে গেল–দেখলুম এক জায়গায় ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে–তাই দেখতে দাঁড়িয়ে যাওয়া গেল। এমনি করে কোনোরকমে সন্ধে অবধি কাটিয়ে দিয়ে একবেলার খাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে এক ভাজা-ভুজির দোকান থেকে পেট ভরে তেলে-ভাজা খেয়ে আমাদের বাড়ি অর্থাৎ ফুটপাথের দিকে রওনা হওয়া গেল।
কাল রাত্রে দুর্গন্ধের চোটে ঘুমুতেই পারিনি,–ওইখানেই কাছাকাছি অন্য কোনো ভালো জায়গা পাওয়া যায় কি না তারই খোঁজ করতে হবে। গিয়ে দেখলুম তখনই অনেকে সেখানে এসে জুটেছে। এক জায়গায় গোল হয়ে বসে স্ত্রী-পুরুষে মিলে দিব্বি আড্ডা জমিয়েছে– কেউ কেউ টিনের কৌটো-ভৰ্তি চা চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। আমরা সে জায়গাটা ছেড়ে আশেপাশে আরও একটু ভালো জায়গা পাওয়া যায় কি না তারই খোঁজ করতে লাগলুম।
ঘুরতে ঘুরতে দেখলুম–বাজারের পাশেই একটা সরু অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার গলির মধ্যে একজন আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছে। গলিটা বেশি লম্বা নয় ও একমুখো। দুটো-তিনটে দোকানও রয়েছে সেখানে। হিসাব করে দেখলুম যে, দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাবার পর সেখানটায় বেশ অন্ধকার হয়ে যাবে। আর বৃথা অন্বেষণে কালক্ষেপ না করে সেইখানেই অঞ্চল বিছিয়ে দেওয়া গেল।
সবেমাত্র সন্ধে হয়েছে–বাজার তখনো খুব জমজমাট। অপ্রশস্ত ও একমুখো গলি হলেও সেখানে ‘লোক চলাচলের অন্ত নেই। বেলা একটা অবধি ঘুম, তার ওপরে রেড়ির তেলে বা চিনে-বাদামের তেলে ভাজা সেই কচুর পাতা, ওলের পাতা খেয়ে, রাস্তায় শুয়ে শরীর ম্যাজ-ম্যাজ করতে লাগল। কাছেই একটা বিড়ির দোকান থেকে দেড় পয়সার ন’টি বিড়ি ও আধ পয়সার একটা দেশলাই কিনে এনে ধোঁয়া দিয়ে বমি চাপবার চেষ্টা করতে লাগলুম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, সেখানেও দু’একটি করে পথবাসী ও বাসিনী এসে ফুটপাথের ওপরে শুয়ে পড়ল। গোটা তিন-চার লোক—আমাদেরই বয়সি হবে তারা–আমাদের কাছে গোল হয়ে বসে কি খেলতে লাগল। কালীচরণ উঁকি-ঝুঁকি মেরে বললে–লোকগুলো জুয়া খেলছে। এখুনি পুলিশ ধরবে।
কিন্তু তাদের হালচাল দেখে মনে হল না যে, তারা পুলিশ কিংবা কারুর ভয় করে। প্রকাশ্য পথের ওপর বসে চিৎকার করে তারা খেলে চলেছিল। তারা একদিকে খেলছে, আমরা কিছু দূরে বলে বিড়ি.ফুঁকছি–বেশ চলছিল, এমন সময় কালী উঠে গিয়ে তাদের কাছে দাঁড়াল। কালীর চেহারা দেখে তারা প্রথমে মনে করলে যে, সে তাদেরই দলের লোক; কিন্তু খানিকক্ষণ বাদে ওদেরই মধ্যে একজনের সন্দেহ হওয়ায় সে বললে–এই, এখানে কি দেখছিস?
অবশ্য এই প্রশ্নের ভাষা ও ভাব ঠিক যাকে বলে…জনোচিত–তা হয়নি। কিন্তু পথে যাদের জন্ম, সারাজীবন যারা পথবাসী, তাদের কাছ থেকে তার চেয়ে ভালো ভাষা আশা করা যায় না–বিশেষ করে তারা কালীকে নিজেদের দলের লোকই মনে করেছিল এবং সেজন্য তাদের বিশেষ দোষও দেওয়া যায় না। কিন্তু কুগ্রহ যখন ঘাড়ে চাপে, তখন মানুষের বিচারবুদ্ধি থাকে না। তাই আমাদের অমন ঠান্ডা-মেজাজী কালীচরণ হঠাৎ তাদের কথা শুনে চিৎকার করে তেরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু তারা ছিল জাত-পথবাসী, শিশুকাল থেকে অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্ত যুদ্ধ করে জিততে হয়েছে, আমাদের ‘বাবা কালী’র হুমকিকে তারা গ্রাহ্য করবে কেন?
তারাও তেরিয়া হয়ে উঠল–মারামারি একটা হয় আর কি!
ব্যাপার দেখে আমরা কালীকে টানতে টানতে নিয়ে এলুম। সারাদিনের রোদ ও অনাহারে কালীর মাথায় কিরকম গর্মি চড়ে গেল–সে আর কিছুতেই থামতে চায় না। কালী বলতে লাগল–ব্যাটাদের মেরে ঠিক করে দেব–জানে না যে, আমরা ভদ্রলোকের ছেলে, নেহাত বিপদে পড়ে আজ রাস্তায় শুয়েছি–ইত্যাদি ইত্যাদি।
কালীচরণকে টেনে নিয়ে এসে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলুম–ভদ্রলোকের ছেলেই হও আর যাই হও—রাস্তায় এসে শুয়ে আর ভদ্রলোকের অভিমান রাখা চলে না। এ-রাজ্যে ওদের নিয়মই মানতে হবে।
কিছুক্ষণ এই অযথা আত্মাভিমান ত্যাগ করবার উপদেশ দিতেই কালীচরণ তো ঠান্ডা হয়ে গেল, কিন্তু ওদিকে ভিখিরিদের আত্মাভিমান চাঙ্গা হয়ে উঠতে লাগল। তারা সেই যে চেঁচামেচি শুরু করলে–তার আর থামা নেই। কাক মরলে যেমন মুহূর্তের মধ্যে পালে পালে কাক এসে একত্র হয়ে কা-কা করতে থাকে, তেমনি সেই দু’ চারজনের চিৎকারে কোথা থেকে পিলপিল করে তারা এসে জুটতে লাগল। তারা কালীকে দেখিয়ে বলতে লাগল–ও নাকি তাদের বাপ তুলে গালাগালি দিয়েছে–ওকে খুন করে ফেলব।
দেখতে দেখতে ব্যাপার যেরকম দাঁড়াল তাতে কালীর মুখ শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে গেল। শুধু কালীই নয়, আমরাও দস্তুরমতন ভড়কে গেলুম। কি করি! উঠে যে পালাব তারও উপায় নেই, কারণ ভিখিরির পল্টন আক্রমণ না করলেও আমাদের চারিদিকে তারা ঘিরে ফেলেছে, এদিকে রাস্তা দিয়ে লোকজন চলছে, কিন্তু কেউ ব্যাপারটার প্রতি ভ্রূক্ষেপও করছে না।
ভদ্রাভিমানী কালীচরণের উষ্মা তখন কোথায় পলায়ন করেছে, তার কাজলকালী মুখ প্ৰায় ফরসা হয়ে এসেছে। ওদিকে শত্রুপক্ষের লোকবল ক্রমেই বাড়তে লাগল–তাদের গালাগালগুলো স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল।
আমরা যেখানে বসে ছিলুম তারই কয়েক হাত দূরে একটা বই-এর দোকান ছিল। দোকানের সামনে বিলিতি সাময়িকপত্র, ডিটেকটিভ উপন্যাস, নানারকম সব মারাঠী, গুজরাটী বই সাজানো ছিল। দোকানে দুই-একজন লোকও দাঁড়িয়ে সেই বই ওলটাচ্ছিল। উপায়ান্তর না দেখে আমরা গিয়ে সেই বইওয়ালা ও তার হবু খদ্দেরদের বললুম-হুঁজুর, আমাদের প্রাণ যায়–রক্ষে করুন।
লোকটি জিজ্ঞাসা করলে–কি হয়েছে? কে তোমরা?
বললুম–আমরা বিদেশি লোক, আমাদের বাড়ি বাংলাদেশে। আশ্রয়হীন হয়ে আমরা রাস্তায় শুয়ে ছিলুম, কিন্তু এখানকার ওই ভিখিরির দল আমাদের মারতে উদ্যত হয়েছে।
বাঙালির নাম শুনলে বা বাঙালি দেখলে আজ যেমন অন্য প্রদেশের লোক জুতো মারতে উদ্যত হয়–সেদিন তা ছিল না। বাংলাদেশের নাম শুনতেই লোকটি একটি আলমারির পাশ থেকে মাথা-সমান লম্বা একটা বাঁশের লাঠি বের করে দোকানের ভেতর থেকে এক লাফে রাস্তায় এসে পড়ল। যে দু’চারজন খদ্দের সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও বলল–তোমাদের কোনো ভয় নেই–সব ঠান্ডা করে দিচ্ছি।
এদের হাল-চাল দেখে ভিখিরির দল এক মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সৈন্যদলের কাওয়াজ শেষ হলে যেমন তারা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেই রকম। কিন্তু দোকানদার ও তার সেই দু’ তিনজন খদ্দেরে মিলে এগিয়ে গিয়ে তাদের দু’ তিনজনকে ধরে দোকানের কাছে নিয়ে বললে–দেখ, এদের সঙ্গে চালাকি কোরো না। বাংলাদেশের লোক এরা, বোমা তৈরি করতে জানে–একটি মেরে দেবে, তামাম মহল্লা উড়ে যাবে। আমি দোকান বন্ধ করে, বাড়ি যাবার সময় পুলিশে খবর দিয়ে যাব–কাল এসে যদি শুনি এদের জ্বালাতন করেছ, তা হলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
ভিখিরিদের প্রতিনিধি বললে–এরা একের নম্বর মওয়ালী, অর্থাৎ গুণ্ডা-বদমাইস। আমাদের বাপ তুলে গালাগালি দিয়েছে–ওদের কি এমনি ছেড়ে দেব!
আমরা বললাম–সব মিছে কথা।
আমাদের কথা থামিয়ে দিয়ে দোকানদার ওদের বললে–বেশ করেছে বাপ তুলেছে–তোর বাপের নাম কি? বল্–বল্ না–
আশ্চর্য! দোকানদারের কথা শুনে লোকগুলো সব ছত্রভঙ্গ হয়ে সরে পড়তে লাগল। যে দু’চারজন তখনও জটলা পাকাচ্ছিল, দোকানদার তাদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে লাগল–এখানে গোলমাল করলে পুলিশে খবর দিয়ে এখানে শোওয়া বন্ধ করে দেব।
তারপর আমাদের বললে–যাও, তোমরা মজাসে শুয়ে পড়। যদি ওদের কেউ কিছু বলে–তা হলে আমায় জানিও।
আমরাও মজাসে আগেকার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম।