৪.২ রক্ত আর বজ্রের হুঙ্কার

২১. রক্ত আর বজ্রের হুঙ্কার

মহত্ত্বের স্বপ্ন দেখা সহজ। সেটা অর্জন করা কঠিন। কাবুলে নিয়ে আসা কামান আর মাস্কেট চালনায় দক্ষ একদল সৈন্যবাহিনী গঠনে বাবুরী আর তার ভাড়াটে তুর্কী যযাদ্ধাদের ছয় মাস লেগে যায়। ইত্যবসরে কাবুলের অধিবাসীরা যখন ধীরে ধীরে কামানের গর্জন আর মাস্কেটের তীক্ষ্ণ আলোর ঝলকানির সাথে পরিচিত হয়ে উঠছে তখন বাবর বাবুরীর একটা চিঠি আর স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তার ব্যক্তিগত দূত তুরস্কের সুলতানের কাছে পাঠায় ইস্তাম্বুলের বন্দুক-নির্মাতা আর ঢালাই কারখানা থেকে আরো চারশ মাস্কেট আর ছয়টা কামান পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে।

বাবরের জন্য আরো সুখবর অপেক্ষা করছিলো। সে জানতে পারে বাবুরীর সাথে কাবুলে আসা ধূসর দাড়ি শোভিত ওস্তাদ তূর্কী গোলন্দাজ আলী কুলীর দক্ষ নির্দেশনায় তার নিজস্ব অস্ত্র নির্মাতারা নতুন অস্ত্র নির্মাণে দ্রুত কুশলতা অর্জন করছে। মাস্কেট আর কামানের ব্যাপারে তার অসাধারণ দক্ষতা- বিশেষ করে পাঁচ বছর আগে, ম্যাচলকের চিড় ধরা ব্যারেল বিস্ফোরিত হয়ে তার ডান হাতের দুটো আঙ্গুল উড়ে গিয়েছে।

 রাতের পর রাত, বাবর বাবুরীর সাথে বসে কথা বলেছে, তাকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে কামান আর ম্যাচলক ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব যুদ্ধের ব্যাপারে সম্ভাব্য সবকিছু জানতে চেষ্টা করেছে। কোনো পরিস্থিতিতে এই আয়ুধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর? সম্মুখ সমরে নাকি অবরোধ প্রয়াসে? ঘোড়সওয়ার বাহিনী আর তীরন্দাজদের হাত থেকে ম্যাচলক বন্দুকধারী আর গোলন্দাজদের কিভাবে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব? সনাতন আক্রমণের ধারায় এই অস্ত্র কি পরিবর্তন এনেছে? যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহারের আগে সে এদের বিষয়ে সবকিছু ভালোমতো জেনে নিতে চায়।

শহরের বিশাল খিলানাকৃতি সরাইখানা। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বণিকের দল খোলা প্রাঙ্গণের মাঝে অবস্থিত উঁচু পাথরের মঞ্চে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করার পাশাপাশি গল্পগুজব করে থাকে। সেখানে বাবর তার লোকদের খবর সংগ্রহের জন্য পাঠায়। বাবরের লোকেরা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন করে। হিন্দুস্তান থেকে আগত বণিকদের কাছ থেকে ইবরাহিম লোদীর দরবারের জৌলুস, গোলাপী বেলেপাথর দিয়ে সজ্জিত বিশাল প্রাসাস নিয়ে বারফট্টাই করতে শোনা যায়। কিন্তু তিনি- বা হিন্দুস্তানের অন্য কোনো শাসক কামান বা ম্যাচলকের অধিকারী সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে সামান্যতম গল্পও তারা বের করতে পারে না।

কিন্তু, এখন জানুয়ারি মাসের এক ঝকঝকে শীতল দিনে, বাবর অবশেষে এসব অস্ত্রের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ এমন শত্রুর বিপক্ষে এর প্রতিক্রিয়া নিজের চোখে দেখবার জন্য বাবর একটা অভিযানে বের হয়। কাবুলের করদ রাজ্য, বাজারের নতুন সুলতানকে সে শত্রু হিসাবে বেছে নেয়। যে নতুন রাজত্ব পেয়ে যৌবনের উদ্দীপনায় বাবরকে প্রথা অনুসারে বাৎসরিক শস্য, ষাঁড় আর ভেড়ার পাল উপঢৌকন হিসাবে দিতে অসম্মতি জানিয়েছে।

পাহাড়ের অনেক উঁচুতে ওক, জলপাই আর সোমরাজ গাছের ঘন অরণ্যে, ময়না পাখির কলরবে মুখরিত স্থানে বসবাসরত, বাজাউরীরা বিচিত্র ধর্মবিশ্বাসের অধিকারী পৌত্তলিক সম্প্রদায়। কোনো বাজাউর রমণী মারা গেলে, তারা তার শবদেহ একটা খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে সেটার চার পায়া ধরে উঁচুতে তুলে। মৃত রমণী যদি আচারনিষ্ঠ জীবনযাপন করে থাকে, বাজাউররা বিশ্বাস করে তাহলে লোকদের উঁচুতে তুলে ধরা খাঁটিয়া এমন ভীষণভাবে কেঁপে উঠবে যে শবদেহ মাটিতে নিক্ষিপ্ত হবে। তখনই কেবল তারা শোকের কালো লেবাস পরিধান করে বিলাপ করা শুরু করবে। কিন্তু যদি, মৃত রমণীর শবদেহ কোনো ধরণের কম্পন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তারা সেটাকে অশুভ জীবনের ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করে এবং মৃতদেহটা তখন দায়সারা ভঙ্গিতে আগুনে নিক্ষেপ করা হয় পুড়ে ছাই হবার জন্য।

অদ্ভুত এসব লোকদের শাসক তাকে একটা মোক্ষম সুযোগ দিয়েছে। বাবুরীকে পাশে নিয়ে, পদাতিক আর গোলন্দাজ বহরের একটা চৌকষ দলের নেতৃত্ব দিয়ে কাবুল থেকে বের হয়ে আসবার সময়ে বাবর ভাবে, সদ্য প্রশিক্ষিত দলটাতে ম্যাচলকধারী সৈন্য আর গোলন্দাজরা রয়েছে। যাদের প্রত্যেককে আলী কুলী নিজে আজকের অভিযানের জন্য মনোনীত করেছে। আর চারটা কামান রয়েছে। তারা উত্তরদিকে বাঁক নিয়ে পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে বাজাউরের দিকে এগিয়ে যায়। আগেকার দিনে, এধরণের হামলার সময়ে বাবর আর তার অনুগত বাহিনী দ্রুত নির্মম ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে অতর্কিতে শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কিন্তু যাঁড়ের গাড়ির পেছনে বেঁধে গড়িয়ে নেয়া কামানের কারণে তাদের অগ্রসর হবার গতি হ্রাস পেয়েছে যা পর্যবেক্ষকদের সতর্ক সংকেত পাঠাবার সুযোগ খামোখাই বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাবর ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে যাবার সময়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। মুখের উপরে এসে আছড়ে পড়া শীতল বাতাসে তার কোনো ভাবান্তর ঘটে না। কাবুল ত্যাগ করার ঠিক আগে আগে একটা দিনপঞ্জিকায় পাঠ করা অনুচ্ছেদের কথা তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে: “তৈমূর সাহসী আর পরাক্রমশালী যোদ্ধাদের বিশেষ খাতির করতেন। যাদের সাহায্যে তিনি আতঙ্ক আর বিভীষিকার ঝড় বইয়ে দিতেন এবং সিংহের মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন প্রতিপক্ষকে এবং এইসব যোদ্ধা আর যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের নৈপূণ্য ব্যবহার করে তিনি পর্বতপ্রমাণ প্রতিবন্ধকতা অনায়াসে টপকে যেতেন…” অনুচ্ছেদটায় কাপুরুষদের জন্য তৈমূরের তিরস্কারের কথাও বলা হয়েছে। কোনো যোদ্ধা, তার পদমর্যাদা যাই হোক, যুদ্ধ ক্ষেত্রে কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে তিনি তাদের মাথা মুড়িয়ে পুরো দেহ লাল রঙে রাঙিয়ে দিতেন। তারপরে তাদের মেয়েদের কাপড় পরিয়ে বেধড়ক পিটাতে পিটাতে সহযোদ্ধাদের গালিগালাজের মাঝে অস্থায়ী শিবিরের ভিতর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। তৈমূর ক্ষমা করতে জানতেন না।

বাবর নির্মমতার প্রয়োজনীয়তা বোঝে। মাত্র তিন রাত্রি আগের কথা। রাতের বেলা আকস্মিকভাবে শিবির পরিদর্শনে বের হয়ে সে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পাঁচজনকে ঘুমাতে দেখে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবার আদেশ দেয়। তাদের বাম কান কেটে ফেলা হয় এবং সেটা গলায় ঝুলিয়ে বাবরের বাকি সৈন্যদের সামনে তারা রক্তাক্ত অবস্থায় হেঁটে যায়। কিন্তু তৈমূরের মতো একটা সাম্রাজ্য সৃষ্টি করে টিকিয়ে রাখতে সে যদি সফল হতে চায়, তাহলে তাকে আরো কঠোর হতে হবে। এবং নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করতে হলে দ্বিতীয়বার না ভেবেই তাকে কঠোরতম সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত হতে হবে।

 “সুলতান।” বাবরের একজন গুপ্তদূত, শীতের তীব্রতার হাত থেকে বাঁচতে ভেড়ার চামড়া দিয়ে ভালোমতো মোড়ান অবস্থায় তার দিকে এগিয়ে আসে। “আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে এখান থেকে বিশ মাইল পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকায় বাজাউর নদীর তীরের এক দূর্গে সুলতান তার রাজধানী ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে।”

“তুমি নিশ্চিত জানো- এটা কোনো ফাঁদ না?”

“আমরা তাকে তার সৈন্যবাহিনী, সাথে শহরের লোকজন আর শিবিরে বসবাসকারীরাও রয়েছে, নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে পুরোটা পথ অনুসরণ করেছি।”

 “আমাকে দূর্গটা কেমন বলো।” বাবর ঘোড়ার পর্যানের উপরে ঝুঁকে বসে, তার গালপাট্টার উপরে দেখা যাওয়া সবুজ চোখ ধকধক করে।

“দূর্গটা একটা বিশাল চতুর্ভূজাকৃতি মাটির তৈরি স্থাপনা। দোতলার সমান উঁচু, নদীর তীরে একটা গিরিসঙ্কটের পাশে অবস্থিত…আমি আপনাকে এঁকে দেখাই।”

গুপ্তদূত তার ঘোড়া থেকে নেমে, পায়ের কাছের মাটি পরিষ্কার করে এবং নিজের খঞ্জরের ডগা দিয়ে উত্তরের গিরিসঙ্কটের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাশে একটা চারকোণা মিনারের নকশা আঁকে। “সুলতান, অনুগ্রহ করে দেখেন। বাকী তিনদিক উঁচু উঁচু করকট গাছের বন দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে এই দরজাটাই ভেতরে প্রবেশের বা বাইরে বের হবার একমাত্র পথ…”

বাবর আর বাবুরী নিজেদের ভিতরে দৃষ্টি বিনিময় করে। এর চেয়ে ভালো সংবাদ আর হতে পারে না। সুলতান ভাবছে তিনি একটা দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছেন। আসলে তিনি একটা ফাঁদে আঁকা পড়েছেন।

*

চারদিন পরে, দূর্গ থেকে সামান্য দূরে যে সংক্ষিপ্ত সমতল ভূমি রয়েছে। সেখানে স্থাপিত সামরিক শিবিরে বাবর তার লাল রঙের সেনাপতির তাঁবুতে দাঁড়িয়ে হাতে চামড়ার দাস্তানা পরিধান করে। সে যেমন আশা করেছিলো, আগের দিন সন্ধ্যাবেলা সুলতান তার পাঠানো আত্মসমর্পন আর ক্ষমা ভিক্ষার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এবার সময় হয়েছে তাকে তার অবাধ্যতার জন্য শিক্ষা দেবার। রাতের আঁধারে তার লোকেরা ষাঁড়ের গাড়ির পেছনে বেঁধে নিয়ে আসা চারটা কামান দূর্গের প্রবেশদ্বার থেকে চারশ গজ দূরে স্থাপন করেছে। যতোটা নিরবে সম্ভব, আলী কুলীর লোকেরা মাটির ঢিবি তৈরি করে তাতে কামানগুলো স্থাপিত করে তারপরে সেগুলো লতাপাতা, ঝোপঝাড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে যতোক্ষণ না আক্রমণের সময় হয়।

আক্রমণ শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। বাবরের সব সেনাপতিকে আলাদা আলাদা আদেশ দেয়া হয়েছে। দূর্গের দক্ষিণ দিকের সমভূমির উপর দিয়ে মূল বাহিনী এগিয়ে গিয়ে প্রথমেই সামনে থেকে আক্রমণ শুরু করবে। সেই ফাঁকে, ম্যাচলকধারী সৈন্যরা তাদের অনুসরণ করবে, দূর্গপ্রাকারের উপরে অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের নিষ্ক্রিয় করতে। অবশেষে বাবর যখন সময় হয়েছে বলে মনে করবে, সে কামানগুলোকে কার্যকরী করে তুলবে।

 ইস্পাতের মতো ধূসর আকাশের নিচে, বাবর আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেয়। দূর্গের পশ্চিম কোণের তিনশ গজ নিচে অবস্থিত একটা নতুন সুবিধাজনক স্থানের প্রান্তে, বাবর আর বাবুরী পাশাপাশি ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, পাথুরে ঢাল বেয়ে দূর্গের দিকে অশ্বারোহী তীরন্দাজদের ছুটে যেতে দেখে। আগুয়ান ঘোড়ার ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে তার ক্রমাগত তীর ছুঁড়ছে। দূর্গের দেয়ালের কাছে পৌঁছে, তারা সাথে নিয়ে আসা মইগুলো দূর্গের প্রবেশপথের বামদিকের দেয়ালে স্থাপন করে। তারা যখন এসব করছে, আলী কুলী আর তার ম্যাচলকধারীর দল দূর্গ প্রাকারের দেয়ালের উপরে প্রতিরোধী যোদ্ধাদের কেউ উঁকি দিলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে।

দু’জন বাজাউরি যোদ্ধা সাথে সাথে ধরাশায়ী হয়। বাবর যেখানে অবস্থান করছে। সেখান থেকেই সে প্রতিরোধকারীদের হতাশা আর ক্ষোভ অনুভব করতে পারে। আরো অনেক যোদ্ধা ধরাশায়ী হয়। বাজাউরি যোদ্ধার দল যখন বুঝতে পারে গনগনে লাল ধাতব বলগুলো তাদের ঢাল আর বর্ম ভেদ করতে সক্ষম তখন দূর্গ প্রাকারের পেছন থেকে তারা টুপটাপ খসে পড়তে শুরু করে।

 বাবরের লোকেরা ততোক্ষণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশাপাশি দুজন করে মই বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে। মই আর দেয়ালের সাথে যতোটা সম্ভব নিজেদের চেপে ধরে রেখে তারা তাদের গোলাকৃতি ঢাল দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে উপর থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাত থেকে বাঁচতে। আলী কুলী ইতিমধ্যে নিজের লোকদের গুলিবিদ্ধ হবার আশঙ্কায় ম্যাচলকধারীদের গুলি বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছেন। বাবা ইয়াসাভাল, হিরাত থেকে আগত অসীম সাহসী এক যোদ্ধা। প্রথমে দূর্গের ছাদে উঠে দাঁড়ায় এবং দ্বাররক্ষীর প্রকোষ্ঠের দিকে অমিত বিক্রমে এগিয়ে গিয়ে, প্রধান প্রবেশদ্বার আটকে রাখা কালো রঙের ধাতব বেষ্টনী সে তার সাথের যোদ্ধাদের নিয়ে গুটানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মাস্কেটের তাণ্ডব বন্ধ হতে প্রতিরোধকারীরা এবার পুনরায় সাহসী হয়ে উঠে। বাবর তাদের দৌড়ে দূর্গপ্রাকারে উঠে এসে, বাবা ইয়াসাভালের সাথের মুষ্টিমেয় সংখ্যক যোদ্ধাদের উপরে কাঁটাওয়ালা গদা আর রণকুঠার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দ্বাররক্ষীর প্রকোষ্ঠ থেকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে।

বাবর আড়চোখে বাবুরীর দিকে একবার তাকালে, সে সাথে সাথে বন্ধুর মনের কথা বুঝতে পেরে, ঢালের আরো কিছুটা সামনে লুকিয়ে রাখা কামান আর গোলন্দাজ বাহিনীর দিকে এগিয়ে যায়। বাবর তাদের কামানগুলোর চারপাশ থেকে লতাপাতার আড়াল সরিয়ে নিয়ে প্রতিটা ব্যারেলের নতি ঠিক করতে দেখে।

 তারা তারপরে দ্রুত বারুদের থলে আর পাথরের গোলা ব্যারেলে ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে স্পর্শ-রন্ধ্রে গোঁজ প্রবিষ্ট করিয়ে ফাটলের চারপাশে আরো কিছু বারুদ ছিটিয়ে দেয়। অবশেষে, গোলন্দাজ বাহিনীর ভিন্ন চারজন তোক সামনে এগিয়ে আসে সলতেতে আগুন ধরাবে বলে- বাবর এতোদূর থেকে কেবল তেলে ভেজানো দড়ির দৈর্ঘের মাথার অংশটুকু দেখতে পায়। বাবুরী এবার তার ফিরে তাকালে সে তরোয়াল মাথার উপরে তুলে বৃত্তাকারে আন্দোলিত করে, আগুন জ্বালাবার আদেশ দেয়। সহসা, যুদ্ধক্ষেত্রের পরিচিত শব্দ ছাপিয়ে বাজাউরবাসীদের অশ্রুতপূর্ব গমগমে তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ বাতাস চিরে ফালা ফালা করে দেয়।

প্রথম কামানের গোলাটা আগে থেকে নির্ধারিত দূর্গের প্রবেশপথের ডানপাশে দক্ষিণ-পূর্বদিকের বিশ ফিট উঁচু দেয়ালের নিম্নাংশে আছড়ে পড়ে। ভূমি সমতল থেকে প্রায় দশ ফিট উঁচুতে গোলাটা আঘাত হানলে ইটের ভাঙা টুকরো আর ধূলোর মেঘে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়। দ্বিতীয় গোলাটা প্রথমটার ঠিক নিচে, তৃতীয় আর চতুর্থটাও একই স্থানে আঘাত করে। ধোয়া আর ধূলোর মেঘ সরে গেলে, দেয়ালের একটা সামান্য অংশকে ভূপাতিত অবস্থায় এবং আশেপাশের দেয়ালে বিশাল সব ফাটলের জন্ম হয়েছে দেখা যায়। বাবরের সেনাবাহিনীর একটা অংশ, এতোক্ষণ যাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিলো, তারা এবার ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে হুড়মুড় করে দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করে।

 হতভম্ভ প্রতিরোধকারীরা পালাতে শুরু করে। কেউ কেউ তাদের বোধাতীত আয়ুধ যা ইতিমধ্যে দূর্গের দেয়ালের একাংশ গুঁড়িয়ে দিয়েছে তা পুনরায় গর্জে উঠবার আগে, দূর্গের ছাদ থেকে দড়ির সাহায্যে দ্রুত নামতে গিয়ে তাড়াহুড়োর কারণে পিছলে যায় এবং নিচে আছড়ে পড়ে।

 বাবরের তীরন্দাজ বাহিনীর নিক্ষেপ করা তীরের আড়াল আচ্ছাদনের মতো ব্যবহার করে ম্যাচলকধারীরা এগিয়ে গিয়ে তাদের অঙ্কুশ স্থাপন করে এবং পলায়নপর যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। বাবর দু’জন বাজাউর যোদ্ধাকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে। একজনের কপালে মাস্কেটের ধাতব গোলক আঘাত করে তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অন্যজন- হলুদ পাগড়ি পরিহিত এক দানব বুকের কাছটা খামচে ধরে আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় ঝটফট করতে করতে চিৎকার করছে। তার কুঁকড়ে থাকা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু বাকী অনেকেই হোঁচট খেতে খেতে দৌড়ে গিয়ে দূর্গের পূর্বদিকের দেয়াল টপকে নিচের ঢালে লাফিয়ে পড়ায় বাবরের ম্যাচলকধারী নিশানাবাজদের পক্ষে তাদের সবাইকে ঘায়েল করা সম্ভব হয় না।

“তাদের তাড়া করো!” বাবর তার রক্ষীবাহিনীর একাংশকে আদেশ দেয়। তারপরে, কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে, সে দূর্গের প্রধান তোরণের ঢাল দিয়ে দুলকিচালে ঘোড়া ছোটায়। যেখানে তার লোকেরা ইতিমধ্যে দ্বাররক্ষীর প্রকোষ্ঠ সাফল্যের সাথে দখল করে নিয়েছে এবং লোহার বেষ্টনী তুলে দিয়েছে। সে প্রবেশপথের নিকটে পৌঁছালে বাবুরী তার সাথে এসে যোগ দিলে তারা একসাথে ভেতরে প্রবেশ করে।

 “সুলতানের জয় হোক!” বাবর দূর্গ প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলে, ঘামে ভেজা মুখ আর বাম কানের উপরে একটা আঁকাবাঁকা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়া অবস্থায় বাবা ইয়াসাভাল তাদের স্বাগত জানায়। “বাজাউরি’র সুলতান মৃত- দূর্গপ্রাকারের উপর থেকে তিনি গিরিসঙ্কটের অতলে লাফিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। আমরা অসংখ্য লোককে বন্দি করেছি। আপনার পরবর্তী আদেশ কি?”

“তৈমূর আতঙ্কের সর্বগ্রাসী স্রোত বইয়ে দিয়ে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা পর্যদস্ত করতেন…” শব্দগুলো- সম্ভবত নিষ্ঠুর, কিন্তু উদ্দেশ্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার বাবরের মস্তিষ্কে অনুরণিত হয়। “শাহী মন্ত্রণা সভার সবাইকে হত্যা করো। তারা আত্মসমর্পণের সুযোগ পেয়েও সেটা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বাকীদের গ্রেফতার করে নারী আর শিশুদেরও- কাবুলে প্রেরণ করো। তারা সেখানে আমার লোকদের দাস হিসাবে কাজ করবে।

“এবার বলেন? আপনার কি মনে হয়? আমরা কেমন দেখিয়েছি?” তারা অধিকৃত দূর্গ আর কামানের গোলায় তার ক্ষতিগ্রস্থ অংশ পর্যবেক্ষণকালে বাবুরী জিজ্ঞেস করে।

 বাবর তার মনোভাব প্রকাশ করার মত শব্দ খুঁজে পেতে সময় নেয়। তার নতুন অস্ত্রের বরাভয়ে দূর্গটা কয়েকদিন, বা সপ্তাহ কিংবা মাসের বদলে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দখল করা সম্ভব হয়েছে। অসীম সম্ভাবনার একটা দ্বার যেনো খুলে গিয়েছে। সে বাবুরীর কাঁধ আঁকড়ে ধরে। “আজ আমরা এমন একটা রীতিতে যুদ্ধ করেছি যা আমার পূর্বপুরুষদের কাছে একেবারেই অজানা ছিলো। যা দেখে তারা হয়তো অভিভূত হতো…”

“বেশ কথা, কিন্তু আপনাকে তাহলে উফুল্ল দেখছি না কেনো?”

“প্রায়ই এমন হয়েছে যে আমি অসীম সম্ভাবনার আলোকে নিজেকে স্নাত করেছি যা কখনও অর্জিত হয়নি। তুমি নিজেও কি সেটা প্রায়শই বলো না? আমি যতোক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছি যে আমরা প্রস্তুত হয়েছি, তার আগে আমি তাড়াহুড়ো করে হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে চাই না।”

“কিন্তু আজ সেই প্রস্তুতির সূচনা হয়েছে, তাই না?”

*

পরবর্তী সপ্তাহগুলো বাবরকে তার যুদ্ধাস্ত্র আর যুদ্ধ কৌশল শানিয়ে নেবার আরো সুযোগ দান করে। বিজিত আর নতজানু বাজাউর থেকে বাবর তার সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে হিন্দুস্তানের সীমান্ত বরাবর বুনো, পাহাড়ি এলাকার দিকে এগিয়ে যায়। এবারও প্রতিপক্ষ তার কামানের হুঙ্কার কিংবা মাস্কেটের গর্জনের সামনে দাঁড়াতেই পারে না।

বস্তুতপক্ষে, বাবরের আগমনের সংবাদ পেতে, ভীতসন্ত্রস্ত গোত্রপতিরা নধর ভেড়া, মটকা ভর্তি শস্যদানা, তেজী ঘোড়া কিংবা সুন্দরী রমণীর সাথে তোষামদপূর্ণ আনুগত্যের বার্তা পাঠিয়ে নিজেদের বশংবদ প্রমাণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। তাকে তুষ্ট করে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত নিজেদের গ্রাম আর মাটির দূর্গসমূহ রক্ষা করতে তাদের আগ্রহ দেখে বাবরের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। কেউ কেউ এমনকি মুখে ঘাস নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়- বাবর তার তরুণ বয়সে অন্যসব বুনো উপজাতির ভিতরে আত্মসমর্পণের এই অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছিলো।

কিন্তু এই সব তুচ্ছ সর্দারদের বশ মানাবার আকাঙ্ক্ষা তার মাঝে ইতিমধ্যেই কমতে শুরু করেছে। রাতের বেলা সে ঘুমাবার চেষ্টা করলে নানা দৃশ্যকল্প তার স্বপ্নে এসে হানা দেয়। এক বিজেতার চেহারা-”মোমবাতির মতো চোখ যেখানে কোনো উজ্জ্বলতা নেই”- তার আর তার উদ্দেশ্যের মাঝ দিয়ে বহমান সিন্ধু নদী পর্যবেক্ষণ করছে। মানুষকে পরাস্ত করতে তৈমূর সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কখনও কোনো পার্থিব বাঁধা তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি কোনো পাহাড় বা নদী তাকে কখনও হতোদ্যম করতে পারেনি। বাবরও ঠিক তেমনই হবে। পনের বছর আগে, গ্রীস্মের প্রচণ্ড দাবদাহে, সে আর বাবুরী সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে ছিলো। চমকে উঠে ঘুম ভেঙে গেলে সে আবারও নিজের ভেতরে সেই একই কাজ করার একটা উদগ্র বাসনা অনুভব করে। যা সে পরে কখনও ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারেনি- না বাবুরীর কাছে, না নিজের কাছে…কিন্তু বাসনাটা দিন দিন তার ভেতরে কেবল বেড়েই চলে। ভবিষ্যত অভিযানের ভাবনা মন থেকে সরিয়ে রেখে, বাবর তার সেনাবাহিনীকে পূর্বদিকে ঘুরিয়ে নেয় এবং মার্চ মাসের এক শীতের সকালে, প্রশস্ত, দ্রুত বহমান একটা নদীর দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠে। নিজের লোকদের অনুসরণের জন্য অপেক্ষা না করে সে ঠাণ্ডা, কঠিন জমির উপর দিয়ে তুড়গ বেগে ঘোড়া দাবড়ে যায়। তীরের কাছে পৌঁছে, সে তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামে, পরণের কাপড় টেনে খুলে এবং বরফগলা নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা সুদূর তিব্বতের কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে বয়ে আসছে।

পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হওয়াতে আগ্রহের প্রথম ঝাপটা তার নিমেষে কেটে যায় এবং বরফশীতল পানি কয়েক ঢোক গিলে ফেলতে তার মনে হয় গলায় বুঝি বরফ জমে গিয়েছে। তীব্র স্রোত তাকে ইতিমধ্যে অনেকদূর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে এবং তীরে দাঁড়িয়ে থাকা তার লোকেরা আতঙ্কে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আরেকবার গভীর শ্বাস নিয়ে এবার সে মুখ পানির অনেক উপরে রাখে- সে তাকে ভাসিয়ে। নিতে চাওয়া প্রাকৃতিক শক্তি নাকচ করে দেহের পুরো শক্তি দিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করে। ভেসে যাওয়া থেমে গিয়ে পেছনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু হতে সে উফুল্ল হয়ে উঠে। সে বিজয়ী হয়েছে। কিছু একটা পানিতে আছড়ে পড়ে এবং বাবুরীর মাথা পানির নিচে থেকে তার পাশে ভেসে উঠে।

“মূর্খের বাদশা, এসব আপনি কি শুরু করেছেন?” বাবুরীর মুখ ঠাণ্ডায় প্রায় নীল হয়ে উঠেছে। “আর পাগলের মত হাসছেন কেন?”

 “আমার সাথে সাঁতরে অপর পাড়ে চলো, সেখানে গিয়ে আমি তোমাকে খুলে বলবো।”

জলাবর্ত আর তীব্র স্রোতের ভিতর দিয়ে তারা একসাথে এগিয়ে যায় যতোক্ষণ না অপর পাড়ে গিয়ে পৌঁছে এবং রুক্ষ্ম, অনুজ্জ্বল ধুসর-হরিৎ বর্ণের ঘাসের গোছ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নিজেদের পানি থেকে টেনে তুলে। বাবর মাটিতে শুয়ে পড়ে, তখনও খিকখিক শব্দে হাসছে। যদিও তার পুরো দেহ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। এবং তার শীতল ত্বক কাটা কাঁটা হয়ে উঠেছে।

“এবার বলেন এসবের মানে কি?” মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে, বাবুরী ঘাড় নিচু করে তার দিকে তাকায় এবং দু’হাতে নিজেকে চাপড় মেরে উষ্ণ রাখতে চেষ্টা করে।

“গতরাতে আমি ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। সিন্ধুর এতো কাছে রয়েছি এই ভাবনাটাই আমার কানে নদীর স্রোতের মতো রক্তের গর্জন সৃষ্টি করে। আমি একটা মানত করেছিলাম, আল্লাহতালা যদি হিন্দুস্তানে আমাকে বিজয়ী করেন তবে আমার নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিটা নদী আমি সাঁতরে অতিক্রম করবো।”

 “আপনি এতো তাড়াতাড়ি সাঁতার শুরু না করলেও পারতেন…কোনো কিছু জয় করা থেকে আপনি এখনও অনেক দূরে রয়েছেন।”

বাবর উঠে বসে। “আমাকে এটা করতেই হতো। আমি কিভাবে সিন্ধু নদী দেখে সেটা অতিক্রম না করে থাকতে পারি…? অবশ্য আমাদের এবার কাবুলে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু শীঘ্রই আবার আমরা ফিরে আসবো। আমি এবার যখন ফিরে আসবো তখন এই ভূখণ্ড জানবে যে আমি এটা অর্জন করেছি। এই অঞ্চল আমাকে স্বাগত জানাবে…”

 “আর তার আগে আমার ধারণা আমাদের বোধহয় আবার সাঁতরে ফিরে যেতে হবে?”

“অবশ্যই।”

*

বরফশীতল সিন্ধু নদের পানিতে সাঁতার কাটবার আট মাস পরে একদিন ভোরের প্রথম প্রহরে, বাবর মাহামের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে। যেখানে সে শেষবারের মতো তার রেশম কোমল দেহের ভাঁজে আর তার চন্দন সুবাসিত দীঘল কেশের জটলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছে এবং সেখান থেকে একাকী সে নিজের নিভৃত কামরায় ফিরে আসে। কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের নিচে অবস্থিত তৃণভূমি থেকে ভেসে আসা রণদামামার গুরুগম্ভীর আওয়াজ সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ভোরের আধো- আলোতে জ্বলজ্বল করতে থাকা সেনাছাউনির অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। গতকাল, এই একই বারান্দা থেকে, বাবুরী পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, সে তার লোকদের জন্য নিজের মহাপরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলো।

“তৈমূরের হিন্দুস্তান আক্রমণের সময় থেকে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য এটা একটা ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তি। তার প্রধান উত্তরাধিকারী হিসাবে আমি আগামীকাল যাত্রা আরম্ভ করবো। যারা আমাকে আমার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে তাদের কবল থেকে সেটা উদ্ধারের নিমিত্তে। চারমাস আগে আমি হিন্দুস্তানের অধিকাংশ স্থানের স্বঘোষিত শাসকের- দিল্লীর ইবরাহিম লোদীর কাছে একটা বাজপাখি উপহার হিসাবে পাঠিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, সে যদি আমাকে তার অধিরাজ হিসাবে স্বীকার করে নেয়, তবে আমার অধীনস্ত করদ রাজ্যের শাসক হিসাবে আমি তাকে মনোনীত করবো। সে বাজপাখিটার মাথা কেটে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়েছে। সে এবার কাবুলের সুলতান এবং তৈমূরের বংশধরকে অপমানিত করার জন্য নিজের সিংহাসন খোয়াবে।”

 বাবরের প্রজারা তার কণ্ঠের তেজোদীপ্ত স্বরের প্রতি গর্জে উঠে সম্মতি প্রকাশ করে। যদিও সুলতান ইবরাহিম কেবলই একটা তাদের কাছে এবং আগ্রা ও দিল্লীতে তার প্রাসাদ এবং দূর্গ সম্বন্ধে, তার বিপুল বৈভব এবং বিশাল সেনাবাহিনী কিংবা শাসকদের জোট- যাদের কেউ তারই মতো মুসলমান, কেউবা মূর্তি উপাসক- যারা তার অধীনস্ত সামন্তরাজ এসব কিছু সম্বন্ধেই তাদের কোনো ধারণাই নেই। বাবর তার বক্তব্যের প্রতি তাদের এইরকম কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই সমর্থন করতে দেখে মনে মনে হাসে। একথা সত্যি যে হিন্দুস্তানের প্রতি তার একটা জন্মগত অধিকার রয়েছে। কিন্তু তার সত্যিকারের জন্মগত অধিকার ছিলো সমরকন্দ। সেখানকার স্মৃতি তাকে আপুত করে তোলে কিন্তু সে এটাও জানে সেখানে সে আর কখনও শাসন করতে পারবে না।

 “সুলতান, আপনার বোন কথা বলতে চান আপনার সাথে।” একজন পরিচারক এসে বাবরের কল্পনায় ছেদ টেনে দেয়।

 “অবশ্যই। তিনি কি আমাকে তার কাছে যেতে বলেছেন?”

 “না, সুলতান। তিনি নিজেই এসেছেন।”

খানজাদা বারান্দা তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাবর আর সে সেখানে একা হওয়া মাত্র, খানজাদা নেকাবের আড়াল অপসারিত করে। দেয়ালের কুলঙ্গিতে রাখা মশালের আলো তার মুখের গড়ন আর ত্বকের বলিরেখা অনেকটাই কোমনীয় করে তোলে। বাবর যে রাতে আকশির দূর্গে ফারগানার সিংহাসনে নিজের অধিকার ঘোষণা ঘোষণা করেছিলো, সেদিন যে মেয়েটা ভাবগম্ভীর ভঙ্গিতে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি আলমগীর এনে তার হাতে তুলে দিয়েছিলো, সেই মেয়েটাকেই যেনো এখন আবার দেখতে পায়।

“আমি জানি তুমি একটু পরে জেনানামহলে আমার আর তোমার স্ত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাবে। কিন্তু আমি তোমার সাথে কিছুটা সময় একাকী কাটাতে চাইছিলাম। ফারগানায় আমাদের কৈশোরে জীবন যখন অনেক বেশি নিরাপদ আর প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ছিলো, সেই সুখী দিনগুলো স্মরণ করতে কেবল আমরা দু’জনই আজ বেঁচে আছি। আমাদের উপর দিয়ে এরপরে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছে, ভালো মন্দ দু’ধরণের…” সে দম নেবার জন্য থামে। “আমাদের জীবন হয়তো অনেক। সহজ আর ঘটনাহীন হতে পারতো, কিন্তু নিয়তির সেটা কাম্য না। তুমি হিন্দুস্তানে তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। যা ইতিহাসের পাতায় আমাদের পরিবারের মর্যাদা নিষ্পন্ন করবে। আমাদের মরহুম। আব্বাজান, আম্মিজান আর নানীজান আজ বেঁচে থাকলে যেমনটা চাইতেন, আমি আশা করি এই অভিযানে তুমি সেসব কিছু অর্জন করো। আমরা যে জন্য বেঁচে আছি- বিজয় আর প্রভুত্ব স্থাপন তাকে ইঙ্গিতপূর্ণ করে তুলবে… কিন্তু আমার আদরের ছোট ভাই নিজের প্রতি যত্ন নিতে ভুলে যেও না। “ খানজাদার কিশমিশের মতো চোখ অনেকটা তাদের নানীজানের মতোই কিন্তু অনেক বেশি গাঢ়- অশ্রুতে টলটল করে।

 “আমি, আমার প্রথম টাট্টু ঘোড়াটাকে আচমকা বাঁক নেওয়াতে গিয়ে পড়ে গেলে তুমি যেমন আমাকে বকুনি দিয়েছিলে সাবধান হতে। ঠিক সেভাবে, নিজের খেয়াল রাখবো।” বাবর তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। “আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক একটা কথা আজ রাতে জেনে রাখো, আমি কেবল আমরা নিয়তি অনুসরণ করছি আর যে কারণে আমার জন্ম হয়েছে সেটা পরিপূর্ণ করতে চাইছি। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান আমার পক্ষে রয়েছে। শাহী জ্যোতিষবিদ কি ভবিষ্যদ্বাণী করেননি যে নভেম্বরের শেষপ্রান্তে যদি আমি আমার অভিযান শুরু করি। সূর্য যখন ধনুরাশিতে অবস্থান। করছে তাহলে বিজয় আমার নিশ্চিত?”

খানজাদা দু’হাতে বাবরের মুখটা পলকের জন্য ধরে রেখে তার কপালে আলতো করে চুমু খায়। “আবার আমাদের দেখা না হওয়া পর্যন্ত বিদায়, আমার ভাই।”

 “বিজয় অর্জিত হওয়ামাত্রই আমি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়ে দেবো।”

তারপরে সে বিদায় নেয়, দ্রুত জেনানামহলের দিকে ফিরে যায়। যেখানে বাবর জানে যে আগামী মাসগুলোতে নিজের দুশ্চিন্তা গোপন করে- সে সবাইকে আগলে রাখবে, সাহস যোগাবে। এবারের অভিযানে হুমায়ূন তার সাথে যাবে। আর সেজন্য কামরানকে সে কাবুলের রাজপ্রতিভূ নিয়োগ করেছে। বাইসানগার আর কাশিমের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তি, এবারের অভিযানে তারা অংশ নিচ্ছে না। দরবারে থাকবেন তাকে পরামর্শ দেবার জন্য। কিন্তু বাবর জানে তার অনুপস্থিতিতে কাবুলের নিরাপত্তা আর সুশাসনের নিশ্চয়তা, অনেকটাই খানজাদার বিজ্ঞ পরামর্শের উপর নির্ভর করবে। সে আরও জানে তার স্ত্রীদের ভিতরে ঈর্ষাজনিত কারণে উদ্ভূত নানা জটিলতা, এসান দৌলত বেঁচে থাকলে যেভাবে সামলে নিতেন, খানজাদাও ঠিক সেভাবে তাদের সাথে কথা বলে, সান্ত্বনা দিয়ে, আপোষ করিয়ে, সামলে নেবে।

অন্ধকার থেকে ভেসে আসা তূর্যধ্বনি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দূর্গপ্রাসাদের নিচের তৃণভূমিতে দশ হাজার অশ্বারোহী অভিযান শুরু করার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। অচিরেই তারা তাদের অস্ত্র আর সমরসজ্জা শেষবারেরমতো পরখ করে নিয়ে ঘোড়াগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করবে। নিশান-বাহকের দল বাবরের মনোনীত সবুজ আর হলুদ ডোরা কাটা- হলুদ রঙ তার জন্মভূমি ফারগানার, আর সবুজ তৈমূরের রাজধানী সমরকন্দের স্মারক- পটভূমিতে তিনটা জ্বলজ্বল করতে থাকা বৃত্ত, যা তৈমূর নিজের জন্মের সময়ে গ্রহসমূহের নিখুঁত অবস্থান প্রকাশ করার জন্য অংকন করতেন, সম্বলিত নিশানের ভাঁজ খুলে।

কঠোর আর নিবিড় প্রশিক্ষণের ফলে দক্ষ হয়ে ওঠা গোলন্দাজ আর ম্যাচলকধারীরাও, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কামান, মাস্কেট, বারুদের থলি, আর কামানের গোলা ইতিমধ্যে গাড়িতে তোলা শেষ হয়েছে। অস্থায়ী ছাউনি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী- চামড়ার তৈরি ভারী তাঁবু, তবু স্থাপনের খুঁটি, বিশালাকৃতি রান্নার পাত্র- সবকিছুই মালবাহী গাড়িতে তোলা হয়েছে।

আকাশের ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে ষড়গুলো গাড়ির জোয়ালের সাথে বাধা হবে। মালবাহী পশুর বিশাল সারি- দুই কুজ বিশিষ্ট উট, গাধা আর খচ্চর খাদ্য শস্যের বস্তা, শুকনো মাংস, আর অন্যান্য রসদ সামগ্রী বহন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বাবরের সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করবে বলে মনোনীত বণিকের দল যারা ছাউনিতে অস্থায়ী বাজার বসাবে তারাও তাদের মালপত্র আর তা বহনকারী পশুর পাল প্রস্তুত করে দীর্ঘ আর সফল অভিযান মানে বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা। তাদের পেছন পেছন যাবে সেনা ছাউনি অনুসরণকারী সাধারণ মানুষের দল- দিনমজুর, মেথর, পানির্বাহক, শিশু সন্তান কোলে নিয়ে উদ্বিগ্ন স্ত্রী, যে তার অভিযানে অংশ নেয়া স্বামীর কাছাকাছি থাকতে আগ্রহী, বারবণিতার দল, দড়াবাজ, বাঈজি আর বাদ্যযন্ত্রীর দল যারা জানে সৈন্যদের মন যুদ্ধের ভাবনা থেকে সরিয়ে রাখতে পারলে বিপুল বখশিশ পাওয়া যাবে। একটা পুরো শহরই যেনো ভ্রমণ করছে সৈন্যবাহিনীর সাথে।

কয়েক ঘণ্টা পরে, দুপুরের ঠিক আগে আগে, শীতের সূর্য দৃশ্যপটের উপরে অকাতরে রূপালি আলো বিকিরিত করার মাঝে, বাবর আঙ্গুলে তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয়, কোমরে কোষবদ্ধ আলমগীর, আর উদ্দাম তূর্যনাদের মাঝে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদ থেকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় বেরিয়ে আসে। শহরের উঁচু দেয়ালের বাইরে বের হয়ে আসার সময়ে তার পেটের ভেতরে কেমন দলা পাকিয়ে উঠে। আশঙ্কা, উত্তেজনা নাকি পূর্বাভাষ? তার বহু পরিচিত, বহুবার অনুভব করা অনুভূতি। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা আলাদা। প্রচণ্ড একটা ঐকান্তিকতা তাকে আপুত করে রাখে। সত্যি সত্যি ভাগ্যদেবী এবার তার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন…তাকে কেবল সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে, আগে যা কিছু হয়েছে- ফারগানার সিংহাসনের দাবিতে তার লড়াই, উজবেকদের পরাস্ত করে সমরকন্দ দখলে রাখার প্রয়াস। তার কাবুল শাসন- সবই তার নিজের অপার ভাগ্য এবং তার ভাবী সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর বলে পরিগণিত হবে…

*

“জ্যোতিষ ঠিকই বলেছিলো। ভাগ্য আমাদের সহায়।” বাবর চঞ্চল বেগে বহমান কাবুল নদীর উপরে বিশাল ভেলায় চামড়ার চাদোয়ার নিচে বিছিয়ে দেয়া গালিচার উপরে তার দু’পাশে বসে থাকা বাবুরী আর হুমায়ূনকে লক্ষ্য করে বলে। দাড়ির দল দাঁড় বেয়ে ভেলাটা পরিচালনা করছে। তাদের চারপাশে বিশাল সব নৌকার একটা বহর। কামানগুলো আর ভারী মালপত্রের অধিকাংশ বহন করছে। সেনাবাহিনীর মূল অংশ নদীর তীর ধরে এগিয়ে চলেছে।

“হুমায়ূন, উত্তরের যাযাবরদের মাঝ থেকে বিশাল একটা বাহিনী গড়ে তুলে তুমি দারুণ একটা কাজ করেছে। বাবর তার মূল বাহিনী নিয়ে কাবুল ত্যাগ করার দশ দিন পরে হুমায়ুন বখশানের বনভূমি এলাকা থেকে সংগৃহীত দু’হাজারের বেশি সৈন্যের একটা বাহিনী নিয়ে তার সাথে এসে যোগ দিয়েছে।

“আব্বাজান–আপনি আমাদের সাথে তাদের দেবার জন্য যতো স্বর্ণমুদ্রা পাঠিয়েছিলেন, সেটার কথা বিবেচনা করলে, ব্যাপারটা মোটেই কঠিন ছিলো না।” “বদখশানীরা ভাল যোদ্ধা, অবশ্য নিজেদের ভেতরে বা অন্যের সাথে ঝগড়া বাধাবার ব্যাপারেও তাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।” পানির উপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে পরনের নীল আলখাল্লাটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাবুরী বলে।

 “আমাদের অগ্রসর হবার গতির সাথে তাল রাখতে গিয়ে তাদের লড়াই করার জন্য বাড়তি শক্তি থাকবে না।” বাবর মন্তব্য করে।

 সবুজ পানির বহমান ধারা তার মনকে কলহপ্রিয় উপজাতির থেকে ভাটিতে হিন্দুস্তানের পানে ধাবিত করে এবং খুশিতে ভরিয়ে তোলে। শীঘ্রই সে আফিম মিশ্রিম ভাঙ দিয়ে যেতে বলে। বাস্তবতা থেকে পলায়নের একটা উপায় হিসাবে সে একসময়ে এটা ব্যবহার করতে। কিন্তু এখন এটা বর্তমানকে আনন্দে ভরিয়ে তুলে আর ভবিষ্যতকে আশাব্যঞ্জক করে। প্রতিবার সে এটা গ্রহণ করলে, তারা যে নিরস পাথুরে দৃশ্যপটের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, সেটাকে সোনালী আলোয় যেনো উদ্ভাসিত করে তোলে এবং এর প্রতিটা অনুষঙ্গ- প্রতিটা বৃক্ষ, প্রতিটা ফুল, নধর ভেড়ার পালের প্রতিটা ভেড়া- তাজা, মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ভরে উঠে। সে যখন চোখ বন্ধ করে, তখন অন্য সব অবয়ব তার মানসপটে ভিড় করে তার লোকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সেনার ভূপাতিত মৃতদেহের ভিতর দিয়ে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। তাদের ধাবমান ঘোড়ার পা যেনো মাটি স্পর্শই করে না, অনন্ত আকাশের নিচে সে একটা সোনার সিংহাসনে উপবিষ্ট এবং মাথায় একটা হীরা পান্নাখচিত সোনার মুকুট চকচক করছে…

“কি পাগলের মতো মিটমিট করে হাসছেন?” বাবুরী জানতে চায়।

 “আমি ভাবছি আগামী, আমাদের কপালে কি আছে। আজ থেকে এক বছর পরে আমরা কোথায় থাকবো।”

 “আমি আশা করছি দিল্লীতে…”

 “আর হুমায়ূন তোমার কি মনে হয় আমরা কোথায় থাকবো?”

“আব্বাজান আমি ঠিক জানি না…কিন্তু আল্লাহতা’লা চাইলে আমরা আপনার শত্রুদের পরাস্ত করে একটা সাম্রাজ্যের অধিকারী হবো।”

 তার অকপট মন্তব্য শুনে বাবর আর বাবুরী নিজেদের মধ্যে উৎফুল্ল দৃষ্টি বিনিময় করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তারা তাদের চেহারা স্বাভাবিক করে তুলে। একজন তরুণের জন্য হতে পারে শব্দগুলো বেশ গালভরা, কিন্তু তাদের মনেও কি একই আবেগ খেলা করছে না?

*

“সুলতান, গুপ্তদূতের দল ফিরে এসেছে। তারা সিন্ধু নদ অতিক্রমের একটা উপযুক্ত জায়গার খবর নিয়ে এসেছে।”

বাবরের বুকটা ধক করে উঠে। কাবুল নদী ত্যাগ করার পরে থেকেই, খাঁ খাঁ নুড়ীপাথরে পূর্ণ খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে সে এই খবরটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সে আর বাবুরী শিকারে যাবে বলে প্রস্তুত হয়েছিলো- পাশ্ববর্তী গ্রামের লোকেরা পাঁচ মাইল দূরে ওক বনের পরস্পর সংবদ্ধ ডালপালার মাঝে দুটো গণ্ডার চড়ে বেড়াচ্ছে। বলে খবর নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু আপাতত তারা আরো কিছুদিন নিরূপদ্রবে ঘাস খেতে পারবে।

 “আমার সাথে এসো!” বাবুরীকে অনুসরণ করতে বলে সে তার অভিযানের সময়ের লাল তাঁবুর বাইরে যেখানে গুপ্তদূতেরা অপেক্ষা করছে সেদিকে ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে যায়।

“সুলতান, এখান থেকে একদিনের দূরত্বে একটা স্থান আছে। যেখানে ভেলা বানিয়ে আমরা ভারী জিনিসপত্র ভাসিয়ে ওপারে নিয়ে যেতে পারবো।” গুপ্তদূতদের দলপতি তাদের নিয়ে আসা খবর বয়ান করে।

“সেখানে স্রোত কিরকম?”

“নদীর একটা তীক্ষ্ণ বাঁকের পরে অতিক্রমের জন্য নির্ধারিত স্থানটা অবস্থিত। ফলে স্রোতের গতিবেগ এখানে অপেক্ষাকৃত কম- আমরা তিনটা মালবাহী খচ্চর পানিতে

নামিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। তারা বেশ ভালোমতোই ওপারে গিয়ে পৌঁছেছে। আর নদীর তীরের এই অঞ্চলটায় কোনো লোকবসতিও নেই। আমরা কোনো ধরণের বিঘ্ন ছাড়াই নদী অতিক্রম করতে পারবো।”

পরের দিন, বাবর আর বাবুরী তৃতীয়বারেরমতো সিন্ধু নদের দেখা পায়।

“দোহাই আপনার, আপনি নিশ্চয়ই এবারও সাঁতরে নদী অতিক্রমের মতলব ভাঁজছেন না?” কণ্ঠে কৃত্রিম উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে বাবুরী জিজ্ঞেস করে। কারণ এবার আমি আর আপনার পেছনে লেজের মতো পানিতে লাফ দিচ্ছি না…”।

“আমি সাম্রাজ্য না পাওয়া পর্যন্ত সাঁতার কাটা বন্ধ। আমাদের কপাল ভালো আমরা শেষবার যেমন দেখে গিয়েছিলাম নদীতে পানির স্তর, এখন তার চেয়ে অনেক কম।” বাবর ঝুঁকে একটা শুকনো ডাল তুলে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারে। “গুপ্তদূতেরা ঠিক খবরই নিয়ে এসেছে। নদীর এই বাঁকটা আসলেই স্রোতের বেগ অনেক কমিয়ে দিয়েছে- ডালটা দেখো কেমন ধীরে সুস্থে ভেসে যাচ্ছে…”

“আপনার কণ্ঠস্বর কেমন হতাশ শোনাচ্ছে। আপনি কি রূপকাশ্রয়ী কোনো সংগ্রাম। আশা করছিলেন নদী অতিক্রম করবার সময়ে?”

 “আমি চাইনি কিন্তু আশা করেছিলাম। আমরা এখানে ছাউনি স্থাপন করবো আর ছুতোরের দল পর্যাপ্ত ভেলা তৈরি করার পরে আমরা নদী অতিক্রম করবো।”

ভেলা বানাতে- গাছ কেটে, চিরে তক্তা করে, দড়ি দিয়ে বেঁধে এবং চামড়ার অতিরিক্ত তাঁবু কেটে উপরিভাগ আচ্ছাদিত করতে তিনদিন সময় লাগে। চতুর্থ দিন তারা নদী অতিক্রম করে। যদিও ঝিরঝির হিম বৃষ্টির একটা পাতলা চাদরে চারপাশ আবৃত থাকায়, নদীর তীরের মাটি চিটচিটে কাদায় রূপান্তরিত হয়েছিলো এবং ভেলার উপরিভাগ পিচ্ছিল করে তুলেছিলো তবুও বিপুল সংখ্যক মানুষ আর ভারবাহী পশুর পাল অন্যপাড়ে নিয়ে যেতে ভোরের আলো ফোঁটার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত সময় লাগে। প্রথমে নদী অতিক্রম করে অগ্রগামী প্রহরীর দল, তারপরে ঘোড়া, মহিষ, উট আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কামান এবং মাস্কেটের বাক্সগুলো। এরপরে পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের। সওদাগর আর অস্থায়ী শিবিরের মালপত্র ওপাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করতে থাকা লোকগুলোকে নিজেদের বন্দোবস্ত নিজেদেরই করতে হয়। পুরো বহরটা পার করতে গিয়ে কেবল তিনটা মালবাহী উট তারা হারায়। ভেলায় ভালোমতো বেঁধে না রাখার কারণে বেচারারা ভেলা নিয়ে উল্টে স্রোতের সাথে ভেসে যায়।

নদীর অপর পাড়ে পৌঁছানো মাত্র, বাবর একটা ছোট তাবু স্থাপন করার আদেশ দেয়। সে তাঁবুর ভেতরে একলা প্রবেশ করে এবং পর্দা টেনে বেঁধে দেয়। তারপরে সে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে এবং মাটিতে সেজদার ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ মাথা ঠেকিয়ে রাখে। “আমি একবার তোমার আনুগত্য দাবি করেছিলাম এবং আমি আরো একবার সেই দাবি নিয়ে এসেছি।” সে ফিসফিস করে বলে। “আমি তৈমূরের দিব্যি, আমার আর আমার বংশধরদের দিব্যি দিয়ে বলছি এই মাটি আমি চাই।” সে গলায় চেনের সাথে ঝোলানো একটা আকিক পাথরের তাবিজ হাতে নিয়ে সেটার মুখটা খুলে এবং কোমর থেকে খঞ্জরটা বের করে সেটার ডগা দিয়ে খুব সাবধানে সামান্য পরিমাণ মাটি তুলে নিয়ে ভেতরে রাখে। তারপরে তাবিজের মুখটা ভালো করে বন্ধ করে সে আবার তার জোব্বার ভিতরে বুকের কাছে ঝুলিয়ে রাখে।

*

ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো একদিন সন্ধ্যাবেলা, বাবরের স্থাপিত ছাউনির পাশ দিয়ে হলুদাভ একটা আভার জন্ম দিয়ে শতদ্রু নদী বয়ে চলে। হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশের সমভূমি আর সুলতান ইবরাহিম লোদির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর দিল্লীর মাঝে এটাই শেষ বড় নদী। বাবর ভাবে, এই পর্যন্ত তারা দ্রুতই অগ্রসর হয়েছে বলতে হবে। সিন্ধু নদ অতিক্রমের পরে, শীতের সেই ঝিরঝির বৃষ্টি তাদের কিছু দিন ভালোই ভুগিয়েছে। নরম মাটিতে ঘোড়া আর মালবাহী পশুগুলোর বিশেষ করে কামান বহনকারী ষাঁড়গুলোর বেশ কষ্ট হয়েছে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু তারপরে একটা সময়ে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়েছে এবং তারাও সিন্ধুর বিভিন্ন শাখানদী অতিক্রম করে সাবলীল ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে গিয়েছে।

 এতোদিন পর্যন্ত কেবল বন্য, আইন অমান্যকারী উপজাতির সাথেই তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। একটা উপজাতি- গুজর- পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এসে বাবরের লোকদের আক্রমণ করেছিলো যখন তারা একটা সংকীর্ণ গিরিপথ অতিক্রমে ব্যস্ত সেই সময়ে। কিন্তু তার পশ্চাতে অবস্থিত প্রহরীর দল তাদের একেবারে দাঁতভাঙা জবার দিয়েছে। গুজরদের কর্তিত মাথার একটা বেশ দর্শনীয় স্তূপ কার্যকরী প্রতিষেধকের কাজ করেছে এবং অন্য কোনো উপজাতি ভুলেও আর এদিকে নাক গলাতে আসেনি। একবার শত অতিক্রম করলে, পুরো ব্যাপারটা তখন একটা ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করবে। তারা তখন ইবরাহিম লোদীর শক্তিশালী সামন্ত রাজাদের অঞ্চলে প্রবেশ করবে। কয়েকদিন আগে সে নদীর অপর পাড়ে তাদেরই একজনকে ফিরোজ খান- দূতের হাতে চরমপত্র দিয়ে পাঠিয়েছিলো। দিল্লী যেতে হলে তার ভূখণ্ডের উপর দিয়েই যেতে হবে: “আপনার এলাকা এক সময়ে তৈমূরের সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো এবং আমি আমার জন্মগত, ন্যায়সঙ্গত অধিকার দাবি করছি। আত্মসমর্পণ করে আমার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। আপনি তাহলে আমার অধীনস্ত সামন্ত রাজা হিসাবে নিজের শাসন বজায় রাখতে পারেন এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি কোনো ক্ষয়ক্ষতির শিকার আপনার রাজ্য হবে না।”

 রাজাটা এর উত্তরে তাকে একটা ধূসর বাদামী রঙের মর্দা ঘোড়া আর সাথে একটা বার্তা পাঠায়: “আপনার দাবি কৃত্রিম। আমি দিল্লীর সুলতান ইবরাহিম লোদীর অনুগত, যিনি হিন্দুস্তানের ন্যায়সঙ্গত সম্রাট। নিজের ভূখণ্ড ছেড়ে এতোদূর ভ্রমণ করার কারণে বোধহয় আপনার ঘোড়া দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমার পাঠানো এই ঘোড়াটা আপনাকে দ্রুত কাবুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।” বাবর লোকটার ঔদ্ধত্য দেখে কেবল হেসেছে আর ঘোড়াটা বাবুরীকে দিয়ে দিয়েছে।

 বাবর তার সেনাপতির তাঁবুর দিকে হেঁটে যাবার সময়ে ভাবে, ফিরোজ শাহ নিজের অবিমৃষ্যকারীতার জন্য পস্তাবে। ফিরোজ খানের শক্তঘাঁটির উদ্দেশ্যে মূল বাহিনী এগিয়ে যাবার আগে শতদ্রর ওপাড়ের এলাকাটা গোপনে রেকী করার জন্য হুমায়ূন তার বদখশান যাযাবর বাহিনীর একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে যেতে চাইলে বাবর অনুমতি দেয়। আল্লাহ সহায় থাকলে, শীঘ্রই নদী অতিক্রম করার পরে ছেলের সাথে তার দেখা হবে এবং ফিরোজ খানকে এমন কিছু অস্ত্র দেখাবে যা সে তার জীবনেও দেখেনি… সে নিজের তাঁবুতে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। সে ভালো করেই জানে তার বহু প্রতিক্ষিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভাগ্য খুব শীঘ্রই নিষ্পত্তি হবে। মাঝরাতের দিকে, সে তার পরিচারককে আফিম মেশানো সুরা নিয়ে আসতে বলে। এটা তার অস্থিরতা প্রশমিত করবে। এমনকি সে একটু ঘুমিয়েও নিতে পারে- যা। কিছু দিন যাবত তার কাছে অধরা হয়ে উঠেছে।

 কড়া পানীয়টা তার ক্রিয়া শুরু করে এবং বাবরের মতো প্রশান্তির রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে…সে বলতে পারবে না কতক্ষণ সময় সে ঘোরের ভিতরে ছিলো। যখন সহসা তার স্বপ্নে বজ্রপাতের ধ্বনি এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে চায়। দিনটা বেশ গরম আর স্যাঁতস্যাঁতে। বৃষ্টি হলেই সম্ভবত এই গুমোট ভাবটা কাটবে। শীঘ্রই ভারী বৃষ্টি তার তাঁবুর ছাদে ঢাক বাজাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে, চামড়ার মাঝের সেলাই দিয়ে চুঁইয়ে পানি পড়তে থাকে। সে গুনতে শুরু করে- এক, দুই, তিন, ঝপাস…এই, দুই, তিন, ঝপাস… তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এমন সময় বাবুরীর কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায় এবং টের পায় কেউ তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জাগাতে চাইছে। “নদীর তীর পানিতে উপচে পড়ছে! পুরো শিবির পানিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছে।”

“কি?” আফিমের নেশায় বুদ, সে বাবুরীর কথা প্রথমে বুঝতে পারে না।

“আমরা পানির ভিতরে আটকে পড়েছি। পুরো নদী একটা হ্রদের রূপ নিয়েছে। আমাদের দ্রুত এই এলাকা ত্যাগ করতে হবে।”

আলমগীর তুলে নিয়ে সেটা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বাবর তাঁবুর বাইরে বের হয়ে আসে এবং চোখের সামনে যা দেখে তার সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়: পুরো শিবির ইতিমধ্যে এক ফিট ঘোলা পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। চারদিক থেকে তার সেনাপতিরা পানি ভেঙে অনেক কষ্ট করে তার তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে, আদেশের জন্য তাকিয়ে রয়েছে।

তার আফিমের নেশা এক লহমায় ছুটে যায়। “তাঁবু পরিত্যাগ করো এবং ভারী জিনিসপত্রও নেবার দরকার নেই। ঘোড়া আর মানুষদের উচ্চভূমিতে সরে যেতে বলো।” বৃষ্টির অঝোর ধারার মাঝে এত জোরে বৃষ্টি পড়ছে যে সূচের মত বিদ্ধ করে- সে তাদের পেছনে অবস্থিত নিচু টিলা দেখতে পায়। “তোমরা যতোগুলো সম্ভব মাস্কেটের বাক্স আর বারুদের থলি সাথে নিয়ে যাও। কামানগুলো নিয়ে ব্যস্ত হবার দরকার নেই- পানি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। মালবাহী পশুগুলোর বাঁধন খুলে দাও। তারা নিজেরা বাঁচার পথ খুঁজে নেবে, ছাউনির সবাইকে এই একই কথা বলে দাও…আমাদের হাতে সময় খুব অল্প।”

বাবর অঝোর বৃষ্টির ভিতরে তার পরিচারকদের বলে তার আর বাবুরীর ঘোড়া নিয়ে আসতে। ক্রমশ বাড়তে থাকা পানির ভিতর দিয়ে তারা একসাথে ঘোড়া চালিয়ে যায়। লোকদের উৎসাহ দেয় সাধ্যমত যা কিছু পারে বাঁচাতে। কিন্তু তারপরে পানি ততোক্ষণে রেকাব স্পর্শ করেছে। তারা টিলার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তাদের ভীতসন্ত্রস্ত ঘোড়া দু’টি, পানিতে প্রথমে আধা সাঁতারের ভঙ্গিতে ছটফট করে। বাবর আর বাবুরী তাদের কাঁধের উপরে ঝুঁকে এসে আলতো করে চাপড় দিয়ে কানে ফিসফিস করে সাহস জোগায়। শিবির থেকে ভেসে আসা নানা জিনিস তাদের চারপাশে ভাসতে থাকে-রান্নার পাত্র, ঘোড়ায় চড়ার জুতা, মৃত ভেড়া আর মুরগী। তারা অবশেষে যখন উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেখে তার অধিকাংশ অশ্বারোহী আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। তাদের কেউ কেউ আবার নিজেদের সাথে অন্যদেরও নিয়ে এসেছে- নারী আর শিশুর দল গাছের নিচে পানিতে ভিজে চুপচুপে অবস্থায় তারা বসে আছে।

সকাল নাগাদ বৃষ্টি থেমে যায় এবং কয়েক ঘণ্টার ভিতরে বাণের জলও নেমে যায়। বাবর চোখ বন্ধ করে, শোকরানা জানায়। তার পুরো সেনাবাহিনীই বলা যায় অক্ষত রয়েছে। পানি নেমে যাওয়া মাত্র তারা শিবিরে ফিরে গিয়ে ফেলে আসা যা কিছু উদ্ধার করা যায় তার চেষ্টা করবে- কামানগুলো, তাদের বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র, তাঁবুগুলো আর যা কিছু খাবার যোগ্য আছে। তারপরে মালবাহী পশুগুলোকে তাড়িয়ে আনতে হবে। হিন্দুস্তান বিজয় সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আফিম আর না।  তার রোদে পোড়া গলায় একটা মশা গুনগুন করতে করতে এসে বসলে বাবর বিরক্ত হয় এবং এক চাপড়ে সেটা থেবড়ে দিলে রক্তের দাগ গলায় লেগে থাকে তার নিজের রক্ত। কিন্তু শীঘ্রই অন্যদের রক্তপাত শুরু হবে। শাহী জ্যোতিষের সাহায্য লাগবে না সেটা বোঝার জন্য। প্রথমে ফিরোজ খান তারপরে তাকে দিল্লী যেতে যারা বাধা দিতে চায়, তাদের সবাইকে রক্ত দিয়ে মূল্য শোধ করতে হবে। তার সামনে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *