৪.২ বাঘারুর বিষাদ

১৩১. বাঘারুর বিষাদ

সকাল আরো কিছুটা বাড়তেই বাঘারু মাচানে বসে দেখতে পায়, তার ডান হাতের, মানে তিস্তার পশ্চিম দিকের, পাড়। বাঘারু বিমর্ষ হয়ে বসে ছিল তার মাচানে–দুই হাঁটু দুই হাতে জড়িয়ে, তার লাঠিটাকে পাশে শুইয়ে। গলায় নাইলনের দড়ির বাণ্ডিল আর পেছনে কুড়ালিয়াখানও ছিল–কিন্তু বাঘারুর বসার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল সেসব আর সে কখনোই ব্যবহার করবে না। না বুঝে, না ভেবে অতগুলো পাখিকে গাছ থেকে ঝড়ের বাতাসের ভেতর উড়িয়ে দিয়ে যে সে মেরে ফেলল, তারপর থেকে বাঘারুর আর নড়াচড়া করে না। প্রথমে ত তার মনে হয়েছিল গাছের সবগুলো পাখিকেই সে উড়িয়ে দিয়েছে। পাখিগুলো ঐ বাতাসে ভেসে যেতেও পারল না, গাছগুলোর ওপর ফিরে আসতেও পারল না। তারপর অবিশ্যি বাঘারুর খানিকটা সান্ত্বনা জুটেছে–এই শালগাছটাতে ও আরো তিন-তিনটি গাছে আরো পাখি থেকে গেছে দেখে। একটা ঝাকই অমন আচমকা উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর বাঘারুর পাখিদের সঙ্গে নেই। পাখিরা ডালপালার ভেতর দিয়ে দিয়ে ওড়াউড়ি করতে করতে যদি জলে পড়ে ভেসে যায়, যাক। তাদের বাঁচানোর চেষ্টা বাঘারু আর করতে যাচ্ছে না। এমন-কি, তাকে যদি এ গাছ থেকে ও গাছে যাতায়াত করতে হয় তাহলেও সে পাখিদের দিকে ফিরে তাকাবে না। সে না-তাকালেই পাখিগুলো তাদের মত উড়বে, থাকবে, ভাসলে ভাসবে, মরলে মরবে। বাঘারু তাই তার মাচানের ওপর স্রোতের দিকে মুখ করে দুই হাতে দুই হাঁটু জড়িয়ে দেখে তার ডান হাতে তিস্তার পশ্চিমপাড়ের ফরেস্টটা দেখা যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে বাধ, মাঝেমধ্যে বাড়িঘর।

বাঘারু ও-সব চেনে না। কিন্তু সে বোঝে যে-স্রোত গাছসহ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটা পশ্চিম পাড়ের দিকেই ছুটছে। এই স্রোতটাকে ঐ পাড়ে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়ে দিতে পারে। আবার ওদিক থেকে আর-একটা স্রোত তাকে পশ্চিম পাড় থেকে টেনে সরিয়েও নিতে পারে। বাঘারুর হাতে যদি লম্বা সরু লগি থাকত তা হলে পাড়ের কাছাকাছি গেলে সে সেই অল্প জলে লগি ঠেলে পাড়ে ভিড়বার চেষ্টা করতে পারত। একটা পাড়ে আটকে গেলেই তার কাজ শেষ। বাকি কাজ ত গয়ানাথ আর আসিন্দিরের–মোক খুঁজিবার আর গাছ খুঁজিবার। ঠিকেই খুঁজি পাবে। গয়ানাথ গন্ধ পাবার পারে–কোটত গাছ আর বাঘারু।

বাঘারু বা দিকে, তিস্তার পুব পারে, তাকায়। কিছু দেখা যায় না। সূর্যটা যে ঐ দিক থেকেই উঠেছে সেটা বোঝা যায় ঘোলা আকাশে মেঘের আঞ্চলিক উজ্জ্বলতা থেকে। আর, দেখা যায় রেল লাইনের একটা ডিসট্যান্ট সিগন্যাল আর খুর আবছা কিছু গাছপালা। কিন্তু এসব জুড়েই তিস্তার জল ছড়িয়ে গেছে, এখনো ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন। বাঘারুর মাচান থেকে মনে হয়, সমস্ত বন্যাটা ছড়িয়ে পড়ছে তিস্তার পুব পারে। মাচানে বসে সামনে জলের স্রোতের দিকে তাকিয়েও মনে হয় সেই দূরের পুব দিকেই জলস্রোত ধেয়ে যাচ্ছে। জল যাছে পুব পাখে, মুই গাছগিলা নিয়া যাছ পশ্চিম পাখে বাঘারু যেন রহস্যে পড়ে যায়, কিন্তু সে রহস্য নিয়ে আর-কোনো দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ নেই। মোক ত ভাসি দিছে, গয়ানাথ ভাসি দিছে, মোক, যেইটে নিগাবে, মুই যাম।

কিন্তু আর-কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঘারুকে উঠে দাঁড়াতে হয়। কারণ, ততক্ষণে তিস্তার পশ্চিমপাড়ে চা বাগানের ফ্যাক্টরির চোঙা আর বাধ দেখা যায় ব আর, আরো একটু পরে বাঘারুর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিস্তার মাঝখানে কিছু গাছের মাথা আর টিনের চাল। সেই গাছ আর চালগুলোর গলা পর্যন্ত জল-চর আছিল, মানছিলা চলি গেইছে। বাঘারুর গাছের বহর সেই চরের দিকেই ধেয়ে যাচ্ছে। বায়ারুকে তার মাচানের ওপর দাঁড়িয়ে প্রস্তুত থেকেও ভাবতে হয় সে কি ঐ চরের জেগে থাকা টিনের চাল আর গাছের মাথায় গাছগুলোকে বাধবার চেষ্টা করবে?

 বাঘারু তার মাচানে দাঁড়িয়ে যখনই এই ভাবনা শুরু করে, তার মনে হয় জলস্রোত যেন তখনই আরো তীব্র হয়ে সেই চরের দিকে ধেয়ে যায়, এই গাছগুলোসহ তাকে সেখানে আছড়ে ফেলার জন্যেই যেন এই জলরাশি ছুটছে। যতক্ষণ, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ছিল না, ততক্ষণ এই জলস্রোতের গতির তীব্রতা বাঘারু যেন বুঝতেই পারে নি–এক কাল অন্ধকারে ভেসে যাবার মুহূর্ত ছাড়া, কিন্তু তারপর, বিশেষত রাত শেষ হওয়ার পর থেকে, এই স্রোতের সঙ্গে বাঘারুর যেন একটা সহাবস্থানই চলছে। যদিও বাঘারু স্রোতে ভেসে যাচ্ছে–তবুও যেন তার এই ভেসে যাওয়া স্রোতনিরপেক্ষ। তেমনি এই স্রোতও বাঘারুনিরপেক্ষভাবেই বয়ে চলেছে। কিন্তু এখন বাঘারু যখন একটি সিদ্ধান্তের মুখোমুখি তখন হঠাৎই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে-সিদ্ধান্তই নিক বাঘারু তা কার্যকর করতে হবে এই জলস্রোতের সঙ্গে লড়ে। বাঘারু প্রতিপক্ষ হিশেবে জলস্রোতের দিকে তাকাতেই জলস্রোতের বেগ ও শক্তি তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর, অনেক, অনেকক্ষণ পর বাঘারু জলের উচ্চকিত কল্লোল শুনতে পায়। এতক্ষণ এই কল্লোল ওপরে বাতাসের সঙ্গে মিশে একটাই আওয়াজ হয়েছিল–সেই একটা আওয়াজ ভেদ করে বাঘারু তার গাছ নিয়ে যাচ্ছে।

তবু, কখনো কখনো বরং, হাওয়ার আওয়াজটা আলাদা করে সে বুঝতে পেরেছ। গাছের ডালে দাঁড়িয়ে ত তাকে হাওয়ার ঝাঁপটই সামলাতে হয়েছে। স্রোতটাকে ত সেরকম ভাবেও কখনো সামলাতে হয় নি। তাই স্রোতটা আছে, স্রোতের জন্যেই এই গাছগুলো নিয়ে সে ভাসছে, ও-সব সত্ত্বেও স্রোতটাই যেন কেমন অবান্তর হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এখন, যে-মুহূর্তে বাঘারু বুঝে ফেলে এই স্রোত তাকে সামনের ঐ চরের ভেতর নিয়ে যেতে পারে এবং ঐ চরের গাছ বা টিনের চালে সে নিজেকে গাছসহ আটকে দিতে পারে, সেই মুহূর্তে, তার পায়ের তলা থেকে জলের প্রবল শক্তি কল্লোলিত হয়ে উঠে আসে। বাঘারু তার পায়ের তলার জলরাশির দিকে তাকায় না বরং সে তাকিয়ে ছিল একটু দূরেই। সেই দূরের জল দেখেই সে আন্দাজ করতে চাইছিল যদি তাকে এই জলে ঝাঁপ দিতে হয়, তা হলে স্রোতের অনুকূলে ভেসে যেতে চাইলেও কি তার শরীর ঐ স্রোতের তীব্রতার অনুকূলতা করতে পারবে? নাকি, এ জলস্রোতের বেগের কাছে সমর্থন বা বিরোধিতার কোনো আলাদা মূল্য নেই, ভাসিয়ে নেয়ার বেগে এ স্রোত সব কিছুকেই তলিয়ে নেবে? আর,এক হতে পারে বাঘারু এই নাইলনের দড়িতে ফাস বানিয়ে তৈরি থাকল, যদি ঐ চাল আর গাছগুলোর কোনো একটার পাশ দিয়ে তাদের ভেসে যেতে হয়, তাহলে, সেই ফাসটা ছুঁড়ে দেবে। যদি ফাস আটকাল, ভাল। যদি না আটকায়, তাতেও ক্ষতি নেই। কিন্তু এই বিকল্প ভাবতে-ভাবতেই বাঘারু বোঝে সেভাবে আটকানো যাবে না। তাকে জলস্রোতের সঙ্গে একটা সংঘাতে যেতেই হবে যদি সে এই চরে নিজেকে আটকাতে চায়। কিন্তু কী ভাবে সে-সংঘাত তৈরি হবে তার কোনো আন্দাজ বাঘারু করতে পারে না, অথচ তার প্রস্তুত শরীরের সামনে ঐ গাছ আর টিনের চালগুলো ক্রমেই কাছে চলে আসছে, দ্রুত, দ্রুততর।

.

১৩২. অস্থায়ী নোঙর

বিশ বাইশ ঘন্টা আগে যে-চর থেকে নিতাইগজেননরেশরা গরুবাছুরগুলোকে বন্যার ভয়ে বাঁধে তুলেছিল, বাঘারু তার ফরেস্ট নিয়ে সেই চরের দিকেই ভেসে যাচ্ছিল। এখন, জলস্রোতে সেখানে। বসতির চিহ্ন জেগে আছে মাত্র দুটি-চারটি গাছের মাথায় আর টিনের চালে।

বাঘারু এখন সেই চরের দিকে ভেসে যেতে-যেতে দেখতে পায় রায়পুর রংধামালির বাঁধের গায়ে মানুষ আর গরুর সারি। তারা বাঘারুর দিকেই তাকিয়ে আছে কি না, বা, ওখান থেকে বাঘারুকে দেখা যায় কিনা–তার কোনো কিছুই বাঘারু বোঝে না। কিন্তু বন্যায় যে-মানুষ বাঁধের ওপর সংসার নিয়ে ভাসছে, সে নদী ছাড়া আর কোন দিকে তাকিয়ে থাকবে?

জলের ভেতর ঐ গাছের মাথা আর টিনের চাল বাঘারুকে একটা আশ্রয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল মাত্র, কিন্তু বাঁধের ওপর মানুষ আর গরুবাছুরের সারি, ত্রিপলের উড়ন্ত ছাউনি, আর প্লাস্টিকের চাদরের ওড়া দেখে বাঘারুর ভেতর নিজের অজ্ঞাতেই সিদ্ধান্ত তৈরি হয়ে যায়, এই চরটাতেই সে গাছগুলোসহ নিজেকে বাধবে। এটা প্রাকৃতিক ভাবেই ঘটে। এই বাতাস আর বৃষ্টি যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে কয়েক দিন ধরে বয়ে চলেছে, এই জলস্রোত যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিদিনই এই এত জলরাশি নিয়ে এমন বয়ে চলেছে, তেমনি বাঘারু বাঁধের ওপর মানুষ আর জলের ভেতর টিনের চাল দেখে সেখানেই নিজেকে আটকানোর জন্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রায় কোনো কার্যকারণ ছাড়াই। পাড়ে, বাঁধের ওপরে মানুষ আর গরু দেখার পর বাঘারুর কাছে ঐ জলকল্লোল তুচ্ছ হয়ে যায়। সে যেমন কয়েক ঘণ্টা আগে গাজোলডোবার ফরেস্টের অন্ধকারে গয়ানাথের একটি কথায় ভাসমান গাছগুলোর ভেতর অন্ধকার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এখনো তেমনি অত মানুষ আর গরু দেখামাত্র সে বুঝে যায় তাকে এখানেই নামতে হবে। জলস্রোত যতই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাক–সে এই গাছের মাথায় বা টিনের চালে নিজেকে আটকাবে।

বাঘারু সেই মুহূর্তে কিন্তু এটা ভাবে না যে সে এই চরের মধ্যে কোনো ভাবে নিজেকে আটকাতে পারলে পশ্চিম পাড়ের বাধে গিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু এতগুলো মানুষ আর গরুর এত কাছ থেকে বাঘারু এই সম্ভাব্য আশ্রয় ছেড়ে চলে যায় কী করে? এরপর তার আরো নিরাপদ ও আরো প্রচুর মানুষ জুটতে পারে কিন্তু সেই অনির্দিষ্ট আশায় বাঘারু এমন হাতের কাছের মানুষদের ছাড়ে কী করে? এখানে তার গাছ বাধলেও ত সে বাধটাকে দেখতে পাবে।

বাঘারু এত দ্রুত তার মাচান থেকে নেমে আসে আর ডাল বেয়ে-বেয়ে এই গাছগুলোর পেছন দিকে চলে যেতে থাকে যেন এমন পরিস্থিতিতে তাকে কী করতে হবে সেটা তার বহু অভিজ্ঞতায় জানা। পশু যেমন শুধু তার শারীরিক অনুভবশক্তিতে জেনে যায় তার শরীরকে অনাহত রাখতে, বাঘারু সেরকম ভাবেই যেন জেনে গেছে যে এই গাছগুলোর আগে ঝাঁপিয়ে নয়, গাছগুলোর পেছনে, গাছের ডাল ধরে জলে ভাসলেই সে হাতের কাছে কোনো কিছু পেয়ে যেতে পারে। যদি সেই কোনো কিছু না পাওয়া যায়, বা সেই কোনো কিছু থেকে তার হাত ফসকে যায়, তা হলে ত এই দড়ি ধরে স্রোতের টানেই আবার সে নিজের গাছে ভেসে ফিরে আসতে পারবে।

বাঘারু যে গাছগুলোর ডাল বেয়ে-বেয়ে পেছন দিকে যায় তাতে গাছগুলো দুলে ওঠে, পাখিগুলো আবার ডেকে-ডেকে ওড়ে কিন্তু বাঘারু এখন গাছটা উল্টে যাবে কিনা, ডালটা তার ভার বইতে পারবে কিনা এসব হিশেবনিকেশের মধ্যেই নেই। এমনকি পা হড়কে জলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তার নেই। কারণ সে ঐ পেছনের গাছ থেকে জলে নামতেই যাচ্ছে। যখন বাঘারু ডাঙা ছেড়ে এই গাছের ডাল ধরে ভেসেছে, তখন, ডালপালার সঙ্গে তার শরীরের যে-সাযুজ্য মেপে-মেপে তৈরি করেছিল, এখন সেই সাযুজ্য ভেঙে-ভেঙেই সে এই গাছগুলোর পেছন দিকে যাচ্ছে।

বাঘারু তার মাচান থেকে শালগাছটারই নীচের ডালে নামে, সেখান থেকে হাত বাড়িয়ে সামনের একটা উঁচু ডাল ধরে ঝুলে নীচের একটা ডালে নামার পর বোঝে এটা পাশের সিসু গাছটা। সেই ডালটা ধরে মাথাটা নুইয়ে তরতর করে খানিকটা এগিয়ে যাবার পর বাঘারু আবার ডান দিকের একটা ডালে, শালগাছের, পা দেয়। শালগাছের ডালগুলো এত শক্ত যে বাঘারুর ওজনে জলে তলিয়ে যেতে পারে কিন্তু নিজে বেঁকে না। সেই ডালটা ধরে হেঁটে, আরো তলায় নেমে যেতে, বাঘারুকে সামনে নুয়ে সিসু গাছের ডালের ওপর হাত রাখতে হয়। শালের ডালটা ডুবে জল তার পা ছাপিয়ে ওঠে। বাঘারু এবার শালগাছটা ছেড়ে দিয়ে সিসু গাছটার তলার দিকের একটা মোটা ডাল ধরে জলে নামে। ডালটা জলের গায়ে লেগে ছিল। বাঘারু ঝুলে পড়ায় আরো তলে ডুবতে থাকে। বাঘারুর শরীরটা স্রোতের ধাক্কায় ডালটার সমান্তরালে ভাসে। সমান্তরাল সেই শরীরে সে ডালটা ধরে ধরে আরো তলার দিকে নামে। নেমে গিয়ে একেবারে তলায় যে-গাছটা আড়াআড়ি ছিল তার সামনে পড়ে। এই গাছটা সে এতক্ষণ চিনতে পারে নি। এখন সিসুগাছটার ডাল ছেড়ে ঐ গাছটার যে-কোনো একটা ডাল ধরার জন্যে হাত বাড়িয়েই চেনে, চাপা গাছ।-যে-ডালটাতে তার হাত পড়েছিল সেটা নেহাৎই পাতলাধরতে না-ধরতেই বাঘারু জলের তলায় ডুবে যায়। ডুবতে-ডুবতেই হাত বাড়িয়ে আর-একটা ডাল ধরে মাথাটা তোলে। তার মাথা অনেকগুলো পাতলা ডালের ভেতর আটকে গেলে বাঘারু আবার ডুব দেয়। জলের তলাতেও তাকে আটকে দেয়ার মত আগডাল ছিল কিন্তু বাঘারু দুই হাতে সেগুলো সরিয়ে ও ভেঙে চাপা গাছটাকে পেরিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। এটা গাছটার মাথার দিক-বাঘারু স্রোতের ধাক্কায় তখন চাপা গাছটার সঙ্গে লেপ্টে আছে, সে গাছটার শেকড়ের দিকে সরে যায়, তারপর গাছটার ওপর উঠে বসে। তার মাচান থেকে বাঘারু এই বন্যার স্রোতের ভেতর দিয়ে এমন ভাবে এই চাপা গাছের গোড়া পর্যন্ত চলে আসে, যেন, আসার পথটা তার প্রতিদিনের অভ্যাসে চেনা।

বাঘারু দেখে একটা পোয়ালের বাশ পেরিয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে বুঝে ফেলে সে চরটাতে ঢুকে পড়েছে। মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে এখানে মানুষের বসতি ছিল। জলের ঠিক তলায় কোথায় কী উঁচিয়ে আছে তা বলা যায় না। বাঘারু জলে নামতে গিয়ে নামে না। কিন্তু নাইলনের ছড়ির বাণ্ডিলটা অনেকটা খুলে স্রোতের বিপরীতে প্রায় প্রস্তুত হয়ে থাকে যে একটা কোনো শক্ত গাছের ডাল পেলেও ঝুলে পড়বে। বাঘারু দেখে, একটু দূরে-দূরে দুটো-একটা টিনের চাল জেগে আছে কিন্তু সে-সব চালে পৌঁছুনো যাবে না। হঠাৎ গাছগুলো আটকে যায়। গাছের তলার জল ফুলে ওঠে। কোথাও আটকে গেছে। বাঘারু সুযোগটা নিতে চায় কিন্তু সে নড়াচড়া করলে ত বাধাটা সরেও যেতে পারে। বাঘারু কোনো রকমে একটা সরু ডাল ধরে দাঁড়িয়ে দেখে দু-তিনটে সুপুরি গাছের ভেতর গাছগুলো আটকা পড়েছে। কিন্তু স্রোতের বেগে এই চাপা গাছটাই ঘুরে সামনে চলে যাচ্ছে। বাঘারু প্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। চাপা গাছটা আর-একটু ঘুরতেই দেখে, সুপুরি গাছগুলোর পশ্চিমে একটা টিনের চাল। বাঘারু বসে পড়ে জলে তার দুই পা নামিয়ে দেয়। যেই সুপুরি গাছগুলোর কাছাকাছি আসবে সে জলে ভেসে ঐ টিনের চালে উঠবে একটা সুপুরি গাছের সঙ্গে দড়িটা পেঁচিয়ে দিয়ে। কিন্তু চাপা গাছটা আর ঘোরে না, থেমে যায়। বাঘারু কোনাকুনি জলে ঝাঁপ দিয়ে মুহূর্তে একটা সুপুরি গাছের মাথা জড়িয়ে ধরে হেলে পড়ে।

নিতাইদের চরে বাঘারু তার গাছগুলো নিয়ে থেকে যাওয়ার জায়গা পেয়ে যায়। কারো একটা সুপুরি বনে গাছগুলো আটকে গেলে জলের ওপর জেগে থাকা সুপুরি গাছের মাথায় উঠে পড়ে বাঘারু, তারপর এক সুপুরি গাছ থেকে আর এক সুপুরি গাছ করে এই টিনের চালের মাথায়। বাঘারুর পক্ষে বাছাই করা মুশকিল–গাছগুলোর ভেতরে বানানো মাচানে বসে থাকা, সুপুরি গাছের আগায় ওঠা আর এই টিনের চালে পা ছড়ানোর মধ্যে কোনটা বেশি লোভনীয়। কিন্তু এখানে ত আর তার কোনো পছন্দের ব্যাপার ছিল না। যেন এখানে আটকে যাবার জন্যেই গয়ানাথ তাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল–গাছগুলো এমনই এখানে আটকে যায়। আর, এত বাছাবাছিরই বা কী আছে? টিনের চালে বসে থাকতে খারাপ লাগলে সুপুরি গাছের মাথায় চলে যাবে। সেখানে ঝুলে থাকতে খারাপ লাগলে আবার দোল খেয়ে গাছের মাচানে ফিরে যাবে নাইলনের ঐ দড়ি দিয়ে গাছগুলোকে এমনই প্যাচাতে-প্যাচাতে এসেছে বাঘারু যে এখান থেকে সেগুলো আর ভেসে যেতে পারবে না।

বাঘারু টিনের চালের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিল রায়পুর রংধামালির বাঁধের দিকে তাকিয়ে। সেই একই হাওয়া, একই বৃষ্টি, একই বন্যা অথচ এই চালের থেকে ঐ বাধটাকে কত রঙিন দেখাচ্ছে। এমন-কি মানুষজনের চলাফেরা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গরুগুলোর রঙও আবছা চিনতে পারছে বাঘারু। একটা বা দুটো মোষও আছে। মেয়েদেরও চেনা যাচ্ছে। শুধু এদের কারোরই মুখ বোঝা যাচ্ছে না। এই টিনের চালের ওপর বসে বসে শুধু জল ছাড়া ওপরের বাঁধের এই সব দৃশ্য দেখাটা ত খুব আরামের।

বাঘারুর পক্ষে কোনো দৃশ্য দেখে ক্লান্ত হওয়া সম্ভব নয়, কারণ সে সব সময়ই দৃশ্যের অংশ। এই এত বনা আর এত জল দেখেও সে ক্লান্ত নয়। কিন্তু ক্লান্ত না হলেও সে ত দৃশ্যান্তর বোঝে। এখন, এই টিনের চাল থেকে ঐ বাধ একই দৃশ্যান্তরের কাজ করে যাচ্ছে। তা ছাড়া, একটা কাজও ত শেষ হল। তাকে গাছের সঙ্গে গয়ানাথ ভাসিয়ে দিয়েছিল ত কোথাও এরকম আটকে যাওয়ার জন্যেই। আটকে থাকার জন্যেও। এখন আসিন্দির জোয়াই-এর ভটভটিয়ার পেছনে বসে গয়ানাথ তাকে যখন খুঁজে পাবে তখন পাবে। বাঘারুর আর-কিছু করার নেই।

এখনো ত জল বাড়ছেই, হাওয়া বাড়ছেই। চারদিকে কোথাও কোনো ইশারা নেই, যা দেখে আন্দাজ করা যায় যে বন্যাটা এবার কমবে। কিন্তু এখন আন্দাজ পাওয়া না গেলেও বন্যা ত একদিন কমবেই। তখন, জলের সঙ্গে-সঙ্গে বাঘারু তার গাছগুলো নিয়েও নামতে থাকবে–এই জলের তলায় কার ঘরবাড়ির আঙিনায় কে জানে? জল নামলেও তখন বাঘারুকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে–গয়ানাথ কবে তাকে খুঁজতে পাবে তার অপেক্ষায়।

কিন্তু তখন, এই চারপাশের দৃশ্যও ত বদলে যাবে। এখন ত মনে হচ্ছে চারদিকে শুধু জল। এর একটা সুবিধে আছে নানা রকম জিনিশে চোখ আটকে যায় না। কিন্তু তখন ত ডাঙা জেগে উঠবে। ডাঙা মানেই জমি। জমি মানেই আল। আল মানেই মালিক। মালিক মানেই বাড়ি। বাড়ি মানেই টাড়ি। টাড়ি মানেই গাও-গঞ্জ-শহর। তখন চারদিকে কত জিনিশ, কত উঁচুনিচু, কত বাকাচোরা, কত সোজাউল্টো। সে ত রোজ যেমন থাকা তেমনি থাকা। এখন ত রোজকার মতন থাকা না। সেই রোজকার দিনটা এখন জলে ঢাকা পড়ে আছে। জলের কোনো মালিক নেই। তাই জলের কোনো আল নেই। আল থাকলেও বাঘারুর কিছু যায়-আসে না, আল না থাকলেও কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এখন এই টিনের চালের ওপর বসে আলহীন জল দেখতে খুব ভাল লাগছে। আরো ভাল লাগছে, এই কথা ভাবতে যে এ-জলে কেউ আল বাধতেও পারবে না। বাঘারুর তাই বেশ মজা লাগে এই ভেজা টিনের চালের মাথায় বসে সামনের একটা জলের ওপারে পশ্চিম পাড়ের বাঁধের লোজন দেখতে।

কিন্তু এটাও একটা টিনের চাল। এখানে ত একটা সুপুরি বাগান। আরো কয়েকটা টিনের চাল, আরো কিছু গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। আবার, এখান থেকে তাকিয়েই বোঝা যায় এরকম কিছু চাল, কিছু গাছগাছালির পর তিস্তার বন্যা তিস্তার বন্যার মতই বয়ে চলে। সেই দূরের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার এই দুটো-চারটে গাছগাছালি টিনের চালের ওপর চোখ ফিরিয়ে আনলে মনে হয়–এগুলোও যেন তিস্তার বন্যায় ভাসছে, যেমন গাছ নিয়ে ভাসতে-ভাসতে বাঘারু এসে গেছে। বাঘারু যে-জলটা অন্ধকারে, আবছা আলোয়, হাওয়ায়, বৃষ্টিতে পেরিয়ে এসেছে, আর এই চালে আর সুপুরি বাগানে আটকে না গেলে সামনের ঐ জলের ধারালো যে-স্রোতে সে এখনো ভেসে যেত-সেই দুইয়ের মাঝখানে তার গাছের বহরকে বেঁধে রেখে এই টিনের চালের ওপর বসে এটা বুঝতে পারে এখানে বাড়ি ছিল, যেমন মানুষের থাকে, এখানে সুপুরি বাগান, খেত, ধানবাড়ি, গোয়ালিয়া ছিল যেমন মানুষের গা-গঞ্জে থাকে। এই জল, এই বন্যা, সেই বাড়িস্টাড়ি গা-গঞ্জকে ঢেকে দিয়েছে শুধু। বাঘারুর ত কোনো বাড়ি নেই, টাড়ি নেই, বাঘারুর কোনো গাছ নেই, আল নেই। বাড়ি আছে গয়ানাথের, টাড়ি আছে। গয়ানাথের, ফরেস্টের গাছ আছে গয়ানাথের, ফরেস্টে গরুমোষের বাথান আছে গয়ানাথের। এই যেখানে সে বসে আছে সেখানেও জলের তলায় গয়ানাথের বাড়ি, টাড়ি, বাগান, ফরেস্ট, ধানবাড়ি, গোয়ালবাড়ি, গরু মোেষ আছে। জল যখন নেমে যাবে–গয়ানাথ তাকে খুঁজে বের করবে, তার ফরেস্টের চারটি গাছের হিশেবনিকেশ বুঝে নেবে, গয়ানাথের বাঘারু আবার গয়ানাথের কাছে ফিরে যাবে। জল যখন নেমে যাবে–এই এখানকার জলের তলায় জমি জেগে উঠবে, বাড়িটাড়ি জেগে উঠবে, ফরেস্ট জেগে উঠবে। এখন এখানে এই ভেজা টিনের চালের ওপর বৃষ্টি আর হাওয়ার মধ্যে বসে ঘালাটে জলস্রোতের ওপর দিয়ে ঐ পাড়ের মানুষজন, গরু মোষের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বাঘারু যেন ভৈবে ফেলতে চায়–এই জলটাই থাকুক, সব আলবাড়িটাড়ি-ফরেস্ট-গরুবাছুর ডোবানো এই জলটাই থাকুক, যে-জলটা দিয়ে বাঘারু ভেসে এল সেরকম জল দিয়েই বাঘারু আরো ভেসে যাক, এতই ভাসুক যে গয়ানাথ আর আসিন্দির আর তাকে খুঁজে পাবার সুযোগ পাবে না।

বাঘারু যে ঠিক এরকমই ভেবে ফেলতে পারে, তা নয়। ঠিক এতটা এরকম করে ভেবে ফেলার মত অভ্যেসও তার নেই। সে ত ভাবতে পারে কেবল তার শরীর দিয়ে। সেই শরীরেই আসলে বাঘারু এই জলের মধ্যে বসে থাকতে ক্লান্ত বোধ করে না, একাকিত্বও বোধ করে না বরং তার শরীরের ভেতরে কোথাও যেন ভবিষ্যতের এক কুণ্ঠা আগে থাকতেই দানা পাকিয়ে ওঠে যে আবার তাকে কোনো এক দিন এই চাল থেকে মাটিতে নামতে হবে। তার শরীরের ভেতরেই বাঘারু এই মাটিঢাকা, বাড়িটাড়িঢাকা, জমিজিরেত-সুপুরি বাগান-গাছগাছালিঢাকা বন্যার জলের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করে ফেলে আর সেই আত্মীয়তাবোধ থেকেই জলের তলার মাটি থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাও তার শরীরে এসে যায়।

জলে ভেসে যাওয়া থামতেই, আর এই এখানে এসে নিজেকে বেঁধে ফেলতেই, বাঘারুর শরীর জানান দেয়। তার খিদে পাচ্ছে। বাঘারুর ত এমনি খিদে পাওয়ার অভ্যেস নেই। গয়ানাথের বাড়িতে যখন তাকে খেতে দেয়, তখন তার খিদের একটা অংশ মেটে, কিন্তু এখানে ত বাঘারুকে কেউ ভাত দেবে না। বাঘারু এই সব গাছগাছালির মাথার দিকে তাকায়–সেখান থেকে কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে। একটা সুপুরি গাছে পাকা সুপুরি আছে, অন্য গাছগুলোতেও কাঁচা সুপুরির গোছা। কিন্তু বাঘারুর খিদে কি এত সুপুরিতেও মিটবে?

.

১৩৩. জলের দিগবিদিক

রবিবার ভোর হতে না-হতেই রংধামালি রায়পুর চা বাগানের বাধ থেকে দেখা যায়, পুবপারে তিস্তা একের পর এক গঁ ও বন্দর ছাড়িয়ে প্রায় ময়নাগুড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তার মানে, দোমোহনি ততক্ষণে তিস্তার প্রায় মাঝখানে। জলপাইগুড়ি শহরের কাছারির বাধ থেকে দেখা যায় তিস্তা সেই বানেশ বন্দর ছাড়িয়ে ল্যাটার্যাল রোডের কাছাকাছি চলে গেছে। আবার, তিস্তার পুব পারের বাকালি-পদমতী, বা আরো ভাটির জোড়পাকড়ি থেকে দেখা যায় বুড়ি তিস্তার খাতের মধ্যে তিস্তা ঢুকে যাচ্ছে।

পুব পার থেকে পশ্চিম পারের, বা, পশ্চিম পার থেকে পুব পারের তিস্তা দেখার বা বন্যা মাপার প্রধান। নিরিখ হচ্ছে তিস্তার মাঝখানের কোন-কোন চর অদৃশ্য হয়ে গেল সেই হিশেব : নদীর এক পার থেকে অন্য পারের দৃশ্য ত সারা বছর দেখতে-দেখতে মানুষের চেনা হয়ে যায়। দোমোহনির পুরনো ডিসট্যান্ট সিগন্যাল, নিতাইদের চরের কোনো বড় গাছ, জলপাইগুড়ির কমিশনারের বাড়ির পেছনের অর্জুন গাছ, বার্নেশের সামনে ভামনি বনের চরটা, কাশিয়াবাড়ির কাছে নদীর তিনমুখো ধারার মাঝে-মাঝেই চিকচিকে বালির চরগুলো–এই সবই মোটামুটি ভাবে নদীটার সীমা সরহদ্দ ঠিক করে রাখে। রবিবার সকালে সূর্য উঠতে না উঠতে দেখা গেল–এই সব সীমাচিহ্নই লোপাট, যতদূর চোখ যায় তিস্তার ঘোলাটে জল ছড়িয়ে গেছে।

রাতের অন্ধকারে জলটা ছড়াল আর ভোরে সূর্যের আলোতে সেটা সকলের চাক্ষুষ হল–তা ত নয়। এখন শুক্লপক্ষ চলছে, সুতরাং রাতে তত অন্ধকার ছিল না। কিন্তু সেই যে বৃহস্পতিবার থেকে আকাশের ঘোলাটে মেঘ জল-ডাঙা মিলিয়ে চরাচরকে ঢেকে দিয়েছে, আর ঝড়ের মত বাতাস বৃষ্টির সঙ্গে বয়েই চলেছে–তার ভেতর দিয়ে কতটুকু আলো আর গলতে পারে? তবু, সারা রাতই রাতের শেষ প্রহরের মত একটা আবছা ভাব ছড়িয়ে ছিল। সেই আবছায়ায় অবিশ্যি আরো বেশি মনে হতে থাকে যে এমন-কি আকাশের ভেতরেও তিস্তার বান ঢুকে গেছে। ভোর হওয়ার আগে সেই আবছা আলোটা মুছে যায়। চঁদ ডোবা আর সূর্য ওঠার মাঝখানে কিছু সময়ের একটা অন্ধকার বিরতি ছিল। সেই বিরতিটা সূর্যোদয়ে একেবারে কাটে তা না, কারণ, ঐ ঘোলাটে আকাশের কোন তল্লাটে সূর্য উঠেছে। তার হদিশ পাওয়া ভার। কিন্তু সেই অন্ধকারটা কাটতে না কাটতেই ধীরে ধীরে যেন বোঝা যায় সারা রাতের মধ্যে তিস্তার জল একটুও কমে নি। তারপর আলো আর-একটু স্পষ্ট হলে বোঝা গেল, জল পাড় ছাপিয়ে উঠে এসেছে। নিজের পাড়ে তিস্তার জলের বাড় দেখে তখনো আশা থাকে, জল তাহলে এদিকেই গড়িয়েছে বেশি, অন্য পাড় তাহলে এখনো ভাসে নি। ঘোলা আলো আর-একটু বাড়তে না বাড়তেই দেখা যায়, শনিবার সন্ধ্যায় চিরকাল দেখা যেসব গাছগাছালি, বা ডিসট্যান্ট সিগন্যাল, বা বালি, বা বাক একে-একে অদৃশ্য হতে-হতে তিস্তার অপর পারটাকে মুছে দিল সেগুলোর কিছুই আর ভোরের আলোতেও দেখা যাচ্ছে না। যেন রাতের আবছা আলোতে তিস্তার দুই পাড় তিস্তার বন্যায় ভেসে-ভেসে নতুন কোনো জায়গায় এসে পৌঁছেছে-নদীর মাঝখান থেকে নতুন সেই দুটো পাড়। দেখতে হচ্ছে। যেন, কেউ আর নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে নেই-সকলেরই সামনে-পেছনে নদীর দুই পাড়। আলো আরো একটু বাড়লে প্রথম দেখার সেই বিভ্রমটুকুও কেটে যায় আর চোখের হিশেব দিয়ে তখন মাপতে-জুগতে হয়-তিস্তা কোন পারে কোথায় কদ্দূর ঢুকল। রাতের আবছায়ায় তিস্তার এই এমন আক্রমণের ভেতর যেন কোথাও অবিশ্বস্ততা আছে, বা, নিজেদের অপ্রস্তুতির ভেতর আছে অসহায় আত্মসমর্পণের অনিবার্যতা–সেটা কেটে যায় আলো আরো একটু বাড়তেই। তখন বোঝ যায়–আকাশ যেমন ছিল সেই বৃহস্পতিবার থেকে, রবিবার সকালেও তেমনই আছে, বৃষ্টি যেমন ছিল সেই বৃহস্পতিবার থেকে, রবিবার সকালে তেমনই। আর তখনই দিনের আলোয় এই হিশেবটা কঠিন সত্য হয়ে ওঠে–জলও ত তা হলে যেমন সেই বৃহস্পতিবার থেকে বাড়ছে, তেমনি বাড়তে থাকবে। আর তেমনি বাড়তে থাকলে কী হবে?

এই হিসেবনিকেশের একটা স্তরপরম্পরা আছে। তিস্তা যদি সেই বৃহস্পতিবার থেকে এই একই বাতাস আর একই বৃষ্টির সঙ্গে একই বেগে বেড়ে থাকে, তা হলেও গত তিন দিনের সেই বাড়া আর এখন এই রবিবারের বাড়ার অর্থ এক নয়। বৃহস্পতিবার থেকে তিস্তা বাড়ছিল প্রথমে নিজের খাতটা ভরে ফেলে, তারপর সেই খাতের মধ্যে ছোটখাট নানা চরজমি ভাসিয়ে, তারপর আরো একটু চর ভেঙে, কখনো পুব কখনো পশ্চিম পাড়ে ছোটখাট ভাঙচুর ঘটিয়ে। তারপর শুক্রবার রাত্রি থেকেই ত শুরু হয়ে গেছে–পুরনো কায়েম চরও ভাসানো। কিন্তু তারও একটা হিশেব ছিল। তিস্তার জলের তলার মাটির ঢালের হিশেব। সে হিশেবের কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কারণ কেউ কি জানে, কয়েক বছর ধরে কোন জায়গায় পাহাড়ের বালি, পাথর, মাটি জমিয়ে তিস্তা তার তলদেশকে উঁচু করে ফেলেছে কতটা? বা, পাহাড়ের খাজে-খাজে যেসব হ্রদে জল জমে থাকে সেগুলো ভেঙেচুরে তিস্তায় বৃষ্টির জল ছাড়াও বাড়তি জল ঢুকেছে কতটা? কিন্তু মাথামুণ্ড না থাকলেও ত সবাই একটা আন্দাজ করতে চায়। সেই আন্দাজের, কাল শনিবারের সন্ধ্যা পর্যন্তও, একটা মানে ছিল। এমনকি কাল রাতেও ছিল। তখন ত আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না যে তিস্তা সব আন্দাজ কেমন ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আজ রবিবার ভোর হতে না-হতেই, তিস্তার জলপ্রান্তর ঐ নিচু আকাশের তলায় দৃশ্য হতে না-হতেই বোঝা গেল, তিস্তা আর-কোনো হিশেবের মধ্যে নেই, কোনো আন্দাজ দিয়ে আর বোঝা যাবে না জল কী ভাবে বাড়বে, কী ভাবে ছড়াবে। নদী এখনো দু পাড়ের বাঁধের অনেক নীচে, বোল্ডারের জালের অনেক দূরে। বোন্ডারের জালের নীচে, পাড়ে, যদিও জল এসেছে, তাহলেও বোঝা যায়, ওটা স্রোতের ধাক্কায় আসা জল। ঐ জায়গাগুলো এখনো বানের জলে ভরে নি। কিন্তু বানের জল ঢোকার জন্যে ত ঐ জায়গাগুলোই মাত্র এখনো বাকি আছে। পাড়ের ঐ জায়গাতেও যদি জল ঢুকে যায়, তা হলে ত এখন বাকি থাকবে বোল্ডারে জাল। ঐ বাধা পাথরের সঙ্গে এখন স্রোতের ধাক্কাধাক্কি শুরু হবে। কিন্তু তার আগেই ত কোথাও, কোনো নিচু পাড়ে বন্যার জল ঢুকে বোল্ডারের ফাঁকগুলো দিয়ে বাঁধের গোড়ায় চলে যেতে পারে। এই এত জলের এত স্রোত কোথাও যদি বাধে এক চুল ভাঙন ধরাতে পারে তা হলে সে বাধ রক্ষা করে সাধ্য কার? সেরকমই ত হয়েছিল, আটষট্টিতে। সেই রবিবারের সকালে তিস্তার ওপর আটষট্টি সালের স্মৃতি যেন বাস্তব হয়ে উঠল। 

তিস্তার এই জলপ্রান্তরে এখন কোনো কিছু দাঁড়িয়ে নেই, নিজের দিকচিহ্নগুলো উপড়ে ফেলেছে তিস্তা, এখন সে সব তিস্তার জলের অংশ। ঘরের চাল, গাছ, সব ভেসে যাচ্ছে। কচুরিপানার মত সবুজের আভাস দিয়ে ধূসর জলে চকিতে ভেসে যায় ফরেস্টের গাছ। ওপরে কোথাও তিস্তা কোনো ফরেস্টের ভেতর ঢুকে পড়েছে। তা হলে তিস্তা কি নতুন কোনো ফাঁক পেয়ে গেছে? সেখান দিয়ে এই জল অনেকটা বয়ে যেতে পারবে? তা হলে এই ভাটিতে জল পাড় না-ভাঙতেও পারে? নাকি ঐ ওপর থেকেই তিস্তা সব পড়াতে-ওপড়াতে আসছে? কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ত জলে ফরেস্টের গাছ দেখা যায় নি! রাতে কখন শুরু হল–এই ফরেস্ট-উৎপাটন? 

.

১৩৪. কমলেকামিনীদর্শনতুল্য চালে বাঘারুদর্শন

এরকম অবস্থায় রায়পুর রংধামালির বাঁধের ওপর থেকে দেখা গেল নিতাইদের চরের একটা টিনের চালের ওপর একটা লোক এদিকে মুখ করে বসে আছে। ঐ চালটা অশ্বিনী রায়ের বাড়ি। বাঘারু তার গাছের বহর নিয়ে যখন ঐ চরে ঢুকেছিল সেটা কারো চোখে পড়েনি-চোখে পড়ার কথাও নয়। সকাল থেকেই ত মাঝনদী দিয়ে ফরেস্টের গাছ ভেসে যাচ্ছে। বাঘারু তার গাছগুলোর ভেতরে যে-ভাবে মাচানে বসে ছিল, গাছগুলো নিয়ে যেভাবে চরে ঢুকল, সুপুরি গাছে যে-ভাবে গাছগুলোকে বাধল–সে সব এই রায়পুর-রংধামালির বাঁধের ওপর থেকে দেখা যেত। কিন্তু কেউই ত সে রকম ভাবে ওদিকে তাকিয়ে থাকে নি। বরং তিস্তা আরো কত নতুন-নতুন দিকে ছড়িয়েছে সে-সব আঁচ করাটা ছিল দরকারী। কিন্তু লোকটা যখন অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর পা ছড়িয়ে বসে এদিকেই তাকিয়ে থাকে তখন সেই লোকটা আর বাধটার মাঝখানে কোনো বাধা থাকে না। তাকে দেখতেই হয়–এই বাঁধের ওপর থেকে সবাইকে এক সঙ্গেই দেখতে হয়। আর দেখামাত্রই কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, মানষি ভাসি যাছে, মানষি ভাসি যাছে। 

এই কথাটা ভয়ঙ্কর। তিস্তা তার পাড়ের ফরেস্ট উপড়ে আনছে–সেটা বোঝা যায়। কত জায়গাতেই ত তিস্তা আর ফরেস্ট পাশাপাশি, গায়ে গা লাগানো। সেখানে ফরেস্টের দু-চারটে ব্লক এমন ফ্লাডে ভাসতেই পারে। কিন্তু গাছ নয়, মানুষ ভেসে আসছে, মানে ওপরের কোথাও কাল রাতে সকলের অজান্তে তিস্তা টাড়িতে গায়ে ঢুকে গেছে, বস্তি ভাসিয়ে দিয়েছে। মানে, ওপরে কোথাও আটষট্টি ঘটে গেছে। নিশ্চয়ই এমন কোথাও ঘটেছে, যেখানকার মানুষ এমন ঘটবে ভাবে নি। নইলে মানুষ ভাসবে কেন? কিন্তু চোখের সামনে ত এই দেখাই যাচ্ছে, আপাদমস্তক একটা মানুষ তিস্তার জলে ভেসে এসে অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর বসে আছে। 

বাঁধের লোকজন ব্রাঘারুর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে তিস্তা ধরে উত্তরে তাকায়–আরো মানুষ ভেসে আসছে কিনা দেখতে। মানুষ ভাসলে ত আর একটা মানুষ ভাসতে পারে না। কিন্তু এ মানুষটিকে যেমন ভাসতে দেখা যায় নি, একবারেই অশ্বিনী রায়ের চালে দেখা গেছে–তেমনি অন্য মানুষদেরও হয়ত কেবল তখনই দেখা যাবে যখন তারা এরকম কোনো গাছের মাথায় বা চালের মাথায় উঠবে। 

কিন্তু তার ভেতরই ছোটদের মধ্যে কেউ চিৎকার করে ওঠে, ঐ একখান ভাসি আসিছে, ঐ একখান। 

কোটত কোটত?

 নিতাই চিৎকার করে ওঠে, কেডা দেখছে রে? কায় দেখিছে? দেখা। 

জগদীশ বারুই নিজের কপালের ওপর বা হাত দিয়ে চেঁচায়, কেডা দেখলিরে? কয়ডা মানুষ? বেটাছেলে না মেয়েছেলে?

জগদীশের কথায় কেউ-কেউ হেসে ওঠে। কে একজন বলেও, আরে আপনার সেই মানাবাড়ির মাগিটাই ত ভাইস্যা আইসছে। এহন সামলান গিয়া। 

জগদীশ রাগ করার সময় পায় না কিন্তু তার ছানিপড়া চোখেও নিবিষ্টভাবে দেখতে চায়। নিতাই আবার চিৎকার করে, কেডা দেখলি রে? দেখা। 

ছোটদেরই আর-একজন কেউ বলে, ঐ ত, আরে ঐ ত, ঐ যে, মাথাখান দেখা যায়। এই পাকে, এই পাকে। বাঁ হাত দিয়ে সে দিক বোঝায়। 

সকলেই চুপচাপ খুঁজে বের করতে চায়। একজন বলেও, হয়। মাথোখান ডুবিছে আর ভাসিছে, ডুবিছে আর ভাসিছে। 

নরেশ পেছন থেকে বলে, আরে, কিছু দ্যাখব্যারই পাই না, তুরা এহেবারে ডোবা ভাসা শুধধ্যা দেইখ্যা ফেললি? 

নিতাই হঠাৎ হাত তুলে বলে, খাড়া, খাড়া, এই কুনটা ডুবে-ভাসেরে, এইডা? এই যে ভাসি যায়, এইডা? নিতাই তার আঙুলটা দিয়ে নদীর ভেতরের একটা জায়গা দেখায়। 

একটা অনির্দিষ্ট গলায় অনিশ্চিত জবাব আসে, তাই ত, ঐডাই

নিতাই নিজের সন্দেহটা আরো জোর দিয়ে জানায়, ঐডাই ত? 

এবার কেউ জবাব দেয় না। নিতাই একটু পরে বলে, মানষি না, কাঠ। কাঠ। কিন্তু নিতাইয়ের কথায় কোনো জোর ছিল না। বলার পরও সে দেখে যায়। এবং যা দেখছিল সেটা দৃষ্টিসীমার বাইরে  চলে যাচ্ছে যখন তখন বলে ওঠে, কাঠই ত মনে হইল! তগ কি মানষি মনে হইল রে?

নিতাই কাকে জিজ্ঞাসা করল, সে নিজেই জানে না। কিন্তু বাধসুষ্ঠু সবাই আবার নতুন করে খোঁজে, নদীর সেই ভেতরের জল দিয়ে কোনো মানুষ ভেসে যায় কি না! নিতাইও যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। 

নরেশ পেছনে ছিল। সে কিছুই দেখতে পায় নি, কোনো সন্দেহও প্রকাশ করতে পারে নি। সে হঠাৎ পেছন থেকে নিতাইকে ডেকে বলে, এ নিতাই। অশ্বিনীদার চালের উপর যেইডা বসি আছে, সেইডা ত মানষি, নাকি ঐটাও কাঠ? 

তখন সবাই আবার বাঘারুর দিকে তাকায়। বাধ থেকে বাচ্চারা চিৎকার করে হাত নাড়ে। কিন্তু বাঘারু তার কোনো সাড়া দেয় না। বাচ্চারা চিৎকার বাড়ায়। তাতেও বাঘারু সাড়া দেয় না বা হাত নাড়ায় না। অমূল্য ধমক দিয়ে ওঠে, থামা ত চিল্লানি, পাশের মানুষের কথা শুনা যায় না এমন হাওয়া আর ওরা চিল্লাবার ধরছে। তারপর গলা নামিয়ে ডাকে, নিতাইদা। 

অমূল্যর ডাক শুনে নিতাই প্রথমে পেছনে তাকায়, তারপর সেখান থেকে অমূল্য নরেশের কাছে চলে আসে। 

অমূল্য জগদীশকেও ডাকে, কাহা।

 কী কস? বলে জগদীশও এগিয়ে আসে, রমণী সরকারকে ডাক।

আরে থামেন ত। কিছুর মধ্যে কিছু নাই, এর মধ্যি ডাকাডাকির কী হইল? 

আপনে আইসেন না এই দিকে। কী কস্ অমূল্যা? 

অমূল্য বলে, কই কি–নিতাইদা ডেপুটি কমিশনারকে একটা ফোন কইর‍্যা দ্যাও রায়পুর বাগান থিক্যা। 

কী কব?

কবা, এইখানে দেখতাছি তিস্তা দিয়া মানুষ ভাসি আইস্যা চরের চালে বইস্যা আছে।

নিতাই একটু ভাবে। নরেশ বলে, যা নিতাই, ফোন কইরা দে, মানুষ ত সত্যি-সত্যি বইস্যা আছে। 

জগদীশ বারুই কাপড়ের গিঠ থেকে দুটো বিড়ি বের করে একটা নিতাইকে দিয়ে বলে, যা, কইর‍্যাই দে ফোন। 

নিতাই বিড়িটা ধরিয়ে চুপ করে টানে। অমূল্য বলে, ভাবো কী, নিতাইদা।

নরেশ নিতাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা পায় নিতাই কী একটা ভাবছে।

 না। কই কী–আমি ভাবছিলাম এ্যাইন ভোলারে নিয়্যা সাইকেল কইর‍্যা, নিতাই সাইকেল চড়তে জানে না, ভোলা তাকে নিয়ে যাবে, শহরে যাব রিলিফের জইন্যে। খাওয়া লাগব ত এতগিলা মানষির। এ্যাহন যদি ডেপুটি কমিশনারকে ফোন কইর‍্যা বলি মানুষ সব উপুর থিক্যা ভাইস্যা আসতেছে তা হালি রিলিফের কথা আর শুইনবে কেডা? সব ত তখন রেসকুতে লাইগবেনে। আমাগো কি এ্যাহন বানভাসি মানষি খুঁইজব্যার লাগব, না নিজেগার চাইল-ডাইল-গম-চিড়া জোগাড় কইরব্যার লাগব? নিতাই বিড়িটা টানতে-টানতে বলে। 

কিন্তু মানুষ একখান যে ভাইস্যা আইসছে? জগদীশ স্বগতোক্তির মত বলে।

 সে ত মোটে একখান মানষি, কোটত ভাসি আসছে কায় জানে, নিতাই যুক্তি খোঁজে। 

.

১৩৫. বাঘারুর কমলেকামিনীতুল্য অন্তর্ধান

শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি বোঝা যায় সমস্যাটা এমন কিছু কঠিন নয়। ঠিক হয়, ভোলাকে নিয়ে, নিতাই যেমন ভেবেছিল, তেমনি জলপাইগুড়ি শহরে যাবে রিলিফের খোঁজে। এখান থেকে তাকে পার্টি অফিসে যেতে হবে। সেখান থেকে পার্টির কোনো নেতাকে ধরে যে-অফিসারের কাছে গেলে রিলিফের ব্যবস্থা হবে তার কাছে যেতে হবে। আজ রবিবার–সুতরাং রিলিফ বললেই ত আর রিলিফ হবে না। চাল-ডাল-চিড়া-গুড় জোগাড় করতে হবে। বৃষ্টির রকমসকম অর ফ্লাড দেখে ব্যবসায়ীরা সেসব গুদামে লুকিয়ে রাখতেও পারে। তার ওপর সরকার এখন রিলিফ ঘোষণা করবে কী না সেটাও দেখতে হবে। কংগ্রেসের সরকার হলে না হয় মিছিল নিয়ে গিয়ে ঘেরাও দেয়া যেত। কিন্তু এখন ত সব বুঝেশুনে কাজ করতে হয়। রিলিফ একবার দেয়া শুরু করলে ত সব জায়গাতেই দিতে হবে। শহরে গেলে ফ্লাডের খবরও কিছু পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং নিতাই শহরেই যাক–আজ না হলেও, কাল অন্তত রিলিফ পাওয়া যাবে। 

নিতাইয়ের চরের যারা এই বাধে উঠেছে তারা ত আগে থাকতে সাবধান হয়েই উঠতে পেরেছে। ফ্লাড আসার আগেই তারা সব কিছু নিয়ে আসতে পেরেছে–ফলে অবস্থা এমন না যে সরকারি চালডাল না-পেলে না-খেয়ে থাকতে হবে। যার যা সংসার বাঁধের ওপর সেই সংসারই বহাল আছে। সকাল থেকে বাঁধের পশ্চিম চালে বাতাস থেকে আগুন বাঁচিয়ে রান্নাটান্নার কাজ শুরুও হয়েছে। তবু ফ্লাড হলে, বাঁধে উঠতে হয়, বাধে উঠলে রিলিফ চাইতে হয়। যে কদিনের রিলিফ পাওয়া যায়, সে কদিনেরই লাভ। 

কিন্তু সেই অনির্দিষ্ট রিলিফের চাইতে এই চোখের সামনে অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর বসে থাকা মানুষটি অনেক বেশি কাছের। লোকটিকে প্রথম দেখার পর নদীর স্রোতে যে আরো মানুষ খোঁজা হচ্ছিল, তাতে এখন আর কেউ ব্যস্ত নেই। কিন্তু অন্তত একটা মানুষও ত সারা রাত ধরে ভেসে এসে এই চালে উঠে বসে আছে! তা হলে ওপরে কোথাও কোনো বড় রকমের ভাঙন হয়েছে। সেই কথাটি এই লোকটির মুখ থেকে জানা দরকার। তাই দুই জনকে সাইকেল দিয়ে রায়পুর বাগানের ম্যানেজারবাবুর কাছে পাঠানো হল–ম্যানেজারবাবু যেখানে যেখানে ফোন করার ফোন করে জানাক যে রায়পুরে সামনের বাঁধের উল্টোদিকের চরে একটা মানুষ, জ্যান্ত মানুষ, ভেসে এসে একটা টিনের চালের ওপর বসে আছে–তাকে রেসকু করা এখনই দরকার। ম্যানেজারবাবুই ভাল বুঝবেন, রবিবার দিন কোথাও ফোন করলে কী কাজ হবে। 

বাঘারুকে নিয়ে যখন বাঁধের ওপর এই সব নানারকম আলাপ-আলোচনা চলছে, তখন সে এই বাঁধের সামনে আরো বেশি করে একটা দৃশ্য হয়ে যায়। বাঁধের লোকজনের সামনে এখন তিস্তার বন্যা মাপা ছাড়া বাঘারুকে দেখাটাই একটা বড় আকর্ষণ হয়ে ওঠে, যেন, তিস্তা দিয়ে কী বন্যা এখন আসছে সেটা তিস্তার জল দেখে যতটা বোঝা যাবে, তার চাইতে অনেক বেশি বোঝা যাবে বাঘারুকে দেখে। 

বাঁধ থেকে বাঘারুকে যতটা দেখা যাচ্ছিল, নদীর ভেতর চালের ওপর থেকে বাঘারু যেন বাধটাকে ততটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছিল না। বাঘারুর কাছে বাধটা একটা বড় দৃশ্য–যেমন তিস্তাটা একটা বড় দৃশ্য। সেখানে কোনো একটা বিশেষ কিছু ত আর বাঘারু দেখতে পাচ্ছে না। অতগুলি মানুষের নড়াচড়া, কিছু রং, বাঘারু দেখতে পাচ্ছিল বটে, কিন্তু তার বদলে বাঁধের মানুষজনও বাঘারুকে পুরোটাই দেখতে পাচ্ছিল। 

তাই বাঘারু যখন চালের ওপর থেকে উঠে সুপুরি গাছে চড়ে, তখন অশ্বিনী রায় নিজের মনেই বলতে থাকে–গেইল, গেইল, মোর তামান গুয়াবাড়িটা গেইল। অশ্বিনী রায় চিৎকার করে বলে নি, কিন্তু এই একটা কথাই ঘুরে-ঘুরে সবাইকে বলে যেতে থাকে, সে নিজে ভাল করে দেখতেও পাচ্ছে না। বাঁধের অন্য সকলে ততক্ষণে এইটুকু বৈচিত্র্যে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে যে লোকটি বন্যার ঐ নদীর মধ্যে এক টুকরো চালের ওপর থেকে সুপুরি গাছে উঠে গেছে এবং উঠে যাওয়ার পর আর নামছে না। এই উত্তেজনার মাঝখানে কেউ একজন অশ্বিনী রায়কে ধমকেও ওঠে, তোমরালার গুয়াবাড়িখান কি ফ্লাডত ভাসি গেইছে, না ঐ মানুষটা খাইছে? এই এক ধমকেই অশ্বিনী রায় চুপ করে যায়। 

কিন্তু লোকটা চালের ওপর থেকে সুপুরি গাছে উঠলই বা কেন আর উঠলই যদি, তা হলে আবার চালে নেমে আসছে না কেন? বাঘারু চালের সঙ্গে লাগানো সুপুরি গাছটা থেকে পাশের সুপুরি গাছ ধরে সেখান থেকে যে তার গাছের মাচানে চলে গেছে সেটা এই বাধ থেকে দেখাও যায় না, বোঝাও যায় না। রবিবারের ভরদুপুরে যতই ঝড়বৃষ্টির অন্ধকার নদীর ওপরের আকাশকে আচ্ছন্ন করে রাখুক, বাঁধের এই এতগুলো লোক ত স্পষ্ট দেখতে পেল অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর একটা লোক বসে আছে,, চলাফেরা করছে, তারপর একটা সুপুরি গাছের ওপর উঠে চলে গেল, আর নামল না। সুপুরি গাছের। ওপর কেউ বসে থাকতে পারে না। আর, টিনের চালের মত এত প্রশস্ত জায়গা থাকতে হঠাৎ সে সুপরি, গাছের মাথায় উঠতেইবা যাবে কেন। আর, যদি কোনো কারণে ওঠেই, তাহলে উঠে আর ফিরে নামবে না? এই বাঁধের ওপর থেকে দেখা গেল–জ্বলজ্যান্ত একটা লোক ভেসে এসে উঠল, বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকল, তারপর, সুপুরি গাছে উঠে হাওয়া হয়ে গেল? 

সুপুরি গাছ থেকে বাঘারুর নেমে আসার সময়টা যখন সব হিশেবের বাইরে চলে যায়, আর চোখের সামনে তিস্তার জলস্রোত নতুন বেগে ফুলে উঠছে মনে হয়, তখন, গত কদিন ধরে একঘেয়ে এই ঝড়ো বাতাস, মাটির প্রায় সমান্তরাল বৃষ্টি ও আবছা আকাশের মধ্যে যেন নতুন অর্থ একটা সঞ্চারিত হতে থাকে। এই বাতাস ও এই বৃষ্টি যেমন চলছে, তেমনই চলবে–কোথাও তার কোনো বিরতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যে-জল নদী বেয়ে আসছে, তারও কোনো বিরতি নেই, যেন অনন্তকাল ধরে এই জল বয়ে আসবে। প্রতিদিনের যে-মানচিত্রের ভেতর এই নদীর বয়ে যাওয়া সেই মানচিত্রটি এমন ভাবে বদলে গেছে, যে এখন আর কোনো বদলও চেনা যাচ্ছে না। আর-মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর রাত্রি আসবে। সেই রাত্রিতেও এই ঝড় বইবে, এই বৃষ্টিবাতাস ভেজাবে, নদীর এই জল বাড়তে থাকবে। অথচ একটা মানুষকে সামনে ডুবে থাকা চরের একটা জেগে থাকা চালে দেখা গেল, আর সে সুপুরি গাছ বেয়ে উঠে আর নামল না–এমন একটা ঘটনাকে মেনে নিতে হচ্ছে, এতগুলো মানুষকে এক সঙ্গে মেনে নিতে হচ্ছে? তিস্তার এমন বন্যায় কোথাও কোনো গাছের মাথায় একা-একা বাঁচতে বাঁচতে কেউ-কেউ কখনো কখনো এমন কোনো-কোনো দৃশ্য দেখে থাকতে পারে। কিন্তু, এখানে রাত জেগে, রেড়িয়ে শুনে, ফোন:করে, পাহাড়ের জলের হিশেব কষে, চর থেকে যে-মানুষজন বাধে গরুবাছুর ঘরসংসার নিয়ে এসে উঠেছে তাদের সবার পক্ষে ত এটা মেনে নেয়া শক্ত। কারণ, এমন একটা ঘটনা মেনে নিলে, বুঝতে হবে, এই বন্যাটা স্বাভাবিক বন্যা নয়, এই তিস্তাও রোজকার তিস্তা নয়–কোনো দৈবী খেলা চলছে এই বন্যায়, জল আর হাওয়ায়। যে-মানুষটা চোখের সামনে ঐ টিনের চালের ওপর ছিল, সে টিনের চাল থেকে উধাও হয়ে যাবে–এমন ঘটনা দেখলেও মেনে নেয়া যায় না। 

বাঘারুর অন্তর্ধান এই বাঁধের লোকজনের মধ্যে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। আর দেখতে-দেখতে এমন লোকের সংখ্যাই বেশি হয়ে যায় যারা বাঘারুকে চালের ওপরও দেখে নি। তারা জিজ্ঞাসা করতে থাকে-তোরা দেখিছিলু ত? মানষিডা ছিল, না, ছি-না? 

.

১৩৬. ফোনে বাঘারুউদ্ধারের আহ্বান

 বেলা আড়াইটে নাগাদ বাঁধের ভিড়টা প্রায় ছোটখাট একটা হাটের ভিড়ের মত হয়ে গেল। 

রায়পুর বাগানের বাবুরা, বাবুদের বাড়ির মেয়েরা, চাবাগানের কুলিকামিনরা, রংধামালি বন্দরের লোজন, রংধামালি হাটের দোকানদাররা, দল বেঁধে-ফ্লাড দেখতে এখানেই এসে ওঠে। 

তিস্তা দেখার জন্যে এদের এতদূর না এলেও চলত। এমন-কি রায়পুর বাগান থেকেও ত উত্তরে বাঁধের যে-কোনো একটা জায়গায় উঠে তিস্তা দেখে নেয়া যায়। আর হাটের লোকজন ত বাঁধের পারেই। কিন্তু এখানে এলে তিস্তার ফ্লাড ও সেই ফ্লাডে ভেসে আসা এই চরের লোকজনকে একসঙ্গে দেখা যাবে–সেটা নদীর পারের এদের এতদিনে জানা হয়ে গেছে। প্রত্যেক বছরই বন্যায় রায়পুরের উল্টোদিকের এই চর যে ভাসে, তা নয়–কোন চর ভাসে, কোন চর ভাসে না, তা নির্ভর করে তিস্তার জল কোন দিক দিয়ে যাবে তার ওপর। কিন্তু যদি তিস্তা পশ্চিম পাড় ঘেঁষেই বয়, তা হলে এই চরটা ভাসবে আর চরের লোকজন এসে বাঁধের ওপর উঠবে–এটা জানা কথা। 

জানা কথা হলেও ত সব সময় জানা যায় না।

আজ সকালে বাঁধ থেকে দুটো ছেলে সাইকেলে রাইপুর বাগানে গিয়ে খবর দিয়েছিল, তিস্তার বন্যায় এখন জ্যান্ত মানুষ ভেসে আসতে শুরু করেছে; এসে, তাদের ডোবাচরের গাছগাছালি ও টিনের ওপর আটকে আছে; এদের রেসকু করার জন্যে যাতে মিলিটারির নৌকো আসে সে জন্যে টাউনে ডি-সিকে যেন ফোন করে দেয়া হয়। রায়পুর বাগানটি ঐ চরের লোকজনের অপরিচিত নয়। রংধামালির হাটে বাবুদের সঙ্গে মুখচেনাও আছে অনেকের। ফলে, তারা যখন এই খবর দেয়, তখন বাবুদেরও কেউ-কেউ তাদের খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে চায় তাদের চর কখন ভাসল, তারা কখন বাধে উঠল, কখন থেকে তিস্তার লোক ভেসে আসতে দেখেছে তারা। এ ঘটনা জেনে নিতে চায় বাবুরা–ফ্লাডের মত একটা ঘটনা আর মানুষ ভেসে আসার মত আরো বড় ঘটনা যদি তাদের হাতের নাগালে কিন্তু চোখের আড়ালেই ঘটে গিয়ে থাকে, তাহলে অন্তত এই ছেলেগুলোর মুখ থেকে তার কিছু প্রত্যক্ষ বিবরণ শুনে নেয়া উচিত। 

কিন্তু রায়পুর বাগানে গিয়েছিল অমূল্যদের পাড়ার সুবল আর ছিদাম। যে কারণেই হোক, তাদের দুজনের কেউই খুব একটা বিশদ বিবরণ দিতে চায় না। সুবল আর ছিদামের বদলে আর-কেউ হলে হয়ত বাবুদের এই এত প্রশ্নের সুযোগে বেশ সবিস্তার কাহিনীই বলতে বসত। সুবল-ছিদামও যে তেমন গল্প বলতে পারত না, তা নয়। কিন্তু নিজেদের চর ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, ভোলা বাঁধের ওপর তাদের একটা রাত কেটেছে, এবং মাত্র একটা রাত। আজ হাওয়ার আর নদীর যা-চেহারা তাতে আর করাত কাটাতে হবে, তারা জানে না। সারা শরীরে ঐ জল আর হাওয়ায় তাদের ইতিমধ্যেই একটা একঘেয়েমি এসে গেছে। যে বন্যার মধ্যে আছে, সেই বন্যা নিয়ে আর কথা বলতে তাদের ভাল লাগছিল না। তা ছাড়া সুবল-ছিদামের যা বয়স, তাতে বাঁধের ওপর তাদের আর-কিছু করার ছিল না–এখন শুধু বসে বসে সময় কাটানো। রিলিফ-টিলিফ এই সব করার জন্যে ত নিতাইকাকারই আছে। গরুবাছুরও আছে বাধা। তারা তাই রায়পুর বাগান থেকেই সাইকেলে টাউনে গিয়ে দুপুরের শোতে একটা সিনেমা দেখে বিকেলে বাঁধে ফিরে আসবে। ডি-সিকে ফোন করার কথাটুকু তারা জানাতে চায় শুধু–এর চাইতে বেশি কথার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চায় না। বাবুদের কথার উত্তরে ছোটখাট ঘ  দিয়ে তারা সাইকেলে চড়ার ভঙ্গি করে। কিন্তু সাইকেলে চড়ার আগে বাবুদের একবার মনে করিয়ে দেয়, ফোনটা কইর‍্যা দিবেন বাবু, মিলিটারিনৌকা য্যান পাঠায়।

ফলে, সুবল-ছিদাম চলে যাবার পর বাবুদের মুখে-মুখে কথাটা বাগানে ছড়ায়, বাগানের কুলিকামিনদের কাছেও কিছু খবর আসে, দুপুরে বাবুরা বাড়িতে খেতে গেলে বাড়িতেও খবরটা পৌঁছে যায়। রায়পুর বাগানের লোকজনের কাছে এটা আর-কোনো খবর না যে চরের লোকজন বাধে উঠেছে। কিন্তু সেই বানভাসি লোকেরা এসে খবর দিয়ে গেছে যে তিস্তা দিয়ে তোকজন ভেসে আসছে–এটা একটা খবর বটে। কত লোক, কখন ভাসল, কোথায় উঠল, মিলিটারির নৌকো কখন আসবে-এর কোনো কিছুই জানা নেই বলে কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই ত বন্যায় যে মিলিটারি নামে তা শুধু রেডিয়োতে শুনেছে, অন্য জায়গার বন্যার খবরে টিভিতেও দেখেছে। কিন্তু তাদেরই বাধ থেকে মিলিটারির নৌকো ছাড়বে–এটা প্রায় যেন অবিশ্বাস্য ঠেকে। এমন আশাও কারো কারো মনে আসে যে মিলিটারি যখন নামবে তখন কি আর টিভিতে দেখাবে না? টিভিতে দেখানো না-হলে কি মিলিটারি নামবে? একেবারে তাদেরই বাঁধের ওপর থেকে মিলিটারিরা যাবে আর সেটা আবার তাদের টিভিতেই দেখা যাবে–এ রকম একটা অসম্ভবও সম্ভব হতে পারে ভেবে দুপুরের খাওয়া কোনো রকমে সেরে রায়পুর বাগানের বাবুরা, গিন্নিরা, বাচ্চারা বাঁধের ওপর এসে ওঠে। 

বাঁধের দিকে আসতে-আসতে রঘু ঘোষ একবার ম্যানেজারের বাংলোতে হাঁক দেয়–কী ম্যানেজারবাবু, খবর পেলেন নাকি মিলিটারির নৌকো কখন আসবে? 

ম্যানেজারবাবু খাওয়াদাওয়ার পর শুয়ে ছিলেন। তিনি জানলায় পর্দা সরিয়ে ঘাড়টা একটু তুলে বলেন, কী, তুমিও যাচ্ছ নাকি বাধে? 

করবটা কী? সবাই যাচ্ছে। আপনি যাবেন না?

তোমরা আগাও। আমি একটু শুয়ে, পরে যাচ্ছি।

 তা একটা ফোন করেন জ্যোতিদাকে, মিলিটারি কখন আসবে। 

ম্যানেজারবাবু পর্দা ফেলে দেন। রায়পুর চা-কোম্পানির অফিস জলপাইগুড়ি শহরে। তাদের সেক্রেটারিকেই ম্যানেজারবাবু ফোন করে জানিয়েছিলেন তখন। তারপর আর-খবর নেন নি। তাঁর আর খবর নেয়ার আছেই বা কী? এখন জ্যোতিবাবুকে ফোন করলে অবিশ্যি জানা যায় কী হয়েছে। 

ম্যানেজারবাবু পর্দা তুলে বলেন, এই রঘু, জ্যোতিবাবু একটা ফোন নম্বর দিলেন। মোবাইল সিবিল এমার্জেন্সির। তাদের কাছে জানতে হবে, কখন আসবে। তুমি এসে ফোন করে দেখো ভাই। 

করেন-না ফোন, রঘু ঘোষ রাস্তার ওপর থেকেই বলে।

ও-সব মিলিটারির ব্যাপারস্যাপার ভাই, তুমি করলে করো, না করলে ছেড়ে দাও, তোক ভাসছে ত ভাসুক, ম্যানেজারবাবু জানলার পর্দা ফেলে দিয়ে আবার শুয়ে পড়েন। 

আপনাকে নিয়ে যে কী হবে, একটা ফোন করতে এত ভয় পান- বলতে বলতে রঘু ঘোষ ম্যানেজারের বাংলোর বাগানের গেট ঠেলে ঢোকে। দরজা খোলাই ছিল। ফুলবাগান থেকে বারান্দায় উঠে পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকে রঘু ঘোষ। ম্যানেজারবাবু যে-চৌকিটাতে শুয়েছিলেন তার পাশেই, টেবিলে ফোন। ম্যানেজারবাবুর চৌকিটাতে রঘু ঘোষ বসতেই ম্যানেজারবাবু বলেন, করো, দেখো কী বলে। আজ রবিবারে দেখবে মিলিটারিও নাই, পুলিশও নাই।

রঘু ঘোষ লাইনটা পেয়ে যায়, হেলো, হ্যাঁ, শোনেন আমি রায়পুর চা বাগান থেকে বলছি, হা, ও, হ্যাঁ, বলতে বলতে রঘু ঘোষ থেমে যায়। ম্যানেজারবাবু চোখের ওপর থেকে হাতটা নামিয়ে তাকিয়ে থাকেন। রঘু ঘোষ বলে ওঠে, আচ্ছা, আপনারা তা হলে আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন? রঘু ঘোষ আরো কিছু শুনে, আচ্ছা বলে ফোনটা রেখে দিয়ে বলে, আরে ওঠেন, ওঠেন, আধঘণ্টার মধ্যে মিলিটারির নৌকা আসবে। চলেন। জ্যোতিদা আবার ফোন করেছিলেন। ম্যানেজারবাবু বলেন, আরে, আমাকে ছেড়ে দাও, তোর্মরা ত যাচ্ছই। 

রঘু ঘোষ দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আরে চলেন ত, আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না। 

ম্যানেজারবাবু অগত্যা ওঠেন। ধুতি ওঁর পরাই ছিল। উনি আলনা থেকে শাদা ফুলশার্টটা গায়ে চড়ান আর স্যাণ্ডেলটা খুলে রবারের চটিটা পরে ছাতাটা হাতে নেন। দরজা দিয়ে বেরতে-বেরতে ম্যানেজারবাবু বলেন, এই রঘু, ঐ মিলিটারিরা এসে যদি জিজ্ঞাসা করে কে খবর দিয়েছে, কী হয়েছে, সে-সব কিন্তু ভাই তোমরা সামলিও। 

হে-হে করে হাসতে-হাসতে রঘু ঘোষ বলে, আরে, আচ্ছা-আচ্ছা, চলেন।

ম্যানেজারবাবুকে নিয়ে রঘু ঘোষ যখন বাধে পৌঁছয় তখন ভিড় একেবারে জমজমাট। রঘু ঘোষ বাধে উঠে ওদের বাগানের দলটাকে খোঁজে। ওদিকে ম্যানেজারবাবুকে দেখে হাটের লোক দু-একজন নমস্কার করে এগিয়ে আসে। রঘু ঘোষ বলে, এই আসার আগে ফোন করলাম। আধঘণ্টার মধ্যে মিলিটারির নৌকো এসে যাবে। এতক্ষণে টাউন থেকে রওনা হয়ে গেছে? 

রায়পুরের গুদামবাবু আগেই এসে গেছেন। উনি এদের দেখে কাছে আসতে-আসতে বলেন, আরে, আর প্রেসকিউ করবে কাকে? যে ভেসে এসেছিল সে নাকি কিছুক্ষণ পর একটা সুপুরি গাছের ওপর উঠে উধাও হয়ে গেছে। 

মানে? সে আবার কী? রঘু ঘোষ জিজ্ঞাসা করে।

 ঐ যে দেখছেন টিনের চাল ভেসে আছে, গুদামবাবু আঙুল দিয়ে অশ্বিনী রায়ের চাল দেখান, ঐখানে নাকি একটা লোক ভেসে এসে উঠেছিল। এরা সবাই দেখেছে। গুদামবাবু বেশ জোরে-জোরে কথাগুলো বলছিলেন–ফলে তাদের ঘিরেই ভিড়টা জমাট বেঁধে যায়। তা ছাড়া এই জায়গায় এই ভিড়ের মধ্যে এখন রায়পুরের ম্যানেজারবাবু, গুদামবাবু, ফ্যাক্টরিবাবুই (রঘু ঘোষ) সবচেয়ে প্রধান ব্যক্তি। রায়পুরের এক শ্রমিক এসে ম্যানেজারবাবুর হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে তার মাথায় ধরে রাখে। গুদামবাবু বলেন-তারপর নাকি লোকটা হঠাৎ একটা সুপুরি গাছে চড়ে। ওরা সবাই দেখেছে। কিন্তু সুপুরি গাছ থেকে আর নামে নি। আর, নামবেই বা কোথায়? 

সুপুরি গাছ ত পিছল হয়ে আছে। পড়ে যায় নি ত গাছ থেকে? ম্যানেজারবাবু বলেন।

 পড়ে গেলে ওরা দেখত না? গুদামবাবু জিজ্ঞাসা করেন।

তা, লোকটা কি হাওয়া হয়ে গেল? রঘু ঘোষ পাল্টা জিজ্ঞাসা করে। 

.

১৩৭. বন্যার উপকথা 

সে আমি কী করে বলব, আমি ত আর দেখি নি, কিন্তু এরা ত সব এক কথা বলছে! গুদামবাবু ডান দিকে হাত দেখান।

চলুন ত দেখি, রঘু ঘোষ সেদিকে পা বাড়িয়ে ম্যানেজারবাবুর দিকে ঘুরে তাকায়। ম্যানেজারবাবু কথা বলছিলেন। হাত তুলে রঘু ঘোষকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করেন। রঘু ঘোষ আর গুদামবাবু ঘিরে ধরা ভিড়টাকে ভেঙে এগিয়ে যায়। ভিড়টার কেউ-কেউ গুদামবাবু আর রঘু ঘোষের পেছন-পেছন যায়, কেউ-কেউ ম্যানেজারবাবুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। 

গুদামবাবুর পেছনে-পেছনে রঘু ঘোষ যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় সেখান থেকেই বানভাসিদের অস্থায়ী আবাস শুরু। এর মধ্যেই বানভাসিদের আলাদা করে চিনে নেয়া যায়। তারা বেশির ভাগই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এক-এক দঙ্গলে জড়াজড়ি করে আছে। চব্বিশ ঘণ্টার ওপর হাওয়া আর বৃষ্টি তাদের শরীরের ওপর দিয়ে গেছে–সেটা দেখেই বোঝা যায়। বাতাসের ধাক্কায় কোনো আড়াল বা ঢাকনা থাকছে না। কিন্তু এরই মধ্যে বড় বড় বোল্ডারের পাশে পাথরের আড়ালে অনেকে নিজেদের শরীর বাঁচাচ্ছে। কেউ-কেউ আবার সংসারের জিনিশপত্র পাজা করে রেখে তার আড়ালে বাতাস আর বৃষ্টি থেকে মাথা বা শরীরের কোনো অংশ বাঁচাচ্ছে। পাশেই গরুগুলো দাঁড়িয়ে বসে। তাদের সারা শরীর সপসপে ভেজা। গোবরের গন্ধে বাতাস ভারী। এক বুড়ি একটা তক্তার ওপর কাত হয়ে শুয়ে, তার মাথার ওপর একটা ঝুড়ি চাপা দেয়া বৃষ্টি ঠেকানোর জন্যে।

রঘু ঘোষ আর গুদামবাবু যে-জায়গায় এসে দাঁড়ায়, সেখান থেকেই বানভাসিরা নিজেদের আলাদা করে রাখা শুরু করেছে বটে কিন্তু ঐ শুরুর জায়গাটাতেই যা ভিড়। তারপর জিনিশপত্র আর গরুবাছুরে বাকি বাধটা এমন ঠাসা যে যারা ফ্লাড দেখতে এসেছে তাদের পক্ষে সেদিকে এগনো মুশকিল। ফলে, ঐ প্রথম দলটার কাছেই ভিড়টা একটু বেশি। সবাই যেন তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছে যে বন্যায় নিজেদের বাড়ি ছাড়তে হলে কী রকম দেখায়। 

এই দেখার মধ্যে যে কৌতূহলের আলস্যই ছিল তা নয়, অনেকের পক্ষে এই দেখাটা স্মৃতিচারণও বটে। এই ভিড়ের মধ্যে অনেকে আছে যারা আটষট্টির বন্যায় কোনো রকমে বেঁচেছে। আবার এমনও অনেকে আছে যারা দু-এক বছর আগের কোনো বন্যায় ভেসেছে। তবু যে সবাই মিলে বানভাসিদের দেখছে, তার কারণ, বানে যে ভেসে আসে শুধু তাকেই দেখে না, তার ভেতর দিয়ে বন্যাটাকেই দেখে। কিন্তু সেই বা কতক্ষণ দেখা? তাই মানুষজন দেখছিল, আবার সরেও যাচ্ছিল। রায়পুরের দলটাও এখানেই ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। গুদামবাবু রঘু ঘোষকে এসে বলেন, এই যে এদের জিজ্ঞাসা করুন। এরা সবাই দেখেছে যে লোকটা টিনের চালের ওপর বসেছিল।

কী, তোমরা দেখেছ নাকি? সত্যি একটা লোক ভেসে এসেছিল? রঘু ঘোষ একটু হেসে, একটু জোরে বলে। কিন্তু বানভাসিদের যে-দলটাকে সে জিজ্ঞাসা করে, তারা জবাব ত দেয়ই না, এমনকি রঘু ঘোষের দিকে ফিরেও তাকায় না! বোধহয় বহুক্ষণ ধরে এই প্রশ্নটা তাদের করা হয়ে আসছে। কেউ জবাব দিল না দেখে অফিসবাবুর বড় শালী রঘু ঘোষের দিকে তাকিয়ে বলে, সত্যি একটা লোক ভেসে এসেছিল, তারপর নাকি সুপুরি গাছে চড়ে উধাও হয়ে গেছে জলের ভেতর থেকে? 

রঘু ঘোষ আবার একটু হে-হে করে হাসে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। তারপর অফিসবাবুর বড় শালীকে বলে, চলেন, আপনাকেও ঐ চালের ওপর রেখে আসি, তারপর বিনা পয়সায় সুপুরি গাছের প্লেনে উঠবেন। 

অফিসবাবুর স্ত্রীর প্রায় সব সময়ই অসুখ। তার বড় শালীই চিরদিন তাদের সংসারের দেখাশোনা করে আসছেন। সেই সুবাদে অফিসবাবুর অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গেও তার এক রকম সস্নেহ রসিকতার সম্পর্ক। 

আর-একটু পরেই দেখা যাবে, কে টিনের চালে উঠেছে, আর কে সুপুরি গাছে উঠেছে, রঘু ঘোষ ঘোষণা করে। 

কেন? মিলিটারি আসবে নাকি? গুদামবাবু জিজ্ঞাসা করেন।

এই ত আসার আগে ফোন করলাম। জ্যোতিদা ফোন করে দিয়েছিলেন। ওরা রওনা হয়ে গিয়েছে, যে-কোনো সময়ই এসে পড়বে, রঘু ঘোষ প্রায় ঘোষণার মত করে বলে। 

রঘু ঘোষের কথাটা চকিতে বিধময় ছড়িয়ে যায় যে মিলিটারিরা টাউন থেকে রওনা দিয়েছে, ৫-কোনো সময়ই এসে পড়বে। এমনকি বানভাসিদের মধ্যেও একটু নড়াচড়া দেখা দেয়। তারা অনেকেই বহুক্ষণ নদীর দিকে তাকায় নি, এখন, কেউ-কেউ আবার তাকিয়ে নেয়। কখনো এক ঝলক, কখনো তাকিয়ে থাকে–চোখ আর ফেরায় না। তেমন তাকিয়ে থাকা কাউকে দেখলে হঠাৎ মনে পড়ে যায় দুদের বাড়িঘর, খেতিবাড়ি, ফসল, সব কিছুর ওপর দিয়ে তিস্তার এই জল দিগন্তগুলিকে ঠেলতে-ঠেলতে ছুটছে। নিজেদের সর্বস্ব এই জলের তলায় রেখে লোকগুলো বাঁধের ওপর বসে আছে কি আবার ওখানে ফিরে যাওয়ার আশায়? 

রঘু ঘোষের বৌ লিলি আর রঘু ঘোষের ভাগ্নী গোপা পেছন থেকে এসে রঘু ঘোষকে ডাকে। রঘু ঘোষ তার সেই অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে বলে, কী? 

গোপা জিজ্ঞাসা করে, মিলিটারি নাকি সত্যি আসবে?

 হ্যাঁ ত—

লিলি বলে, তুমি ফোন করেছিলে? 

হ্যাঁ।

হা? আরে, সকালে ত ম্যানেজারবাবু জ্যোতিদাকে ফোন করেছিলেন। জ্যোতিদা ওদের বলে দিয়েছে। আমরা ফোন করাতে বলল, এখনই যাচ্ছি। 

কী করবে, এসে?

সে আমি কী করে বলব? থাকো, নিজেরাই দেখতে পাবে। 

ঐ যে বলছে, একটা লোক নাকি সুপুরি গাছ দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে বলেই লিলি খিলখিল করে হেসে ওঠে। রঘু ঘোষও হেসে ফেলে তাড়াতাড়ি বলে, এই কী হচ্ছে, ম্যানেজারবাবু আছেন। ততক্ষণে গোপাও মুখে আঁচল চাপা দিয়েছে।

এখন এই ঘটনাটি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের ব্যাপার মাত্র নেই। তিস্তার বন্যায় একটা লোক ভেসে এসেছিল–তেমন ভেসে আসতে পারেই, প্রায় প্রতি বছরই আসে। লোকটা অশ্বিনী রায়ের চালের মাথায় উঠে বেঁচেছে–তেমন বাঁচতেও পারে, ফ্লাডের ভেতর এরকম করেই বাঁচতে হয়। লোকটা অশ্বিনী রায়ের সুপুরি গাছে উঠেছিল–তেমন উঠতেও পারে, তাকে ত কিছু একটা খেতে হবে কিন্তু সে আর সুপুরি গাছ থেকে নেমে আসে নি। 

এই শেষ জায়গাটায় ঘটনাটি যেন আর ঘটনা থাকে না–আজকে সকালেরই একটা ঘটনা। লোকটির সুপুরি গাছে ওঠা আর নেমে না-আসা যেন তিস্তা নদী নিয়ে কত অসংখ্য কাহিনীর একটি হয়ে যায়। তিস্তা যেন আর নদীমাত্র থাকে না–সে তার প্রাচীন অস্তিত্বে ফিরে যেতে চায় এই একটিমাত্র কাহিনীকে অবলম্বন করে। তিস্তার দুই পাড় দিয়ে বাঁধ বাধা হয়েছে। সেই বাঁধের ওপর সবাই দাঁড়িয়ে। একটা ট্রানজিস্টারের আওয়াজও মাঝে-মাঝেই পাওয়া যায়–বোধহয় বানভাসিদেরই ভেতর থেকে। কিন্তু তিস্তা আর তিস্তানদী না থেকে তিস্তাবুড়ি হয়ে ওঠে। সেই তিস্তাবুড়ির মূর্তি পাটকাঠি আর পাট দিয়ে বানিয়ে লোকে পুজো করে। সেই তিস্তাবুড়ি, এখনো পারে তার বুকে ভাসমান একটা লোককে আকাশে উধাও করে দিতে। 

বন্যার উপকথা জন্মাচ্ছিল–নতুন। 

.

১৩৮. বাঘারু উদ্ধার সংক্রান্ত অনুসন্ধান

 বাঁধের ওপরে বানভাসি মানুষের ভিড়টা এই নতুন কথার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন করে দর্শনীয় হয়ে ওঠে।  বর্ষায় তিস্তায় বারকয়েক ফ্লাড ত হবেই, কোনো-কোনোবার তার মধ্যে একটা ফ্লাড বড় হয়ে যায়। বৃষ্টি যদি তেমন পড়ে তবে একটা ফ্লাডই গোটা তিনেক ফ্লাডের সময় জুড়ে বহাল থাকে। এবার যেমন বৃষ্টি হচ্ছে গত প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে তাতে এরকম একটা ফ্লাড ত প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেই হিশেবের বাইরে যদি ফ্লাড়টা চলে যায়, তা হলেই সকলে নড়েচড়ে বসে। 

এবারের এই ফ্লাডটা এখন দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢুকছে। আজ, এই পরিবারের দিকটা সেদিক থেকে খুব দরকারী দিন। এখন এই বিকেলের দিকেও হাওয়া আর বৃষ্টির বেগ কিছুমাত্র কমে নি। কিন্তু সকলেরই মনে একটা হিশেব ছিল যে আজ দুপুরের পর থেকে এই বেগটা কমতে শুরু করবে। এখনো অনেকেই মনে মনে হিশেব কষছে যে বাতাস আর বৃষ্টির বেগ হয়ত একটু কমেছে, কিন্তু এখনই সেটা বোঝা যাচ্ছে না, রাতের মধ্যে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। এরকম ভাবাটাও অনেকটা মনে-মনে সান্ত্বনা পাওয়ার মত। এই সান্ত্বনাটুকু না থাকলে এখনই সকলকে প্রস্তুত হতে হয় যে কালও যদি এই বাতাস আর বৃষ্টি অব্যাহত থাকে তা হলে তিস্তার এই ফ্লাড হিশেবের বাইরে চলে যাবে। গেলে, তাদের কী করতে হবে–তা, এই বানভাসি মানুষজন, বা তখন যাদের নতুন করে বানে ভাসতে হবে, তারা, জানে না। কোনো ইস্কুলটিস্কুলে ক্যাম্প তৈরি হবে? বাঁধের ওপর থেকেও লোক সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? ওপরে, বা নীচে, হয় ত এখানেই, বাধ ভাঙবে?

কিন্তু বাতাস আর বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল সেই অনুমানের আড়ালেও যেন আর মাথা বাঁচানো যায় না–যখন সত্যি করেই চোখের সামনে একটা লোককে তিস্তার জলে ভেসে এসে অশ্বিনী রায়ের চালে উঠতে দেখা যায়। সেটা ছিল, যেন সমস্ত হিশেবের বাইরে। এরকম বৃষ্টি আর বাতাস থাকলে মঙ্গলবার নাগাদ ওরকম একটা ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারত। 

ফলে, বাঘারুর পরে আর নতুন লোকজন যখন সারে-সারে ভেসে আসে না এই প্রায় বিকেল পর্যন্ত, তখন ফ্লাডের হিশেব আবার প্রত্যাশিত সীমার মধ্যেই থাকে। একটা লোকই ভেসে এসেছে–তেমন ত যে-কোনো সময়ই হতে পারে। ঐ একটা লোক টেলিফোনে-টেলিফোনে যতই কেন না আরো অনেক লোক হয়ে যাক, মিলিটারির নৌকোর জন্যে যত ডাকাডাকিই হোক না কেন-বন্যার জলের বাড়া কমার সঙ্গে যাদের মরণর্বাচন জড়িত, তারা কিছুটা আশ্বস্তই হয়। 

আবার সেই লোকটিও যখন নাকি সুপুরি গাছ বেয়ে উধাও হয়ে যায়, তখন তা নিয়ে যত হৈচৈই হোক না কেন, যত গল্পকথাই রটুক না কেন-ফ্লাডটার হিশেব তাতে আরো বেশি করে হিশেবের মধ্যে আসে। লোকটিকে যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন ওরকম একটা লোক ভেসে এসেছিল সেটাও যেন আর তত সত্য থাকে না। ফ্লাডের তিস্তায় ওরকম হয়। কেউ হয়ত ঘরের চালের মায়া কাটাতে না পেরে চালের সঙ্গেই ভেসে যায়। কেউ হয়ত বাড়ির কাঁঠাল গাছের মায়া কাটাতে না পেরে সেই গাছের সঙ্গেই ভেসে যায়। এও হবে তেমনি কিছু একটা। তা ছাড়া পাগল-খ্যাপাও কেউ হতে পারে–সুপুরি গাছের ওপর নিজেকে বেঁধে রাখতেও পারে। সে যাই হোক না কেন–ফ্লাডের হিশেবের মধ্যে তাকে না নিলেও চলে। 

তাই, এই বিকেলের দিকে এই বাঁধের ওপরের ভিড়টায় অলক্ষে দুটো ভাগ হয়ে যায়। চর থেকে যারা উঠে এসেছে তারা নিজেদের মত আলাদা হয়ে থাকে। কেউ-কেউ বৃষ্টিবাতাস থেকে একটু আড়াল বানিয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে মাথা বাঁচায়, কেউ আবার এই ভিড়ের মধ্যেই ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে। হাটের বা বাগানের লোকজনের কাছে গল্পটা ক্রমেই প্রধান হয়ে ওঠে। হতে-হতে শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায়, যেন তারা ঐ গল্পের জন্যেই এখানে অপেক্ষা করছে। 

মোবাইল সিভিল এমার্জেন্সির গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল একটু আগেই বাঁধের ওপর লোজন-গরুমেষ দেখে। দুজন সেপাইকে নিয়ে অফিসার বাঁধের ওপর উঠে দেখে–তারা যে-সীমায় এসে উঠেছে, তাদের সামনে গরুবাছুর, মানুষজন, সংসারের আরো নানা জিনিশ নিয়ে বানভাসি লোকজন। তারা গরুবাছুরের সারির মাঝখান দিয়ে, কিছু-কিছু শুয়েবসে থাকা লোকজনের পাশ দিয়ে, এই ভিড়টার দিকে আসতে শুরু করে। এর মধ্যে ছোটখাট ত্রিপল আর প্লাস্টিকের চাদরের ঢাকনা কেউ-কেউ দিয়েছে, তাই অফিসারকে দূর থেকে দেখাও যায় না। নইলে টুপি, ওয়াটারপ্রুফ আর গামবুটে তাকে দূর থেকে দেখেই সবাই এগিয়ে আসত। ভিড়টার দিকে এগতে-এগতে অফিসার জিজ্ঞাসা করতে থাকে, কী, কোথায় লোক ভেসে এসেছে? কে ভেসে এসেছে? কোথায়? কে দেখেছে? ওদিক থেকে যে কেউ আসতে পারে সেটা, যারা শুয়েবসে ছিল তারা বুঝতে পারে নি। ফলে, আচমকা অফিসারকে তার লোকজনসহ দেখে তারা হকচকিয়ে উঠে বসে, বা দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর অফিসারের প্রশ্নটা শোনে। কিন্তু শুনেও বুঝে উঠতে পারে না। বোঝার পর যখন জবাব দেবার জন্যে অফিসারের দিকে দৌড়ায়, তখন অফিসার আরো খানিকটা এগিয়ে গেছে। 

এই করতে করতে অফিসার যখন বান দেখতে আসা ঐ ভিড়টার মধ্যে গিয়ে পড়ে, তখন তার পেছনেও একটা বেশ বড় ভিড় তৈরি হয়ে গেছে। অফিসারকে দেখেই রায়পুর চা বাগানের ম্যানেজারবাবু একটু পেছিয়ে যান। অফিসারের কাছে যাওয়ার তাড়ায় লোকজন ম্যানেজারবাবুকে অফিসার থেকে আলাদা করে দেয়। 

অফিসার জিজ্ঞাসা করে, কী? আপনাদের এখান থেকে ফোন করা হয়েছে, লোকজন ভেসে এসে চরের চালে উঠে বসে আছে। কোথায় ভেসে এসেছে? কখন? বলুন, বলুন, দেখি নদীটা দেখতে দিন, সামনে থেকে সরে যান 

 অফিসারের এই কথাতে সেপাইদুটো একটা কাজ পায়। তারা অফিসারের সামনে থেকে তোকজনকে দুদিকে সরিয়ে দেয়, লাঠিগুলো দিয়ে সেই ফাঁকটাকে বহালও রাখে। এখন অফিসারের সামনে সরাসরি নদী থাকে। সেই নদীর দিকে মুখ করে অফিসার দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করেই যায়। 

যদি অফিসার একবার জিজ্ঞাসা করেই থামত, তা হলে হয়ত কেউ-না-কেউ একটা জবাব দিতে পারত। কিন্তু উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে কথাগুলো সে বলেই যাচ্ছিল, ফলে, কেউ আর-কোনো কথা বলার সুযোগই পায় না। 

কী? বলুন? কোথা থেকে কে ভেসে এসেছে? বলুন? ফোন গেল ত এখান থেকে। এখানে ফোন কোথায় আছে? 

এবার যেন জবাব দেয়ার মত একটা প্রশ্ন পাওয়া যায়। ভিড়ের ভেতর থেকেই কেউ বলে, রায়পুর চা বাগান। 

ও? রায়পুর? বলে অফিসার যে-ভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে রায়পুরের দিকে তাকায়, তাতে বোঝা যায় রায়পুর বাগানটা চেনে। তার এই ঘাড় ঘোরানোর অবকাশে ভিড়ের ভেতর থেকে আর-কেউ বলে দেয়–ম্যানেজারবাবু ত আছেন। 

কোথায় ম্যানেজারবাবু? অফিসার জিজ্ঞাসা করে।

ঐ ত ম্যানেজারবাবু। ম্যানেজারবাবু, ম্যানেজারবাবু। 

ম্যানেজারবাবু আরো একটু পেছিয়ে গিয়েছিলেন। বাগানের শ্রমিকটি তার মাথায় ছাতা ধরেই ছিল। তিনি যে ইচ্ছে করে ক্রমেই পেছিয়ে পড়ছিলেন, তা হয়ত নয়, কিন্তু অফিসারকে ঘিরে অফিসারের পেছনের ভিড়টা এত বাড়ছিল যে তাকে পেছতেই হচ্ছিল। 

ডাক শুনেও ম্যানেজারবাবু এগিয়ে আসেন না। অফিসার ঘাড় ঘুরিয়ে ম্যানেজারবাবু কোথায় তা দেখার চেষ্টা করে। তার চেষ্টার মধ্যেও সেই অপেক্ষা ছিল যে ম্যানেজারবাবু নিশ্চয়ই এবার এগিয়ে আসবেন। কিন্তু ম্যানেজারবাবু এগিয়ে না আসায় তাকে আরো একটু ঘুরে ম্যানেজারবাবুকে খুঁজতে হয়। ফলে অফিসার ও ম্যানেজারবাবুর মাঝখানের ভিড়টা দু ভাগ হয়ে যায়। অফিসার নদীর দিকে পেছন ফিরে ম্যানেজারবাবুর দিকে যখন ঘুরে দাঁড়ায় তখন ভিড়টা অফিসারের পেছনে চলে যায়। অফিসার ম্যানেজারাবাবু বলতে কাকে বোঝাচ্ছে তা বুঝতে পারে। সেখানেও একটা ইতস্ততের মধ্যে কিছুটা সময় যায়। অফিসার অপেক্ষা করে থাকে যে ম্যানেজারবাবু এবার এগিয়ে আসবেন। ম্যানেজারবাবু যে এগিয়ে আসছেন না এটা বোঝার পর অফিসার ম্যানেজারবাবুর দিকে এগিয়ে যায়। 

নমস্কার। আপনাদের বাগান থেকে ফোন করা হয়েছিল এখানে এই বাধে লোজন ভেসে এসে চালের ওপর উঠে আছে, রেসকিউ করতে হবে। আমাদের একটু রিপোর্ট করুন। 

ম্যানেজারবাবু সরাসরি অফিসারের মুখের দিকে তাকান না। পাশের শ্রমিকটিকে বলেন, রঘুবাবুকে ডা। তারপর রঘুবাবুকে খুঁজতেই সেই ভিড়ের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে বলে যান, আমরা ত কিছু দেখি নি, আমরা ত এখন এলাম। এদেরই দুটো ছে,ে ফালে গিয়ে বলল, লোকজন ভেসে আসছে, ফোন করে দিতে। দাঁড়ান, আমাদের মধ্যে যে জানে তাকে ডেকে আনছে, সে সব বলতে পারবে। 

ম্যানেজারবাবু তখনো ভিড়ের ওপর দিয়ে রঘু ঘোষকে খুঁজছেন। পেছন থেকে রঘু ঘোষ এসে বলে, কী হল?

আরে, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? এই দেখো, এরা কী জানতে চাইছেন? ম্যানেজারবাবু আধ পা পেছনে যান, যেন রঘু ঘোষকে জায়গা দিতে। রঘু ঘোষ পেছন থেকেই বলে, ঐ ত ঐ চালের ওপর নাকি একটা লোক ভেসে এসে উঠেছে। কোন চালটা? অফিসার আবার নদীর দিকে ঘোরে, রঘু ঘোষ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। অফিসার আর রঘু ঘোষ কয়েক পা এগিয়ে যায়। সেপাই দুটো সামনের লোকজনকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু কখন সরতে হবে লোকজন এর মধ্যেই তা শিখে গেছে।

রঘু ঘোষ নদীর দিকে আঙুল তুলে বলে, ঐ ত ঐ সব চালের কোথাও হবে। তারপর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে গলা তুলে বলে, আরে, আপনারা বলছেন না কেন? আপনারা দেখেছেন, আপনাদের জায়গা, আপনারা বলেন। কে আছেন ঐ চরের? 

জগদীশ বারুইয়ের গলা শোনা যায়, আরে, নিতাইডা ত আইল না এহনো। এই গজেন, নরেশ, অমূইল্যা, দ্যাখ না কী কয়? 

নরেশ ভিড়ের ভেতর থেকেই বলে, কওনের কী আছে? ঐ ত ঐ চালডার উপুড় একখান মানুষ ভাইস্যা আস্যা উঠল, সকলেই দ্যাখছে। 

অফিসার আঙুল দিয়ে নদী দেখিয়ে বলে, ঐ চালটার ওপর, ঐ সুপুরি গাছের ভেতরে যে-চালটা?

 হ্যাঁ। নরেশ জবাব দেয়। নরেশ এগিয়ে আসে না, কিন্তু সে লম্বা বলে ভিড়ের ভেতরেও তাকে আলাদা করা যায়। 

কই? কেউ নেই ত! অফিসার জিজ্ঞাসা করে।

আরে সেইডাই ত কথা, ভিড়ের আড়াল থেকে জগদীশ বারুইয়ের গলা ভেসে আসে, সকলে দেইখল্যাম, ভাইস্যা আইল, আবার সকলে দেইখল্যাম, নাই। 

নাই মানে? আবার ভেসে গেল নাকি? অফিসার একটু উদ্বেগের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করে। তাদের আসতে একটু দেরি হয়েইছে। এর মধ্যে যদি কোনো লোক ভেসে এসে আবার ভেসে গিয়ে থাকে আর এ নিয়ে যদি কোনো গোলমাল বাধে, তা হলে, সে ফেঁসে যেতে পারে। 

কেডা জানে? ভাইসল না উইড়ল না কোথায় গেল? হেই সকালের ব্যাপার। আপনারা আইলেন এতক্ষণে। তা লোক কি এতক্ষণ ধইর‍্যা সঁতরাব নাকি? জগদীশ বারুই আড়াল থেকে বলে ওঠে। 

অফিসার গলাটা নরম করে বলে, আমাদের ত আরো দশ জায়গায় দৌড়তে হচ্ছে। কী করা যাবে বলুন। এখন বলুন, কী করতে হবে।

জগদীশ বারুইয়ের কথার ভঙ্গিতে নরেশও একটু সাহস পায়, আমরা ত ফোন কইর‍্যা কইল্যাম মিলিটারির নৌকা পাঠাইতে? তা আপনারা কি নৌকা নিয়্যা আইসছেন? 

ফোন করলেই ত আর নৌকা তুলে আনা যায় না, আপনারা বলুন কী হয়েছে, তারপর নৌকো লাগবে কি কী লাগবে ঠিক করা যাবে। 

এক কথাই ত কয়্যা আইসত্যাছি সকাল থিক্যা। মানুষ ভাইস্যা আস্যা উঠছে। এহন আপনার জিপগাড়ি নিয়্যা যান নদীর ভিতরে–দেইখ্যা আসেন মানুষ আছে কি নাই। 

নরেশের কথায় সবাই হেসে ওঠে। অফিসার একটু এদিক-ওদিক তাকায়। তার সামনে বাঁধের বোল্ডার জল পর্যন্ত নেমে গেছে। সেই বোল্ডারের পরেই বন্যার তিস্তা। নরেশের কথায় রাগ ও অভিযোগ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ভিড়ের ভেতর থেকে ঠাট্টাবিদ্রূপ শুরু হয়েছে। নরেশের কথায় সবাই হেসে ওঠায় এই ভিড়ের মেজাজের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাকে এখন এখানে কিছু কাজ দেখাতেই হবে, নইলে এরা হয়ত ফিরে যেতে দেবে না। অফিসার রঘু ঘোষের দিকে তাকিয়ে গলাটা একটু নামিয়ে বলে, কিন্তু এখন ত চালের ওপর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

 রঘু ঘোষ হে-হে করে হেসে বলে, আরে সেটাই ত সমস্যা। লোকটা নাকি এসেছিল, এখন আর নেই। তারপর আবার একটু হেসে নরেশকে বলে, কী? সবটা বলো– 

কইল্যাম ত সবডা? আবার কী কব?

যাঃ। শুনলাম যে সুপুরি গাছে উঠেছিল লোকটা!

সুপুরি গাছে উঠেছিল মানে? ঐ সুপুরি গাছে? অফিসার জিজ্ঞাসা করে।

তা সুপুরি গাছেই উঠুক, আর গাবগাছেই উঠুক, সেইডা ত দেইখবার নাগব, না, কী? আড়াল থেকে জগদীশ বারুই বলে। 

না। তা ত হবেই। আপনারা বলুন, কী হয়েছে। আমাকে ত সেই অনুযায়ী কন্ট্রোল রুমে জানাতে হবে। তারপর তারা ব্যবস্থা করবে। আমি ত আর পকেটে করে নৌকো আনতে পারব না। 

যেই পারব, তারে পাঠাইলেই পারতান। নরেশ বলে। 

না, সুপুরি গাছের ব্যাপারটা কী? অফিসার জিজ্ঞাসা করে। 

তার কথায় কেউ জবাব দেয় না। রঘু ঘোষ বোঝে, চরের বানভাসি এই লোকজন ঐ কথাটি অফিসারকে বলতে চাইছে না যে, ভেসে আসা লোকটি সুপুরি গাছে উঠে উধাও হয়ে গেছে। এটা বললে, তাদের সমস্ত বক্তব্যটাই হালকা হয়ে যাবে। অথচ লোকটি যদি ঐ চালের ওপর এখনো বসে থাকত তাকে উদ্ধার করার জন্যে এদের এত মাথাব্যথা হত না। তিস্তার এই ফ্লাডে যে ভেসে এসে একটা চালে উঠতে পারে সে নিজেকে বাঁচাতেও পারে। কিন্তু তাকে আর দেখা যাচ্ছে না বলেই নৌকো করে ওখানে গিয়ে দেখে আসা দরকার, এদের আসল ইচ্ছে সেটাই। 

শুনুন, বলে রঘু ঘোষ হাসে, আমরা এসে শুনলাম ঐ লোকটি সুপুরি গাছে উঠেছে কিন্তু আর নামে নি। এখন আপনারা মিলিটারির নৌকো নিয়ে এসে ওখানে দেখুন লোকটি আছে কি নেই। 

হয়, একটু সমবেত স্বরে শোনা যায়। 

ফ্লাডের ভেতর চালের ওপর একটা লোককে দেখতে-দেখতে দিন কাটানো যায়, না দেখতে-দেখতেও রাত পোয়ানো যায়। কিন্তু লোকটা সুপুরি গাছে উঠে উধাও হয়ে গেলে, ফ্লাডের তিস্তায় একটা লোক সুপুরি গাছ বেয়ে উধাও হয়ে গেলে, তাদেরই চর থেকে উধাও হয়ে গেলে, তারা এই বাঁধের ওপর বসে থাকবে কোন ভরসায়? না হয় এখন তাদের বাড়িজমির ওপর দিয়ে কয়েকমানুষ-ডোবা জল এই বেগে বয়ে যাচ্ছে। তবু তারা ঐ চরের মুখোমুখি এই বাধে তাদের গরুবাছুর, ছাওয়াছোট, বেটিছোয়া নিয়ে ত অপেক্ষা করে আছে যে জল একদিন নামবে ও তারা আবার কাদামাটি ভেঙে তাদের চর চিনে নিতে পারবে। এর মধ্যে কিছু অনিশ্চয়তা ত আছেই–তিস্তা ঐ চরটাকে খেয়ে দিয়েছে কি না তা ত জল না নামলে বোঝা যাবে না, কিন্তু এখন ঐ জলঢাকা চরে কি আরো এমন কোনো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, যার ওপর তিস্তার ফ্লাডেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? যে-লোকটার ভেসে আসা তাদের দেখা, টিনের চালের ওপর বসে থাকা তাদের দেখা, সুপুরি গাছ বেয়ে ওঠাও তাদের দেখা-সূপুরি গাছ থেকে সেই লোকটার না-নামাও ত তাদের দেখা। তা হলে তাদের চরের ওপর দিয়ে তিস্তার বন্যাই যে বয়ে যাচ্ছে তা নয়, সুপুরি গাছের মাথা দিয়ে যাদের যাতায়াত তারাও কি এসে চরটার দখল নিয়ে নিল নাকি? সেইটি যাচাই করার জন্যেই মিলিটারি দরকার, মিলিটারির নৌকো দরকার। কিন্তু সেই দাবিটা যে অফিসারের কাছে করা যায় না, তা এরা বোঝে। 

.

১৩৯. বাঘারুউদ্ধার সংক্রান্ত বাজেটবিতর্ক

 মানে? লোকটা সুপুরি গাছে উঠেছে, আপনারা দেখেছেন? অফিসার ভিড়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে। 

হয়, ভিড়টা মাথা নাড়ে। 

তারপরে আর নামে নি, সেটাও দেখেছেন?

হয়।

 গাছের ওপর থেকে পড়েটড়ে যায়নি ত?

কেউ কোনো জবাব দেয় না।

আপনারা দেখেছেন, পড়েটড়ে যায়নি ত? 

আবারও সেই একই নীরবতা। একটু পরে আড়াল থেকে জগদীশ বারুই বলে ওঠে, পইড়লে ত অবার উইঠত চালে? 

সুপুরি গাছের মাথাটা জল থেকে খুব বেশি উঁচুতে নয়। সেখান থেকে পড়ে গেলে স্রোতের টানে লোকটি ভেসে যেতে পারে, কিন্তু ভেসে যেতে-যেতে আবার ঐ চালটাতে, বা, ঐ দিকের আর-একটা সুপুরি গাছে বা আরো দু-একটা চালে উঠতেও পারে–এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা বেশি সম্ভাব্য অফিসার সেটা মনে-মনে যাচাই করে। যাচাই করতে গিয়ে সে জগদীশ বারুইয়ের প্রশ্নটার সামনে পড়ে যায়–লোকটি যদি কোনো রকমে ভেসে যাওয়া থেকে নিজেকে ঠেকাতে পারত, তা হলে ত তাকে আবার দেখা যেত। ঐখানে গিয়ে যাচাই করে না এলে কী করে জানা যাবে, লোকটি আছে কি নেই। অফিসার মনে-মনে খুব সতর্ক হিশেব কষে। তারা একটু দেরি করে এসেছে এই আন্দাজ থেকেই যে এর মধ্যে এখানকার লোকজন নিজেদের মত একটা ব্যবস্থা করে নেবে। দুপুরের পর দ্বিতীয় ফোনটা পেয়ে তাদের ঠিক করতে হয় যে এখানে আসতে হবে। কিন্তু এটা অফিসারের আন্দাজের মধ্যে ছিল না যে, সত্যি করেই এখানে এখন নদীতে নৌকো ভাসাতে হবে। অফিসার এটা বোঝে যে এই চারপাশের ভিড়টা তাকে কিছু না করে চলে যেতে দেবে না। এক, ফোন করব বলে গাড়ি নিয়ে রায়পুরে গিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে পারে–এখানে সেপাইদুটোকে রেখে। এখন যদি সে সত্যি কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কথা বলে তা হলেও নতুন কোনো ব্যবস্থা সন্ধ্যার আগে করা সম্ভব নয়। মিলিটারির নৌকো ব্যাপারটা ভুয়ো। তাদের কিছু রাবারের নৌকো আছে–সে-নৌকো নিয়ে স্রোতের এ বেগ সামলানো যাবে না। অফিসার ঘড়ি দেখে-সাড়ে তিনটে বেজে গেছে, তার হাতে আর বড় জোর ঘণ্টা খানেক-ঘণ্টা দেড়েক সময় আছে। এখান থেকে কোনো নৌকো ভাসালে সেটা ফেরার পথে বিপদে পড়তে পারে, ততক্ষণে অন্ধকারও হয়ে যাবে। 

অফিসার একটু অনিশ্চিত স্বরে বলে, আপনারা যারা ঐ চরের লোক, তারা ত সবাই চলে এসেছেন? 

অফিসারের কণ্ঠস্বরে প্রশ্নটা খুব স্পষ্ট ছিল না বলেই হয় ত কেউ. কোনো জবাব দেয় না। একটু অপেক্ষা করে অফিসার বলে, মানে, আপনাদের কেউ ত আর ওখানে নেই? চরে? 

না। তা নাই। আমরা ত এখানে ওঠা শুরু করছি শুক্রবার শেষ রাইত থিক্যা– জগদীশ বারুই আড়াল থেকে বলে। 

সে ত ভালই করেছেন যে অপেক্ষা করেন নি। তাই গরুবাছুর সবই আনতে পেরেছেন।

 সে আমাগো হিশাব আমাগো কাছে। আপনাদের উপর ভরসা করলে আর ধাধে উইঠতে হইত  নরেশ মেজাজ দেখিয়ে বলে।

অফিসার একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করে, আপনারা কী চান, সেটা বলুন, আমাকে ত কন্ট্রোলে জানাতে হবে। ঐ লোকটি ওখানে আছে কিনা সেটা দেখতে চান?

সেই লগেই ত সকাল থিক্যা ফোন করা হইল, নরেশ বলে।

শুনুন, অফিসার একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার ভঙ্গিতে বলে, আপনাদের এখানে কি কারো নৌকো আছে? 

আমাগো নৌকা নিয়্যা যাবার উপায় থাইকলে আপনাগো ফোন কইরতে যাব কুন কামে? নরেশ জবাব দেয়।

কন্ট্রোলে ফোন করে এখানে নৌকোর ব্যবস্থা করতে করতে ফ্লাডের জল নেমে যাবে–অফিসার স্পষ্ট জানায়।

তয় যে রেডিওতে-টিভিতে এত মিলিটারি দেখান? একটা মেয়েলি গলায় পেছন থেকে কেউ বলে।

সে কোথায় কী দেখায়, সে-সব আমি বলতে পারব না। আমি আপনাদের কাজের কথা বলছি। আপনারা যদি কন্ট্রোলে জানাতে বলেন, আমি রায়পুর বাগানে গিয়ে ফোন করে দিতে পারি। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার বেশি আমার ক্ষমতার বাইরে। সেখানে ডি-সি ঠিক করবেন। আর, যদি আপনারা এখান থেকে কোনো নৌকো আর মাঝি দিতে পারেন, তা হলে আমি এখনই সেটা রিকিউজিশন করতে পারি। 

কী কইরব্যার পারেন? অমূল্য নরেশের পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করে।

 আমরা এখনই ভাড়া করে নেব।

আগে কইলেন নৌকা চাই, এ্যাহন কইলেন মাঝি চাই। তা আপনারা রেসকুটা কী কইরবেন? জগদীশ বারুই স্পষ্ট গলায় আড়াল থেকে বলে। 

না। আমরা গবমেন্ট থেকে নৌকোর ভাড়া দেব, মাঝিদের ওয়েজ দেব মানে মাঝিদের টাকা দেব। 

অফিসারের কথার পর হঠাৎ সবাই চুপ করে যায়। ঠিক বোঝা যায় না, এই নীরবতার অর্থটা কী? রঘু ঘোষ একটু অপেক্ষা করে বলে, কী? এখানে নৌকো আছে কারো? 

আরে এহানে যে-নৌকা সেকি এই জলের টান সামলাবার পারব? আর নৌকাড়া নিয়্যা যাবেনে কে? কত টাকা দিবেন যে মানষি এই জলে ভাইসবে? জগদীশ প্রশ্ন করে। 

এই অবস্থায় টাকা নিয়ে ত আর দরাদরি করব না আপনাদের সঙ্গে। আপনারা কত চান, বলুন না। নৌকো আছে এখানে? 

আবার সবাই চুপচাপ। সেই নীরবতার মধ্যেই ভিড়টা যেন একটু আলগা হয়ে যায়। অমূল্য আর নরেশ প্রায় কানে কানে কথা বলতে-বলতে বাঁধের কিনারার দিকে একটু আড়ালে চলে যায়। আরো কিছু-কিছু এমন কথা হয়। আর, মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসার কেমন একা হয়ে যায় যেন, তার সঙ্গে সকলের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে। আরো একটু অপেক্ষা করে অফিসার গলাটা তুলে বলে, শুনুন, আর দেরি করা যাবে না। হয় আপনারা নৌকো দিন, আর না-হয় আমি রায়পুর বাগানে গিয়ে কন্ট্রোলে ফোন করব। তারপর কন্ট্রোল যা করার করবে। ম্যানেজারবাবু, অফিসার পেছনে তাকায়। 

রঘু ঘোষ হে-হে করে হেসে বলে, ম্যানেজারবাবু চলে গেছেন। আমরা আছি, আপনি গেলে চলুন। 

আপনি বাগানের?

 হ্যাঁ। 

নরেশ আর অমূল্য ফিরে আসে, এসে দাঁড়িয়ে থাকে। অফিসার তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, কী হল? নৌকো পাওয়া যাবে? 

তা যাবেনে। আমরা চারজন যাবার পারি। কিন্তু মাথাপিছু আড়াইশ টাকা দিবার লাগব। নৌকার ভাড়া আলাদা, নরেশ বলে। 

নরেশ কথাটা বলে ফেলার পর হঠাৎ যেন চারপাশের সবাই চুপ করে যায়। শুধু বাতাস আর বৃষ্টির আওয়াজটা বেড়ে ওঠে। এই ভিড়ের ভেতর যারা বাগানের আর হাটের তারা হয়ত এখন একটা দরকষাকষির উত্তেজনাতেই চুপ করে যায়। আর, ঐ চরেরই যে বানভাসিরা ভিড়ের মধ্যে ছিল, তারা নরেশের কথাতেই হঠাৎ বুঝে ফেলে, তাদের নিজেদেরই চরে গিয়ে ফিরে আসার দাম এখন এতটাই বেড়ে গেছে। 

অফিসারই প্রথম কথাটা বলে, সে কী হে? তোমাদের একটা লোক নাকি ওখানে চালের ওপর পড়ে আছে। তোমাদেরই ত উচিত ছিল এতক্ষণ নৌকো করে লোকটাকে নিয়ে আসা। আমরা খরচা করতে রাজি আছি শুনেই হাজার টাকা দর হাঁকলে–কথাটা শেষ করে অফিসার এদিক-ওদিক তাকায়, তারপর রঘু ঘোষের চোখ পেয়ে যায়। রঘু হে-হে করে হেসে অফিসারের কথাটাতে অন্য জোর সঞ্চার করে দেয়। 

কিন্তু রঘু ঘোষের হাসির পরও এই ভিড়ের নীরবতা ভাঙে না। একটা গোহাটে যেমন গরু কেনাবেচার সময় একটা গরু নিয়ে সারা দিন ধরেই দর কষাকষি চলতে থাকে, এখন বাঁধের ওপর যেন সেরকম একটা পরিস্থিতিই তৈরি হল। নরেশ-অমূল্য ভিড় থেকে একটু সরে গিয়ে মাটির ওপর উবু হয়ে বসে পড়ে–কিন্তু নিজেদের মধ্যেও কোনো কথা বলে না। ভিড়টা একটু আলগা হয়ে যায়–কেউ-কেউ অফিসারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ-কেউ আবার সরে গিয়ে নরেশ অমূল্যর কাছে দাঁড়ায়। ভিড়টা একটু আলগা হওয়ার পর বোঝা যায়, অফিসারের ডান দিকে পেছনে জগদীশ বারুই মাটিতে বসে।

বললে যে, নৌকো পাওয়া যাবে, নৌকো কোথায়? অফিসার বলে কিন্তু সে কথার জবাব কেউ দেয় না। একটু অপেক্ষা করে অফিসার এবার গলা তুলে ও ঘাড়টা ঘুরিয়ে বলে, কী? এখানে নৌকো কার আছে? কোথায়? 

অফিসারের কথার কেউ জবাব দেয় না। এবার একটু অধৈর্য হয়েই অফিসার বলে, বাঃ। তোমাদের হাজার টাকা দিতে রাজি হলে নৌকো পাওয়া যাবে আর তা না-হলে পাওয়া যাবে না? ফ্লাডের সময় এরকম করা কিন্তু বে-আইনি। 

এবারও কেউ কোনো কথা বলে না কিন্তু অনেকেই নরেশ-অমূল্যর দিকে তাকায়। সেই চাহনি অনুমান করেই বুঝি নরেশ-অমূল্য মাথা নিচু করে মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁকিবুকি কাটে। অশ্বিনী রায় পেছন থেকে এসে অফিসারকে বলে, স্যার, আমারই ঐ চালটা। লোকটা আমার গুয়াগাছটা উঠি আর নামিল না। 

পেছন থেকে জগদীশ বারুই হেসে দুই হাত ঘুরিয়ে বলে, কিসের মধ্যে কী, পান্তাভাতে ঘি। কথা হব্যার ধইরছে রেসকুর, উনি কন উনার গুয়াবাড়ির কথা। জগদীশের মন্তব্যে একটুআধটু হাসিমশকরা। শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু যারা হাসতে পারত বা পাল্টা মন্তব্য করতে পারত তারা মুখ খোলে না। পরিস্থিতিটা একটু বেশি গম্ভীর হয়ে যায়। অশ্বিনী রায় তার সঙ্গে কথা বলায় অফিসারও যেন একটা অবলম্বন পেয়ে যায়। সে অশ্বিনী রায়কেই জিজ্ঞাসা করে, আমি ত তখন থেকে চেঁচাচ্ছি এখানে নৌকো কার আছে, আপনারা ত তার কোনো জবাব দিচ্ছেন না। তা আমি কি সাঁতার কেটে গিয়ে লোকটাকে ধরে আনব? এখানে নৌকো কোথায় আছে? অফিসার রঘু ঘোষের দিকে ফিরে বলে, আপনারা জানেন নাকার নৌকো আছে? 

আমরা কী করে জানব। আমরা কি রোজ এখানে আসি নাকি? রঘু ঘোষ হে-হে করে অফিসারের মুখের ওপরই হাসে।

আপনাদের বাগান নদীর এত কাছে, আপনারা নৌকো রাখেন না কেন একটা? অফিসার আচমকা রঘু ঘোষকেই জিজ্ঞাসা করে। রঘু ঘোষ প্রশ্নটা শুনে প্রথমে অ্যা বলে ফেলে, তারপর তার সেই হে-হে হাসিটা এবার অনেকক্ষণ ধরে হাসে। সেই হাসিটা শেষ করে জামার হাতায় মুখ মুছে সে বলে, বাঃ, আপনাদের বছরে-দু বছরে কখন দরকার হবে সেই জন্যে কোম্পানি বাগানে নৌকো পুষবে? 

জগদীশ বারুই পেছন থেকে বলে ওঠে, হয়। আপনারা নৌকা রাইখবেন, আলকাতরা মাখাইবেন, গাব ঘইষবেন আর উনারা আইস্যা বছরে একবার জিপে কইর‍্যা নৌকোবিলাস কইরবেন। 

অশ্বিনী রায় নরেশ-অমূল্যর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নরেশ-অমূল্য কেউই তার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। অশ্বিনী রায় একটু দাঁড়িয়ে থেকে সেখানেই উটকো হয়ে বসে। যেন তার পা ধরে গিয়েছে তাই বসেছে, এমন ভাবে বসে থাকে। একটু পরে নরেশের দিকে তাকিয়ে বলে, পুছিবার ধইচছে নৌকাখান কার? তা ক কেনে, কয়ি দে। সরকারের অফিসার 

নরেশ বলে, আপনে কয়্যা দ্যান না, আমাগো কাছে আইছেন ক্যান? আমাগো ত নৌকা নাই। 

নরেশ একটু জোরেই বলে–অনেককে শুনিয়ে। কথাটার মধ্যে একটু ঝাঁঝ ছিল–সেটা অশ্বিনী রায় বুঝতে পারে। তাই এমন মুখভঙ্গি করে বসে থাকে যেন কথাগুলো তাকে বলা হয় নি।

জগদীশ বারুই তার জায়গা থেকে উঠে নরেশের পাশে এসে বসে খুব নিচুগলায় বলে, সাতশতে রাজি হয়্যা যা, আমি কয়্যা দিচ্ছি, তগ মাথা পিছু দ্যাড়শ, আর একশ আমারে দিবি। 

আপনে আবার এর মধ্যি বাসায় চাট মাইরবেন! দ্যাড়শতেও রাজি হবনে না। নরেশও প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলে। 

তরা রাজি কি না সেইডা ক। অফিসার রাজি হয় কি না-হয় আমি বুঝব নে। অমূল্যরে জিগা। 

নরেশ অমূল্যর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলে যায়। তারপর জগদীশের দিকে ঘুরে জানায়, অমূইল্যা মাথাপিছু দুইশর কমে রাজি না। আর আপনার আবার কমিশন কিসের? 

জগদীশ শ্লেষ্মাজড়িত হাসি হেসে বলে, তগই ভাল হইত। আমারে একশ দিতি। না-দিস ত আমিই অফিসারের কনট্রাক্ট নিব–তহন পঞ্চাশ টাহাও পাবি না, কথাটা বলে জগদীশ বারুই দাঁড়ায়–দুই হাতের আঙুল জড়িয়ে মাথার ওপর তুলে মটকায়, আওয়াজ করে একটা হাইও তোলে। 

ততক্ষণে আর-একটু বিকেল হয়েছে, যদিও বিকেলটা তেমন বোঝাই যায় না। জগদীশ বারুই তাদের মগ্ন চরের দিকে একবার তাকায়। একটু তাকিয়ে থেকে বলে, মানষিডা চোখের সামনে ভাইস্যা আইসল, আর সুপুরি গাছে চইড়্যা চইল্যা গেল?

বাঘারুর সেই নিরুদ্দেশ নিয়ে এখানে দরকষাকষি শুরু হয়। সে দরকষাকষি এই বাতাস আর বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যায়। বাঘারু জানবে কী করে যে সে সুপুরি গাছের মাথায় চড়ে আছে না ভেসে গেছে শুধু এইটুকু দেখে যাওয়ার জন্যে সরকারের অফিসারের সঙ্গে দরদাম নিয়ে কথাবার্তা চলছে। বন্যাতে অনেকেরই অনেক কিছু ভেসে চলে যায়, আবার অনেকের কাছেই ত অনেক কিছু ভেসে আসেও। জগদীশ, নরেশ ও অমূল্য বুঝতে পারে না–তাদের কাছে সত্যি কিছু ভেসে আসছে কিনা। তারা ভাসিয়ে আনতে চাইছে। 

অফিসার বলে, দেখুন, আমি ত এখানে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমি দেখলাম–কোনো লোক রেসকিউ করার নেই। আমি সেই কথাই রিপোর্ট করব। আর, তা না হলে আপনারা নৌকো কোথায় বলুন–আমরা রেসকিউয়ের ব্যবস্থা করছি। 

.

১৪০. বাঘারুউদ্ধার নিয়ে আলোচনাসভা ত্যাগ ও পরে মতৈক্য

অফিসার একটু অপেক্ষা করে। কিন্তু অবস্থা কিছু বদলায় না। ভিড়টা আলগা হয়েই আছে, এখন যেন আরো আলগা হয়ে যেতে পারে। জগদীশ বারুই বাঁধের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নরেশ-অমূল্যকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারাও একটু-আধটু তফাতে সরে যায়। অফিসার নদীর দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ায় উত্তর মুখো। বানভাসি লোকদের দুটো-চারটে গরু বাধা আছে কিন্তু তারপর ফাঁকা। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অফিসার নদীর দিকে একেবারে পেছন ফিরে সোজা হাঁটা দেয়।

অফিসারের পেছনে একটা ছোট ভিড় ছিল। অফিসার যে হাঁটা দেবে এটা কেউ বোঝে নি। ফলে দু-একজনকে হাত দিয়ে সরিয়ে অফিসার এগিয়ে যায়। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ভিড়ের লোজন তাকে পথ করে দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে থাকে। রঘু ঘোষ অফিসারের পেছনে দু-এক পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। 

কেউই বুঝতে পারে না–অফিসার কোথায় যাচ্ছে। প্রথমে ভাবে–বোধহয় সঁহ্যাঁড়ানোর জায়গা বদলাচ্ছে। তারপর ভাবে, পেচ্ছাব করতে যাচ্ছে। পেচ্ছাব করতে হলে ত বাঁধের ওপরই উত্তর দিকে দু-পা গেলে হত। কিন্তু হয়ত বাঁধের ওপর থেকে অফিসারের পেচ্ছাব করা চলে না। ততক্ষণে অফিসার বাঁধের নীচে নেমে তার জিপের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। বাঁধের নীচে নেমে অফিসার চলে যাচ্ছে। 

অশ্বিনী রায় ক্ষীণ স্বরে বলে, এ নরেইশ্যা, আরে অফিসার যে চলি যাছে রে, দেখ কেনে। 

শুনে নরেশ-অমূল্য উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই গলা উঁচিয়ে দেখে। কিন্তু বুঝতে না পেরে আঙুলের ওপর ভর দিয়ে তাকায়। পেছন থেকে জগদীশ বারুই মাথার ওপর দুই হাতের তালি বাজিয়ে বলে ওঠে, নেরে অমূইল্যা, তগ হাজার টাকা জিপে চইড়্যা চইল্যা গেল। এহন নিজের হাত নিজে চাট বইস্যা বইস্যা। 

নরেশ গোড়ালি মাটিতে নামিয়ে জগদীশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, চইল্যা গেল! মানে? আপনারা কি এহানে বইস্যা বইস্যা তামাশা দেইখতেছেন? চলেন, জিপটারে আইটক্যান। এই পর্যন্ত বলে নরেশ জগদীশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বাতাসে হাত ঘুরিয়ে বলে, এই চলো সবাই, জিপ আটকাও, জিও আটকাও। 

বলে নরেশ, অমূল্যর আর পাশে যাকে পেল তার, হাত ধরে টেনে বাধ থেকে হুড় হুড় করে নীচে নেমে অফিসারের দিকে দৌড়তে শুরু করে। তাদের সঙ্গে-সঙ্গে আরো দু-একজন নামে। তারও পরে কিন্তু একটু বেশি পেছনে, আরো দু-একজন হেঁটে নামে, হেঁটে-হেঁটেই জিপগাড়ির দিকে যায়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। বানভাসিদের বেশির ভাগই বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ-কেউ নদীর দিক থেকে রাস্তার দিকে গিয়ে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। যারা নিজেদের জিনিশপত্রের আড়ালে শুয়েবসে ছিল, তারা সেখান থেকে যায় না। 

সকালে যখন অশ্বিনী রায়ের চালের ওপরে বাঘারুকে প্রথম দেখা গিয়েছিল তখন বাধসুন্ধু মানুষই, এক নিতাই ছাড়া, ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন, যখন তাকে উদ্ধার করে আনবার জন্যে শহর থেকে অফিসার এসে কিছু না করে ফিরে যাচ্ছে, তখন কারো আর সে ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই। বাঘারুকে আর দেখা যাচ্ছে না, লোকটা ওখানে আছে কি নেই তাইই বোঝা যাচ্ছে না, ভেসে গেলে ত ভেসেই গেছে–এরকম একটা যুক্তি ত ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। লোকটা সুপুরি গাছে চড়ে উধাও হয়ে গেছে–এর ভেতরকার রহস্য ও ভয় ইতিমধ্যে এই এত বৃষ্টিতে, হাওয়ায় ও কথায় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। ফ্লাডের তিস্তায় এমন ভৌতিক দৃশ্য, এখন অবান্তর অথচ ভবিষ্যতের প্রাসঙ্গিক, গল্প হয়েই থাকল। সারা দিনের মধ্যে হাওয়া আর বৃষ্টি যে একটুও কমল না–সেটা আরো বেশি বাস্তব ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে এই বিকেলে। আজও সারা রাত এই বৃষ্টি আর হাওয়া যদি চলে তা হলে ফ্লাডের চেহারা কী হবে তা এরা কেউ ভেবে উঠতে পারছে না। ভাবতে চাইছেও না হয়ত! কিন্তু সেই ভাবতে না-চাওয়ার মধ্যেই নিজেদের প্রস্তুত করে তুলছে আরো বিপদের জন্যে। 

তা ছাড়াও এই ভিড়ের ভেতর আর-একটা অনিশ্চয়তাবোধ এই বিকেল থেকেই ছড়াতে শুরু। করেছে। এদের হিশেব অনুযায়ী আজই ফ্লাডের চরম দিন হওয়ার কথা। কিন্তু এই ফ্লাড় যদি আরো বাড়তেই থাকে, তা হলে কি তাদের চরের আর কিছু বাকি থাকবে? যেন তারা জানত, এই আজকে দুপুর পর্যন্ত যত জল এসেছে তার তলায় তাদের চরটা তাদেরই থেকে যাবে। কিন্তু এর পরও জলের যে-ঢল নামছে তাতে তাদের চরের জমিও নদীর সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তা হলে? আবার কে। কোথায় ঘর খুঁজবে? জমি খুঁজবে? 

এ-সব কথা এখনো কেউ মুখে বলে নি, বলবেও না। কিন্তু কথাগুলো ভেতরে-ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে। যখন তারা এই ঘটনার মুখোমুখি পড়ে যাবে তখন হয়ত সকলে প্রস্তুত হয়ে যাবে–একটা চর ডোবা মানে ত আর-একটা চর জাগা! কিন্তু সেই প্রস্তুতির জন্যেও ত একটা সময় দরকার। যখন অফিসার এসে কথা বলছিল, ফ্লাড় দেখতে আসা রায়পুর রংধামালির লোকজন ভিড় করেছে, তখনই, বানভাসি মানুষদের ভেতরে-ভেতরে বৃষ্টি আর হাওয়া আর নদীর জলের হিসেবনিকেশ শুরু হয়ে গেছে। তাই তারা এ-সব দর্শনার্থীদের সম্পর্কে কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়ে। 

তাও অফিসার পালিয়ে যাচ্ছে, তাকে ধরার জন্যে নরেশ হাঁক দিয়ে দৌড়ল, নরেশের সঙ্গে-সঙ্গে বা পেছনে-পেছনে তাদেরও ছোটারই কথা। অন্তত তাদের চরের ওপরই ত লোকটাকে সকালে দেখা গিয়েছিল, সুতরাং লোকটাকে উদ্ধার করা যেন তাদের চরেরই একজনকে উদ্ধার করা। 

কিন্তু অফিসার নৌকোর ভাড়া আর মাঝির টাকা দেবে শুনে নরেশ মাথাপিছু আড়াইশ, তার মানে চার জনের এক হাজার, নৌকোর ভাড়া আলাদা, বলল যখন, তখন থেকেই যেন চরটাও আর তাদের থাকল না, চরের ঐ মানুষটাও আর তাদের মানুষ থাকল না। এরকম ফ্লাডে, এরকম বিপদের মধ্যে নৌকো নিয়ে যারা যাবে তারা তাদের খুশিমত টাকা চাইতেই পারে। এ ফ্লাডে নৌকো ভাসানোর বিপদও ত কম না! সে টাকা যে দিতে পারবে সে পারবে, যে পারবে না সে পারবে না। কিন্তু এটা ত সরকারি টাকা। নরেশ আর অমূল্য প্রথমে রাজি হয়ে সাহস করে বলতে পারল বলেই টাকাটা তারা পাচ্ছে–এটাতে চরের অন্য সব লায়েক মানুষের ত একটু দুঃখ হতেই পারে। সরকার যদি নিজের নৌকোয় নিজের মাঝি নিয়ে রেসুক করত সেটা হত সরকারের ব্যাপার। কিন্তু তিস্তার বন্যায় ভাসল একটা লোক, কে তা কেউ জানে না; সে নিজেই সাঁতরে উঠল অশ্বিনী রায়ের চালে; তারপর নিজেই সুপুরি গাছ বেয়ে উঠে গেল–এখন সেই লোকটার নাম করে নরেশ-অমূল্য আর-দু-জনকে নিয়ে হাজার টাকা পকেটে ভরবে–এটা কেউ ভাবতেই পারে নি। সকালে যখন এ নিয়ে শোরগোল পড়েছিল, তখন ত সবাইই লোকটাকে দেখে অস্থির হয়ে উঠেছে। তাই তে ফোনাফুনি। কিন্তু সকালের এই শোরগোল বিকেলবেলা নরেশ-অমূল্যর ব্যবসা হয়ে উঠবে, তা কে জানত? এখন নরেশ-অমূল্য যদি অফিসারকে ঘেরাও দিয়ে নৌকোর টাকা আদায় করতে পারে ত করুক। কিন্তু চরের মানুষরা নরেশ-অমূল্যর জন্যে হয়ত তে যাবে কেন? করতে পারে ত 

হয়ত নিতাই থাকলে এ সব ঘটত না। পঞ্চায়েতের লোক হিশেবে অফিসারের সঙ্গে নিতাইই কথা বলত। আর, নিতাইয়ের সঙ্গে কথা হলে এই সব টাকা-পয়সার কথা হয়ত উঠতেই পারত না। বিনি পয়সাতেই নিতাই হয়ত নৌকা ভাসাত। কিংবা, এ নিয়ে মাথাই ঘামাত না। কিন্তু নিতাই ত সারাদিন শহরে–রিলিফের খোঁজে।

অফিসার জিপের কাছে পৌঁছনোর আগেই নরেশরা অফিসারকে ধরে ফেলে। ধরে ফেলে মানে অফিসারই ওদের দৌড়নোর আওয়াজে পেছন ফিরে ওদের দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সোজাসুজি ঘুরে দাঁড়ায় না, বাঁধের দিকে মুখ করে ওদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অফিসার অবিশ্যি নরেশের চিৎকার আগেই শুনতে পেয়েছে, ওরা যে দৌড়ে তার দিকে আসছে সেটাও টের পেয়েছে কিন্তু তার মনে হয়েছিল আগেই জিপের কাছে পৌঁছে যাবে। খানিকটা আসার পর তার সেপাই দুজনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় এই যুক্তিও চলে আসে সে আসলে সেপাই দু-জনকে ওখানে পোস্টিং করে এসেছে কোনো লোক নদীতে ভেসে আসে কি না তার ওপর নজর রাখতে। কিন্তু আরো খানিকটা এগিয়ে তার মনে হয়, এভাবে জিপে চড়ে চলে গেলে ব্যাপারটা খারাপ হতে পারে। আবার এখান থেকে ডি-সিকে হয়ত ফোনটোন করবে, মাঝরাতে তাকে আবার হয়ত এখানে পাঠাবে। তখন ত তার পক্ষে এখানে কিছু করাও মুশকিল হবে। এত কিছু ভেবে অফিসার দাঁড়িয়ে পড়ে। 

কিন্তু নরেশ-অমূল্য যেভাবে তার দিকে ছুটে আসছে, তাতে সে একটু ভয়ও পায়। বেশির ভাগ লোক বাঁধের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে দেখে আবার একটু ভরসাও পায়–এরা নিশ্চয়ই তাকে কিছু করবে না। তার ত কোনো দোষ নেই। এরা প্রায় দেড়-দু হাজার টাকা চেয়ে বসেছে, পঁচশ টাকার বেশি খরচ করার ক্ষমতাই তার নেই। কিন্তু তার বোধহয় এরকম আচমকা চলে আসাটিও ঠিক হয় নি। এখন যদি এরা এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় সেটা আরো খারাপ হবে, সে আর এখান থেকে ফিরতেই পারবে না। অফিসার আবার জিপের দিকে হাঁটতে শুরু করে–এবার একটু আস্তে-আস্তে। 

জিপের কাছে পৌঁছুবার আগেই নরেশ-অমূল্য, আর তাদের সঙ্গে যারা দৌড়চ্ছিল তারা, তার পেছনে এসে পড়ে। অফিসার দাঁড়ায় না, ঘাড়ও ঘোরায় না। নরেশ-অমূল্য তার কাছাকাছি পৌঁছে পেছনে-পেছনে হাঁটে আর জোরে-জোরে শ্বাস ফেলে কিন্তু কিছু বলে না। 

অফিসার জিপের ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাও, ঐদিক দিয়ে রায়পুর যাব, বলে গাড়ি ঘোরানোর জন্যে অপেক্ষা করে। 

তখন নরেশ বলে, আপনি কি চইল্যা য্যান নাকি?

তাদের দিকে মুখ না ঘুরিয়ে অফিসার বলে, শুনলেই ত কী বললাম?

তা ঐ লোকটার রেসকুর কী হবে নে? 

ওখানে ত কোনো লোক দেখলাম না। তোমরা বলছ লোক আছে। বললাম, লোক দাও, নৌকো দাও, টাকা দেব, তোমরা ভাবলে এই সুযোগে পঁহ্যাঁও মারবে। তা এসব ত আমি ঠিক করতে পারব না। আমি কন্ট্রোল রুমে জানাব। তারা যা করতে বলে, তাই করব। 

নরেশ বা অমূল্য অফিসারের সঙ্গে এসব নিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলার লোক না। তা ছাড়া বানভাসি সবাই যদি তাদের সঙ্গে আসত, তারা একটা চিৎকার-চেঁচামেচি তুলতে পারত। আবার, একথাও ঠিক যে তারা পঁও মারার মতই টাকা চেয়েছে। ফলে, অফিসারকে ধরার জন্যে তাদের এতটা ছুটে আসাটা কেমন তাদের নিজেদের কাছেই অনর্থক ঠেকে। জিপ গাড়িটা ঘুরে অফিসারের সামনে দাঁড়ায়। অফিসার ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলে নরেশ এটুকুই একটু জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করে, আপনি কি ফিরা আইসবেন, না, বাগান থিক্যাই ফিরা যাবেন শহরে? 

অফিসার বলে, দেখো ভাই, আমার ক্ষমতা পঁচশ টাকা খরচ করার। তোমরা যদি তার মধ্যে করতে পারতে তা হলে আমি এখনি করে দিতাম। আমি এখন কন্ট্রোলে ফোন করব। এখন তা আর কন্ট্রোল থেকে খবর দিয়ে আর্মির নৌকো পাঠানো যাবে না। যদি হয় তাও কাল দুপুরের আগে না। তা ছাড়া কাউকে ত দেখাই যাচ্ছে না। রেসূক করবে কাকে? যাক গে। অত কথায় কাজ নেই। আমি ফোন করে তোমাদের এখানে ফিরে আসব। কন্ট্রোল আমাকে কী বলল, সেটা তোমাদের জানিয়ে চলে যাব। আমার আর-কিছু করার নেই। চলো।

ড্রাইভার গাড়িটা চালানো শুরু করতেই নরেশ বলে ওঠে, খাড়ান, খাড়ান। ড্রাইভার গাড়ি থামায়। নরেশ এগিয়ে এসে বলে, শুনেন স্যার। এই নদীর মইধ্যে আপনার মিলিটারিও নামার সাহস পাবেনে না। জলের একখান এমন-অমন ধাক্কা যদি লাইগ্যা যায়, তাহলি নৌকা উল্টায়্যা যাবে। আপনারও আর কষ্ট কইর‍্যা ফোন করার কাম নাই–ঐটা এক হাজার কইর‍্যা দ্যান নৌকার ভাড়া ধইর্যা, আমরা এহনি নৌকা ভাসাই। 

তোমরা এখনি যাবে? নৌকো কাছাকাছি আছে?

 হ্যাঁ। ঐ রংধামালি হাটের বগলে

তা হলে শোনো–আমি তোমাদের সাড়ে সাতশ টাকা দিতে পারি। কিন্তু এখন পঁচশ, কাল আমাদের অফিসে গিয়ে বাকি আড়াইশ আনতে হবে। আমাদের একটা ঘটনার জন্যে একবারে পাঁচশ টাকার বেশি খরচ করায় আইন নেই। আড়াইশ কাল তোমাদের দেব। 

নরেশ হেসে-হেসে মাথা চুলকোর্তে-চুলকোতে বলে, কাইল আর-একডা রেসকু যখন বানাইবেনই ত সেডারেও পাঁচশ টাকার রেসকু দ্যান স্যার। বাড়িঘর জমিজমা ত সব দেইখলেন, ভাইস্যা গেল। 

এবার অফিসার সস্নেহ ধমক দেয়, ওঠো ত গাড়িতে, এরপর আর তোমার নৌকো ভাসানোরও টাইম থাকবে না। ওঠো। চলো, নৌকা কোথায়, সেখানে যাব। আর কাকে কাকে নেবে, নিয়ে যাও। গাড়ি ঘোরাও। 

নরেশ একবার তাদের পেছনের ভিড়টার দিকে তাকায়। তারপর এই বালিশ, শোন, বলে একটা। ছেলেকে ডাকে, দৌড়ায়্যা যা, অশ্বিনী কাকারে কবি অর মানষিডারে হাটের বগলে পাঠাইতে। নরেশ গিয়ে জিপের পেছনে ওঠে। অমূল্য যখন ঢুকছে তখন বালিশ পেছন থেকে বলে, মোক গাড়ি নিগাও কেনে। 

নরেশ ধমকে ওঠে, কইল্যাম দৌড়ায়্যা যা।

আরে নাও না ওকে তুলে। তারপর কাকে নেবে তাকেও গাড়িতেই তুলে নাও, হেঁটে যেতে ত সময় লাগবে, অফিসার বলে।

বালিশ পেছনে উঠে পড়ে। গাড়ি বাঁধের তলা দিয়ে ঐ বানভাসিদের অস্থায়ী আবাসের দিকে চলে। নরেশ বলে, না, নৌকা যেইখানে আছে ঐ তক ত গাড়ি যাইব না। ও বাঁধ বরাবর গেলে আগে যাবে নে। 

বলতে বলতেই গাড়ি পৌঁছে যায়। বালিশ পেছন থেকে টুক করে নেমে পড়ে। বাঁধের লোজন বুঝতে পারে না, কী হল। অফিসারই নরেশ আর অমূল্যকে ধরল, নাকি নরেশ আর অমূল্যই অফিসারকে ধরল–সেটা বোঝা যায় না। নরেশ আর অমূল্যর ছুটে যাওয়া, তারপর, অফিসারের গাড়িতে চড়ে তাদের এখানে ফিরে আসা–এর ভেতর কোথাও তাদের কোনো বিপদের আশঙ্কা আছে কিনা, এই নিয়ে বাঁধের লোকজনদের ভেতর একটা অনিশ্চয়তা থাকে। 

নরেশ অফিসারের পাশ দিয়ে মুখ বের করে বাঁধের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, অশ্বিনী কাহা, কাদাখোয়ারে পাঠাইয়্যা দ্যান হাটের বগলে– তারপর মুখ ঢুকিয়ে বলে, চলেন। নরেশের কথা বলার গরম ভাপ অফিসারের ডান কানের পেছনে ও ঘাড়ে লাগে। নরেশ মাথাটা সরালে তিনি রুমাল বের করে ঘাড় মুছে নেন। গাড়ি সোজাই চলছিল। 

ঐ হাওয়ায় নরেশের কথা বধের ওপরে পৌঁছেছিল কি তা বোঝা যায় না। যদিও নরেশ যেখান থেকে কথাটা বলেছে সেখানে বাতাস প্রায় ছিলই না বাধে ঠেকে গিয়েছে।..কিন্তু বাঁধের ওপর ত বাতাস একই রকম। ততক্ষণে বালিশ বাঁধের ওপর উঠে ঘোষণা করে দিয়েছে–নৌকো ভাসবে, কাদাখোয়াকে পাঠাতে বলেছে। 

কাদাখোয়া, অশ্বিনী রায় জোতদারের মানষি, চরের সবচেয়ে ওস্তাদ মাঝি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *