ভাগ ৪ – গঠনের বছরগুলো। পরিচ্ছেদ ২ – তরুণী
সারা শৈশব ভরে বালিকা ভোগ করেছে শাসানো এবং সক্রিয়তা খর্বকরণ; তবুও সে নিজেকে মনে করেছে একটি স্বায়ত্তশাসিত মানুষ। পরিবারের ও বন্ধুদের সাথে তার সম্পর্কে, তার বিদ্যালয়ের পাঠে ও খেলাধুলোয়, তাকে মনে হয়েছে এক সীমাতিক্রমী সত্তা : তার ভবিষ্যৎ অক্রিয়তা ছিলো একটি স্বপ্নমাত্র। বয়ঃসন্ধির সাথে ভবিষ্যৎ শুধু এগিয়েই আসে না : এটা তার দেহে বাসা বাঁধে; এটা ধারণ করে চরম মূর্ত বাস্তবতা। এটা বজায় রাখে তার সব সময়ের ভয়াবহ বৈশিষ্ট্য। কিশোর যখন সক্রিয়ভাবে এগোয় প্রাপ্তবয়স্কতার দিকে, তখন কিশোরী প্রতীক্ষা করে এ নতুন, অপূর্বপরিজ্ঞেয় পর্বের সূচনার জন্যে, যার গল্পের ছকবোনা হবে এখন থেকে এবং সময় তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে-দিকে। সে ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়েছে তার শৈশবের অতীত জীবন থেকে, এবং বর্তমানকে মনে হয় এক ক্রান্তিকাল এর কোনো সুস্পষ্ট লক্ষ্য নেই, আছে শুধু অবসরকালীন কাজকর্ম। তার যৌবন নিঃশেষ হয় প্রতীক্ষায়, যা একটু কম বা বেশি ছদ্মবেশধারী। সে থাকে পুরুষের প্রতীক্ষায়।
কিশোরও নিঃসন্দেহে নারীর স্বপ্ন দেখে : সে নারী কামনা করে; কিন্তু নারী তার জীবনে একটা উপাদানের বেশি কিছু নয় : নারী তার নিয়তির সারসংক্ষেপ ধারণ করে। কিন্তু বালিকা, সে নারীত্বের সীমার মধ্যেই থাকতে চাক বা সীমা পেরিয়েই যেতে চাক, শৈশব থেকেই পূর্ণতা ও মুক্তির জন্যে সে তাকিয়ে থাকে পুরুষের দিকেই; পুরুষ ধারণ করে পার্সিউস বা সেইন্ট জর্জের দীপ্ত মুখমণ্ডল; পুরুষ ত্রাতা; সে ধনী ও ক্ষমতাশালী, তার হাতে আছে সুখের চাবি, সে সুদর্শন রাজকুমার। বালিকা মনে করে ওই রাজকুমারের আদরে তার মনে হবে যেনো সে ভেসে যাচ্ছে জীবনের বিশাল স্রোতে : আলিঙ্গন ও দৃষ্টিপাতের যাদু আবার তাকে প্রতিষ্ঠিত করবে এক মূর্তিরূপে। সব সময়ই সে দৃঢ় বিশ্বাস করেছে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে; পুরুষের মর্যাদা কোনো শিশুসুলভ মরীচিকা নয়; এর আছে আর্থিক ও সামাজিক ভিত্তি; পুরুষেরা অবশ্যই বিশ্বের প্রভু। সব কিছুই তরুণীকে বলে তার নিজের স্বার্থেই তার শ্রেষ্ঠ কাজটি হচ্ছে পুরুষের দাসী হওয়া : তার পিতামাতা তাকে তাড়া দেয় ওদিকে যেতে; তার পিতা গর্ব বোধ করে কন্যার সাফল্যে, তার মা এতে দেখতে পায় এক সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ, বন্ধুরা তাকে ঈর্ষা ও প্রশংসা করে যে বেশি পায় পুরুষের মনোযোগ; আমেরিকার মহাবিদ্যালয়গুলোতে কোনো সহপাঠিনীর সামাজিক মর্যাদা পরিমাপ করা হয় তার ‘অভিসারী’র সংখ্যা দিয়ে।
বিয়ে শুধু একটি সম্মানজনক পেশাই নয় এবং অন্যগুলো থেকে শুধু কম ক্লান্তিকরই নয় : এটাই শুধু নারীকে অক্ষত রাখতে দেয় তার সামাজিক মর্যাদা এবং প্রিয়া ও মা হিশেবে একই সাথে চরিতার্থ করতে দেয় কাম। এরূপেই তার সহচররা দেখতে পায় তার ভবিষ্যৎ যেমন সে নিজে দেখে। এ-ব্যাপারে সর্বসম্মত মতৈক্য হচ্ছে একটি স্বামী পাওয়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ‘রক্ষক’ পাওয়া তার পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে নিজেকে মুক্ত করে নেবে পিতৃগৃহ থেকে, মায়ের কর্তৃত্ব থেকে, সে খুলবে তার ভবিষ্যৎ, কোনো সক্রিয় বিজয়ের মাধ্যমে নয়, বরং অক্রিয় ও বশীভূতরূপে একটি নতুন প্রভুর হাতে নিজেকে অর্পণ করে।
মাঝেমাঝেই দাবি করা হয় যে যদি সে এভাবে হালছাড়া ভাবে মেনে নেয় বশ্যতা, তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সে ছেলেদের থেকে বস্তুগত ও নৈতিকভাবে নিকৃষ্ট এবং তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য : একটা আশাহীন প্রতিযোগিতা ছেড়ে দিয়ে উচ্চবর্ণের এক সদস্যের ওপর সে দেয় তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভার। কিন্তু সত্য হচ্ছে তার হালছাড়া ভাবের উৎপত্তি কোনো পূর্বনির্ধারিত নিকৃষ্টতা থেকে ঘটে নি : সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে, এটাই জন্ম দেয় তার সমস্ত ন্যূনতার; এ-হালছাড়া ভাবের উৎস রয়েছে কিশোরী মেয়ের অতীত জীবনে, তার চারপাশের সমাজে, এবং বিশেষ করে, তার জন্যে ধার্য ভবিষ্যতের মধ্যে।
খুবই সত্য যে বয়ঃসন্ধি রূপান্তরিত করে দেয় বালিকার দেহ। এটা এ-সময় আগের থেকেও ভঙ্গুর; নারীপ্রত্যঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাপূর্ণ, এবং কাজকর্মে সুকুমার; তার অদ্ভুত ও বিরক্তিকর স্তন দুটি একটা বোঝা, তীব্র ব্যায়ামের সময় বেদনাদায়কভাবে আন্দোলিত হয়ে ওগুলো মনে করিয়ে দেয় ওগুলোর উপস্থিতি। ভবিষ্যতে তার পেশিশক্তি, সহিষ্ণুতা ও ক্ষিপ্রতা হবে পুরুষের ওই গুণগুলোর থেকে নিকৃষ্ট। তার হরমোনগুলোর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে স্নায়বিক ও বেসো-নিয়ামক অস্থিতি। ঋতুস্রাব যন্ত্রণাকর। মাথাধরা, অতি-অবসাদ, তলপেটের ব্যথা স্বাভাবিক কাজকর্মকে করে তোলে পীড়াদায়ক বা অসম্ভব; মাঝেমাঝেই দেখা দেয় মানসিক যন্ত্রণা; স্নায়ুদৌর্বল্য ও বিরক্তিতে নারী অস্থায়ীভাবে হয়ে উঠতে পারে আধ-পাগল। এসব অসুবিধা ও অক্ৰিয় দেহের মাধ্যমে বুঝতে গিয়ে সারা বিশ্বকে তার মনে হয় এক দুর্বহ ভার। অতিভারাক্রান্ত, নিমজ্জিত, সে নিজের কাছে নিজে হয়ে ওঠে অচেনা, কেননা সে অচেনা বাকি বিশ্বের কাছে। সংশ্লেষণ ভেঙে পড়ে, সময়ের মুহূর্তগুলো আর সম্পর্কিত থাকে না, অন্য মানুষজনকে অন্যমনস্কভাবে চেনা চেনা লাগে; আর যুক্তিশীলতা অটুট থাকলেও, যেমন থাকে বিষাদচিন্তাগ্রস্ত উন্মাদরোগে, তবু ওগুলো বাড়িয়ে তোলে জৈবিক বৈকল্য থেকে উদ্ভূত আবেগগুলোকে।
তেরো বছর বয়সের দিকেই বালকেরা শিক্ষা নেয় হিংস্রতার, তখন বিকাশ ঘটে তাদের আক্রমণাত্মকতার, দেখা দেয় ক্ষমতালাভের ইচ্ছে, প্রতিযোগিতাপ্রীতি; আর এ-সময় বালিকা ছেড়ে দেয় রূঢ়খেলাধুলোগুলো। তার জন্যে নিষিদ্ধ করা হয় ঘুরে দেখা, উদ্যোগ নেয়া, সম্ভবপরতার সীমা বাড়ানো। বিশেষভাবে, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তরুণদের কাছে, তা মেয়েদের কাছে প্রায়-অজানা। এটা ঠিক, নারীরা তুলনা করে নিজেদের মধ্যে, তবে প্রতিযোগিতা, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একেবারেই ভিন্ন জিনিশ এসব অক্রিয় তুলনা থেকে : দুটি স্বাধীন সত্তা পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিশ্বের ওপর তাদের যে-অধিকার আছে, তা বাড়ানোর জন্যে; খেলার সাথীর থেকে বেশি ওপরে আরোহণ করা, একটা হাতকে জোরে চাপ দিয়ে বাঁকা করা হচ্ছে সাধারণভাবে বিশ্বের ওপর তার সার্বভৌমত্ব দাবি করা। এমন কর্তব্যঞ্জক আচরণ মেয়েদের জন্যে নয়, বিশেষ করে যখন তার সাথে জড়িত থাকে হিংস্রতা।
একইভাবে, যে-কিশোরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে তার অস্তিত্বকে কর্তৃত্বব্যঞ্জকভাবে জ্ঞাপন করতে এবং যে-কিশোরীর আবেগানুভূতির কোনো অব্যবহিত কার্যকারিতা নেই, বিশ্ব তাদের কাছে একই রকমে দেখা দেয় না। একজন নিরন্তর প্রশ্ন করে বিশ্বকে; সে যে-কোনো মুহূর্তে রুখে দাঁড়াতে পারে; তাই সে অনুভব করে সে যখন কিছু মেনে নিচ্ছে তখন সক্রিয়ভাবে সেটিকে সংশোধন করছে। অন্যজন করে বশ্যতাস্বীকার; বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হয় তার প্রতি নির্দেশ না করেই, এবং বিশ্বের বৈশিষ্ট্যগুলো ততোখানি অপরিবর্তনীয়, যতোখানি সে জড়িত বিশ্বের সাথে। শারীরিক শক্তির এ-অভাব তাকে ঠেলে দেয় আরো বেশি সার্বিক ভীরুতার দিকে : তার বিশ্বাস নেই সে-শক্তির ওপর, যা সে নিজের দেহে বোধ করে নি; সে সাহস করে না উদ্যোগী হতে, বিদ্রোহ করতে, আবিষ্কার করতে; বশ মানতে, হালছাড়া ভাব পোষণ করার জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে সে সমাজে নিতে পারে সে-স্থান, যা ইতিমধ্যেই তার জন্যে তৈরি করা হয়েছে। সে বর্তমান অবস্থাকে চিরস্থায়ী বলে মনে করে।
যুবকের কামপ্রবর্তনা শরীর নিয়ে তার গর্বকেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে; এতে সে দেখতে পায় তার সীমাতিক্ৰমণতা ও ক্ষমতার লক্ষণ। যুবতী তার কামনা মেনে নিতে পারে, তবে তাতে লেগে থাকে লজ্জাবোধ। তার সারা দেহই অস্বস্তির এক উৎস। ছোটো শিশুরূপে তার ‘অভ্যন্তরভাগ’ বিষয়ে সে বোধ করেছে যে-আস্থাহীনতা, তা-ই ঋতুস্রাবের সংকটকে দেয় সন্দেহজনক চরিত্র, যা একে ঘৃণ্য করে তোলে তার কাছে। নারীর শরীর—বিশেষ করে যুবতীর শরীর–এক স্নায়ুবিকারগ্রস্ত শরীর, এ-অর্থে যে বলা যায় এতে মনোজীবন ও তার শারীর বাস্তবায়নের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। যেহেতু তার দেহকে তার কাছে মনে হয় সন্দেহজনক, এবং যেহেতু সে একে দেখে আতঙ্কের সাথে, একে তার মনে হয় অসুস্থ : এটা অসুস্থ। আমরা দেখেছি যে আসলে এ-শরীরটি কমনীয়, এবং এতে ঘটে প্রকৃত দৈহিক ব্যাধি; তবে স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞরা একমত যে তাদের রোগীদের দশজনের মধ্যে ন-জনই কল্পিত রোগী; অর্থাৎ, হয়তো তাদের অসুস্থতার আদৌ কোনো শারীরবৃত্তিক সত্যতা নেই বা একটা মানসিক অবস্থার ফলেই ঘটে এ-দৈহিক বিশৃঙ্খলা; এটা মনোদৈহিক। নারী হওয়ার মধ্যে আছে যে-উদ্বেগ, তা-ই অনেকাংশে ধ্বংস করে নারীর শরীর।
এটা স্পষ্ট যে যদি জৈবিক অবস্থা নারীর জন্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকেই, তবে তা ঘটে তার সার্বিক পরিস্থিতির জন্যেই। স্নায়বীয় ও রক্তবাহনিয়ামক স্থিতিহীনতা যদি বিকারধর্মী না হয়, তবে তা তাকে কোনো পেশার অযোগ্য করে তোলে না : পুরুষের মধ্যেও আছে বিচিত্র ধরনের ধাত। মাসে এক বা দু-দিনের অসুস্থতা যন্ত্রণাদায়ক হলেও সেটা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়; বহু নারীই এর সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়, এবং বিশেষ করে তারা, যাদের কাছে এ-মাসিক। অভিশাপটিকে মনে হতে পারে অতিশয় বিব্রতকর : খেলোয়াড়, ভ্রমণকারী, নর্তকী, যে-নারীরা গুরুভার কাজ করে। অধিকাংশ পেশার জন্যেই এতো বেশি শক্তি লাগে না যা নারীর নেই। এটা ঠিক যে নারীর শারীরিক দুর্বলতার ফলে নারী হিংস্রতার পাঠ। নেয় না; কিন্তু সে যদি নিজের শরীর দিয়ে দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করতে পারতো নিজেকে এবং বিশ্বের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারতো অন্য কোনো ধরনে, তাহলে সহজেই এঅভাবের ক্ষতিপূরণ ঘটতো। তাকে দেয়া হোক সাঁতার কাটতে, পর্বতের চুড়োয় উঠতে, বিমান চালাতে, প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে, ঝুঁকি নিতে, রোমাঞ্চের জন্যে বাইরে যেতে, তাহলে সে ভীরুতা বোধ করবে না বিশ্বের মুখোমুখি। একটি সার্বিক অবস্থা, যা নারীকে বিশেষ কোনো বহিঃপ্রকাশের সুযোগ দেয় না, তার ভেতরেই নারীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো লাভ করে গুরুত্ব–সরাসরি নয়, বরং শৈশবে গড়ে ওঠা হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষাকে প্রমাণ করে।
অধিকন্তু, এ-গূঢ়ৈষা ভারি হয়ে চেপে থাকবে তার মননবৃত্তিক সিদ্ধির ওপর। প্রায়ই বলা হয় যে বয়ঃসন্ধির পর বালিকা মননগত ও শৈল্পিক এলাকার অধিকার হারিয়ে ফেলে। এর আছে অনেক কারণ। একটা অতিসাধারণ কারণ হচ্ছে কিশোরীকে তার ভাইদের মতো উৎসাহ দেয়া হয় না। বরং ঘটে তার উল্টোটা। তার কাছে চাওয়া হয় সে নারীও হবে, এবং তার পেশাগত পাঠের দায়িত্ব যুক্ত করতে হবে তার নারীত্বের দায়িত্বের সাথে।
গৃহস্থালির দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজগুলো ও নীরস একঘেয়ে প্রাত্যহিক খাটুনি, মায়েরা যা বিদ্যালয়ের ছাত্রী বা শিক্ষানবিশ কন্যার ওপর চাপিয়ে দ্বিধা করে না, সেগুলো তাদের খাটিয়ে খাটিয়ে নিঃশেষ করে ফেলে। যুদ্ধের সময় সেভরেতে আমার ক্লাশে আমি ছাত্রীদের দেখেছি, বিদ্যালয়ের কাজের সঙ্গে যাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো গার্হস্থ্য কাজের অতিরিক্ত ভার : একজন হঠাৎ পড়ে যায় পটের রোগে, আরেকজন মেনিনজাইটিসে। মা, যেমন আমরা দেখতে পাবো, গোপনে গোপনে তার মেয়ের মুক্তির বিরোধী, এবং সে তার কন্যাকে কম-বেশি স্বেচ্ছাকৃতভাবে পীড়ন করে; কিন্তু পুরুষ হওয়ার জন্যে পুত্রের চেষ্টাকে শ্রদ্ধা করা হয়, এবং তাকে দেয়া হয় প্রচুর স্বাধীনতা। কন্যাকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়, চোখ রাখা হয় তার আসা-যাওয়ার ওপর : তার নিজের হাস্যকৌতুক ও আনন্দোপতভাগের অধিকার তাকে দেয়া হয় না। এটা দেখতে পাওয়া খুবই অস্বাভাবিক যে নারীরা নিজেরা আয়োজন করেছে দীর্ঘ পথযাত্রার বা পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে প্রমোদভ্রমণের, বা তারা নিজেদের নিয়োজিত করেছে বিলিয়ার্ডজ বা বাউলিংয়ের মতো খেলায়।
নারীর শিক্ষার জন্যে যতোখানি উদ্যোগ নেয়া দরকার, তা তো নেয়াই হয় না, এছাড়াও প্রথা স্বাধীনতাকে তাদের জন্যে কঠিন করে তোলে। যদি তারা পথে ঘোরাঘুরি করে, তাদের দিকে সবাই তাকায়এবং লোকজন এগিয়ে আসে তাদের সাথে গায়ে পড়ে আলাপ করতে। কিছু তরুণীকে আমি চিনি, যারা একেবারেই ভীতু নয়, তবুও তারা প্যারিসের পথে একলা হেঁটে কোনো আনন্দ পায় না, কেননা নিরন্তর তারা ডাক পায় দেহদানের জন্যে, এজন্যে তাদের সব সময় থাকতে হয় সতর্ক, এতে নষ্ট হয় তাদের সুখ। বিদ্যালয়ের মেয়েরা যদি দলবেঁধে রাস্তায় দৌড়োদৌড়ি করে, যেমন ছেলেরা করে, তাহলে তারা অবতারণা করে একটি প্রদর্শনীর; দীর্ঘ পা ফেলে হাঁটা, গান গাওয়া, কথা বলা, বা উচস্বরে হাসা, বা একটা আপেল খাওয়া হচ্ছে প্ররোচনা দেয়া; যারা এটা করে তাদের অপমান করা হয় বা তাদের পিছে লাগা হয় বা তাদের সাথে কথা বলার জন্যে এগিয়ে আসে লোকজন। চপল আমোদপ্রমোদ এমনিতেই খারাপ আচরণ; যে-আত্মসংযম চাপিয়ে দেয়া হয় নারীদের ওপর এবং যা দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে ওঠে ‘সুশিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণী’র মধ্যে, তা নষ্ট করে স্বতস্ফূর্ততা; চূর্ণ করা হয় তার প্রাণোচ্ছলতা। এর ফল হচ্ছে উত্তেজনা ও অবসাদ।
এ-অবসাদ সংক্রামক : তরুণীরা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে ওঠে পরস্পরকে দিয়ে; তারা নিজেদের কারাগারে পরস্পরের উপকারের জন্যে দলবদ্ধ হয় না; এবং ছেলেদের সঙ্গ তাদের কেনো দরকার হয়, এটাই তার একটি কারণ। স্বাবলম্বী হওয়ার অযোগ্যতা জন্ম দেয় এমন এক ভীরুতা, যা ছড়িয়ে পড়ে তাদের সমগ্র জীবনে এবং তা ধরা। পড়ে তাদের কাজেও। তারা বিশ্বাস করে অসামান্য সাফল্য শুধু পুরুষদের জন্যেই; তারা উচ্চাভিলাষ পোষণ করতে ভয় পায়। আমরা দেখেছি চোদ্দ বৃছরের বালিকারা ছেলেদের সাথে নিজেদের তুলনা করে ঘোষণা করেছে ‘ছেলেরাই উৎকৃষ্ট’। এটা এক দুর্বলকারী বিশ্বাস। এটা ঠেলে দেয় আলস্য ও মাঝারিত্বের দিকে। এক তরুণী, যার। কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই অধিকতর শক্তিমান লিঙ্গের প্রতি, সে একটি পুরুষকে বকাবকি করছিলো তার ভীরুতার জন্যে; তখন তাকে বলা হয় সে নিজেই তো ভীরু। সে আত্মতুষ্টির সাথে ঘোষণা করে, ‘ওহ্, নারী, তা তো ভিন্ন!’
এমন পরাজয়বাদী মনোভাবের মৌল কারণ হচ্ছে কিশোরী তার ভবিষ্যতের জন্যে নিজেকে দায়ী মনে করে না; সে নিজের কাছে বেশি চাওয়ার মধ্যে কোনো লাভ দেখতে পায় না, কেননা পরিশেষে তার ভাগ্য তার কাজের ওপর নির্ভর করবে না। সে নিজের নিকৃষ্টতা বুঝতে পারে বলে পুরুষের কাছে নিজেকে ন্যস্ত করে না, বরং তাকে যে ন্যস্ত করা হয় পুরুষের কাছে, সেজন্যেই সে মেনে নেয় তার নিকৃষ্টতার ধারণা, এবং প্রমাণ করে এর সত্যতা।
এবং, আসলেই, নিজের যোগ্যতা বাড়িয়ে সে মানুষ হিশেবে পুরুষের কাছে মূল্য পাবে না, বরং মূল্য পাবে নিজেকে তাদের স্বপ্নের আদলে তৈরি করে। যখন তার। অভিজ্ঞতা কম, তখন সে এ-ব্যাপারটি সম্বন্ধে সব সময় সচেতন থাকে না। সে হতে পারে ছেলেদের মতোই আক্রমণাত্মক; কিন্তু এ-মনোভাব তাকে নিষ্ফল করে তোলে। অতিশয় দাসীস্বভাবসম্পন্ন মেয়ে থেকে সবচেয়ে উদ্ধত মেয়েটি পর্যন্ত সব মেয়েই এক সময় বুঝতে পারে যে অন্যদের খুশি করার জন্যে তাদের অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। অধিকার। তাদের মায়েরা তাদের আদেশ দেয় যেননা তারা আর ছেলেদের সঙ্গী মনে করে, যেনো নিজেরা উদ্যোগ না নেয়, যেনো তারা অক্রিয় ভূমিকা নেয়। বন্ধুত্ব বা ফষ্টিনষ্টি শুরু করতে চাইলেও তাদের যত্নশীল হতে হবে, যাতে এমন মনে না হয় যে তারাই উদ্যোগ নিচ্ছে; পুরুষেরা গারর্স শাঁক, বা নীলমুজো বা মেধাবী নারী পছন্দ। করে না; অতি বেশি সাহস, সংস্কৃতি, বা বুদ্ধি, অতি বেশি চরিত্র, তাদের ভীত করবে। অধিকাংশ উপন্যাসে, যেমন জর্জ এলিয়ট মন্তব্য করেছেন, স্বর্ণকেশী ও বোকাটে নায়িকারাই শেষে জয়ী হয় পুরুষস্বভাবের শ্যামাঙ্গীদের ওপর; এবং দি মিল অন দি ফ্লস-এ ম্যাগি নিষ্ফলভাবে চেষ্টা করে ভূমিকা দুটি পাল্টে দিতে; কিন্তু শেষে সে মারা যায় এবং স্বর্ণকেশী লুসির বিয়ে হয় স্টিফেনের সাথে। দি লাস্ট অফ দি মোহিকান্স-এ সাহসী ক্লারা নয়, নায়কের হৃদয় জয় করে নিষ্প্রাণ এলিস; লিটল উইমেন-এ। মনোরম জো লরির বাল্যকালের খেলার সাথী মাত্র : জোর প্রেম রক্ষিত থাকে নিষ্প্রাণ অ্যামি ও তার কোঁকড়ানো কেশরাজির জন্যে।
নারী হতে হলে হতে হবে দুর্বল, অপদার্থ, বশমানা। তরুণীকে শুধু সুসজ্জিত থাকলেই চলবে না, শুধু চটপটে হলেই হবে না, তাকে দমন করতে হবে তার স্বতস্ফূর্ততা এবং তার বদলে তার থাকতে হবে তার গুরুজনদের শেখানো শোভা ও। সৌন্দর্য। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যে-কোনো উদ্যোগই কমাবে তার নারীত্ব ও আবেদন। নিজের অস্তিত্বের ভেতরে ভ্রমণ যুবকের পক্ষে আপেক্ষিকভাবে সহজ, কেননা মানুষ হিশেবে তার বৃত্তি ও তার পুরুষ হওয়ার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; আর এ-সুবিধাটি সূচিত হয় শৈশবেই। স্বাধীনতা ও মুক্তির মধ্যে নিজেকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে সে একই সময়ে অর্জন করে তার সামাজিক মূল্য এবং পুরুষ হিশেবে তার মর্যাদা : উচ্চাভিলাষী পুরুষেরা, বালজাকের রাস্তিনাকের মতো, একই কাজের মধ্য দিয়ে চায় অর্থ, খ্যাতি, ও নারী; একটি ছক, যা তরুণকে কাজে উদ্দীপ্ত করে, তা হচ্ছে ক্ষমতাশালী ও বিখ্যাত পুরুষের ছক, নারীরা মার অনুরাগিণী।
কিন্তু, উল্টোভাবে, তরুণীর জন্যে একজন প্রকৃত মানুষ হিশেবে মর্যাদা লাভ ও নারী হিশেবে তার বৃত্তির মধ্যে আছে বিরোধ। এবং এখানেই মিলবে সে-কারণটি কেননা বয়ঃসন্ধি নারীর জন্যে খুবই কঠিন ও নিষ্পত্তিকারক মুহুর্ত। এ-সময় পর্যন্ত সে থেকেছে এক স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তি। এখন তাকে অস্বীকার করতে হবে সার্বভৌমত্ব। তার ভাইদের মতোই, তবে অনেক বেশি বেদনাদায়কভাবে, তাকে শুধু ছিন্ন করা হয়অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে, কিন্তু এর সাথে দেখা দেয় একটা বিরোধ, সেটি হচ্ছে তার কর্তা হওয়া, সক্রিয়, স্বাধীন হওয়ার মূল দাবি এবং তার কাম প্রবর্তনা ও নিজেকে একটি অক্রিয় বস্তুরূপে মেনে নেয়ার জন্যে সামাজিক চাপের মধ্যে বিরোধ। তার স্বতস্ফূর্ত প্রবণতা হচ্ছে নিজেকে অপরিহার্যরূপে গণ্য করা : কী করে সে মনস্থির করবে অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠার জন্যে? অভিলাষ ও ঘৃণা, আশা ও ভয়ের মধ্যে আন্দোলিত হয়ে সন্দেহের সাথে সে বিলম্ব করতে থাকে শৈশবের স্বাধীনতার কাল ও নারীসুলভ বশ্যতাস্বীকারের মধ্যে।
তার আগের প্রবণতা অনুসারে এ-পরিস্থিতিতে নানা প্রতিক্রিয়া ঘটে তরুণীর মধ্যে। ‘ছোটো মাতা’, ভবিষ্যৎ-মাতৃ, সহজেই আত্মসমর্পণ করতে পারে তার রূপান্তরের কাছে; তবে ‘ছোটো মাতা’ হিশেবে হয়তো সে পেয়েছে কিছুটা কর্তৃত্বের স্বাদ, এটা তাকে পুরুষের অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলতে পারে : সে একটা মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রস্তুত, কামসামগ্রী ও দাসী হওয়ার জন্যে নয়। বড়ো বোনেরা, যারা ছোটোবেলায়ই বহন করে অতিরিক্ত দায়িত্বভার, তাদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে মাঝেমাঝেই। গারর্স মাঁক যখন আবিষ্কার করে সে নারী, তখন কখনো কখনো সে বোধ করে প্রবঞ্চিত হওয়ার প্রচণ্ড জ্বালা, যা তাকে নিয়ে যেতে পারে সমকামিতার দিকে; তবে স্বাধীনতা ও হিংস্রতার মধ্যে সে যা চেয়েছে, তা হচ্ছে বিশ্বকে অধিকার করা : সাধারণত সে চাইতে পারে না তার নারীত্বের, মাতৃত্বলাভের অভিজ্ঞতার, তার নিয়তির এক সার্বিক এলাকার, ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। সাধারণত, কিছুটা প্রতিরোধের সাথে হলেও, তরুণী মেনে নেয় তার নারীত্ব; তার পিতার সাথে, তার শৈশবের ছেনালিপনার সময়, তার যৌন স্বল্পপ্রয়াণে, সে এর মাঝেই জানতে পেরেছে অক্রিয়তার মোহনীয়তা; সে দেখতে পায় এর ক্ষমতা; তার দেহের জাগানো লজ্জার সাথে মিলেমিশে যায় গর্ববোধ। সেই হাত, সেই দৃষ্টি, যা আলোড়িত করেছে তার অনুভূতি, সেটা ছিলো এক আবেদন, এক প্রার্থনা; তার দেহকে মনে হয় ঐন্দ্রজালিক গুণসমৃদ্ধ; এটি একটি সম্পদ, একটি অস্ত্র; সে এর জন্যে গর্বিত। তার যে-ছেনালিপনা হারিয়ে গিয়েছিলো শৈশবের স্বাধীন বছরগুলোতে, তা আবার দেখা দেয়। সে নেয় নতুন প্রসাধন, চুল বাধার নতুন ঢঙ; স্তন লুকিয়ে রাখার বদলে সে ওগুলো বাড়ানোর জন্যে মর্দন করে, সে আয়নায় দেখে তার নিজের হাসি।
তরুণীর জন্যে যৌন সীমাতিক্ৰমণতার মধ্যে থাকে একটি জিনিশ, তার নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে নিজেকে তার হয়ে উঠতে হয় শিকার। সে হয়ে ওঠে একটি বস্তু, এবং নিজেকে সে দেখে বস্তুরূপে; সে বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করে তার সত্তার এনতুন দিকটি : তার মনে হয় সে দ্বিগুণ হয়ে গেছে; নিজের সাথে সম্পূর্ণ খাপ খাওয়ানোর বদলে সে এখন শুরু করে বাইরে অস্তিত্বশীল থাকার। আমরা রোজাদ লেহমানের ইনভিটেশন টু দি রোলস-এ দেখি অলিভিয়া আয়নায় আবিষ্কার করে একটি নতুন শরীর : বস্তু-রূপে-সে হঠাৎ মুখোমুখি হয় নিজের। এটা জন্ম দেয় এক অস্থায়ী, তবে বিহ্বলকর আবেগ।
কিছু মেয়ে পরস্পরকে দেখায় তাদের নগ্ন দেহ, তারা তুলনা করে তাদের স্তনের : আমাদের মনে পড়ে ম্যাটশন ইন ইউনিফর্ম-এর সে-দৃশ্যটি, যাতে আঁকা হয়েছে আবাসিক বিদ্যালয়ের বালিকাদের এসব দুঃসাহসিক আমোদপ্রমোদ; তারা সাধারণ বা বিশেষ ধরনের শৃঙ্গার পর্যন্ত করে থাকে। অধিকাংশ তরুণীর মধ্যেই রয়েছে সমকামী প্রবণতা, যাকে আত্মরতিমূলক সুখানুভূতিবোধ থেকে পৃথক করা যায় না : প্রত্যেকেই অন্যের মধ্যে কামনা করে তার নিজের ত্বকের কোমলতা, তার নিজের দেহের বাকগুলো। পুরুষ, কামগতভাবে, কর্তা, এবং তাই পুরুষেরা সাধারণত পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এমন কামনায়, যা তাদের চালিত করে তাদের থেকে ভিন্ন এক বস্তুর দিকে। কিন্তু নারী হচ্ছে কামনার ধ্রুব কর্ম, এবং এজন্যেই বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে, স্টুডিওতে গড়ে ওঠে এতো ‘বিশেষ বন্ধুত্ব’; ওগুলোর কিছু বিশুদ্ধভাবেপ্লাতোয়ী এবং অন্যগুলো স্থূলভাবেই দৈহিক।
তাকে যেহেতু পুরুষের ভূমিকা নিতে হবে, তাই প্রিয়া অবিবাহিতা হলেই ভালো হয়: বিয়ে সব সময় তরুণী অনুরাগিণীকে হতোদ্যম করে না, তবে এটা তাকে বিরক্ত করে; সে পছন্দ করে না যে তার অনুরাগের বস্তুটি থাকবে কোনো স্বামী বা প্রেমিকের অধীনে। অধিকাংশ সময়ই এ-সংরাগগুলো দেখা দেয় গোপনে, বা কমপক্ষে এক প্রাতোয়ী স্তরে। ম্যাটশন ইন ইউনিফর্ম-এ যখন ডরোথি ভিয়েক চুমো খায়হেটা থিলের ঠোটে, তখন চুমোটি একই সাথে মাতৃধর্মী ও কামময়। নারীদের মধ্যে রয়েছে এমন দুষ্কর্মের সহযোগিতা, যা নষ্ট করে শালীনতাবোধ; তারা একজন আরেকজনের মধ্যে জাগায় যে-উত্তেজনা, তা সাধারণত হিংস্রতাহীন; সমকামী শৃঙ্গারে থাকে না সতীচ্ছদছিন্নকরণ বা বিদ্ধকরণ : নতুন ও উদ্বেগজাগানো পরিবর্তন না চেয়ে তারা তৃপ্ত করে শৈশবের ভগাঙ্কুরীয় কাম। তরুণী নিজেকে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ না করে অক্রিয় বস্তুরূপে বাস্তবায়িত করতে পারে তার বৃত্তি। রেনি ভিভিয়ে এটাই প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো কবিতায়, যাতে তিনি গেয়েছেন তাদের লঘু স্পর্শ ও কমনীয় চুম্বনের গান, যারা একই সাথে প্রেমিকা ও বোন, যাদের শৃঙ্গার ঠোটে বা স্তনে কোনো ছাপ ফেলে না।
ওষ্ঠ ও স্তন শব্দের কাব্যিক অনৌচিত্যের মধ্যে সে তার বান্ধবীকে যে-প্রতিশ্রুতি দেয়, স্পষ্টভাবে তা হচ্ছে যে সে বান্ধবীকে বলাৎকার করবে না। এবং আংশিকভাবে হিংস্রতার, বলাক্তারের ভয়েই কিশোরী মেয়ে অনেক সময় তার প্রথম প্রেম দান করে কোনো পুরুষের বদলে কোনো বয়স্ক নারীকে। বালিকার চোখে ওই পুরুষধর্মী নারীটি হয়ে ওঠে তার বাবা ও মা উভয়ের প্রতিমূর্তি : তার আছে বাবুর কর্তৃত্ব ও সীমাতিক্ৰমণতা, সে হচ্ছে মূল্যবোধের উৎস ও মানদণ্ড, সে অতিক্রম করে যায় বিদ্যমান বিশ্বকে, সে অপার্থিব; তবে সে এক নারীও। শিশু অবস্থায় মেয়েটি মায়ের স্পর্শাদর কমই পেয়ে থাক, এর বিপরীতে, তার মা তাকে দীর্ঘ কাল ধরে লাই-ই দিক, ভাইদের মতোই সে স্বপ্ন দেখে উষ্ণ বুকের; তার সাথে ঘনিষ্ঠ এ-মাংসে এখন সে আবার ফিরে পায় জীবনের সাথে সেই ভাবনাহীন, সরাসরি একীভবন, যা সে একদা হারিয়ে ফেলেছিলো দুধ ছাড়ার সময়; এবং যে-বিচ্ছিন্নতা তাকে করে তুলেছিলো একটি একাকী ব্যক্তিসত্তা, তা পরাভূত হয় আরেকজনের এই পূর্ণতর স্থিরদৃষ্টিতে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি মানবিক সম্পর্ক জ্ঞাপন করে বিরোধ, সব প্রেমই জন্ম দেয় ঈর্ষা। তবে কুমারী মেয়ে ও তার প্রথম পুরুষ প্রেমিকের মধ্যে দেখা দেয় যে-সব বাধা, সেগুলো এখানে মুক্ত হয়। সমকামী অভিজ্ঞতা নিতে পারে একটি প্রকৃত প্রেমের রূপ; এটা তরুণী মেয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারে এমন এক সময়োপযোগী ভারসাম্য যে সে চাইবে একে চিরস্থায়ী করে রাখতে বা পুনরাবৃত্তি করতে, সে বইবে এর আবেগভারাতুর স্মৃতি; সত্যিই, এটা প্রকাশ করতে বা জন্ম দিতে পারে একটি নারীসমকামী প্রবণতা।
পুরুষ তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তবু পুরুষ তাকে ভীত করে। পুরুষের প্রতি সে পোষণ করে যে-বিরোধী অনুভূতি, তাদের খাপ খাওয়ানোর জন্যে সে পৃথক করে নেয় তার ভেতরের সে-পুরুষকে, যে তাকে ভীত করে এবং সে-উজ্জ্বল স্বর্গীয় দেবতাকে, যাকে সে ধার্মিকের মতো পুজো করে। তার পুরুষ সঙ্গীদের কাছে সে রূঢ় ও লাজুক হলেও সে আরাধনা করে কোনো সুদূর সুদর্শন রাজকুমারের : কোনোচিত্রতারকার, যার ছবি সে লাগিয়ে রাখে তার খাটে, কোনো বীরের, মৃত বা এখনো জীবিত, কিন্তু সব সময়ই অগম্য, এমন এক অপরিচিতের, যাকে সে হঠাৎ দেখেছে। এবং জানে তাকে সে আর কখনো দেখতে পাবে না। কিছু প্রেম সমস্যা সৃষ্টি করে না। অধিকাংশ সময়ই সে হয় সামাজিক বা মননগত মর্যাদার কোনো পুরুষ, কোনো দৈহিক কামনা ছাড়াই তরুণী আকৃষ্ট হয় তার প্রতি; মনে করা যাক কোনো বুড়ো ও হাস্যকর অধ্যাপকের প্রতি। এসব বুড়ো পুরুষ আছে কিশোরীর জগতের বাইরে, এবং সে সংগোপনে তাদের অনুরাগী হতে পারে, যেমন কেউ নিজেকে সমর্পণ করে বিধাতার কাছে; এটা অবমাননাকর নয়, কেননা এতে নেই কোনো দৈহিক কামনা। এমনকি মনোনীত ব্যক্তিটি হতে পারে নগণ্য বা মামুলি, কেননা এ-ক্ষেত্রে সে আরো নিরাপদ বোধ করে। যাকে পাওয়া যাবে না, এমন কাউকে বাছাই করে সে প্রেমকে করে তুলতে পারে একটি বিমূর্ত মন্ময় অভিজ্ঞতা, যা তার সততার প্রতি হুমকি নয়; সে বোধ করে আকুলতা, আশা, তিক্ততা, কিন্তু বাস্তবিকভাবে সে জড়িয়ে পড়ে না। বেশ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আরাধ্য দেবতাটি থাকে যতো দূরে, সে হয় ততো দীপ্ত; প্রতিদিনের পিয়ানো শিক্ষককে আবর্ষণহীন হলেও চলে, কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরের নায়ককে হতে হবে সুদর্শন ও পৌরুষসম্পন্ন। গুরুত্বপূর্ণ জিনিশটি হচ্ছে যে কামের উপাদানটিকে একভাবে বা অন্যভাবে রাখা হয় এর বাইরে, এভাবে দীর্ঘায়িত করা হয় অন্তর্নিহিত কামের আত্মরতিমূলক প্রবণতা।
এভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা এড়িয়ে কিশোরী প্রায়ই গড়ে তোলে এক তীব্র কাল্পনিক জীবন, কখনো কখনো অবশ্য সে তার স্বপ্নের ছায়ামূর্তিগুলোকে গুলিয়ে ফেলে বাস্তবের সাথে। হেলেন ডয়েটশ বর্ণনা করেছেন এক তরুণীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে তার থেকে বড়ো এক বালকের সাথে কল্পনা করেছে তার নিবিড় সম্পর্ক, যার সাথে সে কখনো কথাই বলে নি। সে ডায়েরি লিখেছে কাল্পনিক ঘটনাগুলোর, অশ্রুপাত ও আলিঙ্গনের, বিদায় নেয়ার ও ভুল বোঝাবুঝি অবসানের, এবং তাকে চিঠি লিখেছে, যা কখনো পাঠানো হয় নি, কিন্তু সেগুলোর উত্তর সে নিজেই লিখেছে। এগুলো স্পষ্টতই সে-বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, যেগুলোকে সে ভয় পেতো।
এটা এক চূড়ান্ত বিকার, তবে প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক। নারী হওয়ার জন্যে যে-সব পরিস্থিতি তাকে ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনে বাধা দিতো, সে-সব পরিস্থিতিতে নিজের অহমিকা উন্নত রাখার বাসনায় মারি বাশকির্তসেভ এক কাল্পনিক ভাবাবেগপূর্ণ সম্পর্ক লালন করতেন এক অগম্য সামন্তপুরুষের সাথে। তিনি হতে চেয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কেউ, কিন্তু স্কার্ট পরে তা কী করে হওয়া যায়? তাঁর দরকার পড়ে একটি পুরুষের, তবে পুরুষটিকে হতে হবে শ্রেষ্ঠতম। ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে নিজেকে নত করা হচ্ছে উৎকৃষ্টতর নারীদের শ্রেষ্ঠতম গর্ব,’ লিখেছেন তিনি। তাই আত্মরতি নিয়ে যায় মর্ষকামের দিকে। অন্যদের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ লীন করা হচ্ছে অন্যদেরকে নিজের মধ্যে ও নিজের জন্যে বাস্তবায়িত করা। নিরোর প্রেম পেয়ে মারি বাশকির্তসেভ হয়ে উঠবেন নিরো। বস্তুত, শূন্যতার এ-স্বপ্ন হচ্ছে হয়ে ওঠার এক গর্বিত ইচ্ছে; সত্য হচ্ছে তিনি কখনো এমন কোনো অসাধারণ পুরুষের দেখা পান নি যে তার মধ্যে হারিয়ে ফেলবেন নিজেকে। নিজের তৈরি দেবতা, যে সব সময় সুদূরে থাকে, তার সামনে নতজানু হওয়া এক কথা, আর কোনো রক্তমাংসের পুরুষের কাছে নত হওয়া অন্য কথা। অনেক তরুণী বাস্তবতার জগতেও টিকিয়ে রাখে এ-স্বপ্ন; তারা খোঁজে এমন একজন পুরুষ, যে সব কিছুতে সকলের থেকে উৎকৃষ্ট, যার আছে ধন ও খ্যাতি, সে এক পরম কর্তা, যে তার প্রেমে তাদের ভূষিত করবে তার মহিমা ও অপরিহার্যতায়। এ-স্বপ্ন তাদের প্রেমকে আদর্শায়িত করে সে পুরুষ বলে নয়, বরং সে সেই মহিমান্বিত সত্তা বলে। ‘আমি চাই দানব, কিন্তু শুধু পুরুষ দেখতে পাই,’ এক বান্ধবী বলেছিলো আমাকে।
এ-আত্মরতিমূলক আত্মসমর্পণের বাইরে কিছু তরুণী বাস্তবসম্মতভাবেই বোধ করে যে তাদের একজন পথপ্রদর্শক, একজন শিক্ষক দরকার। পিতামাতার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেয়ে এ-অনভ্যস্ত স্বাধীনতাকে তাদের মনে হয় অস্বস্তিকর; তারা লঘুচপলতা ও অসংযমে পতিত হয়ে এর নেতিবাচক প্রয়োগ ছাড়া আর কিছু করে উঠতে পারে না; তারা ছেড়ে দিতে চায় তাদের মুক্তি। জনপ্রিয় উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের একটি মান ছক হচ্ছে অস্থিরমতি, রাগী, বিদ্রোহী, ও দুঃসহ তরুণীর গল্প, যে প্রেমের মাধ্যমে বশ মানে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো পুরুষের কাছে : এটা এমন এক শস্তা জিনিশ, যা একই সাথে শ্লাঘা জাগায় পুরুষ ও নারীর। মার্কিন নারীদের জেদি গর্ববোধ সত্ত্বেও হলিউডের চলচ্চিত্র বারবার দেখিয়েছে স্বামী বা প্রেমিকদের শুভ নিষ্ঠুরতা কীভাবে বশ মানায় বেপরোয়া তরুণীদের : একটি বা দুটো চড়, তার চেয়ে ভালো পাছায় বেশ কয়েকটা ঘা, এটাই তাদের সঙ্গমে সম্মত করার সুনিশ্চিত পদ্ধতি।
কিন্তু আদর্শায়িত প্রেম থেকে যৌন প্রেমে উত্তরণ বাস্তবে এতো সহজ নয়। অনেক নারী সযত্নে এড়িয়ে যায় তাদের প্রিয় জিনিশের কাছাকাছি আসা, তারা ভয় পায় যে তারা প্রতারিত হতে পারে। যদি বীরটি, দানবটি, নরদেবতাটি সাড়া দেয় তার। জাগানো প্রেমের ডাকে এবং একে রূপান্তরিত করে কোনো সত্যিকার অভিজ্ঞতায়, তাতে ভয় পায় তরুণী; তার দেবতা হয়ে ওঠে একটি পুরুষ, যার থেকে সে ঘেন্নায়সরে আসে। অনেক ছেনাল মেয়ে আছে, যারা তাদের কাছে যে-পুরুষকে আকর্ষণীয় বা মনোহর মনে হয়, তাদের আকৃষ্ট করতে গিয়ে তারা কিছুতেই থামে না, কিন্তু তারা অসঙ্গতভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যখন সে পুরুষ তাদের প্রতি প্রাণবন্তভাবে। মনোযোগ দেয়; সে অগম্য বলেই পুরুষটি তাদের মনে আবেদন জাগায় : প্রেমিক হিশেবে তাকে মনে হয় খুবই সাদামাটা- ‘অন্যদের মতোই সে একটি পুরুষমাত্র’। মেয়েটি তার মর্যাদাহানির জন্য দোষ দেয় পুরুষটিকে, একে সে অজুহাতরূপে। ব্যবহার করে এড়িয়ে যায় দৈহিক সম্পর্ক, যা ভীত করে তার কুমারী সংবেদনশীলতাকে। যখন সে ধরা দেয় তার ‘আদর্শ’-এর কাছে, তার বাহুবন্ধনে সে থাকে শীতল, এবং স্টেকেল যেমন বলেছেন, ‘কখনো কখনো এমন ঘটনার পর অহঙ্কারী মেয়ে আত্মহত্যা করে, বা ধসে পড়ে তার প্রণয়াকুল কল্পনার সমগ্র সৌধ, কেননা সে-আদর্শটির প্রকাশ ঘটে একটি “বর্বর জন্তু”রূপে’।
অসম্ভবের জন্যে এ-বাসনা প্রায়ই তরুণীকে ঠেলে দেয় সে-পুরুষের প্রেমে পড়ার দিকে, যে আগ্রহী তার কোনো বান্ধবীর প্রতি, এবং প্রায়ই সে হয় বিবাহিত পুরুষ। ডন জোয়ানকে দিয়ে সে নির্দ্বিধায় মুগ্ধ হয়; সে পরাভূত ও অধীন করতে চায় এরমণীবল্লভকে, যাকে কোনো নারীই দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারে নি; সে লালন করতে থাকে তাকে সংশোধনের বাসনা, যদিও জানে সে ব্যর্থ হবে, এবং তার পছন্দের এটাই একটি কারণ। কিছু মেয়ে চিরকালের জন্যে অসমর্থ হয়ে ওঠে প্রকৃত ও সম্পূর্ণ প্রেমের। জীবনভর তারা চায় এক আদর্শ অসম্ভবকে বাস্তবায়িত করতে।
মেয়ের আত্মরতি এবং তার কাম দিয়ে যে-অভিজ্ঞতার জন্যে সে নির্ধারিত, তার মধ্যে রয়েছে স্পষ্টত বিরোধ। নারী শুধু তখনই নিজেকে মেনে নেবে অপ্রয়োজনীয় বলে যদি সে নিজেকে আবিষ্কার করে দাবিত্যাগের কর্মে। নিজেকে একটি বস্তু হতে দিয়ে সে রূপান্তরিত হয় একটি প্রতিমায় এবং সগর্বে নিজেকে দেখে এ-রূপে; তবে সে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এ-নিষ্করুণ যুক্তি, যা তাকে আরো অপ্রয়োজনীয় করেতোলে। একটি বস্তু মনে করা নয়, তার ভালো লাগতো একটা মুগ্ধকর আকর্ষণীয় সম্পদ হতে পারলে। সে ভালোবাসে ঐন্দ্রজালিক প্রবাহসম্পন্ন এক বিস্ময়কর প্রেতাশ্রিত-বস্তুরূপে প্রতিভাত হতে, সে নিজেকে দেখতে চায় না মাংসরূপে, যা দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, ক্ষতার্ত করা যায় : পুরুষ এভাবেই শিকার হিশেবে পছন্দ করে নারীকে, তবে পালিয়ে যায় মানুষখেকো রাক্ষসী দিমিতার।
সে গর্ব বোধ করে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, পুরুষের অনুরাগ জাগিয়ে, কিন্তু যা তাকে ক্ষুব্ধ করে, তা হচ্ছে ধরা পড়ে যাওয়া। বয়ঃসন্ধির সঙ্গে সে পরিচিত হয়েছে লজ্জাবোধের সাথে; এবং এটা চলতে থাকে তার ছেনালিপনা ও অহমিকার সাথে মিলেমিশে। পুরুষের দৃষ্টি তাকে একই সঙ্গে খুশি ও আহত করে; সে চায় সে যেটুকু দেখাতে চায় সেটুকুই দেখতে পাক : চোখ সব সময়ই অতি অন্তর্ভেদী। তাই দেখা দেয় অসামঞ্জস্য, যা পুরুষের কাছে ব্রিতকর : তরুণী প্রদর্শন করে তার দেকলতে, তার পা, এবং যখন সেগুলোর দিকে কেউ তাকায় তার মুখ লাল হয়ে ওঠে, সে বিব্রত বোধ করে। সে পুরুষকে প্রজ্জ্বলিত করে সুখ পায়, কিন্তু সে যদি দেখে যে সে জাগিয়েছে পুরুষের কামনা, সে ঘেন্নায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পুরুষের কামনা যতোখানি প্রশংসাসূচক ঠিক ততখানিই মনোকষ্টদায়ক; সে নিজের মোহনীয়তার জন্যে নিজেকে যতোটা দায়ী মনে করে বা মনে করে সে এটা প্রদর্শন করছে নিজের ইচ্ছেয়, সে ততখানি সুখ পায় নিজের বিজয়ে, কিন্তু তার মুখ, তার দেহগঠন, তার মাংস এতে যতোটা ভূমিকা পালন করে সে ততোখানি এদের লুকোতে চায় এ-স্বাধীন অপরিচিতের কাছে থেকে যে এগুলোকে ভোগের কামনা বোধ করে।
এখানেই আছে এ প্রাথমিক বিনয়ের গভীরতর অর্থ, যা ব্রিতকরভাবে ব্যাহত করে সাহসীতম ছেনালিপনাগুলোকে। একটা ছোটো মেয়ে বিস্ময়করভাবে দুঃসাহসী হতে পারে, কেননা সে বোঝে না যে উদ্যোগ গ্রহণ করে সে প্রকাশ করছে তার অক্রিয়তা : যখনই সে এটা দেখতে পায়, সে ভীত ও বিরক্ত বোধ করে। কিছুই। তাকানোর থেকে বেশি দ্ব্যর্থবোধক নয়; এটা থাকে দূরে, দূরে থাকা অবস্থায় একে মনে হয় সশ্রদ্ধ, কিন্তু এটা অচেতনভাবেই দখল করে নেয় দেখা মূর্তিকে। অপরিণত নারী লড়াই করে এ-প্রলোভনের মধ্যে। সে শুরু করে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে টানটান করে তোলে এবং দমন করে তার জেগে ওঠা কামনা। তার এখনো-অস্থির দেহে আদরকে একবার মনে হয় একটা কোমল চাপ বলে, তারপরই মনে হয় একটা অস্বস্তিকর কাতুকুতু বলে; একটি চুমো প্রথমে তাকে আলোড়িত করেতোলে, তারপরই তাতে সে হেসে ওঠে; প্রতিটি সমর্পণের পরই দেখা দেয় বিদ্রোহ; সে পুরুষকে চুমো খেতে দেয়, কিন্তু সে তার ঠোট মোছার অভিনয় করে; সে সুস্মিত হাসে ও প্রীতিময় থাকে, কিন্তু তারপরই হয়ে ওঠে শ্লেষপূর্ণ ও শত্রুতামূলক; সে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই সেগুলো ভুলে যায়।
এভাবেই একটি শিশুসুলভ ও যুক্তির বিপরীতধর্মী চরিত্র প্রদর্শন করে ‘অপক্ক ফল’টি নিজেকে রক্ষা করে পুরুষের থেকে। তরুণী মেয়েকে প্রায়ই বর্ণনা করা হয় এমন অর্ধ-বন্য অর্ধ-পোষমানা প্রাণীরূপে। কলেৎ, উদাহরণস্বরূপ, একে চিত্রিত করেছেন তার ক্লদিন অ লেকল-এ এবং ব্লে এ এরব-এও সম্মোহিনী ভিকারূপে। সে তার বিশ্বের প্রতি বোধ করে একটা তীব্র আগ্রহ এবং সার্বভৌম রীতিতে শাসন করে তাকে; তবে ঔৎসুক্য বোধ করে পুরুষের প্রতিও এবং তার জন্যে বোধ করে ইন্দ্রিয়াতুর ও রোম্যান্টিক কামনা। কাঁটাগাছের ঝোপে ছিড়েফেড়ে যায় ভিকা, সে বাগদাচিংড়ি ধরে, গাছে চড়ে, তবুও শিউরে ওঠে যখন তার খেলার সাথী ফিল তার হাত ছোঁয়; সে অনুভব করে সে-উত্তেজনা, যাতে দেহ পরিণত হয় মাংসে এবং নারী প্রথম প্রকাশ পায় নারীরূপে। কামনা জাগার পর, সে চায় রূপসী হতে : কখনো কখনো সে তার কেশবিন্যাস করে, প্রসাধন করে, পরে মিহিমসৃণ অর্গান্ডি, সে নিজে নিজে মজা পায় ছেনাল ও মনোমোহিনী হয়ে উঠে; তবে সে যেনো চায় অন্যদের জন্যে নয়, নিজের জন্যে বাঁচতে, তাই কখনো কখনোপরে অমার্জিত পোশাক বা অশোভন ট্রাউজার্স; তার একটা বড়ো অংশ মেনে নেয় না ছেনালিপনা এবং একে মনে করে নীতিবিসর্জন। তাই সে ইচ্ছাকৃতভাবে নখে কালি মাখে, চুল আঁচড়ায় না এবং থাকেনোংরা ও অসংবৃত। এ-বিদ্রোহী আচরণ তাকে করে তোলে এমন বেঢপ, যাতে তার বিরক্তি লাগে; এতে সে রুষ্ট হয়, লজ্জা লাগে, আবার দ্বিগুণ করে তোলে তার অমার্জিততা, এবং মনোমমাহিনী হওয়ার জন্যে তার ব্যর্থ প্রয়াসের কথা ভেবে ঘৃণায় কেঁপে ওঠে। এ-পর্যায়ে তরুণী মেয়ে আর শিশু হতে চায় না, তবে সে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়াকেও মেনে নেয় না, এবং নিজেকে ফিরে ফিরে তিরষ্কার করে তার বালসুলভতা ও তার নারীসুলভ দাবিত্যাগের জন্যে। সে আছে এক অবিরাম প্রত্যাখ্যানের অবস্থায়।
এটা সে-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা বিশিষ্টতা দেয় তরুণীকে এবং আমাদের দেয় তার অধিকাংশ আচরণের জট খোলার চাবি; তার জন্যে প্রকৃতির ও সমাজের নির্ধারিত নিয়তি সে মেনে নেয় না; তবে সে তা পুরোপুরি অস্বীকারও করে না; সে নিজের বিরুদ্ধে এতে বিভক্ত যে বিশ্বের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে না; সে নিজেকে। সীমাবদ্ধ রাখে বাস্তবতা থেকে পলায়নের বা তার বিরুদ্ধে একটা প্রতীকী যুদ্ধের মধ্যে। তার প্রতিটি বাসনার আছে সেটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উদ্বেগ : সে ব্যগ্র তার ভবিষ্যৎকে অধিকার করতে, কিন্তু সে ভয় পায় অতীতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে; সে একটি পুরুষ অধিকার করতে চায়, তবে সে চায় না যে পুরুষটি তাকে অধিকার করুক তার শিকাররূপে। এবং প্রতিটি ভয়ের পেছনে ওত পেতে থাকে একটি করে বাসনা : বলাকার তাকে আতঙ্কিত করে, তবে সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে অক্রিয়শীলতার জন্যে। এভাবে সে দণ্ডিত হয় আন্তরিকতাহীনতায় ও তার সমস্ত ছলচাতুরিতে; সে উন্মুখ থাকে সব রকম নেতিবাচক আবিষ্টতার প্রতি, যা প্রকাশ করে উদ্বেগ ও বাসনার পরস্পরবিপরীত মূল্যের বিদ্যমানতা।
তরুণী যদি নিজেকে এলোমেলো অশোভনভাবে ছুঁতে বা চুমো খেতে দেয়, তাহলে সে এর প্রতিশোধ নেয় তার নাচের সঙ্গীটির মুখের ওপর বা তার সঙ্গীদের সাথে উচ্চহাস্যে ফেটে পড়ে। দুটি তরুণীর কথা আমার মনে পড়ছে, রেলগাড়ির কামরায় একরাতে, যাদের একজনের পর আরেকজনকে ‘আদর’ করে চলছিলো এক ব্যবসায়িক ভ্রমণকারী, যে স্পষ্টভাবেই উপভোগ করছিলো তার সৌভাগ্য; মেয়ে দুটি থেকে থেকে উন্মত্ত উচ্চহাস্য করে উঠছিলো, কাঁচা বয়সের বৈশিষ্ট্যসূচক আচরণ অনুসারে তারা আবর্তিত হচ্ছিলো কাম ও লজ্জার মিশ্রণের মধ্যে।
এ-তরুণ বয়সে মেয়েরা যেমন ব্যবহার করে রূঢ় ভাষা তেমনি হাসে উন্মত্ত হাসি : তাদের কারো কারো আছে এমন শব্দভাণ্ডার, যা তাদের ভাইদের গাল রাঙিয়ে দিতে পারে; সন্দেহ নেই এ-ভাষা তাদের কাছে অনেক কম জঘন্য মনে হয়, কেননা, আধাঅজ্ঞতার মধ্যে তারা যে-সব প্রকাশভঙ্গি ব্যবহার করে, সেগুলো তাদের মনে কোনো যথাযথ ছবি জাগায় না; তাছাড়া এসব ছবি জাগিয়ে তোলা নয়, বরং তাদের অভিপ্রায় এগুলো রোধ করা, কমপক্ষে এগুলো স্নান করা। বিদ্যালয়ের মেয়েরা একে-অন্যকে বলে যে-সব নোংরা গল্প, সেগুলোর উদ্দেশ্য তাদের যৌনকামনা পরিতৃপ্ত করা নয়, বরং কাম অস্বীকার করা; তারা দেখতে চায় যান্ত্রিক বা দৃশ্যত-শল্যকর্মরূপে এর কৌতুককর দিকটা। তবে উচ্চহাস্যের মতো, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার নিতান্তই একটি যুদ্ধের কৌশল নয় : এটা এক রকমের বয়স্কদের বিরুদ্ধাচারণ, এক ধরনের পবিত্রবস্তুকে অসম্মানকরণ, একটা স্বেচ্ছাকৃত ভ্ৰষ্ট আচরণ। প্রকৃতি ও সমাজকে অবজ্ঞা করে তরুণী মেয়ে নানা অদ্ভুত উপায়ে তাদের যুদ্ধে আহ্বান করে ও নিভীকভাবে তাদের সম্মুখীন হয়। প্রায়ই দেখা যায়খেয়ালি খাদ্যাভ্যাস : সে খায় পেন্সিলের সীসা, গালার চাকতি, কাঠের টুকরো, জ্যান্ত চিংড়ি; সে গেলে ডজন ডজন অ্যাসপিরিন টেবলেট; সে এমনকি খায় মাছি আর মাকড়সা। যা ‘ঘেন্না জাগায়’, তা প্রায়ই তাকে আকৃষ্ট করে।
এ-মনোভাব আরো স্পষ্টতবে প্রদর্শিত হয় নিজের অঙ্গ নিজে ছেদনে, যা এবয়সে বেশ দেখা যায়। তরুণী মেয়ে ক্ষুর দিয়ে গভীর করে কাটতে পারে তার উরু, নিজের গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁক দিতে পারে, নিজের চামড়া ছুলে ফেলতে পারে; একটা ক্লান্তিকর উদ্যান পার্টি এড়ানোর জন্যে আমার তরুণ বয়সের এক বান্ধবী একটি ছোটো কুড়াল দিয়ে মারাত্মকভাবে কেটে ফেলেছিলো তার পা, যার জন্যে তাকে শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিলো ছ-সপ্তাহ। এ-ধর্ষ-মর্ষকামী কাজগুলো একই সঙ্গে যৌন অভিজ্ঞতার পূর্বাভাস এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ; এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে নিজেকে কঠিন করে তোলে সম্ভাব্য সব অগ্নিপরীক্ষার জন্যে এবং হ্রাস করে সেগুলোর কঠোরতা, এমনকি বিয়ের রাতের অগ্নিপরীক্ষার কঠোরতাও। যখন সে তার স্তনের ওপর রাখে একটা শামুক, গিলে ফেলে এক কৌটো অ্যাসপিরিন টেবলেট, নিজেকে আহত করে, তখন তরুণী অবজ্ঞা ছুঁড়ে দেয় তার ভবিষ্যৎ প্রেমিকের প্রতি-‘আমি নিজের ওপর যা করি তুমি তার থেকে বেশি ঘৃণ্য কিছু করতে পারবে না’। এগুলো হচ্ছে কামদীক্ষার প্রতি গর্বিত ও চাপা ক্রোধযুক্ত ইশারা।
পুরুষের অক্রিয় শিকার হওয়ার জন্যে নির্ধারিত হয়ে এমনকি যন্ত্রণা ও ঘৃণার মধ্যেও মেয়ে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে তার স্বাধীনতার অধিকার। যখন সে নিজেকে কাটে বা ঘঁাক দেয়, সে প্রতিবাদ জানায়তার যোনিচ্ছদছিন্নকরণরূপ শূলবিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে : রদ করার মাধ্যমে সে জানায় প্রতিবাদ। সে মর্ষকামী, এতে যে তার আচরণ তাকে যন্ত্রণা দেয়, কিন্তু সর্বোপরি সে ধর্ষকামী : একটি স্বাধীন কর্তারূপে সে চাবুক মারে, অবজ্ঞা করে, পীড়ন করে এ-পরনির্ভর মাংসকে, এ-মাংস, যা দণ্ডিত হয়েছে আনুগত্যে, যা সে ঘৃণা করে। তবে নিজেকে সে এর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করে না। কেননা সব কিছু সত্ত্বেও, সত্যিকারভাবে সে তার নিয়তি বর্জন করাকে বেছে নেয়। তার ধর্ষ-মর্ষকামী বিকৃতির আছে একটা প্রাথমিক আন্তরিকতাহীনতা : মেয়েটি যদি নিজেকে তা চর্চা করতে দেয়, তাহলে বোঝায় যে রদ করার মাধ্যমে সে মেনে নিচ্ছে সেই নারীসুলভ ভবিষ্যৎ, যা রক্ষিত তার জন্যে; সে তার মাংসকে ঘৃণাভরে বিকৃত করতো না যদি না সে প্রথমে নিজেকে মাংস হিশেবে স্বীকার করে নিতো।
যে-মিথ্যাচারে দণ্ডিত তরুণী, তা হচ্ছে তাকে ভান করতে হবে যে সে একটি বস্তু, এবং একটি আকর্ষণীয় বস্তু; নিজের ত্রুটিগুলো সম্পর্কে সচেতন থেকেই সে নিজেকে বোধ করতে থাকে একটি অনিশ্চিত, বিচ্ছিন্নকৃত সত্তারূপে। প্রসাধন, নকল চুল, কোমরবন্ধ, এবং ‘দৃঢ়ীভূত’ বক্ষবন্ধনি সবই মিথ্যাচার। তার মুখটিই হয়ে ওঠে মুখোশ : স্বতস্ফূর্ত অভিব্যক্তিগুলোকে চতুরতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ভান করা হয়। কৌতূহলজাগানো অক্রিয়তার; হঠাৎ কোনো তরুণীর মুখাবয়ব আবিষ্কারের থেকে কিছুই বেশি বিস্ময়কর নয়, যখন এটি নারীসুলভ ভূমিকাগুলো পালন করে তখন এটি সুপরিচিত; সীমাতিক্ৰমণতাকে বর্জন করে এটি অনুকরণ করে সীমাবদ্ধতার চোখ আর অন্তর্ভেদ করে না, প্রতিফলিত করে; দেহটি আর জীবন্ত নয়, এটা প্রতীক্ষা করে; প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও হাসি হয়ে ওঠে আবেদন। নিরস্ত্র, বর্জনীয়, তরুণী এখন একটি নিবেদিত ফুল মাত্র, এমন একটি ফল, যাকে ছিঁড়ে নিতে হবে।
অধিকাংশ বয়স্ক মেয়ে, তা তারা কঠোর পরিশ্রমই করুক বা যাপন করুক চপল জীবন, তারা বাড়িতে বদ্ধই থাকুক বা উপভোগ করুক কিছুটা স্বাধীনতা, তাদের জন্যে একটি স্বামী পাওয়া–বা, কমপক্ষে একটি স্থির প্রেমিক পাওয়া ক্রমশ হয়ে ওঠে খুবই জরুরি ব্যাপার। এটা প্রায়ই নষ্ট করে বান্ধবীদের সাথে সম্পর্ক। শ্রেষ্ঠ বান্ধবী হারিয়ে ফেলে তার সম্মানজনক স্থান। তরুণী তার সঙ্গিনীদের মধ্যে মিত্রের বদলে দেখতে পায় প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি এমন একজনকে চিনতাম, যে ছিলো বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান, সে কবিতা ও সাহিত্যিক প্রবন্ধে নিজের বর্ণনা দিতে সুদূরের রাজকুমারী রূপে; আন্তরিকভাবেই সে ঘোষণা করেছিলোযে শৈশবসাথীদের জন্যে তার মনে কোনো ভালোবাসা নেই : তারা সাদামাটা ও নির্বোধ হলে তাদের তার মনে হতো বিরক্তিকর; আর সুন্দর হলে সে ভয় পেতো তাদের। একটি পুরুষের জন্যে অধীর ব্যগ্রতা, যাতে প্রায়ই থাকে কৌশলী পরিচালনা, ঠকানোর কৌশল, ও অবমাননা, তা সংকীর্ণ করে তরুণীর দিগন্ত : সে হয়ে ওঠে অহমিকাপরায়ণ ও বিচেতন। আর যদি সুদর্শন রাজকুমার দেখা দিতে দেরি করে, তাহলে মনে জমে ক্লান্তি ও তিক্ততা।
তরুণীর চরিত্র ও আচরণ তার পরিস্থিতিরই ফল : এটা বদলালে তরুণী মেয়েও ধরবে আরেক রূপ। আজকাল তার পক্ষে নিজের ভাগ্যের ভার কোনো পুরুষের হাতে দেয়ার বদলে নিজের হাতে নেয়া সম্ভব হয়ে উঠছে। যদি সে নিয়োজিত থাকে পড়াশুনোয়, খেলাধুলোয়, পেশাগত প্রশিক্ষণে, বা কোনো সামাজিক বা রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মে, সে মুক্তি পায় পুরুষভাবনার আবিষ্টতা থেকে, তার ভাবাবেগ ও কামের বিরোধ নিয়ে সে অনেক কম ব্যস্ত থাকে। তবুও, একজন স্বাধীন মানুষ হিশেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভে যুবকের থেকে তার অসুবিধা অনেক বেশি। আমি দেখিয়েছি যে তার পরিবার বা লোকাচার এদিকে তার উদ্যোগের অনুকূল নয়।
অধিকন্তু, যখন সে স্বাধীনতাও বেছে নেয় নিজের জন্যে তখনও তার জীবনে একটি স্থান থাকে পুরুষের জন্যে, প্রেমের জন্যে। সে ভয় পেতে পারে যে যদি সে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োগ করে কোনোকাজে, তাহলে সে হয়তো হারিয়ে ফেলবে তার নারীসুলভ নিয়তি। প্রায়ই এ-বোধটা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয় না, কিন্তু এটা আছে; এটা দুর্বল করে তোলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে, এটা বেঁধে দেয় সীমানা। যাই হোক, যে-নারী কোনো কাজ করে সে তার পেশাগত সাফল্যকে খাপ খাওয়াতে চায় তার একান্ত নারীসুলভ সিদ্ধির সাথে; এটা শুধু বোঝায় না যে বেশ খানিকটা সময়। তাকে দিতে হবে তার রূপের জন্যে, যা আরোগুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে তার প্রাণশক্তিগত আগ্রহগুলো ভেঙে পড়ে নানা ভাগে। তাকে ভাবতে হয় তার দৈহিক রূপ সম্বন্ধে, পুরুষ সম্পর্কে, প্রেম সম্পর্কে; সে ততোটুকুই মনোযোগ দেয় পড়াশুনোয়, পেশায় যতোটা না দিলেই চলে না। এটা মানসিক দুর্বলতার, বা মনোযোগের অসামর্থ্যের ব্যাপার নয়, বরং এটা আগ্রহগুলোর মধ্যে এমনভাবে খণ্ডখন্ড হয়ে যাওয়ার ব্যাপার, যেগুলোর মধ্যে সঙ্গতিবিধান খুবই কঠিন। গড়ে ওঠে একটা দুষ্টচক্র এবং প্রায়ই এটা দেখে স্তম্ভিত হতে হয় যে যখন নারী একটি স্বামী পায় তখন কতো তাড়াতাড়ি সে ছেড়ে দিতে পারে সঙ্গীতচর্চা, পড়াশুনো, পেশা। সব কিছু দল বাধে তার ব্যক্তিগত আকাঙ্খ নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে, এবং বিয়ের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্যে তার ওপর এখনো পড়ে বিপুল সামাজিক চাপ। এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করা হয় যে সে বিশ্বে নিজের জন্যে স্থান সৃষ্টি জন্যে নিজের চেষ্টায় কিছু করবে না বা করবে ভীরুভাবে। যতদিন না সমাজে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হবে আর্থিক সাম্য আর যতোদিন লোকাচার স্ত্রী বা রক্ষিতা হিশেবে পুরুষের কাছে থেকে সুযোগসুবিধা নেয়াকেই অনুমোদন করবে নারীর জন্যে, ততোদিন টিকে থাকবে তার অনর্জিত স্বপ্ন এবং ব্যাহত হবে তার নিজের সিদ্ধি।