১৭. জ্বলন্ত মশাল
জাহাপনা, জেসুইট ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেট আপনার সঙ্গে জরুরি সাক্ষাৎ করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন।
আকবর তুহিন দাশের অঙ্কিত নতুন একটি ভবনের নকশা থেকে মুখ তুলে তাকালেন, তিনি এবং আবুল ফজল সেটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সেলিম তার মুখে বিরক্তির ভাব দেখতে পেলো। দরবারে এমন কথা শোনা যাচ্ছিলো যে জেসুইটরা ক্রমশ উদ্ধত এবং দাম্ভিক হয়ে উঠছে। আকবর তাদের যতোকিছুই করার অনুমতি দিচ্ছিলেন মনে হচ্ছিলো তারা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলো না। তারা তাদের সাধু দিবসে ফতেহপুর শিক্রির রাস্ত য় বড় একটি কাঠের ক্রুশ নিয়ে এবং হাতে মোমবাতি নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে শোভাযাত্রা করছে, উপাসনালয় তৈরি করেছে এবং আগ্রাসীভাবে হিন্দুস্ত নীদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছে। এমনকি তারা আকবরের কাছে একটি আবেদনপত্র পেশ করেছে যাতে ফাদার এ্যান্টোনিওকে তাঁর পুত্র মুরাদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। ভদ্রতাবশত আকবর তা অনুমোদনও করেছেন।
সে কি বলতে চায়?
সেটা তিনি বলেননি, জাঁহাপনা, কেবল বলেছেন বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।
ঠিক আছে। আমি তার সঙ্গে এখানেই দেখা করবো।
সব সময়ের মতো এখনো সেলিম তার পিতার সহ্যক্ষমতা দেখে অবাক হলো। আর কোনো প্রজা সে যতোই ক্ষমতাবান হোক না কেনো এতো ঘন ঘন কিছুর জন্য আকবরকে বিরক্ত করার সাহস পাবে না। সেলিম অপেক্ষা করলো দেখার জন্য বাবা তাকে চলে যেতে বলেন কি না, কিন্তু আকবর ইশারায় তাকে থাকতে বললেন।
জেসুইট পাদ্রীটি সেখানে প্রবেশ করলো। সে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো এবং আকবর কিছু বলতে পারার আগেই ব্যগ্রভাবে তার বক্তব্য শুরু করে দিলো। জাহাপনা, আমি আজ এমন একটি কথা শুনলাম যা বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার একজন মাওলানা শেখ মোবারক বললেন আপনি নাকি একটি নতুন ধর্ম সূচনা করতে যাচ্ছেন!
তুমি যা শুনেছো তা সত্যি। আগামী শুক্রবারের জুম্মার সময় আমি আমার প্রজাদের কাছে এই নতুন ধর্ম দীন-ই-ইলাহী অর্থাৎ ঈশ্বরের ধর্ম বিষয়ে ঘোষণা দিতে যাচ্ছি যা আমার সাম্রাজ্যের সর্বত্র বলবৎ হবে।
এতো ঈশ্বরদ্রোহীতা! ফাদার এ্যান্টোনিওর ডিম্বাকৃতি চোখ দুটি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
সতর্ক হয়ে কথা বলো জেসুইট। তোমরা এতোদিন আমার প্রশ্রয় এবং ধৈর্যের নমুনা ছাড়া আর কিছু প্রত্যক্ষ করোনি। কিন্তু বিনিময়ে তোমরা সংকীর্ণ অসহিষ্ণুতা ব্যতীত আর কি প্রচার করতে পেরেছা? তোমার কাছ থেকে তোমাদের ধর্ম বিষয়ে যা কিছু এতোদিন জেনেছি তাতে আমার মনে হয়নি ক্যাথলিক ধর্ম অন্য ধর্মগুলির তুলনায় অধিক প্রশংসনীয় কিছু ধারণ করে। অবশ্য কোনো একক ধর্মকেই সত্যতা এবং পবিত্রতার দিক থেকে আমার কাছে নিরঙ্কুশ ভাবে শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়নি। এমনকি আমার নিজ ধর্ম ইসলামও নয়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সকল ধর্মের মধ্যে যা কিছু শ্রেষ্ঠ সেসব বিষয় এক সঙ্গে জুড়ে একটি নতুন ধর্ম সৃষ্টি করার। এতে হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং ইসলাম এই সকল ধর্মের নির্যাস একত্রিত থাকবে।
আপনার এই পরিকল্পনার মাঝে ঈশ্বরের অবস্থান কোথায়-আপনার ডান হাতে, নাকি তাকে আপনি সেই সুযোগও দিতে চান না? মনে হলো ক্ষোভের যন্ত্রণায় জেসুইটটির দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ঈশ্বর আমাকে দীন-ই-ইলাহীর মূল প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করেছেন এবং পৃথিবীর বুকে আমি তার ছায়া হিসেবে ভূমিকা পালন করবো, আকবর শান্ত কণ্ঠে বললেন। আমি ঈশ্বরকে প্রতিস্থাপন করতে চাই না কারণ তাহলে সত্যিই ঈশ্বরদ্রোহীতা সংঘটিত হবে।
আপনি যদি আপনার এই পথভ্রষ্ট নির্বুদ্ধিতা অব্যাহত রাখেন তাহলে আমি এবং আমার সঙ্গী পাদ্রীগণ আপনার রাজসভা ত্যাগ করবো। আমি পরিতাপের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমি আর আপনার পুত্র যুবরাজ মুরাদের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারবো না।
তোমাদের ইচ্ছা হলে তোমরা চলে যেতে পারো। তোমাদের রুদ্ধ মন আমাকে হতাশ করেছে। এখন আমি ভাবছি তোমার মতো লোকদেরকে ভবিষ্যতে আমি আমার সাম্রাজ্যে পা রাখার অনুমতি দেবো কি না। আমাকে যদি আরো চটাও তাহলে আমি তোমার ইউরোপীয় অনুগামীদের আমার সাম্রাজ্যে গড়ে তোলা বাণিজ্যবসতি উচ্ছেদ করবো।
সত্যের আলোকে আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং আপনি নিজেকে যতোটা মহান ভাবেন তার থেকেও মহত্ত্বম কারো কাছে আপনাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ফাদার এ্যান্টোনিওর মুখ থেকে যেনো সত্যিকার বিষ উদগিরণ হলো। তারপর সে সামান্য কুর্ণিশ করলো এবং ঘুরে গটমট করে হেঁটে খোলা দরজা পথে প্রহরীদের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
সেলিম দেখলো তার বাবা এবং আবুল ফজল পরস্পরের মধ্যে কৌতুক মিশ্রিত হাসি বিনিময় করলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তারা পাদ্রীর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। সেলিমের নিজের মনেও একাধিক প্রশ্নের আগুন জ্বলছিলো এবং সে প্রথম বারের মতো তা প্রকাশ করতে ভয় পেলো না। কেনো তুমি এই নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে চাচ্ছ। বাবা? এতে কি উলামাবৃন্দ ক্ষুব্ধ হবেন না? সে বললো।
সেলিমের প্রশ্নের উত্তর দিলো আবুল ফজল। উলামাগণ যা খুশি ভাবুক। এটি একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। ইতোমধ্যে মহামান্য সম্রাট তার রাজ্যের ইসলাম ধর্ম বিষয়ক প্রধান হয়েছেন কিন্তু তার প্রজারা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী। দীন-ই-ইলাহী ধর্মটি সকলের জন্য উন্মুক্ত এবং প্রত্যেকে তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম বজায় রেখেও এই ধর্ম অনুসরণ করতে পারবে। ফলে এই ধর্মটি প্রবর্তন করার মাধ্যমে আমাদের স্মাট সকল প্রজার কাছে তাঁদের নিজেদের একজন বলে স্বীকৃত হবেন তিনি আর তার পিতা বা পিতামহের মতো বিদেশী হানাদার বলে বিবেচিত হবেন না। দীন-ই-ইলাহী, হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্ম এবং পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়াই বিশ্বাসীর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য, এমন বিশ্বাসকে ধারণ করবে। সব কিছুর উপরে এই ধর্ম মানুষকে দয়া, সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং সকল জীবের প্রতি সম্মানবোধ শিক্ষা দেবে। ফলে মানুষের আধ্যাত্মিক সত্যের অনুসন্ধানের প্রয়াস সহজ হবে এবং একই সাথে মোগল সাম্রজ্যের বুনিয়াদও শক্ত হবে।
সেলিমের প্রশ্নের উত্তর দানে আবুল ফজলের ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয়ে ইতোমধ্যে আকবর তুহিন দাশের নকশার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। তাই তিনি খেয়াল করলেন না তার পুত্র আবুল ফজলের বক্তব্য পুরোপুরি সমর্থন করতে না পেরে কুটি করছে। সেলিমের মনে হলো এটি একটি অনিশ্চিত পদক্ষেপ। এই নতুন আধ্যাত্মিক বিশ্বাস যতো সহজে মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলতে পারে, অনুরূপভাবে কি তাদের মধ্যে মোগল শাসকদের প্রতি মৈত্রীর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারবে?
*
জাহাপনা, একজন রাজ বর্তাবাহক খবর এনেছে যে, দূরের এক গ্রামে এক বিধবাকে জীবন্ত অবস্থায় তার মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় দাহ করা হবে আজ সূর্যাস্তের সময়। মৃত ব্যক্তিটি সেই গ্রামের প্রধান ছিলো। আপনি আদেশ দিয়েছিলেন এ ধরনের সব ঘটনা তাৎক্ষণিক ভাবে আপনাকে জানানোর জন্য।
গ্রামটি কোথায় অবস্থিত?
এখান থেকে দশ মাইল উত্তরে।
আমি পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছি এ ধরনের বর্বর ধর্মীয় রীতি আমি বরদাস্ত করবো না। তারা আমার আদেশ অমান্য করার সাহস কীভাবে পেলো? আমি নিজে সেখানে যাবো। আমার ঘোড়া প্রস্তুত করো এবং দেহরক্ষীদের আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বলো।
সেলিম তার পিতাকে জনসম্মুখে এতো ক্রুদ্ধ হতে কাদাচিৎ দেখেছে। আকবর তার পরিচারকদের সাহায্যের অপেক্ষা না করে নিজেই তার রেশমের জোব্বাটি খুলে ফেললেন ভ্রমণের পোশাক পড়ার জন্য।
তুমিও আমার সঙ্গে চলো সেলিম। এটা তোমার জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা হবে। সতীদাহ ছাড়া হিন্দু প্রজাদের অন্যসব ধর্মীয় আচারের বিষয়ে আমি তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই জানো সতীদাহ কি, তাই না? হিন্দুরা এই বিধবাদের বলে ভালোবাসা ও সাহচর্যের জ্বলন্ত মশাল কিন্তু বাস্তবে তারা বর্বরতার শিকার। পারিবারিক মর্যাদা রক্ষা করা সম্পর্কে এক বিকৃত ধারণা থেকে স্বামীর আত্মীয় স্বজনেরা বিধবাদের বলপূর্বক মৃত স্বামীর সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ করে। আকবরের মুখমণ্ডল কঠোর দেখালো। আমি আল্লাহকে এই জন্য ধন্যবাদ জানাই যে আমাদের ধর্মে এ ধরনের কোনো নিয়ম প্রচলিত নেই। মোগলদের জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা সবচেয়ে গর্বের বিষয়। আমাদের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি কি আছে যে যুদ্ধ ময়দানের পরিবর্তে নিজ বিছানার গৌরবহীন মৃত্যু বেছে নেবে? কিন্তু আমাদের কারো মৃত্যুর পর আমাদের স্ত্রীরা যদি আত্মহত্যা করে তাকে কি আমরা যুদ্ধ ময়দানে মৃত্যুর মতো গৌরবের মনে করবো? তুমি কি আমার সঙ্গে একমত সেলিম? সেই মুহূর্তে আকবরের পরিচারকগণ তাঁকে জোব্বা এবং পালুন পড়ান শেষ করে তার পেশীবহুল কোমরে কোমর বন্ধনী বাঁধছিলো।
সেলিম সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। কিন্তু সেলিম তার বাবার কাছে প্রকাশ করলো না যে সতীদাহের বিষয়টি একাধারে তার মনে বিতৃষ্ণা এবং রোমাঞ্চ উভয়ই সৃষ্টি করে। অল্প কয়েক দিন আগে তার সমবয়সী এক বালক গুটিবসন্ত হয়ে দুদিনের মধ্যেই মারা গেছে। সেলিমের মতো একজন অল্প বয়সী ছেলের জন্য মৃত্যুর মতো বিষয় কিছুটা দুর্বোধ্য। এই রহস্যের জন্যই হয়তো ব্যাপারটি কিছুটা অসুস্থ্য রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। আধো অপরাধবোধ সম্পন্ন কৌতূহল নিয়ে সে বিধবাদের চিতায় দাহকালীন আর্তচিৎকারের কাহিনী শুনেছে বহুবার। সে এমন গল্পও শুনেছে যে চুলে এবং পড়নের কাপড়ে আগুন লেগে যাওয়া এক বিধবা পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু তার স্বামীর আত্মীয়রা পুনরায় তাকে আগুনে নিক্ষেপ করে।
জলদি করো সেলিম। আমরা সেখানে সময় মতো পৌঁছাতে পারলে হয়তো বিধবাটিকে বাঁচাতে পারবো।
ফতেহপুর শিক্রি থেকে বেরিয়ে পিতা ও পুত্র পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাঁদের সম্মুখে চারজন অগ্রদূত শিঙ্গা বাজানোর মাধ্যমে সতর্ক সংকেত দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছে এবং পেছন থেকে দেহরক্ষীরা তাঁদের অনুসরণ করছে। পিতার সঙ্গী হতে পেরে সেলিম গর্ব বোধ করছে, সেইসঙ্গে এই অভিযানের অভূতপূর্ব রোমাঞ্চের স্বাদ তার পেটের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি করছে।
এটা মার্চের শেষের দিকের এক উষ্ণ দিন এবং তখন মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে। ঘোড়ার খুরের আঘাতে রৌদ্রতপ্ত উষ্ণ ভূমি থেকে ফ্যাকাশে ধূলো উড়ছে। তির্যক দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্ন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে সেলিম দেখতে পেলো সূর্য তখনো অনেক উপরে রয়েছে। শেষকৃত্য যদি সূর্যাস্তের সময় সম্পন্ন হয় তাহলে তাদের হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে। কিন্তু আকবরের মাঝে ছোটার গতি কমানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। তার বাদামি রঙের স্ট্যালিয়নটির শরীর ঘামে ভিজে গেছে এবং সেলিম লক্ষ করলো তার নিজের ঘোড়াটিরও একই অবস্থা। যুদ্ধ যাত্রা করার সময় কি এরকমই পরিস্থিতি হয়? সেলিম ভাবলো। যুদ্ধের বিষয়ে সেলিমের কোনো অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু সে এ বিষয়ে ভীষণ কৌতূহলী।
এই মুহূর্তে তারা একটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরের উঠছে যা সামনের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে এবং এঁকে বেঁকে চূড়ার দিকে অগ্রসর হয়েছে। সেটি একটি সমতল চূড়া বিশিষ্ট পাহাড়। সেখানে সেলিম কিছু সাধারণ ভাবে নির্মিত ঘর দেখতে পেলো। আরো দূরে বাদামি ধোয়ার রেখা দেখা গেলো।
সেলিম আকবরের চিৎকার শুনতে পেলো, ওরা আমাদের আগমনের খবর জেনে গেছে এবং তরিঘড়ি করে চিতায় আগুন জ্বালিয়েছে। এর জন্য ওদের কঠিন শাস্তি পেতে হবে। পিতার দিকে তাকিয়ে সেলিম দেখলো তার দৃঢ় চোয়াল বিশিষ্ট মুখটি ক্রোধ এবং হতাশায় শক্ত হয়ে উঠেছে। ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকা ঘোড়া গুলিকে তারা যখন পাহাড় চূড়ার দিকে ছুটালো, আকবর তাঁর লোকদের চিৎকার করে বললেন, জলদি করো। সময় নষ্ট করা যাবে না।
পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছে সেলিম দেখতে পেলো তারা একটি মালভূমিতে উপস্থিত হয়েছে। তাঁদের বাম পাশে একগুচ্ছ মাটির ইটে তৈরি ঘর যার মাঝখানে একটি কুয়া রয়েছে এবং ডান পাশে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের একটি বাড়ি, যদিও সেটি একতলা কিন্তু নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এটা সম্ভবত গ্রাম-প্রধানের বাসস্থান। সেখানে একটি নিম গাছের নিচে একটি দড়ির চারপায়াতে দুটি শিশু ঘুমিয়ে আছে। চারপায়াটির পাশে মাটিতে একটি কুকুরের ছানা শুয়ে আছে। সেখানে আর কোনো মানুষ জন নেই। তবে সেলিম দেখলো সেখান থেকে তিন চারশ গজ দূরে মেটে বর্ণের পোশাক পরিহিত কিছু সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়ে আছে। তাদের সামনে জ্বলন্ত চিতা থেকে ঘন কালো ধোয়া উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে।
আকবর তার ঘোড়াটির পাঁজরে জোরে লাথি মেরে চিৎকার করে উঠলেন, এগিয়ে চলো সবাই! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারা ছোট খাট ঝোঁপ জঙ্গল পেরিয়ে একটি খোলা জায়গায় এসে উপস্থিত হলো, যেখানে ইতোমধ্যেই কাঠ সাজিয়ে উঁচু করে বানানো চিতার চারপাশে উত্তম ভাবে আগুন ধরে গেছে। চিতার শীর্ষে একটি সাদা মসলিন জড়ানো মৃতদেহ শোয়ানো রয়েছে যাতে এখনো আগুন লাগেনি। দুই জন লোক বারে বারে সামনে ঝুঁকে পাত্র থেকে ঘি অথবা তেল জাতীয় কিছু মৃতদেহটির উপর ছিটিয়ে দিচ্ছিলো। হলুদ বর্ণের সেই তরল আগুনের সংস্পর্শে এসে ছ্যাত ছ্যাত শব্দে জ্বলে উঠছিলো। সেই মুহূর্তে মৃতদেহটির গায়ে পেচানো কাপড়ে আগুন ধরলো এবং তাজা মাংস পোড়ার গন্ধ সেলিমের নাকে এলো। চিতাটির দশ গজের মধ্যে পৌঁছে আকবর তার ঘোড়া থামালেন। উপস্থিত ভিড়টি এতো বেশি মনোযোগ দিয়ে চিতাটি প্রত্যক্ষ করছিলো যে আগত অশ্বারোহীদের ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ধীরে হলো।
চিতাটি ঘিরে ফেলো, আকবর তার দেহরক্ষীদে চিৎকার করে আদেশ দিলেন। ভিড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে তিনি কঠোর স্বরে জানতে চাইলেন, তোমাদের নেতা কে? আকবর হিন্দিতে কথা বললেন যা এখানকার আঞ্চলিক ভাষা। তিনি হিন্দি এবং ফার্সীতে সমান দক্ষ।
আমি, আগুনে যে দুজন লোক তেল ছুড়ছিলো তাদের একজন জবাব দিলো। আমরা আমার পিতার মরদেহ দাহ করছি, তিনি এই গ্রামের প্রধান ছিলেন। আমি তার বড় ছেলে সঞ্জীব।
তুমি কি জানো আমি কে?
না, জনাব। সঞ্জীব মাথা নাড়লো। তবে সেলিম লক্ষ্য করলো সঞ্জীব ধীরে আকবরের ঘোড়ার জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জা এবং এর আরোহীর পোশাক এবং গলা ও হাতের রত্ন গুলি পর্যবেক্ষণ করে তার মর্যাদা বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর সে সশস্ত্র রক্ষীদেরও পর্যবেক্ষণ করলো এবং ভীতির পরিবর্তে তার বসন্তের দাগ সমৃদ্ধ কুৎসিত চেহারায় বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়লো।
আমি তোমাদের সম্রাট। আমি খবর পেয়েছি তোমাদের এখানে একজন বিধবাকে জীবন্ত অবস্থায় তার মৃত স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারার আয়োজন করা হচ্ছে। বিষয়টি কি সত্যি?
সঞ্জীব আবারও মাথা নাড়লো, তবে এক মুহূর্তের জন্য সে কাছাকাছি অবস্থিত খড়ের তৈরি একটি কুড়ে ঘরের দিকে তাকালো। আকবরও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীদের ইশারা করলেন ঘরটি তল্লাশী করার জন্য। কয়েক মুহূর্ত পর একজন রক্ষী একটি অল্পবয়সী সাদা শাড়ী পড়া অচেতন মেয়েকে কোলে করে এনে আকবরের সামনে মাটিতে শুইয়ে দিলো। সেলিম দেখলো মেয়েটির চোখ দুটি ভোলা কিন্তু কি ঘটছে তা বুঝতে পারছে বলে মনে হলো না।
কেউ ওর জন্য একটু পানি নিয়ে এসো। আকবর আদেশ দিলেন। গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে একটি বালক দৌড়ে মাটির পাত্রে করে সামান্য পানি নিয়ে এলো। আকবর ঘোড়া থেকে নেমে ছেলেটির হাত থেকে পানির পাত্রটি নিলেন তারপর মেয়েটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তার মুখে পাত্রটি কাত করে ছোঁয়ালেন। প্রথমে কিছু পানি তার গাল গড়িয়ে পড়ে গেলো কিন্তু তারপর সে তার মাথাটি সামান্য সোজা করে পানি পান করতে লাগলো। সেলিম ঝুঁকে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো চোখের মণি দুটি সম্প্রসারিত হয়ে অনেক বড় আকার ধারণ করেছে।
এই মেয়েটি কে? এক্ষুনি জবাব দাও নইলে আল্লাহর কসম আমি এই মুহূর্তে ধর থেকে তোমার গর্দান নামিয়ে দেবো! আকবর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন।
সঞ্জীব হাত কচলালো। ও আমার পিতার বিধবা স্ত্রী শকুন্তলা-আমার আসল মা মারা যাওয়ার এক বছর পরে আমার পিতা ওকে বিয়ে করে এবং এখন থেকে তিন মাস আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ওর বয়স কত?
পনেরো জাহাপনা।
তুমি তাকে মাদক দিয়ে নেশাগ্রস্ত করেছে, তাই না?
আমি ওকে ওপিয়ামের গুলি সেবন করিয়েছি। আপনি বুঝবেন না জাঁহাপনা। কারণ আপনি হিন্দু নন। পরিবারের মর্যাদা রক্ষার জন্য একজন বিধবার দায়িত্ব নিজ স্বামীকে জ্বলন্ত চিতা পর্যন্ত অনুসরণ করা…আমি ওর কষ্ট কমানোর জন্য ওকে মাদক দিয়েছি।
তুমি ওকে মাদক দিয়েছে যাতে চিতার আগুনে তুমি ওকে নিক্ষেপ করার সময় সে প্রতিবাদ না করে।
মেয়েটি তখন উঠে বসেছে এবং বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছে। তার পেছনে অবস্থিত চিতার আগুন আরো উঁচুতে লাফিয়ে উঠছে, কাঠ ফাটার শব্দ হচ্ছে এবং অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটকে আসছে। সুগন্ধি তেল এবং ঘি সহ মাংস পোড়ার ফলে অত্যন্ত ঝাঁঝালো গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ সে কোথায় রয়েছে এবং কি ঘটছে বুঝতে পেরে শকুন্তলা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে চিতার দিকে ঘুরলো। চিতার মাঝখানে তখন তার মৃত স্বামীর দেহটি মশালের মতো জ্বলছে। শকুন্তলার আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই মৃতদেহের মাথাটি সশব্দে ফাটলো এবং একে অনুসরণ করে কিছু ভাজা হওয়ার ছ্যাত ছ্যাত শব্দ পাওয়া গেলো-বোঝা গেলো মগজ ভস্মীভূত হলো।
সঞ্জীব ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শকুন্তলার দিকে তাকালো, মুহূর্তের জন্য সে আকবর এবং তার সফরসঙ্গী অথবা নিশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবসীদের উপস্থিতির কথা ভুলে গেলো। তোমার স্বামীকে গ্রাস করা ঐ আগুনে নিজেকে সমর্পণ করা তোমার পবিত্র দায়িত্ব। আমার নিজের মা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি তাই করতেন এবং এর জন্য তিনি গর্ববোধ করতেন। তুমি আমাদের পরিবারের সুনামের উপর কালিমা লেপন করছে।
ও নয়, তুমি একটি জঘন্য অপরাধ করতে যাচ্ছিলে। আমি আমার সমগ্র রাজ্যে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেছি, বিধবা নিজে মৃত্যুবরণ করতে রাজি হোক অথবা না হোক। আমি এধরনের বর্বর কাজ বরদাস্ত করবো না। আকবর মেয়েটির দিকে ফিরলেন। তুমি এখানে থাকলে তোমার জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। আমি আকবর, তোমার সম্রাট। আমি তোমাকে এই সুযোগ দিচ্ছি যে, তুমি যদি চাও তাহলে আমার সঙ্গে আমার রাজপ্রাসাদে আসতে পারো। সেখানে তুমি আমার হেরেমে পরিচারিকা হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবে। তুমি কি রাজি আছো?
জ্বী জাহাপনা, মেয়েটি উত্তর দিলো। এর আগে সে বুঝতে পারেনি আকবর কে এবং সেলিম লক্ষ্য করলো মেয়েটি তার বাবার চোখে চোখে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।
এবারে তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো শোনো, আকবর সঞ্জীবের দিকে তাকালেন, তার চেহারায় কিছুটা অবজ্ঞার ভাব বিরাজ করছিলো। তোমার ধর্মে যদি এমন নিয়ম থাকতো যে পিতার সঙ্গে তোমাকেও চিতার আগুনে জ্বলতে হবে তাহলে কি তুমি স্বেচ্ছায় জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিতে? আমার মনে হয় না। রক্ষী, ওকে ধরে চিতার কাছে নিয়ে যাও।
সঞ্জীবের বসন্তের দাগবিশিষ্ট মুখটি হঠাৎ ঘামে ভিজে তেলতেলে হয়ে উঠলো এবং সে ঘন ঘন শ্বাস নিতে শুরু করলো। জাহাপনা, দয়া করুন…. সে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো যখন দুজন রক্ষী দুদিক থেকে তাকে শক্ত করে ধরে আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তার গড়ন এতো হালকা পাতলা যে রক্ষীরা তাকে সহজেই একগুচ্ছ খড়ের মতো আগুনে ছুঁড়ে দিতে পারে, সেলিম ভাবলো।
এবার আকবর এগিয়ে গেলেন। ওর কাঁধের কাছটা শক্ত করে ধরে রাখো, তিনি আদেশ দিলেন। আমরা এখন দেখবো যে বেদনা সে অন্য একজনকে দিতে চেয়েছিলো তা সে নিজে কীভাবে সহ্য করতে পারে।
তারপর সঞ্জীবের ডান হাতটি কনুই এর ঠিক উপরে ধরে আকবর তার হাতের অগ্রভাগটি আগুনে প্রবেশ করালেন। সঞ্জীবের গগন ভেদী চিৎকারে চারদিক প্রকম্পিত হলো। সে সর্বশক্তিতে আকবরের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলো কিন্তু তিনি ইস্পাতদৃঢ় মুষ্ঠিতে তার হাতটি আরো একটু সময় আগুনের মধ্যে ধরে রাখলেন। সঞ্জীবের ক্রমাগত উচ্চ হতে থাকা আর্তনাদ এবারে পশুর চিৎকারের মতো শোনালো। বিধবা মেয়েটি পর্যন্ত এই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছিলো না।
হঠাৎ সঞ্জীব অজ্ঞান হয়ে গেলো এবং আগুনে কাঠ পোড়র শব্দ ছাড়া চারদিকে আর কোনো শব্দ রইলো না। সঞ্জীবের নিস্তেজ দেহটিকে দুহাতে ধরে আকবর আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে আনলেন। তার ডান হাতটি মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে। তিনি পোড়া হাতটি কয়েক মুহূর্ত উঁচু করে ধরে রাখলেন যাতে উপস্থিত সকলে সেটা ভালো মতো দেখতে পারে, তারপর সঞ্জীবের দেহটি ছেড়ে দিলে তা মাটিতে আছড়ে পড়লো। এরপর আকবর গ্রামবাসীদের কিছু বলার জন্য ঘুরলেন, তারা একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে বেশ আতঙ্কিত, পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেনো একদল ভেড়া নেকড়ের উপস্থিতি টের পেয়েছে।
তোমরা আমার ন্যায় বিচার প্রত্যক্ষ করলে। আমি আশা করি আমার আইন সকলে মান্য করবে, তা না হলে আইন ভঙ্গকারীদের ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করা হবে। তোমরা সকলে এই লোকটির মতোই অপরাধী। আকবর আঙ্গুলি নির্দেশ করে সঞ্জীবকে দেখালেন, তখন তার জ্ঞান ফিরে আসছে এবং তার মুখ দিয়ে যন্ত্রণাকাতর শব্দ বের হচ্ছে। তোমরা সকলে জানতে একটি নির্দোষ মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং তা প্রতিরোধ করার জন্য তোমরা কিছুই করোনি। আমি সঞ্জীবের মতো তোমাদের আগুনের স্বাদ অনুভব করাবো না কিন্তু আমি তোমাদের দশ মিনিট সময় দেবো তোমাদের জিনিসপত্র এবং গবাদি পশু সরিয়ে ফেলার জন্য। তারপর আমার লোকেরা তোমাদের সমগ্র গ্রামটিকে একটি জ্বলন্ত চিতায় পরিণত করবে। পরবর্তী সময়ে তোমরা যখন এই গ্রামটি পুননির্মাণ করার জন্য পরিশ্রম করবে তখন তোমরা তোমাদের ম্রাটের আদেশ অমান্য করার পরিণতি কি হতে পারে সে বিষয়ে চিন্তা করার সময় পাবে।
কিছু সময় পরে সারা গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। শকুন্তলা একজন রক্ষীর ঘোড়ার পিছনে বসে ছিলো। শালীনতা রক্ষার জন্য বড় আকারের একটি রুমাল দিয়ে তার মাথা ঢাকা রয়েছে। দলটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ফিরতি পথ ধরেছে। সেলিম লক্ষ্য করলো মেয়েটি এক বারও তার দীর্ঘদিনের বাসস্থানের দিকে ফিরে তাকাল না। নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে সে অনুভব করলো নিজেকে এতোটা গর্বিত তার আগে কখনোও মনে হয়নি এবং সে অকবরের পুত্র এবং একজন মোগল হওয়ার জন্য আনন্দ বোধ করলো।
*
বাবাকে অত্যন্ত চমৎকার লাগছিলো। আমি তাকে এতো ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের সঙ্গে আগে কখনোও বিচার কাজ সম্পাদন করতে দেখিনি। রাজসভার গতানুগতিক ধীর, জড়ো এবং আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের তুলনায় তা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার পিতার হিন্দু বিধবাটিকে রক্ষা করার পর থেকে সেলিম ঘটনাটি স্মরণ করে ভীষণ অনুপ্রাণিত বোধ করছিলো। বিশেষ করে তাৎক্ষণিক ভাবে কি বলতে হবে বা করতে হবে সে সম্পর্কে তার বাবার প্রজ্ঞা তাকে অভিভূত করেছে। সেটাই প্রকৃত ক্ষমতার বহিপ্রকাশ।
তিনি আমাদের ভূখণ্ডে প্রচলিত অত্যন্ত প্রাচীন রীতির উপর অন্যায় হস্ত ক্ষেপ করেছেন, হীরাবাঈ ঠাণ্ডা স্বরে বললো।
কিন্তু বাবা তো হিন্দুদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। মাত্র কয়েকদিন আগে আমি কয়েকজন মাওলানাকে তার সহনশীলতার সমালোচনা করতে শুনেছি। একজন মাওলানা বলছিলেন বাবা যমুনা এবং গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এলাহাবাদে হিন্দুদের একটি তীর্থস্থানে নিজে উপস্থিত থেকে প্রার্থনা করবেন। আরেকজন মাওলানা অভিযোগ করছিলো তিনি নাকি আগুন, পানি, পাথর এবং গাছের পূজা করারও মানসিকতা রাখেন…এমনকি পবিত্র গরুগুলিকে তিনি তার শহর এবং গ্রামগুলিতে মুক্তভাবে চলাফেরা করার ব্যাপারেও অনুমোদন দিয়েছেন এবং সেগুলির গোবর….
তোমার বাবার মনে যখন যা ইচ্ছা হয় তিনি সেটাই বাস্তবায়ন করেন। সতীদাহ প্রথার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তার নেই। এটা তার এক্তিয়ারভূক্ত বিষয় নয়।
আমার মনে হয় সতীদাহের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার রয়েছে। কারণ তিনি এই প্রথা নিষিদ্ধ করেছেন। ঐ গ্রামের লোকেরা তার আদেশ অমান্য করতে চেয়েছিলো।
তারা তোমার বাবার চেয়েও উচ্চতর প্রভুর আদেশ পালন করছিলো। এটা তাঁদের অবাধ্যতা নয় বরং দায়িত্ব ছিলো। হীরাবাঈ এর কথা গুলি সেলিমকে মনে করিয়ে দিলো সঞ্জীব তার কৃতকর্মের বিষয়ে যে যুক্তি প্রদর্শন করেছিলো এবং জেসুইটরা তাঁদের গির্জার নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে যে যুক্তি প্রদর্শন করে, উভয়ই তার কাছে বর্বরতা বলে মনে হয়। সেলিম কোনো মন্তব্য না করে হীরাবাঈ এর বক্তব্য শুনতে লাগলো। আমার লোকেরা- তারা তোমারও স্বজাতীয় রাজপুতরা সতীদাহ প্রথা পালন করে আসছে প্রায় সময়ের আরম্ভ থেকে। আমি যখন বালিকা ছিলাম তখন বহুবার দেখেছি সম্ভ্রান্ত রাজপুত বিধবারা তাদের মৃত স্বামীর মাথা কোলের উপর নিয়ে জীবন্ত অবস্থায় চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের মুখের হাসি বিলীন হয়নি এবং বেদনায় তার টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি।
সেটা তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো…স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় উপস্থিত হওয়ার আগেই কেনো তারা জীবন দেবে? এতে কি মঙ্গল সাধিত হতে পারে?
এর মাধ্যমে তাঁদের অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রমাণিত হয়, সেই সঙ্গে সাহস এবং ভক্তি এবং এই আত্মত্যাগ তাদের পরিবারে সম্মান বয়ে আনে। আমি তোমাকে আগেও বলেছি আমরা রাজপুতরা আগুন এবং সূর্যের সন্তান। আগুনের দহন শক্তি আমাদের পরিচ্ছন্ন এবং মর্যাদা সম্পন্ন করে এমন বিশ্বাস অন্য যে কোনো শ্রেণীর হিন্দুদের তুলনায় আমাদের মধ্যে অনেক বেশি। আমাদের ইতিহাসে বহুবার এমন ঘটেছে এবং শেষ বার তা ঘটেছে যখন তোমার বাবা চিত্তরগড় অবরোধ করেছিলো। যখন বোঝা গিয়েছিলো আমাদের পুরুষদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করতে হবে, তখন রাজপুত নারীরা তাদের উত্তম পোশাক এবং গহনা পরিধান করে, যেনো সেটা তাদের বিয়ের দিন। তারপর তারা তাদের রানীকে অনুসরণ করে দলবদ্ধ ভাবে রাজকীয় তত্ত্বাবধানে নির্মিত বিশাল চিতার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন অবসান করে।
এমনটা কখনোও ঘটবে না যে তার মাকে আকবরের চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সম্ভ্রম রক্ষা করতে হবে যেহেতু মুসলমানরা তাদের মৃতদেহ দাহ করে না, সেলিম ভাবলো। মায়ের যুক্তিহীন অহঙ্কারী চেহারার দিকে তাকিয়ে সেলিমের মনে হলো তিনি যদি কোনো রাজপুতের স্ত্রী হতেন তাহলে তিনি খুশি মনে তার চিতায় আত্মাহুতি দিতেন। কিন্তু শকুন্তলার আতঙ্কিত মুখের স্মৃতি সেলিমের মনে এই অর্থহীন জীবন বিসর্জনের মেকি অহঙ্কার সম্পর্কে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করলো। তার থেকে মাত্র দুই বছরের বড় এই মেয়েটি মৃত্যুর পরিবর্তে জীবন বেছে নিয়েছে এবং তার মন বলছে সে ঠিক কাজটিই করেছে। বহুবার সে তার মা এবং বাবার আচরণ মূল্যায়ন করার সময় এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত বোধ করেছে যে কে সঠিক। কিন্তু সতীদাহের বিষয়ে সে নিশ্চিত ভাবেই তার বাবার সিদ্ধান্ত সমর্থন করে।
.
১৮. যোদ্ধা যুবরাজ
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার রাজধানী ফতেহপুর শিক্রি থেকে লাহোরে স্থানান্তর করবো। অবিলম্বে তার প্রস্তুতি আরম্ভ হবে। দুই মাসের মধ্যে আমি আমার সভাসদদের নিয়ে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। সভা এখানেই সমাপ্ত হলো।
সেলিম সভাকক্ষের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার হৃদস্পন্দন দ্রুততর হলো যখন আকবর দেহরক্ষীসহ তার পাশের দরজা দিয়ে রৌদ্র আলোকিত উঠানে বেরিয়ে গেলেন। সভায় উপস্থিত সদস্যদের হতভম্ব চেহারা এবং উত্তেজিত হৈ হল্লা শুনে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিলো আকবরের এই ঘোষণায় তারা অবাক এবং অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আজকের সভার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো বাজারের উপর আরোপিত করের হার পুণঃনির্ধারণ করা, তার মাঝে হঠাৎ এ ধরনের ঘোষণায় সকলের অবাক হওয়ারই কথা। একমাত্র আবুল ফজলকে অবিচলিত মনে হলো যখন সে সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করা শেষ করলো। তার মাংসল মুখে লেগে থাকা মুচকি হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছিল-সম্ভবত হাসিটি ইচ্ছাকৃত ভাবে আরোপিত-আকবরের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সে পূর্বেই অবগত ছিলো। কেনো তার সর্বদা মনে হয় এক ঘুষি মেরে আবুল ফজলের মুখের ঐ অবজ্ঞামিশ্রিত হাসি বিলুপ্ত করে দেয়? সেলিম ভাবলো। হয়তো সে আশা করে তার বাবা নিজের চিন্তাভাবনা গুলি নিয়ে তার সঙ্গেই বেশি আলোচনা করুক। বিশেষ করে এই রাজধানী পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি। বিষয়টি তাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তুলেছে, কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও। তার বাবা কদাচিৎ আবেগ তাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এই রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্তটি নিশ্চয়ই তার বাবার ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কি সেই পরিকল্পনা? পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে পিতাকে তার যথেষ্ট বোঝা উচিত তার উদ্দেশ্য গুলি অনুমান করার জন্য। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো এর ফলে তার উপর কি প্রতিক্রিয়া হবে? তাকেও কি নতুন রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া হবে? তার মা হীরাবাঈ এর ভাগ্যে কি ঘটবে? তাকে কি এই ফতেহপুর শিক্রির রাজ প্রাসাদে রেখে যাওয়া হবে? এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এখনো সেলিমের ভালো লাগে, যদিও তা অনিয়মিত এবং বাবার প্রতি তিনি এখনো অবিচল ঘৃণা প্রদর্শন করেন। তাকে তার অভিভাবকদের একজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে এমন চিন্তা মাথায় আসতেই সেলিম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। তাকে জানতে হবে বাবা তার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়ে সরাসরি তাঁকে জিজ্ঞাসা করার অধিকার কি তার নেই?
তর্করত সভাসদদের ভিড় ঠেলে সেলিম দ্রুত সভা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। দৌড়ে উঠান পেরিয়ে সে তার পিতার ব্যক্তিগত কক্ষের সামনে হাজির হলো। তাকে দেখে রক্ষীরা কক্ষের দরজা খুলে দিলো প্রবেশ করার জন্য। ভিতরে ঢুকে সেলিম দেখতে পেলো আকবর তাঁর আনুষ্ঠানিক তলোয়ারটি কোমর থেকে খুলে রাখছেন। তার মনে একটু আগে সৃষ্টি হওয়া আত্মবিশ্বাসে হঠাৎ করেই ঘাটতি দেখা দিলো এবং সে ইতস্তত বোধ করলো। সে বুঝতে পারছে না কি বলে শুরু করবে কিম্বা যে রকম দ্রুত বেগে এসেছে সেভাবেই প্রস্থান করবে কি না। যাই হোক, আকবর তাকে কক্ষে ঢুকতে দেখেছেন এবং তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, সেলিম, তুমি কি চাও?
আমি জানতে চাচ্ছিলাম আমরা ফতেহপুর শিক্রি ত্যাগ করছি কেনো, সেলিম চট করে বলে ফেললো।
এটি একটি ভালো প্রশ্ন এবং ন্যায্যও বটে। তুমি ঐ টুলটির উপর বসে একটু অপেক্ষা করো, আমি পোশাক পরিবর্তন করে তোমাকে উত্তর দেবো।
সেলিম টুলের উপর বসলো, অস্থির ভাবে সে তার আঙ্গুলে পড়া সোনার আংটিটা ঘোরাতে লাগলো। এটি তাকে তার মা উপহার দিয়েছেন এবং অভ্যাসবশত সেটা সে সর্বদা তার ডান হতের তর্জনীতে পড়ে থাকে। আকবর পোশাক পরিবর্তন করে সোনার গামলায় রাখা গোলাপ জলে হাত এবং মুখ ধুলেন, তার দুজন তরুণ পরিচারক সেটি তাঁর সামনে ধরে রেখেছে। তিনি পরিচারকদের বিদায় করে সেলিমের পাশে থাকা আরেকটি টুলে বসলেন।
তুমি কি বলতে পারো সেলিম, কেনো আমি রাজধানী লাহোরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি?
এক মুহূর্ত সেলিম চুপ করে রইলো, কি বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর সে কিছুটা বাধো বাধো স্বরে বলে উঠলো, আমি ঠিক জানি না…আমি খুব অবাক হয়েছি কারণ বেশি দিন হয়নি তুমি নিজে এই শহরটি তৈরি করেছে বহু টাকা খরচ করে ভবিষ্যত দ্রষ্টা শেখ সেলিম চিশতির সম্মানে এবং আমার ও আমার অন্য ভাইদের জন্মদিন এবং গুজরাট ও বাংলায় তোমার মহান বিজয় উদ্যাপনের জন্যেও…আমি চিন্তা করে পাচ্ছি না কেনো তুমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই জন্যই আমি তোমার কাছে এসেছি…জানার জন্য…একজন সভাসদ পানি সরবরাহ সম্পর্কে কিছু বলছিলো…।
পানি সরবরাহের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। পানির সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব। আর এই শহরটি নির্মাণ করতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে সে বিষয়েও তোমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমাদের সাম্রাজ্য বর্তমানে এতো সমৃদ্ধ যে অতীতে খরচ করা অর্থ ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আমি আরো অধিক ক্ষমতাশালী হতে চাই এবং সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদ আরো বৃদ্ধি করতে চাই এতো সম্পদ যা দিয়ে এরকম দশটি, এমনকি একশোটি ফতেহপুর শিক্রি তৈরি করা যাবে।
তুমি কি বোঝাতে চাইছো বাবা?
তোমার প্রপিতামহ বাবর লিখে গেছেন একজন সম্রাট যদি তার অনুসারীদের যুদ্ধ এবং লুটতরাজের সুযোগ করে না দেন তাহলে তাদের অলস মনে অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। আর আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি উপলব্ধি করেছি যে একজন শাসক যদি নতুন সাম্রাজ্য বিজয়ে আগ্রহ না দেখায় তাহলে তার প্রতিবেশী রাজ্যের অধিপতিগণ মনে করে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং খুব শীঘ্রই তারা তার রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকে। আমি লাহোরে রাজধানী স্থানান্ত র করতে যাচ্ছি এই জন্য যে শীঘ্রই আমি আমার সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত জন্য আবার যুদ্ধ শুরু করবো।
সেলিমের মাঝে উল্লাস এবং স্বস্তির মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। তার পিতা যুদ্ধ এবং বিজয় অভিযান ব্যতীত আর কিছু ভাবছেন না। তুমি যেহেতু লাহোরে তোমার সেনা শিবির স্থাপন করতে যাচ্ছে এর অর্থ কি এই যে তুমি উত্তর দিকে রাজ্য বিস্তার করতে চাও?
অনেকটা তাই। সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানের শাসকরা বহু দিন ধরে আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ এবং বৈরাম খান যখন আমার অভিভাবক ছিলেন তখন পারস্যের শাহ্ কান্দাহার দখল করে আমার অহমিকায় আঘাত করেছেন, সেটাও আমাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কিন্তু একজন সম্রাট যতোই শক্তিশালী হোক না কেনো সে যদি বিচক্ষণ হয় তাহলে সে একএকবারে একজন শত্রুরই মোকাবেলা করবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রথমে কাশ্মীরে অভিযান চালাবো।
কিন্তু সেখানকার শাসক তো আমাদের আত্মীয়!
হ্যাঁ। হায়দার মির্জা, আমার বাবার চাচাতো ভাই। শেরশাহ্ এর আমলে তিনি কাশ্মীর দখল করেন এবং আমার বাবার আমলে তার জায়গিরদার হিসেবে নিযুক্ত হোন। কিন্তু তার উত্তরসূরিরা- সম্ভবত আমাদের রক্তের বন্ধনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে-কর প্রদান করতে অস্বীকার করছে। এবার তারা শিক্ষা পাবে যে একটি পরিবারে একজনই কর্তা থাকে এবং শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে আমাকে অবশ্যই কর প্রদান করতে হবে। আকবর থামলেন এবং তাঁর দৃষ্টি সেলিমের কাছে শীতল মনে হলো। তার পিতা আবার কথা বলা শুরু করলেন, তোমার পিতামহ হুমায়ুনের কথা বিবেচনা করে। তিনি যদি তাঁর সৎ ভাইদের প্রাথমিক আনুগত্যহীনতা আরো কঠোর ভাবে মোকাবেলা করতেন তাহলে তিনি নিজেকে অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে পারতেন।
যদিও সেলিম বুঝতে পারছিলো তার পিতা তাঁদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় কাশ্মীরের শাসকদের লক্ষ করে কথা বলছিলেন, তবুও নিজের অজান্তেই তার মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হলো।
*
সেলিম সামনের দিকে তাকালো। সে সরল রেখায় অগ্রসরমান রাজকীয় হাতির দলের সবচেয়ে পিছনের হাতিটির পিঠের হাওদায় রয়েছে। তারা কাশ্মীরের উপত্যকার উপর দিয়ে আগাচ্ছে। এই মুহূর্তে ভোরের কুয়াশা কেটে গিয়েছে। হাতির দলের পাশে অগ্রসর হচ্ছে আশ্বারোহী সৈন্যরা। পাহাড়ের ঢালগুলি ঝকঝকে সবুজ পাতা বিশিষ্ট রডোডেনড্রন গাছের গোলাপি এবং বেগুনি রঙের ফুলে ছেয়ে আছে। কাশ্মীরের বসন্ত দেরিতে আসে, কিন্তু যখন আসে তখন এর অসমান্য সৌন্দর্য দিয়ে দেরির ক্ষতি পূরণ করে দেয়। উপত্যকা জুড়ে গজিয়ে উঠা পান্নার মতো সবুজ ঘাসে লাল টিউলিপ এবং বেগুনি ও রক্তাভ বর্ণের আইরিস ফুল ফুটে রয়েছে এবং মৃদুমন্দ বাতাসে সেগুলি আন্দোলিত হচ্ছে।
লাহোরে রাজধানী স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি তার মা তার নতুন কক্ষের ব্যাপারে সামান্যই অভিযোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। লাহোরের প্রসাদের নতুন কক্ষটি ফতেহপুর শিক্রির তুলনায় অধিক আলো-বাতাস সম্পন্ন এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রবি নদী দেখতে পাওয়ার সুবিধা। আবারো বুকে সাহস সঞ্চয় করে সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কাশ্মীর অভিযানে তিনি তাকে সঙ্গে নেবেন কি না, কারণ তার বয়স এখন চৌদ্দর কাছাকাছি এবং সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ শিখতে সে ভীষণ আগ্রহী। আকবর রাজি হওয়ায় সে একই সঙ্গে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়েছে। এমনকি তাকে তিনি একজন সঙ্গী নির্বাচনের সুযোগও দিয়েছেন। সেলিম সুলায়মান বেগকে নির্বাচন করেছে, সে তার দুধভাইদের একজন। তার বয়স প্রায় সেলিমের সমান এবং সে মাত্র কয়েকদিন আগে তার বাবার সঙ্গে বাংলা থেকে ফেরত এসেছে যিনি বেশ কিছু বছর সেখানকার সহকারী প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তার মা বাংলাতে মারা গিয়েছে এবং সেলিমের তার দুধমাকে সামান্যই মনে আছে। সুলায়মানের হালকা পাতলা কাঠামো দেখে তার দৈহিক শক্তি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায় না এবং সে সর্বদা দক্ষতার মহড়ায় বা শিকার অভিযানে সেলিমের সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত থাকতো। তার উপস্থিত কৌতুকবোধের প্রভাবে সেলিম না হেসে থাকতে পারতো না, এমনকি সে যখন তার ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তা করে মনমরা হয়ে থাকতো তখনোও এর ব্যতিক্রম ঘটতো না।
সেলিমকে আকবর অভিযানের সঙ্গী করা সত্ত্বেও কদাচিৎ যুদ্ধসভার সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় এর ব্যতিক্রম ঘটেছিলো, তিনি সেলিমকে সভায় ডেকেছিলেন। সে যখন তার বাবার বিশাল আকারের উজ্জ্বল লাল বর্ণের নিয়ন্ত্রণতাবুতে প্রবেশ করে তখন দেখতে পায় সভা ইতোমধ্যে আরম্ভ হয়ে গেছে এবং আকবর বক্তব্য রাখছেন। সামান্য থেমে তিনি তাকে ইশারা করেন মেঝের শতরঞ্জিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা সেনাপতিদের পাশে বসতে।
সেলিম বসতে বসতে শুনতে পেলো আকবর বলছেন, …তাহলে আমাদের তথ্য সংগ্রহকারী এবং গুপ্তচরদের বয়ে আনা খবর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দুই এক দিনের মধ্যেই আমরা কাশ্মীরের সুলতানের একটি অগ্রগামী সৈন্যদলের মুখোমুখী হবো যেখানে উপত্যকাটি আরেকটু প্রশস্ত হয়েছে। তাঁদের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আকবর তার নতুন প্রধান সেনাপতি আব্দুল রহমানের দিকে তাকালেন, বার্ধক্যের কারণে আহমেদ খানের পদত্যাগের পর সে তার ভূমিকায় নিযুক্ত হয়েছে। সেনাকর্তাদের বলবে আজ সন্ধ্যায় যেনো তারা তাদের অধীনস্ত সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করে। আজ রাতে আমাদের সেনা শিবিরের চারপাশে পাহারারত রক্ষীদের সংখ্যা দ্বিগুণ করবে। আমাদের বাহিনীর প্রস্থের সমান সংখ্যক তথ্যসংগ্রহকারীকে আগামীকাল সকালে আমাদের যাত্রার পূর্বে রওনা করে দেবে। সাধারণত আমরা সকালের যে সময় যাত্রা শুরু করি তার তুলনায় এক ঘন্টা আগেই আগামীকাল রওনা হবো। তুমি অগ্রবর্তী সৈন্য দলের নেতৃত্ব দেবে, তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে আমাদের সবচেয়ে দক্ষ অশ্বারোহী যোদ্ধা এবং বন্দুকধারীরা।
জ্বী জাহাপনা। আজ রাতে শিবিরের পাহারায় দ্বিগুণের পরিবর্তে আমি তিনগুণ বৃক্ষী নিযুক্ত করবো। এবং প্রতিটি পাহারাচৌকিতে যাতে শিঙ্গা এবং ঢাক থাকে তাও নিশ্চিত করবো যা বিপদ সংকেত প্রদানে ব্যবহার করা হবে, যদি কুয়াশার আড়ালকে ব্যবহার করে কোনো আক্রমণের চেষ্টা হয়। তাছাড়া আমি সেনাকর্তাদের নির্দেশ দেবো যাতে পনেরো মিনিট পর পর তারা পাহারাচৌকিগুলিতে টহল দেয়।
ঠিক আছে আব্দুল রহমান।
জাহাপনা, দয়া করে যদি বলেন আগামীকাল সকালে আপনি সেনা দলের কোনো অংশে অবস্থান করবেন তাহলে ভালো হয়, এই তথ্যের ভিত্তিতে আমি আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই।
আমি যুদ্ধহাতির নেতৃত্ব দেবো, কিন্তু সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে হাতিবাহিনীর শেষ অংশে। কারণ আমার পুত্র সেলিম সেখানে অবস্থান করবে। এটা তার জীবনের প্রথম যুদ্ধ। সে এবং তার ভাইয়েরা মোগল সম্রাজ্যের ভবিষ্যত এবং এ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়তা। আমি তাকে আজকের সভায় উপস্থিত হতে বলেছি যাতে সে আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। সেলিম অনুভব করলো তার বাবার সেনাপতিদের দৃষ্টি তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আকবর তাকে বললেন, সভাকে উদ্দেশ্য করে তুমি কি কিছু বলবে, সেলিম?
আকবরের এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে সেলিম কিছুটা বিস্মিত হলো এবং তার মস্তিষ্ক এক মুহূর্তের জন্য শূন্য হয়ে পড়লো। কিন্তু তারপর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সে বলে উঠলো, আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে এই যুদ্ধে আমি আমার সর্বোচ্চ সামর্থ প্রয়োগ করবো এবং আশা করি আমি তোমার সেনাপতিদের মতোই সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারবো এবং তোমার পুত্র হিসেবে তোমার মর্যাদা রক্ষা করতে পারবো।
সেলিম যখন থামলো উপস্থিত সেনাপতিরা একযোগে করতালি দিলো এবং আকবর বললেন, নিশ্চয়ই তুমি পারবে।
সেলিমের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকবর আবার সভার দিকে মনোযোগ দিলেন। সে তখন ভাবছে তার বাবার কণ্ঠস্বরে এমন কোনো আভাস ছিলো কি যাতে বোঝা যায় সে যথেষ্ট মৌলিক এবং উত্তম বক্তব্য প্রদান করতে পারেনি? কিন্তু তারপর আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কিত উত্তেজনা তার মনের সকল দুশ্চিন্তাকে গ্রাস করলো।
আঠারো ঘন্টা পর বর্তমানে পাহাড়ের ঢাল ছেয়ে থাকা রডোডেনড্রন ফুলের দিকে তাকিয়ে সেলিম এখনোও সেই উত্তেজনা অনুভব করছে। হঠাৎ সবচেয়ে ঘন বিন্যস্ত ঝোঁপ যেখানে রয়েছে তার পেছনে সে নড়াচড়া দেখতে পেলো। ওখানে কি হলো? শত্রুরা নয়তো? সেলিম সুলায়মান বেগকে জিজ্ঞাসা করলো।
না, ওটা সামান্য একটা হরিণ, তার দুধভাই উত্তর দিলো। তার ধারণাকে সত্য বলে প্রমাণ করতেই যেনো ঝোঁপের পিছন থেকে একটি হরিণ লাফিয়ে বেরিয়ে এলো। এক সৈনিক তীর ছুঁড়ে সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে হত্যা করলো।
অন্তত কিছু লোকের ভাগ্যে আজ রাতে ভালো খাবার জুটবে, কি বলল সুলায়মান?
দশ মিনিট পর দূরে তাকিয়ে সেলিমের মনে হলো সে আবারো গাছপালার মধ্যে নড়াচড়া দেখতে পেলো। জায়গাটি পর্বতশীর্ষের গাছের সারি বিশিষ্ট সরু ভূমিরেখার উপরে অবস্থিত এবং প্রায় এক মাইলের মতো দূরে। যেহেতু আগের বার তার ভুল হয়েছিলো তাই এবার সংযতভাবে সে সুলায়মান বেগের হাত ধরে সেদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং ফিসফিস করে বললো, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?
সুলায়মান উত্তর দিতে পারার আগেই স্পষ্ট বোঝা গেলো সেটা কোনো হরিণ নয়। সেই মুহূর্তে একজন মোগল তথ্যসংগ্রহকারীর শিঙ্গার দূরাগত আর্তনাদ শোনা গেলো এবং সেলিমের দেখা পর্বতশীর্ষের সেই জায়গাটিতে তাকে ঘোড়া পিঠে চড়ে হাজির হতে দেখা গেলো। তৎক্ষণাৎ উন্মত্তভাবে হাত-পা চালিয়ে সে তার ঘোড়াটিকে গাছপালা ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের দিকে ছোটালো। তার পেছনে বন্দুকের গুলির শব্দ হলো। সেই মুহূর্তে তাকে ধাওয়াকারী কাশ্মীরি সৈন্যরা সেখানে আবির্ভূত হলো। মোগল তথ্য সংগ্রাহকারীটি এঁকে বেঁকে ঘোড়া ছোটানো সত্ত্বেও শত্রুপক্ষের একজন কালো ঘোড়ার সওয়ারী তার অত্যন্ত কাছে চলে এলো। মোগলটির কাছ থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে কাশ্মীরিটি থমকে গেলো এবং কিছু নিক্ষেপ করলো-সম্ভবত ছোরা-এবং মোগলটি ছুটন্ত ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে গেলো।
ইতোমধ্যে আরো কাশ্মীরিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মোগল সৈন্যদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো ঝোপঝাড় মাড়িয়ে। পাশের দিকে থাকা মোগল অশ্বারোহীরা তাদের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আক্রমণকারীদের দিকে ফিরলো এবং ঘোড়ার পিঠে থাকা বন্দুকধারীরা লাফিয়ে মাটিতে নেমে তাদের বন্দুক প্রস্তুত করতে লাগলো। কোনোভাবে কাশ্মীরিরা আব্দুল রহমানের তথ্যসংগ্রকারীদের ব্যুহ ভেদ করেছে, হয়তো তাঁদের সবাইকে হত্যা করেছে কোনো প্রকার সংবাদ প্রেরণের আগেই একমাত্র তাকে ছাড়া যে একটু আগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছিলো।
সেলিমের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হলো এবং সে অনুভব করলো তার সমস্ত ইন্দ্রিয় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে। তার হাওদার পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন দেহরক্ষী গুলি করার জন্য তাদের বন্দুক প্রস্তুত করছে। তার সামনে অবস্থিত হাতিগুলির আরোহীরাও একই কাজে ব্যস্ত। প্রত্যেক হাতির কানের পিছনে দুজন করে মাহুত বসে আছে এবং তারা চেষ্টা করছে। হাতিগুলির মুখ শত্রুদের দিকে ফেরাতে, কারণ এতে করে শত্রুদের লক্ষ হিসেবে তাদের আকার অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে আসবে। হঠাৎ সেলিমের সামনে থাকা দুই নম্বর হাতির পিঠ থেকে একজন সৈন্য নিচে পড়ে গেলো, সে ঘাড়ের উপর তীরবিদ্ধ হয়েছে। মাটিতে পড়ে যাওয়া সৈন্যটির পেছনের হাতিটি সাবধানে তার উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটিকে পাশ কাটিয়ে গেলো যদিও হয়তো ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়েছে। এসময় সেলিম দেখতে পেলো ইস্পাতের বক্ষবর্ম এবং মাথায় ময়ূরের পালক গোজা গম্বুজাকৃতির শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত কাশ্মীরি যযাদ্ধারা সঙ্বদ্ধভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে মোগল অশ্বারোহী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাদের নেমে আসার তীব্র গতির ধাক্কায় বেশ কিছু মোগল সৈন্য তাঁদের ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলো। কিছু কাশ্মীরি যখন মোগল অশ্বারোহীদের ব্যুহ ভেদ করে হাতিবাহিনীর দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলো তখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আরো অধিক সংখ্যক কাশ্মীরি নেমে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিলো। তাঁদের কেউ কেউ সবুজাভ-নীল রঙের যুদ্ধ পতাকা বহন করছিলো। মাঝে মাঝে একজন দুজন কাশ্মীরি বা তাদের ঘোড়া মোগলদের ছোঁড়া গুলি বা তীরের আঘাতে পড়ে যাচ্ছিলো।
একজন সবুজ পাগড়ি পরিহিত মোগল সেনাকর্তাকে একজন পতাকা বহনকারী কাশ্মীরিকে আক্রমণ করতে দেখা গেলো। মোগলটি তার চোখ বরাবর তলোয়ার চালালো এবং আঘাতের কারণে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে কাশ্মীরিটি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো। কিন্তু আরেকজন কাশ্মীরি সেনাকর্তাটির পেট লক্ষ্য করে তার বর্শা চালালো যখন সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসার উদ্যোগ নিচ্ছিলো। মোগলটি তার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলো কিন্তু তার পা রেকাবে আটকে রইলো এবং তার ঘোড়াটি কাশ্মীরি বাহিনীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তার মাথা মাটিতে বাড়ি খেতে খেতে অগ্রসর হলো। অবশেষে তার দেহটি অগ্রসরমান কাশ্মীরি যোদ্ধাদের ঘোড়ার খুরের নিচে পিষ্ট হতে থাকলো।
অন্য কাশ্মীরি অশ্বারোহীরা এখন সেলিমের হাতির কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মতো দূরে রয়েছে। সজোরে তাঁদের ঘোড়ার পাজরে লাথি মেরে তারা মোগল অশ্বারোহীদের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং দুপাশে প্রবলভাবে তলোয়ার চালাচ্ছে। সেলিম এবং সুলায়মান উভয়েই তাঁদের ধনুকের ছিলো টেনে তীর ছুড়লো, একই সঙ্গে তাদের পিছনে অবস্থিত দেহরক্ষীরা বন্দুকের গুলি ছুড়লো। সেলিম যে অগ্রবর্তী কাশ্মীরিটিকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়েছিলো তার গালে তীরটি বিধলো এবং সে ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে গেলো। সেলিম উল্লসিত হয়ে উঠলো। কিন্তু তার উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার পেছনে অবস্থিত দেহরক্ষীদের একজন যার নাম রাজেশ, সে নিজের গলা আঁকড়ে ধরে হাওদা থেকে নিচে পড়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পর তার হাতিটির কানের পিছনে বসে থাকা দুজন মাহুতের একজনও আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। তাদের সামনের হাতিটি তখন সেটার মাহুতদের নির্দেশে কাশ্মীরিদের দিকে ঘুরছিলো এবং সেটার পায়ের নিচে তার হাতির মাহুতটি করুণভাবে পিষ্ট হলো।
ত্রিশ গজ দূরে থাকা আরেকজন কাশ্মীরিকে লক্ষ্য করে সেলিম তীর ছুড়লো। তবে এবারে তার তীরটি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে অশ্বারোহীটির ঘোড়ার ঘাড়ে বিধলো। মাথা ঝাঁকিয়ে তীব্র হ্রেষাধ্বনি দিয়ে ঘোড়াটি একপাশে আছড়ে পড়লো, সেটার আরোহী হাতের বর্শা ফেলে প্রাণপণে ঘোড়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলো। একটি পতনের শব্দের সঙ্গে সেলিম অনুভব করলো তার হাওদাটি ভীষণভাবে দুলে উঠলো। পেছনে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো তার দ্বিতীয় দেহরক্ষীটি হাওদার মেঝেতে পড়ে আছে। ইতোমধ্যে সুলায়মান বেগ তার ডান উরুতে সৃষ্ট গুলির ক্ষততে একটি হলুদ রুমাল জড়িয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
আবার সামনের দিকে তাকিয়ে সেলিম দেখলো মোগল অশ্বারোহীবাহিনীর একটি শক্তিশালী সঙ্বদ্ধ দল কাশ্মীরিদের আঘাত হানতে অগ্রসর হচ্ছে। রাজকীয় দেহরক্ষীদের একজন দলপতি অব্যর্থ নিশানায় স্থূলকায় এবং ঘন দাড়ি বিশিষ্ট এক কাশ্মীরির দিকে তার বর্শাটি ছুঁড়ে মারলো এবং বর্শাবিদ্ধ হয়ে কাশ্মীরিটি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো। মোগল সেনার যুদ্ধকুঠারের আঘাতে আরেকজনের মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সেলিম অনুভব করলো যুদ্ধক্ষেত্রে মোগলদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার হাতিটি প্রবলভাবে দুলে উঠলো। হাতিটির কানের পেছনে বসে থাকা দ্বিতীয় মাহুতটিও আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। প্রবলবেগে ড় নাড়তে নাড়তে মাহুতবিহীন জানোয়ারটি সংঘর্ষের এলাকা থেকে সরে যেতে লাগলো এবং যাওয়ার সময় একজন মোগল অশ্বারোহীকে ধাক্কা মেরে তার ঘোড়া থেকে ফেলে দিলো। এই মুহূর্তে সেলিম যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে হাতিটি আরো সৈন্যকে হতাহত করবে এবং ঘোড়াগুলিকে আতঙ্কিত করবে।
চারপাশের ভয়ানক সংঘর্ষ এবং চিৎকার উপেক্ষা করে সেলিম দ্রুত তার হাওদার সমানের কাঠের কার্ণিশ টপকালো। তারপর দুদিকে পা দিয়ে কসরৎ করে হাতিটির ঘাড়ের উপর বসে ঘষটে ঘষটে সেটার কানের পিছনের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। জায়গামতো পৌঁছে হাতিটির মাথার ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণ ধরে নিজেকে স্থির করলো। তারপর খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়ে উল্টো করে ধরে সেটার হাতলের সাহায্যে মাহুতরা যেভাবে হাতির মাথায় টোকা দেয় শান্ত করার জন্য সেভাবে ঠুকতে লাগলো। এসময় তলোয়ারের ধারালো অংশে ঘষা লেগে কয়েক জায়গায় তার হাত কেটে গেলো। হাতিটি তার ঘাড়ের উপর পুনরায় সওয়ারীর ওজন অনুভব করে এবং মাথায় থামার সংকেত স্বরূপ টোকা খেয়ে ক্রমশ স্থির হয়ে এলো। উ ভ্রান্ত হাতিটি ইতোমধ্যে লড়াই এর কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ গজের মতো দূরে সরে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে সেলিম দেখলো আক্রমণ শেষে যে সব কাশ্মীরি এখনোও জীবিত রয়েছে তার রণেভঙ্গ দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের অনেকেই পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে পালাতে সক্ষম হলো না। সেলিম দেখলো ঘিয়া রঙের পাগড়ি পড়া এক কাশ্মীরি তাকে ধাওয়া করা মোগল সেনাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারবে না বুঝতে পেরে তার কালো ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে মোগলদের দিকে পুনরায় ধেয়ে এলো। একজন মোগল সেনা তার তলোয়ারের আঘাতে নিহত হলো ঠিকই কিন্তু তারপর সে নিজেও মাথায় তলোয়ারের আঘাত পেয়ে লুটিয়ে পড়লো।
সেইদিন সন্ধ্যায় আবার সেলিমের ডাক পড়লো আকবরের যুদ্ধ সংক্রান্ত সভায়। এবারে সে যখন রক্তবর্ণের যুদ্ধনিয়ন্ত্রণ তাবুতে প্রবেশ করলো দেখতে পেলো তাকে ছাড়াই আগের মতো সভা আরম্ভ হয়ে যায়নি। বরং সে সেখানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হলো এবং তার বাবার নেতৃত্বে উপস্থিত সেনাপতিরা তাকে উদ্দেশ্য করে করতালি প্রদান করতে লাগলো। আকবরের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে সে তার বাবার সিংহাসনের পাশে স্থাপিত টুলের দিকে অগ্রসর হলো। তার মনে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না যে আর কর্মকাণ্ডে তার পিতা সন্তুষ্ট কি না।
.
১৯. কৌমার্যের রত্ন
তোমার বয়স বর্তমানে পনেরো। এখন তোমার প্রথম স্ত্রী গ্রহণ করার সময় হয়েছে। সেলিম উত্তর দিতে পারার আগেই আকবর লক্ষ্যবস্তু পর্যবেক্ষণ করতে এগিয়ে গেলেন। তারা লাহোর রাজপ্রাসাদের সামনে অবস্থিত কুচকাওয়াজের ময়দানে রয়েছে এবং সেলিম ও আকবর গাদাবন্দুক ছোঁড়ার অনুশীলন করছে। একটি গাছের গুঁড়ির উপর রাখা মাটির পাত্রকে লক্ষ্য করে এই মাত্র সেলিম গুলি করেছে। তিনশ গজ দূর থেকে সে দেখতে পাচ্ছে তার বাবা মধ্যের পাত্রটি আগেই গুলি করে ভেঙ্গেছেন। তিন মাস আগে কাশ্মীর বিজয় করে ফেরার পর থেকে আকবর অনেক বার তাকে শিকার, বাজপাখি উড়ানো এবং বন্দুক ছোঁড়ার অনুশীলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
সেলিম তৎক্ষণাৎ তাকে অনুসরণ করলো। বাবা, তুমি কি বললে?
বলেছি তোমার বিয়ে করার সময় হয়েছে। তোমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি আমাদের কাশ্মীরের মহান বিজয়ের উৎসব উদ্যাপন করতে চাই। তাছাড়া সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ শক্ত করার জন্যেও আমি নাতিদের মুখ দেখতে চাই। আকবর হাসলেন। সেলিম জানতো আকবর ভাবতে পারেননি কাশ্মীর এতো সহজে তাঁর করতলগত হবে। কাশ্মীর রাজ্যের চারদিক ঘিরে থাকা পাহাড়ের প্রাচীর মোগল বাহিনীর দুর্দমনীয় ঐকান্তিকতার কাছে কোনো প্রতিবন্ধকতা নয় এই বাস্তবতা অনুধাবন করে কাশ্মীরের সুলতান সময় নষ্ট
করে সন্ধির আবেদন করে। সেলিমের মনে পড়ে গেলো সেই ক্ষণটির কথা যখন সুলতান মাথা নিচু করে আকবরের রক্তলাল নিয়ন্ত্রণ তাবুর সম্মুখে মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং মোগল সম্রাটের নামে খুতবা পাঠ করা হচ্ছিলো। আকবর সুলতানকে জীবন ভিক্ষা দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে কাশ্মীরের উপর দৃঢ় মোগল নিয়ন্ত্রণও আরোপ করেছেন। তবে এই
বিজয় বা সাম্রাজ্যের সীমা বর্ধনে আত্মতৃপ্তিবোধ না করে আকবর ইতোমধ্যেই সিন্ধু আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করেছেন।
কিন্তু আমি কাকে বিয়ে করবো?
আমার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি তোমার মামাতো বোন মান বাঈকে তোমার স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করেছি। তার পিতা অম্বরের রাজা ভগবান দাশ ইতোমধ্যেই আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন।
সেলিম তার বাবার দিকে তাকালো। মান বাঈ তার আপন মামাতো বোন। সে তাকে একবারই দেখেছে যখন তারা উভয়েই শিশু ছিল এবং তার কেবল একটি শান্তশিষ্ট, পাতলা গড়ন ও লম্বা লম্বা পা বিশিষ্ট এবং মাথার চুল বেনি করা মেয়েকে মনে আছে।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ অবাক হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম এই মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে পূর্ণপুরুষে রুপান্তরিত হতে তুমি আগ্রহী হবে। তাছাড়া আমি শুনেছি বাজারের মেয়েদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার বিষয়ে তোমার যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে।
সেলিমের মুখ লজ্জায় আরক্ত হলো। সে এতোদিন মনে করত তার গোপন অভিযান সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। কাশ্মীর থেকে ফেরার পথে সে এবং সুলায়মান বেগ রাতের বেলা তাদের তাবু থেকে বের হয়ে সহযাত্রীদের মধ্যে ইচ্ছুক কোনো মেয়ে পাওয়া যায় কি না তার সন্ধান করতো। এক রাতে তাদের অনুসন্ধান সফল হয় এবং সেলিম এক দারুচিনি ঘ্রাণ বিশিষ্ট তুর্কি রমণীর কাছে তার কৌমার্য হারায়। জায়গাটি ছিলো ঠাণ্ডা বায়ু প্রবাহিত এক গিরিপথ। লাহোরে ফিরে এসে তারা দুজন রাতের বেলা গোপনে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে একই রকম অভিযান চালাতে থাকে লাহোর শহরে। একটি নির্দিষ্ট সরাইখানায় সে গীতা নামের নধর দেহের অধিকারী এক নর্তকীর সন্ধান পায়। তার বক্ষযুগল উঁচু এবং সুগোল এবং সে মিলনের কলাকৌশল সম্পর্কে বিশেষ পারদর্শী। আর সুলায়মান বেগও তার বোনের তত্ত্বাবধানে ভালোই সময় কাটাতো। পরে কঠিন গোপনীয়তায় প্রাসাদে ফিরে তারা নিজেদের শৌর্য সম্পর্কে অতিরঞ্জিত গল্প বলে একে অন্যকে নিজের তুলনায় দুর্বল প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতো। কিন্তু বাজারের কোনো মেয়েকে নাড়াচাড়া করা এবং একজন স্ত্রী গ্রহণ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। বিয়ের চিন্তা আমার মনে একদম আসেনি…
এখনো তোমার বয়স খুব একটা বেশি নয়, কিন্তু এই চিন্তা তোমার করা উচিত। আমাদের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত এবং সম্মানিত জায়গীদারদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে আমাদের সাম্রাজ্যের ভিত আরো শক্ত হবে। আমাদের বিপদের সময় তারা আমাদের সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করবে এই জন্য নয় যে তারা আমাদের ভালোবেসে বরং এই জন্য যে এতে তাদেরও উপকার হবে। আকবর থামলেন, তাঁর দৃষ্টি সেলিমকে পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি তার পুত্রের সঙ্গে এতো আন্তরিকভাবে কদাচিৎ কথা বলেন। আমাদের বিরুদ্ধে খুব অল্প সংখ্যক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটছে আজকাল এবং প্রতি বছর আমরা আরো অধিক ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে উঠছি। এসব কেনো ঘটছে বলে তুমি মনে করো? তাছাড়া ওলামারা এখন কেনো আর আমার ধর্মীয় সহনশীলতা নিয়ে খোলা মেলা ভাবে প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না অথবা আমার হিন্দু স্ত্রীগণের বিষয়ে নাক গলায় না বা দিন-ই ইলাহী কে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে না? এ সব কিছুর প্রধান কারণ বৈবাহিক মৈত্রীর মাধ্যমে আমি এমন শক্তিশালি অবস্থান গড়ে তুলেছি যাতে আক্রমণ করার সাহস কারো নেই। আমার বক্তব্য বোঝার চেষ্টা করো সেলিম, এটা তোমার নিজস্ব ইচ্ছা বা অনন্দ উপভোগের বিষয় নয়। তার জন্য তুমি নিজের রক্ষিতা সম্বলিত হেরেম গড়ে নিতে পারো। এটা দায়িত্বের প্রশ্ন। তোমার মাকে আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি।
বিয়ে সম্পর্কে তার বাবার দৃষ্টিভঙ্গী আকর্ষণ, আবেগ, ভালোবাসা এবং আনন্দ বর্জিত, সেলিম ভাবলো। অথচ তার দাদীর দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ বিপরীত। দাদা হুমায়ূন এবং তার মাঝে যে পারস্পরিক ভালোবাসা এবং সহযোগীতার সম্পর্ক ছিলো সে গল্প তিনি বহুবার সেলিমকে শুনিয়েছেন। সম্ভবত তার মায়ের সঙ্গে বাবার ভালোবাসাহীন সম্পর্কই এই আবেগহীনতার মূল কারণ। এই বৈবাহিক সম্পর্ক যেহেতু রাজনৈতিক মৈত্রী ব্যতীত প্রকৃত প্রেম-ভালোবাসা প্রসব করতে পারেনি তাই বাবা হয়তো তার পরবর্তী স্ত্রীদের কাছেও নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরতে পারেননি। তিনি তাঁর স্ত্রীদের কারো প্রতিই কখনোও ভালোবাসার উচ্ছ্বাস বা আবেগ প্রকাশ করেননি, বরং বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে যে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জিত হয়েছে তা নিয়েই বেশি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
যাইহোক, মা হীরাবাঈ নিশ্চয়ই এই বিয়েতে অত্যন্ত খুশি হবেন। মান বাঈ এর গর্ভে যে সন্তান জন্ম নেবে সে হয়তো ভবিষ্যতে মোগল সম্রাট হবে। এবং একজন মোগলের তুলনায় তার মধ্যে রাজপুত রক্তের প্রভাবই বেশি থাকবে। কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজ ভাই ভগবান দাশ সম্পর্কে হীরাবাঈ এর মন্তব্যটি সেলিমের মনে পড়ে গেলো: মানুষকে যে কোনো সময় কেনো যায়… সবসময় যেমন হয় তেমন ভাবেই সেলিমের মন সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তার মেঘে ছেয়ে গেলো, তবে সে অনুভব করছিলো তার খুশি হওয়া উচিত যেহেতু তার পিতা তার জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ রাজ সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। সে নিজের চেহারায় কৃতজ্ঞতার ভাব আনার চেষ্টা করলো- অন্তত তার হৃদয়ে সে তেমনই অনুভব করছে।
বিয়েটা কবে হবে বাবা?
সম্ভবত আট সপ্তাহ পরে, তোমার হবু স্ত্রীর অম্বর থেকে এখানে পৌঁছাতে এরকম সময়ই লাগবে। আকবর হাসলেন। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে অতিথিদের আসতেও ওরকম সময়ই লাগবে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্যদের তোমার বিয়ের উপহার পাঠাতে। আমার ইচ্ছা তোমার বিয়ের অনুষ্ঠানটি লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হোক এবং ইতোমধ্যেই আমি এ বিষয়ে আবুল ফজলকে নিয়ে পরিকল্পনা করা শুরু করে দিয়েছি। উৎসবটি একমাস ধরে চলবে এবং এতে অন্তর্ভূক্ত থাকবে শোভাযাত্রা, উটের দৌড়, পোলো প্রতিযোগীতা এবং হাতির লড়াই। এছাড়া প্রতি রাতে অনুষ্ঠিত হবে ভোজসভা এবং আতশবাজীর প্রদর্শনী। এসো। এখন আমরা আবার লক্ষ্যভেদের অনুশীলন শুরু করি।
সেলিম হতাশ হলো। কারণ বাবাকে তার আরো অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিলো। কিন্তু আকবর ইতোমধ্যেই তার বন্দুকে বারুদ ভরা আরম্ভ করে দিয়েছেন।
*
মান বাঈ প্রাসাদের সোনর কারুকাজ খচিত চাদোয়ার নিচে বসে ছিলো। প্রাসাদটি অম্বর থেকে আসা অতিথিদের জন্য বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে সাজান হয়েছে। দুই দিন আগে সূর্যাস্তের সময় অম্বরের রাজপুত সেনারা সেলিমের হবু স্ত্রীকে নিয়ে দীর্ঘ শোভাযাত্রা সহকারে লাহোরে এসে পৌঁছেছে। মিছিলটির সম্মুখভাগে ছিলো ঘিয়া রঙের স্ট্যালিয়ন ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট চল্লিশজন রাজপুত যোদ্ধা। তাঁদের বক্ষবর্ম এবং বর্শার শীর্ষভাগ অন্তিম সূর্যের আলোতে ঝলসে উঠছিলো। তাদের পিছনে ছিলো ছয়টি হাতি, সেগুলির রূপার মস্তক আবরণ মণিমাণিক্য খচিত এবং সোনার গিলটি করা হাওদার মধ্যে অবস্থান করছিলো মান বাঈ এর ভ্রমণকালীন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা। এর পরেই ছিলো মান বাঈকে বহনকরী হাতিটি যার সাজসজ্জা আরো অধিক জাঁকজমকপূর্ণ। সোনার পাত মোড়া এবং টাকোয়াজ (সবুজাভ-নীল রঙের রত্ন) রত্ন খচিত হাওদাটি মাছরাঙার পাখার অনুরূপ উজ্জ্বল নীল বর্ণের রেশমের পর্দায় ঢাকা ছিলো মান বাঈকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্য। এই হাতিটিকে অনুসরণ করে উটের পিঠে চড়ে অগ্রসর হচ্ছিলো তার পরিচারিকারা। তাঁদের পিছনে ছিলো আর এক দল রাজপুত যোদ্ধা, এদের পোষাক এবং ঘোড়া উভয়ই কালো রঙের। সকলের শেষে অবস্থান করছিলো সবুজ পতাকা বহনকারী একদল মোগল নিরাপত্তা রক্ষী। রাজপুত শোভাযাত্রাটিকে পথ প্রদর্শন করা এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আকবর তাদের পাঠিয়েছিলেন।
সেলিম সেদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে কনের প্রসাদে যাওয়ার জন্য। আকবরের নির্দেশ অনুযায়ী সেখানে অম্বর দাশের সৌজন্যে হিন্দু রীতিতে বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালিত হবে। উচ্চ তারে বাজতে থাকা বাঁশি এবং ঢাকের তালে তালে আকবরের প্রিয় হাতিটির জাঁকজমকপূর্ণ হাওদায় পাশাপাশি বসে পিতা ও পুত্র অগ্রসর হচ্ছে বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রসাদের দিকে। তাদের সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে অগ্রসর হচ্ছে পরিচারকরা। তাঁদের হাতে ধরা বারকোশে রয়েছে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী- মণিমুক্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপাদেয় মসলা এবং কাশ্মীরের সুলতানের পাঠান শ্রেষ্ঠ মানের জাফরান।
এ সময় শেখ মোবারক এবং আরো দুজন মাওলানা কোরান তেলাওয়াত আরম্ভ করলেন এবং সেলিম তার হাতের দিকে তাকালো, অনেক ভোরে তার মা হীরাবাঈ এবং তার সহচরী সৌভাগ্যের চিহ্নস্বরূপ সেখানে মেহেদী ও হলদী পড়িয়ে দিয়েছেন। সেলিমকে একাধারে বিস্মিত ও স্বস্তি প্রদান করে তার মা নিজের ভাগ্নির সঙ্গে তার বিয়েকে স্বাগত জানিয়েছেন। এই মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম নেবে তার তিনচতুর্থাংশ হবে রাজপুত এমন কিছু বিবেচনা করে হয়তো তিনি আপত্তি করেননি, সেলিম ভাবলো। মাথায় পড়া বিয়ের মুকুটটির ওজন বিবেচনায় নিয়ে সেলিম একটু নড়েচড়ে বসলো। হীরা এবং মুক্তা বসান মুকুটটি আকবর নিজের হাতে তার মাথায় পড়িয়ে দিয়েছেন।
মাওলানাদের কোরান তেলাওয়াত শেষ হলো এবং শেখ মোবারক মান বাঈকে খুব কাছ থেকে মুসলিম রীতি অনুযায়ী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি এই বিয়েতে রাজি আছেন? সেলিম তার প্রচ্ছন্ন সম্মতিসূচক বাক্য শুনতে পেলো এবং দেখলো তার মাথাটি একদিকে সামান্য কাত হলো। একজন পরিচারক লাল সবুজ রঙের গোলাপ জলের জগ নিয়ে এগিয়ে এলো এবং সেলিমের দুই হাতের একত্রিত তালুতে তা ঢাললো। তারপর আরেকজন পরিচারক তার হাতে একটি পনির পানপাত্র দিলো তাতে চুমুক দিয়ে বিবাহ বন্ধন নিশ্চিত করার জন্য। আমি এখন একজন বিবাহিত পুরুষ, সেলিম ভাবলো যখন সেই ঠাণ্ডা তরল তার গলা বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। সবকিছু এই মুহূর্তে তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
ভোজসভা আরম্ভ হলো সেই সঙ্গে রাজপুত নর্তকীদের নৃত্য এবং বাজিকরদের দৈহিক কসরৎ। কিন্তু সেলিম সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারছিলো না। জালির আড়ালে অবস্থিত রাজপরিবারের মহিলা সদস্যদের চাপা কণ্ঠের হাসির শব্দ ভেসে আসছিলো, তারাও নাচ গানের অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করছে সকলের দৃষ্টির অন্তরালে থেকে। সেলিম তার সামনে থাকা শত রকমের উপাদেয় খাদ্যের প্রতিও আকর্ষণ বোধ করছে না। ফিজন্ট পাখি এবং ময়ূরের ঝলসানো মাংস; শুকনো ফল, বাদাম এবং মসলা দিয়ে রান্না করা বিরানী ও আস্ত কচি ভেড়ার রোস্ট; পেস্তা, কাঠবাদাম, কিসমিস ও জাফরান দিয়ে তৈরি উপদেয় মিষ্টান্ন প্রভৃতি খাবার থরে থরে টেবিলের উপর সাজান রয়েছে। সর্বক্ষণ সে শুধু ভাবছে, আমাকে এই মুহূর্তটি মনে রাখতে হবে। এটা আমার স্বয়ংম্পূর্ণ পুরুষে পরিণত হওয়ার মুহূর্ত। এখন থেকে আমার নিজের সংসার হবে এবং স্ত্রী, যে আমার মায়ের সমপর্যায়ের সম্ভ্রান্ত বংশীয়। এক নতুন আত্মবিশ্বাস তার শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছিলো। সেলিম তার পাশে বসা ঝলমলে অবয়বের দিকে তাকালো, এই নতুন নারীটিকে আবিষ্কার করার ভাবনায় তার সমগ্র দেহে উত্তেজনার তরঙ্গ প্রবাহিত হলো।
বাবার স্থলে হামিদা তাকে এ ব্যাপারে অবহিত করার চেষ্টা করেছেন যে কীভাবে একজন নারীকে সন্তুষ্ট করতে হয়- কথাটি মনে পড়তে সেলিমের হাসি পেলো। অবশ্য শালীনতা বজায় রাখতে গিয়ে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যেতে পারেননি কিন্তু সেলিম বুঝতে পেরেছে তিনি কি বলতে চেয়েছেন তার নববধূর প্রতি অত্যন্ত কোমল ও বিবেচকের মতো আচরণ করতে হবে। সে তাই করবে। বাজারের নর্তকী গীতা তাকে অনেক কৌশল শিখিয়েছে। সে জেনেছে কীভাবে নিজের আগ্রাসী আবেগের মুখে লাগাম পড়িয়ে উভয় পক্ষের তৃপ্তি অর্জিত হতে পারে। সে গীতার কাছে গিয়েছিলো একজন অনভিজ্ঞ অতি উৎসাহী বালক হিসেবে, অনেকটা পাল (পশুর প্রজনন ক্রিয়া) দেয়া স্ট্যালিয়ন ঘোড়ার মতো। কিন্তু গীতা তাকে একজন প্রেমিকে পরিণত করেছে…শৈল্পিক আঙ্গিকে রতিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য হামিদার ইঙ্গিতপূর্ণ নির্দেশনা তার প্রয়োজন ছিলো না। তবে বাসর রাতের মিলন বিষয়ক রীতি নীতি সম্পর্কে হামিদার কাছ থেকে প্রাপ্ত উপদেশ তার অনেক কাজে লাগবে। পরদিন সকালে বিছানা পর্যবেক্ষণ করা হবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে যৌনমিলন সত্যিই সম্পাদিত হয়েছে এবং নববধূ প্রকৃতপক্ষে কুমারী ছিলো।
দুই ঘন্টা পরের ঘটনা, সেলিম আকবরের প্রদান করা নতুন ভবনের হেরেমের শয়ন কক্ষে পরিচারকদের সহায়তায় বিয়ের পোশাক এবং অলঙ্কার খুলছিলো। সবুজ কিংখাবের পর্দার অন্যপাশে নববধূ নিজস্ব পরিচারিকাদের তত্ত্বাবধানে গোসল করে সুগন্ধি মেখে বাসর শয্যায় স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলো। সেলিম সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়ার পর পরিচারক তার মাথার উপর দিয়ে একটি সবুজ রেশমের ঢিলে জামা পড়িয়ে দিলো এবং এর গলা ও বুকের পান্নার কজা এটে দিলো। এরপর পরিচারকরা সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। সেলিম এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তেলের প্রদীপের হালকা আলো পড়ে ঝিকমিক করতে থাকা কিংখাবের পর্দাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। সে আসলে বিচলিত অনুভব করছে না বরং এই বিরল মুহূর্তটিকে মনের পর্দায় গেঁথে রাখতে চাইছে। একদিন সে হয়তো সম্রাট হবে এবং যে রাজপুত রাজকুমারীর সঙ্গে আজ তার মিলন হবে তার গর্ভে জন্ম নেবে পরবর্তী মোগল সম্রাট। এই মিলনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, এটি বাজারের কোনো অখ্যাত সরাই খানায় হুড়মুড় করে তাৎক্ষণিক যৌন সুখ লাভের মতো তুচ্ছ বিষয় নয়। এটি তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং তার নিয়তির ভিত্তি স্তম্ভ।
হঠাৎ পর্দার অন্যপাশে তার জন্য অপেক্ষারত নারীটির কথা মনে হতেই সেলিমের দেহে কামনার ঢেউ আছড়ে পড়লো এবং দার্শনিক চিন্তা গুলি মন থেকে উবে গেলো। সে পর্দা সরিয়ে শয়ন কক্ষে পা রাখলো। মান বাঙ্গ বিছানায় বসে ছিলো, তার স্তন যুগলের আকৃতি জামরঙের প্রায় স্বচ্ছ মসলিন পোষাকের মধ্যদিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। তার লম্বা ঘন কালো চুল কাঁধের উপর ছড়িয়ে আছে এবং কানের চুনি পথরের দুল গুলো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। গলার চিকন সোনার হারটিও চুনি পাথর খচিত। কিন্তু যা সেলিমের দৃষ্টি কাড়লো তা হলো মেয়েটির লম্বা লম্বা পাপড়ি বিশিষ্ট কালো চোখের উত্তেজিত চাহনি এবং তার দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস সমৃদ্ধ মৃদুহাসি।
সেলিম কল্পনা করেছিলো তার বাসর ঘরে প্রবেশের সময় নববধূটি লাজুক ভঙ্গীতে মাথা নত করে থাকবে-সুলায়মান বেগ বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে ঠাট্টাও করেছে, তাকে সতর্ক করেছে যাতে গণিকাগৃহের অশালীন আচার প্রদর্শন করে অনভিজ্ঞ মেয়েটির মনে ত্রাসের সঞ্চার না করে। কিন্তু সেলিম অনুভব করলো যা ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে মান বাঈ এর মধ্যে কোনো সংশয় নেই বরং সে বিষয়টি সম্পর্কে কৌতূহলী। নিজের পোশাকের বন্ধনীগুলি আলগা করে সেলিম সেটাকে মেঝেতে পড়ে যেতে দিলো এবং বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। মনে মনে ভাবছে সে বহু যুদ্ধে লড়াই করেছে ফলে নিজের স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে বেশি বেগ পেতে হবে না। সেলিম বিছানার ধারে মান বাঈ এর কাছাকাছি বসলো কিন্তু তাকে স্পর্শ করলো না এবং হঠাৎ কিছুটা অনিশ্চিত বোধ করলো। কিন্তু মান বাঈ কোমলভাবে সেলিমের কাধ ধরে নিজের পাশে শুইয়ে দিলো। স্বাগতম ফুফাতো ভাই, সে ফিসফিস করে বললো। সেলিমের আর বেশি উৎসাহের প্রয়োজন হলো না, মান বাঈকে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে সে তার উন্মক্ত অধরে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর তার দেহের স্বচ্ছ মসলিন পোশাকটি ধীরে খুলে ফেললো এবং সেলিমের হাত মান বাঈ এর নরম দেহের স্পর্শকাতর অংশগুলিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। মান বাঈ এর কোমর খুব চিকন কিন্তু তার বক্ষযুগল গীতার চেয়েও বড়, সেলিম চট করে তুলনামূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলো। এখন মান বাঈ এর হাত দুটি সেলিমের দেহে বিচরণ করতে লাগলো, গীতার মতো দক্ষ এবং নিশ্চিত ভঙ্গীতে না হলেও যথেষ্ট আগ্রহী এবং দ্বিধাহীন ভাবে। মান বাঈ এর উরু যুগল কিছুটা ফাঁক করে নিয়ে সেলিম সেখানে তার প্রণয়স্পর্শ প্রদান করা শুরু করলো। মান বাঈ এর সমগ্র দেহ প্রকম্পিত হলো এবং তার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পর তার পিঠ ধনুকের মতো বেঁকে গেলো এবং সে সেলিমকে এত দৃঢ়ভাবে জাড়িয়ে ধরল যে সেলিম তার শক্ত হয়ে আসা বোটা দ্বয়ের স্পর্শ অনুভব করতে পারলো। যদিও সে তরুণ, তবুও সেলিমের এটা বোঝার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে যে মান বাঈ মিথীয়া আর দীর্ঘায়িত না করে এখনই চূড়ান্ত উপলব্ধি পেতে চাইছে। সেলিম নিজেকে তার উপরে স্থাপন করলো এবং কোমল ভাবে তার মাঝে প্রবেশের চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রবেশ পথটি সেলিমের কাছে অত্যন্ত আঁটসাঁট মনে হলো। সে ইতোপূর্বে কোনো কুমারী নারীর সঙ্গে মিলিত হয়নি এবং সে বুঝতে পারছিলো তাকে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে মান বাঈ ব্যথা না পায়। কিন্তু পুনরায় সে তার নববধূর মাঝে ব্যাগ্রতা প্রত্যক্ষ করলো। তার চাপা আর্তনাদ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, হাতের আঙ্গুলগুলি সেলিমের কাঁধের মাংসে চেপে বসেছে এবং সর্বশক্তিতে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছে। সেলিমের উত্থান পতন আরো তীব্রতর হলো। মান বাঈ এর আর্তচিৎকার এখন গোঙ্গানিতে পরিণত হয়েছে, তবে সেটা কষ্টের জন্য নয় সুখানুভূতির জন্য। হঠাৎ সেলিম অনুভব করলো মান বাঈ কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে এলো। এবং সে সম্পূর্ণ গভীরে প্রবেশ করতে পারলো। দুটি ভিন্ন দেহ সম্পূর্ণ একত্রিত হয়ে গেলো এবং তারা এখন একক অস্তিত্ব নিয়ে উঠা নামা করছে। সেলিম তাঁদের মিলনটি আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। চূড়ান্ত মুহূর্ত উপস্থিত হলো, এবং নিজের পরমতৃপ্তিময় গোঙ্গানির পাশাপাশি সে মান বাঈ এর সুখানুভূতি সূচক ঘন ঘন শ্বাস টানার শব্দ পেলো।
সেলিম তার স্ত্রীর পাশে ঘনিষ্ট হয়ে শুয়ে আছে, তার একটি হাত মেয়েটির নরম নিতম্বের উপর স্থাপিত, সে কোনো কথা বলছে না। মেয়েটির যৌন ক্ষুধা তাকে সামান্য অবাক করেছে তবে সে এ কারণে খুশি যে তার স্ত্রী বিয়ের প্রথম রাতে কোনো সংকোচ প্রকাশ না করে অত্যন্ত আগ্রহীভাবে মিলনক্রিয়া উপভোগ করেছে। বিছনায় উঠে বসে নিজের ঘামসিক্ত চুল মুখের উপর থেকে সরাতে সরাতে মান বাঈ প্রথম কথা বললো। তুমি কি ভাবছো ফুপাতো ভাই?
ভাবছি আমার স্ত্রী ভাগ্য খুব ভালো।
আমার স্বামী ভাগ্যও খুব ভালো। মান বাঈ সেলিমের ঘাড়ে হাত রাখল। সকলে আমাকে বলেছিলো তুমি খুব সুপুরুষ, কিন্তু কনের অভিভাবকরা সর্বদাই তাঁদের জন্য নির্বাচিত বরের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে। তাই আমার মনে সন্দেহ ছিলো। তোমাকে আমার মনে ছিলো একজন মুখবন্ধ বিব্রত চেহারার বালক হিসেবে।
পরদিন সকালে বাসর শয্যার চাদর যথাযথভাবে পরীক্ষা করে অনুমোদন দেয়া হলো এবং বাসর রাতের সাফল্যকে ঘোষণা করতে ঢাক বাজান হলো। নতুন বরকনেকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য প্রথমে হাজির হলো আবুল ফজল। আমি রাজকীয় ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করেছি যে মহামান্য যুবরাজ সেলিম গতকাল সাম্রাজ্যের উজ্জ্বল এক কুমারীরত্বের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, তার গতানুগতিক মধুমাখা মসৃণ কণ্ঠে আবুল ফজল ব্যক্ত করলো।
সেলিম কষ্ট করে ঠোঁটে হাসি টেনে তার বক্তব্য শ্রবণ করলো, কারণ এটাই রেওয়াজ এবং আবুল ফজল প্রস্থান করলে সে খুশি হলো।
পরবর্তী দিন গুলির উৎসব আনন্দ তেমন ভাবেই উদ্যাপিত হলো যেমনটা আকবর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের সকল এলাকা থেকে বিবাহের শুভেচ্ছা উপহার আসতে লাগলো: মণিমাণিক্য, ইযাশম্ পাথরের থালা, রূপা এবং সোনার বারকোশ, দ্রুতগামী আরবী ঘোড়া এবং সবচেয়ে নরম পশম দিয়ে তৈরি সোনা ও রূপার কারুকাজ করা কাশ্মীরি শাল। শেষোক্ত উপহারটিও যথারীতি কাশ্মীরের অধুনা দমনকৃত সুলতানের পাঠানো উপহার। উৎসবে অধিক বৈচিত্র যোগ করতে আকবরের নির্দেশে দুটি সিংহ যোগাড় করা হয়েছিলো, সেগুলি রাজকীয় দর্প নিয়ে লাহোরের রাস্তাগুলি প্রদক্ষিণ করেছে। রবি নদীর তীরে উটের দৌড় প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। একটি প্রতিযোগীতায় সেলিম তার দুই সৎ ভাইকে পরাজিত করতে পেরে সীমাহীন সন্তুষ্টি অনুভব করে। মাটির উঁচু বাধ দেয়া ময়দানে আকবরের সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধা হাতির জোড়াকে পারস্পরের সঙ্গে লড়াই এ নামানো হয়, লড়াই চলতে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ না তাঁদের ধূসর গা ক্ষতবিক্ষত এবং রক্তরঞ্জিত হয়ে পড়ে। মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে আরম্ভ হয় আতশ বাজির উৎসব, এতো অধিক সংখ্যক বাজি উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে যাতে করে রাত, দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠতে থাকে।
কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায়, যতোই চিত্তাকর্ষক বা মোহনীয় প্রদর্শনীর আয়োজন করা হোক না কেনো, সেলিম মান বাঈ এর আগ্রহী বাহুতে ধরা দেয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠতো এবং ভোরের সূর্যের উত্তাপ রাজপ্রাসাদকে উষ্ণ করতে আরম্ভ করার পূর্ব পর্যন্ত প্রেমের মহাসাগরে অবগাহন করতে থাকতো। সুলায়মান বেগ সেলিমকে এ বিষয়ে ঠাট্টা করে বলেছিলো, সে যদি তার বর্তমান তৎপরতা অব্যাহত রাখে তাহলে তার অতি সঞ্চালনশীল উরুকে প্রশমিত করার জন্য রাজ হেকিমের মলম প্রয়োজন হবে।
*
আমার সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে আদরের সন্তান, আমি তোমার নাম রাখছি। খোসরু। কথাগুলি বলে, সেলিম স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি সাদা জেড পাথরের পিরিচ হাতে নিয়ে খুব সাবধানে শিশুটির মাথায় ঢাললো। কামনা করি তোমার জীবন সাফল্যের মুকুটে আবৃত হোহাক, এর নিদর্শন স্বরূপ আমি তোমার মাথায় এই জাগতিক সমৃদ্ধির প্রতীক বর্ষন করছি। শিশুটি চোখ পিটপিট করলো, তারপর স্বচ্ছ সজীব চোখে সেলিমের দিকে তাকালো। সেলিম ভাবলো যে কোনো মুহূর্তে শিশুটির আপত্তিসূচক ক্রন্দন শুনতে পাবে, কিন্তু তার পরিবর্তে খোসরু হাসলো এবং উজ্জ্বল চিত্তে হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। সেলিম খসরুকে, তার মখমলের গদি সহ উঁচু করে ধরলো যাতে উপস্থিত সকলে তার স্বাস্থ্যবান নবজাত সন্তানটিকে দেখতে পারে। উপস্থিত সভাসদ এবং সেনাপতিগণ মার্জিত গুঞ্জন তুলে শিশুটির দীর্ঘায়ু কামনা করলো। সেলিম তার পাশে মার্বেল পাথরের বেদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা আকবরের দিকে একপলক তাকালো। এই শিশুটি আকবরের প্রথম নাতি, কিন্তু তার চেহারা এখনো সুপুরুষ এবং চোয়ালে দৃঢ়তা বিরাজ করছে যদিও তাঁর বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, তাকে সন্তুষ্ট এবং গর্বিত দেখাচ্ছে। গতকাল সেলিম একজোড়া শিকারী চিতা উপহার পেয়েছে যাদের গায়ে ছিলো মখমলের আচ্ছাদন এবং গলায় পান্নাখচিত চামড়ার মালা-নিঃসন্দেহে তার বাবার অনুমোদনের নিদর্শন। সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, যেহেতু এখন সে একজন পিতার মর্যাদা লাভ করেছে সেজন্য বাবা তাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্টীয় পদে অধিষ্ঠিত করবেন যাতে সে তার যোগ্যতা প্রদর্শন করার সুযোগ পায়। যদি তাকে মোগল সৈন্যদলের নেতৃত্বে নিযুক্ত করা হয় তাহলে সে শুধু তার বাবার কাছেই নয় বরং সকলের কাছে প্রমাণ করতে পারবে যে সে একজন দক্ষ যোদ্ধা এবং সেনাপতি এবং একদিন হয়তো একজন মহান সম্রাটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
তার সৎ ভাইদের কারো মধ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার যোগ্যতা নেই, বাবা নিশ্চয়ই সেটা বোঝেন। মুরাদ তিন মাস আগে বিয়ে করছে এবং সে তার বিবাহের প্রীতিভোজের সময় সম্পূর্ণ মাতাল হয়ে পড়ে। পরে তাকে প্রায় চ্যাংদোলা করে তার বাসরশয্যায় নিয়ে যেতে হয়েছিলো। সেলিম মুরাদের সুরাআসক্তির কথা আগেই জানতো। কিন্তু নিজের বিবাহের আসরে মাতাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার সৎ ভাইটি তার মাতলামির অভ্যাসের বিষয়টি আকবরের কাছ থেকে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। আকবর এতো ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে অল্প কয়েক দিন পরেই তিনি মুরাদকে সাম্রাজ্যের দক্ষিণে বিজয় অভিযানে যাওয়ার আদেশ দেন। মুরাদের উপর নজর রাখার জন্য তিনি তার সঙ্গে একজন উচ্চপদস্থ সেনাপতিকে পাঠান এবং তাকে আদেশ দেন এক ফোঁটা মদও যাতে তার পুত্রের ঠোঁট অতিক্রম না করে সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে। দানিয়েলও মুরাদের পথেই অগ্রসর হচ্ছিলো। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পর আরাম আয়েশ এবং ইন্দ্রিয়সুখ চরিতার্থ করাই তার প্রধান মনোযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেলিমের সঙ্গে তার সৎ ভাইদের সরাসরি সাক্ষাৎ হতো না ঠিকই কিন্তু তাদের কীর্তিকলাপের গল্প তার কানে আসতো। দানিয়েল সম্পর্কে যে অভিনব ঘটনাটি সে শুনেছে সেটা হলো, তার প্রাসাদ কক্ষের সম্মুখের উঠানে অবস্থিত সবচেয়ে বড় মার্বেল পাথরের ফোয়ারাটি থেকে সে পানির পরিবর্তে গজনীর উত্তম আঙ্গুরের তৈরি মদ প্রবাহের ব্যবস্থা করেছে। দানিয়েল এবং তার বন্ধুরা নগ্ন হয়ে সেই ফোয়ারার মদে নেমে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে। মুরাদের আচরণ আরেকটু জটিল। কিছু দিন আগে সে মাতাল অবস্থায় নর্তকীদের নাচের পোশাক পড়ে শুধু তার সভাসদদের সামনেই নয়, গোয়া থেকে আগত এক পর্তুগীজ প্রতিনিধি দলের সম্মুখেও অশোভন নৃত্যকলা প্রদর্শন করে।
খোসরুকে তার একজন দুধমায়ের কোলে হস্তান্তর করতে করতে সেলিম হাসলো, সে সুলায়মান বেগের বোন। এবং সেই মুহূর্তে সে মনে মনে শপথ করলো যে তার শিশুকালে আকবর তার সঙ্গে যতোটা সময় কাটিয়েছেন সে তার পুত্রের সঙ্গে তার তুলনায় অনেক বেশি সময় কাটাবে। সে তার পিতার তুলনায় অধিক সন্তানও জন্ম দেবে- মান বাঈ ছাড়াও ইতোমধ্যে আরেকজন রাজপুত রাজকুমারী যোধ বাঈ এবং আকবরের এক সেনাপতির কন্যা সাহেব জামালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। নিজের ক্রমবর্ধমান হেরেম নিয়ে সে আনন্দিত। আকবর সর্বদাই তাকে বিয়ের মাধ্যমে মিত্রতা তৈরির জন্য তাগাদা দিয়ে আসছিলেন কিন্তু বাস্তবে এ বিষয়ে তার বাড়তি উৎসাহের প্রয়োজন ছিলো না। যে কোনো নতুন নারী, যদি সে অল্প বয়সী এবং সুন্দরী হয় তাকে সেলিমের কাছে অনাবিস্কৃত ভূখণ্ডের মতো মনে হতো। আর রাজনৈতিক প্রয়োজনে যদি কোনো কুৎসিত মেয়েকে তার বিয়ে করতে হয় তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ সকল স্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার মিলিত হতে হবে এ ধরনের কোনো বাধা ধরা নিয়ম নেই এবং সে যাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে সে হেরেমে একটি সম্মানজনক অবস্থান লাভ করবে। তার পিতা এমন নীতিই অনুসরণ করে আসছেন। আকবর তার বিপুল সংখ্যক স্ত্রীর জন্য গর্ববোধ করেন এবং তার বহু স্ত্রী গ্রহণের নীতি রাজ্যের শান্তি এবং সংহতিতে যথেষ্ট অবদান রাখছে। সে নিজেও একই নীতি অনুসরণ করলে সমস্যা কোথায়? সেলিম ভাবলো।
সেলিমের এই নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের পথে একমাত্র বাধা মান বাঈ, পুত্রের জন্ম উপলক্ষে আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময় তার মনে হলো। মান বাঈ এখনো রতিক্রিয়ায় সেলিমকে উত্তেজিত এবং আগ্রহী করে তুলে কিন্তু তাকে বিয়ে করার ছয় মাস পরে আকবর যখন ঘোষণা দেন সেলিমকে আবার বিয়ে করাবেন তখন সে ঈর্ষন্বিত হয়ে পড়ে। মান বাঈ চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে না করতে অনুরোধ জানায়। সেলিমের দ্বিতীয় বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলে সে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। সেলিম তাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করে যে পিতার আদেশ তাকে মান্য করতেই হবে কিন্তু এতে সে কর্ণপাত করে না। এক সময় সে চিৎকার করে বলতে থাকে সেলিম তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এক রাতে সন্ত্রস্ত এক পরিচারক সেলিমকে হেরেমে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছে সে দেখতে পায় মান বাঈ উঠান থেকে ত্রিশ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ঝুলবারান্দার কার্ণিশে ঝুঁকে নিচে লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হয়েছে। আমার করুণ পরিণতির জন্য তুমি দায়ী হবে, সেলিমকে দেখে সে চিৎকার করে বলে উঠে। তুমিই আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ। আমার ভালোবাসা কি তোমার জন্য যথেষ্ট ছিলো না? আমি এখনো গর্ভধারণ করতে পারিনি বলেই কি আমার উপর এই অবিচার করতে যাচ্ছ?
মান বাঈ এর উশকোখুশকো চুল, লাল চোখ এবং রোগা দেহ প্রত্যক্ষ করে সেলিমের এক পাগলীর কথা মনে পড়ে যায় যাকে সে মাঝে মাঝে বাজারে দেখতো। পাগলীটি জনে জনে গিয়ে তাঁদের কাছে কোনো কাল্পনিক আঘাতের জন্য গালাগালি করতো এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার দিকে ঢিল ছুড়তো। নিজের সুন্দরী রাজপুত-পত্নীর এমন বিকারগ্রস্ত চেহারা দেখে সেলিমের তাকে অচেনা মনে হয়। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে সেলিম তাকে কার্ণিশের কাছ থেকে সরিয়ে আনে। তারপর ধৈর্য সহকারে নরম সুরে বারে বারে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে একজন মোগল যুবরাজ হিসেবে পিতার আদেশ না মানলে তার প্রতি তিনি রুষ্ট হবেন এবং তাহলে তাঁদের উভয়ের ভবিষ্যতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং আরেকটি বিয়ে করলেও তার প্রতি তার ভালোবাসায় একটুও কমতি হবে না।
কিন্তু বাস্তবে ভালোবাসার কমতি ঘটলো। মান বাঈ এর যুক্তিহীন উন্মত্ত আচরণ প্রত্যক্ষ করে সেলিমের মনে নতুন করে প্রশ্ন জাগলো সে তার মামাতো বোন সম্পর্কে আর কি কি বিষয় এখনো জানে না। সেলিম আরো উপলব্ধি করলো এতোদিন সে মান বাঈ এর প্রতি যে আকর্ষণ অনুভব করত সেটা ভালোবাসার কারণে নয়- নিছক যৌনতার কারণে। মোগল রাজপ্রাসাদের জাঁকজমক এবং বিলাসিতায় তার খুশি থাকা উচিত যার প্রাচুর্য একজন রাজপুত রাজকুমারীর প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার তুলনায় অনেক বেশি। সে ঘন ঘন তার বিছানায় গেছে যেখানে তারা ইন্দ্রিয়সুখ আদান প্রদানের ক্ষেত্রে পরস্পরের সমকক্ষ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। সেটাই মান বাঈ এর যথেষ্ট প্রাপ্তি বলে গণ্য করা উচিত। কিন্তু সেলিমের একমাত্র স্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা নিছক তার নির্বুদ্ধিতা। মান বাঈ এর অপ্রত্যাশিত ঈর্ষাকাতরতা সেলিমকে তার প্রতি ক্রমশ নিরাসক্ত করে তুলতে লাগলো। তার সঙ্গে সেলিমের মিলিত হওয়ার প্রবণতা কমে গেলো এবং তার আত্মহত্যার হুমকির অল্প কিছুদিন পরেই সেলিম যোধা বাঈকে বিয়ে করলো। তার কোমল দেহ এবং ডিম্বাকৃতি মুখ যদিও মান বাঈ এর মতো সুন্দর নয় কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা ও কৌতুক বোধের কারণে সেলিম না হেসে থাকতে পারতো না এবং যৌন মিলন ছাড়াও তার সঙ্গ সেলিমের ভালো লাগতো।
তার সঙ্গে যোধ বাঈ এর বিয়ে হওয়ার চার মাস পর এবং সাহেব জামালের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার অল্প আগে, মান বাঈ এর গর্ভে খোসরু এলো- মোগল রাজবংশের পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম সন্তান। এর ফলে মান বাঙ্গ যে মর্যদা লাভ করলে তাতে তার সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, কিন্তু সে যদি সন্তুষ্ট না হয় তাহলে সেলিমের কিছুই করার নেই এবং সে বিষয়টি নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তাও করবে না। কিন্তু সেলিম দুশ্চিন্তা থেকে অব্যাহতি পেলো না, তার মনে হতে লাগলো মান বাঈ এর স্বার্থপর মানসিকতার প্রভাব হয়তো তার সন্তানের মধ্যেও পড়বে।
আকবরের গম্ভীর কণ্ঠস্বর সেলিমের চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করলো। এই নতুন যুবরাজের জন্ম উপলক্ষ্যে এখন এসো আমরা সকলে ভোজে অংশ গ্রহণ করি। আমি খোসরু এবং সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি কামনা করছি।
ভোজসভায় তার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে আসন গ্রহণ করে, সেলিম তার নিজের সমৃদ্ধির জন্য মনে মনে প্রার্থনা করলো। সে যদি পরবর্তী মোগল সম্রাট হতে পারে তাহলে তার পুত্রদের জন্য সে কতো কিছুই না করতে পারবে।