চতুর্থ অধ্যায় : অধিবিদ্যা : জিন ও জাদু
জিন মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় অদৃশ্য। জিন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন পুরুষ জিন, স্ত্রী জিন পরী ইত্যাদি। উপকারী জিন যেমন আছে তেমনি অপকারী জিনও রয়েছে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে মানুষ জিনকে দেখতে সক্ষম হয় এবং লোকমুখে শোনা যায় কখনো কখনো পরীদের রাণী কোনো এক পুরুষ মানুষের প্রেমে পড়ে যায়, কখনো আবার পুরুষ জিন স্ত্রী মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেক সমাজ-সংস্কৃতিতে এ-বিষয়টি লোককথায় রয়েছে-কিছু অশুভ আত্মা আছে যা মানুষের দেহে প্রবেশ করে মৃগী রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করে।
একইভাবে জাদুতে বিশ্বাসও দীর্ঘকালব্যাপী বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে। অনেকের বিশ্বাস মন্ত্র, মন্ত্রপূত কবচ বা এরকম অন্যান্য কিছু দ্রব্য স্বাভাবিক উপায়ে পাওয়া অসম্ভব এমন কিছু করতে বা পেতে সহায়তা করে, যেমন এগুলো কারো মৃত্যু ঘটাতে পারে, প্রেমে পড়তে বাধ্য করতে পারে, পাগল করে দিতে পারে অথবা একটি মোমের পুতুলের চোখদুটি বিদ্ধ করার মাধ্যমে সাথে সাথে কাউকে অন্ধ করে দিতে পারে। এরকম জড়বুদ্ধিসম্পন্ন বিশ্বাস ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই সকল জাতির মধ্যে স্পষ্ট। দুঃখজনকভাবে এগুলো অপেক্ষাকৃত উন্নত জাতির মধ্যেও এখনো বিদ্যমান।
এই দুই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বিশ্বাসকে (জিন ও জাদু) ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়। মানুষ উপলব্ধি ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কৌতুহলী প্রাণী। মানুষের মন তার চারপাশে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে বেড়ায় এবং প্রায়ই প্রকৃত কারণ বের করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যখন মানুষের দুর্বল মন অজানার-অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় তখন তা বেশিরভাগ সময় অনুমান ও কল্পনার রাজ্যে চলে যায়। যৌক্তিক চিন্তা করে সমাধান পাওয়া না গেলে মানুষ কল্পনার আশ্রয় নেয়। মানুষ প্রকৃতির কাছে দুর্বল এবং সে প্রায়ই ভয় ও বাসনার উর্ধ্বে যেতে পারে না। উক্ত ব্যাপারগুলো মানুষকে কুসংস্কারের রসাতলে ঠেলে দেয়। একসময় জাদুটোনা, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদির সাহায্যে ভবিষ্যতকথন মানুষের হৃদয়ের অন্ধকারে বাসা বেধেছিল। সপ্তম শতাব্দীর আরবরা কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকার বিষয়টি আশ্চর্যজনক নয়। আশ্চর্যের বিষয় যেটি তা হলো কোরানে উক্ত বিভ্রমদ্বয়ের (জিন ও জাদু) কথা শুধু উল্লেখ করা হয়েছে তাই নয় বরং এগুলোকে বাস্তব বলে অবিহিত করা হয়েছে।
সুরা ফালাক ও সুরা নাস -এর মূল বিষয় জাদুটোনা। বেশির ভাগ তফসিরকারকের মতে, কুরাইশ বংশের পৌত্তলিক লাবিব বিন আসাম নবিকে জাদু করেছিল, যা তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে ব্যাঘাত ঘটায় এবং নবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জিবরাইল এসে তাঁকে জাদুর বিষয়টি অবহিত করেন। ক্যামব্রিজ তফসিরে রয়েছে, নবি যখন অসুস্থ অবস্থায় ঘুমাচ্ছিলেন তখন স্বপ্নে দেখলেন দুজন ফেরেশতা তাঁর মাথার উপরে এসেছেন এবং একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করছেন- এই লোকটি কেন অসুস্থ হয়েছে ও আর্তনাদ করছে? অন্য ফেরেশতা উত্তর দিলেন-কারণ লাবিব তাঁকে জাদু করেছে, ও যা দিয়ে জাদু করেছে তা দরওয়ান কূপের নিচে আছে। নবি ঘুম থকে উঠে হজরত আলি এবং আমার বিন ইয়াসিরকে (প্রথমদিককার একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম) জাদুকৃত বস্তুর সন্ধানে পাঠালেন। তাঁরা কূপ থেকে পানি সরিয়ে ফেললেন এবং ফেরেশতারা যেমন বলেছিলেন সেভাবে কূপের নিচের একটি পাথরের তলদেশ থেকে বস্তুটি উদ্ধার করলেন। বস্তুটি ছিল একটি দড়ি যাতে এগারোটি গিট দেয়া ছিল। তাঁরা এটি নবির কাছে নিয়ে এলেন। এরপর কোরানের সুরা দুটি নাজিল হয় যাতে এগারোটি আয়াত ছিল এবং একেকটি আয়াত পাঠের সাথে একটি করে গিট খুলতে লাগলো। এবং নবি সুস্থ হলেন। তাবারি আরও বর্ণিল বিবরণ দিয়েছেন, অবশ্য তফসির আল-জালালাইনে শুধু বলা হয়েছে এই সুরা দুটির প্রতিটি আয়াত একেকটি গিট খুলেছিল। জামাখশারি জাদুতে বিশ্বাসী ছিলেন না তাই তিনি যুক্তিবাদীদের মতো এই কাহিনী তাঁর ‘কাশশাফ থেকে বাদ দিয়েছিলেন। দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৭১ নম্বর ৬৫৮, ৬৬০-৬৬১ হাদিসে এই জাদুটোনার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।-অনুবাদক।]
কোরানের কোনো তফসিরকারক বা ধর্মতত্ত্ববিদ জিনের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করেননি, কারণ কোরানের দশটিরও অধিক আয়াতে জিনের কথা বলা হয়েছে। জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধূম্রহীন অগ্নিশিখা থেকে। (সুরা রহমান ; আয়াত ১৫)। সুরা জিন নামে কোরানের একটি সুরা রয়েছে, এর প্রথম দুই আয়াতে বলা হয়েছে একদল জিন কোরান আবৃত্তি শুনেছে ; বলো, আমি প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জেনেছি যে জিনদের একটি (কোরান) শুনেছে ও তাদের সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কোরান শুনেছি, যা সঠিক পথনির্দেশ দেয়। তাই আমরা এতে বিশ্বাস করেছি। আমরা কখনও আমাদের প্রতিপালকের কোনো শরিক করব না। (৭২১-২)। বিশ্বের অন্যান্য আদিম সমাজের মতো প্রাচীন আরবরাও ভাল এবং মন্দ আত্মায় বিশ্বাস করতো। মরুভূমির রুক্ষ আবহাওয়া ও একাকীত্ব তাদের এ-বিশ্বাসকে প্রবল করে তুলত। যখন একজন আরব বসবাসের অযোগ্য ভূতুড়ে জায়গায় একাকী রাত্রি যাপন করত তখন সে ভয় পেয়ে খারাপ জিনের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্ত্রোচ্চারণ করত। কোরানে এ নিয়ে বলা হয়েছে : . . . কোনো কোনো মানুষ কিছু জিনের শরণ নিত, ফলে ওরা জিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিত। ( ৭২:৬)।
যেখানে আদিম সমাজ ও উন্নত সভ্যতার নিম্নস্তরের লোকদের মধ্যে এই ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অযৌক্তিক বিষয়ে বিশ্বাসের কারণ সহজেই বোধগম্য, সেখানে আল্লাহর গ্রন্থ কোরানে উক্ত বিষয়গুলো সত্য বলে বর্ণিত হওয়া বিস্ময়কর বটে। অথচ ওই গ্রন্থ তথা ধর্মকে যিনি প্রচার করেছেন তিনি তাঁর এলাকার বহু লোকপ্রথা এবং কুসংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করেছেন; তাদের নৈতিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সংস্কার করেছেন। সুরা জিনে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে (যেমন নবির সাথে জিনের যোগাযোগ) তা হয়তো মুহাম্মদ স্বপ্নে দেখেছিলেন। নবি হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার সময় তিনি প্রথমবারের মত ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েছিলেন-এটা মানসিক উত্তেজনাপ্রসূত অলীক দর্শন ছিল। দূরবর্তী মসজিদে ভ্রমণ (ইসরা ও মেরাজ) স্বপ্নে ঘটেছিল বলে ব্যাখ্যা করা যায়।
আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়। জিনের অস্তিত্বের প্রতি মুহাম্মদের গভীর বিশ্বাস তাঁর কল্পনাবিলাসী মনের ওপর এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি মানুষের মতই উপলব্ধিক্ষমতা সম্পন্ন, বৌদ্ধিক চিন্তার অধিকারী ও নৈতিক বোধসম্পন্ন আরেকটি জাতির দর্শন লাভ করেছেন বলে তাঁর মনে হতে লাগলো, যারা এক ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাসের ব্যাপারে মানুষের মতই বাধ্য ছিল। এখানে প্রশ্ন আসে জিনদের নিজেদের মধ্য থেকে নবি নিয়োগ করা হয়নি কেন? কারণ কোরানের একাধিক আয়াতে (১০:৪৭ ও ১৬:৩৬) স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রতিটি জাতি থেকে (যিনি তাদের ভাষায় কথা বলেন ও তাদের অন্তর্ভুক্ত) তাদের নিজস্ব রসুল প্রেরণ করা হয়। তদুপরি সুরা বনি-ইসরাইল বলা হয়েছে : ফেরেশতারা যদি নিশ্চিন্ত হয়ে পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করতে পারত তবে আমি আকাশ থেকে এক ফেরেশতাকেই ওদের কাছে রসুল করে পাঠাতাম।” (১৭৯৫)। বিষয়টি এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, সুরা জিন রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন জালালুদ্দিন রুমি বলেছিলেন : আপনি যখন শিশুদের সাথে থাকবেন তখন শিশুসুলভ ভাষা ব্যবহার করতে হবে। সম্ভবত নবি তাঁর লোকদের প্রণোদিত করার মানসে এই কাহিনী তৈরি করেন যে, জিনরা কোরান শুনে এত বেশি প্রভাবিত হয়েছে যে তারা মুসলমান হয়ে গেছে।
ব্যাখ্যা যাই হোক, নবি মুহামদকে দোষারোপ করা যায় না। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেরই গণিত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানে উন্নত ধারণা থাকা সত্ত্বেও সমসাময়িক সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পরিহার করতে পারেননি, প্রকৃতপক্ষে তারা গ্রিক ধর্মীয় মিথলজির মধ্যে ডুবে ছিল। তবে হ্যাঁ, এখানে একটি উভয় সঙ্কট আছে। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর কাছ থেকে নবি মুহাম্মদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং কোরানের কোনো অংশ নবি কর্তৃক রচিত বলে অস্বীকার করেন। তদুপরি সুরা
জিন শুরু হয়েছে “বল”আদেশ দিয়ে। আল্লাহ কি আরবের হেজাজ অঞ্চলের লোকদের জিন-পরীতে বিশ্বাসের সাথে একমত? অথবা এগুলোতে বিশ্বাস কি মুহাম্মদের হৃদয়ে প্রোথিত ছিল এবং তাঁর বাণীতে তা চিরন্তন রূপ পেয়েছে?