৪.২ গুরুভাব ও নানা সাধু সম্প্রদায়

চতুর্থ খণ্ড – দ্বিতীয় অধ্যায়: গুরুভাব ও নানা সাধু সম্প্রদায়

ঠাকুরের সাধুদের সহিত মিলন কিরূপে হয়

অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ॥
– গীতা, ১০।৮

তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা॥
– গীতা, ১০।১১

ঠাকুর এক সময়ে আমাদের বলিয়াছিলেন, “কেশব সেনের আসবার পর থেকে তোদের মতো ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর (Young Bengal) দলই সব এখানে (আমার নিকটে) আসতে শুরু করেছে। আগে আগে এখানে কত যে সাধু-সন্ত, ত্যাগী-সন্ন্যাসী, বৈরাগী বাবাজী সব আসত যেত, তা তোরা কি জানবি? রেল হবার পর থেকে তারা সব আর এদিকে আসে না। নইলে রেল হবার আগে যত সাধুরা সব গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটা পথ ধরে সাগরে চান (স্নান) করতে ও ৺জগন্নাথ দেখতে আসত। রাসমণির বাগানে ডেরা-ডাণ্ডা ফেলে অন্ততঃ দু-চার দিন থাকা, বিশ্রাম করা, তারা সকলে করতই করত। কেউ কেউ আবার কিছুকাল থেকেই যেত। কেন জানিস? সাধুরা ‘দিশা-জঙ্গল’ ও ‘অন্ন-পানি’র সুবিধা না দেখে কোথাও আড্ডা করে না। ‘দিশা-জঙ্গল’ কি না – শৌচাদির জন্য সুবিধাজনক নিরেলা জায়গা। আর, ‘অন্ন-পানি’ কি না – ভিক্ষা। ভিক্ষান্নেই তো সাধুদের শরীর ধারণ – সেজন্য যেখানে সহজে ভিক্ষা পাওয়া যায়, তারই নিকটে সাধুরা ‘আসন’ অর্থাৎ থাকিবার স্থান ঠিক করে।”

সাধুদের জল ও ‘দিশা-জঙ্গলের’ সুবিধা দেখিয়া বিশ্রাম করা

“আবার চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ভিক্ষার কষ্ট সহ্য করেও বরং সাধুরা কোন স্থানে দু-এক দিনের জন্য আড্ডা করে থাকে, কিন্তু যেখানে জলের কষ্ট এবং ‘দিশা-জঙ্গল’-এর কষ্ট বা শৌচাদি যাবার ‘ফারাকৎ’ (নির্জন) স্থান নেই, সেখানে কখনো থাকে না। ভাল ভাল সাধুরা ওসব (শৌচাদি) কাজ যেখানে সকলে করে, যেখানে লোকের নজরে পড়তে হবে সেখানে করে না। অনেক দূরে নিরেলা জায়গায় (নিরালায়) গোপনে সেরে আসে। সাধুদের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম -“

ঐ সম্বন্ধে গল্প

“একজন লোক ভাল ত্যাগী সাধু দেখবে বলে সন্ধান করে ফিরছিল। তাকে একজন বলে দিলে যে, যে সাধুকে লোকালয় ছাড়িয়ে অনেক দূরে গিয়ে শৌচাদি সারতে দেখবে, তাকেই জানবে ঠিক ঠিক ত্যাগী। সে ঐ কথাটি মনে রেখে লোকালয়ের বাহিরে সন্ধান করতে করতে একদিন একজন সাধুকে অপর সকলের চেয়ে অনেক অধিক দূরে গিয়ে ঐ সব কাজ সারতে দেখতে পেলে ও তার পেছনে পেছনে গিয়ে সে কেমন লোক তাই জানতে চেষ্টা করতে লাগল। এখন, সে দেশের রাজার মেয়ে শুনেছিল যে ঠিক ঠিক যোগী পুরুষকে বিয়ে করতে পারলে সুপুত্তুর লাভ হয়; কারণ শাস্ত্রে আছে – যোগী পুরুষদের ঔরসেই সাধু পুরুষেরা জন্মগ্রহণ করেন। রাজার মেয়ে তাই সাধুরা যেখানে আড্ডা করেছিল, সেখানে মনের মতো পতি খুঁজতে এসে ঐ সাধুটিকেই পছন্দ করে বাড়ি ফিরে গিয়ে তার বাপকে বললে যে, সে ঐ সাধুকে বিবাহ করবে। রাজা মেয়েটিকে বড় ভালবাসত। মেয়ে জেদ করে ধরেছে, কাজেই রাজা সেই সাধুর কাছে এসে ‘অর্ধেক রাজত্ব দেব’ ইত্যাদি বলে অনেক করে বুঝালে যাতে সাধু রাজকন্যাকে বিবাহ করে। কিন্তু সাধু রাজার সে সব কথায় কিছুতেই ভুলল না। কাকেও কিছু না বলে রাতারাতি সে স্থান ছেড়ে পালিয়ে গেল। আগে যার কথা বলেছি, সেই লোকটি সাধুর ঐরূপ অদ্ভুত ত্যাগ দেখে বুঝলে যে বাস্তবিকই সে একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের দর্শন পেয়েছে ও তাঁর শরণাপন্ন হয়ে তাঁর মুখে উপদেশ পেয়ে তাঁর কৃপায় ঈশ্বর-ভক্তি লাভ করে কৃতার্থ হলো।”

দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে ‘দিশা-জঙ্গল’ ও ভিক্ষার বিশেষ সুবিধা বলিয়া সাধুদের তথায় আসা

“রাসমণির বাগানে ভিক্ষার সুবিধা, মা গঙ্গার কৃপায় জলেরও অভাব নেই। আবার নিকটেই মনের মতো ‘দিশা-জঙ্গল’ যাবার স্থান – কাজেই সাধুরা তখন এখানেই ডেরা করত। আবার, কথা মুখে হাঁটে – এ সাধু ওকে বললে, সে আর একজন এদিকে আসছে জেনে তাকে বললে – এইরূপে রাসমণির বাগানে যে সাগর ও জগন্নাথ দেখতে যাবার পথে একটি ডেরা করবার বেশ জায়গা, এ কথাটা সকল সাধুদের ভেতরেই তখন চাউর হয়ে গিয়েছিল।”

ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সাধুসম্প্রদায়ের আগমন

ঠাকুর আরও বলিতেন, “এক এক সময়ে এক এক রকমের সাধুর ভিড় লেগে যেত। এক সময়ে সন্ন্যাসী পরমহংসই যত আসতে লাগল! পেট-বৈরাগীর দল নয় – সব ভাল ভাল লোক। (নিজের ঘর দেখাইয়া) ঘরে দিনরাত্তির তাদের ভিড় লেগেই থাকত। আর দিবারাত্তির ব্রহ্ম ও মায়ার স্বরূপ, অস্তি ভাতি প্রিয় – এই সব বেদান্তের কথাই চলত।”

পরমহংসদেবের বেদান্তবিচার – ‘অস্তি, ভাতি, প্রিয়’

অস্তি, ভাতি, প্রিয় – ঠাকুর ঐ কথা কয়টি বলিয়াই আবার বুঝাইয়া দিতেন। বলিতেন, “সেটা কি জানিস? – ব্রহ্মের স্বরূপ; বেদান্তে ঐ ভাবে বোঝানো আছে, যিনিই ‘অস্তি’ কি না – ঠিক ঠিক বিদ্যমান আছেন, তিনিই ‘ভাতি’ কি না – প্রকাশ পাচ্ছেন। এখন, ‘প্রকাশটা’ হচ্চে জ্ঞানের স্বভাব। যে জিনিসটার সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান হয়েছে সেটাই আমাদের কাছে প্রকাশিত রয়েছে। যেটার জ্ঞান নেই সে জিনিসটা আমাদের কাছে অপ্রকাশ রয়েছে। কেমন, না? তাই বেদান্ত বলে, যে জিনিসটার যখনই আমাদের অস্তিত্ব-বোধ হলো, তখনি অমনি সেই বোধের সঙ্গে সঙ্গে সেই জিনিসটা আমাদের কাছে দীপ্তিমান বা প্রকাশিত বলে বোধ হলো – অর্থাৎ তার জ্ঞান-স্বরূপের কথাটা আমাদের বোধ হলো। আর অমনি সেটা আমাদের প্রিয় বলে বোধ হলো – অর্থাৎ তার ভেতরের আনন্দ-স্বরূপ আমাদের মনে প্রিয় বুদ্ধির উদয় করে সেটাকে ভালবাসতে আমাদের আকর্ষণ করলে। এইরূপে যেখানেই আমাদের অস্তিত্ব-জ্ঞান হচ্চে, সেখানেই আবার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-স্বরূপ ও আনন্দ-স্বরূপের জ্ঞান হচ্চে। সেজন্য, যেটা ‘অস্তি’, সেটাই ‘ভাতি’ ও ‘প্রিয়’ – যেটা ‘ভাতি’, সেটাই ‘অস্তি’ ও ‘প্রিয়’ এবং যেটা ‘প্রিয়’ সেটাই ‘অস্তি’ ও ‘ভাতি’ বলে বোধ হচ্চে। কারণ, যে ব্রহ্মবস্তু হতে এই জগৎ ও জগতের প্রত্যেক বস্তু ও ব্যক্তির উদয় হয়েছে, তাঁর স্বরূপই হচ্চে ‘অস্তি-ভাতি-প্রিয়’ বা সৎ-চিৎ-আনন্দ। সেজন্যই উত্তর গীতায় বলেছে – জ্ঞান হলে বোঝা যায়, যেখানে বা যে বস্তু বা ব্যক্তিতে তোমার মনকে টানছে, সেখানে বা সেই সেই বস্তু ও ব্যক্তির ভিতর পরমাত্মা রয়েছেন। ‘যত্র যত্র মনো যাতি তত্র তত্র পরং পদম্।’ রূপ-রসেও তাঁর অংশ রয়েছে বলে লোকের মন সেদিকে ছোটে, এ কথা বেদেও আছে।

“ঐ সব কথা নিয়ে তাদের ভেতর ধুম তর্কবিচার লেগে যেত। (আমার) আবার তখন খুব পেটের অসুখ, আমাশয়। হাতের জল শুকাত না! ঘরের কোণে হৃদু সরা পেতে রাখত। সেই পেটের অসুখে ভুগচি, আর তাদের ঐ সব জ্ঞান বিচার শুনচি! আর, যে কথাটার তারা কোন মীমাংসা করে উঠতে পারছে না, (নিজের শরীর দেখাইয়া) ভিতর থেকে তার এমন এক একটা সহজ কথায় মীমাংসা মা তুলে দেখিয়ে দিচ্চে – সেইটে তাদের বলচি, আর তাদের সব ঝগড়া-বিবাদ মিটে যাচ্চে!”

জনৈক সাধুর আনন্দ-স্বরূপ উপলব্ধি করায় উচ্চাবস্থার কথা

“একবার এক সাধু এল, তার মুখখানিতে বেশ একটি সুন্দর জ্যোতিঃ রয়েছে। সে কেবল বসে থাকে আর ফিক্ ফিক্ করে হাসে! সকাল সন্ধ্যা একবার করে ঘরের বাইরে এসে সে গাছপালা, আকাশ, গঙ্গা সব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত ও আনন্দে বিভোর হয়ে দু-হাত তুলে নাচত; কখনও বা হেসে গড়াগড়ি দিত, আর বলত ‘বাঃ বাঃ ক্যায়া মায়া – ক্যায়সা প্রপঞ্চ বনায়া।’ অর্থাৎ, ঈশ্বর কি সুন্দর মায়া বিস্তার করেছেন। তার ঐ ছিল উপাসনা। তার আনন্দলাভ হয়েছিল।”

ঠাকুরের জ্ঞানোন্মাদ সাধু-দর্শন

“আর একবার এক সাধু আসে – সে জ্ঞানোন্মাদ! দেখতে যেন পিশাচের মতো – উলঙ্গ, গায়ে মাথায় ধুলো, বড় বড় নখ চুল, গায়ে মরার কাঁথার মতো একখানা কাঁথা! কালীঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শন করতে করতে এমন স্তব পড়লে, যেন মন্দিরটা সুদ্ধ কাঁপতে লাগল; আর মা যেন প্রসন্না হয়ে হাসতে লাগলেন। তারপর কাঙালীরা যেখানে বসে প্রসাদ পায় সেখানে তাদের সঙ্গে প্রসাদ পাবে বলে বসতে গেল। কিন্তু তার ঐ রকম চেহারা দেখে তারাও তাকে কাছে বসতে দিলে না, তাড়িয়ে দিলে। তারপর দেখি, প্রসাদ পেয়ে সকলে যেখানে উচ্ছিষ্ট পাতাগুলো ফেলেছে, সেখানে বসে কুকুরদের সঙ্গে এঁটো ভাতগুলো খাচ্চে! একটা কুকুরের ঘাড়ে হাত দিয়ে রয়েছে, আর একই পাতে ঐ কুকুরটাও খাচ্চে, আর সেও খাচ্চে! অচেনা লোকে ঘাড় ধরেছে, তাতে কুকুরটা কিছু বলছে না বা পালাতে চেষ্টা করচে না! তাকে দেখে মনে ভয় হলো যে, শেষে আমারও ঐরূপ অবস্থা হয়ে ঐ রকম থাকতে বেড়াতে হবে নাকি!”

ব্রহ্মজ্ঞানে গঙ্গার জল ও নর্দমার জল এক বোধ হয়; পরমহংসদের বালক, পিশাচ বা উন্মাদের মত অপরে দেখে

“দেখে এসেই হৃদুকে বললুম, ‘হৃদু, এ যে-সে উন্মাদ নয় – জ্ঞানোন্মাদ।’ ঐ কথা শুনে হৃদু তাকে দেখতে ছুটল। গিয়ে দেখে, তখন সে বাগানের বাইরে চলে যাচ্ছে। হৃদু অনেক দূর তার সঙ্গে সঙ্গে চলল, আর বলতে লাগল, ‘মহারাজ! ভগবানকে কেমন করে পাব, কিছু উপদেশ দিন।’ প্রথম কিছুই বললে না। তারপর যখন হৃদে কিছুতেই ছাড়লে না, সঙ্গে সঙ্গে যেতে লাগল, তখন পথের ধারের নর্দমার জল দেখিয়ে বললে – ‘এই নর্দমার জল আর ঐ গঙ্গার জল যখন এক বোধ হবে, সমান পবিত্র জ্ঞান হবে, তখন পাবি’। এই পর্যন্ত – আর কিছুই বললে না। হৃদে আরও কিছু শোনবার ঢের চেষ্টা করলে, বললে, ‘মহারাজ! আমাকে চেলা করে সঙ্গে নিন।’ তাতে কোন কথাই বললে না। তারপর অনেক দূর গিয়ে একবার ফিরে দেখলে হৃদু তখনও সঙ্গে সঙ্গে আসচে। দেখেই চোখ রাঙিয়ে ইট তুলে হৃদেকে মারতে তাড়া করলে। হৃদে যেমন পালাল অমনি ইট ফেলে সে পথ ছেড়ে কোন্ দিকে যে সরে পড়ল, হৃদে তাকে আর দেখতে পেলে না। অমন সব সাধু, লোকে বিরক্ত করবে বলে ঐ রকম বেশে থাকে। ঐ সাধুটির ঠিক ঠিক পরমহংস অবস্থা হয়েছিল। শাস্ত্রে আছে, ঠিক ঠিক পরমহংসেরা বালকবৎ, পিশাচবৎ, উন্মাদবৎ হয়ে সংসারে থাকে। সেজন্য পরমহংসেরা ছোট ছোট ছেলেদের আপনাদের কাছে রেখে তাদের মতো হতে শেখে। ছেলেদের যেমন সংসারের কোন জিনিসটার আঁট নেই, সকল বিষয়ে সেই রকম হবার চেষ্টা করে। দেখিসনি, বালককে হয়তো একখানি নূতন কাপড় মা পরিয়ে দিয়েছে, তাতে কতই আনন্দ! যদি বলিস, ‘কাপড়খানি আমায় দিবি?’ সে অমনি বলে উঠবে, ‘না, দেব না, মা আমায় দিয়েচে।’ বলেই আবার হয়তো কাপড়ের খোঁটটা জোর করে ধরবে, আর তোর দিকে দেখতে থাকবে – পাছে তুই সেখানি কেড়ে নিস! কাপড়খানাতেই তখন যেন তার প্রাণটা সব পড়ে আছে! তার পরেই হয়তো তোর হাতে একটা সিকি-পয়সার খেলনা দেখে বলবে, ‘ঐটে দে, আমি তোকে কাপড়খানা দিচ্ছি।’ আবার কিছু পরেই হয়তো সে খেলনাটা ফেলে একটা ফুল নিতে ছুটবে। তার কাপড়েও যেমন আঁট, খেলনাটায়ও সেই রকম আঁট। ঠিক ঠিক জ্ঞানীদেরও ঐ রকম হয়।”

রামাইত বাবাজীদের দক্ষিণেশ্বরে আগমন

“এই রকম করে কতদিন গেল। তারপর তাদের (সন্ন্যাসী পরমহংসশ্রেণীর) যাওয়া-আসাটা কমে গেল। তারা গিয়ে, আসতে লাগল যত রামাইৎ বাবাজী – ভাল ভাল ত্যাগী ভক্ত বৈরাগী বাবাজী। দলে দলে আসতে লাগল। আহা, তাদের সব কি ভক্তি, বিশ্বাস! কি সেবায় নিষ্ঠা! তাদের একজনের কাছ (নিকট) থেকেই তো ‘রামলালা’1 আমার কাছে থেকে গেল। সে সব ঢের কথা।”


1. ‘রামলালা’ অর্থাৎ বালকবেশী শ্রীরামচন্দ্র। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে লোকে বালকবালিকাদের আদর করিয়া লাল বা লালা ও লালী বলিয়া ডাকে। সেজন্য শ্রীরামচন্দ্রের বাল্যাবস্থার পরিচায়ক ঐ অষ্টধাতুনির্মিত মূর্তিটিকে উক্ত বাবাজী ‘রামলালা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। বঙ্গভাষায়ও ‘দুলাল’, ‘দুলালী’ প্রভৃতি শব্দের ঐরূপ প্রয়োগ দেখিতে পাওয়া যায়।

রামলালা সম্বন্ধে ঠাকুরের কথা

“সে বাবাজী ঐ ঠাকুরটির চিরকাল সেবা করত। যেখানে যেত, সঙ্গে করে নিয়ে যেত। যা ভিক্ষা পেত রেঁধে-বেড়ে তাকে (রামলালাকে) ভোগ দিত। শুধু তাই নয় – সে দেখতে পেত রামলালা সত্য সত্যই খাচ্ছে বা কোন একটা জিনিস খেতে চাচ্চে, বেড়াতে যেতে চাচ্চে, আবদার করচে, ইত্যাদি! আর ঐ ঠাকুরটি নিয়েই সে আনন্দে বিভোর, ‘মত্ত’ হয়ে থাকত! আমিও দেখতে পেতুম, রামলালা ঐ রকম সব কচ্চে! আর রোজ সেই বাবাজীর কাছে চব্বিশ ঘণ্টা বসে থাকতুম – আর রামলালাকে দেখতুম!

“দিনের পর দিন যত যেতে লাগল, রামলালারও তত আমার উপর পিরীত বাড়তে লাগল। (আমি) যতক্ষণ বাবাজীর (সাধুর) কাছে থাকি ততক্ষণ সেখানে সে বেশ থাকে – খেলা-ধুলো করে; আর (আমি) যেই সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে আসি, তখন সেও (আমার) সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে! আমি বারণ করলেও সাধুর কাছে থাকে না! প্রথম প্রথম ভাবতুম, বুঝি মাথার খেয়ালে ঐ রকমটা দেখি। নইলে তার (সাধুর) চিরকেলে পুজোকরা ঠাকুর, ঠাকুরটিকে সে কত ভালবেসে – ভক্তি করে সন্তর্পণে সেবা করে, সে ঠাকুর তার (সাধুর) চেয়ে আমায় ভালবাসবে – এটা কি হতে পারে? কিন্তু ও রকম ভাবলে কি হবে? – দেখতুম, সত্য সত্য দেখতুম – এই যেমন তোদের সব দেখছি, এই রকম দেখতুম – রামলালা সঙ্গে সঙ্গে কখনো আগে কখনো পেছনে নাচতে নাচতে আসছে। কখনো বা কোলে ওঠবার জন্য আবদার কচ্চে। আবার হয়তো কখনো বা কোলে করে রয়েছি – কিছুতেই কোলে থাকবে না, কোল থেকে নেমে রোদে দৌড়াদৌড়ি করতে যাবে, কাঁটাবনে গিয়ে ফুল তুলবে বা গঙ্গার জলে নেমে ঝাঁপাই জুড়বে! যত বারণ করি, ‘ওরে, অমন করিসনি, গরমে পায়ে ফোস্কা পড়বে! ওরে, অত জল ঘাঁটিসনি, ঠাণ্ডা লেগে সর্দি হবে, জ্বর হবে’ – সে কি তা শোনে? যেন কে কাকে বলছে! হয়তো সেই পদ্ম-পলাশের মতো সুন্দর চোখ দুটি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক্ ফিক্ করে হাসতে লাগল, আর আরও দুরন্তপনা করতে লাগল বা ঠোঁট দুখানি ফুলিয়ে মুখভঙ্গি করে ভ্যাঙ্চাতে লাগল! তখন সত্য সত্যই রেগে বলতুম, ‘তবে রে পাজি, রোস্ – আজ তোকে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব!’ – বলে রোদ থেকে বা জল থেকে জোর করে টেনে নিয়ে আসি; আর এ জিনিসটা ও জিনিসটা দিয়ে ভুলিয়ে ঘরের ভেতর খেলতে বলি। আবার কখনো বা কিছুতেই দুষ্টামি থামছে না দেখে চড়টা চাপড়টা বসিয়েই দিতাম। মার খেয়ে সুন্দর ঠোঁট দুখানি ফুলিয়ে সজলনয়নে আমার দিকে দেখত! তখন আবার মনে কষ্ট হতো; কোলে নিয়ে কত আদর করে তাকে ভুলাতুম! এ রকম সব ঠিক ঠিক দেখতুম, করতুম!

“একদিন নাইতে যাচ্চি, বায়না ধরলে সেও যাবে! কি করি, নিয়ে গেলুম। তারপর জল থেকে আর কিছুতেই উঠবে না, যত বলি কিছুতেই শোনে না। শেষে রাগ করে জলে চুবিয়ে ধরে বললুম – তবে নে কত জল ঘাঁটতে চাস ঘাঁট; আর সত্য সত্য দেখলুম সে জলের ভিতর হাঁপিয়ে শিউরে উঠল! তখন আবার তার কষ্ট দেখে, কি করলুম বলে কোলে করে জল থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসি!

“আর একদিন তার জন্য মনে যে কষ্ট হয়েছিল, কত যে কেঁদেছিলুম তা বলবার নয়। সেদিন রামলালা বায়না করচে দেখে ভোলাবার জন্য চারটি ধানসুদ্ধ খই খেতে দিয়েছিলুম। তারপর দেখি, ঐ খই খেতে খেতে ধানের তুষ লেগে তার নরম জিব চিরে গেছে! তখন মনে যে কষ্ট হলো; তাকে কোলে করে ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলুম আর মুখখানি ধরে বলতে লাগলুম – ‘যে মুখে মা কৌশল্যা, লাগবে বলে ক্ষীর, সর, ননীও অতি সন্তর্পণে তুলে দিতেন, আমি এমন হতভাগা যে, সেই মুখে এই কদর্য খাবার দিতে মনে একটুও সঙ্কোচ হলো না’!” – কথাগুলি বলিতে বলিতেই ঠাকুরের আবার পূর্বশোক উথলিয়া উঠিল এবং তিনি আমাদের সম্মুখে অধীর হইয়া এমন ব্যাকুল ক্রন্দন করিতে লাগিলেন যে, রামলালার সহিত তাঁহার প্রেম-সম্বন্ধের কথার বিন্দুবিসর্গও আমরা বুঝিতে না পারিলেও আমাদের চক্ষে জল আসিল।

ঠাকুরের মুখে রামলালার কথা শুনিয়া আমাদের কি মনে হয়

মায়াবদ্ধ জীব আমরা রামলালার ঐ সব কথা শুনিয়া অবাক। ভয়ে ভয়ে (রামলালা) ঠাকুরটির দিকে তাকাইয়া দেখি, যদি কিছু দেখিতে পাই। ওমা, কিছুই না! আর পাবই বা কেন? রামলালার উপর সে ভালবাসার টান তো আর আমাদের নাই। ঠাকুরের ন্যায় শ্রীরামচন্দ্রের ভাবটি ভিতরে ঘনীভূত হইয়া আমাদের সে ভাবচক্ষু তো খুলে নাই যে বাহিরেও রামলালাকে জীবন্ত দেখিব। আমরা একটি ছোট পুতুলই দেখি, আর ভাবি, ঠাকুর যা বলিতেছেন তা কি হইতে পারে বা হওয়া সম্ভব? সংসারে সকল বিষয়েই তো আমাদের ঐরূপ হইতেছে, আর অবিশ্বাসের ঝুড়ি লইয়া বসিয়া আছি! দেখ না – ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি বলিলেন, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম নেহ নানাস্তি কিঞ্চন’, জগতে এক সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্মবস্তু ছাড়া আর কিছুই নাই; তোরা যে নানা জিনিস নানা ব্যক্তি সব দেখিতেছিস, তার একটা কিছুও বাস্তবিক নাই। আমরা ভাবিলাম, ‘হবেও বা’। সংসারের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একমেবাদ্বিতীয়ং ব্রহ্মবস্তুর নামগন্ধও খুঁজিয়া পাইলাম না; দেখিতে পাইলাম, কেবল কাঠ মাটি, ঘর দ্বার, মানুষ, গরু, নানা রঙের জিনিস। না হয় বড় জোর দেখিলাম, নীল সুনীল তারকামণ্ডিত অনন্ত আকাশ, শুভ্রকিরীটি হরিৎ-শ্যামলাঙ্গ ভূধর তাহাকে স্পর্শ করিতে স্পর্ধা করিতেছে; আর কলনাদিনী স্রোতস্বতীকুল ‘অত স্পর্ধা ভাল নয়’ বলিয়া তাহাকে ভর্ৎসনা করিতে করিতে নিম্নগা হইয়া তাহাকে দীনতা শিক্ষা দিতেছে! অথবা দেখিলাম, বাত্যাহত অনন্ত জলধি বিশাল বিক্রমে সর্বগ্রাস করিতে যেন ছুটিয়া আসিতেছে, কিন্তু সহস্র চেষ্টাতেও বেলাতিক্রম করিতে পারিতেছে না। আর ভাবিলাম, ঋষিরা কি কোনরূপ নেশা ভাঙ করিয়া কথাগুলি বলিয়াছেন? ঋষিরা যদি বলিলেন, ‘না হে বাপু, কায়মনোবাক্যে সংযম ও পবিত্রতার অভ্যাস করিয়া একচিত্ত হও, চিত্তকে স্থির কর, তাহা হইলেই আমরা যাহা বলিয়াছি তাহা বুঝিতে – দেখিতে পাইবে। দেখিবে, জগৎটা তোমারই ভিতরের ভাবের ঘনীভূত প্রকাশ; দেখিবে তোমার ভিতরে ‘নানা’ রহিয়াছে বলিয়াই বাহিরেও ‘নানা’ দেখিতেছ।’ আমরা বলিলাম, ‘ঠাকুর, পেটের দায়ে ইন্দ্রিয়তাড়নায় অস্থির, আমাদের অত অবসর কোথায়?’ অথবা বলিলাম, ‘ঠাকুর, তোমার ব্রহ্মবস্তু দেখিতে হইলে যাহা যাহা করিতে হইবে বলিয়া ফর্দ বাহির করিলে, তাহা করা তো দুই-চারি দিন বা মাস বা বৎসরের কাজ নয় – মানুষে এক জীবনে করিয়া উঠিতে পারে কি না সন্দেহ। তোমাদের কথা শুনিয়া ঐ বিষয়ে লাগিয়া তারপর যদি ব্রহ্মবস্তু না দেখিতে পাই, অনন্ত আনন্দলাভটা সব ফাঁকি বলিয়া বুঝিতে পারি, তাহা হইলেই তো আমার এ কুলও গেল, ও কুলও গেল – না পৃথিবীর, ক্ষণস্থায়ীই হউক আর যাহাই হউক, সুখগুলো ভোগ করিতে পাইলাম, না তোমার অনন্ত সুখটাই পাইলাম – তখন কি হইবে? না, ঠাকুর! তুমি অনন্ত সুখের আস্বাদ পাইয়া থাক, ভাল – তুমিই উহা শিষ্যপ্রশিষ্যক্রমে সুখে ভোগদখল কর; আমরা রূপরসাদি হইতে হাতে হাতে যে সুখটুকু পাইতেছি, আমাদের তাহাই ভোগ করিতে দাও; নানা তর্ক-যুক্তি, ফন্দি-ফারক্কা তুলিয়া আমাদের সে ভোগটুকু মাটি করিও না!’

বর্তমান কালের জড়বিজ্ঞান ভোগসুখবৃদ্ধির সহায়তা করে বলিয়া আমাদের উহাতে অনুরাগ

আবার দেখ, বিজ্ঞানবিদ্ আসিয়া আমাদিগকে বলিলেন, ‘আমি তোমাকে যন্ত্রসহায়ে দেখাইয়া দিতেছি – এক সর্বব্যাপী প্রাণপদার্থ ইট-কাঠ, সোনা-রূপা, গাছ-পালা, মানুষ-গরু সকলের ভিতরেই সমভাবে রহিয়া ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হইতেছে।’ আমরা দেখিলাম, বাস্তবিকই সকলের ভিতরে প্রাণস্পন্দন পাওয়া যাইতেছে! বলিলাম – ‘বা! বা! তোমার বুদ্ধিখানার দৌড় খুব বটে। কিন্তু শুধু ঐ জ্ঞান লইয়া কি হইবে? ও কথা তো আমাদের শাস্ত্রকর্তা ঋষিরা বলিয়া গিয়াছেন বহুকাল পূর্বে।1 তুমি না হয় উহা এখন দেখাইতেই পারিলে। উহার সহায়ে আমাদের রূপরসাদি-ভোগের কিছু বৃদ্ধি হইবে বলিতে পার? তাহা হইলে বুঝিতে পারি।’ বিজ্ঞানবিদ্ বলিলেন – ‘হইবে না? নিশ্চিত হইবে। এই দেখ না, তড়িৎ-শক্তির পরিচয় পাইয়া তোমার দেশ-দেশান্তরের সংবাদ পাইবার কত সুবিধা হইয়াছে; বিস্ফোরক পদার্থের গূঢ় নিয়ম বুঝিয়া বন্দুক কামান করিয়া তোমার ভোগসুখলাভের অন্তরায় শত্রুকুলনাশের কত সুবিধা হইয়াছে। এইরূপে আজ আবার এই যে সর্বব্যাপী প্রাণশক্তির পরিচয় পাইলে তাহার দ্বারাও পরে ঐরূপ কিছু না কিছু সুবিধা হইবেই হইবে।’ তখন আমরা বলিলাম, ‘তা বটে; আচ্ছা, কিন্তু যত শীঘ্র পার ঐ নবাবিষ্কৃত শক্তিপ্রয়োগে যাহাতে আমাদের ভোগের বৃদ্ধি হয়, সেই বিষয়টায় লক্ষ্য রাখিয়া যাহা হয় কিছু একটা বাহির করিয়া ফেল; তাহা হইলেই বুঝিব, তুমি বাস্তবিক বুদ্ধিমান বটে; ঐ বেদ-পুরাণ-বক্তা ঋষিগুলোর মতো তুমি নেশা ভাঙ করিয়া কথা কহ না।’ বিজ্ঞানবিদ্ও শুনিয়া আমাদের ধারা বুঝিয়া বলিলেন – ‘তথাস্তু’!


1. “অন্তঃসংজ্ঞা ভবন্ত্যেতে সুখদুঃখসমন্বিতাঃ” – বৃক্ষপ্রস্তরাদি জড়পদার্থসকলেরও চৈতন্য আছে; উহাদের ভিতরেও সুখদুঃখের অনুভূতি বর্তমান।

বৌদ্ধযুগের শেষে কাপালিকদের সকাম ধর্মপ্রচারের ফল। যোগ ও ভোগ একত্র থাকা অসম্ভব

ধর্মজগতে জ্ঞানকাণ্ডের প্রচারক ঋষিরা ঐরূপে ‘তথাস্তু’ বলিতে পারিলেন না বলিয়াই তো যত গোল বাধিয়া গেল। আর তাঁহাদিগকে সংসারের কোলাহল হইতে দূরে ঝোড়ে জঙ্গলে বাস করিয়া দুই-চারিটা সংসারবিরাগী লোককে লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে হইল! তবে ভারতে ধর্মজগতে ঐরূপ ‘তথাস্তু’ বলিবার চেষ্টা যে কোন কালে কখনও হয় নাই তাহা বোধ হয় না। বৌদ্ধযুগের শেষের কথাটা স্মরণ কর – যখন তান্ত্রিক কাপালিকেরা মারণ, উচাটন, বশীকরণাদির বিপুল প্রসার করিতেছেন, যখন শান্তি-স্বস্ত্যয়নাদিতে মানবের শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির উপশম ও আরোগ্যের এবং ভূত-প্রেত তাড়াইবার খুব ধুমধাম পড়িয়াছে, যখন তপস্যালব্ধ সিদ্ধাই-প্রভাবে অলৌকিক কিছু একটা না দেখাইতে পারিলে এবং শিষ্যবর্গের সাংসারিক ভোগসুখাদি নির্বিঘ্নে যাহাতে সম্পন্ন হয়, দৈবকে ঐভাবে নিয়ন্ত্রিত করিবার ক্ষমতা তুমি যে ধারণ কর লোকের নিকট এরূপ ভান না করিতে পারিলে তুমি ধার্মিক বলিয়াই পরিচিত হইতে পারিতে না – সেই যুগের কথা স্মরণ কর। তখন ধর্মজগৎ একবার ভোগের কামনা পূর্ণ করিবার সহায়ক বলিয়া ধর্মনিহিত গূঢ় সত্যসকলকে সংসারী মানবের নিকট প্রচার করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছিল। কিন্তু আলোক ও অন্ধকার একত্রে একই স্থানে এক সময়ে থাকিবে কিরূপে? ফলে স্বল্পকালের মধ্যেই কাপালিক তান্ত্রিকদের যোগ ভুলিয়া ভোগভূমিতে অবরোহণ এবং ধর্মের নামে রূপরসাদি সুবিস্তৃত ভোগশৃঙ্খলের গুপ্ত প্রচার! তখন দেশের যথার্থ ধার্মিকেরা আবার বুঝিল যে, যোগ-ভোগ দুই পদার্থ পরস্পরবিরোধী – একত্র একাধারে কোনরূপেই থাকিতে পারে না এবং বুঝিয়া পুনরায় ঋষিকুল-প্রবর্তিত জ্ঞানমার্গের পক্ষপাতী হইয়া জীবনে তাহার অনুষ্ঠান করিতে লাগিল।

ঠাকুরের নিজের অদ্ভুত ত্যাগ এবং ত্যাগধর্মের প্রচার দেখিয়া সংসারী লোকের ভয়

আমাদেরও সংসারী মানবের মতে মত দিয়া ঐরূপে ‘তথাস্তু’ বলিবার সুযোগ কোথায়? আমরা যে এক জগৎছাড়া ঠাকুরের কথা বলিতে বসিয়াছি – যাঁহার মনে ত্যাগের ভাব এত বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল যে, সুষুপ্তাবস্থায়ও হস্তে ধাতু স্পর্শ করিলে হস্ত সঙ্কুচিত ও আড়ষ্ট হইয়া যাইত এবং শ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হইয়া প্রাণের ভিতর বিষম যন্ত্রণা উপস্থিত হইত! – যাঁহার মনে জগজ্জননীর সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি বলিয়া জ্ঞান স্ত্রী-শরীর দেখিলেই উদয় হইত, নানা লোকে নানা চেষ্টা করিয়াও ঐ ভাব দূর করিতে পারে নাই! – সহস্র সহস্র মুদ্রার সম্পত্তি দিতে চাহিয়াছিল বলিয়া যাঁহার মনে এমন বিষম যন্ত্রণা উপস্থিত হইয়াছিল যে, পরম অনুগত মথুরকে যষ্টিহস্তে আরক্ত-নয়নে প্রহার করিতে ছুটাছুটি করিয়াছিলেন এবং পরেও সে-সব কথা আমাদের নিকট কখনও কখনও বলিতে বলিতে উত্তেজিত হইয়া বলিতেন, ‘মথুর ও লক্ষ্মীনারায়ণ মাড়োয়ারী বিষয় লেখাপড়া করে দেবে শুনে মাথায় যেন করাত বসিয়ে দিয়েছিল, এমন যন্ত্রণা হয়েছিল!’ – যাঁহার মনে সংসারের রূপরসাদি কখনও আসক্তির কলঙ্ক-কালিমা আনয়ন করিয়া সমাধিভূমির অতীন্দ্রিয় আনন্দানুভবের বিন্দুমাত্র বিচ্ছেদ জন্মাইতে পারে নাই – এ সৃষ্টিছাড়া ঠাকুরের কথা বলিতে যাইয়া আমাদের যে অনেক তিরস্কার-লাঞ্ছনা সহ্য করিতে হইবে, হে ভোগলোলুপ সংসারী মানব, তাহা আমরা বহু পূর্ব হইতেই জানি। শুধু তাহাই নহে, পাছে তোমার দলবল, আত্মীয়-স্বজন, পুত্র-পৌত্রাদির ভিতর সরলমতি কেহ এ অলৌকিক চরিত্রের প্রতি আমাদের কথায় সত্য সত্যই আকৃষ্ট হইয়া ভোগ-সুখে জলাঞ্জলি দিয়া সংসারের বাহিরে যাইবার চেষ্টা করে, তজ্জন্য তুমি এ দেবচরিত্রেও যে কলঙ্কার্পণ করিতে কুণ্ঠিত হইবে না – তাহাও আমরা জানি। কিন্তু জানিলে কি হইবে? যখন এ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তখন আর আমাদের বিরত হইবার বা অন্ততঃ আংশিক গোপন করিয়া সত্য বলিবার সামর্থ্য নাই। যতদূর জানি, সমস্ত কথাই বলিয়া যাইতে হইবে। নতুবা শান্তি নাই। কে যেন জোর করিয়া বলাইতেছে যে! অতএব আমরা এ অদৃষ্টপূর্ব দেবমানবের কথা যতদূর জানি বলিয়া যাই, আর তুমি এই সকল কথা যতটা ইচ্ছা ‘ন্যাজামুড়ো বাদ দিয়া’ নিজের যতটা ‘রয় সয়’ ততটা লইও, বা ইচ্ছা হইলে ‘কতকগুলো গাঁজাখুরি কথা লিখিয়াছে’ বলিয়া পুস্তকখানা দূরে নিক্ষেপ করিয়া নিত্য নূতন ফুলে ‘বিষয়-মধু’ পান করিতে ছুটিও। পরে, সংসারে বিষম ঘূর্ণিপাকে পড়িয়া যদি কখনও ‘বিষয়-মধু তুচ্ছ হলো, কামাদি-কুসুমসকলে’ – এমন অবস্থা তোমার ভাগ্যদোষে (বা গুণে?) আসিয়া পড়ে, তখন এ অলৌকিক পুরুষের লীলাপ্রসঙ্গ পড়িও – নিজেও শান্তি পাইবে এবং আমাদের ঠাকুরেরও ‘কদর’ বুঝিবে।

রামলালার ঠাকুরের নিকট থাকিয়া যাওয়া কিরূপে হয়

‘রামলালা’র ঐরূপ অদ্ভুত আচরণের কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর বলিতেন – “এক এক দিন রেঁধেবেড়ে ভোগ দিতে বসে বাবাজী (সাধু) রামলালাকে দেখতেই পেত না। তখন মনে ব্যথা পেয়ে এখানে (ঠাকুরের ঘরে) ছুটে আসত; এসে দেখত রামলালা ঘরে খেলা করচে! তখন অভিমানে তাকে কত কি বলত! বলত, ‘আমি এত করে রেঁধেবেড়ে তোকে খাওয়াব বলে খুঁজে বেড়াচ্চি, আর তুই কি না এখানে নিশ্চিন্ত হয়ে ভুলে রয়েছিস! তোর ধারাই ঐরূপ, যা ইচ্ছা তাই করবি; মায়া দয়া কিছুই নেই! বাপ-মাকে ছেড়ে বনে গেলি, বাপটা কেঁদে কেঁদে মরে গেল, তবুও ফিরলি না – তাকে দেখা দিলি না!’ – এইরকম সব কত কি বলে রামলালাকে টেনে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত! এই রকমে দিন যেতে লাগল। সাধু এখানে অনেক দিন ছিল – কারণ রামলালা এখান (আমাকে) ছেড়ে যেতে চায় না – আর সেও চিরকালের আদরের রামলালাকে ফেলে যেতে পারে না!

“তারপর একদিন বাবাজী হঠাৎ এসে সজলনয়নে বললে, ‘রামলালা আমাকে কৃপা করে প্রাণের পিপাসা মিটিয়ে যেমন ভাবে দেখতে চাইতাম তেমনি করে দর্শন দিয়েছে ও বলেছে, এখান থেকে যাবে না; তোমাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চায় না! আমার এখন আর মনে দুঃখকষ্ট নাই! তোমার কাছে ও সুখে থাকে, আনন্দে খেলাধুলো করে, তাই দেখেই আমি আনন্দে ভরপুর হয়ে যাই। এখন আমার এমনটা হয়েছে যে ওর যাতে সুখ, তাতেই আমার সুখ! সেজন্য আমি এখন একে তোমার কাছে রেখে অন্যত্র যেতে পারব। তোমার কাছে সুখে আছে ভেবে ধ্যান করেই আমার আনন্দ হবে।’ – এই বলে রামলালাকে আমায় দিয়ে বিদায় গ্রহণ করলে। সেই অবধি রামলালা এখানে রয়েছে।”

ঠাকুরের দেবসঙ্গে বাবাজীর স্বার্থশূন্য প্রেমানুভব

আমরা বুঝিলাম ঠাকুরের দেবসঙ্গেই বাবাজীর মন স্বার্থগন্ধহীন ভালবাসার আস্বাদন পাইল এবং বুঝিতে পারিল যে ঐ প্রেমে প্রেমাস্পদের সহিত আর বিচ্ছেদের আশঙ্কা নাই। বুঝিল যে, তাহার শুদ্ধ-প্রেমঘন উপাস্য তাহার নিকটেই সর্বদা রহিয়াছেন, যখনি ইচ্ছা তখনি তাঁহার দর্শন পাইবে! সাধু ঐ আশ্বাস পাইয়াই যে প্রাণের রামলালাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিয়াছিল, ইহা নিঃসংশয়।

জনৈক সাধুর রামনামে বিশ্বাস

ঠাকুর বলিতেন, “আবার এক সাধু এসেছিল, তার ঈশ্বরের নামেই একান্ত বিশ্বাস! সেও রামাৎ; তার সঙ্গে অন্য কিছুই নেই, কেবল একটি লোটা (ঘটি) ও একখানি গ্রন্থ। গ্রন্থখানি তার বড়ই আদরের – ফুল দিয়ে নিত্য পূজা করত ও এক একবার খুলে দেখত। তার সঙ্গে আলাপ হবার পর একদিন অনেক করে বলে কয়ে বইখানি দেখতে চেয়ে নিলুম। খুলে দেখি তাতে কেবল লাল কালিতে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে, ‘ওঁ রামঃ!’ সে বললে, ‘মেলা গ্রন্থ পড়ে কি হবে? এক ভগবান থেকেই তো বেদ-পুরাণ সব বেরিয়েছে; আর তাঁর নাম এবং তিনি তো অভেদ; অতএব চার বেদ, আঠার পুরাণে, আর সব শাস্ত্রে যা আছে, তাঁর একটি নামেতে সে-সব রয়েছে! তাই তাঁর নাম নিয়েই আছি!’ তার (সাধুর) নামে এমনি বিশ্বাস ছিল!”

রামাইত সাধুদের ভজন-সঙ্গীত ও দোঁহাবলী

এইরূপে কত সাধুর কথাই না ঠাকুর আমাদিগের নিকট বলিতেন; আবার কখনও কখনও ঐ সকল রামাইৎ বাবাজীদের নিকট যে সকল ভগবানের ভজন শিখিয়াছিলেন, তাহা গাহিয়া আমাদের শুনাইতেন। যথা –

(মেরা) রামকো না চিনা হ্যায়, দিল্, চিনা হ্যায় তুম্ ক্যারে;
আওর্ জানা হ্যায় তুম্ ক্যারে।
সন্ত্ ওহি যো, রাম-রস চাখে
আওর্ বিষয়-রস চাখা হ্যায় সো ক্যারে॥
পুত্র ওহি যো, কুলকো তারে
আওর্ যো সব পুত্র হ্যায় সো ক্যারে॥

অথবা –

সীতাপতি রামচন্দ্র,        রঘুপতি রঘুরাঈ।
ভজলে অযোধ্যানাথ,        দুসরা ন কোঈ॥
হসন বোলন চতুর চাল,        অয়ন বয়ান দৃগ্-বিশাল।
ভ্রূকুটি কুটিল তিলক ভাল,        নাসিকা শোভাঈ॥
কেশরকো তিলক ভাল,        মানো রবি প্রাতঃকাল।
শ্রবণ-কুণ্ডল-ঝলমলাত,        রতিপতি-ছবি-ছাঈ॥
মোতিনকো কণ্ঠমাল,        তারাগণ উর বিশাল।
মানো গিরি শিখর ফোড়ি,        সুরসরি বহিরাঈ॥
বিহরে রঘুবংশবীর,        সখা সহিত সরযূতীর।
তুলসীদাস হরষ নিরখি,        চরণরজ পাঈ॥

অথবা গাহিতেন –

‘রাম ভজা সেই জিয়ারে জগমে,
রাম ভজা সেই জিয়ারে॥’

অথবা –

‘মেরা রাম বিনা কোহি নাহিরে তারণ-ওয়ালা!’

– এই মধুর গীত দুইটির অপর চরণসকল আমরা ভুলিয়া গিয়াছি।

কখনও বা আবার ঠাকুর ঐ সকল সাধুদিগের নিকট যে-সকল দোঁহা শিখিয়াছিলেন, তাহাই আমাদের শুনাইতেন। বলিতেন, “সাধুরা চুরি, নারী ও মিথ্যা এই তিনের হাত থেকে সর্বদা আপনাকে বাঁচাতে উপদেশ করে।” বলিয়াই আবার বলিতেন, “এই তুলসীদাসের দোঁহায় সব কি বলছে শোন্ –

সত্যবচন অধীনতা পরধন-উদাস।
ইস্সে না হরি মিলে তো জামিন্ তুলসীদাস॥
সত্যবচন অধীনতা পরস্ত্রী মাতৃ সমান।
ইস্সে না হরি মিলে, তুলসী ঝুট্ জবান্॥

“অধীনতা কি জানিস – দীনভাব। ঠিক ঠিক দীনভাব এলে অহঙ্কারের নাশ হয় ও ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। কবীরদাসের গানেও ঐ কথা আছে –

সেবা বন্দি আওর্ অধীনতা, সহজ মিলি রঘুরাঈ।
হরিষে লাগি রহোরে ভাই॥”

ইত্যাদি।

ঠাকুরের সকল সম্প্রদায়ের সাধকদিগকে সাধনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিবার ইচ্ছা ও রাজকুমারের (অচলানন্দের) কথা

আবার একদিন ঠাকুর বলিলেন, “এক সময়ে এমনটা মনে হলো যে, সকল রকমের সাধকদের যা কিছু জিনিস সাধনার জন্য দরকার, সে সব তাদের যোগাব! তারা এইসব পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ঈশ্বর সাধনা করবে, তাই দেখব আর আনন্দ করব। মথুরকে বললুম। সে বললে, ‘তার আর কি বাবা, সব বন্দোবস্ত করে দিচ্চি; তোমার যাকে যা ইচ্ছা হবে দিও।’ ঠাকুরবাড়ির ভাণ্ডার থেকে চাল, ডাল, আটা প্রভৃতি যার যেমন ইচ্ছা তাকে সেই রকম সিধা দিবার বন্দোবস্ত তো ছিলই – তার উপর মথুর সাধুদের দিবার জন্য লোটা, কমণ্ডলু, কম্বল, আসন, মায় তারা যে-সব নেশা ভাঙ করে – সিদ্ধি, গাঁজা, তান্ত্রিক সাধুদের জন্য ‘কারণ’ প্রভৃতি সকল জিনিস দিবার বন্দোবস্ত করে দিলে। তখন তান্ত্রিক সাধক ঢের আসত ও শ্রীচক্রের অনুষ্ঠান করত! আমি আবার তাদের সাধনার দরকার বলে আদা পেঁয়াজ ছাড়িয়ে, মুড়ি কড়াইভাজা আনিয়ে সব যোগাড় করে দিতুম; আর তারা সব ঐ নিয়ে পূজা করছে, জগদম্বাকে ডাকছে, দেখতুম। আমাকে তারা আবার অনেক সময় চক্রে নিয়ে বসত, অনেক সময় চক্রেশ্বর করে বসাত; ‘কারণ’ গ্রহণ করতে অনুরোধ করত। কিন্তু যখন বুঝত যে, ও সব গ্রহণ করতে পারি না, নাম করলেই নেশা হয়ে যায়, তখন আর অনুরোধ করত না। তাদের সঙ্গে বসলে ‘কারণ’ গ্রহণ করতে হয় বলে ‘কারণ’ নিয়ে কপালে ফোঁটা কাটতুম বা আঘ্রাণ নিতুম বা বড়জোর আঙুলে করে মুখে ছিটে দিতুম আর তাদের পাত্রে সব ঢেলে ঢেলে দিতুম। দেখতুম, তাদের ভিতর কেউ কেউ উহা গ্রহণ করেই ঈশ্বর চিন্তায় মন দেয়, বেশ তন্ময় হয়ে তাঁকে ডাকে। অনেকে আবার কিন্তু দেখলুম লোভে পড়ে খায়, আর জগদম্বাকে ডাকা দূরে থাক বেশি খেয়ে শেষটা মাতাল হয়ে পড়ে। একদিন ঐ রকমে বেশি ঢলাঢলি করাতে শেষটা ওসব (কারণাদি) দেওয়া বন্ধ করে দিলুম! রাজকুমারকে1 কিন্তু বরাবর দেখেছি, গ্রহণ করেই তন্ময় হয়ে জপে বসত; কখনো অন্য দিকে মন দিত না। শেষটা কিন্তু যেন একটু নাম-যশ-প্রতিষ্ঠার দিকে ঝোঁক হয়েছিল। হতেই পারে – ছেলেপিলে পরিবার ছিল – বাড়িতে অভাবের দরুন টাকাকড়ি-লাভের দিকে একটু-আধটু মন দিতে হতো; তা যাই হোক, সে কিন্তু বাবু, সাধনার সহায় বলেই ‘কারণ’ গ্রহণ করত; লোভে পড়ে ঐ সব খেয়ে কখনো ঢলাঢলি করেনি – ওটা দেখেছি।”


1. ইনি কয়েক বৎসর হইল দেহত্যাগ করিয়াছেন। কালীঘাটে অনেক সময় থাকিতেন এবং অচলানন্দনাথ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইনি অনেকগুলি শিষ্য-প্রশিষ্য রাখিয়া যান। ইঁহার দেহত্যাগের পর শিষ্যেরা কালীঘাটের নিকটবর্তী গ্রামান্তরে মহাসমারোহে তাঁহার শরীরের মৃৎসমাধি দেয়।

ঠাকুরের ‘সিদ্ধি’ বা ‘কারণ’ বলিবামাত্র ঈশ্বরীয় ভাবে তন্ময় হইয়া নেশা; ও খিস্তি-খেউড়-উচ্চারণেও সমাধি

ঠাকুর ‘কারণ’ গ্রহণ করিতে কখনও পারিতেন না – এ প্রসঙ্গে কত কথাই না মনে উদয় হইতেছে! কতদিন না আমাদের সম্মুখে তিনি কথা-প্রসঙ্গে ‘সিদ্ধি’, ‘কারণ’ প্রভৃতি পদার্থের নাম করিতে করিতে নেশায় ভরপুর হইয়া, এমনকি সমাধিস্থ পর্যন্ত হইয়া পড়িয়াছেন – দেখিয়াছি! স্ত্রী-শরীরের বিশেষ গোপনীয় অঙ্গ, যাহার নামমাত্রেই সভ্যতাভিমানী জুয়াচোর আমাদের মনে কুৎসিত ভোগের ভাবই উদিত হয় বা ঐরূপ ভাব উদিত হইবে নিশ্চিত জানিয়া আমাদের ভিতর শিষ্ট যাঁহারা তাঁহারা ‘অশ্লীল’ বলিয়া কর্ণে অঙ্গুলিপ্রদানপূর্বক দূরে পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করেন, সেই অঙ্গের নাম করিতে করিতেই এ অদ্ভুত ঠাকুরকে কতদিন না সমাধিস্থ হইয়া পড়িতে দেখিয়াছি! আবার দেখিয়াছি – সমাধি-ভূমি হইতে কিছু নিম্নে নামিয়া একটু বাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়াই ঐ প্রসঙ্গে বলিতেছেন, “মা, তুইতো পঞ্চাশৎ-বর্ণ-রূপিণী; তোর যে-সব বর্ণ নিয়ে বেদ-বেদান্ত, সেই সবই তো খিস্তি-খেউড়ে! তোর বেদ-বেদান্তের ক খ আলাদা, আর খেউড়ের ক খ আলাদা তো নয়! বেদ-বেদান্তও তুই, আর খিস্তি-খেউড়ও তুই।” এই বলিতে বলিতে আবার সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন! হায়, হায়, বলা-বুঝানোর কথা দূরে যাউক, কে বুঝিবে এ অলৌকিক দেবমানবের নয়নে জগতের ভাল-মন্দ সকল পদার্থই কি অনির্বচনীয়, আমাদের মনোবুদ্ধির অগোচর, এক অপূর্ব আলোকে প্রকাশিত ছিল! কে সে চক্ষু পাইবে যে, তাঁহার ন্যায় দৃষ্টিতে জগৎ-সংসারটা দেখিতে পাইবে! হে পাঠক, অবহিত হও; স্তম্ভিত মনে কথাগুলি হৃদয়ে যত্নে ধারণ কর, আর ভাব – এ অদ্ভুত ঠাকুরের মানসিক পবিত্রতা কি সুগভীর, কি দুরবগাহ!

শ্রীশ্রীজগদম্বার কৃপাপাত্র শ্রীরামপ্রসাদ গাহিয়াছেন – “সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয় কালী বলে। আমার মন-মাতালে মাতাল করে, যত মদ-মাতালে মাতাল বলে” ইত্যাদি। বাস্তবিক নেশা-ভাঙ না করিয়া কেবল ভগবদানন্দে যে লোকে, আমরা যে অবস্থাকে বেয়াড়া মাতাল বলি তদ্রূপ অবস্থাপন্ন হইতে পারে, এ কথা ঠাকুরকে দেখিবার পূর্বে আমাদের ধারণাই হইত না। আমাদের বেশ মনে আছে, আমাদের জীবনে একটা সময় এমন গিয়াছে যখন ‘হরি’ বলিলেই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হইত – একথা কোন গ্রন্থে পাঠ করিয়া গ্রন্থকারকে কুসংস্কারাপন্ন নির্বোধ বলিয়া ধারণা হইয়াছিল। তখন ঐ প্রকারের একটা সকল বিষয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাসের তরঙ্গ যেন শহরের সকল যুবকেরই মনে চলিতেছিল! তাহার পরেই এই অলৌকিক ঠাকুরের সহিত দেখা। দেখা, দিবসে রাত্রে সকল সময়ে দেখা, নিজের চক্ষে দেখা যে কীর্তনানন্দে তাঁহার উদ্দাম নৃত্য ও ঘন ঘন বাহ্যজ্ঞানের লোপ – টাকা পয়সা হাতে স্পর্শ করাইলেই ঐ অবস্থাপ্রাপ্তি – ‘সিদ্ধি’, ‘কারণ’ প্রভৃতি নেশার পদার্থের নাম করিবামাত্র ভগবদানন্দের উদ্দীপন হইয়া ভরপুর নেশা – ঈশ্বরের বা তদবতারদিগের নামের কথা দূরে থাক, যে নামের উচ্চারণে ইতর সাধারণের মনে কুৎসিত ইন্দ্রিয়জ আনন্দেরই উদ্দীপনা হয়, তাহাতে ব্রহ্মযোনি ত্রিজগৎপ্রসবিনী আনন্দময়ী জগদম্বার উদ্দীপন হইয়া ইন্দ্রিয়সম্পর্কমাত্রশূন্য বিমল আনন্দে একেবারে আত্মহারা হইয়া পড়া! এখনও কি বলিতে হইবে, এ অলৌকিক দেবমানবের কি এমন গুণ দেখিয়া আমাদের চক্ষু চিরকালের মতো ঝলসিত হইয়া গেল, যাহাতে তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার-জ্ঞানে হৃদয়ে আসন দান করিলাম?

ঐ বিষয়ে ১ম দৃষ্টান্ত – রামচন্দ্র দত্তের বাটীতে

ঠাকুরের পরম ভক্ত, পরলোকগত ডাক্তার শ্রীরামচন্দ্র দত্তের সিমলার (কলিকাতা) ভবনে ঠাকুর ভক্তসঙ্গে উপস্থিত হইয়া অনেক সময়ে অনেক আনন্দ করিতেন। একদিন ঐরূপে কিছুকাল ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গে আনন্দ করিয়া দক্ষিণেশ্বরে ফিরিবেন বলিয়া বাহির হইলেন। রামবাবুর বাটীখানি গলির1 ভিতর, বাটীর সম্মুখে গাড়ি আসিতে পারে না। বাটীর কিছু দূরে পূর্বের বা পশ্চিমের বড় রাস্তায় গাড়ি রাখিয়া পদব্রজে বাড়িতে আসিতে হয়। ঠাকুরের যাইবার জন্য একখানি গাড়ি পশ্চিমের বড় রাস্তায় অপেক্ষা করিতেছিল। ঠাকুর সেদিকে হাঁটিয়া চলিলেন, ভক্তেরা তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। কিন্তু ভগবদানন্দে সেদিন ঠাকুর এমন টলমল করিতেছিলেন যে, এখানে পা ফেলিতে ওখানে পড়িতেছে। কাজেই বিনা সাহায্যে ঐ কয়েক পদ যাইতে পারিলেন না। দুই জন ভক্ত দুই দিক হইতে তাঁহার হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে লইয়া যাইতে লাগিল। গলির মোড়ে কতকগুলি লোক দাঁড়াইয়াছিলেন – তাঁহারা ঠাকুরের ব্যাপার বুঝিবেন কিরূপে? আপনাদিগের মধ্যে বলাবলি করিতে লাগিলেন, ‘উঃ! লোকটা কি মাতাল হয়েছে হে!’ কথাগুলি ধীরস্বরে উচ্চারিত হইলেও আমরা শুনিতে পাইলাম। শুনিয়া না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না; আর মনে মনে বলিলাম, ‘তা বটে’।


1. গলির নাম মধু রায়ের গলি।

ঐ ২য় দৃষ্টান্ত – দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমার সম্মুখে

দক্ষিণেশ্বরে একদিন দিনের বেলায় আমাদের পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীকে পান সাজিতে ও তাঁহার বিছানা ঝাড়িয়া ঘরটা ঝাঁটপাট দিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিতে বলিয়া ঠাকুর কালীঘরে শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে দর্শন করিতে যাইলেন। তিনি ক্ষিপ্রহস্তে ঐ সকল কাজ প্রায় শেষ করিয়াছেন, এমন সময় ঠাকুর মন্দির হইতে ফিরিলেন – একেবারে যেন পুরোদস্তুর মাতাল! চক্ষু রক্তবর্ণ, হেথায় পা ফেলিতে হোথায় পড়িতেছে, কথা এড়াইয়া অস্পষ্ট অব্যক্ত হইয়া গিয়াছে! ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া ঐ ভাবে টলিতে টলিতে একেবারে শ্রীশ্রীমার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শ্রীশ্রীমা তখন একমনে গৃহকার্য করিতেছেন, ঠাকুর যে তাঁহার নিকটে ঐ ভাবে আসিয়াছেন তাহা জানিতেও পারেন নাই। এমন সময়ে ঠাকুর মাতালের মতো তাঁহার অঙ্গ ঠেলিয়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ওগো, আমি কি মদ খেয়েছি?” তিনি পশ্চাৎ ফিরিয়া সহসা ঠাকুরকে ঐরূপ ভাবাবস্থ দেখিয়া একেবারে স্তম্ভিত! বলিলেন – ‘না, না, মদ খাবে কেন?’

ঠাকুর – তবে কেন টলচি? তবে কেন কথা কইতে পাচ্চি না? আমি মাতাল?

শ্রীশ্রীমা – না, না, তুমি মদ কেন খাবে? তুমি মা কালীর ভাবামৃত খেয়েছ।

ঠাকুর ‘ঠিক বলেছ’ বলিয়াই আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

ঐ ৩য় দৃষ্টান্ত – কাশীপুরে মাতাল দেখিয়া

কলিকাতার ভক্তদিগের ঠাকুরের নিকট আগমন ও কৃপালাভের পর হইতেই ঠাকুর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দুই একবার কলিকাতায় কোন না কোন ভক্তের বাটীতে গমনাগমন করিতেন। নিয়মিত সময়ে কেহ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইতে না পারিলে এবং অন্য কাহারও মুখে তাহার কুশল-সংবাদ না পাইলে কৃপাময় ঠাকুর স্বয়ং তাহাকে দেখিতে ছুটিতেন। আবার নিয়মিত সময়ে আসিলেও কাহাকেও কাহাকেও দেখিবার জন্য কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিত। তখন তাহাকে দেখিবার জন্য ছুটিতেন। কিন্তু সর্বসময়েই দেখা যাইত, তাঁহার ঐরূপ শুভাগমন সেই সেই ভক্তের কল্যাণের জন্যই হইত। উহাতে তাঁহার নিজের বিন্দুমাত্রও স্বার্থ থাকিত না। বরাহনগরে বেণী সাহার কতকগুলি ভাল ভাড়াটিয়া গাড়ি ছিল। ঠাকুর প্রায়ই কলিকাতা আসিতেন বলিয়া তাহার সহিত বন্দোবস্ত ছিল যে, ঠাকুর বলিয়া পাঠাইলেই সে দক্ষিণেশ্বরে গাড়ি পাঠাইবে এবং কলিকাতা হইতে ফিরিতে যত রাত্রিই হউক না কেন গোলমাল করিবে না; অধিক সময়ের জন্য নিয়মিত হারে অধিক ভাড়া পাইবে। প্রথমে মথুরবাবু, পরে পানিহাটির মণি সেন, পরে শম্ভু মল্লিক এবং তৎপরে কলিকাতা সিঁদুরিয়াপটির শ্রীযুক্ত জয়গোপাল সেন ঠাকুরের ঐ সকল গাড়িভাড়ার খরচ যোগাইতেন। তবে যাঁহার বাটীতে যাইতেন, পারিলে সেদিনকার গাড়িভাড়া তিনিই দিতেন।

আজ ঠাকুর ঐরূপে কলিকাতায় যাইবেন – যদু মল্লিকের বাটীতে। মল্লিক মহাশয়ের মাতাঠাকুরানী ঠাকুরকে বিশেষ ভক্তি করিতেন – তাঁহাকে দেখিয়া আসিবেন; কারণ, অনেক দিন তাঁহাদের কোন সংবাদ পান নাই। ঠাকুরের আহারাদি হইয়া গিয়াছে, গাড়ি আসিয়াছে। এমন সময় আমাদের বন্ধু অ – কলিকাতা হইতে নৌকা করিয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর অ-কে দেখিয়াই কুশল-প্রশ্নাদি করিয়া বলিলেন, “তা বেশ হয়েছে, তুমি এসেছ। আজ আমি যদু মল্লিকের বাড়িতে যাচ্চি; অমনি তোমাদের বাড়িতেও নেবে একবার গি-কে দেখে যাব; সে কাজের ভিড়ে অনেক দিন এদিকে আসতে পারেনি। চল, একসঙ্গেই যাওয়া যাক।” অ – সম্মত হইলেন। অ-র তখন ঠাকুরের সহিত নূতন আলাপ, কয়েকবার মাত্র নানা স্থানে তাঁহাকে দেখিয়াছেন। অদ্ভুত ঠাকুরের, আমরা যাহাকে তুচ্ছ, ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য বা দর্শনাযোগ্য বস্তু ও ব্যক্তি বলি, সে সকলকে দেখিয়াও যে ঈশ্বরোদ্দীপনায় ভাবসমাধি যেখানে সেখানে যখন তখন উপস্থিত হইয়া থাকে, অ – তাহা তখনও সবিশেষ জানিতে পারেন নাই।

এইবার ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। যুবক ভক্ত লাটু, যিনি এখন স্বামী অদ্ভুতানন্দ নামে সকলের পরিচিত, ঠাকুরের বেটুয়া, গামছাদি আবশ্যক দ্রব্য সঙ্গে লইয়া ঠাকুরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া গাড়িতে উঠিলেন; আমাদের বন্ধু অ-ও উঠিলেন; গাড়ির একদিকে ঠাকুর বসিলেন এবং অন্যদিকে লাটু মহারাজ ও অ – বসিলেন। গাড়ি ছাড়িল এবং ক্রমে বরাহনগরের বাজার ছাড়াইয়া মতিঝিলের পার্শ্ব দিয়া যাইতে লাগিল। পথিমধ্যে বিশেষ কোন ঘটনাই ঘটিল না। ঠাকুর রাস্তায় এটা ওটা দেখিয়া কখনও কখনও বালকের ন্যায় লাটু বা অ-কে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন; অথবা এ কথা সে কথা তুলিয়া সাধারণ সহজ অবস্থায় যেরূপ হাস্য-পরিহাসাদি করিতেন, সেইরূপ করিতে করিতে চলিলেন।

মতিঝিলের দক্ষিণে একটি সামান্য বাজার গোছ ছিল; তাহার দক্ষিণে একখানি মদের দোকান, একটি ডাক্তারখানা এবং কয়েকখানি খোলার ঘরে চালের আড়ত, ঘোড়ার আস্তাবল ইত্যাদি ছিল। ঐ সকলের দক্ষিণেই এখানকার প্রাচীন সুপ্রসিদ্ধ দেবীস্থান ৺সর্বমঙ্গলা ও ৺চিত্রেশ্বরী দেবীর মন্দিরে যাইবার প্রশস্ত পথ ভাগীরথীতীর পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। ঐ পথটিকে দক্ষিণে রাখিয়া কলিকাতার দিকে অগ্রসর হইতে হয়।

মদের দোকানে অনেকগুলি মাতাল তখন বসিয়া সুরাপান ও গোলমাল হাস্য-পরিহাস করিতেছিল। তাহাদের কেহ কেহ আবার আনন্দে গান ধরিয়াছিল; আবার কেহ কেহ অঙ্গভঙ্গী করিয়া নৃত্য করিতেও ব্যাপৃত ছিল। আর দোকানের স্বত্বাধিকারী নিজ ভৃত্যকে তাহাদের সুরাবিক্রয় করিতে লাগাইয়া আপনি দোকানের দ্বারে অন্যমনে দাঁড়াইয়াছিল। তাহার কপালে বৃহৎ এক সিন্দুরের ফোঁটাও ছিল। এমন সময় ঠাকুরের গাড়ি দোকানের সম্মুখ দিয়া যাইতে লাগিল। দোকানী বোধ হয় ঠাকুরের বিষয় জ্ঞাত ছিল; কারণ, ঠাকুরকে দেখিতে পাইয়াই হাত তুলিয়া প্রণাম করিল।

গোলমালে ঠাকুরের মন দোকানের দিকে আকৃষ্ট হইল এবং মাতালদের ঐরূপ আনন্দ-প্রকাশ তাঁহার চক্ষে পড়িল। কারণানন্দ দেখিয়াই অমনি ঠাকুরের মনে জগৎকারণের আনন্দস্বরূপের উদ্দীপনা! – খালি উদ্দীপনা নহে, সেই অবস্থার অনুভূতি আসিয়া ঠাকুর একেবারে নেশায় বিভোর, কথা এড়াইয়া যাইতেছে। আবার শুধু তাহাই নহে, সহসা নিজ শরীরের কিয়দংশ ও দক্ষিণ পদ বাহির করিয়া গাড়ির পাদানে পা রাখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া মাতালের ন্যায় তাহাদের আনন্দে আনন্দ প্রকাশ করিতে করিতে হাত নাড়িয়া অঙ্গভঙ্গী করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন – “বেশ হচ্চে, খুব হচ্চে, বা, বা, বা।”

অ – বলেন, “ঠাকুরের যে সহসা ঐরূপ ভাব হইবে, ইহার কোন আভাসই পূর্বে আমরা পাই নাই; বেশ সহজ মানুষের মতোই কথাবার্তা কহিতেছিলেন। মাতাল দেখিয়াই একেবারে হঠাৎ ঐ রকম অবস্থা! আমি তো ভয়ে আড়ষ্ট; তাড়াতাড়ি শশব্যস্তে, ধরিয়া গাড়ির ভিতর তাঁহার শরীরটা টানিয়া আনিয়া তাঁহাকে বসাইব ভাবিয়া হাত বাড়াইয়াছি, এমন সময় লাটু বাধা দিয়া বলিল, ‘কিছু করতে হবে না, উনি আপনা হতেই সামলাবেন, পড়ে যাবেন না।’ কাজেই চুপ করিলাম, কিন্তু বুকটা ঢিপ ঢিপ করিতে লাগিল; আর ভাবিলাম, এ পাগলা ঠাকুরের সঙ্গে এক গাড়িতে আসিয়া কি অন্যায় কাজই করিয়াছি! আর কখনও আসিব না। অবশ্য এত কথা বলিতে যে সময় লাগিল, তদপেক্ষা ঢের অল্প সময়ের ভিতরই ঐ সব ঘটনা হইল এবং গাড়িও ঐ দোকান ছাড়াইয়া চলিয়া আসিল। তখন ঠাকুরও পূর্ববৎ গাড়ির ভিতরে স্থির হইয়া বসিলেন এবং ৺সর্বমঙ্গলাদেবীর মন্দির দেখিতে পাইয়া বলিলেন, ‘ঐ সর্বমঙ্গলা বড় জাগ্রত ঠাকুর, প্রণাম কর।’ ইহা বলিয়া স্বয়ং প্রণাম করিলেন, আমরাও তাঁহার দেখাদেখি দেবীর উদ্দেশে প্রণাম করিলাম। প্রণাম করিয়া ঠাকুরের দিকে দেখিলাম – যেমন তেমনি, বেশ প্রকৃতিস্থ। মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। আমার কিন্তু ‘এখনি পড়িয়া গিয়া একটা খুনোখুনি ব্যাপার হইয়াছিল আর কি’ – ভাবিয়া সে বুক-ঢিপঢিপানি অনেকক্ষণ থামিল না!

“তারপর গাড়ি বাড়ির দুয়ারে আসিয়া লাগিলে, আমাকে বলিলেন, ‘গি – বাড়িতে আছে কি? দেখে এস দেখি।’ আমিও জানিয়া আসিয়া বলিলাম, ‘না’। তখন বলিলেন, ‘তাই তো গি-র সঙ্গে দেখা হলো না, ভেবেছিলাম, তাকে আজকের বেশি ভাড়াটা দিতে বলব। তা তোমার সঙ্গে তো এখন জানাশুনা হয়েছে, বাবু, তুমি একটা টাকা দেবে? কি জান, যদু মল্লিক কৃপণ লোক; সে সেই বরাদ্দ দু টাকা চার আনার বেশি গাড়িভাড়া কখনো দেবে না। আমার কিন্তু বাবু একে ওকে দেখে ফিরতে কত রাত হবে তা কে জানে? বেশি দেরি হলেই আবার গাড়োয়ান ‘চল, চল’ করে দিক্ করে। তাই বেণীর সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়েছে, ফিরতে যত রাতই হোক না কেন, তিন টাকা চার আনা দিলেই গাড়োয়ান আর গোল করবে না। যদু দুই টাকা চার আনা দেবে, আর তুমি একটা টাকা দিলেই আজকের ভাড়ার আর কোন গোল রইল না; এই জন্যে বলছি।’ আমি ঐ সব শুনে একটা টাকা লাটুর হাতে দিলাম এবং ঠাকুরকে প্রণাম করিলাম। ঠাকুরও যদু মল্লিককে দেখিতে গেলেন।”

ঠাকুরের এইরূপ বাহ্যদৃষ্টে মাতালের ন্যায় অবস্থা নিত্যই যখন তখন আসিয়া উপস্থিত হইত। তাহার কয়টা কথাই বা আমরা লিপিবদ্ধ করিয়া পাঠককে বলিতে পারি।

দক্ষিণেশ্বরে আগত সকল সম্প্রদায়ের সাধুদেরই ঠাকুরের নিকট ধর্মবিষয়ে সহায়তা-লাভ

রাসমণির কালীবাড়িতে পূর্বোক্ত প্রকারে যত সাধু সাধক আসিতেন, তাঁহাদের কথা ঠাকুর ঐরূপে অনেক সময় অনেকের কাছেই গল্প করিতেন; কেবল যে আমাদের কাছেই করিয়াছিলেন তাহা নহে। ঐ সকল বিষয়ে সাক্ষ্য দিবার এখনও অনেক লোক জীবিত। আমরা তখন সেন্ট্ জেভিয়ার কলেজে পাঠ করি। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও রবিবার দুই দিন কলেজ বন্ধ থাকিত। শনি ও রবিবারে ঠাকুরের নিকট অনেক ভক্তের ভিড় হইত বলিয়া আমরা বৃহস্পতিবারেও তাঁহার নিকট যাইতাম এবং উহাতে তাঁহার জীবনের নানা কথা তাঁহার শ্রীমুখ হইতে শুনিবার বেশ সুবিধা হইত। ঐ সকল কথা শুনিয়া আমরা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, ভৈরবী ব্রাহ্মণী, তোতাপুরী স্বামীজী, মুসলমান গোবিন্দ – যিনি কৈবর্তজাতীয় ছিলেন1, পূর্ণ নির্বিকল্প ভূমিতে ছয় মাস থাকিবার সময় জোর করিয়া আহার করাইয়া ঠাকুরের শরীররক্ষা করিবার জন্য যে সাধুটি দৈবপ্রেরিত হইয়া কালীবাটীতে আগমন করেন তিনি এবং ঐরূপ আরও দুই একটি ছাড়া নানা সম্প্রদায়ের অপর যত সাধু-সাধকসকল ঠাকুরের নিকটে আমরা যাইবার পূর্বে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রত্যেকেই ঠাকুরের অদ্ভুত অলৌকিক জীবনালোকের সহায়ে নিজ নিজ ধর্মজীবনে নবপ্রাণ-সঞ্চারলাভের জন্যই আসিয়াছিলেন, এবং তল্লাভে স্বয়ং কৃতার্থ হইয়া ঐ ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত যথার্থ ধর্মপিপাসু সাধকসকলকে সেই সেই পথ দিয়া কেমন করিয়া ঈশ্বরলাভ করিতে হইবে তাহাই দেখাইবার অবসর লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা শিখিতেই আসিয়াছিলেন এবং শিক্ষা পূর্ণ করিয়া যে যাঁহার স্থানে চলিয়া গিয়াছিলেন। ভৈরবী ব্রাহ্মণী এবং তোতাপুরী প্রভৃতিও বহু ভাগ্যে ঠাকুরের ধর্মজীবনের সহায়ক-স্বরূপে আগমন করিলেও এতকাল ধরিয়া সাধনা করিয়াও নিজ নিজ ধর্মজীবনে যে সকল নিগূঢ় আধ্যাত্মিক সত্যের উপলব্ধি করিতে পারিতেছিলেন না, ঠাকুরের অলৌকিক জীবন ও শক্তিবলে সে সকল সত্য প্রত্যক্ষ করিয়া ধন্য হইয়া গিয়াছিলেন।


1. সাধকভাব (১০ম সংস্করণ) দ্রষ্টব্য – প্রঃ।

ঠাকুর যে ধর্মমতে যখন সিদ্ধিলাভ করিতেন তখন ঐ সম্প্রদায়ের সাধুরাই তাঁহার নিকট আসিত

আবার এই সকল সাধু ও সাধকদিগের দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট আগমনের ক্রম বা পারম্পর্য আলোচনা করিলে আর একটি বিশেষ সত্যের উপলব্ধি করিতে বিলম্ব হয় না। তাঁহাদের ঐরূপ আগমনক্রমের কথা আলোচনা করিবার সুবিধা হইবে বলিয়াই আমরা বর্তমান প্রবন্ধে ঠাকুরের শ্রীমুখে যেমন শুনিয়াছিলাম, সেই ভাবে যতদূর সম্ভব তাঁহার নিজের ভাষায় তিনি যেমন করিয়া ঐ সকল কথা আমাদের বলিয়াছিলেন, সেই প্রকারে ঐ সকল কথা পাঠককে বলিবার প্রয়াস পাইয়াছি। ঠাকুরের শ্রীমুখে যাহা শুনিয়াছি, তাহাতে বুঝা যায় যে, তিনি এক এক ভাবের উপাসনা ও সাধনায় লাগিয়া ঈশ্বরের ঐ ঐ ভাবের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যেমন যেমন করিতেন, অমনি সেই সেই সম্প্রদায়ের যথার্থ সাধকেরা সেই সেই সময়ে দলে দলে তাঁহার নিকট কিছুকাল ধরিয়া আগমন করিতেন এবং তাঁহাদের সহিত ঠাকুরের ঐ ঐ ভাবের আলোচনায় তখন তখন দিবারাত্র কাটিয়া যাইত। রামমন্ত্রের উপাসনায় যেমন সিদ্ধিলাভ করিলেন, অমনি দলে দলে রামাইৎ সাধুরা তাঁহার নিকট আগমন করিতে লাগিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবতন্ত্রোক্ত শান্ত দাস্যাদি এক-একটি ভাবে যেমন যেমন সিদ্ধিলাভ করিলেন, অমনি সেই সেই ভাবের সাধকদিগের আগমন হইতে লাগিল। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর সহায়ে চৌষট্টীখানা তন্ত্রোক্ত সকল সাধন যখন সাঙ্গ করিয়া ফেলিলেন বা শক্তিসাধনায় সিদ্ধিলাভ করিলেন, অমনি সে সময়ের এ প্রদেশের যাবতীয় বিশিষ্ট তান্ত্রিক সাধকসকল তাঁহার নিকট আগমন করিতে লাগিলেন। পুরী গোস্বামীর সহায়ে অদ্বৈতমতের ব্রহ্মোপাসনা ও উপলব্ধিতে যেমন সিদ্ধিলাভ করিলেন, অমনি পরমহংস সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট সাধকেরা তাঁহার সমীপে দলে দলে আগমন করিতে লাগিলেন।

সকল অবতারপুরুষের সমান শক্তি-প্রকাশ দেখা যায় না, কারণ তাঁহাদের কেহ বা জাতিবিশেষকে ও কেহ বা সমগ্র মানবজাতিকে ধর্মদান করিতে আসেন

ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধককুলের ঐ ভাবে ঐ ঐ সময়ে ঠাকুরের দেবসঙ্গ-লাভ করিবার যে একটা বিশেষ গূঢ় অর্থ আছে তাহা বালকেরও বুঝিতে দেরি লাগিবে না। যুগাবতারের শুভাগমনে জগতে সর্বকালেই এইরূপ হইয়া আসিয়াছে এবং পরেও হইবে। তাঁহারা আধ্যাত্মিক জগতের গূঢ় নিয়মানুসারে ধর্মের গ্লানি দূর করিবার জন্য বা নির্বাপিতপ্রায় ধর্মালোককে পুনরুজ্জীবিত করিবার জন্য সর্বকালে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন। তবে তাঁহাদের জীবনালোচনায় তাঁহাদের ভিতরে অল্পাধিক পরিমাণে শক্তিপ্রকাশের তারতম্য দেখিয়া ইহা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তাঁহাদের কেহ বা কোন প্রদেশ-বিশেষের বা দুই-চারিটি সম্প্রদায়-বিশেষের অভাবমোচনের জন্য আগমন করিয়াছেন; আবার কেহ বা সমগ্র পৃথিবীর ধর্মাভাব-মোচনের জন্য শুভাগমন করিয়াছেন। কিন্তু সর্বত্রই তাঁহারা তাঁহাদের পূর্ববর্তী ঋষি, আচার্য ও অবতারকুলের দ্বারা আবিষ্কৃত ও প্রচারিত আধ্যাত্মিক মত-সকলের মর্যাদা সম্যক্ রক্ষা করিয়া, সে সকলকে বজায় রাখিয়া, নিজ নিজ আবিষ্কৃত উপলব্ধি ও মতের প্রচার করিয়াছেন, দেখা গিয়া থাকে। কারণ তাঁহারা তাঁহাদের দিব্যযোগশক্তিবলে পূর্ব পূর্ব কালের আধ্যাত্মিক মতসকলের ভিতর একটা পারম্পর্য ও সম্বন্ধ দেখিতে পাইয়া থাকেন। আমাদের বিষয়-মলিন দৃষ্টির সম্মুখে ভাবরাজ্যের সে ইতিহাস, সে সম্বন্ধ সর্বদা অপ্রকাশিতই থাকে। তাঁহারা পূর্ব পূর্ব ধর্মমতসকলকে ‘সূত্রে মণিগণা ইব’ এক সূত্রে গাঁথা দেখিতে পান এবং নিজ ধর্মোপলব্ধি-সহায়ে সেই মালার অঙ্গই সম্পূর্ণ করিয়া যান।

হিন্দু, য়াহুদী, ক্রীশ্চান ও মুসলমান ধর্মপ্রবর্তক অবতারপুরুষদিগের আধ্যাত্মিক শক্তি-প্রকাশের সহিত ঠাকুরের ঐ বিষয়ে তুলনা

বৈদেশিক ধর্মমতসকলের আলোচনায় এ বিষয়টি আমরা বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারিব। দেখ, ইহুদি আচার্যেরা যে সকল ধর্মবিষয়ক সত্য প্রচার করিয়া গিয়াছিলেন, ঈশা আসিয়া সে সকল বজায় রাখিয়া নিজোপলব্ধ সত্যসকল প্রচার করিলেন। আবার কয়েক শতাব্দী পরে মহম্মদ আসিয়া ঈশা-প্রচারিত মতসকল বজায় রাখিয়া নিজ মত প্রচার করিলেন। ইহাতে এরূপ বুঝায় না যে, ইহুদি আচার্যগণ বা ঈশা-প্রচারিত মত অসম্পূর্ণ; বা ঐ ঐ মতাবলম্বনে চলিয়া তাঁহারা প্রত্যেকে ঈশ্বরের যে ভাবের উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহা করা যায় না। তাহা নিশ্চয়ই করা যায়; আবার মহম্মদ-প্রচারিত মতাবলম্বনে চলিয়া তিনি যে ভাবে ঈশ্বরের উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহাও করা যায়। আধ্যাত্মিক জগতের সর্বত্র ইহাই নিয়ম। ভারতীয় ধর্মমতসকলের মধ্যেও ঐরূপ ভাব বুঝিতে হইবে। ভারতের বৈদিক ঋষি, পুরাণকার এবং তন্ত্রকার আচার্য মহাপুরুষেরা যে সকল মত প্রচার করিয়া গিয়াছেন, তাহাদের যেটি যেটি ঠিক ঠিক অবলম্বন করিয়া তুমি চলিবে, সেই সেই পথ দিয়াই ঈশ্বরের তত্তদ্ভাবের উপলব্ধি করিতে পারিবে। ঠাকুর একাদিক্রমে সকল সম্প্রদায়োক্ত মতে সাধনায় লাগিয়া উহাই উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং উহাই আমাদের শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন।

ঠাকুরের নিকট সকল সম্প্রদায়ের সাধু-সাধকদিগের আগমন-কারণ

ফুল ফুটিলেই ভ্রমর আসিয়া জুটে – আধ্যাত্মিক জগতেও যে ইহাই নিয়ম, ঠাকুর সে কথা আমাদের বারংবার বলিয়া গিয়াছেন। ঐ নিয়মেই, অবতার মহাপুরুষদিগের জীবনে যখন সিদ্ধিলাভ বা আধ্যাত্মিক জগতের সত্যোপলব্ধি, অমনি উহা জানিবার শিখিবার জন্য ধর্মপিপাসুগণের তাঁহাদিগের নিকট আকৃষ্ট হওয়া – ইহা সর্বত্র দেখিতে পাওয়া যায়। ঠাকুরের নিকটে একই সম্প্রদায়ের সাধককুল না আসিয়া যে, সকল সম্প্রদায়ের সাধকেরাই দলে দলে আসিয়াছিলেন তাহার কারণ – তিনি তত্তৎ সকল পথ দিয়াই অগ্রসর হইয়া তত্তৎ ঈশ্বরীয় ভাবের সম্যক উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং ঐ ঐ পথের সংবাদ বিশেষরূপে বলিতে পারিতেন। তবে ঐ সকল সাধকদিগের সকলেই যে নিজ নিজ মতে সিদ্ধ হইয়াছিলেন এবং ঠাকুরকে যুগাবতার বলিয়া ধরিতে পারিয়াছিলেন, তাহা নহে; তাঁহাদের ভিতর যাঁহারা বিশিষ্ট তাঁহারাই উহা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকেই ঠাকুরের দিব্যসঙ্গগুণে নিজ নিজ পথে অধিকতর অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং ঐ ঐ পথ দিয়া চলিলে যে কালে ঈশ্বরকে লাভ করিবেন নিশ্চয়, ইহা ধ্রুব সত্যরূপে বুঝিতে পারিয়াছিলেন। নিজ নিজ পথের উপর ঐরূপ বিশ্বাসের হানি হওয়াতেই যে ধর্মগ্লানি উপস্থিত হয় এবং সাধক নিজ জীবনে ধর্মোপলব্ধি করিতে পারে না, ইহা আর বলিতে হইবে না।

দক্ষিণেশ্বরাগত সাধুদিগের সঙ্গলাভেই ঠাকুরের ভিতর ধর্ম-প্রবৃত্তি জাগিয়া উঠে – একথা সত্য নহে

আজকাল একটা কথা উঠিয়াছে যে, ঠাকুর ঐ সকল সাধুদের নিকট হইতেই ঈশ্বর-সাধনার উপায়সকল জানিয়া লইয়া স্বয়ং উগ্র তপস্যায় প্রবৃত্ত হন এবং তপস্যার কঠোরতায় এক সময়ে সম্পূর্ণ পাগল হইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল এবং কোনরূপ ভাবের আতিশয্যে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হওয়ারূপ একটা শারীরিক রোগও চিরকালের মতো তাঁহার শরীরে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল। হে ভগবান, এমন পণ্ডিত-মূর্খের দলও আমরা! পূর্ণ চিত্তৈকাগ্রতা-সহায়ে সমাধি-ভূমিতে আরোহণ করিলেই যে সাধারণ বাহ্যচৈতন্যের লোপ হয়, এ কথা ভারতের ঋষিকুল বেদ, পুরাণ, তন্ত্রাদি-সহায়ে আমাদের যুগে যুগে বুঝাইয়া আসিলেন ও নিজ নিজ জীবনে উহা দেখাইয়া যাইলেন, সমাধি-শাস্ত্রের পূর্ণ ব্যাখ্যা – যাহা পৃথিবীর কোন দেশে কোন জাতির ভিতরেই বিদ্যমান নাই – আমাদের জন্য রাখিয়া যাইলেন; সংসারে এ পর্যন্ত অবতার বলিয়া সর্বদেশে মানব-হৃদয়ের শ্রদ্ধা পাইতেছেন যত মহাপুরুষ তাঁহারাও নিজ নিজ জীবনে প্রত্যক্ষ করিয়া ঐরূপ বাহ্যজ্ঞানলোপটা যে আধ্যাত্মিক উন্নতির সহিত অবশ্যম্ভাবী, সে কথা আমাদের ভূয়োভূয়ঃ বুঝাইয়া যাইলেন, তথাপি যদি আমরা ঐ কথা বলি এবং ঐরূপ কথা শুনি, তবে আর আমাদের দশা কি হইবে? হে পাঠক, ভাল বুঝ তো তুমি ঐ সকল অন্তঃসারশূন্য কথা শ্রদ্ধার সহিত শ্রবণ কর; তোমার এবং যাঁহারা ঐরূপ বলেন তাঁহাদের মঙ্গল হউক! আমাদের কিন্তু এ অদ্ভুত দিব্য পাগলের পদপ্রান্তে পড়িয়া থাকিবার স্বাধীনতাটুকু কৃপা করিয়া প্রদান করিও, ইহাই তোমার নিকট আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ বা ভিক্ষা। কিন্তু যাহা হয় একটা স্থিরনিশ্চয় করিবার অগ্রে ভাল করিয়া আর একবার বুঝিয়া দেখিও; প্রাচীন উপনিষদ্কার যেমন বলিয়াছেন, সেরূপ অবস্থা তোমার না আসিয়া উপস্থিত হয়! –

অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ স্বয়ং ধীরাঃ পণ্ডিতম্মন্যমানাঃ।
দন্দ্রম্যমাণাঃ পরিয়ন্তি মূঢ়া অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ॥

ঠাকুরের ভাবসমাধিসমূহকে রোগবিশেষ বলাটা আজ কিছু নূতন কথা নহে! তাঁহার বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যভাবে শিক্ষিত অনেকে ওকথা বলিতেন। পরে যত দিন যাইতে লাগিল, এবং এ দিব্য পাগলের ভবিষ্যদ্বাণীরূপে উচ্চারিত পাগলামিগুলি যতই পূর্ণ হইতে লাগিল এবং তাঁহার অদৃষ্টপূর্ব ভাবগুলি পৃথিবীময় সাধারণে যতই সাগ্রহে গ্রহণ করিতে লাগিল, ততই ও কথাটার আর জোর থাকিল না। চন্দ্রে ধূলিনিক্ষেপের যে ফল হয় তাহাই হইল এবং লোকে ঐ সকল ভ্রান্ত উক্তির সম্যক পরিচয় পাইয়া ঠাকুরের কথাই সত্য জানিয়া স্থির হইয়া রহিল। এখনও তাহাই হইবে। কারণ সত্য কখনও অগ্নির ন্যায় বস্ত্রে আবৃত করিয়া রাখা যায় না। অতএব ঐ বিষয়ে আর আমাদের বুঝাইবার প্রয়াসের আবশ্যক নাই। ঠাকুর নিজেই ঐ সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা বলিতেন, তাহাই বলিয়া ক্ষান্ত থাকিব।

ঠাকুরের সমাধিতে বাহ্যজ্ঞানলোপ হওয়াটা ব্যাধি নহে; প্রমাণ – ঠাকুর ও শিবনাথ-সংবাদ

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আচার্যদিগের মধ্যে অন্যতম, শ্রদ্ধাস্পদ শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় ঠাকুরের ভাবসমাধিটা স্নায়ুবিকার-প্রসূত রোগ-বিশেষ (hysteria or epileptic fits) বলিয়া তখন হইতেই আমাদের কাহারও কাহারও নিকট নির্দেশ করিতেন এবং ঐ সঙ্গে এরূপ মতও প্রকাশ করিতেন যে, ঐ সময়ে ঠাকুর, ইতরসাধারণে ঐ রোগগ্রস্ত হইয়া যেমন অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়ে, সেইরূপ হইয়া যান! ঠাকুরের কর্ণে ক্রমে সে কথা উঠে। শাস্ত্রী মহাশয় বহু পূর্ব হইতে ঠাকুরের নিকট মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিতেন। একদিন তিনি যখন দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত আছেন, তখন ঠাকুর ঐ কথা উত্থাপিত করিয়া শাস্ত্রী মহাশয়কে বলেন, “হ্যাঁ শিবনাথ, তুমি নাকি এগুলোকে রোগ বল? আর বল যে ঐ সময় অচৈতন্য হয়ে যাই? তোমরা ইট, কাঠ, মাটি, টাকাকড়ি এই সব জড় জিনিসগুলোতে দিনরাত মন রেখে ঠিক থাকলে, আর যাঁর চৈতন্যে জগৎ-সংসারটা চৈতন্যময় হয়ে রয়েছে, তাঁকে দিনরাত ভেবে আমি অজ্ঞান অচৈতন্য হলুম! এ কোনদিশি বুদ্ধি তোমার?” শিবনাথবাবু নিরুত্তর হইয়া রহিলেন।

সাধনকালে ঠাকুরের উন্মত্তবৎ আচরণের কারণ

ঠাকুর ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘জ্ঞানোন্মাদ’ প্রভৃতি কথা আমাদের নিকট নিত্য প্রয়োগ করিতেন এবং মুক্তকণ্ঠে সকলের নিকট বলিতেন যে, তাঁহার জীবনে বার বৎসর ধরিয়া ঈশ্বরানুরাগের একটা প্রবল ঝটিকা বহিয়া গিয়াছে। বলিতেন, “ঝড়ে ধুলো উড়ে যেমন সব একাকার দেখায় – এটা আমগাছ, ওটা কাঁঠালগাছ বলে বুঝা দূরে থাক, দেখাও যায় না, সেই-রকমটা হয়েছিল রে; ভাল-মন্দ, নিন্দা-স্তুতি, শৌচ-অশৌচ এ-সকলের কোনটাই বুঝতে দেয়নি! কেবল এক চিন্তা, এক ভাব – কেমন করে তাঁকে পাব, এইটেই মনে সদা-সর্বক্ষণ থাকত! লোকে বলত – পাগল হয়েছে!” যাক এখন সে কথা, আমরা পূর্বানুসরণ করি।

দক্ষিণেশ্বরাগত সাধকদিগের মধ্যে কেহ কেহ ঠাকুরের নিকট দীক্ষাও গ্রহণ করেন; যথা – নারায়ণ শাস্ত্রী

দক্ষিণেশ্বরে তখন তখন যে সকল সাধক পণ্ডিত ঠাকুরের নিকট আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের ভিতর কেহ কেহ আবার ভক্তির আতিশয্যে ঠাকুরের নিকট হইতে দীক্ষা এবং সন্ন্যাস পর্যন্ত লইয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী উঁহাদেরই অন্যতম। ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি, নারায়ণ শাস্ত্রী প্রাচীন যুগের নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারীদিগের ন্যায় গুরুগৃহে অবস্থান করিয়া একাদিক্রমে পঁচিশ বৎসর স্বাধ্যায় বা নানা শাস্ত্র পাঠ করিয়াছিলেন। শুনিয়াছি, ষড়দর্শনের সকলগুলির উপরই সমান অভিজ্ঞতা ও আধিপত্য লাভ করিবার প্রবল বাসনা বরাবর তাঁহার প্রাণে ছিল। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কাশী প্রভৃতি নানা স্থানে নানা গুরুগৃহে বাস করিয়া পাঁচটি দর্শন তিনি সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু বঙ্গদেশের নবদ্বীপের সুপ্রসিদ্ধ নৈয়ায়িকদিগের অধীনে ন্যায়দর্শনের পাঠ সাঙ্গ না করিলে ন্যায়দর্শনে পূর্ণাধিপত্য লাভ করিয়া প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িকমধ্যে পরিগণিত হওয়া অসম্ভব, এজন্য দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট আসিবার প্রায় আট বৎসর পূর্বে এ দেশে আগমন করেন এবং সাত বৎসর কাল নবদ্বীপে থাকিয়া ন্যায়ের পাঠ সাঙ্গ করেন। এইবার দেশে ফিরিয়া যাইবেন। আবার এদিকে কখনও আসিবেন কিনা সন্দেহ, এইজন্যই বোধ হয় কলিকাতা এবং তৎসন্নিকট দক্ষিণেশ্বরদর্শনে আসিয়া ঠাকুরের দর্শন লাভ করেন।

শাস্ত্রীজীর পূর্বকথা

বঙ্গদেশে ন্যায় পড়িতে আসিবার পূর্বেই শাস্ত্রীজীর দেশে পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতি হইয়াছিল। ঠাকুরের নিকটেই শুনিয়াছি, এক সময়ে জয়পুরের মহারাজ শাস্ত্রীজীর নাম শুনিয়া সভাপণ্ডিত করিয়া রাখিবেন বলিয়া উচ্চহারে বেতন নিরূপিত করিয়া তাঁহাকে সাদরে আহ্বান করিয়াছিলেন। কিন্তু শাস্ত্রীজীর তখনও জ্ঞানার্জনের স্পৃহা কমে নাই এবং ষড়দর্শন আয়ত্ত করিবার প্রবল আগ্রহও মিটে নাই। কাজেই তিনি মহারাজের সাদরাহ্বান প্রত্যাখ্যান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। শাস্ত্রীর পূর্বাবাস রাজপুতানা অঞ্চলের নিকট বলিয়াই আমাদের অনুমান।

ঐ পাঠসাঙ্গ ও ঠাকুরের দর্শনলাভ

এদিকে আবার নারায়ণ শাস্ত্রী সাধারণ পণ্ডিতদিগের মতো ছিলেন না। শাস্ত্রজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার মনে অল্পে অল্পে বৈরাগ্যের উদয় হইতেছিল। কেবল পাঠ করিয়াই যে বেদান্তাদি শাস্ত্রে কাহারও দখল জন্মিতে পারে না, উহা যে সাধনার জিনিস তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং সেজন্য পাঠ সাঙ্গ করিবার পূর্বেই মধ্যে মধ্যে তাঁহার এক একবার মনে উঠিত – এরূপে তো ঠিক ঠিক জ্ঞানলাভ হইতেছে না, কিছুদিন সাধনাদি করিয়া শাস্ত্রে যাহা বলিয়াছে, তাহা প্রত্যক্ষ করিবার চেষ্টা করিব। আবার একটা বিষয় আয়ত্ত করিতে বসিয়াছেন, সেটাকে অর্ধপথে ছাড়িয়া সাধনাদি করিতে যাইলে পাছে এদিক ওদিক দুই দিক যায়, সেজন্য সাধনায় লাগিবার বাসনাটা চাপিয়া আবার পাঠেই মনোনিবেশ করিতেন। এইবার তাঁহার এতকালের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে, ষড়দর্শনে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন; এখন দেশে ফিরিবার বাসনা। সেখানে ফিরিয়া যাহা হয় একটা করিবেন, এই কথা মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছেন। এমন সময় তাঁহার ঠাকুরের সহিত দেখা এবং দেখিয়াই কি জানি কেন তাঁহাকে ভাল লাগা।

পূর্বেই বলিয়াছি, দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে তখন তখন অতিথি, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের থাকিবার এবং খাইবার বেশ সুবন্দোবস্ত ছিল। শাস্ত্রীজী একে বিদেশী ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণ, তাহাতে আবার সুপণ্ডিত, কাজেই তাঁহাকে যে ওখানে সসম্মানে তাঁহার যতদিন ইচ্ছা থাকিতে দেওয়া হইবে ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। আহারাদি সকল বিষয়ের অনুকূল এমন রমণীয় স্থানে এমন দেবমানবের সঙ্গ! – শাস্ত্রীজী কিছুকাল এখানে কাটাইয়া যাইবেন স্থির করিলেন। আর না করিয়াই বা করেন কি? ঠাকুরের সহিত যতই পরিচয় হইতে লাগিল, ততই তাঁহার প্রতি কেমন একটা ভক্তি ভালবাসার উদয় হইয়া তাঁহাকে আরও বিশেষভাবে দেখিতে জানিতে ইচ্ছা দিন দিন শাস্ত্রীর প্রবল হইতে লাগিল। ঠাকুরও সরলহৃদয় উন্নতচেতা শাস্ত্রীকে পাইয়া বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিতে এবং অনেক সময় তাঁহার সহিত ঈশ্বরীয় কথায় কাটাইতে লাগিলেন।

ঠাকুরের দিব্যসঙ্গে শাস্ত্রীর সঙ্কল্প

শাস্ত্রীজী বেদান্তোক্ত সপ্তভূমিকার কথা পড়িয়াছিলেন। শাস্ত্রদৃষ্টে জানিতেন, একটির পর একটি করিয়া নিম্ন হইতে উচ্চ উচ্চতর ভূমিকায় যেমন যেমন মন উঠিতে থাকে অমনি বিচিত্র বিচিত্র উপলব্ধি ও দর্শন হইতে হইতে শেষে নির্বিকল্পসমাধি আসিয়া উপস্থিত হয় এবং ঐ অবস্থায় অখণ্ড সচ্চিদানন্দস্বরূপ ব্রহ্মবস্তুর সাক্ষাৎ উপলব্ধিতে তন্ময় হইয়া মানবের যুগযুগান্তরাগত সংসারভ্রম এককালে তিরোহিত হইয়া যায়। শাস্ত্রী দেখিলেন, তিনি যে সকল কথা শাস্ত্রে পড়িয়া কণ্ঠস্থ করিয়াছেন মাত্র, ঠাকুর সেই সকল জীবনে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। দেখিলেন – ‘সমাধি’, ‘অপরোক্ষানুভূতি’ প্রভৃতি যে সকল কথা তিনি উচ্চারণমাত্রই করিয়া থাকেন, ঠাকুরের সেই সমাধি দিবারাত্র যখন তখন ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গে হইতেছে! শাস্ত্রী ভাবিলেন, ‘এ কি অদ্ভুত ব্যাপার! শাস্ত্রের নিগূঢ় অর্থ জানাইবার বুঝাইবার এমন লোক আর কোথায় পাইব? এ সুযোগ ছাড়া হইবে না। যেরূপে হউক ইঁহার নিকট হইতে ব্রহ্মসাক্ষাৎকারলাভের উপায় করিতে হইবে। মরণের তো নিশ্চয়তা নাই – কে জানে কবে এ শরীর যাইবে। ঠিক ঠিক জ্ঞানলাভ না করিয়া মরিব? তাহা হইবে না। একবার তল্লাভে চেষ্টাও অন্ততঃ করিতে হইবে। রহিল এখন দেশে ফেরা।’

শাস্ত্রীর বৈরাগ্যোদয়

দিনের পর দিন যতই যাইতে লাগিল, শাস্ত্রীর বৈরাগ্যব্যাকুলতাও ততই ঠাকুরের দিব্য সঙ্গে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। পাণ্ডিত্যে সকলকে চমৎকৃত করিব, মহামহোপাধ্যায় হইয়া সংসারে সর্বাপেক্ষা অধিক নাম যশ প্রতিষ্ঠা লাভ করিব – এ সকল বাসনা তুচ্ছ হেয় জ্ঞান হইয়া মন হইতে একেবারে অন্তর্হিত হইয়া গেল। শাস্ত্রী যথার্থ দীনভাবে শিষ্যের ন্যায় ঠাকুরের নিকট থাকেন এবং তাঁহার অমৃতময়ী বাক্যাবলী একচিত্তে শ্রবণ করিয়া ভাবেন – আর অন্য কোন বিষয়ে মন দেওয়া হইবে না। কবে কখন শরীরটা যাইবে তাহার স্থিরতা নাই; এই বেলা সময় থাকিতে থাকিতে ঈশ্বরলাভের চেষ্টা করিতে হইবে। ঠাকুরকে দেখিয়া ভাবেন – “আহা, ইনি মনুষ্যজন্ম লাভ করিয়া যাহা জানিবার, বুঝিবার, তাহা বুঝিয়া কেমন নিশ্চিন্ত হইয়া রহিয়াছেন! – মৃত্যুও ইঁহার নিকট পরাজিত; ‘মহারাত্রি’র করাল ছায়া সম্মুখে ধরিয়া ইতরসাধারণের ন্যায় ইঁহাকে আর অকূল পাথার দেখাইতে পারে না! আচ্ছা, উপনিষদ্কার তো বলিয়াছেন এরূপ মহাপুরুষ সিদ্ধ-সঙ্কল্প হন; ইঁহাদের ঠিক ঠিক কৃপালাভ করিতে পারিলে মানবের সংসার-বাসনা মিটিয়া যাইয়া ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হয়। তবে ইঁহাকেই কেন ধরি না; ইঁহারই কেন শরণ গ্রহণ করি না?” শাস্ত্রী মনে মনে এইরূপ নানাবিধ জল্পনা করেন এবং দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে থাকেন। কিন্তু পাছে ঠাকুর অযোগ্য ভাবিয়া আশ্রয় না দেন এজন্য সহসা তাঁহাকে কিছু বলিতে পারেন না। এইরূপে দিন কাটিতে থাকিল।

শাস্ত্রীর মাইকেল মধুসূদনের সহিত আলাপে বিরক্তি

শাস্ত্রীর মনে দিন দিন যে সংসার-বৈরাগ্য তীব্রভাব ধারণ করিতেছিল, ইহার পরিচয় আমরা নিম্নের ঘটনাটি হইতে বেশ পাইয়া থাকি। এই সময়ে রাসমণির তরফ হইতে কি একটি মকদ্দমা চালাইবার ভার বঙ্গের কবিকুলগৌরব শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ঐ মকদ্দমার সকল বিষয় যথাযথ জানিবার জন্য তাঁহাকে রানীর কোন বংশধরের সহিত একদিন দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে আসিতে হইয়াছিল। মকদ্দমাসংক্রান্ত সকল বিষয় জানিবার পর এ কথা সে কথায় তিনি ঠাকুর এখানে আছেন জানিতে পারেন এবং তাঁহাকে দেখিবার বাসনা প্রকাশ করেন। ঠাকুরের নিকট সংবাদ দেওয়া হইলে ঠাকুর মধুসূদনের সহিত আলাপ করিতে প্রথম শাস্ত্রীকেই পাঠান এবং পরে আপনিও তথায় উপস্থিত হন। শাস্ত্রীজী মধুসূদনের সহিত আলাপ করিতে করিতে তাঁহার স্বধর্ম ত্যাগ করিয়া ঈশার ধর্মাবলম্বনের হেতু জিজ্ঞাসা করেন। মাইকেল তদুত্তরে বলিয়াছিলেন যে, তিনি পেটের দায়েই ঐরূপ করিয়াছেন। মধুসূদন অপরিচিত পুরুষের নিকট আত্মকথা খুলিয়া বলিতে অনিচ্ছুক হইয়া ঐ ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়াছিলেন কি না, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু ঠাকুর এবং উপস্থিত সকলেরই মনে হইয়াছিল তিনি আত্মগোপন করিয়া বিদ্রূপচ্ছলে যে ঐরূপ বলিলেন তাহা নহে; যথার্থ প্রাণের ভাবই বলিতেছেন। যাহাই হউক, ঐরূপ উত্তর শুনিয়া শাস্ত্রীজী তাঁহার উপর বিষম বিরক্ত হন; বলেন – “কি! এই দুই দিনের সংসারে পেটের দায়ে নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করা – এ কি হীন বুদ্ধি! মরিতে তো একদিন হইবেই – না হয় মরিয়াই যাইতেন।” ইঁহাকেই আবার লোকে বড় লোক বলে এবং ইঁহার গ্রন্থ আদর করিয়া পড়ে, ইহা ভাবিয়া শাস্ত্রীজীর মনে বিষম ঘৃণার উদয় হওয়ায় তিনি তাঁহার সহিত আর অধিক বাক্যালাপে বিরত হন।

ঠাকুর ও মাইকেল-সংবাদ

অতঃপর মধুসূদন ঠাকুরের শ্রীমুখ হইতে কিছু ধর্মোপদেশ শুনিবার বাসনা প্রকাশ করেন। ঠাকুর আমাদের বলিতেন – “(আমার) মুখ যেন কে চেপে ধরলে, কিছু বলতে দিলে না!” হৃদয় প্রভৃতি কেহ কেহ বলেন, কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরের ঐ ভাব চলিয়া গিয়াছিল এবং তিনি রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি বিশিষ্ট সাধকদিগের কয়েকটি পদাবলী মধুর স্বরে গাহিয়া মধুসূদনের মন মোহিত করিয়াছিলেন এবং তদ্ব্যপদেশে তাঁহাকে, ভগবদ্ভক্তিই যে সংসারে একমাত্র সার পদার্থ, তাহা শিক্ষা দিয়াছিলেন।

শাস্ত্রীর নিজ মত দেওয়ালে লিখিয়া রাখা

মাইকেল বিদায় গ্রহণ করিবার পরেও শাস্ত্রীজী মাইকেলের ঐরূপে স্বধর্মত্যাগের কথা আলোচনা করিয়া বিরক্তি প্রকাশ করেন, এবং পেটের দায়ে স্বধর্মত্যাগ করা যে অতি হীনবুদ্ধির কাজ, এ কথা ঠাকুরের ঘরে ঢুকিবার দরজার পূর্ব দিকের দালানের দেওয়ালের গায়ে একখণ্ড কয়লা দিয়া বড় বড় অক্ষরে লিখিয়া রাখেন। দেওয়ালের গায়ে সুস্পষ্ট বড় বড় বাঙলা অক্ষরে লেখা শাস্ত্রীর ঐ বিষয়ক মনোভাব আমাদের অনেকেরই নজরে পড়িয়া আমাদিগকে কৌতূহলাক্রান্ত করিত। পরে একদিন জিজ্ঞাসায় সকল কথা জানিতে পারিলাম। শাস্ত্রী অনেক দিন এ দেশে থাকায় বাঙলা ভাষা বেশ শিক্ষা করিয়াছিলেন।

শাস্ত্রীর সন্ন্যাসগ্রহণ ও তপস্যা

এইবার শাস্ত্রীর জীবনের শেষ কথা। সুযোগ বুঝিয়া শাস্ত্রীজী একদিন ঠাকুরকে নির্জনে পাইয়া নিজ মনোভাব প্রকাশ করিলেন এবং ‘নাছোড়বান্দা’ হইয়া ধরিয়া বসিলেন, তাঁহাকে সন্ন্যাসদীক্ষা দিতে হইবে। ঠাকুরও তাঁহার আগ্রহাতিশয়ে সম্মত হইয়া শুভদিনে তাঁহাকে ঐ দীক্ষাপ্রদান করিলেন। সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়াই শাস্ত্রী আর কালীবাটীতে রহিলেন না। বশিষ্ঠাশ্রমে বসিয়া সিদ্ধকাম না হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মোপলব্ধির চেষ্টায় প্রাণপাত করিবেন বলিয়া ঠাকুরের নিকট মনোগত অভিপ্রায় জানাইলেন এবং সজলনয়নে তাঁহার আশীর্বাদভিক্ষা ও শ্রীচরণবন্দনান্তে চিরদিনের মতো দক্ষিণেশ্বর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন; ইহার পর নারায়ণ শাস্ত্রীর কোন নিশ্চিত সংবাদই আর পাওয়া গেল না। কেহ কেহ বলেন, বশিষ্ঠাশ্রমে অবস্থান করিয়া কঠোর তপশ্চরণ করিতে করিতে তাঁহার শরীর রোগাক্রান্ত হয় এবং ঐ রোগেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল।

সাধু ও সাধকদিগকে দেখিতে যাওয়া ঠাকুরের স্বভাব ছিল

আবার যথার্থ সাধু, সাধক বা ভগবদ্ভক্ত যে কোন সম্প্রদায়ের হউন না কেন, কোন স্থানে বাস করিতেছেন শুনিলেই ঠাকুরের তাঁহাকে দর্শন করিতে ইচ্ছা হইত এবং ঐরূপ ইচ্ছার উদয় হইলে অযাচিত হইয়াও তাঁহার সহিত ভগবৎপ্রসঙ্গে কিছুকাল কাটাইয়া আসিতেন। লোকে ভাল বা মন্দ বলিবে, অপরিচিত সাধক তাঁহার যাওয়ায় সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইবেন, আপনি তথায় যথাযথ সম্মানিত হইবেন কি না – এ সকল চিন্তার একটিরও তখন আর তাঁহার মনে উদয় হইত না। কোনরূপে তথায় উপস্থিত হইয়া উক্ত সাধক কি ভাবের লোক ও নিজ গন্তব্য পথে কতদূরই বা অগ্রসর হইয়াছেন ইত্যাদি সকল কথা জানিয়া, বুঝিয়া, একটা স্থির মীমাংসায় উপনীত হইয়া তবে ক্ষান্ত হইতেন। শাস্ত্রজ্ঞ সাধক পণ্ডিতদিগের কথা শুনিলেও ঠাকুর অনেক সময় ঐরূপ ব্যবহার করিতেন। পণ্ডিত পদ্মলোচন, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রভৃতি অনেককে ঠাকুর ঐভাবে দর্শন করিতে গিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের কথা আমাদিগকে অনেক সময় গল্পচ্ছলে বলিতেন। তন্মধ্যে পণ্ডিত পদ্মলোচনের কথাই আমরা এখন পাঠককে বলিতেছি।

বঙ্গে ন্যায়ের প্রবেশ-কারণ

ঠাকুরের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলায় বেদান্তশাস্ত্রের চর্চা অতীব বিরল ছিল। আচার্য শঙ্কর বহু শতাব্দী পূর্বে বঙ্গের তান্ত্রিকদিগকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করিলেও সাধারণে নিজমত বড় একটা প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই। ফলে এদেশের তন্ত্র অদ্বৈতভাবরূপ বেদান্তের মূল তত্ত্বটি সত্য বলিয়া স্বীকার করিয়া নিজ উপাসনাপ্রণালীর ভিতর উহার কিছু কিছু প্রবিষ্ট করাইয়া জনসাধারণে পূর্ববৎ পূজাদির প্রচার করিতেই থাকে এবং বাংলার পণ্ডিতগণ ন্যায়দর্শনের আলোচনাতেই নিজ উর্বর মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি ব্যয় করিতে থাকিয়া কালে নব্য ন্যায়ের সৃজন করতঃ উক্ত দর্শনের রাজ্যে অদ্ভুত যুগবিপর্যয় আনয়ন করেন। আচার্য শঙ্করের নিকট তর্কে পরাজিত ও অপদস্থ হইয়াই কি বাঙালী জাতির ভিতর তর্কশাস্ত্রের আলোচনা এত অধিক বাড়িয়া যায় – কে বলিবে? তবে জাতিবিশেষের নিকট কোন বিষয়ে পরাজিত হইয়া অভিমানে অপমানে পরাজিত জাতির ভিতরে ঐ বিষয়ে সকলকে অতিক্রম করিবার ইচ্ছা ও চেষ্টার উদয় জগৎ অনেকবার দেখিয়াছে।

বৈদান্তিক পণ্ডিত পদ্মলোচন

তন্ত্র ও ন্যায়ের রঙ্গভূমি বঙ্গে ঠাকুরের আবির্ভাবের পূর্বে বেদান্তচর্চা ঐরূপে বিরল থাকিলেও, কেহ কেহ যে উহার উদার মীমাংসাসকলের অনুশীলনে আকৃষ্ট হইতেন না, তাহা নহে। পণ্ডিত পদ্মলোচন ঐ ব্যক্তিগণের মধ্যে অন্যতম। ন্যায়ে ব্যুৎপত্তিলাভ করিবার পর পণ্ডিতজীর বেদান্তদর্শন-পাঠে ইচ্ছা হয় এবং তজ্জন্য ৺কাশীধামে গমন করিয়া গুরুগৃহে বাসকরতঃ তিনি দীর্ঘকাল ঐ দর্শনের চর্চায় কালাতিপাত করেন। ফলে, কয়েক বৎসর পরেই তিনি বৈদান্তিক বলিয়া প্রসিদ্ধিলাভ করেন এবং দেশে আগমন করিবার পর বর্ধমানাধিপের দ্বারা আহূত হইয়া তদীয় সভাপণ্ডিতের পদ গ্রহণ করেন। পণ্ডিতজীর অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় পাইয়া বর্ধমানরাজ তাঁহাকে ক্রমে প্রধান সভাপণ্ডিতের পদে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাঁহার সুযশ বঙ্গের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়।

পণ্ডিতের অদ্ভুত প্রতিভার দৃষ্টান্ত

পণ্ডিতজীর অদ্ভুত প্রতিভা সম্বন্ধে একটি কথা এখানে বলিলে মন্দ হইবে না। আধ্যাত্মিক কোন বিষয়ে একদেশী ভাব বুদ্ধিহীনতা হইতেই উপস্থিত হয় – এই প্রসঙ্গে ঠাকুর পণ্ডিতজীর ঐ কথা কখন কখন আমাদের নিকট উল্লেখ করিতেন। কারণ, আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, অসাধারণ সত্যনিষ্ঠ ঠাকুর কাহারও নিকট হইতে কখন কোন মনোমত উদারভাব-প্রকাশক কথা শুনিলে উহা স্মরণ করিয়া রাখিতেন এবং কথাপ্রসঙ্গে উহার উল্লেখকালে যাহার নিকটে তিনি উহা প্রথম শুনিয়াছিলেন, তাহার নামটিও বলিতেন।

‘শিব বড় কি বিষ্ণু বড়’

ঠাকুর বলিতেন, বর্ধমান-রাজসভায় পণ্ডিতদিগের ভিতর ‘শিব বড় কি বিষ্ণু বড়’ – এই কথা লইয়া এক সময় মহা আন্দোলন উপস্থিত হয়। পণ্ডিত পদ্মলোচন তখন তথায় উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত পণ্ডিতসকল নিজ নিজ শাস্ত্রজ্ঞান, ও বোধ হয় অভিরুচি-সহায়ে কেহ এক দেবতাকে, আবার কেহ বা অন্য দেবতাকে বড় বলিয়া নির্দেশ করিয়া বিষম কোলাহল উপস্থিত করিলেন। এইরূপে শৈব ও বৈষ্ণব উভয়পক্ষে দ্বন্দ্বই চলিতে লাগিল, কিন্তু কথাটার একটা সুমীমাংসা আর পাওয়া গেল না। কাজেই প্রধান সভাপণ্ডিতের তখন উহার মীমাংসা করিবার জন্য ডাক পড়িল। পণ্ডিত পদ্মলোচন সভাতে উপস্থিত হইয়া প্রশ্ন শুনিয়াই বলিলেন – “আমার চৌদ্দপুরুষে কেহ শিবকেও কখনও দেখেনি, বিষ্ণুকেও কখনও দেখেনি; অতএব কে বড় কে ছোট, তা কেমন করে বলব? তবে শাস্ত্রের কথা শুনতে চাও তো এই বলতে হয় যে, শৈবশাস্ত্রে শিবকে বড় করেছে ও বৈষ্ণবশাস্ত্রে বিষ্ণুকে বাড়িয়েছে; অতএব যার যে ইষ্ট, তার কাছে সেই দেবতাই অন্য সকল দেবতা অপেক্ষা বড়।” এই বলিয়া পণ্ডিতজী শিব ও বিষ্ণু উভয়েরই সর্বদেবতাপেক্ষা প্রাধান্যসূচক শ্লোকগুলি প্রমাণস্বরূপে উদ্ধৃত করিয়া উভয়কেই সমান বড় বলিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন। পণ্ডিতজীর ঐরূপ সিদ্ধান্তে তখন বিবাদ মিটিয়া গেল এবং সকলে তাঁহাকে ধন্য ধন্য করিতে লাগিলেন। পণ্ডিতজীর ঐরূপ আড়ম্বরশূন্য সরল শাস্ত্রজ্ঞান ও স্পষ্টবাদিত্বেই তাঁহার প্রতিভার পরিচয় আমরা বিলক্ষণ পাইয়া থাকি এবং তাঁহার এত সুনাম ও প্রসিদ্ধি যে কেন হইয়াছিল, তাহার কারণ বুঝিতে পারি।

পণ্ডিতের ঈশ্বরানুরাগ

শব্দজালরূপ মহারণ্যে বহুদূর পরিভ্রমণ করিয়াছিলেন বলিয়াই যে পণ্ডিতজীর এত সুখ্যাতিলাভ হইয়াছিল তাহা নহে। লোকে দৈনন্দিন জীবনেও তাঁহাতে সদাচার, ইষ্টনিষ্ঠা, তপস্যা, উদারতা, নির্লিপ্ততা প্রভৃতি সদ্গুণরাশির পুনঃপুনঃ পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে একজন বিশিষ্ট সাধক বা ঈশ্বর-প্রেমিক বলিয়া স্থির করিয়াছিল। যথার্থ পাণ্ডিত্য ও গভীর ঈশ্বরভক্তির একত্র সমাবেশ সংসারে দুর্লভ; অতএব তদুভয় কোথাও একত্র পাইলে লোকে ঐ পাত্রের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়। অতএব লোক-পরম্পরায় ঐসকল কথা শুনিয়া ঠাকুরের ঐ সুপুরুষকে যে দেখিতে ইচ্ছা হইবে, ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। ঠাকুরের মনে যখন ঐরূপ ইচ্ছার উদয় হয়, তখন পণ্ডিতজী প্রৌঢ়াবস্থা প্রায় অতিক্রম করিতে চলিয়াছেন এবং বর্ধমান-রাজসরকারে অনেক কাল সসম্মানে নিযুক্ত আছেন।

ঠাকুরের মনের স্বভাব ও পণ্ডিতের কলিকাতায় আগমন

ঠাকুরের মনে যখনি যে কার্য করিবার ইচ্ছা হইত, তখনি তাহা সম্পন্ন করিবার জন্য তিনি বালকের ন্যায় ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন। ‘জীবন ক্ষণস্থায়ী, যাহা করিবার শীঘ্র করিয়া লও’ – বাল্যাবধি মনকে ঐ কথা বুঝাইয়া তীব্র অনুরাগে সকল কার্য করিবার ফলেই বোধ হয় ঠাকুরের মনের ঐরূপ স্বভাব হইয়া গিয়াছিল। আবার একনিষ্ঠা ও একাগ্রতা-অভ্যাসের ফলেও যে মন ঐরূপ স্বভাবাপন্ন হয়, এ কথা অল্প চিন্তাতেই বুঝিতে পারা যায়। সে যাহা হউক, ঠাকুরের ব্যস্ততা দেখিয়া মথুরানাথ তাঁহাকে বর্ধমানে পাঠাইবার সঙ্কল্প করিতেছিলেন, এমন সময় সংবাদ পাওয়া গেল, পণ্ডিত পদ্মলোচনের শরীর দীর্ঘকাল অসুস্থ হওয়ায় তাঁহাকে আড়িয়াদহের নিকট গঙ্গাতীরবর্তী একটি বাগানে বায়ু-পরিবর্তনের জন্য আনিয়া রাখা হইয়াছে এবং গঙ্গার নির্মল বায়ু-সেবনে তাঁহার শরীরও পূর্বাপেক্ষা কিছু ভাল আছে। সংবাদ যথার্থ কি না, জানিবার জন্য হৃদয় প্রেরিত হইল।

হৃদয় ফিরিয়া সংবাদ দিল – কথা যথার্থ, পণ্ডিতজী ঠাকুরের কথা শুনিয়া তাঁহাকে দেখিবার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন এবং হৃদয়কে তাঁহার আত্মীয় জানিয়া বিশেষ সমাদর করিয়াছেন। তখন দিন স্থির হইল। ঠাকুর পণ্ডিতজীকে দেখিতে চলিলেন। হৃদয় তাঁহার সঙ্গে চলিল।

পণ্ডিতের ঠাকুরকে প্রথম দর্শন

হৃদয় বলেন, প্রথম মিলন হইতেই ঠাকুর ও পণ্ডিতজী পরস্পরের দর্শনে বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে অমায়িক, উদার-স্বভাব, সুপণ্ডিত ও সাধক বলিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন; এবং পণ্ডিতজীও ঠাকুরকে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অবস্থায় উপনীত মহাপুরুষ বলিয়া ধারণা করিয়াছিলেন। ঠাকুরের মধুর কণ্ঠে মা-র নামগান শুনিয়া পণ্ডিতজী অশ্রু-সংবরণ করিতে পারেন নাই এবং সমাধিতে মুহুর্মুহুঃ বাহ্য চৈতন্যের লোপ হইতে দেখিয়া এবং ঐ অবস্থায় ঠাকুরের কিরূপ উপলব্ধিসমূহ হয়, সে সকল কথা শুনিয়া পণ্ডিতজী নির্বাক হইয়াছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আধ্যাত্মিক অবস্থাসকলের সহিত ঠাকুরের অবস্থা মিলাইয়া লইতে যে চেষ্টা করিয়াছিলেন, ইহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। কিন্তু ঐরূপ করিতে যাইয়া তিনি যে সেদিন ফাঁপরে পড়িয়াছিলেন এবং কোন একটা বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন নাই ইহাও সুনিশ্চিত। কারণ ঠাকুরের চরম উপলব্ধিসকল শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ দেখিতে না পাইয়া তিনি শাস্ত্রের কথা সত্য অথবা ঠাকুরের উপলব্ধি সত্য, ইহা স্থির করিতে পারেন নাই। অতএব শাস্ত্রজ্ঞান ও নিজ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসহায়ে আধ্যাত্মিক সর্ববিষয়ে সর্বদা স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত পণ্ডিতজীর বিচারশীল মন ঠাকুরের সহিত পরিচয়ে আলোকের ভিতর একটা অন্ধকারের ছায়ার মতো অপূর্ব আনন্দের ভিতরে একটা অশান্তির ভাব উপলব্ধি করিয়াছিল।

পণ্ডিতের ভক্তি-শ্রদ্ধা-বৃদ্ধির কারণ

প্রথম পরিচয়ের এই প্রীতি ও আকর্ষণে ঠাকুর ও পণ্ডিতজী আরও কয়েকবার একত্র মিলিত হইয়াছিলেন; এবং উহার ফলে পণ্ডিতজীর ঠাকুরের আধ্যাত্মিক অবস্থাবিষয়ক ধারণা অপূর্ব গভীর ভাব প্রাপ্ত হইয়াছিল। পণ্ডিতজীর ঐরূপ দৃঢ় ধারণা হইবার একটি বিশেষ কারণও আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি।

পণ্ডিত পদ্মলোচন বেদান্তোক্ত জ্ঞানবিচারের সহিত তন্ত্রোক্ত সাধন-প্রণালীর বহুকাল অনুষ্ঠান করিয়া আসিতেছিলেন; এবং ঐরূপ অনুষ্ঠানের ফলও কিছু কিছু জীবনে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। ঠাকুর বলিতেন, জগদম্বা তাঁহাকে পণ্ডিতজীর সাধনালব্ধ শক্তিসম্বন্ধে একটি গোপনীয় কথা ঐ সময়ে জানাইয়া দেন। তিনি জানিতে পারেন, সাধনায় প্রসন্না হইয়া পণ্ডিতজীর ইষ্টদেবী তাঁহাকে বরপ্রদান করিয়াছিলেন বলিয়াই তিনি এতকাল ধরিয়া অগণ্য পণ্ডিতসভায় অপর সকলের অজেয় হইয়া আপন প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিয়াছেন! পণ্ডিতজীর নিকটে সর্বদা একটি জলপূর্ণ গাড়ু ও একখানি গামছা থাকিত; এবং কোন প্রশ্নের মীমাংসায় অগ্রসর হইবার পূর্বে উহা হস্তে লইয়া ইতস্ততঃ কয়েক পদ পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়া মুখপ্রক্ষালন ও মোক্ষণ করতঃ তৎকার্যে প্রবৃত্ত হওয়া আবহমান কাল হইতে তাঁহার রীতি ছিল। তাঁহার ঐ রীতি বা অভ্যাসের কারণানুসন্ধানে কাহারও কখনও কৌতূহল হয় নাই এবং উহার যে কোন নিগূঢ় কারণ আছে, তাহাও কেহ কখনও কল্পনা করে নাই। তাঁহার ইষ্টদেবীর নিয়োগানুসারেই যে তিনি ঐরূপ করিতেন এবং ঐরূপ করিলেই যে তাঁহাতে শাস্ত্রজ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব দৈববলে সম্যক জাগরিত হইয়া উঠিয়া তাঁহাকে অন্যের অজেয় করিয়া তুলিত, পণ্ডিতজী একথা কাহারও নিকটে – এমনকি নিজ সহধর্মিণীর নিকটেও কখনও প্রকাশ করেন নাই। পণ্ডিতজীর ইষ্টদেবী তাঁহাকে ঐরূপ করিতে নিভৃতে প্রাণে প্রাণে বলিয়া দিয়াছিলেন এবং তিনিও তদবধি এতকাল ধরিয়া উহা অক্ষুণ্ণভাবে পালন করিয়া অন্যের অজ্ঞাতসারে উহার ফল প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন।

ঠাকুরের পণ্ডিতের সিদ্ধাই জানিতে পারা

ঠাকুর বলিতেন – জগদম্বার কৃপায় ঐ বিষয় জানিতে পারিয়া তিনি অবসর বুঝিয়া একদিন পণ্ডিতজীর গাড়ু, গামছা তাঁহার অজ্ঞাতসারে লুকাইয়া রাখেন এবং পণ্ডিতজীও তদভাবে উপস্থিত প্রশ্নের মীমাংসায় প্রবৃত্ত হইতে না পারিয়া উহার অন্বেষণেই ব্যস্ত হন। পরে যখন জানিতে পারিলেন ঠাকুর ঐরূপ করিয়াছেন তখন আর পণ্ডিতজীর আশ্চর্যের সীমা থাকে নাই! আবার যখন বুঝিলেন ঠাকুর সকল কথা জানিয়া শুনিয়াই ঐরূপ করিয়াছেন, তখন পণ্ডিতজী আর থাকিতে না পারিয়া তাঁহাকে সাক্ষাৎ নিজ ইষ্টজ্ঞানে সজলনয়নে স্তবস্তুতি করিয়াছিলেন। তদবধি পণ্ডিতজী ঠাকুরকে সাক্ষাৎ ঈশ্বরাবতার বলিয়া জ্ঞান ও তদ্রূপ ভক্তি করিতেন। ঠাকুর বলিতেন, “পদ্মলোচন অত বড় পণ্ডিত হয়েও এখানে (আমাতে) এতটা বিশ্বাস ভক্তি করত! বলেছিল – ‘আমি সেরে উঠে সব পণ্ডিতদের ডাকিয়ে সভা করে সকলকে বলব, তুমি ঈশ্বরাবতার; আমার কথা কে কাটতে পারে দেখব।’ মথুর (এক সময়ে অন্য কারণে) যত পণ্ডিতদের ডাকিয়ে দক্ষিণেশ্বরে এক সভার যোগাড় করছিল। পদ্মলোচন নির্লোভ অশূদ্রপ্রতিগ্রাহী নিষ্ঠাচারী ব্রাহ্মণ; সভায় আসবে না ভেবে আসবার জন্য অনুরোধ করতে বলেছিল! মথুরের কথায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ‘হ্যাঁগো, তুমি দক্ষিণেশ্বরে যাবে না?’ তাইতে বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে হাড়ির বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসতে পারি! কৈবর্তের বাড়িতে সভায় যাব, এ আর কি বড় কথা’!”

পণ্ডিতের কাশীধামে শরীর-ত্যাগ

মথুরবাবুর আহূত সভায় কিন্তু পণ্ডিতজীকে যাইতে হয় নাই। সভা আহূত হইবার পূর্বেই তাঁহার শারীরিক অসুস্থতা বিশেষ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সজলনয়নে ঠাকুরের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া ৺কাশীধামে গমন করেন। শুনা যায়, সেখানে অল্পকাল পরেই তাঁহার শরীরত্যাগ হয়।

ইহার বহুকাল পরে ঠাকুরের কলিকাতার ভক্তেরা যখন তাঁহার শ্রীচরণপ্রান্তে আশ্রয় লইয়াছে এবং ভক্তির উত্তেজনায় তাহাদের ভিতর কেহ কেহ ঠাকুরকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া প্রকাশ্যে নির্দেশ করিতেছে, তখন ঐসকল ভক্তের ঐরূপ ব্যবহার জানিতে পারিয়া ঠাকুর তাহাদিগকে ঐরূপ করিতে নিষেধ করিয়া পাঠান; এবং ভক্তির আতিশয্যে তাহারা ঐ কার্যে বিরত হয় নাই, কয়েকদিন পরে এ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া বিরক্ত হইয়া একদিন আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “কেউ ডাক্তারি করে, কেউ থিয়েটারের ম্যানেজারি করে, এখানে এসে অবতার বললেন। ওরা মনে করে ‘অবতার’ বলে আমাকে খুব বাড়ালে – বড় করলে! কিন্তু ওরা অবতার কাকে বলে, তার বোঝে কি? ওদের এখানে আসবার ও অবতার বলবার ঢের আগে পদ্মলোচনের মতো লোক – যারা সারা জীবন ঐ বিষয়ের চর্চায় কাল কাটিয়েছে – কেউ ছ-টা দর্শনে পণ্ডিত, কেউ তিনটে দর্শনে পণ্ডিত – কত সব এখানে এসে অবতার বলে গেছে। অবতার বলা তুচ্ছজ্ঞান হয়ে গেছে। ওরা অবতার বলে এখানকার (আমার) আর কি বাড়াবে বল্?”

পদ্মলোচন ভিন্ন আরও অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিতদিগের সহিত ঠাকুরের সময়ে সময়ে সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তাঁহাদের ভিতরে ঠাকুর যে সকল বিশেষ গুণের পরিচয় পাইয়াছিলেন, কথাপ্রসঙ্গে তাহাও তিনি কখনও কখনও আমাদিগকে বলিতেন। ঐরূপ কয়েকটির কথাও সংক্ষেপে এখানে বলিলে মন্দ হইবে না।

দয়ানন্দের সম্বন্ধে ঠাকুর

আর্যমত-প্রবর্তক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী এক সময়ে বঙ্গদেশে বেড়াইতে আসিয়া কলিকাতার উত্তরে বরাহনগরের সিঁতি নামক পল্লীতে জনৈক ভদ্রলোকের উদ্যানে কিছুকাল বাস করেন। সুপণ্ডিত বলিয়া বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিলেও তখনও তিনি নিজের মত প্রচার করিয়া দলগঠন করেন নাই। তাঁহার কথা শুনিয়া ঠাকুর একদিন ঐ স্থানে তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। দয়ানন্দের কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর একদিন আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “সিঁতির বাগানে দেখতে গিয়েছিলাম; দেখলাম – একটু শক্তি হয়েছে; বুকটা সর্বদা লাল হয়ে রয়েচে; বৈখরী অবস্থা – দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই কথা (শাস্ত্রকথা) কচ্চে; ব্যাকরণ লাগিয়ে অনেক কথার (শাস্ত্রবাক্যের) মানে সব উলটো-পালটা করতে লাগল; নিজে একটা কিছু করব, একটা মত চালাব – এ অহঙ্কার ভেতরে রয়েচে!”

জয়নারায়ণ পণ্ডিত

জয়নারায়ণ পণ্ডিতের কথায় ঠাকুর বলিতেন, “অত বড় পণ্ডিত, কিন্তু অহঙ্কার ছিল না; নিজের মৃত্যুর কথা জানতে পেরে বলেছিল, কাশী যাবে ও সেখানে দেহ রাখবে – তাই হয়েছিল।”

রামভক্ত কৃষ্ণকিশোর

আড়িয়াদহ-নিবাসী কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্যের শ্রীরামচন্দ্রে পরম ভক্তির কথা ঠাকুর অনেক সময় উল্লেখ করিতেন। কৃষ্ণকিশোরের বাটীতে ঠাকুরের গমনাগমন ছিল এবং তাঁহার পরম ভক্তিমতী সহধর্মিণীও ঠাকুরকে বিশেষ ভক্তি করিতেন। রামনামে ভক্তির তো কথাই নাই, ঠাকুর বলিতেন – কৃষ্ণকিশোর ‘মরা’ ‘মরা’ শব্দটিকেও ঋষিপ্রদত্ত মহামন্ত্রজ্ঞানে বিশেষ ভক্তি করিতেন। কারণ, পুরাণে লিখিত আছে, ঐ শব্দই মন্ত্ররূপে নারদ ঋষি দস্যু বাল্মীকিকে দিয়াছিলেন এবং উহার বারংবার ভক্তিপূর্বক উচ্চারণের ফলেই বাল্মীকির মনে শ্রীরামচন্দ্রের অপূর্ব লীলার স্ফূর্তি হইয়া তাঁহাকে রামায়ণপ্রণেতা কবি করিয়াছিল। কৃষ্ণকিশোর সংসারে শোকতাপও অনেক পাইয়াছিলেন। তাঁহার দুই উপযুক্ত পুত্রের মৃত্যু হয়। ঠাকুর বলিতেন, পুত্রশোকের এমনি প্রভাব, অত বড় বিশ্বাসী ভক্ত কৃষ্ণকিশোরও তাহাতে প্রথম প্রথম সামলাইতে না পারিয়া আত্মহারা হইয়াছিলেন।

পূর্বোক্ত সাধকগণ ভিন্ন ঠাকুর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতিকেও দেখিতে গিয়াছিলেন; এবং মহর্ষির উদার ভক্তি ও ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মযোগপরায়ণতার কথা আমাদের নিকট সময়ে সময়ে উল্লেখ করিতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *