এক সময়ে কাইরো শহরে এক ফেরিওয়ালা বাস করতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সে মুরগীর ডিম বিক্রি করে বেড়াতে।
ফেরিওয়ালার তিনটি কন্যা। তিনজনেই ফুটফুটে সুন্দরী। তার মধ্যে ছোট জাইনাহ শুধু রূপে নয়, বিদ্যাবুদ্ধিতেও চৌকস।
ফেরিওয়ালা কষ্ট করেও মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো পাত্রের যোগ্য করে তুলেছিলো। সূক্ষ্ম সূচীশিল্প শেখার জন্য প্রতিদিন সকালে ওরা এক বৃদ্ধার বাড়িতে যেত। ওদের যাওয়ার-আসার পথের মাঝে সুলতানের প্রাসাদ। প্রতিদিন তিন বোন লক্ষ্য করে সুলতানের একমাত্র পুত্র জানলার ধারে বসে তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে সে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়, এই যে ফেরিওয়ালার মেয়েরা, ভালো আছ তো?
বড় এবং মেজ বোন মৃদু হেসে ঈষৎ ঘাড় নেড়ে শাহজাদাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানায়। কিন্তু ছোট বিন্দুমাত্র সাড়া না দিয়ে অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে প্রাসাদ-চত্বর পার হয়ে যায়।
ছোটর অবজ্ঞা অবহেলার ভাবভঙ্গীতে শাহজাদা মনে মনে ক্ষুব্ধ ও কিছুটা রুষ্ট হয়। যতই দিন যায় ক্রমশ সে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভাবে, মেয়েটার তো জব্বর সাহস! সে কিনা সুলতানের পুত্র। তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এক সামান্য ফেরিওয়ালার মেয়ে? ঠিক আছে এমন শিক্ষা দিতে হবে তাকে, যাতে জিন্দগী ভর ইয়াদ থাকে তার। সে শাহজাদা—তার যে কতখানি ক্ষমতা থাকতে পারে ঐ মূখ মেয়েটার কোনও জ্ঞান নাই। একবার ওকে মজাটা দেখিয়ে দিতে হবে।
একদিন সে ফেরিওয়ালাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলো, যে তিনটি মেয়ে রোজ আমার প্রাসাদের সামনে দিয়ে যায় আসে ওরা কি তোমার মেয়ে?
—জী হুজুর। ভয়ে ফেরিওয়ালার গলা কাঠ হয়ে যায়।
—হুম, শাহজাদা গম্ভীর চালে হুকুম জারি করে, কাল সকালে নামাজের সময় তোমাকে হাজির হতে হবে এখানে। আমি তোমার সাজ-পোশাক খুলতে আবার পরতে, মুহূর্তে হাসতে এবং পর-মুহূর্তেই কাঁদতে, ঘোড়ার পিঠে উঠে বসতে এবং সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়তে-যখন যেমন হুকুম করবো পলকের মধ্যে সে-সব তামিল করতে হবে তোমাকে? যদি এক তিল এদিক ওদিক হয়, এক পল দেরি হয় তবে তোমার গর্দান যাবে, মনে থাকে যেন।
শাহজাদার এই রকম ক্রোধান্বিত ফরমাস শুনে ফেরিওয়ালার হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়। আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ কেতা জানিয়ে বলে, জো হুকুম মালিক।
বিষণ্ণবদনে ঘরে ফিরে আসে ফেরিওয়ালা। মেয়েরা বাবাকে দারুণ চিন্তিত দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বাবা, তোমাকে এমন দেখছি কেন?
ফেরিওয়ালা শাহজাদার উদ্ভট হুকুমের কথা সব খুলে বললো মেয়েদের। এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো ঊননব্বইতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?
সে বলতে থাকে– ছোট কন্যা জাইনাহ বাবার কাছ থেকে সব শোনার পর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, ও হো হো, এই সব বলেছে শাহজাদা তোমাকে, বাবা? যা তোমার একটুও ঘাবড়াবার কিছু নাই, আমার কথা শোনো-আমি যা বলি সেইভাবে কাজ করে যাবে, দেখবে তোমার গায়ে আঁচড়টি লাগবে না। এক কাজ কর, জেলেপাড়া গিয়ে একখানা মাছধরা জাল নিয়ে এসো। আমি তোমাকে অনেক কায়দা করে জালখানা পরিয়ে দেব। শাহজাদার সামনে দাঁড়ালে সে বুঝবে তুমি একই সঙ্গে পোশাক পরে আছ আবার উলঙ্গ হয়েও আছ। আর সঙ্গে নিয়ে যাবে একটা পেঁয়াজ। শাহজাদার সামনে দাঁড়াবার আগে পেঁয়াজটার রস চোখে লাগিয়ে দেবে। তাহলেই তুমি একই সঙ্গে হাসতেও পারবে, কাঁদতেও পারবে। একটা খুদে গাধার ওপর চেপে তুমি হাজির হবে সেখানে। তোমার পা দু’খানা নিচে নামালেই মাটিতে ঠেকে যাবে। তা হলে একই সঙ্গে গাধার পিঠে চড়াও হবে
– আবার মাটিতে ঠেকে যাবে। এরপর খোদা ভরসা, নসীবে যা থাকে হবে।
জাইনাহর বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে যায় ফেরিওয়ালা। মেয়েকে আদর করে তার যথা পরামর্শ মতো সেজেগুজে গাধার পিঠে চেপে প্রাসাদের দিকে রওনা হয় পরদিন প্রত্যুষে।
শাহজাদা ফেরিওয়ালার বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতা দেখে অবাক হয়। মনের ক্ষোভ মনেই চেপে গজরাতে থাকে। ফেরিওয়ালার কোনও খুঁতই ধরতে পারে না সে।
ঘরে ফিরে এসে কন্যাকে আদর করে চুমু খেয়ে বলে, মা, তোর বুদ্ধির জোরে আমি আজ মস্ত ফঁড়া কাটিয়ে জান নিয়ে আসতে পারলাম।
জাইনাহ ভাবে, কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই ইতি হবে না। এর পরে শাহজাদা তার ওপর প্রতিশোধ তোলার চেষ্টা করবে। যাই হোক, আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। বাবাকে সে বলে, আমার জন্য লোহার বর্মপোশাক বানিয়ে দাও, তুমি। মেয়েরা যুদ্ধক্ষেত্রে যে ধরনের বর্ম পরে ঠিক সেই রকম। আর দেরি করো না, আজই তুমি কামারকে। বায়না করে এসো, যেন সে কালকের মধ্যেই বানিয়ে দিতে পারে।
পরদিনই বর্ম তৈরি হয়ে এলো! জাইনাহ রণরঙ্গিনী সাজে সাজালো নিজেকে। হাতে নিলো একখানা কাঁচি, একখানা ক্ষুর আর একখানা ইয়া বড় কাটাচামচ। গট গট করে রওনা হলো প্রাসাদের উদ্দেশ্যে।
প্রাসাদের সদরে প্রহরীরা চমকিত হয়ে ফটক ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। জাইনাহ বীরাঙ্গনার মত সদর্পে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করলো। সোজা চলে এলো সে শাহজাদার কক্ষে।
জাইনাহর ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে শাহজাদার আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া হবার দাখিল। কি করবে সে কিছুই ঠিক করতে না পেরে জাইনাহর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে, দোহাই ইফ্ৰিত সাহেবা, আমাকে জানে মেরো না আমি কোনও দোষ করিনি।
জাইনাহ গম্ভীর স্বরে হুকুম করে, ঠিক আছে সোজা হয়ে বস। আমি তোমার মাথার চুল আর গোঁফ কামিয়ে দেব। একটু নড়া-চড়া বা বেয়াদপি করবে না। তাহলে এই দেখছো কাটা-চামচে একেবারে গেলে দেবো তোমার চোখ দুটো।
শাহজাদা তৎক্ষণাৎ সুবোধ ছেলের মতো বসে বসে মাথাটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, না না, এক চুল নড়বো না আমি। দোহাই তোমায় আমাকে অন্ধ করে দিও না।
জাইনাহ কঁচি দিয়ে মাথার আধখানা এবং ক্ষুর দিয়ে ভুরু আর গোঁফের আধখানা কামিয়ে দিলো শাহজাদার। তারপর মুখে লেপে দিলো গাধার গোবর।
তারপর শাহজাদা এবং তার কম্পমান চেলা-চামুণ্ডা খোজা নফরদের সামনে থেকে আবার বীরাঙ্গনার মতো প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে ফিরে এলো সে।
পরদিন সকালে আবার যথারীতি তিন বোন সেজেগুজে সেলাই শিখতে বেরিয়ে পড়ে। এদিন আর ওরা বোরখার নাকাব তুলে রাখে না। একেবারে ঢেকে ঢুকে মাথা নিচু করে প্রাসাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায়।
শাহজাদা সেদিনও বসেছিলো তার ঘরের জানলার পাশে। তিন বোন সামনে আসতেই গলায় মধু ঢেলে সে জিজ্ঞেস করে, কি গো তোমরা কি সেই ফিরিওয়ালার মেয়েরা?
এবার ছোটজন নাকাব তুলে শাহজাদার দিকে তাকিয়েই ফিক করে। হেসে বলে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনার আধখানা ভুরু আর আধখানা গোঁফ কে কামিয়ে দিয়েছে, শাহজাদা?
জাইনাহর এই বাক্যবাণে মুষড়ে পড়ে শাহজাদা। কি উত্তর দেবে ভেবে পায়। মাথাটা আপনা-আপনি ঝুঁকে পড়ে নিচের দিকে। জাইনাহ খিল খিল করে হেসে ওঠে, আহা অত শরম হচ্ছে কেন, শাহজাদা? তা গাধার গোবর খেতে কেমন স্বাদের? ভালোই হজম হয়েছিলো তো?
তিনজনের উচ্চকিত হাসির অট্টরোলে শাহজাদার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। ব্যাপারটা এতক্ষণে তার কাছে কাচের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেছে। দাঁত কড়মড় করে সে সিংহনাদ করতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে পাখিরা অনেক দূরে পার হয়ে গেছে।
ক্রোধে সারা অঙ্গ জ্বলতে থাকে শাহজাদার। কিন্তু নিরুপায় হয়েই নিজের ঘরে বন্দী-জীবন কাটাতে হয় তাকে। অপেক্ষা করতে হয় ততদিন, যতদিন না তার গোঁফ, ভুরু, চুল গজিয়ে বাকী অর্ধেকের সমান হয়ে ওঠে।
আবার একদিন ফেরিওয়ালাকে ডেকে পাঠালো শাহজাদা।
—শোনো ফেরিওয়ালা, আমি তোমার ছোটকন্যাকে শাদী করতে চাই। আশা করি তোমার অমত হবে না? তাকে দেখা অবধি আমি মহব্বতে মজে গেছি। আমার কথায় যদি সায় না দাও, তবে তোমার গর্দান যাবে, ফেরিওয়ালা—হুঁশিয়ার!
ফেরিওয়ালা বললো, এ তো খুবই আনন্দের কথা, তবে কি জানেন মালিক, মেয়ে বড় হয়েছে, তার তো মতামত বলে একটা কথা আছে। আপনি যদি আমাকে কিছু সময় দেন তবে তার মতামত জেনে আপনাকে জানাতে পারি, হুজুর।
শাহজাদা বলে, শুনে সুখী হলাম। একশোবার, তোমার মেয়ের মতামতই তো সব। ঠিক আছে আমি তোমাকে তিন দিনের সময় দিলাম। কিন্তু একটা কথা ইয়াদ রেখ, তোমার মেয়ে যদি রাজি না হয় তাহলে তুমিও বাঁচবে না, তোমার কন্যাও কোতল হবে।
বেচারা ফেরিওয়ালা প্রায় কাঁদ কাঁদ হয়ে ঘরে ফিরে আসে। জাইনাহকে কাছে ডেকে শাহজাদার বাসনার কথা বলে।
—তুই যদি অমত করিস মা, বাপ বেটি দু’জনকেই সে কোতল করবে।
জাইনাহ খিল খিল করে হেসে ওঠে, তুমি কি ভীতু, বাবা। মন থেকে ওসব বাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলো তো, দেখো, কিছু বিপদ হবে না আমাদের। এরকম শাদী তো তোমার মেয়ের পরম ভাগ্যেরই কথা, বাবা! আমি রাজি। তুমি তাকে কথা দিয়ে এসো গে।
ফেরিওয়ালা শাহজাদাকে জানিয়ে এলো তার কন্যার সম্মতি। শাহজাদা তো আহ্বাদে আটখানা হয়ে নৃত্য করতে লাগলো।
বাবা প্রাসাদের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলে জাইনাহ বাজারের এক মিঠাইওলার দোকানে গিয়ে একটা চিনির পুতুল বানাবার বায়না দিয়ে এলো। পুতুলটা হবে একটি সুন্দরী কিশোরীর মাপের। দেখতে হওয়া চাই অবিকল জাইনাহর মতো।
ময়রা বললো, আমার নিজের হাতের কাজের প্রশংসা নিজে করবো না, মালকিন। তবে চিনির পুতুলটা যখন আপনার পাশে দাঁড় করিয়ে দেব তখন আপনার জন্মদাতা বাবাও ঠিক চিনে নিতে পারবেন না কোনটি তার আসল মেয়ে।
পরদিন শাদীর রজনী। বাসর ঘরে বড় দুই বোন জাইনাহর চিনিনির্মিত প্রতিমূর্তিটাকে সোনার পালঙ্কে মখমলের শয্যায় সযত্নে শুইয়ে দিয়ে আবক্ষ চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো। শাহজাদা বাসরঘরে এলে বড় দুই বোন বললো, আমাদের ছোট বোনটির শরীর চিনির পুতুলের মতো। সারাদিনের ধকল সইতে না পেরে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শাহজাদা নিজগুণে তার গোস্তাকি মাফ করবেন।
এই বলে তারা দুইবোন ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেলো। শাহজাদার সুপ্ত ক্রোধ প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো। কোটিবন্ধ থেকে তলোয়ারখানা খুলে নিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে বসিয়ে দিলো সে চিনির পুতুলের গলার ওপর। মুহূর্তে মুণ্ডুটা ছিটকে গিয়ে পড়লো মেঝেয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, এতো জাইনাহর মুণ্ড নয়!
চিনির মুণ্ডুটা মেঝেয় পড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে খুঁড়িয়ে গেছে ততক্ষণে।
শাহজাদা আর একবার বুদু বনলো জাইনাহর কাছে। রাগে। ক্ষোভে সে দিশাহারা হয়ে নিজের তলোয়ার দিয়ে নিজেকেই শেষ করে দিতে উদ্যত হলো।
কিন্তু সেই মুহূর্তে—পর্দার আড়াল থেকে পিছনে ছুটে এসেশাহজাদার হাতের তরবারি চেপে ধরে জাইনাহ, ক্ষমা কর আমাকে। মারতে হয় আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু দোহাই তোমার, নিজে আত্মঘাতী হয়ো না। তা হলে সে পাপ আমি রাখতে পারবো না!
আবার চমক লাগলো শাহজাদার। নতুন করে জানলো জাইনাহকে।এ যেন সম্পূর্ণ এক নতুন মেয়ে। সব ক্রোধ, সব ক্ষোভ মুহূর্তে উবে গেলো কোথায়। তলোয়ার ফেলে দিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো জাইনাহকে বুকের মধ্যে।
এইবার বুঝি দুটি হৃদয়ে নতুন করে ভালোবাসার জন্ম হলো।