এরপর শাহরাজাদ তার কাহিনী শুরু করলো :
কোনও এক শহরে তিন বোন বাস করতো। ওরা সবাই একই পিতার সন্তান। কিন্তু মা ভিন্ন ভিন্ন।
তিন বোন একই সঙ্গে থাকতো। শনের কাপড় বুনে অন্ন সংস্থান করতো।
তিনজনেই দেখতে শুনতে অপরূপ ছিলো। বিশেষ করে ছোটটির রূপের জেল্লার কোনও তুলনা হয় না। হাতের কাজও তার নিখুঁত। অন্য দুই বোনের কাপড় বোনার সঙ্গে তার বোনার আকাশ পাতাল তফাত ছিলো। ফলে ওদের বোনা কাপড় যে দামে বিকাতো তার অনেক বেশি দামে বিক্রি হতো ছোট বোনা কাপড়। এই সব কারণে বড় দুই বোন প্রচ্ছন্ন ঈর্ষার চোখে দেখতো তাকে।
একদিন ছোট বোন বাজার থেকে একটা ছোট্ট চিনেমাটির ফুলদানী কিনে নিয়ে এলো। জিনিসটা দেখতে সুন্দর সন্দেহ নাই। কিন্তু মেহনতের সীমিত পয়সা খরচ করে এমন শৌখিন বস্তু আবার কেউ কিনে নাকি! বড় বোন ঠোঁট উল্টে চোখ নাচিয়ে মেজকে বলে যতসব আদিখ্যেতা। মেজ বলে ঢং দেখে আর বাঁচি না। পেটে খেতে কুলায় না, এদিকে ফুলে সাজাবেন ঘর!
ছোট বোন ওদের ব্যঙ্গ বিদ্রপে আহত হলো, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। নিজের ঘরে গোলাপ ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখলো ফুলদানীটি।
আসলে এই ফুলদানীটি একটি অভিনব যাদু বস্তু। ফুলদানীর সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম মুখরোচক খানাপিনা বা সুন্দর সুন্দর জমকালো সাজ-পোশাক বা অন্য যা কিছু চাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে সে সব এসে হাজির হয়। কিন্তু ছোট বোন ফুলদানীর এই আশ্চর্য ক্ষমতার কথা সযত্নে গোপন করে রাখে। ওরা জানতে পারলে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে।
রাতে যখন অন্য দুই বোন ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে, ফুলদানীর কাছে ভালো ভালো খাবার-দাবার, সাজ-পোশাক গহনা চায়। এবং তৎক্ষণাৎ এসে হাজির হয় সব। তৃপ্তি করে খানাপিনা করে সে। তারপর সেই বন্ধ ঘরে একা একাই বাহারী সাজে অলঙ্কারে সেজে-গুজে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে পুলকিত হয়। আবার সকাল হতে না হতে অন্য দুই বোন ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই সাজ-পোশাকটি ছেড়ে ফেলে ফুলদানীকে বলে, ছোট ফুলদানী, ছোট ফুলদানী, এ সবগুলো এখন তুমি নিয়ে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে সাজ-পোশাক অলঙ্কারাদিঅদৃশ্য হয়ে যায়। সুতরাং দুই বোন ঘূণাক্ষরেও কিছু টের পায় না।
এইভাবে কয়েকটা মাস কেটে যায়, বড় দুই বোনের সামনে সে নিতান্ত গরীব-সরীবের মতো থাকে। কিন্তু রাতের বেলায় নিজের ঘরে সে শাহজাদী বনে যায়।
একদিন সুলতানের পেয়াদা বরকন্দাজরা তাঁড়া পিটিয়ে সারা শহরবাসীকে শাহজাদীর শাদীর নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলো। বড় দুই বোন ছোটকে বললো, তুই আর গিয়ে কি করবি, বাড়িটা পাহারা দে, আমরা দু’জনে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে আসি।
ছোট আহত হলো, কিন্তু মুখে কোনও প্রতিবাদ করলো না।
ওরা নিজেদের সেরা সাজ-পোশাক যা ছিলো তাই বের করে সেজে-গুজে সুলতানের প্রাসাদে রওনা হয়ে গেলো। ছোট তখন ফুলদানীকে বললো, আমার জন্য এমন সাজ-পোশাক এনে দাও যা দেখে প্রাসাদের বেগম বাদীরাও ভিরমি খেয়ে যায়। আমার দু’হাতের জন্য চাই দশটা হীরে চুনী পান্না মুক্তোর সুন্দর সুন্দর আংটি, তুরস্কের রংদার বাজুবন্ধ এবং পায়ের জন্য ছোট ছোট হীরেখচিত মল।
ফুলদানীটা তখুনি ছোটবোনের চাহিদা পূরণ করে দিলো। খুব সুন্দর করে শাহজাদীর মতো সেজেগুজে সে প্রাসাদে এসে হাজির হলো। তার সাজের বাহারে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আমন্ত্রিতরা। এ ওর কানে ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগলো, নিশ্চয়ই কোনও আমীর বাদশাহর কন্যা হবে।
সাজ-পোশাক এবং অলঙ্কার আভরণের চাকচিক্যে ছোটর চেহারা এতই চমৎকার দেখাচ্ছিল যে নিজের বোনরাও তাকে চিনতে পারলো না সেখানে।
খানাপিনা শেষ হতেই শুরু হলো জলসা, নাচ গানের আসর যখন জমজমাট, সবাই যখন আনন্দে আত্মহারা, সেই সুযোগে সবার অলক্ষ্যে ছোট প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের, বাড়িতে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে। গান-বাজনা শেষ হলেই তার বোনরা বাড়ি ফিরে আসবে। তাই তার আগেই সাজ-পোশাক গহনাপত্র আবার ফুলদানীর কাছে জমা করে দেবে, সেই জন্যে ত্বরিতপদে ঘরে ফিরে এলো সে। কিন্তু গহনাপত্র খুলতে গিয়ে দেখলোবা পায়ের মলখানা কোথায় খুলে পড়ে গেছে! মনটা ঈষৎ খারাপ হয়ে গেলো, তা যাক, ফুলদানীর কাছে চাইলে তো আর অভাব হবে না কিছু!
প্রতিদিন সকালবেলায় শাহজাদা প্রাতঃভ্রমণে বেরোয়। সেজেগুজে তার তাজি ঘোড়াটায় চাপবে বলে আস্তাবলে আসতেই দেখে সহিসরা কী একটা বস্তু দেখতে ভিড় জমিয়েছে। শাহজাদাকে দেখে তারা শশব্যস্ত হয়ে ছুটে পালাতে থাকে। শাহজাদা দেখতে পায় একজনের হাতে একটি রত্নালঙ্কার।
—এই—এদিকে শোন; তোর হাতে ওটা কি রে?
লোকটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, আমার কোনও গুণাহ নাহী হুজুর, এটা আমি আস্তাবলের দরজার সামনে কুড়িয়ে পেয়েছি, বিশ্বাস করুন।
এই বলে সে অলঙ্কারটি শাহজাদার হাতে তুলে দেয়। শাহজাদা দেখে বুঝতে পারে কোনও বাদশাহজাদীর সাধের মল। চলতে চলতে চরণ থেকে স্খলিত হয়ে গিয়ে থাকবে। মলটি মহামূল্যবান হীরকতারকা খচিত বলে নয়, আশ্চর্য হলো সে এতো ক্ষুদ্রাকৃতির মল যে চরণে আশ্রয় পেয়ে ধন্য হয়েছিলো, না জানি সে সুন্দরী দেখতে কেমন অপরূপ! নানা ভাবে সে কল্পনায় তার মুখচ্ছবি আঁকতে চেষ্টা করে। কিন্তু বার বারই ব্যর্থ হয়। বুকের মধ্যে এক অদম্য বাসনা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। অদর্শনাকে দেখার জন্য, প্রাণের প্রিয়তমা রূপে একান্ত আপন করে পাওয়ার জন্য বুকের মধ্যে উথাল পাথাল শুরু হয়ে যায়।
শাহজাদার এই প্রেম-জ্বরের কাহিনী সুলতানের কর্ণগোচর হতে বেশি সময় লাগে না। একমাত্র পুত্রের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য সুলতানের চেষ্টার অন্ত নাই। শাহজাদার অভিপ্রায় জানার পর উজিরদের ডেকে বললো, সারা শহর তোলপাড় করে খোঁজার ব্যবস্থা কর। একটি মূল্যবান হীরের মল পাওয়া গেছে আমার প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে। অনুমান করছি শাহজাদীর শাদীর সময় আমন্ত্রিত হয়ে যারা এসেছিলো তাদেরই কারো হবে সেটি। যারই হোক, সেই মালকিনকে হাজির করো আমার প্রাসাদে।
সুলতানের হুকুমে সঙ্গে সঙ্গে সারা শহরে সিপাই সান্ত্রীরা সন্ধান করতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু বাদশাহের পেয়াদা বরকন্দাজের সামনে মুখ খুলবে কে? সুলতানের লোকেরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। মল-মালকিনের সন্ধান পাওয়া গেলো না। এই সংবাদে শাহজাদা বিরহ-বেদনায় কাতর হয়ে শয্যা নিলো। পুত্রের মুখ চেয়ে শাহবানু সুলতানকে প্রস্তাব দিলেন, অলঙ্কারটি একটি মেয়ের সুতরাং তাকে খুঁজে বের করতে গেলে প্রতিটি বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
সুলতান বললেন, বেশ তাই কর। ঘরে ঘরে মেয়েদের পাঠাও। তারা প্রতিটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জেনে আসুক।
খুঁজতে খুঁজতে সুলতানের নারীচররা অবশেষে তিন বোনের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। পায়ের গোড়ালীর সরু গোছ দেখে তারা বুঝতে পারে ঐ ছোট্ট মলটির মালকিন তিন বোনের ছোটজন ছাড়া আর কেউ নয়! জেরার মুখে পরে সে স্বীকার করতেও বাধ্য হয়, হামলটা তারই। প্রাসাদে নিমন্ত্রণ সেরে ফেরার পথে তার পা থেকে খসে পড়ে গেছে।
শাহবানুর চররা মহা সমাদরে ছোট বোনকে প্রাসাদে নিয়ে যায়। শাহবানুতাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে বলে, বাঃ কি সুন্দর দেখতে তুমি, আমার ছেলের সঙ্গে তোমার শাদী দেব।
সঙ্গে সঙ্গে সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। শাদীর উৎসবে মুখর হয়ে উঠলো সারা শহর।
ঈর্ষাকাতর বড় দু’বোন জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ছোটর সৌভাগ্যে খুব যেন খুশি হয়েছে এমনি ভাব দেখাতে থাকে। ছোট সরলমতি মেয়ে, সে ওদের মনের কুটিলতা ধরতে না পেরে খুশির বন্যায় গা ভাসিয়ে বলে, সুলতানের অতবড় প্রাসাদে আমি একা-একা দিন কাটাবো কি করে দিদি, তোমরা চলো আমার সঙ্গে।
ওরা পা বাড়িয়েই ছিলো, তখুনি রাজি হয়ে গেলো দু’জনে। মহা ধুমধামে শাদী পর্ব সমাধা হয়ে গেলো। একটানা চল্লিশ দিন আনন্দে উৎসবে উত্তাল হয়ে কাটালো সারা শহরবাসী।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো তিরাশিতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
চল্লিশটা দিনের আনন্দমুখর সুখ-সম্ভোগে ছোট বোন আত্মহারা হয়ে বড় দুই বোনকে সেই আশ্চর্য যাদু ফুলদানীর গুপ্ত রহস্য বলে ফেলে। এখন সে সুলতানের পুত্রবধু, সুতরাং ঐশ্বর্যের আর অভাব কী? সুতরাং ঐ ফুলদানীটা তার দিদিরাই নিক।
কিন্তু কাল হলো সেই। চল্লিশ দিনের শেষ দিনে সে হামাম থেকে গোসলাদি সেরে ঘরে ফিরে এসে দিদিদের সামনে চুল বাঁধতে বসে। বড় বোন সযত্নে পরিপাটি করে কেশ পরিচর্যা করে একটা খোঁপা বেঁধে তার চার পাশে সোনার কাটা খুঁজতে থাকে। একটা একটা করে আটখানা কাঁটা গোঁজা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট বোনটি, কি আশ্চর্য হঠাৎ একটি ঝুঁটি বাঁধা বুলবুলি পাখিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। দু’বোন তখন হাতের তুড়ি বাজিয়ে পাখিটিকে প্রাসাদকক্ষের বাইরে তাড়িয়ে দেয়। ছোটবোন পাখি হয়ে মনের দুঃখে জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে গিয়ে সামনের বাগিচার একটা ফুলগাছের ডালে গিয়ে বসে।
এর পর দুই বোন আনন্দে নাচতে নাচতে প্রাসাদ ছেড়ে নিজেদের ঘরে ফিরে আসে।
সন্ধ্যায় শাহাজাদা শয্যাকক্ষে এসে দেখে তার প্রান-প্রতিমা অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রথমে সারা প্রাসাদ, তারপর সারা শহর তোলপাড় করেও কোনও সন্ধান করতে পারা গেলো না। বড় দুই বোন শোকের ভান করে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে বসে, ওরে বাবারে, এ আমাদের কি হলো গো! এতো আদরের পিয়ারের বোন তুই কেন বা তুই শাহাজাদার বেগম হতে গেলি–
শাহাজাদা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে নিজের ঘরে পড়ে থাকে। আর পাখিটা জানলার ওপর এসে বসে কিচির মিচির আওয়াজ তুলে কত কী বলে। প্রথম প্রথম শাহাজাদা বিশেষ নজর দেয়নি। কিন্তু দিন কয়েক পরে, রোজ দেখে দেখে পাখিটার ওপর কেমন মায়া বসে যায় তার।
আদর করার জন্য সে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাবে,ভয় পেয়ে বুঝি পালিয়ে যাবে পাখিটা।
কিন্তু না, ভয় সে পায় না, বরং শাহাজাদার হাতের স্পর্শ পেয়ে আদরে গলে যায় সে।
অনেক শোক তাপের মধ্যে এই পাখিটাকে পেয়ে শাহাজাদা মনটাকে একটু হালকা করতে পারে। নিজে হাতে করে সে তাকে খাওয়ায়, আদর করে।
পাখিটার মাথায় সুন্দর একটি খোপর মতো ঝুঁটি। শাহাজাদা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হাতে শক্ত কী যেন অনুভব করে কৌতূহলী চোখে ঝুঁটিটার দিকে বিশেষ ভাবে নজর করে।
আশ্চর্য তো! পাখির মাথায় ঝুঁটিতে সোনার কাঁটা! একটা একটা করে কাটাগুলো ওঠাতে থাকে সে। সাতটা কাটা তোলর পর অষ্টম কাঁটাটি টেনে তুলতেই বুলবুলিটা তার আসল রূপ ফিরে পেয়ে শাহাজাদাকে সালাম করে দাঁড়ায়।
এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত।
তার সৌভাগ্যের ঈর্ষায় কাতর হয়ে বড় দুই বোন, তারই কাছ থেকে উপহার পাওয়া যাদু,, ফুলদানীর কাছ থেকে ঐ যাদুকরী সোনার কাঁটাগুলো চেয়ে নিয়েছিলো।
এর পরে অনন্ত সুখ-সম্ভোগের সায়রে গা ভাসিয়ে ওরা দু’জনে সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছিলো। অনেক সুন্দর সুন্দর সন্তানের জনক-জননী হতে পেরেছিলো ওরা। আর ঐ দুষ্টপ্রাণ দুই বোন হিংসার জ্বালায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে মরেছিলো।
সে রাত শেষ হতে তখনও অনেক বাকী। তাই শাহরাজাদ অন্য একটি কাহিনী শুরু করলো :