লোকটি কুর্ণিশ জানিয়ে বলতে শুরু করে :
ধর্মাবতার, আমি ছিলাম এক দরিদ্র মাদ্রাসা-মৌলভী। চব্বিশটি ছাত্রকে নিয়ে চালাতাম আমার বিদ্যালয়টি। এই ছেলেদের নিয়েই আমার কাহিনী।
শিক্ষক হিসাবে আমি ভীষণ কড়া মানুষ ছিলাম। ছেলেরা আমাকে দেখে ভয়ে কাঁপতো। সারাদিনের মধ্যে এক দণ্ডও বিশ্রাম দিতাম না তাদের। সেই সকালে আসতো তারা। আর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে যেত। তার মধ্যে ছুটি বলে কিছু থাকতো না।
একদিন সবে আমি মাদ্রাসায় এসে ছাত্রদের নিয়ে পাঠ শেখাতে বসেছি, এমন সময় একটি ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে সভয়ে বললো, মৌলভী সাহেব, আপনার মুখখানা কেমন হলুদবর্ণ হয়ে গেছে কেন?
আমি তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিই, আর ভেঁপোমি করতে হবে না। চুপ করে বসো। ছেলেটি মাথা হেট করে বসে পড়লো কিন্তু আমার সহকারী এক শিক্ষক এগিয়ে এসেও ঐ একই কথা বললো, সত্যিই মৌলভীজী, আপনার সারা মুখে কে যেন হলুদ বেটে লাগিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আপনার কোনও অসুখ হয়েছে। আপনি ঘরে চলে যান, আজ আমিই আপনার ছাত্রদের পাঠ শিখিয়ে দেব।
এরপর প্রতিটি ছাত্রই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এমন আঁৎকে উঠতে লাগলো তা দেখে সত্যি সত্যি আমি ঘাবড়ে গিয়ে অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম।
মনে ভয় ধরে গেলো, তবে কি আমার ন্যাবা হয়েছে? দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে এলাম। বিবিকে বললাম, আমার জন্য একটু শরবত বানাও তো। তবিয়তটা ভালো ঠেকছে না।
এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
আটশো বাহাত্তরতম রজনী
আবার সে বলতে থাকে :
একটু পরে আমার সহকারী শিক্ষক এলো। চব্বিশটা দিরহাম তুলে দিলো আমার হাতে, আপনার ছাত্ররা চাঁদা তুলে পাঠিয়েছে। আপনার ভালো পথ্যের যাতে ব্যবস্থা করা হয় তা দেখতে বলেছে আমাকে।
আমি ওদের এই সহৃদয় বদান্যতায় বড় স্পর্শকাতর হয়ে উঠলাম। আহা, ওরা কত ভালো আর ঐ দুধের বাচ্চাগুলোর ওপর কি নির্দয় অত্যাচারই না করি আমি। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে গেলো।
-কাল ওদের সারাদিন ছুটি দিয়ে দিও। আচ্ছা একটা দিন ওরা ছুটি পায় না, এক দম খেলাধুলোর সময় পায় না।
পরদিন সকালে আমার সহকারীটি আবার এলো আমার বাসায়।
—একি আজ যে আপনি আরও বেশি হলুদ বর্ণ হয়ে গেছেন? না না, একদম নড়া চড়া করবেন না। একটানা বিশ্রাম করুন। ছাত্রদের নিয়ে কোনও দুর্ভাবনা করবেন না, সে আমি সামলাবো।
ওর কথা শুনে আমি আরও কাহিল হয়ে পড়ি। আমি নিজে এখনও তেমন কিছু বুঝতে পারছি না কিন্তু রোগের প্রকাশ যখন হয়েছে তখন ভিতরে ভিতরে আঁঝরা করে দেবে সে। আমি
বললাম, ছেলেদের পড়াশুনাটা একটু দেখো। মনে করো আমি মাদ্রাসার কুর্শিতেই বসে সবাইকে লক্ষ্য করছি।
এইভাবে একটা সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। আমার সহকারী নিত্য এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়। সপ্তাহান্তে আবার সে চব্বিশটা দিরহাম দিয়ে গেলো আমার হাতে। আমার ছাত্ররা চাদা তুলে পাঠিয়েছে। খুশিতে মন ভরে উঠলো। আহা, ওরা কত ভালো।
দিন কাটে। কিন্তু নিজেকে একটুও অসুস্থ মনে হয় না আমার। ভাবলাম এইভাবে আর রুগীর মতো বিছানায় পড়ে থাকবো না। ঘরে বসে ঐ সব ভালো ভালো খানাপিনা কি আর রোজ মুখে রুচে। সত্যি কথা বলতে কি অত সব ভালোমন্দ খাবার-দাবার খাওয়ার অভ্যাস আমার কোনও কালে নাই। তাই, প্রথম প্রথম দু-একদিন চৰ্য্য চোষ্য করে খেলেও পরে আর আদৌ ভালো লাগলো না।
কিন্তু ছাত্ররা আমার কথায় কর্ণপাত করলো না। তাদের ধারণা আমি ওঠা হাঁটা করলেই মরে যাবো।
এরও কয়েকদিন পরে একদিন সকালে আমার তাবৎ ছাত্ররা দেখতে এলো আমাকে। আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি তখন। ছেলেরা আমার মুখের দিকে কতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। তারপর একজন বললো, একি চেহারা হয়েছে আপনার? মুখখানা কেমন ফোলা ফোলা লাগছে। শুনলাম আপনি নাকি চোয়াল নাড়াচাড়া করতে পারছেন না?
এই সময় আমার বিবি দুটো সিদ্ধ ডিম আর কয়েক টুকরো রুটি রেখে গেলো সামনে। আমার নিত্যকার প্রাতরাশ। আমি বাধা দিয়ে বললাম, কারা এসব গুজব রটায়? কে বললে আমি চোয়াল নাড়তে পারি না?
এই বলে ওদের সামনে বাহাদুরী দেখাবার জন্যে দু দু’টো ডিম একই সঙ্গে মুখে পুরে ফেললাম। কিন্তু সদ্য সিদ্ধকরা খোসা ছাড়ানো প্রচণ্ড গরম ডিমের ভাপ মুখের অভ্যন্তরের নরম মাংসল মণ্ডল সইতে পারবে কেন? মনে হলো সারা মুখের ভেতরটা পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলো। কিন্তু তখন সেই অবস্থায় ছেলেদের সামনে মুখ থেকে ডিম দুটোকে আবার বের করে ফেলি কিরূপে। তাতে যে সপ্রমাণ হয়ে যাবে, তারা যা শুনেছে তা তাহলে সত্যিই।
কিন্তু দু’দু’টো আস্ত ডিম এক সঙ্গে মুখে পুরে এগাল ওগাল করা সম্ভব কী? আর জাবর কাটতে না পারলে গিলবোই বা কি করে, তাই সদ্যসিদ্ধ ধোঁয়াওঠা ডিমজোড়া অনড় অচল হয়েই রয়ে গেলো আমার মুখগহ্বরে।
এরপর যা অবশ্যম্ভাবী ফল ঘটতে পারে তাই ঘটেছিলো। গরম ডিমের সাকা লেগে দু’ গালের নরম মাংস পুড়ে ঘা হয়ে গেলো। এবং সে ঘা আর শত চেষ্টা করেও সারাতে পারলামনা। তারই পরিণতি আজ এই রকম হয়েছে। দুপাশের চোয়াল পচে পচে খসে খসে পড়ছে এখন। বিশ্রী দুর্গন্ধে কোনও মানুষ আমার কাছে ভিড়তে পারে না।
মুখের ঘা নিয়েও আমি কিছুদিন মাদ্রাসা চালিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকদিন শাসন না করার ফলে ছেলেগুলো বড় বেয়াড়া হয়ে পড়েছিলো। আগে যেমন আমাকে জুজুর মতো ডরাতো তখন কিন্তু আর তেমনটা করতো না।
যাই হোক, কোনও রকমে দিন কাটছিলো, কিন্তু নসীবে যা লেখা আছে তা খণ্ডন করবে কে? গোদের ওপর বিষফোড়া হলো। একে দু’গালের দুরারোগ্য ক্ষত তারপর একখানা পা খোঁড়া হয়ে গেলো।
একদিন দুপুরে প্রচণ্ড দাবদাহে দুনিয়া জ্বলছে। ছেলেরা বললো, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি খাব।
মাদ্রাসায় যেটুকু পানি ছিলো খতম হয়ে গেছে অনেক আগেই। বড় মায়া হলো, আহা। এইটুকু কচি কচি বাচ্চারা পানি পান করতে না পেয়ে কষ্ট পাবে? ওদের বললাম, ওপাশে গাছতলায় একটা কুয়া আছে কিন্তু পানি তোলার পাত্র তো কিছু নাই এখানে। ঠিক আছে, তোমরা সবাই আমার সঙ্গে চলো, দেখা যাক কি করে ওঠানো যায় কুয়ার পানি।
আমার দারুন বুদ্ধি ছিলো। ছেলেদের বললাম, তোদের সব টুপিগুলো নিয়ে এই পাগড়ীর একপ্রান্ত ধরে আমি কুয়ার নিচে নেমে যাবে। তারপর টুপিগুলো ভরে পানি নিয়ে আসবো। কিন্তু সাবধানে নামিয়ে দিবি, আবার টেনে তুলবি আমাকে।
যথারীতি ওরা আমাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে দিচ্ছিল নিচে। আর খানিকটা নামালেই পানি স্পর্শ করতে পারতাম। কিন্তু তা আর হলো না। কূয়ার নিচে থেকে বুঝতে পারলাম, ওপরে কিসের যেন সোরগোল পড়েছে। ঘোড়া কিংবা গাধা কিছু একটা তাড়া করেছিলো ছেলেদের। এবং সেই ভয়ে তারা হাতের পাগড়ী ছেড়ে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেছে। আর আমি পড়ে গেছি তলায়।
কুয়াতে বেশি গভীর পানি ছিলো না। সে দিক থেকে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো না। কিন্তু আচমকা আছাড় খাওয়ায় এই পা-টায় বিষম চোট পেলাম। তখন অবশ্য অতটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে মালুম হলো। প্রচণ্ড ব্যথা হলো, পা-খানা ফুলে ঢোল হয়ে গেলো। পরে ফোলাটা কমলেও ব্যথাটা চির সঙ্গী হয়ে থেকে গেলো আমার কাছে।
তারপর থেকে লাঠি ভিন্ন চলাফেরা করতে পারি না, জাঁহাপনা। মাসরুর লোকটিকে ধরে বসতে সাহায্য করলো।