3 of 4

৪.২০ সিদি নুমানের কাহিনী

শুনুন ধর্মাবতার, আমার নাম সিদি নুমান। আজ যে কাহিনী বলার জন্য আপনি আমাকে অদেশ করেছেন তা আমাদের পরিবারের ধর্মবিশ্বাসের কাহিনী।

অল্পক্ষণের জন্য যুবকটি নীরব হলো। হয়তো বা সে কাহিনীটা মনে মনে একবার ঝালাই করে নিতে চাইলো।

আমার বাবা যখন ইন্তেকাল করলেন, তাঁর বিশাল বিত্তের আমিই একমাত্র উত্তরাধিকারী হলাম। যে-কোনও মানুষের কাছে সে ধনসম্পদ কেবলমাত্র যথেষ্ট নয়—প্রচুর। এক কথায় অতুলনীয়ও বলা চলে। আমাদের এলাকায় আমার চেয়ে ধনীমানুষ আর কেউ নাই।

ছোটবেলা থেকেই, আমাদের বংশমর্যাদা বা আভিজাত্য অহঙ্কারের জন্যেই বোধহয় আমি একেবারে নিঃসঙ্গ একা। পাড়া প্রতিবেশী কারো সঙ্গে মেলামেশা করা নিষেধ ছিলো। তাই ছোট থেকেই আমি নির্বান্ধব অবস্থায় মানুষ হয়েছি। এবং বড় হয়েও সে অভ্যাস কাটাতে পারিনি। কোনও বাধা নিষেধ অবশ্য ছিলো না তখন, কিন্তু আমার নিজেরই ভালো লাগতো না কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে। নিঝঞাট শান্ত একা একা থাকতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

এবং বোধহয় এই কারণে এখনই আমি অবিবাহিত।কাউকে শাদী করে আমার জীবন-সঙ্গিনী করবো, সেকথা ভাবতেই পারি না আমি। আমিই আমার একমাত্র মালিক, তার ওপর কেউ ভাগ বসাতে আসবে সে আমি সইতে পারবো না। সেই কারণে আজও আমি অকৃতদার। বিবি বন্ধু ইয়ারবিহীন একা একা থাকায় যে কী মজা তা কী করে বোঝাবো আপনাকে। যে যাই বলুক, আমার মতে নিঃসঙ্গ মধুর জীবনের চেয়ে আর কিছুই সুন্দর হতে পারে না।

এই ছিলো আমার আজন্মের ভাবনা। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে আমার এতোকালের ধ্যান ধারনার অকস্মাৎ পরিবর্তন ঘটে গেলো। ভাবতে শুরু করলাম, এই একঘেয়ে জীবনের গতি

ফেরাতে হবে। শাদী করে নতুন ভাবে জীবন শুরু করবো। জগতে এতো ভোগের সামগ্রী আছে তা যদি সময়কালে আস্বাদ করেই না দেখলাম তবে তো জীবনটাই সেই আঙুর ফল কি শৃগালের মতো হয়ে যাবে।

কিন্তু শাদী কী করে সম্ভব? আমাদের যা বংশমর্যাদা, তার সমকক্ষ অভিজাত পরিবারই বা তামাম আরব দুনিয়ায় ক’টা আছে? আর দু’চারটে থাকলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগই বা ঘটতে পারবে কী উপায়ে? এছাড়া অন্য নিচু বংশের কোনও মেয়েকে ঘরের বিবি করার প্রশ্নই উঠতে পারে না আমাদের পরিবারে।

কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, যার কড়া শাসনে কেটেছে এতকাল সেই বাবা তো গত হয়েছেন। এবার আমার পরিবারের আমিই তো মাথা। আমি যদি ঐ সব নীল রক্তের বাধা না মানি কে আমার গর্দান নেবে?

তাই ঠিক করলাম, বাঁদী-হাট থেকে পরমাসুন্দরী দেখে একটি মেয়ে কিনে আনবো আমার জন্য। তারপর যদি মনে ধরে তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে শাদী করে বিবি বানাবো। না হলে, যেমন বাঁদী তেমনি বাঁদীই সে থেকে যাবে। ক্ষতি কী?

পরদিন সকালে আমি বাঁদীবাজারে গেলাম। খবর পেয়েছিলাম সম্প্রতি নানা দেশ থেকে পরমাসুন্দরী মেয়েরা সব এসেছে। আমাকে দেখেই দালাল এবং নিলামদাররা হেঁকে ধরলো। এক এক করে অনেক মেয়েকে দেখালো তারা। আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেলো। যাকেই দেখি তাকে ডানাকাটা পরী বলে মনে হতে লাগলো। এক সঙ্গে এতোগুলো পরমাসুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখিনি কখনও। তাই বাঁশবনে ডোম কানার মতো দিশাহারা হয়ে পড়লাম।

রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

আটশো বাষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরেও আমি ঠিক করতে পারলাম না কাকে কিনবো। অথচ বাড়ি থেকে পণ করে বেরিয়েছি, খালি হাতে ফিরবো না। একটি বাঁদীকে আনবোই ঘরে। তাই শেষমেশ সব চেয়ে বয়সে ছোট যে মেয়েটি তাকেই পছন্দকরে দাম জিজ্ঞেস করলাম। তার রূপের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার নাই তবে বলতে পারি অমন রূপসী কন্যা সচরাচর চোখে পড়ে না।

যাই হোক তারই হাত ধরে আমি ঘরে ফিরে এলাম। ওর শান্ত বিনয় নম্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছিলো।

কিন্তু অসুবিধায় পড়লাম, সে আমার ভাষা বোঝে না, আমিও তার ভাষা জানি না। তাই আমি তাকে কোনও প্রশ্ন করতে পারি না, সেও কিছু বলতে সমর্থ হয় না। তবুও আমার বেশ ভালো লেগেছিলো। নাই বা বুঝলো সে আমার মুখের কথা, মনের ভাষা পড়তে তো শুধু ভালোবাসার দরকার হয়। আমরা যদি দু’জনে দু’জনকে ভালোবাসতে পারি তবে মুখের ভাষা কোনও অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না।

মেয়েটি কিন্তু আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায় না। আকারে প্রকারে নানা ভাবে তাকে কাছে টানার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু কিছুতেই সাড়া দেয় না সে।

আমার স্বভাব প্রকৃতি জন্মগত ভাবেই একটু ভিন্ন ধাঁচের। জোর জুলুম গায়ে পড়ে ভাবসাব করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বিশেষ আর বিরক্ত করলাম না তাকে।

সে নিজের খেয়ালেই চলাফেরা করে। বলতে গেলে আমার সামনেই আসতে চায় না সে। আমিও ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না।

এইভাবে দিন দশেক কেটে গেলো। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমার বাঁদী পাশের ঘরে শোয়। ভাবলাম দেখে আসি তো কেমন সে ঘুমাচ্ছে।

কিন্তু অবাক হলাম, পাশের ঘরের সামনে যেতেই বুঝতে পারলাম, মেয়েটি এই নিশুতি রাতেও বিছানায় শোয় নি। ঘরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত অবধি অস্থির পায়ে পায়চারী করে চলেছে।

মনে হলো, মেয়েটিকে কিনে আনা আমার উচিত হয় নি। কেনার আগে ওর মত জানা উচিত ছিলো।

যাই হোক, কতক্ষণ সে ঐ ভাবে না ঘুমিয়ে কাটায়, আমার দেখা দরকার। হয়তো এই গৃহ ওর কাছে কয়েদখানার মতো মনে হয়েছে। তা যদি হয় তবে তো ওকে আর এখানে বন্দী করে রাখা। ঠিক হবে না।

কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি দরজা খুলে বাইরে বেরুলো। আমি নিজেকে আড়াল করবার জন্য অন্য পাশে সরে গেলাম। মেয়েটি ধীর পায়ে চলতে চলতে বাড়ির সদর ফটক ছাড়িয়ে পথে নামলো। আমি অবাক হয়ে তাকে অনুসরণ করে চললাম। সে বুঝতে না পারে সেইভাবে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে ওর পিছনে পিছনে যেতে থাকলাম।

আমাদের বাড়ির অদূরে একটি কবরখানা। মেয়েটি সোজা গিয়ে প্রবেশ করলো ঐ গোরস্থানে। বেশ সহজ এবং সাবলীল গতিতে এমন ভাবে ঢুকলো যা দেখে আমার মনে হলো, এ জায়গা যেন তার কতকালের চেনা।

মেয়েটি কবরখানার মাঝখানে গিয়ে একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটু পরে দেখলাম, একটি ছায়ামূর্তি উঠে এলো ঐ কবর থেকে। তারপর মেয়েটিকে হাতে ধরে একটা বেদীর ওপর বসে পড়লো।

আমি একটু দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনকে দেখতে থাকলাম। ছায়া মূর্তি কবরের তলা থেকে একটি মানুষের মাথা তুলে মেয়েটির হাতে দিলো। আমি শিউরে উঠলাম।

মেয়েটি মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে কামড়ে কামড়ে খেতে লাগলো! এই দৃশ্য দেখে আমি ভয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিলাম। আমার চিৎকারে ওরা দু’জন তেড়ে এলো আমার দিকে। আমি তখন প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে মাটিতে পড়ে গেছি।

মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় বিড় বিড় করে কি যেন সব বলতে থাকলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম আমি একটি কুকুরে রূপান্তরিত হয়ে গেছি।

এরপর ঐ ছায়ামূর্তি আর মেয়েটি আমার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ে কিল চড় লাথি মারতে মারতে কবরখানা থেকে বাইরে বের করে দিলো। আমি প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলাম।

কিন্তু শহরের যে পথেই যাই অন্য সব কুকুররা আমাকে দেখামাত্র মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে। আমি আরও জোরে ছুটে পালাতে থাকি। কিন্তু পালাবো কোথায়, শহরের সব পথেই নেড়িকুত্তার দল। তারা আমায় দেখামাত্র তাড়া করতে থাকলো।

অবশেষে এক কষাইখানায় এসে ঢুকে পড়লাম। আমার পিছনে পিছনে কুকুরগুলোও ঢুকতে চেষ্টা করলো। কিন্তু দোকানীর ডাণ্ডার তাড়া খেয়ে পিছু হটে গেলো তারা।

বাকী রাতটুকু ঐ দোকানেরই এক কোণে কুঁকড়ে পড়ে রইলাম আমি। দোকানী হয়তো বুঝেছিলো ঐ রাতে আমাকে বের করে দিলে কুকুরগুলো আমাকে ছিঁড়ে খাবে। তাই সে-রাতের মতো সে আর আমাকে কিছু বললো না। কিন্তু পরদিন ভোর হতে না হতেই আমাকে পথে বের করে দিলো সে।

অন্য কুকুরের চোখ ফাঁকি দিয়ে গুটি গুটি চলতে চলতে এক সময় এক রুটির দোকানের সামনে এসে পৌঁছলাম। দোকানের মালিক ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ এক শেখ। সকালের নামাজ সেরে সবে সে তখন নাস্তা করতে বসেছে। আমাকে দেখে বোধ হয় প্রাণে দয়া হলো তার, তাই এক টুকরো রুটি একটু বেগুনের কোপ্তা জড়িয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলো।

সারারাত ধরে অনেক ছুটাছুটি করতে হয়েছে, ক্ষিদেও বেশ পেয়েছিলো। তাই আর দ্বিধা না করে বেশ সাগ্রহেই খেলাম সেই রুটিখানা।

পথে অন্য কুকুর আসছে দেখে আতঙ্কিত হয়ে আমি বৃদ্ধের দোকানের এক কোণে ঢুকে কুঁকড়ে রইলাম। দোকানী বুঝতে পারলো, আমার অসহায় অবস্থা। পথের কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিলো সে।

দুপুরে দোকান বন্ধ করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে তার বাড়িতে এলো। বৃদ্ধের একমাত্র কন্যা আমাকে দেখামাত্র বোরখার নাকাবে মুখ ঢেকে ফেললো। বৃদ্ধ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার বেটি, সঙ্গে তো আমি বাইরের কোনও পুরুষ মানুষকে নিয়ে আসিনি, তা এতো শরম করছো কেন?

মেয়েটি বললো, দাঁড়াও আব্বাজান, আমি আসছি।

এই বলে সে পাশের ঘরে চলে গেলো। একটু পরে একট ছোট্ট পাত্রে খানিকটা জল এনে আমার গায়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে কি যেন সব মন্ত্র আওড়াতে থাকলো। আর কী আশ্চর্য, আমি তখনি, আবার আমার নিজের রূপ ফিরে পেলাম। বৃদ্ধ অবাক হলো ততোধিক। বললো, এসব কী ব্যাপার আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, মা?

মেয়েটি বললো, তুমি যাকে কুকুর বলে ঘরে এনেছো আব্বাজান, আসলে সে এক খানদানী ঘরের নওজোয়ান। এক মায়াবিনীর যাদুতে ঐ অবস্থা ঘটেছিলো ওর।

এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। আগাগোড়া ব্যাপারটা বৃদ্ধকে খুলে বললাম আমি। শুনে মর্মাহত হলো সে। মেয়েটি বললো, ঐ শয়তানীটা এখনও তোমার বাড়িতে আস্তানা গেড়ে আছে। আবার দাঁও পেলেই তোমাকে যাদু করে অনেক তখলি দেবে। তুমি এক কাজ কর, এই মন্ত্রপুত পানির খানিক আমি তোমাকে দিচ্ছি। বাড়িতে গিয়ে ঐ মেয়েটাকে দেখামাত্র সে কিছু করার আগেই তার গায়ে ঐ পানিটুকু ছিটিয়ে দিয়ে বলবে, আল্লা এই শয়তানীকে তুমি একটা মাদী ঘোড়া বানিয়ে দাও। দেখবে সঙ্গে সঙ্গে সে একটা সফেদ মাদী ঘোড়া বনে গেছে। এর পর তোমার কাজ হবে প্রতিদিন ঐ ঘোড়ায় চেপে তুমি তাকে নৃশংস ভাবে চাবকাতে থাকবে। তোমার চাবুকে ওর গা থেকে দর দর করে ঝরতে থাকবে খুন। মুখে ফেনা উঠবে। তখন তাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে আস্তাবলে আটকে রাখবে। এইভাবে একটানা অত্যাচার চালাতে থাকবে নিয়ম করে। যাতে ঐ শয়তানী হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে সে কি করেছিলো।

যুবকটি একবার খলিফার দিকে তাকিয়ে বললো, সেইদিন থেকে আমি ঐ মেয়েটির হুকুম তামিল করে চলেছি, ধর্মাবতার। জানি না, আপনি আমাকে কি সাজা দেবেন এসব শুনে।

খলিফা বললেন, বড় অদ্ভুত তোমার কাহিনী, বেটা। আমি এখন দেখছি, বেইমানকে শায়েস্তা করার জন্য মেয়েটি তোমাকে যা করতে বলেছে তার মধ্যে একটুও বাড়াবাড়ি নাই। ঠিকই করছো তুমি।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *