৪.১ বৃক্ষপর্ব – বাঘারুর প্রত্যাবর্তন

বৃক্ষপর্ব – বাঘারুর প্রত্যাবর্তন

১২০. আপলচাঁদ ফরেস্টে রাত তিনটে

শনিবার রাত তিনটের সময় আপলাদের ভেতরে তিস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে গয়ানাথ ও আসিন্দির তিস্তার ফ্লাড দেখছিল, ঠিক রাত তিনটেয়। আসিন্দিরের এক হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ, আর-এক হাতের কব্জিতে সিকো ঘড়ি ঢলঢল করে। সেই বাতাস, বৃষ্টি আর ফ্লাডের মধ্যেও আসিন্দিরের কব্জিতে নীল সময় দপদপ করছিল, যদি আকাশে তখন তারা থাকত, তবে সে তারাও দপদপ করত আসিন্দিরের সিকো ঘড়ির মতই। বাঘারু ফ্লাড দেখছিল না। সে গয়ানাথ আর আসিন্দিরের একটু পেছনে দাঁড়িয়েছিল। তিস্তার ওপরে ঘোলাটে আকাশ, ঘোলাটে আলো। কিন্তু পাড়ে, অত গাছগাছড়া থাকায় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে বাঘারু আর-একটা গাছের মতই দাঁড়িয়েছিল।

আপলচাঁদ ফরেস্টের ভেতরে গাজোলডোবা যেখানে, সেখানে, শনিবার বিকেল থেকেই তিস্তা পাড় ভাঙছিল। ভাঙতে-ভাঙতে রাত বারটা নাগাদ সেখানে একটা ছোট সোঁতামতই যেন হয়ে যায়। এমন সোঁতা নয় যে তিস্তার জল ওখান দিয়ে হু হু করে ঢুকে আপলাদের ভেতর দিয়ে ছুটবে। কিন্তু এমন একটা সোঁতা যে তিস্তার ফ্লাডের জল এখন ওখানে এসে ধাক্কা মারবে ও আরো মাটি খাবে। পরে, তিস্তার ফ্লাড যখন সরে যাবে–এ সোঁতাটাও শুকিয়ে যাবে। দেখতে-দেখতে গাছগাছালি বা জঙ্গলে গর্তটা বুজে যাবে। এক বছর পরে আর বোঝাও যাবে না যে এখানে তিস্তার একটা সোঁতা ঢুকেছিল।

আসিন্দিরের হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ কিন্তু সে সেটা জ্বালায় না। গয়ানাথ আর আসিন্দির পাড়ে দাঁড়িয়ে তিস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে-যেন তিস্তা থেকে কেউ উঠে আসবে।

গয়ানাথ বলে, কয়টা গাছ পড়িছে দেখ কেনে।

আসিন্দির বলে, কয় দফা দেখিবার নাগে? স্যালায় ত চারিখান পড়িছে, আর পড়ে নাই।

গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে, তর মনত খায় কী? অর্জুন গাছটা পড়িবে কি না পড়িবে?

আসিন্দির পাল্টা জিজ্ঞেস করে–তোমরালার মনত কী খায় বাপা? জল কি আরো ধাক্কা মারিবার ধরোছে? না, ছাড়ি দিছে?

এ কথার জবাবে গয়ানাথ তিস্তার স্রোতের দিকে আরো নিবিষ্ট তাকায়। এখন তিস্তার জল আর আকাশের মেঘ একই রকম ঘোলাটে। তাতে তিস্তার জলের আলাদা গতি, বোঝা যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু গয়ানাথ আর আসিন্দির সেই রাত বারটা থেকে দেখে যাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে দেখতে-দেখতে তারা তিস্তার জল চোখ দিয়ে মাপার কতকগুলি পদ্ধতি তৈরি করে নিতে পেরেছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে তারা এখন বুঝতে পারছে, কোন একটা জায়গায় স্রোতটা মোটা হয়ে বয়ে মোড় নিয়ে এই পাড়ের দিকে চলে আসছে। সেই বাকটাতে এই মরা আলোও একটু চকচকায়। স্রোতের আবর্তে যখন বেশি জল ঢুকে পড়ে আর আরো বাক নেয় তখন সেখানে আলোটা আরো একটু বেশি চকচকায়।

তেমন একটু দেখেই গয়ানাথ ডাকে, হে-এ বাঘারু, দ্যাখত জল বাড়ি গেইছে কি না। বাঘারু তখন পাড় থেকে ঝপ করে নতুন সোঁতায় লাফিয়ে পড়ে। জল মাপবার জন্যে সেখানে বাঘারু একটা ডাল পুঁতে রেখেছে। জলের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ার আওয়াজ উঠলে আসিন্দির একটু ঘুরে টর্চটা জ্বালায়। টর্চের আলোপথ জুড়ে দেয়ালির পোকার মত বৃষ্টির ছাট। বাতাসে সেই আলোময় বৃষ্টি তোলপাড় হয়–টর্চের ঐটুকু আলো জুড়েও। বাঘারু নিচু হয়ে দেখে তার আগের বারের দাগ জল ছাড়াল কি না? সে জন্যে জলের কিছু স্থিরতা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়-জলের যে সামান্য তোলপাড় সে কি নতুন স্রোতের ঘায়ে নাকি বাঘারু লাফিয়ে পড়ায়? আসিন্দির একবার নিবিয়ে আবার আলো জ্বালে। বাঘারু সেই আলোর মধ্যে নিজের ঘাড়টা পেতে দিয়ে নিচু হয়ে দেখে বলে, নাই রো। তারপর দাঁড়িয়ে থাকে। আলো নিবে যায়। বাঘারু একটা অর্জুন গাছের শেকড় ধরে উঠে আসে।

গয়ানাথ আর আসিন্দির অপেক্ষা করে আছে এই অর্জুন গাছটা কখন পড়বে। কিন্তু অর্জুন গাছটার গোড়ার মাটি প্রায় অর্ধেক ক্ষয়ে গেলেও গাছটা সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে একবার গয়ানাথ বাঘারুকে দিয়ে গাছটা ঠেলিয়েও ছিল। বাঘারু জানে এখানে স্রোতটা যত জোরে লাগছে তাতে অর্জুন গাছটা কোনোদিনই হয়ত পড়বে না। ওর শেকড় ওদিকে অনেকখানি ছড়িয়ে আছে। এখানে স্রোতের টানের জোর এত কিছু নয় যে সেই শেকড় খেয়ে নিতে পারে। বরং উল্টনো এই অর্জুন গাছটার জন্যেই হয়ত স্রোতটা এখানে ঠেকে থাকবে, বা, ডাইনে বেঁকবে নরম মাটি খেয়ে।

আসিন্দির বলে ওঠে, আর দেরি করিবার কাম নাই, ভাসি দেন, বাপই, ভাসি দেন। গয়ানাথ আবার সেই জলের বাকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেও বলে ওঠে, তা হয় ত দে কেনে, ভাসি দে, বাঘারুক বল, কুড়ালিয়াখান নিয়া আয়।

আসিন্দির, বাঘারুকে ডাকে না। ঘুরে, টর্চটা আর-একবার জ্বালিয়ে বাঘারুর দিকে যায়। তার পরনে। লুঙি, পায়ে গামবুট। একটু গিয়েই তার চোখে কেমন ধাঁধা লাগে। কিন্তু চোখের সেই ধাঁধা দূর করতে টর্চ না জ্বেলে সে গাছ-মোচড়ানো বাতাসে অন্ধকারে ডেকে ওঠে, হে-এ বাঘারু, খানিকটা চমকে ডেকে ওঠার মত। বাঘারু আসিন্দিরের ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলার ঘনিষ্ঠতায় কথা বলে ওঠে, কন কেনে। তখন আসিন্দির টর্চ জ্বালায়। টর্চ জ্বালিয়ে বাঘারুকে আপাদমস্তক একবার আলোকিত করে। সেই প্রক্রিয়ায় বাতাসে গাছগাছড়ার পাক খেয়ে যাওয়া ও ভেজা জঙ্গলও চকিতে দেখা যায়। আসিন্দির তিস্তার দিকে টর্চ মেরে তার শ্বশুরকেও দেখে নেয়। মাত্র এই কয়েক পা এসেই তার মনে হল হারিয়ে যাচ্ছে–হাতে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ থাকতেও? বাঘারুকে নিশ্চিত ভাবে দেখে নিয়ে সে বলে, কুড়ালিগা নিয়া যা, বুড়া ডাকিছে।

অন্ধকারে বাঘারু দু পা গিয়ে অভ্রান্ত হাত মেলে এক গাছের কাণ্ডে বিধিয়ে রাখা কুড়ালটি এক ঝটকায় তুলে নেয়। ঝপ করে ঝোপের মধ্যে কিছু পড়ে যায়। বাঘারু ভুলে গিয়েছিল কুড়ালের সঙ্গে নাইলনের দড়ির দুটো বাণ্ডিল ঝোলানো ছিল। সেটা ঝোপ থেকে তুলে সে গয়ানাথের দিকে যায়। গয়ানাথ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। আসিন্দির একটু ভেতরে। কুড়োল হাতে গয়ানাথের দিকে বাঘারুর হটাটা দেখে আসিন্দির একটু ভয় পেয়ে ওঠে–আবার। সে তার নাইলনের জামার বুক পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে।

গয়ানাথ টের পায় না বাঘারু পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তখনো স্রোতের সেই বাকের দিকে কিয়ে। বাঘারু ডাকে দেউনিয়া।

অ্যাঁ? আসিছিস? নে, ভাসি দে, ভাসি দে।

বাঘারু নদীর পাড়ে দাঁড়ায়। তারপর, জেলেরা জাল ফেলার সময় জালটা মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে জলে ফেলার আগের মুহূর্তে হাঁটুটা যেমন সামান্য ভেঙে দেয়, বাঘারু সেরকম ভঙ্গিতে নদীর দিকে তাকায়। নদীর বিস্তারের দিকে নয়, যে-নদীটা এখন বন্যাবাহিনী তিস্তা সেই নিশীথ জলরাশির দিকে নয়, বাঘারু তাকিয়ে থাকে ঠিক তার পায়ের তলার জলগুলোর দিকে, যেন ঐ জল, নেহাৎই বাঘারুর শোল-মাগুর জিয়নো ডোবার জল, তার সঙ্গে ঐ জলরাশির প্রবলতার যেন কোনো সম্পর্কই নেই, বা, থাকলেও তাতে বাঘারুর কিছু যায়-আসে না।

.

১২১. বাঘারুর বৃক্ষকর্তন

বাঘারু ডান দিকে ঘুরে পাড় দিয়ে জঙ্গলের আরো ভেতরে চলে যায়। সেখানে একটা মাঝারি সাইজের শালগাছ জলের মধ্যে পড়ে গেছে কিন্তু তার শেকড়টা এখনো মাটিতে। বাঘারু বা হাত দিয়ে কুড়ালটা তার নেংটির পেছনে খুঁজে নেয় কুড়ালের কাঠটা তার মেরুদণ্ডে বাঁজের সঙ্গে মিশে যায় আর কুড়ালটা একটু আলগা হয়ে থাকে। নাইলনের দড়ির বাণ্ডিলটার মাঝখানের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে সে বাণ্ডিলটাকে বা কাঁধে তুলে নেয়; কাঁধে পুরোটা ওঠে না, বাহুতে ঝুলে থাকে। তারপর সে শালগাছটার উৎপাটিত শেকড়টা ধরে টেনে একবার আন্দাজ নিয়ে গাছটার কাণ্ডে পা দেয়–সেই কাণ্ডের নীচেই তিস্তার জল। বাঘারু ব-পাটা কাণ্ডের ওপর দেয় কিন্তু ডান পা-টা মাটি থেকে তুলতে গিয়ে বোঝে শরীরের পুরো ওজনটা এক ধাক্কায় সে বাঁ-পায়ের ওপর নাও তুলতে পারে। সে বা-পাটা নামিয়ে নেয়। শেকড়টা ছেড়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এবার সে ঘুরে গাছটার উল্টো দিকে যায়। বা হাতে তাকে ঐ একই শেকড় ধরতে হয়। এবার ডান পা-টা কাণ্ডের ওপর তুলতেই বাঘারু বুঝে ফেলে নদীর ভেতর পড়ে থাকা গাছটির অবস্থান ও তার লাফিয়ে উঠে ডালপালার কাছে চলে যাওয়ার মধ্যে একটা সঙ্গতি এসে গেল। এটা প্রথমে বুঝে তারপর যে বাঘারু ডান পায়ের ওপর শরীরের ভর দিয়ে নদীর ভেতর সঁকোর মত ঐ গাছটাতে ওঠে, তা নয়! সে বা হাতের মুঠোতে শেকড় ধরে ডান পা-টা কাণ্ডটির ওপর নিয়ে একবার মাত্র পায়ে একটা ঝোঁক দিয়েছে, তারপরেই গাছটা বেয়ে উঠেই সে ডান হাতে তলার ডালটা ধরে ফেলে, শেকড় থেকে বা-মুঠোটা খুলে শূন্যের ওপর দিয়ে হাতটাকে নিয়ে এসে তলার আরো একটা ডাল ধরে ফেলে। ঐ কয়েকটি সেকেণ্ডে বাঘারু জলের ওপর দিয়েই যেনে হেঁটে গেল চিলের ডানার মত তার দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে। সেই তলার ডালদুটোর কাছে পৌঁছেই বাঘারু দু দিকে দু পা দিয়ে গাছটার মধ্যে বসে পড়ে। নাইলনের বাণ্ডিল দুটো বেঁধে একটা বাণ্ডিল করা আছে। সে বাণ্ডিলটা বের করে না, কিন্তু তার মাথাটা যেখানে গেঁজা ছিল সেখানে একটা ঝটকা দিয়ে মাথাটা বের করে এনে গাছটার তলার ঐ ডাল দুটোর ফেঁকড়ির ভেতর দিয়ে দড়িটা চালিয়ে দেয়। বাঘারু কাণ্ডটাকে পেঁচিয়ে দু দিকের দুই ডালের ফেঁকড়ির ভেতর দিয়ে ৪-এর মত এক গিট দিয়ে ফেলে। দড়িটা কাটবার জন্যে বা হাতটা ঘুরিয়ে কুড়োলটায় হাত দিয়েও সে হাত সরিয়ে আনে। তারপর তার শরীরটাকে লম্বা করে সে গাছটার ডালপালার আরো ভেতরে মাথাটা নিয়ে যায়। পাতার ভেতর দু-হাতের দশটা আঙুল চালিয়ে আর-একটা ডাল খুঁজে বের করে কিন্তু সেটাতেও গিট দিতে গিয়ে দেখে সে ত মাথাটাকে আগের গিঠেই বেঁধে দিয়েছে। বাঘারু তখন বা বাহু থেকে বাণ্ডিলটাকে গড়িয়ে হাতের আঙুলে আনবার জন্যে ওখানে শুয়ে-শুয়ে বা হাতটা আস্তে-আস্তে ঝোলায়, কব্জিটা বেঁকিয়ে রেখে, যাতে বাণ্ডিলটা ঝপ করে জলে পড়ে না যায়। কব্জির কাছে বাণ্ডিলটা এসে গেলে বাঘারু হাতটাকে নাচিয়ে বাণ্ডিলটাকে আঙুলে নিয়ে আসে, এইবার বাণ্ডিলটাকে গাছটার তলা দিয়ে হাতে চালান করে আবার ওপর দিয়ে বা হাতে নিয়ে আসে। পেঁচানো হয়ে গেছে, এবার গিট দিতে হবে। কিন্তু পুরো বাণ্ডিল দিয়ে ত আর গিট দেয়া যাবে না। বাঘারুর ডান হাতটা পিঠের দিকে বেঁকিয়ে কুড়োলটা খোলে। দড়িটা কাণ্ডের ওপর তার চোখের ঠিক নীচে। সে কুড়োলেরই পেছনটা ধরে খুচ করে একটা ঘা দিতেই দড়িটা কেটে যায়–এখন তার ডান হাতে কুড়োল, হাতে বাণ্ডিল। সে আগে কুড়োলটা পিঠে গেজে, ডানহাতে বাণ্ডিলদড়ির আলগা মাথাটাকে আর গিটের আলগা মাথাটাকে ধরে রেখে বাণ্ডিলটাকে বা হাতের আঙুল থেকে কনুইয়ের দিকে নিয়ে যায়। তারপর দশ আঙুলে গিঠটা দেয়। গাছে পিঁপড়ে ছিল। গিঠ দেয়ার সময় পিঁপড়েগুলো তাকে এত কামড়ায় যে গিঠ দেয়া হয়ে গেলে তাকে আগে হাত দুটো ঝেড়ে তারপর সোজা হতে হয়। পাড়ে ফিরে আসার জন্যে বাঘারু দু দিকের ডাল ধরে দাঁড়ায় আর তারপর একটা পা এগিয়ে দিয়ে মাটিতে লেগে থাকা শেকড়টার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সঙ্গে-সঙ্গে নাইলনের দড়িটা গাছের মাথা থেকে পাড় পর্যন্ত দোলে। সেটাকে আরো একটু দুলিয়ে বাঘারু ফরেস্টের আর-একটু ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে একটা গাছের কাণ্ডে কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে বাণ্ডিলটাকে গাছটার গোড়ায় ফেলে রেখে ডান হাতে পিঠ থেকে কুড়োলটা খুলে নিয়ে জলে পড়া শালগাছটার কাছে এসে নিচু হয়ে উৎপাটিত শেকড়ের যে-অবশিষ্ট অংশ তখনো গাছটাকে আটকে রেখেছিল, সেটুকুর ওপর ঝুঁকে পড়ে। বাঘারু কিছু দেখতে পায় না। সে ডানহাত দিয়ে আন্দাজ নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু আন্দাজও কিছু পায় না। তখন সোজা দাঁড়িয়ে কুড়োলটা মাথার ওপর তুলে সেই শেকড়টার ওপর নামায়। কোপটা পড়তেই বাঘারু বোঝে ঠিক জায়গায় পড়েছে। তার পরের কোপগুলো সেই নিশ্চয়তাতেই নেমে আসতে থাকে। গাছটার ভেতর থেকে একটা আওয়াজ একটু-একটু করে উঠে সারা গাছেই ছড়িয়ে যায়। তারপর গাছের মাথা থেকে জলের আওয়াজটা বদলে যায়। বাঘারু বোঝে গাছটা আরো ঝুলে গেছে। আরো দু কোপ দিতেই গাছটা একটা সংক্ষিপ্ত তীব্র আওয়াজ তুলে জলের ভেতর পড়ে যেতে থাকে। জলের আওয়াজটা হঠাৎ বেড়ে উঠে আবার কমে যায়। ঝুপঝুপ করে কিছু মাটি পড়ার শব্দ ওঠে, গাছটার শেকড়টা তারও পরে নাইলনের দড়িটাকে টানটান করে তিস্তার জলে ভেসে ওঠে। বাঘারু তাড়াতাড়ি কুড়োলটা পিঠে খুঁজে, সেই গাছের গোড়ায় গিয়ে দড়ি ধরে টানতেই বোঝে গাছটাকে স্রোত টানছে। সে তাড়াতাড়ি বাণ্ডিলটা তুলে নিয়ে প্যাঁচটা একে একে খোলে। প্যাঁচ খোলার আগেই যেন ভেসে যাচ্ছে–স্রোতের এত টান। শেষ প্যাঁচটা খোলে না বাঘারু–তা হলে তাকেই জলে টেনে নিতে পারে। সে একটা প্যাঁচ গাছের সঙ্গে রেখে একটু-একটু করে দড়ি ছাড়তে থাকে। বেশ খানিকটা ছাড়ার পর বাঘারু বোঝে সে জলের টান সামলাতে পারবে। তখন গাছ থেকে শেষ প্যাঁচটা খুলে সে স্রোতে ভাসা গাছের সঙ্গে সমান বেগে দৌড়ে গয়ানাথ আসিন্দির যেখানে আছে সেদিকে ছোটে। কিন্তু দু পা ছুটেই আবার একটা গাছের সঙ্গে দড়িটাকে লাগিয়ে দেয়। একটু অপেক্ষা করে আবার দু পা ছোটে। এই প্রথম গাছটাকে ভাসানোর আগে তাকে একটু বুঝে নিতে হয়–বাতাসের বেগ, স্রোতের। ধার আর তার নিজের জোর। তাকে আরো তিনটে গাছ এরকম করে ভাসানোর জন্যে বেঁধে এনে, তারপর চারটেকে একসঙ্গে ভাসিয়ে দিতে হবে।

এখানে, এই ওপরে, ফরেস্টের ভেতর, বাতাস আর বৃষ্টির ধরনটা আলাদা। নদীর ওপর দিয়ে বৃষ্টি আর বাতাস এই আবছা আলোতে নদীর স্রোতের মত বেগে স্রোতেরই বিপরীতে পাহাড়ের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়তে পারছে না। কিন্তু সেই বাতাসই আবার হু হু করে ফরেস্টের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। এই নিশুত রাতে, তারাহীন, বা বলা যায় আকাশহীন রাতে, হঠাৎ বাধভাঙা বন্যার জলের মত বাতাস নদীর ভেতর থেকে ফরেস্টের ভেতর ঢুকে আর বেরতে পারছে না। গাছের পাতায়-পাতায় আকাশটা এত ঢাকা যে বাতাস আকাশে বেরিয়ে যেতে পারে না। গাছের নীচে মাটির ওপরে এত বেশি ঘাস আর জঙ্গল যে বাতাস সেখানে ঢুকে হেঁটেও বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে, নদীর বুক থেকে হু হু ঢুকে কাণ্ড বেয়ে, ডালপালা বেয়ে, গাছের সংলগ্ন অন্যগাছের ডালপালা দিয়ে ফরেস্টময় স্রোতের বেগে ছড়িয়ে অপর কাণ্ড বেয়েই ছুটে নেমে আসে। মাটির ওপরের জঙ্গলগুলির ভেতর, লুকনো একপাল পশুর মত সে বাতাস ছুটে গিয়ে ঢোকে কিন্তু বেরিয়ে আসতে গিয়ে সাত পথে হারিয়ে যায়। আর সেই বাতাসের বেষ্টনীতে আপাদমস্তক ফরেস্টটা মুচড়ে-মুচড়ে ওঠে।

.

১২২. গয়ানাথ মাটি-গাছ-জলের স্বরে কথা বলে ওঠে

গয়ানাথ বলে, হে-এ আসিন্দির, দেখ ত কনেক, অর্জুন গাছটা খাইছে কি খায় নাই?

আসিন্দির টর্চ জ্বালে আর বলে, ঐ অর্জুন গাছটোর তানে তোমাক শালগাছ গিলা ছাড়িবার নাগিবে, বলে সে টর্চটা নিবিয়ে দেয়। আবার দু জনে চুপ করে থাকে। এখন দু-জনই বসে আছে–একই গাছের গুঁড়ির ওপর। গয়ানাথ তিস্তার দিকে মুখ করে, আসিন্দির ফরেস্টের ভেতরের দিকে মুখ করে। ফরেস্টের সেই ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে–বাঘারু শেষ গাছটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে জলে ভাসিয়ে এই বাকি যে-তিনটি গাছ গয়ানাথের সামনের পাড়ের নীচে তিস্তায় রাখা আছে, সেগুলোর সঙ্গে আঁটি বাধার জন্যে টেনে আনবে। অত বড়-বড় গাছের ডালপালা জলের ভেতর থেকে পাড়ের ওপর উঠে এসেছে-একেবারে গয়ানাথের পা পর্যন্তই প্রায়। আবছা আলোয় সেই ডালপালাগুলো কিছুটা ছায়া-ছায়া বলেই অনেক বড় দেখাচ্ছে। এখান থেকে গয়ানাথ তিস্তার ভেতরে জলের, যে উজ্জ্বলতা দেখে জলের তোড় আন্দাজ করছিল–সেই জায়গাটি আর দেখা যাচ্ছে না। তিন-তিনটি গাছের ডালপালা তিস্তাকে প্রায় সম্পূর্ণ আড়াল করে রেখেছে। তিস্তা আড়ালে পড়ার পর তিস্তার আওয়াজটা এখন গয়ানাথ আর আসিন্দিরের কানে আসছে। গুমগুম আওয়াজ তুলে তিস্তার জল বয়ে যাচ্ছে–আওয়াজেই যেন বোঝা যায় পেছনে আরো নদী-নদী জল এমন চণ্ড বেগে এই জলটাকে ভাটিতে ঠেলছে। তিস্তার বন্যার সঙ্গে যাদের কিছু পরিচয় আছে তারাই জানে–তিস্তার জল যখন জলের মত ছলছল খলখল শব্দ না করে, বড়-বড় বোন্ডারের সঙ্গে বোন্ডারের ঘর্ষণের মত গুমগুম আওয়াজ তোলে তখন পাতাল থেকে তিস্তার জল উঠতে থাকে, সে জল সব ভাসিয়ে দেবে–গা-গঞ্জ, বাড়ি-টাড়ি সব। এই শেষ রাতে তিস্তার ভাঙনে ফরেস্টের পড়ে যাওয়া গাছ বেঁধেছেদে তিস্তায় ভাসিয়ে, কয়েকদিন পর জল নামলে, ভাটিতে যেখানে ঠেকে থাকবে সেখানে গিয়ে দখল নিয়ে স মিলের কাছে বেচে হাজার-হাজার টাকা লাভের ব্যবসায়ী নেমেছে জামাই-শ্বশুর। কিন্তু, এখন, গাছগুলো ভাসিয়ে দেয়ার ঠিক আগে, এই গাছের থেকেও এই তিস্তার বন্যা তাদের কাছে বেশি সত্য হয়ে উঠল হঠাৎ–যে বন্যা ফরেস্টের এমন-এমন আকাশছোঁয়া গাছকে তাদের পঞ্চাশ-আশি-একশ বছরের শেকড়সুদ্ধ উপড়ে দেয়, সেই বন্যা আসিন্দির আর গয়ানাথকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে চোখের পলক ফেলার আগেই। উৎপাটিত গাছের ডালপালার আড়াল থেকে তারা সেই সর্বনাশের আওয়াজ শোনে।

কিন্তু এ গাছগুলোতে গয়ানাথের এক ধরনের হকও ত আছে!

 গাজোলডোবার কাছে তিস্তা আপলাদের পাড় ভাঙতে শুরু করে শনিবার সকাল থেকেই। এক সময় সেখানেই ফরেস্টের সঙ্গে গয়ানাথের পৈতৃক একখতিয়ানের জমি ছিল। শেষ সেটলমেন্টে সাব্যস্ত হয়ে গেছে–সেখানে গয়ানাথের আর-কোনো জমি ফরেস্টের সঙ্গে নেই, সব জমিই ফরেস্টের খতিয়ানভুক্ত করে দেয়া হয়েছে। গয়ানাথ সেই সেটলমেন্টের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেটলমেন্টের সব আপিলেই রায় বহাল থাকে। তখন গয়ানাথ জলপাইগুড়ির কোর্টে সিবল মামলা ঠোকে ও ফৌজদারি কোর্টের কাছে দরখাস্ত করে যে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পূর্বাবস্থা বহাল থাকুক। আদালতও একটা সময় পর্যন্ত কার্যকর রাখার জন্যে এই আদেশ দেন। কিন্তু সেই সময় পার হয়ে যাওয়ার পর গয়ানাথ আবার দরখাস্ত করলে আদালত আর একটু বিশদভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখেন যে ওখানে পূর্বাবস্থা বহাল রাখলেও গয়ানাথ বা সরকারের কারো কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না। তা হলে আপনারা পূর্বাবস্থা বহাল রাখতে চান কেন–আদালতের এই প্রশ্নের জবাবে গয়ানাথের উকিল জানান যে তাদের ভয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট তা হলে এই জায়গায় সব গাছ কেটে নেবে। কথাটায় আইনি প্যাঁচ ছিল। যে-সম্পত্তির মালিকানা এখনো আদালতে সাব্যস্ত হয় নি সেই সম্পত্তির ভোগ্রদখল যদি অপরপক্ষ করে বসে তা হলে বাদীর সমূহ আর্থিক ক্ষতি। বিশেষত, যে-জমির মালিকানা নিয়ে মামলা, সে-জমির প্রধান আর্থিক সম্পদ ফরেস্টের এই গাছ। আদালত রঙ্গরসিকতা করে গয়ানাথের উকিলবাবুকে বলেও ছিলেন–আরে ওটুকু না-হয় গয়ানাথবাবু সরকারকে খয়রাৎ করে দিন। আদালতের সম্মান রাখার জন্যে উকিলবাবুও গয়ানাথবাবুকে কানে কানে কথাটা জানান। গয়ানাথবাবুর কথামত উকিলবাবু আদালতকে জবাবে জানান যে স্যার যদি হুকুম দেন তা হলে গয়ানাথবাবু তার নিজ খতিয়ানের যে-কোনো দাগ থেকে মামলাধীন জমির সমপরিমাণ জমি সরকারকে খয়রাৎ করতে রাজি আছেন কিন্তু এখানে ত সম্পত্তির মালিকানার মামলা, সেই মালিকানা ঠিক না হলে গয়ানাথবাবু খয়রাৎকরার কে, তা হলে বরং স্যার রায় দিয়ে দিন যে ঐ জমিতে গয়ানাথেরও অংশ আছে, তার পরে গয়ানাথবাবু ওটা সরকারকে খয়রাৎ করে দেবেন। আইনের প্যাঁচ হাকিমের চাইতেও ভাল জানেন গয়ানাথবাবু উকিল–তিনি জেলার এক নম্বর উকিল। কিন্তু উকিলের চাইতেও ভাল জানে গয়ানাথবাবু নিজেই–তার বাপঠাকুর্দার কাছ থেকে জমির আইন তার শেখা। সরকার পক্ষের উকিল একবার অন্যমনস্ক ভাবে বলেছিলেন, স্যার, এখানে এ-অর্ডার দিলে তিস্তা ব্যারেজ তৈরি করার অসুবিধে হবে। আদালত একটু খুশি হয়েই বলেন, তা হলে তিস্তা ব্যারেজের প্ল্যানটা দেখান আর ওরা এই জমির এলাইনমেন্টে কী করবে সেটা বলুন। কিন্তু সরকারি উকিলের কাছে সে-সব কিছুই ছিল না। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে আদালতকে জানান–স্যার ঠিক আছে, এবারও অর্ডার যদি দিতে চান দিন, আমরা পরের ডেটে তিস্তা ব্যারেজের মাস্টার প্ল্যান ও এই জমির ব্যাপারে ইনজিনিয়ারদের রিপোর্ট আদালতে পেশ করব। সরকারি উকিলের কথাতে, পরে, গয়ানাথ হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছিল। যে-তারিখেই এই দরখাস্ত ওঠে, গয়ানাথের উকিলবাবু বলেন যে স্যার সরকারপক্ষ তাদের কথামত কাজগপত্র জমা দেন নি, সুতরাং পূর্বাবস্থা বহাল রাখার আদেশ বহাল থাকুক। সরকারি উকিলের হাতে আরো জরুরি মামলা। এখন এই এক চিলতে জমির জন্যে কে মাস্টার প্ল্যান আর ইনজিনিয়ারদের রিপোর্ট জোগাড় করবে? ফলে সিবিল কোর্টে জমির মালিকানার মামলা চলতে থাকে আর ঐ জমির ব্যাপারে পূর্বাবস্থাও বহাল থাকে।

সোম-মঙ্গলবার থেকে ক্রান্তিহাট-গাজোলডোবা-আপলাদের আকাশও ভারী হয়ে নীচে নেমে আসে; বাতাস আর বৃষ্টি বইতে থাকে। কিন্তু ভাটির বৃষ্টি আর বাতাসের চাইতে ওপরের বৃষ্টি আর বাতাসের প্রকৃতি আলাদা। ভাটিতে বাতাস আকাশ থেকে বা আকাশের সীমান্ত থেকে, অবলম্বনহীন ছুটে আসে। আর ওপরে, এই ফরেস্টের কাছে বাতাসটা মাটির ভেতর থেকে উঠে আসে। খ্যাপা হাতির ত পাল হয় না। তা হলে বলা যেত–এ বাতাস খ্যাপা হাতির পালের মতন।

এরকম বাতাস আর বৃষ্টি থাকলে তিস্তার জল বাড়বেই। কিন্তু কতটা বাড়বে, কত দিন থাকবে তার ত আর-কোনো আন্দাজ পাওয়া যায় না। গয়ানাথ জোতদারের জমিজমা চারদিকে ছড়ানো। সে এই অংশ-জমির মালিকানা নিয়ে সিবিলকোর্টে মামলা করতে পারে, সে এই জমিতে পূর্বাবস্থা বহাল রাখার জন্যে ফৌজদারিও করতে পারে কিন্তু তাই বলে তার সব কাজকর্ম ফেলে সে ত আর এই জমিতে পাহারা দিতে পারে না।

পাহারা দিক আর না-দিক, শুক্রবার বিকেলেই গয়ানাথের কাছে খবর আসে আরো ওপরে তিস্তা ভাঙছে। তাতেও গয়ানাথের কিছু যায়-আসে না। কারণ, ওদিকে গয়ানাথের জমি নেই আর গয়ানাথের বাড়িঘর তিস্তা থেকে দূরে। কিন্তু শনিবার দুপুর নাগাদ গয়ানাথ যখন খবর পায় তিস্তার ভাঙন গাজোলডোবায় শুরু হয়েছে সে তার জামাইকে ডেকে বলে, ভটভটিখান বাহির কর, জমিখান দেখি আসি।

আসিন্দিরের পেছনে বসে গয়ানাথ তার পূর্বাবস্থাবহাল জমির হাল তিস্তা কোনোভাবে বদলে দিচ্ছে কি না দেখতে গিয়ে দেখল–ফরেস্টের অত ভেতরে, বাড়িটাড়ি থেকেঅত দূরে তিস্তা ফরেস্টের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। একটা জায়গায় জমি এতটাই খেয়ে ফেলেছে যে সেখানে আলাদা খাড়ি তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

তখনই মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল গয়ানাথ জোতদারের। তার চোখের সামনে একটা অন্তত বছর সাতেকের শালগাছ উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

বাঘারুক নিগি আয়, আর টর্চখান, গয়ানাথ সেই স্বরে জলে কথা বলে ওঠে যে-স্বর এখানকার মাটি-গাছপালা-জলের সঙ্গে মেশানো। গয়ানাথ যদি এই হাওয়ার আর এই জলের আওয়াজ বোঝে, তা হলে এই জল আর হাওয়াও গয়ানাথের গলার আওয়াজ বোঝে। সেই তরুণ শালতরুর শেকড়ের ওর পা রেখে গয়ানাথ তার জামাইকে আদেশ দেয়–ভটভটিখান নিগি যা, টর্চ আনিবু, তোর বড় টর্চখান, বাঘারুক আনিবু, ভাল একখান কুড়ালিয়া আনিবু, নাইলনের দড়ি আনিবু এক বাণ্ডিল কি দুই বাণ্ডিল, মোটা নাইলন–তিস্তার দিকে তাকিয়ে গয়ানাথ তার ছোট-ছোট হাতের রোগা আঙুলগুলোর মাথা বুড়ো আঙুলের সঙ্গে মিলিয়ে কত মোটা সে চায় তার একটা আন্দাজ দেয়, দুই হাতের আঙুলগুলো দিয়েই আন্দাজ দেয়। আসিন্দির পেছন ফিরলে ঘাড় ঘুরিয়ে গয়ানাথ বলে দেয়–চিড়াগুড় আনিবু, সারা রাইত থাকা নাগিবা পারে।

আসিন্দির চলে যায় আর গয়ানাথ একা-একা সেই প্রবল বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে তিস্তার ফ্লাড় আর ফরেস্টের গাছ পাহারা দেয়। সেই কিছুক্ষণ, কয়েক ঘন্টা তিস্তার জলের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে গয়ানাথ সেই লক্ষ-লক্ষ কিউসেক জলের তলার মাটিটাকেও যেন দেখে নেয়–দেখে নেয় সে মাটির ঢাল কোনদিকে কতটা, সে ঢালে বালি আর পাথর জমে আছে কিনা। সেই কিছুক্ষণ, কয়েকটি ঘন্টা ঐ বাতাসের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে গয়ানাথ সেই বায়ুর বেগ মেপে নেয়–মেপে নেয় আকাশের যে-শূন্যতা পূর্ণ করতে এই বাতাস পুর থেকে ছুটে আসছে সে-শূন্যতা আরো কত গভীর; এই বায়ুনিহিত জলরাশির ভেতর আরো কত মেঘ আছে, মেঘে আরো কত জল আছে। তিস্তা, বাতাস, বৃষ্টি আর ফরেস্ট মিলিয়ে গয়ানাথ এই নদী-অববাহিকার আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়ার কর্মসূচি ঠিক করে নেয়।

সেই ফ্লাড গয়ানাথের নির্দেশ অনেকটাই মানল–যে-জায়গাটায় ভাঙন ধরেছিল সেখান দিয়ে তিস্তার জল সত্যিই ঢুকল, সেই স্রোতের পথে আরো দুটো গাছ জলেও পড়ল।

আসিন্দির বাঘারুকে মোটর সাইকেলের পেছনে প্রায় বেঁধেই নিয়ে আসে–কারণ চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বারবারই বাঘারু পড়ে যায়। বাঘারুর সঙ্গে কুড়োলও আসে, নাইলনের দড়ির বাণ্ডিলও আসে। আরো একটা গাছ জলে পড়ে। কিন্তু অর্জুন গাছটা আর পড়ল না।

বাঘারু চতুর্থ গাছটিকে ভাসিয়ে আগের তিনটি গাছের কাছে নিয়ে আসে।

.

১২৩. ‘বাঘারু হে, তুই ভাসি যা’

 বাঘারু নদীর পাড়ে দাঁড়ায়, তার বা বাহুতে নাইলনের দড়ির একটা বাণ্ডিল, বা হাতের মুঠোতে ধরা দড়ি-গাছগুলোকে টেনে রেখেছে, ডানহাতে কুড়োলটা ঝুলছে। দড়িটা বাঘারুর মুঠোতে ছাড়াও যে-গুড়িটার ওপর গয়ানাথ আর আসিন্দির বসেছিল, সেই গুঁড়িটাতে জড়িয়ে রাখা। গয়ানাথ বললেই বাঘারু তার মুঠোর দড়িটা ছেড়ে দেবে, তখন স্রোতের টানে গাছগুলো কিছুটা দূরে চলে যাবে, তার পর গুঁড়িটা থেকে দড়িটা খুলে দিলেই ভেসে যাবে। বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে, গয়ানাথ কখন ছাড়ি দে বলে তার অপেক্ষায়।

গয়ানাথ আসিন্দিরকে জিজ্ঞাসা করে–কয়ড়া বাজিছেন হে?

 আসিন্দির চকিতে ঘড়িটা দেখে বলে–চারিডা।

 চারিডা? গয়ানাথ নিজের মনেই বলে ওঠে।

নদীর ওপরে যে-আবছা আলো ছিল সেটা হঠাৎ মুছে যেতে থাকে। অথবা অনেকক্ষণ ধরেই মুছে যাচ্ছিল, এতক্ষণে তাদের নজরে পড়ে। দশমী-একাদশীর চাঁদ হঠাৎ কাল মেঘে ছেয়ে গেলে যে-রকম হঠাৎ আধার ঘনায়, এখন আলোটা সেরকম হয়ে উঠল। বাঘারু আকাশে তাকায় নি। গয়ানাথ আর আসিন্দির তাকায়। তাকিয়ে বোঝে, চঁদ ডুবে গেছে, এখন অন্ধকার আরো বাড়তে থাকবে, যতক্ষণ না সূর্য ওঠে। কিন্তু সূর্য কখন উঠছে, কয়েক দিন ধরে সেটা বোঝাও যাচ্ছে না। না গেলেও আকাশটা আবার ঐরকম আবছা আলোয় ভরে যাবে, রাতের চাইতে আর-একটু কম আবছা।

এতক্ষণ ঐ আবছা আলোটা নদীর ওপরের ফাঁকটায় ছিল। সেই ফাঁক থেকে ফরেস্টে যেটুকু নদীর পাড়ে, সেই অংশটাতেও একটু ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু আর-একটু ভেতরে ঢুকতে সে-আলো আর পারে নি। এখন নদীর ওপর থেকে ঐ আবছা আলোটাও মুছে গিয়ে আঁধার ছড়িয়ে পড়ল। সেই ফাঁকা থেকে ফরেস্টের নদীর কিনারাতেও ঐ আধার ছড়াল। ফরেস্টের ভেতরটা হয়ে উঠল আরো অন্ধকার। নদীর ওপরে ঐ আঁধারটা ছড়িয়ে পড়তেই নদীর জলটাও যেন বদলে গেল। এতক্ষণ নদী আর আকাশ জুড়ে ছিল একটাই ঘোলা স্রোত। সেই ঘোলা স্রোত জলের ধাক্কায় মাঝেমধ্যে চলকাচ্ছিল, এই-যা। এখন আকাশের অন্ধকার নদীতেও ছায়া ফেলে। কিন্তু সেই অন্ধকারের ফলেই যেন ঘোলাটে ভাবটা কেটে গেল বলে একটা বিভ্রম হয়। নদীর জলটা হঠাৎ ঘোলাটে থেকে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে যেন, যেন জলের মধ্যে জল রুপোলি চলকায়। আর নদীর অন্য পাড়টাও যেন দেখা যাচ্ছে। সবই বিভ্রম, বিভ্রম।

আসিন্দির অধৈর্য হয়ে ওঠে, এ্যালায়ও যদি না ছাড়েন, তা হালি আর আইত (রাত) জাগিবার কামটা কী আছিল?

হ্যাঁ, ছাড়ি দিম, ছাড়ি দিম, বলে গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে, বানার ক্যানং টান, কোনঠে গিয়া ঠেকিবে আন্দাজ করিবার নাগে।

এ্যালায় কী আন্দাজ করিবেন? কালি মোটর সাইকেল নিয়া দেখিবার নাগিবে। নাইলনের দড়ি দিয়া বান্ধা আছে, সগায় বুঝিবে কারো সম্পত্তি নাগে। আর ঠেকিলে ঠেকিবে ত চরত, মানষি সব ত চর ছাড়ি চলি গেইসে। ভয় না খান। কায়ও তোমার সম্পত্তি না নিবেবাপা। না-হয় ত গাছের গাওত লিখি দাও কেনে গয়ানাথ এণ্ড কোম্পানি।

গয়ানাথ আসিন্দিরের কথার কোনো জবাব দেয় না। সে তিস্তার ওপরের অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন তিস্তার ফ্লাডটা আন্দাজ করার জন্যে ঐ অন্ধকার ছাড়া আর-কোনো অবলম্বন নেই। এখানে দাঁড়িয়ে বাতাস আর বৃষ্টির যে-ধাক্কা তারা খাচ্ছে সেটা গত নদশ ঘন্টায় শরীরেরই অংশ হয়ে গেছে। এ্যানং করি গাছগিলাক বান্ধা গেইল, এ্যালায় ভগোয়ানের নাম করি ছাড়ি দিম এই বানার মুখত? তারপর কোটত খুঁজি বেড়াম রে? গয়ানাথ বেশ জোরেই বলে, কিন্তু তার স্বরের মধ্যে স্বগতোক্তি ছিল। আসিন্দির হয়ত গয়ানাথের কথা সব শুনতেও পায় না–সে ত পেছনে দাঁড়িয়ে। শুনতে পারে বাঘারু, কারণ গয়ানাথ কথাগুলো বাঘারু আর তিস্তার দিকে তাকিয়েই বলে।

য্যালায় গিয়া গাছগিলা ঠেকিবে, স্যালায় হয়ত কায়ও নাই, তার পুব-পশ্চিম দিয়া বানা বহি যাছে, কায় আর দেখিবে?

এ গাছগুলো যেন ভেলা, সেই ভেলায় এ প্রলয়ে গয়ানাথ যেন তার প্রিয়তম কাউকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কোথায় গিয়ে এ-ভেলা এই বন্যায় ঠেকবে? কী করে খুঁজে পাবে গয়ানাথ যদি এই বন্যা পুবপশ্চিম সব পাড়ই ভাসিয়ে নেয়? চার-চারটি গাছে কত-কত হাজার টাকা তা হলে লোকসান? যেন, এই হাজার-হাজার টাকা গয়ানাথ তার কাছার গিট থেকে খুলে বন্যায় ভাসাচ্ছে! এই চার-চারটি গাছ বন্যার এই রাত ধরে তার তেমনই আপন হয়ে গেছে, তেমনই আপন।

মউয়ামারির চরচরুয়াগিলান আছে, প্রেমগঞ্জের চর, ভাটিয়াগিলান আছে, বাকালির চরত মুসলমানের ঘর আছে, কশিয়াবাড়ি পার হইয়া এই বৃক্ষগিলান কি পাকিস্তান চলি যাবার ধরিবে?

বাতাসের আওয়াজের সঙ্গে গয়ানাথের হাহাকার মিশে যায়। এই গাছগুলো যেন তার ময়ূরপঙ্খী, এখন হারা উদ্দেশে সেই ময়ূরপঙ্খীটাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে, কোনো দিন আর দেখতে পাবে কি না কে। জানে। জলের তোড়ে গাছগুলোর ডালপাতা গয়ানাথকে ঘেঁয়। বাতাসের বেগে স্পর্শটা বোঝা যায় না।

গয়ানাথ এবার চিৎকার করে ওঠে, হে-এ বাঘারু, যেন বাঘারু তার সামনেই দাঁড়িয়ে নেই, নদীর অপর পারে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। গয়ানাথ আবার চিৎকার করে ওঠে, বাঘারু হে-এ।

বাঘারু সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো জবাব দেয় না। দেউনিয়ার ডাকের জবাবে বাঘারু সামনে হাজির হতে পারে, জবাব দিতে ত পারে না। সে এখন ত সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা তিস্তার দিকে মুখ, কিছুটা গয়ানাথের দিকে মুখ। সে গয়ানাথের দিকে আরো একটু ঘোরে–তার হাতের মুঠোয় গাছবাধা দড়ি টানটান হয়ে ওঠে। স্রোতের ধাক্কা গাছগুলোকে পাড় থেকে ভাসিয়ে নিতে টানছে।

বাঘারু হে, তুই যা কেনে গাছগিলার সাথত। এ্যানং অমূল্য বৃক্ষ, কোটত না কোটত ভাসি যাবে, কার না কার ভোগত নাগিবে! তুইও ভাসি যা গাছগিলার সাথত, গাছগিলাক পাহারা দিয়া নিগি যা।

গয়ানাথের চিৎকারের পরবর্তী নীরবতা জুড়ে বাতাস হামলে পড়ে উৎপাটিত গাছগুলোর ডালপাতায় আর স্রোতের টান প্রায় অনিবারণীয় বেগে এসে লাগে বাঘারুর পাঞ্জায়, কব্জিতে, হাঁটুতে। কুড়োলটা মাটিতে ফেলে বাঘারু নরম মাটিতে গোড়ালি পুঁতে গাছগুলিকে টেনে রাখে।

বাঘারু হে, গাছত উঠ কেনে। যেইঠে ঠেকি যাবু, থাকিবু। হামরালা গাছগিলাক আর তক খুঁজি নিম।

গয়ানাথ সেই মুহূর্তে গাছে ওঠা কথাটির অর্থ আমূল বদলে দেয়। বাঘারু তার হাতের দড়িটা আস্তে-আস্তে ছাড়ে। তার ছাড় বোঝামাত্র স্রোত যেন একটানে গাছগুলোকে ভাসিয়ে নিতে চায়। বাঘারু খুব ধীরে ধীরে আর-একটু ছেড়ে, পেছিয়ে, সেই গাছের গুঁড়িটার কাছে যায়। সেখানে সে গুঁড়িটাতে হাটু ঠেকিয়ে দড়িটাকে আরো টেনে এনে তার শরীরের সমস্ত পেশির শক্তি সংহত করে অত্যন্ত ধীরে সেই শক্তি প্রয়োগ করে গুঁড়িটাতে প্যাঁচ দেয়–দুটো-তিনটে। গাছগুলো পাড়ের কাছাকাছি চলে আসা আবার। খালি হাতে বাঘারু সোজা হয়ে দাঁড়ায়, তারপর দু পা এগিয়ে কুড়োলটা তুলে পিঠের ভঁজে ঢুকিয়ে নেংটিতে গেঁজে। এবার পাড়ে দাঁড়িয়ে-সঁড়িয়ে একটা শক্তমত ডাল সে খোঁজে। তার বাহু থেকে নাইলনের দড়ি শূন্যতায় ঘনঘন দোলে। বাঘারু একটা ডাল পেয়ে যায়। পাখি যেভাবে ডাল পা রাখে বাঘারু সেই ভাবে ডালটার ওপর হাত দুটো রেখে আকাশ-আঁকড়ানো বন্যার আকাশে ঝাঁপ দেয়। ভাসমান গাছের মাথা যেন অতিরিক্ত ঝড়ে কেঁপে ওঠে।

খুলি দে, খুলি দে, দড়িখান খুলি দে–গয়ানাথ চিৎকার করতে করতে গাছের গুঁড়িটার দিকে ছুটে যেতে গিয়ে ফিরে আসে। নদীর পাড়ে তখন নাইলনের দড়ি ঝুলছে–গাছের ভাসমান মাথার ভেতর থেকে যে-গুঁড়িটাতে দড়ি পেঁচানো ছিল, সেই গুঁড়ি পর্যন্ত। সেই দড়ির শেষেই বাঘারু কোনো ডালের ভেতর ঢুকে গেছে। তার উদ্দেশে গয়ানাথ জোতদার চিৎকার করে বলে, হে-এ বাঘারু, অর্জুন গাছখান পাছত ভাসি গেইলে বান্ধি ফেলিস। বাঘারু, অর্জুন গাছখান বান্ধি ফেলিস

আসিন্দির বোঝে নি, বাঘারুও গাছের সঙ্গে ভেসে যাবে। সে বাঘারুকে গুঁড়িটাতে আরো গোটা কতক প্যাঁচ দিয়ে দড়িটাকে আটকাতে দেখল, দড়ি দুলিয়ে পড়ে যেতে দেখল, পাড় থেকে নদীর ভেতরের গাছেও যেতে দেখল। তখন সে বুঝে থাকতেও পারে, নাও পারে। গয়ানাথ যখন চিৎকার করে তাকে গুঁড়িটা থেকে দড়িটা খুলে দিতে বলে তখন আসিন্দির টর্চ জ্বালিয়ে দেখে। হাতে টটটা নিয়ে, ডান হাতে দড়িটা ধরে টান দিতেই ওপরের প্যাঁচটা খুলে আসে। পরের প্যাঁচটা আর একটানে খোলে না, কিন্তু টর্চটাকে মাটিতে রেখে দু হাতে টানতেই খোলেস্রোতের টানে গাছগুলো পাড় থেকে সরে যায়। এই প্যাঁচদুটো বাঘারু শেষে দিয়েছিল। পাড়ছাড়া স্রোতে গাছগুলো যেন আন্দোলিত হয়, সেটা বাঘারু ডালে-ডালে জায়গা খুঁজছে বলেও হতে পারে, স্রোতের ধাক্কাতেও হতে পারে। শেষের প্যাঁচগুলো আসিন্দির দু হাতে টেনে খুলতে পারে না। গয়ানাথও ডান হাত লাগায়। কিন্তু গাছের বাকলের কোনো খুঁজে দড়িটা আটকে গেছে। দড়ি ছেড়ে দিয়ে গয়ানাথ বলে, আঠিয়াল মাটি আনি ঢুকা কেনে। গয়ানাথ এবার টর্চটা ধরে–আসিন্দির সেই অর্জুন গাছের গোড়াতে যায়। শিকড়ের তলাত হাত দে–গয়ানাথ টর্চ ধরে। দু হাতের মুঠো ভরে পাড় থেকে ভেজা মাটি তুলে আনতে আসিন্দিরের সিকো ঘড়ির নীল ডায়াল চমকায়। সেই মুঠোভরা মাটি ঐ দড়ির ওপর দিতেই গুঁড়ির গায়ে লেগে থাকা জলে গুঁড়িটা পিছল হয়ে যায়। কাদামাখা হাতে আসিন্দির দড়িটা ধরে হ্যাঁচকা একটা টান মারতেই দড়িটা অনেকখানি উঠে আসে। বুঝতে পেরে, আর-একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই আসিন্দির মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, চোখের সামনের পাহাড়ের মত আড়াল মুহূর্তে সরে যায়, গুচ্ছগুলো ও বাঘারু চোখের পলক না-ফেলতেই দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে যায়, আর তিস্তার বন্যা আবার বাধাহীন পাড়ে ধাক্কা মারে।

.

১২৪. অন্ধকার ও জলস্রোতের মাঝখানে

 পাড় থেকে গাছের ডাল ধরে ঝুলে নদীর স্রোতে ভাসা চারটে গাছের ভেতর সেঁদিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘারু বুঝে ফেলে সে ডালটা সমেত জলে ডুবে যাচ্ছে। এমন আচমকা ডুবে গেলে তাড়াতাড়ি আরো ওপরের ডাল ধরে ভেসে ওঠার কথা বা তাড়াতাড়ি ডালপালা মাড়িয়ে পাড়ে উঠে আসার কথা। কিন্তু বাঘারু যখনই বোঝে সে যে-ডালটায় দাঁড়িয়ে, সেই ডালসমেতই ডুবছে, তখনই একেবারে দাঁড়িয়ে যায়, যেন মেপে নিতে যে আচমকা তার ওজনে এ ডালটা কতটা ডুবে যায়। বাঘারু নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে না কোনোভাবেই। তাড়াতাড়ি পাড়ে উঠে আসার উপায় যে তখনো আছে তা যেন তার জানাই নেই। বা, ওপরে উঠে যাবার মত ডাল যে নেই এটা তার বড় বেশি জানা আছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে বাঘারু জানেই জলেভাসা গাছের ওপর চাপ দিলে তা জলে ডোবে। আর একটা কারণ এও হতে পারে যে বাঘারু আসলে জানেই না কী করে নিজেকে বাঁচাতে হয়। পশুপাখি নিজেকে যেমন বাঁচাতে জানে তেমনই স্বাভাবিক আত্মরক্ষার শক্তি, অথবা পশুপাখি যেমন টের পায় না তার মরণফাঁদ কোথায়, তেমনই স্বাভাবিক আত্মহত্যার শক্তি–এর ভেতর কোনো শক্তির ওপর ভর করে বাঘারু ডালসমেত জলে ডুবে যেতে থাকে তা আন্দাজ করেও বলা মুশকিল। তখন ত বাঘারুকে আর দেখা যাচ্ছিল না। দিনের বেলা হলেও দেখা কঠিন হতচার-চারটি গাছের ডালপালা এমনই ঘন আর ছড়ানো। আর, তখন ত কথাই নেই। নদীর ওপর নেমে আসা ছাইরঙামেঘের আড়ালে দেখতে না-পাওয়া সঁদও অস্তে চলে গিয়ে বাতাস আর বৃষ্টিকে আরো অন্ধকারময় করে তুলেছে। আসিন্দির আর গয়ানাথ মিলে গাছের গুঁড়ি থেকে প্যাঁচগুলো একটার পর একটা খুলে দিয়ে যখন ফিরে যায় তখন বাঘরু ঐ জলের তলায় ডুবে মরে থাকতেও পারত। তার মত সাঁতারুও, বন্যার তিস্তার চার-চারটে শক্ত করে বাধা গাছের ডালপালায় চাপা পড়লে বেরতে পারত না। তার চুল, বা তার শরীরে চামড়ার মত লেগে থাকা নেংটিটাও কোনো ডালে আটকে তাকে জলের তলে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলতে পারত।

কিন্তু বাঘারু দড়ির বাণ্ডিলটা তাড়াতাড়ি গলায় ঝুলিয়ে নিতে নিতে বোঝে, ডালটা খানিক ডুবে আর ডুবল না। তার হাটু পর্যন্ত জল। অর্থাৎ, ডালটা ওখানে পাড়ের মাটি পেয়েছে। সেই সুযোগে সে গাছের ডালের ওপর শুয়ে পড়ে ডালটার সঙ্গে মিশে যেতে চায়–মিশে গিয়ে পাদুটো আর হাতদুটো দিয়ে ডালটাকে জড়িয়ে ধরতে চায়, যেন সে এই গাছটারই একটা ডাল। তখন চকিতে বাঘারুর একবার মনে হয়েছিল নাইলনের দড়িটা দিয়ে ডালের সঙ্গে সে নিজেকে বেঁধে নিলে পারে! কিন্তু সে ত মাত্র মনে হওয়াই।

ইতিমধ্যে আসিন্দির একটা প্যাঁচ খুলে দিতেই ঐ চার-চারটি গাছ পাড় ছেড়ে স্রোতের ভেতরে ঢুকে পড়ে, মুহূর্তে সেই ডালটা আরো তলিয়ে যায়, বাঘারুর পিঠের ওপর দিয়ে তিস্তার স্রোত বয়ে চলে। এখন গাছগুলোর তলায় মাটি নেই–গাছগুলোর ভেতর দিয়ে জলস্রোত এত জোরে বইতে থাকে যেন সেই স্রোতের ধাক্কায় গাছগুলো আবার সোজা হয়েও যেতে পারে। বাঘারুর মনে হয়–এ-অবস্থাটাই অপরিবর্তিত থাকলে সে ভেসে যেতে পারবে কারণ তার পা থেকে কোমর পর্যন্ত যতটা জল বইছে, কোমর থেকে পিঠের ওপর দিয়ে ততটা জল বইছে না। তার মানে, এই ডালটার যেদিকে তার মাথা সেটা উঁচু ও মোটা। তার মানে, এই গাছটা যখন খাড়া ছিল তখন কাণ্ডের যে-জায়গাটা থেকে ডাল বেরিয়েছিল, সেই মোটা জায়গাটাতেই তার মাথা।

ততক্ষণে, আসিন্দির আর গয়ানাথ মিলে আরো একটা প্যাঁচ খুলে দিতেই আর-এক ধাক্কায় গাছগুলো নদীর আরো কিছুটা ভেতরে চলে যায়। সেই ধাক্কাতেই থোক, আর যেখানে গিয়ে গাছগুলো পড়ল সেখানকার স্রোতের জন্যেই তোক গাছটা ঘুরে যেতে থাকে। জলের নিয়মে এখন গাছটা ত জলের ভেতরে ঘুরতে থাকবে। বাঘারু ডালটার তলায় পড়ে যাবে। তখন বাঘারুর ওজনে ডালটা আরো তলিয়ে যাবে। সেই ডালটা যেভাবে ঘুরছিল, তার বিপরীত মুখে একটু ঘুরে বাঘারু ডান হাতটা মাথার দিকে বাড়িয়ে দেখে হাতে আন্দাজ মত কোনো মোটা ফেঁকড়ি পায় কি না। এ যেন এমন কোনো গাছে ওঠা যার ডালপাতাগুলো মাটিতে পোতা আর শেকড়টা আকাশে। বাঘারু উল্টোপথে সেই শেকড়টার দিকেই যেতে চায়। ভবিষ্যৎ না-ভেবেই যেতে চায়–কারণ ডালের চাইতে কাণ্ড মোটা। মোটা বলেই সেখানে সে বেশি আশ্রয় পেতে পারে। কিন্তু মোটা বলেই সেই কাণ্ডটা যদি জলের নিয়মে পাক খেতে শুরু করে তা হলে বাঘারু সেই কাণ্ডটাকে সামলাতে পারবে না। কিন্তু সামলাতে না পারলেও ত সে জলে ভেসে যেতে পারবে। এই ডালপালার ভেতর চাপা পড়বে না। বাঘারু এই ডালপালার চাপ থেকে বেরতে চাইছিল। সে এমন একটা জায়গা খুঁজছিল যেখান থেকে সে নদীটাকে দেখতে পাবে।

ডানহাতের আঙুলে সে ফেঁকড়িটা পেয়ে যায় কিন্তু সেটা আঁকড়ে ধরতে না-ধরতেই পাড় থেকে আরো একটা প্যাঁচ খোলা হয়, আর সেই ধাক্কায় বাঘারুর ডালটা প্রায় সম্পূর্ণ ঘুরে যায়। মুহূর্তের মধ্যে বাঘারু ডালের ওপর পায়ের একটা ধাক্কা দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে দু হাতে, সেই ফেঁকড়ির আন্দাজ যেখানে পেয়েছিল সেই জায়গাটা ধরে, ঝুলে পড়ে। সম্পূর্ণ ঝুলে যেতে সে পারে না কারণ অন্য ডালপালায় তার দু পা আটকে যায়। সেই সব ডালপালার ওপর শরীরের সবটুকু ভর দিয়ে বাঘারু ওপরের ডালটাতে উঠতে যায়। নদীর মধ্যে, স্রোতের মধ্যে মড়মড় আওয়াজে ডালপালা ভেঙে যায়, বাঘারু তার দুই হাত কনুই পর্যন্ত দু দিকের ডালে দিয়ে ঝুলতে থাকে।

এই অবস্থায় সে কিছু সময় পায়। গাছের গুঁড়িতে নাইলনের দড়ির বাধন আটকে গিয়েছিল। সেটাকে এঠেল মাটি দিয়ে পিচ্ছিল করে নিচ্ছিল আসিন্দির। সেই ফাঁকে নিজের দুই হাতের ওপর জোর দিয়ে বাঘারু নিজেকে ঐ গাছপালার ভেতর থেকে বন্যার আকাশের ভেতর উত্থিত করে, সেখানে সেই উত্থানের মধ্যেই গভীর একটা শ্বাস নেয়, আর সেই শাসের জোরেই যেন ওপরের সেই কাণ্ডটার দুদিকে নিজের দু পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে পড়তে পারে। এমনভাবে বসে পড়তে হয় বাঘারুকে যে গাছের মাথাগুলো তার পেছনে পড়ে যায় আর তার সামনে থাকে শুধু নদী। তখন অন্ধকার এতই যে বাঘারু ঠাহর করতেও পারে না সবগুলো গাছের শিকড় কাণ্ডই একদিকে কি না। সেটা সে তখন ঠাহর করতে চায় না। সে দেখে, তার সামনে নদী এবং দিকটা খোলা। তেমন বিপদে সে ত এখান থেকে বায়ে, এবং সামনে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্রোতে ভেসে যেতে পারবে। গাছের ডালপাতার চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে বাঘারু যেন আশ্বস্ত হয়।

কিন্তু তখনই পাড়ের শেষ প্যাঁচটাও খুলে যায় আর বাঘারুকে দু হাতে দু দিকের ডাল চেপে নিজেকে সামলাতে-সামলাতে বুঝতে হয় সে বাতাসের আর বৃষ্টির দেয়াল ভেদ করে সামনের আরো অন্ধকারের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

.

১২৫. জলস্রোতে বৃক্ষবাহন

প্রথম কয়েকটি মুহূর্ত বাঘারুর নিজেকে সামলাতেই যায়। যেন যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে এমন একটা আশঙ্কায় তাকে হাতদুটো দিয়ে গাছের কাণ্ডটাকে শক্তির সর্বস্বসহ আঁকড়ে থাকতে হয়। সে নিজেও টের পায় না, তার পাদুটোও হাঁটুতে বেঁকে গিয়ে কাণ্ডের সঙ্গে মিশে আছে। নদীর ঐ স্রোতটাকে সে শরীর দিয়ে বুঝছিল বাতাসের বিপরীত বেগ শরীর দিয়ে ঠেকাতে-ঠেকাতে। অন্ধকার ত ছিলই, কিন্তু তার সঙ্গে ঐ বাতাস আর বৃষ্টিতে তার দৃষ্টিতে এতই আচ্ছন্নতা আসে যে প্রতিটি মুহূর্তে তার ভয় হয়, সামনে কোনো বিরাট পাথরের সঙ্গে সে ধাক্কা খাবে আর তার মাথাটা চুরমার হয়ে যাবে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই ভয়টা তাকে এমনই পেয়ে বসে সে বা হাতটার কনুই তার চোখে চাপা দেয়, মাথাটা নিচু করে। কিন্তু তাতেও মনে হয় সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝি বাঁচার কিছু সম্ভাবনা আছে। সে আবার বা হাতটা নামিয়ে নিজের বুকমুখ দিয়ে সামনের অন্ধকারটা ভাঙতে-ভাঙতে এগয়, তার নিজের ইচ্ছেয় নয়–নীচের স্রোতের টানে, সেই স্রোতের ওপর কোনোভাবেই বাঘারুর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে সেই মুহূর্তে চাইছিল কোনো এক কারণে এই স্রোতটা একবার একটু থামুক অথবা এই গাছের পাজা কোথাও ঠেকে যাক, অন্তত একটু সময়ের জন্যে ঠেকে যাক। বায়ে-ডাইনে, ওপরে নীচে-সামনে-কোনোদিকে বাঘারু কোনো পরিচিত চিহ্ন দেখতে পায় না, যেমন সে দেখতে অভ্যস্ত, আকাশের তারাদের দিকবদল, অথবা ধানের খেতে বা ফরেস্টে বাতাসের হঠাৎ মোড় নেয়া। রাত্রির নদীও ত বাঘারুর চেনাই, নদীর স্রোতও ত বাঘারুর চেনাই, এই অন্ধকার, এই বাতাস, এই বৃষ্টিও ত তার চেনাই কিন্তু সে ত এই সবকিছুকে এমন একসঙ্গে নদীর মাঝখান থেকে কখনো দেখে নি। এর আগে গয়ানাথের গাছ নিয়ে বাঘারুকে কখনো ভাসতে হয়নি।

বাঘারু একবার ডাইনে তাকায়–তার কাটা অন্য গাছগুলো দেখলে যেন কিছুটা ভরসা পাবে। যদিও সে বোঝে যে গাছগুলো একটু আগুপিছু করেও একই বেগে ভেসে চলেছে কিন্তু কোন গাছটা কোথায় তা টের পায় না। বরং যেন মনে হয় সে যে-গাছটায় শেকড়ের ওপর বসে সেটাই সবচেয়ে আগে ছুটছে।

দু দিকের দুই ডাল শক্ত করে ধরে বাঘারু তার পাদুটো ঝুলিয়ে দেয়। তার পায়ে জল লাগে না। কিন্তু ডান দিকে হেলে পাটা আর-একটু ঝোলাতেই স্রোতের টানে পা-টা যেন তার শরীর থেকে ছিঁড়ে যেতে চায়। বাঘারু পা-টা তুলে আনে।

কিন্তু জলের ছোঁয়ায় বাঘারু যেন একটু সাহস পেয়ে যায়। এতক্ষণ যে তার মনে হচ্ছিল সে আকাশপথে বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে সেই ভয়টা তার কেটে যায়। পায়ে যে জল আর স্রোতের ধাক্কা লাগল সেটা ত তার চেনা। কিন্তু জলটা এত নীচে কী করে গেল?

বাঘারু আবার দুই হাতের দু দিকের ডাল শক্ত করে ধরে পাদুটো সোজা নামিয়ে বুড়ো আঙুলটাও টানটান করে রাখে। কিন্তু জল ছুঁতে পারে না। হাতের ওপর ভর দিয়ে সে একটু গড়িয়ে নামে। কিন্তু কোনো পায়ের বুড়ো আঙুলেই জল পায় না। হাতের ভরে পেছনে আর-একটু গড়াতেই সে হড় করে গাছের একটা গর্তের মধ্যে পড়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার দু পা জলের তোেড় সামনে টেনে নেয়। তার পায়ের পাতা পুরোটাই জলে। গর্তের মধ্যে পড়ে সে খানিকটা সেঁটে গিয়েছিল। তাতে হাতের ওপর ভরসা না রেখেও সে যেন বসতে পারে। ঐ ভাবে সেঁটে গিয়ে বাঘারু গাছটাকে চিনতে চায়। এটা সেই বড় খয়ের গাছটাই হবে। মাটি থেকে সোজা খানিকটা উঠে বায়ে বেঁকে আরো খানিকটা যাওয়ার পর ডালপালা বেরিয়েছে। গাছটা খুব বড়। আর, এখন ঐ বাকের ওপরের দিকটা জলের ওপরে আছে। অর্থাৎ বাকটা আকাশের দিকে। এতক্ষণ বাঘারু ছিল সেই বাকেরও ওপরে। তাই পায়ে জল পাচ্ছিল না। এখন সে গড়িয়ে নেমে গেছে ঠিক সেই বাকের খাজটাতে! তাই আটকে গেছে। কিন্তু জলের তোড়ে এখন যদি গাছটা ঘুরে যায় তাহলে বাঘারু জলের তলায় চলে যাবে। তেমন হলে, তার আত্মরক্ষার উপায় কী হবে সেটা স্থির করতেই বাঘারু হাত দিয়ে গাছের উল্টো দিকটা দেখেকের পিঠেই ত কুঁজ থাকার কথা, কুঁজটা আছে কি না। বাঘারু যেন পেয়ে যায়–সে যে-গর্তের ভেতর সেঁটে আছে তার ভেতর দিয়েই গাছটা যেন উল্টো দিকে ফুলে উঠেছে। বাঘারু আশ্বস্ত হয়। গাছটা উল্টে গেলে সে আলগোছে নিজেকে সোজা রাখবে-তারপর গড়ানো শেষ হলে আবার বসবে।

এখন গাছটার কাণ্ড ও শেকড় তার সামনে–নৌকোর গলুইয়ের মত খানিকটা। এখন যদি কোথাও ধাক্কা লাগে তা হলে বাঘারুর মাথাটা অন্তত ফাটবে না–বাঘারু সেটুকু আড়াল পেয়েছে। আর মাঝে-মাঝে পা-দুটো ঝুলিয়ে বাঘারু স্রোতটাকে যে আন্দাজ করতে পারছে এতেও তার ভেতরে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস চারিত হয়ে যায়। পাড়ের বাধন সম্পূর্ণ উৎপাটিত হওয়ার পর এই অন্ধকারে বাতাসের বিপরীতে ঐ বেগে ভেসে যেতে-যেতে বাঘারু ভয় পেয়ে গিয়েছিল–এমনই ভয়, যাতে সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। কিন্তু এখন এই একটু তলায় নেমে এসে, এই একটা গর্তে সেঁটে গিয়ে, পা দিয়ে জল পেয়ে, গাছটাকে হাতিয়ে-হাতিয়ে চিনতে পেরে ও গাছটা উল্টে গেলে সে কী করবে তা পর্যন্ত ঠিক করে ফেলতে পেরে বাঘারুর ভয়টা কেটে যায়। শুধু যে ভয়টাই কেটে যায় তা নয়, সে অবস্থাটা অনেকখানি ঠাহর করে ফেলতেও চায়। তিস্তার বন্যা না হয় গাছ চারটিকে মাটি থেকে টেনে জলে নামিয়েছে কিন্তু ভাসিয়ে ত আর নেয় নি। বাঘারু ত নিজে হাতে প্রত্যেকটা গাছের শেকড় কেটে, সেগুলোকে দড়িতে বেঁধে, এক জায়গায় এনে, জলে ভাসিয়েছে। সুতরাং বাঘারু ত জানে, এই গাছগুলোর এত ডালপালা, এত পাতা যে বাঘারু যদি হিশেব মত তার ভেতর সেঁদিয়ে যেতে পারত তা হলে এই বাতাস ও বৃষ্টি তার গায়ে লাগতই না–গয়ানাথের যে-ঘরে সে শোয় সেই ঘর থেকে তিস্তার ভেতরের এই উপড়নো গাছে আশ্রয় অনেক বেশি। কিন্তু এখন এই অন্ধকারে বাঘারু সেরকম একটা জায়গা খুঁজে বের করবে কেমন করে? এখন ত সবচেয়ে বেশি অন্ধকার। আরো অনেকক্ষণ এই অন্ধকার থাকবে–কতক্ষণ সে-হিশেব তার জানা নেই। কিন্তু সে জানে এই অন্ধকারটা দিয়েই রাত শেষ হয়। সূর্য উঠবার আগের আলোতেই এই অন্ধকারটা কাটতে শুরু করবে। গত কয়েকদিনের মধ্যে সূর্যের মুখ দেখা যায় নি। যেন, সারাটা দিনই সঁঝবেলা। কিন্তু মুখ দেখা না-গেলেও আলোটা ত থাকবেই। তাকালে ত কোনটা আকাশ, কোনটা নদী, কোনটা মেঘ, কোনটা জল, কোনটা গাছ, আর কোনটা পাড় তা চেনা যাবে। তখন ত বাঘারু তার নিজের হাতে কেটে ভাসিয়ে দেয়া এই গাছগুলোর ডালপালার ভেতরে কোথায় ঢোকা যায়, আর কোথায় ঢোকা যায় না, তার একটা হিশেব কষতে পারবে।

তার আগে বাঘারুর এখন অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকা।

.

১২৬. দুই আঘাতের মাঝখানে

এরকমই সময় কেটে যায়।

কিন্তু সে সময় কতটা তার কোনো অনুমান বাঘারুর আসে না। সময়ের সঙ্গে ত বাঘারুর শরীর বাধা। বাতাসের ছোঁয়ায় সে বোঝে বেলা কত হল, ছায়ায় গাঢ়তায় সে টের পেয়ে যায় বেলা কত হেলল, শোয়ানো ঘাস দেখলে সে পায়ের স্পর্শে শেষ রাতেও আন্দাজ পায় সূর্য উঠতে আর দেরি কত, এমন-কি গয়ানাথের গোয়ালিয়া ঘরে বা বাইরের এগিনায় (আঙিনায়) গভীর ঘুমিয়ে থাকলেও তার শরীর তার অজ্ঞাতেই জেনে যায় রাত কতটা ফুরিয়েছে। কিন্তু এখন তেমন কোনো অনুমান বাঘারুর আসে না। কতক্ষণ আগে গাজোলডোবা থেকে গাছগুলোর সঙ্গে সে ভেসেছে তার আন্দাজ পাবে কী দিয়ে। পাড় ছাড়ার পর থেকে জলস্রোতে গাছগুলো য়ে-বেগে ভেসে যাচ্ছে তার কোথাও কোনো ছেদ নেই। নদীর এই খোলা আকাশের ভেতর দিয়ে যে-বেগে হাওয়া আর বৃষ্টি বয়ে আসছে তারও কোনো ছেদ নেই। তা হলে বাঘারু সময় মাপবে কী দিয়ে? একটু যদি আবছা আলোও থাকত তা হলে বাঘারু অন্তত চেষ্টা করতে পারত ডাইনে বায়ে তাকিয়ে দুই পাড়ের বা কোনো চরের ইশারা খুঁজতে। দেউনিয়া যখন গাছগুলোর সঙ্গে তাকে ভাসতেই বলল, আর-একটু আগে বলল না, কেন–মেঘের আড়ালে-আড়ালেও যতক্ষণ একটা চাঁদ ছিল। দেউনিয়া ঐ অর্জুন গাছের আশায়-আশায় বসে থাকল। এতই যদি তোমরালার অর্জুনগাছখানের শখ, হামাক বলিলেন না কেনে? যে-টাইমত মোক জোয়াইটা ভটভটিয়াত্ বান্ধি আনি ফেলাছে, ঐ অর্জুনগাছখান ত কাটি ফেলাবার পারছু।

বাঘারু একটু যেন হেসে ফেলতে পারে।

মোর দেউনিয়াখান অর্জুনগাছখান চাহিবার পারে, কিন্তু কাটিবার না দিবে। কাটিবার ত টাইম নাগিবে। কাটিবার ত আওয়াজ উঠিবে। স্যালায় কায় জানে কোটত কোন ফরেস্টের গার্ড আসি খাড়ি যাবে। স্যালায় অর্জুনগাছে কুড়ালিয়ার দাগ ত আর মুছি ফেলা না যায়। মোর দেউনিয়াখান সারা রাত বসি থাকি, কিন্তু কহিল্ না, বাঘারু হে কাটি ফেল, অর্জুনগাছখান কাটি ফেলা। এক অর্জুনগাছোখান মোর চাঁদখান ডুবি দিলা। এ্যালায় এই আন্ধারত মুই না জানো কতখন ভাসি যাছি, জানো না কতখন ভাসি যাম। চাদাডোবা আন্ধার ত বেশি টাইম থাকিবার কথা না হয়। মোর ত মনত খাছে কি সারা রাতি এই আন্ধার দিয়া ভাসিছু। বাঘারু খুক করে হাসে।

ভাসি যাছু, না, মোর ভটভটিখান চড়ি যাছু। বাঘারু আবারও খুক করে একটু হাসে। আসিন্দির জোয়াইয়ের ভটভটিখান ডাঙার উপর দিয়া যাছে, মোর ভটভটিয়াখান জলের উপর দিয়া যাছে। বাঘারু টাকরায় জিভ লাগিয়ে মোটর সাইকেলের মতন একটা আওয়াজ তুলতে চায়। আওয়াজের কথা ভেবে আবার একটু হাসে বটে, তবে আওয়াজটা তোলে না। জিভটা টাকরা থেকে নামিয়ে নেয়। কিন্তু দু দিকের ডালটা ধরে, যেন মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেল।

একটু পরে সেরকম মনে হওগার খেলাটা শেষ হয়ে যায়। তখন বাঘারুর মনে হয়, তাকে তার দেউনিয়া যে বলদ বলে ডাকে সেটা কতটা সত্য। সে এই গর্তটা পেয়ে যেন বতুতে গেছে, হাতের ভেতর ডাল পেয়ে যেন আশ্রয় জুটে গেছে তার। কিন্তু সে এরকম ভটভটিয়া চালাবার মত করে ডালের ওপর বসে আছে কেন? এই গর্তটাতে সেঁটে থেকেই ত সে উল্টে যেতে পারে, পা দুটো ডাল বরাবর ছড়িয়ে দিতে পারে, মাথাটা ডালে হেলিয়ে দিতে পারে-তাতে তার এক রকমের শোয়াই ত হতে পারে। এমন-কি, সে চোখও বুজিতে পারে। তারপর যখন অন্ধকার কাটবে, কাটবে।

গর্তটার ভেতর বাঘারু এমনই হেঁটে গিয়েছিল যে নিজেকে ঘোরাতে তার অসুবিধে যেটুকু হয় সেটা এই কারণে, নিজে ঘুরতে গিয়ে গাছটাকে যেন দুলিয়ে না দেয়। এই স্রোতের মধ্যে গাছে যদি সে ঝাঁকি দিয়ে ফেলে তা হলে গাছটা ঘুরে যেতে পারে। তাতে, যেটুকু জায়গা গুছিয়ে নিতে পেরেছে বাঘারু, সেটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।

বাঘারু দুদিকের ডাল ছেড়ে এই ডালটার মাথাটা ধরে কোমরটাকে তোলে, তারপর পা দুটোকে আস্তে করে ডালের সঙ্গে লেপ্টে লম্বা করে দেয়। মাথার ওপর লম্বা করে দেয়া হাত আর ডালের সঙ্গে লম্বা করে দেয়া পা–এতেই তার এতটা আরাম হয় যে বাঘারু ভাবে কী দরকার আর চিত হওয়ার, বরং এরকম উপুড় হয়ে থাকা যেন তার অভ্যেস হয়ে গেছে, কী দরকার আবার একটা নতুন ভঙ্গিতে যাওয়ার? বরং এই ভঙ্গিতে থাকলে, দরকার হলেই সে সোজা হয়ে বসে পড়তে পারবে।

কিন্তু যে-গর্তটার জন্যে সে বসার একটা জায়গা পেয়েছিল, সেই গর্তটার জন্যেই সে অমন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে পারে না। কোমরটা গর্তের ভেতরে ঢুকে যায়। বাঘারু তখন কোমরটা উঁচু করে ডালটার ওপর কাত হয়–বা দিকে। কাত হয়েও সে ডালের ওপর লম্বালম্বি থাকতে পারে। একটু থাকেও। তার এই চিত হওয়ায়, কাত হওয়ায় ডালটা বা গাছটা সামান্য একটু নড়লেও, তারপরই স্থির হয়ে যায়। বাঘারু এবার গর্তটার ভেতর তার পেছনটাকে চিত করে দেয় প্রথমে, একটু অপেক্ষা করে, তারপর জলস্রোতের তালে-তালে নিজেকে চিত করে ফেলে। তার পা দুটো ডালের সঙ্গে লম্বা করে ছড়ানো, এখন হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে ডালের ওপর রাখা। যদি তেমন দরকার হয় তা হলে সে চট করে বসতে পারবে। কেমন করে পারবে সেটা বোঝার জন্যে পা দুটো দ্রুত গুটিয়ে আনে। হ্যাঁ, পারবে। আবার পা দুটো মেলে দেয়। আর তখন পিঠে গোজা কুড়োলটা পিঠে লাগে।

প্রথমে বাঘারু সেটাকে অগ্রাহ্য করতে চায়। কিন্তু স্রোতের দোলায় যখনই ডান দিকে হেলে তখনই কুড়োলের ধ্বরটা তার চামড়ায় লাগে। সে বোঝে, জোরে একটা ধাক্কা লাগলে কুড়োলটা মাংসের ভেতর সেঁদিয়ে যেতে পারে। সে ডান হাতটা বেঁকিয়ে পিঠের দিকে নিয়ে যায়; তারপর কুড়োলের লোহাটা ধরে সেটাকে তুলে নিয়ে আসে। এনে,দু হাতে কুড়োলটাকে চোখের সামনে মেলে ধরে। এত অন্ধকার দিয়ে ক্ষণ, নিজে ঘুরতে গিমনই হেঁটে গিয়েছিলরে। তারপর যৎ

যে কুড়োলের ধারটাও চমকায় না। লোহাটার ওপর হাত বোলায় বাঘারু। ভিজে গেছে। বাঁ হাতে কুড়োলটা ধরে ডান হাতের পাতা দিয়ে কুড়োলটা মোছে। তারপর শুয়ে-শুয়েই পা দুটো ফাঁক করে, শুয়ে-শুয়েই কুড়োলের কাঠটা ধরে, শুয়ে-শুয়েই কুড়োলটাকে বাতাস আর বৃষ্টির ঝাঁপটের মধ্যে তোলে আর নিজের দুই পায়ের মাঝখানে ডালটার ওপর নামিয়ে আনেকুড়োলটা গভীর গেঁথে যায়। বাঘারু পা দুটো আবার ডালের ওপর লম্বা করে দেয় মাঝখানে কুড়োলের লোহাটা বেষ্টন করে। হাত দুটো দু দিকের ডালে ছড়িয়ে রাখে। এইবার যেন সে একটু চোখ বুজতে পারে। বাঘারু চোখ বোজে।

যেন এতক্ষণ চোখ খোলা ছিল বলেই বাতাসের আর বৃষ্টির গর্জন সে শুনতে পাচ্ছিল না। চোখ বুজতেই তার শরীরের তলা থেকে জলের অন্তর্ঘাতী কল্লোল উঠে এসে তার শরীরের ওপরে হাওয়ার পরাক্রান্ত আক্রমণের সঙ্গে মিশে যায়। এই দুই আঘাতের মাঝখানে চোখ বুজে বাঘারু ভেসে থাকে। ভেসে থাকতে-থাকতে সেই দুই আওয়াজও তার শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। সে আর-কোনো আওয়াজ। শুনতে পায় না।

এর পর, কতক্ষণ পর বোঝা যায় না, সে আওয়াজ পায় পাখির ডাকাডাকির–অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, সে আওয়াজে বোঝা যায়।

.

১২৭. জলস্রোতে নিদ্রাভঙ্গ

বাঘারু পাখির ডাক শুনে চোখ খোলে না। পাখির ডাকটা কোনো আওয়াজের মত করে তার কানে পৌঁছয় না। যেন অনেকক্ষণ ধরেই এক-আধবার আওয়াজটা হচ্ছে, তারই মধ্যে এক-আধবার সে শুনতে পাচ্ছে, এক-আধবার শুনতে পাচ্ছে না, যেমন রোজই হয়। তারপর, এক সময় সে শুনতেই পায় পাখি ডাকছে। মানে, ভোর হয়েছে। ভোর হওয়ার কথাটা মনে হতেই বাঘারু চোখ মেলতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু মেলে নি। আর এই না মেলার সময়টুকুর ভেতরেই বাতাসের বিপরীত ঝাঁপট আর স্রোতের কল্লোলের উঠে আসা তার কানে বাজে। তা হলে কি সে একটু ঘুমিয়েও গিয়েছিল? কিন্তু চোখখোলা আর ডাল থেকে হাত সরিয়ে কুড়োলের হাতলটা ধরার মধ্যে কোনটা আগে ঘটে বোঝা যায় না। বাঘারু দেখে তার কিছুটা ওপরে গাছের পাতাভরা ডাল, সে-ডালে দু-একটা পাখি।

এতক্ষণ পর, বাঘারুর সচেতনতা পুরো ফিরে আসে। সে কুড়োলের হাতলে হাত দিয়ে মাথার ওপরের সেই ডালটার দিকে, বা ডালের পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকারটা কাটে নি কিন্তু এখনই শুরু হল সূর্য ওঠার আগের আলোর আভাস ছড়ানো। এখনো বাঘারু তার মাথার ওপরের পাতার রং দেখতে পাচ্ছে না, শুধু আকারটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু পাখি? তা হলে কি গাছটাছ নিয়ে সে কোথাও ঠেকে গেছে? কোনো পাড়ে কিংবা কোনো চরে? তার নীচে ত সে স্রোতের আওয়াজ পাচ্ছে। সে ত কোথাও ঠেকে গেলেও পাওয়া যেতে পারে। যে-ডালটায় সে শুয়ে আছে সেটাও ত দুলছে। তাও ত কোথাও ঠেকে গেলে দুলতে পারে। বাঘারু তার মাথার ওপরের ডালগুলোকে দেখে-দুলছে। সেও ত কোথাও ঠেকে গেলে বাতাসে দুলতে পারে। কিন্তু কোথাও ঠেকে না-গেলে পাখিগুলো ডেকে-ডেকে উঠছে কেন? নাকি এগুলো এই গাছেরই পাখি–গাছগুলোর সঙ্গেই ভেসে আসছে? নাকি এগুলো এই পাড়ের বা চরের পাখি–গাছের ডাল পেয়ে উড়ে এসে বসেছে?

বাঘারু যেন নিজের সঙ্গে একটা খেলাই পায়। তার ত এখন কিছু করার নেই। অন্ধকারটা কাটছে মানে, তার প্রায় আর-কোনো বিপদ থাকল না–এখন ত সে সব কিছু দেখতেই পাবে, ভাসমান গাছের কোথায় পা দিতে পারবে সেটা দেখেই বুঝবে। এখন ত সে দড়ি দিয়ে টেনে-টেনে গাছগুলোকে আরো কাছাকাছি এনে ফেলতে পারবে–প্রায় ভেলার মত। সে সারাটা রাত টেরই পেল না–তার মাথার ওপর এত পাতাওয়ালা একটা ডালের আচ্ছাদন ছিল? আর এখন সে বুঝতেই পারছে না সে কোথাও ঠেকে আছে, না ভেসে যাচ্ছে?

বাঘারু শুয়ে থেকেই তার পা দুটো দুদিক থেকে ঝুলিয়ে দেয়। জলের ছোঁয়া লাগে–স্রোত পা-টা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে ত কোথাও ঠেকে গেলেও হতে পারে। পাখিগুলো আবার ডাকে, কেটু বেশি সমবেত ডেকে ওঠে–যেন তারা তাদের পরিচিত পরিবেশেই আছে। কিন্তু যত পরিচিতই হোক, এই গাছটা ত তাদের চেনা হতে পারে না। তা হলে সেই গাজোলডোবার ফরেস্ট থেকে এই খয়ের গাছ, শালগাছ আর বাঘারুর মত, তারাও, ভেসে আসছে রাতভর? বাঘারু দুদিকের ডালে সামান্য ভর দিয়ে উঠে বসে। দড়ির বান্ডিলটা তার বুকে দোলে। সে দেখে তার সামনের, নদীর পেছনের অন্ধকার থেকে তার এখনকার পেছনে নদীর সামনের দিকে, হু হু করে ছুটে যাচ্ছে। রাতের সেই অন্ধকার জুড়ে বাঘারু এ রকম বেগেই ছুটে এসেছে কিন্তু দেখতে পায় নি। এখন, আধার আবছা হয়ে যাওয়ায় সে স্রোতের সেই গতির দারুণ টান যেন প্রথম বোধ করে।

বোধ করতেই, বাঘারু সেই গতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চায়। সে পেছন থেকে কোনো গতির সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারে না–জিপগাড়ির পেছন থেকে ফরেস্টের ভেতর ঢুকতে যেমন তার দিকজ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়, এখানেও স্রোতের বিপরীত দিকে মুখ করে সে স্রোতটাকে সামলাতে পারে না। সে কুড়োলটা তুলে পিঠে গোজে, দড়ির বাণ্ডিলটাকেও পিঠের দিকে ঠেলে দেয়, তারপর সেই গর্তটার ভেতর বসেই ঘুরে যায়–স্রোতের টানে নোঙরছেঁড়া কোনো নৌকোর মত গাছগুলো সোজা ভেসে যাচ্ছে। সামনে, বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না কিন্তু জলের ওপরকার অন্ধকারটা আবছা হচ্ছে, যেন সেই আবছা অন্ধকারটা এই গাছগুলোর আঘাতেই দূর হচ্ছে। : বাঘারু দেখে কাল সে এই ডালটারই মাথাতে বহুক্ষণ ভয়ে এঁটে ছিল। এখন বোঝে ঐখানেই বিপদ ছিল সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি কোনো ডাল নেই–হাত পিছলে গেলে জলে ত পড়তই, এই গাছগুলোর নীচে চাপাও পড়ত। এই গাছগুলো যে-স্রোতের টানে ভাসছে, সেও সেই স্রোতের টানেই ভাসত, ফলে, গাছগুলোর তলা থেকে বেরতে পারত না। বাঘারু ঘাড় ঘুরিয়ে গাছের ডালপালাগুলো একবার দেখে যেন আশ্বস্ত হতে চায়, সে ঐ উঁচু ডাল থেকে জলে পড়ে গেলেও ডালপালা ধরে আবার জল থেকে মাথা তুলতে পারত! কাল রাতে সে একেবারে মরে যেতে পারত–এমন ধারণাটা তাড়াতে না পারলে যেন বাঘারুর এখনকার বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ হবে না।

ততক্ষণে ঐ গাছগুলোর ডাল থেকে উড়ে আবার গাছের ডালে ফিরে বসা আর ডাকাডাকি করা পাখির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই পাখিগুলোর বাসাসমেতই গাছগুলো জলে পড়েছিল। এই পাখিগুলোর বাসা জলে ভাসে নি বা ভেজে নি। ফলে, অন্ধকারে অন্ধের মত তারা বাসা ছাড়ে নি। এখন স্রোতের টানে গাছগুলোর সঙ্গেই ভেসে যাচ্ছে।

বাঘারু একটু দাঁড়িয়ে দেখতে চায় বসে যা দেখছে তার চাইতে বেশি কিছু দেখা যায় কি না, আর, গাছগুলো কী ভাবে বাধা আছে, কোনো গাছ ত খসেও গিয়ে থাকতে পারে!

বাঘারু জানে, কোনো গাছের বাধন আলগা হয়ে গেলে সে বুঝতে পারতই– কারণ গাছগুলোকে ত খুব ভালভাবে বাধা যায় নি, একটা বাধন আলগা হলে সব বাধনই ঢিলে হয়ে যেতে পারত। সব বাধনের মূল ত তার গলায় দড়ির বাণ্ডিলে। যদি জলের ভেতর কোনো স্রোতের বিপরীত টানও থাকত তা হলে স্রোতের আড়াআড়িতে বাধন ঢিলে হয়ে যেতে পারত। এই এত জল এমন টানে একদিকে চলছে যে গাছগুলো ঘুরছে না পর্যন্ত। কিন্তু তবু বাঘারু একবার দাঁড়িয়ে দেখতে চায়।

যে-গর্তটার ভেতর সে বসে আছে সেখানে পা রেখে এই ডালটাতেই ঝুঁকে হাতের ভর দিয়ে খানিকটা দাঁড়াতে পারে বটে কিন্তু সেটা ঠিক খাড়া দাঁড়ানোত হবে না। এমন ভাবে খাড়া দাঁড়াতে চায় বাঘারু যাতে সবগুলো গাছ আলাদা-আলাদা করে চেনা যায়, দরকার হলে নতুন করে আবার গাছগুলোকে বাধা যায়। কিন্তু আসিন্দিরের ভটভটিয়ার মত করে ডালটার ওপর বসে থেকে একবার সামনের আবছা আঁধার আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যান্য গাছের দিকে তাকিয়ে বাঘারু বোঝে এখনো অন্ধকার ততটা কাটে নি যাতে সে দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজতে পারে, বা যদিও পায়, সেখানে দাঁড়িয়ে সে গাছগুলোকে বা গাছের বাধনগুলোকে আলাদা করে দেখতে পারবে না। তার জন্যে এই আঁধার আরে কিছু কাটা দরকার। পাখিগুলো যেরকম বেশি-বেশি ডাকছে তাতে বোঝা যায়–আঁধারটা কাটছে।

.

১২৮. বাঘারু ও পাখিদের জাগরণ

বাতাস আর বৃষ্টি সেই একইরকমভাবে নদীস্রোতের বিপরীতে আকাশ দিয়ে বয়ে আসছে। বাঘারু স্রোতের বেগে ধেয়ে যাচ্ছে আর তার গায়ের ওপর বাতাসের ও বৃষ্টির পাল্টা ঝাপ্টা এসে লেগেই যাচ্ছে–এই অবস্থাটা এতই অপরিচিত যে বাঘারু মনে আনার চেষ্টাও করে না যে কতক্ষণ আগে সে গাজোলডোবায় ঐ ফরেস্ট থেকে জলে ভেসেছিল।

এ ক্যানং বসি থাকা বেলা ঠাকুরের তানে? আতির (রাত্রির) আন্ধার কনেক কনেক করি কাটিবার ধরিবে আর পুবপাখে বেলাঠাকুর উঠিবার আগত নাল, হলদিয়া রংগিলা উঠিবে আর মুছিবে। সেগিলা অঙের (রঙের) ছাও পড়িবে জলের উপরত। আর নদীর জল টলটল করিবার ধরিবে অঙত। এ্যানং, চলিবা থাকিবে অঙের খেলা আকাশত্ নদী আর মাঠঘাট, ফরেস্টত। তার বাদে সব অঙ মুছি যাবার ধরিবে। কায় মুছিছেন কায় জানে। য্যাঁলায় রঙগিলা মুছি গিয়া, ধরো কেনে, সারাখান আকাশ গোবরমোছা এগিনার (আঙিনা) নাখান নাগে, য্যান, এ্যালায় সিদ্ধ ধান শুখাবার তানে ঐঠে মেলা দিবার লাগিবে, স্যালায় বেলঠাকুরখান উঠিবেন, লাল টকটক বন্ন ধরি নদীখানের মাঝঠে। বেলাঠাকুর যেইঠে উঠেন সেইঠে মাঝঠে উঠেন। মাঠ দেখো, বেলাঠাকুর মাঠের মাঝতৃটে উঠিবার ধরিবেন। নদীত দেখো, বেলাঠাকুর নদীর মাঝতুঠে উঠিবেন। ফরেস্ট দেখো, বেলাঠাকুর ফরেস্টের মাঝতটে উঠিবেন। আর, এ কী হবা ধরিছেন? আতি আর দিনত বৃষ্টি আর বাও, বাও আর বৃষ্টি। দিনের বেলা আতির নাখান আবছা, আতির বেলা দিনের নাখান আবছা। এ্যালায় থাকো এইঠে বসি–এ আন্ধার পাতলা হওয়ার তানে। থাকো বসি।

বাঘারু যেন অস্থির হয়ে ওঠে এই স্রোত, বাতাস, বৃষ্টির ভেতরে এই গাছগুলো নিয়ে তার ভেসে যাওয়ার নির্দিষ্ট একটা ভূমিকা তৈরি করে নিতে। কাল রাতের শেষে সে যখন গাজোলডোবার পাড় ছেড়েছে তারপর থেকে প্রতিটি মুহূর্তই যে-ডাল হাতেপায়ে পেয়েছে, সেই ডাল তাকে অন্ধের মত আঁকড়ে থাকতে হয়েছে, একটা আন্দাজ পর্যন্ত পায় নি–কোথায় কতটুকু পা সরাতে পারবে বা হাত নাড়াতে পারবে। আন্দাজে-আন্দাজে একটা বসার জায়গা পেয়ে ডাল বরাবর শুয়ে সে হয়ত একটু ঝিমিয়েও নিয়েছে। কিন্তু সেসব যেন মাঝরাতের অন্ধকারে হঠাৎ জলে পড়ার মত। বাঘারুর কিছু করার ছিল না। অথচ বাঘারু ত গয়ানাথের চার-চারটে গাছ কেটে, বেঁধে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অর্জুনগাছটা পড়লে পাঁচটা গাছ হত। বাঘারুর এই গাছগুলো এক-একটাই ত এক-একটা ফরেস্ট যেন। শাল আছে একটা, খয়ের আছে একটা। বাকি দুটো গাছ খুব ভাল করে দেখেও নি ত বাঘারু। এই গাছগুলো দিয়ে গয়ানাথ তাকে ভাসিয়ে দিয়েছে। তাকে কোথাও গিয়ে ঠেকতে হবে। কোথায়, তা সে জানে না, গয়ানাথও জানে না। এক, নদীর এই ফ্লাড জানলেও জানতে পারে। তার, বাঘারুর কাজ, এই গাছগুলোকে নিয়ে সেই কোথাও ঠেকে যাওয়ার, ঠেকে থাকার। তারপর আসিন্দির আর গয়ানাথ ভটভটিতে করে তাকে খুঁজে বের করে গাছগিলাক আর হামা যা করিবার করিবে। কিন্তু সেইজন্যে ত এখন এই সকাল থেকে এই গাছ আর বানা আর বাতাস আর বৃষ্টি নিয়ে বাঘারুর সচেতন ও সক্রিয় হয়ে ওঠার কথা। তা না, এখনো তাকে এই ডালের ওপর বসে থাকতে হচ্ছে প্রায় অন্ধের মতই।

বাঘারু চোখ মেলে চারদিকে তাকায়। আকাশের দিকে তাকালে সেই ছাই-ছাই মেঘগুলো কোথাও কোথাও দেখা যায়, নদীর জলও দূরে কোথাও-কোথাও চলকায়। কিন্তু এই যে-গাছগুলোর সঙ্গে সে ভেসে যাচ্ছে তার পাতাগুলো কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না, তার রঙও না। এর মধ্যে পাখিগুলি চারটে শোয়ানো গাছের ডালে বসে নদীর জল অথবা কোনো অনির্দিষ্ট সকালের দিকে তাকিয়ে আছে। সকালের পাখি সাধারণত আলোর দিকে মুখ করে থাকে। কিন্তু গাছগুলো এমন কাত হয়ে পড়ায়, ডালপালার যে-বিন্যাসের সঙ্গে পাখিগুলো পরিচিত ছিল, সেটাই কেমন বদলে গেছে। ফলে, তারা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কোন ডালে বসে কোন দিকে তাকালে তাদের পরিচিত আলো দেখতে পাবে। নীচের জলস্রোতের ঐ বেগটাও তাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় নেই। তাদের অভ্যাস এতটা ভেঙে যাওয়াতেও কিন্তু পাখিগুলো নিজেদের মত করে একটা রোজকার অভ্যেসে ফিরে যায়–চার-চারটে গাছের মেলানো-মেশানো ডালপালার মধ্যে উড়তে-উড়তে। চার-চারটে গাছ এমনি জটপাকিয়ে আছে যেন মনে হয়–একটাই কোনো এমন বড় গাছ, যে-গাছে সূর্য আড়ালে পড়ে যেত। একটা গাছের সরু মোটা নানা ডালে নানা ভাবে ছোটাছুটি করতে করতে পাখিগুলো হঠাৎ-হঠাৎ একসঙ্গে ভয় পেয়ে ডেকে উঠছে। বাঘারু বুঝে উঠতে পারে না–ভয়টা ওরা পাচ্ছে কেন, এমনই সমবেত ভয়।

বাঘারু গাছটা দিয়ে গড়িয়ে আরো খানিকটা নীচে নামে। তার পায়ের পাতা ত জলে ডুবেই যায়, গোড়ালি ভেঙে জল উঠতে থাকে। এইখানে বাঘারু পাশে আর-একটা মোটা ডাল পায়। কিন্তু সেটা ধরে বসেবসেই এই ডাল থেকে ঐ ডালে যেতে বাঘারু পিঠে একবার হাত ঘেঁয়ায় কুড়োলটা আছে ত? এতই বেশি মিশে গেছে কুড়োলটা শরীরের সঙ্গে যে বাঘারুর প্রায় মনেই থাকছে না। মনে ত না-থাকবারই কথা। শুধু কাজের সময় হাত বাড়ালেই যেন পাওয়া যায়। নতুন ডালটাতে পা দিতেই ডালটা ভোস করে জলে ডুবে যায় আর বাঘারু তাড়াতাড়ি আগের ডালটাতেই ফিরে আসতে যায়। ডালটা আচমকা ধাক্কায় আবার ডুবে যায়, আর বাঘারু এতটাই তলিয়ে যায় যে তাকে পুরনো গাছের ডালটায় পা দেয়ার বদলে দুই হাত দিতে হয়। কোমর পর্যন্ত ভিজে গিয়ে সেই পুরনো ডালটা দুই পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে বাঘারু–তার পিঠে জলের ছোঁয়া লাগে। এখন যদি সে একটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ডালের ওপর তুলতে যায়, যা হলে এই ডালটাও ঘুরে জলের তলায় চলে যেতে পারে। ফলে বাঘারুকে ওরকম ঝুলেই থাকতে হয়। কিন্তু রাতের শেষ কয়েক ঘণ্টা ঐ ডালটার ওপরেই ভর দিয়ে এসেছে বলে ডালটাকেও সে একটু বেশি চিনেছিল। বাঘারু নিজেকে জলের ভেতর আরো খানিকটা ছেড়ে দেয়-ফলে তার শরীরটা হাল্কা হয়ে যায়। সেই হাল্কা শরীরটাকে জলের ভেতর দিয়েই সে ওপরে নিয়ে যায়–যেখানে সে বসেছিল সেই জায়গাটিতে। ঝুঁকি লাগলেও ঐ জায়গাটিতে ঘুর লাগবে না।

ভেজা শরীরে বাঘারু আবার তার পুরনো গর্তের ভেতর বসে পড়ে। সেখানে সেঁটে যেতেই বাঘারুর একবার মনে হয়–তার এখান থেকে নড়ার দরকারটা কী? যেখানে গিয়ে ঠেকবে সেখানে তার নামার মত জায়গা থাকলে, নামবে। এ-ছাড়া ত তার কিছু করারও নেই।

পাখিগুলো চিরকাল যেমন, এখনো তেমনি, বাঘারুর নাগালের বাইরে ওড়াউড়ি করে যাচ্ছে। কিন্তু আজ যে বাঘারু আর তারা একটা গাছে চড়ে যাচ্ছে সেটাও অবান্তর হয়ে যায় এই গাছগুলোর উঁচু ডাল-নিচু ডালের পার্থক্যে। পাখিগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে না যে তারা আর বাঘারু একই গাছে ভেসে আছে।

পাখিগুলো আবার আচমকা ডেকে উঠল–একসঙ্গে, ভয়ার্ত।

বাঘারু এবার ঐ ডাল বেয়েই একটু পেছিয়ে যায়। গাছগুলো পাড় থেকে ছাড়ার সময় সে হাত-পা বুক-পেট দিয়ে ডালের যে-অংশটাকে জড়িয়ে এটে বসেছিল, সেই জায়গাটাতে পৌঁছয়। সেখান থেকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করে–পাখিগুলো সব কটি গাছ জুড়েই এরকম ভয় পাচ্ছে, নাকি, একটা জায়গাতেই। ঐ একটু উঁচু ডাল থেকে বাঘারু দেখে চারটি উৎপাটিত গাছে কত পাখি ও তাদের কত ওড়াউড়ি চলছে সবগুলো গাছ জুড়ে। ফিরে-ফিরে ওড়া কিন্তু বাতাসের ধাক্কা সইতে না পেরে আবার পাতার ভেতর ঢুকে যাওয়া।

কিন্তু পাখিগুলোর ভয় দূর করার দায়িত্ব বাঘারুকে কে দিল?

গাছগিলা গয়ানাথের, পাখিগিলা গাছের, পাখিগিলা গয়ানাথের না হয়। গাছগিলার চামড়ার নাখান পাখিগিলা গাছের ডালত বাসা বান্ধির ধরেছে। যেইল বাও দিবার ধরে, ঝড়ের নাখান বাও দিবার ধরে, বাওড় গাছগিলার ডালপালা ওলটপালট খাবার ধইচছে–এ্যানং ওলটপালট য্যান গাছের মাথাগিলা মাটিত নামি আসিবে আর গাছের শিকড়খান আকাশত উঠি যাবে–স্যালায় বৃক্ষের কুনো প্রাণী বৃক্ষ ছাড়িবেন না। পাখ-পাখাল ডালপালা আঁটি ধরি থাকিবেন, পিপিড়া গাছের গাওত সিন্ধি যাবে, সাপখোপ গাছের গর্তত ঢুকি যাবে। সেই বৃক্ষখান যদি ঝড় উলট খায়, পড়ি যায়, স্যালায়ও বৃক্ষের কুনো প্রাণী বৃক্ষ ছাড়িবেন না। তারপর বাও থামিবেন, বৃষ্টি থামিবেন, বৃক্ষের পাতা পচি খসি যাবার ধরিবেন–স্যালায় পাখপাখাল, সাপপিপিড়া নতুন গাছত বাসা বান্ধিবার ধরে। গয়ানাথের ঝড় গয়ানাথের গাছক উপড়ি দিছে। গয়ানাথের বাঘারু মুই, গয়ানাথর গাছক ভাসি দিছি। গায়ানাথের বাঘারু মুই গয়ানাথর গাছ নিগি ভাসিছু। তিস্তার এই বানাত ভাসি যাছু। তিস্তার বানার নাখান এই ঝড় আর বৃষ্টির বানাত ভাসি যাছু। গয়ানাথর বাঘারু মুই গয়ানাথর গাছ নিগি ভাসি যায় গয়ানাথর জোয়াই আর গয়ানাথ ভটভটিয়াখান চড়ি সদর আস্তা (রাস্তা) দিয়া তামান চর আর কায়েম দেখি-দেখি খুঁজিবার ধরিবেন–কোটে গিয়া ঠেকি গয়ানাথর গাছ আর গয়ানাথর বাঘারু। মোর আর কী কষ্ট? বসি আছু, খাড়ি আছু, তিস্তার বানা মোক টানি নিয়া যাছে। গয়ানাথ দেউনিয়াখানের বড় কষ্ট। আসিন্দির জোয়াইখানের বড় কষ্ট। এ্যালায় এ্যানং বানা। কোটৎ চর, কোট টাড়ি। আর এ্যানং ঝড়। এ্যানং বৃষ্টি। কোটত মোক খুঁজি-খুঁজি বেড়িবার লাগিবে। মুই চিল্লি পারি–হে দেউনিয়া মুই এইঠে। কিন্তুক কায় শুনিবেন সেই চিৎকার। কী আর করিবেন রে দেউনিয়া? তোমরালার গাছগিলা আর বাঘারুক য্যালায় ভাসি দিছেন, স্যালায় ত তুলি নিবার নাগিবে। না-হয় ত সবখানই তোমার লস্, পুরাখান লস, এই চারিখান গাছ ল, এই বাঘারুখান লস্। জ্বালিয়া যেইলা জালখান নদীতে ফেলেন, স্যালায়, ত গুটিবার নাগিবেই। না হয় ত জালখানই লস্,। তোমরালার গাছ গিলাক আর বাঘারুখানক যেইলা ভাসি দিছু স্যালার গুটিবার নাগিবেই। এই ঝড়ত, এই বৃষ্টি তোমায় ভটভটিয়াখান নিগি বাহির হওয়া নাগিবে। কিন্তু গাছের এই পাখিগিলা ত গয়ানাথ দেউনিয়ার না-হয়। পাখিগিলা গাছের। গাছখান ফ্লাড়ত ভাসিরার ধরিছে ত পাখিগিলাও ভাসিবার ধরিছে। এ্যালায় ঝড়ত কাঁপছে, বৃষ্টিত ভিজিছে কিন্তুক পাখিগিলাই আন্ধার কাটি দিছে। পাখিগিলার কুনো গয়ানাথ নাই রো, কিন্তুক পাখিগিলার ত বাঘারু আছো, মুই আছো। মোক দেখিবার নাগিবে না কেনে ভয় খাছে পাখিগিলা? এই সব কথাবার্তা ভাবনাচিন্তার ভেতরই সেই বৃষ্টিপাত-ও ঝড়ো হাওয়া আক্রান্ত সূর্যোদয়ের আচ্ছন্নতার সময় জুড়ে বাঘারু ব্যস্ত থাকে। সেই ব্যস্ততায় সে থই হারিয়ে ফেলে কখন ও কেমন করে গাছের পাতাগুলোর সবুজ, দৃশ্য হয়ে ওঠে, এবং এমন-কি খয়ের গাছের পাতার সবুজের সঙ্গে শালগাছের পাতার সবুজের পার্থক্যও, এমন-কি, একই গাছের বিভিন্ন পাতার আকার ও রঙের পার্থক্যগুলিও। বাঘারুর চিন্তায় তরপরম্পরা যেমন আছে, আরো সব মানুষের মতই, তেমনি তার চিন্তার পরম্পরাহীন। জট পাকিয়ে যাওয়াও আছে, আরো সব মানুষের মতই, কিন্তু সেই আর-সব মানুষ থেকে তার পার্থক্যও আছে। গয়ানাথের জমিতে হাল দিতে-দিতেই হোক, গয়ানাথের বাথানের মোষ-গরুগুলিকে নিয়ে চলতে-চলতেই থোক আর গয়ানাথের গাছগুলো নিয়ে জলে ভাসতে-ভাসতেই হোক–বাঘারুকে আজও সব মানুষের মতই একা-একা ভাবতে হয় বটে, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তাকে কথাও বলতে হয়। একা-একাই। যদি সে কথা বলে উঠতে পারে তা হলে তার মাথার ওপরে আকাশ, পায়ের তলায় মাটি বা জল থাকলেই যথেষ্ট। এর আগে তার কোনো-কোনো বাক্যোদগমের সময় কখনো কোথাও কোনো অনির্দিষ্ট অফিসার বা নির্দিষ্ট এম-এল-এ থাকতে পারে, এখন তেমনি এই নতুন দিনে তিস্তার বন্যার সীমান্ত ধরে-ধরে গাছগুলোকে খুঁজবে যে-আসিন্দির আর গয়ানাথ, সেই তারাও তার কথা বলার উপলক্ষ হতে পারে। হয়ও।

হয় বটে, কিন্তু সে-জন্যে বাঘারুর পক্ষীসন্ধানে কোনো ছেদ পড়ে না। সে ঐ মাস্তুলের মত গাছের কাণ্ড থেকে দেখে, পাখিগুলো আসলে এই নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে কখনো কোথাও-কোথাও এক সঙ্গে ভয় পাচ্ছে। তারা গাছের ডালপাতার মত স্থায়ী ও অনড় আশ্রয়েই আছে, অথচ বন্যার স্রোতে ঐ বেগে ভেসে যাচ্ছে–এর ভেতর মিলটা কোথায় তারা বোঝে না। ফলে, সকালবেলার অভ্যস্ত ছোটাছুটি করতে করতে গাছগুলোর পাতার ভেতর দিয়ে একেবারে জলের কাছ। পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, এমন-কি জল ছুঁয়েও ফেলছে–আর তার পরই ভয়ে চিৎকার করে ওপরে উঠে আসছে।

এই প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করে যখন বাঘারু, তখন সে বুঝে উঠতে পারে না–কিছুপাখি স্রোতে পড়ে ভেসে গেছে কিনা। যদি স্রোতে ডানা লেগে থাকে তা হলে আর উঠতে পারে নি, ভেসেই গেছে)। কিন্তু বাঘারু কী করে পাখিগুলোকে এই গাছগুলোর ডালপালার ভেতরে যাওয়া থেকে আটকাবে? নীচের ডালপাতার ভেতরে ঢুকে গেলে নীচের বন্যায় তাদের ভেসে যাওয়া ঠেকাবে কী করে বাঘারু? পাখিগুলোও কখনো দেখে নি, ডাল থেকে ডালে গেলে জলে পড়তে হয়।

বাঘারু জলস্রোতের কাছ থেকে পাখিগুলোকে বাঁচাতে চায়। সে হেট হেট করে গাছটার ডালে ঋকি দেয়। তাতে ওপরের ডালের পাখিগুলো ডাল ছেড়ে আকাশে উড়ে আবার ডালে বসে। বাঘারু, দেখে, পাখিগুলো যেন বেশি করে ডালপালার ভেতর দিয়ে জলের কাছাকাছি যেতে চায়। কেন চায়, সেটা বাঘারু বুঝে ফেলে–ডালপাতার অত ভেতরে গেলে ঝড়ো বাতাসের ও বৃষ্টির ঐ ঝাপ্টা থেকে বাঁচছে। কিন্তু পাখিগুলো বাতাস আর বৃষ্টি চেনে, বন্যার স্রোত ত আর চেনে না। তাই জলের কতটা ওপরে থাকলে তারা আত্মরক্ষা করতে পারবে হিশেব করতে পারে না।

বাঘারুর চোখের সামনে এতক্ষণে স্পষ্ট হল–একটা শাল, একটা খয়ের, একটা সিসু, আর-একটা গাছ এখনো সে চিনতে পারছে না–একেবারে পরস্পরের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু নীচের যে-গাছটাকে সে চিনতে পারে না সেটা আড়াআড়ি এই তিনটি গাছের তলায় লেগে আছে স্রোতের ধাক্কায় নাকি নাইলনের দড়ির বাধনে। যাতেই হোক, লেগে ত আছে। বাঘারু সেদিক থেকে একেবারে বা দিকের গাছটার সীমার ডালে দাঁড়িয়ে। সে যদি মাঝখানের শালগাছটারও মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবার একটা জায়গা পেত তা হলে সেখান থেকে সে সবগুলো গাছকেই ও সেই গাছের পাখিগুলোকে দেখতে পেত।

বাঘারু ঠিকই করে ফেলে সে ঐ গাছগুলোর ঠিক মাঝামাঝি যে-শালগাছটা তারও মাঝখানে যাবে। এখন চারপাশ ফরশা হয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকেও দেখা যাচ্ছে। তিস্তার স্রোত–যতদূর পর্যন্ত চোখ যায়, ততদূর পর্যন্ত একই রকম ঘোলাটে। তাকালে মনে হয় না, এই বিরাট জলপ্রান্তরের কোনো স্রোত আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে স্রোতের সেই বেগে মাথা ঘোরে।

খয়ের গাছের ঐ বাকা কাণ্ডটা বেয়ে বাঘারু তরতর করে নীচে নেমে ঐ জলটা ধরে জলেই নেমে যায়। স্রোতের ধাক্কায় তার শরীরটা ডালের সমান্তরালে ভাসে-দেখিছু ক্যানং সোঁতা হে। কিন্তু এতে তার শালগাছের ডালটা ধরতে সুবিধেই হয়। সে ডালটা ধরায় যে ঝাঁকুনি লাগে, তাতে পাখিগুলো কিচিরমিচির করে ওপরে উঠে যায়। বাঘারুর মনে হয়, শালগাছটাতে পুরো ভর দিলে গাছটা জলের ভেতরে ডুবে যেতে পারে। কিন্তু তা নাও যেতে পারে যদি তলার সেই না-চেনা গাছটার ডালপালা শালগাছটার তলায় থাকে। একবার ডান হাতের ওপর বেশি ঝোঁক দিয়ে দেখে নিতে চায়। সেই ঝোঁকটা দিতে-দিতেই তার বা হাতটা খয়ের গাছ ছেড়ে দেয়। দুই হাতে শালগাছটা ধরতে-ধরতেই শালগাছটা তলিয়ে যায়-বাঘারু সেটাকে আরো একটু তলিয়ে নিয়ে শালগাছের ওপর উঠে বসলে তার হাঁটু পর্যন্ত জলে ডুবে থাকে।

.

১২৯. মাচাননির্মাণ

ডালের ওপর বসে বাঘারু একটু অপেক্ষা করে যে ওপরে তার উঠে বসার ধাক্কা সামলে ডালটা আবার ভেসে ওঠে কিনা। জলের স্রোত তার হাঁটুর পেছনের গর্তটায় সামান্য ধাক্কা মারে কিন্তু স্রোত এতই খর যে জল উছলে ওঠে না। ডালটা একটু ভেসে ওঠে বটে কিন্তু পুরোটা ভেসে ওঠে না। বাঘারু তার ডানে তাকিয়ে আর একটা এমন ডাল খোঁজে যেটা কাণ্ড থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সে তেমন একটা ডাল বাছাই করতে পারে বটে কিন্তু সেটা আবার একটু পেছনে। এই ডাল থেকে ঐ ডালে যাবার হাঙ্গামা পোষাবে কিনা সেটা মাপতে বাঘারু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ডালটা ত দেখেই, তার সঙ্গে-সঙ্গে ডালের আশপাশটাও দেখে নেয়। তারপর সেই ডালটায় যাবার জন্য একই সঙ্গে ডান হাত ও পা বাড়িয়ে দেয়। তাতে এই ডালটা আবার জলে ডুবে যায় বটে কিন্তু তাতে বা হাত, বা পা-টা ঐ ডাল থেকে সরিয়ে আনতে বাঘারুর সুবিধেই হয়। এবার সে অনেকগুলো ছোট-ছোট ডালপালা ভেদ করে, আবার সেগুলোকেই ধরে একটা উঁচু ডালের ওপর দাঁড়াতে পারে ও চারদিকে তাকাতে পারে। একটা উঁচু জায়গায় উঠে যেমন চারদিকে তাকাতে হয় তেমনি তাকিয়েছিল বাঘারু কিন্তু তাকানোর পর, অতটা ফরশা সকালেও সে বুঝে উঠতে পারে না কোথায় এসে পড়েছে, কোন পাড়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছে। বাঘারুকে কখনো তিস্তার ওপর দিয়ে তিস্তার দুই পাড় চিনতে-চিনতে যেতে হয় নি, তার পক্ষে নদীর ভেতর থেকে নদীর পাড় চিনে নেয়া এমনিতেই মুশকিল হত। আর, এ নদী তার সারা বছরের চেনা নদীই নয়। সারাটা বছরের মধ্যে দু-চার-দশ দিন এই নদী বাঘারুর অপরিচিত হয়ে ওঠে আর নদী অপরিচিত হয়ে ওঠায় এই নদীর সঙ্গে জড়িত দুই পারের সব বাড়িটাড়ি গাছগাছড়াও অচেনা হয়ে যায়। বছরের তেমনি দু-চার দশ দিন এখন চলছে।

বাঘারু ডাল থেকে ডালে চলে আসায় এই গাছগুলোর ডালপালায় যে-আলোড়ন উঠেছিল তাতে পাখিগুলো মাঝে-মাঝেই একটু উড়ে উঠে আবার নতুন জায়গায় বসে পড়ছিল। বাঘারু উঁচু ডালটাতে দাঁড়িয়ে যে-সময়টুকু চারপাশ দেখে, পাখিরা সেই ফাঁকে চার-চারটি গাছের ডালপাতার ভেতরে-ভেতরে ঢুকে যায়। এক-একটা ঝাঁকিতে পাখিগুলো কিন্তু গাছ ছেড়ে বেশি দূর উঠতে পারে না–সেখানে বাতাসের ঝাঁপট লাগে। কিন্তু সেটা পুষিয়ে নিতেই আবার জলের বিপজ্জনক কিনারা পর্যন্ত চলে যায়। বাঘারু ঠিক ভেবে উঠতে পারে না, কী করে পাখিগুলোকে জল আর বাতাস থেকে সমদূরত্বের নিরাপদ ডালপালাগুলিতে ফিরিয়ে আনবে।

কিন্তু এই ডালটা বাঘারুর পছন্দ হয়ে যায়। সবচেয়ে না হলেও, এই ডালটা বেশ উঁচুই। চারদিক দেখা যায়। চারটি গাছের মাঝখানেও। একটাই অসুবিধেমাথার ওপর বড় ভারী কোনো ডালপালা না-থাকায় জল আর হাওয়ার ঝাপটা সরাসরি বাঘারুর গায়ে এসে পড়েছে। বাঘারু আবার তার বায়ে তাকিয়ে দেখে ওদিকে আর-একটা নিচু কোনো ডাল পাওয়া যায় কিনা যেখানে দরকার হলে সে বৃষ্টি আর বাতাসের ধাক্কা থেকে বাঁচার জন্যে গিয়ে মাঝেমধ্যে বসতে পারে।

কিন্তু তেমন কোনো ডাল খুঁজে পাবার আগেই বাঘারু তার পিঠ থেকে কুড়োলটা তুলে আনে। এই ডালটার ওপর একটা মাচান মত বানিয়ে নিতে চায় সে।

মোক ত ভাসিবা নাগিবে, যত দিন এই ফ্লাড চলিবে, তত দিন এই গাছগিলা নিয়া মোক ভাসিবার নাগিবে। যত দিন আসিন্দির জোয়াই আর গয়ানাথ দেউনিয়া মোক খুঁজি না পায় তত দিন মোক ভাসিবার নাগিবে। গয়ানাথ এই ফ্লাডের নদীর ভেতর কোনঠে মোক খুঁজিবার পাবে হে? যেইলা ফ্লাড থামিবে, হেই পাহাড়ভাঙা ফরেস্ট ভাঙাজলগিলা সব নদী খালি করি বহি যাবে, যে-চরগিলা টাড়িগিলা ফ্লাডত ঢাকা পড়ি যাছে, স্যালায় সেগিলা আবার দেখি যাবার পাম, স্যালায় মুই এই গাছগিলাক নিয়া কোটত ঠেকি থাকিম আর গয়ানাথ আর আসিন্দিরজোয়াই মোক খুঁজি পাবে। তত্ত দিন ত মোক ভাসিবার নাগিবে–

এই সব কথা কখনো কখনো ভাবার জন্যেই বলতে বলতে বাঘারু তার কুড়ালিয়া দিয়ে ছোট-ছোট নানা ডাল কেটে যায়। কাটা ডালগুলো ওখানেই ঝুলে থাকে, দুটো-একটা ডাল পড়ে গিয়ে নীচের ডালে আটকে যায়। কাটার সময় বাঘারু কোন ডালই কুড়োয় না। সে কখনো বা হাতে একটা ছোট ডাল নামিয়ে এনে তার গোড়ায় ডান হাতে কোপ দেয়–একটা। তারপর বা হাতটা ছেড়ে দেয়। কাটা। ডালটা আটকে থাকে। কখনো বাঘারু ডান হাতটা একটু লম্বা করে দূরের কোনো ডালের গোড়ায় কোপ দেয়। সেটা এক কোপে না নামলে, আর একটা কোপ তাকে দিতে হয়। কিন্তু তার দুই হাতের সমবেত শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন হয় এরকম কোন ডাল সে কাটে না।

দেখতে-দেখতে বাঘারু নিজের জন্যে যেন আকাশটাকে পরিষ্কার করে ফেলে। তাতে বৃষ্টি আর হাওয়ার ঝাঁপটের মুখে সে আরো পড়ে যায় বটে কিন্তু চারদিকটা বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই শেষ রাতের অন্ধকার থেকে সে যেন এই চার গাছের সঙ্গে আরো একটা গাছ হয়ে ভেসেছে–এতক্ষণে সে গাছ আর নদীস্রোতের ওপর তার প্রভুত্ব দেখাবার মত একটা আসন তৈরি করতে পারছে।

কুড়ালিয়াটাকে আবার পিঠে খুঁজে নিয়ে বাঘারু কাটা ডালগুলো টেনে আনতে শুরু করে। ততক্ষণে এই ডালটার ওপর তার হাঁটাচলা এতই স্বাভাবিক হয়ে যায় সে অনেক সময় দুই হাতেই কাটা ডালগুলো, তুলে এনে এখানে এই ডালটার ওপর আড়াআড়ি ফেলে। ফেলতে-ফেলতে একবার তাকিয়ে দেখে যথেষ্ট ছোট ডাল কাটা হয়েছে কিনা।

বারু এবার নীচের একটা ডালে নেমে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে সে দুই হাতে ঐ ছোট ডালগুলোকে ওপরের বড় ডালের ও পাশাপাশি আরো নানা ডালের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি মেলে দেয়। মেলে দিতেই একটা মাচানের মত হয়ে যায়।

এইবার বাঘারু নাইলনের দড়ির বাণ্ডিলটা গলা থেকে খুলে সামনে এনে একটু ভাবতে বসে। এই ছোট ডালগুলোকে বড় ডালটার সঙ্গে বেঁধে না দিলে ডালগুলো ত খসে পড়ে যাবে কিন্তু এত মোটা গাছ বাধা নাইলনের দড়ি দিয়ে সে ঐ টুকু টুকু ডাল বাধবে কেমন করে? সুতলি থাকলে হত। বাঘারু সামনে দাঁড়িয়ে গাছগুলোর দিকে তাকায় যেন ওখানে কোথাও পাটের সুতলি থাকতে পারে। একটু দূরে একটা লতা মত দুলছিল। বাঘারু হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতেই ছিঁড়ে যায়। সেটা বাঘারুর হাতেই লেগে থাকে। ততক্ষণে সকালের আবছা আলোয় ঘোলাটে আকাশ ও ঘোলাটে নদীস্রোতের ওপর দিয়ে নিজের দৃষ্টিটা একবার বুলিয়ে নিয়ে আসে–কোথাও কি পাটের সুতলি থাকতে পারে? অগত্যা বাঘারু তার হাতের নাইলন দড়ির বাণ্ডিলটার দিকেই তাকায়। এই চার-চারটি গাছের সব বাধন এই বাণ্ডিলটার সঙ্গে বাটা। কোনো গাছ কোথাও আটকে গেলে বা সরে গেলে সে এই বাণ্ডিলের টানে বুঝতে পারবে। এই বাণ্ডিলটা থেকে একটা টুকরো কেটে নিয়ে তার প্যাঁচ খুলে-খুলে ছোট-ছোট সুতলির মত দড়ি হয়ত বের করা যেত কিন্তু তা হলে ত বাণ্ডিলটাকে কাটতে হয়। কাটলে সে কী করে টের পাবে–গাছগুলো ঠিক আছে কিনা। গয়ানাথকে যেমন বাথান বুঝিয়ে দিতে হয়, তেমনি ত এই ফরেস্টও বুঝিয়ে দিতে ইর।

.

১৩০. পাখিরা জলে ঝরে যায়

শেষে বাঘারু একটা বুদ্ধি বের করে।

বুদ্ধিটা যে বের করে তা নয়–হাতে আছে এক মোটা নাইলনের বান্ডিল, সুতরাং যা করার তাকে এই দড়ি দিয়েই করতে হয়। ঐ ছড়িয়ে রাখা ছোট ডালগুলোর ওপর দিয়ে নীচ দিয়ে সে নাইলনের দড়িটাকে দু দিকের মোটা ডালগুলোর সঙ্গে আড়াআড়ি বাধে। মোটা ডালগুলোর সঙ্গে দড়িটা পেচিয়ে দেয়াতে ঐ মাচানটা যেন নাইলনের মোটা দড়ির জালে আটকা পড়ে যায়। তাতে ঐ ছোট ডালগুলো খুব শক্ত করে বাধা হল না বটে কিন্তু ঐ মাচানের ওপর থেকে বাঘারুর পড়ে যাওয়ার ভয় আর-থাকল না–দড়ির জালে আটকে যাবে।

নাইলনের দড়ির বাণ্ডিলটাকে আবার গলায় ঝুলিয়ে বাঘারু ডালের ওপর পা দিয়ে তার মাচানের ওপর উঠে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে চারপাশে সামনে-পিছনে, ডাইনেয়ে, ওপরে-নীচে তাকায়। দাঁড়িয়ে ও তাকিয়ে তার এত ভাল লাগে যে সে একবার ঐ মাচানের ওপর বসে পড়ে, তারপর সেখানে আধশোয়াও হয়, তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়।

দাঁড়ানো, বসা বা শোয়ার সময় বাঘারুকে একটু সাবধান হতে হয় বটে যাতে ডালগুলো সরে না যায়, কিন্তু তাতে তার আনন্দ কিছু কমে না। এতক্ষণে সে যেন এই বন্যা, এই বৃষ্টি, এই হাওয়া ও এই গাছগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ পায়। সে ছোটখাট ডালগুলো কাটায় তার দৃষ্টিপথও অনেকটা খুলে গিয়েছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল, স্রোত ঠেলে তার এই চার গাছের বহর প্রায় একটুও না হেলে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। স্রোত এই গাছের বহর ও তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই যেতে হচ্ছে বটে কিন্তু এই মাচানের ওপর বসে চারপাশ দেখতে পাওয়ায় বাঘারুর মনে একটা ভাব আসে যে সে গাছগুলোকে, এবং স্রোতটাকেও, অনেকখানি নিজের খুশিমত চালাতে পারছে।

নিজের এই মনে হওয়ার সমর্থনের জন্যে বাঘারুর একটা লাঠি দরকার–বেশ লম্বা ও সোজা একটা লাঠি, এখান থেকে যে-লাঠি দিয়ে জল ঘেঁয়া যাবে, আবার দরকার হলে যে-লাঠি আকাশেও ভোলা যাবে। আকাশে তোলার কোনো দুরকার বাঘারু ভাবে না–কিন্তু লাঠি একটা থাকলে সেটা ত আকাশে তোলাই যায়, নইলে আর সেটা লাঠি কেন?. এ অভাবটা বাঘারু রাখতে চায় না।

সে-কুড়ালিয়া খান আবার পিঠ থেকে খুলে এনে, ডান হাতে ঝুলিয়ে, স্রোতের দিকে মুখ করে মাচানের ওপর দাঁড়িয়ে, নিজের চারপাশের ডালপালা-ঘঁটা ফাঁকায় দাঁড়ায় আর এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে লাঠি বানানোর মত একটা ডাল খোঁজে। যে-খয়ের গাছটাতে সে রাত কাটিয়েছে সেটাকে এখন মনে হয় কত দূরের–তার ডালপালাগুলোকেও মনে হয়, ঘন। সিসু গাছটাও ত পাশেই; সেটার পাতাগুলো গায়ে গা লাগানোবাতাসের ধাক্কায় সব একদিকে হেলে আছে। বাঘারু সেদিকে তাকিয়ে ভাবে–সিসুগাছের ডালাপালুর মধ্যে সে তার পছন্দমত একটা লম্বা সরু ডাল পেয়ে যেতে পারে। এবার সে স্রোতের উল্টোদিকে তাকায় যে-গাছটাকে সে আগে চিনে উঠতে পারে নি সেই গাছটা দেখতে। কিন্তু, কুড়ালিয়া হাতে ঝাপানোর জন্যে প্রস্তুত ভঙ্গিতে সে বোঝে ঐ গাছটাতে পৌঁছনো অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার।

সে মাচানটি থেকে পাশের সিসু গাছটাতেই যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে দেখে তলায় একটা ডাল উল্টো হয়ে পড়ে আছে, কাটা দিকটা ওপরে। আগাটা কোথায় গিয়ে পড়েছে দেখা যাচ্ছে না। সে কুড়ালিয়াটা পেছনে খুঁজে ঐ ডালটাকে টেনে তোলে। আর বেশ ভেতর থেকে উঠে আসে লম্বা একটা হিলহিলে ডাল। বাঘারু ডালটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে–আগার দিকটা একটু বেশি সরু কিন্তু আপাতত তার কাজ চলে যাবে। সে মাচানে ফিরে এসে বসে। পিঠ থেকে কুড়ালিয়াটা খুলে ডালটাকে পরিষ্কার করে। সব পাতাটাতা ঝরিয়ে দেবার পর ডালটাকে বেশ একটা চাবুকের মত দেখায়। বাঘারু লাঠিটাকে সামনে ধরে দেখে। গায়ের চামড়াটা খুলে দিলে ভেতরের রঙটা বেরিয়ে পড়ত। কাঁচা সিসু কাঠের ভেতরের রং সরষের তেলের মত ঝকঝক করে। কুড়ালিয়ার হ্যান্ডেলটা ডান বগলে চেপে ধরে সে গোড়া থেকে একটু-একটু চাছতে শুরু করে। এতক্ষণে, ঐ ঝড়ো বাতাস সত্ত্বেও ফরেস্টের কাঁচা সবুজের গন্ধ বাঘারুর নাকে আসে—ডালটার চামড়ার ভেতর থেকে উঠে আসছে। এই গন্ধটাতে বাঘারু নিজের অজ্ঞাতেই একটু স্বস্তি পায়। গাছের ওপর এ রকম একটা মাচান পেতেছে, তার হাতে ডালের রস লাগছে, নাকে ফরেস্টের গন্ধ-বাঘারু যেন বন্যায় ভেসে যাচ্ছে না, ফরেস্টেরই ভেতর দিয়ে হাঁটছে, বা চা বাগানের ভেতর দিয়ে।

একটা হ্যান্ডেলমত তৈরি হয়ে যাওয়ার পর বাঘারু ছাল ছাড়ানো বন্ধ করে। কুড়ালিয়াটা পাশে রেখে হাত তুলেই আবার হাত দিয়ে চেপে ধরে–যদি জলে পড়ে যায়। সে সেটা পিঠে গোজে।

তারপর দাঁড়িয়ে উঠে, দুই পা ফাঁক করে বাঘারু দুই হাতে লাঠিটা মাথার ওপরে বৃষ্টি আর বাতাসের ভেতর ঘোরায়। ঘোরাতে-ঘোরাতে তার বেশ মজাই লাগে–যেন তার লাঠিটা দিয়ে বৃষ্টি আর হাওয়ার ঐ তোড়টা ভেঙে দেয়া যাচ্ছে। সেই মজাতেই বাঘারু লাঠিটাকে নামিয়ে আনে যেন আরো বাস্তব প্রতিরোধের সঙ্গে লড়ে আনন্দ পেতে আর গাছের ডালপালাগুলোর ওপর মারতে থাকে-হে-হে-হে-হে–এই রকম আওয়াজ তুলে।

হঠাৎ লাঠির ঘায়ে ডালগুলো থেকে, এবং আরো নীচের ডাল থেকেও, পাখিগুলোর একটা ঝাক বাঁচার তাড়নায় ফরফর করে আকাশে উঠে যায়। সে যে পাখিগুলোকে নীচে জলের কাছ থেকে ওপরে তুলে আনতে চেয়েছিল সেটা বাঘারুর মনে পড়ে যায়। সে এতক্ষণে সম্বোধনের সুযোগ পায়, উঠি আয় কেনে, জলের কাছতঠে উঠি আয় বলে সে লম্বা লাঠিটাকে আরো নীচে ডাইনোয়ে চালায়।

তেমন চালায় বলেই আর মাথা তুলে দেখে না। তলা থেকেও পাখিগুলো ডাকতে-ডাকতে ওপরে আসে, তারপর ডাল ছেড়ে আকাশে উঠে যায়।

তখন বাঘারু দেখে, তার লাঠির ভয়ে পাখিগুলো আওয়াজ করতে করতে ডাল ছেড়ে বড় বেশি ওপরে উঠে গেছে–এতটা ওপরে যেখান থেকে তারা আর নামতে পারছে না, ঝড়ো বাতাসের ধাক্কায় তাদের স্রোতের বিপরীতে চলে যেতে হচ্ছে আর চার-চারটি গাছের বহর নিয়ে বাঘারু তাদের তলা থেকে স্রোতের টানে সরে আসছে। সেই বাতাসের ভেতর পাখিগুলোর তলায় জল ছাড়া কোনো আশ্রয়। নেই। এ পাখিগুলো হাওয়ার বিপরীতে উড়ে এই গাছের কাছে ত আসতে পারছেই না, হাওয়া এত জোরে বইছে যে অনুকূলে পাখা মেলেও থাকতে পারছে না। নদীর ওপরে হাওয়ার, ভেতরে পাখির আঁকটা কেমন শুকনো পাতার মত ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। বাঘারু আরো সরে যেতে-যেতেও দেখতে পায়–দুটো একটা পাখি যেন আকাশ থেকে নদীতে পড়ে গেল, ঐ শুকনো পাতার মতই।

বাঘারু বিহ্বল হয়ে ঘুরে সামনে যত দূর চোখ যায় তত দূর ঘোলা জলের দিকে তাকিয়েই মাচানের ওপর আবার ঘুরে পেছনে বাতাসের ভেতর পাখিগুলোর ঝরে পড়ার দিকে তাকায়। কিন্তু তখন সে আরো দূরে সরে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *