চতুর্থ অধ্যায় – শিক্ষা
৪.১ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার সমস্যা
শিক্ষকতা আমার পেশা; আমি শিক্ষক সম্প্রদায়ের একজন। অপরের সমালোচনায় ভদ্রতার প্রশ্ন থাকে; আত্ম-সমালোচনায় সে প্রশ্ন অবান্তর। তা ছাড়া, শিক্ষার সমস্যা আজ এতোই গুরুতর, শিক্ষার পুনর্গঠনের প্রয়োজন এতোই জরুরী যে, বলবার কথাটা একটু জোর দিয়ে বলাই ভালো।
গত কয়েক বছর যাবত পরীক্ষাকেন্দ্রে ছাত্রদের হৈ-চৈ-টা বেড়ে চলেছে। প্রশ্ন কঠিন বা প্রত্যাশিতের বাইরে বলে ছাত্রেরা বেরিয়ে চলে আসছে। কয়েকজন ছাত্র, যারা পরীক্ষা দিতে অনিচ্ছুক, অপর ছাত্রদের জোর করে পরীক্ষা কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে আসছে। আইনভঙ্গকারীদের আঘাতে কখনও আসবাবপত্র ভাঙছে, কখনও নিদোষ লোক জখম হচ্ছে। পরীক্ষা হলে নকল তো এখন নিত্য-নৈমিত্তিক। কি করে এ-জিনিসটা বন্ধ করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এটাই আজ একটা প্রধান চিন্তার ব্যাপার হয়ে উঠছে।
পরীক্ষাকেন্দ্রে যে-ব্যাপারটা ঘটছে, সেটা নিন্দনীয় সন্দেহ নেই; এ বিষয়ে কড়া ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কিন্তু আজকের প্রবন্ধে সেটা আমার প্রধান বলবার কথা নয়। পরীক্ষার প্রতিটি কেন্দ্রে যদি আজ কোনো যাদুবলে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের অনেকেই তা হলে নিশ্চিন্ত হতেন। অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে এমন সামঞ্জস্যবিহীন, ছাত্রদের মনে জ্ঞানস্পৃহা। জাগাবার পক্ষে এটা এতোই অনুপযোগী যে এর পরিবর্তন যতদিন না হচ্ছে ততদিন শুধু পরীক্ষাকক্ষে শন্তি রক্ষা করেই যিনি নিশ্চিন্ত বোধ করেন শিক্ষার প্রকৃত সমস্যাটা তাঁর চেতনায় প্রবেশ করেনি বলেই আমার ধারণা।
এই বৃহৎ সমস্যার একটি অংশ মাত্র নিয়ে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করব। শিক্ষার ব্যাপারে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ; আমার বক্তব্যও প্রধানত উচ্চশিক্ষার দুয়েকটি সমস্যাঁতেই আবদ্ধ রাখব। কিন্তু তার আগে বলে নিতে চাই যে, প্রাথমিক শিক্ষাটা পর্যন্ত আজ অবধি আমরা এ দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে। পৌঁছে দিতে পারিনি, এটা অত্যন্ত ক্ষোভের কথা। অন্তত খানিকটা শিক্ষা আপামর জনসাধারণের ভিতর ছড়িয়ে দিতে না-পারলে আমাদের গণতন্ত্রও যেমন অসম্পূর্ণ থাকবে, কৃষি তথা আর্থিক উন্নতিও তেমনি গোড়ায় দুর্বল থেকে যাবে।
আলোচনার গোড়ায় উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের ধারণা খানিকটা স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন। মধ্যযুগে উচ্চশিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ____ ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা এবং বংশপরম্পরায় সেটাকে অবিচল শ্রদ্ধায় বাঁচিয়ে রাখা। বর্তমান যুগের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। এযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্রুত এগিয়ে চলেছে, সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ। প্রগতিশীল প্রতিটি দেশে এমন এক শ্রেণীর মানুষ প্রয়োজন যাঁদের কাজ হবে জ্ঞানবিজ্ঞানের এই অগ্রগতিতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করা, নিদেনপক্ষে নিজের চিন্তাকে ক্রমশ বাড়িয়ে যাওয়া জগতের সঙ্গে তাল রেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও প্রধান কাজ এই বিশেষ ধরনের জ্ঞানব্রতী মানুষ তৈরী করা। যে-দেশে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থায় এই মানুষ তৈরী হবে না সে-দেশ পিছিয়ে পড়বে।
চাকরীর সমস্যার কথা আমি আপাতত বলছি না। সেটার জন্য প্রধান প্রয়োজন কারিগরী শিক্ষার পুনর্গঠন এবং শিল্পের প্রসারের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য বিধান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ভিন্ন। শুধু কেরানী তৈরীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় চালানো তুচ্ছ বস্তুর উৎপাদনে দামী যন্ত্রের ব্যবহারের মতই সামাজিক সম্পদের অপচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য কেরানী তৈরী নয়, বরং সেই মানুষ তৈরী যিনি গৃহীত জ্ঞানকে সমালোচকের দৃষ্টিতে বিচার করতে পারেন, বর্ধিষ্ণু বিজ্ঞানের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে পারেন, যাঁকে ছাড়া দেশের দৃষ্টি প্রসারিত হয় না, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির উন্নতি সম্ভব হয় না। আমাদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা এই মানুষ তৈরী করার পক্ষে উপযোগী কি না, এটাই প্রধান প্রশ্ন, ডিগ্রিধারী ক’টি অথবা ক’ হাজার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরলো, সেটা প্রধান নয়।
এই গোড়ার কথাটা মনে রেখে আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে একবার তাকানো যাক। শিক্ষাকে আমরা যুক্ত করতে পারিনি নিয়ত বিবর্তিত জীবনের গভীরতর অভিজ্ঞতা ও সমস্যার সঙ্গে। এটা করা প্রয়োজন। শিক্ষার নামে এখানে চলেছে ধমক ধমকে মুখস্থ বিদ্যার চচা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু বছরের শেষে একটি পরীক্ষা, তাতেই ছাত্রের ফলাফল বিচার হয়। পরীক্ষা কাছে না-এলে ছাত্রদের লেখাপড়ার চাড় থাকে না। কাজেই প্রথম দেড় বছর শিক্ষার্থীরা, বিশেষত কলা বিভাগের ছাত্রেরা, শিক্ষায় মনঃসংযোগ করে না। এতে বুদ্ধি ও চরিত্র দুয়েরই ক্ষতি। বছরের পর বছর এই বুদ্ধিনাশের তুলনায় পরীক্ষা হলে অশান্তির ফলে যে-ক্ষতিটুকু হয় সেটা সামান্য। শেষ ছ মাসে পড়াশোনার তাড়া পড়ে। বাছাই করা কিছু প্রশ্নোত্তর ছেলেরা তৈরী (অর্থাৎ পরীক্ষার খাতায় লিখার মত মুখস্থ করে যায়। এর বাইরে কোনো প্রশ্ন এলে তারা ক্রুদ্ধ বোধ করে, অধ্যাপক তাদের সঙ্গে শর্ত ভঙ্গ করেছেন এই রকম একটা অনুযোগে মুখর হয়ে ওঠে। দু বছরের ভিতর ক্লাসে কোনো পরীক্ষা নেই–পরীক্ষা নেওয়া হলেও শেষ ফলাফলের সঙ্গে তার। কোনো সম্পর্ক নেই, কাজেই সে-পরীক্ষাতে বিদ্যার্থীর কোনো আগ্রহ নেই। ক্লাসে অধ্যাপক ছাত্রদের কোনো প্রশ্নে টানলে, কোনো আলোচনায় তাকে যোগ দিতে বললে, সেটা তার বিরক্তির কারণ হয়। আবার ছাত্রেরা প্রশ্ন তুললে অনেক অধ্যাপকও তাতে বিরক্ত হন। আসলে আমরা নিজে চিন্তা করে একটা সমস্যার অবতারণা করতে, সেই সমস্যা নিয়ে ভাবতে ও ভাবাতে, অভ্যস্ত নই। চিন্তা করা ও জ্ঞানান্বেষণ নামক কার্যটি যে কি অনেক ছাত্রেরই সেটা জানা হয়ে ওঠে না। অনেকের যেন ধারণা যে কয়েক পাতার একটি সংক্ষিপ্ত নোট তৈরী করার নাম বুঝি জ্ঞানান্বেষণ, আবার কেউ কেউ ভাবেন যে কিছু শ্লোগান বা বাঁধা বুলি চেঁচানটাই মৌলিক চিন্তার নিদর্শন।
অতএব যা হবার তাই হয়; অর্থাৎ আমরা জ্ঞানস্পৃহ এবং সম্যক সমালোচনায় অভ্যস্ত। ছাত্র তৈরী করি না; বরং দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীর ব্যাখ্যা-পুস্তক পুঁজি করে শিক্ষার দরিদ্র মুদিখানা চালিয়ে যাই। মাঝে মাঝে এর ভিতর থেকেও দুয়েকটি উজ্জ্বল ছেলে বেরিয়ে আসে পৃথিবীর যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-ছেলে প্রশংসিত হবে। কিন্তু সেজন্য গৌরবের অধিকারী নয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। উপর দিককার দুয়েকটি ছেলে-কোনো অব্যবস্থাই যাদের প্রতিভাকে বিনষ্ট করতে পারে না–তাদের ছাড়িয়ে গেলেই শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ অজন্ম চোখে পড়ে তা দিয়েই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচার হবে।
আমরা শিক্ষকেরা যে এ-ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত এমন মনে হয় না। আমাদের শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা বার বার বেতন বৃদ্ধি দাবি করেছি। সে দাবি ন্যায্য। কিন্তু এর বাইরে আমরা কতটুকু করেছি? বেতন বাড়াবার আন্দোলনে আমরা যে উৎসাহ দেখিয়েছি শিক্ষা অথবা পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে তার এক-দশমাংশও কি কখনও দেখা গেছে? আমাদের সরল যুক্তিটা এই, বেতন না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানে ভাল লোক আসবেন না, কাজেই শিক্ষার মানের উন্নতি হবে না। কিন্তু এইটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাঁরা পড়াচ্ছেন তাঁরা অনেকেই কোনো একদিন কৃতী ছাত্রই ছিলেন। কিন্তু শিক্ষা-ব্যবস্থার গুণে তাঁদের জ্ঞান বদ্ধ-জলাশয়ের মত কিছুদিনের মধ্যে পচতে শুরু করে। আমরা ভালো লোক খানিকটা ভালো মাইনে দিয়ে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে পারি, কিন্তু তারপর তাঁদের অধঃপতন রোধ করবার জন্য কি করছি?
অধিকাংশ শিক্ষক দশ বছরের ভিতর নিজ নিজ বিষয়ে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের অনেকটা পিছনে পড়ে যান। দর্শন, গণিত, সমাজবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পিছিয়ে পড়াটা একবার শুরু হলে কারও একক চেষ্টায় সেটা রোধ করা অনেক সময় কঠিন। কিন্তু অধঃপতন বন্ধ করবার জন্য নানা উপায় আছে। একটি উপায় হল অধ্যাপকদের জন্য নিয়মিত পূজোর ছুটিতে অথবা গ্রীষ্মবকাশে শিক্ষা-শিবিরের ব্যবস্থা করা। শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান থেকে এ-বিষয়ে উৎসাহ নেই। অথচ শিক্ষকেরা নিজেদের ক্রমাগত শিক্ষিত করে না তুললে যে-জ্ঞান তাঁরা বিতরণ করবেন সেটা বিতরণের অযযাগ্য হয়ে উঠবে, এবং সেই অযোগ্য শিক্ষার নামে সমাজের কাছে বর্ধিত পারিশ্রমিক দাবি করতেও বিবেকবান শিক্ষকের একটা সংকোচ বোধ করা উচিত।
কিছুদিন আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিষ্ঠাবান অধ্যাপক বিভিন্ন কলেজের সম্বন্ধে একটি বিশেষ সাল ধরে (১৯৬২-৬৩) কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। সত্তরটি শিক্ষায়তন থেকে সংগৃহীত উত্তরে প্রকাশ যে, অধিকাংশ (দুই-তৃতীয়াংশ) কলেজে বছরে অর্ধেক দিন ক্লাস হয়নি। এই বার-মাসে-তের-পার্বণের দেশে খুচরো ছুটিগুলি যথাসম্ভব তুলে দেওয়া দরকার। এটা শুধু ছুটি কমাবার প্রশ্ন নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাৎসরিক একটা দীর্ঘ অবকাশের প্রয়োজন আছে; কিন্তু কাজের তালে আধুনিকতার স্পন্দন জাগাবার জন্য খুচরো ছুটি ছাটাই আবশ্যক। এই দাবি ছাত্র ও শিক্ষকদের ভিতর থেকে আসা উচিত।
শিক্ষা ব্যবস্থার কয়েকটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা উপরে বলেছি। যেমন পুরনো বিদ্যার বদ্ধ জলাশয়ে নতুন চিন্তা ও বিচারের স্রোত প্রবাহিত করার জন্য পড়াবার পদ্ধতি ও পরীক্ষার ব্যবস্থা এই দুয়েরই পরিবর্তন আবশ্যক। পরীক্ষা আরও ঘন ঘন না। হলে ছাত্রদের পরিশ্রমী ও জ্ঞানান্বেষণে সতর্ক করে তোলা যাবে না। কিন্তু এই সব সংস্কারের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ উদাসীন। সংস্কারের অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজনটা যাঁরা বোঝেন না প্রশাসনগত অসুবিধাগুলিই তাঁদের চিন্তায় পরিবর্তনের বিপক্ষে বিরাট যুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। একটি ছোট উদাহরণ দিচ্ছি। বি এ-র তুলনায় এম এ পরীক্ষার সংস্কার সাধন অপেক্ষাকৃত সহজ। বছরের শেষে একটি, দু বছরের শেষে আর একটি, এইভাবে দু’ভাগে পরীক্ষা নেওয়া এমন কিছু দুঃসাধ্য কাজ নয়। এই পরিবর্তনটুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকেরা নানা কারণে গ্রহণ করতে পারেননি। অর্থনীতি বিভাগ থেকে এর সপক্ষে অভিমত শোনা যায়। ঘরোয়া আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় কর্তাব্যক্তিকে আমি বলি যে, অন্তত অর্থনীতি বিভাগে পরীক্ষা ব্যবস্থার এই সংস্কারটুকু চালু করবার অনুমতি দেওয়া হোক। আমার সে আবেদন সমর্থন লাভ করেনি। যে-কোনো পরিবর্তনই সমস্ত বিভাগের একসঙ্গে গ্রহণ। অথবা বর্জন করতে হবে, প্রশাসনকর্তা এবং বর্তমান ব্যবস্থার সমর্থকদের কাছে এটা যেন। প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সত্য। এই মতৈক্যের বেড়া ডিঙিয়ে কোনো পরিবর্তন সাধনই দুষ্কর, এ কথাটা সংস্কারের প্রয়োজন যাঁরা বোঝেন তাঁদের কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার। আসলে আমরা মুখে যাই বলি-না কেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রয়োজনটাই আমাদের ভাবনায় তেমন। গভীরভাবে ঢোকেনি। তাই আমাদের কলহ ও দুশ্চিন্তা ছোট ব্যাপার নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে আর একটু শান্তি, কোসটা কোনো রকমে শেষ করবার ব্যবস্থা, আরও কয়েকটা নম্বর অবশেষে যোগ করে আরও কয়েকজনকে পাশ করিয়ে দেওয়া অথবা না-দেওয়া।
আমরা শিক্ষকেরা এ-কথাটা কবে মনেপ্রাণে উপলব্ধি করব যে, স্বাধীনতার পর গত বিশ বছরে আর কিছুতেই দেশের এত বড় ক্ষতি হয়নি যতটা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রটিতে আগামী বিশ বছরে আর কিছুতেই হয় তো এতটা উন্নতি সম্ভব নয় যতটা সম্ভব শিক্ষা ব্যবস্থার সুচিন্তিত, বলিষ্ঠ সংস্কারে; এবং শিক্ষার এই সংস্কারে শিক্ষকদেরও কিছু কর্তব্য আছে!
এদেশে সুস্থ ও প্রগতিশীল সমাজ গড়তে হলে একই সঙ্গে চাই প্রাথমিক ও কারিগরী শিক্ষার প্রসার এবং উচ্চশিক্ষার গুণগত উৎকর্ষ সাধন। এর একটিকে ছেড়ে অন্যটির প্রতি পক্ষপাত দেখানো ভুল। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ছাড়া দেশের জড়ত্ব ভাঙ্গবে না। আবার উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি ও গুণগত পরিবর্তন ছাড়া দেশের দিকভ্রষ্টতা ঘুচবে না, দেশের জাগ্রত-শক্তি খোকামি আর ক্ষ্যাপামিতে নিজেকে ক্লান্ত করবে, ভবিষ্যতকে করবে বিপন্ন।
পরিশেষে আর একটি কথা বলব। শিক্ষায়তনের ভিতর থেকেই শুধু শিক্ষার স্থায়ী উন্নতি সম্ভব। ব্রিটিশ আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতাকে বিশেষ মূল্য দিতে আমরা শিখেছিলাম কয়েকজন অসামান্য শিক্ষাব্রতীর নির্ভীক নেতৃত্বে। আজ কারও কারও মুখে শোনা যায়, যে-সরকার জনগণের প্রতিনিধি তার হস্তক্ষেপে দোষ নেই। এটা ভুল ধারণা। শিক্ষা ও রাজনীতির প্রকৃতি ভিন্ন। দলীয় রাজনীতির প্রয়োজনে শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শিক্ষার চরিত্র নষ্ট হয়। শিক্ষার প্রসার ও সংস্কারে সরকারী দাক্ষিণ্য আবশ্যক; কিন্তু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্রতীদের রাজনীতিক নির্দেশ ও অনুকম্পার উপর নির্ভরশীল করে তুললে তাতে শিক্ষার স্থায়ী ক্ষতিসাধনই সম্ভব। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কথা বলছি ১৯৬৮ সালে, এদেশে রাজনীতির এক সন্ধিক্ষণে।
গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)