চতুর্থ পাঠ
রেনকো দীর্ঘ সময় ধরে লিনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
ভোর হচ্ছে সে বলল, তার শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করে।
তখনো বাইরে অন্ধকার, কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মাঝে ভোর হবে।
ঠিক, লিনা বলল।
দুর্গের অস্পষ্ট আগুনের আলোয়, আমি রেনকর চেহারায় ভেসে ওঠা ভাবনাগুলো দেখতে পেলাম–আইডলটা বাঁচাতে তার মিশনের সাথে প্রয়োজনের সময় ভিলকাফোরের লোকদের সাহায্য করার ইচ্ছার ধন্ধ।
রেনকো দুর্গের ভেতরে তাকাল। বাসেরিও তীক্ষ্ণভাবে বলল সে।
আমি ঘুরে দেখলাম বাসেরিও দুর্গের এক অন্ধকার কোণায় মেঝের ওপর পা আড়াআড়ি করে বসে আছে, পিঠ সবসময়ের মতো ঘরের দিকে।
হা, ও, জ্ঞানী রাজপুত্র, ক্রিমিনালটা বলল, যা করছিল তা থেকে মুখ তুলে তাকাল না।
কতটুকু এগোতে পারলে?
প্রায় শেষ করে ফেলেছি।
রেনকো সেদিকে এগিয়ে গেল যেখানে ভণ্ড ক্রিমিনালটা বসে ছিল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
রেনকো তার পাশে পৌঁছাতে বাসেরিও ঘুরল, আর আমি তার পাশে মেঝেতে আইডলটা দেখলাম যেটাকে রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব। বাসেরিও তারপর মূল্য নির্ধারণের জন্য রেনকোকে কিছুর প্রস্তাব দিল।
যখন আমি দেখলাম এটা কি, আমি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
তারপর আমি দুইবার আমার চোখে পিটপিট করলাম আর আবার তাকালাম কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম এরা আমার সাথে চালাকি করছে।
কিন্তু তা নয়।
নিশ্চিতভাবেই না।
কারণ বাসেরিও-র হাতে, ঠিক আমার চোখের সামনে, রেনকোর আইডলটার ঠিক অবিকল একটা নকল আইডল।
অবশ্যই পুরো পরিকল্পনাটা করেছিল, শুরু থেকেই এটা সে গোপন করে রেখেছিল।
আমার মনে পড়ল আমাদের অভিযানের একদম প্রথমে কলকোর পাথুরে শহরে আমাদের সংক্ষিপ্ত বিরতির কথা, মনে পড়ল রেনকো তীক্ষ্ণ ধারবিশিষ্ট বস্তু দিয়ে একটা বস্তা ভরেছিল। আর আমার পরিষ্কার মনে আছে সে সময় ভাবছিলাম কেন আমরা পাথর সংগ্রহ করে আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছি।
কিন্তু এখন আমি বুঝলাম।
রেনকো বেশ কিছু পাথর সংগ্রহ করেছিল যেগুলোর অধিকাংশ ছিল অদ্ভুত কালো আর পার্পল পাথর যেগুলো খোদাই করে আইডলটা তৈরি করা হয়েছিল।
তারপর সে ঐ পাথরগুলো বাসেরিওকে দিয়েছিল আর আইডলটার একই রকম একটা নকল তৈরি করার জন্য তাকে নিযুক্ত করে যার সাহায্যে, সম্ভবত সে হার্নান্দোকে ধোকা দিবে।
অসাধারণ।
আমি আরো বুঝতে পারলাম আমাদের পুরো ভ্রমণের সময় বাসেরিও কি করছিল, সে সময়গুলোতে যখন সে আমাদের ক্যাম্পের একটা কোণায় গিয়ে আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে একটা ছোট আগুনের ওপর উবু হয়ে বসে থাকত।
সে আইডলটার নকল খোদাই করত।
আর সত্যিসত্যি, বলতেই হয়, এটা ছিল অসাধারণ একটা নকল। বিড়ালটার দাঁত খেচানো চোয়াল, ছুরির মতো দাঁত। এর পুরোটাই কালো আর পার্পল রঙের চকচকে পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে।
আর এক মুহূর্তের জন্য, আমি শুধু নকল মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম এবং ভাবলাম বাসেরিও কত বড় ক্রিমিনাল।
শেষ করতে তোমার কতক্ষণ লাগবে? রেনকো বাসেরিও-র কাছে জানতে চাইলো৷ রেনকো বলা মাত্র, আমি খেয়াল করলাম নকলটার এখনো ফিনিশিং টাচ বাকি, বিড়ালটার চোয়ালের চারপাশে।
বেশি সময় লাগবে না, ক্রিমিনালটা উত্তর দিল। ভোরের মধ্যে এটা শেষ হয়ে যাবে।
তুমি এর অর্ধেক সময় পাবে রেনকো বলল, বাসেরিও-র দিকে পেছন ফিরল আর তার পেছনে দুর্গে জড়ো হওয়া জীবিতদের দলটার দিকে তাকাল।
এটা তাকে তেমন কোনো আশা দিতে পারল না।
তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভিলকাফোর, বৃদ্ধ এবং ব্যর্থ আর দুর্বল, আর সাতজন ইনকা যোদ্ধা, যারা সৌভাগক্রমে প্রথম আক্রমণের সময় ভেতরে ছিল। সাতজন যোদ্ধার সাথে, রেনকো ভয়ার্ত চেহারার মাত্র কয়েকজন বৃদ্ধ, মহিলা আর শিশু দেখতে পেল।
রেনকো আমি ফিসফিস করে বললাম। আমরা কি করব?
আমার সাহসী সঙ্গী তার ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল। তারপর সে এভাবে বলল। আমরা সব দুঃখ-কষ্টের ইতি টানতে যাচ্ছি। একবারে এবং সবার জন্য।
এবং এর সাথে, যখন বাসেরিও উত্তেজিতভাবে তার আইডলের নকল তৈরির কাজ শেষ করতে থাকল, রেনকো ভিলকাফোরের জীবিত সদস্যদের সংগঠিত করা শুরু করল।
এখন শোন, সকলে ওর চারপাশে জড় হয়ে পরে বলল, সোনা-খেকোরা সূর্যোদয়ের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে। আমার হিসেব অনুযায়ী, তাদের আগমনের আগে প্রস্তুতির জন্য আমাদের দুই ঘণ্টারও কম সময় হাতে আছে।
মহিলা, বাচ্চা আর বৃদ্ধরা, তোমরা আমার বোনের দেখানো গুপ্তপথ ধরে গ্রাম থেকে যতদূর সম্ভব চলে যাবে।
যোদ্ধারা, গ্রামের বেঁচে থাকা সাতজন যোদ্ধার দিকে ফিরে সে বলল। তোমরা আমার সাথে আসবে মনাস্ট্রিতে ভিলকাফোর যার কথা উল্লেখ করেছেন। যদি এ রাপাগুলো ঐ দালান থেকে আসে, তাহলে আমাদের শুধু তাদের এর ভেতরে আটকে ফেলতে হবে। আমরা এদের ভেজা আইডলের প্রলোভন দেখিয়ে মনাস্ট্রিতে ঢুকাব আর তারপর আমরা এদের ভেতরে আটকে ফেলব। এখন যাও যেটুকু সম্ভব অস্ত্র জড়ো করো।
যোদ্ধারা দ্রুত চলে গেল।
লিনা, রেনকো বলল।
হ্যাঁ, ভাই? সুন্দরী বোন তার পাশে হাজির হল। হাজির হয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, চোখদুটি চকচক করছিল।
আমি সবচেয়ে বড় ব্লোডারটা চাই, রেনকো বলল। বৃষ্টির পানি দিয়ে ভরে ফেল।
হয়ে যাবে, লিনা বলল, দ্রুত চলে গেল।
হার্নান্দোর কি হবে? আমি রেনকোর কাছে জানতে চাইলাম। কি হবে যদি আমরা রাপারদের তাদের খোয়াড়ে ফেরত পাঠাবার সময় সে হাজির হয়?
রেনকো বলল, যদি আমার বোন যেমন বলেছে, সে চানকা ট্র্যাকারদের সাথে আমাদের অনুসরণ করে, তাহলে এখানে পৌঁছামাত্র সে জানতে পারবে আমরা কোন দিকে গিয়েছি। বিশ্বাস কর, অ্যালবার্তো, আমি একথা ভেবেছি। যখন সে আমাকে খুঁজে পাবে, তখন আমার সাথে একটা আইডলও থাকবে… আর আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি তাকে আইডলটা দিয়ে দেব।
হার্নান্দো একটা ঠাণ্ডা, নির্মম লোক, রেনকো, আমি বললাম অসৎ আর ঠুর। তুমি তার কাছ থেকে সম্মান আশা করতে পার না। তুমি একবার তাকে আইডলটা দিয়ে দিলে, সে নিশ্চিত ভাবে তোমাকে হত্যা করবে।
আমি জানি।
কিন্তু তাহলে কেন
বন্ধু, কোনটা বৃহত্তর স্বার্থ? রেনকো কোমলভাবে বলল। তার চেহারা আর গলা শান্ত। আমি বেঁচে থাকি আর হার্নান্দো আমার স্বজাতির আইডল পেয়ে যাক? নাকি আমি মারা যাই আর সে একটা মূল্যহীন আইডল পাক?
আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। ব্যক্তিগতভাবে, আমি হয়তো বেঁচে যাব, কিন্তু আমার ভয় আমার জীবনের চেয়ে এখানে জীবন আরো বেশি বিপন্ন।
ভিলকাফোরের লোকজন আসন্ন বিপদের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতেই দুৰ্গটা একটা সক্রিয় মৌচাকে পরিণত হল।
শহরের যোদ্ধাদের আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দেবার জন্য রেনকো নিজে গেল। ও চলে যাওয়ার পর আমি এ সুযোগে অল্প সময়ের জন্য বাসেরিওর নকল আইডল নিয়ে কাজ করা দেখলাম। সত্যি বলছি, আর ঈশ্বর এজন্য আমাকে ক্ষমা করো, আমার তার সাথে কথা বলার অন্য উদ্দেশ ছিল।
বাসেরিও, আমি দ্বিধাগ্রস্তভাবে ফিসফিস করলাম, লিনার কী লিনার কী স্বামী আছে?
বাসেরিও শয়তানি হাসি হাসল। কেন, সন্ন্যাসী বুড়ো বদমাশ… জোর গলায় বলল ও।
আমি ফ্যাসফ্যাসে গলায় তাকে অনুরোধ করলাম জোরে কথা না বলার জন্য। বাসেরিও, এরকম দুবৃত্তের কাছ থেকে সবাই যে রকম অশা করে, বেশ আনন্দিত হল।
একসময় তার স্বামী ছিল, বলল সে। কিন্তু অনেক আগেই তাদের বিয়ে শেষ হয়ে গেছে, সোনা-খেকোদের আসার আগেই লিনার স্বামীর নাম ছিল হুয়ার্কা আর সে ছিল প্রতিভাধর তরুণ যোদ্ধা, আর তাদের বিয়ে, একটা পারিবারিক বিয়ে যে রকম হতে পারে, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ছিল দেখতে। খুব কম লোকই জানত, হুয়ার্কা খুব রাগী ছিল। তাদের ছেলের জন্মের পর, হুয়ার্কা লিনাকে জানোয়ারের মতো প্রহার করত। সবাই বলে লিনা মার সহ্য করত শুধু বাবার হিংস্রতা থেকে মানিকে রক্ষার জন্য। আপাতভাবে সে এই লক্ষ্যে সফল হয়। হুয়ার্কা একবারও ছেলেটার গায়ে হাত তোলেনি।
কেন সে তাকে ছেড়ে দেয়নি? আমি জানতে চাইলাম। সর্বোপরি, সে তোমাদের রাজকন্যা-~
হুয়ার্কা তাকে হুমকি দেয় যদি সে কাউকে প্রহারের কথা বলে তাহলে সে ছেলেকে হত্যা করবে।
হে ঈশ্বর, আমি ভাবলাম।
তো তারপর কি হল? আমি জানতে চাইলাম।
সত্যিকারভাবে, পুরোটা দুর্ঘনাক্রমে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, বাসেরিও বলল, একদিন রেনকো অপ্রত্যাশিতভাবে লিনার সাথে দেখা করতে যায়, গিয়ে শুধু দেখল সে তার ঘরের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, তার কোলে তার বাচ্চাকে দোল খাওয়াচ্ছে। চোখে পানি আর তার চেহারা রক্তাক্ত আর কালশিটে পড়া।
হুয়ার্কাকে তৎক্ষণাৎ বন্দী করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আমার বিশ্বাস তাকে শেষপর্যন্ত একজোড়া ক্ষুধার্ত বনবিড়ালের সাথে একটা গর্তে ফেলে দেয়া হয়। ওই বিড়ালগুলো তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। বাসেরিও তার মাথা নাড়ল। সন্ন্যাসী যে তার স্ত্রীকে মারে সে নিচু পর্যায়ের কাপুরুষ, সবচেয়ে নিচু পর্যায়ের। আমার ধারণা হুয়ার্কার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।
আমি বাসেরিওকে তার কাজে ছেড়ে এলাম এবং আসন্ন মিশনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে দুর্গের এক কোণায় গেলাম।
কিছুক্ষণ পর, রেনকো একই কাজের জন্য আমার সাথে যোগ দিল। সে তখনো স্প্যানিশ পোশাক পরিহিত ছিল যা সে অনেক সপ্তাহ আগে বন্দী জাহাজ থেকে পালানোর সময় চুরি করেছিল, বাদামী চামড়ার জামা, সাদা পায়জামা, হাঁটু পর্যন্ত উঁচু চামড়ার জুতা। অতিরিক্ত পোশাক সম্পর্কে একবার সে আমাকে বলেছিল, রেইনফরেস্টের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ যাবার সময় তার কাছে এগুলো মূল্য অনেক।
কাঁধের ওপর একটা তৃণ রাখল, তারপর কোমরে তলোয়ারের বেল্ট পরা শুরু করল।
রেনকো? আমি বললাম।
হ্যাঁ।
বাসেরিও কেন কারাগারে ছিল?
আহ, বাসেরিও…দুঃখের সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আমি তার ব্যাখ্যার জন্যে অপেক্ষা করলাম।
বিশ্বাস কর বা না কর, বাসেরিও একসময় একজন যুবরাজ ছিল, রেনকো বলল। একজন শ্রদ্ধেয় তরুণ যুবরাজ, অবশ্য, তার বাবা রাজকীয়, স্থপতির চেয়ে কম ছিলেন না। পাথরের একজন অসাধারণ স্থপতি, এবং সাম্রাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় প্রকৌশলী। বাসেরিও ছিল তার ছেলে আর অনুগ্রহভাজন। সেও দ্রুত একজন চমৎকার স্থপতি হয়ে ওঠে। কারণ, ষোল বছরের মধ্যে জ্ঞান এবং দক্ষতায় তার বাবাকে ছাপিয়ে গেল, তার বাবা রাজকীয় স্থপতি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি সাপা ইনকাদের দুর্গ তৈরি করেছিল।
কিন্তু বাসেরিও ছিল বেপরোয়া। সে ছিল অসাধারণ একজন খেলোয়াড়, তীরন্দাজ হিসেবে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। কিন্তু তার বংশের অনেকের মতো, সে মদ্যপান এবং জুয়া আর কুজকোর তরুণীদের সাথে আমোদ-প্রমোদে আসক্ত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মেয়েদের সাথে তার সাফল্য জুয়ায় প্রতিফলিত হয়নি। সেতার চেয়ে কম খ্যাতিসম্পন্নদের কাছে অনেক ঋণ জমা করে ফেলে। যখন, পরিশোধের জন্য পাওনা অনেক বেশি হয়ে গেল, ওসব দুবৃত্তরা ঠিক করল বাসেরিও এটা অন্যভাবে শোধ করবে–তার অসাধারণ সেবা দিয়ে।
কিভাবে?
তার অসাধারণ ক্ষমতা দক্ষতা ব্যবহার করে বিখ্যাত আইডল আর অমূল্য সম্পদ জালিয়াতি করার মাধ্যমে সে তার ঋণ পরিশোধ করে। পান্না বা স্বর্ণ, রূপা বা জেইড, বস্তুটা। যাই হোক না কেন, বাসেরিও সবচেয়ে জটিল বস্তুতে নকশা করতে পারত।
একবার সে একটা বিখ্যাত আইডলের নকল তৈরি করে। তার দুরভিসন্ধিপূর্ণ সহকর্মীরা আসল আইডলের মালিকের বাড়িতে চুরি করে ঢুকে আর আসলটার জায়গায় নকলটা রেখে আসে।
তারা প্রায় এক বছর ধরে এ কাজ করে এবং অপরাধীরা এ থেকে প্রচুর লাভ করে, কিন্তু একদিন, বাসেরিও এর বন্ধুরা সাপা ইনকার কাজিনের বাড়িতে ধরা পড়ে। আসল আইডলের স্থলে নকল আইডল প্রতিস্থাপন করার সময় ধরা পড়ে।
একাজে বাসেরিও-এর ভূমিকা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তাকে কারাগারে পাঠানো হয় আর তার পুরো পরিবারকে অপমান করা হয়। তার বাবাকে রাজকীয় স্থপতির পদ হতে সরিয়ে দেয়া হয় এবং তার উপাধি কেড়ে নেয়া হয়। আমার ভাই, সাপা ইনকা, ঘোষণা করল বাসেরিও এক পরিবারকে রাজকীয় আবাস থেকে কুজকোর একটা নিচু বস্তিতে চলে যেতে হবে।
আমি নীরবে সব শুনলাম।
রেনকো বলতে থাকল, আমি ভেবেছিলাম শাস্তিটা বেশি কঠিন হয়ে গিয়েছিল এবং আমার ভাইকে তা বলেছিলাম। কিন্তু বাসেরিওকে দিয়ে সে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিল, সে আমার আবেদন উপেক্ষা করে।
রেনকো দুর্গের কোনায় কাজ করতে থাকা বাসেরিও-এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
বাসেরিও একসময় একজন সম্ভ্রান্ত তরুণ ছিল। অবশ্যই দোষী, কিন্তু সম্ভ্রান্ত। এ কারণে যখন করিকাঞ্চা থেকে আইডল উদ্ধারের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার উদ্দেশ পূরণের জন্য তার মেধাকে ব্যবহার করব। আমি কারণ দেখালাম যদি কুজকোর দুবৃত্তগুলো তার দক্ষতা ব্যবহার করে নিজেদের ঠিক করতে পারে। তাহলে আমার লোকদের মনোবল উদ্ধারের অভিযানে, আমি নিশ্চিতভাবেই পারব।
অবশেষে বাসেরিও তার নকল আইডল তৈরি শেষ করল।
যখন কাজ শেষ হল, যে নকল আইডল, আসলটার সাথে একত্রে রেনকোর কাছে নিয়ে এলো।
রেনকো দুটো আইডলই তার সামলে তুলে ধরল। আমি তার কাঁধের ওপর দিয়ে ওগুলোর দিকে তাকালাম, সত্যি বলছি বাসেরিওর দক্ষতা এত ভালো ছিল যে আমি বুঝতে পারলাম না কোনটা আসল আর কোনটা নকল।
বাসেরিও তার দুর্গের কোণায় ফিরে গেল এবং তার জিনিসগুলো একত্রিত করা শুরু করল, তার তলোয়ার তৃণ, ধনুক।
তুমি কোথায় যাচ্ছ? তাকে দাঁড়াতে দেখে রেনকো জানতে চাইল।
আমি চলে যাচ্ছি। বাসেরিও সরলভাবে বলল।
কিন্তু তোমার সাহায্য দরকার, রেনকো বলল। ভিলকাফোর বলেছেন টেম্পলের প্রবেশদ্বার থেকে তার লোকদের একটা বড় পাথর সরাতে হয়েছিল আর এরজন্য দশজন লোকের দরকার হয়েছিল। আমাকে ওটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে অনেক লোকের প্রয়োজন। আমার তোমার সাহায্য দরকারি।
আমার ধারণা তোমার উদ্দেশ্য পূরণে আমি আমার অংশের চেয়েও বেশি করেছি। যুবরাজ, বাসেরিও বলল। কুজকো থেকে পালানো, পাহাড়-পর্বত পার হওয়া, বিপজ্জনক জঙ্গলের মাঝ দিয়ে অন্ধভাবে যাওয়া। আর তোমার জন্য, একটা নকল আইডল তৈরি করা। না, আমি আমার কাজ করেছি। আর এখন আমি চলে যাচ্ছি।
তোমার লোকদের প্রতি কোন আনুগত্য নেই?
আমার লোকেরা আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল, রেনকো, বাসেরিও দ্রুত কর্কশগলায় জবাব দিল। তারপর তারা আমার অপরাধের জন্য আমার পরিবারকে শাস্তি দিয়েছিল। তাদের নোংরা কঠিন কুজকোর আবাসে বাস করার জন্য বের করে দিয়েছিল। ঐ বস্তিতে আমার বোন নিপীড়নের শিকার হয়, আমার বাবা আর মাকে প্রহার করা হয় আর ডাকাতি করা হয়। ডাকাতরা আমার বাবার আঙ্গুলগুলো ভেঙ্গে ফেলে, যাতে তিনি আর পাথর খোদাই করতে না পারেন। তাকে ভিক্ষা করতে হয়, তার পরিবারের জন্য। আমার নিজের শাস্তি নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কোনো আপত্তিই নেই। সমাজের প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই, যা শুধু আমার অপরাধে আমার পরিবারকে শাস্তি দিয়েছিল।
আমার দুঃখিত, রেনকো হালকা গলায় বলল। আমি এ ঘটনাগুলো জানতাম না। কিন্তু প্লীজ, বাসেরিও, আইডলটা, লোকদের মনোবল।
এটা তোমার অভিযান, রেনকো। আমার নয়। আমি তোমার জন্য যথেষ্ট করেছি। যথেষ্টর চেয়েও বেশি। আমার ধারণা আমি আমার মুক্তি অর্জন করেছি। তুমি তোমার পথ দেখ আর আমাকে আমার পথ দেখতে দাও।
এ কঠিন কথাগুলো বলে, বাসেরিও তার ধনুক কাঁধে তুলে নিয়ে কোয়েঙ্কোতে নামল আর অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রেনকো তাকে থামানোর চেষ্টা করল না। সে শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকল এবং চেহারায় দুঃখের ছাপ দেখা গেল।
আমরা বাকিরা রাপাগুলোর সাথে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত। শুধু একটা শেষ স্পর্শ বাকি।
আমি বানরের মূত্রের থলিটা তুলে নিলাম। যা দন্তহীন বৃদ্ধ লোকটা আমাকে আগেই দিয়েছিল, ছিপি খুললাম।
সাথে সাথে, একটা তীব্র বিশ্রী গন্ধ আমার নাক দিয়ে ঢুকল। আমার শরীরের ওপর এ দুর্গন্ধযুক্ত তরল ঢালার ভাবনায় আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেল আর শিউরে ওঠলাম।
কিন্তু তারপরও আমি করলাম। আর ওহ, কি পচা! কোন সন্দেহ নেই রাপারা এটা ঘৃণা করবে।
আমার অস্বস্তি দেখে রেনকো মুচকি হাসল। তারপর সে ছোট থলিটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিজেকে দুগন্ধময় হলুদ তরলে ভেজানো শুরু করল। থলিটা অন্য যোদ্ধাদের কাছে দেয়া হল যারা ঝুঁকি নিয়ে পর্বতে ওঠবে, তারাও নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত তরলে নিজেদের ভেজানো শুরু করল।
সবার প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষ, লিনা একটা বড় প্রাণীর থলি নিয়ে এলো, একটা লামার থলি, আমার ধারণা, এটাও তরলে পূর্ণ।
তুমি চেয়েছিলে বৃষ্টির পানি। রেনকোকে বলল।
ভালো, তার কাছ থেকে নামার থলিটা নিয়ে বলল সে। তাহলে আমরা যাবার জন্য প্রস্তুত।
.
রেনকো লামার থলি থেকে খানিকটা পানি আনল আইডলটার ওপর ঢালল।
এটা তৎক্ষণাৎ গুঞ্জন তুলল, সুরেলা গান গেয়ে ওঠল।
দুর্গের ভেতরটা খালি। ইতোমধ্যে লিনা মহিলা, বাচ্চা আর বৃদ্ধদের নিচে কোয়েঙ্কোতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর গোলকধাঁধার সুড়ঙ্গে তাদের যাত্রা করার জন্য যে যাত্রার শেষে তারা মালভূমির প্রান্তে জলপ্রপাতটার কাছে পৌঁছাবে। লিনা নিজে দুর্গের পেছনে রয়ে গিয়েছে। আমাদের পেছনে পাথরের দরজা বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত।
ঠিক আছে, রেনকো বলল, পাথর দরজার দায়িত্বে থাকা একজোড়া ইনকা যোদ্ধার উদ্দেশে মাথা নাড়ল। এখন।
সেই মুহূর্তে, ইনকা যোদ্ধা দুজন বড় পাথরটাকে একপাশে গড়িয়ে দিল। বাইরের অন্ধকার রাত প্রকাশিত হল।
রাপাগুলো ঠিক সেখানে।
আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
দুর্গের পাথরের দরজার ঠিক বাইরে একটা বড় বৃত্তে জমা হয়েছে।
আমি ওগুলোর সংখ্যা শুনলাম, বারোটা বিশাল কালো বিড়াল, প্রতিটার হলুদ দানবীয় চোখ, উঁচু তীক্ষ্ণ কান এবং শক্তিশালী পেশীবহুল কাঁধ।
রেনকো তার সামনে আইডলটা ধরে রাখল আর রাপাগুলো স্তম্ভিত হয়ে এর দিকে তাকিয়ে থাকল।
আইডলটা আকস্মিকভাবে, গান থামিয়ে দিল আর সাথে সাথে, রাপাগুলো সম্মোহন ভেঙে বেরিয়ে এলো আর একটা মৃদু গর্জন শুরু করল।
রেনকো দ্রুত লামার থলি থেকে আইডলটাকে আরো পানি দ্বারা ভেজালো আর আইডলটার গান আবার শুরু হল আর রাপাগুলো আবার সম্মোহিত হয়ে পড়ল।
আমার হৃদস্পন্দন আবার শুরু হল।
হাতে আইডলটা নিয়ে সাতজন ইনকা যোদ্ধা আর আমাকে পেছনে নিয়ে, রেনকো দুর্গের দরজা দিয়ে বাইরের ঠাণ্ডা রাতের বাতাসে বেরোল।
অবশেষে বৃষ্টি নামল আর মেঘ সরে পূর্ণিমার চাঁদ আর অসংখ্য তারার রাত বেরিয়ে এলো। জ্বলন্ত মশালগুলো আমাদের মাথার ওপরে ধরে রেখে, আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে নদী বরাবর চলে যাওয়া একটা সরু পথের দিকে এগোলাম।
রাপাগুলো আমাদের চারপাশে, ধীর, সতর্ক পদক্ষেপে চলছে, শরীর মার্টির কাছে নামান, যখন তাদের চোখগুলো রেনকোর হাতের গান গাওয়া আইডলের দিকে নিবদ্ধ।
আমার ভয় ছিল সীমাহীন। না, বলা উচিত আমি জীবনে এর চেয়ে বেশি ভয় পাইনি।
এরকম বিশাল, বিপজ্জনক প্রাণী দ্বারা ঘেরা, প্রাণীগুলো দয়া-মায়াহীন, কোন দ্বিধা ছাড়া হত্যা করে।
ওগুলো ছিল অনেক বড়। আমাদের মশালের মিটমিটে আলোয় ওগুলোর কাঁধের মাংসপেশীতে কমলা ঢেউ তুলল। শ্বাস ফেলার শব্দ ছিল জোরালো, অনেকটা ঘোড়ার মতো।
নদীর পাশের পথ দিয়ে যাবার সময়, আমি আমার পেছনে তাকালাম, লিনাকে দেখলাম গ্রামের প্রান্তে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের দেখছে।
কয়েক মুহূর্তে পর, সে অদৃশ্য হয়ে গেল, আমার কল্পনা, দুর্গে ফিরে গেল তার দায়িত্ব পালনের জন্য। রহস্যময় টেম্পলের পথে আমাদের যাত্রা থেমে থাকল না।
পথ ধরে আমরা নয়জন চলতে চলছি–রেনকো, আমি আর সাতজন ইনকা যোদ্ধারাপাদের দল দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায়।
আমরা পর্বতের পাশে চলে এলাম। পাহাড়ের ভেতর ঢুকে যাওয়া একটা সংকীর্ণ পথের কাছে। ইনকা যোদ্ধাদের একজন রেনকোকে বলল টেম্পলটা এ পথের অন্য প্রান্তে।
রেনকো আবারো আইডলটাকে ভেজালো। এটা জোরে বাজনা বেজে ওঠল, ভোরের বাতাসে এর তীক্ষ্ণ স্বর ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সরু পথটাতে ঢুকে পড়ল। বিড়ালগুলো কাছ থেকে তাকে অনুসরণ করল, স্কুল শিক্ষককে যেভাবে বাচ্চারা অনুসরণ করে।
সরু পথ ধরে মশালের আলোয় এগিয়ে যাবার সময়, ইনকা যোদ্ধাদের একজন বোকামি করে তার বর্শার মাথা দিয়ে একটা রাপাকে খোঁচা দেবার চেষ্টা করল— কিন্তু যখন তার অস্ত্র দিয়ে খোঁচা দিবে, রাপাটা তার দিকে ঘুরল আর হিংস্রভাবে দাঁত খেচানো, তাকে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দিল। বড় বিড়ালটা তারপর সামনে ঘুরল আর আইডলটাকে অনুসরণ করে চলল।
যোদ্ধাটা তার একজন সঙ্গীর সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল। রাপাগুলোকে হয়তো ঢুকান যাবে, কিন্তু ওগুলো পুরোপুরি প্রতিরোধহীন নয়।
আমরা সরু পথ থেকে একটা প্রশস্ত গোলাকার গিরিখাদে বেরিয়ে এলাম। সর্দার ভিলকাফোর যেমন বলেছিলেন, একটা অবিশ্বাস্য পাথুরে আঙ্গুল এর মাঝখান থেকে, ঘাড়া অনেক উচুঁতে রাতের আকাশে উঠে গিয়েছে।
আমাদের বামে গিরিখাদের দেয়ালে একটা পথ কাটা হয়েছে। ভিলকাফোর তার লোকদের দিয়ে পালানোর যে পথ তৈরি করেছিলেন। এটা বেলনাকার গিরিপথের পরিধি ধরে পেঁচিয়ে ওঠে গেছে। ওপরে আর পাথরের আঙ্গুলটার চারপাশে ওটাকে মাঝখানে রেখে।
রেনকো পথটায় ওঠল, ধীরে ধীরে ওপরে ওঠল। বিড়ালগুলো তাকে অনুসরণ করল। ইনকা যযাদ্ধারা আর আমি ধীরে ধীরে তাদের পেছনে হাঁটলাম।
ওপরে, আরো ওপরে আমরা ওঠলাম। পথটার স্থির বাঁক ধরে ঘুরলাম আর ঘুরলাম।
অবশেষে আমরা গিরিখাদের ওপর বিস্তৃত একটা দড়ির সেতুর কাছে এলাম, যা বাইরের পথটাকে পাথরের আঙ্গুলের সাথে যুক্ত করেছে।
আমি আমার ওল্টোদিকে গিরিখাদের ওপারের পাথরের টাওয়ারটার দিকে তাকালাম।
টাওয়ারটার চুড়ায় কিন্তু ছোট ছোট পাতাগাছে ঘেরা অবস্থায় আমি একটা অসাধারণ স্টেপ পিরামিড দেখলাম। অনেকটা অ্যাজটাকদের এলাকায় যেগুলো দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোর মতো। বাক্স আকৃতির একটা তাবু মনোরম ত্রিভুজাকৃতির পিরামিডটার ওপর স্থাপন করা হয়েছে।
রেনকো প্রথমে সেতুটা পার হল। বিড়ালগুলো তাকে অনুসরণ করল, একটার পর একটা। তারপর গেল যযাদ্ধারা। আমি সবার শেষে পার হলাম।
সেতুটা পার হবার পর আমি প্রশস্ত পাথরের ওপর দিয়ে ওঠতে থাকলাম যেগুলো একটা পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। পরিষ্কার জায়গায় মাথার টেম্পলের প্রবেশদ্বার।
প্রশস্ত আর অন্ধকার, বর্গাকৃতির এরা ভয়ঙ্কর, এমনভাবে হাঁ করে রয়েছে যে পুরো দুনিয়াকে ভয় দেখাচ্ছে।
হাতে ভেজা আইডল নিয়ে, রেনকো তোরণের দিকে এগোল। যোদ্ধারা, সে দৃঢ়ভাবে বলল, পাথরটার দায়িত্ব নাও।
সাতজন যোদ্ধা আর আমি দ্রুত পাথরটার দিকে গেলাম যেটা মন্দিরের হা করা মুখের পাশে ছিল।
রেনকো তোরণের মুখে দাঁড়ালো, মূর্তিটাকে পানি নিয়ে ভেজালো, টেম্পলের হাঁ করা সুরেলা গান শুরু হল।
বিড়ালগুলো তার সামনে দাঁড়িয়ে, আইডলটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সম্মোহিত।
রেনকো টেম্পলের ভেতর এক পা এগোল।
বিড়ালগুলো তাকে অনুসরণ করল।
রেনকো আরেক ধাপ নামল আর প্রথম বিড়ালটা তার পিছু নিয়ে ভেতরে গেল।
আরেক ধাপ।
দ্বিতীয় বিড়াল, তারপর তৃতীয়, তারপর চতুর্থ।
এক পর্যায়ে রেনকো লামার থলিতে থাকা অবশিষ্ট পানিটুকু আইডলটার ওপর ঢেলে দিল, আর তারপর, নিজের লোকদের অবস্থানের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে, ওটাকে টেম্পলের অন্ধকার গভীরতার দিকে ছুঁড়ে দিল।
বিড়ালগুলো এর পিছু নিয়ে টেম্পলের ভেতরে লাফ করল। বারোটা বিড়ালের সবগুলো।
তাড়াতাড়ি পাথরটা। ওটাকে টেম্পলের প্রবেশদ্বার থেকে বেরিয়ে এসে, রেনকো চিৎকার করল। ওটাকে তোরণের মুখে নিয়ে এসো।
আমরা এক হয়ে ধাক্কা দিলাম।
ধাক্কায় পাথরটা গড়ানো শুরু করল।
আমি আমার পুরো শক্তি দিয়ে এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। রেনকো আমার পাশে এলো, সেও ঠেলতে থাকল।
পাথরটা ধীরে ধীরে তোরণে ফিরে যেতে লাগল। আর মাত্র কয়েক পদক্ষেপ।
প্রায় হয়ে গেছে…।
আর মাত্র দুই ধাপ…
রেনকো, হঠাৎ কাছাকাছি থেকে একটা কণ্ঠ বলে ওঠল।
একজন মহিলার কণ্ঠস্বর।
রেনকো আর আমি একসাথে ঘুরলাম।
লিনাকে পরিষ্কার জায়গাটার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।
লিনা? রেনকো বলল। তুমি এখানে কি করছ? আমার ধারণা আমি তোমাকে বলেছিলাম
সেই মুহূর্তে, লিনাকে ধাক্কা দিয়ে মার্টিতে ফেলে দেয়া হল, আর হঠাৎ আমি তার পেছনে পাথরের ধাপগুলোর ওপর একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, আর ঐ একক, একমাত্র মুহূর্তে আমার শিরার প্রতি আউন্স রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল।
আমি হার্নান্দো পিজারোর দিকে তাকিয়ে আছি।
.
লিনার পেছনের নিচু ঝোঁপঝাড় হতে প্রায় বিশজন কনক্যইস্টাডোর বেরিয়ে এলো আর পরিষ্কার জায়গাটার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, তাদের মাসকিটগুলো আমাদের চেহারার দিকে তাক করা। তাদের মশালের আলো পুরো জায়গাটা আলোকিত করেছে।
ওদের সাথে তিনজন স্থানীয় যাদের প্রত্যেকের গালের হাড় বেরিয়ে এসেছে। চানকা। ভিলকাফোরের দিকে আমাদের পথ অনুসরণ করার জন্য হার্নান্দোর নিয়োজিত চানকা ট্র্যাকার।
সবার শেষে না, সবার চেয়ে অশুভভাবে, আরেকটা লোক এলো। সে অন্যদের চেয়ে লম্বা, বড়, তার কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়া অনুজ্জ্বল কালো চুলের গোছা। তারও বাম গালের হাড় বেরিয়ে এসেছে।
ক্যাস্টিন, নিষ্ঠুর চানকা, যে আমাদের অভিযানের শুরুতে রেনকোর সাথে একই বন্দী জাহাজে ছিল, যে রেনকোকে বলতে শুনেছে আইডলটা আছে কুজকোর করিকাঞ্চায়।
আমার আর সাতজন ইনকা যোদ্ধার চারপাশে একটা বড় বৃত্ত তৈরি করল ইনকুইস্টাভোয়া।
আমার নজরে এলো ওরা দেখতে কত নোংরা। স্প্যানিশ সৈনিকরা কাদা আর হতাশায় আচ্ছন্ন। আর তাদের ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে, অসম্ভব রকম ক্লান্ত।
বুঝতে পারলাম—হার্নান্দোর একশ লোকের শক্তিশালী সৈন্যদলের মাত্র এত টুকুই অবশিষ্ট আছে। পর্বত আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তাদের যাত্রায়, হার্নান্দোর লোকেরা তার চারপাশে মারা গেছে। অসুখে, ক্ষুধায়, অথবা শুধু পরিশ্রমে।
সৈন্যদলের শুধু এটুকুই অবিশিষ্ট আছে। বিশজন।
হার্নান্দো এগিয়ে এলো। লিনাকে টেনে তার পায়ে দাঁড় করাল। তাকে পেছনে টানতে টানতে সে টেম্পলের দিকে এগোল আর রেনকোর সামনে দাঁড়াল, তার দিকে কতৃত্বের সাথে তাকিয়ে থাকল। হার্নান্দো রেনকোর চেয়ে এক মাথা লম্বা আর পাশে দ্বিগুণ। ধাক্কা দিয়ে লিনাকে রেনকোর দিকে এগিয়ে দিল।
আমি ভয়ে ভয়ে, টেম্পলের তোরণের দিকে তাকালাম।
এখনো একটু খোলা, পাথর আর পাথরের দরজার ফাঁকটা একটা রাপার বেরিয়ে আসার পক্ষে যথেষ্ট।
ভালো লক্ষণ নয়।
আইডলটার পানি শেষ হয়ে গেলে, এর গুঞ্জন থেমে যাবে, আর রাপাগুলোর সম্মোহন কেটে যাবে আর
অবশেষে আমাদের সাক্ষাত হল, হার্নান্দো রেনকোকে স্প্যানিশ ভাষায় বলল। তুমি আমাকে অনেক দূর পর্যন্ত কৌশলে ফাঁকি দিয়েছ, তরুণ যুবরাজ। তুমি ধীরে ধীরে মরবে।
রেনকো কিছু বলল না।
আর তুমি সন্ন্যাসী, হার্নান্দো আমার দিকে ঘুরে বলল। তুমি তোমার দেশ আর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকা। তোমার মৃত্যু তার চেয়েও ধীরে হবে।
আমি ভয়টা গিলে ফেললাম।
হার্নান্দো আবার রেনকোর দিকে ঘুরল। আইডল। ওটা আমাকে দাও।
রেনকো পিছিয়ে গেল না। ধীরে ধীরে তার বেল্টের থলে থেকে নকল আইডলটা বের করল।
ওটা দেখে হার্নান্দোর চোখ চকচক করে ওঠল। আমি ভালোভাবে না জানলে, আমি শপথ করে বলতাম তার লালা ঝরছিল।
ওটা আমাকে দাও বলল সে।
রেনকো সামনে এগিয়ে এলো।
হাঁটুমুড়ে বস।
ধীরে ধীরে, অপমান সত্ত্বেও, রেনকো হাঁটু গেড়ে বসল আর দাঁড়িয়ে থাকা হার্নান্দোর সামনে আইডলটা তুলে ধরল।
হার্নান্দো তার কাছ থেকে ওটা নিল, তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পুরস্কার পেয়ে তার চোখগুলো লোভে জ্বলজ্বল করছিল।
কয়েক মুহূর্ত পর, সে আইডলের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার একজন লোকের দিকে ঘুরল।
সার্জেন্ট, বলল সে।
ইয়েস, স্যার? তার সবচেয়ে কাছে দাঁড়ানো সাজেন্ট জবাব দিল।
এদের হত্যা কর।
আমার হাতগুলো লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। রেনকোর গুলোও।
দুজন স্প্যানিশ সৈন্য লিনাকে রেনকোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। আর লোক দুটো রেনকো আর আমি মারা যাবার পর তাকে নিয়ে কি করবে তা বলে তাকে উত্যক্ত করছিল।
রেনকো আর আমাকে পরিষ্কার জায়গার মাঝে একটা বড় আয়তাকার পাথরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হল। পাথরটা দেখতে একটা নিচু বেদীর মতো।
স্প্যানিশ সার্জেন্ট আমার সামনে দাঁড়ানো, তার খোলা তরবারি হাতে।
তুমি চানকা, ক্যাস্টিমোর দিকে একটা তলোয়ার ছুঁড়ে দিয়ে হার্নান্দো বলল। পরিষ্কার জায়গায় উপস্থিত হবার পর থেকে, নিষ্ঠুর চানকাটা রেনকোর দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তুমি হয়তো যুবরাজের ব্যবস্থা করতে চাইবে।
খুশি মনে, ক্যাস্টিনো স্প্যানশি বলল, তলোয়ারটা ধরে সে দ্রুত বেদীর পাথরের দিকে এগিয়ে এলো।
প্রথমে তাদের হাত কেটে ফেল। হার্নান্দো বিচারকের মতো বলল। আমি তাদের মৃত্যুর আগে তাদের আর্তনাদ শুনতে চাই।
আমাদের হত্যাকারী দুজন মাথা ঝোঁকালো যখন আরো দুজন সৈন্য রেনকো আর আমাকে অবস্থানে টেনে ধরে রাখলো। আমাদের কবজিগুলো এখন পুরোপুরি অরক্ষিত, হাতগুলো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার জন্য প্রস্তুত।
অ্যালবার্তো রেনকো কোমলস্বরে বলল।
হ্যাঁ।
বন্ধু আমার, আমাদের মৃত্যুর আগে, আমি তোমাকে জানাতে চাই তোমার সাথে পরিচিত হওয়া সম্মান আর আনন্দের একটা ব্যাপার ছিল। তুমি আমার লোকদের জন্য যা করেছ, আমার পরবর্তী প্রজন্মগুলো সে কথা মনে রাখবে। এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
আমার সাহসী বন্ধু, আমি উত্তর দিলাম, যদি পরিস্থিতি আবারো এরকম হত, আমি আবারো এটা করতাম। ঈশ্বর স্বর্গে তোমার দেখাশোনা করুন।
আর তোমারও, রেনকো বলল,। আর তোমরাও।
ভদ্রলোকগণ, হার্নান্দো আমাদের হত্যাকারীদের বলল। তাদের হাতগুলো আলাদা করো।
সার্জেন্ট আর চানকাটা একই সময়ে তাদের চকচকে তরবারি তুলল মাথার ওপরে।
একটু দাঁড়াও! হঠাৎ কেউ একজন বলে ওঠল।
সেই মুহূর্তে, সৈনিকদের একজন বেদীর দিকে দৌড়ে এলো। তাকে তার সঙ্গীদের চেয়ে বয়স্ক মনে হল। সে দৌড়ে সোজা রেনকোর দিকে গেল।
সে আমার সঙ্গীর গলায় ঝুলতে থাকা পান্নার লকেটের দিকে তাকিয়ে ছিল।
বুড়ো সৈন্যদের দ্রুত চামড়ার হারটা রেনকোর মাথার ওপর দিয়ে তুলে নিল, লোভীর মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
ধন্যবাদ, জংলী কোথাকার, তার নিজের গলায় হারটা পরতে পরতে সে বলল আর দ্রুত টেম্পলের তোরণের পাশে তার জায়গায় ছুটে গেল।
আমাদের জল্লাদ দুজন ইশারার জন্য হার্নান্দোর দিকে তাকাল।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে, হার্নান্দো আর তাদের দেখছিল না।
এমনকি, সে রেনকো বা আমার দিকেও তাকিয়ে নেই।
সে আমাদের ডানে টেম্পলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তার মুখ হাঁ হয়ে আছে।
সে কি দেখছে, দেখার জন্য আমি ঘুরে তাকালাম।
হে প্রভু….. আমি নিঃশ্বাস ফেললাম।
রাপাগুলো একটা তোরণে অর্ধউন্মুক্ত মুখের দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার সামনে জড়ো হওয়া মানুষগুলোকে কৌতূহলের সাথে দেখছে।
দরজায় অস্পষ্টভাবে এটাকে বড় দেখা গেল, এর শক্তিশালী সামনের পাগুলো ছড়ানো, কাঁধের পেশী গোছা হয়ে আছে, কিন্তু চেহারা সেই মুহূর্তে অদ্ভুতরকম হাস্যকর। কারণ এটা এর মুখে কিছু একটা ধরে আছে।
ওটা ছিল আইডলটা।
আসল আইডলটা।
বিশাল কালো বিড়াল, আগে যেটাকে ভয়ঙ্কর আর হিংস্র মনে হয়েছিল, এখন একটা বিনয়ী লাগছে যেটা এর মালিকের কাছে লাঠি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। অবশ্যই, রাপাটা শুধু বোবার মতো এর মুখে আইডলটা ধরে ছিল, যেন কাউকে খুঁজছে, যে এটাকে আবার ভিজিয়ে দিতে পারে আর যাতে এটা গুঞ্জন শুরু করতে পারে।
হার্নান্দো শুধু বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে, অথবা হয়তো, এর চোয়ালের মাঝে থাকা আইডলটার দিকে। তারপর হঠাৎ তার চোখগুলো রাপা আর ওটার মুখে থাকা আইডলটার দিক থেকে তার নিজের হাতে থাকা আইটার দিকে এলো, তারপর সেখানে থেকে রেনকো আর আমার দিকে। তার চেহারায় বুঝতে পারার একটা ভাব ছড়িয়ে পড়ল।
সে বুঝতে পারল।
সে বুঝতে পারল তাকে বোকা বানানো হয়েছে।
রেনকো আর আমার দিকে তাকাতেই বিশাল স্প্যানিয়াডটার মুখ ক্রোধে লাল হয়ে গেল।
এদের হত্যা কর? জল্লাদ দুজনের দিকে গর্জে ওঠল। এদের এখনি হত্যা করো!
.
সেই মুহূর্তে একসাথে অনেকগুলো ঘটনা ঘটল।
আমাদের মৃত্যুদাতারা আবার তাদের তরবারি তুলল, এখন আমাদের গলার দিকে নিশানা করল আর একটা বিশাল বাক রচনা করে তাদের তলোয়ারগুলো নামিয়ে আনা শুরু করল যখন হঠাৎ একটা হুশ শব্দ আমার মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল।
এক মুহূর্তে পর, একটা শক্তিশালী ধুপ শব্দের সাথে, একটা তীর আমার মৃত্যুদাতার নাকে এসে বিঁধল, তার চেহারায় রক্তের একটা উজ্জ্বল ধারা ছুটিয়ে দিয়ে মার্টিতে ফেলে দিল।
তোরণে দাঁড়ানো রাপাটা, ওর সামনে লোকের ভিড় দেখে আর আরেকটা সুস্বাদু নরমাংসের গন্ধ পেয়ে, তৎক্ষণাৎ মুখ থেকে, আইডলটা ছেড়ে দিল আর সবচেয়ে কাছের স্প্যানিয়ার্ডের ওপর লাফিয়ে পড়ল, এক মুহূর্তে পর অন্য এগারোটা রাপা টেম্পলের ভেতর থেকে একটার পর একটা বেরিয়ে এলো আর স্প্যানিশ সৈন্যদের ওপর নিজেদের আক্রমণ শুরু করল।
ক্যাস্টিনো তার পাশের মৃত্যুদাতাকে তীরের আঘাতে মার্টিতে পড়ে যেতে দেখল। আর ক্ষণিকের জন্য রেনকোর গলার দিকে তরবারি নামিয়ে আনা থামিয়ে দিল, তার চেহারায় একটা বিস্ময়কর দুর্বোধ্যতা ফুটে ওঠল।
আমি জানতাম সে কি ভাবছিল।
কে তীরটা ছুঁড়েছে? কোথা থেকে?
ক্যাস্টিনো স্পষ্টত সিন্ধান্ত নিল এসব প্রশ্নের জবাব সে পরে দেবে, রেনকোকে হত্যা করার পর।
সে দ্রুত আবার তার তরবারি তুলল এবং প্রচণ্ড শক্তিতে নামিয়ে আনল, আর ঠিক তখনি আরেকটা তীর তার তরবারির হাতলে আঘাত করল আর ওটা তার হাত থেকে উড়ে গেল।
এক মুহূর্তে পর, তৃতীয় একটা তীর কোনো জায়গা থেকে আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে এলো আর রেনকোর হাতের দড়িকে দুটুকরো করে তাকে মুক্ত করে দিল।
রেনকো তৎক্ষণাৎ তার পায়ে ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়াল, সাথে সাথে ক্যাস্টিনো তার দিকে ঘুসি চালালো। রেনকো তাকে বেদীর সাথে ধরে রাখা স্প্যানিশ সৈন্যকে ধাক্কা দিয়ে এবং ঘুসির মাঝে নিয়ে এলো, আর ক্যাস্টিনোর বিশাল আঙ্গুল গুলো সরাসরি সৈন্যটার মুখে আঘাত করল, এক মুহূর্তে তার নাক ভেঙে গেল তার মাথার খুলি পেছনে আঘাত খেল। এক ঘুসিতেই ভবলীলা সাঙ্গ।
ঠিক তারপর আরেকজন সৈন্য নিজের মাসকিট রেনকোর দিকে তাক করে গুলি করার সাথে সাথে রেনকো নিজের জায়গার ওপর ঘুরে, মৃত সৈন্যটাকে ঢাল হিসেবে সামনে নিয়ে এলো, আর মাসকিটের গুলি মৃত সৈন্যটার বুকে একটা লাল ফুটো তৈরি করল।
রেনকো যুদ্ধে যোগ দিতেই, আমার কবজি ধরে রাখা স্প্যানিশটা তার তরবারি বের করল আর শয়তানী উদ্দেশ্য নিয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকালো।
কিন্তু চোখের পলকের চেয়ে দ্রুত, একটা তীর লোকটার চেহারার মাঝখানে বিদ্ধ হল, সৈন্যটা উপুড় হয়ে বেদীর ওপর সাথে সাথে পড়ে গেল, মুখ নিচের দিকে, তার মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
আমি তার পেছনের অন্ধকারে তাকালাম, তীরের উৎস খুঁজলাম।
দেখতে ও পেলাম।
চাঁদের বিপরীত একটা ছায়া, গিরিখাদের কিনারায় অবস্থান নিয়ে এক হাঁটুর ওপর গুটিসুটি মেরে ধনুক প্রসারিত করে ধরা এবং একটা তীর কান পর্যন্ত টানা।
বাসেরিও।
আমি খুশিতে চিৎকার করে উঠে তৎক্ষণাৎ আমার বাঁধন খুলতে শুরু করলাম।
আমার চারপাশের হত্যাযজ্ঞ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এটা ছিল প্রচণ্ড। খাঁটি এবং চরম বিশৃঙ্খলা। সামনের পরিষ্কার জায়গায় একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে গেছে। একটা ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে।
সব জায়গায় যুদ্ধ চলছে, প্রায় একডজন পৃথক যুদ্ধ।
টেম্পলের সামনে, রাপাগুলো ইতোমধ্যে পাঁচজন সৈন্যকে হত্যা করেছে, তারপর ওগুলো আরো চারজন স্প্যানিয়ার্ড এবং তাদের চানকা ট্র্যাকারদের আক্রমণ করছে।
পরিষ্কার জায়গায় অন্য অংশে ইনকা যোদ্ধা সাতজন, তাদের শরীর বানরের মূত্রে ঢাকা থাকায় রাপাগুলোকে এড়িয়ে অবশিষ্ট স্প্যানিয়ার্ডদের সাথে যুদ্ধ করছে। কয়েকটা স্প্যানিয়ার্ডদের মাসকুইটোর গুলিতে পড়ে গেল, অন্যরা তাদের হাতের কাছে থাকা শিলা বা পাথর বা অন্য অস্ত্র নিয়ে স্প্যানিশ শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিউ স্পেনের সর্বত্র ভ্রমনের সময় আমি হত্যা আর রক্তপাত দেখলেও। নিশ্চিতভাবে এটা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর আদিম যুদ্ধ।
আমার পাশে, রেনকো আর ক্যাস্টিনো দুজনেই তলোয়ার তুলে নিয়েছে আর এখন মারাত্মক তলোয়ার যুদ্ধ ব্যস্ত।
ক্যাস্টিনো, আমার বন্ধুর চেয়ে অন্তত দুই মাথা লম্বা, তার তরবারি দুই হাতে ধরল আর রেনকোর ওপর আক্রমণ চালল।
কিন্তু রেনকো ভালোই ঠেকাল, এক হাতে, যেভাবে আমি তাকে শিখিয়েছিলাম, একজন আদর্শ স্প্যানিশ তলোয়ারবাজের মতো কাদায় নেচে নেচে পেছনে যাচ্ছে, ঝোঁপের দিকে পেছাতে পেছাতে তার ভারসাম্য রাখছে।
শেষপর্যন্ত আমি আমার বাম কবজি থেকে দড়ি খুলে ওঠে দাঁড়ালাম। আমি বুঝতে পারলাম রেনকো কত মনোযোগী ছাত্র ছিল। আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ছাত্র শিক্ষককে ছাড়িয়ে গেছে।
তার তলোয়ারবাজি ছিল হতবাক করার মতো।
ক্যাস্টিনোর ছুঁড়ে দেয়া প্রতিটা শক্তিশালী আক্রমণের বিপরীতে, রেনকো দ্রুত তার তলোয়ার তুলল আর সময় মতো সেটাকে থামিয়ে দিল।
লোক দুজনের তরবারি মারাত্মক তীব্রতায় সংঘর্ষিত হতে থাকল।
ক্যাস্টিনো আক্রমণ করে, রেনকো ঠেকায়। ক্যাস্টিনো ঝুঁকে পড়ে, রেনকো নাচে।
ক্যাস্টিনো একটা দানবীয় আক্রমণ চালাল, এত কঠিন আর দ্রুত যে একটা সাধারণ লোকের ধর থেকে মাথা উড়ে যাবে।
কিন্তু রেনকোর নয়।
তার রিফ্ল্যাক্স ছিল খুব দ্রুত। আক্রমণের সময় মাথা নামিয়ে নিয়ে পরমুহূর্তে সে লাফ দিয়ে সামনে এগোল, একটা নিচু পাথরের ওপর উঠে বাতাসে লাফিয়ে ওঠল। তার আর ক্যান্টিনোর উচ্চতার পার্থক্য বাতিল করে দিল, ওর তরবারি বাতাসে এত দ্রুত ছুটল যে হুশ করে ওঠল। আমি কিছু জানার আগেই, দেখলাম অনুভূমিকভাবে ক্যাস্টিনোর গলার পেছনের গাছের গুঁড়িতে গেঁথে গেছে।
ক্যাস্টিনো শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে, মুখ খোেলা, চোখগুলো বড় বড়। এক মুহূর্তে পর, তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল।
তারপর তার পুরো শরীর থেকে কুৎসিত মাথাটা আলাদা করে ফেলেছে।
আমি প্রায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠলাম।
আমি খুশি হয়ে উঠতাম, যদি না অন্যান্য ব্যাপারগুলো নিয়ে না ভাবতে হত।
চারদিকের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখার জন্য ঘুরলাম।
পুরো উঠোন জুড়ে ছোট ছোট যুদ্ধ চলছে কিন্তু একমাত্র বিজয়ী বলে মনে হল রাপাগুলোকে।
আমি আইডল দেখতে পেলাম।
আসল আইডল।
তোরণের প্রবেশদ্বারের ওপর পড়ে রয়েছে। এক পাশে কাত হয়ে রয়েছে, যেখানে রাপটার মুখ থেকে এটা পড়েছিল, ঠিক সেখানেই।
আমার ডানহাতের কবজিতে তখনো দড়ি বাঁধা প্রায় দুই হাত লম্বা—ওই হাত দিয়ে আমি একটা তলোয়ার আর মশাল উঠালাম আর মন্দিরের দিকে দৌড়ে গেলাম। তলোয়ারের ঝংকার আর বিধ্বস্ত সৈন্যদের আর্তনাদের মাঝ দিয়ে।
তোরণের কাছে পৌঁছে আইডলটার সামনে মার্টিতে বসে পড়লাম। ওটা ধরতেই একটা স্প্যানিশ সৈন্য আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল। আমরা দুজই তোরণের ভেতর দিয়ে উড়ে গিয়ে টেম্পলের ভেতরে গিয়ে পড়লাম।
দুজন প্রশস্ত পাথরের ওপর দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লাম, টেম্পলের ভেতর অন্ধকার। হাত, পা, আইডল আর মশালের মিশ্রণের জট।
আমরা সিঁড়ির নিচে পড়লাম আর দূরে ছিটকে গেলাম। আমরা গিয়ে পড়লাম অন্ধকার দেয়ালের সুড়ঙ্গের ভেতরে।
আমার শত্রু প্রথমে ওঠে দাঁড়ালো ও দেয়ালের বিপরীতেই থাকল, একটা ছোট খুপরির সামনে। আমি তখনো মার্টিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছি। আইডলটা আমার কোলের ওপর।
স্প্যানিশ সৈন্যটা আমার ওপর দাঁড়াতেই, আমি তার গলায় পান্নার হারটা দেখতে পেলাম আর তৎক্ষণাৎ তাকে চিনতে পারলাম। ও হল ধূর্ত বৃদ্ধ সৈন্য যে রেনকোর গলা থেকে আগেই হারটা ছিনিয়ে নিয়েছিল।
বয়স্ক শেয়ালটা তার তলোয়ার বের করল, উঁচুতে তুলল। আমি প্রতিরোধহীন, সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
সেই মুহূর্তে, একটা ভয়ঙ্কর গর্জন কোনো কিছু পেছন থেকে আমার মাথার ওপর দিয়ে লাফ দিল, ভয়ানক গতিতে সৈন্যটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
একটা রাপা।
বিড়ালটা স্প্যানিয়ার্ডের ওপর এত প্রচণ্ড গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল যে সে তার পেছনের খুপরিতে নিক্ষিপ্ত হল। মাথা দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে একটা শব্দের সৃষ্টি হল, এবং বিস্ফোরিত হল। অনেকটা ডিম ভাঙ্গার মতো, তাৎক্ষণিকভাবে তার খুলির পেছনে সৃষ্টি হওয়া গর্ত থেকে রক্ত আর মগজের একটা নোংরা স্রোত বেরিয়ে এলো।
ধূর্ত বুড়ো সৈন্য খুপরির ভেতর ভেঙে পড়ল, তবে মেঝেতে পৌঁছার আগেই সে সম্পূর্ণ মৃত।
বিড়ালটা তাকে ক্ষতবিক্ষত করা শুরু করল, লেজ নাড়তে নাড়তে।
আমি ওই মুহূর্তটাকে কাজে লাগালাম, আইডলটা আঁকড়ে ধরলাম আর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত টেম্পল থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আবারো মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসতে পেরে কৃতজ্ঞ।
কিন্তু আমার আনন্দ ক্ষণস্থায়ী হল। তোরণ থেকে বেরোতেই আমি আমার পেছনে কোথাও ক্লিক, ক্লিক শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর দ্রুত একটা কর্কশ চিৎকার সন্ন্যাসী!
পাঁই করে ঘুরলাম।
দেখলাম হার্নান্দো পিজারো আমার সামনে দাঁড়িয়ে, তার হাতের পিস্তল আমার বুকের দিকে তাক করা।
আমি নড়ার আগেই, পিস্তলের মাথায় একটা আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম, আমার চারপাশে এর শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে শুনলাম। আর প্রায় একই সাথে একটা প্রচণ্ড ওজন আমার বুকে আঘাত করল আর আমি পিছিয়ে গেলাম।
আমি সাথে সাথে মার্টিতে পড়ে গেলাম। মেঘ ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না, আমার ওপরের তারা জ্বলছে, রাতের আকাশে ঘন ঝড়ো মেঘ, সেই মুহূর্তে আমি আতঙ্কিত হয়ে বুঝতে পারলাম আমাকে গুলি আঘাত করেছে।
পিঠের ওপর শুয়ে যন্ত্রণায় দাঁত বাড়ি খেল, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে, এবং জ্বলন্ত একটা ব্যথা আমার বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
হার্নান্দো আমার ওপর ঝুঁকল এবং আমার আলগা মুঠো থেকে আইডলটা তুলে নিল। আমার মুখে চড় মারে আর বলল, ধীরে ধীরে মর, সন্ন্যাসী। তারপর সে চলে গেল।
আমি টেম্পলের সামনের পাথরের সিঁড়ির ওপর শুয়ে থাকলাম। প্রাণ বেরিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করছি, ব্যথা অসহ্য হবার জন্য অপেক্ষা করছি।
কিন্তু কোনো কারণে, আমার শক্তি, কণার পরিবর্তে, ফিরে আসতে শুরু করল।
বুকের তীব্র ব্যথা কমে গেল আর সাথে সাথে আমি ওঠে বসলাম, আমার বুকে হাত বুলালাম যেখানে বুলেটটা আমার আলখেল্লায় একটা ফুটো তৈরি করেছে।
আমি সেখানে একটা কিছু আছে তা অনুভব করলাম।
নরম মোটা আর বর্গাকার কোনোকিছু। কি সেটা দেখার জন্য ভেতর থেকে বের করলাম।
আমার বাইবেল।
আমার তিনশ পাতার, হাতে লেখা, চামড়ায় বাঁধাই করা বাইবেল।
মাঝখানে একটা ফুটো, দেখতে অনেকটা পোকায় কাটা গর্তের মতো। গর্তের শেষ মাথায় আমি একটা গোলাকার দুমড়ানো ধূসর সীসা দেখতে পেলাম।
হার্নান্দোর বুলেট।
আমার বাইবেল তার বুলেট থামিয়ে দিয়েছে।
সমস্ত প্রশংসা ঈশ্বরের।
আমি লাফিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম, ওই মুহূর্তে উল্লসিত। আমার তলোয়ার খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না, উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম।
উঠোনের অদূরে রেনকোকে দেখতে পেলাম, দুই তলোয়ার দিয়ে দুজন সৈনিকের সাথে যুদ্ধ করছে।
দুজন ইনকা যোদ্ধা দুজন স্প্যানিশ সৈন্যকে আঁকড়ে ধরেছে, যেখানে আমি। দাঁড়িয়ে আছি তার কাছাকাছি। পাহাড়ের ওপর একমাত্র অন্য লোক হিসেবে তাদেরই জীবিত দেখা যাচ্ছে।
এবং তারপর আমি হার্নান্দোকে দেখলাম। তার হাতে আইডল, আমার ডানের গাছপালার ভেতর দিয়ে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে, সেখানকার পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামছে।
আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
দড়ির সেতুর দিকে যাচ্ছেও।
যদি সেখানে যেতে পারে, নিশ্চিত যে, সেতুটা কেটে দেবে এবং আমাদের টাওয়ারের ওপর ফেলে যাবে, রাপাগুলোর সাথে।
দ্রুত তার পিছু নিলাম, উঠোন দিয়ে দৌড়ালাম, একটা সৈনিকের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করতে থাকা রাপার ওপর দিয়ে লাফিয়ে পালালাম।
আমি একবারে দুটো করে পাথরের ধাপ বেয়ে নামতে থাকলাম, আমার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। আমার পাগুলো লাফাচ্ছে, হার্নান্দোর পেছনে দৌড়াচ্ছে। সিঁড়ির একটা বাঁক ঘুরতেই, আমি তাকে দেখতে পেলাম, আমার প্রায় দশ কদম সামনে, দড়ির সেতুর দিকে যাচ্ছে।
হার্নান্দো বিশাল আর পেশীবহুল; আমি ছোট, অধিক চটপটে, দ্রুত। দ্রুত তাকে ধরে ফেললাম। কোনো কিছু না ভেবে আমি তার পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
কঠিনভাবে তার সাথে সংঘর্ষ হল, আমরা একত্রে দড়ির সেতুর পাতলা পাটাতনের ওপর পড়ে গেলাম, গিরিখাদ থেকে অনেক উঁচুতে।
কিন্তু আমরা এত জোরে পড়লাম যে আমাদের নিচের পাটাতন পাতার মতো ছিঁড়ে গেল আর আমরা সরাসরি সেগুলোর মাঝ দিয়ে পড়ে গেলাম, নিচের অতল গহ্বরে।
কিন্তু আমাদের পতন সংক্ষিপ্ত হল।
হঠাৎ একটা ধাক্কার ঝাঁকুনির সাথে আমরা দুজন হঠাৎ থেমে গেলাম। পতনের ভয়ে হার্নান্দো হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করেছে। এমন কোনো কিছু আঁকড়ে ধরেছে যা তার পতন ঠেকাবে।
সে আমার ডান কবজির সাথে বাঁধা দড়িটাই খুঁজে পেল। দড়িটা দড়ির সেতুর ওপরে একটা পাটাতনের ওপর বিস্তৃত, এর দুই মাথায় হার্নান্দো আর আমি দুলছি!
আর আমরা একটা পুলির মতো দড়ির দুই প্রান্তে ঝুলে ভারসাম্যে রক্ষা করছি।
ভাগ্যের সহায়তায়, আমার ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্য, আমি হার্নান্দোর নিচে ঝুলে আছি। আমার মাথা তার হাঁটুর প্রায় কাছাকাছি। হার্নান্দো উঁচুতে ঝুলছে, সেতুর অবশিষ্ট পাটাতানগুলোর ঠিক নিচে।
দেখলাম সে বাম হাত দিয়ে আইডলটা ধরে আছে, আর ডানহাত দিয়ে আমার দড়ি। মরিয়া হয়ে আইডলটা সেতুর অবশিষ্ট পাটাতনের ওপর রেখে কিছু আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করছে।
একবার তাতে সফল হলে, আমি বুঝতে পারলাম, সে আমাকে ফেলে দেবার জন্য নিরাপদ হবে। বর্তমানে, আমার ওজন, তার তুলনায় কম হলেও, আমাকে ধরে রেখেছে।
আমাকে কিছু একটা করতে হবে এবং দ্রুত।
কেন এটা করছ, তুমি সন্ন্যাসী? হার্নান্দো কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে চিৎকার করল, খুব কাছাকাছিও। এ আইডলটা তোমার কি? আমি এর জন্য হত্যা করতে পারি।
ও চিৎকার করতেই, আমি আমাদের ওপরে দড়ির সেতুর হ্যান্ডরেইলের একটা চিকন দড়ি ঝুলতে দেখলাম।
যদি আমি শুধু…..
তুমি ওটার জন্য হত্যা করতে পারবে, তুমি পারবে, হার্নান্দো? আমি বললাম, তার মনোযোগ অন্য দিকে সরানোর চেষ্টা করলাম যখন আমি আমার ডান কবজির সাথে বাধা দড়ি খোলার চেষ্টা করছি যে দড়ি হার্নান্দোর সাথে আমাকে আটকে রেখেছে। আমার কাছে এর কোন অর্থ নেই?
নেই? ও চিৎকার করল। এটা এখন একটা প্রতিযোগিতা, কে তার লক্ষ্যে আগে পৌঁছবে তার প্রতিযোগিতা–হার্নান্দো আমাদের ওপরের পাটাতনে উঠে গেল, আমি দড়ি খুলতে ব্যস্ত।
না! আমি দড়ির প্রান্ত থেকে নিজেকে মুক্ত করা মাত্র বললাম।
কেন? সন্ন্যাসী?
কারণ, হার্নান্দো, আমি এর জন্য মরতে পারি।
সাথে সাথে, আমার কবজি থেকে দড়ি খুলে ওপরে সেতু থেকে ঝুলতে থাকা চিকন দড়ির দিকে হাত বাড়ালাম। ওটা ধরা মাত্র আমাকে হার্নান্দোর সাথে আটকে রাখা দড়িটা ছেড়ে দিলাম।
ফল হল তাৎক্ষণিক।
দড়ির অন্যপাশের ভারসাম্য রক্ষার ওজন চলে যাওয়ার হার্নান্দো পড়ে গেল। সোজা নিচে।
আমার পাশ দিয়ে পড়ে গেল, চিৎকাররত মানুষের মতো বিদ্যুৎ বেগে অস্পষ্ট হয়ে গেল, একটা উপযুক্ত শেষ অপমান হিসেবে। আইডলটা আমার সামনে দিয়ে পড়ার সময়, আমি হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে আইডলটা কেড়ে নিলাম।
না আ আ আ আ! পড়তে পড়তে হার্নান্দো চিৎকার করল।
আমি এক হাতে দড়ি ধরে, অন্য হাতে পবিত্র আইডলটা ধরে ঝুলতে ঝুলতে, তার আতঙ্কিত চেহারা ছোট থেকে আরো ছোট হতে দেখলাম, শেষপর্যন্ত, সে আমার নিচের অতল গহ্বরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি শুধু তার চিৎকার শুনতে পেলাম।
কিছুক্ষণ পর আর্তনাদ থেমে গেল, একটা ধুপ শব্দ শুনতে পেলাম।
.
কিছুক্ষণ পর উঠোনে ফিরে এলাম, আমার হাতে আইডলটা।
চারপাশের দৃশ্য আমাকে পাতালের কথা মনে করিয়ে দিল।
মশালের মিটমিটে আলোয় আমি দেখতে পেলাম, রাপাগুলো সৈনিকদের মৃতদেহের স্তূপের ওপর বসে আছে, তাজা নরমাংসে ভুরিভোজ করছে। চারপাশে হেলমেট পড়ে আছে, আলোতে চকচক করছে।
রেনকো, লিনা আর ইনকা যোদ্ধা তিনজনকে তোরণের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তাদের হাতে তলোয়ার আর মাসকিট, হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র জীবিতরা, তাদের যুদ্ধের দক্ষতা আর তাদের বানরের মূত্রকে ধন্যবাদ। মনে হল তারা কোন কিছু খুঁজছে। সন্দেহ নেই আইডলটা।
রেনকো! আমি ডাকলাম। লিনা।
এর জন্য অনুতপ্ত হলাম।
আমার সামনে মার্টিতে শুয়ে থাকা একটা রাপা সাথে সাথে তার খাবার থেকে মুখ তুলে তাকাল, আমার চিৎকারে বিরক্ত।
বিশাল জন্তুটা পায়ের ওপর দাঁড়াল। আমার দিকে কটকট করে তাকালো।
এর পেছনের আরেকটা বিড়াল ঠিক তাই করল।
তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা।
বিশাল বিড়ালের দলটা আমার চারপাশে একটা বড় বৃত্ত রচনা করল। এদের মাথা নামানো, কানগুলো পেছনে টানটান।
রেনকো ঘুরল এবং আমার বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখতে পেল, কিন্তু সাহায্য করার পক্ষে সে অনেক দূরে।
আমি ভাবলাম বানরের মূত্র কেন বিড়ালগুলোকে কোনঠাসা করে রাখছে না। হয়তো বুড়ো সৈন্যের সাথে সংঘর্ষের সময় মুছে গেছে অথবা হার্নান্দোর গুলি খেয়ে মার্টিতে পড়ার পর ঘষা খেয়েছে।
যেটাই হোক, আমি ভাবলাম, সর্বশেষ।
সামনের রাপাটা পুরো শরীর টানটান করল, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত।
আর তারপর—
.
পানির প্রথম ফোঁটাটা আমার মাথার ওপর বেশ বড় হয়ে পড়ল। দ্বিতীয় ফোঁটাটাও দ্রুত পড়ল আর তারপর তৃতীয়, তারপর চতুর্থ।
আর তারপর, ঈশ্বরের নিজস্ব উপহারের মতো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল।
ওহ, বৃষ্টি! মুষলধারে, শুরু হল, পাথুরে টাওয়ারের ওপর পানির বড় বড় ফোঁটা পড়তে থাকল প্রচণ্ড গতিতে, আমার মাথায় পড়তে থাকল, আইডলটার ওপর পড়তে থাকল।
আর সেই মুহূর্তে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আইডল গুঞ্জন শুরু হল।
সাথে সাথে বিড়ালগুলো শান্ত হল।
সবগুলো আমার হাতের ভেজা আইডলটার দিকে তাকিয়ে থাকল, ওগুলোর মাথা এর গুঞ্জন শুনে এক পাশে আটকে গেল।
রেনকো, লিনা আর ইনকা যোদ্ধা তিনজন আমার কাছে এগিয়ে এলো, বৃষ্টি থেকে তাদের মশাল বাঁচিয়ে, রাপাগুলোকে পাশ কাটিয়ে।
আমি দেখলাম রেনকোর হাতে বাসেরিওর নকল আইডল।
ধন্যবাদ, অ্যালবার্তো, বলল সে, আইডলটা আমার হাত থেকে নিল। আমার মনে হয় এখন আমার ওটা নেয়া উচিত।
তার পাশে, লিনা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তার সুন্দর হলুদাভ সবুজ চামড়া বৃষ্টিতে চকচক করছে। তাহলে, আমাদের আইডলটা রক্ষার জন্য তুমি বড় সোনা-খেকোটাকে হারিয়ে দিয়েছে। বলল সে, এমন কী কিছু নেই যা তুমি করতে পার না, আমার সাহসী ছোট নায়ক?।
একথাগুলো বলে সে আমার দিকে ঝুঁকে হালকা করে আমার ঠোঁটে চুমো খেল। তার ঠোঁটগুলো আমার ঠোঁটকে চেপে ধরতেই আমার একটা হৃদস্পন্দন মিস হল। আমার হাঁটু দুর্বল মনে হল। তার স্পর্শে এত আনন্দ পেলাম যে প্রায় পড়ে গেলাম।
আমার পেছন থেকে কোনো কণ্ঠস্বর বলে ওঠল। ওঠো সন্ন্যাসী। আমার ধারণা ছিল তোমাদের মতো লোকদের জন্য এর অনুমতি নেই।
বাসেরিওকে আমার পেছনের পাথরের ধাপগুলোতে দেখতে পেলাম। তার ধনুক কাঁধে, চেহরায় বড় হাসি।
আমরা ব্যতিক্রম তৈরি করার অধিকার সংরক্ষণ করি, আমি বললাম।
বাসেরিও হাসল।
রেনকো তার মুখোমুখি হল। আমাদের সাহায্য করতে ফিরে আসার জন্য ধন্যবাদ, বাসেরিও। তোমার তীরগুলো আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে। তুমি ফিরে এলে কেন?
বাসেরিও শ্রাগ করল। আমি কোয়েঙ্কোর প্রান্তে জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে, সোনা-খেকোদের নদীর অপর দিক হতে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ভাবলাম যদি অলৌকিক কোনোভাবে তুমি এসব থেকে বেঁচে যাও। লোকজন তোমাকে নিয়ে গান গাইবে। আমি এ গানগুলোর অংশ হব বলে ঠিক করলাম। আমার পারিবারিক নাম অপদস্থ হবার চেয়ে মনে রাখার মতো কোন কিছু। আর একই সাথে, ঐ নামকে সম্মানের স্থানে পুনঃ স্থাপিত করবে।
তুমি দুক্ষেত্রেই সফল হয়েছ, রেনকো বলল। সত্যিই তুমি পেরেছ। এখন, আমি আরো একবার তোমার অনুকূল প্রার্থনা করছি। তোমার কাছ থেকে একটা শেষ সাহায্য চাচ্ছি।
এ কথা বলে, রেনকো, এক হাতে একটা মশাল ধরে আর অন্য হাতে আইডল দুটো ধরে, আমাদের সবার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে থাকল বৃষ্টির ভেতর দিয়ে তোরণের দিকে এগোতে থাকল। যাবার পথে, সে পড়ে থাকা লামার থলিটা তুলে নিল এবং এর ভেতরে বৃষ্টির পানি ভরতে দিল।
বিড়ালগুলো সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করা শুরু করল। বরং বলা চলে তার হাতের গুঞ্জন তোলা টেম্পলের অনুসরণ শুরু করল।
আমি একবার টেম্পলের ভেতর ঢুকে গেলে রেনকো হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি চাই তোমরা সবাই মিলে আমার পেছনে পাথরটা বন্ধ করে দিবে।
আমি রেনকোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইনকা যোদ্ধা তিনজনের দিকে তাকালাম।
তুমি কি করতে যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
আমি নিশ্চিত করতে যাচ্ছি যাতে কেউ এ আইডলটা খুঁজে না পায়, রেনকো বলল। আমি বিড়ালগুলোকে এর প্রলোভন দেখিয়ে টেম্পলের ভেতরে নিয়ে যাব। তারপর, যখন সবগুলো ভেতরে ঢুকে পড়বে, আমি চাই তোমরা পাথরটাকে তোরণে বসিয়ে দেবে।
কিন্তু
আমাকে বিশ্বাস করো, অ্যালবার্তো, সে বলল, তার কণ্ঠস্বর শান্ত। আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমাদের আবার দেখা হবে।
রেনকো টেম্পলের খোলা মুখটায় পা রাখল। বিড়ালগুলো চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল, বৃষ্টি সম্পর্কে অচেতন।
লিনা, বাসেরিও, যোদ্ধা তিনজন আর আমি দ্রুত পাথরটার কাছে গেলাম।
রেনকো টেম্পলের প্রবেশদ্বারে দাঁড়ানো আর শেষবারের মতো আমার দিকে তাকাল।
মুচকি হাসল, ভালো থেকো বন্ধু, সে বলল।
সে চলে গেল ভেতরে, পাথর আর পাথরের তোরণের মাঝের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিড়ালগুলো একটা একটা করে তাকে অনুসরণ করল।
যখন শেষ বিড়ালটা তোরণের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, বাসেরিও চিৎকার করল, ঠিক আছে ধাক্কা দাও।
আমরা ছয়জন বিশাল পাথরটার ওপর ঝুঁকে পড়লাম, সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলাম।
বড় পাথরটা পাথুরে মেঝের ওপর শব্দ করে গড়াতে শুরু করল। ভাগ্য ভালো যে আমাদের মাত্র কয়েক কদম সরাতে হলে, বেশি দূর হলে আমাদের ছয়জনের পক্ষে সম্ভব হত না।
কিন্তু বাসেরিও আর ইনকা যোদ্ধারা ছিল শক্তিশালী। লিনা এবং আমি আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলোম, আর ধীরে ধীরে। পাথরটা বর্গাকৃতির তোরণটা ঢাকতে শুরু করল।
বিশাল পাথরটা দিয়ে টেম্পল বন্ধ করতে করতে, আমি এর ভেতরে আইডলের গুঞ্জনকে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হতে শুনলাম।
তারপর আকস্মিকভাবে পাথরটা তোরণকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিল, এবং এটা আইডলের গুঞ্জন পুরোপুরি থামিয়ে দিল। আর গুঞ্জন থেমে যাবার সাথে সাথে, আমার ওপর এক রাশ দুঃখ ভর করল, কারণ আমি জানতাম আমি আমার ভালো বন্ধু রেনকোকে আবার দেখতে পাব না।
ভয়ঙ্কর পাথুরে টাওয়ারটা ত্যাগ করার আগে, আমি শেষ একটা কাজ করব ভাবলাম।
আমি পড়ে থাকা স্প্যানিশ সৈন্যদের কাছ থেকে এটা ছোরা তুলে নিলাম আর তোরণের মুখে থাকা, বিশাল পাথরটার ওপর একটা বার্তা লিখলাম। আমি তাদের জন্য একটা সতর্কবার্তা লিখলাম যারা হয়তো মন্দিরটা আবার খুলতে চাইবে।
আমি লিখলাম :
নো এন্ট্রেয়ার আলসোলুটো
মানেট্রি এসোমারাস ডেনট্রো
–এস
কোনভাবেই প্রবেশ করো না। ভেতরে মৃত্যু ওত পেতে আছে।
.
ঘটনাগুলো ঘটার পর অনেক বছর কেটে গেছে।
এখন আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, শীর্ণ আর দুর্বল, একটা মনাস্ট্রির টেবিলে বসে, মোমবাতির আলোয় লিখছি। আমার চারদিকে বিস্তৃত তুষারে ঢাকা পর্বত, পাইরেনিস পর্বতমালা।
রেনকো আইডল দুটো আর রাপাগুলো সহ টেম্পলে ঢুকে যাবার পর, বাসেরিও, লিনা এবং আমি ভিলকাফোরে ফিরে এলাম।
দ্রুত পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে আমাদের কথা ছড়িয়ে পড়ল হার্নান্দোর মৃত্যুর কথা, আর একপাল মারাত্মক রাপার মাঝে একটা রহস্যময় টেম্পলের ভেতর আইডলের শায়িত থাকার কথা।
স্বাভাবিকভাবেই, স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক সরকার গভর্নরের ভাই, হার্নান্দোর মৃত্যু সম্পর্কে একটা মিথ্যে গল্প তৈরি করল। তারা বলল স্থানীয়দের অজানা এক গোত্রের হাতে তার সম্মানজনক মৃত্যু হয়েছে, যখন সে সাহসিকতার সাথে কোনো নকশাবিহীন জংলা নদীর ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। যদি আমার দেশের লোকেরা সত্যি কথাটা জানত।
আমি আরো জানি, ইনকারো নিশ্চয়ই আমাদের অভিযান নিয়ে গান গায়। আর,হা, ওই গানগুলোতে নামও ছিল, আর ঐ বীরগাথাগুলো স্প্যানিশদের দ্বারা তাদের জমি দখল হবার পরও চলতে থাকল।
স্বর্ণ-খেকোরা, তারা বলত, তাদের জমি কেড়ে নিতে পেরেছিল, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে পেরেছিল, তাদের লোকদের নির্যাতন আর হত্যা করতে পেরেছিল।
কিন্তু তারা তাদের মনোবল কেড়ে নিতে পারেনি।
আজ পর্যন্ত আমি জানি না, রেনকো আইডল দুটো নিয়ে টেম্পলের ভেতর কি করেছিল।
আমি শুধু অনুমান করতে পারি যে, সে অনুমান করতে পেরেছিল হার্নান্দোর ওপর আমাদের বিজয়ের কথা ছড়িয়ে পড়বে। সোলানের মতো, সে জানত, টেম্পলের ভেতর আইডলটার কথা শুনে, লোকজন এটা খুঁজে বের করবে।
আমার ধারণা সে নকল আইডলটা টেম্পলের প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি কোনো জায়গায় রেখেছিল, যাতে যদি কেউ আইডলের খোঁজে এর ভেতরে ঢুকে তারা প্রথমে নকল আইডলটা খুঁজে পাবে।
কিন্তু আমি শুধু অনুমান করতে পারি, নিশ্চিতভাবে জানি না।
আমি তাকে আর কখনো দেখিনি।
আমি নিউ স্পেনের আতঙ্কে আর সেখানে থাকতে পারলাম না। ইউরোপে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আর সুন্দরী লিনা আর সম্ভ্রান্ত বাসেরিওর কাছ থেকে বিদায় নেবার পর কয়েকজন ইনকা গাইডের সাহায্যে নিয়ে আমি নিউ স্পেনের পর্তগুলোর মাঝ দিয়ে একটা দীর্ঘ যাত্রা শুরু করলাম, উত্তরের দিকে।
হাঁটলাম আর হাঁটলাম, জঙ্গল, পবর্ত আর মরুভূমির ভেতর দিয়ে যতক্ষণ না শেষপর্যন্ত আমি অ্যাজটেকদের এলাকায় পৌঁছালাম, যা কয়েক বছর আগে কর্টেজ স্পেনের নামে জয় করেছ।
সেখানে আমি ঘুষ দিয়ে একটা বণিক জাহাজে জায়গা করে নিলাম, চোরাই সোনা নিয়ে ইউরোপে ফিরবে।
কয়েক মাস পর বার্সেলোনায় পৌঁছে আমি পাইরেনিসের এক উঁচু মনাস্টিটে চলে এলাম, রাজা আর তার রক্তপিপাসু সৈনিকদের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। আর এখানেই আমি বুড়ো হলাম, প্রতি রাতে নিউ স্পেনের অভিযানের স্বপ্ন দেখতাম আর প্রতি মুহূর্তে চাইতাম যদি আর একটা দিন আমার ভালো বন্ধু রেনকোর সাথে কাটাতে পারতাম।
.
রেস পৃষ্ঠা উল্টাল।
এ পর্যন্তই। এখানেই ম্যানুস্ক্রিপ্টটার সমাপ্তি।
সে গুজের কেবিন দিয়ে সামনে তাকাল। ছোট্ট সী-প্লেনটার উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সে তার সামনে আন্দেজ-র খাড়া চূড়াগুলো দেখতে পেল।
ওরা দ্রুতই ভিলকাফোরে ফিরবে।
মাত্র পড়া গল্পটার কথা ভেবে রেস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে অ্যালবাটো সান্তিয়াগোর সাহসিকতা, রেনকোর উৎসর্গের কথা আর তাদের দুজনের বন্ধুত্বের কথা ভাবল। টেম্পলের ভেতরে থাকা আইডল দুটোর কথাও ভাবল।
রেস এক মুহূর্তের জন্য ভাবল।
এর সম্পর্কে কিছু একটা ঠিক নয়।
ম্যানুস্ক্রিপ্টটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে, আকস্মিকভাবে, আর এখন সে এটাও ভাবছে, গতকাল সে কিছু একটা দেখেছে, লরেন যখন সত্যিকার থাইরিয়াম আইডলটার অবস্থান বের করার জন্য আসল নিউক্লিওটাইতে রেনোন্যান্স টেস্ট করেছিল। ঐ টেস্টের ফল পুরো ঠিক ছিল না।
লরেন এবং ফ্র্যাঙ্ক ন্যাশের অভিযানের ভাবনা রেসের মনে নতুন এক ভাবনার জন্ম দিল।
ন্যাশ কিভাবে ডারপা-র সাথে ছিল না। কিভাবে সে একটা আর্মি ইউনিটের দায়িত্ব থেকে একটা সত্যিকারের সুপারনোভা টিম, একটা নেভি টিমকে থাইরিয়াম আইডলের জন্য হারিয়ে দেয়। আর কিভাবে সে রেসকে ধোঁকা দিয়ে এ মিশনে নিয়ে আসে।
রেস চিন্তাগুলো তাড়িয়ে দিল।
তাকে খুঁজে বের করতে হবে ভিলকাফোর পৌঁছে ন্যাশের সাথে কি করতে হবে। তার কী ন্যাশের মুখোমুখি হওয়া উচিত, নাকি চুপ করে কাজ করা উচিত, নাকি ন্যাশকে না জানান উচিত সে কতখানি জানে?
যাই হোক তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়া শেষ হতেই সী-প্লেনটা নিচু হাওয়া শুরু করেছে, এর নাক নিচের দিকে।
তারা নামা শুরু করেছে।
তারা ভিলকাফোরে ফিরছে।
স্পেশানা এজেন্ট জন পল ডিমোনাকো ভল্ট রুমের ভেতর দিয়ে সতর্কভাবে হাঁটল, অপরাধের এলাকা পরীক্ষা করছে।
নেভি ক্যাপ্টের, অ্যারোনসন, সন্দেহভাজন ফ্রিডম ফাইটারদের এলাকায় আক্রমণের জন্য সবুজ সংকেত দেবার উদ্দেশে চলে যাবার পর, অন্য নৌ তদন্তকারী, কমান্ডার টিম মিশেল, অপরাধের জায়গা পরিদর্শনের জন্য ডিমোনাকোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। হয়তো সে এমন কিছু খুঁজে বের করবে যা তারা পায়নি।
অ্যারোনসন ভুল, তাই না? ভল্ট রুমের ভেতরে ঘুরে বেড়ানোর সময় মিশেল বলল।
আপনি কি বলতে চান? ভালোভাবে সজ্জিত ল্যাবটা দেখতে দেখতে ডিমোনাকো বলল। খুবই অসাধারণ ল্যাবরেটরি। সত্যি বলতে কি, এটা তার দেখা অত্যাধুনিক ল্যাবগুলোর একটা।
ফ্রিডম ফাইটাররা এটা করেনি, মিশেল বলল।
না… না, তারা করেনি।
তাহলে কারা করেছে?
ডিমোনাকো এক মুহূর্তে চুপ থাকল।
যখন শেষ পর্যন্ত কথা বলল, সে প্রশ্নটার উত্তর দিল না। নেভি এখানে যে যন্ত্রটা তৈরি করছিল সে সম্পর্কে বলুন। এই সুপারনোভা।
মিশেল একটা গভীর শ্বাস নিল। আমি যা জানি বলছি। সুপারনোভা হল ফোর্থ জেনারেশন অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র। ইউরেনিয়াম আর প্রটোনিয়ামের মতো পার্থিব তেজস্ক্রিয় উপাদানের পরমাণুর ভাঙন ঘটিয়ে মহা বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে।
একটা থাইরিয়াম পরমাণুর ভাঙনের দ্বারা সৃষ্ট বিস্ফোরণ এতই শক্তিশালী যে ওটা পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিঁড়ে ফেলবে। সহজভাবে, সুপারনোভা হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট প্রথম ডিভাইস যা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
এ মৌল, থাইরিয়াম, তা হলে কোন জায়গা থেকে আছে?
গ্রহাণুর সংঘর্ষ, উল্কার পতন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে আসার পথে শিলাখণ্ডের যে অংশটুকু বেঁচে থাকে। কিন্তু আমাদের জানা মতে, কেউ এখনো থাইরিয়ামের কোন জীবন্ত নমুনা খুঁজে পায়নি।
আমার ধারণা আপনি পাবেন, ডিমোনাকো বলল, কেউ না কেউ এখন খুঁজে পেয়েছে। আর যদি জানতাম কে পেয়েছে।
ডিমোনাকো ব্যাখ্যা করল।
কমান্ডার গত ছয় মাস ধরে, ব্যুরোতে আমার ইউনিট একটা আন্তবাহিনী যুদ্ধের গুজব শুনছে। ওকলাহোমা ফ্রিডম ফাইটারস আর আরেকটা সন্ত্রাসী দলের মধ্যে, যারা নিজেদের বলছে, রিপাবলিকান আর্মি অব টেক্সাস।
রিপাবলিকান আর্মি অব টেক্সাস, তারা নয় কী যারা মন্টানায় বনরক্ষীদের হত্যা করেছিল।
তারাই প্রধান সন্দেহভাজন, ডিমোনাকো বলল। আমরা মিডিয়াকে বলেছি রক্ষী দুজন অবৈধ খেলায় মত্ত কিছু বোকা লোকের গুলিতে মারা গিয়েছে। কিন্তু আমাদের ধারণা এটা তারচেয়েও খারাপ। আমাদের ধারণা তারা একটা গোপন টেক্সান ট্রেনিং ক্যাম্পের খবর পেয়ে গিয়েছিল।
ট্রেনিং ক্যাম্প?
উহ–হু। টেক্সানেরা ফ্রিডম ফাইটারের চেয়ে বড় দল, আর অনেক ভালো যোদ্ধা। আসলে, আপনি টেক্সানদের সাথে যোগ দিতে পারবেন না যদি আপনি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য না হন।
ব্যতিক্রমীভাবে সংগঠিত সন্ত্রাসী দল, একটা সাপ্তাহিক ডাকাতের দল নয় বরং অনেকটা একটা সেরা মিলিটারি ইউনিটের মতো।
তাদের একটা কঠিন চেইন অব কমান্ড আছে, সাথে পদমর্যাদা ভঙ্গকারী কোন সদস্যের জন্য কঠিন শাস্তি, তাদের নেতা, আর্ল বিটটেকারের প্রভাবে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে। সে একজন সাবেক নেভি সিল, যাকে ১৯৮৬ সালে পদচ্যুত করা হয় একজন মহিলা লেফটেন্যান্টকে যৌন নিপীড়ন করার কারণে যার আদেশ তার পছন্দ হয়নি। সে তাকে ধর্ষণ করে।
মিশেল শিউরে ওঠে মুখ বিকৃত করল।
আপাতদৃষ্টিতে বিটটেকার সিল-এর শ্রেষ্ঠ লোকদের একজন ছিল সম্পূর্ণ অনুশোচনাহীন একজন কিলিং মেশিন। কিন্তু তাদের অনেকের মতোই তার কিছু নাগরিক গুণের কমতি ছিল। ১৯৮৩ সালে, ধর্ষণের ঘটনার তিন বছর আগে, তাকে ক্লিনিক্যালি মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু নেভি তাকে সক্রিয় দায়িত্বে থাকার অনুমতি দেয়। তার আগ্রাসন যতদিন আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে ছিল, তারা এটাকে আমলে নেয়নি। ভালো যুক্তি।
ধর্ষণের পর, বিটটেকারকে নেভি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং লিভেনওর্থে আট বছর সাজার জন্য পাঠানো হয়। ১৯৯৪ সালে, জেল থেকে বেরিয়ে, সে আরো কয়েকজন অপমানিত কর্মীর সাথে, যাদের সাথে তার জেলে পরিচয় হয়, মিলে রিপাবলিকান আর্মি অব টেক্সাস প্রতিষ্ঠা করে।
টেক্সানরা বিরামহীন প্রশিক্ষণ নেয় ডিমোনাকো বলল। মরুভূমিতে, টেক্সাস আর মন্টনার খারাপ জায়গাগুলোতে। আর কখনো কখনো, ওরেগণের পর্বতগুলোর ওপর। তারা নিশ্চিত করতে চায় যখন তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকার বা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে পুরোপুরি যুদ্ধ ঘোষণা করবে, তখন তারা সবধরনের ভূখণ্ডে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে।
আর সবচেয়ে খারাপটা হল তাদের অর্থও আছে। সরকার তার একটা তেল চুক্তিতে ঝামেলা করায়, টেক্সান তেল ধনকুরের স্ট্যানফোর্ড কোল, বিটটেকার আর টেক্সানদের জন্য প্রায় বেয়াল্লিশ মিলিয়ন ডলার রেখে যান আর সাথে একটা নোট। ওদের নরকের স্বাদ দাও। এরপর বিস্মিত হবার কিছু নেই যে বিটটেকার আর তার সঙ্গীদের প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকান ব্ল্যাক মার্কেট অস্ত্র বাজারে দেখা যায়। গতবছর, তারা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছ থেকে আটটা বাড়তি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার কিনে নেয়।
ক্রাইস্ট মিশেল বলল।
এখনো, ডিমোনাকো বলতে থাকল, তারা প্রায়ই ভারি অস্ত্র চুরি করে। যেমন ধরুন, যদিও প্রমাণ করতে পারে না, আমাদের বিশ্বাস একটা অ্যাব্রামস এম-১ এ ১ যুদ্ধ ট্যাংক চুরির জন্য টেক্সানরাই দায়ী, যখন
ওরা ট্যাংক চুরি করেছে? মিশেল অবিশ্বাসের সাথে বলল।
একটা সেমি-ট্রেইলারের পেছন থেকে যখন এটাকে ডেট্রয়েটরে ক্রাইসলার প্ল্যান্ট থেকে ওয়ারেন, মিশিগানের ট্যাংক অ্যান্ড অটোমেটিভ কমান্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
আপনারা কেন তাদের সন্দেহ করছেন? মিশেল জানতে চাইলো।
কারণ দুই বছর আগে, টেক্সানরা ইরানের একটা অস্ত্র বাজার থেকে একটা পুরনো অ্যান্টোনভ এএন-২২ হেডি লিফট কার্গো প্লেন কেনে। এএন-২২ একটা বিশাল প্লেন, আমাদের সি-৫ গ্যালক্সি আর সি-১৭ রাশিয়ান গ্লোবমাষ্টারের সমতুল্য। এখন যদি আপনি একটা রেগুলার কার্গো প্লেন চান, আপনি একটা ছোট এএন-২২ বা সি-১৩০ হারকিউলিস কিনবেন, এএন-২২ নয়। আপনার একটা এএন-২২ দরকার হবে যখন আপনি বড় কিছু সরাতে চাইবেন। সত্যিকারের বড় কিছু। ৬৭ টন ট্যাংকের মতো বড় কিছু।
ডিমোনাকো বিরতি দিয়ে মাথা নাড়ল। কিন্তু এটাই এখন আমাদের শেষ দুঃশ্চিন্তা নয়।
কেন?
কারণ সম্প্রতি আমরা টেক্সানদের নিয়ে কিছু বিরক্তিকর গুজব শুনছি। মনে হচ্ছে তারা জাপানের আম শিনরিকিও দলের সাথে কোন বন্ধুত্ব খুঁজে পেয়েছে। যে দলটা ১১৯৫ সালে টোকিও সাবওয়েতে সারিন গ্যাস ছেড়ে দেয়। টোকিওতে আক্রমণের পর এ দলের কিছু সদস্য আমেরিকায় চলে আসে আর আমাদের কয়েকটা সন্ত্রাসী বাহিনীতে ঢুকে পড়ে। আমাদের বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে আম শিনরিকিও-এর বেশ কিছু সদস্য টেক্সনাদের সাথে যোগ দিয়েছে।
আমাদের জন্য এর অর্থ কি? মিশেল জানতে চাইল।
এর মানে হল আমাদের এখন একটা বিশাল বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
কেন?
কারণ আম শিনরিকিও হল কেয়ামত বানানো দল। এর একমাত্র উদ্দেশ পৃথিবীর সমাপ্তি টানা। আমরা শুধু টোকিও সাবওয়ে ঘটনাটা জানি কারণ নেটওয়ার্কগুলো এর ফিল্ম ফুটেজ পেয়েছিল। আপনি কী জানেন ১৯৯৪ এর শুরুর দিকে আম শিনরিকিও একটা রিমোট চায়নিজ মিসাইল সাইলোর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়? একটা পুরোপুরি থার্মোনিউক্লিয়ার যুদ্ধ শুরু করার চেষ্টায় তারা ত্রিশটা নিউক্লিয়ার মিসাইল প্রায় ছুঁড়ে ফেলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।
না, আমি জানি না, মিশেল বলল।
কমান্ডার আমেরিকায় আমরা কখনো কোনো কেয়ামত সৃষ্টিকারী দল দেখিনি। আমাদের ভয়ঙ্কর সরকার বিরোধী দল, জাতিসংঘ বিরোধী দল, গর্ভপাত-বিরোধী দল, সেমিটিক বিরোধী দল আর নিগ্রো-বিরোধী দল আছে। কিন্তু এমন কোন সন্ত্রাসী দল ছিল না যাদের একমাত্র উদ্দেশ পৃথিবীতে ব্যাপক প্রাণহানী ঘটানো।
এখন, যদি আর্ল বিটটেকার আর টেক্সানরা কেয়ামত সৃষ্টির দর্শন বেছে নেয়, তাহলে আমরা বিশাল বড় সমস্যার মুখোমুখি। কারণ তখন আমেরিকার ভয়ঙ্করতম প্যারামিলিটারি সন্ত্রাসী দলগুলোর একটা মৃত্যু ইচ্ছায় দৌড়াবে।
ঠিক আছে, তাহলে, মিশেল বলল, তো কিভাবে এসব কিছু এ ডাকাতির সাথে সম্পর্কিত?
সহজ, ডিমোনাকো বলল। যে দলটা ডাকাতি করেছে তারা উচ্চ প্রশিক্ষিত, ভালো দক্ষ অ্যাসল্ট স্কোয়াড়। তাদের ব্যবহৃত কলাকৌশল বিশুদ্ধ স্পেশাল ফোর্সের, বিশেষ করে সিল-এর লোকদের যা নির্দেশ করে টেক্সান রিপাবলিকান আর্মির মতো দলকে আর ফ্রিডম ফাইটারদের নয়।
ঠিক।
টাঙস্টেন কোর্ড বুলেট রেখে গেছে তারা, ফ্রিডম ফাইটারদের নিশানা। এখন, টেক্সানরা কাজটা করে কি আমাদের ফাঁসিয়ে দিতে পারে না ওকলোহোমা ফ্রিডম ফাইটারদের দিকে নিশানা তাক করে, শক্রদের বিপদে ফেলে দেয়?
হ্যাঁ…?
আরো যেটা দেখার বিষয় হল, ডিমোনাকো বলে চলল, ওরা ভেতরে ঢুকল কীভাবে। কোনো লোক ওদেরকে সাহায্য করেছে, যে কোডগুলো জানত, ইচ্ছে করলে পেতে পারত সমস্ত সিকিউরিটি লকের কার্ডকি। প্রজেক্টে যারা কাজ করে তাদের সবার রেকর্ড আছে আপনার কাছে?
বুক পকেট থেকে একটা কম্পিউটার পেপার বের করে ডিমোনাকোর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন মিশেল।
সুপারনোভা প্রজেক্টে যারা কাজ করছে তাদের নামের তালিকা, নেভি ও ডারপা।
ডিমোনোকা লিস্টের দিকে চোখ বুলাল।
মিশেল বলল, এদের প্রত্যেককে চেক করা হয়েছে। সবাই পরিষ্কার, এমনকী ভেতরে ঢোকার জন্য যার সিকিউরিটি কার্ড ও পিন কোড ব্যবহার করা হয়েছে সেটার বিরুদ্ধেও কিছু পাওয়া যায়নি।
ডাকাতির দিন কোথায় ছিলেন তিনি? জানতে চাইলেন ডিমোনাকো।
আরলিংটন মর্গে, জবাব দিলেন মিশেল। প্যারামেডিক রেকর্ডে দেখা গেছে ভোর ৫:৩৬ মিনিটে, ডাকাতরা এই দালানে ঢোকার ঠিক পনেরো মিনিট আগে হেনরী টন ও তার স্ত্রী সারাহ নিজেদের আরলিংটনের বাড়িতে গুলির আঘাতে মারা গেছেন।
৫:৩৬, বলল ডিমোনাকো। খুন করার পর তাড়াতাড়িই এখানে চলে আসে তারা। মাথায় এই চিন্তা ছিল যে হাসপাতাল ওর নামটা জানে।
ডিমোনাকো আর মিশেল দুজনেই জানে, হাই লেভেল গভর্মেন্ট অফিশিয়ালদের জন্য নামের পাশে সব সময় একটা ইলেক্ট্রনিক ফ্ল্যাগ থাকে, যদি তারা অপ্রত্যাশিতভাবে কখনো হাসপাতালে যায়। তারা হাসপাতালে ভর্তি হবার সাথে সাথে স্ক্রিনে একটা লেখা ওঠে, যেন ডাক্তার সরকারের সাথে যোগাযোগ করে লোকটার বিষয়ে।
নর্টনের সঙ্গে কোনো মিলিশিয়া গ্রুপের যোগাযোগ ছিল? জানতে চাইল ডিমোনাকো।
প্রশ্নই ওঠে না। সারাটা জীবন নেভিতে কাটিয়েছেন। টেকনিকাল সাপোর্ট সিস্টেম এক্সপার্ট–কম্পিউটার, কমিউনিকেশন সিস্টেম, নেভিগেশন কম্পিউটার। রীতিমত দৃষ্টান্তমূলক রেকর্ড। মানুষটা কঠিন বয় স্কাউট। এই লোক তার দেশের সঙ্গে বেঈমানী করবেন না।
অন্যদের ব্যাপারে?
কিছুই না। কারো সঙ্গেই প্যারামিলিটারি কোনো অর্গানাইজেশনের সম্পর্ক নেই। টিমের প্রতিটি সদস্যকে প্রজেক্টে কাজ দেয়ার আগে সিকিউরিটি চেকের মাধ্যমে ওকে করিয়ে নেয়া হয়েছে। সবাই পরিষ্কার কোনো মিলিশিয়া গ্রুপের একজনেরও সম্পর্ক নেই তা চেনা আছে।
অন্তত একজন পারে, বলল ডিমোনাকো। খোঁজ নিয়ে দেখুন নরম্যানের সঙ্গে কে বেশিক্ষণ কাজ করত, কে তাকে প্রতিদিন পিন কোড ব্যবহার করতে দেখত। এদিকে আমি খবর নিয়ে জানার চেষ্টা করে দেখি আর্ল বিটটেকার ও টেক্সানরা কী নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।
.