৪.১ চতুর্থ খণ্ড – হীরক আর ভষ্মের ভূখণ্ড

চতুর্থ খণ্ড – হীরক আর ভষ্মের ভূখণ্ড

২০. তূর্কী নাচ

১৫২২ সালের গ্রীষ্মকালের এক দাবদাহপূর্ণ দিন। বাবরের ছেলেরা কাবুল শহরের দেয়ালের বাইরে অবস্থিত তৃণভূমিতে খেলা করছে। চৌদ্দ বছরের হুমায়ূন- খুরের কাছে সাদা ফেট্টি দেয়া বাদামী রঙের চকচকে চামড়ার ঘোটকী- লম্বা সোনালী ঘাসের ভিতর দিয়ে দাবড়ে নিয়ে যাবার ফাঁকে পর্যানে বসা অবস্থায় খড়ের একসারি লক্ষ্যবস্তুকে স্থির করে নিশানা মকশো করে। পর্যানের উপরে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রেখে সে তূণীর থেকে একটার পরে একটা তীর বের করে হাতের দুই বাঁক বিশিষ্ট ধনুকে সন্নিবেশিত করে এবং বাতাসের বরাভয়ে ভাসিয়ে দেয়। প্রতিটা তীর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। কামরান তার ধূসর রঙের টাটুতে বসে চোখে ভক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখে। হুমায়ূন এক ঝটকায় আকাশের দিকে তাকিয়ে এবং কোনো ছন্দপতন না ঘটিয়ে তীর ছুঁড়ে অবলীলায় একটা উড়ন্ত পাখিকে বিদ্ধ করলে বাবর তাকে ঢোক গিলতে দেখে।

 বাবর হেসে ফেলে। দূর্গপ্রাকারের এই সুবিধাজনক স্থান থেকে সে হুমায়ুনের ফুর্তি আর-ঘোড়ায় ঋজু ভঙ্গিতে বসে, সুদর্শন মাথাটা দেহের উপরে স্থির রেখে অনায়াসে ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখে-নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ঠিকই অনুভব করতে পারে। তাকে পুরোদস্তুর একজন শাহজাদা যোদ্ধা মনে হয়, আর সেটা সেও জানে। কিন্তু তার চেয়ে মাত্র পাঁচ মাসের ছোট কামরান বড় হচ্ছে। সৎ-ভাইয়ের মতো সেও লম্বাই হবে এবং তার মতো শক্তিশালী না হলেও সেটা পুষিয়ে দিয়েছে তার দুর্দান্ত সাহস- যার কারণে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার সে বড় ধরণের দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনোমতে বেঁচে গেছে।

 বাবর কৃতজ্ঞ যে তার আম্মিজান এই দুজনের বড় হওয়া পর্যন্ত আর খানজাদার সাথে মিলিত হওয়ার মত দীর্ঘায়ু মনে মনে তিনি ভালো করে জানতেন যা তাকে প্রায়শই হতাশ করে তুলতো- লাভ করেছিলেন। গ্রীষ্মের খাণ্ডবদাহনের পরে বৃষ্টিপাতে তৃণভূমি যেমন আবার সবুজ হয়ে উঠে, মেয়ে কাবুলে ফিরে আসতে খুতলাঘ নিগার তেমনই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। সাইবানি খানের হাতে অত্যাচারিত হবার ব্যাপারে সে তাদের আম্মিজানকে কি বলেছিলো বাবর সেটা কখনও জানতে পারেনি। মাঝে কেবল তাকে বিষণ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে সে দেখেছে। খানজাদারও নিশ্চয়ই সেটা দৃষ্টি এড়ায়নি। সে লক্ষ্য করেছে মায়ের কাছে থাকবার সময়ে খানজাদা ইচ্ছা করেই কেমন উছুল আর প্রাণবন্ত থাকতো। যেনো বোঝাতে চাইতো তার সাথে যাই ঘটে থাকুক, সেসব কিছু তার মানসিকতা বদলে দিতে পারেনি। কেবল একটা ব্যাপারেই সে খুতলাঘ নিগারকে কোনো ধরণের প্রশ্রয় দেয়নি। খুতলাঘ নিগার মনেপ্রাণে চাইতেন অতীতের ঘটনার সমাপ্তির স্মারক হিসাবে খানজাদা যেনো আবার বিয়ে করে। কিন্তু সে তার কোমল অনমনীয় ভঙ্গিতে, পাত্র যতোই ভালো মানুষ বা বংশ যতোই সম্ভ্রান্ত হোক, নাকচ করে দিয়েছে।

সাত বছর আগে খুতলাঘ নিগারও তার নানীজান এসান দৌলতের মতোই আকষ্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। তিনি তার কক্ষে বসে একটা সুতির আলখাল্লার পাড়ে কারুকাজ করছিলেন যখন খানজাদা তার পাশে বসে তাকে পড়ে শোনাচ্ছিল এবং সেই অবস্থায় তিনি একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে ঝুঁকে পড়েন। দেখা যায় সেটাই পৃথিবীর বুকে তার শেষ নিঃশ্বাস ছিলো। তার আত্মা দেহের খাঁচা ত্যাগ করেছে আর হেকিমকে কিছু করার কোনো সুযোগই তিনি দেননি। কয়েক ঘণ্টা পরে, বাবর কান্না দমন করে, কাবুলে প্রথমবার আগমনের পরে সে পাহাড়ের পাদদেশে যে উদ্যানটা তৈরি করেছিলো সেখানে এসান দৌলতের পাশে তাকে সমাহিত করে। সে শপথ নিয়েছে, কিভাবে তার সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন, সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ে, তার নানীজান আর আম্মিজান কিভাবে তাকে সাহায্য করেছে, পথ দেখিয়েছে, এবং এই দুই নারীর সাহায্য ছাড়া সে আদৌ কোনো সিংহাসনে আসীন হতে পারতো না, এই ব্যাপারগুলো কখনও বিস্মৃত হবে না… তার পরের সন্তানদের তারা দেখে যেতে পারেননি এই বিষয়টা তাকে সবসময়ে বিষণ্ণ করে তোলে।

 সে এবার সেদিক থেকে ছয় বছরের আসকারির দিকে দৃষ্টি ফেরায়। বিছুটা একটা চোখা লাঠি নিয়ে তার তিন বছরের সৎ-ভাই হিন্দালকে সমানে খুঁচিয়ে চলেছে। তাদের আয়া লাঠিটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে এবং বাবর তাকিয়ে দেখে আসকারির টানাটানা ছোট মুখটা অনিচ্ছুক একটা চিৎকারে বেঁকেচুরে যায়, যা কেবল কানে একটা মৃদু টান ডেকে আনতে সে তার অস্ত্র সমর্পনে বাধ্য হয়। আর এবার তারস্বরে চিৎকার শুরু করে। হিন্দাল- তার আয়া তাকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে ভাইয়ের নাকাল অবস্থা বেশ তার নাদুসনুদুস গোলাকার মুখে, উৎসাহের সাথে তাকিয়ে দেখছিলো।

বাবর ভাবে, তাকে ভাগ্যবানই বলা চলে। এতগুলো স্বাস্থ্যবান সন্তানের সে পিতা। এবং একটা সমৃদ্ধ, নিরাপদ সালতানাতের অধিকারী। সমরকন্দ পরিত্যাগের পরে গত দশ বছর, সে একনাগাড়ে কাবুল শাসন করেছে। বিদ্রোহের যেকোনো সম্ভাবনা দ্রুত দমন করে এবং কাবুলের চারপাশে উঁচু, সংকীর্ণ গিরিপথে- কোটাল সওদাগরী কাফেলায় রাহাজানি করে বেড়ানো উপজাতি গোষ্ঠীগুলোকে সাফল্যের সাথে দমন করে সে তার প্রজাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। খুগিয়ানী, খিরিজী, তুরী আর ল্যান্ডার ডাকাত গোষ্ঠীর সবাই নাকে খত দিয়ে ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছে। গিরিপথে উঁচু দণ্ডের মাথায় সন্নিবিষ্ট তাদের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কর্তিত মস্তক অন্যদের জন্য সতর্কবাণী হিসাবে কাজ করেছে আর আগত বণিকদের আশ্বস্ত করেছে যে তারা এমন একটা রাজ্যে প্রবেশ করছে যেখানে সুলতানের শাসন বজায় আছে।

নিরব দক্ষ, বিশ্বস্ত কাশিম- শাহী কোষাগারের রক্ষক হিসাবে বয়স্ক ওয়ালি গুলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। প্রতি চন্দ্রমাসের শুরুতে গর্বিত ভঙ্গিতে কোষাগারে প্রাচুর্য উপচে পড়ার কথা বাবরের কাছে ঘোষণা করে। কাবুলের ব্যবসায়ীরা, প্রতিবার নিরাপদে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে ফেরত আসার পরে উটের ঝলসানো মাংস দিয়ে ভূড়িভোজ করে, নিজেদের নিরাপদ আর ধনবান ভাবে। তারা নিজেদের নিয়ে সুখী। কিন্তু সেও কি নিজেকে সুখী দাবি করতে পারে? এসান দৌলত- তাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারতেন যিনি- সহজাত প্রবৃত্তির বশে উত্তরটা ঠিকই টের পেতেন যে সে মোটেই সুখী না।

নিজেদের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে, বাবর এতদিন চাপা পড়ে থাকা তার অপূর্ণ আকাক্ষটার খোঁচা আবার নতুন করে অনুভব করে। ভবিষ্যতের গর্ভে তাদের জন্য কি রয়েছে? মানুষের নেতা হিসাবে, একজন যোদ্ধা হিসাবে সে অনেক কিছু শিখেছে। অনেক চড়াই উতরাই অতিক্রম করেছে। কখনও হতাশ না হতে, বিপর্যয়ের কারণে কখনও নিজেকে লক্ষ্যচ্যুত না হতে, তার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে। আর কাবুলের চেয়ে সেটা অনেক বড় কিছু একটা লক্ষ্য…তার সন্ত নিদের, এবং তাদের সন্তানদের জন্য চমকপ্রদ একটা স্মারক…

 “সুলতান, পশ্চিম থেকে একদল আগন্তুক কাবুলের দিকে এগিয়ে আসছে বলে আমরা সংবাদ পেয়েছি।” বাবরের কল্পনাবিলাস বাইসানগারের কথায় ব্যাহত হয়। তাকে বরাবরের মতোই উদ্বিগ্ন দেখায়। ঘুমের ভেতরে বয়োবৃদ্ধ বাহলুল আইয়ুব মারা গেলে, বাবর বাইসানগারকে কাবুলের গ্রান্ড উজিরের পদে নিয়োগ দিতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি- ব্যাপারটা ছিলো সমরকন্দের গ্রান্ড উজির হিসাবে তার স্বল্পকালীন নিয়োগের একটা সান্ত্বনা।

 “আগন্তুকের দলের পরিচয় জানা গেছে? বণিকের কাফেলা?”।

“সুলতান, আমি নিশ্চিত বলতে পারছি না। তারা কাফেলা চলাচলকারী পথ ধরে এগিয়ে আসছে। কিন্তু দলটার সাথে মালবহনকারী খচ্চরের সংখ্যা অনেক কম অস্থায়ী শিবির স্থাপন করতে প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য যতোগুলো দরকার : ঠিক ততোগুলো। অবশ্য আমাদের গুপ্তদূতের দল বলেছে তাদের সাথে দুটো বিশাল বলদে টানা মালবাহী গাড়ি রয়েছে যা বিচিত্র দর্শন ধাতব অনুষঙ্গে বোঝাই। প্রতিটা গাড়ি ত্রিশটা বলদের পাল টেনে আনছে…”

“দলটাতে লোকজনের সংখ্যা কতো?”

 “পঞ্চাশজন হবে সম্ভবত এবং তাদের পরণে রয়েছে বিচিত্ৰদৰ্শন চামড়ার জোব্বা। আর মাথায় উজ্জ্বল কমলা রঙের চূড়াকৃতি পাগড়ি…”

 “তারা সম্ভবত ভ্রাম্যমাণ দড়াবাজের দল…”

 “সুলতান, আমার কিন্তু তা মনে হয় না।”

“বাইসানগার, আমি ঠাট্টা করছিলাম। তাদের উপরে নজরদারি বজায় রাখেন। তারা কবে নাগাদ এখানে এসে পৌঁছাবে?”

 “তিন দিনের ভেতরে, খুব বেশি দেরি হলে চারদিন।”

 “তারা পৌঁছালে আমাকে খবর দেবেন।” রাজ্যের লোক কাবুলে এসে ভীড় করে, এখান দিয়ে অতিক্রম করে- রেশমের উপরে জরির কারুকাজ করা জোব্বা আর পিঠে সবুজ চামড়ার তূণীর এবং একই রঙের পর্যান, দুর্বিনীত অহংকারী খোঁচা খোঁচা দাড়ির চীনা বণিকের দল। আফগান উপজাতির লোকদের মতো নাকে মাছি বসতে দিতে নারাজ। আর যেকোনো ছুতোয় লড়াই বাধাতে ওস্তাদ। শ্যামবর্ণের নাদুসনুদুস পার্সী বণিকের দল, আর হিন্দুস্তানের একেবারে ভেতর থেকে মশলা আর চিনির পসরা নিয়ে আগত রঙচঙে পাগড়ী পরিহিত কৃষ্ণবর্ণের বণিক। নতুন আগত এই দলটা যদি কৌতূহল উদ্রেককারী হয়, তবে সে তাদের দূর্গপ্রাসাদে ডেকে পাঠাবে…বহুদূর থেকে আগত আগন্তুকদের দেখে কামরান আর হুমায়ূন হয়তো খুশিই হবে।

বাইসানগারের গণনা কার্যত ভুল প্রমাণিত হয়। দুদিন পরে, ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে, আগন্তুক দলটাকে তাদের রহস্যময় গাড়ির বহর নিয়ে কাবুলের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তারা শহরের দিকে না গিয়ে দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখী খাড়া পথটা বেছে নেয়। বাবর তার ব্যক্তিগত কক্ষের বারান্দা থেকে বৃষ্টির ফলে ধূলোর স্তর থেকে সৃষ্ট কাদায় মালবাহী বিশাল গাড়ি দুটো পিছলে গিয়ে আটকে যেতে দেখে। আবহাওয়ার কারণে গাড়িতে নিয়ে আসা মালামাল মোটা চামড়া দিয়ে ভালো করে মোড়ানো। ভারী কাঠের জোয়ালের নিচে মাথা নিচু করে বলদের পাল প্রাণপণে চেষ্টা করছে গাড়িটা টেনে তুলতে। তাদের পেষল কাঁধ তিরতির করে কাঁপছে।

বৃষ্টির কারণে দলটার কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা, লম্বা চওড়া দেখতে দলপতি। ঘাড় ঘুরিয়ে পরিশ্রান্ত জন্তুগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে। বাবর বারান্দা থেকে খেয়াল করে লোকটা হাত নাড়ছে। কোনো সন্দেহ নেই সে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলেছে। কারণ তার আটজন তোক সাথে সাথে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামে এবং পেছন থেকে গাড়িটা ধাক্কা দিতে শুরু করে। তাদের একজন পা পিছলে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

 দলনেতা লোকটা যেনো ধৈর্যের শেষপ্রান্তে পৌঁছে যায়। সে তার ধূসর ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে এবং ঢাল বেয়ে উঠার জন্য সেটার পেটে খোঁচা দেয়। দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত উঠে যাওয়া খাড়া, পাথর দিয়ে বাঁধানো ঢালু পথটায় উঠে সে যেনো তার বাহনকে আরও দ্রুত এগিয়ে যাবার জন্য তাগাদা দেয়। দু’জন। তোরণ রক্ষী লাফিয়ে তার গতিরোধ করতে সে কেবল লাগাম টেনে তার বাহনকে সহসা টলতে টলতে দাঁড় করায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবর নিচের কোনো কথা শুনতে পায় না। কিন্তু লোকটার সবকিছুই কেবল একটা বিষয়েই ইঙ্গিত করে যে, সে বণিক নয় একজন যোদ্ধা। প্রহরীর প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় তার মাথাটা স্পর্ধিত ভঙ্গিতে বাঁকানো থাকে এবং সে অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে তার বৃষ্টিতে ভেজা ঘোড়সওয়ারীর আলখাল্লী ঝটকা দিয়ে কাঁধের পেছনে সরিয়ে দিলে বাবর অদ্ভুত দর্শন ময়ানে কোষবদ্ধ তরবারির বাঁট এক ঝলকের জন্য দেখতে পায়- একধারি তরবারির মতো বাঁকানো কিন্তু আরো অনেক বেশি সরু।

 “প্রহরী।” বাবর বারান্দা থেকে ডাক দেয়, “লোকটাকে এখনই আমার কাছে নিয়ে এসো।”

 পাঁচ মিনিট পরে, সামনে চারজন আর পেছনে ছয়জন প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় লোকটা তার কক্ষে প্রবেশ করে। তার পরণের আলখাল্লা খুলে নেয়া হয়েছে এবং তার ময়ানও শূন্য- কোমরে একটা সরু ধাতব শিকলের সাহায্যে আটকানো ইস্পাতের বাঁকানো শূন্য খাপটা ঝুলছে। কিন্তু লোকটার মুখের নিম্নাংশ তখনও কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং তার মাথার চূড়াকৃতি পাগড়ী টেনে ভুরু পর্যন্ত নামান। প্রহরীরা তাকে বাবরের বিশ ফিটের বেশি কাছে যেতে দেয় না।

 “সুলতানের সামনে হাঁটু মুড়ে বসো!”

লোকটা বাবরের সামনে কেবল নতজানুই হয় না সে মেঝেতে পূর্ণাঙ্গ, আনুষ্ঠানিক তৈমূরীয় অভিবাদন রীতি কুর্নিশের ভঙ্গিতে হাত পা ছড়িয়ে নিজেকে প্রণত করে।

“আগন্তুক তুমি এবার উঠে দাঁড়াতে পারো।” বাবর এবার আগের চেয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ যেনো তার অধিকার এমন ভঙ্গিতে প্রহরীদের সাথে তর্ক করছিলো, সে নিজে থেকে কেনো এভাবে শ্রদ্ধা প্রকাশ করছে? এবং তার চেয়েও যেটা তাকে কৌতূহলী করে তোলে সেটা হলো এখনও কেন সে মুখ নিচে রেখে, বাহু প্রসারিত করে রেখেছে? সে কি বাবর যা। বলেছে সেটা বুঝতে পারেনি?

 বাবরের এক দেহরক্ষী তার হাতের বর্শার হাতলের প্রান্তভাগ দিয়ে আগন্তুক লোকটাকে খোঁচা দিতে যাবে, কিন্তু বাবর তার আগেই হাত তুলে তাকে বিরত করে। হাত দিয়ে খঞ্জরের বাঁট স্পর্শ করে সে ধীরে ধীরে লোকটার দিকে এগিয়ে যায় এবং তার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। “আমি এবার তোমাকে উঠে দাঁড়াতে আদেশ করছি।”

শায়িত দেহটার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে, লোকটা হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসে কিন্তু তখনও সে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারপরে ধীরে ধীরে সে মুখ তুলে তাকায় এবং নোংরা, ঘামের দাগ লাগা কাপড়টার উপরে বাবর দেখে একজোড়া নীল চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

 “বাবুরী!” এতোবছর পরে তার যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। সে। নিজে এবার ঝুঁকে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে এবং তাকে টেনে দাঁড় করায়। মুখটায় আগের চেয়ে অনেক বেশি পোড়খাওয়া বলিরেখা দেখা যায়। কিন্তু চোখের নিচের উঁচু হাড়, গাঢ় নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কোনোমতেই ভুলবার মতো না।

 বাবর তার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলে, বাবুরী তার বৃষ্টিতে ভেজা পাগড়িটা এবার খুললে ধূসর ছোপধরা লম্বা কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসে। “আমাকে ক্ষমা করেন…” শব্দগুলো বলতে বাবুরীর যেনো গলা ভেঙে আসে এবং তার চোখ চকচক করতে থাকে।

বাবর হাত তুলে তাকে বিরত করে। “অপেক্ষা করো…” সে ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষীদের যেতে বলে এবং তারা বের হয়ে গিয়ে দুই পাল্লার ভারী ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ করার পরে সে তার বিশ্বস্ত বন্ধুর দিকে ঘুরে তাকায়। “আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি…”।

 বাবুরীর চোখমুখ লাল হয়ে উঠে। “আমি আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষার জন্য ফিরে এসেছি। আমাকে যখন আপনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো আমি সেই সময়ে। আপনাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলাম। প্রথম থেকেই আমি এটা জানতাম কিন্তু আমার অহংকার আমাকে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছে…”

“না…” বাবর এবার আরো শক্ত করে বাবুরীর বাহু আঁকড়ে ধরে। “আমার উচিত তোমার কাছে ভুল স্বীকার করা। তুমিই ঠিক- তুমি যা বলেছিলে সব ঠিকই বলেছিলে। তুমি নও, আমিই ছিলাম গর্বিত গাধা। আমি ভেবেছিলাম সমরকন্দ আমার, ভেবেছিলাম এটাই আমার নিয়তি, যেকোনো মূল্যে, এমনকি শাহের কাছে নতজানু হয়ে হলেও, শহরটার শাসক হবার জন্য সেটা ধর্তব্যের ভিতরে পড়ে না। তোমার কথা শোনা আমার উচিত ছিলো… আমি এক বছরও শহরটা দখলে রাখতে পারিনি। শহরের লোকেরা আমার চেয়ে বর্বর উজবেকদের স্বাগত জানানটা মেনে নিয়েছিল,..”

 “কিন্তু আমি ছিলাম আপনার বন্ধু… আমি জানতাম আমাকে আপনার তখন দরকার ছিলো এবং আমি সেটা থাকতে পারিনি। এই লজ্জাটা বিগত বছরগুলোতে আমাকে কুড়েকুড়ে খেয়েছে…” বাবুরীর কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে যায়।

 “তুমিই একমাত্র তোক যে সবসময়ে আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছো তুমিই আমার সাথে সুলতান হিসাবে না, একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে আচরণ করেছে, আর আমিও যার সাথে অকপটে সবকিছু বলতে পারতাম… আর তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিলো। আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি… তোমার কথা কখনও ভুলিনি…আমি প্রথমদিকে সবসময়ে ভেবেছি তুমি একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু আমার সেই আশা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে…তখন আমার ভয় হতো তুমি বুঝি আর বেঁচে নেই।”

 “মাশুলের উপায় না খুঁজে বের করে আমি কিভাবে ফিরে আসি আপনার কাছে?”

 বাবর তার কাঁধ ছেড়ে দেয়। “আমি তোমাকে কখনও বুঝতে পারিনি…”

“না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ে আলাদা ছিলো, আর সেরকমই থাকা বাঞ্ছনীয়।”

 “তো, বদমাশ এবার বলল এতোদিন পরে হঠাৎ কেন ফিরে আসবার কথা মনে পড়লো?”

 “কারণ এতোদিন পরে আপনাকে দেবার উপযুক্ত কিছু একটা আমি খুঁজে পেয়েছি। গত আটটা বছর আমি তুরস্কের সুলতানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলাম। সেনাবাহিনীতে আমি অনেক উপরে উঠেছিলাম আর তিনি একটা ব্যাপারে আমার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। যুদ্ধে আমি একবার শাহজাদার প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কিভাবে তিনি আমাকে পুরস্কৃত করবেন। আর সেই সময়ে আমি বুঝতে পারি এবার আমার ফিরে যাবার সময় হয়েছে। শোনেন…” বাবুরীর চোখ যা একটু আগেও বিষণ্ণ দেখাচ্ছিলো তা এখন চকচক করতে থাকে। “তৃর্কীদের কাছে এমন একটা অস্ত্র আছে, যা আমাদের এই অঞ্চলে একেবারে অপরিচিত। সেই অস্ত্রের সাহায্যে আপনি যা ইচ্ছা করতে পারবেন। যাকে ইচ্ছা পরাজিত করতে পারবেন। আমি আপনার জন্য সেই অস্ত্র নিয়ে এসেছি। আর ভাড়াটে তূর্কী যোদ্ধার দল এসেছে আমার সাথে যারা আমার মতো এই অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। আমরা আপনার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে তুলব…যাতে আপনি জগদ্দল পাথরের মতো কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ানো আপনার সেই নিয়তি পরিপূর্ণ করতে পারেন…” শেষ কথাগুলো বলার সময়ে বাবুরীর চোখেমুখে একটা সেঁতো হাসি ফুটে উঠে। আর বাবর তাকিয়ে দেখে তার কৃরিৎকর্মা বন্ধুর, যার উপস্থিত বুদ্ধির ঝলক দেখতে পারে, যা হতে পারে কাঁটাতারের মতো খোঁচা দেয়, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। “তোমার এই হামেহাল অস্ত্রটা আবার কি দ্রব্য?”

 “আপনি কি বোমারু বা তারা মাঝে মাঝে যাকে কামান বলে, তার কথা কি শুনেছেন বা নিদেনপক্ষে ম্যাচলক মাস্কেট?”

 বাবর মাথা নাড়ে অজ্ঞতা জানাতে।

“অস্ত্রটা এতোটাই শক্তিশালী যে আট বছর আগে আমি সুলতানের বাহিনীতে যোগ দেবার ঠিক আগে আগে- তার সেনাবাহিনী পারস্যের শাহ ইসমাইলের বাহিনীকে চালতানের যুদ্ধে এমন গো-হারান হারায় যে পারস্যের অধিকাংশ এলাকা তার হাতছাড়া হয়। আর সীমান্তের নকশা পর্যন্ত বদলে যায়। সেদিন যারা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলো আমি তাদের সাথে পরে কথা বলেছি। তারা বলে শাহের কিজিল-বাশ- লাল পাগড়ী পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী সেদিন হাজারে হাজারে স্রেফ কচুকাটা হয়ে গিয়েছিলো। আমরা শহর অবরোধের সময়ে যে কালো গুড়ো ব্যবহার করি শহর রক্ষাকারী দেয়ালের নিচে মাইন স্থাপনের জন্য, এই অস্ত্রে সেই কালো গুড়োই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তূর্কীরা এর একটা ভিন্ন নাম দিয়েছে বারুদ’। আর সেই সাথে ব্যবহারের একটা নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। আপনি দেখলে বিস্মিত হবেন…”

কিন্তু এসব কিছুই বাবর শুনতে পায় না। এতগুলো বছর যে বন্ধুর অভাব সে অনুভব করেছে, তার অপরিবর্তনীয় সহযোদ্ধা সে ফিরে এসেছে, এই ব্যাপারটা এতোক্ষণে যেনো সে ধীরে ধীরে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। বাবুরীর দিকে তাকিয়ে, সুলতানের দায়িত্বের বোঝা, হতাশা আর নিরাশা সব যেনো নিমেষে দূরীভূত হয়। সবকিছু ছাপিয়ে একটা উদ্দাম আবেগ, বুনো উল্লাস তাকে আপুত করে যে, তার মনে হয় তাকে বুঝি শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলবে। বাবুরী কি বলছে বলতে থাকুক, সেটা পরে শুনলেও চলবে…

বাবরের মনের ভাব বুঝতে পেরেই যেনো বাবুরীও কথা বন্ধ করে। কিছুটা সময় তারা নির্বাক ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে কখন যেনো আধো কান্না আর আধো হাসিতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। বাবরের আবার নিজেকে তরুণ মনে হয়। বর্তমানের প্রাচুর্যে চঞ্চল আর আগামীকালের কোনো ভাবনা সেখানে ঠাই পায় না।

***

 “বাবুরী আমাকে বললো এতোগুলো বছর তোমার কেমন কেটেছে। তুমি কি বিয়ে করেছো…কোনো সন্তান?” সেদিন রাতে বাবরের ব্যক্তিগত কক্ষে একান্তে বসার পরে সে জানতে চায়। তার তখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে সত্যি সত্যি বাবুরীই তার পাশে বসে আছে। তার ভয় হয় যে চোখের পলক পড়লেই বুঝি বাবুরী মরিচীৎকার মতো মিলিয়ে যাবে।

 “আমি আপনাকে বহু বছর আগে বলেছিলাম, স্ত্রী বা সন্তানের কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই…”

 “কিন্তু তুমি কি চাও না যে তোমার পরেও তোমার বংশধরেরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক? তুমি চলে যাবার পরে কে তোমার কথা স্মরণ করবে?”

“হয়তো, আপনার মত বন্ধুরা। সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট…” বাবুরী কথা শেষ করে না। সে যাই হোক, কেউ যদি বিয়ে করে থিতু হতে চায় তবে তাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি সুস্থির হয়ে অবস্থান করতে হবে।”

 “কাবুল ত্যাগ করার পরে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

“আমি ধারণা করেছিলাম আপনি আমাকে চোর খোঁজার মতো খুঁজবেন। আর তাই আমি এমন স্থানে গিয়েছিলাম যেখানে আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন না। আমি একটা সওদাগরী কাফেলার সাথে পশ্চিমে ইস্পাহানে চলে যাই। সেটা ছিলো একটা দীর্ঘ, কষ্টকর আর কখনও বিপজ্জনক একটা ভ্রমণ- পদে পদে উজবেক আর যাযাবর ডাকাত দলকে আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমরা শেষ পর্যন্ত যখন ইস্পাহানে পৌঁছাই ততদিনে বণিক দলের অনেক মারা গিয়েছে। তাদের মালপত্রের একটা ভালো অংশ খোয়া গিয়েছে। কিন্তু যোদ্ধা হিসাবে আমার কুশলতা সবার নজর কেড়েছে। কাফেলা দলের সর্দার উত্তরে তাবরিজে পশম আর রেশমের পসরা নিয়ে যাবে এমন একটা কাফেলার সাথে আমাকে যেতে অনুরোধ করে। আমি সেখানে গিয়ে জানতে পারি আপনি সমরকন্দ হারিয়েছেন। আর পারস্যের শাহ্’র সাথে আপনার মৈত্রীর বন্ধন ঘুচে গিয়েছে। আমি ফিরেই আসতাম কিন্তু কিছু একটা আমাকে ফিরে আসতে বাধা দেয়… সম্ভবত আমি হয়তো ভীত ছিলাম আপনি আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে…সম্ভবত আমার গর্ব আমাকে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছিলো…তারপরে আমার কানে আসে তুরস্কের সুলতান তার সেনাবাহিনীতে ভাল বেতনে লোক নিয়োগ করছে। আমি আমার মতো আরো কিছু ভাগ্যান্বেষীর সাথে যোগ দেই। যাদের কেউ কেউ উত্তরে কাস্পিয়ান হ্রদের তীর থেকে এসেছিলো। আর আমরা একসাথে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ‘সুলতানে যুদ্ধযাত্রায় অংশ নেবার জন্য…”

 “হ্যাঁ, যদিও আমার এখানে আপনার পাশে থাকা উচিত ছিলো… সমরকন্দ আর শাহের ব্যাপারে আমার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেতে ব্যাপারটা আমাকে অস্থির করে তুলেছিলো। আমি প্রায়ই ভাবতাম সমরকন্দ পুনরায় আপনার হাতছাড়া হতে আপনি কতোটা কষ্ট পেয়েছিলেন…”।

“আমার সেটা প্রাপ্য ছিলো…”

 তারা মাথা নত করে চুপচাপ বসে থেকে স্মৃতি রোমন্থন করে। তারপরে বাবুরী জোর করে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে এর বাইরে বের করে আনে। “আমি শুনেছি আপনি আরো স্ত্রী গ্রহণ করেছেন এবং হুমায়ুন আর কামরান ছাড়া আরও দুটো স্বাস্থ্যবান সন্তানের জনক হয়েছেন?”

“ঠিকই শুনেছো।”

“আপনি দেখছি পুরোপুরি সংসারী মানুষে পরিণত হয়েছেন। গ্রামের নিষিদ্ধপল্লীতে দু’পায়ের মাঝে আগুন নিয়ে আমি আর আপনি যখন ঘোড়া নিয়ে দাবড়ে বেড়াতাম, সেটা কত যুগ আগের কথা বলে আজ মনে হয়…ইয়াদগারকে আপনার মনে আছে?”

 “অবশ্যই।” বাবর মুচকি হেসে বলে। “আমি মাঝে মাঝে ভাবি সে এখন কোথায় আছে? আশা করি উজবেকদের হাতে সে ধরা পড়েনি।”

 “মাহাম কি এখনও আগের মতোই সুন্দরী আছে?”

 “সে আগের মতোই আছে- একটুও মোটা হয়নি- আর গুলরুখও তেমনই আছে। তুমি কি আশা করেছিলে…? আমি আজও মাহামকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। তাকেই অন্যদের চেয়ে বেশি কামনা করি, কিন্তু…” বাবর ইতস্তত করে “…আমি প্রথমে যেমন আশা করেছিলাম, সে আমার তেমন সহচরীতে পরিণত হতে পারেনি। আমাদের দেহ আর কামনা মিলিত হয়, কিন্তু আমাদের মন সবসময়ে পরস্পরকে স্পর্শ করতে পারে না… আমি আমার নানীজান, আম্মিজান বা খানজাদার কাছে সবকিছু খুলে বলতে পারি- অভিযান, গুরুত্বপূর্ণ শাহী নিয়োগ- কিন্তু মাহামের সাথে না। সে আসলেই এসব কিছুই বোঝে না…মোটেই আগ্রহী নয় এসব নিয়ে…”

“আপনি সম্ভবত একটু বেশিই আশা করছেন। আপনার পরিবারের মেয়েরা এমন পরিস্থিতির মাঝেই বেড়ে উঠেছে।”

“এতো সহজ না ব্যাপারটা।”

 “আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”

 “মাহাম অসুখী। হুমায়ুনের পরে তার আর কোনো সন্তান বাঁচেনি। পরবর্তীতে তিনবার গর্ভবতী হলেও, দুইবার গর্ভেই সন্তান মারা যায়। আর তৃতীয়বার-সেটাও ছেলে- হাকিম আমাকে মাহামের কক্ষে ডেকে পাঠাবার কয়েক মিনিটের ভিতরে আমার কোলে মারা যায়। মাহাম ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ছিল। যে সন্তানের জন্ম আমরা গভীরভাবে কামনা করেছিলাম সে আমাদের দুজনের চোখের সামনে নিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে স্তব্ধ হয়ে গেলে আমি মাহামের চোখ থেকেও ধীরে ধীরে দীপ্তি নিভে যেতে দেখি। আজ পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমার মনে হয় সেই মুহূর্তে তার সত্ত্বার একটা অংশও মারা গিয়েছিলো।”

 “তার হুমায়ুন বেঁচে আছে…”

 “হ্যাঁ, কিন্তু তারপরেও তার মনে হয় সে ব্যর্থ…যদিও সে আমাকে আক্ষরিক অর্থেই ভালবাসে। আর আমিও মাহামকে খাতির করি। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে এটা একটা অস্পষ্টতার আড়াল তৈরি করেছে।”

 “আপনি কি এজন্যই আরও স্ত্রী গ্রহণ করেছেন? সঙ্গীর জন্য? আত্মার-সহচর খুঁজে পেতে?”

 “আমার সেরকম কোনো প্রত্যাশা ছিলো না। আমার আবারও বিয়ে করার পেছনে বাস্তব বিষয়বুদ্ধি কাজ করেছে। একজন সুলতানের অনেক উত্তরাধিকারী থাকাটা উত্তম। আর বিশ্বস্ত অনুসারী এবং শক্তিশালী গোত্রের সাথে আত্মীয়তা করার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

 “আপনার নতুন স্ত্রীরা কে কেমন?”

বাবর কাবুলের কাছে পাহাড়ী এলাকার ইউসুফজাই গোত্রের শক্তিশালী সর্দারের কন্যা দীর্ঘাঙ্গি, তন্বী দেখতে বিবি মুবারকের কথা ভাবে এবং ছোট চ্যাপ্টা নাকের নাদুসনুদুস দিলবার, যার বাবা উজবেক আক্রমণের কারণে হিরাত থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পালিয়ে কাবুলে এসে নিজের আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন। তুমি যদি জানতে চেয়ে থাকো তবে বলি, তারা কেউই অসাধারণ সুন্দরী না। কিন্তু ভালো মেয়ে…”।

“শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে ভালো?”

 “যথেষ্ট ভালো…”

 “এরাই কি আপনার ছোট দুই ছেলের মা?”

 “ছয় বছর আগে গুলরুখের গর্ভে কামরানের এক ভাই হয়েছে, পিচ্চি আসকারী। তারপরে তিন বছর পরে, দিলবারের একটা ছেলে হয়েছে।”

 “আর মাহাম? তার জন্য এটা অবশ্যই কষ্টকর।”

বাবরের মুখটা শক্ত হয়ে যায়। বহু বছর আগে…নববধূ হিসাবে তার সামনে যখন পুরো জীবনটা পড়ে ছিলো, সে তখন কোনো প্রশ্ন না করেই গুলরুখের সাথে আমার বিয়েটা মেনে নেয়। কিন্তু আমি যখন অন্য স্ত্রী গ্রহণ করি তখন তার বিষাদময়তা অস্বাভাবিক। আমার নবপরিণীতা স্ত্রীরা গর্ভবতী হবার খবর চাউর হলে তার কষ্টের কোনো সীমাপরিসীমা থাকে না। বাইসানগার, তার নিজের বাবা, কিংবা খানজাদা তাকে শান্ত করতে পারেনি। একরাতে সে কাপের ভাঙা টুকরো দিয়ে সে নিজের কব্জি কাটতে চেষ্টা করে। আমার হেকিম মাদকদ্রব্য কামালি আর সুরার সাহায্যে। প্রস্তুত শক্তিশালী মিশ্রণ তৈরি করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে…”

“আর সে এখনও অসুখী?”

“না…অবশ্য তার একটা কারণ আছে। চার বছর আগে, হিন্দুস্তানের সীমান্তের কাছে আমি একটা অভিযানে যাই, মাহাম তখন আমাকে চিঠি লিখে জানায় যে দিলবার সন্তানসম্ভবা। সে চিঠির শেষে লিখেছিলো, “তার ছেলে কি মেয়ে হবে, আমি জানি না। তার সন্তান আমাকে দিন, আমি নিজের সন্তানের মতো তাকে মানুষ করে আমার দুঃখ ভুলে থাকতে চাই।”

“আপনি কি বলেছিলেন?”

 “সিদ্ধান্তটা নেয়াটা কঠিন ছিলো। আমি জানতাম দিলবারের সাথে আমি অন্যায় করছি। কিন্তু মাহাম খুশি হবে এমন কিছু একটা থেকে আমি তাকে কিভাবে না বলি? আমি তাকে লিখে পাঠাই দিলবারের সন্তান এখনও ভূমিষ্ঠ না হলেও, সেটা মাহামেরই সন্তান। আর যেমনটা সবাই ভেবেছিলো, সেবার দিলবারের ছেলেই হয়েছিলো…”।

“তার নাম কি?”

 “হিন্দাল।”

বাবুরী বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। তার মানে হিন্দুস্তানের বিজেতা।”

“মুহূর্তের উত্তেজনার বশে আমি নামটা রেখেছিলাম। আমি অভিযানে থাকাকালীন অবস্থাতেই আমি হিন্দালের জন্মের খবর পাই। হয়তো পুরোটাই আমার কল্পনা ছিলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো যে সমস্ত সম্পদ আর সম্ভাবনা নিয়ে হিন্দুস্তানেই আমার ভাগ্য নিহিত আছে। কেবল আমি যদি একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারি…”

 “বহু বছর আগে আমি আর আপনি যখন হিন্দুস্তানের সীমান্তের কাছে অভিযান পরিচালনার সময়ে আলাপ করেছিলাম। আপনার কি সেই অনন্ত আকাশ আর কমলা রঙের তীব্র সূর্যের কথা মনে আছে?”

 “অবশ্যই- আর আমাদের দেখা সেই হ্রদের কথা যেখানে লাল ডানার পাখির ঝাঁক দেখে মনে হয়েছিলো কেউ বুঝি সেটা রক্তে রাঙিয়ে দিয়েছে…সেসব স্মৃতি ভুলে যাওয়াটা বেশ কষ্টকর।” বাবর হলুদ জরির কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দেয়া অবস্থা থেকে উঠে খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতের আঁধারে যেমনটা থাকার কথা, নিচের প্রাঙ্গনের দুপাশের প্রবেশপথে জ্বলতে থাকা মশালের আলোতে সবকিছু থমথম করছে। “কিন্তু মুশকিল হলো হিন্দালের এখন তিন বছর বয়স। আর আমি হিন্দুস্তান বা অন্য কোথাও আমার স্বপ্নের সাম্রাজ্য স্থাপনের কাজ কিছুই আরম্ভ করতে পারিনি…আমি জানি আমার যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমার অভিজাত অমার্ত আর সেনাপতিরা যখন আমাকে দেখে- এমনকি বাইসানগার পর্যন্ত যে বহুদিন আমার সাথে রয়েছে আমার মাঝে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত এমন একজন সুলতানকে দেখতে পায় যাকে বিব্রত করার মতো তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। তারা কখনও আমাকে ঘিরে থাকা হতাশা বা অপূর্ণতা টের পায় না। আর তার টের পাবেই বা কিভাবে? আমি কখনও তাদের সেটা বলতে পারবো না…”

“খানজাদা এসব কিছু টের পায় না? আমার ধারণা আপনার বোনের চোখে এসব যাবে না।”

 “সে আমার ভিতরের অস্থিরতা টের পায়- আমি নিশ্চিত। কিন্তু তার নিজের সেই ভাগ্য বিপর্যয়ের পরে আমি তাকে আমার আকাশচুম্বী স্বপ্ন আর স্বার্থপর ভাবনার বোঝা তার উপরে চাপিয়ে দিতে চাই না- তার নিজের সহ্য করা মানসিক কষ্টের সাথে এর কোনো তুলনাই চলে না…আর মাহামের সাথেও আমি এসব নিয়ে আলোচনা করতে পারবো না। তাহলে সে এমনই বিষণ্ণ হয়ে উঠবে যে, আমার তখন মনে হবে আমি বুঝি তারই সমালোচনা করছি। শুধু তুমি যদি এখানে থাকতে তাহলে সবকিছু হয়তো আলাদা হতো। তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না যে, আমার জীবনটা কেমন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এবং প্রাচুর্যের মাঝে জীবন কাটাচ্ছি, কিন্তু কখনও কখনও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই একই ঈর্ষণীয় জীবনযাপন করতে দেখে একে কলুর বলদের মতো জীবনযাপন মনে হয়। মাঝে মাঝে নিজের হতাশার বোঝা লাঘব করতে আমি সুরাপানের আসর আয়োজন করি। সেখানে আমার অমাত্যদের সাথে মিলিত হয়ে আমরা আমার রাজ্যের বিভিন্ন শক্তিশালী সুরার স্বাদ পরখ করি- যেমন এই মুহূর্তে আমরা গজনীর লাল ওয়াইন পান করছি। আমরা ভোর পর্যন্ত পানাহারে মত্ত থাকি। যখন আমার পরিচারকের দল আমাকে বহন করে আমার কক্ষে পৌঁছে দেয় মাথা বিস্মৃতির অতলে ডুবে আছে। কখনও কখনও আমি আফিম আর ভাঙ- গাঁজা সেবন করি। তারা আমাকে একটা উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত সব সম্ভবের দুনিয়ায় নিয়ে যায়।”

“এতে লজ্জিত হবার কিছু নেই।”

“কিন্তু এই জীবনে কোনো মহত্ত্ব নেই। আমার আত্মা আজঅব্দি যে গৌরবের জন্য লালায়িত, সেটা কোথায়? আমার প্রায় দুই কুড়ি বয়স হতে চললো। আর আমিও আমার মরহুম আব্বাজান যেমন ফারগানায় আটকে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনই নিয়তি বরণ করতে চলেছি। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের চির পরিচিত সেই পুরাতন তৈমূরীয় জগত ধবংস হয়ে গেছে। উজবেক বর্বরের দল চিরতরে তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আমার জন্য তার কিছুই আর বেঁচে নেই।” বাবরের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। সে বাবুরীর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমি জানি আমার কথাগুলো স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞের মতো শোনাচ্ছে… আমি এই কথাগুলো কখনও কাউকে বলিনি, আর তোমাকেও বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না…তুমি সবসময়ে আমার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুহূর্তগুলো নিয়ে নির্মম রসিকতা করেছো…”

“না, আপনার দ্বিধা নিয়ে রসিকতা করিনি কখনও। কেবল আপনার আত্ম-বঞ্চনার অনুভূতি আমার অসহ্য মনে হয়। কিন্তু বিগত বছরগুলো আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। নিজের মতামতের উপরে আমার অশেষ আস্থা ছিলো, যা ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে। আমি আপনার চেয়েও অহংকারী ছিলাম। যদিও আপনিই ছিলেন আমাদের সুলতান, আমি নই। এখন আমি বুঝতে পারি…আমি এখন জানি মনেপ্রাণে কিছু কামনা করে সেটা অর্জনের পথ খুঁজে না পেলে কেমন কষ্টকর সেই অভিজ্ঞতা।”

“তুমি আবার কিসের মোহে পড়লে?”

 “ফিরে আসবার…”

“তুমি থাকতে এসেছো?”

 “হ্যা…একসাথে অন্তত আরেকটা যুদ্ধ লড়াই না করা পর্যন্ত…”

*

বাবুরী পাঁচ ফিট লম্বা একটা ব্রোঞ্জের নলের একপ্রান্তে আলতো করে চাপড় দেয়। “এটাকে ব্যারেল বলে। প্রথমে বারুদ ভর্তি কাপড়ের ব্যাগ আর গোলা এটার ভিতরে ঠেসে ভরা হয়। আর এটা,” সে ব্যারেলের শেষ প্রান্তে ফুলে থাকা একটা জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে, “এটাকে বলে ব্রীচ। এই ছোট ফাটলটা খেয়াল করেছেন? তূর্কীরা এটাকে বলে স্পর্শ-র। এখানেই- আগুন দেবার ঠিক আগে গোলন্দাজের দল একটা তীক্ষ্ণ ধাতব শলাকা প্রবিষ্ট করায়- গোঁজ- বারুদের বস্তা ছিঁড়ে দিতে। তারপরে একজন একটা জ্বলন্ত মোম মাখানো শলাকা স্পর্শ-রন্ধ্রে প্রবিষ্ট করে ব্যারেলের ভিতরের মূল বারুদে অগ্নিসংযোগ করতে।”

“একটা গোলা কতদূরে নিক্ষেপ করা সম্ভব?”

 “পুরো ব্যাপারটা ব্যারেলের দৈর্ঘ আর গহ্বরের ব্যাসের উপরে- যাকে বোর বলা হয়। ব্যারেল যত লম্বা আর বোর যতো বড় হবে, নিক্ষেপণ পাল্লা ততোবেশি হবে। তূর্কী সুলতানের অনেক কামান আছে যেগুলোর ব্যারেল দশফিট বা তারচেয়ে বেশি লম্বা এবং ওজন বিশ হাজার পাউন্ডের বেশি। কিন্তু ইস্তাম্বুল দখল করার সময়ে সত্তর বছর আগে যে অতিকায় তূর্কী বোমারু ব্যবহার করেছিলেন তার তুলনায় এগুলো সবই দুগ্ধপোষ্য। আপনি যদি সেটা একবার দেখতেন! ত্রিশ ইঞ্চি বোরের সতের ফুট লম্বা ব্যারেল। আর সেটা দিয়ে বারোশো পাউন্ডের গোলা এক মাইল দূরে নিক্ষেপ করা যায়। তারা বলে দশ মাইল দূর থেকে এর আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু সেটা দিয়ে দিনে মাত্র পনের বার গোলাবর্ষণ করা যায় আর দুইশ গোলন্দাজ প্রয়োজন হয় সেটা পরিচালনা করতে। এতই ভারী সেটা যে দশ হাজার লোক মিলে সেটা উত্তোলন করতে পারে এবং সত্তরটা শক্তিশালী আঁড় সেটা স্থানান্তরিত করতে পারে, এগুলোর মতো না।”

“আমাকে এর কেরামতি দেখাও…” বাবর অলৌকিক অস্ত্রটার কারিশমা দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তিনশ গজ দূরে বাবরের লোকদের তৈরি করা একটা দশ ফিট উঁচু স্তূপকে নিশানা হিসাবে নির্বাচন করা হয়।

মাথায় এঁটে বসা চামড়ার গোলাকার টুপি, চামড়ার জোব্বা আর চোগা পরিহিত পাঁচজন যোদ্ধাকে বাবুরী আদেশ দেয়। পোলো খেলার ম্যালেটের মতো অনেকটা দেখতে, একটাই পার্থক্য যে এর মাথার দিকটা ভেড়ার চামড়া দিয়ে মোড়া। একটা লম্বা লাঠির সাহায্যে একজন বারুদের থলে ব্যারেলের ভিতরে ঠেসে ভরে। তারপরে অন্য দু’জন হাঁফাতে হাঁফাতে একটা গোলাকার পাথরের খণ্ড উঁচু করে ব্যারেলে প্রবেশ করায় আবার সেই লাঠিটার সাহায্যে- ব্রীচের ভিতর দিয়ে সেটা গড়িয়ে দেয়। এদের কাজ শেষ হতে, চতুর্থ আরেকজন গোঁজ হাতে এগিয়ে আসে বারুদের থলে ফাটাতে সেটা ফাটলের ভিতরে প্রবিষ্ট করায় এবং স্পর্শ-রন্ধ্রের চারপাশে সামান্য আলগা বারুদ ছড়িয়ে দেয়- “নিশ্চিত হবার জন্য,” বাবুরী ব্যাখ্যা করে।

 “পেছনে সরে দাঁড়ান।” বাবর নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিত হবার পরেই কেবল সে কামানের দিকে এগিয়ে যায় এবং ব্যারেলের নতি পরীক্ষা করে। সন্তুষ্ট হয়ে সে পিছনে সরে এসে, পঞ্চম গোলন্দাজকে ইশারা করে। তার হাতে একটা অঙ্কুশের মত জিনিস। যেটার সাথে তেলে ভেজানো একটা সুতা লাগানো, যার একপ্রান্তে আগুন জ্বলছে। লোকটা বাবুরীর দিকে তাকায়।

“আগুন দাও!”

লোকটা তার হাতে ধরা প্রজ্জ্বলিত সলতে স্পর্শ-রন্ধ্রে খুঁজে দিয়েই লাফিয়ে পেছনে সরে যায়। মুহূর্ত পরে, একটা বিকট বুম শব্দের সাথে ব্যারেল থেকে পাথরটা নিক্ষিপ্ত হয়ে তৃণভূমির উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আছড়ে পড়ে। একটা ধোঁয়ার মেঘের জন্ম হয় এবং সেটা কেটে যেতে, বাবর তাকিয়ে দেখে পাথরের চূড়াটা এখন একটা ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে।

 “নমুনাটা একবার দেখুন!” বাবুরী গর্বিত কণ্ঠে বলে। “চালতানে, সুলতান সেলিম ঠিক এধরণের একসারি কামান, গরুর গাড়ির বহরের দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায়, ব্যবহার করেছিলেন ফলে পারস্যের সেনাবাহিনীর কিছুই করার ছিলো না…এরপরে তূর্কী পদাতিক সামনে এগিয়ে গিয়ে হাতের ম্যাচলক দিয়ে তখন প্রতিরোধ গড়তে ইচ্ছুক বাকী পার্সী সৈন্যদের ধরাশায়ী করে…”

 বাবুরী হাততালি দিতে তার লোকেরা একটা লম্বা সরু কাঠের বাক্স বয়ে এসে তার পায়ের কাছে নামিয়ে রাখে। “আপনি বহুদিন আগে আমাকে তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আপনি আমাকে ওস্তাদ ধনুর্ধর, কোর বেগি, বানিয়েছিলেন। আমি এবার আপনাকে এটার সাহায্যে নিশানাভেদ করতে শেখাবো।” বাবুরী ঝুঁকে পড়ে বাক্স থেকে একটা লম্বা ধাতব বস্তু তুলে নেয়। “সর্বোৎকৃষ্ট ইস্পাত দিয়ে এটা নির্মাণ করা হয়েছে।”

“আকৃতি দেখে ছোট কামান বলে মনে হচ্ছে।”

“ঠিক তাই। এটাকে বলে মাস্কেট- ক্ষুদ্রাকৃতি কামান। ভাল করে খেয়াল করে দেখেন এর একটা লম্বা ব্যারেল রয়েছে ধাতব গোলা নিক্ষেপ করার জন্য। এর ম্যাচলক যান্ত্রিক ব্যবস্থা, এই নামেই এটাকে অভিহিত করা হয়। এটা অনেকটা এভাবে কাজ করে। আপনি এখানে বারুদ দেবেন, এই পাত্রে, তারপরে একটুকরো পাতলা দড়ির প্রান্তে অগ্নি সংযোগ করবেন। আগুনের শিখা বারুদ স্পর্শ করে সেটাকে প্রজ্জ্বলিত করবে এবং উৎপন্ন শক্তি ব্যারেল থেকে ক্ষুদ্র গোলকটা প্রচণ্ড বেগে নিক্ষেপে সাহায্য করবে।”

 “কতো দূরে?”

“কমবেশি দুইশ গজ দূরত্বে। কিন্তু পঞ্চাশ গজের ভিতরে সবচেয়ে কার্যকরী এর নিশানা। পরীক্ষা করে দেখেন!”

তূর্কীদের একজন একটা দণ্ডের মাথায় লক্ষ্যবস্তু হিসাবে তরমুজ স্থাপন করতে, বাবুরী পাত্রে বারুদ ঢেলে গুলিটা ব্যারেলে প্রবেশ করায়। “ওজনের কারণে সৃষ্ট অসুবিধা নিশানা স্থির করার সময়ে এই হাতলের উপর আপনি ব্যারেলটা স্থাপন করবেন। বাবুরী চারফিট লম্বা একটা ধাতব দণ্ডের দিকে, যার মাথার দিকটা দুভাগ হয়ে অনেকটা অঙ্কুশের আকার নিয়েছে, সেদিকে ইঙ্গিত করে। দণ্ডটার একপ্রান্ত মাটিতে প্রোথিত করে সে বাবরকে দেখায় কিভাবে ব্যারেলটা সেটায় স্থাপন করতে হবে। “ব্যারেলের উপর দিয়ে সোজা নিশানার দিকে তাকান, এবং মনে রাখবেন যখন গুলি করবেন তখন একটা ধাক্কা অনুভব করবেন তাই সেজন্য প্রস্তুত থাকবেন।”

বাবর মাস্কেটটা নিয়ে সেটার বাট নিজের কাঁধে স্থাপন করে বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখে চকচকে ব্যারেলটা বরাবর তাকায়। সে তরমুজটা দৃশ্যপটে দেখতে পেয়েছে বোঝার পরে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করে। বাবুরী দড়ির প্রান্তে অগ্নিসংযোগ করে যা নিমেষে জুলতে শুরু করে।

“মাস্কেটটা স্থির রাখবেন…” বাবুরীর কথা শেষ হবার আগেই একটা তীক্ষ্ণ শব্দে ধাতব বলটা নিক্ষিপ্ত হয় এবং তরমুজের উধ্বাংশ নিমেষে কমলা রঙের ছাতুতে পরিণত হয়… “দারুণ। কিন্তু আমার অভিজ্ঞ বন্দুকবাজরা এর সাহায্যে কি ভেল্কি দেখাতে পারে সেটা আপনাকে দেখাই…” সে আরেকপ্রস্ত লক্ষ্যবস্তুর দিকে ইঙ্গিত করে: পঞ্চাশ গজ দূরে একটা কাঠের পায়ার উপরে স্থাপিত টেবিলে রাখা পনেরটা খড়ের পুতুল। বাবুরীর সমান সংখ্যক বন্দুকবাজ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে নিশানা স্থির করে। মাস্কেটে বারুদ ভরে এবং একের পর এক নিখুঁত দক্ষতায় লক্ষ্যভেদ করে। তারপরে পিছিয়ে এসে চটপটে ভঙ্গিতে মাস্কেটে বারুদ ভরে এবং সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পনের জনের বারুদ ভরা শেষ হতে তারা একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতলের উপরে ব্যারেল স্থাপন করে আরো দূরে স্থাপিত মাটির পাত্র লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এবারও প্রতিটা লোকই লক্ষ্যভেদ করে।

“অবশ্য যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, আঙ্গুল কাঁপতে পারে, লক্ষ্যবস্তু নড়াচড়া করে কিন্তু আমি এই বন্দুক দিয়ে আগুয়ান সৈন্যদের সারি ছিন্ন ভিন্ন করতে দেখেছি।”

তার বন্ধুর প্রদর্শিত এই অলৌকিক অস্ত্রের ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে বাবরের মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকা ভাবনা কথায় প্রকাশ করতে গিয়ে সে বাবুরীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে নিজের শব্দ সতর্কতার সাথে নির্ধারণ করে। তার আর তার সাম্রাজ্যের উপরে যেনো আরো একবার উজ্জ্বল গনগনে ক্যানোপাস মেঘের আড়াল সরিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে।

“তুমি কেবলই আমার বন্ধু নও। তুমি আমার প্রেরণা। তুমি অস্ত্রের চেয়েও বেশি কিছু আমার জন্য নিয়ে এসেছো…এখন পর্যন্ত, আমার, হিন্দুস্তানে একটা পুরোদস্তুর আক্রমণের আকাক্ষার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। আমার না ছিলো লোকবল, না ছিলো কোনো বাড়তি সুবিধা। প্রতিপক্ষ ছিলো অগণিত আর শক্তিশালী। তাদের অধিরাজ দিল্লীর গর্বিত, অহংকারী ইবরাহিম লোদি। হিন্দুস্তান দখল করতে হলে আমাকে তার বিশাল সেনাবাহিনী আর যুদ্ধবাজ হাতির বহরকে পরাস্ত করতে হবে। এই নতুন অস্ত্রের সাহায্যে আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে তাকে পরাজিত করা সম্ভব। আমার জন্মস্থানে আমি হয়তো তৈমূরের মতো মহান সম্রাটে পরিণত হতে পারবো না। কিন্তু এই কামান আর বন্দুকের সাহায্যে আমি তার সিন্ধু থেকে দিল্লী অভিযানের মাত্রা ছাপিয়ে যেতে পারবো। এতোগুলো বছর আমরা যে স্বপ্ন দেখেছি এবার সেটা পূর্ণ হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *