৪.১ কোরানে আল্লাহ

চতুর্থ অধ্যায় : অধিবিদ্যা : কোরানে আল্লাহ

নয়টি উজ্জ্বল গম্বুজের (গ্রহ) পাশে আমাদের পৃথিবীটা আসলে মহাসাগরে ভাসমান একটা ক্ষুদ্র পোস্তদানার মত। কিন্তু নিজেকে যখন আমরা সেই পোস্তদানার সাথে তুলনা করি তখন নিজেদেরই আবার হাস্যকর রকম ক্ষুদ্র বলেই প্রতীয়মান হয়।–শাবেস্তারি(৭৮)

 

আমাদের পৃথিবী যাকে চতুর্দশ শতাব্দীর পারস্যের খ্যাতিমান সুফি কবি মাহমুদ শাবেস্তারি সামান্য একটা পোস্তদানার সাথে তুলনা করেছেন, আসলে এর ওজন ছয় হাজার বিলিয়ন টন, পরিধি ৪০, ০৭৬ কিলোমিটার এবং ভূপৃষ্ঠের মোট ক্ষেত্রফল ৫১০,১০০,০০০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু অন্যান্য গ্রহের তুলনায় পৃথিবী ক্ষুদ্র একটা গ্রহ মাত্র। সূর্যের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর ৩৬৫ দিনের সামান্য কিছু বেশি সময় লাগে। সৌরজগতের অন্য ৮টি গ্রহও নির্ধারিত কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে। সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ প্লুটো যা তুলনামূলকভাবে অল্প ভরবিশিষ্ট (প্রায় বুধের সমান) এবং এর কক্ষপথ সূর্য থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন থেকে ৭.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার পর্যন্ত দূরবর্তী। উল্লেখ্য ১৯৩০ সালের দিকে প্লুটোর আনুষ্ঠানিক নামকরণ হলেও, ২০০৬ সালের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের ২৬তম সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্লুটো আর আমাদের সৌরজগতের গ্রহ নয়, এটি বামন গ্রহ বলে পরিচিত হবে।-অনুবাদক। প্লুটো থেকে সূর্যের বিশাল দূরত্বকে আমাদের কল্পনার মধ্যে নিয়ে আসার সুবিধার্থে এভাবে ভাবতে পারি, একটি জেট বিমান যদি ঘণ্টায় ১০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে তবে সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্ব অতিক্রম করতে বিমানটির ৭০০ বছর সময় লাগবে। আবার সূর্যের মহাকর্ষ বলের কার্যকর প্রভাব শুধু প্লুটো পর্যন্ত নয়, বরং তা সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্বের শতগুণ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এই দূরত্ব অতিক্রম করতে জেট বিমানের পূর্বোক্ত গতিতে সত্তর হাজার বছর লাগবে।

আবার সূর্য আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল নক্ষত্র হওয়া সত্ত্বেও এটি আকাশ গঙ্গা ছায়াপথের মধ্যম আকৃতির একটি তারকা মাত্র। আকাশ গঙ্গা ছায়াপথকে ফার্সি ভাষায় কাহকাসান (হলুদাভ ফিতা) বলা হয়, কারণ গ্রীষ্মের রাতে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালে একে কিছুটা হলুদাভ ডোরাকাটা দাগের মত দেখায়। আকাশ গঙ্গা ছায়াপথে এখন পর্যন্ত সাত হাজার তারকা চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের প্রায় সবারই সূর্যের মত আলাদা গ্রহমণ্ডলী রয়েছে।

মহাসাগরে ভাসমান আমাদের এই পৃথিবী নামক পোস্তদানটির পৃষ্ঠতল মোট ৫১০, ১০০ ০০০ বর্গকিলোমিটার এবং এর আয়তন ১, ০৮২, ৮৪২, ২১০, ০০০ ঘনকিলোমিটার যা সূর্যের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। পৃথিবী থেকে সূর্য কত বড় সেটা আমরা এইভাবে তুলনা করলে বুঝতে পারি, সূর্যকে যদি আমরা একটি ফাঁপা গোলক হিসাবে বিবেচনা করলে তবে এক মিলিয়ন সংখ্যক পৃথিবী গোলকের মধ্যে স্থান করে নিতে পারবে। কেবল সূর্যই আমাদের সৌরজগতের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ পদার্থ নিয়ে গঠিত আর বাকি ৯টি গ্রহ ০.১৪ ভাগ নিয়ে গঠিত যার মধ্যে পৃথিবী ও তার চাঁদ শতকরা ০.০০১৪ ভাগ পদার্থ নিয়ে গঠিত।

মহাকাশে সূর্যের চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বড় নক্ষত্রও রয়েছে যেখানে সূর্যের ব্যাস ১, ৩৯২ ০০০ কিলোমিটার ও এবং এর আনুমানিক ভর হচ্ছে ১, ২০০ ০০০, ০০০ বিলিয়ন টন। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে মহাকাশের আকাশ-গঙ্গা ছায়াপথের একটি নক্ষত্র হচ্ছে সূর্য। হিসাব করে দেখা গেছে মহাকাশের প্রতিটি ছায়াপথে কমপক্ষে একশ বিলিয়ন করে নক্ষত্র রয়েছে। উন্নত টেলিস্কোপ ও গাণিতিক বিশ্লষণের সাহায্যে পাওয়া তথ্য অনুসারে মহাকাশে আমাদের আকাশ গঙ্গা ছায়াপথসহ প্রায় ১০০ মিলিয়ন ছায়াপথ ছড়িয়ে আছে।

সাধারণত আমাদের চারপাশের দূরত্ব মাপতে যে ধরনের হিসাব ব্যবহার করি, সেভাবে নক্ষত্রদের মধ্যকার দূরত্ব মাপা অনেকের কাছেই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং এর মাধ্যমে সহজে বোধগম্যও হয় না। এ-জন্য মহাকাশে নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপতে আলোকবর্ষের হিসাব ব্যবহার করা হয়। সূর্যের আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০০ ০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে এবং এক বছরে (এক আলোকবর্ষ) আলো প্রায় ৯.৪৬০ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। মহাকাশের অনেক নক্ষত্রই আমাদের থেকে এত দূরে অবস্থিত যে এগুলো থেকে আলো এসে পৌঁছতে প্রায় শত থেকে হাজার খানেক বছর লেগে যায়।

মহাকাশ সম্পর্কে উপরের এই হিসাব-নিকাশ আমাদেরকে একদম হতবুদ্ধি করে দেয় এবং এর বিশালতা সম্পর্কে এমন একটা অস্পষ্ট ধারণা দেয়। কিন্তু একইসাথে পরিষ্কারভাবে এটাই দেখায় যে, পৃথিবী আসলে বিশাল একটা মহাসাগরে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র পোস্তদানা মাত্র। যেকোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি যদি মহাবিশ্বের এ বিশালতা উপলব্ধি করতে চায় তবে সে নিজেকে অসহায় মনে করতে বাধ্য। আপাত প্রতীয়মান অসীম মহাবিশ্বের যদি কোনো সীমা থেকেও থাকে তবে সেটা মানুষের এখনও অবোধগম্য। যদি এই অসীম মহাবিশ্বের একটা সীমা থাকেও এবং এর একটা শুরুর কাল থাকে তবে তাও আমাদের কাছে অবোধগম্য বলে মনে হয়। বিশাল এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা হিসেবে আমরা যদি এখানে আল্লাহ বা ঈশ্বরকে নিয়ে আসি তবে আমাদেরকে আগেই ধরে নিতে হবে তিনি মহাবিশ্ব থেকে অনেক বড় এবং এর উর্ধ্বে। বিশাল এই মহাকাশের বিস্ময় উদ্রেককর ব্যবস্থার একজন নিয়ন্ত্রক রয়েছেন বলে যদি ধরে নিতে হয় তবে পূর্বেই আমরা ভেবে নেব তিনি অসীম ক্ষমতাধর হবেন। তাই এ ধরনের স্রষ্টা বা নিয়ন্ত্রক আমাদের সীমাবদ্ধ বোধশক্তিরও অতীত হবেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারস্যের জনপ্রিয় সুফি সাধক জালালউদ্দিন রুমি যেমনটি বলেছেন : তিনি তাই যা আমাদের জন্য অকল্পনীয়। সাধারণভাবে মানুষ খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে নিরীক্ষা করলে দেখা যায় মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বৃহৎ কিছু বলে ধরে নেয়, তাঁর মধ্যে মানুষের মতই আবেগ, দুর্বলতা, আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ রয়েছে।

হাদিসে একটি আরবি লোককথা রয়েছে এবং এটা বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (ওল্ড টেস্টামেন্ট) থেকেই এসেছে, তা হল : ঈশ্বর মানুষকে তাঁর নিজের মত করে সৃষ্টি করেছেন। তবে সত্য হচ্ছে এর বিপরীত। স্বয়ং মানুষই ঈশ্বরকে নিজের মত করে সৃষ্টি (বা কল্পনা) করে নিয়েছে। কিছুদিন আগে এবং মুসা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছেন নামে একটি বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক বই লেখা হয়েছে যা হঠাৎ করেই আমার নজরে আসে। ওল্ড টেস্টামেন্টের এবং ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেনবাক্যটিকে ব্যবহার করে এ বইতে যুক্তির সাহায্যে দেখানো হয়েছে যে উল্টোটাই সঠিক, ঈশ্বর বরং মুসার কল্পনার ফসল। ওল্ড টেস্টামেন্টে আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই অত্যন্ত উদ্ধত, রাগী, নির্মম ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য উন্মুখ। অগণিত সৃষ্টির মধ্যে তিনি আব্রাহামকে পছন্দ করেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাধ্যগত এবং আব্রাহামের বংশধরদেরকেও ঈশ্বর নির্বাচন করলেন পৃথিবীর অধিপতি হিসাবে।

নুহের পরে আব্রাহামকে সবচেয়ে বেশি বাধ্য এবং বিনীত বান্দা হিসাবে পাওয়ায় ঈশ্বর তাকেই পছন্দ করলেন এবং একই কারণে আব্রাহামের স্ত্রী সারাহকে অন্তঃসত্ত্বা হতে সমর্থ করলেন যাতে বৃদ্ধ বয়সে তিনি ইসহাকের জন্ম দিতে পারেন। ঈশ্বরের পছন্দের লোকদের জনক হওয়ার জন্য ও কেনানে ইসহাকের সাথে বিবাহযোগ্য কোনো রমণী না থাকায় ঈশ্বরের নির্দেশে আব্রাহাম ক্যালডিয়ায় দূত পাঠালেন যিনি ইসহাকের সাথে আব্রাহামের ভ্রাতুষ্পপুত্র রেবেকাকে বিবাহের জন্য বাগদানের অনুরোধ করেছিলেন ও রেবেকাকে ফিলিস্তিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ঈশ্বর ইসরাইলের সন্তানদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পেলেন যে তারা অন্য কারো উপাসনা করবে না এবং এর পরিবর্তে তারা পৃথিবীর শাসনকর্তা হবে। বিশাল এই মহাবিশ্বের প্রতিপালকের সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু সৌরজগতের বা পৃথিবীর প্রতি নিবদ্ধ হয়নি বরং তা কেবল সীমাবদ্ধ ছিল পৃথিবীপৃষ্ঠের অতিক্ষুদ্র একটি অংশের প্রতি, যার নাম ছিল ফিলিস্তিন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যে-সকল নবি-রসুল ও জনপদের ঘটনাবলীর বর্ণনা পাই তার প্রায় সবটাই কেবল স্থানীয়, বিশ্বের অন্যান্য অংশের কোনো উল্লেখ নেই, বিষয়টি নিঃসন্দেহে কৌতুহল উদ্রেককর-অনুবাদক)।

একদা ঈশ্বর সদম ও গমোরাহ শহরের অধিবাসীদের অসদাচারণ ও পাপাচার দেখে এত ক্রুদ্ধ হোন যে তিনি শহরদ্বয় ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র আব্রাহামের সুপারিশও কাজে আসেনি। ঈশ্বরের নির্দেশে বজ্রপাতে সকল লোক মারা গেল। নারী, পুরুষ, মহিলা, শিশু, দোষী, নির্দোষ কেউই বাদ গেল না। ব্যতিক্রম কেবল ঘটলো আব্রাহামের ভ্রাতুষ্পপুত্র লুতের ক্ষেত্রে, যাকে ঈশ্বরের আদেশে ফেরেশতাগণ এই গণহত্যা থেকে নিরাপদ রেখেছিলেন। সম্পূর্ণ ওল্ড টেস্টামেন্ট জুড়ে ঈশ্বরকে অস্থিরমতি, নির্দয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। বাইবেল থেকে দেখা যায় মুসারও একই রকম স্বৈরতান্ত্রিক মনোবৃত্তি ছিল। ডেভিড ও সলোমনও তাঁদের রাজত্বকালে ইসরাইলিদের শাসনের ক্ষেত্রে একই ধরনের ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। উরিয়ার স্ত্রী’র (বাথ-সেবা, বাইবেলে বর্ণিত উরিয়ার স্ত্রী। ডেভিড তাঁকে প্ররোচিত করে তাঁর স্বামীকে হত্যা করেন এবং তাঁকে বিয়ে করেন) কাহিনী থেকে দেখা যায়, অন্য মানুষের অধিকারের ব্যাপারে ডেভিডের সমানবোধ খুব সামান্যই ছিল।

কোরানে আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট ও সদ্বগুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সব অভাব থেকে মুক্ত এবং করুণাময়। শুধু এগুলো নয়, তিনি কর্তৃত্বব্যঞ্জক, ক্রুদ্ধ এবং ছলনাকারী। যেমন সুরা আনফালের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ; বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম। সুরা আল ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। স্রষ্টার এই গুণাবলী পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যদি সর্বশক্তিমান স্রষ্টা পূর্ণ সত্তা এবং পরমোৎকর্ষ গুণাবলীসম্পন্ন হয়ে থাকেন তবে তিনি কিভাবে রাগ করা বা প্রতিশোধ নেয়ার মত চরিত্র ধারণ করেন? [ দেখুন সুরা সাজদাহ ; আয়াত ২২]

সুরা জুকরুফ ; আয়াত ৪১ ও ৫৫ ইত্যাদি-অনুবাদক)। যেখানে স্রষ্টা সর্বশক্তিমান সেখানে তাঁর রাগ করা বা ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রয়োজন কী যা সরাসরি দুর্বলতাকে নির্দেশ করে? কেন ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হবেন এমন নগণ্য মানুষের ওপর, যারা তাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরুন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও মহাবিশ্বের উপর কর্তৃত্ব হৃদয়ঙ্গমে অক্ষম? কোরানে যখন আল্লাহ নিজেকে পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু বলে অভিহিত করেছেন (১২৯২), তাঁর কি উচিত মানুষকে এই মর্মে হুমকি প্রদান করা যে, কেউ তাঁর সাথে শরিক করলে তা হবে সম্পূর্ণ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ (৪:১১৬)। তাঁর কি উচিত মানুষকে অনন্তকাল নরকবাসের শাস্তি দেয়া? কোরানে তো আল্লাহ নিজেই বলেছেন তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি অবিবেচক হবেন না (৫০:২৮) অথচ তিনি পাপীদের নরকের উত্তপ্ত আগুনে পতিত করে শাস্তি দেবেন। তিনি বলেন যখনই অবিশ্বাসীদের চামড়া দোজখের আগুনে পুড়ে যাবে তখনই আবার নতুন চামড়া জন্মাবে যাতে তারা অনন্তকাল কঠোর শাস্তি পেতে থাকে (৪:৫৫)। কারো চির-অতৃপ্ত ক্ষোভই কেবল এরকম শাস্তি দিতে প্রলুব্ধ করতে পারে এবং ক্ষোভ নিঃসন্দেহে দুর্বলতার পরিচায়ক। একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার এরকম দুর্বলতা কি থাকতে পারে? কোরানে বলা হয়েছে, পরম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন আর যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন (১৮:১৭), আবার এও বলা হয়েছে যারা বিভ্রান্ত হবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। দ্রষ্টব্য : সুরা বাকারা : আয়াত ১০ ও ৯০; সুরা মায়িদা ; আয়াত ৯৪, সুরা তওবা ; আয়াত ৩৯। ইত্যাদি।- অনুবাদক

কোরানে একদিকে আল্লাহকে সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী বলে অভিহিত করা হয়েছে অপরদিকে ঠিকই আবার বলা হচ্ছে তাঁর মানুষের সাহায্য প্রয়োজন : মরিয়মের সন্তান ঈসা যখন তার শিষ্যদের বললেন, কে আল্লাহর রাস্তায় আমাকে সাহায্য করবে? তখন শিষ্যরা বলল, আমরা ঈশ্বরের সাহায্যকারী।” (সুরা সাফফ ; আয়াত ১৪)। আমি মানুষের জন্য লোহা নাজিল করেছি যাতে মানুষের জন্য মহাশক্তি ও উপকার রয়েছে যাতে অদৃশ্য আল্লাহ জানতে পারেন কে তাঁকে ও তাঁর রসুলকে সাহায্য করেছে। (সুরা আল হাদিদ ; আয়াত ২৫)।

এসব অভিযোগ গুরুতর। দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি পণ্ডিত ও কোরানের ব্যাখ্যাকারকরা এসব অসঙ্গতি দূর করার জন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। এই প্রবন্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার পটভূমিকেন্দ্রিক কোরানের কয়েকটি আয়াত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

হজরত মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাব একবার তাঁকে বলেছিলেন : ধ্বংস হও মুহামদ, তুমি কি এজন্য আমাদের আমন্ত্রণ করেছ?” এর জবাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা অসীম ক্ষমতাশালী আল্লাহ নগণ্য আবু লাহাবের মাথায় বজ্রপাতের মত নাজিল করলেন সুরা লাহাব (১১১), যা থেকে লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলও রেহাই পাননি :

‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত আর সে নিজে।
তার ধনসম্পদ ও উপজেন তার কোনো কাজে আসবে না।
সে ভুলবে অগ্নিশিখায়
আর তার জ্বালানিভারাক্রান্ত স্ত্রীও
যার গলায় থাকবে কড়া আঁশের দড়ি।’

[ আবু লাহাবের আসল নাম আব্দুল ওজা, তিনি নবি মুহাম্মদের চাচা আবু তালিবের ছোট ভাই। নবির দুই মেয়ে রোকেয়া এবং উমে কুলসুমের সাথে আব্দুল ওজার দুই ছেলে ওতবা ও ওতাইবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু এই বিয়ে বেশি দিন টিকেনি, উভয়ের মধ্যে তালাক হয়ে যায়। এ-জন্য নবি মুহামদ মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন এবং চাচা আব্দুল ওজার পরিবারের সাথে তাঁর শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছিল। ৬১৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে একদিন হজরত মুহাম্মদ সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে কুরাইশ গোত্রের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন। সে-সময় এভাবে পাহাড়ের উপরে উঠে ডাক দেয়া হত কোনো বিশেষ বিপদের আশংকা হলে। সবাই কাজকর্ম ফেলে সেখানে ছুটে এলে মুহাম্মদ তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে অনেকেই বিরক্ত হন। আব্দুল ওজাও বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন : ‘ধ্বংস হও মুহাম্মদ! … তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে মুহাম্মদও বলেছিলেন, ‘তুমিও ধ্বংস হও, অনির্বাণ শিখায় জ্বলতে থাকো। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নবি ওহি পেলেন ‘সুরা লাহাব আর চাচা আব্দুল ওজা হয়ে গেলেন আবু লাহাব মানে ‘অগ্নিশিখার পিতা – অনুবাদক] নিজেকে নিয়ে গর্ব করার জন্য আবুল আসাদকে তিরস্কার করা হয় সুরা বালাদে। সুরা হুমাজায় (১০৪) ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা এবং উমাইয়া বিন খালাদের প্রতি একই ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে যারা নবি মুহামদকে নিয়ে নিন্দা এবং নিজেদের সম্পদ নিয়ে গর্ব করত। সুরা কাউসারে আলাস বিন ওয়ায়েলকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে মুহাম্মদকে লেজকাটা (উত্তরাধিকারহীন) বলে উপহাস করার জন্য। বদরের যুদ্ধের পর কাব বিন আল-আশরাফ নামের জনৈক ইহুদি কবি মক্কায় গিয়ে এ যুদ্ধে হেরে যাওয়া পৌত্তলিকদের প্রতি সমবেদনা জানালে এবং তাদেরকে মুহাম্মদের উপর মর্যাদা দান করলে মহাবিশ্বের পরম স্রষ্টা ক্রুদ্ধ হয়ে কোরানের আয়াত নাজিল করলেন : সুরা নিসা : ৫১-৫৭। সুরা হাশরে আল্লাহ বানু নাজির নামের ইহুদি গোত্র নির্মুল করাকে আনন্দের সাথে সমর্থন করেন। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস একসময় সুরাটির নাম দিয়েছিলেন সুরা বানু নাজির।

কোরানে আল্লাহ শুধু মুহাম্মদের উদ্দেশ্য-বাস্তবায়নে বাধাদানকারীদের তিরস্কার করেছেন এমন নয়, তিনি বিভিন্ন নারীর সাথে মুহাম্মদের সমস্যায় জড়ানোর বিষয়েও মধ্যস্থতা করেছেন। সূরা আহজাবের ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মুহামদকে তাঁর পালকপুত্রের স্ত্রীর সাথে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। একই সুরার ২৮-২৯ নম্বর আয়াতে বানু-কুরাইজা গোত্রকে হত্যা করে নবির বাহিনী যেসব মাল দখলে নিয়েছিলেন তা থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে দাবি করলে নবির স্ত্রীদের তালাকের হুমকি দিয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়। হাফসা যখন নবির সাথে মরিয়মের সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ আনেন তখন সুরা তাহরিমের বিভিন্ন আয়াত নাজিল হয়েছে, বিষয়টি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। হাফসা ও আয়েশার পারস্পরিক মনোমালিন্য আল্লাহকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে, তিনি তাদেরকে সতর্ক করে দেন যেন তাঁরা নবিকে জ্বালাতন বন্ধ করেন ও অনুতপ্ত হন অন্যথায় আল্লাহ, জিবরাইল ও সৎ ঈমানদাররা নবিকে সমর্থন করবে এবং নবি যদি তাঁদেরকে তালাক প্রদান করেন তবে আল্লাহ তাঁদের পরিবর্তে আরও উত্তম স্ত্রী প্রদান করবেন যারা হবেন অনুগত, ইবাদতকারী, রোজা পালনকারী, কতক বিধবা এবং কতক কুমারী (সুরা তাহরিম ; আয়াত ৫)। কোরানের একজন ব্যাখ্যাকারক এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিধবা মানে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়াআর কুমারীমানে যিশুর মা মরিয়ম এবং তাঁদের সাথে জান্নাতে নবি মুহাম্মদের বিবাহ সম্পন্ন হবে। অবশ্য কোরানে এই সুরার শেষ আয়াতদ্বয়ে আসিয়া ও মরিয়মের কথা উল্লেখ থাকলেও সরাসরি এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

সুরা নূর-এ আয়েশার প্রতি মিথ্যা অপবাদ ও সতী নারীর প্রতি এ ধরনের মিথ্যা অপবাদদানকারীদের প্রতি শাস্তি বিষয়ে বক্তব্য রয়েছে। আয়েশাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার অভিযোগে বিশিষ্ট সাহাবি ও ওহি লেখক হাসান বিন সাবিত ও হামনা বিন জাহাশকে শাস্তি প্রদান করা হয় এবং আয়েশাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।

হিজরি ১ থেকে ১১ হিজরি (৬২২- ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত শুধু অসীম মহাবিশ্ব নয় বরং আরবের হেজাজ ও নেজদ অঞ্চল ছাড়া প্রায় সমগ্র বিশ্বকেই ভুলে যাওয়া বা অবজ্ঞা করা হয়েছিল। ঐসব অঞ্চলের লোকেরা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল এবং ধর্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনীহা বা শৈথিল্য প্রদর্শন করেছিল। তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য দোজখের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছিল আর যারা ভয় ও যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মালের প্রতি দৃঢ়তা ও সাহস প্রদর্শন করেছিল তাদের জন্য বেহেশতের তলদেশে নহর প্রস্তুত হচ্ছিল।

নবিকে যখন উপহাস করা হয়েছিল তখন তাঁকে কোরানের আয়াত নাজিল করে সান্তুনা দেয়া হল : “যারা বিদ্রুপ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। (সুরা হিজর :৯৫)। সুরা আনফালের পুরোটা জুড়ে দ্বিতীয় হিজরিতে (৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) সংঘটিত বদরের যুদ্ধে মহান সৃষ্টিকর্তার গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসু ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দামেস্ক থেকে মক্কার দিকে একটি মালবাহী বাণিজ্যিক কাফেলা যাচ্ছিল। নবি এ খবর জানতে পেরে একদল সাহাবি নিয়ে ওই কাফেলাকে আক্রমণ করতে মদিনায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। আবু সুফিয়ান গুপ্তচর মারফত বিষয়টি জানতে পেরে মক্কায় সাহায্যের জন্য খবর পাঠান, তখন আবু জেহেলের বাহিনী মক্কা থেকে কাফেলাকে রক্ষা করতে চলে এল। আবু সুফিয়ান সংঘর্ষ এড়িয়ে সর্তকতার সাথে নিরাপদে কাফেলা নিয়ে মক্কায় চলে যান। নবির বাহিনীর কিছু লোক যারা আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে কজা করতে না পেরে হতাশ হয় এবং বদরের মাঠে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের সমূখীন হয় আৰু জেহেলের বাহিনীর সাথে। যুদ্ধে আৰু জেহেলকে পরাস্ত করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মালিকানা তারা দাবি করেন। আল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে সতর্ক করে দেন সুরা আনফালের প্রথম দিকের আয়াতগুলো নাজিল করে। নবম আয়াতে আল্লাহ এই যুদ্ধে এক সহস্র ফেরেশতা দিয়ে সহায়তা করার কথা বলেছেন। দ্বাদশ আয়াতে অবিশ্বাসীদের ঘাড়ে এবং সারা অঙ্গে আঘাত করে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সপ্তদশ আয়াতে বলছেন : ‘তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করেছিলেন, আর তুমি যখন কাঁকর ছুড়েছিলে তখন তুমি ছোড়নি আল্লাহই তা ছুড়েছিলেন। তা ছিল বিশ্বাসীদেরকে ভালো পুরস্কার দেওয়ার জন্য। এ-বক্তব্য দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যখন মুহাম্মদ আবু

জেহেলের বাহিনীর দিকে কাঁকর নিক্ষেপ করেছিলেন সেটা আসলে আল্লাহই করেছেন এবং এর মাধ্যমে আবু জেহেলের দল পরাজিত হয়।

যুদ্ধ শেষে প্রথমে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বণ্টন নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। সমস্যা সমাধানে আল্লাহ এই সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ নিজের জন্য এবং রসুলের জন্য বরাদ্দ করেন। তোমাদের গনিমায় এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর, রসুলের, পিতৃহীন দরিদ্র ও পথচারীদের জন্য। (৮:৪১)। সৃষ্টিকর্তা যেহেতু গনিমার ভাগ নিতে কখনো আসবেন না, তাই এই অংশটুকু রসুলের ভাগেই থাকবে। এবার আরেকটি সমস্যা তৈরি হল যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে। হজরত ওমরের পছন্দ মত একটা আয়াত নাজিল হল : দেশে সম্পূর্ণভাবে শক্রনিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনো নবির পক্ষে সমীচীন নয়।’(৮:৬৭)। একটু পরেই এই সিদ্ধান্ত বদল করে হজরত আবু বকরের পছন্দ মত যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে মুক্তি ব্যবস্থা করে আরেকটি আয়াত নাজিল কাছ থেকে যা নেওয়া হয়েছে তার চেয়ে ভালো কিছু তিনি তোমাদেরকে দেবেন ও তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (৮:৭০)। উল্লেখ্য বদর যুদ্ধে নবি মুহাম্মদের চাচা আব্দুল বিন আব্বাসও যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। প্রথম দিকে হজরত ওমরের সিদ্ধান্তানুযায়ী যুদ্ধবন্দীদেরকে মেরে ফেলতে চাইলেও পরে হজরত আবু বকরের পরামর্শানুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়।

সুরা আনফালের সম্পূর্ণটা পৌত্তলিকদের সাথে যুদ্ধ-বিবাদ নিয়ে রচিত হয়েছে। গাতাফান গোত্র কুরাইশদের সাথে মিলিত হয়ে একসাথে মদিনা আক্রমণ করে বসে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আল্লাহ কিভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তার বিবরণ রয়েছে সূরা আহজাবের নবম আয়াতে : হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা তোমরা সারণ করো, যখন শক্রবাহিনী তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল ও আমি তাদের বিরুদ্ধে এক ঘূর্ণিঝড় ও অদৃশ্য বাহিনী পাঠিয়েছিলাম। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন। (সুরা আহজাব ; আয়াত ৯)। দশম থেকে ত্রয়োদশ আয়াত পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ কিভাবে এ-যুদ্ধে মুসলমানদের বিরাট সাহায্য করেছিলেন।

ক্যামব্রিজ তফসির’- এ ঘটনাটির বিবরণ এভাবে দেয়া হয়েছে: ‘মহান আল্লাহতায়ালা প্রচণ্ড ঝড় পাঠিয়ে শক্রদলের তাবুগুলোকে উল্টে দিলেন, তাদের আগুনকে নিভিয়ে দিলেন এবং তাদের ঘোড়ার আস্তাবল ধ্বংস করেছিলেন। ফেরেশতারা তখন চিৎকার করে বললেন, আল্লাহ মহান! ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ নামে খ্যাত। মক্কা থেকে বিশাল সেনাবাহিনী মদিনা আক্রমণ করতে গেলে পারস্যের নাগরিক সালমান আল-ফার্সির পরামর্শে চারদিকে পরিখা খনন করা হয়। আক্রমণকারী মক্কাবাসীরা পরিখা ডিঙিয়ে আর অগ্রসর হতে না পেরে পরিখার পাশে তাবু ফেলে অপেক্ষা করতে থাকেন। মাসখানেক মদিনা অবরুদ্ধ করে রাখার পর তারা এক মরুঝড়ের কবলে পড়েন।-অনুবাদক ।

কোরানের গভীর বিশ্বাসী তফসিরকারক কখনো প্রশ্ন উত্থাপন করেন না, আল্লাহ ওই ঝড় এক মাস পর না পাঠিয়ে আগে কেন পাঠালেন না? আল্লাহ যদি তা করতেন তবে মদিনার মুসলমানদের সে-সময় পরিখা খননের মত দুঃসাধ্য কাজ করতে হত না এবং দীর্ঘদিন শক্রদ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় থাকতে হত না। কোনো ভাষ্যকারই প্রশ্ন তোলেননি, ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা কেন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন যেখানে নবির ছোট চাচা হামজা বিন আব্দুল মোতালেবসহ সত্তরজন সাহাবি মৃত্যুবরণ করেন। কেন আল্লাহ তাঁদের সাহায্যার্থে ফেরেশতা পাঠালেন না যেমন পাঠিয়েছিলেন খন্দকের যুদ্ধে? কয়েকজন ফেরেশতা বা গায়েবি কোনো মরুঝড় যদি ওহুদের যুদ্ধে সাহায্য করত তবে নবি পরাজয়ের গ্রানি থেকে মুক্তি পেতেন, পাথরের আঘাত থেকে রক্ষা পেতেন এবং এমন পরিস্থিতিতে পড়তেন না যেখানে হজরত আলি নিজের জীবন বিপন্ন করে তাঁকে একদম শহিদ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব আয়াতে ধর্মীয় আদেশনিষেধের সাথে তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন বিতর্ক, রটনাকারীদের কুৎসার জবাব, ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্থতা, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহ্বান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং বিরোধীপক্ষ ও অবিশ্বাসীদের মৃত্যুর পর দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে কোরানে শতাধিক আয়াত রয়েছে। নগরের বাসিন্দারা যদি পাপকাজে লিপ্ত থাকে তবে স্রষ্টার ক্রোধে গোটা নগর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, পূর্বে এরকম গজব নাজিল হয়েছিল পুণ্যবানপাপী সবার ওপরে।

কোরানে স্রষ্টার মানবসুলভ গুণাবলী আছে। তিনি খুশি হোন, তিনি ক্রোধান্বিত হোন। তাঁর পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে ও তাঁকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব। এককথায় মানুষের সব ধরনের মানবীয় গুণাবলী ও স্বভাব স্রষ্টার রয়েছে, যেমন ভালবাসা, রাগ করা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, ষড়যন্ত্র, ছলনা ইত্যাদি। আমরা যদি ধরে নেই বিশাল এই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা রয়েছেন তবে যৌক্তিকভাবে ধরে নিতে হবে সেই স্রষ্টা আমাদের মতো নগণ্য মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্য ও দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত। সুতরাং আমরা কোরানের স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যাবলী হজরত মুহাম্মদের নিজস্ব চিন্তা প্রসূত বলে ধরে নিতে বাধ্য। আর হজরত মুহাম্মদ নিজেই বলেছেন তিনিও একজন মানুষ মাত্র। আমরা জানি তিনি অন্যান্য মানুষের মত মনে কষ্ট পেতেন, ছেলে হারানোর ব্যথায় কাতর হয়েছেন, ওহুদের যুদ্ধে তাঁর চাচা হামজার বিকৃত লাশ দেখে শোকাতুর হয়ে প্রতিশোধের শপথ নিয়েছেন।

পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে প্রশ্ন আসে, কোরানে হজরত মুহাম্মদ ও আল্লাহকে কি আদৌ আলাদা করা সম্ভব নাকি দুজন আসলে এক সত্তা? কোরানের প্রচুর সুরা-আয়াত পর্যালোচনা করলে ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার। সকল মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর বাণী।এই বিশ্বাস কোরানেরই কিছু আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে, যেমন: ‘কোরান ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সুরা নজম : আয়াত ৪-৫)। আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি কদরের রাত্রে। (সুরা কাদর ; আয়াত ১)। কোরান মুসলমানদের বিশ্বাসের একমাত্র দলিল, যা অবিসংবাদিত, রাজকীয় ও পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।

শুরু থেকে কোরানকে এত বেশি মর্যাদাশীল বলে ভাবা শুরু হয় যে (কোরান রচিত হওয়ার) মাত্র একশ’বছরের মধ্যে মুসলিম পণ্ডিতদের কাছে জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কোরান সৃষ্ট নাকি তা আল্লাহর মতই অসৃষ্ট মানে তা কখনো অস্তিত্বহীন ছিল না। এই বিতর্ক চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কিন্তু কোরান অসৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মৌলিক নীতিমালার সাথে সাং |

তথাপি আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের (৮৩৩-৮৪২ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলে সুন্নি ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের অসৃষ্ট হওয়ার মতবাদকে পরিত্যাগ করা দূরের কথা এ ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস এতই প্রবল ছিল যে তিনি বরং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এজন্য চাবুকের আঘাত সহ্য করে নেন। অর্থাৎ তিনি আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোকআয়াতখানিও আল্লাহর মতই চিরন্তন বলে মনে করতেন। কোরান অসৃষ্ট বিষয়টি ইমাম আহমদ বিন হানবলের মতো ব্যক্তিদের গভীর বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কোরানের একাধিক আয়াত। যেমন সুরা বুরুজে বলা হয়েছে : বস্তুত এ হচ্ছে সমানিত কোরান, যা রয়েছে লওহে মাহফুজে (সংরক্ষিত ফলকে)। (৮৫:২১-২২)। লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরান লিখেছিলেন পবিত্র-সম্মানিত ফেরেশতারা। (দেখুন : ৮০ সুরা আবাসা : আয়াত ১৩-১৬) -অনুবাদক

বিশ্বাসের মোহে আবদ্ধ থাকলে কাউকে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে লাভ হয় না। বিষয়টি তাদের জন্যও সত্য, যারা কোরান পড়েছেন। কোরানের প্রথম সূরা ফাতিহা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। এই সুরায় সাতটি” আয়াত রয়েছে এবং একে ‘সাত পুনরাবৃত্তি(৮০) বলে। এই সুরার বিশেষ মর্যাদার জন্য একে কোরানের সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। সুরাটির অনুবাদ নিচে দেয়া হল :

‘পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই
বিচারদিনের মালিক।
আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি
তুমি আমাদেরকে চালিত করে সঠিক পথে
তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ
যারা (তোমার) রোমে পতিত হয়নি, পথভ্রষ্টও হয়নি।’

এই বাক্যগুলো আল্লাহর হতে পারে না। এর বিষয়বস্তু থেকে এটা পরিষ্কার যে, এটি নবির (বা অন্য কোনো ব্যক্তির) রচিত কথামালা, কারণ এখানে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে, আল্লাহর প্রতি প্রণতি ও মিনতি রয়েছে। স্রষ্টা কখনো নিজের প্রতি বলবেন না-আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। বাক্যের এই বিড়ম্বনা এড়ানো যেত যদি সূরাটির আগে বল (আরবিতে কুল) বা এই বলে প্রার্থনা কর” কথাটি সংযুক্ত থাকত; যেমন রয়েছে সুরা ইখলাস-এর প্রথম আয়াতে (বলো, তিনি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয়), সুরা কাফিরুন (বলো, “হে অবিশ্বাসীরা) কিংবা সুরা কাহাফ-এ রয়েছে, বলো, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র উপাস্য। ( ১৮:১১০)। এটি যৌক্তিকভাবে অসম্ভব যে, এই বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা কখনো বলবেন, আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। যেহেতু সুরা ফাতিহা কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি মিনতি ছাড়া কিছুই নয় তাই ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে এই সুরা আল্লাহর বাণী নয় বরং নবি বা অন্য কারো রচিত প্রার্থনা। বিখ্যাত সাহাবি, কোরানের হাফেজ, হাদিস-বক্তা ও কোরানের অনুলেখক আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ সুরা ফাতিহার এই আয়াতকে তাঁর অনুমোদিত কোরানে অন্তর্ভুক্ত করেননি এবং সুরা ফালাক ও সুরা নাসকেও তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন।

সুরা লাহাবকেও এর উদ্যত ভঙ্গির জন্য মহাবিশ্বের মহান প্রতিপালকের বাণী বলে ধরে নেয়া যায় না (যা লাওহে মাহফুজে হজরত মুহাম্মদের জন্মের অনেক আগে অনাদিকাল থেকেই সংরক্ষিত ছিল), যার দ্বারা নবির চাচা আব্দুল ওজাকে জবাব দেয়া হয়েছে। মহাবিশ্বের মহান প্রতিপালকের জন্য শোভনীয় হতে পারে না একজন অজ্ঞ আরব ও তাঁর স্ত্রীকে হিংসামূলক অভিশাপ বর্ষণ করা।

কোরানের কিছু আয়াতের বক্তা আল্লাহ আবার কিছু আয়াতে বক্তা মুহাম্মদ বলে প্রতীয়মান হয়। সুরা নজমের প্রথমে আল্লাহ বলেছেন, তিনি মুহাম্মদের নবুওতিকে অনুমোদন করেছেন : তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, পথভ্রষ্টও নয়। আর সে নিজের ইচ্ছামতো কোনো কথা বলে না। কোরান ওহি, যা তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়। (৫৩:২-৫)। একই সুরার পরের আয়াতগুলো (২১২৮) থেকে মনে হয়, এখানে বক্তা নবি মুহাম্মদ নিজে। যেমন নবি এখানে পৌত্তলিকদের লাত, মানাত ও ওজ্জাকে আল্লাহর কন্যা হিসেবে বিশ্বাস করার নিন্দা করছেন ; তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওজা সম্বন্ধে, আর তৃতীয়টি মানাত সম্বন্ধে? তোমরা কি মনে কর তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান আর আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান? এরকম ভাগ তো অন্যায়। (৫৩:১৯-২২)। এটি আল্লাহর বাণী বলে মনে হয় না, কারণ আল্লাহ নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন না তাঁর কন্যা সন্তান আছে কিনা সে ব্যাপারে। প্রায় চৌদশত বছর আগে আরবের হেজাজ অঞ্চলের সমাজে অনেক কুসংস্কার-কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। তাঁরা পুত্রসন্তানের জন্য গর্ববোধ করতো আবার কন্যা সন্তানের জন্য বিব্রতবোধ করতো। কন্যা সন্তান সে-সময়কার সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল যা কোরানের কিছু আয়াতেও বিবৃত হয়েছে। যেমন সুরা বনি-ইসরাইলে রয়েছে ; তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান ঠিক করেছেন আর তিনি নিজে ফেরেশতাদেরকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন?’(১৭:৪০)। এই ধরনের প্রশ্ন কেবল নবি মুহাম্মদ দ্বারা উত্থাপিত হতে পারে। কারণ তা আল্লাহর বাণী হলে এরূপ হতে পারতো ; আমি কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান নির্ধারিত করেছি এবং নিজের জন্য ফেরেশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছি? তদুপরি মহাবিশ্বের স্রষ্টা-প্রতিপালকের কাছে লিঙ্গভেদ কোনো গুরুতর বিষয় হতে পারে না, বিধায় তাঁর পক্ষে এরকম আয়াত রচনাও সম্ভব নয়।

কন্যাশিশুর প্রতি কুসংস্কার এখনো বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান, এমনকি অনেক সভ্য দেশেও তা বিদ্যমান। প্রাচীন আরবরা পুত্র সন্তান নিয়ে গর্ব করত আবার কেউ কেউ এমন বর্বর ছিল যে কন্যাশিশুকে হত্যা করে ফেলত। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক স্থানে কন্যাশিশু হত্যা বা কন্যাভ্রুণ নষ্ট করে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়।-অনুবাদক। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল প্রাচীন আরবরা আবার ফেরেশতাদের স্ত্রীলিঙ্গ বিশিষ্ট বলে মনে করত। নবি মুহাম্মদ তৎকালীন আরবদের মত পুত্রসন্তান লাভের আশা করতেন। যখন তিনি কোনো নারীকে বিয়ে করেছেন তখন তাঁর গর্ভ থেকে পুত্র সন্তান ভীষণভাবে প্রত্যাশা করতেন। নবির সন্তান কাশেম মারা যাওয়ায় তিনি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন, যখন আলাস বিন ওয়ায়েল তাঁকে “লেজকাটা (উত্তরাধিকারহীন) বলে ব্যঙ্গ করতো তখন তিনি বেশ দুঃখ পেতেন (নবিকে তখন সান্তনা দেয়ার জন্য সুরা কাউসার নাজিল হয়)। পরবর্তীতে নবি বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন যখন উপপত্নী মরিয়মের (মারিয়া দ্যা কপ্ট) গর্ভে ইব্রাহিম নামের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু মাত্র নয় মাসের মাথায় শিশুটি মারা গেলে বংশের প্রদীপ রক্ষার চিন্তায় ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনি। তাই নবি পৌত্তলিকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আল্লাহ কি তোমাদের পুত্রসন্তান দিয়ে অনুগ্রহ করেন?”

কোরানে এরকম অসংখ্য আয়াত রয়েছে যেখানে আল্লাহ ও মুহাম্মদের মধ্যে কে আসল বক্তা তা নিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। সুরা বনিইসরাইলের প্রথম আয়াত, যেখানে নবির রাত্রিকালীন ভ্রমণের (মেরাজ) কথা উল্লেখ রয়েছে ; পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর দাসকে রাত্রে সফর করিয়েছিলেন তাঁর নির্দশন দেখাবার জন্য মসজিদ-উল-হারাম থেকে মসজিদ-উল-আকসায়-যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন।’ (১৭:১)। পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর দাসকে রাত্রে সফর করিয়েছিলেন মক্কা থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত – এধরনের বক্তব্য আল্লাহর উচ্চারিত বাণী হতে পারে না কারণ আল্লাহ নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দিতে পারেন না, এটি মনুষ্যসুলভ বাতুলতা। এটা আল্লাহর প্রতি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে প্রশংসাজ্ঞাপন মাত্র। এই আয়াতের পরের অংশ যেখানে দূরবর্তী মসজিদের কথা বলা হয়েছে, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি’- এর বক্তা আল্লাহর নিজের বলে মনে হয়, তবে শেষের অংশ তিনি তো সব শোনেন, সব দেখেন-নবি মুহাম্মদের উক্তি বলেই মনে হয়।

এভাবে একই আয়াতে বারেবারে বক্তা পরিবর্তিত হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে সূরা ফাতহ। আল্লাহ তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছেন। যাতে আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রটিগুলো মাফ করবেন…। (৪৮:১-২)। এই আয়াতদ্বয় আল্লাহর বাণী হলে এ-রকম হতে পারতো ; আমি আপনার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছি। যাতে আমি আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রটিগুলো মাফ করবো। যদিও এই ধরনের ভাষাগত গোলযোগের কারণ আমরা সহজে ব্যাখ্যা করতে পারি। শুধু এই আয়াতদ্বয় নয়, আরও অনেক আয়াত আছে যা একই ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে। এরকম একটি আয়াত হচ্ছে সুরা আহজাবের ২১ নম্বর আয়াত : তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশি করে সারণ করে তাদের জন্য আল্লাহর রসুলের মধ্যে এক উত্তম আদর্শ রয়েছে। সহজেই বলা যায়, এখানে বক্তা আল্লাহ হলে অবশ্যই বাক্যটি এরকম হতো : তোমাদের মধ্যে যারা আমাকে ও পরকালকে বেশি ভয় করে এবং আমাকে বেশি করে সারণ করে তাদের জন্য আমার রসুলের মধ্যে এক উত্তম আদর্শ রয়েছে। সুরা আহজাবের পরের দুটি আয়াতে (২২-২৩) মদিনার মুসলমানদের খন্দকের যুদ্ধে অবিচলতার জন্য। পরের আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহ তো সত্যবাদিতার জন্য পুরস্কার দেন, আর তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি মুনাফিকদের শাস্তি দেন বা ক্ষমা করেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৩৩:২৪)। এই আয়াত পরিষ্কারভাবে আল্লাহর বাণী বলে প্রতীয়মান হয় না, বরং বক্তা স্বয়ং নবি মুহাম্মদ। কেননা আল্লাহ বক্তা হলে তা হতো : আমি তো সত্যবাদিতার জন্য পুরস্কার দেই…”।

অষ্টম হিজরিতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দে) যখন রোমানদের বিরুদ্ধে নবির অভিযানের প্রস্তুতিকালে মদিনার একটি গোত্রের প্রধান জাদ বিন কায়েস যুদ্ধে যোগ দিতে অপারগতা জানিয়ে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করুন ও প্রলোভন থেকে বাঁচান। রোমান নারীদের দেখে আমি হয়তো তাদের প্রলোভন থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারবো না। এর প্রত্যুত্তরে সুরা তওবার এই আয়াত নাজিল হয় ; আর ওদের মধ্যে এমন লোক আছে যে বলে আমাকে অব্যাহতি দাও আর আমাকে বিশৃঙ্খলায় ফেলো না। সাবধান! ওরাই বিশৃঙ্খলায় পড়ে আছে। আর জাহান্নাম তো অবিশ্বাসীদের ঘিরে রাখবে।’(৯:৪৯)। স্বাভাবিকভাবে এটি নবি মুহাম্মদের বাণী, আল্লাহর বাণী নয়। কারণ নারীলোভী জাদ বিন কায়েস যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার জন্য নবি মুহাম্মদের কাছে অব্যাহতি চেয়েছেন, আল্লাহর কাছে নয়। আল্লাহ তাঁর রসুলকে সমর্থন করে ওজর-উত্থাপনকারীদের জন্য দোজখ তৈরি করতে পারেন কিন্তু এ-ধরনের বিষয়ে তিনি এভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

কোরানে বক্তা হিসেবে আল্লাহ ও নবির মধ্যকার বিভ্রান্তিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। মাঝে মাঝে আল্লাহ নবিকে আদেশ দিয়ে বলছেন-বিলো। মাঝে মাঝে কিছু আয়াত পাওয়া যাচ্ছে যেখানে মুহাম্মদ বক্তা হয়ে আল্লাহর প্রশংসা করছেন। কোরানের এই আয়াতগুলি থেকে আভাস পাওয়া যায় নবি মুহাম্মদের অবচেতন মন হয়তো আরবদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, সুনির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য, বিভিন্ন মানবিক ক্রটি-বিচূতি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এবং উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ক্রমাগত প্রণোদনা দিত।

কোরানে আল্লাহর ওপর ছলনা বা ষড়যন্ত্রের মতো বৈশিষ্ট্য আরোপিত হওয়ার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সুরা কলমে রয়েছে : “যারা এই বাণী প্রত্যাখান করে তাদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি ধীরে ধীরে ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাব ওরা তা জানে না। আমি ওদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল অত্যন্ত শক্ত। (৬৮৪৪-৪৫)। সুরা আরাফ-এ রয়েছে : ‘যারা আমার নির্দশনাবলিকে মিথ্যা বলে আমি তাদেরকে ক্রমে ক্রমে এমনভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল বড়ই নিপুণ। (৭:১৮২-১৮৩)। সুরা আনফালে কুরাইশ-প্রধানদের গোপন সভাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে : “সারণ করো, অবিশ্বাসীরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তোমাকে বন্দী, হত্যা বা নির্বাসিত করার জন্য। তারা যেমন ছলনা করত, তেমনি আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম। (৮৩০)। উল্লেখ্য এই আয়াতে আরবি শব্দ ইয়ামকুরু ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থ হচ্ছে- সে ধোঁকা দিচ্ছে, “ষড়যন্ত্র করছে’ ইত্যাদি। শব্দটি আয়াতে দুইবার উল্লেখ রয়েছে। অনেক কোরান-অনুবাদক কাফেরদের ক্ষেত্রে এই শব্দের অর্থ ষড়যন্ত্র/ছলনা হিসেবে ব্যবহার করেছেন কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে এর অর্থ করেছেন ‘পরিকল্পনা করা’, ‘কৌশল করা ইত্যাদি।-অনুবাদক)।

ধূর্তামি বা ছলনাকে বীরত্বের বিকল্প হিসাবে ভাবা সম্ভব, যদি প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী হয়। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ যিনি মহাবিশ্বকে হও বললেই হয়ে যায়; যার হুকুমে মহাবিশ্বের সব কিছু ঘটে তাকে কেন ছলনা, ধূর্তমি, ষড়যন্ত্র বা প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে?এ-ধরনের ছলনার একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে যখন হজরত আলি ও হজরত মুয়াবিয়ার মধ্যে খেলাফত সমস্যার সমাধানে কুরাইশ বংশের আমর ইবনে আল-আস চালাকি করে পরাস্ত করেছিলেন আবু মুসা আল-আশারিকে।”

আল্লাহ ও মুহাম্মদের মধ্যে কোরানে কে আসল বক্তা, তা নিয়ে বিভ্রম তৈরি হয় প্রচুর। যেমন সুরা ইউনুসে রয়েছে : তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে সকলেই বিশ্বাস করত। তা হলে কি তুমি বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?’(১০:৯৯)। এই আয়াতটি নবির সাথে আল্লাহর কথোপকথন মনে হলেও পরের আয়াতেই মনে হয়, নবি পৌত্তলিকদের একরোখা মনোভাবের জন্য নিজেকে সান্তনা দিচ্ছেন এই বলে- আল্লাহর অনুমতি ছাড়া বিশ্বাস করা কারও সাধ্য নেই। আর যারা বোঝে না আল্লাহ তাদেরকে কলুষলিপ্ত করবেন। (১০:১০০)। মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ কখনো এমন মনোভাব পোষণ করবেন না যে, কিছু লোক তাঁকে বিশ্বাস করুক আর কিছু লোক তাঁকে অবিশ্বাস করুক। পরম স্রষ্টা কখনো রাগ করতে পারেন না কারণ রাগ মানবীয় অনুভূতি দুর্বলতার প্রকাশক এবং রাগের কারণ হচ্ছে কোনো কিছু ব্যক্তি-ইচ্ছার বিপরীত ঘটা। অথচ আল্লাহর জন্য অপছন্দনীয় কিছু হওয়া বা ঘটা সম্ভব নয়। সুরা আহজাবের ২৪ নম্বর আয়াতটিও আল্লাহর নয়, নবি মুহাম্মদের উক্তি বলেই মনে হয় : আল্লাহ তো সত্যবাদিতার জন্য পুরস্কার দেন, আর তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন বা ক্ষমা করেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

আরবরা অস্থিরমতি এবং প্রায়শ পরিবর্তনশীল স্বভাবের ছিল; এবং যেদিকে সুবিধা বেশি সেদিকে পক্ষ নিত। ইসলামের শুরুর দিকে এজন্য মক্কার কিছু মুসলমান হিজরত করেননি। বদর যুদ্ধে আৰু জেহেলের পক্ষে ও নবি মুহাম্মদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। গরিব ও অসহায় হওয়া সত্ত্বেও এদের অস্থিরচিত্ততা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। ফলে সুরা নিসার এই আয়াতগুলি নাজিল হয় : “যারা নিজেদের অনিষ্ট করে তাদের প্রাণ নেওয়ার সময় ফেরেশতারা বলে, “তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা (ফেরেশতারা) বলে, তোমরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস তো করতে পারতে, আল্লাহর দুনিয়া কি এমন প্রশস্ত ছিল না? এরাই বাস করবে জাহান্নামে, আর বাসস্থান হিসেবে তা কী জঘন্য! তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না ও কোনো পথও পায় না, আল্লাহ হয়তো তাদের পাপ ক্ষমা করবেন, কারণ আল্লাহ পাপমোচনকারী ক্ষমাশীল। (৪:৯৭৯৯)। মৃত্যুভয় থাকায় অনেক মুসলমান হিজরতে উৎসাহিত হননি। তাই বারে বারে হিজরতে পুণ্যের কথা ও লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কোরানে ; আর যে-কেউ আল্লাহর পথে দেশত্যাগ করবে সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয় ও প্রাচুর্য লাভ করবে। আর যেকেউ আল্লাহ ও রসুলের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হয়ে বের হয় আর তার মৃত্যু ঘটে তার পুরস্কারের ভার আল্লাহর ওপর। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (৪:১০০)। পরম করুণাময়ের কাছ থেকে এ-রকম প্রস্তাব শোভনীয় নয়।-অনুবাদক)।

হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবস্থানকালীন সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নবি মুহাম্মদের প্রতি নির্দেশ এসেছিল ; তুমি মানুষকে হিকমত ও সৎ উপদেশ দিয়ে তোমার প্রতিপালকের পথে ডাক দাও ও ওদের সাথে ভালোভাবে আলোচনা করো। তাঁর পথ ছেড়ে যে বিপথে যায় তার সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক ভালো করেই জানেন। আর যে সৎপথে আছে তাও তিনি ভালো করে জানেন। যদি তোমরা শাস্তি দাও, তবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয় ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে। অবশ্য ধৈর্য ধরা ধৈর্যশীলদের জন্য ভালো। (সুরা নাহল ; আয়াত ১২৫-১২৬)। কয়েক বছর পর ইসলাম প্রভাবশালী হয়ে উঠলে মক্কায় বিজয়ী বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রবেশ করেন নবি মুহাম্মদ। নির্দেশ তখন পরিবর্তন হয়ে যায় : তারপর নিষিদ্ধ মাস পার হলে মুশরিকদের যেখানে পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে বন্দী করবে, অবরোধ করবে ও তাঁদের জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওত পেতে থাকবে। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা তওবা । আয়াত ৫)।

মানুষের সীমাবদ্ধতার দরুন সে অসহায় অবস্থায় একভাবে আর সফল হলে অন্যভাবে আচরণ করে। কিন্তু পরম স্রষ্টা যেহেতু সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ তাই তাঁর পক্ষে দুই ধরনের পরিস্থিতিতে ভিন্ন মানসিকতা দেখানোর কারণ অবোধগম্য। হিজরতের প্রথম বছর আল্লাহ কোরানে বললেন : ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। নিঃসন্দেহে সৎপথ ভ্রান্তপথ থেকে পৃথক হয়ে গেছে। সুতরাং যে তাগুত (অসত্য দেবতা)-কে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করবে সে এমন এক শক্ত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙবে না। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। (সুরা বাকারা ; আয়াত ২৫৬)। বছরখানিক পরই (নবি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীক্ষমতাশালী হলে) আল্লাহ আদেশ দিলেন : “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। (২:১৯০)। এবং তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো। (২:২৪৪)। এবং এই বলে সতর্ক করে দিলেন : “মুসলমানদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে নিজের ধনপ্রাণ দিয়ে জিহাদ করে তারা সমান নয়, যারা নিজেদের ধনপ্রাণ দিয়ে জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন। (২:৯৫) । পূর্বে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই আর এখন মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।

হিজরতের পূর্বে আল্লাহ নৈতিক উপদেশ নাজিল করেছিলেন : “ভালো ও মন্দ দুই-ই সমান নয়। ভালো দিয়ে মন্দকে বাধা দাও। এতে তোমার সাথে যার শক্রতা সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। (সুরা হা-মিম-সিজদা :আয়াত ৩৪)। হিজরতের পর মদিনায় বিপরীতধর্মী আয়াত নাজিল হলো : সুতরাং তোমরা অলস হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, তোমরাই প্রবল আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি তোমাদের কর্মফল ক্ষুন্নকরবেন না। (সুরা মুহামদ ; আয়াত ৩৫)।

আচরণ ও কণ্ঠস্বরের এরকম পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, অগণিত তারকারাজি আর গ্রহমণ্ডলী নিয়ে গঠিত বিশাল মহাবিশ্বের স্রষ্টার কেবলমাত্র আরবের হেজাজ অঞ্চলের লোকদের প্রতি এ ধরনের প্রশ্নের হেতু কী হতে পারে ; তোমরা যে-পানি পান কর, সে-সম্পর্কে কি তোমরা চিন্তা করেছ? তোমরাই কি তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি তা বর্ষণ করি? আমি তো ইচ্ছা করলে তা লোনা করে দিতে পারি। তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না? (সুরা ওয়াকিয়া ; আয়াত ৬৮-৭০)।

কোরানের একাধিক সুরা পাঠে মনে হতে পারে স্রষ্টা বোধহয় মানুষের ওপর নির্ভরশীল। আর আমি দিয়েছি লোহা, যার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য নানা উপকার; আর এটা এজন্য যে, আল্লাহ যেন জানতে পারেন কে না-দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে। আল্লাহ তো শক্তিধর, পরাক্রমশালী।” (সুরা হাদিদ ; আয়াত ২৫)। এ-আয়াত থেকে মনে হতে পারে মানুষ তরবারি দ্বারা আল্লাহ ও রসুলকে সাহায্য করতে পারে, এই ধরনের দুর্বলতার কারণ কি? সৰ্বশক্তিমানের কেন প্রয়োজন হবে মানুষের সাহায্যের? আর আরেকটি আয়াত আছে এ-রকম : হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। (সুরা সাফফ ; আয়াত ১৪) এই আয়াতে সাহায্যের আরবি হিসেবে ‘আনসার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয়েছে ‘আনসারাল্লাহমানে আল্লাহর সাহায্যকারী”-অনুবাদক]। আবার কোরানে পঞ্চাশটিরও বেশি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসা বা ইসলাম ধর্মে আনা তাঁর (আল্লাহর) ইচ্ছার বা পছন্দের ওপর নির্ভরশীল। যেমন : নিশ্চয়ই তারা বিশ্বাস করবে না যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়ে গেছে। এমনকি ওদের কাছে প্রত্যেকটি নিদর্শন আসলেও, যতক্ষণ না তারা কঠিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (সুরা ইউনুস ; আয়াত ৯৬-৯৭)। আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। কিন্তু আমার একথা অবশ্যই সত্য যে আমি নিশ্চয়ই জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব।” (সুরা সিজদা : আয়াত ১৩)। যারা আল্লাহও নিদর্শনে বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদেরকে পথনির্দেশ করেন না এবং তাদের জন্য আছে নিদারুণ শাস্তি। (সুরা নাহল ; আয়াত ১০৪)। এ-ধরনের আয়াতগুলো পড়লে মনে হয় আল্লাহ হয়তো নিজেই চাচ্ছেন না সব মানুষ সঠিক পথে বা তাঁর ধর্মে আসুক, আবার যারা সঠিক পথে বা ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন অনন্তকাল ধরে দোজখের যন্ত্রণাময় শাস্তি। মানুষ সঠিক পথে আসুক তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়-বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সুরা আনআ’মে : . . . আমি তাদের অন্তরের ওপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা তা বুঝতে না পারে। আমি তাদেরকে বধির করেছি। আর তারা সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করলেও তাতে বিশ্বাস করবে না। (সুরা আন’আম ; আয়াত ২৫)। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য আছে সুরা কাহাফে : যখন ওদের কাছে পথের নির্দেশ আসে, তখন কখন ওদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা হবে বা কখন শাস্তি এসে পড়বে এই প্রতীক্ষাই ওদেরকে বিশ্বাস করতে ও ওদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধা দেয়। ( ১৮:৫৫)। আবার এটাও সত্যি যে, কোরানে প্রায় পঞ্চাশটিরও অধিক আয়াত আছে যেখানে আল্লাহকে বিশ্বাস ও অনুসরণ না করার জন্য মৃত্যুর পর অসীম সময় ধরে ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগের হুমকি দেয়া আছে।

কোরানে বাতিলকৃত ও বাতিলকারী আয়াতের উপস্থিতি রয়েছে।” এগুলোকে যথাক্রমে মানসুখও নাসিখ’বলা হয়। সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু বলবেন বা সিদ্ধান্ত দিবেন যা পরে বাতিল করতে হবে এ-রকম ভাবা অযৌক্তিক। ইসলাম মতে, কোরানের সবগুলো আয়াতই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত ক্রিয়াশীল। কিন্তু কোরানে ঠিক এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার, আল্লাহ কোনো বিষয়ে একটা নির্দেশ দিয়েছেন পরে সে নির্দেশের পরিবর্তন এনেছেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, যে আয়াতগুলোর নির্দেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে সেগুলো কোরান থেকে কেন বাদ দেয়া হয়নি? এগুলোর বর্তমান উপযোগিতা কী?-অনুবাদক)। তফসিরকারক এবং ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক কোরানের কয়েকটি বাতিল আয়াতের তালিকা করেছেন। সিদ্ধান্তের পরিবর্তন কেবল মানুষ বা অন্যকেউ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে মানুষ একসাথে সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে আঁচ করতে পারে না। মানুষের চিন্তা কোনো ঘটনার বাহ্যিকরূপ দর্শনে ভ্রান্তির দিকে যেতে পারে কিন্তু তারা অভিজ্ঞতা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে শোধরাতে পারে। সুতরাং মানুষের জন্য এটি বাঞ্ছনীয় যে তারা তাদের অতীত সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে। কিন্তু সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী স্রষ্টার পক্ষে সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা পরিবর্তন অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিরোধী। হজরত মুহাম্মদের বিরোধীরা এ-ব্যাপারটা নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন যে, তিনি আজ এক ধরনের উপদেশ পান তো পরদিন আবার তা বাতিল করে ফেলেন। এদের এই বক্তব্যের জবাবে আরেকটি আয়াত নাজিল হয় ; আমি কোনো আয়াত রদ করলে বা ভুলে যেতে দিলে তার চেয়ে আরও ভালো বা তার সমতুল্য কোনো আয়াত আনি। তুমি কি জান না যে আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান? (সুরা বাকারা : ১০৬)। স্রষ্টা যেহেতু সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তাই স্পষ্টত তিনি এমন কোনো আয়াত নাজিল করতে পারেন না যা পরবর্তীতে বাতিল করতে হয়। যেহেতু স্রষ্টা সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান তাই তিনি এমন নির্দেশনা দিতে সক্ষম যার পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি যিনি স্রষ্টাকে সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করেন তিনি প্রশ্ন তুলতে বাধ্য যে, কেন স্রষ্টা এমন কোনো নির্দেশনা দিবেন যা পরবর্তীতে তাঁর কাছে সঠিক নয় বলে মনে হয়, বিধায় তা প্রত্যাহার করে নেবেন বা পরিবর্তন করবেন।

উপরে প্রদত্ত আয়াতে (২:১০৬) একটা অসংগতি হলো, যেহেতু আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম তাই তিনি কেন উত্তম আয়াতগুলো আগে নাজিল করেননি? দেখা যায় কোরান নাজিল হওয়ার যুগেও কিছু প্রশ্নকারী লোক তাদের অনড় অবস্থানে ছিল। সুরা নাহলে বলা হয়েছে : ‘আমি যখন এক আয়াতের জায়গায় অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি, তখন তারা বলে, “তুমি তো কেবল মিথ্যা বানাও। আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তা তিনি ভালো জানেন, কিন্তু ওদের অনেকেই (তা) জানে না।’ ( ১৬:১০১)।

কোরান আল্লাহর বাণী হলে তাতে মানবীয়-বুদ্ধিমত্তার আলামত থাকার কথা নয়। উপরের আয়াতের অসঙ্গতি একদম স্পষ্ট। আল্লাহ জানতেন তিনি কী নাজিল করছেন। তাই এক আয়াত দ্বারা আরেক আয়াতকে প্রতিস্থাপিত করার ব্যাপারটি সন্দেহের সৃষ্টি করে। এমনকি আরবের হেজাজ অঞ্চলের অশিক্ষিত জনগণের মনেও এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল যে, যিনি (আল্লাহ) তার বান্দাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আবগত, তিনি প্রথমেই তাঁদের (বান্দাদের) জন্য সর্বোত্তম বিধান প্রদান করতে পারেন এবং তাঁকে (আল্লাহ) তাঁর দুর্বল বান্দাদের মতো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হত না। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত অধ্যয়ন ও গবেষণা থেকে এই উপসংহারে পৌছানো যায় যে, কোরানের আয়াতে এসব অসঙ্গতি আল্লাহ ও নবির মধ্যে পরস্পর মিলেমিশে যাওয়ার কারণেই উদ্ভূত হয়েছে। মুহাম্মদের মনের গভীরে মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ প্রোথিত ছিলেন এবং তিনি আরবদের পরিচালনার জন্য হয়েছিলেন আল্লাহর তাঁর উভয় ধরনের (আল্লাহ ও নবি) ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এ ব্যাপারে হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহারের নিরীক্ষণ বেশ চমৎকার ও সম্পূর্ণ বিবেচনাযোগ্য, যা বর্ণিত হয়েছে তাঁর মূল্যবান বই Le dogme et le loi de l’Islam – AH তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতে। তিনি লিখেছেন : “নবিরা দার্শনিক বা ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন না। তাদের বোধশক্তি যে বার্তা তাঁদেরকে বহন করতে উদ্বুদ্ধ করত তা পূর্বপরিকল্পনার দ্বারা তৈরি মতবাদ ছিল না এবং তা প্রণালীবদ্ধ করতে সক্ষম কোনো নীতিমালাও ছিল না। ’

নবি মুহাম্মদ যা শিক্ষা দিয়েছেন তা তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই নির্গত হয়েছিল এবং জনগণ তাঁর প্রদান করা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বিশ্বাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আকার নেয়। পরে ধর্মীয় পণ্ডিতরা জনগণের মধ্যেকার বিভিন্ন বিশ্বাসকে সমন্বয় করে একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ধর্মীয় পণ্ডিতরা ধর্মে কোনো খুঁত বা অসঙ্গতি পেলে বিভিন্নভাবে তা দূর করা বা ব্যাখ্যা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তারা নবি প্রদত্ত প্রতিটি বাণীর একটি গৃঢ় অর্থ কল্পনা বা আবিষ্কার করে নিয়েছেন ও ধরে নিয়েছেন এগুলোর পেছনে কোনো না কোনো যুক্তি রয়েছে। এক কথায় তারা এমন অর্থ ব্যাখ্যা ও ধারণা নিয়ে এসেছিলেন যা স্বয়ং নবির মনে কখনো উদয় হয়নি, এবং সে-সব প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান দিয়েছেন যার সমুখীন নবিকেও কখনো হতে হয়নি। ধর্মীয় পণ্ডিতরা তা করেছিলেন একটি ধর্মীয় ও দার্শনিকভিত্তি-সম্পন্ন ব্যবস্থা হিসাবে এবং বিরুদ্ধবাদীভিন্নমতাবলম্বী ও সংশয়বাদীদের জন্য এক অলঙ্ঘনীয় দূর্গ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। তারা নবির নিজস্ব দর্শনের উপর ভিত্তি করেই তা করেছিলেন। এসব উৎসাহী পণ্ডিতরা যে চ্যালেঞ্জের সমুখীন হননি তা নয়, অন্য ধর্মতাত্ত্বিক ও তফসিরকারক নবির কথার প্রচুর ভিন্ন অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন এবং ভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সমাজ গড়ে তুলেছেন। উল্লেখ্য আমরা বিখ্যাত চার সুন্নি মাজহাবের চার ইমামের কথা ধরতে পারি। তাদের সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। এছাড়া সুন্নি, আহলে হাদিস, শিয়া, কাদিয়ানি ইত্যাদি বিভিন্ন যুগের ধর্মীয় পণ্ডিতদের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দেখা যায়।-অনুবাদক)। যদিও পশ্চিমা ইসলামবিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার তাঁর ভাবনাকে সব ধর্মের ক্ষেত্রে একই সাথে প্রকাশ করেছেন তথাপি তাঁর অন্তদৃষ্টি প্রখর হয়েছে ইসলামের প্রাথমিক সময়ের খারিজি”, শিয়া, মরজিতি”, মুতাজিলা” ও আশারিয়া” ইত্যাদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধকে পর্যবেক্ষণ করার মধ্য দিয়ে। নিজে জন্মসূত্রে ইহুদি হওয়ায় এবং খ্রিস্টান চার্চ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকায় তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে একই ধরনের ব্যাপক বিতর্কের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তবে তিনি একইসাথে ইসলামের বিস্তারের ব্যাপারে গভীর পর্যবেক্ষণে আগ্রহী ছিলেন।

আরও কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা এ-অধ্যায়ে যোগ করা যায়। কোরানে এমন অনেক আয়াত আছে যেগুলো বুদ্ধিমান পাঠকের কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা। যেমন: সুরা ফাতেহর দশম আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপরে অর্থাৎ এটাই বুঝাচ্ছে আল্লাহর ক্ষমতা অনেক বেশি। সুরা ফুরকানের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন। আরশ শব্দের অর্থ রাজসিংহাসন। যেহেতু আল্লাহর কোনো দেহ নেই তাই তিনি কোনো আসনে বসার কথা নয় বরং তিনি হবেন মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ প্রভু। সুরা কিয়ামাতে বলা হয়েছে : “সেদিন কোনো কোনো মানুষের মুখ উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ ( ৭৫:২২-২৩)। এখান থেকে বুঝায় যে, পুণ্যবান নরনারী আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করবে। কোরানে বারবার একথা পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে, আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানী- এ থেকে আমরা বুঝি কোনো কিছুই আল্লাহর অজানা নেই।

অনেক মুসলমান বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনমনীয়। তারা কোরানের যে ব্যাখ্যা হাদিসে আছে শুধু তা-ই গ্রহণ করতে চান এবং মনে করেন ধর্মীয় ব্যাপারে এর বাইরে কোনো যুক্তি বা বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ অনুমোদনযোগ্য নয়। তারা উপরে উল্লেখিত কোরানের আয়াতগুলোকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং বিশ্বাস করেন আল্লাহর মানুষের মতই মাথা, মুখ, চোখ, হাত, পা রয়েছে এবং তিনি ঠিক মানুষের মতই অনুভূতিক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ কোরানে আল্লাহর শোনা, বলা, দেখা এবং মানবসুলভ বিভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ আছে। বাগদাদের একজন ধর্মপ্রচারক আবু মামার আল হুজাইলির (মৃত্যু ২৩৬ হজরি বা ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) মতে কেউ যদি এরকম আক্ষরিক ব্যাখ্যা অবিশ্বাস করে তবে সে কাফের। বিখ্যাত ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের আক্ষরিক অর্থকেই গ্রহণ করেছেন এবং এর প্রতি আজীবন অবিচল ছিলেন। এই মজহাবের পরবর্তী প্রধান আহমদ বিন তায়মিয়া এ-ব্যাপারে এতোই গভীর বিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি মুতাজিলাদের কাফের ও বিশিষ্ট ইসলামি দার্শনিক গাজ্জালিকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করতেন। একদিন তিনি দামেস্কর প্রধান মসজিদে (উমাইয়া মসজিদ) উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভাষণ শেষে মিম্বর থেকে নামতে নামতে বলেছিলেন, “আল্লাহ তাঁর সিংহাসন (আরশ) থেকে এভাবে নামবেন যেভাবে আমি নামছি। ”

এই ধরনের রক্ষণশীল মানসিকতাসম্পন্ন ধর্মান্ধরা শুধু মুতাজিলাদের নয় বরং আশারির মতো ধর্মতাত্ত্বিকদেরও অনৈসলামিক বলে মনে করতেন। তারা তাদের সংকীর্ণ ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিন্নব্যাখ্যাকে বিপজ্জনক উদ্ভাবন বলে অভিহিত করতেন। আবু আমর আল কোরেশি ঘোষণা দিয়েছিলেন সুরা শুরা’র ১১ নম্বর আয়াত : কোনোকিছুই তাঁর মতো নয় যা প্রকাশ করছে তা সরাসরি গ্রহণ করা ধর্মবিরুদ্ধ। তাঁর মতে এ আয়াত দ্বারা কেবল বুঝায় আল্লাহর সদৃশ কোনো পরম সত্তা নেই। কারণ আল্লাহর মানুষের মতোই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। আবু আমর আল কোরেশি শেষ বিচার সংক্রান্ত সুরা কলমের একটি আয়াতের কথা বলেছেন ; সেই দারুণ সংকটের দিনে যেদিন ওদেরকে সিজদা করার জন্য ডাকা হবে, ( সেদিন) কিন্তু ওরা তা করতে পারবে না। (৬৮:৪২)। এরপর কোরেশি নিজের উরুতে হাত দিয়ে আঘাত করে বলেছিলেন, “আল্লাহরও ঠিক আমার মত হাতপা রয়েছে।

গোঁড়া ধর্মবাদীদের এ-রকম বিশ্বাস ইসলাম-পূর্ব যুগের আদিম বিশ্বাস ও প্রথার কথা আমাদের সারণ করিয়ে দেয়। আরবদের মধ্যে থেকে হঠাৎ করে জড়বাদী ধারণা, বিমূর্ত চিন্তায় অক্ষমতা, আধ্যাত্মিক নির্লিপ্ততা, উচ্ছঙ্খলা ও একগুঁয়েমি দূর হয়ে গেছে এমন নয়। সর্বোপরি তাদের মন-মানসিকতা ইরানীয়দের মতো কোনো ভিন্ন জাতি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি অথবা তারা বিভিন্ন ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক দল যেমন মুতাজিলা, সুফি, শিয়া, ইখওয়ানুস-সাম এবং বাতেনাইতদের” সংশ্রবে আসেনি।

এটা সুবিদিত যে, মৌলবাদের ধারা আরবীয়দের মধ্য থেকে আগত এবং ইসলামের প্রথম দিকের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অ-আরবীয়দের কাছ থেকে এসেছে। মুতাজিলা ও তাদের পরবর্তী চিন্তাবিদরা হয় অ-আরবীয় অথবা এরকম আরবীয় যারা গ্রিক ও ইরানীয় প্রভাবে আদিম সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। সবশেষে বলা যায় এসব বিষয় এ অধ্যায়ের প্রথম দিকে দেয়া অভিমতটিকে প্রমাণ করে, ‘মানুষ ঈশ্বরকে নিজের মত করে কল্পনা করে নিয়েছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *