ঐদিন সকালে গ্রামের লোকেরা তাদের বাড়িতে বসে রইল। খোলা দরজার মধ্য দিয়ে উদাসভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। তারা দেখল, মাল্লির লোকজন ও পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা মুসলমানদের ঘরবাড়ি লুঠ করছে। তারা দেখল, গরু-ছাগলকে নির্দয়ভাবে পেটাতে পেটাতে নিয়ে যেতে তারা দেখল, শিখ সৈন্যরা যাচ্ছে, আসছে–যেন মাল্লির ইশারায় তারা কাজ করছে। যন্ত্রণাকাতর পশুগুলোর কাতর ধ্বনি তারা শুনতে পেল ঘরে বসেই। গৃহপালিত মোরগ-মুরগির আর্ত ডাক, ঝটপটানি ও ছুরির আঘাতের পর তাদের নীরবতা তারা উপলব্ধি করল। তাদের কিছুই করার ছিল না— শুধু দেখা আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া।
মাঠ থেকে ছত্রাক তুলে গ্রামে ফিরে একটা রাখাল ছেলে জানোল যে, নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কথায় কেউ কান দিল না। তারা এই ইচ্ছা পোষণ করল যে, নদীর পানি আরও বাড়ক এবং পুরো মানো মাজরা গ্রামটাকে ডুবিয়ে দিক। তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পশু-পাখিসহ তারাও নিমজ্জিত হোক, ঐ পানিতে। কিন্তু তাদের শর্ত একটাই, ঐ পানিতে নিমজ্জিত হতে হবে মাল্লি, তার দলের লোক, পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু ও সৈন্যদেরও।
গ্রামের লোকেরা যখন দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে হতাশা ব্যক্ত করছিল এবং গভীর আর্তনাদে ফেটে পড়ছিল তখন বৃষ্টি ঝরছিল অঝোর ধারায়। শত্রুঘ্ন নদীর পানি বাড়ছিল ক্ৰমান্বয়ে। তীর ছাপিয়ে পানি আশপাশের জমি প্লাবিত করল, শীতকালে পানি সংরক্ষণের জন্য নির্মিত চ্যানেলের মুখে খিলানের ভাররক্ষক স্তম্ভের দুপাশে পানির ঢেউ এসে আছড়াতে লাগল। নির্মিত ঐ চ্যানেলের চিহ্ন আর দেখা গেল না, সব কিছুই ঢাকা পড়ে গেল বাড়তি পানির নিচে। এই পানির ঢেউ বিস্তৃত হলো বড় ব্রিজের পাশ পর্যন্ত। মানো মাজরা গ্রামের চাষাবাদী জমিতে যে বাঁধটি; প্রয়োজনের সময় পানি সরবরাহ করে, সেই বাধেও পানির ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগল। নদীর তীরে ছোট ছোট যে সব উঁচু টিলা ভূমি ছিল তাও ডুবে গেল। পানির ওপর দেখা গেল। আগাছার অগ্রভাগ। সামুদ্রিক পাখি ও শঙ্খ জাতীয় পাখি যে সব গাছে রাত কাটাত, সেই সব গাছের আশ্রয়স্থল ত্যাগ করে তারা উড়ে চলে গেল ব্রিজের ওপর। কয়েকদিন ধরে ঐ লাইন দিয়ে কোন ট্রেন যাতায়াত করেনি।
বিকালের দিকে জনৈক গ্রামবাসী একাধিক বাড়ির কাছে চিৎকার করে বলতে লাগলঃ ওহে বানটা সিং, নদীর পানি বাড়ছে! ও দলিপ সিং, নদীর পানি বেড়ে গেছে! শোন তোমরা, বাঁধের কাছ পর্যন্ত পানি এসে গেছে৷ অবসন্ন দৃষ্টি মেলে। ওরা বলল: এ, খবর আমরা আগেই পেয়েছি। এরপর আর একজন লোক এসে খবর দিল, নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর আর একজন, পরে আরও একজন। সবাই বললঃ তোমরা কি জান, নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে!
শেষে সর্দার সাহেব বেরুলেন সব কিছু নিজের চোখে দেখতে। হ্যাঁ, সত্যি সতি্যু নদীর পানি বেড়েছে। দু’দিনের বৃষ্টিতে এ অবস্থা হয়নি। পর্বতের বরফগলা পানির কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। বন্যার পানি রোধ করার জন্য হয়ত খালের মুখের স্কুইন্সগেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে নদী ছাড়া পানি চলে যাওয়ার আর কোন পথ খোলা নেই। নদীর পানির মৃদু ঢেউ এখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে, নদীর পাড় ভাঙ্গার কারণে সাদা পানির রং মেটে হয়ে গেছে। ব্রিজের স্তম্ভগুলো এখনও দৃঢ় থাকায় নদীর পানির উন্মত্ত ঢেউ ওখানে আছড়ে পড়ে ফিরে আসছে। আশপাশের ছোট ছোট পথে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে, স্তম্ভের ছুচালো শীর্ষে পানির প্রবাহ ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করছে। বৃষ্টির পানি ফোঁটায় ফোঁটায় এখনও ঝরছে। নদী ও সমতল ভূমি একাকার হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির ফোঁটার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায় সমগ্ৰ এলাকা জুড়ে। শত্রুঘ্ন নদীর এ দৃশ্য সত্যি ভয়াবহ!
সন্ধ্যার দিকে মানো মাজরার লোকেরা মুসলমানদের কথা, মাল্লির অপকর্মের কথা ভুলে গেল। আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল নদীর পানি। ঘরের মেয়েরা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখল। লোকেরা মাঝে মাঝে বাঁধের করতে লাগল। সূর্যাস্তের আগে সর্দার সাহেব। আবার নদীর অবস্থা দেখতে পেলেন। বিকালে তিনি যে অবস্থা দেখেছিলেন, তার চেয়ে পানি এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব ঝোপঝাড় আগে পানির অনেক ওপরে ছিল, এখন তার সবটাই ডুবে গেছে। ঐ সব গাছের পাতা ও পাতলা ডাল এখন পানির ওপর ভাসছে। গত কয়েক বছরে শত্রুঘ্ন নদীর পানি এত বেড়েছে কি না তাঁর মনে পড়ে না। বাঁধ থেকে মানো মাজরা এখনও অনেক দূরে। মাটির বাঁধটা এখনও দৃঢ় ও নিরাপদ আছে। তবু বলা যায় না, সারা রাত ধরেই সতর্ক থাকা দরকার। তিনজন করে চারটি দল সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত বাঁধে প্রহরায় থাকতে হবে এবং তারা এক ঘণ্টা অন্তর পরিস্থিতি সম্পর্কে গ্রামবাসীকে অবহিত করবে। বাকিরা সব তাদের বাড়িতেও থাকবে।
সর্দারের ঐ সিদ্ধান্তে সবাই বাড়িতে আরামে ঘুমাল। নিরাপদে থাকার কারণে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত হলো না। সর্দার সাহেব অবশ্য নিজে ভালমতো ঘুমাতে পারলেন না। মধ্যরাতের কিছু পরে পাহারারত তিনজন লোক ফিরে এসে চিৎকার করে কথা বলছিল। তাদের কথায় উত্তেজনা প্ৰকাশ পাচ্ছিল। নদীর পানি বেড়েছে কিনা, ধূসর চাঁদের আলোয় তারা বুঝতে পারেনি। তাদের কথায় এ সম্পর্কে কিছু ছিল না। তবে তারা শুনেছে, মানুষ সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। পানির মধ্য থেকেই তারা ঐ আর্ত চিৎকার শুনেছে। নদীর ওপারে বা নদী থেকেই ঐ চিৎকার শোনা গেছে। সর্দার তাদের সাথে করে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর টর্চ লাইটটাও সাথে নিলেন।
চারজন লোক বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে শক্রিান্ন নদীকে দেখলেন। কালো একটা খন্ডের মত দেখা যাচ্ছে নদীকে। সর্দারের হাতের টর্চের সম্মুখভাগের সাদা গোলাকার অংশ থেকে বিছুরিত আলো পুরো নদীটাি একবার নিরীক্ষণ করে এলো। চঞ্চল পানি ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছু শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু নদীর পানির ওপর পড়া বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ ছাড়া তারা আর কিছুই শুনতে পেল না। সর্দার তাদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তারা কি মানুষের না শিয়ালের শব্দ শুনেছে। তারা যেন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল। একজন অন্য জনকে জিজ্ঞাসা করল, আমরা তো স্পষ্ট মানুষের চিৎকার শুনেছি। তাই না করনাইলা?
হ্যাঁ। খুবই স্পষ্ট চিৎকার। হায়, হায় বলে কেউ যেন আর্তচিৎকার করছিল।
ওরা চারজন হেরিকেনের চারপাশে একটা গাছের তলায় জড়ো হয়ে বসল। বর্ষাতি হিসাবে তারা যে চটের ছালা পরেছিল তা ভিজে গেছে। তাদের পরিধেয় জামা-কাপড়ও ভিজে গেছে। ঘন্টাখানেক পরে বৃষ্টির ধারা কমে এলো। প্রথমে ঝির ঝিরে বৃষ্টি এবং পরে একেবারে থেমে গেল। পশ্চিম দিগন্তে চাঁদ দেখা গেল মেঘের ফাঁক দিয়ে। চাঁদের আলো পানির ওপর প্রতিবিন্বিত হওয়ায় নদীর এপার-ওপার একটা আলো-পথের সৃষ্টি হলো। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় পানির ঢেউয়ের ফলে সৃষ্ট বুদ্ভুদ স্পষ্টভাবে দেখা যেতে লাগল।
ডিম্বাকার আকারের একটা কালো বস্তু ব্রিজের খিলানের সাথে আঘাত খেয়ে মানো মাজরার দিকের বাঁধের দিকে স্রোতে ভেসে এলো। বস্তুটা দেখতে বড় ড্রামের মতো, এর চারপাশে লাঠি বাঁধা। বস্তুটা কিছুটা এগিয়ে গেল, কিছুটা পিিছয়ে গেল এবং এক সময় নদীর এক পাশে সরে গেল। স্রোতের টানে বস্তুটা চাঁদের আলোর পথে পৌঁছল এবং বাঁধের ওপর বসে থাকা ঐ চারজন লোক থেকে তা খুব দূরে ছিল না। এটা ছিল একটা মৃত গরু। এর পেটটা এমনভাবে ফুলে উঠেছিল যে, দেখতে অনেকটা বড় ব্যারেলের মতো। এর পা কাঁটা ছিল শক্ত এবং তা ছিল। ওপরের দিকে উত্থিত। এর পর ভাসতে দেখা গেল কিছু ঘাস-বিচালি এবং তারপর এক বোঝা কাপড়।
এসব দেখে সর্দার বললেন, দেখে মনে হয় কোন গ্রাম বন্যায় ভেসে গেছে। চুপ করুন! শুনুন চাপা গলায় এক জন বলল। কারও বিলাপের মূৰ্ছিনা নদীর অপরদিকের কিনারা থেকে শোনা গেল।
তুমি শুনতে পাচ্ছে?
চুপ কর!
তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে এ শব্দ শোনার অপেক্ষায় রইল।
না। এ শব্দ কোন মানুষের হতে পারে না। ওটা ছিল গুড় গুড় শব্দ। ওরা আবার শুনল। হ্যাঁ, ওটা গুড় গুড় শব্দই। একটা ট্রেনের শব্দ। এর ছশ দুশ শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। এর পর ওরা দেখল ইঞ্জিনের অগ্রভাগ এবং ক্ৰমে ট্রেনের পুরো অংশ। ইঞ্জিনের ধোঁয়া বেরুনোর ফাঁক দিয়ে এমনভাবে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে, যেন মনে হয়, কেউ আতসবাজি পোড়াচ্ছে। ট্রেনের কামরায় কোন খভাগের লাইটও জুলছে না। ব্রিজের ওপর ট্রেনটা আসার পর ব্রিজের ওপর বসা সামুদ্রিক পাখি নীরবে নদীর দিকে আর শংখ। থামল। ট্রেনটা এলো পাকিস্তান থেকে।
ট্রেনে কোন বাতি নেই।
ইঞ্জিন থেকেও হুইসেল বাজল না।
এটাও ভৌতিক ট্রেনের মতো।
ভগবানের দোহাই, এ ধরনের কথা বলে না, সর্দার বললেন, এটা মাল ট্রেনও হতে পারে। এর যে সাইরেন আছে তা তোমরা শুনেছ। আমেরিকার তৈরি এই নতুন ইঞ্জিন এমনভাবে শব্দ করে যেন কেউ খুন হয়েছে।
না সর্দার, আমরা প্রায় এক ঘণ্টা আগে শব্দ শুনেছি; একই শব্দ শুনলাম ট্রেন আসার আগে, একজন বলল।
এখন আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। কারণ ইঞ্জিনটা এখন আর কোন শব্দই করছে না।
রেল লাইনের উল্টো দিকে আগে যেখানে হাজার বেশি। মৃতদেহ পোড়ানো হয়েছিল থেকে একটা শিয়াল দীর্ঘ একটা বিলাপপূৰ্ণ ডাক দিল। ঐ ডাকের সাথে আরও শিয়াল ডেকে উঠল। এক্যোগে। লোকগুলো ভয়ে আঁতকে উঠল।
শিয়ালের কান্না। কোন লোক মারা গেলে মেয়েরা যেমন কাঁদে ঠিক সেই ধরনের কান্না, সরদার বললেন।
না না, একজন প্রতিবাদ করে বলল, না। এটা মানুষের কান্না। আপনার কথা। যেভাবে আমি স্পষ্ট শুনছি, ঠিক সেভাবেই ঐ কান্না শোনা যাচ্ছে।
ওরা বসে শুনল, দেখল। বন্যার স্রোতে ভেসে আসছে পৃথক করা যায় না। এমন অদ্ভুত ধরনের বস্তু। আকাশের চাঁদ অস্তমিত হওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য অন্ধকার ঘনিয়ে এ। এর পর পূর্বকাশ হলো ধূসর। লম্বা লাইন দিয়ে শব্দ করে বাদুড় উড়ে গেল নদীর ওপারে। কাকেরা তাদের ঘুমের মধ্যে থেকেও কা কা শব্দে মেতে উঠল। ঝোপের মধ্য থেকে কোয়েলের তীক্ষ্ণ ডাক ভেসে এলো। মনে হলো, সমগ্র জগতটাই যেন জেগে উঠেছে।
মেঘ সরে গেল উত্তর দিকে। আস্তে আস্তে সূর্যের আলো। বৃষ্টিভেজা সমতল ভূমিতে সূর্যরশ্মি কমলা রংয়ের উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত। সব কিছুই যেন সূর্যের আলোয় ঝলসে উঠল। নদীর পানি আরও বেড়েছে। এর কর্দমাক্ত পানিতে ভেসে যাচ্ছে গরুর গাড়ি, ফুলে-ফেপে ওঠা গরুর মৃতদেহ-তখনও গাড়ির সাথে বাঁধা। ঘোড়ার মৃতদেহ পানির মধ্যেই ওলট-পালট হয়ে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে। মনে হয়, ঘোড়া তার পিঠ ওপরের দিকে রাখার চেষ্টা করছে তখনও। পুরুষ ও মহিলার মৃতদেহও ভাসছে, কাপড় জড়িয়ে আছে ওদের নিম্প্রাণ দেহে। ছোট ছোট শিশু যেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পানির ওপর, পানিতে হাত দুটা ভাসছে। পশ্চাৎ দিকটা মাঝে মাঝে ডুবছে, আবার ভাসছে। আকাশে অসংখ্য চিল ও শকুনের আনাগোনা শুরু হলো। নদীর পানির ওপরে ভাসমান মৃতদেহের ওপর তারা নিরাপদে এসে বসছে। মৃতদেহ উল্টে না যাওয়া পর্যন্ত তারা ঠুকরে ঠুকরে থাচ্ছে। এর পর মৃতদেহের কিছু টুকরা নিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই পানির ওপর পড়ে যাচ্ছে ঐ সব টুকরা।
দুঃখের সাথে সর্দার বললেন, রাতে বোধ হয় কিছু গ্রাম বন্যায় ভেসে গেছে।
তার একজন সঙ্গী বলল, রাতে গাড়িতে গরু বেঁধেছে কে?
ঠিক কথা। গরুগুলো গাড়ীর সাথে জোড়া থাকবে কেন?
ব্রিজের খিলাদের দিক থেকে বহু লোকের বিকৃত মৃতদেহ ভেসে আসতে দেখা গেল। সেতুর ভার রক্ষার জন্য নির্মিত নির্মিত স্তম্ভে এসে ঐসব মৃতদেহ আঘাত খেয়ে থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এর পর ঘূর্ণায়মান পানির স্রোতে ঘুরতে ঘুরতে যাত্রা করল অনির্দিষ্ট ঠিকানার উদেশে। লোকগুলো ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল নদীর ধারে পড়ে থাকা কয়েকটি মৃতদেহ দেখতে।
মৃতদেহগুলো ওরা পরখ করে দেখল।
সরদার, ওরা ডুবে মরেনি। ওদের মারা হয়েছে।
পানির ওপর সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ সটান শুয়ে আছে। ওর হাত দু’টো দুদিকে এমনভাবে প্রসারিত ছিল যে, মনে হয়, ওকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। হাঁ করা মুখের মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে দাঁতের মাড়ি দেখা যায়, দাঁত নেই। কাপড় দিয়ে তার চোখ দু’টো বাঁধা, মাথার চুলগুলো এমন এলোমেলোভাবে আছে যেন মনে হয় সাধুর বেশ। তার ঘাড়ে একটা গভীর ক্ষত, ঐ আঘাতটা নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। বৃদ্ধের হাতের ওপর একটা শিশুর মাথা। ওর পিঠেও একটা গভীর ক্ষত। নদীর স্রোতে আরও মৃতদেহ ভেসে আসছে। পাহাডের ওপর গাছ কেটে তা সমতল ভূমিতে আনার জন্য যেমন নদীতে ভাসমান অবস্থায় আনা হয়, তেমনিভাবে ভেসে আসছে মৃতদেহ-মানুষ, পশুর। কিছু মৃতদেহ পুলের নিচের পানির মধ্য থেকে বেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু মৃতদেহ পুলের খুঁটির সাথে আঘাত খেয়ে উল্টে-পাল্টে আশেপাশে সরে যাচ্ছে, যেন তাদের ক্ষত স্থান দেখাবার জন্য। অতঃপর স্রোতের আওতায় এসে তারাও চলে যাচ্ছে। কারও হাত-পা নেই, কারও পেট কার্ট অনেক মহিলার স্তন ধারালো অন্ত্র দিয়ে কাটা। সূর্যের কিরণসিক্ত নদীতে ওরা ভেসে যাচ্ছে। কখনও ডুব।ছে, কখনও ভাসছে। ওদের ওপরে আছে ছিল আর শকুন।
সর্দার ও তাঁর সঙ্গীরা মাথার পাগড়ির একটা অংশ মুখে দিল। গুরু, আমাদের প্রতি দয়া করা, কেউ ফিসফিস করে বলল।
কোথাও নির্মম খুনখারাবী হয়েছে। পুলিশকে আমাদের জানানো দরকার।
পুলিশ? আর একজন লোক বিরক্ত প্রকাশ করে বলল, ওরা কি করবে? ওরা তো শুধু ডাইরীতে লিখে রাখবে।
অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ওরা গ্রামে ফিরল। গ্রামের লোকদের ওরা কি বলবে ঠিক করতে পারল না। নদীর পানি আরও বেড়েছে? আরও গ্রাম বন্যা প্লাবিত হয়েছে? নদীর উজানে গণহত্যা হয়েছে? শত্রুঘ্ন নদীতে কি শয়ে শয়ে লাশ ভাসছে? না শুধু চুপ করেই থাকবে?
ওরা যখন গ্রামে ফিরে এলো, ওদের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য গ্রামবাসীরা কোন আগ্রহ দেখাল না। ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে ওরা স্টেশনের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। কয়েক দিন পর দিনে একটা ট্রেন মানো মাজরায় এসে থেমেছে। ট্রেনের ইঞ্জিন যেহেতু পূর্বদিকে, সেহেতু এটা পাকিস্তান থেকে এসেছে। ঐ সময়ও স্টেশনে বহু সৈন্য ও পুলিশকে দেখা গেছে। পুরো স্টেশন এলাকা ওরা ঘিরে রেখেছিল। বাড়ির ছাদ থেকেই ঐ লাশ দেখে প্রত্যক্ষদর্শীরা শিউরে উঠেছিল। শিশু ও মহিলার ওপর নির্যাতনের কথা লোকে আলোচনা করেছে। লাশগুলো কাদের তা কেউ জানতে চায়নি বা নদীর ধারেও ওরা যায়নি মৃতদেহ দেখতে। স্টেশনে আরও নতুন কিছু দেখার আগ্রহে ওরা বাড়ির ছাদ ছেড়ে যায়নি কোথাও। শেষ এই ট্রেনটার পর আরও তো ট্রেন আসতে পারে!
ট্রেনের কামরায় কি আছে তা নিয়ে তাদের কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না। ওরা নিশ্চিত ছিল যে, এখনই সৈন্যরা বেরিয়ে আসবে তেল ও কাঠ সংগ্রহ করতে। দেয়ার মতো বাড়তি তেল তাদের কাছে নেই, যে কাঠ আছে তা ভেজা। ফলে সহজে তা জ্বালানো কষ্ট হবে। কিন্তু সৈন্যরা এলো না। দেখা গেল, ঐ স্থানে কোথা থেকে একটা বুলডোজার এলো। ক্টেশনের উল্টো দিকে মানো মাজরা গ্রামের পাশে মাটি খুঁড়তে শুরু করল ঐ বুলডোজারটি। মনে হলো মাটি খুঁড়ে সে খেয়ে ফেলল এবং এর পর পরই মুখ উঁচু করে চিবিয়ে তা এক পাশে ফেলে দিল। কয়েক ঘণ্টা ধরে সে এ কাজই করল। প্রায় পঞ্চাশ ফুট লম্বা ত্রিকোণ বিশিষ্ট একটা গভীর খাদ সৃষ্টি হলো। খাদের দুপাশে মাটির পাহাড় দেখা গেল দূর থেকে। কিছুক্ষণের জন্য থামল বুলডোজারটি। যে সব সৈন্য ও পুলিশ অলসভাবে বুলডোজারের মাটি খোঁড়া দেখছিল, তাদের ডাকা হলো। লাইন করে ওরা প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেল। দেখা গেল, দুজন সৈন্য একটা করে স্ট্রেচার নিয়ে খাদের দিকে এগিয়ে আসছে। খাদের কাছে এসে স্ট্রেচার কাৎ করে সৈন্যরা স্ট্রেচার খালি করে আবার ছুটছে প্লাটফর্মের দিকে, স্ট্রেচার ভর্তি করে আরও কিছু আনতে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে একই কাজ করুল সৈন্যরা। এর পর আবার বুলডোজার গর্জে উঠল। মুখ খুলে সে তার নিজের খোড়া মাটি খের মধ্যে পুরে বমি করার মতো করে ঐ মাটি আবার উগরে দিল খোড়া গর্তের মধ্যে। সমতল ভূমির সাথে গর্তের মাটি সমান না হওয়া পর্যন্ত সে এ কাজ করল অত্যন্ত দ্রুত। আঘাতপ্রাপ্ত ও ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় দেখা গেল। ঐ গর্তের স্থানটি। শিয়াল ও অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুর কবল থেকে রক্ষার জন্য স্থানটির পাহারায় নিযুক্ত রইল দুজন সৈন্য।