একদিন জাফর আর মাসরুরকে সঙ্গে করে খলিফা হারুণ অল রসিদ টাইগ্রীসের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। বেড়াতে বেড়াতে এক সময় তিনি একটা সেতুর ওপরে এসে দেখলেন এক অন্ধ পদ্মাসন হয়ে বসে ভিক্ষে মেগে চলেছে। সুলতান হাত বাড়িয়েএকটি স্বর্ণমুদ্রা দিলো তার ভিক্ষাপাত্রে। অন্ধটি সঙ্গে সঙ্গে দাতার হাতখানা চেপে ধরে, আপনার এই দান-এর যোগ্য প্রতিদান আপনি পাবেন মালিক। আল্লাহ আপনাকে সবচেয়ে সেরা বস্তু দান করবেন। আমার। একটা অনুরোধ আছে, আপনাকে রক্ষা করতে হবে।
খলিফা ঈষৎ বিরক্তই হলেন। বলেন, বেশ তো কী অনুরোধ, বলল শুনি।
—আমাকে যারা দান করেন তাদের হাতের একটা ঘুষি না পেলে আমি কিছুই গ্রহণ করতে পারি না। তাই আপনাকেও আমার অনুরোধ, যদি দিতেই চান তবে আমার মুখে একটা ঘুষি লাগিয়ে দিন।
খলিফা অবাক হন, সে কি কথা, তুমি অন্ধ আতুর মানুষ। আমি দয়াপরবশ হয়ে তোমাকে সাধ্যমতো কিছু দান করবো, তা ঘুষি দিতে যাবো কেন?
-তা যদি না-দিতে পারেন মালিক, আপনার দান আপনি ফিরিয়ে নিন। আমার শপথ আছে, নিতে পারবো না।
বৃদ্ধ অন্ধটার একগুয়েমী দেখে খলিফা বেশ বিরক্তই বোধ করেন। কিন্তু লোকটা দান গ্রহণ করবে না। অগত্যা বাধ্য হয়ে তার কানের গোড়ায় ছোট্ট একটা টোকা দিয়ে রেহাই পান।
একটু দুরে গিয়ে জাফরকে বলেন খলিফা, ইয়া আল্লাহ একি আজব মানুষ। নিশ্চয়ই ওর জীবনে এমন কোনও ঘটনা ঘটেছিলো, যার জন্যে এই ধরনের এক অদ্ভুত শপথ নিতে হয়েছিলো। যাও লোকটার কাছে গিয়ে বলে এসো আগামীকাল দুপুরে তাকে খলিফার দরবারে হাজির হতে হবে।
জাফর ফিরে এলে আবার খলিফা হাঁটতে থাকেন। কিছু দূরে গিয়ে আর এক ভিক্ষুকের দেখা পান। লোকটি খঞ্জ! মুখের এক পাশ কাটা। সেও ভিক্ষাপাত্র বাড়িয়ে ধরলো। খলিফা সহজভাবে একটি দিনার দিলেন তার পাত্রে। স্বর্ণমুদ্রা দেখে লোকটির চোখ দুটো চকচক করে ওঠে, ওরে বাবা, গোটা একটা মোহর? যখন মাদ্রাসার মৌলভী ছিলাম তখনও এক সঙ্গে একটা গোটা মোহর চোখে দেখিনি কখনও।
–লোকটা বলে কি, হারুণ অল রসিদ বিস্ময়াহত হয়ে বলেন, একটা মাদ্রাসার মৌলভীর এই দীন ভিখারীর দশা হলো কি করে? জাফর, লোকটা কি সত্যিই বলছে? সে কি কোনওকালে শিক্ষক ছিলো তোমার মনে হয়? যাই হোক মনে হচ্ছে, এরও জীবনের ঘটনাস্রোত সোজা পথে বয়ে চলেনি। তা না হলে আজ সে ভিক্ষে করে খাবে কেন? তুমি একেও কাল দুপুরে আমার দরবারে হাজির করবে! জাফর বলে, জো কুম, জাঁহাপনা।
এরপরে ওরা তিনজনে আরও খানিকটা এগোতে অন্যতম ভিখারীর উচ্ছ্বসিত আশীর্বাণী শুনতে পেলেন। সুলতান দেখলেন, এক বৃদ্ধ সওদাগর বেশ মুঠিভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দান করছে ভিক্ষুকটিকে এবং তাতে সে দিশাহারা হয়ে কি ভাবে তাকে যে কৃতজ্ঞতা জানাবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। খলিফা লক্ষ্য করলেন, বৃদ্ধ সত্যই বেশ মোটা অঙ্কের মুদ্রা দরাজহাতে দান করেছে তার পাত্রে। খলিফা অবাক হলেন এই ভেবে, একজন সাধারণ নাগরিক যা দান করতে পারে তিনি নিজে সুলতান হয়েও তা পারেন না। জাফরকে বললেন তিনি, শোনো সাহেবকে কাল দুপুরে খলিফার দরবারে হাজির হতে বলো।
আরও একটু এগোতে খলিফা দেখলেন রাস্তার দু পাশের মানুষজন সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে পালাচ্ছে, আর এক অশ্বারোহী সেনাপতি হাঁক ছাড়ছে। এই, খবরদার, পথ ছেড়ে দাঁড়াও। চীন-সম্রাটের রাজকুমারীর স্বামী আসছেন! হট যাও, তফাত যাও, মহামান্য চীন-সম্রাটের জামাতা হিন্দুস্তানের সম্রাট আসছেন এই পথে। দেখা গেলো একটি প্রিয়দর্শন যুবক রাজবেশে সুসজ্জিত হয়ে অশ্বারোহী সেনাপতিটির পিছনে পিছনে এগিয়ে আসছে।
খলিফা জাফরকে বললেন, আমার শহরে এমন মেহেমান এসেছেন। নিশ্চয়ই আলাপ-পরিচয় করা দরকার। জাফর, তুমি ঐ মিছিলের পিছনে পিছনে ধাওয়া কর। দেখ, তারা কোথায় গিয়ে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই আমার এই শহরেই কোথাও রাত্রিবাস করবে। তুমি কাল দুপুরে আমার দরবারে তাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসবে। আমি আর মাসরুর প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছি। এদের খোঁজ খবর নিয়ে তুমিও ফিরে এসে জানাও আমাকে। এদের খবরা-খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবো আমি।
আরও খানিকটা এগোতে খলিফা দেখলেন, এক যুবক একটা সুন্দর মাদী ঘোড়ায় চেপে সাঁই সাঁই করে চাবকাচ্ছে আর ঘোড়াটি তারস্বরে চিহি চিহি করে চিৎকার ছাড়ছে। কিন্তু যুবকের কি অমানুষিক খেলা! গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে বা ঘোড়াটাকে সে একটানা বেদম প্রহার করেই চলেছে। উঃ কী নৃশংস!
একটুক্ষণের মধ্যেই সাদা ঘোড়াটার গা ফেটে লাল রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে থাকলো, কিন্তু তবুও ছেলেটি ক্ষান্ত হতে চায় না।
খলিফা নিজে এক অশ্বপ্রিয় ব্যক্তি। ঘোড়াকে কেউ কষ্ট দিচ্ছে দেখলে তিনি ঠিক থাকতে পারেন না। পথচারীদের অনেককে ডেকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপারটা কী? সাহেব এতে ক্ষেপে গেছেন কেন?
কিন্তু খলিফার প্রশ্নের কেউই জবাব দিতে পারে না। বলে, খোদা জানেন, আমরা কি করে বলবো? তবে এইটুকু শুধু বলতে পারি, এই যুবক নিয়ম করে প্রতিদিন ঠিক এই সময় ঘোড়ায় চেপে এখানে আসেন এবং এলোপাতাড়ি পিটাতে পিটাতে রক্তের বন্যা বইয়ে দেন। কেন, কী কারণে তা কেউ জানে না।
খলিফা মাসরুরকে বললেন, যাও ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর কেন সে এইরকম ভাবে এক নিরীহ জানোয়ারের ওপর অত্যাচার করে। যদি সহজ কথায় জবাব না দেয় ওকে গ্রেপ্তার করে কাল দুপুরে আমার দরবারে হাজির করবে।
এরপরে হারুণ অল রসিদ প্রাসাদে ফিরে এলেন।
ত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
আটশো একষট্টিতম রজনী। আবার সে বলতে থাকে–
পরদিন দুপুরের নামাজ শেষে খলিফা দরবারে এলেন। জাফর সুলতানের সামনে ঐ পাঁচজনকে হাজির করলেন। সকলে যথাবিহিত কুর্ণিশ জানিয়ে সুলতানের মসনদের সামনে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকলো। খলিফা ইশারায় তাদের বসতে আদেশ করলেন।
তখন খলিফা সেই সাদা ঘোড়ার সওয়ার যুবককে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি কাল বিকেলে নিজের চোখে দেখেছি তুমি একটি বোবা জানোয়ারের পিঠে চেপে নির্মমভাবে তাকে প্রহার করছিলে। কিন্তু কেন, কারণ কী? তুমি তোমার ঘোড়ায় চাপবে তাতে কোনও অপরাধ নাই। কিন্তু একটা অসহায় জানোয়ারকে ঐ ভাবে প্রহার করা অমানুষিকতা। সহ্য করা যায় না। আমি এও লক্ষ্য করেছি সেখানে যারা উপস্থিত ছিলো তারা সকলেই তোমার ত্রাসে আতঙ্কিত। কেউ কিছু জানে কি না জানি না, কিন্তু আমরা বারবার জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও তারা মুখ খুলতে সাহস করলো না। এরই বা কারণ কী? আমার এমনই ক্রোধ জন্মেছিলো, নিজের ছদ্মবেশের কথা ভুলে গিয়ে তখুনি তোমাকে সমুচিত শিক্ষাদানের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সে যাই হোক, নিজেকে সামলে নিয়ে কোনও রকমে ঘটনাস্থল থেকে চলে এসেছি। কিন্তু তা বলে ব্যাপারটা আমি ভুলতে পারিনি আদৌ। আজ তোমাকে ডাকা হয়েছে তার উপযুক্ত কারণ দর্শাবার জন্য। তোমার সব কথা। শোনার পর আমি যদি সন্তুষ্ট হই তবেই তুমি রেহাই পাবে; নচেৎ যোগ্য সাজা তোমার, জন্য অপেক্ষা করছে। নাও, দেরি কোরো না তোমার যদি কিছু বক্তব্য থাকে দ্বিধাহীন চিত্তে তা পেশ করতে পার এখানে।
খলিফার ফরমান শুনে ঘোড়সওয়ার বাবাজীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ঘাড় গুজে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। দু’গাল বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা।
যুবককে কাঁদতে দেখে খলিফা কিছুটা নরম হয়ে বললেন, তোমার কিছু ভয় নাই। তুমি ভুলে যাও, তোমার সামনে স্বয়ং খলিফা বসে আছেন। নাও, খোলসা করে বলো দেখি কাহিনীটা কী? ঠিক আছে, আমি তোমাকে জবান দিচ্ছি, তোমাকে কোনও সাজা দেব না। অবশ্য যদি সত্যি কথা সব খুলে বলল।
জাফরও ভরসা দেয়, ভয় নাই, জাঁহাপনা যখন অভয় দিচ্ছেন তখন নির্ভয়ে সত্যি কথা বলতে পার তুমি।
এরপর যুবকটি চোখের জল মুছে মুখ তুলে সোজা হয়ে বসে।