3 of 4

৪.১৭ তিন পাগলের কাহিনী

একদিন প্রহরীরা তিনজনকে ধরে এনে হাজির করলো সুলতান মামুদের সামনে। সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কে?

তিনজনেই বললো, তারা কেউ পাগল নয়। প্রহরীরা ভুল করে তাদের পাকড়াও করেছে।

সুলতান বললেন, বেশ তোমাদের কাহিনী শোনাও দেখি।

একজন এগিয়ে এসে কুর্ণিশ করে বলতে শুরু করলো?

—জাঁহাপনা, আমি একজন রেশমী কাপড়ের সওদাগর। আমার বাবা, তার বাবাও এই ব্যবসা করতেন। হিন্দুস্থান থেকে সুন্দর সুন্দর কাশ্মীরি রেশমের পোশাক-আশাক এনে এখানকার আমির বাদশাহদের কাছে বেশ চড়া দামে বিক্রি করাই আমার একমাত্র নেশা। এতে বেশ মোটা লাভ থাকে।

একদিন দোকান খুলে বসে আছি আমি, এক সময় এক বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে এক খানদানি ঘরের সুন্দরী এলেন। ভালো ভালো দামী যা কাপড়-চোপড় আছে দেখাতে বললেন।

একখানা কাপড় বের করে দেখাতেই তার পছন্দ হয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলেন কত দাম।

শাঁসালো মক্কেল পেয়েছি, দামটা চড়িয়েই বললাম, পাঁচশো দিনার।

মেয়েটি কোনও দরদাম করলো না। বৃদ্ধাকে নির্দেশ করতে সে পাঁচশো দিনার গুণে দিয়ে দিলো। আসলে কাপড়খানার নাম দেড়শো দিনার। মফতে সাড়ে তিনশো দিনার বাড়তি মুনাফা হয়ে গেলো।

পরদিন আবার এলো সুন্দরী। আর একখানা কাপড় দেখাতেই পছন্দ করে পাঁচশো দিনার গুণে দিয়ে নিয়ে গেলো।

এরপর এক নাগাড়ে পর পর পনেরদিন সে আমার দোকানে এসেছিলো। এবং প্রতিদিন একটি করে কাপড় পাঁচশো টাকা গুণে দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রতিটা কাপড়েই মোটা লাভ করে আমি ফুলে উঠেছি।

কিন্তু সোল দিনের দিন মেয়েটি এসে একখানা কাপড় পছন্দ করার পর দাম দিতে গিয়ে দেখলো, দিনারের থলেটা আনতেই সে ভুলে গেছে। লজ্জিত হয়ে বললো, ইস টাকাই আনতে ভুলে গেছি। থাম, আজ আর নেব না। কাল নিয়ে যাব।

আমি বললাম, আহা, তাতে কি হয়েছে, নিয়ে যান। এর পরে যখন সুবিধে হয় দিয়ে যাবেন। আর যদি ভুলে যান আরও খুশি হবো।

মেয়েটি বললো, না তা হয় না। ধারে আমি নেব না। কাল নগদ পয়সা দিয়ে নিয়ে যাবো। আমি দেখলাম এর আগে পনেরখানা কাপড়ে যা বাড়তি মুনাফা করেছি তাতে এ-রকম দু’চারখানা কাপড় বিনে পয়সায় দিলেও আমার কোন লোকসান নাই। তাই সৌজন্যের বাকযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো দু’জনের মধ্যে। নগদ না দিয়ে সে কিছুতেই নেবে না। আর আমিও তাকেনা গছিয়ে ছাড়বো না। শেষে একটা রফা হলো। মেয়েটি বললো, নিতে পারি, একটা শর্তে। আপনি আমার সঙ্গে যাবেন আমার গরীবখানায়। আমি দাম দেব আপনাকে। নিয়ে চলে আসবেন।

আমি হাসলাম, আপনার দৌলতখানায় নিয়ে যেতে চান, পা বাড়িয়েই আছি। হাজার বার যাবো। কিন্তু মহাজনের মতো পাওনা পয়সা আদায় করতে নয়।

মেয়েটি হাসলো, বেশ তো মেহেমান হয়ে চলুন। আমার ঘরে আপনার পায়ের ধুলো পড়লে ধন্য হবো আমি।

আর দ্বিধা না করে দোকান বন্ধ করে ওর পিছনে পিছনে অনুসরণ করে চললাম আমি। এক সময় এটা গলির মুখে এসে মেয়েটি একখানা বড়সড় রুমাল বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, যদি কিছু মনে না করেন, চোখ দুটো বেঁধে এই বৃদ্ধার হাত ধরে আসুন একটুখানি পথ।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন কী ব্যাপার?

মেয়েটি বললো, ও কিছু না, এই গলিটার দু’পাশের বাড়ির জানালায় অনেকগুলো খুবসুরত লেড়কী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পথচারীদের যাওয়া আসা দেখে। তাদের কাউকে যদি আপনার নজরে ধরে যায় সেই ভয়েই বাঁধতে বলছি।

হো হো করে হেঁসে উঠলাম, ও, এই কথা। তা বেশ, শক্ত করেই বাঁধছি।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো পঁয়ত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

কয়েক পা চলার পরই একটা বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছালাম আমরা। মেয়েটি কড়া নাড়লো। কে যেন দরজা খুলে দিলো। আমরা ভিতরে ঢুকলাম। বৃদ্ধা আমার চোখের পটি খুলে দিলো। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, এক সুরম্য প্রাসাদের ঝলমলে মহলে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। জীবনে কখনও ঐ রকম ঘরদোর প্রত্যক্ষ করিনি। গল্প কাহিনীতে অনেক সুলতান বাদশাহর নয়নাভিরাম প্রাসাদকক্ষের বর্ণনা শুনেছি, কিন্তু সেদিন নিজের চোখে যা দেখলাম তা আমার কল্পনা-রসজারিত সেই সব মানস-প্রাসাদের বিলাস-বাসনাকে হার মানিয়ে দিলো।

বৃদ্ধা আমাকে একটি ছোট ঘরে বসিয়ে অন্দরে চলে গেলো। সে ঘরের খোলা দরজা দিয়ে পাশের বিশাল কক্ষের চোখ বাঁধানো বাহার দেখে মোহিত হয়ে গেলাম আমি।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ঐ ঘরের এক কোণে অবহেলা ভরে স্তুপীকৃত করে ফেলে রেখেছে আমার কাছ থেকে কেনা রেশমী কাপড়গুলো। অত দামী দামী দুষ্প্রাপ্য কাপড়গুলোর দশা দেখে বুকের মধ্যে টনটন করতে লাগলো। আহা, এর একখানা কাপড় পেলে মেয়েরা কত যত্ন করে আলমারীতে তুলে রাখে। আর এতোগুলো মূল্যবান কাপড় এমন অযত্ন করে দলা পাকিয়ে ফেলে রেখেছে ওখানে?

করুণ চোখে কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় দুটি মেয়ে পানির গামলা হাতে করে ঢুকলো ওঘরে। ঐ রেশমী কাপড়গুলো গামলার পানিতে চুবিয়ে চুপড়ি করে স্ফটিকের তৈরি ঘরের মেঝেটার জল মুছে ঝকঝকে তকতকে করতে থাকলো। •

সত্যিই এ দৃশ্য অসহ্য। মানুষের পয়সা থাকলেই কি তা এইভাবে অপব্যবহার করতে হয়? কাপড়গুলো ওরা ফালা ফলা করে ফেঁড়ে ফেলে ন্যাতা বানিয়ে ফেললো!

ধোয়া মোঁছা হয়ে গেলে মেঝেয় মূল্যবান গালিচা এনে পেতে দিলো ওরা। তারপর, এক এক করে কেদারা কুর্শি, পালঙ্ক আসনে নিখুঁত এবং চমৎকার করে সাজিয়ে ফেললো কিছুক্ষণের মধ্যে।

এরপর সেই বৃদ্ধা এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেলো ওই ঝকঝকে সাজানো গোছানো ঘরখানায়।

আমি ভাবলাম, এবার আর রক্ষা নাই, নিশ্চয়ই এরা আমাকে মেরে ফেলবে। এখন আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।

কিন্তু সেই সুন্দরী আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে এগিয়ে এলো আমার সামনে। মুখে হাসি, চোখে লাস্য। হাতে ধরে নিজের পাশে রাখলো আমাকে। আমি নিরুপায়, প্রতিবাদ করবো, সাধ্য কি! সুবোধ বালকের মতো বিনা প্রতিবাদে বসে পড়লাম তার গা ঘেঁষে।

মেয়েটি মধুর করে হেসে আমার কানে কানে বললো, কী, আমাকে দেখে পছন্দ হচ্ছে না? আমি যদি। তোমাকে সারা জীবনের মতো স্বামী করে পেতে চাই, পাবো না?

আমি বললাম, কিন্তু মালকিন, আমার মতো সাধারণ এক সওদাগর আপনার যোগ্য হবে কি করে? আমি যদি সুখ-স্বপ্নও দেখি—তবু তো আপানর নফর বান্দা হওয়ার সৌভাগ্য ছাড়া অন্য কিছুই কল্পনা করতে পারবো না।

সুন্দরী বললো, না, না, তোমার ওসব এড়িয়ে যাওয়ার কথা আমি শুনতে চাই না। আমাকে কথা দাও তুমি রাজি কিনা। ভেবো না, কোনও ঝোঁকের মাথায় এসব কথা বলছি। আমার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ তোমার সঙ্গে মিলিত হতে চায়, আমি তোমাকে মন প্রাণ সঁপে দিয়েছি, মেরি জান!

ভেবে পেলাম না দুনিয়াতে এতো সুন্দর সুন্দর নওজোয়ান থাকতে আমাকে সে এতো পছন্দ করলো কি দেখে! তবে এও ঠিক, ভালোবাসা এমনই বস্তু যা কখনও যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না।

মেয়েটি আমাকে নীরব থাকতে দেখে বললো, চুপ করে থেক না। কথা দাও, আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না। তোমার মত পেলে এক্ষুনি আমি কাজীকে ডেকে পাঠাবো। আজই হবে আমাদের প্রথম মিলন উৎসব।

আমি না করতে পারলাম না। এবং সেই রাতেই আমাদের শাদী হলে গেলো। এ এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড বটে।

পরপর কুড়িটি সুখ-সঙ্গমের বিনিদ্র রজনী অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। বৃদ্ধা মায়ের জন্য চিন্তিত হলাম আমি। বিবিকে বললাম, দেখ, বেশ কিছুদিন বাড়ি ছাড়া, আমার বুড়ো মা বেচারা বোধহয় কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে। তাছাড়া দোকানপাটও বন্ধ আছে—ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে যে।

সে বললো, ঠিক আছে। প্রত্যেক দিন দোকানে যাবে, মাকে দেখে আসবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে একটা রাতও কাটাতে পারবো না আমি। রুমালে চোখ বেঁধে দেবো, আমার বুড়ি বাঁদীর সঙ্গে যাবে, আবার তার সঙ্গেই ফিরে আসতে হবে।

প্রতিদিন সকালে চোখ বেঁধে বুড়ির হাত ধরে প্রাসাদের বাইরে বের হই। গলি পার হয়ে বড় রাস্তার মুখে এসে সে আমার বাঁধন খুলে দিয়ে বলে, আমি আর তোমার সঙ্গে যাবো না বেটা। এইখানেই বসে থাকি, সারাদিন শেষে সব কাজ সেরে যখন ফিরে আসবে আবার চোখ বেঁধে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে যাব।

এইভাবে তিনটি মাস কেটে গেলো। আমার প্রতি এক বিন্দু আকর্ষণ কমলো না আমার বিবির। বরং আদর যত্ন সোহাগ চুম্বনের মাত্রাটা যেন দিন দিন বেড়েই চললো।

একদিন বাড়ির এক নিগ্রো দাসীকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা মেয়ে, একটা কথা বলতে পার? তোমাদের মালকিন একজন পরমাসুন্দরী পয়সাওলা ঘরের মেয়ে। কিন্তু আমার মধ্যে সে এমন কি অসাধারণ বস্তুর সন্ধান পেয়েছে যার জন্যে এতো ভালোবাসা এতো দরদ দেখায়, এমন আড়াল করে আগলে রাখার চেষ্টা করে?

মেয়েটি জিব কেটে দু’কানে হাত রাখলো। সর্বনাশ, এ সব কি বলছেন মালিক? মালকিন জানতে পারলে আমার গর্দান যাবে।

আমি বললাম, কথা দিচ্ছি, তুমি আর আমি ছাড়া তৃতীয় কোন মানুষ জানবে না, বলো।

দেখলাম নিগ্রো মেয়েটি আতঙ্কে সিটিয়ে যাচ্ছে। ফিস ফিস্ করে বললো, সে অনেক কথা। এখনে দাঁড়িয়ে টুক করে বলা যাবে না। এখন যান, যদি কখনও তেমন সময় সুযোগ পাই, বলবো আপনাকে। বৃহৎ কেচ্ছা আছে ভিতরে, অনেক সময় লাগবে!

মেয়েটি আর দাঁড়ালো না আমার সামনে। আমিও চলে এলাম নিজের ঘরে।

এর কয়েকদিন পরে দোকানে বসে আছি—এক সময় দেখলাম, রংদার সাজ-পোশাক পরা

এক সোড়শী আমার দোকানের সামনে এলো। অবাক হলাম, মেয়েটি নির্লজ্জের মতো আমার মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে অতি মন্থর পায়ে পার হয়ে গেলো। একটু পরে দেখলাম মেয়েটি আবার ফিরে আসছে আমার দোকানের দিকেই। ভাবলাম কোনও খদ্দের হবে, উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাতে সে দোকানের ভিতরে এসে বসলো। ওর হাতে একটা ছোট থলে।

মেয়েটি থলে থেকে একটা ছোট্ট সোনার মোরগ বের করে বললো, এর চোখ দুটো হীরের। খুব সখের জিনিস! কিন্তু দায়ে পড়ে বেচতে এসেছিলাম। তা এসব বাহারী জিনিসের সমঝদার আদমী আজকাল আর নাই। কেউ দরই দিতে চাইলো না। আপনাকে দেখে বড় বংশের ছেলে বলে মনে হলো, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো দিলেও দিতে পারেন।

খেলনাটা নেড়ে চেড়ে দেখলাম। সত্যিই ব্যবহারিক কোনও মূল্য নাই, তবে ঘর সাজাবার জন্য বড়লোক এবং সৌখিন ব্যক্তিরা নিলেও নিতে পারে। আমার বিবির ভালো লাগতে পারে ভেবে বললাম, একশোটা দিনার আমি দিতে পারি। যদি রাজি থাকেন দিয়ে যেতে পারেন।

মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বললো, একি বলছেন, আমির সাহেব! হাজার দিনার যার দাম মাত্র একশো দিনারে তা কিনতে চাইছেন?

–আমি জানি এর দাম এক হাজারেরও বেশি। কিন্তু আদপে আমার প্রয়োজন নাই এ জিনিসে। নেহাত আপনি দায়ে ঠেকেছেন, তাই একশোটা দিনার দিতে পারি। না হলে অন্য কোথাও দেখুন, যদি কারো নজরে ধরে যায় বেশি দাম পেলেও পেতে পারবেন।

মেয়েটি কিন্তু নড়লো না। বললো, বাজারের সব মক্কেলকেই যাচাই করে করে দেখে এলাম। কিন্তু ভোতা। সবাই ফোঁকো কাপ্তেন। কারো শখ নাই রুচি নাই। সে যাক আপনি আর কিছু দিতে পারেন কিনা, দেখুন।

আমি বললাম, না, একশোটা দিনারই দিতে পারি।

মেয়েটি কি যেন একটু ভাবলো, তারপর বললে, বেশ ওতেই রাজি, তবে আর একটা ছোট্ট। জিনিস চাই। পয়সার জিনিস নয়।

-কী?

—আপনার এই টুকটুকে গালে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে দিতে চাই।

অদ্ভুত প্রস্তাব তো! কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগলাম। অমন রূপসী তরুণীর চুম্বন—সে তো আমারই বাড়তি লাভ! বললাম, বেশ আমি রাজি।

মেয়েটি তখন গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখের নাকাব তুলে আমার বাঁ গালের ওপর অধর রাখলো। কিন্তু একি! মেয়েটি অমনভাবে দাঁত দিয়ে আমার গালের চামড়া কামড়ে ধরেছে কেন?

নিজেকে ছাড়িয়ে দেবার জন্য একটু জোর দিয়ে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে আমার গাল বেয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে।

মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে হাসতে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলো দোকান থেকে। যাবার সময় সে কিন্তু আমার দেওয়া দিনারের থলেটাও নিয়ে গেলো না।

সোনার মোরগটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, এর দাম একটি সুন্দরী নারীর দাঁতের দংশন। ঘরে ফিরে এসে বিবির হাতে মোরগটা তুলে দিতে গিয়ে হোঁচট খেলাম।

-থাক আর ঢং দেখাতে হবে না।

—হঠাৎ এতো রাগ কেন, মনি? তোমার জন্যে আশা নিয়ে কিনে আনলাম।

এবার সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, কিনে আনলে? কী দাম দিয়ে? সুন্দরী নারীকে চুম্বন বিলিয়ে? বেতমিজ বেল্লিক কোথাকার?

প্রচণ্ড জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলে সে আমার বাঁ গালের ক্ষতটার ওপর। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো। তারপর পড়ে গেলাম মেঝেয়। আর মনে নাই।

অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো। স্ফটিকের মেঝের ওপর তখনও আমি পড়ে আছি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলাম, সামনে একটা কুর্শিতে বসে আছে আমার বিবি। ইশারা করতেই চারটি মেয়ে ধরাধরি করে একটি মেয়ের লাস এনে রাখলো আমার পাশে। আঁৎকে উঠলাম আমি। দোকানে যে মেয়েটি আমার গালে দংশন করে এসেছিলো সেই মেয়েটি। ছোরার আঘাতে আঘাতে সারা দেহ ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত। অমন সুন্দর লাবণ্যময়ীর একি বীভৎস চেহারা?

আবার আমি সংজ্ঞা হারালাম। তারপর থেকে মাথাটা আমার বিগড়ে গেছে। নিজেকে আর কিছুতেই সাহস করতে পারি না। যখনই ঐ মেয়েটির ক্ষত-বিক্ষত চেহারা ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে, তখনই কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়। আর মাথা ঠিক রাখতে পারি না, আবোল তাবোল বকি, অকারণে অন্যকে আঘাত করি, কিংবা কোনও রকম অশোভন আচরণে মত্ত হয়ে উঠি।

সুতরাং বুঝতে পারছেন, জাঁহাপনা, আসলে আমি দুষ্ট লোক নই। নেহাতই নসীবের ফেরে এই রকম হয়ে গেছি। তাই আমার আর্জি জাঁহাপনা, এ বান্দার জানটা আপনি রক্ষা করুন।

সুলতান মামুদ উজিরকে বললেন, বড় তাজ্জব কি বাত উজির! কী ব্যাপার বলতো? এই রমণীটি কে? কেনই বা এই সওদাগর বেচারাকে সে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আদর সোহাগ করেছিলো, আর কেনই বা আবার তাকে কুকুর বেড়ালের মতো মারধোর করে পথে নামিয়ে দিয়েছে—একেবারে পাগল বানিয়ে? চলো, ওকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধান করতে হবে। আসল ঘটনা আমাকে জানতেই হবে।

উজির বললো, তা হলে আপাতত বাকী দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া যাক, জাঁহাপনা। আমার মনে হয় একে সঙ্গে নিয়ে সেই গলিটার মুখে গেলে হদিশ একটা মিলে যাবে।

সুলতান এবং উজিরকে সঙ্গে নিয়ে সওদাগর যুবক এক সময় সেই গলির মুখে এসে দাঁড়ালো, এই সেই গলি, জাঁহাপনা, এখানেই আমার চোখে ফেটি বাঁধা হতো। তাই এব পরের নিশানা আর বলতে পারবো না আমি।

সুলতান বললেন, এ গলির ভিতরে প্রাসাদতুল্য একটিমাত্র ইমারতই আছে। এবং সেখানে তো আগের সুলতানের একটি বিধবা বৃদ্ধা বেগম তার একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বসবাস করে। তাহলে কি ঐ শাহজাদীই এই সওদাগরকে শাদী করেছিলো।

উজির বললো, অসম্ভব নয়।

সুলতান বললেন, চলো এগোন যাক।

কয়েক পা আসার পর একটি দরজায় কড়া নাড়লেন সুলতান মামুদ। একটি খোজা নফর এসে দরজা খুললো। সুলতানকে দেখেই সে আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানিয়ে ছুটে অন্দরমহলে চলে গেলো খবর দিতে।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

আটশো সাঁইত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেই সুন্দরী হারেম থেকে বেরিয়ে এসে সুলতানকে কুর্নিশ জানিয়ে সাদর অভ্যর্থন করে অন্দরে নিয়ে গেলো।

আপনারা হয়তো এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন কে এই সুন্দরী। সুলতান মামুদ—সুলতানের বড় মেয়েকে শাদী করেছিলেন। এটি তার বৈমাত্রেয় ভগিনী।

এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। সুলতান মামুদ তার শ্যালিকাকে বোঝালেন, ঘর-সংসার করতে গেলে ছোটখাট অসঙ্গতি কিছু ঘটেই থাকে তার জন্যে কেউ শাদী করা স্বামীকে পরিত্যাগ করে না। আমি কথা দিচ্ছি, এরপর তোমার স্বামী অন্য কোনও মেয়েকে চুমু খাওয়ার জন্য গাল পেতে দেবে না। ওকে তুমি গ্রহণ করে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর সংসার কর। আমি ভায়রাকে আমার দরবারের আমির করে নিলাম আজ থেকে!

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে থামলো একটু, তারপর বললো, যদি অনুমতি করেন তবে এবার বাকী দুই পাগলের কাহিনীও শোনাতে পারি, জাঁহাপনা।

সুলতান শাহরিয়ার বললেন, বেশ তো, শোনার জন্যই তো আমি রাত জেগে বসে আছি শাহরাজাদ।

শাহরাজাদ দ্বিতীয় পাগলের জবানীতে কাহিনী শুরু করে–

আমিও এক সওদাগর! আমার বাবাও সওদাগর ছিলেন। এই শহরেই স্যাকরা বাজারে আমার দোকান। সব রকম অলঙ্কারই বিক্রি করি আমি। বিশেষ করে আমার দোকানের বাহারী বাজুবন্ধের খ্যাতি শহরের সকলেই জানেন।

ছোটবেলা থেকেই আমি ভীষণ লাজুক প্রকৃতির ধর্মপ্রাণ ছেলে। নরনারীরর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি না কখনও। আমার স্বভাব চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে শাদীর জন্য কত কন্যার মায়েরা আমার মাকে ধরাধরি করতে আসতো। কিন্তু একেবারে উঠতি বয়স, মা রাজী হতেন না। ছেলে আর

একটু বড় হোক তারপর শাদীর কথা ভাবা যাবে।

আমারও ভি শাদী নিকা সম্বন্ধে তেমন কোনও আগ্রহ ছিলো না। আমার নিত্যসঙ্গী কোরাণ নিয়েই সময় কেটে যেত বেশ সুন্দরভাবে।

একদিন আমার দোকানে একটি বেঁটে মুটকী নিগ্রো তরুণী এলো। হাতে তার একখানি খৎ। বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমার মালকিন দিয়েছেন মেহেরবানী করে পড়ে জবাব লিখে দিন।

খুলে দেখলাম, একখানি রগরগে প্রেমপত্র। প্রেমপত্র না বলে কামপত্র বলাই সঙ্গত। প্রতিটি ছত্র কুৎসিত কামনার বিকৃতির ছবি। গা জ্বলে গেলো। দাঁত কড়মড় করতে করতে চিঠিখানি, কুটি কুটি করে ছিঁড়ে পায়ের তলায় পিষে দিলাম।

নিগ্রো মেয়েটির চোখে মুখে তখন বিস্ময় আতঙ্ক। ওর কান ধরে হিড়হিড় করে দরজার কাছে নিয়ে পাছায় একটা লাথি মেরে দোকানের বাইরে বের করে দিলাম।

নির্লজ্জ বেহায়া বেয়াদপ বেশরম মাগী, দুর হ, আমার দোকান থেকে। ফের যদি এ মুখো কখনও হোস, মেরে বদন বিগড়ে দেব। যা, তোর ঐ খানকী মালকিনকে গিয়ে বলগে, বেশ্যাবৃত্তি করার সাধ জাগে যদি তবে পট্টিতে গিয়ে ঘর ভাড়া নিক। অনেক মক্কেল জুটবে। বামন হয়ে দে হাত বাড়াতে গেলে বিপদ হবে।

আমার দৃপ্ত চরিত্রের দার্ট দেখে আশেপাশের সকেলেই ধন্য ধন্য করতে লাগলো।

এ ঘটনা যখন ঘটে তখন বয়স আমার মাত্র যোল, এর অনেক পরে বুঝেছিলাম সে দিনের সেই আদর্শ চরিত্রের অহঙ্কার কতই না অসার ছিলো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ঘটনা সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনটাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পেলাম। তখন জানতে পারলাম চরিত্রের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যে এতদিন যা করে এসেছি আসলে তার কোনও মানে হয় না।

আমি যুবক। যৌবনের মধুর স্বাদ আমাকে পাগল করেছে। এ বস্তু কৈশোরে কি করে অনুভব করা যাবে? আজ আমি ভালোবাসার আলোয় উদ্ভাসিত হতে পেরেছি। কিন্তু তখন কৈশোর কালে অবোধের মতো তাকে পায়ে দলে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

যৌবনের মধুপ আমাকে জানিয়ে দিলো, এবার সময় হয়েছে, শাদী কর। আল্লার ইচ্ছায় শাদীও আমি করেছিলাম।

একদিন বিকেলে গোটা পাঁচ-ছয় ফর্সা বাঁদী নফরানী এসে ঢুকলো আমার দোকানে। তাদের সঙ্গে একটি পরমাসুন্দরী ষোড়শী মালকিন। ভাব-সাব দেখে মনে হলো যেন এক শাহজাদী। বেশ গুরুগম্ভীর চালে আমাকে জিজ্ঞেস করলো সে, আপনার দোকানে ভালো গহনাপত্র কিছু আছে?

আমি বললাম, যা আছে দেখাতে পারি, যদি আপনার পছন্দ হয়— সে বললো, আমাকে এক জোড়া তাগা দেখান তো?

বেশ ভারি ওজনের সূক্ষ্ম কারুকার্য করা এক জোড়া তাগা বের করে দিলাম। আমার দোকানের সবচেয়ে দামী অলঙ্কার।

মেয়েটি বললো, হাতে হবে কিনা একবার পরিয়ে দেখান। বাঁদীরা এসে বোরখা তুলে শাহজাদীর দু’খানা হাত-এর আস্তিন গুটিয়ে বাহুমূলে সরিয়ে দিলো। তাগা পরাবো কি, আমি ঐ হাতের নিখুঁত গড়ন এবং পেলব কোমলতা দেখে হতবাক হয়ে গেছি তখন। কোনও মানুষের হাত যে এমন সুন্দর ছাঁচে ঢালা হতে পারে ভাবতে পারিনি।

আমার ভারি ওজনের তাগাটা ও হাতে আদৌ মানায় না। লজ্জিত হয়ে বললাম, মাফ করবেন শাহজাদী ও হাতের যোগ্য তাগা আমার দোকানেই নাই।

তখন সে বললো, ঠিক আছে, পায়ের একজোড়া মল দিন। বলা বাহুল্য আমার দোকানের সেরা জিনিসই বের করলাম। বাঁদীরা শাহজাদীর গোড়ালি থেকে শালোয়ার-এর হেমটা হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে ধরলো, নিন, পরিয়ে দিন?

আমি লজ্জিত হলাম এবারও। বললাম, ঐ হুরীর মতো সুন্দর পায়ে এ মল মানাবে না।

মেয়েটি বললো, ঠিক আছে আমার গলার একটি নেকলেস আর বুকের মাপের একটা সাতনরী দিন।

মেয়েরা এগিয়ে বললো, দাঁড়ান আগে মাপ নেবেন তো, তা না হলে বুঝবেন কি করে কোষ্টা জুৎসই হবে?

এই বলে বাঁদীরা শাহজাদীর অঙ্গবাস এক এক করে খুলে ফেলতে লাগলো।

সব খোলা শেষ হয়ে গেছে, বাকী রয়েছে মাত্র পাতলা একটা রেশমী শেমিজ।

আমি ঘামতে থাকলাম। দুটি সুন্দর সুগঠিত স্তন উদ্ধত ভঙ্গীতে এগিয়ে এলো আমার বুকের কাছে। শাহজাদীর চোখে লাস্য, অধরে দুর্বোধ্য হাসি। শেমিজটা নিজেই খুলে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, কই, হাত দু’খানা দিয়ে মুঠি করে ধরে মাপটা নিন ভালো করে?

আমার তখন বুকের মধ্যে ধড়াস। ধড়াস করছে। বললাম, থাক থাক, আমি আন্দাজেই মাপ নিতে পারবো, আপনি ঢাকুন।

-কেন, ঢাকবো কেন?

দিনে আমি কি সত্যিই এতো কুৎসিত, কুরূপা!

আমি প্রতিবাদ করে বলি, কুৎসিত? আপনার মতো সুন্দরী বেহেস্তর পরীরাও নয়, এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি।

তবে যে আমার বুড়ো বাবা আমাকে দিনরাত, কানি, বাঁদরমুখী, লেংড়ী, কুঁজি বলে গালাগাল করে। বলে, তোর মতো মত। কুৎসিত মেয়েকে শাদী দিতে আমার জান শেষ হয়ে যাবে। আচ্ছা বলুন না সাহেব, সত্যিই কি আমার শাদী নিকা কিছু হবে না?

আমি অবাক হয়ে বলি, সে কি? আপনার মতো সুন্দরী কন্যা সারা দেশে,কটা আছে? মুখ ফুটে চাইলে আপনি অনেক সুলতান বাদশাহর ছেলেকে পাবেন।

মেয়েটি বললো, না না, আপনার চোখে রং ধরেছে, তাই এসব কথা বানিয়ে বানিয়ে শোনাচ্ছেন আমাকে। আমার বাবা-শেখ ইসমাইল কত চেষ্টা করছে, কিন্তু সুলতান বাদশাহ দূরে থাক একটা বণিক সওদাগর পাত্রও জোটাতে পারছে না।

আমি বললাম, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

মেয়েটি অসঙ্কোচে বললো, তাহলে আপনিই রাজি হয়ে যান না। আমার একটা হিল্লে হয়ে যায় তা হলে।

-আমি? আমাকে শাদী করবেন আপনি? আমি তো সামান্য একজন স্যাকরা। আপনার মতো সুন্দরী পত্নী আমি আশা করবো কি করে।

—আহা, ওসব রাজি না হওয়ার বাহানা। আমি বললাম, আমি রাজি।

মেয়েটি বললো, তা হলে আমার বাবার কাছে গিয়ে প্রস্তাব পেশ করুন। বলবেন, আপনার একমাত্র কন্যার পাণিপ্রার্থী আমি। তার সম্বন্ধে আমার সবকিছুই জানা হয়ে গেছে।

বাবা তবু আমার গুণের কথা শোনাতে ছাড়বেন না আপনাকে। বলবেন, আমার মেয়ের মতো কালো কুৎসিত মেয়ে আরবে দুটি নাই। আপনি তখন বলবেন, আমি তা জানি, এবং সব জেনেশুনেই শাদী করতে চাইছি। বাবা তবু আপনাকে নিরুৎসাহ করার জন্য বলবেন, তার তো একটা চোখ কানা, লাঠিতে ভর দিয়ে লেংড়িয়ে চলে, কোমরে বাত, পিঠে ইয়া বড় কুঁজ, চিৎ হয়ে শুতে পারে না। যত রকম অঙ্গহানি ঘটতে পারে মানুষের দেহে তার সব রকম ফিরিস্তি তিনি শুনিয়ে দেবেন আপনাকে। তার আসল মতলব আপনাকে নিরুৎসাহ করে ফিরিয়ে দেওয়া।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এতে তার কি ফয়দা হবে। এভাবে পাত্রদের ফেরাতে থাকলে তো কোনও দিন আপনার শাদী দিতে পারবেন না। তিনি।

—আমার তো শাদী দিতে চান না তিনি। আমি তার ভীষণ আদরের দুলালী। এক পলক চোখের আড়াল করতে পারেন না! অথচ মেয়ে ডাগর হয়েছে, শাদী দিতে না চাইলে সমাজে নিন্দে হবে। তাই তিনি এই পথ বেছে নিয়েছেন।

আমি বললাম, কিন্তু ও চালে তো এ ভবি ভুলবে না, মালকিন! যেভাবে উনি, আমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করুন আমি শুধু বলবো, আমি সব জানি, সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছি। আপনি শাদীর আয়োজন করুন, আপনার এই কন্যাকেই শাদী করবো আমি।

—বহুত আচ্ছা, মেয়েটির চোখে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেলো। তা হলে শুভ কাজে আর দেরি করবেন না, আমি ঠিকানা বাৎলে দিচ্ছি, আজই আপনি আমার বাবা শেখ ইসমাইলের বাড়িতে চলে যান।

মেয়েটি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে যেতে আমি দোকানপাট বন্ধ করে শেখ ইসমাইলের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।

বাড়িটা বেশ বড়সড়। খানদানি কিনা জানি না, তবে বেশ পয়সাওলা লোকের ইমারত বলে মনে হলো।

দরজায় নিগ্রো নফর ছিলো, তাকে বলতেই সে আমাকে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেলো। দেখলাম, গালিচার ওপর বসে এক অশিতিপর পলিতকেশ বৃদ্ধ কোরান পাঠ করছেন। বয়সের ভারে দেহ নুজ হয়ে পড়েছে। একটা চোখ কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত। বুঝলাম, যে-কোন কারণেই হোক চোখটা হারিয়েছেন তিনি।

সালাম আদান প্রদানের পর তিনি আমার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনার একমাত্র কন্যার পাণিপ্রার্থনা করতে এসেছি আমি। যদি আমাকে অপছন্দ না হয় তবে তাকে শাদী করতে পারি।

বৃদ্ধ বললেন, আমার দিক থেকে আপত্তির কোনও প্রশ্ন ওঠে না। মেয়েকে আমি পার করতে পারলে উদ্ধার পাই। কিন্তু তেমন উদারচেতা পাত্র কোথায় পাব বাবা—সে সব জেনে-শুনে আমার ঐ কুরূপ কুৎসিত, কানা-কুজি লেংড়ি, বামন জরাগ্রস্ত মেয়েকে শাদী করবে?

আমি জানতাম শেখ সাহেব কন্যার নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবেন। ওঁকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি যা যা বলবেন সব আমার জানা, শেখজী। সব জেনে-শুনেই আপনার কন্যাকে শাদী করতে এসেছি আমি। এখন আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর সব নির্ভর করছে।

বৃদ্ধ অবাক হলেন। দেখলাম, একটু পরে তার দু’গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বুঝলাম, এবার নিশ্চিতভাবে মেয়েকে কাছ ছাড়া করতে হবে জেনে তিনি আর শোক সামলাতে পারছেন না। এবং মুখ ফুটে বলেও ফেললেন, ঠিক আছে বাবা, শাদী আমি দেবো। কিন্তু এই বৃদ্ধের একটি আর্জি আছে, বাবা।

আমি বিব্রত বোধ করলাম, আহা এমনভাবে বলে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আর্জি কেন, আদেশ করুন, কী করতে হবে।

শেখ ইসমাইল বললো, শাদীর পর, যতদিন না সে সুস্থ হয়ে চলা ফেরা করতে পারে ততদিন আমার এই বাড়িতেই তোমরা বসবাস করবে। আমি কথা দিচ্ছি, জামাই হিসাবে কোনও অনাদর হবে না আমার কাছে।

আমি বললাম, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব!

বৃদ্ধ শেখ সেই রাতেই কাজী ডেকে শাদীনামা লেখালেন। যথাসময়ে শাদীর আচার অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো।

এবার আমার মধুযামিনী শুরু হবে। মনে অনেক রঙিন কল্পনা। কি ভাবে প্রিয়তমাকে আদর-সোহাগ চুম্বন সহবাস করবো, তারই মহড়া দিয়েছি সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যে।

কিন্তু সব ধূলিসাৎ হয়ে গেলো এক নিমেষে। বাসরঘরে ঢুকে পাত্রীকে দেখে আমি মাথাঘুরে পড়ে গেলাম। শেখ ইসমাইল এতোটুকু মিথ্যে বলেননি। বরঞ্চ নিজের কন্যা বলেই বোধহয়, তার কুরূপের যথার্থ বর্ণনা দিতে পারেননি।

কি অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে যে কেটেছিলো রাত্রিটা তা বোঝাতে পারবো না। মনে হতে লাগলো, আমি বুঝি বা পাগল হয়ে যাব।

খুব সকালে উঠে দোকানে চলে এলাম। দোকান খুলে গুম মেরে বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছি এমন সময় আমার একদল ইয়ারদোস্ত এসে মজাক মস্করা করতে শুরু করলো।

-কী হে দোস্ত, এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজটা সারলে? তা বেশ, শাদী করেছ ভালোই করেছ, এখন মিঠাই-মণ্ডা, খাওয়াও দেখি।

ওদের নানারকম কাঁচা রসিকতায় মনটা আরও বিষিয়ে উঠলো। কিন্তু কি করবো, নিরুপায়, নীরবে সব সহ্য করে যেতে হলো। নাছোড়বান্দা বন্ধুদের মিষ্টিমুখও করাতে হলো।

দুপুর গড়িয়ে গেলো।

একসময়ে সখী বাঁদী পরিবৃত হয়ে আবার এসে উপস্থিত হলো সেই সুন্দরী শাহজাদী। চোখে-মুখে তার হাসির ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল।

—কী সাহেব, সোহাগ-রাত কাটলো কেমন? রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে।

শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

আটশো একচল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–

আমি চিৎকার করে উঠলাম, আল্লাহ তোমার সর্বনাশ করবেন, শয়তানী কোথাকার! তোমার মতো বাজারের বেবুশ্যার পাল্লায় পড়ে আজ আমার জানটাই বরবাদ হয়ে গেলো। তবে এও বলে দিচ্ছি, অহেতুক একটা নিরীহ লোকের অনিষ্ট করে তোমার দোজকেও ঠাই হবে না।

—অহেতুক কোনও লোকের অনিষ্ট করা আমার পেশা নয় সাহেব। তবে জেনে রাখুন একদিন আমার মহব্বতকে আপনি অবজ্ঞা করেছিলেন, আমার প্রেমপত্র ছিঁড়ে কুটি কুটি করে আমারই নিগ্রো বাঁদীর সামনে পায়ে দলে ছিলেন, এ তারই প্রতিশোধ।

মেয়েটির চোখে আগুনের ঝলকানী দেখলাম। নিমেষে সব ব্যাপারটা পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে গেলো আমার সামনে। ওর পাছাটা জড়িয়ে ধরলাম আমি, না জেনে যে অন্যায় করেছি তার জন্য ক্ষমা চাইছি, শাহজাদী। তুমি আমাকে ঘৃণা করে চলে যেও না।

আমার কথায় সে নরম হলো। বললো, তোমাকে খানিকটা শিক্ষা দেবার সাধ হয়েছিলো আমার। এবং তা আমি যথার্থ ভাবেই মিটিয়ে নিয়েছি। এবার আর কোনও রাগ নাই। বেশ, তুমি যদি রাজি থাক, তবে যাও, ঐ শেখ ইসমাইল-এর বাড়ি গিয়ে তোমার নবপরিণীতাকে বয়ান তালাক দিয়ে এসো। দেনমোহর যা লাগে আমি দেব। তারপর সন্ধ্যাবেলায় আমার নফর এসে তোমাকে নিয়ে যাবে আমার প্রাসাদে।

তার কথামতো বিশ হাজার দিনার দেনমোহর গুণাগার দিয়ে তখুনি শেখ ইসমাইলের কন্যাকে তালাক দিয়ে এলাম আমি।

সেই রাতেই শাহজাদীর সঙ্গে শাদী হলো আমার!

এরপর পুরো একটা মাস সোহাগ সম্ভোগের মধ্যে কাটিয়ে দিলাম আমরা। কিন্তু আমার বিবি ভীষণ কাম-কাতর। দিনে দিনে বুঝতে পারলাম আমার সঙ্গম-ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসছে। এতে সেক্ষুব্ধ হতে লাগলো। শেষে একদিন যখন শরীর খারাপের অজুহাতে আমি তার সঙ্গে সহবাসের অক্ষমতা জানালাম সে আমাকে বেদম প্রহার করে অজ্ঞান করে ফেললো। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম, আমি পাগলা গারদে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে আছি।

এই হচ্ছে আমার কাহিনী, জাঁহাপনা।

সুলতান মামুদ বললেন, তোমার বিবির প্রাসাদ চিনে যেতে পারবে।

দ্বিতীয় পাগল বললো, হ্যাঁ, পারবো, জাঁহাপনা।

তখন সুলতানের ইশারায় তাকে শৃঙ্খলমুক্ত করা হলো। সুলতানকে সঙ্গে নিয়ে সে তার বিবির প্রাসাদে এসে হাজির হলো। শাহজাদী সুলতানকে দেখে সাদর অভ্যর্থনা করে বসালো।

সুলতান মামুদ বললেন, তুমি হচ্ছো আমার এক শ্যালিকা। আর এ হচ্ছে আমার ভায়রা। দাম্পত্য-জীবনের অনেক গরমিল মানিয়ে চলতে হয়। নিজের স্বামীকে কি কেউ একটা তুচ্ছ কারণে পরিত্যাগ করে। তোমরা সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর-সংসার কর এই আমি চাই। আজ থেকে আমার এই ভায়রাটিকে দরবারের অন্যতম আমীর করে নিলাম।

শাহজাদী কুর্নিশ জানিয়ে বললো, আপনার আদেশ শিরোধার্য জাঁহাপনা। এরপর থেকে আপনার ভায়রার প্রতি আর কোনও খারাপ আচরণ করবো না কথা দিচ্ছি।

সুলতান বললো, যাক তুমি আমার বুক থেকে একটা ভারি বোঝা নামিয়ে দিলে।

শাহরাজাদ থামলো। শারিয়ার বললো, এরপর আর একজনের কাহিনীটা শোনাবে না?

শাহরাজাদ বললো, জাঁহাপনা—হুকুম করলেই শোনাতে পারি।

এরপর শাহরাজাদ তৃতীয় পাগলের ইতিবৃত্তান্ত বলতে শুরু করে :

তৃতীয় পাগল তার কাহিনী বলতে শুরু করলো।

আমি যখন খুব ছোট, সেই সময় আমার বাবা-মা মারা যায়। নিতান্তই গরীব ছিলো আমার বাবা। সুতরাং অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে বড় হতে লাগলাম আমি।

লেখা-পড়া শেখা হলো না। দয়া করে তারা যা খেতে-পরতে দিত তাই খেয়ে-পরে কোনও রকমে পরগাছার মতো বাড়তে থাকলাম। এইভাবে বারোটা বছর কেটে গেলো।

একদিন একটা পড়োবাড়ির ভিতরে ঢুকে চড়ুইপাখী তাড়া করতে করতে একজন পলিতকেশ বৃদ্ধকে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমি। এরকম একটা জনমানব-বর্জিত নির্জন পুরীতে কোনও মানুষ বাস করতে পারে, ভাবতে পারলাম না। মনে হলো, নিশ্চয়ই ওটা কোনও দৈত্য হবে।ভয়ে পালাবার জন্যে ছুট দিতে গিয়ে বাধা পেলাম।

—এই খোকা, শোনো শোনো, ভয় কি? এদিকে এসো। আমি কি বাঘ ভালুক নাকি? তোমাকে খেয়ে ফেলবো?

ছুটে পালাতে গিয়েও বৃদ্ধের কথায় থমকে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধ আবার ডাকলো, কাছে এসো।

রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

আটশো তেতাল্লিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–

বৃদ্ধ কাছে ডেকে বললো, আমাকে ভয় করছ কেন অত। দেখছ না, আমি একজন বুড়ো ফকির মানুষ। ভাবছ, কোন জীন দৈত্য কিনা? না না, ওসব কিছুমই। তোমারও কোনও ভয় নাই। আমার কাছে এসো।

আমি ভরসা পেয়ে এগিয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বলতে থাকলো, বুড়ো হয়েছি, বাবা। আজ বাদে কাল মরে যাবো। কিন্তু মুখে একটু পানি দেবার মতো আপনজন কেউ নাই আমার। তুমি আমার কাছে থাকবে বেটা। তোমাকে আমি নিজের ছেলে বলে বুকে টেনে নেব। তোমাকে আমি আমার বিদ্যা শিখিয়ে যাবো। আমি যা জানি সব তোমাকে দিয়ে যাবো।

বৃদ্ধের স্নেহ আদরে আমার মাতৃ-পিতৃহারা হৃদয় বিগলিত হয়ে গেলো। সেই থেকে আমি ঐ পড়োবাড়িতে ওর আশ্রয়ে রয়ে গেলাম।

একদিন বৃদ্ধ আমাকে ভিক্ষে করে কিছু আহার্য সংগ্রহের জন্য মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বললো। যারা নামাজ পড়তে আসে তারা পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য দীন-দুঃখীদের দু’ চার দিরহাম দান-খয়রাত করে থাকে।

সেদিন মসজিদের সামনে ভীষণ ভীড়। লোকে লোকারণ্য। সুলতানের সিপাই সান্ত্রীরা জনতার ভীড় সরাতে ব্যস্ত। আমি উৎসুক হয়ে নিগ্রো খোজার ধমক উপেক্ষা করে আরও খানিকটা গিয়ে ফটকের একপাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

একটু পরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলো এক অপ্সরী তুল্যা সুলতান কন্যা। তার রূপের বর্ণনা কি দেব, জাঁহাপনা! আমার চোখে ঝলসে গেলো সেই মুহূর্তে। উফ্, সে কি রূপের জেল্লা! সমস্ত হৃদয়মন উদ্বেল হয়ে উঠলো আমার। কেন জানি না, এই বয়সেই আমার দেহে কামনার বহ্নি জ্বলে উঠলো ওকে দেখে। ভাবলাম, বৃথাই আমার জীবন। দুনিয়াতে ভোগ করার এমন সব বস্তু আমাদের একেবারে নাগালের বাইরে।

বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম পড়োবাড়িতে। কেন জানি না, কিছুই আমার ভালো লাগছিলো না। বুকের মধ্যে কেমন হু হু করতে লাগলো।

আমার অবস্থা আঁচ করে বৃদ্ধ আমাকে কাছে ডেকে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলো, কি বেটা কি হয়েছে? অমন মনমরা হয়ে শুয়ে পড়লে কেন?

আমি বললাম, না, কিছু না।

বৃদ্ধ কিন্তু সে কথায় তুষ্ট হলো না, তুমি আমার কাছে কিছু গোপন করো না, বাছা। আমি সব জানতে পারি।

এবার আমি কেঁদে ফেললাম। সব কথা তাকে খুলে বললাম।

—এর পর শাহজাদীকে না পেলে আমি আর বাঁচবো না; বাপজান। কেন বলতে পারবো না, আমার দেহমন অসাড় হয়ে আসছে তাকে দেখার পর থেকে।

বৃদ্ধ আমাকে নানা ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলো, ওরা আমির বাদশা, আর আমরা ফকির দরবেশ। ওদের দিকে নজর রাখতে নাই বাবা। তাতে কখনও শুভ হয় না। ওরা বড়লোক, আমরা গরীব। দু’টো আলাদা জাত। একসঙ্গে মিল খায় না কোনও দিন। আমরা যেমন দীন দরিদ্র—তেমনি সামান্যয় সন্তুষ্ট থাকতে হয় আমাদের।

আমি বললাম, তা কেন হবে? আমিও তো মানুষ?

—কিন্তু গরীব যে! ওরা সুলতান বাদশাহ—আমির আদমী, প্রচুর আছে ওদের। তাই ওদের সঙ্গে আমাদের খাপ খেতে পারে না। তুমি নিজেকে সংযত কর বাবা।বামন হয়ে দেহাত দেবার স্বপ্ন দেখো না।

আমি গোঁ ধরে রইলাম, না, বাপজান। আপনার কথা মানতে পারছি না। প্রাণ যায় যাক, আমার একমাত্র পণ ঐ শাহজাদীর সঙ্গে অন্তত একটিবার আমি মিলিত হবো।

বৃদ্ধ প্রমাদ গুণলো। ছেলে নাছোড়বান্দা, তাই সে আমাকে তুষ্ট করার জন্যই বললো, আমি একটি তুক জানি। সুর্মা আছে আমার কাছে। ওটা চোখে লাগালে তোমাকে আর কেউ দেখতে পাবে না। সোজা তুমি প্রাসাদের হারেমে ঢুকে যেতে পারবে। তোমার দেহমন আকুল হয়ে উঠেছে শাহজাদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। তাই এ সুর্মা মাত্র একবারের জন্য তোমাকে আমি পরিয়ে দেব। কিন্তু কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর বেটা। আমার ইন্তেকালের দিন এগিয়ে এসেছে। সামনের জুম্মাবার আমি দেহ রাখবো। এই পোড়োবাড়িরই একপ্রান্তে আমাকে সমাহিত করবে তুমি। তারপর এই সুর্মা চোখে লাগিয়ে শাহজাদীর ঘরে চলে যেও। তবে খেয়াল রেখ, যে রাতে যাবে সেই রাতেই তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে আবার রাতের অন্ধকারেই বেরিয়ে চলে আসবে, কেমন?

আমি বললাম, তাই হবে বাপজান।

এর পর শুক্রবার দিন সকালে বৃদ্ধ-তার কথামতো দেহ-রক্ষা করলো। আমিও আমার ওয়াদা মতো ঐ ভাঙ্গা বাড়িরই একপ্রান্তে তাকে সমাহিত করলাম।

সেইদিনই সন্ধ্যার পরে সেই সুমা চোখে লাগিয়ে পথে বের হলাম। বেশ বুঝতে পারলাম, আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। চলতে চলতে এক সময় প্রাসাদের প্রধান ফটকে এসে হাজির। হলাম। প্রহরী তখন চরস খেয়ে বুদ হয়ে ঝিমোচ্ছিল। তার কাছে ঘেঁষে আমি ওর ঘাড়ের নিচে সুড়সুড়ি দিলাম। লোকটা বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকালো। একবার আশে-পাশে দেখে নেবার চেষ্টা করলো, কেউ আছে কিনা। কাউকে দেখতে না পেয়ে, একটা বিশ্রী গালাগাল দিয়ে উঠলো, অদৃশ্য মশাদের উদ্দেশে, তেরি–

আমার তখন সে কি আনন্দ! সোজা হারেমে ঢুকে পড়লাম। বাইরে সে কি কড়া প্রহরা। কিন্তু তখন আর কাকে পরোয়া করি? কেউ তো আমাকে প্রত্যক্ষ করতে পারছে না।

সোনার পালঙ্কে মখমল-শয্যায় শায়িত ছিলো সে। একটি মাত্র ফিনফিনে পাতলা শেমিজ ছাড়া পরনে কোনও অঙ্গবাস ছিলো না ওর। খুব ভালো করে নজর না করলে সে-শেমিজও চোখে পড়বে না কারো।

কি সুন্দর ওর নগ্ন নির্জন দেহখানি। যেন একখানি বেহালা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর পীনোন্নত ছোট ছোট স্তন দুটির দিকে। অজান্তেই কখন আমার হাত দু’খানা ওর বুকে রেখেছিলাম বুঝতে পারিনি। চৈতন্য ফিরে পেলাম, শাহজাদীর নিদ্রাভঙ্গ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় টুক করে হাত দুখানা সরিয়ে নিলাম আমি। একবার মাত্র সে চোখ মেলে তাকিয়ে বন্ধ করে নিলো। আবার একটু পরেই ঘুমে এলিয়ে পড়লো আবার।

এবার আমি অতি সন্তর্পণে পালঙ্কের উপরে উঠে পড়লাম। আলতোভাবে শাহজাদীর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন বুঝলাম সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে তখন

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি শাহজাদীর পাশে শুয়ে আছি আমি। ভেবেছিলাম, বেশ খানিকটা অন্ধকার থাকতে সকলের অজান্তে প্রাসাদ থেকে কেটে পড়বো। কিন্ত তা আর হলো না।

দরজা ঠেলে শাহজাদীর সহচরীরা ভিতরে ঢুকলো। আমি পালঙ্ক ছেড়ে নিচে নেমে ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

শাহজাদীকে ঘুম ভাঙ্গাতে এসে প্রধান পরিচারিকা আঁৎকে উঠলো।

—সর্বনাশ! একি কাণ্ড! শাহজাদীর জঙ্য় রক্তের দাগ! সঙ্গে সঙ্গে হারেমের বুড়ি সর্দারণীকে ডাকা হলো। সে পরীক্ষা করে বললো, শাহজাদীর সতীচ্ছেদ হয়ে গেছে। এই হারেমে এ কাণ্ড ঘটলো কি করে? এখানে পরপুরুষ এলো কোথা থেকে?

শাহজাদীকে জাগানো হলো। সে-ও বললো, কি জানি, রাতের অন্ধকারে ঘুমের ঘোরেই আমি বুঝতে পারছিলাম, কে যেন আমার শরীরের ওপরে চেপে বসেছে। ছাড়াবারও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি।

ভয়ে বুক দুরু দুরু করতে লাগলো সহচরীদের। এখন যদি সুলতান জানতে পারেন, গর্দান যাবে তাদের।

একজন বাঁদী শাহজাদীর খাবারের থালাটা এনে মেলে ধরলো। কাল রাতে শাহজাদীর জন্যে খানা-পিনা এনে রেখেছিলাম। কিন্তু শাহজাদীর তবিয়ত ভালো ছিলো না বলে তিনি কিছু খেলেন না। থালাখানা টেবিলের ওপরে ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম। এখন দেখছি, সবই খেয়ে গেছে কে! বুড়ি বললো এ নির্ঘাৎ কোনও জীন দৈত্যের কাণ্ড। তা ছাড়া কার সাধ্য এই দুর্ভেদ্য হারেমে ঢুকতে পারবে। তবে বাছাধন, মনে হচ্ছে, এখন পালাতে পারেনি। এই ঘরেরই কোনও খানে লুকিয়ে আছে। তোমরা এক কাজ কর, উটের গোবর-ঘঁটে এখানে ডাই কর এই ঘরের মাঝখানে। তারপর আমি সব ব্যবস্থা করছি।

সর্দারণীর আদেশে কয়েক ঝুড়ি উটের গোবর-ঘুটে এনে স্তুপীকৃত করা হলো ঘরের মেঝে। বুড়িটা নুড়ো জ্বেলে দিলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় সারাঘর ভরে গেলো। বুড়ি বললো, দরজা জানলা সব বন্ধ করে শাহজাদীকে সঙ্গে নিয়ে তোমরা সবাই ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। তারপর আমি যখন ডাকবো তখন আসবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়ার গমকে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো আমার। চোখ দুটো জ্বলতে লাগলো। আমি দু’হাত দিয়ে প্রাণপণে ডলতে লাগলাম চোখের পাতা।

এবং এরপর যা অবশ্যম্ভাবী ফল হতে পারে তাই হলো। আমার হাতের ডলায় চোখের সুর্মা গেলো মুছে। আর সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেলো আমার তুক। আমি দৃশ্যমান হয়ে পড়লাম।

বুড়ি আমাকে দেখতে পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো, কে আছ, শিগ্নির ছুটে এসো, জীন ধরা পড়েছে।

হুড়পাড় করে একপাল নিগ্রো খোজা খাড়া উঁচিয়ে ঢুকে পড়লো ঘরে। তখন আমার অবস্থাটা কি হতে পারে আশা করি আঁচ করতে পারছেন, জাঁহাপনা।

নিগ্রো নফরগুলো আমাকে জাপটে ধরলো।

—কে তুমি? সত্যি করে বলো? না হলে এখুনি কোতল করে ফেলবো।

আমি বললাম, আমাকে মেরো না। নেহাত ঘটনাচক্রে আজ আমি তোমাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমাকে যদি জানে মারো, তবে এও বলে রাখছি, আমার ভাই জীন-সম্রাট তোমাদের বংশ নির্বংশ করে দেবে।

দেখলাম আমার এই মিথ্যে শাসানীতে ওরা একটু থতমত খেয়ে গেলো। বুড়ি বললো, ঠিক আছে, ওকে জানে মারার দরকার নাই। তবে মারিস্থানে কয়েদ করে রেখে দাও আপাততঃ। পরে বিচার করা যাবে।

তৃতীয় পাগল তার কাহিনী শেষ করে সুলতান মামুদের দিকে করুণভাবে তাকালো। আমার গোস্তাকি মাফ করুন, জাঁহাপনা। কামনার বশে যে অপরাধ আমি করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত।

সুলতান ওকে শৃঙ্খল মুক্ত করার আদেশ করলেন।

-তুমি যার সঙ্গে সহবাস করেছ, সে আমার সবচেয়ে ছোট্ট শ্যালিকা। যাই হোক তোমার দ্বারা যখন তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়েছে তখন তোমাকে শাদী করতে হবে ওকে। এই আমার হুকুম।

জাঁহাপনার আদেশ শিরোধার্য। সুলতান মামুদ বললেন, আজ থেকে তুমিও হবে আমার দরবারের এক মহামান্য আমির। কি, ঠিক আছে?

-সুলতানের যা অভিরুচি—

শাহরাজাদ বললো, তিন পাগলের কাহিনী এখানেই ইতি। এরপর আপনাকে নতুন কিসসা শোনাবো জাঁহাপনা, আলিবাবা ও চল্লিশ চোর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *