আপনারা সবাই জানেন খলিফা হারুন অল রসিদের সদগুণের অবধি ছিলো না। তার মতো ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু, উদার মহৎ নরপতি আর কেউই ছিলো না। কিন্তু একটা জায়াগায় তার একটু খামতি ছিলো। তার মনে একটা বিষয়ে দারুণ অহমিকা ছিলো। এবং প্রকাশ্যে সেকথা সবাইকে শোনাতেও তিনি কসুর করতেন না। তিনি বললেন, তার মতো মুক্তহস্তে দান-ধ্যান করতে আর কেউই পারে না।
একদিন তিনি তার নিজের কক্ষে অবসর-বিনোদন করছেন, এমন সময় প্রধান উজির জাফর এসে কুর্ণিশ জানালো তাকে। তারপর জ্ঞানগর্ভ বাণী শোনাতে থাকলো :
ধর্মাবতার, আপনি আমাদের মাথার মণি, জগতের আলো। এই বান্দার গোস্তাকি মাফ করবেন, জাঁহাপনা, আজ সে আপনার কাছে গলা চড়িয়ে দু-চারটে বাক্য শোনাবে।
একজন ধর্মবিশ্বাসীর প্রধান গুণ হবে সে আল্লাহর পায়ে নিজের কায়-মন-প্রাণ সমর্পণ করে দেবে। এবং সেই আত্ম-নিবেদনই রীতি-সম্মত গৌরব। দুনিয়ার যা কিছু বৈভব, এই যে প্রকৃতির অপরূপ দান, আর মানব আত্মার যে মহৎ উপাদান—এসবই সেই পরমপিতার অকৃপণ আশীর্বাদে সম্ভব হচ্ছে। এ জন্যে কোনও মানুষই আত্মম্ভরিতা করতে পারে না। তার যতটুকু বড়াই বা অহঙ্কার—তার জন্য একমাত্র আল্লাহই দায়ী। একটি বৃক্ষ কি তার ফল-সম্ভারের জন্য অহঙ্কার করে? কিংবা সগার কি বলে, দেখ দেখ, কি বিপুল জলরাশি আর রত্নমণির মালিক আমি? আকাশ কি কখনও অহঙ্কার করে বলে, আমার মতো উঁচু কি তোমরা কেউ হত পার? না। সত্যিকারের যে বড়, মহৎ—সে কখনও বড়াই করে লোকের কাছে জাহির করে না। তাই বলছিলাম, ধর্মাবতার আপনার বলতে যা কিছু আছে—সব পরার্থে বিলিয়ে দিন। দরিদ্র জন-সাধারণ আল্লাহর পরম প্রিয়ভাজন। তাদের মধ্যে আপনার সম্পদ বিভক্ত হয়ে গেলে, তার চরণে উৎসর্গীকৃত হবে, মনে করবেন।
আচ্ছা ধর্মাবতার, একটা কথা কি বান্দাকে বলবেন, এই যে বিশাল সলনিয়ত বিপুল অর্থভাণ্ডার, আর অগণিত অট্টালিকা ইমারত প্রাসাদের যে বাহ্যাঁড়ম্বর, এ-সবের কি আপনি একাই মালিক? একাই সব করছেন, সেইজন্যই কি আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন এসব?
বসরাহ শহরে আবু অল কাসেম নামে এক বিরাট বিত্তশালী সওদাগর আছে। তার বিপুল ঐশ্বর্যের পরিমাপ সে নিজেও করতে পারে না। লোকে বলে তার বিত্ত-বৈভব যে-কোনও বড় সুলতান বাদশাহর চেয়েও বেশি। তবে শুধু এই কারণেই তার দেশজোড়া অত নাম-খ্যাতি হয়নি। তার মতো দরাজ দিল এবং মুক্তহস্ত সারা আরব দুনিয়ায় কারো নাই। এমনকি স্বয়ং ধর্মাবতারও তার তুল্য দানশীল নন।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো বাইশতম রজনী
আবার সে বলতে শুরু করে :
জাফরের এবম্বিধ বক্তৃতা শুনতে শুনতে খলিফা হারুন অল রসিদের মুখমণ্ডল ক্রোধে আরক্ত হয়ে ওঠে।
কুত্তাকা বাচ্চা! এতো বড় স্পর্ধা তোমার, আমার মুখের সামনে এই রকম বেয়াদপি করার দুঃসাহস কর! তুমি কি ভুলে গেছ, এই ধরনের মিথ্যাচার মানে অবধারিত মৃত্যু।
জাফর বলে, খোদ কসম, জাঁহাপনা, এক বর্ণও মিথ্যা বলিনি আমি। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তবে বসরাহতে কাউকে পাঠিয়ে আপনি খবর নিন। আমি তার কথাই মেনে নেব। এর আগে আমি যখন একবার বসরাহতে গিয়েছিলাম তখন ঐ আবুকাসেমের বাড়িতেই অতিথি হয়ে উঠেছিলাম। যা বললাম, সে-সব আমার নিজের চোখে দেখা। অন্যের মুখের ঝাল খাইনি। তাকে জানার পর মুক্ত কণ্ঠে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তার মতো উদার এবং দানে মুক্তহস্ত মানুষ আজকের দুনিয়ায় আর দুটি নাই।
জাফরের কথায় খলিফা উত্তেজিত হয়ে প্রহরীকে হুকুম করলো, এই বেয়দপকে গ্রেপ্তার কর।
প্রহরীরা জাফরকে হাতকড়া পরাবার জন্য এগিয়ে এলো। খলিফা আর সেখানে থাকলেন না, ঘর ছেড়ে জুবেদার মহলের দিকে চলে গেলেন।
খলিফার বিষণ্ণ গম্ভীর মুখ দেখে বেগম জুবেদা অনুমান করলেন, নিশ্চয়ই কোনও খারাপ কিছু ঘটে গেছে।
খলিফা কোনও কথা না বলে গুম হয়ে বসে পড়লেন একটা আরামকেদারায়।
জুবেদা জানতেন এ অবস্থায় খলিফাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে নাই! এক গেলাস সুগন্ধি সরবৎ এনে খলিফার সামনে ধরলেন তিনি।
—নিন, খেয়ে নিন ধর্মাবতার। শরীরটা ঠাণ্ডা হবে। জীবনের দুটি রং আছে। একটি সফেদ সুন্দর, অন্যটি কালো, অন্ধকার। আপনাকে আমি সদা সর্বদাই হাসি-খুশিই দেখতে চাই,
জাঁহাপনা।
খলিফা বাধা দিয়ে বলেন, কিন্তু আজ আমার খুব খারাপ দিন, বেগম। ঐ বেতমিজ বারসাফী জাফর আমার মন মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে। ওর এতো বড় সাহস, আমার কাজের সমালোচনা করে?
বেগম জুবেদাকে তিনি সব কথা খুলে বললেন। জুবেদা বুঝতে পারলেন, জাফর বড় বেকায়দার কাজ করেছে। এর পরিণাম যে কি হতে পারে ভাবতে পারেন না তিনি। এ অবস্থায় খলিফাকে শান্ত করতে গেলে ভোলাখুলি জাফরকে সমর্থন করতে যাওয়া বিপদজনক। অথচ তাকে বাঁচাতে গেলে তার পক্ষ না নিলেও চলবে না। তাই তিনি কায়দা করে বললেন, বসরাহতে একটা দূত পাঠিয়ে খবরটা যাচাই করে নিলে কেমন হয়, জাঁহাপনা? যতদিন না দূত ফিরে আসে ততদিন পর্যন্ত জাফরের সাজা দেওয়াটা না হয় মুলতুবিই রাখলেন। তবে এও জানি, সাজা সে এড়াতে পারবে না কোনও মতে।
জুবেদার কথায় খলিফা অনেকটা শান্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, এ ব্যাপারে অন্য কোনও লোজন পাঠিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো না। জাফর আমার দরবারের পুরোনো লোক। ওর বাবা, তার বাবা সকলেই আমাদের বংশের সেবা করে এসেছে। তাই এ ব্যাপারে অন্য কোনও লোকের ওপর তদন্ত করতে দিয়ে আমি স্বস্তি পাবো না। সুতরাং আমি নিজেই যাবো বসরাহয়। আবু কাসেমের সঙ্গে মোলাকাত করে নিজেই বিচার করবো। যদি বুঝি জাফর তার সম্বন্ধে বাড়িয়ে বলেছে, রেহাই নাই, ওকে ফাঁসীতে ঝোলাবো।
জুবেদা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন, একা যাওয়া ঠিক হবে না! কিন্তু খলিফা সে-কথায় কর্ণপাত না করে তখুনি এক বণিকের ছদ্মবেশ ধরে বসরাহর পথে বেরিয়ে পড়লেন।
আল্লাহর দোয়ায় যথাসময়ে নিরাপদে বসরাহয় পোঁছে গেলেন তিনি। সেখানকার বড় সরাইখানায় একখানা ঘর ভাড়া করে উঠলেন। রাতে খানাপিনা সেরে নেবার আগে তার ঘরের খানসামাকে জিজ্ঞেস করলেন খলিফা, আচ্ছা বাপু বলতে পার, এই শহরে নাকি আবু নামে এক যুবক আছে। তার দান-ধ্যানের নাকি তুলনা হয় না?
বৃদ্ধ খানসামা দু’হাত তুলে আল্লাহর নাম স্মরণ করে বললো, খোদা তাকে চিরজীবী করে রাখুন। সত্যি কথা বলতে কি, তার তুল্য মানুষ এ দুনিয়ায় দুটি নাই, জনাব। এই শহরে এমন একজনকেও পাবেন না যে তার নাম শুনে কপালে হাত না রাখবে। আমার যদিশতমুখ থাকতো তবে একসঙ্গে সব মুখ দিয়ে একই কথা বেরিয়ে আসতো, তার মতো মানুষ দুটি জন্মাবে না দেশে। তাঁর গুণগান করে আমরা নিজেরাই ধন্য হই। তাকে ধন্য করার স্পর্ধা কারো নাই।
পরদিন সকালে খলিফা সরাইখানা থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে হাঁটতে থাকলেন। দোকানপাট তখনও খোলেনি, নানা পথ ধরে হেঁটে হেঁটে গোটা শহরটাকে দেখতে লাগলেন।
তারপর এক সময় বাজারে জনসমাগম হতে লাগলো। এক এক করে সব দোকানই খুলে গেলো। এক দোকানের মালিককে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এ শহরে আবু কাসেমের প্রাসাদটা কোন দিকে বলতে পারেন?
দোকানী একটু কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে, আপনি পরদেশী! অনেক দূর দেশ থেকে আসছেন? এখানে আবু কাসেমের প্রাসাদ একটা দুধের বাচ্চাও দেখিয়ে দিতে পারে।
খলিফা স্বীকার করলেন তিনি বিদেশী। তখন দোকানী তার ছোকরা কর্মচারীকে সঙ্গে দিয়ে বললো, এর সঙ্গে যান, আপনাকে দেখিয়ে দেবে।
আবু কাসেমের প্রাসাদটা দাঁড়িয়ে দেখার মতো বটে! দামী দামী নানা বর্ণের মার্বেল পাথরে আগাগোড়া প্রাসাদটা তৈরী। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে এক দঙ্গল খুদে পল্টন লড়াই-এর মহড়া খেলায় মত্ত হয়েছিলো। সুলতানের উপস্থিতিতে ওরা রণে ভঙ্গ দিয়ে কাছে এগিয়ে এলো। খলিফা বললেন, এ বাড়ির মালিকের সঙ্গে মোলাকাত করতে এসেছি। একবার ডেকে দাও তাকে।
ছেলেদের একজন ছুটে ভিতরে ঢুকে গেলো। এবং প্রায় তখুনি আবু কাসেম বাইরে বেরিয়ে; এসে মুসাফির মেহেমানকে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা মখমলের দিবানে
বসালো। একটু পরে সাকীরা শরবৎ, খাবারের পেয়ালা পাত্র সাজিয়ে সোনার রেকাবীগুলো রাখলো তার সামনের মেজ-এ। বারটি চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দরী বাঁদী। সকলেই কুসুমাদপি পেলব-কোমল পঞ্চদশী।
খলিফা হারুণ অল রসিদ শরবতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তারিফ করলেন, বাঃ চমৎকার, এমন জিনিস তো আগে কখনও খাইনি?
এরপর নানা উপচারে আহারাদি সমাধা করলেন তিনি। মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করলেন, প্রতিটি খাবারই বড় সুস্বাদু, মুখরোচক।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে গান-বাজনার আসর বসলো।
খলিফা বুঝলেন আবু কাসেম সমঝদার মানুষ। প্রকৃত গুণী গাইয়ে বাজিয়েদের সে সংগ্রহ করে রেখেছে।
একটি পরমাসুন্দরী কিশোরী কন্যার গান শুনে খলিফা মুগ্ধ বিস্ময়ে তার দিকে যখন মনোনিবেশ করেছেন, সেই ফাঁকে আবু কাসেম অন্দরে চলে গেলো। একটু পরে ছোট্ট একটা গাছ হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলো। গাছের গুঁড়িটা রূপোর, পাতাগুলো পান্নার, আর ফলগুলো সব পলার তৈরি। গাছটাকে সামনে বসিয়ে দিতে খলিফা দেখলেন গাছের মাথার উপরে একটা ময়ূর পেখম মেলে বসে আছে। ময়ুরটা সোনার। ময়ূরটার মাথায় মিশমিশে কালো রঙের একটা লাঠি দিয়ে মৃদু ঠোকা দিতেই সে পাখা দু’টো ঝাপটাতে লাগলো, পুচ্ছটা উচ্চে তুলে নাচতে থাকলো। একটু পরে সেলাটুর মতো বন বন করে ঘুরতে আরম্ভ করলো। এতো জোরে যে ময়ুরটাকে আর দেখা গেলো না কিছুক্ষণ। সারা ঘর চন্দনের সুবাসে ভরপুর হয়ে উঠলো।
হারুণ অল রসিদ হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলেন সেই অবিশ্বাস্য আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ।
ইয়া আল্লাহ, এমন বস্তুও দুনিয়াতে থাকতে পারে। এ যে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না?
আবু কাসেম ময়ূর-সুদ্ধ গাছটাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। খলিফা ভাবলেন, এ কি রকম ব্যবহার আবু কাসেমের? তার কি মনে হয়েছে ওর ঐ গাছ আর পাখীটা চেয়ে নেব আমি? তবে যে জাফর বড়াই করে বলেছিলো, তার মতো দাতা আর সারা দুনিয়ায় কেউ নাই? আর যদি চাই-ই, তবে কি দিতে তার বুকে বাজবে?
একটু পরে একটি ছোট্ট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো আবু কাসেম। একমাত্র সূর্যকিরণের সঙ্গেই ছেলেটির রূপের জেল্লার তুলনা চলে। সোনার জরির কাজ করা তার মুল্যবান সাজ-পোশাকে অসংখ্য বড় বড় মনিমুক্তো বসানো ছিলো, ছেলেটির হাতে একটা পলার তৈরী পেয়ালা। সে পেয়ালাটি সোনালী মদে পরিপূর্ণ। প্রায় আভূমি আনত হয়ে কুর্ণিশ জানিয়ে মদের পেয়ালাটা খলিফার সামনে বাড়িয়ে ধরলো সে। ছেলেটির উপহার প্রসন্ন মনে হাত পেতে নিলেন তিনি। এবং এক চুমুকে সবটুকু সরাব নিঃশেষ করে শূন্য পেয়ালাটা ছেলেটির হাতে ফেরত দিতে গিয়েই থমকে গেলেন। একি! পেয়ালাটা সঙ্গে সঙ্গেই আবার পূর্ণ হয়ে গেছে। আর এক চুমুকে মদটুকু খেয়ে নিয়ে আবার তিনি ফেরত দিতে যান, কিন্তু এবারও একই দৃশ্য। পেয়ালাটা পূর্ববৎ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। একি! এ যে ভুতুড়ে কাণ্ড!
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
আটশো তেইশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
খলিফা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, এ অদ্ভুত কাণ্ড কী করে সম্ভব হতে পারে।
আবু কাসেম বিনীত ভাবে বলে, সত্যিই, অবাক হওয়ার মতো কিছু নাই, মালিক। এক প্রবীণ দার্শনিক এটা বানিয়েছেন। দুনিয়ার মধ্যে সেরা পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। এমন কোনও গুপ্তবিদ্যা ছিলো না যা তার অজানা।
ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে সে দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। খলিফা ক্রুদ্ধ হলেন, কি বেয়াদপ, আদব-কায়দার সাধারণ নিয়ম-কানুনগুলো পর্যন্ত সে জানে না, বর্বর কোথাকার। এমনভাবে ছেলেটাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো যেন আমি কেড়েকুড়ে নেব সব। এক এক করে যত সব অবাক অদ্ভুত বস্তু এনে হাজির করছে, আর কিছুক্ষন ভেল্কিবাজী দেখিয়েই আবার অন্দরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখে আসছে?যখনই সে বুঝতে পারছে আমি বেশ মজা পেয়েছি তখনই সে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটা। একে এককথায় কি বলা যায়? কুৎসিত-অসৎ! দাঁড়াও জাফর, তোমার মউৎ-এর আর বেশি দেরি নাই। বাগদাদে ফিরে গিয়েই আমি তোমার ব্যবস্থা করছি।
কিছুক্ষণ বাদে আবু হোসেন আবার ফিরে এলো। এবার তার সঙ্গে একটি কিশোরী মেয়ে।খুব ফর্সা এবং পরীর মতো পরমাসুন্দরী। তার সাজ-পোশাক এক গাদা হীরে বসানো। কিন্তু হীরেয় কি হবে, তার তন্বীদেহের রূপের ছটা আরও বেশি চমক লাগার মতো। সেই মুহূর্তে হারুণ সব বিস্মৃত হলেন, এমন কি সেই গাছ, ময়ুর, পেয়ালা কিছুই তার মনে ঠাঁই পেলো না। মেয়েটি তার সামনে বসে বাঁশীতে সুমধুর তান তুলে একনাগাড়ে চব্বিশটা রাগ-রাগিনী বাজিয়ে শোনালো। মুগ্ধ খলিফা আবু কাসেমকে বাহবা দিয়ে বললেন, সত্যিই সাহেব, তোমার সংগ্রহ বড় অসাধারণ, হিংসে করার মতো।
এই কথা শোনামাত্র আবু কাশেম আর দাঁড়ালো না সেখানে, মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
এবারে খলিফা প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। নাঃ, এ জিনিস আর বরদাস্ত করা যায় না।
আবু কাসেম ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন, মনের রাগ মনে চেপে তিনি যথাসাধ্য সৌজন্য-স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, আবু কাসেম, তোমার আতিথেয়তায় প্রীত হয়েছি। কিন্তু আর বেশি সময় তোমাকে বিব্রত করতে চাই না, এবার আমি চলি
আবু কাসেম কিন্তু একবারও তাকে আরও কিছু সময় থেকে যাবার জন্য অনুরোধ জানালো। বরং বিদায়ের শুভেচ্ছা জানানোর ঢং এ মাথাটা নুইয়ে সালাম জানিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে দিতে এলো তাকে।
সরাইখানায় ফিরে আসতে আসতে খলিফা ভাবলেন, লোকটা হাড়-কিপ্পন। ঘর ভরা দৌলত থাকলে কি হয়, চড়ুই পাখীর মতো দিল। এর প্রশংসায় আমার উজির সাহেব পঞ্চমুখ। দাঁড়াও ব্যাটাকে আমি মজাখানা দেখাবো–বাগদাদে ফিরে গিয়ে।
কিন্তু খলিফাকে আরও বেশি অবাক করে দিলো আর একটি ঘটনা। সরাইখানায় তার ঘরের দরজার সামনে দুটি কৃষ ক্রীতদাসের সঙ্গে সেই ছোট্র পেয়ালা হাতে ছেলেটি এবং সেই বাঁশী হাতে কিশোরীটি আর চাকর দুটির হাতে সেই গাছটি আর ময়ুর। খলিফা সামনে আসতেই সুন্দরী কিশোরীটি একটুকরো চিঠি বাড়িয়ে দিলো খলিফার দিকে।
খোদা ভরসা। আপনার বান্দা এই সামান্য উপহারগুলো পাঠাচ্ছে আপনাকে। আমার গরীবখানায় আপনার স্বল্পক্ষণের আতিথ্য সারাজীবন আমার স্মৃতি-পটে আঁকা থাকবে। এই তুচ্ছ কয়টি বস্তু আপনাকে মুগ্ধ করেছিলো দেখে এগুলো আপনাকেই উপহার পাঠালাম। গ্রহণ করে ধন্য করবেন এ অধমকে।
চিঠিখানা পড়ে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেন না খলিফা। স্বপ্ন দেখছেন না তো তিনি? এ কি সেই আবু কাসেমের লেখা খৎ? একজন সামান্য যুবকের পক্ষে এতো সব অমূল্য বস্তু সংগ্রহ করাই বা সম্ভব হলে কি করে? আর তার চেয়ে বড় কথা, যে জিনিস কোনও অর্থের বিনিময়েই কিনতে পাওয়া যায় না তা অবলীলাক্রমে দান করে দিতে পারে কে? এমন দাতা তো ত্রিভুনে কোথাও আছে বলে শুনিনি।
খলিফার আর ঘরে প্রবেশ করা হলো না, সেইখানেই দানসামগ্রী সব ঐ অবস্থাতেই ফেলে রেখে তিনি আবার ছুটলেন আবু কাসেমের প্রাসাদের দিকে। কী ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান হলে এই অমূল্য সম্পদ তুচ্ছজ্ঞানে দিয়ে দিতে পারে অন্যকে? সেই তথ্যটি আজ তাকে জানতেই হবে।
দ্রুতপায়ে আবু কাসেমের প্রাসাদে আবার ফিরে এসে খলিফা কাসেমকে বললো, আমার দোষ যদি কিছু ঘটে থাকে, তবে নিজগুণে তুমি ক্ষমা কর সাহেব। আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি। হয়তো আমার আচার আচরণে কোন অসৌজন্য দেখিয়ে থাকতে পারি। আশা করি সে ত্রুটি মনে রাখবে না। আমি আবার ফিরে আসতে বাধ্য হলাম, একটি কারণে। এইভাবে তুমি যদি দু’হাতে বিলাতে থাক তোমার বিত্ত বৈভব তবে বাদশাহর ভাড়ারও একদিন ফুরিয়ে যাবে যে। তোমার এই দানপত্র না কমালে তো একদিন তুমি ফতুর হয়ে যাবে! হয়তো তোমার সম্পদের পরিমাণ অনেক, কিন্তু তা বলে তো অফুরান নয়।
-এই যদি আপনার ফিরে আসার কারণ হয়ে থাকে তবে আপনি নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যেতে পারেন আপনার ঘরে। প্রতিদিন আমি আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি, আমার ইহজগতের ঋণ যেন আমি পরিশোধ করে যেতে পারি। যখনই আমার দরজায় কোনও মেহেমান আসে তাকে দু’সহাত ভরে দিতে পেরে আমি ধন্য হই। সত্যি কথা বলতে কি, খোদা আমাকে অফুরন্ত ধন-সম্পদই দিয়েছেন। দু’হাতে বিলিয়েও তা শেষ করা যাবে না কোনদিন। আপনাকে সব খুলে বললে আপনি হয়তো আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন। সে কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ সন্দেহ নাই। তা হলে মেহেরবানী করে একটু বসুন এখানে, আপনাকে শোনাই সে কাহিনী।
খলিফা আসন গ্রহণ করলেন। আবু কাসেম বলতে শুরু করলো :
আমার বাবা আবদ অল আজিজ কাইরোর খুব নামজাদা জহুরী ছিলো এক সময়ে। আমার বাবার বাবা এবং তার বাবাও বংশানুক্রমে মিশরের আনুকূল্য লাভ করে অনেক ধন-সম্পদ সঞ্চয় করে গিয়েছিলেন। যদিও কাইরোতেই সারাজীবন কেটেছে তাদের তবু জন্মভূমি বসরাহকে তারা কখনই ভোলেননি। বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া সব ধন-সম্পদই তারা বসরাহয় নিয়ে এসে জমা করেছিলেন।
আমার বাবা একটি মাত্র কন্যাকেই শাদী করে জীবন কাটিয়ে গেছেন। এবং আমি তার একমাত্র সন্তান। সুতরাং বাবা যখন ইন্তেকাল করলেন, আমি একাই তার সমস্ত সম্পত্তির পুরো মালিক হলাম।
রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
আটশো চব্বিশতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–
আমার ভীষণ খরচের হাত ছিলো বরাবরই। তাই ঐ বিপুল ঐশ্বর্য নিঃশেষ করতে দু’বছরও সময় লাগলো না আমার। আল্লাহর দোয়াতে যা হাতে এসেছিলো আবার তারই ইচ্ছায় তিনি তা ফিরিয়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দিলেন আমাকে। এরজন্য মনে আমার অনুতাপ হয়নি কখনও।
বাড়ি ঘর-দোর সব বিক্রি করে দিয়ে একদিন বসরাহ ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়লাম আল্লাহর নাম করে। কেমন করে জানি না, এক সওদাগরের দলের সঙ্গে ভিড়ে পড়েছিলাম আমি। প্রথমে মশুল এবং পরে দামাসকাসে গেলাম আমরা। তারপর দুস্তর মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে মক্কার পরে কাইরো শহরে গিয়ে পৌঁছলাম একদিন। এই কাইরোয় আমরা কিছুকাল অবস্থান করবো, ঠিক হলো।
কাইরোর সুন্দর সুন্দর দালান কোঠা আর অসংখ্য ছোটবড় মসজিদ দেখে পুলকে নেচে উঠলো আমার মন। বাবার কথা মনে হলো, তিনি এবং তাঁর পিতৃপুরুষরা এই শহরেই কাটিয়ে গেছেন চিরটাকাল। কান্নায় চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো, এই শহরে আমার বাপ-ঠাকুরদাদারা কি নবাবী চালে কাটিয়ে গেছেন, আর আমি তাদের বংশধর হয়ে দীন ভিখিরির মতো হাজির হয়েছি এখানে।
নীলনদের তীরে বসে নদীর শোভা দেখছিলাম। আমার পাশেই সুলতানের বিলাসমহল ঝকমক করছিলো। মুগ্ধ নয়নে প্রাসাদের কারুকার্য লক্ষ্য করছি হঠাৎ একটা বাতায়নের পর্দা সরিয়ে একটি পরমাসুন্দরী মুখ বাড়িয়ে দিলো। আমার চিত্ত উদ্বেল হয়ে উঠলো। কিন্তু কয়েকটি মুহূর্তমাত্র। মেয়েটি জানালা থেকে সরে গেলো। ওপরের দিকে তাকিয়ে সারাটা বিকেল শেষ হয়ে গেলো, মনে আশা আর একবার হয়তো সে জানলার সামনে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু না, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে থাকলো, মেয়েটি আর দর্শন দিলো না।
নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে সরাইখানায় ফিরে আসতে হলো। সারাটা রাত সেই মুখচ্ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
সকাল হতে না হতেই আবার আমি নদীর ধারে এসে প্রাসাদের পাশে বসে উন্মুখ, উর্ধ্বমুখ হয়ে বসে থাকি। কিন্তু সারাদিনের মধ্যে একটি বারের জন্য জানলার পর্দা সরিয়ে সে এসে দাঁড়ালো না। আমি কিন্তু হাল ছেড়ে দিলাম না। তৃতীয়দিন বিকেলে জানলার পর্দা সরে গেলো। সেই মুখখানি আবার দেখতে পেলাম। আমার সারা শরীরে সে যে কি এক অভূতপূর্ব রোমাঞ্চ খেলে গেলো, বোঝাতে পারবো না আপনাকে। কেন জানি না সেই মুহূর্তে হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে
উঠে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা গলা চড়িয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, শোনো সুন্দরী, আমি এ শহরে নবাগত মুসাফির। তোমার রূপে আমি মুগ্ধ। এতে পথ হেঁটে এই দূরদেশে আসা সার্থক হয়ে গেলো তোমাকে দেখে।
আমি থামলাম। ভাবলাম মেয়েটি কিছু বলবে। কিন্তু ওর মুখে-চোখে দারুণ একটা ভয়ের ছাপ লক্ষ্য করে দমে গেলাম। একটু পরে সে খুব আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে আমাকে বুঝিলে দিলো, এখন তুমি পালাও এখান থেকে। ঠিক মাঝরাতে এসো।
জানলাটা বন্ধ হয়ে গেলো। আনন্দে নেচে উঠলো আমার হৃদয়। কি ঘটতে পারে কিছুই ক্ষেপ না করে সেইদিন মাঝরাতে এসে হাজির হলাম আবার সেখানে। দেখলাম, জানলাটা থেকে একটা রেশমী দড়ি ঝুলছে। দড়িটা ধরে প্রাণপণ করতে একসময় জানালায় উঠে আসতে পারলাম আমি। ঘরের ভিতরে একখানা চাদী পালঙ্কে শুয়েছিলো সে। তার রূপের বর্ণনা দিতে পারবো না, তবে একথা বলতে পারি, ওধরনের সুন্দরী মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না।
এরপরে সহজভাবেই যা ঘটা সম্ভব ছিলো তাই সংঘটিত হয়েছিলো সে রাতে। আমরা দু’জনে গভীর আশ্লেষে একাত্ম হয়ে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু থাক সেসব কথা, প্রেমোপাখ্যান বিবৃত করার প্রয়োজন নাই এখানে। সে রাতে মেয়েটি তার দুঃখের কাহিনী শুনিয়েছিলো আমাকে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, আমি সুলতানের বেগম লুবিবাহ। এই বিলাসমহলে আজ আমি নির্বাসিতা। সুলতানের অন্যান্য বেগমরা শত্রুতা করে এই সর্বনাশ করেছে। আমার। সুলতান আমাকে বিষনজরে দেখেন এখন। অথচ একদিন আমিই ছিলাম তার একমাত্র নয়নতারা। আজ আমি বড় একা নিঃসঙ্গ। এই নিঝুম পুরীতে আজ আমি বন্দিনী। অথচ একদিন কি না আমার ছিলো। আজ আমি বড় একা—অসহায়। মাঝে-মাঝে জানলায় দাঁড়িয়ে নীলের শোভা দেখে দেখে দিন কাটাই। একটা সঙ্গী সাথী নাই আমার, যার সঙ্গে দু’টো মনের কথা বলতে পারি। এখন কাউকে কাছে পাই না যাকে আমার দেহ-প্রাণ-মন উজার করে দিতে পারি। বহুকাল পরে নদীর তীরে তোমাকে দেখে মনে বড় আশা হলো। তোমার সুঠাম সুন্দর যৌবন আমাকে চঞ্চল করে তুলেছিলো, তাইতো তোমাকে আসতে বলেছিলাম আজ রাতে। তুমি এলে, অনেকদিনের অতৃপ্ত কামনা শান্ত করে দিয়েছ তুমি! কিন্তু আজকের রাতই কি শেষ সুখের রাত হবে গো? আর তুমি আসবে না আমার কাছে?
আমি বলতে পারলাম, চিরকাল-যতদিন বাঁচবো তোমাকে নিয়েই বাঁচতে চাই আমি।
ঠিক এই সময় কে যেন দরজায় প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারতে লাগলো। বেগম লুবিবাহ শিউরে উঠলো, সর্বনাশ, এতো সুলতানের করাঘাত। এখন উপায়?
জানালার কাছে গিয়ে দেখি রেশমী দড়িটা কেটে দেওয়া হয়েছে! ভয়ে আমি পালঙ্কের নিচে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু বিশজন কাফ্রি খোজার হাত থেকে পালঙ্কের তলায় পালিয়ে নিস্তার পাওয়া যায়? ওরা আমাকে টেনে বের করে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নীলের জলে। শুধু আমাকেই নয়, আমার প্রাণাধিকা লুবিবাহকেও ওরা রেহাই দিলো না। তাকেও ছুঁড়ে দিলো আমারই পাশে।
সাঁতার জানা ছিলো, তাই নীলের স্রোতে হারিয়ে গেলাম না। কোনরকমে সাঁতার কাটতে কাটতে এক সময় অপর পারে গিয়ে তীরে উঠতে পারলাম। কিন্তু সে যে কোথায় তলিয়ে। গেলো তার আর কোনও হদিস পেলাম না। এর পর কাইরোয় থাকার বাসনা ত্যাগ কের বাগদাদে চলে গেলাম আমি। আমার কোমরের তোড়ায় তখন গুটিকয়েক মাত্র দিনার অবশিষ্ট ছিলো। সেই ক’টা টাকা দিয়ে একটা বারকোষ ভর্তি করে মেঠাই মণ্ডা কিনে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে গেয়ে ফিরি করে বেড়াতে লাগলাম। আমার গলায় খুব মিষ্টি সুর ছিলো। এবং এই কারণেই অতি অল্প সময়ের মধ্যে খদ্দেরদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। প্রতিদিন বারকোষ ভরে মেঠাই নিয়ে পথে বেরুই। কিন্তু দিনান্তে একটিও পড়ে থাকে না। এইভাবে দিনে দিনে যা লাভ হয় তার সামান্যই খরচ হয় খানাপিনা করতে। বাকীটা জমতে থাকে।
একদিন পথে পথে ঘুরতে এক দোকানের বৃদ্ধ মালিক আমাকে ডাকলেন। শেখ সাহেব কিছু মিঠাই কিনবেন। বারকোষখানা নামালাম তার দোকানে। বৃদ্ধ আমার নাম ধাম জিজ্ঞেস করায় আমি কিঞ্চিৎ বিব্রত বা ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললাম, অতীতের স্মৃতিটা নিয়ে আর নাড়াচাড়া করতে চাইনে শেখ সাহেব। সে বড় মর্মান্তিক মনে হয় আমার কাছে।
বৃদ্ধ আমাকে আর ঘাঁটালো না। দশটা দিনার হাতে গুজে দিলো সামান্য মিঠাইএর জন্য। এটা দয়ার দান বুঝতে পেরেও, না করতে পারলাম না। বৃদ্ধকে খুশি করার জন্যই নিলাম।
রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
আটশো পঁচিশতম রজনী :
আবার সে বলতে শুরু করে :
পরদিন আবার আমি ঐ বৃদ্ধের দোকানে গেলাম। সেদিনও তিনি সামান্য খানিকটা মিঠাই কিনলেন। তারপর আবার সেই একই প্রশ্ন করলেন, কি আমার নাম, কোথায় আমার দেশ।
সেদিন আর আমি তাকে বিমুখ করলাম না। আমার সব কাহিনী তাকে খুলে বললাম। বৃদ্ধ শুনে সানয়নে বললেন, বেটা তোমার বাবা আবদ অল আজিজ আমার প্রাণের দোস্ত ছিলো। তার ছেলে হয়ে আজ তুমি পথে পথে ফিরি করে বেড়াচ্ছ? বাবা একটা কথা বলবো, আমি সারাজীবন অপুত্রক। তোমার বাবা আমার পরম বন্ধু ছিলেন, সেই অধিকারে তোমাকে আমি দত্তক গ্রহণ করতে চাই। আজ থেকে তুমি আমার ছেলে হলে।
পরদিনই তিনি দোকানপাঠ বন্ধ করে আমাকে নিয়ে বসরাহয় রওনা হলেন। বসরাহতেই তার আদি বাসগৃহ ছিলো।
বসরাহয় এসে আমি বৃদ্ধের প্রাসাদে দারুণ আদর যত্নে দিন কাটাতে লাগলাম। বৃদ্ধ আমাকে বললেন, বাবা, বয়স হয়েছে। এবার যাবার সময় হলো। আমার মৃত্যুর পর আমার যা-কিছু বিষয়-আশয় সব তোমার হবে।
এরপরও তিনি বছরখানেক জীবিত ছিলেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন, বাবা, যে সম্পদ আমি রেখে গেলাম তোমার জন্য তা দুনিয়ার তাবৎ সুলতান বাদশাহর কোষাগারেও নাই। এ আমাদের বংশানুক্রমে সঞ্চিত ঐশ্বর্য। সৃষ্টির আদিকাল থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা জমিয়ে গেছেন এসব। আমিও যতটা পেরেছি বাড়িয়েছি। আমার নানাজী মৃত্যুকালে আমার বাবাকে যে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন আমার বাবাও মৃত্যুশয্যায় আমাকে ডেকে সেই উপদেশই রেখে গেছেন। আমিও তোমাকে সেই কথাই কানে কানে বলে যাচ্ছি বেটা, প্রাণ খুলে মুক্ত হাতে দান ধ্যান করবে, তোমার ঐশ্বর্য কখনও ফুরাবে না। আর একটা কথা, সব অবস্থাতেই নিজেকে সুখী মনে করবে। আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন।
এই ছিলো তার শেষ কয়টি কথা। এবং সেই নির্দেশই আমি যথাযথ পালন করে চলেছি। আমাকে যারা গোড়া থেকে জানতো তারা ভেবেছিলো, বাবা দাদার ঐ বিশাল ঐশ্বর্য যখন আমার হাতে পড়ে উড়ে গেছে, এ বিষয় সম্পত্তির মেয়াদও বেশি ছিলো না। কিন্তু দু’হাতে বিলিয়ে আজও একই রকম ঐশ্বর্যবান রয়ে গেছি দেখে তারা একটু যেন দমে গেছে।
আমার দান ধ্যানের বহর দেখে সরঝরের শহর অধিকর্তাদেরও চোখ টাটাতে লাগলো। একদিন বড় কোতোয়াল সাহেব এলেন আমার প্রাসাদে। বেশ খানিকটা খোঁচা দিয়েই তিনি বললেন, আবু কাসেম সাহেব, চোখ কান তো আমাদেরও খোলা আছে, সবই দেখতে শুনতে পাচ্ছি। তা অত নবাবী চালে দু’হাতে ধন দৌলত বিলিয়ে দিয়ে কতদিন চলবে? দিন দিন যা মাঙ্গি-গণ্ডার বাজার হচ্ছে তাতে লোকে দু’বেলা দু’খানা রুটি জোগাড় করতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তোমার এইরকম দান খয়রাতি কি শোভা পাচ্ছে, মালিক? এই দেখ না, আমি সরকারের উঁচু পদে বহাল থেকেও সংসার চালাতে পারছি না ঠিকমতো। রুটির দাম বেড়ে গেছে, এদিকে গাইগরুটা দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে, কি যে করি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, ঠিক আছে দিনে রুটি আর দুধের বাবদ কত খরচ হয় আপনার?
সে বললো, দিনে দিনারের বেশি না। কিন্তু এই দশটা দিনারও আমি জোগাড় করতে পারছি না।
আমি বললাম, আপনাকে আপাতত একশো দিনার দিচ্ছি। মাস শেষ হলে আবার আসবেন, আমি আপনাকে আবার দেব।
লোকটি গদগদ হয়ে হাতে চুমু দিতে এলো। কিন্তু আমি তাকে নিরস্ত করে বললাম, আমি যা দিচ্ছি সবই আল্লাহর জিনিস, এরজন্য আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার কিছু নাই।
এর কয়েকদিন পরে বসরাহর সুবেদার সাহেব আমাকে তলব করলেন। আমি হাজির হতেই তিনি আমায় খুব খাতির যত্ন করে বসতে দিলেন। এবং বললেন, এই শহরের কিছু লোক বলছে, তোমার কাছে বিপুল ধন-সম্পত্তি আছে। এবং তুমি তা বেপরোয়া ভাবে অপাত্রে দান করে যাচ্ছ।
সুবেদারের মতলব বুঝতে আমার দেরি হলো না। বললাম, আপনি যা শুনেছেন তা অনেকখানিই সত্যি। তবে অপাত্রে দান করছি কিনা বলতে পারবো না। মোট কথা আমার কাছে। যারা চাইতে আসেন আমি তাদের ফেরাতে পারি না।
সুবেদার বললেন, এই শহরে প্রায় দু’হাজার অত্যন্ত দরিদ্র ধার্মিক মানুষ আছে। তারা সভাবে আল্লাহর নাম গান করে। কিন্তু দু’বেলার আহার জোটাতে পারে না। তুমি যদি প্রতিদিন দু’হাজার দিনার করে আমার হাতে দাও আমি ঐ সব ধর্মপ্রাণদের মধ্যে বিতরণ করতে পারি।
বুঝতে পারলাম গরীব মানুষদের নাম করে সুবেদার নিজের পকেট ভরতে চায়। বললাম, ঠিক আছে তাই হবে। প্রত্যেক দিন আমি আপনাকে দু’হাজার দিনার পাঠিয়ে দেব।
বলা বাহুল্য সুবেদার সাহেব এখন আমার প্রসংশায় পঞ্চমুখ।
খলিফা হারুন অল রসিদ আবু কাসেমের পাঠানো উপহারগুলো সঙ্গে নিয়ে বাগদাদে ফিরে এলেন। জাফরকে ডেকে এনে বললেন, জাফর তোমার কথা বিশ্বাস না করে আমি তোমার উপর অবিচার করেছি। আবু কাসেম সম্বন্ধে তুমি যা বলেছিলে, আমি নিজে যাচাই করে এসেছি, আসলে সে তার চাইতে আরও অনেক বড়। তার ব্যবহারে আমি বিশেষ প্রীত হয়েছি। আমি তাকে পুরস্কৃত করতে চাই। কিন্তু সে তো আমার চেয়েও অনেক ঐশ্বর্যবান, ধন-দৌলতের উপহার নিয়ে সে কি করবে?
জাফর বললো, অর্থের প্রয়োজন জীবনে সীমিত, জাঁহাপনা। কিন্তু সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, পদমর্যাদা এবং ক্ষমতা লাভের বাসনা অনন্ত। আমার মনে হয় আবু কাসেমকে যদি আপনি। বসরাহর সুলতান পদে অধিষ্ঠিত করেন সেই হবে তার যোগ্যতম পুরস্কার।
খলিফা বললেন, যথার্থ বলেছ তুমি। আর কালবিলম্ব না করে তার অভিষেকের আয়োজন কর।
কয়েকদিনের মধ্যেই বাগদাদ শহরে মহা সমারোহে দারুণ জাঁকজমকের মধ্যে আবু কাসেমকে বসরাহর সুলতান পদে বহাল করে নিলেন খলিফা। নানা প্রকারের উপহার উপঢৌকনের মধ্যে সবচেয়ে সেরা একটি সুন্দরী বাঁদী তুলে দিলেন তিনি কাসেমের হাতে। কাসেম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লো, একি পরম সৌভাগ্য তার! একদিন নীলের অতল জলে যে হারিয়ে গিয়েছিলো সেই বেগম লুবিবাহ আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে।
লুবিবাহকে একটি জেলে উদ্ধার করে বাগদাদের বাঁদীবাজারে বিক্রি করে দিয়েছিলো। এবং ঘটনাক্রমে সে খলিফার হারেমে এসে অবস্থান করছিলো।
লুবিবাহকে ফিরে পেয়ে আবু কাসেমের জীবন কানায় & কানায় ভরে ওঠে। এতে অর্থ, এতো সম্মান মর্যাদা এতো প্রেম ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে মেলে?
গল্প শেষ করে শাহরাজাদ চুপ করে বসে রইলো। দুনিয়াজাদ উঠে এসে দিদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, কি সুন্দর তোমার কিসসা দিদি, আর কেমন মিষ্টি করেই না তুমি বলতে পার।
শাহরাজাদ বলে, জাঁহাপনা, যদি অনুমতি করেন তবে আজ রাত থেকে আর একটা কাহিনী শুরু করতে পারি।
শারিয়ার বললো, আমি তো আহার নিদ্রা ত্যাগ করে তোমার কিসসা শোনার জন্যেই বসে আছি, শাহরাজাদ। নাও শুরু কর।
শাহরাজাদ বলে, এবারে যে কাহিনী বলতে শুরু করছি, তার নাম বাদশাহী জারজ।