হাসিতে অশ্রু – হায়াতুল্লাহ আনসারি
‘কেসু তোমাকে যদি আমি পড়াতে চাই, পড়বে?
‘আমাকে পড়াবে বাবু! আমাকে–?’
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ঝগড়ু চাক্কি থামিয়ে আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকাল।
‘কেন, এতে খারাপের কী আছে।’
‘কিন্তু আগে বলো কী পড়াবে তুমি?’
‘কেন– ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, দেশের বড় বড় লোকদের জীবনকাহিনি এবং তাঁদের মূল্যবান উপদেশাবলি!’
ঝগড়ু হেসে উঠল, উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
বেদম হাসির চোটে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখ বড় একটা পাত্রের মতো হাঁ করে থাকল। আর তার ভেতর দিয়ে উঁচু-নিচু নানান স্বরের হাসি ভেসে আসতে লাগল।
‘কী বললে, ইতিহাস, ভূগোল আর কী– বাবু আমরা তো এখানের সকলেই নিরক্ষর।’
তার এ-কথায় আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। বললাম– ‘কিন্তু তোমরা প্রয়োজনের সময় তো দেখি দিব্যি একজনের কার্ড আরেকজনের কার্ড থেকে আলাদা করে নিতে পারো।’
‘ওসব কার্ডের উপর তো আমরা বিশেষ চিহ্ন দিয়ে রাখি। এখানে পড়ালেখা কে জানে? ‘ঠিক আছে কোনও চিন্তা নেই, আমি তোমাকে পড়া শেখাব আগে, তার পর লেখা।’
‘শেখাবে আমাকে পড়ালেখা! কিন্তু আমি তো বোকা!’
‘কে বলল তুমি বোকা, তুমি তো সব কথাবার্তায় বেশ চালাক।’
‘কিন্তু বাবু যখনি বই সামনে আসে অমনি আমি বোকা বনে যাই।’
‘তা হলে চলো তোমাকে এমন এক পদ্ধতিতে পড়াব যাতে বইয়ের প্রয়োজন হয় না।’ বারে বারে বাড়ির কথা মনে পড়ত ঝগড়ুর। তাকে আনমনা করে দিত সে-চিন্তায়। সারাক্ষণ সে চিন্তার সায়রে ডুবে থাকত! কিন্তু এরপরও সে আমার কাছে পড়ালেখা করে যেতে লাগল। পিষানো আটার উপর অক্ষর তৈরি করে তার উপর তাকে মক্শ করাতাম। তাকে পড়াবার এটাই ছিল শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।
খুনের অপরাধে ঝগড়ুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সে ছিল বড় ঝগড়াটে কয়েদি। আর বোধহয় এ-কারণেই জেলার সাহেব তাকেই দিয়েছে আমার সাথি হিসেবে। কিন্তু আমার সাথে সে কখনও ঝগড়া করেনি, বরং চাক্কি চালাবার সময় সে নিজে গায়ের সব জোর দিয়ে চালায়, আমাকে শুধু বলে– ‘বাবু, তুমি শুধু হাত দিয়ে ধরে রাখো।’
কোর্টের পক্ষ থেকে আমাকে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের জেলার সাহেব রাজবন্দিদের ব্যাপারে বড় তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখেন। তিনি বলতেন– ‘এ’ ক্লাস হোক, চাই ‘বি’ ক্লাস হোক, তাদের কাজ করতেই হবে। নাহয় আবার তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে আর খোদ জেলারের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করবে।
আমি তার সাথে এ-ব্যাপারে কথা-কাটাকাটি করেছিলাম।
তিনি রেগে গিয়ে বললেন– ‘তোমার সমস্ত শক্তি বের করে ছাড়ব। এমন কয়েদির সাথে তোমাকে চাক্কি চালাতে দেব– যে তোমার মেজাজই ঠিক করে দেবে।’
প্রথম প্রথম চাক্কি চালাতে সত্যি আমার কষ্ট হয়েছিল। চাক্কির ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে ঝগড়ু বসে থাকত। কিন্তু যখনি সে জানতে পারল– ‘রাজবন্দি কাদের বলে’- তখনি সে আমার ওপর সহৃদয় হয়ে উঠল এবং চাক্কির সমস্ত ভার নিজে নিতে লাগল।
‘কেমন ভাই, পড়া মুখস্থ হয়েছে তো?’
‘কালকেরটা হয়নি। তার আগের দুদিনের পড়া মুখস্থ হয়েছে।’
‘যা হোক– অন্তত কিছু তো হয়েছে।’
ঝগড়ুর স্থির বিশ্বাস– পড়াটাই আসলে ভালো জিনিস, কিন্তু লেখা শিখে কী করবে। তার আছেই-বা কে যে, একখানা চিঠি লিখবে?’
‘বাড়ির কথা তুমি খুব স্মরণ করো– তাই না?’
‘হাঁ বাবু, খুব।’
‘যাকে স্মরণ করো– তার কাছে লিখবে?
‘না বাবু, তা হয় না।
‘কেন?’
‘কী আর বলব।’
আটার মাঝে অক্ষর এবং অক্ষর থেকে শব্দ গঠন হতে থাকল। আর শব্দ পড়ার সাথে সাথে তার চেহারায় এক অদ্ভুত সজীবতা ফুটে উঠতে লাগল– সাথে একটুখানি আশার ক্ষীণ আভা। পড়ার দিকে তার আকর্ষণ ক্রমশ বেড়েই যেতে লাগল, শব্দের পর বাক্য লিখে যেতে লাগল আটার উপর।
আস্তে আস্তে ঝগড় এসব বাক্যগুলো পড়তে থাকল।
একদিন আমি বললাম– ‘ঝগড়ু ভাই! এবার তুমি চিঠিও পড়তে পারবে।’
ঝগড় হঠাৎ হাত থামিয়ে ফেলল।
‘আমি চিঠি পড়তে পারব?’
‘হ্যাঁ।’
তার কালো বর্ণের শরীরে ঈষৎ রক্তিমাভা খেলে গেল, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বইতে শুরু করল এবং হাত কাঁপতে থাকল– ‘আমি চিঠি পড়তে পারব!’
‘হ্যাঁ ঝগড়ু! তুমি চিঠি পড়তে পারবে।’
সে এক আশ্চর্য খুশিভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
‘দ্যাখো বাবু, ভেবেচিন্তে বলো, পড়তে বসলে আবার আটকে যাব না তো!’
‘না ঝগড়ু, যদি পরিষ্কার লেখা হয় তা হলে নিশ্চয়ই তুমি পড়তে পারবে।’
ঝগড়ু উৎফুল্ল, ভাবনাচিন্তার অতলে ডুবতে থাকল সে এবং ডুবতে ডুবতে একসময় একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। চাক্কি চলতে থাকল গড় গড় করে স্বাভাবিক গতিতে আর আমিও জোর দেওয়ার তেমন কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম না। কিন্তু ঝগড়ুর চোখজোড়া অতীত চিন্তার গভীর অতলে তলিয়ে গেল– যা দেখে আমি ভয়ে এতটুকুন হয়ে গেলাম।
ঝগড়ুর চেহারার এই অদ্ভুত পরিবর্তন দুপুর থেকে ছ-প্রহর পর্যন্ত থাকল। পরে একসময় সে আমার কাছে এসে বলল– ‘বাবু কিছুক্ষণের জন্য আমাকে ছুটি দাও, এই এক্ষুনি চলে আসব।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও।’
একটা দেয়ালের আড়ালে চলে গেল ঝগড়ু। আমি পুরোদমে আটা পিষতে থাকলাম। ঠিক সে-সময় ঝগড়ুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সে উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলছে, কখনও হাসছে, কখনও-বা জোরে জোরে কাঁদছে। আর তার গলার স্বরও এমন অদ্ভুত যে, আমার ভয় পেয়ে গেল এবং জোরে তার কাছে দৌড়ে এলাম আমি।
ঝগড় তখন হাতে একখানা কাগজের পাতা নিয়ে পড়ছিল। তার ঠোঁটে ঈষৎ হাসি, চোখে অশ্রু –আর তার হাতজোড়া কাঁপছিল।
‘সে মারা গেল, তা সে আমার হয়েই মারা গেল। মরার সময় সে আমারই ছিল এবং এখনও আমার থাকল, হ্যাঁ।’
এবার সে কাঁদতে থাকল এবং ফুটফুট করে কাঁদতে থাকল। আমি অনুভব করলাম এসময় তার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই দূরেই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। ঝগড়ুর কান্নার রেশ কিছুটা কমলে আমি ডাকলাম– ‘ঝগড়ু, ঝগড়।’
কিন্তু ঝগড়ু তেমনি নিজের চিন্তার রাজ্যে ডুবে থাকল। আমি বারবার তাকে ডাকতে থাকলে সে বলল– ‘বাবু তুমি চাক্কি চালাও গে, নাহয় আমাদের উভয়েরই পিঠে কোড়া পড়বে। তোমার বদৌলতে আমার সে-কথা জানা হয়ে গেছে যে-কথা জানার জন্য আমি পাঁচ বছর ধরে অস্থির চিত্তে উন্মুখ ছিলাম। কিন্তু আমাকে কে বলত –।‘
তার এসব কথাবার্তায় আমরা নিশ্চিন্ত হলাম যে, সে পাগল হয়ে যায়নি। পরে এসে আটা পিষতে থাকল সে।
২
পরের দিন ঝগড়ু এলে দেখলাম তার চেহারায় বিষণ্নতাও ছিল, নীরবতাও ছিল এবং একটা ক্ষীণ হাসির ছোঁয়াও ছিল। তবে এখন তার চোখে সেই মৃত-মৃত ভাব নেই– যা প্রায়শ তার মাঝে দেখা যেত।
আমি ঝগড়ুকে জিগ্যেস করলাম– ‘কী ব্যাপার।’
সে কিন্তু কোনও জবাব দিল না। সেদিন বিকেলে যখন সে চলে যাচ্ছিল তখন বড় নম্রভাবে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে গেল। পরের দিন সকালেও তাই করল, সন্ধ্যায়ও। তিন-চার দিন পর ঝগড়ু আমাকে তেমনি পা ছুঁয়ে বলতে লাগল–
‘বাবু তুমি আমার ওপর এমন অনুগ্রহ করেছ যে, সাত জনমেও তার শোধ দিতে পারব না। যদি আমি জেলের বাইরে হতাম তা হলে একটা কাজ নিশ্চয়ই করতাম। তা হল তোমার সব শত্রুদের খুঁজে খুঁজে বের করতাম।’
‘আমার কোনও শত্রু নেই, কিন্তু তোমার হয়েছে কী বলো দিকিনি, তুমি খুশি, না বিষণ্ণ।’
‘আমার নিজেরও বুঝে আসছে না, তোমাকে কী বলব।’
‘আচ্ছা বলো দিকি সেদিন আমার হাতে চাক্কি ছেড়ে দিয়ে গিয়ে কী পড়ছিলে?’ ‘একখানা চিঠি।’
‘কার চিঠি?’
‘আমার স্ত্রীর।’
‘স্ত্রীর! তুমি তো সবসময়ে বলতে তোমার কেউ নেই।’
‘এখন সে কোথায় বাবু– সে তো এখন ভগবানের কাছে।’
‘ভগবানের কাছে? তবে তার চিঠি কীভাবে পেলে তুমি?’
‘এ চিঠি তো পাঁচ বছর আগে এসেছিল।’
‘তা তুমি কারও কাছ থেকে নিশ্চয়ই পড়িয়ে নিয়েছিলে?’
‘না, তা কারও কাছে যাইনি।’
‘কারও কাছে যাওনি?’
‘হ্যাঁ, চিঠিখানি এভাবেই পাঁচ বছর যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম।’
আমি কেঁপে উঠে মনে-মনে বললাম –”পাঁচ বছর, পাঁচ বছর! গত পাঁচ বছরে এ পৃথিবীর কত পরিবর্তন হয়েছে, কত কিছু ঘটেছে।-–”
আমি চাকরি পেয়েছি, বিয়ে করেছি, আমার বড়ছেলে ইশকুলে পড়ছে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি এবং ‘৪৬ সনের আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে এসেছি।
এই পাঁচ বছর হিন্দুস্তানে কী তুমুল বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেছে। দেশে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সেই নেতৃবৃন্দ– যাদের লোক গুণ্ডা বলে মনে করে– তারা শাসক হল। শিক্ষার নিয়মকানুন পরিবর্তিত হল, কৃষকদের উচ্ছেদ করা বন্ধ হল। এতে তাদের জীবনের কাঠামোই বদলে গেল, এবং আরও অনেককিছুই হয়ে গেছে এ পাঁচ বছরে– যখন থেকে এ চিঠিখানা ঝগড়ুর কাছে এমনি পড়ে ছিল।
‘উহ্! পাঁচ বছর।
ঝগড়ু বলতে থাকল, ‘যদি এটা যেই-সেই চিঠি হত তা হলে অবশ্য অন্য কারও কাছ থেকে পড়িয়ে নিতাম। কিন্তু এটা তো অন্যধরনের চিঠি। আমার সবসময় ভয় ছিল– চিঠিতে এমন কোনও কথা নেই তো যদ্দ্বারা সে হেসে দেয়। তা হলে তো নির্ঘাত আমি তার গলা চেপে ধরব। এবং আমার এ-ও ভয় ছিল– চিঠির কথা নিয়ে তারা যদি হাসাহাসি করে তা হলে আমি তাদের মেরে শেষ করে দেব। ভাই আমার রাগকে আমি বড় ভয় করি,–রাগই তো আমাকে এই চার দেয়ালের অভ্যন্তরে নিয়ে এসেছে।
‘আমি তাই চিঠিখানা অন্য কারও কাছ থেকে পড়িয়ে নিইনি। তা সেই চিঠিখানা আমার বুকের উপর রাবারস্ট্যাম্পের মতো লেগেছিল। সবসময় বুকে একধরনের ব্যথা অনুভব করতাম– না-জানি চিঠিখানার ভেতরে কী লেখা আছে। আমি ভেবে রেখেছিলাম জেল থেকে ছাড়া পেয়েই স্টেশনে গিয়ে একজন লোককে দিয়ে তা পড়িয়ে নেব।
‘তা এখন চিঠি পড়েছ তো?’
‘হ্যাঁ বাবু, পড়েছি। এবং পড়ে জানলাম- আমার পত্নী আমার ছিল এবং মরার সময়ও আমার হয়ে মরেছে।’
‘এর ওপর তোমার সন্দেহ হল কেন?’
‘বাবু– দীর্ঘ সাজা কাকে বলে তা তো জানো না। যখন আমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়– তখন আমি যুবক, আর সে তো ধরতে গেলে একেবারে বাচ্চাই। আমি রায় শুনেই পাঁচজনকে সাক্ষী রেখে বলে দিয়েছি যে, আমার পত্নী যাকে ইচ্ছা বিয়ে করে নিতে পারবে, আমার দিক থেকে সে মুক্ত। পরে সে জেলে আমার সাথে দেখা করতে এলে তাকে একথা আমি নিশ্চয়ই বলতাম– ‘তুই এই যৌবন নিয়ে কী করে বাঁচবি রে মূর্খ? যা কাউকে বিয়ে করে নেগে।’ কিন্তু ভগবান জানেন একথা বলার সময় আমার হৃদয় ফেটে চৌচির হয়ে যেত। আমি নিজের মনকে প্রায়শ বলতাম, তোর হৃদয় ফেটে যায় তো যাবে– কিন্তু এটা তো চিন্তা কর্ এ মেয়েটা যাবজ্জীবন কয়েদির পত্নী হয়ে কী করে থাকবে। তুমি তো জানো যৌবনেরও একটা বয়েস আছে, একটা সময় আছে। সে-বয়সের রঙিন দিনগুলোতেই যদি সে তার প্রেমাস্পদকে না-পেল তা হলে তো বৃথা তার এ জীবন। তবুও সে এল না দেখে মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শেষমেশ আমিও রেগে গেলাম। মনে মনে বললাম –ঠিক আছে, তুই না-আসিস্ –অন্য কারও ঘরে চলে যা। তা সে এলও না। প্রতিদিন সে আসবে ভেবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে উঠতাম, গভীর জলের মাছের মতো চঞ্চল হয়ে উঠতাম। পরে একজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েও তাকে ডাকলাম, তবুও সে এল না। আমার খুব কান্না পেল, আর আমি খুব করে কাঁদলামও। পরে নিজকে নিজে বললাম– ‘মূর্খ, তুই নিজেই তো তাকে আসতে বাধা দিচ্ছিস, অন্যের ঘরে চলে যেতে পরামর্শ দিচ্ছিস। তবুও সে অনেকদিন তোর ঘরে থেকেছে, এখন যদি সে তোর ঘরে না-থাকে…তোর কথামতো অন্যের ঘরে চলে যায়- তাতে তোর কী!– তুই কেন আবার কাঁদছিস?
‘তবুও আমি তার আশা ছাড়িনি। ভাবলাম –যদি কখনও আমার কথা তার মনে পড়ে এবং তার নতুন পুরুষের সাথে চলে আসে?– এমনি আশায় আশায় বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে যায়।
শেষে একদিন এই চিঠি পেলাম। চিঠিখানা নিয়ে আমি মুন্সির কাছে ছুটলাম পড়িয়ে নিতে, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ভাবলাম –চিঠিতে কী লিখবে? লিখবে সে অন্যের ঘরে চলে গেছে। এটা পড়ে মুন্সিও দেবে হেসে। ঝগড়ু কি এ হাসি সহ্য করতে পারবে! একথা মনে হতেই রক্ত আমার গরম হতে শুরু করল, পরে ভাবলাম– না-হয় মুন্সি হাসলই না– কিন্তু কথা তো আর গোপন থাকবে না, একদিন-না-একদিন জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়বে– এবং কয়েদিরা যেখানেই আমাকে দেখবে হাসবে– আর তা আমিও সহ্য করতে পারব না।
‘তা শেষপর্যন্ত চিঠিখানা তেমনি রেখেই দিলাম– চিঠিখানাও তেমনি পড়ে থাকল। এরই মধ্যে একদিন খবর পেলাম তার মৃত্যু হয়েছে।
‘তার মৃত্যুখবরে আমি মুষড়ে পড়েছিলাম– কিন্তু কাঁদতে পারিনি। কান্না আমার আসেনি। কারণ এটুকুই জানতে পারিনি যে, মরার সময় সে কার ছিল।
‘পরে তুমি যখন বললে যে পড়া শিখো– তখনও আমার একথা মনে ছিল না– আমি এতদূর পড়তে পারব বলে, অন্তত চিঠি।
‘আমাদের গাঁয়ে অনেক লোক আছে– যারা পাঠশালায় পড়ালেখা করেছে, তারাও না পারে একটা চিঠি পড়তে, না পারে লিখতে। এ দুটো কাজ তারা অন্যের দ্বারা সারিয়ে নেয়। এবং কখনও তাদের ঘরে এক-একটা চিঠি মাসের-পর-মাসও পড়ে থাকতে দেখা
যায়, তারা শুধু অপেক্ষা করে একজন শিক্ষিত লোকের জন্য।
‘যখন তুমি বললে, ‘তুমি চিঠি পড়তে পারবে’–
তখন আমার বিশ্বাস হয়নি- তাই তোমার কাছ থেকে সরে গিয়ে চুপি চুপি এ চিঠিখানা খুললাম এবং পড়তে শুরু করলাম, আর চিঠিখানা পড়েই তার মৃত্যুর জন্য কেঁদে দিলাম। এবং একথা জেনেই বড় খুশি হলাম যে, সে মরার সময় আমারই ছিল।’
‘তা হলে সে তোমার সাথে দেখা করতে আসেনি কেন?’
‘বাবু তার দুটো পা-ই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল –আসবে কী করে! — জানি না সে কীভাবে বেঁচে ছিল। উপোস থেকে মরে যায়নি তো?’
ঝগড়ু পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে দেখতে থাকল। তার চোখে ছিল ব্যথা-মিশ্রিত অশ্রু এবং ঠোঁটে বিজেতার হাসি।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী