৪.১১ সৈন্য সমাবেশ

॥ এগার ॥

এক বসতিতে এই সৈন্য সমাবেশ চলে। সূর্য অনেকপূর্বেই ছুটি নিয়ে বিশ্রামে গিয়েছিল। বসতিতে অসংখ্য মশালধারী হৈ চৈ সৃষ্টি করে পায়চারি করছিল। বসতিটি দিনের মত জাগ্রত এবং তৎপর ছিল। এরই মধ্যে দুই অপরিচিত লোক এসে বসতিতে ঢুকে পড়ে এবং মানুষের ভীড়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলে।

“একটি আহ্বান শুনে আমরা এসেছি” আগন্তুকদ্বয়ের একজন বলে “আমরা আয়-রোজগারের উদ্দেশ্যে অনেক দূর থেকে এসেছি। এভাবে যেতে যেতে হয়ত এক সময় মাদায়েন গিয়ে পৌঁছব। তা এসব কি হচ্ছে?”

“তোমরা কারা?” কেউ জানতে চায়– “কোন ধর্মের অনুসারী?” উপরে নিজ নিজ শাহাদাত আঙ্গুল পর পর উভয় কাঁধে রাখে অতঃপর নিজ নিজ বুকে আঙ্গুল উপর নীচ করে ক্রুশ চিহ্ন বানায় এবং উভয়ে একসাথে বলে ওঠে যে, তারা ইহুদী।

“তবে তোমরা ময়দানে গিয়ে কি করবে?” এক বৃদ্ধ তাদের বলে “তোমরা বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট। শরীরে বেশ শক্তি আছে। তোমরা নিজেদেরকে কুমারী মারইয়ামের ইজ্জত রক্ষার্থে উৎসর্গ হওয়ার যোগ্য মনে কর না? তোমাদের কাছে পেটের মায়াই কি বড় হয়ে গেল?”

“না, কখনো নয়। তাদের একজন বলে আমাদেরকে সব ভেঙ্গে বল এবং তোমাদের মাঝে যিনি সবচেয়ে বিচক্ষণ ও জ্ঞানী তার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করিয়ে দাও। আমরা তাকে কিছু বলতে চাই।

সেখানে ইরানী ফৌজের সাবেক এক কমান্ডার ছিল। আগন্তুকদ্বয়কে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

“শুনলাম তোমরা নাকি কিছু বলতে চাও” কমান্ডার বলে। “জী, হ্যাঁ!” একজন বলে “আমরা গন্তব্যের রাস্তা ছেড়ে এদিকে এসেছি। “শুনলাম, মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজ তৈরি হচ্ছে।”

“হ্যাঁ, হচ্ছে” কমান্ডার বলে “তোমরা সে ফৌজে শামিল হতে এসেছ?”

“ইহুদী হয়ে এটা কিভাবে বলা যায় যে, আমরা ঐ ফৌজে শামিল হব না?” একজন বলে “কাজিমা থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত এক বসতির আরব আমরা। মুসলমানদের ভয়ে আমরা এদিকে পালিয়ে এসেছি। আর সামনে যাব না।

আপনাদের সাথে থাকব।… আমরা যে কথা বলতে এসেছি তা এই যে, মুসলমানদের সংখ্যা মূলত অনেক বেশী। কিন্তু তারা সামনে খুব সামান্যই আনে। মূলত এ কারণেই আপনাদের ফৌজ তাদের হাতে পরাজিত হয়।

“মাটিতে ছক একে তাকে বুঝাও” দিতীয় ব্যক্তি তার সাথীকে বলে। এরপর কমান্ডারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানায় “সাধারণ ব্রেনের মানুষ আমাদের মনে করবেন না। আমরা ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে পারি যে মুসলমানদের যুদ্ধের কৌশল কি? তারা বর্তমানে কোথায়? কোথায় নিয়ে যুদ্ধ করলে আপনারা তাদের পরাজিত করতে পারবেন। আমরা যা যা বলব, আপনাদের সেনাপতিকে গিয়ে তা জানাবেন।”

একটা মশাল এনে মাটিতে গেঁঢ়ে দেয়া হয়। আগন্তুকদ্বয় মাটিতে বসে ছক আঁকতে শুরু করে। তারা সমর পরিভাষায় এমন নক্সা পেশ করে যে, কমান্ডার খুবই প্রভাবিত হয়।

“মাদায়েনের সৈন্য কোন্ রুট হয়ে আসছে জানালে আমাদের পক্ষে ভাল ও দিক নির্দেশনামূলক পরামর্শ দেয়া সম্ভব হত” তাদের একজন বলে “সাথে সাথে কিছু বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করতে পারতাম।”

“দুই ফৌজ মুসলমানদের নিশ্চিহ্ণ করতে আসছে” কমান্ডার বলে “মুসলমানরা তাদের সামনে টিকতে পারবে না।”

তবে শর্ত হলো, উভয় বাহিনীকে ভিন্ন ভিন্ন পথে আসতে হবে” এক অপরিচিত ইহুদী বলে।

“হ্যাঁ, তারা ভিন্ন পথেই আসছে” কমান্ডার বলে “আমাদের নামকরা এবং অসাধারণ বীর আন্দারযগারের নেতৃত্বে একটি ফৌজ মাদায়েন থেকে আসছে। এমনি আরেক শ্রেষ্ঠ বাহাদুর বাহমানের নেতৃতে ইরানীদের আরেকটি ফৌজ আসছে। উভয় বাহিনী ওলযা নামক স্থানে এসে মিলিত হবে। তাদের সাথে যোগ দিবে বকর বিন ওয়ায়েলের পুরো গোত্র। ছোট ছোট কিছু গোত্রও তাদের জনশক্তি দিতে চেয়েছে।”

‘তবে আপনাদের সালারের জন্য নতুন কোন যুদ্ধ চাল চালার প্রয়োজন নেই” দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে “আপনাদের সৈন্য তো প্লাবনের মত। যার স্রোতে মুসলমানরা তৃণের ন্যায় ভেসে যাবে।… আপনি কি আমাদের দু’জনকেই আপনার সাথে রাখবেন? আমরা আপনার মাঝে অসাধারণ বিচক্ষণতা প্রদর্শন করছি। সেনাপতি না হলেও সহসেনাপতি হওয়ার যোগ্য অবশ্যই আপনি।”

“তোমরা আমার সাথে থাকতে পার” কমান্ডার বলে।

“তাহলে আমরা ঘোড়া নিয়ে আসি” দু’জনের একজন বলে “কাল প্রত্যুষে আমরা ঠিক এখানে আপনার সাথে এসে যোগ দিব।”

“ভোরে আমরা রওনা দেব” কমান্ডার বলে “লড়ার উপযোগী লোকদেরকে একস্থানে সমবেত করা হচ্ছে। তোমরা তাদের সাথে এস। আমাকে পেয়ে যাবে।”

আগন্তুকদ্বয় বসতি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তারা বসতির অদূরে এক বৃক্ষের সাথে ঘোড়া বেঁধে রেখে পায়ে হেঁটে বসতিতে গিয়েছিল। বসতি হতে বেরিয়েই তারা ছুট দেয় এবং দৌড়ে ঘোড়ায় চেপে বসে।

“সকাল নাগাদ আমরা পৌঁছতে পারব বিন আছেফ?” একজন অপরজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে।

“খোদার কসম! আমাদের পৌঁছতেই হবে। চাই উড়ে গিয়ে হোক না কেন” বিন আছেফ বলে “এই সংবাদ সময়মত হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে না পারলে আমাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের ঘোড়া ক্লান্ত নয়। আল্লাহর নাম স্মরণ কর এবং ঘোড়া ছুটিয়ে দাও।”

উভয় ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ঘোড়া উড়ে উড়ে চলতে থাকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ছাউনী অভিমুখে। উড়ন্ত ঘোড়ায় বসে দু’অশ্বারোহী সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে আলোচনা করতে থাকে।

“আশ’আর!” বিন আছেফ উচ্চ আওয়াজে তার সাথীকে বলে “এটা তো রীতিমত তুফান। অগ্নিপূজকদের এবার পরাজিত করা সহজ হবে না। শুধু বকর বিন ওয়ায়েলের সংখ্যা দেখছ? কয়েক হাজার হবে।”

“আমি সালার হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বড় পেরেশান দেখেছিলাম” আশ’আর বলে।

“তুমি তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ বোঝনি আশ’আর?” বিন আছেফ বলে “আমরা শক্তিশালী দুশমনের উদরে ঢুকে গেছি।”

“আল্লাহ আমাদের সহায়” আশ’আর বলে “অগ্নিপূজকরা ঐ ভূখণ্ড রক্ষায় লড়ছে, যাতে তারা তাদের সাম্রাজ্য বলে মনে করে। আর আমরা ঐ আল্লাহর রাহে লড়ছি, সমগ্র ভূপৃষ্ঠ যার মালিকানাধীন।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পারস্যভুক্ত এলাকা অধিকার করার পর স্থানীয় শত্রু ও ইরানীদের সম্পর্কে সতর্ক হতে যে গোয়েন্দা দল গঠন করেছিলেন এই দু’ব্যক্তি সেই দলের বিচক্ষণ ও দক্ষ সদস্য ছিল। শত্রু পরিবেষ্টিত অচেনা অজানা দেশে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গোয়েন্দা বাহিনীর বিকল্প ছিলনা। গোয়েন্দারা যেমনি দুর্ধর্ষ তেমনি সাহসী হত। শত্রুর পেটের মধ্যে ঢুকে তার নাড়ীর খবর বের করে আনতে তাদের জুড়ি ছিল না। শত্রুর তৎপরতা মনিটরিং করতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গড়ে তোলে চতুর্দিকে গোয়েন্দাজাল বিছিয়ে রেখেছিলেন। গোয়েন্দারা ছিল তাঁর চোখ, কান। নিজের ছাউনীতে বসেই তিনি এ চোখ, কানের মাধ্যমে শত্রুর অবস্থা ও গতিবিধি সম্পর্কে যথা সময়ে অবহিত হতেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ফযরের নামায সবেমাত্র শেষ করেছেন। নামায থেকে অবসর হতেই দু’টি ঘোড়া তাঁর তাঁবুর কাছে এসে থামে। ঘোড়ার আরোহীদ্বয় এক প্রকার লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে অবতরণ করে। অশ্বারোহীদের দেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই তাদের দিকে এগিয়ে যান।

ঘোড়ার শরীর ছুঁড়ে ঘাম এমনভাবে ঝরছিল যেন কোন নদী হতে সদ্য উঠে এল। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বড় আওয়াজে ধুক ধুক করে উঠানামা করছিল। আরোহীদের অবস্থা ঘোড়ার থেকেও খারাপ ছিল।

“আশ’আর!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “বিন আছেফ! … কি খবর এনেছ? ভেতরে চল। একটু বিশ্রাম নাও।”

“বিশ্রাম গ্রহণের সময় নেই সেনাপতি আমার!” বিন আছেফ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিছু পিছু তাঁর তাঁবুতে প্রবেশ করতে করতে বলে “অগ্নিপূজকদের প্লাবন আসছে। আমরা এ তথ্য ইহুদীদের এক বসতি হতে সংগ্রহ করেছি। বকর বিন ওয়ায়েলের স্বতন্ত্র বাহিনী তৈরি হয়ে গেছে। তারা আন্দারযগার নামক এক বীর সেনাপতির নেতৃত্বে মাদায়েনের সৈন্যের সাথে আসছে। আরেকটি ফৌজ বাহমানের নেতৃত্বে অপর দিক থেকে আসছে।”

“সৈন্যরা কি আমাদের উপর ভিন্ন ভিন্ন দিক হতে আক্রমণ করবে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“না” আশ’আর জবাবে বলে “উভয় বাহিনী ওলযায় এসে একত্রিত হবে।”

“এরপর তারা প্লাবনের মত আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে এই বলছ?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।

“ইরানীদের কমান্ডার এমনই বলেছে” বিন আছেফ বলে। তাদের রিপোর্ট শেষ হতে না হতেই তাঁবুর বাইরে এক উট এসে থামে। উষ্ট্রারোহী উট থেকে নেমেই পূর্বাব গতি ছাড়াই তাঁবুতে ঢুকে যায়। সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জানায় যে, অমুক দিক হতে বাহমানের নেতৃত্বে ইরানীদের একটি ফৌজ আসছে। এ উষ্ট্রারোহীও এক গোয়েন্দা ছিল। সে কোন এক বেশে ঐ পথে গিয়েছিল, যে পথে বাহমানের ফৌজ আসছিল।

ঐতিহাসিকদের অভিমত, আন্দারযগার এবং বাহমানের এমন সময় মার্চ করা উচিত ছিল যাতে উভয় ফৌজ একই সময়ে কিংবা সামান্য আগে পিছে ওলজা নামক স্থানে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু আন্দারযগার একটু পূর্বেই রওনা করে। এর কারণ এটা হতে পারে যে, সে কিসরা উরদূশেরের কাছে অবস্থান করছিল। উরদূশের তার মাথার উপর চেপে বসেছিল। তার পীড়াপীড়িতে সে আগে মার্চ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাহমান দূরে ছিল দূত মারফত সে ফৌজসহ আসার নির্দেশ পেয়েছিল। দুদিন পরে সে রওনা হয়।

আন্দারযগারের সাথে আসা সৈন্যের সংখ্যা কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনায় পাওয়া যায় না। বাহমানের নেতৃত্বাধীন ফৌজের সংখ্যাও ইতিহাস সংরক্ষণ করেনি। তবে তাদের বর্ণনা হবে সন্দেহাতীতভাবে বুঝা যায় যে, উভয় বাহিনীর সম্মিলিত সৈন্য বাস্তবিকই প্লাবনের মত ছিল। এত বিশাল সৈন্য সমাবেশের কারণ এই ছিল যে, সম্রাট উরদূশের স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল যে, সে আর কোন পরাজয়ের ঝুঁকি নিবে না। ফলে যত সৈন্য জমা করা সম্ভব তা করা হয়েছিল।

আন্দারযগারের নিজেরই সৈন্য ছিল বে-হিসাব। তারপরেও সে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের হাজার হাজার ইহুদীকে নিজের বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। তাদের মধ্যে পদাতিকও ছিল, অশ্বারোহীও ছিল। আন্দারযগারের সৈন্যসংখ্যা পথিমধ্যে এসে এভাবেও বৃদ্ধি পায় যে, মা’কাল দরিয়ার কূলে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যে সকল ইরানী সৈন্য নৌকা করে ভাগ্যক্রমে পালিয়ে বেঁচে যেতে পেরেছিল, তারা নদীতে এদিক ওদিক ভেসে অনেক দিন পর এখন মাদায়েন যেতে থাকে। আন্দারযগার পথিমধ্যে এদের পেয়ে ছাড়ে না। সৈন্য বৃদ্ধির প্রবণতায় তাদেরও ফৌজের সাথে যুক্ত করে নেয়।

এ সমস্ত সৈন্যরা আন্দারযগারের ফৌজের সাথে যেতে চায় না। প্রাচীন পাণ্ডুলিপি প্রমাণ করে যে, পরাজিত এ সৈন্যরা বিধ্বস্ত অবস্থায় দুই দুইজন, চার-চারজন বা তার থেকেও বেশী একসাথে আসছিল। ইরানীদের এ নয়া বাহিনী দেখে অনেকে পালাতে উদ্যত হয়। মানসিক বিধ্বস্ত এবং বিকারগ্রস্ত হওয়ায় তারা দ্রুত দৌড়াতেও পারে না। তাদের ধরে ধরে আনা হয় এবং ফৌজে শামিল করে নেয়া হয়। তাদের কতক এমনও ছিল যাদের মধ্যে ভারসাম্যও ছিল না। কতক কথা বলতে পারত না। তাদের সাথে কথা বললে তারা ফ্যাল ফ্যাল নজরে শুধু চেয়ে থাকত এবং প্রতিক্রিয়াশূন্য চেহারা নিয়ে মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। কেউ কেউ কথা বলার পরিবর্তে চিৎকার করে উঠত এবং ছুটে দৌড় দিত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যদের হাতে চরম মার খাওয়ায় তাদের মাঝে এমন প্রভাব পড়েছিল যে, তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল এবং ব্রেনে চাপ পড়ায় অনেকের মতিভ্রমও ঘটে।

“সমস্ত ফৌজে ভীতি এবং উদ্বেগ সৃষ্টির পূর্বেই তাদের দূরে কোথাও নিয়ে শেষ করে দাও” অচল শ্রেণীর সৈন্যদের ব্যাপারে আন্দারযগার এই কঠিন সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয়।

তার সিদ্ধান্ত যথাসময়ে বাস্তবায়িত হয়। যে প্রাণে বাঁচার জন্য তারা শতবিধ বিপদ এড়িয়ে আসে। আন্দারযগারের এক নিষ্ঠুর নির্দেশে সে প্রাণ চিরদিনের জন্য স্তিমিত হয়ে যায়।

মাদায়েনের সৈন্যরা তেজোদ্যম ছিল। মুসলমানদের বাহুর বিজলি তখন তারা দেখে নাই। কিন্তু মা’কাল দরিয়ার কূলে পরাজিত সৈন্যদের ধরে যখন ফৌজে আনা হয় তখন তাদের অবস্থা দেখে ভীতির একটি হাল্কা শিহরণ ও মৃদু বার্তা পুরো ফৌজের শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যায়। পরাজিত সৈন্যরা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে এবং নিজেদেরকে ভর্ৎসনার ঊর্ধ্বে প্রমাণ করতে মুসলমানদের সমরশক্তি ও আক্রমণের তীব্রতার এমন এমন কথা উল্লেখ করে, যা সৈন্যদের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়, ভীতি সৃষ্টি করে। মুসলমানদেরকে তারা সৈন্যদের কাছে অদৃশ্য শক্তির আধার এবং জ্বিন দানব বলে প্রকাশ করে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সমর সফলতার একটি দিক এই ছিল যে, তিনি শত্রুপক্ষকে শারীরিকভাবে এমন শাস্তি দিতেন যে, তার প্রতিক্রিয়া অন্তরেও গভীর রেখাপাত করত। আর এ প্রভাব এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কার্যকর থাকত। এ শ্রেণীর সৈন্যদের দ্বারা আরেকটি যুদ্ধ করানো হলে পূর্বভীতির প্রভাব হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অনেক উপকার দিত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব হতেই তারা পলায়নের জন্য প্রস্তুত থাকত। একটু চাপ সৃষ্টি হলেই তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যেত। নতুন সৈন্যরাও তাদের দেখাদেখি রণাঙ্গন ছেড়ে যেত। সৈন্যদেরকে দৈহিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুদেরকে পিছু হটিয়ে দেয়ার উপর ক্ষান্ত করতেন না; বরং দূর দূরান্ত পর্যন্ত তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে ভেড়া বকরীর মত তাড়িয়ে নিয়ে যেতেন এবং পাইকারী হারে প্রাণহানী ঘটাতেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তাঁকে এ তথ্যও সরবরাহ করে যে, বিগত রণাঙ্গনের পরাজিত সৈন্যরাও মাদায়েন থেকে আগত ফৌজে শামিল হচ্ছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সেনাপতিদের ডেকে পাঠান এবং তাদেরকে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন।

“আমার প্রিয় বন্ধুগণ।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের উদ্দেশে বলেন “আমরা একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে এখানে লড়তে এসেছি। কেবল সমরদৃষ্টিতে বিবেচনা করলে নিশ্চিত আমরা ইরানী ফৌজের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উপযুক্ত নই। স্বদেশ থেকে আমরা বহুদূরে। সেনাসাহায্যের কোন পথ আমাদের নেই। আমরা ফিরেও যেতে পারি না। আমরা ইরানী এবং কিসরাকে নয়; আগুনের উপাস্য বলে যাদের মনে করা হয় তাদের পরাস্ত করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ।…“আপনাদের সবার চেহারায় আমি ক্লান্তির ছাঁপ দেখছি। চোখ থেকেও ক্লান্তি ঝরে পড়ছে। কথাবার্তাতেও কেমন ক্লান্তির জড়তা ভাব। কিন্তু কা’বার প্রভুর কসম। আমাদের আত্মা ক্লান্ত নয়। এখন আমাদের এই আত্মশক্তি নিয়ে লড়তে হবে।”

“এমনটি উচ্চারণ করবেন না জনাব খালিদ!” সালার আছেম বিন আমর বলেন “অবশ্যই আমাদের চেহারা থেকে ক্লান্তি ঠিকরে পড়ছে। কিন্তু তাই বলে এটা নৈরাশ্যের নিদর্শন নয়।”

“আমাদের দৃঢ়তায় ক্লান্তি অনুপ্রবেশ করতে পারেনি ইবনে ওলীদ!” আরেক সালার হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমরা পরিমিত বিশ্রাম নিয়েছি। সৈন্যরাও ক্লান্তি ঝেড়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।”

“আল্লাহর সৈনিকরা যাতে বিশ্রাম নিতে পারে তার জন্যই আমি এখানে ছাউনী ফেলেছি” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তোমাদের প্রত্যয়ে ভাটা না পড়লে আমার কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমি এখন ভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে চাই, যা বর্তমান সময়ে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।… তোমরা হয়ত লক্ষ্য করেছ যে, আমরা প্রথমবার ইরানীদের পরাজিত করলে তারা দ্বিতীয়বার আবার আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসে। তাদের সাথে ঐ সমস্ত সৈন্যও ছিল যারা প্রথম যুদ্ধে পালিয়ে গিয়েছিল। এবারও আমাকে জানানো হয়েছে যে, দ্বিতীয় যুদ্ধে যারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল মাদায়েন থেকে আগত সৈন্যদের সাথে পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হওয়ায় তারাও আবার এসেছে। এখন তোমাদের বেশীর থেকে বেশী এই চেষ্টা করতে হবে, যেন অগ্নিপূজকদের একটি সৈন্যও জীবিত ফিরে যেতে না পারে। খতম করে ফেলবে নতুবা বন্দী করবে। কিসরার সৈন্যের নাম নিশানা মিটিয়ে ফেলতে আমি বদ্ধপরিকর।”

“তাদের প্রভু এমনটাই করবেন” তিন-চার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

“সবই আল্লাহর কুদরতের আওতাধীন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমরা তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য ঘর-বাড়ী ছেড়ে এতদূর এসেছি।… বর্তমানে আমাদের সামনে যে পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে সে ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা কর। আবেগের বশবর্তী হয়ে এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। এই বাস্তবতা অনস্বীকার্য যে, ইরানীদের যে সৈন্য স্রোত আসছে তার মোকাবিলায় দাঁড়ানোর যোগ্যতা আমাদের নেই। কিন্তু পশ্চাদপসারণের ধারণাও মাথা থেকে মুছে ফেল। সদ্য প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক মাদায়েনের সৈন্যরা দজলা পার হয়ে এসেছে। আজ রাতে ফোরাত অতিক্রম করে ফেলবে। এরপর তারা ওলযায় পৌঁছবে। তাদের অপর বাহিনীও আসছে। আমাদের গোয়েন্দারা তাদের নিরীক্ষণ করছে এবং আমাকে প্রতিনিয়ত সংবাদ সরবরাহ করছে। …

মহান আল্লাহ আমাদের সাহায্য করছেন। এটা ঐ সত্তারই অপার অনুগ্রহ ও করুণা যে, বাহমান সেনাপতির নেতৃত্বে অপর যে বাহিনী আসছে তাদের গতি দ্রুত নয়। তারা অধিক বিশ্রাম নিতে নিতে আসছে। আমরা নিজেদের মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে উভয় বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারি না। আমার বিবেক সচল থাকলে আমি এটা ভাল মনে করছি যে, আন্দারযগারের নেতৃত্বে মাদায়েন থেকে যে বাহিনী আসছে তারা দ্রুত ওলযায় পৌঁছে যাবে। বাহমান তার সাথে এসে মিলিত হওয়ার পূর্বেই আমি আন্দারযগারের সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। এটা কি ভাল হয় না?

“এর চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না” সালার হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “মাদায়েন বাহিনীর এক দুর্বলতা আমি দেখতে পাচ্ছি। আর তা হলো, ঐ বাহিনীতে ইহুদী লোকেরাও আছে। তারা যুদ্ধ করতে সামর্থ্য হলেও নিয়মিত যুদ্ধে তারা অভ্যস্ত নয়। সুশৃঙ্খল যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। আমি তাদেরকে সৈন্য নয়; সুসজ্জিত জনতার ভীড় বলে মনে করি। আরেকটি দুর্বলতাও আছে। সাবেক যুদ্ধের পরাজিত সৈনিকরা মাদায়েনদের সাথে যোগ দিয়েছে। আমার বিশ্বাস তারা এখনো ভীত। তারা চোখের সামনে তাদের হাজার হাজার সাথীকে তলোয়ার, তীর এবং বর্শার শিকার হতে দেখেছে। পশ্চাদপসারণে তারা থাকবে সবার আগে।”

“খোদার কসম, ইবনে আমর!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আনন্দবিমোহিত কণ্ঠে বলেন “তোমার মেধা শত্রুর দুর্বলতা চিহ্নিত করতে দারুণ সক্ষম।” এরপর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত সকলের চেহারায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন “আমি মনে করি এখানে এমন একজনও নেই যে এ কথাটি বুঝেনি। তারপরেও শত্রুর এই দিকটি এড়িয়ে যাবার নয় যে, তাদের কাছে অস্ত্র, হাতিয়ার, যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম, রসদ ও সৈন্যের কমতি নেই। কেবল আন্দারযগারের ফৌজই আমাদের সংখ্যার ছয়গুণ বেশী। আমি যে কৌশল এঁটেছি তা যথাযথ এবং অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। তবে সহজ হবে না। যুদ্ধই সৈন্যর পেশা। তারা বুঝে এখানে আসার মতলব কি? তারপরেও তাদের বুঝাও যে, আমরা এখান থেকে ফিরে যেতে আসিনি থাকলে মাদায়েনে থাকব নতুবা আল্লাহর কাছে চলে যাব।”

আল্লামা তবারী এবং ইয়াকুত দুই ঐতিহাসিক লেখেন যে, এটা বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতার লড়াই ছিল। সংখ্যা, সাজ-সরঞ্জাম এবং অন্যান্য অবস্থার দিকে তাকালে উভয় বাহিনীর মাঝে তুলনার কোন দিকই ছিল না। হয়ত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চেহারা ছিল বিবর্ণ। গভীর চিন্তার মাঝে তাঁর রাত অতিবাহিত হত। সেনা ছাউনীতে পায়চারি করতে করতে তিনি থেমে যেতেন এবং গভীর চিন্তায় ডুব দিতেন। মাটিতে বসে আঙ্গুলির সাহায্যে বালুর উপর নক্সা করতেও তাঁকে দেখা যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এই ছিল যে, ইরানীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াই না করে ফিরে যাবেন না বলে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সৈন্যদেরকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। পূর্বের মত এবারও ডান এবং বাম বাহিনীর নেতৃত্বে থাকেন হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু। নিজের সাথে মাত্র দেড় হাজার সৈন্য রাখেন, যাদের মধ্যে পদাতিকও ছিল আবার অশ্বারোহীও ছিল। সৈন্য বিন্যস্ত শেষ হলে তিনি মার্চ করার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ তিনি ঠিক ঐ সময় দেন, যখন গোয়েন্দা সূত্র তাকে জানায় যে, আন্দারযগারের বাহিনী ফোরাত অতিক্রম করেছে। তিনি চলার গতি এমন রাখেন, যাতে ইরান ফৌজ ওলযায় পৌঁছেই তাদের সামনে দেখতে পায়। এটা যুদ্ধ বিচক্ষণতার বিস্ময়কর এবং অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল।

বার

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিকল্পনাই পদে পদে বাস্তবায়িত হয়। আন্দারযগারের সৈন্যরা ওলযায় পৌঁছলে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ আসে চীপ কমান্ডার থেকে। কারণ, এখানেই বাহমানের বাহিনী এসে মিলিত হওয়ার কথা। সৈন্যরা দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি নিয়ে তাঁবু স্থাপন করতে থাকে। ইত্যবসরে শোরগোল ওঠে বাহমানের বাহিনী আসছে। সমস্ত সৈন্য তাদের অভ্যর্থনা জানাতে আনন্দে উচ্ছসিত হতে থাকে কিন্তু আচমকা উল্লাস থেমে যায়।

“এটা মদীনার ফৌজ” কেউ উচ্চকণ্ঠে বলে এবং এর সাথে সাথে একাধিক আওয়াজ ভেসে আসে “শত্রুরা এসে গেছে।… প্রস্তুত হও।… সাবধান!”

আন্দারযগার ঘোড়ায় চেপে সামনে এগিয়ে যায়। ভাল করে আগত বাহিনী নিরীক্ষণ করে। বাস্তবেই এটা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী ছিল। তারা যুদ্ধের বিন্যাসে থেকে অবস্থান করছিল। তাঁবু স্থাপন কিংবা ছাউনী ফেলছিল না। যার অর্থ ছিল, মুসলমানরা লড়ার জন্য প্রস্তুত।

“চীফ কমান্ডার?” এক সালার আন্দারযগারকে উদ্দেশ করে বলে আমাদের অপর বাহিনী এখনো পৌঁছেনি। মনে হচ্ছে তারা এখনো অনেক দূরে। নতুবা এই মুসলমানদেরকে এখনই পিষ্ট করে ফেলতাম। এরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অথচ আমাদের সৈন্যরা ক্লান্ত।”

“তাদের সৈন্য সংখ্যা কত কম দেখছ না?” আন্দারযগার বলে “অতি কষ্টে দশ হাজারই হবে। আমি তাদেরকে পিঁপড়ার থেকে বেশী মনে করিনা। … তাদের অশ্বারোহীরা কোথায়? কোথায় আবার হবে!” এক সালার মন্তব্য করে “ময়দান সম্পূর্ণ ফাঁকা যা কিছু আছে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।”

“মনে হয় আমাদের সালার এবং কমান্ডাররা এক একজনকে ছয় ছয় জন দেখত” আন্দারযগার বলে “পরাজিত হয়ে পলায়নপর সৈন্যরা মাদায়েনে গিয়ে বলেছিল যে, মুসলমানদের অশ্বারোহী বাহিনী বিরাট শক্তিধর তাদের অশ্বারোহীরা যুদ্ধে এতই দক্ষ যে, তাদেরকে কেউ ছুঁতে পর্যন্ত পারে না। অশ্বারোহী ইউনিট তো আমার চোখেই পড়ছে না।”

“আমাদেরকে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে” সালার বলে “আমরা বাহমান আসার অপেক্ষায় বসে থাকব না। তাদের আসতে আসতেই আমরা মুসলমানদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিব।”

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, মুসলমানদের অশ্বারোহী দল বাস্তবিকই সেখানে ছিল। পদাতিক বাহিনীর সাথে সামান্য সংখ্যক অশ্বারোহী ছিল কিংবা হয়ত তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহরক্ষী ছিল। ঘোড় সওয়ার ইউনিট নেই দেখে অগ্নিপূজকদের সাহস বেড়ে যায়। আন্দারযগারের রঙিন কল্পনায় এ যুদ্ধ জয় ছিল হাতের মোয়া সম। বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করলে এ ফলাফলই বের হয় যে, মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে বিশাল ইরানী বাহিনীর মোকাবিলায় এসে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ভুলই করেছিলেন।

উভয় বাহিনী এক সমতল ভূমিতে মুখোমুখী। ডানে এবং বামে দু’টি সুউচ্চ টিলা ছিল। একটি টিলা একটু সামনে বেড়ে মোড় পরিবর্তন করেছিল। তার পশ্চাতে আরেকটি টিলা ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনী যুদ্ধ বিন্যস্ততায় রেখেছিলেন। ওদিকে ইরান বাহিনীও যুদ্ধের সারিতে এসে যায়। উভয় বাহিনীর সেনাপতি পরস্পরের অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে থাকে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দেখতে পান যে, ইরানীদের পশ্চাতে দরিয়া আছে। কিন্তু আন্দারযগার তার সৈন্যদেরকে দরিয়া হতে কমপক্ষে এক মাইল দূরে এনে রেখেছে। ইরানীদের পূর্ববর্তী সেনাপতিরা পশ্চাতে দরিয়া খুব নিকটে রেখেছিল, যাতে পশ্চাৎ দিক সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু আন্দারযগার এত সতর্কতা অবলম্বন করেনি। তার বিশ্বাস ছিল, মুষ্টিমেয় মুসলমানরা তাদের পশ্চাদভাগে আসার দুঃসাহস করবে না।

“যরথুস্ত্রের ভক্তবৃন্দ!” আন্দারযগার তার সৈন্যদের উদ্দেশে বলে “আমাদের সাথীরা যাদের হাতে পরাজিত হয়েছে সে সকল মুসলমান এই। তাদেরকে চোখ খুলে দেখ। তাদের হাতে পরাজিত হওয়ার চেয়ে পানিতে ডুবে মরে যাওয়াই কি ভাল নয়? এদেরকে কি সৈন্য বলা যায়? আমার দৃষ্টিতে তারা ডাকাত এবং লুটেরা গ্রুপ বৈ নয়। তাদের একজনকেও জীবিত রাখবে না।”

এ দিন এভাবেই গত হয়ে যায়। সেনাপতিরা পরস্পরের ফৌজ দেখতে এবং নিজের বাহিনী বিন্যস্ত করার মাঝেই ব্যস্ত থাকে। পরের দিন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় বাহিনীকে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। ইরানী সৈন্যরা প্রাচীরবৎ দাঁড়িয়ে ছিল। মুসলমানদের হামলা যথেষ্ট তীব্র এবং উপর্যুপরি ছিল কিন্তু শত্রুদের সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, মুসলমানদের পিছে সরে আসতে হয়। এ সময় শত্রুপক্ষ আক্রমণের শিকার প্রথম সারির সৈন্যদের পিছে সরিয়ে আনে। এবং তেজোদ্যম সৈন্য দ্বারা ঐ খালি স্থান পূরণ করে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু আরেকটি আক্রমণের জন্য কয়েক প্লাটুন সৈন্যকে সামনে পাঠান। রক্তক্ষয়ী তুমুল সংঘর্ষ হয়। তারপরেও মুসলমানদের পিছু সরে আসতে হয়। অগ্নিপূজকরা একে তো সংখ্যায় বেশী ছিল, তারপরে আবার তারা বর্মাচ্ছাদিতও ছিল। আক্রমণকারী মুসলমানদের মনে হতে থাকে, তারা কোন প্রাচীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পিছনে সরে এসেছে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কিছু সময় ধরে এ হামলা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মুজাহিদরা ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে। অসংখ্য মুজাহিদ আহত হয়ে যুদ্ধের অযোগ্য হয়ে যায়। মুজাহিদরা যাতে হতাশ না হয়ে পড়ে তার জন্য নিজেই সিপাহীদের সাথে সাথে আক্রমণে যেতে থাকেন। এতে সৈন্য প্রেরণ চাঙ্গা থাকলেও দৈহিক দিক দিয়ে তারা অবসন্ন হয়ে পড়ে। ইরানীরা তাদের এ নাজুকতা দেখে হেঁসে ফেটে পড়তে থাকে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বাধীন এটাই ছিল সর্বপ্রথম যুদ্ধ, যাতে মুসলমানরা তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলে। প্রতিবাদ হাল্কা পর্যায়ের হলেও সৈন্যদের মাঝে হতাশভাব বিরাজ করতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত ভুবনখ্যাত রণকুশলী এবং বীরশ্রেষ্ঠ সেনাপতির বিরুদ্ধে সৈন্যদের অসহিষ্ণুতা ও অনীহা চরম বিস্ময়কর ছিল বটে। সৈন্যদের অভিযোগ ছিল যে, আমাদের অশ্বারোহীরা কেন রণাঙ্গনে নেই। ময়দানে অশ্বারোহীদের না দেখে পদাতিক সৈন্যরা এই ধারণা করতে থাকে যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে লড়ে থাকেন এ ময়দানে তিনি তা থেকে রহস্যজনকভাবে বিরত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সিপাহীদের মত প্রতিটি হামলায় শরীক হতে থাকেন। কিন্তু তারপরেও তাঁর সৈন্যরা কিসের যেন কমতি অনুভব করতে থাকে। শত্রু সৈন্যদের জনস্রোত দেখে মুসলমানদের প্রেরণা দ্রুত ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে। পরাজয় তাদের চোখে ভেসে ওঠে। ভাটা পড়তে থাকে তাদের শক্তিতে। বাহুবল হয়ে আসে শ্লথ।

ইরানীরা এ পর্যন্ত একটি আক্রমণও করে না, আন্দারযগার মুসলমানদের আক্রমণের সুযোগ দিয়ে দিয়ে তাদের ক্লান্ত করতে চায়। অতঃপর ক্লান্ত সৈন্যদের উপর আঘাত হেনে দ্রুত জয় করাই ছিল তার পরিকল্পনা। মুসলমানরা বাস্তবিক অর্থেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট সৈন্যদের এই নাজুক অবস্থা ধরা পড়ে। তিনি হামলার ধারাবাহিকতা বন্ধ রাখেন। তিনি মনে মনে নতুন কৌশল রচনায় নিমগ্ন ছিলেন। ইত্যবসরে ইরান বাহিনী হতে দৈত্যকায় দেহবিশিষ্ট এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়। সে এসেই মুসলমানদের থেকে প্রতিপক্ষ আহ্বান করে।

ইরানীদের মাঝে এ লোকটি ‘হাজার ব্যক্তি’ নামে খ্যাত ছিল। তরবারী চালানাতেও সে বিশেষ দক্ষতা রাখত। ইরানে ‘হাজার ব্যক্তি’ নামে ঐ বীর বাহাদুরের উপাধি ছিল, যাকে কেউ পরাজিত করতে পারত না। ‘হাজার ব্যক্তি’ বলে এটা বুঝানো হত যে, এই এক ব্যক্তিই হাজার ব্যক্তির বরাবর।”

মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে আন্দারযগার এই দৈত্য পাঠিয়ে তাদের সাথে কৌতুক করতে চায়। মুসলমানদের মধ্যে তার মোকাবিলা করার মত কেউ ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামেন এবং নাঙ্গা তলোয়ার উঁচিয়ে ‘হাজার ব্যক্তি’-র সামনে গিয়ে দাড়ান। কিছুক্ষণ উভয়ের তরবারির সংঘর্ষ চলে এবং কৌশল পরিবর্তন করে করে তারা লড়তে থাকে। ‘হাজার ব্যক্তি’ উপাধিধারী এ লোকটি মাতাল মোষের মত ছিল। তার দেহে এত শক্তি ছিল যে, তার এক আঘাতেই যে কোন মানুষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেত। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ দৈত্যের সাথে লড়তে এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন যে, তিনি আঘাত করতেন কম; প্রতিহত করতেন বেশী। বেশী বেশী তাকে আঘাত করার সুযোগ দিতেন, যাতে সে ক্লান্ত হয়ে ওঠে। সাথে সাথে তিনি তার সামনে নিজের এ অবস্থা প্রকাশ করেন যে, তিনি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

ইরানী দৈত্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দুর্বল এবং ক্লান্ত দেখে তার সাথে মনের আনন্দে খেলতে থাকে। তরবারি ঘুরিয়ে উপর থেকে নীচে কখনো আক্রমণ করে, মাঝপথে আক্রমণ ফিরিয়ে নিতে থাকে। ব্যঙ্গোক্তি এবং উপহাসমূলক উক্তিও ছুঁড়তে থাকে। নিজের শক্তির উপর সীমাহীন আস্থা থাকায় সে কিছুটা অসতর্ক হয়ে যায়। একবার সে তরবারি এমন ভঙ্গিতে ঘুরায় যেন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গর্দান উড়িয়ে দিবে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আক্রমণ তরবারি দ্বারা প্রতিহত করার পরিবর্তে দ্রুত পিছে সরে যান। দৈত্যের হামলা শূন্যে মিলিয়ে গেলে সে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। দৈত্যের মত শরীর নিয়ে ঘুরে যায়। তার এক পার্শ্ব হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে এসে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নয়া চাল চেলে এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন। ইরানী দৈত্যের পার্শ্বদেশে তিনি বর্শার মত করে তরবারি সবেগে ঢুকিয়ে দেন। এ আঘাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে থাকলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত তরবারি টেনে বের করে এমনি আরেকটি আঘাত করেন এবং তরবারি তার পার্শ্বদেশ ভেদ করে শরীরের অনেক ভেতরে চলে যায়।

আল্লামা তবারী ও আবু ইউসুফ লেখেন যে, পরপর দু’ আঘাতে ইরানী দৈত্য মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং মারা যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বুকের উপর উঠে বসেন এবং তার সৈন্যদের খানা আনার নির্দেশ দেন। খানা আনা হলে তিনি ‘হাজার ব্যক্তি’-এর লাশের উপর বসে সেই খানা খান। এই মল্লযুদ্ধ মুজাহিদদের প্রেরণা আরেকবার উজ্জীবিত করে।

ইরানী সালার মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে ছিল। যখনই সে অনুধাবন করে যে, মুসলমানরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ঠিক তখনই সে তার বাহিনীকে ক্ষুব্ধ শার্দুলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়। জয়লাভের ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল। ইরান সৈন্যরা মুসলিম বাহিনীর লক্ষ্যে সমুদ্রের উর্মিমালার মত গর্জন করতে করতে আসে। পিষে যাবার সময় এসে গিয়েছিল মুসলমানদের। তারা জীবন বাঁচাতে মরণপণ যুদ্ধ করে। এক একজন মুসলমানের প্রতিপক্ষ ছিল ১০/১২ জন ইরানী। স্বীয় নৈপুণ্য ও চমক দেখিয়ে মুসলমানরা লড়ছিল। চরম সংকটে পড়েও তারা হাল ছাড়ে না। নিজেদের বিক্ষিপ্ত হতে দেয় না।

মুজাহিদদের অন্তরে এ সময় আরেকবার এ প্রশ্ন উদয় হয় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এখনো কেন তার কৌশলী আক্রমণে যাচ্ছেন না? কেন তিনি অশ্বারোহী বাহিনী ব্যবহার করছেন না? হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও সিপাহীর মত লড়ছিলেন। তার কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল, যা তাঁর আহত হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে।

উভয়পক্ষে হতাহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে ইরানীদের সৈন্য সংখ্যা বেশী হওয়ায় অধিক প্রাণহানী তাদের ঘটে।

আন্দারযগার আক্রমণে নিয়োজিত সৈন্যদের পিছে সরিয়ে নিয়ে পিছনের তেজোদ্যম বাহিনী আক্রমণভাগে আনে। শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রমণ। এ হামলায় অধিক সৈন্য অংশ নেয়। বিশাল ইরানীদের মাঝে মুসলমানদের চোখে পড়ছিল না। আন্দারযগারের এই অঙ্গীকার পূরণ হতে থাকে যে, একজন মুসলমানকেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে দিব না। সে দ্রুত বিজয়ের লক্ষ্যে অতিরিক্ত বাহিনীকেও আক্রমণে নেমে পড়ার নির্দেশ দেয়। ধেয়ে আসা প্লাবন মাড়িয়ে পলায়ন করার পথও মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। তারা এখন আহত সিংহের ন্যায় লড়তে থাকে।

মুজাহিদ বাহিনী যখন ইরানীদের চতুর্মুখী ঘেরাওয়ে ক্রমেই সংকটের গভীর আবর্তে নিক্ষেপ হতে থাকে তখন তাদের সেনাপতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখানে ছিলেন না। ইরানী বাহিনী যখন সমস্ত শক্তি নিয়ে ময়দানে নেমে আসে তখন তিনি সকলের অগোচরে রণাঙ্গন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামের ঝাণ্ডা বাহী তাঁর সাথেই ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঝাণ্ডা নিজে হাতে গ্রহণ করে প্রথমত উপরে অতঃপর একবার ডানে আরেকবার বামে ঘুরান, এরপর ঝাণ্ডা যার কাছ থেকে নিয়েছিলেন তাকে দিয়ে দেন। ঝাণ্ডাকে এভাবে ডানে বামে হেলানো একটি ইঙ্গিত ছিল। একটু পরেই ধূলিঝড় উড়িয়ে রণাঙ্গনের পার্শ্বস্থ দু’ টিলার আড়াল হতে দু’হাজার অশ্বারোহী বেরিয়ে আসে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ধরা বর্শা ছিল। সবাই ছিল আক্রমণের পজিশনে। দু’হাজার অশ্ব সুশৃঙ্খল গতিতে ছুটে এসে ইরানীদের পশ্চাদ্ভাগে চলে যায়। ইরানীরা যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়ায় পশ্চাতে এসে যাওয়া বাহিনী সম্পর্কে জানতে পারে না। অশ্বারোহী বাহিনী পশ্চাৎভাগ হতে যখন তাদের উপর বিজলির গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তারা আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কে সর্বপ্রথম টের পায়। এটা ছিল ঐ অশ্বারোহী বাহিনী যা যুদ্ধের প্রাক্কালে আন্দারযগার হন্যে হয়ে খুঁজছিল এবং যাদের ব্যাপারে পদাতিক মুজাহিদ বাহিনীর অন্তরে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অশ্বারোহী বাহিনী প্রথমে ব্যবহার না করে তাদের লুকিয়ে রাখা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর একটি চাল ছিল। নিজের বাহিনীর স্বল্পতা বনাম শত্রুর প্লাবন দেখে তিনি এই চাল চেলেছিলেন। তিনি রাতের আধারে অশ্বারোহী বাহিনীকে এত গোপনে টিলার পশ্চাতে পাঠিয়ে দেন যে, পদাতিক বাহিনী পর্যন্ত তা জানতে পারে না। রণাঙ্গনে আসার জন্য পতাকার ডানে বামে হেলা নিদর্শন হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অশ্বগুলো শত্রু হতে প্রায় দেড় মাইল দূরে লুকিয়ে রাখা হয়। এত দূর থেকে ঘোড়ার ডাকের আওয়াজ শত্রুর কানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ছিল না। এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাতে ঘোড়ার মুখ বেঁধে দেয়া হয়েছিল। অশ্বারোহী দলের কমান্ডার ছিলেন হযরত বুসর বিন আবী রহম এবং হযরত সাঈদ বিন মুররাহ। সকালে লড়াই শুরু হলে কমাণ্ডারদ্বয় অশ্বারোহীদের পা রেকাবে রাখার নির্দেশ দেন এবং নিজেরা একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে সুনির্দিষ্ট সংকেতের অপেক্ষায় থাকেন। ইরানী বাহিনীর উপর পশ্চাৎ হতে আকাশ ভেঙ্গে পড়লে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পরবর্তী চাল চালেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ব হতেই এ পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিলেন। পার্শ্ব বাহিনীর কমান্ডারদ্বয় এ চাল বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু লড়ছিলেন এবং নিজেদেরকে সতর্কও রাখছিলেন। কারণ তাদের জানা ছিল, নির্দিষ্ট সংকেত পেলে কি করতে হবে পশ্চাৎ হতে অশ্বারোহীরা হামলা করলে পার্শ্বদ্বয়ের কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনী উভয় পাশে ছড়িয়ে দিয়ে ইরানীদের প্রথম থেকেই যুদ্ধে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন।

মুহূর্তে যুদ্ধের গতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রণাঙ্গনের চিত্র পাল্টে যায়। ইরানীদের বিজয় উল্লাস করুণ আর্তনাদ আর ক্রন্দনে পরিবর্তিত হয়। মুসলিম অশ্বারোহীদের বর্শা তাদের এ ফোঁড় ও ফোঁড় করতে এবং মাটিতে আছড়ে ফেলতে থাকে। অনভিজ্ঞ হাজার হাজার ইহুদীরাই সর্বপ্রথম হুলস্থুল ছড়িয়ে দেয়। পূর্ববর্তী যুদ্ধের পরাজিত সৈন্যরা এই হুলস্থূলকে আরো ব্যাপক করে তোলে। কারণ, তাদের জানা ছিল যে, মুসলমানরা তাদের জীবিত রাখবে না।

রণাঙ্গনে মুসলমানদের নারাধ্বনির গর্জন ওঠে। যুদ্ধের গতি এমনভাবে পাল্টে যায় যে, যরথুস্ত্রের আগুন সহসা নিভে যায়। কোন কোন ঐতিহাসিক ওলযার যুদ্ধকে ‘ওলযার নরক’ বলে অভিহিত করেছেন। আগুন পূজারীদের জন্য এই যুদ্ধ জাহান্নাম থেকে কোন অংশে কম ছিল না। বিশাল বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত ভেড়া বকরীতে পরিণত হয়। তারা পালাতে থাকে আর মুসলমানদের হাতে নিহত হতে থাকে। মুসলমানদের ঘোড়াও সেদিন আজরাইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ইরানীদের পদতলে পিষে মারতে থাকে।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ইরানী সৈন্যরা পলায়নের পথ ধরলে আন্দারযগারও পালিয়ে যায়। কিন্তু মাদায়েনের পরিবর্তে সে মরুভূমির দিকে এগিয়ে চলে। কারণ, তার জানা ছিল যে, মাদায়েন ফিরে গেলে উরদূশের তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিবে। তাই সে মরুভূমির পথে চলতে থাকে এবং ক্রমেই বিস্তীর্ণ মরুবক্ষে হারিয়ে যায়। অতঃপর মরুফাঁদে আটকা পড়ে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করে।

অপর ইরানী বাহিনী সেনাপতি বাহমানের নেতৃত্বে তখনো ওলযায় পৌঁছে ছিল না। এমনি আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অপেক্ষায় মুসলমানদের থাকতে হয়। উভয়টিই ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

***

ইরানীদের প্রখ্যাত সেনাপতি বাহমানকে স্বসৈন্যে ওলযায় পৌঁছানো এবং উরদূশেরের নির্দেশ অনুযায়ী তার ফৌজকে সর্বাধিনায়ক আন্দারযগারের ফৌজের সাথে যোগ করে সম্মিলিতভাবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীর উপর হামলা করার কথা ছিল। কিন্ত বাহমান তখনো ওলযা হতে কয়েক মাইল দূরে ছিল এবং তার এই বিশ্বাস ছিল যে, সে আর আন্দারযগার মিলে মুসলমানদের একেবারে পিষে ফেলবে। তবে আর এত ব্যস্ততা কিসের-এমন একটা ভাব ছিল তার। তার বাহিনী যখন শেষ ছাউনী গুটিয়ে ওলযা অভিমুখে চলতে শুরু করে তখন চার-পাঁচজন বাইরের সৈন্য তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। দু’জন ছিল আহত। আর যারা অক্ষত ছিল তাদের শ্বাস জোরে উঠা-নামা করছিল। তারা এতই ক্লান্ত ছিল যে, পা টেনে টেনে চলছিল। চেহারায় বিনিদ্র রজনী এবং ভীতির ছাঁপ ছিল। এই ছাঁপের মাঝে ধুলোবালির ছিটাও লেপ্টে ছিল।

“তোমরা কারা?” তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় “কোত্থেকে আসছ?”

“সেনাপতি আন্দারযগারের ফৌজের সৈন্য আমরা” তাদের একজন ক্লান্ত জড়িত এবং ভীতিমিশ্রিত কম্পিত কণ্ঠে বলে।

“সবাই মারা পড়েছে” আরেকজন বলে।

“তারা মানুষ নয়?” আরেকটি কাতরকণ্ঠে উচ্চারণ “তোমরা বিশ্বাস করবে না।… আমাদের কথা উড়িয়ে দিবে জানি।”

“এরা মিথ্যাচার করছে এক কমান্ডার খেঁকিয়ে ওঠে “এরা পলায়নপর, সবাইকে ভীত করে নিজেদের সাধু বানাতে চাচ্ছে। তাদেরকে সেনাপতির কাছে নিয়ে চল। আমরা তাদের গর্দান উড়িয়ে দিব। এরা কাপুরুষ।”

তাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে সেনাপতি বাহমানের সামনে উপস্থিত করা হয়। এরই মধ্যে তাদের সম্পর্কে বাহমানকে সংক্ষেপে অবগত করানো হয়।

“তোমরা কোন্ যুদ্ধ লড়ে আসলে?” বাহমান জিজ্ঞাসা করে বলে “লড়াই তো এখনো শুরুই হয়নি। আমার বাহিনী এখনও…।”

“সম্মানিত সেনাপতি!” একজন বলে “যে যুদ্ধে আপনার অংশগ্রহণের কথা ছিল তা সমাপ্ত। সেনাপতি আন্দারযগার নিখোঁজ। আমাদের কুশলী বীর এবং বাহাদুর ‘হাজার ব্যক্তি’ মুসলমানদের সেনাপতির হাতে নিহত হয়েছে।…আমরা যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিলাম। মুসলমানদের অশ্বারোহী বাহিনী ছিলই না। আমাদের প্রতি নির্দেশ আসে, আরবের এই বুদ্দুদের অধিক হারে হত্যা কর। তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। তাদের দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্লোগান এবং উল্লাস প্রকাশ করতে করতে আমরা সামনে অগ্রসর হতে থাকি। যখন আমরা হামলা করতে করতে তাদের মাঝে ঢুকে পড়ি তখন পশ্চাৎ হতে না জানি কত হাজার অশ্বারোহী আমাদের ঘাড়ে আছড়ে পড়ে। এরপর আমরা বিদিশা হয়ে যাই। আমাদের কারো কোন হুশ থাকে না।”

“শ্রদ্ধাস্পদ সেনাপতি!” আহত এক সিপাহী হাঁফাতে হাঁফাতে বলে “সর্বাগ্রে আমাদের ঝাণ্ডার পতন হয়। কমান্ড দেয়ার কেউ ছিলনা। নিজ নিজ জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় সবাই ব্যস্ত ছিল। হুলস্থুল আর হুটোপুটি চলছিল গণহারে। চারদিকে কেবল আমাদের সৈন্যের লাশ পড়েছিল।”

“আমি কিভাবে এ কথা বিশ্বাস করব যে, বিশাল এক বাহিনীকে মুষ্টিমেয় কিছু লোক পরাজিত করেছে?” বাহমান সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলে।

এ সময়ে তাকে জানানো হয় যে, আরো কয়েকজন সিপাহী এসেছে। তাদেরও বাহমানের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। ১৩/১৪ জনের একটি দল ছিল। তাদের অবস্থা এত বিপর্যস্ত ছিল যে, ৩/৪ জন সিপাহী উপুর হয়ে পড়ার মত ধপ করে বসে পড়ে।

“তোমাকে সবচেয়ে প্রবীন সিপাহী মনে হচ্ছে।” বলিষ্ঠ দেহের আধাবয়সী এক সিপাহীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাহমান বলে “যা শুনলাম তা কতদূর সত্য তুমি আমায় বলতে পার? … তোমরা নিশ্চয় জানো, কাপুরুষতা, পশ্চাদপসারণ এবং মিথ্যা বলার শাস্তি কেমন কঠোর হয়ে থাকে।”

আপনি যা শুনছেন তা যদি এই হয়ে থাকে যে, সেনাপতি আন্দারযগারের সৈন্যরা মদীনার বাহিনীর হাতে নিহত ও পরাজিত হয়েছে, তবে কথাটি এমন সত্য যেমন সত্য আপনি সেনাপতি আর আমি সাধারণ সিপাহী।” প্রবীণ সিপাহী বলে “আকাশেতে ঐ যে সূর্য আর আমাদের এই মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাটাও সঠিক।… মুসলমানদের বিরুদ্ধে এটা আমার তৃতীয় লড়াই। তিন যুদ্ধেই মুসলমানদের সংখ্যা কম ছিল।… খুব কম।…

যরথুস্ত্রের কসম দিয়ে বলছি! আমার কথার এক বর্ণও যদি মিথ্যা হয় তবে যে আগুনের আমি পূজা করি তা যেন আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। নিশ্চয় তাদের মাঝে এমন শক্তি যা চোখে দেখা যায় না। তাদের এই অদৃশ্য শক্তি আমাদের উপর ঐ সময় চড়াও হয় যখন পরাজয় তাদের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।”

“আমাকে যুদ্ধ বৃত্তান্ত খুলে বল” সেনাপতি বাহমান বলে “বুঝাও, কিভাবে তোমাদের পরাজয় ঘটল।”

আন্দারযগারের বাহিনী ওলযায় পৌঁছার পরপরই কিভাবে মুসলিম ফৌজের হঠাৎ আগমন হয়, তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে কিভাবে দ্রুত আক্রমণ করে এবং লড়াই শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ সময় মুসলমানরা কোন্ পন্থায় যুদ্ধ করে–বিস্তারিতভাবে সবই সেনাপতি বাহমানকে অবগত করে।

“তাদের যে মূলশক্তির কথা আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি” সিপাহী বলে চলে– “এ যুদ্ধে তা অশ্বারোহী বাহিনী রূপে আসে। এ বাহিনীতে হাজার হাজার ঘোড়া ছিল। আক্রমণের পূর্বে তাদের ঘোড়া ময়দানের কোথাও দেখা যায়নি। আর একসাথে এত হাজার ঘোড়া কোথাও লুকিয়ে রাখাও যায় না। আমাদের পশ্চাৎভাগে দরিয়া ছিল। ঘোড়াগুলো এই দরিয়ার দিক থেকেই আসে। আমরা তাদের সম্পর্কে তখন অবগত হই। যখন তারা পাইকারীভাবে হত্যা এবং ঘোড়া নির্দয়ভাবে পিষতে থাকে। …আলমপনা! এটাই ঐ অদৃশ্য শক্তি যা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং যার কাছে আমরা বরাবর ব্যর্থ হচ্ছি।

***

“তোমাদের মধ্যে ঈমানী শক্তি আছে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় বাহিনীকে সম্বোধন করে বলছিলেন “এটা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা যে, মাত্র ২০ জন হলেও তোমরা ২০০ কাফেরের উপর বিজয়ী হবে।”

ইরানী সৈন্য এবং তাদের সহগামী ইহুদিরা পালিয়ে অনেক দূরে চলে যায়। রণাঙ্গন জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। একদিকে গণীমতের মাল স্তূপকৃত ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার পিঠে বসে ঐ স্তূপের নিকটে সৈন্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

“খোদার কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলতে থাকেন “কুরআনী ঘোষণার বাস্তবায়ন তোমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছ। ইরানীদের সৈন্যস্রোত দেখে তোমরা ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলে নয় কি? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং ইতিহাস বলবে যে, এটা হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুপম সমর কুশলতা ছিল যে, তিনি অশ্বারোহী বাহিনী লুকিয়ে রেখে তাদেরকে ঐ সময় ব্যবহার করেন যখন শত্রুবাহিনী মুসলমানদের হত্যা এবং পিষে ফেলতে প্লাবনের রূপে এসেছিল।… কিন্তু আমি বলব, এটা আমার কোন কৃতিত্ব নয়, বরং ঈমানী শক্তি এবং নৈপূণ্যের ফসল ছিল। যারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর বিশ্বাস রাখে আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন।…

“প্রিয় বন্ধুগণ! এখন পিছু হটার কোন সুযোগ নেই। শুধুই এগিয়ে যেতে হবে। এই ভূখণ্ড ইরানীদের নয়। সকল ভূখণ্ডের মালিক আল্লাহ তায়ালা। জমিনের শেষভাগ পর্যন্ত আল্লাহর বাণী আমাদের পৌঁছাতেই হবে।”

সমবেত সৈন্যরা নারায়-নারায় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকে। তারা এভাবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে।

এরপর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের মাঝে গণীমতের মাল বণ্টন করে দেন। এবারকার গণীমতের মাল পূর্বের দু‘যুদ্ধের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিয়মানুযায়ী এক পঞ্চমাংশ মাল বাইতুল মালে জমা দিতে মদীনায় পাঠিয়ে দেন।

তের

প্রবীন সিপাহীর বর্ণনায় বাহমান ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আন্দারযগারের সৈন্যরা সত্যই মুসলমানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে এবং আন্দারযগার এমনভাবে পালিয়েছে যে, এখন তার কোন পাত্তা নেই। বাহমান যাবান নামী তার এক সালারকে ডেকে পাঠায়।

“আন্দারযগারের পরিণতি নিশ্চয় তুমি শুনেছ” বাহমান বলে “আমাদের প্রতি কিসরার নির্দেশ ছিল, ওলযায় গিয়ে আন্দারযগারের সৈন্যের সাথে মিলিত হওয়া। এ পরিকল্পনা এখন শুধুই অতীত। আমাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তুমি কিছু ভেবেছ?”

“যা কিছুই করি না কেন” যাবান বলে “আমাদের ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।” “কিন্তু যাবান!” বাহমান বলে “বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরিকল্পিত কোন পদক্ষেপ নেয়াও ঠিক হবে না। তৃতীয়বারের মত মুসলমানরা আমাদের পরাজিত করে ফেলেছে। তুমি এখনো অনুধাবন করনি যে, সে সময় অতীত হয়ে গেছে, যখন আমরা মদীনার বাহিনীকে মরুডাকাত কিংবা বুদ্দু বলে উড়িয়ে দিতাম? এখন আমাদের ভেবে চিন্তেই কদম ফেলতে হবে। প্রতিপক্ষকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসে গেছে।”

“আমাদের পূর্ববর্তী তিন পরাজয়ের কারণ এই একটাই যে, আমাদের সেনাপতিরা প্রতিপক্ষকে কোন গুরুত্ব দেয়নি। এবং মরু লুটেরাদের এক বিক্ষিপ্ত কাফেলা মনে করে তাদের সামনে গিয়েছে” যাবান বলে “প্রত্যেক সেনাপতিই তাদের অমূল্যায়ন এবং তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। প্রথম পরাজয়ের পরেই আমাদের চোখ খুলে যাওয়া দরকার ছিল। শত্রুকে গুরুত্ব দিতে হত। কিন্তু বাস্তবে এমনটি হয়নি।… আপনি নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে।”

“এ চিন্তা আমাকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছে” বাহমান বলে “কিসরা উরদূশের অসুস্থ। আমি জানি, প্রথম দুই পরাজয়ের আঘাত তাকে শয্যাশায়িত করে দিয়েছে। এ মুহুর্তে আরেক পরাজয়ের খবর তাকে চিরদিনের জন্য স্তিমিত করে দেবে। এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, পরাজয়ের সংবাদ বাহককেও সে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিবে।”

“কিন্তু বাহমান!” যাবান বলে “আমাদের লড়াই আর প্রাণ বিসর্জন ব্যক্তি উরদূশের জন্য নয়; যরথুস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা এবং সম্মানের জন্যই আমাদের এই রথযাত্রা এবং আত্মবিসর্জন।”

“তোমার সাথে একটি বিষয়ে পরামর্শ করতে চাই যাবান!” বাহমান বলে “এখন স্পষ্ট যে, আমাদের প্রতি কিসরার যে নির্দেশ ছিল তা এখন অর্থহীন। আমি মাদায়েন যেতে চাই। সেখানে গিয়ে নয়া হুকুম কি তা জেনে আসব। এছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সাথে কথা বলতে চাই। তারও এখন এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, যাও এবং মুসলমানদের তুলোধুনা করে আস। তাকে এ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে, সমরশক্তির অধিকারী কেবল আমরাই নই। প্রতিপক্ষও মজবুত। তাদের শক্তিও অগ্রাহ্য করার নয়। আমি বিশ্বাস করি যে, যুদ্ধ দক্ষতা এবং ভরপুর প্রেরণা মুসলমানদের মাঝে যতটুকু আছে তা আমাদের মধ্যে নেই।… যাবান! শক্তির বলে কাউকে পরাজিত করা যায় না।”

“আমি আপনাকে প্রস্তাব করছি” যাবান বলে “সৈন্যদের যাত্রা স্থগিত ঘোষণা করুন এবং এখন আপনি মাদায়েন চলে যান।”

“সৈন্যদের যাত্রা স্থগিত করে দাও” বাহমান নির্দেশের সুরে বলে “তাদের এখানেই তাঁবু স্থাপন করতে বল। আমার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তুমি এ বাহিনীর প্রধান সালার থাকবে।”

“আপনার অনুপস্থিতিতে মুসলমানরা এদিকে এলে কিংবা পরস্পরের সম্মুখীন হলে তখন আমার প্রতি আপনার নির্দেশ কি?” যাবান জিজ্ঞাসা করে “তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হব নাকি আপনার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব?”

“তুমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবে, যেন আমার প্রত্যাবর্তনের আগে কোন সংঘর্ষ না হয়” বাহমান বলে।

ইরানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা স্থগিত ঘোষণা করে সেখানেই তাদের ছাউনী ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। সৈন্যরা হাফ ছেড়ে বাঁচে। অন্তত কয়েক দিনের জন্য তারা বিশ্রামের সুযোগ পায়। এদিকে বাহমান কয়েকজন অশ্বারোহী বডিগার্ড পরিবেষ্টিত হয়ে মাদায়েনের উদ্দেশে রওয়ানা হয়।

বকর বিন ওয়ায়েলের বসতিতে একসাথে দুই রকম পরিবেশ বিরাজ করছিল। একদিকে ক্রন্দন আর বিলাপের মাতম ছিল আর অপরদিকে আবেগ-উত্তেজনা এবং প্রতিশোধের জযবার উল্লাস ছিল। ইহুদী গোত্রের যে হাজার হাজার লোক হুংকার এবং উল্লাস করতে ইরানী বাহিনীর সাথে মুসলমানদেরকে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা ছাড়া করতে গিয়েছিল তারা রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে এসেছিল। তাদের কয়েক সাথী নিহত হয়েছিল। কিন্তু আহতও ছিল। তারাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল জীবনটুকু নিয়ে ঘরে ফিরতে। কিন্তু পথিমধ্যেই তারা মারা যায়।

ইহুদীরা মাথা নীচু করে ফিরে আসতে থাকলে বাড়ী-ঘর থেকে নারী, শিশু আর বৃদ্ধরা ছুটে আসে। পরাজিত দলের মাঝে নারীরা তাদের ছেলে, ভাই এবং স্বামীদেরকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। ছেলে পিতাকে আর পিতা ছেলেকে খুঁজে ফিরে। সৈন্যদের পরাজিত হয়ে ফিরে আসাটাই ছিল তাদের জন্য এক চপেটাঘাত। দ্বিতীয় আঘাত পড়ে তাদের অন্তরে যাদের প্রিয়জন রণাঙ্গন হতে ফেরেনা। বসতিতে এমন মহিলাদের বিলাপ আর মাতম চলছিল। তারা উঁচু আওয়াজে কাঁদছিল।

“তবে তোমরা জীবিত ফিরলে কেন?” এক মহিলা পশ্চাদপসারণকারীদের লক্ষ্য করে চিৎকার দিয়ে বলছিল, “তোমাদের ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তোমরা কেন থেকে গেলে না?”

এই আওয়াজ কয়েকটি কণ্ঠের আওয়াজে পরিণত হয়। অতঃপর মহিলাদের এই তীর্যক ভর্ৎসনা ওঠে “তোমরা বনূ বকরের নাম ডুবিয়েছ। তোমরা ঐ সমস্ত মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছ। যারা একদিন এ গোত্রেরই লোক ছিল।… যাও এবং প্রতিশোধ নাও।… মুসান্না বিন হারেসার মুণ্ডু কেটে নিয়ে আন। সে একটি গোত্রকে কেটে দুখণ্ড করেছে।”

মুসান্না বিন হারেছা ইহুদী গোত্রেরই একজন সর্দার ছিলেন। তিনি কিছুদিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার প্রভাবে এই গোত্রের অনেক লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ফৌজে শামিল হয়ে গিয়েছিল। এভাবে একই গোত্রের লোক পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখী হয়।

আল্লামা তবারী এবং ইবনে কুতাইবা লেখেন, পরাজিত ঈহুদীরা স্ত্রীদের ভর্ৎসনা এবং উত্তেজনায় প্রভাবিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে আবার প্রস্তুত হয়ে যায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক লেখেন, ইহুদীদের এ কারণেও রক্ত গরম ও চঞ্চল হয়ে ওঠে যে, সমাজে যাদের কোন মূল্য ও গুরুত্ব ছিল না তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলাম গ্রহণোত্তর ইসলামী ফৌজে শামিল হয়ে তারা এমন শক্তিধর হয়ে ওঠে যে, পারস্যের মত শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে কেবল হুঙ্কার নয়, ইতোমধ্যে তিন তিনবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে।

“পূর্বধর্মে এখন তাদের ফিরিয়ে আনা বড়ই কঠিন” বকর বিন ওয়ায়েলের এক নেতা-আব্দুল আসওয়াদ আযালী বলে “এখন এর একটাই প্রতিষেধক; আর তা হলো নির্বিচারে তাদের হত্যা করা।”

আব্দুল আসওয়াদ আযলান গোত্রের নেতা ছিল। এটাও বনূ বকরের একটি শাখা। এই হিসেবে আব্দুল আসওয়াদকে আযালীও বলা হত। সে নামকরা ইহুদী বীর ছিল।

“মুসলমানদের হত্যা করা এতই সহজ মনে করেছ?” এক বৃদ্ধ ইহুদী বলে “রণাঙ্গনে তোমরা তাদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছ।”

“আমি একটি পরামর্শ দিচ্ছি” ইহুদীদের আরেক নেতা বলে “আমাদের এলাকায় অবস্থানরত মুসলমানদের হত্যা করা হোক। এর পূর্বে তাদের একটি শেষ সুযোগ দিতে হবে ইহুদী ধর্মে ফিরে আসার। এতে রাজি না হলে গোপনে তাদের হত্যা করা হবে।”

“না” আব্দুল আসওয়াদ বলে “আমাদের গোত্রের মুসলমানরা গেরিলা হামলার মাধ্যমে ইরানী বাহিনীর মাঝে যে বিপর্যয় ও ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তার কথা কি তোমরা ভুলে গেছ? তারা অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সাথে ইরানীদের উর্ধ্বতম সামরিক অফিসারদের হত্যা করে। এখানকার একজন মুসলমানকেও যদি তোমরা গোপনে হত্যা কর, তাহলে মুসান্নার গেরিলা গ্রুপ প্রতিশোধ হিসেবে তোমাদের ব্যাপকভাবে হত্যা করবে এবং ঘরে-ঘরে আগুন ধরিয়ে দিবে। তোমাদের সতর্ক ও প্রতিরোধের পূর্বেই তারা নিমিষে সফল অপারেশন চালিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।”

“তাহলে প্রতিশোধ আমরা কিভাবে নিতে পারি?” একজন উদ্বেগের সাথে জানতে চায় “ওলযা রণাঙ্গনে তোমার দু‘পুত্র নিহত হওয়ায় তাদের থেকে কঠিন প্রতিশোধ নেয়া তোমার জন্য অনিবার্য।”

“ইরান সম্রাট আর মুসলমানরা নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় লড়াইরত” আব্দুল আসওয়াদ বলে “আমাদেরও নিজস্ব ও জাতিগত স্বার্থে যুদ্ধ করতে হবে। তবে ইরানী ফৌজের সরাসরি সাহায্য ব্যতীত আমাদের পক্ষে তাদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। তোমরা ভাল মনে করলে আমি মাদায়েন গিয়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। আমার বিশ্বাস আমাদের অনুরোধ তিনি ফেলবেন না। সেনাবহর দিয়ে সাহায্য করবেন। তিনি সাহায্য না করলে আমরা নিজেরাই ফৌজ তৈরি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। তুমি ঠিকই বলেছ, মুসলমানদের থেকে দু‘পুত্র হত্যার প্রতিশোধ অবশ্যই আমাকে নিতে হবে। তাদের পরাজিত করে পুত্র হত্যার বদলা আমি নিবই।”

উক্ত বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সক্ষম যত ইহুদী রয়েছে তাদেরকে ফোরাত নদীর উপকূলে উলাইয়িস নামক স্থানে সমবেত করা হোক। সর্বাধিনায়ক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সর্ববাদী নেতা আব্দুল আসওয়াদ আযালীর নাম পাস হয়। বকর বিন ওয়ায়েল এবং তার শাখা গোত্রসমূহের প্রেরণা ভীষণ চাঙ্গা ও উজ্জীবিত ছিল। ক্ষতও ছিল তাজা। নিহতদের পরিবারে মাতম চলছিল। এমতাবস্থায় ফের যুদ্ধের আহ্বানে নওজোয়ান এবং বয়স্ক লোকেরাও যুদ্ধের নেশায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সারা বসতিতে যুদ্ধের হাওয়া বইতে থাকে। প্রতিশোধের প্রশ্নে তারা এত উন্মাদ ও আবেগী হয়ে ওঠে যে, যুবতী নারীরাও পুরুষের বেশে সৈন্যের সারিতে চলে আসে।

***

ইরাকী ইহুদীদের মনোভাব, যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং উলাইয়িস নামক স্থানে ফৌজের আকারে তাদের জমা হওয়ার সংবাদ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অজানা ছিলনা। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যরা অনেক দূরে অবস্থান করলেও শত্রুদের প্রতিটি আচার-আচরণ উঠা-বসা যথাসময়ে রেকর্ড হচ্ছিল। প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সাথে সাথে পেতে থাকেন। তার গোয়েন্দা টিমও চতুর্দিকে ছড়ানো ছিল। ইহুদীদের পাশে আরব মুসলমানরাও অবস্থান করত। মদীনার মুসলমানদের সাথে ছিল তাদের গভীর সম্পর্ক। আন্তরিক টান। উপর্যুপরি মুসলমানদের বিজয় দেখে অগ্নিপূজকদের হাত থেকে নাজাত এবং নির্যাতন থেকে মুক্তির সূর্য চোখের তারায় ঝলমল করতে থাকে। তারা অকৃত্রিমভাবে মুসলমানদের বন্ধু ছিল। তাদের হৃদয়-মন মুসলমানদের সাথেই মিলিত ছিল। ফলে তারা কারো কোন নির্দেশ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুসলমানদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি ও গুপ্তচরবৃত্তি করতে থাকে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যদের মানসিক অবস্থা ও মনোবল ছিল অত্যন্ত চাঙ্গা এবং দুরন্ত। এক বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে উপুর্যপরি তিনবার বিরাট জয়লাভ এবং প্রচুর মালে গণীমত অর্জনের দরুণ মুজাহিদ বাহিনীর দৃঢ়তা ও মনোবল ছিল তুঙ্গে। প্রতিটি সৈন্য সাহসে বলীয়ান ছিল। তবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঠিকই জানতেন যে, তার সৈন্যরা দৈহিক দিক দিয়ে দারুণ বিধ্বস্ত। উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না পাওয়ায় দুর্বলতা তাদের গ্রাস করে ফেলছে। ইরান সাম্রাজ্যে পা দেয়ার পর থেকে এখনও তারা বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। সতত মার্চ এবং শত্রুর উদ্দেশে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই কেটেছে তাদের এতদিনের ব্যস্ততম দিনগুলো। এছাড়া তিনটি বিশাল রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা তো ছিলই।

“তাদেরকে পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দাও” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক বৈঠকে কমান্ডারদের উদ্দেশে বলছিলেন “তাদের অস্থি-মজ্জাও চূর্ণ-বিচূর্ণ। যতদিন সম্ভব আমি তাদেরকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে চাই।… শত্রুর উপর নজরদারি করতে যাদেরকে আমরা দজলার উপকূলে রেখে এসেছিলাম তাদেরও এখানে ডেকে পাঠাও …কই, মুসান্না বিন হারেছাকে তো দেখছি না! সে কোথায় গেল?”

“তাকে গতকাল রাত থেকে দেখছি না” এক সালার জবাবে বলে। এ সময় দূর থেকে একটি ঘোড়ার ঘণ্টির আওয়াজ শোনা যায়। আওয়াজ ক্রমে নিকটবর্তী হচ্ছিল। একটু পরেই আরোহীসহ ঘোড়া হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাঁবুর নিকটে এসে থামে।

“মুসান্না বিন হারেছা এসেছেন” বাইরে থেকে এক ব্যক্তি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অবগত করায়।

হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-ঘোড়া থামিয়ে একপ্রকার লাফিয়ে নেমে ছুটে গিয়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাবুতে প্রবেশ করেন।

“আল্লাহ্ আপনার প্রতি রহম করুন জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত আবেগঝরা কণ্ঠে বলেন এবং বসার পরিবর্তে তাঁবুতে পায়চারি করতে থাকেন।

“খোদার কসম, ইবনে হারেসা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্মিত হেসে বলেন “তোমার হাব-ভাব এবং খুশির উত্তেজনা বলছে যে, নিশ্চয়ই তুমি কোন গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছ।”

“ধন-ভাণ্ডারের চেয়েও দামী তথ্য নিয়ে এসেছি আমি” মুসান্না বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমার গোত্রের ইহুদীরা একটি ফৌজ তৈরি করে উলাইয়িসে সমবেত হতে রওয়ানা হয়েছে। তাদের নেতৃবৃন্দ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আমাদের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে আমি তা অন্তরে অন্তরে অবগত।”

“এই তথ্য লাভ করতেই কি তুমি গত রাত থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“হ্যাঁ” মুসান্না জবাব দেন “তারা আমার গোত্রীয়। আমি জানতাম আমার গোত্রের লোকেরা প্রতিশোধ না নিয়ে স্বস্তিতে বসে থাকবে না। বেশ বদল করে আমি তাদের পিছু নিয়েছিলাম। যে স্থানে বসে তারা আমাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা তৈরি করে আমি তার পার্শ্বস্থ কক্ষে বসে ছিলাম। আমি সেখান থেকে পুরো খবর সংগ্রহ করে রওয়ানা হয়েছি।… দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবরটা হলো, তাদের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সেনাসাহায্য চাইতে মাদায়েনে উরদূশেরের দরবারে গিয়েছে।”

“তাহলে তো এর অর্থ এটাই যে, আমার সৈন্যদেরকে বিশ্রামের সুযোগ দিতে পারব না।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “এ মুহূর্তে এটা করলে ভাল হয় না যে, যেভাবে আমরা ওলযায় ইরানীদের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ দিই নি, ঠিক তেমনি এখানেও আমরা ইহুদী ও ইরানীদের সমবেত হওয়ার পূর্বেই তাদের উপর আক্রমণ করব?”

“আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না বলেন “শত্রু মাথা উঁচু করার পূর্বেই তার ঘাড় মটকে দেয়াই সর্বোত্তম।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত অন্যান্য সালারদের থেকে পরামর্শ চাওয়ার ভঙ্গিতে এক এক করে সকলের দিকে তাকান।

“এমনটিই হওয়া উচিত” সালার হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তবে সৈন্যদের শারীরিক অবস্থার প্রতিও নজর রাখা চাই। সৈন্যদেরকে কমপক্ষে দুটি দিন বিশ্রামের সুযোগ দিলে কি ভাল হয় না।?”

“হ্যাঁ, জনাব খালিদ!” অপর সালার হযরত আদী ইবনে হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “যেন এমনটি না হয় যে, প্রথম তিন বিজয়ের নেশায় সার্বিক দিক বিবেচনা না করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম, অতঃপর পরাজয়ের শিকার হতে হল।”

“ইবনে হাতেম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “সুন্দর এ পরামর্শ দানের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে যে, সৈন্যদের বিশ্রামের উদ্দেশে দু‘টো দিন ব্যয় করলে এরই মধ্যে ইরানী বাহিনী ইহুদীদের সাথে এসে মিলিত হবে না তো?”

“এমনটি হতে পারে” হযরত আদী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “ইরানী বাহিনীর আসতে দেয়াই আমার মতে ভাল। কেননা, এর আগেই বকর বিন ওয়ায়েলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে হতে পারে ইতোমধ্যে ইরানী বাহিনী এসে পশ্চাৎ হতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যে রণাঙ্গনে যারা যারা আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে ইচ্ছুক তাদেরকে সেখানে সমবেত হওয়ার সুযোগ দেয়াকেই আমি ভাল মনে করি।”

“জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “ইহুদীদের বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণ রচনার অনুমতি প্রার্থনা করছি আমি।”

“এ পরিকল্পনার ফায়দা কি?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“ফায়দা হলো তাদেরকে আমি যেভাবে চিনি আর কেউ এমন চেনে না।” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন, “আর এ জন্যও অগ্রবর্তী হয়ে আমি তাদের উপর আক্রমণ করতে চাই যে, তাদের পরিকল্পনার মধ্যে এটিও একটি বিশেষ দিক ছিল যে, তাদের গোত্রের যারা মুসলমান হয়েছে তাদেরকে তারা হত্যা করবে। তাই আমি আক্রমণের অগ্রভাগে থেকে তাদের বলতে চাই যে, দেখ কারা কাদের হত্যা করছে।

“বর্তমানে আমাদের সৈন্য সংখ্যা কত?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান। “আঠারো হাজারের কিছু বেশী এক সালার জানান।”

“পারস্যের সীমানায় পা রাখার সময় আমাদের সৈন্যসংখ্যা আঠারো হাজারই ছিল।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “এই এলাকার মুসলমানরা আমার সৈন্যসংখ্যা হ্রাস পেতে দেয়নি।”

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, ইতোপূর্বে সংঘটিত তিন যুদ্ধে প্রচুর মুসলমান শহীদ এবং অনেকে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। কেউ কেউ এটাও লিখেছেন, তিন যুদ্ধের পর সৈন্যদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গোত্র নিজেদের জনবল দিয়ে এই কমতি পূরণ করে দিয়েছিল।

***

আগুনপূজারী বাহিনীর সেনাপতি বাহমান উরদূশেরের সাথে সাক্ষাৎ করে তার থেকে নতুন নির্দেশ লাভের জন্য মাদায়েন পৌঁছেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক তাকে সম্রাট পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ পৌঁছতে দেয়নি।

“ভাল খবর আনলে ভেতরে যাও” চিকিৎসক বলে “আর ভাল খবর না এনে থাকলে আমি তোমাকে ভিতরে যাবার অনুমতি দিব না।”

“খবর ভাল নয়” বাহমান বলে “আমাদের বাহিনী তৃতীয়বারের মত পরাস্ত হয়েছে। আন্দারযগার তো অন্তর্ধানই হয়ে গেছে।”

“বাহমান!” চিকিৎসক বলে “উরদূশেরের জন্য এর চেয়ে খারাপ খবর আর হতে পারে না। আন্দারযগারকে সম্রাট উরদূশের তাঁর সমরশক্তির সবচেয়ে মজবুত স্তম্ভ মনে করতেন। এই সেনাপতি যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কয়েকবার করে তিনি জিজ্ঞাসা করতে থাকেন যে, আন্দারযগার মুসলমানদেরকে পারস্য সীমানা থেকে তাড়িয়ে ফিরে এসেছে কিনা। এই একটু পূর্বেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন।”

“সম্মানিত ডাক্তার।” বাহমান বলে “একটি বাস্তবতা লুকিয়ে আমরা কোন ভুল তো করছি না। কিসরা একদিন না একদিন অবশ্যই এ তথ্য জেনে যাবেন।”

‘বাহমান!” চিকিৎসক বলে “আমি তোমাকে এই মর্মে সতর্ক করছি যে, তুমি এ খবর সম্রাটকে শুনালে নিজের গলা কেটে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”

বাহমান সামনে পা বাড়ায় না। সেখান থেকেই ফিরে আসে। তবে সৈন্যদের কাছে ফিরে আসার পরিবর্তে মাদায়েনে কোথাও এই আশায় অবস্থান করতে থাকে যে, সম্রাটের অবস্থা একটু ভাল হলে সে নিজেই সম্রাটকে পরাজয়ের খবর জানাবে এবং তাকে এই প্রতিশ্রুতি দিবে যে, সে গত তিন পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে।

এ দিন কিংবা এর একদিন পর ইহুদিদের এক প্রতিনিধি দল উরদূশেরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক কিংবা রাজ পরিবারের কেউ ইতোপূর্বে জানতে পারে না যে, এই প্রতিনিধি দল কোন্ উদ্দেশ্যে এসেছে। উরদূশের যেহেতু জানত যে, আন্দারযগারের বাহিনীতে ইহুদীরাও যোগ দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাই সে সানন্দে ইহুদী প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়। এই প্রতিনিধি দল সম্রাটকে প্রথম সাক্ষাতে যে খবর শুনায় তাহলো আন্দারযগার পরাজিত হয়েছে।

“আন্দারযগার পরাজিত হতে পারে না।” উরদূশের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বলে “তোমারা আমাকে এই মিথ্যা খবর শুনাতে এসেছ?… কোথায় আন্দারযগার? তার পরাজিত হওয়ার সংবাদ সঠিক হয়ে থাকলে এটাও নিশ্চিত যে, যেদিন সে মাদায়েনের মাটিতে পা রাখবে সে দিনই তবে তার জীবনের শেষ দিন।”

“আমরা মিথ্যা খবর শুনাতে আসিনি।” প্রতিনিধিদল প্রধান বলে।

“আপনার এই তৃতীয় পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এসেছি। কিন্তু আপনার সাহায্য ব্যতীত আমরা সফল হতে পারবনা।”

উরদূশের নীরবে ঘরময় পায়চারী করতে থাকে। তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে। ঔষধ তাকে সুস্থ করে তোলার পরিবর্তে দীর্ঘ অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। তৃতীয় পরাজয়ের খবরে তার আশার আলো ধপ করে নিভে যায়। হতাশা আর ব্যর্থতা তাকে চরমভাবে গ্রাস করে ফেলে। সুস্থ হওয়ার যেটুকু ক্ষীণ আশা ছিল তাও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ডাক্তার তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল।

“মহামান্য সম্রাটের এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। চিকিৎসক বলে “সম্মানিত মেহমানগণ এখন বিদায় নিলে সম্রাটের জন্য ভাল হত।”

ইহুদী প্রতিনিধিদল প্রস্থানের জন্য আসন ত্যাগ করে। চিকিৎসকের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা ক্ষণকাল দেরী করে না।

“দাঁড়াও!” উরদূশের দুর্বল আওয়াজে বলে “পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করার কথা তোমরা বলছিলে। তা তোমরা কি চাও?”

“কিছু ফৌজ চাচ্ছি মহামান্য সম্রাট। তবে অধিক সংখ্যক অশ্বারোহী হলে ভাল হয়।” প্রতিনিধি প্রধান বলে “আমাদের পুরো গোত্র উলাইয়িসে পৌঁছে গেছে।”

“যা চাবে পাবে” উরদূশের বলে ‘বাহমানের কাছে চলে যাও এবং তার বাহিনীকে সাহায্য হিসেবে নিবে। বাহমান ওলযার ধারে কাছেই কোথাও থাকবে।”

“বাহমান এখন মাদায়েনে জনাব!” কেউ উরদূশেরকে জানায় সে সম্রাটের কাছে এসেছিল। কিন্তু চিকিৎসক তাকে আপনার কাছে আসা ভাল মনে করেনি।”

“তাকে ডাক” উরদূশের নির্দেশ দেয়” আমাকে কোন কিছু লুকিয়ো না। নতুবা সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।”

চৌদ্দ

বাহমান যখন সম্রাটকে বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে বলছিল যে, রণাঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগই তার হয়নি তখন ওদিকে উলাইয়িসের চিত্র কিছুটা ভিন্ন ছিল। বাহমান মাদায়েনে আসার সময় যাবানকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপতি নিয়োগ করে এসেছিল এবং তাগিদ দিয়ে বলেছিল, সে যেন তার আসা পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে জড়ানো হতে দূরে থাকে।

যাবান উলাইয়িসের নিকটবর্তী কোথাও অবস্থানরত ছিল। সে এক সূত্রে এই সংবাদ পায় যে, ইহুদীদের একটি ফৌজ উলাইয়িসের আশে-পাশে জমা হচ্ছে। অপর এক সুত্রে সে এ তথ্যও পায় যে, মুসলমান বাহিনী উলাইয়িসের দিকে ক্রমে এগিয়ে আসছে। যাবানের প্রতি নির্দেশ কিছুটা ভিন্ন রকম থাকলেও মুসলমানদের মার্চ করার সংবাদ শুনে সে চুপটি মেরে বসে থাকতে পারে না। নিজ বাহিনীকে মার্চ করার নির্দেশ দিয়ে উলাইয়িসের পথ ধরে।

উলাইয়িস অভিমুখে মুসলমানদের এগিয়ে যাবার খবর যাবানকে বিচলিত করে তুলেছিল। বাহমান সেখানে ছিল না। যাবান ছিল দায়িত্বে। মুসলমানদের ঠেকাতেই এতদূর আসা। তাই কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করেই সে ঝুঁকি গ্রহণ করে এবং ইহুদীদের সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়।

উলাইয়িসে সমবেত ইহুদীদের সংখ্যা মোট কতজনে গিয়ে পৌঁছে ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাদের সর্বাধিনায়ক ছিল আব্দুল আসওয়াদ আযালী। সে ফৌজের সাথে থেকে মাদায়েন থেকে প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অপেক্ষা করার মত সেনাধ্যক্ষ ছিলেন না। তিনি স্বীয় বাহিনীকে সামান্য বিশ্রাম দেয়া জরুরী মনে করেছিলেন। এরপর তাদেরকে উলাইয়িস অভিমুখে মার্চ করার নির্দেশ দেন। গতি স্বাভাবিকতার চেয়ে অনেক দ্রুত ছিল। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর দুর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে একটু পৃথক হয়ে চলছিলেন।

“আল্লাহর সৈনিকেরা!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু পথিমধ্যে তার বাহিনীর উদ্দেশে বলেন “সামনের লড়াই আমরা এমনভাবে লড়ব, যেভাবে ইরানের সীমান্ত এলাকার সেনাছাউনিতে তোমরা লড়েছিলে।… গেরিলা হামলা।… গুপ্ত আক্রমণ।… তোমরা যাদের সাথে লড়তে যাচ্ছ যারা এ প্রক্রিয়ায় লড়তে অভ্যস্ত নয়। তাদেরকে তোমরা চেন। তারা তোমাদেরই গোত্রের ইহুদী। তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে লড়াই করতে বাধ্য করব। এজন্য আমি তোমাদের মূল বাহিনী হতে পৃথক রেখেছি। তবে মনে রাখবে, আমরা মূল বাহিনীর সেনাপতিরই অধিনস্থ। সাথে সাথে এটাও মনে রাখবে যে, এটা ধর্ম সমুন্নত এবং মাজহাবী চেতনা রক্ষার লড়াই। তোমাদের প্রতিপক্ষ দুই ভ্রান্ত মতবাদী। আল্লাহ্ যে আমাদেরই সাথে তা যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রমাণ করতে হবে।… মনে রেখ এই ইহুদী তারাই যারা সর্বক্ষণ আমাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে এবং অগ্নিপূজকদের হাতে আমাদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমরা তাদের থেকে আজ প্রতিশোধ নিব।”

সৈন্যরা ঈমানী দীপ্ততায় স্লোগান তুলতে থাকে। কিন্তু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের থামিয়ে দেন এবং নীরবে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। তিনি তাদের ভাল করে জানিয়ে দেন যে, আমরা অতি সন্তর্পণে পথ অতিক্রম করব। শত্রুরা আমাদের আগমণের খবর তখন টের পাবে যখন আমাদের তরবারি তাদের হত্যা করতে থাকবে।

***

ইহুদী ফৌজ উলাইয়িসে তাঁবু স্থাপন করে মাদায়েন থেকে প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিল।

“হুশিয়ার! শত্রু আসছে” ইহুদী ফৌজের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সাথীরা একসাথে চিল্লিয়ে ওঠে “খবরদার! সাবধান! প্রস্তুত হও।”

আকস্মিক এ আওয়াজে রীতিমত হুলস্থূল পড়ে যায়। নেতৃপর্যায়ের লোকেরা উঁচু উঁচু বৃক্ষে উঠে খবরের সত্যতা যাচাই করতে চেষ্টা করে। একদল সৈন্যের প্রতি তাদের দৃষ্টি আটকে যায়। তাদের দিকে একটি বাহিনী এগিয়ে আসছিল। নেতারা বৃক্ষে বসেই তীরন্দাজ বাহিনীকে প্রথম সারিতে আসার নির্দেশ দেয়। ইহুদীরা নিয়মিত সৈন্য না হওয়ায় তাদের মাঝে নিয়মতান্ত্রিকতা, সুশৃঙ্খলা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অভাব ছিল। তারা পরিকল্পিত ও কৌশলী হামলার পরিবর্তে এক স্থানে দাঁড়িয়ে টানা হামলায় অভ্যস্ত ছিল। তারপরেও নেতাদের নির্দেশে ইহুদীরা সারিবদ্ধ হতে থাকে।

আগন্তুক বাহিনী কাছে এসে পড়েছিল প্রায়। সৈন্যরা আরো এগিয়ে এলে নেতাদের মাঝে কিছুটা সংশয়ের উদ্রেক হয়। এক সালার বলে যে, এটা মুসলিম বাহিনী হতে পারে না। কারণ এরা সেদিক থেকে আসছে যেদিকে বাহমানের বাহিনী থাকার কথা ছিল। সেনাপতি দু’অশ্বারোহীকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আগন্তুক বাহিনী সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে বলে।

“এরা শত্রু নয়; বন্ধু” এক অশ্বারোহী দ্রুত ফিরে এসে উঁচু আওয়াজে বলে “আগত বাহিনী পারস্যের ফৌজ।”

“ঈসা মসীহের পূজারীগণ!” বৃক্ষের উপর থেকেই সেনাপতি চিৎকার করে বলে “তোমাদের সাহায্যার্থে মাদায়েন থেকে ফৌঝ এসে গেছে।”

ইহুদীরা আনন্দে স্লোগান তুলতে থাকে এবং এ শ্লোগান চলা অবস্থাতেই যাবানের বাহিনী ইহুদীদের ছাউনীতে এসে প্রবেশ করে। যাবান পুরো বাহিনীর কমান্ড নিজের হাতে নিয়ে নেয়। এবং ইহুদী নেতাদের বলে তারা এখন থেকে তার নির্দেশ এবং নির্দেশনা মোতাবেক চলবে। যাবান ইহুদীদের সাহস বৃদ্ধির জন্য একটি গরম ভাষণ দেয়। তার এ ভাষণের সার-সংক্ষেপ এটাই ছিল যে, এবার তাদেরকে পূর্বের তিন পরাজয়ের চরম প্রতিশোধ নিতেই হবে।

“…তোমরা তন্বী তরুণীদের সাথে এনেছ” যাবান বলে “তোমরা হেরে গেলে এই কোমল নারীরা মুসলমানদের মালে গণীমত হবে। তাদেরকে তারা বাঁদী বানিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের ইজ্জত-আবরুর দিকে চেয়ে জীবন বাজি রেখে লড়বে।”

সারিবদ্ধ ইহুদীদের মুখে শ্লোগানের খই ফুটছিল। তারা তো প্রথম থেকেই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল এখন সাথে ইরানীদের সুশৃঙ্খল বাহিনী দেখে তাদের সাহস ও মনোবল শত ডিগ্রী বৃদ্ধি পায়।

মদীনা বাহিনীর গতিতে বেশ দ্রুততা ছিল। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তার দুর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন। সেটা শ্যামলিমা এবং সবুজাভ এলাকা ছিল। বৃক্ষের পর বৃক্ষ দাঁড়িয়ে ছিল। বিভিন্ন ঝোঁপ ঝাড় এবং উঁচু উঁচু ঘাসও ছিল প্রচুর। এলাকাটি এত ঘন গাছ-গাছালি ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল যে, কেউ এখানে একটু এগিয়ে গেলেই সে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যেত। এলাকাটি বিনোদন কেন্দ্রও ছিল। ইরানের বড় বড় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা অফিসার এখানে ভ্রমণ এবং শিকার করতে আসত। উলাইয়িসের পরে হীরা নামে একটি শহর ছিল। বাণিজ্য ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ শহরের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী ছিল। এটা ছিল সম্পূর্ণ ইহুদী বসতিপূর্ণ এলাকা। সার্বিক দিক দিয়ে এ শহরটি রুচিশীল, দৃষ্টিনন্দন এবং সমৃদ্ধশালী ছিল।

“আর এটাও খেয়াল রাখবে” যাবান কমান্ডারদের উদ্দেশে বলছিল যে, সামনে হীরা শহর। তোমরা জান যে, হীরা শহরটি আমাদের সাম্রাজ্যের একটি অমূল্য রত্ন– হীরা। মুসলমানরা এ শহর পদানত করলে শুধু সম্রাটের অন্তর ভেঙ্গে যাবে তা নয়; বরং পুরো সেনাবাহিনীর মনোবল ভেস্তে যাবে। হীরা রাজধানী মাদায়েন অপেক্ষাও মূল্যবান এবং গুরত্বপূর্ণ।

সবুজের সমারোহ চিরে এক অশ্বারোহী সাঁতরে আসছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের মাঝভাগে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টি ঐ অশ্বারোহীর প্রতি আটকে যায়। অন্য কাউকে তার কাছে পাঠানোর পরিবর্তে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই তার উদ্দেশে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এবং তার সাথে গিয়ে মিলিত হন। অশ্বারোহী হযরত মুসান্না বাহিনীর এক সদস্য ছিল।

“ইবনে হারেছার পয়গাম নিয়ে এসেছি আমি” অশ্বারোহী হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বলে “উলাইয়িসের ময়দানে ইরানী ফৌজও এসে গেছে। ইবনে হারেছা খুব সাবধানে সামনে এগুতে বলেছেন।”

“এখনই ফিরে যাও” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অশ্বারোহীকে বলেন “এবং মুসান্নাকে উড়ে আমার কাছে আসতে বলবে।”

হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দূত এমনভাবে গায়েব হয়ে যায় যেন জমিন তাকে গিলে ফেলেছে। তার ঘোড়ার ঘণ্টাধ্বনি কিছুক্ষণ পর্যন্ত শোনা যেতে থাকে।

অতঃপর তা এক সময় বাতাসের শা শা শব্দে মিলিয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজে সৈন্যদের মাঝে ফিরে এসে সালারদের ডেকে পাঠান এবং তাদের বলেন যে, সামনে কেবল বনুবকরই নয়; মাদায়েনের সৈন্যরাও তাদের সাথে এসে মিলিত হয়েছে। তিনি তাদের এ কথাও বলেন যে, মুসান্না বিন হারেছা আসছে। তিনি পূর্বের মত এবারও সালার হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডান এবং বাম বাহিনীতে রাখেন।

একটু পরেই হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু এমনভাবে এসে পৌঁছান যেন তিনি সত্যই উড়ে এসেছেন।

“ইবনে হারেছা?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তুমি নিজ চোখে ইরান বাহিনীকে ইহুদীদের সাথে দেখেছ?”

হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু কেবল দেখেই ছিলেন না, তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কিছু অবগত হয়েছিলেন। তিনি গুপ্তচর আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারাই সর্বপ্রথম তাকে জানায় যে, ইরান বাহিনী ইহুদীদের সাথে এসে মিলিত হয়েছে। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তখনই বিস্তারিত জানার সংকল্প করেন। রাতে তিনি তিন অশ্বারোহী সাথে নিয়ে শত্রুর তাঁবুর নিকটে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন এবং ঘোড়াগুলো একটি বৃক্ষের সাথে বেঁধে রাখেন। সেখান থেকে তারা সন্তর্পনে এবং প্রয়োজন অনুপাতে বিভিন্ন স্থানে ক্রলিং করে করে তাঁবুর নিকটে গিয়ে পৌঁছান। ইরানী মন্ত্রীরা তাঁবুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছিল। তাদের এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান ছিল ১২ হিজরীর সফর মাসের মধ্যবর্তী কোন এক রাতে। আকাশে চাঁদ ছিল পূর্নিমা ভরা। এই রাত একদিকে অনুকূল ছিল আবার অপরদিকে প্রতিকূল হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। তারা যেমন চাদের আলোয় সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল তেমনি প্রহরীরাও তাদের দেখে ফেলার সম্ভাবনা ছিল।

দুই প্রহরী তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। পশ্চাৎ হতে তাদের জাপটে ধরা অতি সহজ ছিল। কিন্তু তাদের পেছনে এক অশ্বারোহী আসছিল। সে জোর গলায় ডেকে প্রহরীদের থামায় এবং তাদের কাছে এসে তাদেরকে অত্যন্ত সতর্ক এবং হুশিয়ার থাকতে বলে। লোকটিকে একজন কমান্ডারের মতই মনে হচ্ছিল।

‘মুসলমানরা রাতে তো আর আক্রমণ করবে না।” এক প্রহরী বলে “তার পরেও আমরা পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক।”

“তোমরা সাধারণ সিপাহী” অশ্বারোহী নির্দেশের ভঙ্গিতে বলে “আমরা কমান্ডাররা যা জানি তা তোমরা জাননা। মুসলমানদের সম্পর্কে বলা যায় না যে, তারা কখন কি করে বসে। তাদেরকে গোবেচারা কোন শত্রু মনে কর না। তোমরা মুসান্না বিন হারেছার নাম শোন নি? তোমাদের জানা নেই যে, সম্রাট মুসান্নার মাথার দাম কত ঘোষণা করে রেখেছে? তাকে মৃত অথবা জীবিত ধরতে পারলে কিংবা যদি কেবল তার কল্লা কেটে উপস্থিত করতে পার তবে ধনৈশর্যে ভরপুর হয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা তাকে ধরতে পারবে না। সে জ্বিন বৈ নয়। কারো দৃষ্টিতে আসে না। সামনে যাও এবং নিজ পয়েন্টে সতর্ক দৃষ্টি রাখ।”

প্রহরী সামনে চলে যায় আর অশ্বারোহী সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তিন জানবাযসহ এক ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। প্রহরীর গমন পথের দিকে না গিয়ে অশ্বারোহী উল্টো পথে সামনে এগুতে থাকে। ঘোড়ার পিঠে থাকা অবস্থায় তাকে বন্দী করা ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু এক জানবাযের কানে কানে কিছু বলেন এবং অশ্বারোহীর দিকে তাকান। অশ্বারোহী কমান্ডার তখন ধীর গতিতে চলছিল।

হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু নিকটবর্তী একটি বৃক্ষে চড়ে বসেন। তার এক সাথী জোর আওয়াজে কি যেন বলে। কমান্ডার ঘোড়া দাঁড় করায়। জানবায সাথী তাকে ফিরে আসতে বলে। সে ঐ আহ্বানের জবাবে ফিরে আসতে থাকে। আচমকা হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বৃক্ষ থেকে ঘোড়ার উপর লাফিয়ে পড়েন এবং কমান্ডারকে ঘোড়া থেকে মাটিতে ফেলে দেন। মুসান্নার এক সাথী দৌড়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে ফেলে আর অপর দু’জন কমান্ডারকে পাঁজাকোলা করে উঠিয়ে নেয়। এবং তার মুখ বেধে দেয়। এরপর দ্রুত কমান্ডার ও তার ঘোড়া সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়। হযরত মুসান্নার জানবাযরা নিজেদের ঘোড়ার বাঁধন খোলে এবং সবাই এত দূরে চলে যায় যে, কেউ চিৎকার দিলেও সে আওয়াজ শত্রুর তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছবে না।

“প্রাণে বাঁচতে চাইলে তোমাদের সৈন্যরা কোত্থেকে আসছে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তলোয়ারের অগ্রভাগ তার শাহরগে চেপে জিজ্ঞাসা করেন।

সে বাহমান বাহিনীর কমান্ডার ছিল। প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে সে সব কিছু বলে দেয়। সে ভয়ে ভয়ে এটাও জানিয়ে দেয় যে, বাহমান এখন মাদায়েনে। তার স্থলে যাবান সেনাপতি। বনূ বকরের ফৌজের সাথে তারা ঘটনাক্রমে মিলিত হয়েছে। কমান্ডার এ তথ্যও জানায় যে, ইহুদী গোত্রের কিছু নেতা মাদায়েন থেকেও সৈন্য নিয়ে আসবে।

“মদীনার সৈন্যদের অবস্থান তোমরা জান কি?” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করেন।

“তারা অনেক দূরে” কমান্ডার জবাবে বলে “আমরা তাদের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছি।… সম্ভবত দু’দিন পরেই।”

যা কিছু জানার দরকার তা জানা হয়ে গেলে তাকে হত্যা করে তার লাশ সেখানেই মাটিচাপা দেয়া হয়।

***

হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এই অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনাতে থাকেন তখন ইতোমধ্যে সূর্য উঠে গিয়েছিল।

“সংখ্যায় তারা কত হতে পারে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা কঠিন জনাব খালিদ?” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমাদের আর তাদের সংখ্যার আনুপাতিক হার তেমনই যেমনটি পূর্বে ছিল। তারা আমাদের থেকে চারগুণ না হলেও তিনগুণ থেকেও অনেক বেশী হবে।”

সময় অপচয় না করে অগোচরেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের পথ চলা অব্যাহত রাখেন। তিনি চলতে চলতেই সালারদের সাথে পরামর্শ সেরে নেন, নিজেও চিন্তা করেন এবং নির্দেশ দেন।

আরব মুসলমানদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ইরানীদের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অভিজ্ঞ সেনাপতি আন্দারযগার বলেছিল, এরা বর্বর মরুচারী, মরুভূমিতেই কেবল তারা লড়তে পারে। আন্দারযগার আরো বলেছিল সে তাদেরকে দজলা এবং ফোরাতের ঐ স্থানে লড়াই করতে বাধ্য করবে যে স্থানটি বৃক্ষ, ঝোপ-ঝাড় এবং ঘাসে ভরপুর, এবং কোথাও কোথাও অগভীর জলাভূমিও আছে। কিন্তু আন্দারযগারের সকল স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা ঐ উর্বর এবং শ্যামলিমা সবুজাভ মনোরম স্থানে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভেস্তে গিয়েছিল।

“খোদার কসম! তোমরা এখন পানি পথে এবং বন জঙ্গলেও লড়তে পারবে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সালার উদ্দেশে বলেন “বিদেশের মাটিতে তোমরা এত শক্তিধর শত্রুকে তিনবার পরাস্ত করেছ। শত্রুদের লড়াইয়ের কৌশল ভঙ্গি তোমরা দেখেছ। মুসান্না বলেছে, শত্রুরা বর্তমানে যে স্থানে অবস্থান করছে তা দুই দরিয়ার মধ্যবর্তী একটি স্থান ময়দান সমতল, তবে বৃক্ষ এবং সবুজে পরিপূর্ণ। ঘোড়া ছুটানোর সময় এ সমস্ত বৃক্ষ ও তার ঝুলে থাকা ডালপালার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নতুবা এ সকল ডালে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে।…

ময়দান খুব প্রশস্ত নয়; সংকীর্ণ। শত্রুকে কোনরকম ফাঁদে ফেলা কিংবা নয়া কৌশল অবলম্বনের সুযোগ আমাদের হবে না। এবার মুখোমুখী সংঘর্ষ হবে। ইবনে আমর এবং ইবনে হাতেম পার্শ্ব বাহিনীর সালার থাকবে। তারা নিজ নিজ বাহিনী ব্যবহারের ব্যাপারে স্বাধীন। যখন পরিস্থিতি সামনে আসে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেক সালার তার কমান্ডারদের বলে দেবে, মুখোমুখী সংঘর্ষে সর্বোচ্চ প্রেরণা, ফুরফুরে মন এবং দৃঢ় হিম্মতের প্রয়োজন সর্বাধিক।…

ইবনে হারেছা! এ লড়াইয়ে তুমি আমার অধীনস্থ নও। তোমার সাথে পূর্বেই কথা হয়েছে যে, তুমি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে লড়বে। তবে খেয়াল রাখবে তোমার বাহিনী যেন আমাদের পথে এসে না পড়ে। তোমার বাহিনীকে তুমি যেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছ সেভাবেই তাদের ব্যবহার করবে। তবে তা কোনভাবেই উল্টোপাল্টা এবং অন্ধভাবে নয়। সুশৃঙ্খল এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী।”

“জনাব খালিদ!” মুসান্না বিন হারেছা বলেন, “আল্লাহ আপনাকে রহম করুন আপনি যেমনটি বলেছেন ঠিক তেমনটিই দেখবেন।… আমার অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝে এখন আমি ফিরে যেতে পারি কি?”

“আমি তোমাকে আল্লাহর ভরসায় ছেড়ে দিচ্ছি ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “যাও, যুদ্ধের ময়দানে দেখা হবে। নতুবা হাশরের ময়দানে।”

হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এবং চোখের পলকে দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। তিনি আসার সময় ইরানী ঐ কমান্ডারের ঘোড়াও সাথে নিয়ে এসেছিলেন, যাকে তিনি ফিল্মি কায়দায় অপহরণ করে নিয়ে এসে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে হত্যা করেছিলেন। তিনি যাবার বেলা সে ঘোড়াটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যদের দিয়ে যান।

সৈন্যসংখ্যার সল্পতা এবং রণসম্ভারের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও মদীনা বাহিনী ঐ ফৌজের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে চলছেন। যাদের সংখ্যা তাদের চেয়ে তিনগুণ থেকেও বেশী। যুদ্ধাস্ত্রও উন্নত। তাদের প্রত্যেক সৈন্যের মাথা শিরস্ত্রাণ এবং চেহারা লৌহ শিকলে ঢাকা। তাদের পা পশুর মোটা এবং শুষ্ক চামড়ার আবরণে আচ্ছাদিত।

পনের

মুজাহিদদের মনে কোন শংকা ছিল না। মাথায় কোন দুশ্চিন্তা কিংবা বদ মতলব ছিল না। তাদের সামনে এক মহান উদ্দেশ্য ছিল। তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং মাজহাবের সম্মান ও মর্যাদা ছিল। বেঁচে থাকার প্রশ্নটি তাদের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তারা এই মনোভাব পোষণ করত যে, জীবন আল্লাহ প্রদত্ত, তাই তাকে আল্লাহর রাহে কুরবান করতে হবে। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা ইসলাম রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছিল। আল্লাহর রাহে বের হবার পর থেকে তারা বাড়ী-ঘর স্ত্রী, মা বাপ, ভাই বোন এবং পুত্র-কণ্যা হতে কেবল দূরেই সরে যেতে থাকে। তাদের দিন রাত রক্ত-মাটির মাঝেই ব্যয়িত হতে থাকে। জমিন ছিল তাদের বিছানা আর উপরে ছিল আসমান। বাতিলের প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দেয়া, কুফরের বুক চিরা এবং ইসলামের শত্রুদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদলিত করাই ছিল তাদের ইবাদত। তাদের মুখে জারী থাকত সর্বদা আল্লাহর নাম। আল্লাহর নাম নিয়েই তারা তলোয়ার চালাত। প্রতিপক্ষের তলোয়ারের আঘাতে লুটিয়ে পড়ার সময়ও তাদের মুখে শোনা যেত আল্লাহর নাম। আহত হয়ে তারা আল্লাহকে স্মরণ করত। নিঃসন্দেহে ঈমানের দৃঢ়তা এবং তাজা প্রেরণাই ছিল তাদের অস্ত্র। আর এটাই ছিল তাদের ঢাল।

***

মুজাহিদ বাহিনী সর্পিল গতিতে এগিয়ে প্রতিপক্ষের সামনে তখন উদয় হয় শত্রুদের দুপুরের আহার প্রস্তুত যখন সদ্য শেষ হয়েছে। সর্বাধিনায়কের নির্দেশে সৈন্যদের জন্য বিশেষ খাদ্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক আল্লামা তবারী, ইবনে হিশাম এবং মুহাম্মদ হুসাইন হায়কাল লেখেন, পারস্য সৈন্যদের ষাড়ের মত প্রতিপালন করা হত। সৈন্যদের স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টিকর খানা খাওয়ানো হত। পারস্যপতিদের বদ্ধমূল বিশ্বাস এই ছিল যে, শক্তিশালী এবং কর্মঠ সেনাবাহিনীই সাম্রাজ্য এবং সিংহাসন নিরাপত্তার রক্ষাকবচ।

ইরান সেনাপতি যাবান অন্য সময়ের চেয়েও এ সময় উত্তম ও মজাদার খানা তৈরি করায় তার অধীনস্থ বাহিনী রীতিমত এ মজাদার খানা পাচ্ছিল। এই খাদ্যের বর্ণনা ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রচুর পশু জবাই করা হয়। গোস্ত ছাড়াও আরো কয়েক আইটেমের খানা ছিল। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, যাবান এ উদ্দেশ্যে ভাল ভাল খানার ব্যবস্থা করে যে, তার সৈন্যরা যেন আন্তরিকতার সাথে লড়াই করে এবং এরকম ভাল ভাল খানা খাওয়ার জন্য জীবিত থাকে।

খানা যেহেতু বিশেষ এবং উন্নত ধরনের ছিল তাই তা রাঁধতেও একটু বেশী সময় লেগে যায়। খাদ্য রন্ধন যখন সমাপ্ত তখন ক্ষুধায় সৈন্যরা বড় কাতর হয়ে পড়েছিল। যখন ঘোষণা দেয়া হয় যে খানা প্রস্তুত এবং সবাই যেন নিয়মমত খানা খেতে বসে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তে নিরাপত্তা প্রহরী জলদগম্ভীর স্বরে জানিয়ে দেয় যে, মুসলিম বাহিনী নিকটে এসে পড়েছে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ লক্ষ্যে পূর্ণ সফল হন যে, শত্রু বাহিনী তার আগমনের সংবাদ পূর্ব হতে জানতে পারে না। তিনি শত্রুর মাঝে তাদের অগোচরেই হাজির হন। প্রহরীর মতকে ইরানী ফৌজ এবং ইহুদীদের মাঝে ভীতি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সালার এবং কমান্ডাররা গলা ফাঁটিয়ে সৈন্যদেরকে যুদ্ধে প্রস্তুতি এবং সারিবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিতে থাকে। কিন্তু সৈন্যদের সামনে যে সুঘ্রাণ ও মজাদার খানা ছিল তা ছেড়ে তারা উঠতে রাজি হয় না।

আল্লামা তবারীর বর্ণনা প্রমাণ করে যে, সৈন্যদের থেকে বড় জোরালো এই আওয়াজ ওঠে যে, মুসলমানরা এখনও দূরে আছে। আমরা ক্ষুধায় কাতর।

তাদের আসার পূর্বেই আমরা খানা খেয়ে নিতে পারব। অনেক সৈন্য সালারদের আহ্বান কানে না তুলে খাওয়া শুরু করে দেয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। তারা পৌঁছেই যুদ্ধের জন্য উন্মুখ ছিল। ইরানী বাহিনী ও ইহুদীদের মাঝে তারাও ছিল, ইতোপূর্বে যারা মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছিল। তারা নিজেদের ফৌজ মুসলমানদের তলোয়ার এবং বর্শায় নির্মমভাবে নিহত হতে দেখেছিল। এ সমস্ত লোকেরা মুসলমানদের কথা শুনেই ভীত হয়ে পড়ে।

“পানাহার ত্যাগ কর” পূর্ব পরাজিত সৈন্যদের কয়েকজন সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে থাকে “এই মুসলমানদের সুযোগ দিওনা।… তারা নির্বিচারে হত্যা করবে। পালানোর সুযোগ দিবে না…প্রস্তুতি নাও।”

***

আহাররত সৈন্য অগত্যা মাঝপথেই উঠে পড়ে। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। যারা তখনও পানাহার করেনি তারা সালার এবং কমান্ডারদেরও নির্দেশ মানছিল না। ক্ষুধায় তাদের জীবন খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম ছিল। কিন্তু যারা মুসলমানদের রণমূর্তি দেখেছিল, তাদের গণহত্যার বিষয় অবগত ছিল তাদের আতংক এবং উদ্বেগ দেখে সকলেই খানা ছেড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।

মুজাহিদ বাহিনী আরো সামনে এগিয়ে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দান করছিলেন।

শত্রুবাহিনী তখনও ঘোড়ায় জ্বিন স্থাপন এবং দেহে বর্ম ধারণে ব্যস্ত ছিল। যাবান আরেকটু সময় হাতে পেতে তৎকালীন রীতি অনুযায়ী ইহুদী নেতা আব্দুল আসওয়াদ আযালীকে মল্লযুদ্ধ করতে সামনে পাঠায়।

“আমার মোকাবিলা করার হিম্মত কারো আছে কি?” আব্দুল আসওয়াদ ইহুদীদের সারি ডিঙ্গিয়ে সামনে গিয়ে মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলে “আমার তলোয়ারে দ্বিখণ্ডিত হয়ে কারো মৃত্যুর সাধ হয়ে থাকলে সে সামনে আস।”

“আমি ওলীদের পুত্র।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খাঁপ থেকে তরবারী টেনে বের করে উপরে তুলে ধরেন এবং একথা বলতে বলতে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন “আমার তলোয়ার তোর মত ব্যক্তির খুনের পিয়াসী থাকে সদা।… ঘোড়ার পিঠেই থাক এবং নিজের নাম বল।”

“আমি আব্দুল আসওয়াদ আযালী” সে বড় আওয়াজে বলে “আযলান গোত্রের নাম সমুন্নত থাকবে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোড়া তার পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। একটু আগে গিয়ে আবার পিছে ফিরে আসেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার কোষমুক্ত ছিল। আব্দুল আসওয়াদও মুক্ত তরবারি হাতে ধারণ করেছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছুটন্ত ঘোড়ার উপর থেকেই তার প্রতি আঘাত করেন। কিন্তু আঘাত ব্যর্থ হয়ে যায়। আব্দুল আসওয়াদও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় এবং আরেকবারের মত পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখী হয়। এবার আব্দুল আসওয়াদ আক্রমণ করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার আঘাত এভাবে প্রতিহত করেন যে, আব্দুল আসওয়াদের হাত তলোয়ারের যেখানে ধরা ছিল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার সেখানে গিয়ে লাগে। ঝলকিত তলোয়ারের তীব্র আঘাতে তার বাটে ধরা হাতের দুই আঙ্গুলের মাথা কেটে পড়ে যায়। এবং সেই সাথে তার তলোয়ারও হাত থেকে ছিটকে পড়ে।

আব্দুল আসওয়াদ পালিয়ে যাবার পরিবর্তে চিৎকার করে বর্শা চায়। তার বাহিনী হতে এক ব্যক্তি বর্শা হাতে এগিয়ে আসে। সে প্রায় দৌড়ে তার নেতার কাছে আসতে চায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে বাঁধা দিতে ঘোড়ার মুখ ঐ ব্যক্তির দিকে ঘুড়িয়ে নেন। লোকটি পদাতিক ছিল। সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কোপানল থেকে বাঁচতে বর্শা নেতার দিকে ছুঁড়ে দেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বর্শাও আসতে শুরু করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাথার উপর দিয়েই এ বর্শার গতিপথ ছিল। আব্দুল আসওয়াদ ঠিকমত বর্শা ধরতে দু’হাত প্রসারিত করে রেখেছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্শার দৌড় ঠেকাতে না পেরে সর্বশেষ উপায় হিসেবে তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বর্শায় তরবারীর আঘাত হানেন। বর্শার কোন ক্ষতি না হলেও উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়। বর্শার গতি মাঝপথেই থমকে যায়। এবং সে ভূতলে আছড়ে পড়ে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুহূর্তে আব্দুল আসওয়াদের দিকে ঘোড়া ঘুরিয়ে আনেন এবং তার পালানোর পথ রুদ্ধ করেন। তলোয়ারের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার মত শক্তি ও উপায় তার ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিছক কৌতুকের উদ্দেশ্যে তাকে এদিক ওদিক ঘুরাতে থাকেন।

“জনাব খালিদ!” এক সালার জোর আওয়াজে বলেন “তাকে হত্যা করে ফেল। শত্রু এদিকে প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার গতি তীব্র করে এবং আব্দুল আসওয়াদের নিকট দিয়ে অতিবাহিত হতে তলোয়ার বর্শার মত মারেন। আব্দুল আসওয়াদ ঘোড়ার এক পার্শ্বে ঝুঁকে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার তার অপর পার্শ্বদেশ ভেদ করে যায়। আব্দুল আসওয়াদ আহত হয়েও নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু সে পালায় না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবার পিছন থেকে এসে তার উপর এমন আঘাত করে যে, তার মাথা কেটে এক কাঁধের দিকে চলে যায়। গর্দান সম্পূর্ণ কাটে না।

***

এদিকে যখন আব্দুল আসওয়াদের দেহ ঘোড়ার পিঠ থেকে জমিনে আছড়ে পড়ে ঠিক তখন ফোরাতের দিক হতে অসংখ্য ঘোড়ার খুরধ্বনি ভেসে আসে। ঘোড়া দ্রুত ছুটে আসে। ঘোড়াগুলো যেদিক থেকে আসে সেদিকে ইহুদীদের সৈন্যরা ছিল। অশ্বারোহীদের হাতে বর্শা ছিল। ঘোড়া বিদ্যুতগতিতে ছুটে এসে সোজা ইহুদীদের সারি ভেদ করে যায়। অশ্বারোহীদের হাতের বর্শা এ সময় ইহুদীদের এ ফোঁড় ও ফোঁড় করতে থাকে। ইহুদীদের দৃষ্টি ছিল মুসলমানদের দিকে। তারা পশ্চাৎ আক্রমণ প্রতিহত করার সুযোগ পায় না।

“আমি হারেছার পুত্র মুসান্না!” গেরিলা আক্রমণের হৈ চৈ এর মাঝে একটি কণ্ঠ সকলের কানে আঘাত করে “আমরা তোমাদেরই গোত্রের লোক।… আমি মুসান্না বিন হারেছা।”

এই অশ্বারোহীরা হযরত মুসান্নার অধীনস্থ বাহিনী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুমতিক্রমে তিনি এ বাহিনীকে মূল বাহিনী হতে পৃথক রেখেছিলেন। তারা গেরিলা হামলায় অত্যন্ত দক্ষ ও পটু ছিল। বর্তমান যুদ্ধে কৌশল হিসেবে গেরিলা হামলা চালানোর প্রয়োজনও ছিল খুব। কারণ, এ রণাঙ্গন সর্বোচ্চ দু’ মাইল দীর্ঘ ছিল। ডানে-বামে ছিল দুটি নদী। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এ রণাঙ্গনে বিশেষ কৌশল অবলম্বন তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। এ যুদ্ধে যে সম্পূর্ণ মুখোমুখী হবে তা তিনি স্পষ্ট ভাষায় সালারদের অবগত করিয়েছিলেন, এহেন যুদ্ধে সফলতার একটিই মাত্র পথ; আর তা হলো, শত্রুর উপর ভারী এবং প্রচণ্ড গতিতে হামলা চালানো, আরো ভাল হয় ঢেউয়ের গতিতে হামলা চালাতে পারলে। আর তা এভাবে যে, ছোট ছোট ইউনিট থাকবে। একটি দল আক্রমণ করে ফিরে আসলে আরেকটি দল যাবে। এভাবে নিয়মতান্ত্রিক এবং ধারাবাহিক আক্রমণ চালালে জয় করায়ত্ত হতে সময় লাগবে না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্তমান যুদ্ধে সৈন্যদেরকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দান করেন। সৈন্যরাও দিন-রাত এই প্যাকটিস চালিয়ে আক্রমণের কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মল্লযুদ্ধ শেষ হতেই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি পার্শ্ব বাহিনীকেও যুদ্ধে শামিল করে দেন। প্রথম আক্রমণের নেতৃত্ব হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই দেন। পার্শ্ববাহিনীর সালাররাও নিজ নিজ বাহিনীর সাথে গিয়ে আক্রমণে শরীক হন। ইরানীরা দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে।

তবে মুসলমানরা ইরানীদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায় যে, তারা লড়াইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে যে, ইরানী বাহিনী মানসিকভাবেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা ছিল ক্ষুধার্ত। প্লেটে পরিবেশিত ঐ সুস্বাদু ও মজাদার খানা ছেড়ে তাদের তলোয়ার হাতে তুলে নিতে হয়, যা তাদের জন্য বিশেষভাবে রান্না করা হয়েছিল। ক্ষুধার তাড়নায় অনেকে তো মুসলমানদের আক্রমণেরও পরোয়া করেনা। এই যুদ্ধে মুসলমানদের ব্যাপক জানের কুরবানী দিতে হয়। ইরানী বাহিনী পূর্ণ প্রস্তুত না হওয়া সত্ত্বেও প্রথম চোঁটেই অনেক মুসলমানকে শহীদ করে দেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পিছে সরে আসেন এবং অন্য গ্রুপ সামনে পাঠান। ইরানীরা সংখ্যাধিক্যে প্রবল ছিল। একজন মুজাহিদের প্রতিপক্ষ ছিল চার-পাঁচ ইরানী এবং ইহুদী। শত্রুকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে মুসান্নার দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী শত্রু শিবিরে ঝড়-তুফান সৃষ্টি করতেই থাকে। হযরত মুসান্না তার বাহিনীকে কয়েকটি ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে দেন। তারা পালাক্রমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে শত্রুদের পশ্চাতে, পাশে যমদূতের মত হাজির হতে থাকে। এবং চোখের পলকে বর্শার আঘাতে কয়েকজনকে ধরাশায়ী করে তীরবেগে বেরিয়ে যেত। এভাবে শত্রুর দৃষ্টি পশ্চাতেও ফিরে যায়। কিন্তু মুসান্না বাহিনীর নাগাল তারা পায় না। হঠাৎ এক এক প্রান্ত হতে উল্কার বেগে এসে সৈন্যসারি লণ্ডভণ্ড করে দিত। হযরত মুসান্নার এই ঝড়োগতির হামলা থেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ণ ফায়দা উঠাতে থাকেন। পাশ্চাৎ আক্রমণে যখন তারা বিব্রত তখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে মানসিকভাবে আঘাত করতে সম্মুখ হতে চাপ আরো বৃদ্ধি করেন।

‘বনূ বকর!” যুদ্ধের ময়দানে একটি ঘোষণা শোনা যায়। “এবং যরথুস্ত্রের পূজারীরা! দৃঢ়পদে লড়াই চালিয়ে যাও। মাদায়েন থেকে বাহমান সৈন্য নিয়ে আসছে।”

ঘোষক থেকে থেকে ঘোষণাটি বারবার সম্প্রচার করতে থাকে। ঘোষণাটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিচলিত করে তুলছিল। তিনি দূত মারফৎ পার্শ্বদ্বয় বাহিনীর সালারদের সবদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রিজার্ভ বাহিনীকেও পূর্ণ সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, পাশ্চাৎ হতে আক্রমণের আশংকা রয়েছে।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের অভিমত, বাহমান মাদায়েন থেকে কোন সৈন্য আনছিল না। কোন ঐতিহাসিক এ তথ্য লেখেন নাই যে, বাহমান যাবানের সাহায্যার্থে কেন এগিয়ে আসে নাই। ঐতিহাসিক ইয়াকূত লেখেন, বাহমান নিজ বাহিনীতে ফিরে আসছিল। পথিমধ্যে পলায়নরত কতক সৈন্যের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তারা উলাইয়িসের বর্তমান অবস্থা তাকে অবহিত করে। বাহমান সৈন্যদের মাঝে ফিরে যাবার পরিবর্তে সেখানেই যাত্রা বিরতি করে। তার উদ্দেশ্য ছিল, পরাজয়ের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। ভর্ৎসনার গ্লানি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। মোটকথা, রণাঙ্গনের ঐ উপর্যপরি ঘোষণার বাস্তবতা যাই হোক না কেন মুসলমানদের মাঝে তা নয়া প্রেরণা সৃষ্টি করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও ঘোষণা করেন যে, মাদায়েনের সৈন্য এসে পৌঁছানোর পূর্বেই তোমরা এ বাহিনীর কোমর ভেঙ্গে দাও। কিন্তু ইরানী বাহিনী এবং ইহুদীরা প্রস্তরময় প্রান্তের মত দৃঢ়, অটল অবিচল হয়ে থাকে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রতি রণাঙ্গনে দু’আ করতেন। কিন্তু এই সর্বপ্রথম যুদ্ধ, যেখানে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে হাঁটু ফেলে এবং হাত তুলে দোয়া করেন “হে পরওয়ারদেগার। আমাদের শক্তি বৃদ্ধি এবং অটুট মনোবল দান করুন যেন আমরা শত্রুদের পিছপা করাতে পারি। আমি অঙ্গিকার করছি যে, আপনার দ্বীনের শত্রুদের রক্তে আমি নদী বইয়ে দিব।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দোয়া শেষে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে হামলা চালাতে থাকেন। ইতোমধ্যে দু’পার্শ্বের সালারদ্বয় দু’দিক থেকে শত্রুদেরকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। হযরত মুসান্নার বাহিনী অব্যাহত গেরিলা হামলা চালিয়েই যেতে থাকে। চতুর্মুখী পরিকল্পিত তীব্র হামলার মুখে শত্রুদের পা টলটলায়মান হয়ে উঠছে। শত্রুসংখ্যা বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে তারাই অধিকহারে আহত ও নিহত হতে থাকে। স্বপক্ষীয় সৈন্যদের এ ব্যাপক হত্যার চিত্র দেখে ইতোপূর্বের বিভিন্ন যুদ্ধে যারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল তারা সাহস হারিয়ে ফেলে এবং রণাঙ্গন থেকে নিজেকে দূরে সরাতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের দেখাদেখি অন্য সৈন্যরাও পলায়নের পথ ধরে। শত্রুদের পিছু হটার দৃশ্য দেখে মুসলমান বাহিনী আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর করে। তাদের তলোয়ার এখন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর বিদ্যুৎ বর্ষণ করতে থাকে। এরপর হঠাৎ করে কাফেররা রণে ভঙ্গ দিতে শুরু করে।

***

“পশ্চাদ্ধাবন কর” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই পয়গাম দিয়ে বাহিনীতে দূত পাঠান এবং উচ্চ আওয়াজে এই ঘোষণাও করান যে, তাদেরকে পালিয়ে যেতে দিও না। হত্যাও কর না। জীবিত বন্দী কর।”

এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক ফল এই দেখা দেয় যে, কাফেররা পালানোর পরিবর্তে গণহারে অস্ত্র সমর্পণ করতে শুরু করে। অনেকে পলায়ন করাকেই ভাল মনে করে সটকে পড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু হযরত মুসান্নার বাহিনী তাদের ইচ্ছায় বাঁধ সাধে। এ বাহিনী পশ্চাতে ছিল। যারা পালাতে পিছে ভেগে যায় মুসান্নার বাহিনী তাদেরকে ঘেরাও করে করে ফিরিয়ে আনতে থাকে। যুদ্ধ সমাপ্ত। রণাঙ্গণ লাশ এবং অজ্ঞান ও ছটফটরত আহতদের দ্বারা ভরা ছিল। এক কোণে ঐ খানা অবহেলায় পড়েছিল যা শত্রুরা দুপুরে খেতে প্রস্তুত করেছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে মুজাহিদরা খানা খেতে বসে যায়। পলায়নপর সৈন্যদের ধরে ধরে আনছিল তারাও পালাক্রমে আহার সেরে নেয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সময় মুজাহিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন “খানা আল্লাহপাক তোমাদের জন্য প্রস্তুত করিয়েছেন। প্রাণভরে খাও।” মুসলমানরা বিভিন্ন পদের খানা দেখে বিস্মিত হচ্ছিল। তারা ইতোপূর্বে এমন খানা খাওয়া তো দূরে থাক দেখেও নাই। তারা যবের রুটি, উটের দুধ এবং খেজুর খেতে অভ্যস্ত ছিল। আর খাদ্য বলতে তারা এগুলোকেই বুঝত।

ঐতিহাসিকদের বর্ণনা, যে সমস্ত শত্রু জীবিত ধরে আনা হচ্ছিল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে তাদেরকে খুসাইফ নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের মাথা ধড় থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয় যে, মাথা সোজা নদীতে গিয়ে পড়ত। অতঃপর মুণ্ডহীন ধর নদীর কূলে এভাবে নিক্ষেপ করা হত যে, রক্ত যা পড়ার তার সবই নদীতে গিয়ে পড়ত। এভাবে নিহতদের সংখ্যা হাজারেরও বেশী ছিল।

অমুসলিম ঐতিহাসিক এবং বিশেষজ্ঞরা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই নির্দেশকে জুলুমাত্মক বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই নির্দেশের কারণ ছিল স্বীয় অঙ্গীকার পূরণ। তিনি যুদ্ধের এক পর্যায়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন যে, যুদ্ধে বিজয় করায়ত্ত করতে পারলে রক্তের নদী বইয়ে দেবেন।

যে নদীর কূলে এই হত্যাকাণ্ড চলে সেখানে একটি বাঁধ ছিল। এই বাঁধের ফলে নদীর পানি থমকে ছিল; পানির প্রবাহ ছিল না। যার দরুণ রক্তও জমে থাকছিল পানিতে বয়ে যাচ্ছিল না। এক ব্যক্তি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে পরামর্শ দেয় যে, এই বাঁধ খুলে দিলে তবেই রক্তের নদী বইবে; নতুবা বইবেনা। অতঃপর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে নদীর বাঁধ খুলে দেয়া হয়। হাজার হাজার মানুষের রক্ত নদীতে পড়লে পানি লাল হয়ে যায় এবং পানি বাঁধ মুক্ত হয়ে স্রোতের বেগে বইতে থাকে। এ কারণে ইতিহাসে এ দরিয়াকে ‘খুনের দরিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

কোন কোন ঐতিহাসিকদের অভিমত, পলায়নপর এবং আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদেরকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ কারণে গণহারে হত্যা করেন যে, এই সৈন্যরা এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে আবার পরবর্তী রণাঙ্গনে উপস্থিত হত। এর প্রতিষেধক হিসেবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সিদ্ধান্ত নেন যে, এবার একজন সৈন্যকেও জীবিত রাখা হবেনা। বলা হয়, একাধারে তিন দিন পর্যন্ত ইরানী এবং ইহুদীদের গণহত্যা চলতে থাকে। এভাবে নিহতদের সংখ্যা যোগ করে এ যুদ্ধে ইরানী এবং ইহুদী সৈন্যদের নিহতের সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ হাজার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *