অরিন্দম বাবু বলিলেন, “বল কি, এমন লোক সে! তাহা হইলে ত, এইবার তোমার স্বর্ণসুযোগ উপস্থিত-ইহার জন্য আবার দুঃখিত হইতে আছে? যশস্বী হইবার ত এই একমাত্র পন্থা| ইহা ত্যাগ করা কদাচ বুদ্ধিমানের কাজ নহে| গোয়েন্দাগিরি করিয়া বাহাদুরী লইবার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আজকাল দুর্ল্লভ| আগেকার মত কি আর সে রকম চতুর, সে রকম সুদক্ষ চোর ডাকাত, খুনী পাওয়া যায় হে? তা’ পাওয়া যায় না| এখনকার অপরাধীরা ও সব সাদা সিধে রকমের, নিতান্ত সরল প্রকৃতির; তাহাদের অপরাধগুলাও তেমনি সরল এবং নির্জ্জীব-তাহার মধ্যে দুরূহতা বা দুরাবগাহতার কিছুই পাইবে না| আজ-কালকার চোর ঘটী বাটী চুরি করিয়াই একটা মস্ত চোর; খুনী রক্তপাতের উত্তেজনা নিজের বুকের মধ্যে নিজেই সংবরণ করিতে না পারিয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলে| তাহাদিগকে ধরিবার জন্য বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকারের আবশ্যক দেখি না| কাহাকেও ধরিতে হইলে, সটান্ একখানা গাড়ী ভাড়া কর-সটান্ তাহার বাড়ীতে গিয়া হাতকড়ি লাগাইয়া দাও-ব্যস, আসামী গ্রেপ্তার হইয়া গেল| ইহাতে চিন্তাই বা কি এত, উদ্বেগেই বা কি এত? তুমি যে ইহার মধ্যে এমন একজন সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাইয়াছ, শুনিয়া সুখী হইলাম| তোমার অপরাধীর অপরাধটা কি রকম আমাকে বল দেখি; তাহা হইলে অনেকটা বুঝিতে পারিব, তিনি কিরূপ উচ্চদরের লোক|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তিনি খুব উচ্চদরের লোক, সন্দেহ নাই| পথিমধ্যে একজন স্ত্রীলোককে অতি অদ্ভুত উপায়ে হত্যা করিয়া একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছেন|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন-পর পর তিনবার তিন রকমস্বরে বলিলেন, ‘বটে! বটে! বটে!’ যেন তিনটি লোকের মুখ হইতে তিনটা ‘বটে’ বাহির হইল| ক্ষণেক চিন্তার পর বলিলেন, “খুনটা হয়েছে কোথায়?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মেহেদী-বাগানের একটা গলি মধ্যে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ওঃ! আমি এ কথা শচীন্দ্রের মুখে একবার শুনিয়াছিলাম বটে| তা’ ছাড়া একখানা খবরের কাগজেও এই খুনের বিষয় একটু লিখিয়াছিল| সে খুনটার তুমি কি এখনও কোন কিনারা করিতে পার নাই? কি আশ্চর্য্য! তোমার হাতে কেস্ পড়ায় হত্যাকারী যখন এখনও নিরুদ্দেশ-তখন অবশ্যই সে একজন যোগ্য লোক বটে! ব্যাপারটা সব খুলিয়া আমাকে বল দেখি; দেখি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যদি তোমার কিছু সাহায্য করিতে পারি| আচ্ছা, পরে তোমার শুনিব| (নিম্নস্বরে) তার আগে পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া, ধাঁ করিয়া এই দরজা টা খুলিয়া ফেল দেখি-একটা বড় মজা দেখিতে পাইবে| নিশ্চয়ই একজন কেহ দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আমাদের পরামর্শ শুনিবার চেষ্টায় আছে| আমি এখান থেকে তাহার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছি|”
কবাট ভিতর হইতে ভেজান ছিল| দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া দ্রুতহস্তে কবাট খুলিয়া ফেলিলেন| চকিতে দেখিলেন, সম্মুখে দাঁড়াইয়া-রেবতী| দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় খুব বিস্মিত হইলেন| অরিন্দম বাবু খুব একটা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন, এবং রেবতী খুব লজ্জিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া পলাইবার পথ পাইলেন না|
অরিন্দম বাবু এখনও হাস্য সম্বরণ করিতে পারেন নাই| হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তাই ত’ দিদি যে আবার আমাদের উপরে ডিটেক্টিভগিরি করিতে আসিবে, তা’ আমি ভাবি নাই; যাহা হউক, খুব ধরা পড়িয়া গিয়াছে|” তাহার পর হাস্য সম্বরণ করিয়া, সুর বদ্লাইয়া বলিলেন, “দেখ্লে দাদা, পুরুষের হৃদয় হইতে স্ত্রীলোকের হৃদয় কত তফাৎ! আমি রোগে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছি; তুমি পুরুষ মানুষ-মনে করিলেই এখানে আসিতে পার, তাই আসো না; কিন্তু দিদি আমাকে ভুলিতে পারে নাই-সংসারের শত কাজ-কর্ম্ম ফেলিয়াও তাড়াতাড়ি আমাকে দেখিতে আসিয়াছে|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি আপনার দিদির কত উপকার করিয়াছেন!”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “দাদারই বা কি অনুপকার করিয়াছি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার যে উপকার করিয়াছেন, তাহাতেও প্রকারান্তে আপনার দিদিরই উপকার করা হইয়াছে|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “আর দিদির যে উপকার করিয়াছি, তাহাতে বুঝি প্রকারান্তে দাদার কোন উপকার করা হয় নাই? যাক্ ভাই, আর তর্কের প্রয়োজন নাই; এখন কাজের কথাই হউক|”
দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের খুনের মোকদ্দমা হাতে লওয়া অবধি যখন যাহা ঘটিয়াছে, যাহা তিনি করিয়াছেন, আদ্যোপান্ত অরিন্দম বাবুকে বেশ গুছাইয়া বলিতে লাগিলেন|
শুনিতে শুনিতে অরিন্দম বাবুর মুখভাব বদ্লাইয়া গেল; রোগের যন্ত্রণা তিনি একেবারে বিস্মৃত হইয়া গেলেন, অখণ্ড মনোযোগের সহিত শুনিয়া যাইতে লাগিলেন| কখন বা শুনিতে শুনিতে কি-এক তীব্র উত্তেজনায় দুই হস্তে শয্যাস্তরণ মুষ্টিবদ্ধ করিয়া উঠিবার উপক্রম করেন, আবার একান্তে তন্ময়ভাবে নীরবে শুনিতে থাকেন| পরমভক্ত বৈষ্ণব যেমন সুমধুর হরিনামের মধ্যে মগ্ন হইয়া যান, আমাদের অরিন্দম বাবুও দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনীর মধ্যে তেমনি মগ্ন হইয়া গেলেন| কেবল এক-একবার তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইতে লাগিল, ‘পূর্ব্বে যদি ইহা শুনিতাম’, ‘পূর্ব্বে যদি আমি খবর পাইতাম’, ‘তখন যদি আমি সেখানে উপস্থিত থাকিতাম! ‘ ইত্যাদি|
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের কাহিনী শেষ হইলে তিনি অধিক উত্তেজনায় উভয় হস্তে হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে বলিয়া উঠিলেন, “বড় মজাই হইয়াছে-বিরাট ব্যাপার! একরূপ লুকোচুরি খেলাই আরম্ভ হইয়াছে-খেলা জমিয়াছে-এখন বুড়ি ছুঁইবার পালা| আরে দাদা, তুমি ত এ কেস্টা বুদ্ধিমানের মত পরিচালিত করিতেছ|”
হতাশ দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি উপহাস করিতেছেন-ইহাতে আমার নির্ব্বুদ্ধিতাই প্রকাশ পাইয়াছে|”
জিহ্বা ও তালুর সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “নিশ্চয়ই না-তোমার কথা শুনিয়া এ বুড়ার বুকে আনন্দ ধরিতেছে না! এখন আমি বুঝিয়াছি, আমি মরিলেও আমার আসন অধিকার করিবার একজন যোগ্য লোক রাখিয়া যাইতে পারিব| আমার ইচ্ছা হইতেছে, একবার উঠিয়া, তোমার বুকে করিয়া নৃত্য করি|”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে এখনও সন্দেহ যে, অরিন্দম বাবু তাঁহাকে উপহাস করিতেছেন| তিনি বলিলেন, “আপনি আমাকে উপহাসই করিতেছেন; আমি কিসে এতটা প্রশংসার যোগ্য-বুঝিতে পারিলাম না| হত্যাকারী এখনও ধরা পড়ে নাই; আমার এ কাজে যতটুকু যশঃ ছিল, বরং তাহা এখন যাবার দাখিলে পড়িয়াছে|”
বিশ্রী মুখভঙ্গি করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কিছু না-কিছু না-ব্যস্ত হইয়ো না-ইহাতে তোমার যশঃ শতগুণে বাড়িয়া যাইবে| আমার ত খুবই মনে হয়, তুমি এই কেস্টা বেশ ভাল রকমেই পরিচালিত করিয়া আসিতেছ; কিন্তু আরও ভাল রকম হওয়া দরকার ছিল| মনোযোগ থাকিলে খুবই ভাল পরিচালিত করা যাইতে পারিত| তোমার মুখে যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে তোমার বুদ্ধি ও সাহসের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়| কেবল একটু অভিজ্ঞতার অভাব, একটুতেই তুমি লাফাইয়া ওঠ, আবার একটুতেই একেবারে হতাশ হইয়া পড়| স্থিরসঙ্কল্প হওয়া চাই-একটা বিষয়ে স্থির লক্ষ্য চাই-এখনও তুমি অনেক ছেলেমানুষ-পাকাচুলের অবশ্যই একটা মূল্য আছে| যাহা হউক, তুমি ইহাতে কয়েকটা বিষয়ে বড় ভুল করিয়াছ; আমি তাহা তোমাকে এখন সরলভাবে বুঝাইয়া দিতেছি|”